১১. সঙ্কুল যুদ্ধ

১১শ অধ্যায় – সঙ্কুল যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই প্রাতঃকালে নানাস্ত্রসমাকীর্ণ, চতুরঙ্গ বলসমাকুল, যমরাজ্যবিবর্ধন, ভীরুজনের ভয়জনক, বীরগণের হর্ষবর্ধন, ঘোরতর সংগ্রামস্থলে উভয়পক্ষীয় বীরগণ পরস্পরের বধসাধনে সমুদ্যত হইয়া নিশিতশরনিকরে পরস্পরকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলে, সৈন্যগণ নিতান্ত শ্রান্ত ও ইতস্ততঃ ধাবমান হইল, কুঞ্জরসকল চীৎকার করিতে লাগিল এবং কোলাহলপ্রবৃত্ত পদাতিসৈন্যমধ্যে অশ্বগণ চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। ঐ সময় লব্ধলক্ষ্য পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ মহাত্মা যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক পরিক্ষিত হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। প্রবলপরাক্রমশালী পাণ্ডবগণের প্রভাবে সেই অসংখ্য কৌরবসেনা অনল-সমাকুল কুরঙ্গীর [অগ্নিপরিবেষ্টিত হরিণীর ন্যায়] ন্যায় নিতান্ত অবসন্ন হইয়া পড়িল। মহাবীর শল্য তাহাদিগকে পঙ্কনিমগ্ন গাভীর ন্যায় নিতান্ত অবসন্ন অবলোকন করিয়া তাহাদিগের উদ্ধারার্থ উৎকৃষ্ট শরাসনগ্রহণ পূর্ব্বক ক্রোধভরে পাণ্ডবসৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণও নিশিতশরনিকরে মদ্ররাজকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহারথ শল্য বিপক্ষগণের শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সমক্ষেই শাণিতশরনিকরদ্বারা তাঁহার সৈন্যগণকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন।

সমরক্ষেত্রে বিবিধ উৎপাত উৎপত্তি

“হে মহারাজ! ঐ সময় সমরাঙ্গনে বিবিধ দুর্নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইল। বসুন্ধরা শব্দায়মানা হইয়া ভূধরগণের সহিত কম্পিত হইতে লাগিল। দণ্ড ও শূল সমুদয়ের সহিত উল্কাসকল সূৰ্য্যমণ্ডল তিরোহিত করিয়া আকাশ হইতে ভূতলে নিপতিত হইতে আরম্ভ হইল। অসংখ্য মৃগ, মহিষ ও পক্ষিগণ কৌরবসেনার বামপার্শ্বে অবস্থান করিতে লাগিল এবং শুক্র, মঙ্গল ও বুধগ্রহ পাণ্ডবগণের পশ্চাদ্ভাগে ও অন্যান্য নরপতিগণের সম্মুখে সমরক্ষেত্রে অবস্থিত হইলেন। অস্ত্রসমূহের অগ্রভাগ হইতে দৃষ্টিপ্রতিঘাতিনী প্রভা বিনির্গত হইতে লাগিল এবং কাক ও উলূকসকল বীরগণের মস্তকে ও রথধ্বজে উপবেশন করিতে আরম্ভ করিল।

“অনন্তর উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। কৌরবগণ সমস্ত সৈন্যসমভিব্যাহারে পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মদ্ররাজ শল্য সলিলবর্ষী সহস্রলোচনের ন্যায় ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং ভীমসেন, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে সুবর্ণপুঙ্খশিলানিশিত দশ দশ শরে বিদ্ধ করিয়া শরনিকরে সমরাঙ্গন সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। সহস্র সহস্র সোমক ও প্রভদ্রক মদ্ররাজের শরজালে সমাহত হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিল। মহাবীর শল্যের শরনিকর ভ্রমরাবলি, শলভশ্রেণী ও জলদনিৰ্গত বজ্রের ন্যায় অনবরত নিপতিত হইতে লাগিল। অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতি মদ্ররাজের শরাঘাতে ইতস্ততঃ ভ্রমণ ও আর্তনাদ পরিত্যাগ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তখন কালপ্রেরিত অন্তকসদৃশ মদ্ররাজ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পুরুষকার প্রকাশ করিবার মানসে মেঘের ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিয়া শরজালে শত্রুগণকে সমাচ্ছন্ন করিলেন।

শল্যসহ সমবেত পাণ্ডবগণের যুদ্ধ

“এইরূপে পাণ্ডবসৈন্যসমুদয় শল্যকর্ত্তৃক নিহন্যমান হইয়া আত্মরক্ষার্থে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইল। তখন মহাবীর মদ্ৰাধিপতি ক্ষিপ্রহস্তে শরজাল বর্ষণ করিয়া ধৰ্ম্মরাজকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহারাজ ধর্মরাজ মদ্ররাজকে পদাতি ও অশ্বসৈন্যের সহিত ধাবমান দেখি, মাতঙ্গকে যেমন অঙ্কুশদ্বারা নিবারণ করে, তদ্রূপ নিশিতশরনিকরে তাঁহাকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মদ্ররাজ তাঁহার প্রতি এক আশীবিষোপম নিতান্ত ভীষণ শর পরিত্যাগ করিলেন। শল্যনিক্ষিপ্ত সায়ক ধৰ্ম্মরাজের দেহ ভেদ করিয়া মহাবেগে ভূতলে নিপতিত হইল।

“তখন মহাবীর বৃকোদর সাত, সহদেব পাঁচ ও নকুল দশ শরে মদ্ররাজকে বিদ্ধ করিলেন এবং দ্রৌপদীতনয়গণ, জলদজাল যেমন মহীধরের উপর বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহার উপর অনবরত শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর কৃতবর্ম্মা ও কৃপ মদ্ররাজকে পাণ্ডবগণের শরজালে ক্ষতবিক্ষত নিরীক্ষণ করিয়া ক্রোধভরে তাঁহাদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত উলূক, শকুনি, অশ্বত্থামা ও আপনার পুত্রগণ মদ্ররাজের সমীপে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা তিন শরে রোষোদ্ধত ভীমসেনকে বিদ্ধ করিয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারিত ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর শকুনি দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রের প্রতি এবং অশ্বত্থামা নকুল ও সহদেবের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারাজ দুর্য্যোধনও অর্জুনের অভিমুখীন হইয়া তাঁহাদের উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে বিপক্ষগণের সহিত কৌরবদিগের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। মহাবীর কৃতবর্ম্মা ভীমসেনের ঋক্ষ[ভল্লুক]বর্ণ অশ্বসকল বিনাশ করিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর দণ্ডধারী কৃতান্তের ন্যায় গদাহস্তে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় মহারাজ মদ্ররাজ সহদেবের অশ্বসকল বিনাশ করিলেন; মহাবীর সহদেবও ক্রুদ্ধ হইয়া অসিদ্বারা শল্যপুত্রের মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাত্মা কৃপাচার্য অসম্ভ্রান্তচিত্তে নির্ভীক ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত পুনরায় সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন। আচাৰ্য্যতনয় অশ্বত্থামা অম্লানমুখে দ্রৌপদীতনয়গণকে দশ দশ শরে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেনের রথে নূতন অশ্বসমুদয় সংযোজিত হইয়াছিল। মহাবীর অশ্বত্থামা অবিলম্বে উহাদিগকেও নিপাতিত করিলেন। তখন মহাবল পরাক্রান্ত পাণ্ডুপুত্র বৃকোদর পুনরায় হতাশ হইয়া অবিলম্বে রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক দণ্ডধারী ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় গদা গ্রহণ করিয়া কৃতবর্ম্মার রথ ও অশ্বসকল চুর্ণ করিয়া ফেলিলেন। কৃতবর্ম্মা সত্বর সেই ভগ্ন রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া পলায়ন করিলেন।

ভীমশল্য সমর

“ঐ সময় মহাবীর শল্যও কোপাবিষ্ট হইয়া পুনরায় নিশিতশরনিকরে সোমক ও পাণ্ডবসৈন্যগণকে সংহার করিয়া যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া অধরদংশনপূর্ব্বক শল্যের বিনাশবাসনায় স্বীয় সুবিখ্যাত লৌহময় গদা সমুদ্যত করিলেন। ঐ গদা অশ্ব গজ ও মনুষ্যগণের প্রাণসংহারকারী, সুবর্ণপটে সমলঙ্কৃত, গিরিশৃঙ্গ বিদারণক্ষম, শতঘণ্টাযুক্ত, বসা, মেদ ও রুধিরে চর্চিত, রিপুসৈন্যের ভয়বর্ধন, স্বসৈন্যের হর্ষজনক, কামিনীর ন্যায় অগুরু ও চন্দনচর্চিত এবং যমদণ্ডের ন্যায়, কালরাত্রির ন্যায়, প্রজ্বলিত মহোল্কার ন্যায়, উগ্র ভুজঙ্গীর ন্যায়, ইন্দ্রনির্মুক্ত অশনির ন্যায়, যমের জিহ্বার ন্যায় নিতান্ত ভীষণ; মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ঐ গদা গ্রহণ করিয়া কৈলাসভবনে মহেশ্বরের সখা ক্রুদ্ধ অলকাধিপ কুবেরকে আহ্বান এবং দ্রৌপদীর প্রিয়কাৰ্য্যসাধনার্থ সৌগন্ধিক গ্রহণাভিলাষে গন্ধমাদনে গর্বিত গুহ্যকগণকে সংহার করিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি সেই বিবিধ মণিরত্নখচিত ভীষণ গদা উদ্যত করিয়া মদ্ররাজ শল্যকে আহ্বান করিয়া তাঁহার অভিমূখীন হইয়া অবিলম্বে তাঁহার বেগবান অশ্বচষ্টয়কে সংহার করিলেন। মদ্ৰাধিপতি তদ্দর্শনে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমসেনের বিশাল, বক্ষঃস্থলে তোমর নিক্ষেপপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। শল্যনিক্ষিপ্ত তোমর ভীমসেনের বর্ম্ম ভেদ করিয়া বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ হইল। মহাবীর বৃকোদর তোমরাঘাতে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া অশঙ্কিতচিত্তে স্বীয় দেহ হইতে সেই তোমর উত্তোলনপূর্ব্বক শল্যসারথির হৃদয় ভেদ করিলেন। সারথি তোমরাঘাতে মর্মপীড়িত হইয়া রুধির বমন করিয়া নিপতিত হইল। তখন মদ্ররাজ ভীমসেনের পরাক্রমদর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক গদাহস্তে বৃকোদরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ ভীমসেনের ভয়ঙ্কর কর্ম নিরীক্ষণ করিয়া আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।”