এখানে সত্যিই কি কোনো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে মিসেস অলিভারের বিশ্বাস মতো? আমার বিশ্বাস মতো, ঠিক সেটাই। কিন্তু সেই অঘটন কি ধরনের? এমন কে আছে এখানে যে এব্যাপারে আমাকে একটু ইঙ্গিত দিতে পারে? আমি ভালোভাবেই জানতে চাই এই বাড়ির লোকজনদের। এখানে কে কে আছে যারা আমাকে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর দিতে পারে? পোয়ারো মাথায় টুপি চাপিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল কথাটা তার মনে প্রতিফলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। মাস্টারটনের গাঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে ঠিক সেই সময়েই, সামান্য তফাৎ থেকে। স্যার জর্জের প্রেমাদ্ভুত উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল অনতিদূরে।
জর্জ বলছে, শোন শেলি, ওসব লুকোচুরি খেলার কথা ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে আনতে চাই আমার হারেমে অর্থাৎ অন্তঃপুরে। আগামীকাল আসব আমি। ভাগ্য গণনা করব।
কি বললে আমাকে তুমি? অভিনয়ের ভান করে বলল শেলি।
এগিয়ে আসতে শুনলো ওদের পায়ের শব্দ পোয়ারো, সুবিধামতো পাশের দরজার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। ততক্ষণে তার বোঝা হয়ে গেছে স্যার জর্জ এবং মিসেস মাস্টারটনের গোপন সম্পর্কের কথা।
মিসেস অলিভারের আশঙ্কা যদি অবশ্য সত্যে পরিণত হয়, তবে এটা একটা আগাম ক্ল, সফল হল তার কৌশলী অভিযান। পোয়ারো এসে দাঁড়াল মিসেস ফোলিয়াট-এর পাশে একটা খুশীর আমেজ নিয়ে। যেন তার হাতের ঝুড়িটা নিতে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিমা করে বলল সে, ম্যাডাম, যদি অনুমতি দেন…।
মঁসিয়ে পোয়ারো ধন্যবাদ, এটা কিন্তু বেশি ভারী নয়।
আপনার বাড়িতে এটা পৌঁছে দিই না কেন? প্রশ্ন করল পোয়ারো। কাছাকাছি থাকেন নাকি আপনি?
আমি থাকি সামনের গেটে পাশের লজ-এ। আমাকে অনুগ্রহ করে ভাড়া দিয়েছেন স্যার জর্জ বলল, মিসেস ফোলিয়াট।
পোয়ারো অন্য প্রসঙ্গে গেল, লেডি স্টাবস অনেক কমবয়সী তার স্বামীর থেকে তাই না?
হ্যাঁ, প্রায় তেইশ বছরের ছোট হবে, বললো মিসেস ফোলিয়াট। হ্যাটি বড় ভালো মেয়ে।
পোয়ারো এরকম একটা জবাব আশা করেনি। বলতে লাগলো মিসেস ফোলিয়াট, খুব ভালো করেই ওকে আমি জানি। ও কিছুদিন আমার কাছে যত্নেই ছিল। সেটা খুব করুণ কাহিনী। ওর অভিভাবকের এস্টেট ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। চিনির এস্টেট। সেখানে একবার দারুণ ভূমিকম্প হয়। তার ফলে শুধু ওদের ঘরবাড়িই ধ্বংস হয়নি। তখন ও ওর বাবা-মা ভাই-বোনদের হারায়। প্যারিসের একটা কনভেন্টে হ্যাটি তখন পড়াশোনা করত। হঠাৎ সে স্বজনবিহীন হয়ে পড়ে। তাকে পরামর্শ দেয় তার এক্সিকিউটররা। বিদেশে কিছুদিন কাটাবার পর সেখানে ফিরলে, তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় সেখানকার সমাজের কাছে। আমি তখন রাজী হয়ে যাই ওর দায়িত্ব নিতে। শুষ্ক হাসি হেসে মিসেস ফোলিয়াট আবার বলল, নিজেকে আমি প্রয়োজন হলে স্মার্ট করে তুলতে পারি। আমার যোগাযোগও ছিল বেশ কয়েকজন লোকের সঙ্গে প্রাক্তন গভর্নর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তোমার কাছে আমি সত্যি কথাই বলছি।
পোয়ারো বলল,-ম্যাডাম, সেটাই তো খুব স্বাভাবিক, কারণ আমার বোধশক্তি আছে।
মানিয়ে নিয়েছিলাম বেশ ভালোভাবেই তবে খুব কষ্টের মধ্যে সময় কাটছিল। আমার স্বামী মারা যান যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। নেভিতে যোগদান করে আমার বড় ছেলে, সে তার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দেয়। কেনিয়া থেকে ফিরে ছোট ছেলে কমান্ডের সঙ্গে যোগ দেয়, তারপর ইতালিতে সে খুন হয়। তার ফলে এই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে হয়, এতগুলো মৃত্যুর ডেথ–ডিউটি দিতে গিয়ে। আমার তখন আর্থিক অবস্থা সংকটময় ছিল। আমার খুব প্রিয় ছিলো হ্যাটি। বেশ কিছুদিন যেতে না যেতেই, আমি বুঝতে পারলাম, হ্যাটির কোনো দৃঢ়তা নেই। মঁসিয়ে পোয়ারো বুঝলেন, তার কোনো অক্ষমতা ছিল না মানসিক দিক থেকে, অর্থাৎ সে সহজ সরল প্রকৃতির মেয়ে, গ্রাম্য মানুষেরা এরকমই বলে থাকে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভাবলাম টাকা না থাকাটা। যদি সে তার বাবার অগাধ সম্পত্তির অধিকারিণী হত তাহলে অনেক অসুবিধা হত। সে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয়। তার দিকে অবশ্যই যে কোনো পুরুষ নজর দিতে পারে। হ্যাটি সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করার পর দেখা যায়, আখের খেত খামার (যা থেকে চিনি তৈরি হত) নষ্ট হয়ে গেছে, তার দেনাই বেশি হয়ে গেছে কোম্পানির আয়ের থেকে। তার প্রেমে পড়ে যায় স্যার জর্জ আর তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়, এজন্যই তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
পোয়ারো বলল, যথাসম্ভব, নিশ্চয়ই এটা একটা সমাধান।
মিসেস ফোলিয়াট বলল, স্যার জর্জ, বিত্তবান এবং ভদ্রলোক অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক। তাদের দুজনের বয়েসের যে বিরাট পার্থক্য, তাতে সে তার স্ত্রীর কাছ থেকে দেহ মনের মিলন চাইবে এটা আমার মনে হয় না। ওদিকে হ্যাটি দারুণ খুশী তাকে স্বামী হিসাবে পেয়ে, কারণ পোশাকের প্রাচুর্য্য, খুশীমতো অলঙ্কার সব সে পেয়ে যাচ্ছিল, আর সে তো এইরকমই চেয়েছিল। আমি খুব খুশী যেহেতু সে তার মনের মতো স্বামী হিসাবে জর্জ স্টাবসকে পেয়েছে, এটা আজ আমি স্বীকার করছি।
যদি স্বামী বয়স্ক বলে হ্যাটি সুখী না হতো, তবে তার দুঃখের সীমা থাকত না, আমার এই আশঙ্কা ছিলো। আপনাকে আমি আগেই বলেছি, ওর মতো সুখী, আর কে আছে পৃথিবীতে, সেটা এখন বুঝতে পারছি।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, আপনি উপযুক্ত ব্যবস্থা করেছিলেন মেয়েটির জন্য আমারও তাই মনে হচ্ছে। ঠিক ইংলিশ রোমান্টিকের মতো বলছি না, বিয়ের ভালো ব্যবস্থা করতে হলে, সকলকে রোমান্স-এর থেকে অন্য আরো কিছু ভেবে দেখতে হবে। অত্যন্ত সুন্দর জায়গা এই ন্যাসে হাউস।
তাই তো! আমি খুব খুশী স্যার জর্জ এই বাড়িটা কেনাতে। বলল মিসেস ফোলিয়াট, থামল একটু, আবার বলল, তাদের জমি বাড়ি বিক্রি করে চলে যায় আমাদের প্রতিবেশী ফ্রেবারসরা। সেখানে এখন একটা ইয়ুথ হোস্টেল তৈরি হয়েছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে স্কুলের ছেলেমেয়েদের।
তরুণ যুবক-যুবতীরা না আমাদের এখানে প্রবেশ করে আমাদের শান্তি নষ্ট করে ফেলে, এটাই আমার ভয়। ওদের এখানে ঢুকতে দেখলে স্যার জর্জ ভীষণ রেগে যায়। যদিও তারা এখানে ঢুকে বাগানের গাছপালা নষ্ট করে। তবুও একথা ঠিক যে, ওরা আসে ফেরি ধরার জন্য নদীর পথ সংক্ষিপ্ত করতে।
তারা এসে পড়েছিল মিসেস ফোলিয়াটের লজ-এর সামনে কথা বলতে বলতে। সাদা ছোট এভনো বাড়ি। তার হাত থেকে বাস্কেটটা ফিরিয়ে নিয়ে মিসেস ফোলিয়াট ধন্যবাদ জানালো। দুঃখ করে মিসেস ফোলিয়াট বললেন চলে আসার সময় আমরা এখন একজন যুবককে পেয়েছি প্রধান মালী হিসাবে, তার স্ত্রী যুবতী, আর নিশ্চয়ই ইলেকট্রিক আয়রন, আধুনিক কুকার আর টিভি আছে এই যুবতী মেয়েটির…সবাই সময়ের সঙ্গে তাল রেখেই চলে..সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখানে পুরনো দিনের এস্টেটের আগেকার খুব কম লোকই আছে এখন…সব নতুন মুখ এখানে।
পোয়ারো বলল, ম্যাডাম, আমি খুব খুশী। আপনি অবশেষে এখানে আপনার হাতে স্বর্গ পেয়েছেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো এই পৃথিবী দয়ামায়াহীন আর এই পৃথিবীর লোকগুলো তার থেকেও বেশি খারাপ। আমি এসব কথা বলতে চাই না, কারণ তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলবে। তবুও এটাই সত্যি এই পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর এবং খারাপ।…মিসেস ফোলিয়াট তার লজে ঢুকে পড়ল পোয়ারোকে বিদায় জানিয়ে। তার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো তখন দাঁড়িয়ে রইল।
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল এরকুল পোয়ারো কেতাদুরস্তভাবে। সে টয়লেট সেরে এসেছিল তার আগে বেশ ছিমছাম হয়ে। সে মনে রেখেছিল গোঁফে সুগন্ধী পমেও লাগাতে হবে। খুশী হলো সে আয়নার নিজের চেহারা দেখে তাকে এখন ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে, যেমনটি সে আশা করেছিল। তারপর সে নিচে নামে সিঁড়ি বেয়ে। নিজের মনে ভাবলো সে যখন খানসামাকে দেখতে পেল-খানসামার লেখাও হতে পারে অথবা হাউস-কীপারের কাছ থেকে ব্ল্যাকমেল করা চিঠি…। অবশ্য এ কথা মনে হয় যে খানসামার লেখা চিঠিও হতে পারে, অবাক হয়ে ভাবলো পোয়ারো, জীবন থেকে কি তার চরিত্রগুলি সৃষ্টি করেছে মিসেস অলিভার? যখন পোয়ারো মিস ব্রেউইসকে অতিক্রম করে আসছিল, তখন সে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, মিস আপনাদের এখানে কী হাউস-কীপার আছে?
না না, মিঃ পোয়ারো আমিই এখানে একাধারে সেক্রেটারি এবং হাউস-কীপার একথা বলতে পারেন। মেয়েটি তিক্ত হাসি উপহার দিলো।
পোয়ারো যেন কী চিন্তা করল, তারপর বলল, আচ্ছা আপনিই তাহলে হাউস-কীপার? সে ভাবলো, মেয়েটিকে দেখে ভাবা তো দূরের কথা; কল্পনাও করা যায় না যে সে লিখতে পারে ব্ল্যাকমেল করা চিঠি।
পরবর্তী প্রশ্ন পোয়ারোর, আপনাদের খানসামার নামটা বলুন তো?
মিস ব্রেউইস একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকাল, উত্তর দিল হেনডেন।
পেয়ারো তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, কেন জিজ্ঞাসা করছি জানেন, আমি যেন তাকে আগে কোথাও দেখেছি।
মিস ব্রেউইস উত্তর দিল–সেটা অবশ্য হতে পারে কারণ কেউ এক জায়গায় কখনো থাকে না চার মাসের বেশি।
তারা ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হলো। কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিলো স্যার জর্জকে সেখানে ডিনার জ্যাকেট পরা অবস্থায়। যেন একটা বাতিল যুদ্ধ জাহাজ মিসেস অলিভারকে দেখে মনে হচ্ছিল।
ভোগ-এর ফ্যাশন-এর পাতায় মনোযোগ সহকারে লেডি স্টাবস ঝুঁকে পড়ে দেখছিল। ড্রয়িং রুমে তখন মিঃ আলেক, শেলি লেগি এবং জিম ওয়ারবারটন ছিলেন। স্যার জর্জ সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, অনেক কাজ এখনো বাকি, আগামীকাল সান্ধ্য উৎসবে ভবিষ্যৎবক্তার বড় কার্ড এবং এখনো অনেক নোটিস ছাপাতে হবে। আমরা যেন কি নাম দেব:
ম্যাডাম জুলেকা? এসমারাল্ডা নাকি রোমানি লেইগি অথবা জিপসি কুইন?
শেলি বলল, প্রাচ্যের স্পর্শ, জিপসির নাম শুনলে ঘৃণা করবে চাষবাসের জায়গায়।
বেশ মনোমতো নাম-জুলেকা।
আর বেশি পছন্দসই নাম হতে পারে ক্লিওপেট্রা জ্বলেকার তুলনায়।
হেডেন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল এবং জানাল, ভদ্রমহিলাগণ, আপনাদের নৈশ ভোজ প্রস্তুত হয়ে গেছে। তারা ডাইনিংরুমে গিয়ে জমায়েত হলো। সারিবদ্ধভাবে মোমবাতি জ্বলছিলো লম্বা টেবিলে। তাদের হোস্টেস-এর দুপাশে বসে ছিল, আলেক আর ওয়ারবারটন। পেয়ারো স্থান নির্বাচন করেছিলেন মিসেস অলিভার আর ব্রেউইস-এর মাঝখানে। খুবই কম কথা বলছিল মিসেস অলিভার। আর লেডি স্টাবসও নীরব ছিল। তারা ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে এলো নৈশভোজের পর।
লেডি স্টাবস তন্দ্রালু দৃষ্টিতে জর্জের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, জর্জ আমি ভীষণ ক্লান্ত, আমি বিছানায় যাচ্ছি, তুমি কিছু মনে করো না।
হ্যাটি, ঠিক আছে, তুমি যাও একখানা সুন্দর ঘুম যেন তুমি উপভোগ করো। যাতে আগমীকালের জন্য সতেজ হয়ে ওঠো।
এই কথা বলে স্যার জর্জ হাল্কা চুম্বন করলো লেডি স্টাবসকে। সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে হাত নেড়ে ওপরে উঠে গেল লেডি স্টাবস।
ব্রেকফাস্ট-এর টেবিলে নিচে নেমে এল পোয়ারো পরদিন সকাল সাড়ে নটায়। সেখানে অন্যান্যরা পূর্বেই হাজির ছিলো।
ডাকে সেইমাত্র চিঠিগুলো এসে পৌঁছাল। অসংখ্য চিঠি মিস ব্রেউইস-এর সামনে। ব্যক্তিগত মার্কা স্যার জর্জ-এর চিঠিগুলো ছাড়া বাকিগুলো সে নিজেই খুলছিলো।
তিনখানা চিঠি লেডি স্টাবস-এর। বেশ কয়েকটা বিল পাওয়া গেলো দুটি খাম থেকে।
হঠাৎ সে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল, আরেতৃতীয় খামটি খোলার পর। সবাই অবাক চোখে তার দিকে তাকাল এমনভাবে শব্দ করে উঠেছিল। বলল লেডি স্টাবস, ইটিয়েনের চিঠি। সে আমার খুড়তুতো ভাই, তার চিঠি। সে এখানে আসছে ইয়েট।
স্যার জর্জ চেয়ে নিল চিঠিটা লেডি স্টাবস-এর হাত থেকে, তারপর পড়ল চিঠিটা। এই ইটিয়েন ডি সৌসা কে? তুমি বললে না তোমার খুড়তুতো ভাই, জিজ্ঞাসা করল স্যার জর্জ।
হ্যাঁ আমার তাই মনে হচ্ছে, আমার দ্বিতীয় খুড়তুতো ভাই। অবশ্য বিশেষভাবে তার কথা আমার মনে নেই, কারণ আমি তখন ছোট ছিলাম। জানালেন মিসেস স্টাবস।
বলছ তোমার মনে পড়ছে না, তাতে কি হল? আমরা অবশ্যই তাকে অভ্যর্থনা জানাব, বেশ আন্তরিকভাবেই স্যার জর্জ জানালো, আবার বলল, এই উৎসবের দিনেই সে আসছে, তা ভালোই হলো।
আর কোনো কথাই বলল না লেডি স্টাবস, সে তার কফির পাত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো। পোয়ারো তখন সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লেডি স্টাবসকে লক্ষ্য করছিলো, যখন সকলে আসন্ন উৎসবের আলোচনায় ব্যস্ত। এটাই তার বিস্ময় কোন লেডি স্টাবস-এর মনে এখন কোনো ভাবের খেলা চলছে। তাদের দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেল ঠিক সেই মুহূর্তেই। পোয়ারো চমকে উঠলো তার চোখের ধারালো দৃষ্টি দেখে। তবে চোখাচোখি হতে উধাও হয়ে গেল তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এবার কোমল এবং সজাগ তার চোখের দৃষ্টি …
মিস ব্রেইসের মোটেই পছন্দ নয় লেডি স্টাবস-এর এই এলোথলো, নিরাসক্ত ভাবটা। স্যার জর্জের বিবাহের আগে যদি মিস ব্রেউইস সেক্রেটারি হত, তাহলে আসন্ন নবাগতের আগমনে সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হত। পোয়ারো অবাকভাবে এ কথা ভাবতে লাগলো। লেডি স্টাবস হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো এবং বলল সে, আমার মাথা ব্যথা করছে, আমার ঘরে শুতে চললাম।
তার হাতের রুমালটা ফেলে গেল লেডি স্টাবস চলে যাওয়ার সময়। রুমালটা তুলে নিলো পোয়ারো নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করার সময়। সে তার হস্টেসকে সিঁড়ির সামনেই ধরল–বলল, আপনার রুমালটা আপনি ফেলে এসেছিলেন ম্যাডাম।
লেডি স্টাবল রুমালটা হাতে নেবার পর বলল, তাই নাকি? আমি সেটা ফেলে এসেছিলাম? ধন্যবাদ আপনাকে।
পোয়ারো বলল, আমার খুবই খারাপ লাগছে যে, আপনি কষ্ট পাবেন এজন্য, বিশেষভাবে যখন আপনার খুড়তুলো ভাই আসছে।
সঙ্গে সঙ্গে যেন মিসেস স্টাকস উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, না না, কখনই আমি ইটিয়েনকে দেখতে চাই না। সে করতে পারে না এমন কুকাজ নেই। পোয়ারো চলে আসার সময় দেখলো লেডি স্টাবস-এর কাঁধে হাত রাখলো ছুটে এসে মিঃ জর্জ, তারপর তাকে নিয়ে তাদের ঘরে অন্তর্হিত হলো।
ভালোভাবে তাকিয়ে চতুর্দিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখে নিল পোয়ারো, কেউ তার দিকে মনোযোগী নয়। নিজেকে আড়াল করে নেওয়ার এই সুযোগ আছে। সে বাড়ির এককোণে টেরেসের সামনে এল তারপর সে নতুন এক নাটকের দর্শক হয়ে গেল।
অনিশ্চিত চোখের দৃষ্টি নিয়ে দুটি মেয়ে অরণ্য প্রান্তর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল, তাদের পরিধানে শর্টস এবং চকচকে ব্লাউজ। গতকাল সে যাদের গাড়িতে লিফট দিয়েছিল, মনে হল তাদের মধ্যে একজন, সেই ইতালি মেয়েটি। স্যার জর্জ লেডি স্টাবস-এর শয়ন কক্ষ-এর জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে বলে উঠলো মেয়ে দুটিকে, তোমরা অনাহুত, কোন অধিকারে তোমার এখানে প্রবেশ করেছ।
একজন বলল–এই পথেই তো ন্যাসকম্ব যাওয়া যায়। দয়া করে যেতে দিন আমাদের, একটি মেয়ে অনুরোধ করল।
পুনরায় স্যার জর্জ চিৎকার করে উঠলো, অনাহূত তোমরা। তোমরা অনধিকার প্রবেশকারী। কোনো পথ নেই এখান দিয়ে যাওয়ার। যে পথে তোমরা এসেছ সেই পথেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
তারা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করল বিদেশী ভাষায়। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির মাথায় জড়ানো ছিল রয়্যাল ব্লু স্কার্ফ, তার সাথীর উদ্দেশ্যে সে বলে উঠল, আবার হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে?
পোয়ারোর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই স্যার জর্জ বলে উঠলো, আসল গেটে তালা ঝোলানো আছে। অরণ্যপথে বেড়া ডিঙিয়ে চালাকি করে এইসব বিদেশিনীরা রাস্তা সংক্ষেপ করতে চায়, আমার বাড়ির ভিতর দিয়ে।–এটা কি সাধারণের চলার পথ? আমাদের কথা এরা বুঝতেই পারে না কারণ এরা সবাই বিদেশিনী। হয়তো ডাচ্ কিংবা অন্য জাতীয় কিছু হবে। পোয়ারো বলল, ওদের মধ্যে একজন জার্মান আর অন্যজন ইতালির মনে হয়। গতকাল আমি ইতালির মেয়েটিকে দেখেছিলাম স্টেশন থেকে আসার সময়ে।
জর্জ এই কথা বলতে বলতে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল, আচ্ছা হ্যাটি এরা কি যে কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে? মনে হল তুমি কিছু বললে? বছর চোদ্দ বয়সের একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়েকে গাইডের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় পোয়ারো দেখতে পেল, যখন সে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিসেস অলিভারকে খুঁজছিল। মিসেস অলিভার পরিচয় করিয়ে দিলো–এর নাম মারলিন। মারলিন চপলভাবে হাসল। বলল মেয়েটি, আমি সেই ভয়ঙ্কর শব। তবে আমি আমার শরীর থেকে এক ফোঁটাও রক্ত ঝরতে দেব না।
তাই নাকি? বিস্মিত হলো পোয়ারো। কেবলমাত্র আমার গলায় ফাঁস লাগাবে, আমার দেহে বিদ্ধ হবে নকল ছোরা–ক্ষতস্থান থেকে লাল রক্ত ঝরে পড়বে, অবশ্য আসল রক্ত নয়, ব্যস, এইমাত্র ব্যাপার।
মিসেস অলিভার বলল, এটা খুবই বাস্তবোচিত ব্যাপার দেখাবে– ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন এটা ভেবেছে। মারলিন মুখ গোমড়া করে বলল, অবশ্যই রক্ত ঝরাতে হবে খুনের কেসে এটাই আমার মনে হয়। পোয়ারোর দিকে তাকালো সে ঔৎসুক্য ভরে। প্রশ্ন করলো পোয়ারোকে, অনেক খুনের কেসে হয়তো আপনি দেখেছেন, তাই নয় কি? মেয়েটি মিসেস অলিভারকে উদ্দেশ্য করে জানাল উনি বলেছেন।
পোয়রো নম্রভাবে জানাল, একটি অথবা দুটি। তখনই সে দেখতে পেল তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে মিসেস অলিভার। জিজ্ঞাসা করল, ঘটনাটা কি সেক্স-ম্যানিয়াক? আমি তাদের কথাবার্তা শুনেই বলছি আর কি। নিশ্চয়ই তুমি ঐরকম একজনের সঙ্গে মিলিত হতে চাইবে না? পোয়ারো জানতে চাইলো, কখনোই না, জানেন কেন? বললো মেয়েটি, এখানে একজন সেক্স-ম্যানিয়াকের সন্ধান পেয়েছিলাম–এটা আমি বিশ্বাস করি।
জঙ্গলে একটা মৃতদেহ দেখতে পান আমার ঠাকুর্দা। তিনি পালিয়ে আসেন ভীষণ ভয় পেয়ে। মৃতদেহটি ছিলো একজন মহিলার। তার কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি, কারণ আমার ঠাকুর্দা ছিলেন একজন সুযোগসন্ধানী। এই মুহূর্তে তার বিশ্রামের প্রয়োজন এই কথা মনে করে পোয়ারো মেয়েটিকে এড়িয়ে কোনোরকমে সেখান থেকে চলে এলে।
উৎসব মেলার উদ্বোধন করার কথা বেলা আড়াইটের সময় একজন চিত্রতারকার। আকাশের মেঘ সরে যাচ্ছে, বৃষ্টির সম্ভাবনাও ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে। উৎসব প্রাঙ্গণ জমজমাট বেলা তিনটের সময়। একে একে সবাই প্রবেশ-ফি দিয়ে ভিতরে ঢুকছে–সারিবদ্ধ লম্বা লাইন দিয়ে বাইরে গাড়িগুলো রয়েছে। দলে দলে আসছে ইয়ুথ হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রীরা। ফলে গেল মিসেস মাস্টারটনের ভবিষ্যৎবাণী। শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো লেডি স্টাবস আড়াইটের ঠিক একটু আগে সুসজ্জিত পোশাকে, কালো রঙ-এর বিকট একটা খড়ের টুপি মাথায় দিয়ে। প্রচুর হীরের অলঙ্কার পরেছে সে।
মিস্ ব্রেউইস, অস্ফুটস্বরে ব্যঙ্গোক্তি করল, চিন্তা করে দেখুন, প্রসঙ্গক্রমে এসকর্টের এ যেন রয়্যাল এনক্লোজার। গম্ভীরভাবে পোয়ারো মন্তব্য করল, এ যেন এক চমৎকার সৃষ্টি–এই আপনাদের ম্যাডাম। হ্যাটি পুলকিত স্বরে জানতে চাইল, দারুণ হয়েছে আমার সাজ তাই না? এগুলো এসকর্টের জন্যই পরেছি। ওদিকে হ্যাটি এগিয়ে গেল, সেই ফিল্মস্টারকে আসতে দেখে তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।
পোয়ারো উৎসবের প্রাঙ্গণের দিকে তাকালো পেছন থেকে, তার যেন মনে হল উৎসবের সব কিছু যেন স্বাভাবিকভাবেই চলেছে।
ভীড় হয়েছে মন্দ নয়, এইমাত্র শুরু হলো বাচ্চাদের নাচের একজিবিসন। দেখা পাওয়া যাচ্ছে না মিসেস অলিভারের। তবুও তার চিনে নিতে অসুবিধা হলো না। ভীড়ের মধ্যে থেকেও লেডি স্টাবসকে তার জমকালো পোশাকের জন্য। তবে বেশি তৎপর বলে মনে হল মিসেস ফোলিয়াটকে, সে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে উৎসবে আগত অতিথিদের। এক জায়গায়ও দাঁড়িয়ে পড়ছে না, উৎসব প্রাঙ্গণ-এর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অতিথিদের টুকরো সংলাপ শুনতে লাগলো পোয়ারো নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে
কেমন আছ তুমি, প্রিয় অ্যামি–
কি চমৎকার লাগছে, পামেলা তোমাকে। জানো কি এডওয়ার্ড আসছে? টিভারটন থেকে, অনেক দূর পথ।…
আচ্ছা ডরোথি, এ বছর গ্রীষ্ম খুব সুন্দর সাজে সেজেছে তাই না? মনে হচ্ছে আমি যেন তোমাকে কত যুগ ধরে দেখে আসছি আবার কেউ বা বলছে–ন্যাসেতে এসে তার সৌন্দর্য দেখব, আমরা ভেবেছিলাম।
অবশ্যই এখানকার পরিবেশ লাল গোলাপ-এর থেকেও সুন্দর।
এখানকার সকলে এবং সবকিছুই সুন্দর।
তোমার গ্রোগ্রাম কিন্তু গতবছর চমৎকার হয়েছিলো। সত্যিই এর জন্য তার আগের সৌন্দর্য আবার ফিরে আসছে ন্যাসেতে।
ভরাট কণ্ঠে ডরোথির স্বামী বলল, এখানকার অবস্থা যুদ্ধের সময় দেখতে এসেছিলোম। তখন আমার প্রচণ্ড দুঃখ হয়েছিলো।
মিসেস ফোলিয়াট ঘুরে দাঁড়াল, একজন বিনীত ভদ্র অতিথিকে আপ্যায়ন জানাবার জন্য। খুব খুশি হলাম মিসেস ল্যাপার আপনাকে দেখে। এই মেয়েটি লুসি নয় কি? বেশ বড় হয়ে গেছে তাই না?
মিসেস ল্যাপার ফোলিয়াটকে উত্তর দিলেন, ওর স্কুলের পাঠ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী বছরে, আপনাকে আজ এমন সুন্দর দেখে মুগ্ধ হলাম ম্যাডাম।
ফোলিয়াট বললেন, খুব সুখে আছি আমি, ধন্যবাদ। হুপলায় গিয়ে বরং তোমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখ লুসি। অল্পবয়সী মেয়েটিকে তিনি বললেন, আচ্ছা আবার পরে আপনার সঙ্গে টি-টেন্টে দেখা হবে ম্যাডাম, ঠিক আছে, এখন চলি–বললেন মিসেস ফোলিয়াট। সম্ভবত মিঃ ল্যাপার একজন বয়স্ক পুরুষ–আন্তরিকতার সঙ্গে ফোলিয়াটকে জানাল, খুব খুশী হলাম আপনাকে ন্যাসেতে ফিরে আসতে দেখে। ম্যাডাম আবার যেন আমরা সেই পুরাতন দিনগুলোয় ফিরে এসেছি একথা মনে হচ্ছে। উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল মিসেস ফোলিয়াট। একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক দুজন মহিলার সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসছিলো। একজন বললেন, তোমাকে এই বয়সেও দারুণ সতেজ লাগছে, প্রিয় অ্যামি। গোলাপ বাগানের কাজ কিরকম হচ্ছে তোমার তাই বলো? তুমি নাকি পুরানো গাছগুলির পাশাপাশি নতুন গাছের চারা বসিয়েছ, মারিয়েল বলছিল? তাদের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে মোটাসোটা লোকটি জিজ্ঞেস করল–কোথায় গেলো মেরিলিন? তার সঙ্গে দেখা করার জন্য রেগী ব্যস্ত হয়ে উঠেছে–সে তার শেষ ছবি দেখেছে।
ঐ যার মাথায় বিরাট টুপী তার সঙ্গে? প্রশ্ন করলেন তিনি। ওঃ তুমি কি বোকা প্রিয়তমা, হ্যাটি স্টাবস উনি। শোনো অ্যামি ওকে ঘুরে বেড়াতে দিও না ঐরকম জমকালো পোশাক পরে।
তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল আর একজন বন্ধু, এই যে অ্যামি, এই হলো এডওয়ার্ডের ছেলে রজার। খুব খুশী হলাম প্রিয় তুমি আবার ন্যাসেতে প্রত্যাবর্তন করেছ দেখে।
ধীরে ধীরে এবার সরে গেল পোয়ারো, অন্যমনস্কভাবে একটা এক শিলিং-এর টিকিট কিনলো নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য।
এখনো তার কানে অতিথিদের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল–আপনারা আসাতে কি ভালোই না লাগছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। মিসেস ফোলিয়াট যে কার্যতঃ হোস্টেসে পরিণত হয়ে গেছেন সেটা কি নিজেই সে উপলব্ধি করতে পারছে? আজ এই গোধূলি লগ্নের ফিকে হয়ে আসা রোদ্দুরে ন্যাসে হাউসের মিসেস ফোলিয়াট রূপে তিনি আবির্ভূতা এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
পোয়ারো একটা টেন্টের গায়ে লেবেল সাঁটা এই কথাগুলি পড়ে দেখলো-আপনার ভাগ্য বলে দেবেন ম্যাডাম জ্বলেকা আড়াই শিলিং-এর বিনিময়ে। তারপর সে টিকিট কেটে টেন্টে ঢুকে পড়ল। তখন চা বিতরণ হচ্ছিল টি-টেন্টে, তাই এখানে ভীড় নেই। পোয়ারো বলল, ম্যাডাম লেডি, আমি চাই সত্য প্রকাশ হোক। আপনি সব পরিষ্কার করে জানান আমাকে। শেলি বলল, আশ্চর্য! আপনি তাহলে আমাকে জানেন। মিসেস অলিভার আমাকে প্রথমেই বলেছেন, বাস্তবিক আপনারই কথা ছিলো শিকার হওয়ার, তার কাছ থেকে অর্থাৎ তার গল্পের চরিত্র থেকে আপনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। শেলি বলল, আমার ইচ্ছা ছিলো মৃতদেহ হওয়ার। অনেক শান্তি তাতে। সব দোষ জিম ওয়ারবারটনের, আচ্ছা চারটে বেজে গেছে নাকি? এবার আমি চা পান করবো।
আমার অবসর চরেটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত। পোয়ারো উত্তর দিল তার মান্ধাতা আমলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, দশ মিনিট বাকি আছে এখনো চারটে বাজতে। এখানে কি আপনার জন্য এককাপ চা?
না, আনতে হবে না, একটু বিশ্রাম নিতে চাই আমি, হাঁপিয়ে উঠেছি এই টেন্টের মধ্যে। আচ্ছা বাইরে কি খুব বেশি ভীড় হয়েছে?
তারা মনে হয় চা-এর জন্য লাইন দিয়েছে, জানালো পোয়ারো। ভালো কথা। এই বলে শেলি পা বাড়ালো টি-টেন্টের দিকে। পোয়ারো বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল তারপর। যাকে সে আগের দিন লিফট দিয়েছিল, মাঝপথে গিয়ে দৃষ্টি পড়ল তার সেই ডাচ্ মেয়েটির দিকে। প্রশ্ন করলো পোয়ারো, দেখছি তুমি উৎসবে এসেছ, আর তোমার সেই বন্ধুটি কোথায়?
মেয়েটি উত্তর দিল, সেও বিকালে এসেছে। তাকে অবশ্য আমি এখনো দেখিনি, ফেরার সময় দুজন একসঙ্গে এখান থেকে বাসে করে ফিরব–গেটের মুখ থেকে বাস ধরব সোয়া পাঁচটায়। প্রথমে আমরা টরকোয়ের যাব, সেখানে আর একটা বাস বদল করব, প্লিমাউথ-এর বাস। পোয়ারো সেই ব্যাগটা ঝুলতে দেখল ডাচ্ মেয়েটির কাঁধে। মেয়েটি ঘর্মসিক্ত হয়েছিল ওজনের ভারে, তার সেই অবস্থা দেখে পোয়ারো অবাক হলো, সে বললো, তোমার বন্ধুটিকে আজ সকাল বেলায় দেখেছি। আচ্ছা, আপনি কি জার্মান মেয়ে এলসার কথা বলছেন অদুরে স্যার জর্জের দিকে তাকিয়ে ডাচ মেয়েটি পোয়ারোকে প্রশ্ন করল, আর কি বলব, এই বাড়ির মালিক যে ভদ্রলোক এলসার ওপর সকালে খুব রেগে উঠেছিলেন, রাস্তা শর্টকার্ট করতে চেয়েছিল বেচারা, এই বাড়ির ভিতর দিয়ে, নদীর ধারে যাওয়ার জন্য। উনি বাধা দিয়েছিলেন তাকে। তাহলেও উনি খুব নম্র এবং ভদ্র। তাকে পোয়ারো জানাতে যাচ্ছিল যে সকালে অনাহূত অতিথি, আর এখন আড়াই শিলিং-এর টিকিট কেটে আইনসম্মতভাবে ন্যাসে হাউসে প্রবেশ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু সে বলতে পারলো না যেহেতু ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন হাজির হলেন।
লেডি স্টাবসকে দেখেছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো? তিনি বিচারক হয়েছেন ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগিতায়। কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে, জানতে চাইলেন ওয়ারবারটন। আমি ওকে প্রায় আধঘণ্টা আগে দেখেছিলাম ঠিকই-এবার চলুন দেখা যাক এখন তিনি কোথায়? ক্রুদ্ধ স্বরে ওয়ারবারটন বলল, অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করছে ভদ্রমহিলাকে। বুঝতে পারছি না, কোথায় উধাও হয়ে গেছেন তিনি। এদিকে অপেক্ষা করছে বাচ্চারা। আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি আমাদের নির্দিষ্ট কর্মসূচী থেকে। একবার দেখে নিলো চারিদিকে তাকিয়ে, কোথায় গেলই বা আমাদ্দা ব্রেউইস?
পোয়ারো অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো লেডি স্টাবস-এর সন্ধান করতে গিয়ে, মিসেস অলিভারই এসময় কোথায় গেলেন? একটি যুবককে জেটির পথ ধরে এগিয়ে আসতে দেখলেন পোয়ারো এসময়। খুবই কালো লোকটির গাত্রবর্ণ। ইয়টিং কস্টিউম পরনে। পোয়ারোর কাছে আসার পর তাকে একটু ইতস্তত করে বলল, মাপ করবেন আমাকে, আচ্ছা জর্জ স্টাবস-এর বাড়ি কি এটাই? হ্যাঁ এটাই বাড়ি, বলল পোয়ারো। যুবকটির দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো সে তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনিই কি লেডি স্টাবস-এর খুড়তুতো ভাই?
হ্যাঁ, আমি ইটিয়েন ডি সৌউসা–উত্তর দিল যুবকটি। পোয়ারো জানাল, আমি এরকুল পোয়ারো। তারপর তারা উভয়েই শুভেচ্ছা বিনিময় করল, পোয়ারো তাকে যখন উৎসবের বর্ণনা দিচ্ছিল, সেটা শেষ করতেই লন পেরিয়ে স্যার জর্জ তাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন, তুমিই ডি সৌউসা, খুব খুশী হলাম তোমাকে দেখে। হ্যাটি তোমার চিঠি পেয়েছে আজ সকালে। আচ্ছা দেখা যাক্ ্যাটি কোথায়? কোথাও আছে নিশ্চিয়ই মনে হয়।
তুমি আমাদের সঙ্গে সন্ধ্যায় নৈশভোজ সারবে আশা করি। স্যার জর্জ একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এখানে অনেকদিন থাকবে?
দু-তিনদিন হয়তো, সেটা নির্ভর করছে,কথাটা অসমাপ্ত রাখলো ডি সৌউসা। খুব খুশী হবে হ্যাটি তোমাকে দেখলে, কিন্তু ও কোথায় গেলো? লিকে খুঁজতে চলে গেলেন স্যার জর্জ। ডি সৌউসা তার (জর্জ দিকে তাকিয়ে রইলো। আর পোয়ারো দেখতে লাগল ডি সৌউসাকে। পোয়ারো অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করল, কতদিন পরে আপনার জ্যাঠাতুতো বোনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে?
আমি ওকে শেষ দেখেছিলাম যখন ওর পনেরো বছর বয়স। তখন ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফ্রান্সের একটা কনভেন্টে। ছোটবেলায় ও দেখতে বেশ সুন্দর ছিল, একথা জানাল ডি সৌউসা, তারপর জিজ্ঞাসু চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালো সে।
পোয়ারো জানালো, এখন উনি দারুণ সুন্দরী মহিলা।
জানতে চাইল যুবকটি, উনিই কি ওর স্বামী?
ভদ্রলোককে দেখে তথাকথিত ভালোমানুষ বলে মনে হয়, তবে মনে হয় ওর বিশেষ চাকচিক্য নেই। হ্যাটির উপযুক্ত স্বামী খুঁজে পাওয়াও খুব মুশকিল ছিলো। বলল ডি সৌউসা। কোনো মন্তব্য করল না পোয়ারো, চুপ করে রইল সে। ডি সৌউসা হেসে উঠে বলল, কিন্তু এখন এটা কোনো গোপন কথা নয়, হ্যাটির মানসিক বিকাশ ঘটেনি পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত। ওর মনটা ভীষণ চঞ্চল ছিলো।
এখনো কি ও সেইরকম আছে?
সন্তর্পণে পোয়ারো বলল, হ্যাঁ মনে হয় সেইরকম আছে। স্যার জর্জ তাদের কাছে এসে দাঁড়াল–এই অবসরে মিস ব্রেউইসকে সঙ্গে নিয়ে। মিসেস স্টাবস যে কোথায় আছেন আমি তা জানি না স্যার জর্জ। জানালো মিস ব্রেউইস। তাকে আমি শেষবার দেখেছিলাম ভবিষ্যত বক্তার টেন্টের কাছে। হ্যাঁ, তাও আধঘণ্টা হয়ে গেল। আচ্ছা তিনি কি এখন বাড়িতেও নেই?
পোয়ারো বলল, আচ্ছা এমনটা নয়তো যে, তিনি দেখতে গেছেন মিসেস অলিভারের মার্ডার হান্টের কাজ কতদূর এগোল? এটাও হতে পারে, আমি যেতে পারছি না এখানকার শো ছেড়ে, আর খুবই ব্যস্ত আমাদ্দা। আর আমি এখানকার ইনচার্জ। দয়া করে আপনি একটু সন্ধান করুন না মঁসিয়ে পোয়ারো। এখানকার প্রায় সমস্ত জায়গাগুলিই আপনি চিনে গেছেন। অনুরোধ করলো পোয়ারোকে স্যার জর্জ। অথচ পোয়ারো কতটুকুই বা জানে। বিড়বিড় করে সে নিজের মনে বলতে লাগলো, টেনিস কোর্ট, ক্যামেলিয়া গার্ডেন ফলি, নার্সারি-গার্ডেন বোড হাউসে…।
পোয়ারো টেনিস কোর্ট-এর একজন মিলিটারি ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না, ক্যামেলিয়া গার্ডেন-এর দিকে রওনা হলো সে। মিসেস অলিভারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ক্যামেলিয়া গার্ডেন-এ। সে বসেছিল বাগানের একটা বেঞ্চে। সে তার পাশে বসতে বলল পোয়ারোকে দেখে। একটা অদ্ভুত শব্দ করে সে বলল, এটা শুধু দ্বিতীয় কু, মনে হয় আমি তাদের অসুবিধায় ফেলেছি, এটা আমার মনে হচ্ছে। কেউ আসেনি এখনো পর্যন্ত। একজন যুবক এইসময় বাগানে ছুটে এসে প্রবেশ করে এবং উৎফুল্ল মেজাজে চিৎকার করে বলতে থাকে যে, সে পরবর্তী ক্লু আবিষ্কার করে ফেলেছে। অস্বস্তির সঙ্গে সে বলল, কর্ক গাছের ব্যাপারে জানে না অনেক ব্যক্তি, প্রথম ক্লু চতুর ফটোগ্রাফার আমি লক্ষ্য করেছি যে, সেটা একটা টেনিস নেটের অংশ, একটি কর্ক এবং বিষের একটি খালি বোতল সেখানে, এই ক্ল বোতলের পিছনে ছুটবে বেশির ভাগ লোক। অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। কর্ক গাছ খুবই দুষ্প্রাপ্য, সেটা পৃথিবীর এই প্রান্তে। আমিও আগ্রহী ঝোঁপঝাড় আর গাছের ব্যাপারে। এবার দেখা যাক অন্য কেউ কোথায় যায়।
সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার হাতের নোট বই-এর দিকে। মনে হয় সেটা কোনো কাজে লাগবে না, পরবর্তী কু-আমি যেটা কপি করেছি।
সকলের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন?
না না, মিসেস অলিভার বললো আমরা নিতান্ত কিছু খুঁজছি।
ফলির দিকে যখন কোনো সুন্দরী মহিলা ঝুঁকে পড়ে…কোথায় যেন আমি এরকম শুনেছি এবং আমার ধারণা!
পোয়ারা উত্তর দিল, এটা একটা বহু পরিচিত উক্তি।
ফলি হয়তো একটা ইমারত হতে পারে সাদা সেই সঙ্গে অনেকগুলো স্তম্ভও থাকবে..অনেক আশা নিয়ে বলল মিসেস অলিভার। যুবকটি বলল, অজস্র ধন্যবাদ–অবশ্যই এমন একটা ধারণাও হতে পারে। সে আরও বলল, মিসেস অলিভারকে এখানেই কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে–ওরা বলছিল। তার ফটোগ্রাফ নিতে চাই আমি। আচ্ছা আপনি কি তাকে দেখেছেন?
মিসেস অলিভার দৃঢ়স্বরে বলল, না।
পোয়ারো, যুবকটি চলে যাবার পর মিসেস অলিভারকে বলল–আপনি এটা অন্যায় করলেন না তো-পরবর্তী কু-র ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে?
অলিভার বলল, আমি তাকে উৎসাহ দিলাম কারণ একমাত্র এই যুবকটি ক্লু খুঁজে পেয়েছে।
পোয়ারো জানতে চাইলো, তবে তাকে আপনি ফটোগ্রাফ দিলেন না কেন?
এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, বলল মিসেস অলিভার-চুপ করুন মনে হচ্ছে কেউ যেন আসছে– না, যারা আসছে তারা শুধু দুজন মহিলা, কু হান্টার নয়। তারা উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে এসেছে টিকিট কেটে।
মিসেস অলিভার পোয়ারোর দিকে ফিরল, মেয়ে দুটির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে।
বিহ্বল দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বলল, মনে করুন, কেউ যদি কখনো আমার দেহ খুঁজে না পায়।
পোয়ারো বলল, ম্যাডাম ধৈৰ্য্য ধরুন এবং সাহস সঞ্চয় করুন। অনেক দেরি আছে বিকাল শেষ হতে।
মিসেস অলিভার উজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল-হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছেন আপনি। এবার চলুন দেখি বাচ্চা মেয়ে মারলিন কি করছে?
এই মেয়েটিকে আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না বুঝলেন মিঃ পোয়ারো। যেহেতু দায়িত্বজ্ঞান নেই ওর। আমি ওকে মৃতদেহের ভূমিকায় ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তারা এলোমেলোভাবে নদীর পথের দিকে এগিয়ে চলল, ফলি অতিক্রম করে। বোট-হাউসের ছাদ দেখা যাচ্ছিল নিচের দিকে। ধরুন যদি খুনের সন্ধান করতে গিয়ে বোট-হাউসে দেহটা পাওয়া যায়? মন্তব্য করলো পোয়ারো। সেটা কি মনে হতে পারে অস্বাভাবিক বলে? আমিও সেটা ভেবেছিলাম, জানালো অলিভার। শর্টকাটের নমুনা তো? আর সে জন্যই চাবিকাঠি হল শেষ ক্লু-টা। আপনি কিছুতেই তালা খুলতে পারবেন না সেই চাবিটা ছাড়া, কেবল মাত্র ভেতর থেকে খুলতে পারেন।
মিসেস অলিভার বোট-হাউসের সামনে এসে লুকোনো চাবিটা বের করে দরজা খুলল।
মিসেস অলিভার ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল, তোমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এসেছি আমরা মারলিন।
একটু সন্দেহ ছিল মারলিনের সম্পর্কে।
যেভাবে মারলিন নিজের দেহটা সাজিয়ে রেখেছিল তা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। মারলিন তাদের ডাকে কোনো উত্তর দিল না। মাটির ওপর সে নিঃশব্দে পড়ে রইলো। হাওয়া প্রবেশ করছিল খোলা জানলা দিয়ে। হাওয়ায় লুটোপুটি খাচ্ছিল টেবিলে রাখা কমিক্স-এর পাতাগুলো।
মিসেস অলিভার অধৈৰ্য্য হয়ে বলল–বেশ তো সবই ঠিক আছে। অন্য কেউ কু-র ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি আপনি আর আমি ছাড়া।
পোয়ারো সন্দিগ্ধ হলো। মিসেস অলিভারকে আলতোভাবে সরিয়ে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারোর কণ্ঠে একটা চাপা আওয়াজ বেরিয়ে এল। তারপরেই সে চোখ তুলে তাকাল মিসেস অলিভারের দিকে। সুতরাং…তাই ঘটলো শেষ পর্যন্ত আপনি যা আশা করেছিলেন, বলল পোয়ারো। আতঙ্কে মিসেস অলিভারের চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠলো-আপনি কি মনে করছেন?
এই কথা বলে সে একটা বাঁশের চেয়ার চেপে ধরে বসে পড়ল। আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি মনে করছেন–সে মৃত নয়তো? পোয়ারো মাথা নাড়লো, জানালো, হ্যাঁ, মেয়েটি মারা গেছে, অবশ্য বেশিক্ষণ হয়তো সে মারা যায়নি। প্রশ্ন করল অলিভার, কিন্তু কি করে এটা হলো, মিসেস অলিভারকে মুখটা দেখানোর জন্য মেয়েটির মাথার ওপর থেকে স্কার্ফটা তুলে ধরল সে।
ঠিক আমার বইয়ে যেভাবে লেখা ছিল, খুনটা সেইরকম ভাবেই হয়েছে, মিসেস অলিভার কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, প্রশ্ন করলো আবার, কিন্তু কেন, কে খুন করলো তাকে? আর এরকম ঘটলই বা কেন?
পোয়ারো বলল, আমারও সেই একই প্রশ্ন? পোয়ারো এ ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল যে মিসেস অলিভারেরও একই প্রশ্ন।
আর অলিভার যে প্রশ্নের উত্তর দেবে, সে উত্তর তার নিজস্ব নয়। কারণ যে মেয়েটি নিহত হয়েছে সে এ্যাটম বিজ্ঞানী নিহত যুগোস্লাভিয়ার প্রথমা স্ত্রী নয়। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সের একটি গ্রাম্য মেয়ে। পৃথিবীতে তার কোনো শত্রু ছিলো না, যতদূর জানা যায়।
ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ব্লান্ড স্যার জর্জের স্টাডি টেবিলের পেছনে বসেছিলো। তাকে বোট-হাউসে নিয়ে এসেছিলো স্যার জর্জ। আর তার সঙ্গে এখন সে বাড়িতে ফিরে এল। ফটোগ্রাফিক ইউনিট নিচে বোট-হাউসে তাদের কাজে ব্যস্ত। সবেমাত্র এসে পৌঁছেছে ম্যাডিক্যাল অফিসার এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট-এর লোকেরা। স্যার জর্জ জিজ্ঞাসা করল, উৎসব চলবে না কি বন্ধ করে দেবে?
স্যার জর্জ এখনো পর্যন্ত কি করছেন? জিজ্ঞাসা করল ব্লান্ড। না, কিছুই বলিনি, তবে এরকম একটা কানাঘুষো চলছে যে এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, এছাড়া কিছু নয়। এখানে কেউ সন্দেহ করছে না এটাই আমার মনে হয়, যে এখানে কোনো খুন হয়েছে। স্যার জর্জ বলল।
অতএব চলবে দিন যেমন চলছে। তারপর কিছু একটা ভেবে ব্লান্ড জিজ্ঞাসা করলো আবার, আপনার কি মনে হয়, যে এই ব্যাপারে কতজন লোক এসেছে? কয়েক শো তো হবেই, আরো অনেকে আসতে পারে–উৎসব বেশ সফল হয়েছে এটা বলা যায়। তবে খুবই দুর্ভাগ্যের কথা -বলে থেমে গেল স্যার জর্জ।
তার কথা সংশোধন করে ব্লান্ড বলল, যেহেতু একজন খুন হয়েছে, অতএব উৎসব সফল বলা যায় না।
ব্লান্ড চিন্তা করলো কয়েকশোলোক হয়েছে তাহলে মনে হয়, তাদের মধ্যে যে কেউ খুন করতে পারে। অবশ্য বুঝতে পারছি না, তাদের মধ্যে যেই হোক না কেন–খুন করার কারণটাই বা কি? আশ্চর্য, স্যার জর্জ জিজ্ঞেস করল, কে খুন করতে পারে মেয়েটিকে, বুঝতে পারছেন না?
কতটুকুই বা বলতে পারেন মেয়েটির সম্পর্কে সেটাই বলুন। শুধু জানতে পেরেছি সে স্থানীয় মেয়ে, তাই নয় কি?
জবাব দিল স্যার জর্জ, হ্যাঁ, মেয়েটি স্থানীয়। নদীর ধারে নিচে জেটির কাছেই একটা কটেজে থাকতো সে। একটা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্যাটারসনে মেয়েটির বাবা কাজ করে এটাই শুনেছি। বিকেল থেকে এই উৎসবে রয়েছে ওর মা। আমার থেকে আরও ভালোভাবে বোঝাতে পারবে আপনাকে, মিস ব্রেউইস আমার সেক্রেটারি।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ইনসপেক্টর বলল, তা অবশ্য ঠিক। ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। বুঝলেন স্যার জর্জ, জানাল ইনসপেক্টর ব্লান্ড। তাহলে বোট-হাউসে কি করছিল মেয়েটি? শুনেছি ওখানে কি একটা উৎসব চলছিল, মার্ডার হান্ট অথবা ট্রেজার হান্ট?
স্যার জর্জ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, তারপর বলল, ডেকে দেবো মিস ব্রেউইসকে? আমার থেকে সে আরো ভালোভাবে বলতে পারবে। যদি আরও কিছু আপনার জানার থাকে।
এখনই নয়, স্যার জর্জ-বললেন ইনসপেক্টর। তবে আপনাকে পরে আমি অনেক প্রশ্ন করতে পারি। তার আগে আমি অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। যেমন স্বয়ং আপনি, লেডি স্টাবস এবং আর যারা এই মৃতদেহটি প্রথম দেখেছিল। এও আমি জানতে পেরেছি যে, তাদের মধ্যে একজন মহিলা ঔপন্যাসিক, অর্থাৎ আমাদের কথা অনুযায়ী তিনিই নাকি এই মার্ডার। হান্টের লেখিকা।
হ্যাঁ সেটা ঠিক কথা, তার নাম মিসেস এরিয়াডন অলিভার। বললেন স্যার জর্জ। আচ্ছা উনি, তাই নাকি? বলল ব্লান্ড, বেস্ট সেলার, আমি তার অনেক বই পড়েছি। স্যার জর্জ বলল, উনি এখন খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। আপনি ওঁর জন্য অপেক্ষা করছেন, ওঁকে সেটা জানিয়ে দিচ্ছি। আমি ঠিক বলতে পারছি না আমার স্ত্রী এখন কোথায়?
হয়তো দু-তিনশো লোকের মাঝখানে রয়েছে সে। মনে হয় সে আপনাকে এ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানাতে পারবে না, তাহলে আপনি প্রথমে কার সঙ্গে দেখা করতে চান? ব্লান্ড জবাব দিলেন, প্রথমে কথা বলব আপনার সেক্রেটারি মিস ব্রেউইসের সঙ্গে তারপর মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। সম্মতি জানিয়ে স্যার জর্জ বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। লোকাল পুলিশ কনস্টেবল রবার্ট হপকিন্স দরজা খুলে দিল তার জন্য, আবার দরজা বন্ধ করে দিল সে বেরিয়ে যেতেই। সে একটা জবানবন্দী শুনলো তারপর–অবশ্যই স্যার জর্জের মন্তব্যের ধারাবিবরণী। সে বলল, লেডি স্টাবসকে চাই, উঠে এসো এখানে। তার কপাল টিপে ধরল সে। স্যার জর্জ এই জন্যই বলেছিলেন, তার কাছ থেকে বিশেষ একটা সাহায্য পাওয়া যাবে না। স্থানীয় মেয়েকে কি বিয়ে করেছিলেন তিনি? না, সে কালো চামড়ার মহিলা, বিদেশিনী অবশ্য কেউ কেউ তা বলে থাকেন, অবশ্য নিজে আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই না। ব্লান্ড মাথা নাড়ল, নীরব হলো মুহূর্তের জন্য। তারপর এমন একটা প্রশ্ন করল সে যেটা স্পষ্টতই রেকর্ড-এর বাইরে। সে বলল, কে এ কাজ করেছে হপকিন্স? ব্লান্ড ভাবলো হয়তো হপকিন্স জানতে পারে। যার স্ত্রী গল্প করার মতো এবং তার কাছে অনেক খবর থাকে ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় কনস্টেবল হিসাবে। হপকিন্স বলল, যদি আপনি আমাকে প্রশ্ন করেন মেয়েটি বিদেশিনী কিনা; তার উত্তরে বলব–কেউ স্থানীয় নয়। টাকার ঠিক বলছি তো? তাদের ন-জনের পরিবার; তারা চমৎকার সম্মানিত, তাদের মধ্যে বড় দুটি মেয়ে বিবাহিত, একটি ছেলে নেভিতে, আর একজন আছে ন্যাশনাল সার্ভিসে আর একটি মেয়ে আছে টরকোয়ের হেয়ার-ড্রেসার। বাড়িতে যে তিনজন আছে, তাদের মধ্যে একটি মেয়ে, দুটি ছেলে। একটু থেমে কিছু একটা মনে করে হপকিন্স বলল আবার, অবশ্য তাদের মধ্যে কেউই উজ্জ্বল নয়। মিসেস টাকারের ঘর-বাড়ি খুব পরিষ্কার রাখে, সব থেকে ছোট সে এগারজনের মধ্যে, বৃদ্ধ পিতা তার সঙ্গে থাকে। ব্লান্ড এইসব খবর পেলো নীরবে বসে থাকা অবস্থায়। টাকারদের সামাজিক অবস্থানের নমুনা পাওয়া গেল, হপকিন্স-এর বৈশিষ্ট্যমূলক প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে। বলে চলল হপকিন্স, এ একজন বিদেশিনী–এই কারণেই আমি বললাম। হুডাউন হোস্টেলে এসে উঠেছে তাদের মধ্যে একজন। একবার তাদের মধ্যে সন্দেহের কারণ ঘটেছিল এবং মাঝে মাঝে অনেক কিছুই ঘটে। বনের মধ্যে তাদের আমি কি করতে শুনেছি দেখলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। কানে আঙ্গুল দেবেন পার্ক করা গাড়িতে প্রতি মুহূর্তে কি ঘটেছে শুনলে। এরই মধ্যে পিসি হপকিন্স যৌন ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। কথপোকথনের একটা দীর্ঘ তালিকা দিল সে সব কিছু শুনিয়ে।
ব্লান্ডের বক্তব্য অনুযায়ী মনে হয় না এখানে কোনো কিছু ঘটেছে। সে যাই হোক ডাক্তার তার পরীক্ষা অনুযায়ী রিপোর্ট দেবে।
হপকিন্স বলল, সবকিছুই তার ওপর নির্ভর করছে স্যার। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি অবশ্যই কখনই কিছু জানতে পারবেন না এই বিদেশিনীদের সম্পর্কে। তারা যে কোনো খারাপ কাজ যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে।
ইনসপেক্টর ব্লান্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়, যেটা ভাবা হয়েছিল। হপকিন্স অবশ্য বিদেশিনী আখ্যা দিয়ে দোষরোপ করতে চাইছে। কিন্তু তাহলেও সব ঝামেলা মিটবে না। এইসময় ডাক্তার প্রবেশ করল দরজা খুলেই। এবার আমার কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করলো ডাক্তার। মেয়েটিকে এবার নিয়ে যাবে অরা, অন্যান্য সব সামগ্রী যেগুলি তদন্তের কাজে সাহায্য করেছে সেগুলি সব প্যাক করা হয়ে গেছে।
ব্লান্ড বলল, সার্জেন্ট কোটরিল ওদিকে ব্যবস্থা করবে। আচ্ছা ডাক্তার আপনার বিশ্লেষণ সম্বন্ধে কিছু বলুন।
ডাক্তার জানাল, কোনো জটিল ব্যাপার নয়, কেবল ফাস দেওয়া হয়েছে গলায় এক টুকরো কাপড় দিয়ে। এতে সহজে এর থেকে অন্য আর কিছু ঘটানো যায় না।
আততায়ীর সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ বাধেনি মৃত্যুর পূর্বে মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি জানতেই পারেনি কি ঘটতে যাচ্ছে, যতক্ষণ না ঘটনাটা ঘটেছিল, এটা আমার মত।
ব্লান্ড প্রশ্ন করল, বাধা দেওয়ার মতো কোনো কিছু যেমন ধর্ষণের চিহ্ন–অপমান সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেছে কি?
মনে হয় এটা কোনো যৌন অপরাধ নয়। সুতরাং কি? সেটা আমিও ব্যাখ্যা করতে পারবো না। ডাক্তার আবার বলল–আর মেয়েটি যে আকর্ষণীয় ছিল সেটাও আমি বলছি না।
আচ্ছা মেয়েটি কি ছেলেদের খুব প্রিয় ছিল?
ব্লান্ড কনস্টেবল হপকিন্স-এর উদ্দেশ্যে বলল, অবশ্য ওরা আমাদের কোনো সাহায্যে আসবে না। হয়তো তার পছন্দমতো কোনো ছেলে ছিল। ব্লান্ড রাজী হয়ে বলল, হতেও পারে। তার মনটা ফিরে গেল বোট-হাউসের একরাশ কমিক কাগজের দিকে।
কাগজগুলোর একধারে তাড়াতাড়ি লেখা ছিল–কোটির সঙ্গে জনি যায়। জর্জি গোগী চুমু খায়–অরণ্যে ভ্রমণরত মেয়েটিকে। সব কিছু ভেবে দেখলে মনে হয়, মারলিন টাকারের মৃত্যুর পেছনে একটা যৌন দিক আছে। যদিও এরকম ভয়ঙ্কর অপরাধী থাকতেই পারে তবুও কেউ তা জানত না। পুরুষদের সুপ্ত কাম বাসনা, খুন করার স্পৃহা-তারা বিশেষজ্ঞ অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরী শিকারে। অতএব এরকম উদ্দেশ্যহীন অপরাধের কোনো কারণ থাকতে পারে না এটাই সম্ভব, এবং তার বিশ্বাস এটাই। ব্লান্ড ভাবলো যাই হোক দেখা যাক, লোকের মতামত কি?
সে প্রশ্ন করল, কটার সময় মৃত্যু ঘটেছে?
এই মুহূর্ত থেকে ঠিক সাড়ে চারটের পরে।
সে উত্তর দিল–পাঁচটা কুড়ি মিনিটের সময় আমি তাকে দেখেছি, তাহলে ঘণ্টাখানেক পূর্বে তার মৃত্যু হয়েছে হয়তো।
চারটে কুড়ি অথবা পঁচিশ হতে পারে সময়টা। সঠিক সময় অটোপসি করে জানা যাবে। যথাসময় পাবেন বিস্তারিত রিপোর্ট।
এবার আমি চলি, অনেক রুগী বসে আছেন আমার জন্য। ডাক্তার চলে গেলেন।
মিস ব্রেউইস-এর ডাক পড়ল, ডাক্তার চলে যাওয়ার পর। মিস ব্রেউইস জানাল মিসেস টাকার বসে আছে আমার বসার ঘরে। খবরটা আমি তাকে জানিয়েছি, খুব ভেঙে পড়েছে সে। ছটার পর মিঃ টাকার তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবে। উৎসবে মেতে রয়েছে তাদের ছেলেমেয়েরা এখনো।
ইনসপেক্টর ব্লান্ড বলল, জবাব নেই। আমি আপনার আর লেডি স্টাবস-এর বক্তব্য জেনে নিতে চাই মিসেস টাকারের সঙ্গে দেখা করার আগে।
মিসেস স্টাবস এখন কোথায় জানি না, উৎসবের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য হয়তো সে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে আমার থেকে অনেক বেশি কিছু বলতে পারবেন এটা আমার মনে হয় না। বললেন, ব্রেউইস।
আচ্ছা আপনি ঠিক কি জানতে চান বলুন তো।
প্রথমে জানতে চাই এই মার্ডার হান্টের বিশদ তথ্য।
মারলিন টাকার কিভাবে প্রবেশ করলো এতে অংশগ্রহণের জন্য?
বললেন মিঃ ব্লান্ড, এটা তো খুব সহজ ব্যাপার। সুপরিচিত ঔপন্যাসিক মিসেস অলিভার উৎসব-এর আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য এই মাৰ্ডর হান্টের আয়োজন করেন। এবং প্লটটা তারই। মিস ব্রেউইস ব্যাখ্যা করে বলতে লাগলো। এই মেয়েটির ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিলো। প্রথমে শেলি লেগির। জানতে চাইলেন ইনসপেক্টর, মিসেস আলেক লেগি?
তাহলে হঠাৎ এই চরিত্র পরিবর্তন করা হলো কেন?
মিসেস আলেগ লেগি একদিন সন্ধ্যায় আমাদের সবার ভবিষ্যৎ কি বলে দিলো। তার ফলে আমরা ঠিক করলাম যে, উৎসবে ভবিষ্যতে বক্তার একটা টেন্ট ভোলা হবে।
প্রাচ্য ধরনের পোশাক পরে মিসেস লেগি ম্যাডাম জ্বলেকার ভূমিকায় যারা অর্থের বিনিময়ে জানতে উৎসুক তাদের ভাগ্য গণনা করে দেবে। আরও জানালা মিস ব্রেউইস–আমাদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান মিসেস লেগি–এর ফলে আমরা অন্য একটি মেয়ের সন্ধান করি। এই মেয়ে গাইডের নাম প্রস্তাব করে স্থানীয় গাইড মেয়েরা।
মিস ব্রেউইস আপনি ঠিকভাবে জানেন কি, কে তার নাম প্রস্তাব করেছিলো?
জিজ্ঞাসা করল ব্লান্ড। মিস ব্রেউইস বলল, সত্যি আমি বলতে পারবো না, কারণ আমি জানি না। তবে একজন সদস্য-এর স্ত্রী মিসেস মাস্টারটন হয়তো নির্বাচন করেছেন? অথবা বোধ হয় ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন..না-না আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। তবে এটা সত্য কথা যে, তার নামটা প্রস্তাব করা হয়েছিলো।
আর সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায় মেয়েটি।
তার ঠিক কি করার কথা ছিল, বলুন তো? তাকে বোট-হাউসে থাকতে হবে। যেই সে দেখবে দরজার সামনে কেউ আসছে তৎক্ষণাণৎ সে মাটিতে শুয়ে পড়বে। তারপর মরার ভান করে পড়ে থাকবে গলার দড়ির ফাঁস লাগিয়ে।
তারপর শান্ত স্বরে মিস ব্রেউইস বলল, অথচ সত্যি সত্যি তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায় মৃত অবস্থায়। ইনসপেক্টর ব্লান্ড মন্তব্য করলো, একটা ঘরে একা একা আবদ্ধ থাকা খুব একঘেয়েমির ব্যাপার, বিশেষত যখন বাড়িতে উৎসব চলছে।
মিস ব্রেউইস বললো, সবাই কি সব কিছু পারে তাছাড়া মারলিন নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করে ছিলো নকল মৃতদেহ সাজার জন্য। প্রচুর কমিক্সের রই রাখা হয়েছিল তার সময় কাটাবার জন্য।
বোট-হাউসে আমি নিজের হাতে করে প্রচুর মিষ্টি, কেক, ফল খাবারেরর প্লেটে রেখে এসেছিলাম, তার খাবার জন্য।
ফিরে তাকালেন ব্লান্ড একপলকে। তার দৃষ্টি ধারালো–তার খাবারের প্লেট আপনি নিজে রেখে এসেছিলেন? কখন?
তখন বিকেল প্রায় চারটে বেজে পাঁচ মিনিট হবে। আর বোট-হাউসে যখন পৌঁছেই–কেক ফুট আর ড্রিঙ্কস নিয়ে তখন চারটে বেজে পনেরো মিনিট হবে, এটাই আমার মনে হয়, জানালো ব্রেউইস।
তাহলে মারলিন টাকার সোয়া চারটে পর্যন্ত জীবিত ছিলো? জিজ্ঞেস করলো ইনসপেক্টর ব্লন্ড। আপনি কি তখন তাকে মৃতের ভান করে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন নাকি?
না, আমি তাকে বাইরে থেকে ডাক দিই, সে নিজে দরজা খুলে দিয়েছিলো। তারপর আমি খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে এসেছিলাম। বলল মিস ব্রেউইস।
তার নোট বুকে লিখলো ইনসপেক্টর সোয়া চারটের সময়, যখন এই কথা বলল সে, এক্ষেত্রে সময়টা খুব জরুরী মিস ব্রেউইস। আবার জিজ্ঞাসা করছি, আপনি একেবারে নিশ্চিত তো সময় সম্পর্কে? ঠিকভাবেই আমি বলছি, নিশ্চিতভাবে ঘড়ি আমি দেখিনি–তাই আপনার কথামতো নিশ্চিত করে সময়টা বলতে পারব না আমি।
তবে মনে হয় সময়টা ঐ কাছাকাছিই হবে।
আচ্ছা আর একটা কথা মিস ব্রেউইস, আপনি কি কারো সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন বোট-হাউসে যাওয়ার সময় অথবা ফেরার সময়। কিংবা বোট-হাউসে কাউকে যেতে অথবা ফিরে আসতে দেখেছিলেন?
ব্রেউইস জানালো না। একটুপরে কি ভেবেই যেন মিস ব্রেউইস বলে উঠলো–তবে সেই ফলিতে কাদের যেন দেখেছিলাম।
ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, ফলি?
হ্যাঁ তাই, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান একটা, ছোটখাটো সাদা। বছর এক কি দুই আগে এটা তৈরি করা হয়, বোট-হাউসে যাওয়ার রাস্তার ডান দিকে।
আমার মনে হচ্ছে সেখানে যেন একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।
হাসছিলো একজন, আর অন্যজন বলে উঠলো চুপ করো।
আপনি কি জানেন মিস ব্রেউইস ওরা দুজন কারা? সে উত্তর দিল, না, রাস্তা থেকে ফলির সামনেটা দেখা যায় না।
ইনসপেক্টর ভাবল, যারাই দাঁড়িয়ে থাকুক না কেন ফলির সামনে, তাদের খুঁজে বার করা এই কেসের পক্ষে জরুরী। যদি তাদের খুঁজে বার করা যায় তবে তারা বলতে পারবে তারা কাউকে বোট-হাউসে যেতে বা আসতে দেখেছিল কিনা? প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো ইনসপেক্টর। অন্তত তদন্তের কাজে আমাদের সুবিধা হয় যদি আপনি মেয়েটির সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন ব্যক্তিগতভাবে। মিস ব্রেউইস বলল, না, আমি মেয়েটির ব্যাপারে কিছুই জানি না, এবং সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আজ এই উৎসবে প্রথমবারই তাকে আমি দেখেছি–আজকেই।
ব্লান্ড আবার বলল–তাহলে আপনি তার ব্যাপারে সত্যিই কিছু জানেন না?
মিস ব্রেউইস বলল, তাকে যে কেউ খুন করতে পারে এ বিষয়ে কিছুই জানি না আমি।
ব্লান্ড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, এবার মনে হয় মেয়েটির মায়ের সঙ্গে দেখা করা দরকার।
মিসেস টাকারের চেহারা ক্ষীণাঙ্গী। টিকালো নাক, চুল সোনালি, তার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে ক্ৰলেনের ফলে। তবে সে তৈরি হয়ে আছে ইনসপেক্টর ব্লান্ডের প্রশ্নের উত্তর দিতে।
সে অনুযোগ করে বলে উঠল, ব্লান্ড প্রশ্ন করার আগেও–এ ধরনের নৃশংস হত্যা কাহিনী শুনেছেন গল্পে, উপন্যাসে কিংবা খবরের কাগজে, ইনসপেক্টর আমার মেয়ে মারলিন-এর ক্ষেত্রে এরকম ঘটল কেন?
ইনসপেক্টর ব্লান্ড বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত ম্যাডাম। আপনার মেয়ের সর্বনাশ কে করতে পারে বলে মনে হয় আপনার, সেই ধারণাটা আমাকে জানান।
মিসেস টাকার বলল, আমিও ভাবছি সেই একই কথা। ওর দু-একজন সহপাঠী বা সহপাঠিনীর সঙ্গে ওর মাঝেমধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলেও, এরকম নৃশংস প্রতিশোধ কেউ নেবে বলে মনে হয় না, একথা ওর স্কুলের টিচাররা বলেছে। ওর সত্যিকারের কোনো শত্রু ছিলো, একথা তো আমার মনে হয় না।
অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু বিশ্রী ধরনের উক্তি করতো, তবে অন্য কিছু নয়, এইরকম আর কি, কোনো শত্রু ওর পেছনে লেগেছে। ও একটু সাজগোজ করতে ভালোবাসত এই যা। যদিও ও এখন কিশোরী, তবুও পূর্ণ যুবতীদের মতো সজ্জাবিলাসী হয়ে উঠেছে ও। অবশ্য সব সময় নয়। ও নিজে ওর প্রসাধন সামগ্রী কিনে আনতে, হাতে টাকা পেলেই–যেমন লিপস্টিক, সেন্ট এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখতো। হাঠাৎ মিসেস টাকার ভেঙে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো।
মিসেস টাকার বলল, যদি আপনি বলেন আমার মেয়েকে খুন করেছে ঐ হোস্টেলের নোংরা বিদেশীদের মধ্যে একজন কেউ, তাহলে আপনি ব্যাপারটা বুঝতেই পারবেন না। সুন্দরভাবে কথা বলে প্রায় তারা সকলেই। বিশ্বাসই করতে পারবেন না, একটি মেয়ে এমন সব শর্টস পরে। ছিঃ, কি কুৎসিত শর্টস পরিহিত মেয়ে-সঙ্গে বিকিনি। আবার নদীর ধারে কোনো কোনো মেয়ে যখন রোদে পিঠ রেখে শুয়ে থাকে–তখন অনেকেরই গায়ে শর্টসও থাকে না–আর সব গণ্ডগোলের মূল হল সেটাই। এবং আমি সেটাই বলতে চাইছি।
মিসেস টাকারের দুচোখ-এ অশ্রুর বন্যা নেমেছিল যখন সে কনস্টেবল হপকিন্স-এর সঙ্গে ঘব থেকে বেরিয়ে গেল। তখনও ভাবছিলো ব্লান্ড। সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো অস্বস্তিজনক ভাব দেখা গেল না। আর যেহেতু তারা বহু বছর ধরে অপরিচিত বিদেশীদের সঙ্গে বাস করছে, সেজন্য হয়তো তাদের কাছে নতুন নয় এই বেদনাদায়ক ঘটনা। তবুও
হপকিন্স বলল, ভদ্রমহিলার জিভে বেশ ধার আছে। একবার কি দুবার নিজের মেয়ের সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ গলায় বললেও, এখন অনুভব করছে যে কাজটা ঠিক হয়নি। তবে মেয়েরা আজকাল পরোয়াই করে না কে কি বলল আর না বলল। ইনসপেক্টর ব্লান্ড তাকে বাধা দিয়ে নির্দেশ দিলো–এবার ডেকে আনো মিসেস অলিভারকে।
একটু যেন অবাক হয়ে গেল ব্লান্ড মিসেস অলিভারকে দেখে। অলিভার যে এত ভাবপ্রবণ সে তা যেন ভাবতেই পারেনি।
মিসেস অলিভার বলল, আমি ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গেছি। সে বেশ জোর দিল ভীষণ শব্দটার উপর এবং এটাই বোঝাতে চাইল যে, কী সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে সে মারলিনের মৃত্যুতে। আমি ভয় পেয়েছি কেন জানেন? যেহেতু আমার কল্পিত ঘটনা সেজন্য মনে হচ্ছে আমিই খুন করেছি।
ইনসপেক্টর ব্লান্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবল মিসেস অলিভার এই অপরাধের জন্য নিজেকে নিযুক্ত ভাবছে।
আমি কেনই বা এটা চাইলাম এ্যাটম বৈজ্ঞানিকের যুগোস্লাভীয় স্ত্রী শিকার হোক।
একথা আমি চিন্তা করতে পারছি না। এটা আমার ছন্নছাড়া মূর্খামি। তার যোগতা ততটা নয়। বাগানের মালি যেভাবে নিজেকে হোমরা-চোমরা মনে করে। তবে এ কেসের সঙ্গে তার অর্ধেক সম্পর্কও নেই। বেশির ভাগ লোকই আত্মকেন্দ্রিক, শুধু নিজেরটাই তারা ভালোভাবে চিন্তা করতে পারে, অন্য কিছু তারা ভাবতেই পারে না। অতএব তারা অপরের ভালো-মন্দ কি করে বিচার করবে? সেক্ষেত্রে আমার কিছু মনে করা উচিত নয়। কেউ কিছু চিন্তা করে না মানুষ খুন হলে। অর্থাৎ তাদের স্ত্রী, প্রিয়জন, আর সন্তান ছাড়া তারা অন্য কারো ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
ইনসপেক্টর ভাবল এক্ষেত্রে অলিভারকে সন্দেহের কোনো মানে হয় না। পোয়ারো তার বন্ধুকে বাড়িতে ফিরে আসার পর দৃঢ়ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছিল তার আঘাত প্রশমিত করার জন্য।
মিসেস অলিভার বলল, আমি পাগল বা মাতাল নই–আমার অবশ্যই বলার সাহস আছে, সেজন্য আমি বলছি, হা ঐ নোকটা ভাবে মাছের মতো আমি মদ খাই, তাই বলে সকলে এবং মনে হয় আপনিও তাই ভাবেন। ইনসপেক্টর জানতে চাইলো কোন্ লোকটি?
ইনসপেক্টর নাটকে দ্বিতীয় মালির অকস্মাৎ প্রবেশের ঘটনা থেকে সরে এসে ভাবতে চেষ্টা করল অপরিচিত লোকটা কে?
মিসেস অলিভার বলল, সে ইয়র্কশায়ারের লোক। আবার আমি বলছি, আমি মাতাল বা পাগল নই। ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি আমি। সে একটু থেমে আবার বলল, সাঘাতিক ব্যাপার হলো এই যে, মেয়েটা সেক্স-ম্যানিয়্যাকের শিকার হতে চেয়েছিলো, আমার এখন মনে হয়, সে ছিল…ঠিক ভাষায় আমি বোঝাতে পারছি না।
ইনসপেক্টর বলল, সেক্স-ম্যানিয়্যাকের কোন প্রশ্নই আসে না।
মিসেস অলিভার জানতে চাইলো, তাই নাকি? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তার জন্য। হয়তো সেই পক্ষেই চলতো মেয়েটি। ইনসপেক্টর তা হলে কেনই বা তাকে খুন করতে গেল, যদি সে সেক্স-ম্যানিয়াক না হয়।
আপনি আমাকে সাহায্য করবেন এটা আমি আশা করি।
মিসেস অলিভার জানাল–হ্যাঁ, অবশ্যই সাহায্য করতে পারি। কিন্তু চিন্তা করতে পারি না কে তাকে খুন করল?
অবশ্য আমি এই মুহূর্তে শুধু এই ব্যাপারটাই চিন্তা করতে পারি। যদিও সেটা ঠিক ভাবেই করব, অবশ্য সত্য নয় কোনোটাই। অর্থাৎ তাকে এমন কেউ খুন করেছিল, যে শুধু মেয়েদেরই খুন করতে চায়। অবশ্যই সেটা খুব সহজ, হয়তো উৎসবে এমন কেউ এসেছিল যে তাকে খুন করেছে। খুনী কিভাবে খবর পেলো যে মারলিন বোট-হাউসে আছে? অথবা মারলিন কি কিছু জানতো কারো গোপন কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপার? হয়তো মেয়েটি রাতে কাউকে মৃতদেহ কবর দিতে দেখেছিলো, হয়ত সে চিনে ফেলবে বলে খুনী পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছিল। আবার হয়তো কেউ গোপন ধনরত্ন যুদ্ধের সময় এখানে পুঁতে রেখে গেছে, মারলিন সেটা জানতো?
হয়তো মধ্যাহ্নভোজের সময় কেউ কাউকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে থাকবে, সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য হয়তো দেখেছিলো মারলিন বোট-হাউসের জানলা দিয়ে। হয়তো মারলিন কোনো সাংকেতিক বার্তা পেয়ে থাকবে, আর সেই সাংকেতিক ভাষা সে জানতো না।