৪১. আর্ষ্টিষেণ তপস্বীর মাহাত্ম্যকথা

৪১তম অধ্যায় – আর্ষ্টিষেণ তপস্বীর মাহাত্ম্যকথা

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মণ! ভগবান্ আর্ষ্টিষেণ কিরূপে কঠোর তপানুষ্ঠান এবং সিন্ধুদ্বীপ, দেবাপি ও বিশ্বামিত্র কিরূপে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। ঐ সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সত্যযুগে আর্ষ্টিষেণ নামে এক ব্রাহ্মণ গুরুকুলে অবস্থানপূর্ব্বক বিদ্যাভ্যাস করিতেন। তিনি সর্বদা অধ্যয়নে অনুরক্ত থাকিয়াও বিদ্যা ও বেদে পারদর্শী হইতে পারিলেন না। তখন তিনি নিতান্ত দুঃখিত হইয়া সেই সরস্বতীতীরে তপস্যায় প্রবৃত্ত হইলেন এবং তপোবলে অচিরাৎ বিদ্বান, বেদজ্ঞ ও সিদ্ধ হইয়া সেই তীর্থে এই তিন বর প্রদান করিলেন যে, ‘অদ্যাবধি যে পুরুষ এই তীর্থে অবগাহন করিবেন, তাঁহার অশ্বমেধযজ্ঞের সম্পূর্ণ ফললাভ হইবে; আজ হইতে এই তীর্থে হিংস্র জন্তুর ভয় থাকিবে না এবং আজ অবধি এই স্থানে লোকে অল্পকালমধ্যে সমধিক ফলোভের অধিকারী হইবে।” তেজঃপুঞ্জকলেবর আর্ষ্টিষেণ ইহা বলিয়া স্বর্গারোহণ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে ভগবান আর্ষ্টিষেণ তথায় সিদ্ধ হইয়াছিলেন।

সিন্ধুদ্বীপ-দেবাপি বিশ্বামিত্রবিবরণ

ঐ তীর্থে প্রতাপশালী সিন্ধুদ্বীপ, রাজর্ষি দেবাপি ও বিশ্বামিত্র ইহারা তপঃপ্রভাবে ব্রাহ্মণ্য লাভ করিয়াছিলেন। পূৰ্ব্বে গাধি নামে এক ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব ভুবনবিখ্যাত মহাযোগী নরপতি ছিলেন। প্রতাপশালী বিশ্বামিত্র তাঁহারই ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। মহারাজ গাধি দেহত্যাগবাসনায় স্বীয় পুত্রের প্রতি সাম্রাজ্যের ভারাপণ করিতে সমুদ্যত হইলে তাঁহার প্রজাগণ তাঁহাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক কহিল, ‘মহারাজ! আপনি পরলোকযাত্রা করিবেন না; ইহলোকে অবস্থানপূর্ব্বক আমাদিগকে ভয় হইতে পরিত্রাণ করুন।’ রাজর্ষি প্রজাগণ কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘আমার পুত্র সমুদয় পৃথিবী রক্ষা করিবেন।’ মহাত্মা গাধি এই বলিয়া বিশ্বামিত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া স্বর্গারোহণ করিলেন। বিশ্বামিত্র পিতার পরলোকগমনানন্তর রাজকার্য্যে ব্যাপৃত হইলেন, কিন্তু বহু যত্নসহকারেও সুচারুরূপে পৃথিবী রক্ষায় সমর্থ হইলেন না। পরিশেষে তিনি রাক্ষস ভয়বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া চতুরঙ্গিণী সেনা সমভিব্যাহারে নগর হইতে বহির্গত হইয়া বহুদূরে অতিক্রমপূর্ব্বক বশিষ্ঠের আশ্রমে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় তাঁহার সৈন্যগণ বিবিধ গৃহ নির্ম্মাণ করাতে সেই মহাবন ভগ্ন হইতে লাগিল। ব্রহ্মার পুত্র ভগবান্ বশিষ্ঠ তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্টচিত্তে স্বীয় হোমধেনুকে অসংখ্য ঘোরদর্শন শবরের সৃষ্টি করিতে কহিলেন। ধেনু বশিষ্ঠের আদেশ প্রাপ্তিমাত্র ভীষণাকার শবর-সমুদয়ের সৃষ্টি করিলেন। শবরগণ বিশ্বামিত্রের সৈন্যগণকে আক্রমণ করিলে তাঁহারা দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। গাধিনন্দন বিশ্বামিত্র তদ্দর্শনে তপস্যাই পরম ধন বিবেচনা করিয়া তপানুষ্ঠানে কৃতনিশ্চয় হইলেন এবং সরস্বতীর তীরে সমাহিত হইয়া উপবাস, জলপান, পর্ণাহার, বায়ুভক্ষণ ও স্থণ্ডিলে শয়ন প্রভৃতি কঠোর নিয়ম-সমুদয় দ্বারা কলেবর ক্ষীণ করিতে লাগিলেন। দেবগণ তাঁহার সমাধিভঙ্গের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহার বৃদ্ধি বিচলিত হইল না। গাধিনন্দন বহু যত্নে কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক সূৰ্য্যের ন্যায় তেজস্বী হইয়া উঠিলেন। অনন্তর লোকপিতামহ ব্রহ্মা বিশ্বামিত্রের তপঃপ্রভাবে তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বর প্রদান। করিতে উদ্যত হইলেন। তখন বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘ভগবন! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমাকে ব্রাহ্মণত্ব প্রদান করুন।’ ভগবন্‌ কমলযোনি গাধিনন্দনের প্রার্থনা-শ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহার মনোরথ পূর্ণ করিলেন। মহাত্মা বিশ্বামিত্র এইরূপে অপ্রতিহত দৈবশক্তিপ্রভাবে সেই সরস্বতী তীর্থে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়া সমুদয় পৃথিবী ভ্রমণ করিয়াছিলেন।

হে মহারাজ! মহাত্মা বলদেব সেই তীর্থে দ্বিজগণের পূজা করিয়া তাঁহাদিগকে অসংখ্য দুগ্ধবতী ধেনু, যান, শয্যা, বস্ত্র, অলঙ্কার, ভক্ষ্য ও পানীয় প্রদানপূর্ব্বক মহর্ষি বকের আশ্রমে গমন করিলেন। মহাত্মা দল্‌ভতনয় ঐ স্থানে কঠোর তপস্যা করিয়াছিলেন।