এ.বি.সি. রহস্যের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পনেরো বছরের কিশোর থেকে আশি বছরের বৃদ্ধের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। সকলেই চায় রহস্যের জাল ভেদ করতে। দেখা যাক, এই ছেলেটি কি বলে?
মিঃ টম হার্টিগান নামে একটি ছেলে ঘরে এসে ঢুকলো। কাগজের সেই খবরটা পড়ে ক্যামডেন থেকে সে এসেছে।
আপনাকে যে খবরটা দেবো, সেটা আপনাদের কতখানি কাজে লাগবে জানি না, স্যার। সে বলতে থাকে, লিলিদের বাড়ির সেই আধপাগলা গোবেচারা স্বভাবের বুড়ো, নিতান্ত ভালো মানুষ গোছের চেহারা, দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না, অথচ পেটে তার শয়তানি বুদ্ধি।
–কে লিলি?
–আমার বান্ধবী। লিলি মার্থার। ক্যামডেনে থাকে। নিজেদের বাড়ির কয়েকটা ঘর ভাড়া দিয়েছে। ঐ বুড়োটা গত এক বছর ধরে ওদের বাড়িতে বাস করছে। নাম মিঃ কাস্ট।
–কাস্ট?
–হ্যাঁ, তারপর সে ইউস্টেন স্টেশনের সমস্ত ঘটনা ক্রোমকে বললো। আমি বার বার লিলিকে বলেছি, ঐ লোকটাকে ইউস্টেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখেছি। লিলি আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। ও কেবল বললো, ইউস্টেন না ব্রিস্টন। সেদিন নাকি কাস্টের বেলতেন হ্যাঁমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে যাচ্ছিলো ড কাস্টারে। টিকিটটা পড়ে যাওয়ায় আমি তার হাতে তুলে দেওয়ার সময় দেখেছিলাম। লিলি বললো, লোকটার নাকি নিজের ভালো–মন্দ বোঝার জ্ঞানটুকুও নেই। এর আগের খুনের দিন নাকি সে টকি গিয়েছিল। একটু ভেবে লিলি জানালো, বেক্সহিলে যেদিন খুনটা হলো তার দুদিন আগে সে ঐ স্থানের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। তিনদিন পরে সেখান থেকে ফিরে এসেছিল। আমি তাকে তামাশা করে বলেছিলাম, হয়তো লোকটা এ.বি.সি. দলের। শুনে লিলি বললো, ওর নাকি মারতে গেলে হাত কাপে, সে আবার খুন করবে?..স্যার, সেদিন বিকেলের সংবাদে এ.বি. ক্যাস না কেস-এর যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে কাস্টের একেবারে সাদৃশ্য হয়েছে। এরপর লিলির মাকে সব কিছু বললাম। উনি ভাড়াটিয়াদের রেজিস্টার টেনে বের করলেন। খুলে দেখলেন নাম রয়েছে এ.বি. কাস্ট। আমি, লিলি আর তার মা একসঙ্গে বসে আলোচনা করতে লাগলাম, প্রথম খুনের সময় কাস্ট কোথায় ছিল। ভাবতে, ভাবতে আমরা কোনো সঠিক জবাব খুঁজে পেলাম না। এমন সময় লিলি-ই কথাটা মনে করলো, এ্যান্ডোভারের খুনের আগের দিন ক্যাসাড থেকে ওর এক কাকা এসেছিল ক্যামডেনে। দুদিনের জন্য তিনি থাকবেন। তাই হোটেলের ঘর না নিয়ে লিলির মা তাকে কাস্টের ঘরে থাকতে দিয়েছিল। কারণ ঐ সময় কাস্ট দিন চারেকের জন্য ক্যামডেনে ছিল না।
একটানা কথাগুলো বলে টম থামলো।
-তারপর? ক্রোম আগ্রহ প্রকাশ করলো।
-তারপর আর কি? সময় নষ্ট না করে আপনার কাছে চলে এলাম। বুধবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কাস্ট ফিরে এসেছে। সেই থেকে ঘরের মধ্যেই রয়েছে। সারাক্ষণ কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে আর আপনমনে কি সব বলে। লিলির মার কাছ থেকে আমি এসব শুনেছি।
লিলিদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে টম বিদায় নিলো।
–ঠিক আছে, পারলে আজই একবার কাস্টের সঙ্গে দেখা করে আসবো, ক্রোম টমকে জানিয়ে দিলো।
মিঃ জ্যাকবের কাছ থেকে কার্স্টনের ফাইলটা চেয়ে নিয়ে ক্রোম পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নিজের মনে বললো, হিস নামে একজন তোক সিনেমা হলের সামনে এক অদ্ভুত লোককে দেখেছিল, ছবি দেখে বেরিয়ে সে নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কি সব বলছিল। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিলো–যে লোক পরপর চারটে খুনের সময় বাইরে থাকে, তাকে তো সন্দেহ করা যেতেই পারে। ওর ওপর কড়া নজর রাখা প্রয়োজন।
ক্রোম জ্যাকবকে উদ্দেশ্য করে বললো-শুনুন, লোকজন নিয়ে আপনি বরং ক্যামডেনের এই ঠিকানায় চলে যান, আমি স্যার লায়লেনের সঙ্গে কিছু আলোচনা সেরে ওখানে যাচ্ছি।
.
টমকে ইয়ার্ডের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে লিলি বাইরে ফুটপাথে অপেক্ষা করছিল। টম ফিরে এলো তার কাছে। লিলি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো, সে কার সঙ্গে কথা বলেছে? কি কথা হয়েছে ইত্যাদি।
টম ক্রোমের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সব হুবহু বলে গেল।
-তাহলে ওরা আজই ক্যামডেনে আসছে কাস্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য?
–সেরকমই বললো।
–তোমরা দেখছি গোবেচারা নিরীহ লোকটিকে তিষ্ঠোতে দেবে না।
বাঃ, তুমি দেখছি খুনীটার হয়ে ওকালতি শুরু করলে। এখন চুপ করো, যখন কাগজে তোমার মার, তোমার আমার ছবি বের হবে তখন তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো, কেমন। তার আগে তোমার মাকে বলল, আমারে যেন পেট ভরে খাইয়ে দেয়।
হঠাৎ যেন মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিমায় লিলি বললো, এক বান্ধবীকে ফোন করতে হবে। সে একথা বলেই সামনের ডাক্তারখানাতে ঢুকলো ফোন করতে।
.
হাত থেকে রিসিভার নামিয়ে রেখে কাস্ট মিসেস মার্থারির দিকে তাকালেন।
–কোনো খারাপ খবর নাকি? মিসেস মাথারি জানতে চাইলো। ফোনে আপনাকে ডেকে দিতে বললো…আপনাদের তো কোনো ফোন আসে না, গলাটা চেনা লাগলো, মনে হলো লিলির গলা। আচ্ছা মিঃ কাস্ট, মেয়েটি কে?
কাস্ট কি বলবে ভেবে পেল না। আমতা আমতা করে বললো, আমার বোন ফোন করেছিলো। পরশু সকালে ওর একটা ছেলে হয়েছে। পরপর দুটো মেয়ের পর এই ছেলে।
-দারুণ আনন্দের খবর। তাহলে আজ বিকেলে নিশ্চয়ই চায়ের আসর বসছে?
–দুঃখিত, আজ হবে না। আমাকে যেতে হবে বোনের বাড়ি। স্টেশনে থেকে বেশ কিছুটা হাঁটতে হয়। এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। নতুবা রাত হয়ে যাবে। এই বলে কাস্ট দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
মিসেস মার্থারি তার পথ রোধ করলো। বাধা দিতে চাইলো।
কাস্ট বললেন-সামনের সপ্তাহে সোমবার বা মঙ্গলবার আবার ফিরে আসব। আর দেরি না করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। মিসেস মাথারি বোকার মতো তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
কাস্ট উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলতে লাগলো। চারদিকে মানুষ গিজ গিজ করছে। ফোনটা পাওয়ার পর থেকে ওর মাথা চক্রাকারে ঘুরছে।
…মিঃ কাস্ট, আমি লিলি বলছি, আমি খবর পেলাম, স্কটলান্ড ইয়ার্ডের এক পুলিশ অফিসার আপনার কাছে যাচ্ছেন। সময় আছে, পালিয়ে যান। পালান আপনি…
লিলি…তোমার হৃদয়ে আমার জন্য এত দয়া! তুমি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে আজীবন বেঁচে থাকো। তোমার ফুলের মতো কোমল হৃদয়ে দুঃখ যেন আঁচড় বসাতে না পারে।
বিদায় লিলি, বিদায়…।
তোমাদের ভালোবাসা আমি মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখবো। বিদায়…
আবার নিয়মমাফিক বৈঠক বসলো। বৈঠকে পোয়ারো, স্যার লায়লেন, ক্রোম এবং আমি উপস্থিত ছিলাম।
মিঃ পোয়ারো, স্যার লায়লেন বললো, আপনিও তো এই বয়সে একটা খেল দেখিয়ে ছাড়লেন। আপনার সেই মোজার সূত্র ধরে কাস্টন, বেক্সহিল, এ্যান্ডোরভারের মোট তিরিশজন লোকের জবানবন্দী থেকে জানা গেছে ঘটনার দিন ভিন্ন ভিন্ন সময় শহরে, শহতলীর বিভিন্ন জায়গায় এক আধপাগলা বুড়োকে তারা মোজা বিক্রি করতে দেখেছে। তাদের কাছ থেকে লোকটার যে চেহারার বর্ণনা পেলাম তার সঙ্গে ব্ল্যাক সোয়ান হোটেলের মেরি স্ট্রাউডের বর্ণনার হুবহু মিল আছে। এমন কি এই খবর পাওয়া গেছে যে বিভিন্ন ঘটনাস্থলের ধারে-কাছে কোনো হোটেলে সে উঠতো।
…আজ সকালে টম নামের ছেলেটির কাছ থেকে সব শুনে আমরা মিসেস মার্থারির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সে জানিয়েছে, মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে লোকটা সেখান থেকে চলে গেছে। ভাবলাম, ওর ঘরটা একবার দেখে যাই। তাই ছজন গোয়েন্দা নিয়ে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। চারদিকে সতর্ক নজর রেখে দেখলাম। তেমন কিছু ঘরে নেই। সেলফের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি ওপরের তাকে বেশকিছু পিচবোর্ডের বাক্স। আমি বাক্সগুলি খুলে ফেললাম। বেরিয়ে এলো সস্তা দামের কয়েক জোড়া সিল্কের মোজা।
…নিচের তাকে একটা ভারী পার্শেল দেখে হাতে নিলাম। খুলে ফেললাম। আটখানা এ.বি.সি. গাইড বুক যত্ন করে রাখা ছিল। ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
হলঘরের আলনায় একটা পুরোনো ওভারকোট ঝুলছিল। আমাদের মধ্যে একজন আলনার হাতল ধরে টান মারলো। ঠুং করে মাটিতে পড়লো একটা ছোরা, দশ ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের তীক্ষ্ণ ধারালো ফলা। ফলাটার দুধারে তখনও রক্তের ছিটে শুকিয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না, এই ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুনী তার চতুর্থ খুনটি সম্পন্ন করেছিল।
ক্রোমের কথা শেষ হতে পোয়ারো নিচু স্বরে বললো-ডন কাস্টারে কাজ শেষ করে অস্ত্র টাকে কেন বোকার মতন বয়ে নিয়ে এলো।
–হয়তো ব্ল্যাক সোয়ানের মেরি স্ট্রাউড ভীষণ তাড়া দিয়েছিল। তাই কোথাও ফেলে রেখে আসার সুযোগ পায়নি।
তবে, লায়লেন বললো, মিসেস মার্থারির বাড়ির ভাড়াটে মিঃ আলেকজান্ডার বোনাপার্টের কাস্ট-ই এ.বি.সি., এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মিঃ পোয়ারো, আপনি কি বলেন?
-আমি…আবার…হয়তো হিসেবের গরমিল…এখনো আমার পুরোনো হিসেবের উত্তর পেলাম না। কেবল ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন মনে জাগে–এই খুনের কারণ কি? খুনের মোটিভ-ই বা কি? জবাব এখনও অজানা। তাই হিসেবের ফাঁকটুকু ভরাট করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
সেদিনের মতো বৈঠক শেষ হলো।
‘এটাকে আবার ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর লেখা বলে মনে করবেন না।‘
কাস্ট ঐখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওখান থেকে দাঁড়িয়ে দূরের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে।..কবে যেন এসেছিলাম, সেই জুন মাসের একুশ তারিখে। এখনও দোকানের সামনে সাইনবোর্ডটা ঝুলছে। দোকানের নাম ঝলমল করে নজরে পড়ছে—
এ. এ্যাম্বার।
আর দোতলার জানলায় ওটা কি ঝুলছে..গরাদে দেখছি একটা কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা…কি যেন লেখা…গোটা গোটা অক্ষরে…নজরে পড়ছে না। চশমাটা বের করে চোখে লাগলেন বাড়ি–ভা-ডা-দে-ও-য়া-হ-ই-বে।
তার মানে বাড়িতে এখন কোনো বাসিন্দা নেই, খালি।
দয়া করে দোকানের সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়াবেন।
কথাটা শুনে কাস্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, সবজির দোকানের মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালেন।
খানিক বাদেই ওখান থেকে তিনি সরে পড়লেন। হঠাৎ তার দেওয়ালের নিকে নজর পড়লো। বড় বড় হরফে লেখা একটা পোস্টার সাঁটা।
সাবধান।
হয়ত আপনার পাশের মানুষটাই সেই উন্মাদ এ.বি.সি.। এই নরপিশাচ শয়তানের থেকে নিজে বাঁচুন, অপরকে রক্ষা করুন। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো বলেন…
মঁসিয়ে পোয়ারো…উনি কি এতদিন কোনো সন্দেহ করে উঠতে পারেননি।
আবার কাস্ট পথ ধরে এগোতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল সেই কথাটা। কে যেন বলেছিলেন–মানুষ এক অদ্ভুত জীব। কথাটা শুনে আজ আর বিস্মিত হতে হয় না। নিজেই যখন আজব জীব।…আমাকে অনেকে ব্যঙ্গ করতো, তামাশা করতে…আমি গুরুত্ব দিতাম না।
হঠাৎ তার চিন্তার ছেদ পড়লো। কোথায় এলাম…আলো ঝলমল করছে..লোকজন…পুলিশ… সার্জেন্ট…সত্যি, হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসতে গিয়েও হাসি ঠোঁটে এলো না। চোখের সামনে পৃথিবী দুলে উঠলো। মাথা বনবন করে ঘুরছে। জ্ঞান হারিয়ে তিনি লুটিয়ে পড়লেন উঠোনের কেয়ারি করা ঘাসের ওপর।
তেসরা কি চৌঠা সেপ্টেম্বর হবে। বেলা দশটা নাগাদ ডঃ টম্পসনকে নিয়ে জ্যাপ এসে হাজির হলো। এতদিনে পুলিশ কোর্টের একদফা শুনানি হয়ে গেছে। এরপর সরকার বনাম আলেকজান্ডার বোনাপার্ট কাস্টের মামলার দায়রার সোপাদ হয়েছে। শুনানির দিন পোয়ারো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। ফলে আমরা কেউই কোর্টে হাজির থাকতে পারিনি।
কাগজে মামলার খবর ছাপা হয়েছে।
–আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের এমন ফলাও সুযোগ দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আমি বললাম।
পোয়ারো আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। সেটা ওদের ব্যাপার, ও নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা করার কোনো দরকার নেই। যদি বিচারে প্রমাণ হয় যে সে প্রকৃতিস্থ নয়, পাগল, তাহলে বেকসুর খালাসের প্রশ্ন আসছে।
-না, তার মধ্যে পাগলামির কোনো লক্ষণ আমি সেদিন দেখিনি। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার চাল-চলন কথাবার্তা স্বাভাবিক। আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে স্বপ্নচারিতা বলে একটা রোগের কথা উল্লেখ আছে। যে লোক এই রোগের কবলে পড়ে সে ঘুমন্ত অবস্থায় যে কাজ করে, তার চেতন মনের সমর্থনে সে সেটা করে থাকে। কাস্ট এর ব্যতিক্রম নয়। সে যে চারটে খুন এ পর্যন্ত করেছে, তার প্রত্যেকটিতে তার চেতন মনের সায় সম্পূর্ণভাবে রয়েছে।
প্রতিটি খুন করার আগে সে পোয়ারোকে চিঠি দিয়ে জানান দিয়েছে। তার মানে খুনটা সেছে পরিকল্পনামতো। আগে থেকেই ভেবে নিচ্ছে। ধরা যেতে পারে শহরে এত লোক থাকতে বেছে বেছে আপনাকে কেন আক্রমণ করছে? সেটা হলো, আসলে আপনার নামের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, তার আক্রমণ। আপনাকে নিয়ে ওর যত না ভাবনা, তার থেকে বেশি মাথা ব্যথা ছিল এরকুল পোয়ারো নামটাকে নিয়ে। মনোবিজ্ঞানে এই রোগকে বলা হয় মনোবিকল। যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, নাম-যশ আছে, তাদের হিংসা করা। লোকের সামনে তাকে ছোটো করে তুলে ধরা…লক্ষ্য করুন, ওর নামের প্রথম দুটো অংশ দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষের নামের অংশবিশেষ। শিশু বয়সে ওর ঐ নাম রাখা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিলো, বড় হয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হবে। কিন্তু সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তার মনে একটা ক্ষোভ বাসা বাঁধলো। বিতৃষ্ণা জাগলো স্বনামধন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু টমসন, থানায় ভালোমানুষের মতো নিজে আসার কারণটা কি?
-ওটা সাধারণত হয়ে থাকে। অপরাধী মনের চিরন্তন মনস্তত্ত্ব। যাকে বলে বিবেক। পাপ যখন কানায় কানায় ভরে যায় তখন বিবেকের দংশনে নিজেই পাগল হয়ে যায়। অপরাধ স্বীকারের জন্য মন তখন ছটফট করে ওঠে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এইভাবে কিছুক্ষণ আলোচনা চললো। টমসনের অন্য কাজ পড়ে আছে। তাই সে সেখান থেকে চলে গেল।
আমাকে একা পেয়ে জ্যাপ বললো–আপনার আর মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে এ.বি.সি.-র মামলার ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে এলাম, দায়রা কোর্টে ইতিমধ্যে একটা জট পাকিয়ে উঠেছে। এটার জন্য দায়ী ঐ উঠতি বয়সের ব্যারিস্টার লুকাস। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে হট করে মস্ত বড় একটা দরখাস্ত জর্জ সাহেবের এজলাসে জমা দিয়েছে আসামী পক্ষের হয়ে সে কথা বলতে চায় এটাই তার ইচ্ছা।
-তাতে ক্ষতি কি?
-ক্ষতি আছে। সে নাকি কাস্টকে খালাস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নাকি পাকা করে ফেলেছে। বেক্সহিল খুনের রাতে কাস্ট নাকি ঘটনাস্থলের ধারেকাছেই ছিল না, এমন প্রমাণ তার কাছে আছে। সেদিন ঐ লোকটা নাকি স্ট্রেঞ্চ নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত দাবা খেলে কাটিয়েছিল ইস্টবোনের হোয়াইট ক্রম হোটেলের বৈঠকখানায় বসে। কাগজে কাস্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশিত হতে স্ট্রেঞ্চ নিজে থেকে এসে ঐ উকিলের সঙ্গে দেখা করে এবং সমস্ত ঘটনার কথা বলে। ফলে উকিলটি আনন্দে একটা মস্ত বড় দরখাস্ত নিয়ে বসে আছে।
-তুমি কি ঐ ভদ্রলোককে কখনো দেখেছো? ঐ যে কি নাম? স্ট্রেঞ্চ।
-হ্যাঁ, লুকাসের কাছ থেকে ওর ঠিকানা আমি সংগ্রহ করেছিলাম। সেইমতো ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করি। আমাকেও ঐ একই কথা সে বললো। ওরা নাকি খেলায় এত মত্ত ছিল যে রাত বেড়ে গেছে খেয়াল নেই। হোটেলের বেয়ারা আলো নেভাতে এলে ওদের হুশ হয়। ফলে খেলায় ইতি টেনে যে যার কামরায় চলে যায়। হোটেলে রেজিস্টার দেখলাম। সেখানে কাস্টের হাতের লেখা নিজের সই রয়েছে। হোটেলের বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে-ও একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো। এবার তাহলে বুঝতে পারছেন ঘটনাটা কোথায় গড়াতে চলেছে। তাই এ্যান্ডোভার, কাস্টন আর ডকাস্টারের খুনের অভিযোগগুলি যদি একসঙ্গে ওর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বেহিলের ব্যাপারটা আর আমল পাবে না। তবে বেহিলের ঘটনার মৃতদেহ পরীক্ষা করে জানা গেছে খুনটা হয়েছে রাত বারোটা থেকে রাত একটার মধ্যে। যদি ভদ্রলোকের কথা ধরে নেওয়া যায়, তাহলে ইস্টবোর্ন থেকে বেহিল চৌদ্দ মাইল রাস্তা। যদি সে বারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরোয় তাহলে অত রাতে গাড়ি পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে টাঙ্গা ধরতে হয়। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা, খুব কম করেও। আর পায়ে হেঁটে যেতে পাঁচ ঘণ্টা খরচ করতে হবে। ঐ সময়ের মধ্যে বেক্সহিলে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
–এই অবস্থায় তুমি কি করতে চাও?
–আমি কি করবো? যা করার মিঃ পোয়ারো করবেন। সে কিভাবে খুন করেছে সেটাই সর্বপ্রথম জ্ঞাতব্য বিষয়। আচ্ছা, স্যার এখন চলি। জরুরী মিটিং আছে। সবাই আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, স্যার। আসি।
পোয়ারো আমাকে লক্ষ্য করে বললো–হেস্টিংস, তোমার কি ধারণা? এ.বি.সি. মামলা শেষ পর্যন্ত কি নিষ্পত্তি হতে চলেছে?
-সেরকমই, কারণ সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে যা জানা গেছে আর লোকটার সম্পর্কেও তো কিছু তথ্য জানা গেছে। তাছাড়া তুমি, ক্রোম, জ্যাপ আছো…সবাই আছো, বাধা কোথায়?
-তোমরা কিন্তু একটা ব্যাপারে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ.বি.সি. রহস্যের প্রধান এবং প্রথম কথা সেখানেই সেই বশংবদ বন্ধুটির কথা একবারও জানার চেষ্টা করলে না।…সে কবে জন্মেছে..বংশ পরিচয়, চাকরি থেকে কবে বরখাস্ত হয়েছে…কতদিন ধরে মিসেস মার্থারির ভাড়াটে হিসাবে ছিল, এগুলো জানলেই সব জানা হয় না। আমাদের জানতে হবে, কেন সে নরঘাতক হয়ে উঠেছে। কুশলী হওয়া সত্ত্বেও কেন সে তার পাপের মাত্রা বাড়িয়ে গেছে। কেন সে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করে, সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয়। ইত্যাদি এই ধরনের নানা প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা আছে? কেন সে বেছে বেছে এই লোকগুলোকে খুন করলো? ..হেস্টিংস, আমি আর একটা আলোচনা করতে চাই সকলের সঙ্গে বসে। তারপর যাবো আমার সেই বন্ধুটির কাছে। আমি তার মুখোমুখি হবো। নিভৃতে বসে আমি তার সঙ্গে কথা বলবো। তাকে আমি নতুন করে চিনবো, আমার প্রশ্নের উত্তরে কাস্ট কি বলবে, তুমি তা জানো না। আমি জানি সে নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলবে। সেটাই হবে আমার সত্যের উন্মোচন। মিথ্যের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসবে এক নির্দয় নিষ্করুণ মহাসত্য।
এরপর প্রায় সাত-আটদিন পোয়ারোর সঙ্গে কোনো কথা হলো না। সে নিজের কাজে এত মগ্ন যে নাওয়া-খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে গেল। আর ধ্যান ভঙ্গ হতে সে আমাকে বললো, তার ইচ্ছে বেক্সহিল আর তার আশেপাশের অঞ্চলে সে আর একবার যেতে যায়। আমিও ইচ্ছে করলে তার সঙ্গে যেতে পারি।
অতএব পরদিন সকালে আমরা দুজনে বেহিলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে দেখি আমাদের দলের অনেকে সেখানে হাজির হয়েছে। সকলেই আলাদা আলাদা ভাবে পোয়ারোর সঙ্গী হবে বলে জানিয়েছিল। পোয়ারো কারো মনে ব্যথা দিতে চায়নি। তাই সকলে এসে জমা হয়েছে।
আমরা সকলে একজোট হয়ে বার্নাড়দের বাড়ি গেলাম। মিসেস বার্নাডের সঙ্গে তার নিহত মেয়ের সম্পর্কে আর একবার আলোচনা হলো।
এরপর আমরা গেলাম ইস্টবোর্নে। হোয়াইট ক্রস হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কাস্টের ব্যাপারে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। হোটেলের বেয়ারাও বাদ পড়লো না এই জেরার হাত থেকে। এবার আমরা এলাম ঘটনাস্থলে। যেখানে বেটির মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছিল। সমুদ্রের বালিয়াড়িতে কয়েকপাক ঘুরঘুর করে আমরা গাড়ির দিকে রওনা হলাম।
আমরাও নির্বাক পোয়ারোর পেছনে পেছনে ঘুরছি। এরকম হয়রানি করার কি মানে, সেটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাওয়ার আগে সে গিয়ে ঢুকলো জিঞ্জার ক্যাটে। সেখানে লিলি হিগলির সঙ্গে কথাবার্তা সেরে সে তার রসিকতা করতে বসলো। যেমন তার পায়ের সৌন্দর্য নিয়ে কত প্রশংসা করলো। মুহূর্তের মধ্যে তার ঠাট্টা-তামাশা ভরা মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠলো।
আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো–আমি একবার ইস্টবোর্নে যাবো। একাই যাবো। কাজ সেরে ফিরে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। আপনারা সবাই এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হোয়াইট ক্রসে চলে যাবেন। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
আমরা যখন হোয়াইট ক্রস হোটেলে ফিরে এলাম তখন বেলা দুটো বাজে। টেবিলের চারধারে বসলাম। বৈঠক শুরু হলো।
নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলে উঠলো ফ্রাঙ্কলিন–আচ্ছা, সকাল থেকে যে চক্কর মারা হলো, তাতে কি কোনো কাজ হলো?
-না সব বিফলে গেল। এখন আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। চুপ করে কেবল অপেক্ষা করতে হবে। এখন ওসব কথা বাদ দিন। আসুন, একটা খেলা খেলি।
-খেলা! আমরা সবাই অবাক হয়ে পোয়াটের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-হা, ছোটোবেলায় অনেকে মিলে আমরা এই খেলাটা খেলতাম। দলে একজন নেতা থাকতো। গোল হয়ে সকলে বসতাম। দলনেতা প্রত্যেকটি ছেলেকে বিভিন্নভাবে তিনটি করে প্রশ্ন করতো। এই খেলায় নিয়ম ছিল, তিনটে প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও জবাব দেওয়া চলবে না। প্রথম দুটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হত, কিন্তু শেষের প্রশ্নের জবাব ইচ্ছা না থাকলেও ভুল বলতে হত। যদি-বা কেউ মনে না থাকার দরুন সঠিক জবাব দিতো তাহলে সে ফল হিসাবে পেত এতবড় এক গোল্লা। অনেকক্ষণ ধরে এই খেলা চলতো। তারপর প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নাম যোগ-বিয়োগ করে দেখা হত। সে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে তাকে জয়ী বলে ঘোষণা করা হত। এই খেলার নাম কি জানেন? মহাসত্য। তবে আর একটা মজা ছিল। খেলায় যোগ দেওয়ার আগে খেলোয়াড়কে ঈশ্বরের নামে শপথ করতে হত, বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না কেউ।
শুরু হলো খেলা। খেলার উদ্বোধন করলো মেগান। সে শপথ করলো, সময় কম, তাই পোয়ারো বললো-এখানে তিনটে প্রশ্ন হবে না। হবে একটা প্রশ্ন। সকলকে ঐ একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে। এ ব্যাপারে কারো কোনো মন্তব্য থাকলে এ সময়ে বলতে পারেন।
সবাই ঘাড় নেড়ে জানালো, তাদের কারো কিছু বলার নেই।
-তাহলে আমার ইচ্ছা, পোয়ারো বললো, খেলাটা কোনো ছেলেকে দিয়েই শুরু করা হোক। প্রথমে জবাব দেবে ফ্রাঙ্কলিন। পোয়ারো প্রশ্ন করলো–ফ্রাঙ্কলিন, আপনি বলুন, অ্যাসকটের শীতপ্রধান অঞ্চলের মেয়েরা যে ধরনের টুপি পরে আপনি কি দেখেছেন?
–আসলে অ্যাসকটে তো কোনোদিন যাইনি।..তবে শহরের আশেপাশে যে সব মেয়েদের নজরে পড়েছে, তাদের টুপির চেহারা দেখেছি। বলা যায় প্রশংসনীয়, যেন একটা বুড়ি মাথার ওপর উল্টে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঝুড়িটা কপালের ওপর দিয়ে নাক পর্যন্ত নেমে এসেছে। আচমকা নজরে পড়লে মনে হয়, যেন একটা মস্ত টুপি অলস ভঙ্গীতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
-এবার মঁসিয়ে ফ্রেসার বলুন, এ বছরের ঠিক কোন সময় আপনি অফিসে ছুটি নিয়েছিলেন?
–আগস্ট মাসের পয়লা থেকে পনেরো তারিখ পর্যন্ত পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছিলাম।
এবার থরার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললো, আচ্ছা মাদমোয়াজেল, স্যার কারমাইকেলের জীবিত অবস্থায় যদি লেডি ক্লার্ক মারা যেতেন তাহলে আপনি তাকে বিয়ে… ।
-থামুন…আর একটা কথাও বলবেন না। উনি ছিলেন আমার কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। দেবতার মতো। ঐরকম ভদ্র, সজ্জন লোকের সম্পর্কে আপনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। আপনাকে আগেই জানিয়েছি, উনি আমাকে তার মেয়ের মতো স্নেহ করতেন।
মাদমোয়াজেল বার্নার্ড, মেগানকে প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আপনি কি আপনার বোনের হত্যা রহস্যের নিগুঢ় সত্যটি জানতে চান না?
মেগান ইচ্ছার বিরুদ্ধে জবাব দিলো, না, আমি জানতে আগ্রহী নই।
ওর জবাব শুনে ঘরের সকলে হতভম্ব হয়ে গেল।
তারপর মেরির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, তোমার মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে এতদিনে কি কিছু ঠিক করে উঠতে পারলে?
সে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে উত্তর দিলো, না, পারিনি।
পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
–আমাকে বিশেষ কাজে এখুনি বেরোতে হচ্ছে। কে কত নম্বর পেলো, সেটা পরে জানাবো। ভাবছি, আর একবার বেক্সহিলে টহল দিয়ে বাড়ি ফিরবো। আপনারা যে এতক্ষণ বসে আমাকে সহযোগিতা করলেন সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। হেস্টিংস, দেরি কোরো না চলো।
দ্রুত পায়ে পোয়ারোর পিছু পিছু রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
প্রশ্ন করলাম–পোয়ারো এই নিয়ে তিনবার তুমি বেক্সহিলে গেলে। কি ব্যাপার বলো তো?
-উঁহু…। দুবার।
–দুবার ঘুরে এসেছে, আবার যাচ্ছে। তাহলে তিনবার হলো না।
-না, এখন বেক্সহিলে যাচ্ছি না। ওখানে আর কাজ নেই। আসলে ওদের কাছ থেকে ঐ অছিলায় বেরিয়ে এলাম। নাও, আর কথা না বাড়িয়ে এগোও। কাস্টের সঙ্গে আলোচনাটা এই বেলা সেরে ফেলতে হবে। তারপর বাকি কাজগুলো সম্পূর্ণ করে পরে তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো।
আমাকে অপেক্ষা করতে বলে পোয়ারো চলে গেল কাস্টের সঙ্গে দেখা করতে। ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল এটা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। অবশ্য পোয়ারো ইচ্ছে করলে, তার প্রিয় বন্ধু হেস্টিংসকে সঙ্গে নিতে পারতো। কিন্তু তা করলো না–
কিছুক্ষণ পরে পোয়ারো ফিরে এলো। আলেকজান্ডার বোনাপার্ট কাস্টের সঙ্গে পোয়ারোর কি কথাবার্তা হয়েছে সব কিছু নিখুঁতভাবে আমাকে জানালো, সাক্ষাৎকারের সমস্ত ঘটনা যেন আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো। আমার মনে আর কোনো দুঃখ রইল না।
কয়েকদিনেই কাস্টের চেহারা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। বললাম, কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কাস্ট আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো–না। আমি আমার নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনিই তো আমাকে পরপর চারখানা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তখন তিনি আমাকে গোয়েন্দা হিসাবে চিনতে পারলেন ঠিকই কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললেন, আপনাকে আমি কখনো কোনো চিঠি লিখিনি।
–তাহলে কে কিঠিগুলো পাঠালো?
হবে আমার কোনো শত্রু। আমাকে বিপদে ফেলতে চায়, আমাকে হেনস্তা করা তার ইচ্ছা। আমার দুঃখকষ্ট দেখে আনন্দ পাবে বলে একাজ করেছে।…জানেন, আমার বিরুদ্ধে সবাই ষড়যন্ত্র করে, আমাকে ভালো নজরে কেউ দেখে না। তাই পুলিশ কোর্টের কেউ আমায় পছন্দ করে না। আমি যেন ওদের কাছে বিষ।..কিন্তু আমার জীবনের গোড়ার দিকে, যখন আমার মা বেঁচেছিল, তখন মায়ের স্নেহ-মমতায়, আদর-যত্নে, ভালোবাসায় আমার মন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।
আমিও আমার ভালোবাসা শ্রদ্ধা তাকে উজাড় করে দিতাম। আমাকে নিয়ে তার মনে অনেক স্বপ্ন ছিলো। বলতো, আমার একটি আঙুলের ইঙ্গিতে পৃথিবী অচল হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলেন মিঃ পোয়ারো, আমার মায়ের কোনো সাধ আমি পূর্ণ করতে পারিনি। তাই বুকভরা হতাশা নিয়ে একদিন তার কাছ থেকে চলে এলাম। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস, তারা যে যার ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কেউ তোয়াক্কা করে না। কেউ সেই স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারে না।…আমাকেই দেখুন না, আমার মায়ের স্বপ্ন কি আমি সার্থক করতে পেরেছি…পারিনি। সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে চাকরি জীবন পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। জানেন, সবাই আমাকে মূর্খ বলতো। পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে নিজকে সযত্নে আড়াল করে সেই অন্ধ অহঙ্কারের তাড়নায় সারাটা জীবন বোকার মতোই কেবল ছুটেই মরলাম।.অপদার্থ অপবাদ জীবনে ঘোচাতে পারলাম না।
-আপনি যখন যুদ্ধে গেলেন?
-হ্যাঁ, যুদ্ধ। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমাদের তখন একটাই পরিচয়, আমরা সৈন্য। জাত–পাত, মূর্খ-জ্ঞানীর কোনো আলাদা পরিচয় নেই। শত্রু সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কি অসহায়!…আমি সেখানে পেলাম বুকভরা আনন্দ।..তারপর সেই গুলি মাথার পেছনে ঢুকে গেলো।..ভয়ঙ্কর জখম। আরো নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।… থেকে থেকে মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতাম।…কি করতাম, না করতাম, কিছু মনে থাকতো না।…অবশেষে মোজা বিক্রি শুরু করলাম। শরীর না চললেও পেট তো মানবে না। তাই ঘুরে ঘুরে মোজা ফেরি করি।
-কোনো কোম্পানি নাকি আপনার নাম কখনও শোনেনি?
–এই কথা বলেছে? সব ব্যাটা শয়তান। সবুর করুন। আমিও মজা দেখিয়ে দেবো। যেদিন কোর্টে মামলা উঠবে, তাদের ছাপানো প্যাডে আমার নাম লেখা চিঠির বোঝা ম্যাজিস্ট্রেটের নাকের ডগায় ছুঁড়ে দেবো। তখন দেখবো ব্যাটারা কিভাবে অস্বীকার করে।
বললাম, চিঠি?
-হ্যাঁ, চাকরিতে যোগ দিতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে কোন শহরে যেতে হবে, সেসব নির্দেশ দেওয়া চিঠি–সবাইকে দেখিয়ে দেবো। টের পাবে সবাই।
-না, হাতে লেখা হবে কেন? বড় কোম্পানি, সব টাইপ করা চিঠি। তাদের তো টাইপ মেশিনের অভাব নেই।
-আপনার ঘর তল্লাশি করে একটা টাইপ মেশিন পাওয়া গেছে। আমি ইতস্তত করে বললাম।
হতে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাজের সুবিধার জন্য কোম্পানি মেশিনটা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। আমি আলমারিতে সেটা রেখে দিয়েছিলাম।
–কিন্তু আমি যদি বলি, আমাকে যে চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো ঐ টাইপ মেশিনে টাইপ করা হয়েছিল। আপনি কি সেটা উড়িয়ে দেবেন?
অবশ্যই। আমি যেটা করিনি সেই দোষ নিজের ঘাড়ে নেবো কেন? তাছাড়া আপনি কি করে জানলেন, চিঠিগুলো ঐ মেশিনে টাইপ করা হয়েছিল।
–না, অন্য মেশিনে নয়। তাছাড়া আপনার ঘর থেকে বেশ কয়েকখানা এ.বি.সি গাইড পাওয়া গেছে।
–আসল ব্যাপারটা কি জানেন, ওগুলো যে এ.বি.সি, গাইড সেটা আমি নিজেই জানতাম না। পিওন পার্শেলটা দিতে এসেছিল। ভাবলাম, কোনো কোম্পানি হয়তো মোজা পাঠিয়েছে। খুলে তো অবাক। ফেলে না দিয়ে সেগুলো আলমারিতে রেখে দিলাম।
আর ঐ যে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা নামের তালিকা। এক-একটি নামের পাশে পেন্সিল দিয়ে মার্ক করা হয়েছে, এর মানে কি?
এটা তো সোজা ব্যাপার। যেসব বাড়িতে ঘুরেছি, সেগুলো পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে রেখেছি।
–আপনার কথা আমি মানতে পারলাম না। যদি বলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দাগগুলো দিয়েছেন, এক-একটা খুনের পর
না, এসব সাজানো, সব মিথ্যে। আমাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য এ এক চক্রান্ত। আমি সেদিন রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ইস্টবোর্নের হোয়াইট ক্রমের বৈঠকখানায় বসে দাবা খেলেছি। …সেদিনর রেজিস্টারে আমার নাম সই করা আছে, তাছাড়া চব্বিশ তারিখ স্পষ্ট করে লেখা আছে।
-আপনি সেদিন দাবা খেলতে বসেছিলেন কেন? অন্য খেলাও তো খেলতে পারতেন। দাবা আপনি ভালো খেলেন বুঝি?
ভালো-মন্দ জানি না। তবে খেলতে বসলে কোনো হুঁশ থাকে না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনই নেশা। সেদিনের একটা ঘটনার কথা বলি, সেটা ছিল দ্বিতীয় বাজি। চুপচাপ খেলছি। তার আগের বাজিতে আমি জিতেছি। দ্বিতীয় বাজিতে স্ট্রেঞ্চকে প্রায় ঘায়েল করে এনেছি, এমন সময় দর্শকদের মধ্যে একজন আমার হাত টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করলো। আমার সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন করলো, কি চাকরি করি, কত আয় ইত্যাদি। শেষে বললো, মরার আগে আমার নাম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এক ডাকে সকলে আমাকে চিনবে। আরো বললো, ফাঁসিতেই নাকি আমার মৃত্যু।
কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার মুখ কুঁকড়ে উঠলো। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠলো–কি যন্ত্রণা…এক বিরাট শূন্যতা।
আমি সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন, আপনি খুন করেন নি? কেন করেছেন? আপনার কি উদ্দেশ্য
মুখ বিকৃত করে বললো–জানি না, আমি খুন করিনি। কেন খুন করেছি, সেটাও আমার অজানা।
কাস্টের সঙ্গে পোয়ারোর কথোপকথন আমরা সকলে মন দিয়ে শুনলাম। এবার পোয়ারো আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে, কিভাবে সঠিক সমাধানে সে উপনীত হলো।
বিবৃতি শুরু করলো পোয়ারো–যেদিন থেকে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকে অর্থাৎ গত কয়েক মাস ধরে আমি কেবল মনের মধ্যে একটি খোঁচা অনুভব করতাম, কেন এই খুন?… তাছাড়া খুনীর আসল পরিচয় কি, সেটাও আর একটি বড় প্রশ্ন। আপনারা হয়তো বলবেন, লোকটি উন্মাদ, অপ্রকৃতিস্থ, কার্যকারণ সম্পর্কে মাথা ঘামাবার মতো শক্তি তার নেই। কিন্তু আমি বলবো, ঠিক এর উল্টো। একজন সুস্থ মানুষ যতখানি যুক্তিবাদী হয়ে থাকে। একজন পাগলও ভেতরে ভেতরে ততখানি হয়। আমাদের তার দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতে হবে। তবেই আমরা সেই যুক্তির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারব। নতুবা প্রতিটি কাজ আমাদের সৃষ্টিছাড়া…আমাদের অপরাধীটি এক বিচিত্র মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। একদিকে যেমন যুক্তিবাদী তেমনি যুক্তিহীন, নিয়মমাফিক এবং নিয়মছাড়া। পরম বিবেচকের মতো সে যেমন প্রতিটি খুনের আগে চিঠি দিয়ে এরকুল পোয়ারোকে সতর্ক করেছে। তেমনি নিজের খেয়ালে একটা একটা করে চারটে খুন করতে পেরেছে।…আসলে লোকটির মনে দ্বি-মানসিকতা বাসা বেঁধে আছে। রহস্যের সমাধানে এটাই জটিলতা সৃষ্টি করেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, একই মানুষের মধ্যে এত বিরোধিতা থাকতে পারে। তাই প্রথম চিঠি পেয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম এর মধ্যে কোনো গোলমাল আছে…। কিন্তু মিসেস এ্যাম্বার-এরপর থেকে যে খুনগুলো হলো সেখানে আমি মাথা ঘামালাম না যে কে খুনী। তার স্বরূপ কি, খুনের অন্তরালে তার মোটিভই-বা কি?..কিন্তু ধীরে ধীরে আমার হাতে কিছু কিছু সূত্র এসে পড়তে লাগলো।
শুধু নিজের নাম জাহির করা যে খুনীর উদ্দেশ্য তা মোটেও নয়। তাহলে সংবাদপত্র অফিস বসে থাকতো না। এরকম কয়েকটা চিঠি পেলে তারা নিশ্চয়ই ছাপাতো। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটা পাওয়ার পর অর্থাৎ মিস বার্নার্ডের মৃত্যু রহস্য আমাদের এক নতুন তথ্যের সন্ধান দিলো। অবশ্য কিছু করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আবিষ্কার করলাম বর্ণমালার অক্ষর ধরে একের পর এক খুন অনুষ্ঠিত হবে। ততদিনে নতুন আর একটি প্রশ্ন উদয় হলো–কেন এ.বি.সি. এমন নারকীয় হতা চালিয়ে যাচ্ছে? সে কি কেবল খুন করার তাগিদেই এমন বীভৎস কাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে? প্রশ্নে প্রশ্নে আমার মন জর্জরিত হয়ে উঠলো। কে যেন আমাকে বার বার বললো, পোয়ারো খুনীকে জানার চেষ্টা করো। কেন শুধু শুধু তার রহস্যের টানাপোড়েনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছো? কেবল একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, খুনী তার ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু করতে পারে তাতেই সে সন্তুষ্ট, সে খুশী।…এ.বি.সি. গাইড আমরা প্রত্যেকটা খুনের জায়গায় পেয়েছি। তাতে ভাবলাম, খুনীর হয়তো ভ্রমণের নেশা আছে। আর একটা করে গাইড নিহত ব্যক্তির পাশে ফেলে আসা হয়তো তার মনোবিকারের একটা পর্যায়। বেটির মৃত্যুর বর্ণনা আমি মেগানের কাছ থেকে পাবার পর মনে মনে একটা ছবি এঁকে ফেলেছি। এ.বি.সি. এবং বেটি–দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। সামনে নীলসমুদ্র। বালিয়াড়ির উপর জলরাশি উপরে পড়ছে। রাতের আকাশ মাথার ওপরে, নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। রাতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দুজনেই আনমনা হয়ে উঠেছে। এ.বি.সি.-র ওপর বেটি তার শরীর হেলিয়ে দিয়েছে। বেটির চুল নিয়ে আদর করছে এ.বি.সি.। কি একান্ত সেই ক্ষণ? বেটি আদরে আদরে জর্জরিত, ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার দুটি চোখ। এ.বি.সি.-র হাত ততক্ষণে চলে এসেছে আরো নিচে। তার আঙুল খেলা করে বেড়াচ্ছে বেটির মুখে, নামে, গলায়। খেলতে খেলতে খেলার ছলে সেই আদরভরা হাতখানাই খুলে নিলো তার কোমরের বেল্ট। হাতের মালিক বেটিকে বললো, যদি এই মুহূর্তে তোমাকে খুন করি। বেটি নীরব। চোখ বন্ধ। বেল্টটা জড়িয়ে ধরলো বেটির গলা। বেটি শান্তভাবে বললো, খুন করবে? করো না। আর অপেক্ষা না করে এ.বি.সি. একটু একটু করে টেনে দিলো বেটির গলার বেল্ট।
…এবার স্যার কারমাইকেলের প্রসঙ্গে আসছি। ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথা থেতলে দেওয়া হয়েছিল। জেরা-টেরার পর একটা নতুন প্রশ্ন সংযোজিত হলো–বর্ণমালার নিয়ম মেনে খুনী ঠিক এ.বি.সি. করে এগোচ্ছে, তখন সি.-র ঘরে একশো তিপান্ন অথবা পঞ্চান্ন অথবা সাতান্ন নম্বরে থাকা কাস্টন। অতএব আমি প্রায় পনেরো মিনিট ধরে নাজেহাল হয়ে গাইড বুক ঘাঁটলাম। কিন্তু খোঁজাই সার। নম্বরের ব্যাপারে মিলের নাম গন্ধও নেই। এই তফাত কেন? নিয়মনিষ্ঠ ব্যক্তির এমন অনিয়ম হওয়ার তো কথা নয়। তারপরেই এলো চতুর্থ চিঠি। এবারে খুনের জায়গা ডন্ কাস্টার। কিন্তু ভুল হলো একটা জায়গায়। বর্ণমালার চার নম্বর অক্ষরের খুন হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ নম্বর অক্ষর সেই জায়গায় চলে এলো। অবশেষে বিবেকের দংশনে তাড়িত হয়ে হত্যাকারী স্বয়ং এসে ধরা দিলো। বাকি সমস্যা সমাধানের অবশিষ্ট রইলো আদালতের রায়। আমি কিন্তু এখনও খুশী নই। শুনে অবাক হচ্ছেন তাই তো? কারণ দুঃখ রয়ে গেল একটাই, কেন-র জবাব এখনও আমার অজানা রয়ে গেল। আর একটা ব্যাপার, বেহিলের খুনের ব্যাপারে আসামী যে মিথ্যে উত্তর খাড়া করেছে, সেটা আজও আমার কাছে অন্ধকারের মতো কালো হয়ে আছে।
…যদি ধরি চারটি খুনের মধ্যে তিনটি খুন করেছে কাস্ট। দুনম্বর খুনটা করেছে অন্য কেউ… যার সঙ্গে বেটি বার্নার্ড সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কারণ কথা যে গুছিয়ে বলতে পারে না, এমন একটা লোকের পক্ষে রাত বারোটার পর প্রেম নিবেদনের অছিলায় বেটি বার্নার্ডকে নিয়ে গেছে সমুদ্রের ধারে…ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। যদিও বা সে অন্য ব্যক্তি হয় তাহলে খুনটা বেশ নিয়ম মেনেই করেছে, কে সেটা জানতে হবে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি আমার দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে হাজির হলাম, যে দ্বিতীয় খুনটি করেছে সে অন্য কেউ এবং বেটি বার্নার্ডের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, ঠিক তিনটে খুনের জন্য সেই লোকটাই দায়ী।
-না না, এ অসম্ভব। ফ্রাঙ্কলিন জোরালো প্রতিবাদ করে উঠলো, এটা কোনো যুক্তি নয়।
–এটাই যুক্তি। এরকুল পোয়ারোর কোনো সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নয়। এই সিদ্ধান্তকে ভালো করে যাচাই করে নেওয়ার জন্য আমি চিঠি দুখানা আবার ভালো করে পড়লাম। চিঠি পড়ে বুঝলাম, চিঠির লেখক এ.বি.সি. সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক। পাগলও নয়, মাথা খারাপও নয়। আসলে সে আমাদের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর জন্য পাগলের ভান করছে। তাহলে এমন চিঠি লেখার উদ্দেশ্য কি তার? হঠাৎ মনে হলো, একাধিক খুন করে আমার বা আমাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরাতে চেয়েছিল।…তাহলে এবার দেখা যাক, প্রথমে আলাদাভাবে, তারপর একই সঙ্গে চারটি খুনের জন্য মৃত বা মৃতার আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক। যদি এ্যান্ডোভারের মিসেস এ্যাম্বারকে দিয়ে শুরু করি তাহলে সেখানে তার স্বামী…কিন্তু অন্য খুনের ব্যাপারে তাকে দোষারোপ করা যায় না। বেক্সহিলের ঘটনাতে বেটি বার্নার্ডের হত্যার জন্য দায়ী করা যায় মঁসিয়ে ফ্রেসারকে তাহলে বাকি খুনের ব্যাপারে হিসেব গরমিল হয়ে যায়।..আবার ধরা যাক, স্যার কারমাইকেলের খুন করা হয়েছে প্রচুর সম্পত্তির লোভে, উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে যদি মঁসিয়ে ফ্রাঙ্কলিনকে খুনী ধরা হয় তাহলে হঠাৎ মনে হয়, এই ফ্রাঙ্কলিন ক্লার্ক এবং এ.বি.সি, এক ও অভিন্ন।
ফ্রাঙ্কলিন রেগে গিয়ে বলে উঠলো, কাস্ট নিশ্চয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো স্বীকার করেনি?
-না, সে সব স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু তার জবানবন্দী লক্ষ্য করে হিসেব করতে গিয়ে দেখি গরমিল হয়ে যাচ্ছে। তার সব কথা শুনে, তাকে দেখে আমার মনে হলো, সে আসল অপরাধী নয়। লোকে তাকে খুনী বলে অভিহিত করার চেষ্টা করছে।
…কিন্তু মঁসিয়ে ফ্রাঙ্কলিন, আপনার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। কূলে এসে তরী ডুবলো। আপনি আপনার দাদার সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার জন্য তাকে খুন করলেন। আপনি আমাকে একটা চিঠি দেখিয়েছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই…যেটি আপনার দাদা আপনাকে লিখেছিলেন। সেই চিঠি পড়ে আপনার মনে আশঙ্কা জাগলো। মিস গ্রে-কে আপনার দাদা স্নেহ করতেন। যদি সেটা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় পরিণত হয় এবং যদি দুজনে বিয়ে করে। ভবিষ্যতে তাদের সন্তান হবে। তাহলে সে-ই সন্তান হবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। অতএব ভালো-মন্দ বিচার না করে আপনার দাদাকে আপনি খুন করবেন। আর এই একটি কারণকে উপলক্ষ্য করে আপনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কি করে সব বাস্তবায়িত করা যায় যখন ভাবছেন তখন একদিন কাস্টের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে গেল। ভাগ্য আপনার সুপ্রসন্ন ছিল।
…তার মাথা যন্ত্রণা, শারীরিক অসুস্থতা, এ.বি.সি. বর্ণানুক্রমিক খুনের পরিকল্পনা সব মিলিয়ে আপনি হিসেব করে দেখলেন কাস্ট এবং আপনার দাদার আদ্যাক্ষর সি। তারপরেই আপনি রণক্ষেত্রে নেমে পড়লেন। শহরের নামকরা কোম্পানির নামে প্যাড ছাপালেন যেগুলো ভুয়ো। ভুয়ো নিয়োগপত্র পাঠালেন কাস্টের কাছে। যেখানে আপনি মোটা মাইনে এবং কমিশনের টোপ দিয়েছেন। কোনো এজেন্টের কাছ থেকে সস্তায় কিনে নিয়ে এলেন মোজা এবং সেই মোজা নিজের খরচায় পার্শেল করে পাঠিয়ে দিলেন কাস্টের কাছে। সেই সঙ্গে রেজিস্ট্রি ডাকে এ.বি.সি. গাইড পাঠাতে ভুললেন না। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ এখানেই শেষ। এবার আপনার কাজ হলো শিকার খুঁজে বেড়ানো। একদিন মিসেস এ্যাম্বারের দোকানের সাইন বোর্ডে স্বত্বাধিকারীর নাম এবং ঘটনাস্থলের খুঁটিনাটি সব জেনে ফিরে এলেন বাড়িতে।…দ্বিতীয় শিকার বেটি বার্নার্ড, যে পুরুষ সঙ্গ পেতে পছন্দ করে। তার সঙ্গে পরিচয় হলো এবং ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। প্রথম দুটি খুন করে আপনি যখন সম্পূর্ণ ফল লাভ করলেন তখন বাকিটুকু করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে পড়লেন। এ্যান্ডোভারের কয়েকটি বাড়ির পরিবারের নামের একটা তালিকা করে কাস্টকে পাঠালেন। কাস্টকে নির্দেশ দিলেন সে যেন তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকটি পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এর উদ্দেশ্য হলো, খুনের দিন কাস্ট যে এ্যান্ডোভারে ছিল এটা তার প্রমাণ। একইভাবে আমাকে চিঠি দিয়ে খুনের তারিখ এবং জায়গা জানালেন। আপনি মিসেস এ্যাম্বারের দোকানে গিয়ে সিগারেট চাইতে সে পিছন ঘোরে। আপনি সময় নষ্ট না করে তাকে আঘাত করে বসলেন। এরপর বেক্সহিল, নির্দিষ্ট তারিখের একেবারে দিনের প্রারম্ভে সেখানে কাজটা হাসিল করলেন। সেটা চব্বিশ তারিখ হলেও কাগজে কলমে সেটা হবে পঁচিশ।
…এবার তৃতীয় খুন অর্থাৎ আপনার দাদার পালা। আপনি এক্ষেত্রে একটু চালাকির আশ্রয় নিলেন। চিঠিটা যাতে আমি দেরিতে পাই তার ব্যবস্থা করলেন।…আপনি আমাকে কেন চিঠি পাঠান? এর জবাব খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করলাম, দুটি কারণে আপনি আমাকে চিঠি পাঠান। প্রথমত, আমাকে এবং গোয়েন্দা দপ্তরকে এ.বি.সি. রহস্য সম্বন্ধে সচেতন করতে। দ্বিতীয়ত, আমার নামকে মূলধন করে তার এক অদ্ভুত মনোবাসনা পূরণ করতে…এখানে আপনি যদি আপনার পরিকল্পনামাফিক খুন না করেন তাহলে আপনাকে সন্দেহ করা যেতে পারে। তাই কায়দা করে আপনি ঠিকানা ভুল করে চিঠি দেরি করে পাঠালেন। ততক্ষণে আপনি আপনার কর্ম সমাধা করে ফেলবেন। এই তিন নম্বর হত্যা সম্পূর্ণ করার পর আলোচনা থেকে আপনি বুঝতে পারলেন, সন্দেহের ঊর্ধ্বে আপনি আছেন। দেখলেন, পুলিশ আর বসে নেই। জোর কদমে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আপনি তাই নিয়মের ব্যতিক্রম করে চার নম্বর অক্ষরের পরিবর্তে পাঁচ নম্বরকে বেছে নিলেন শিকার হিসেবে।
…এরপর আমরা সদলবলে ডন কাস্টারে গিয়ে হাজির হলাম। আপনিই এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। এদিকে অপনার নির্দেশমতো কাস্টও সেখানে এসে হাজির। সে এখানে কোথায় থাকবে সেটা আপনার আগেই জানা ছিলো। সেদিন আপনার একটা উদ্দেশ্য ছিল যেভাবে হোক খুন করতেই হবে এবং কাস্টকে সেই খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। কাস্ট সিনেমা হলে ঢুকতে আপনিও তার পেছন পেছন ঢুকে পড়লেন। ইচ্ছে করে মাথা থেকে টুপিটা ফেলে দিলেন এবং খোঁজার অছিলায় সামনের সারির দিকে ঝুঁকে পড়ে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাস, কাজ শেষ।
…কাগজে কাগজে খবরগুলো প্রকাশিত হলো। কাস্টের নজর এড়ালো না। সে মনে করেছিল যেহেতু তিনটি খুনের ক্ষেত্রে সে ঐসব ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, তাই লোকে তাকে খুনী মনে করছে। অনেক সময় দেখা গেছে, দুর্বল মানুষ নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। এমন সময়ে তার কাছে চতুর্থ নির্দেশ এলো ড কাস্টারে যাওয়ার। সে কিছু বুঝতে না পেরে ইচ্ছাকৃতভাবে বেরোনোর সময় সে মিথ্যে কথা বললো মিসেস মার্থারিকে, যে সে বেলতেন হ্যাঁমে যাচ্ছে।
…তারপর ডন কাস্টারের কাজ শেষ করে সিনেমা হল থেকে ফিরে যখন নিজের জামার আস্তিনে রক্ত ও পকেটে ছুরি দেখে তখন তার সমস্ত চিন্তাভাবনা সত্য বলে মনে হলো। তখন তার কেবল একটাই কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, আগের তিনটি মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী।…হতাশা, ভয়ে সে কুঁকড়ে উঠলো। সে পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো। একটু শান্তির আশায় সে ক্যামডেনের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দী করলো। ভাবলো একটু স্বস্তি পেলো। ক-দিন ঘর থেকে বাইরে বেরোলো না। কেবল একই চিন্তায় ডুবে রইলো। ছুরিটা আলনার পেছনে লুকিয়ে রাখলো, তবু কি শান্তিতে থাকতে পারছে? এমনই যখন উথালপাথাল অবস্থা তখনই ভগবানের নির্দেশের মতো ফোনে কে যেন বললো, পালিয়ে যেতে। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো পথে। কিন্তু কোথায় যাবে? তখন খেয়াল হলো, থানার উঠোনে এসে হাজির হয়েছে। অজানা আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে লাগলো, জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পড়ে গেলো।
…তাকে থানায় প্রথম দিন দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, এই লোকের পক্ষে খুন করা সম্ভব নয়, আততায়ী হতে পারে না। অবশ্য সে নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে চারটি খুনের নায়ক সে নিজে। কিন্তু ওর স্বীকারোক্তি থেকে আমার যুক্তির বুনিয়াদ আরো মজবুত হলো।…
-ভারি তো যুক্তি, তার আবার বুনিয়াদ। ফ্রাঙ্কলিন তাচ্ছিল্যভাবে বললো।
–এ্যান্ডোভার এবং কার্স্টনের খুনের জন্য যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি আমি বাইরের ঘরের আলমারিতে দেখেছি, যেদিন লেডি ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।…আর সেদিন সিনেমা হলের দারোয়ান থেকে শুরু করে টিকিট চেকার–সবাই আপনাকে ছবি শেষ হওয়ার প্রায় দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। বেক্সহিলের মিলি হিগলি জিঞ্জার ক্যাটে বেটির সঙ্গে যাকে কথা বলতে দেখেছিল, সে আপনি স্বয়ং।…আর কাস্টের কাছে পাঠানো টাইপ রাইটার মেশিনে কম করে দশটা চাবিতে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, আপনিই জিতলেন। এই বলে ফ্রাঙ্কলিন নিজের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে নিজের কপাল লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপলো। কিন্তু রিভলবার থেকে কোনো গুলি বেরোলো না।
পোয়ারো হেসে উঠলো।
-মঁসিয়ে ফ্রাঙ্কলিন, আপনার হাতে ঐ যন্ত্র আর কাজ করবে না। আমার নতুন কাজের ছেলেটি সুযোগ বুঝে আগেই আপনার পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে গুলি বের করে রেখেছে।
ফ্রাঙ্কলিনের আর কিছু করার নেই। সে রাগে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। পোয়ারোকে গালমন্দ করতে লাগলো।
পোয়ারো হাসতে হাসতে বললো, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন, নিজের মনকে কখনও ভুলেও ছোটো ভাববেন না।
পাশের ঘর থেকে ক্রোম, জ্যাক এসে ঢুকলো। ফ্রাঙ্কলিন লজ্জা অবনত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে চলে গেল।
ঘরে নেমে এলো এক চরম নিস্তব্ধতা। একসময় মেগানের ফিসফিসানি শোনা গেল:..এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। বিশ্বাস হয় না। কিন্তু
–সব জানি আমি, মাদমোয়াজেল, আপনার মনের আশঙ্কাটা নিতান্তই অমূলক। মঁসিয়ে ফ্রেসার আর যাই করুক খুন করার মতো মানসিকতা তার নেই।
–তাহলে রাতের পর রাত আমি সেই স্বপ্নটা–ফ্রেসার বলে উঠলো।
–আসলে এটা একটা হৃদয় বদলের ব্যাপার। পোয়ারো ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগলো। বেটি বার্নার্ডের মৃত্যুর পর সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর দিদি মেগান। তবে এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আপনারা কেউ কাছাকাছি হতে পারেননি। সেগুলো স্বপ্নের আকারে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে মঁসিয়ে ফ্রেসার, আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, বেটি বার্নার্ডের পরিবর্তে যাকে আপনি আপনার মনের অন্তঃস্থলে স্থান দিয়েছেন তার সহযোগিতা আপনি সবসময় পাবেন, এটা আমার ধারণা।
লজ্জায় মেগান ও ফ্রেসারের মুখ রাঙা হয়ে উঠলো।
এবার সুযোগ বুঝে আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা পোয়ারো, সেদিন ইস্টবোনের হোটেলে বসে এমন অদ্ভুত খেলা খেললে কেন?
–আমি প্রত্যেককে প্রশ্ন করার মাধ্যমে মাদমোয়াজেল গ্রে-র উত্তরের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলোম। এই ফাঁকে মঁসিয়ে ফ্রাঙ্কলিনের মনের ইচ্ছা বুঝে নেওয়া যাবে। এটাই ছিল আমার প্রধান উদ্দেশ্য।
-সত্যি, আপনি সেদিন কি প্রশ্নটাই না করেছিলেন..থরা মিস্টি রেগে পোয়ারোকে বলল।
–হ্যাঁ, আপনিও সঠিক জবাব দেননি।
-টাইপ মেশিনের বোতামে যে আঙুলের ছাপের কথা বললে, আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম।
–এই কথাটা কেন বলেছিলাম জানো? তোমার মনকে সন্তুষ্ট করার জন্য। আসলে সমস্ত মেশিন খুঁজেও কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।
এরপর চারদিন কেটে গেল।
–এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত? কাস্ট সরাসরি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি যে কাগজের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন…আমার জীবনী ও ইতিহাস তারা ছাপবে…বিনিময়ে আমি পাবো একশো পাউন্ড…বলুন তো, আমার কি করা ঠিক?
আপনি ওদেরকে জানিয়ে দিন যে আপনার জীবনী কাগজে প্রকাশ করতে হলে পাঁচশো পাউন্ড আপনাকে দিতে হবে। এর একটা পয়সা কম হলে আপনি রাজি হবেন না। আপনার মতো এমন বিখ্যাত মানুষ সারা ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় কেউ নেই।
আনন্দে কাস্টের চোখে জল এসে গেল–হ্যাঁ, আজ যদি আমার মা জীবিত থাকতেন..আর হ্যাঁ, লিলির মতো মেয়ে হয় না। এই বিয়ের যৌতুক হিসাবে ওকে আমি একটা আংটি উপহার দেবো।
-খুব ভালো হবে। তবে নিজের চোখের চিকিৎসার কথা ভুলবেন না। এতে আপনার মাথার যন্ত্রণা কিছুটা কমতে পারে।
-মনে থাকবে।
তারপর কাস্টের থেকে বিদায় নিলাম।
পোয়ারো বললো, ভবিষ্যতে কোনোদিন আমাদের হয়তো দেখা হবে, আজ আসি। আমরা সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলাম।