৪০. ঔশনস-কপালমোচনাদি তীর্থ-বিবরণ

৪০তম অধ্যায়ঔশনসকপালমোচনাদি তীর্থ-বিবরণ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! মহাত্মা বলদেব সেই সপ্তসারস্বত-তীর্থে মহর্ষি মঙ্কণকের প্রতি প্রীতি প্রদর্শনপূর্ব্বক আশ্রমবাসীদিগকে পূজা ও ব্রাহ্মণগণকে ধন দান করিয়া সেই রজনী অতিবাহিত করিলেন এবং প্রভাতকালে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তপোধনদত্ত পূজা গ্রহণ ও সলিল স্পর্শ করিয়া তাঁহাদিগের আদেশানুসারে তীর্থ পর্যটনার্থ নিষ্ক্রান্ত হইলেন। অনন্তর তিনি ঔশনস-তীর্থে আগমন করিলেন। ঐ তীর্থ কপালমোচন নামেও অভিহিত হইয়া থাকে। পূৰ্ব্বে দাশরথী রাম এক রাক্ষসের মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক দূরে নিক্ষেপ করিলে সেই ছিন্নমস্তক মহর্ষি মহোদরের জঙ্ঘার সংলগ্ন হইয়াছিল। মহর্ষি মহোদর ঐ তীর্থে আগমন করিয়া সেই ছিন্নমস্তক হইতে মুক্ত হয়েন। ঐ তীর্থে দৈত্যগুরু শুক্র তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ঐ স্থানেই দানবগণের সংগ্রামবিষয়ক চিন্তা করিয়াছিলেন এবং ঐ স্থানেই তাঁহার সমগ্র নীতি প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল। মহাবল বলদেব সেই ঔশনস-তীর্থে আগমন করিয়া ব্রাহ্মণগণকে বিধিপূর্ব্বক ধন দান করিলেন।

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মণ! কি নিমিত্ত উহার নাম কপালমোচন হইল? কিরূপে মহর্ষি মহোদর ঐ তীর্থে জঙ্ঘালগ্ন ছিন্ন মস্তক তাঁহার জঙ্ঘায় লগ্ন হইয়াছিল?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বকালে রঘুবংশাবতংস রাজা রামচন্দ্র রাক্ষসবিনাশবাসনায় দণ্ডকারণ্যে বাস করিয়াছিলেন। তিনি একদা জনস্থানে খরধার ক্ষুর দ্বারা এক দুরাত্মা নিশাচরের মস্তকচ্ছেদ্নপূর্ব্বক দূরে নিক্ষেপ করিলে ঐ মস্তক সহসা মহোদর-নামক বনচারী ব্রাহ্মণের ঊরুদেশে নিপতিত হইয়া অস্থি ভেদপূর্ব্বক সংলগ্ন হইল। মস্তক ঊরুদেশে লগ্ন হওয়াতে বিজ্ঞবর মহোদরের দেবাল্য বা তীর্থ পৰ্য্যটনে আর তাদৃশ ক্ষমতা রহিল না। তাঁহার ঊরুদেশ হইতে অবিরত পূজ নির্গত হইতে লাগিল। তখন তিনি নিতান্ত বেদনার্ত হইয়াও পাচারে পৃথিবীস্থিত যাবতীয় তীর্থ পর্যটন করিয়া ঋষিদিগের নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। ঐ মহাতপস্বী প্রায় সকল তীর্থেই অবগাহন করিয়াছিলেন; কিন্তু কুত্রাপি মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন নাই। পরিশেষে তিনি মুনিগণের প্রমুখাৎ শুনিলেন যে, সরস্বতীতে ঔশনস নামে এক অতি উৎকৃষ্ট তীর্থ আছে। ঐ তীর্থে সমস্ত পাপের শান্তি এবং সিদ্ধিলাভ লইয়া থাকে। হে মহারাজ! দ্বিজবর মহোদর তাঁহাদের বাক্য-শ্রবণে ঔশনস-তীর্থে গমন করিয়া অবগাহন করিবামাত্র সেই জঙ্ঘালগ্ন মস্তক স্খলিত হইয়া সলিলমধ্যে নিপতিত ও অদৃশ্য হইল। তখন মহাত্মা মহোদর নিষ্পাপ, কৃতার্থ ও পরম সুখী হইয়া প্রীতমনে স্বীয় আশ্রমে প্রত্যাগত হইলেন। তখন তিনি ঋষিদিগের নিকট সেই বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলে তাঁহারা সকলে একত্র হইয়া সেই ঔশনসতীর্থের কপালমোচন নাম প্রদান করিলেন। তৎপরে মহর্ষি মহোদর পুনরায় সেই কপালমোচন-তীর্থে গমনপূর্ব্বক তাহার জল পান করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন।

হে মহারাজ! বৃষ্ণিবীর বলরাম সেই তীর্থে ব্রাহ্মণগণকে পূজা ও বিবিধ ধনদান করিয়া তাহাদিগের সহিত রুষঙ্গু তপোধনের সুসমৃদ্ধ আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। ঐ আশ্রমে আর্ষ্টিষেণ অতি কঠোর তপানুষ্ঠান এবং মহর্ষি বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন। ঐ আশ্রম মুনি ও ব্রাহ্মণগণের আবাসভূমি। একদা তপানুষ্ঠাননিরত বৃদ্ধ দ্বিজবর রুষঙ্গু, কলবের-পরিত্যাগে কৃতনিশ্চয় হইয়া তনয়গণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পুত্রগণ! তোমরা আমাকে প্রভূতসলিলসম্পন্ন তীর্থে লইয়া চল।” তপোধন-পুত্রেরা বৃদ্ধ পিতার বাক্য-শ্রবণে তাঁহাকে তীর্থশত সমবেত ব্রাহ্মণসেবিত সরস্বতীতীরে উপনীত করিলে মহর্ষি সেই তীর্থে অবগাহনপূর্ব্বক তাঁহার গুণরাশি চিন্তা করিয়া প্রীতমনে পুত্রগণকে কহিলেন, “হে তনয়গণ! যে ব্যক্তি সরস্বতীর উত্তরভাগে অগাধজলে জপকার্য্যে নিরত হইয়া স্বীয় কলেবর পরিত্যাগ করেন, তাঁহাকে পুনরায় মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় না।”

হে মহারাজ! ধর্ম্মাত্মা বলরাম সেই তীর্থে স্নান ও আচমন করিয়া ব্রাহ্মণগণকে বিপুল ধনদানপূর্ব্বক যে স্থানে ভগবান্ ব্রহ্মা লোকালোকপর্ব্বত নির্ম্মাণ, উগ্রতপাঃ মহাযশাঃ আর্ষ্টিষেণ সিদ্ধিলাভ এবং সিন্ধুদ্বীপ, রাজর্ষি দেবাপি ও বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন, সেই স্থানে সমুপস্থিত হইলেন।