০২. ধৃতরাষ্ট্রের শোকোচ্ছ্বাস

২য় অধ্যায় – ধৃতরাষ্ট্রের শোকোচ্ছ্বাস

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! কামিনীগণ প্রস্থান করিলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন। পরে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও বারংবার বাহুযুগল বিধূনন [কম্পিত] করিয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হে সূত! তোমার নিকট পাণ্ডবগণকে সমরাঙ্গনে নিরাপদ শ্রবণ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত হইলাম। আমি নিশ্চয়ই কহিতেছি, আমার হৃদয় বজ্র-নির্মিত নতুবা পুত্রগণের নিধনবার্তা-শ্রবণে উহা সহস্ৰধা বিদীর্ণ হইত। হে সঞ্জয়! আজ পুত্রগণের বয়ঃক্রম, ও বাল্যক্রীড়া স্মরণ হওয়াতে আমার চিত্ত বিদীর্ণ হইতেছে। যদিও আমি জন্মান্ধপ্রযুক্ত তাহাদের রূপসন্দর্শনে বঞ্চিত ছিলাম, তথাপি তাহাদিগের প্রতি আমার অপত্যস্নেহ নিতান্ত বলবান ছিল। তাহারা বাল্যাবস্থা অতিক্রম করিয়া যৌবনাবস্থা ও যৌবনানন্তর প্রৌঢ়বস্থায় অধিরূঢ় হইয়াছে শ্রবণ করিয়া আমি যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়াছিলাম। কিন্তু আজ তাহাদিগকে ঐশ্বৰ্য্যবিহীন ও নিহত শ্রবণ করিয়া শোকে নিতান্ত অধীর হইতেছি, কিছুতেই শান্তিলাভ হইতেছে না।

“হা পুত্র দুর্য্যোধন! এক্ষণে আমি অনাথ হইয়াছি, একবার আমাকে দর্শন প্রদান কর। তোমার অভাবে আমার কি দশা ঘটিবে? হে বৎস! তুমি সমাগত নরপালগণকে পরিত্যাগ করিয়া কি নিমিত্ত প্রাকৃত ভূপতির ন্যায় ভূতলে নিপতিত রহিয়াছ? তুমি জ্ঞাতি ও বন্ধুগণের অনন্য অবলম্বন ছিলে, এক্ষণে এই বৃদ্ধ অন্ধপিতাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিলে? হে রাজেন্দ্র! তোমার সে ভক্তি, সে স্নেহ ও সম্মান কোথায় গেল?

তুমি ত’ সমরে অপরাজিত ছিলে, তবে পাণ্ডবগণ কিরূপে তোমাকে নিহত করিল হে বৎস! আমি যথাসময়ে গাত্রোত্থান করিলে কে আর ‘হে তাত! হে মহারাজ! হে লোকনাথ বলিয়া’ বারংবার সম্বোধনপূর্বক স্নেহভরে আলিঙ্গন করিয়া অনুজ্ঞা প্রার্থনা করিবে? হে বৎস! এক্ষণে একবার সেই মধুরবাক্য প্রয়োগ কর। আমি তোমার মুখে শুনিয়াছি যে, এই সমুদয় পৃথিবীতে পাণ্ডুতনয়ের ন্যায় আমারও অধিকার আছে। তুমি বলিয়াছিলে– ভগদত্ত, অবন্তীনাথ, জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্রবা, গল, সোমদত্ত, বাহ্লীক, অশ্বত্থামা, ভোজ, মাগধ, বৃহদ্ধল, কাশীশ্বর, শকুনি, কাম্বোজাধিপতি সুদক্ষিণ, ত্রিগর্ত্তাধিপতি, পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচাৰ্য, কৃপাচার্য্য, শ্রুতায়ু, অচ্যুতায়ু, শতায়ু, জলসন্ধ, সুবাহু, ঋষ্যশৃঙ্গতনয়, রাক্ষস অলায়ুধ ও অলম্বুষ, অন্যান্য নরপালগণ এবং শক, যবন, ও ম্লেচ্ছগণ সকলেই আমার নিমিত্ত প্রাণপণে সমরে সমুদ্যত হইয়াছে। আমি সেই সমস্ত বীরগণমধ্যে ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত হইয়া পাণ্ডব, পাঞ্চাল, চেদিগণ এবং সাত্যকি, ভোজ, রাক্ষস ঘটোৎকচ ও দ্রৌপদীর পাঁচপুত্রের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইব। তুমি বলিয়াছিলে—”আমি ক্রুদ্ধ হইলে একাকীই পাণ্ডবপক্ষীয় সমস্ত বীরগণকে নিবারণ করিতে পারি, তাহাতে আবার অন্যান্য অসংখ্য বীর একত্র সমবেত ও পাণ্ডবদিগের সহিত বৈরাচরণে প্রবৃত্ত হইলেন। পাণ্ডবগণের প্রধান অবলম্বন বাসুদেব সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন না। অতএব নিশ্চয়ই অস্মৃৎপক্ষীয় বীরগণ পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিবেন; আর মহাবীর কর্ণ একাকীই আমার সহিত সমবেত হইয়া পাণ্ডবগণকে বিনষ্ট করিবে। তাহা হইলে সমস্ত নরপালগণই আমার বশবর্তী হইবেন।

“হে সঞ্জয় দুৰ্য্যোধন বারংবার আমার নিকট এই সমস্ত বাক্য প্রয়োগ করাতে আমি বোধ করিয়াছিলাম, পাণ্ডবগণ আমাদিগের বলপ্রভাবে সমরে নিহত হইবে। এক্ষণে যখন আমার পুত্রগণ সেই সমস্ত বীরমণ্ডলে অবস্থিত হইয়াও বিনষ্ট হইল, তখন আমার দুরদৃষ্ট ভিন্ন আর কি হইতে পারে? শৃগাল-হস্তে সিংহ যেমন নিহত হয়, তদ্রূপ প্রবলপরাক্রম ভীষ্ম শিখণ্ডীর হস্তে নিহত হইয়াছেন। সর্বাবিশারদ দ্রোণাচার্য্য, ভূরিশ্ৰবা, সোমদত্ত, বাহ্লীক, গজযুদ্ধবিশারদ ভগদত্ত, জয়দ্রথ, সুদক্ষিণ, জলসন্ধ, শ্রুতায়ু, অচ্যুতায়ু, মহাবলপরাক্রম পাণ্ড্য, বৃহদ্বল, মগধরাজ, উগ্ৰায়ুধ, বিন্দ, অনুবিন্দ, ত্রিগর্ত্তাধিপতি, অসংখ্য সংশপ্তক, রাক্ষসরাজ অলম্বুষ ও অলায়ুধ, ঋষ্যশৃঙ্গতনয়, নারায়ণী সেনাগণ, যুদ্ধদুৰ্ম্মদ গোপালগণ, অসংখ্য ম্লেচ্ছ, সসৈন্য সুবলনন্দন শকুনি, মহাবল কৈতব্য, নানাদেশ-সমাগত সর্বাস্ত্রবিশারদ মহেন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী ক্ষত্রিয়গণ এবং আমার পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা ও বয়স্যগণ ইহারা সকলেই কালকবলে ঐ নিপতিত হইয়াছেন। অতএব এ বিষয়ে দুর্ভাগ্য ভিন্ন আর কি সম্ভব হইতে পারে? মানবগণ নিশ্চয়ই ভাগ্যসহযোগে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে; যাহার সৌভাগ্য সঞ্চিত থাকে, সে শুভফল প্রাপ্ত হয়। আমি নিতান্ত হতভাগ্য বলিয়াই পুত্ৰবিহীন হইলাম। হায়! আমি কিরূপে অরাতির বশবর্তী হইয়া কালযাপন করিব? এক্ষণে বনবাস ভিন্ন উপায়ান্তর দেখিতেছি না। এরূপ সহায়হীন ও বন্ধুবান্ধববিহীন হইয়া লোকালয়ে অবস্থান করা কদাপি কর্তব্য নহে, বনগমনই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। হায়! দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন, শল্য ও বিকর্ণ প্রভৃতি মহাবলপরাক্রান্ত বীরগণ নিহত হইল। ভীমসেন একাকীই আমার একশত পুত্রকে বিনাশ করিয়াছে। সে দুৰ্য্যোধনের বিনাশ জন্য বারংবার আত্মশ্লাঘা করিলে আমি কিরূপে তাহার সে কঠোর শব্দ শ্রবণ করিব? আমি দুঃখশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াছি, আর বৃকোদরের পুরুষ বাক্য শ্রবণে সমর্থ হইব না।”

শোকার্ত ধৃতরাষ্ট্রের সমরবৃত্তান্ত শ্রবণেচ্ছা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! এইরূপে পুত্রশোকাবিভূত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বহুক্ষণ বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া শত্রুকৃত পরাভব-স্মরণে বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পুনরায় সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে সঞ্জয়! আমার পক্ষীয় বীরগণ ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণকে নিহত শ্রবণ করিয়া কাহাকে সেনাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত করিল? তাহারা যাহাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করে, সেই বীরই অচিরকালমধ্যে পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হয়। দেখ, তোমাদের এবং অন্যান্য ভূপালগণের সমক্ষে মহাবীর ধনঞ্জয় ভীষ্ম ও সূতপুত্রকে এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচাৰ্য্যকে সমরে নিপাতিত করিয়াছে। পূৰ্ব্বে সৰ্ব্বধর্মবেত্তা বিদুর আমাকে কহিয়াছিল যে, দুৰ্য্যোধনের অপরাধেই সমস্ত প্রজাক্ষয় হইবে। তৎকালে কোন ব্যক্তিই মোহাবেশপ্রভাবে উহার সেই বাক্য পর্যালোচনা করে নাই; কিন্তু ঐ মহামনা যাহা কহিয়াছিল, এক্ষণে তাহাই সত্য হইল। যাহা হউক, এক্ষণে আমার দুর্দৈবনিবন্ধন যে দুর্নীতি উপস্থিত হইয়াছে, তাহার ফল পুনরায় কীৰ্ত্তন কর। মহাবীর কর্ণ নিপাতিত হইলে কোন বীর সেনাপতি হইয়াছিল? কোন রথী অৰ্জ্জুন ও বাসুদেবের প্রত্যুদগমনে প্রবৃত্ত হইল? মহাবীর মদ্ররাজ সমরোদ্যত হইলে কোন্ কোন্ ব্যক্তি তাঁহার দক্ষিণচক্র, বামচক্র ও পৃষ্ঠদেশ রক্ষা করিয়াছিল? মহাবলপরাক্রান্ত মদ্ররাজ ও আমার আত্মজ দুৰ্য্যোধন, তোমাদের সমক্ষে কিরূপে পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইলেন? অনুচরবর্গসমবেত পাঞ্চালগণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ইহারাই, বা কিরূপে সমরশয্যায় শয়ন করিল? আর পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব ও সাত্যকি এবং কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা, ইহারাই বা কি প্রকারে মৃত্যুমুখ হইতে নির্ম্মুক্ত হইলেন? হে সঞ্জয়! তুমি সমরবৃত্তান্ত-বর্ণনে সুনিপুণ, এক্ষণে কৌরব ও পাণ্ডবগণের যেরূপে যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন কর।’