০৩.
মিঃ ডিনমিড বেশ শক্ত সমর্থ পুরুষ, কাঁধ দুটো একটু ঝোকানো, মুখটা বেশ বড় সড় ও লালচে।
মিঃ ডিনমিড গোল টেবিলটা লক্ষ্য করলেন ফায়ার প্লেসের আগুনে সাদা টেবিলক্লথ, মিঃ মেহার্ন বললেন, ছুরি কাঁটা ও অন্যান্য সরঞ্জাম চক্ করছে।
মিসেস ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, দেখ সব কিছু ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ সব প্রস্তুত, মিঃ ডিনমিড বললেন।
তাহলে রান্নাগুলো করে ফেল, শার্লট রান্নাঘরে আছে তোমাকে সাহায্য করবে।
ডিম, কোল্ড কর্ড বিফ, রুটি আর চিজ এই হলো আজ রাতের খাবার। মিঃ ডিনমিড মিনিট দুয়েক ধরে শিস দিতে দিতে বললেন কি বিশ্রী আবহাওয়া আজ আর কেউ আসবে না। প্রায় দশমিনিট বাদে মিসেস ডিনমিড হাতে ডিম ভাজা নিয়ে ঢুকলেন এবং কিছু পরে তার দুই মেয়ে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। পিছন পিছন মিঃ ডিনমিড। ছেলে ডনিকে নিয়ে ঢুকলেন। তিনি সামনের চেয়ারে বসলেন। এবার মজা করে বলতে লাগলেন নানা কথাবার্তা।
যেমন তার মেয়ে মলিন বলল, লোকালয় থেকে এতদূরে বাড়ি করার জন্য কোন জন প্রাণীর দেখা পাই না।
শার্লট বলল, আমি কিছুতেই এই বাড়িতে একা একা ঘুমাব না।
ডিনমিড খুব রেগে গিয়ে বললেন, যত্তোসব বাজে কথা, তুমি কি কখনও কিছু দেখেছ? শার্লট কোনো উত্তর দিল না। এদিকে বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হল।
মিঃ ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি? আমরা আগুনের ধারে নিরাপদে আছি।
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ দরজায় করাঘাত শোনা গেল।
মিসেস ডিনমিড আর্তনাদ করে শালটা গায়ে জড়ালেন।
কুড়ি মিনিট আগে মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ড বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে দেখতে লাগলেন। দশ মিনিটের মধ্যে পর পর দুটো টায়ার ফেটে গেল আর তিনি এখন উইন্টশায়ারের এই লোকালয় বর্জিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন সত্যিই তার ভাগ্য খুব খারাপ।
চারিদিকে সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে আসছে। ধারে-কাছে আশ্রয়স্থল নেই। তার উচিত ছিল বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া। গাড়িটাকে সচল করার কোনো উপায় এখন আর নেই কারণ তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন পাহাড়ের পাশে সরু রাস্তায়। তিনি হতবুদ্ধি হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে হঠাৎ আলোর ঠিকানা পেলেন এক মুহূর্ত চিন্তা করে তিনি গাড়ি ছেড়ে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠলেন।
এবার তিনি একটা কুটিরের আলো দেখতে পেলেন। মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ড ভাবলেন ওখানে নিশ্চয়ই আশ্রয় পাওয়া যাবে।
ক্লিভল্যাণ্ড একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। তিনি অবচেতন মন নিয়ে দুটো টেক্সট বই লিখেছেন। তিনি রিসার্চ সোসাইটির সভ্য এবং অতিপ্রাকৃত বিদ্যার ছাত্র।
মিঃ ডিনমিডের বাড়ি পৌঁছে দরজায় ধাক্কা মারার পূর্ব মুহূর্তে একটা উত্তেজনার আঁচ পেলেন। তিনি পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া বিচার করে ভবিষ্যৎ ফল সম্পর্কে অনুমান করতে পারেন।
তিনি দরজায় ধাক্কা মারতেই ভিতরের সবাই চুপ করে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে দরজাটা খুলে গেল। ক্লিভল্যাণ্ড ভিতরের সব দৃশ্য দেখতে পেলেন, মনে হলো ভেতরটা কোনো ডাচ শিল্পীর আঁকা ছবি।
একটা বড় গোল টেবিল, পরিবারের সবাই বসে আছে। বাড়ির কর্তা, গিন্নী এবং তাদের কিশোর পুত্র ও কিশোরী কন্যা। মেয়েটি আশ্চৰ্য্য সুন্দরী।
ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ক্লিভল্যাণ্ড তার অসহায় অবস্থার কথা বললেন। অবশেষে কর্তা উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ ক্লিভল্যাণ্ডকে ভিতরে ডাকলেন। আগুনের পাশে কাঠের টুলে ক্লিভল্যাণ্ড বসলেন। জনি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমার নাম ডিনমিড কর্তা বললেন। আর ইনি আমার স্ত্রী এবং এরা দুজন আমার মেয়ে শার্লট এবং মদলিন। শার্লট অপূর্ব সুন্দরী। মলিন দেখতে একটু অন্য ধরনের। তার সৌন্দর্য্য যেন পটে আঁকা।
মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ডকে চা-পান করার জন্য অনুরোধ করলেন এবং কিছুক্ষণ বাদে তার স্ত্রী গরম চা ও নানারকম খাবার দিয়ে পরিচর্যা করলেন। পরিচর্যার ভিতর দিয়ে মিঃ ডিনমিড নানারকম কথাবার্তা শুরু করলেন। নিজের সম্বন্ধে সব কথা খুলে বললেন, তাঁর ব্যবসা, এই গ্রামে থাকা ইত্যাদি।
তার কথার তোড়ে মার্টিমার মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু তবুও ঘরের ভিতর দৃষ্টির ফেলার সময় চারজনের মধ্যে একজনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন।
আপনাকে আজ রাত্রিতে এখানেই থাকতে হবে। মিঃ ক্লিভল্যাণ্ড না হলে এত রাত্রিতে যাবেনইবা কোথায়?
আপনাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না। মেয়ে দুজন ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
একটু পরে মর্টিমার পায়ের শব্দ পেলেন।
আপনার মেয়েরা খুব সুন্দরী, ক্লিভল্যাণ্ড বললেন।
মিঃ ডিনমিড গর্বের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। আমার মতো বা মা-র মতো হয়নি।
একটু পরেই জানানো হলো ঘর প্রস্তুত। মর্টিমার আরও একবার ধন্যবাদ জানালেন।
ডিনমিড বললেন, তোমরা ওঁর সঙ্গে উপরে গিয়ে দেখ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা।
মলিন জানালাটা পরীক্ষা করে দেখল এবং শার্ট ওয়াশ হ্যাঁণ্ড বেসিনের দিকে নজর দিল। তারপর গুডনাইট মিঃ ক্লিভল্যাণ্ড বলে বিদায় নিল।
দরজাটা বন্ধ করে তারা দুজন চলে গেল। ঘরে মর্টিমার এখন একা।
কিছুক্ষণ বাদে নিচ থেকে মিঃ ডিনমিডের গলার শব্দ তিনি পেলেন।
তারপর তিনি পায়চারি করতে করতে চিন্তায় ডুবে গেলেন। আচ্ছা মর্টিমার এমন ভাবে তাকাল কেন? তাহলে এই বাড়িতে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে।
এস.ও.এস। এটা বিপদ সংকেত কিন্তু ধুলোর মধ্যে কে এটা লিখল?
তার মনে পড়ল তারা দুজনেই ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু লিখল কে?
দরজার সামনে গিয়ে তিনি আবার দরজাটা খুললেন না, মিঃ ডিনমিডের গলার আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না।
তিনি চিন্তা করলেন কাল যা কিছু করার করব।
ক্লিভল্যাণ্ড সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলেন। লিভিংরুমের ভিতর দিয়ে বাগানে চলে গেলেন। শার্লট সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে।
ক্লিভল্যাণ্ডকে শার্লট দেখতে পেয়েই সুপ্রভাত জানাল।
গুডমর্নিং, মর্টিমার হাসিমুখে বলল।
কিছুক্ষণ পর মর্টিমার একটা গাছের ডাল ভেঙে ঐটা দিয়ে বালুময় মাটিতে এস.ও.এস লিখে শার্লটকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না।
তুমি কি জান এই তিনটে অক্ষরের মানে কি? শার্লট ভ্রূ কোঁচকাল।
সে বলল, কোনো জাহাজ যখন বিপদে পড়ে তখনই তো এই সংকেত পাঠায়।
মর্টিমার সায় দিল মাথা নেড়ে। কিন্তু তুমি কি এটা লিখেছ।
শার্লট চোখ বড় করে অবাক হয়ে বলল, না আমি লিখিনি।
তাহলে আমার ভুল হয়েছে। হতাশায় মনটা তার ভরে গেল।
এবারে তারা দুজনে বাড়ির দিকে চলল। যেতে যেতে শার্লট হঠাৎ নীচু গলায় বলে উঠল, কথাটা আমি লিখিনি বটে কিন্তু যে কোন সময় লিখে ফেলতে পারতাম। কারণ আমি ভীষণ ভয়ের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু আপনি আসার পর যেন কিছু উত্তর পেলাম।
তুমি কিসের ভয় পেয়েছিলে?
আমি তা জানি না, শার্লট বলল। তবে মনে হয় বাড়িটা। এখানে আসার পর সবাই কেমন যেন পালটে গেছে, তাছাড়া এই বাড়িতে ভূত আছে।
মর্টিমারের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। শার্লট বলল, এই বাড়িতে একজন লোক তার স্ত্রীকে খুন করেছিল। এখানে আসার পর আমরা তা জানতে পারি। মর্টিমার চিন্তা করতে লাগলেন। আমাকে বল কাল রাতে আমি যে ঘরে ছিলাম খুনটা কি সেই ঘরেই হয়েছিল?
শার্লট বলল, আমি ও সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
মর্টিমার প্রায় নিজের মনে বললেন, খুনটা ঐ ঘরে হয়ে থাকতে পারে।
আমার মনে হয় কাল রাতে তুমিই এস.ও.এস লিখেছিলে! তুমি অবচেতন অবস্থায় লিখেছ। অনেক বছর আগে যে খুন হয়েছিলো সে হয়ত এস.ও.এস লিখেছিল, এখন তুমি অবচেতন মনে লিখে ফেলেছ।
শার্লটের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, আপনি এই ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বাড়ির ভিতর থেকে কে যেন তাকে ডাকল সে ভেতরে চলে গেল।
মর্টিমার একাই বাগানে পায়চারি করতে লাগলেন। কাল রাতে এই বাড়িতে ঢুকে তিনি যে উত্তেজনার আভাস পেয়েছিলেন এই ব্যাখ্যা কি তার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত? তিনি নিজের মনে বললেন, আমার আবির্ভাব জনি ছাড়া সবাইকে ভীষণ চমকে দিয়েছিল কিন্তু কেন?
এমন সময় জনি অতিথিকে বলল, ব্রেকফাস্ট রেডি আপনি ভেতরে আসুন।
মর্টিমার লক্ষ্য করলেন জনির হাতের আঙুলে কিসের দাগ। জনি বুঝতে পেরে বলল, আমি রসায়ন নিয়ে পরীক্ষা করি। বাবা পছন্দ করেন না। তবুও আমার ইচ্ছা রসায়ন নিয়ে আমি গবেষণা করি।
ইতিমধ্যে মর্টিমার ব্রেকফাস্ট টেবিলে এলেন এদিকে মিঃ ডিনমিড মিসেস ডিনমিড, খাবার টেবিলে এসে মর্টিমারকে সুপ্রভাত জানাল। মর্টিমারের মনে হলো মিসেস ডিনমিড যেন ভয় পেয়েছে তাঁকে দেখে। সবার শেষে মলিন এল, সে মর্টিমারকে অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করল কাল আপনার ভালো ঘুম হয়েছে তো?
মর্টিমার বললেন, হ্যাঁ তার ভালোই ঘুম হয়েছে। মদলিনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মর্টিমারের উত্তরে। মর্টিমার এবার গৃহস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনার ছেলে রসায়ন বিদ্যায় আগ্রহী। হঠাৎ মিসেস ডিনমিড তার হাতের কাপটা মেঝেতে ফেলে দিলেন অর্থাৎ পড়ে গেল। তার স্বামী বলে উঠলেন কি হলো ম্যাগি? তার গলার স্বরে মনে হলো ধমক ও সাবধান করে দেওয়া। তারপর অতিথির দিকে তাকিয়ে অন্য কথা শুরু করলেন।
প্রাতঃরাশের পর মর্টিমার নিজেই বাগানে চলে গেলেন। তার যাবার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু তার যেতে ইচ্ছে করছে না মনের মধ্যে চিন্তা করতে করতে তিনি একটা রাস্তা ধরে বাড়িটার অন্য দিকে চলে এসেছেন। তার জুতোর তলা ক্রেপসোলের তাই মোটেই শব্দ হচ্ছিল না। তাই তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ ডিনমিডের কথাগুলি শুনতে পেলেন, তিনি বলছিলেন প্রায় ষাট হাজার পাউণ্ডের মত উকিল বলছিল।
তাদের এই কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে উঠল। মদলিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিল কিন্তু তার বাবার ডাকে সে বাড়িতে ফিরে গেল।
মিঃ ডিনমিড খুশি মনে বললেন, আশা করি আপনার গাড়ির বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। মর্টিমার উঁচু গলায় মিঃ ডিনমিডকে বিপদে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ জানালেন।
মলিন ও শার্লট বলল, না না, এটা আমাদের কর্তব্য তারপর তারা হাত ধরাধরি করে দুজনে দূরে একটা বেঞ্চে বসল।
মর্টিমার হঠাৎ বলে ফেললেন, আপনার মেয়ে দুজনকে দেখতে কিন্তু মোটেই একরকম নয় তাই না মিঃ ডিনমিড।
মিঃ ডিনমিড কথাটা শুনে একটু হতচকিত হয়ে গেল।
আপনার তাই মনে হচ্ছে না কি? হা ওরা দেখতে আলাদা।
মর্টিমার সহজ গলায় বলল, তবে ওরা দুজনেই নিশ্চয়ই আপনার মেয়ে নয়।
মিঃ ডিনমিড এবার সত্যি কথা বললেন, ঠিক ধরেছেন মশাই, ওরা দুজনই আমাদের মেয়ে নয়। একজনকে শিশু বয়স থেকে পালন করে আসছি। সে কিন্তু এসবের কিছু জানে না। তবে তাকে এবার সব জানাতে হবে।
মর্টিমার জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু সম্পত্তি ও পাচ্ছে বোধহয়?
মিঃ ডিনমিড ভাবলেন সব খুলে বলাই ভালো। আপনি কি করে ধরলেন মশাই।
এটা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পারদর্শিতা।
হ্যাঁ, আপনার কথাই ঠিক। আমরা তাকে পালিতা কন্যা হিসাবে গ্রহণ করি। মদলিনের সম্বন্ধে খবরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। তার বাবা খুব ধনী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি তার সন্তানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন। তিনি লোকও লাগিয়ে ছিলেন এবং উইল করে গিয়েছেন যে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেলে তার সব সম্পত্তি মেয়ে পাবে।
মিঃ মর্টিমার মন দিয়ে সৰু শুনলেন এইজন্যই মদলিন অন্যরকম দেখতে, চুলগুলো কালো কেমন যেন নিস্পৃহ ভাব। মিঃ ডিনমিডের কাহিনী সত্য হলেও কিছু তথ্য গোপন আছে।
তবু মর্টিমার মিঃ ডিনমিডকে বুঝতে দিলেন না।
তিনি বললেন, বাঃ মদলিন সুন্দরী এবং প্রচুর অর্থের মালিক তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।
এবার এখন আমার যাবার সময় হয়েছে আপনাদের আতিথেয়তার জন্য আর একবার ধন্যবাদ। মিসেস ডিনমিডের দুচোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন।
মেয়ে দুটোকে মর্টিমার দেখতে পেলেন না কিন্তু আগের রাতে গাড়িটাকে যেখানে ফেলে এসেছিলেন সেই রাস্তায় ধারের ঝোপে মদলিন দাঁড়িয়েছিল।
আপনার সাথে আমার দেখা করার দরকার ছিল। মদলিন বলল, দেখুন, আমি বিচার বুদ্ধি দিয়ে চলি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে তা ধরা ছোঁওয়ার মধ্যে, এটা ভূত প্রেতের সৃষ্টি নয়। প্রতিদিনই রহস্যটা ঘনীভূত হচ্ছে। বাবা, মা, শার্লট সব বদলে যাচ্ছে, একমাত্র জনি পাল্টায়নি।
মদলিন বলল, আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম কাল রাতে। কিন্তু আপনি আসায় সেটা থেমে গেছে। আমি বিপদের আশঙ্কায় এস. ও. এস হঠাৎ লিখে ফেলেছি।
মর্টিমার মদলিনকে ভরসা দিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। যা করার আমি করব। শুধু আপনি চিন্তা করে বলুন কাল রাতে এমন কোনো কথা আপনার মনে দাগ কেটেছিল কিনা?
মদলিন বলল সে রকম কিছু মনে পড়ছে না। শুধু শার্লটকে দেখতে হুবহু মার মত হয়েছে এই কথা বাবা বলেছিলেন মাকে।
ঠিক আছে আপনি চিন্তা করবেন না আপনি এখন বাড়ি যান। আমার হাতে সব কিছু ছেড়ে দিন।
এবারে মর্টিমার চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মনে বার বার জনির মুখটা ফিরে আসতে লাগল। জনি নিরীহ তবু তাকে কেন্দ্র করেই সব ঘটনা ঘটেছে। আজ সকালে প্রাতঃরাশের সময় মিসেস ডিনমিডের হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল কেন? উত্তেজনার কারণটা কি? তিনি বলেছিলেন জনি রসায়ন ভালোবাসে সেই জন্য কি? তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন মিঃ ডিনমিডের চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে ধরা।
এই সব ভাবতে ভাবতে শার্লটের কথা মনে পড়ে গেল। কাল রাতে সে কেমন অদ্ভুত ভাবে মিঃ মর্টিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আরও একটা ব্যাপার মিঃ ডিনমিড একটার পর একটা চায়ের কাপ খালি করে বললেন, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কিন্তু তখনও চা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
মাসখানেক আগে একটা ঘটনা তিনি পড়েছিলেন একটা ছেলের অমনোযোগিতার জন্য পুরো একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আধঘণ্টা পরে মর্টিমার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন এবং তিনি মিঃ ডিনমিডের বাড়িতে আবার ছুতো করে গেলেন। মর্টিমার বললেন, আমি দুঃখিত একটা জিনিষের জন্য আমাকে আবার আসতে হল।
মিঃ ডিনমিড চেঁচিয়ে উঠলেন, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, আপনি কিসের জন্য ফিরে এলেন আমি তা জানতে চাই।
একটু চায়ের জন্য তড়িৎগতিতে তিনি পকেট থেকে কি একটা বার করে টেবিলে থেকে একটা চায়ের কাপ তুলে বাঁ হাতে ধরা একটা টেস্টটিউবে খানিকটা চা ঢাললেন।
মিঃ ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি করছেন? তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি নিশ্চিত মিঃ ডিনমিড যে, আপনি খবরের কাগজ পড়েন। কিছুদিন আগে একটা খবর বের হয়েছিল যে, একটা পুরো পরিবার বিষক্রিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল কিন্তু আজকে ঘটনায় মাত্র একজন মারা যেত।
প্রথম প্রশ্ন হলো টিনের যে হ্যাম খেয়েছিলেন তাতে কিছু ছিল। আপনার ভাড়ার ঘরে এক প্যাকেট আর্সেনিক আছে। তার নীচের শেলফে এক প্যাকেট চা আছে। উপরের শেলফে একটা ফুটো আছে। ঐ আর্সেনিক ফুটো দিয়ে চায়ের প্যাকেটে পড়েছে এটা সবাই স্বাভাবিক ভাববে।
মর্টিমার আরও বললেন, আপনি নিজের মেয়ে শার্লটের চায়ের কাপে কিছু মেশাননি কিন্তু মদলিনের চায়ের কাপে চার পাঁচগুণ বেশি আর্সেনিক আছে। এটা ঠিক নয় আসল যেটায় লাল লেবেল লাগানো হলো সেটায় আপনার মেয়ে শার্লটের কাপের চা আর দ্বিতীয়টায় মদলিনের কাপের চা। আমি শপথ করে বলতে পারি প্রথম টেস্টটিউবে দ্বিতীয় টেস্টটিউবের চেয়ে চার পাঁচগুণ বেশী আর্সেনিক রয়েছে।
ডিনমিড বললেন, আপনি পাগল হয়ে গেছেন।
না, আমি পাগল হইনি। আপনি মিথ্যে কথা আমাকে বলেছিলেন আসলে শার্লট আপনার মেয়ে নয়। মদলিনই আপনার নিজের মেয়ে। আপনি চেয়েছিলেন শার্লটকে লুকিয়ে, আপনার মেয়ে মদলিনই সম্পত্তিটা পাক। তাই আপনি শার্লটকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠল না কারণ তার মায়ের সাথে খুবই মিল তার। যারা তার মাকে চেনে শার্টকে দেখলেই তারা চিনতে পারবে, তাই আপনি শার্লটের চায়ের কাপে সাদা আর্সেনিক মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মিসেস ডিনমিড হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত করতে লাগলেন। মিঃ ডিনমিড স্ত্রীকে ধমক দিলেন।
মর্টিমার দেখলেন শার্লট চোখ বিস্ফারিত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মলিন বলল, চল আমরা একটু দূরে গিয়ে বসি।
মর্টিমার বললেন, তিনি যদি এই বিশেষ বাড়িটায় না আসতেন তাহলে হয়ত তিনি ঐ রকম পরিকল্পনা করতেন না। আমি এই টেস্টটিউব দুটো শার্লটের নিরাপত্তার জন্য আমার কাছে রেখে দেব। আচ্ছা, বিদায়।
.
০৪.
মিসেস হার্টার একজন হার্ট পেশেন্ট। তাকে ডাক্তার দেখতে এসেছেন। ডাক্তার তাকে বললেন আপনি একদম দুশ্চিন্তা করবেন না, উত্তেজিত হবেন না, আপনার হার্ট একটু দুর্বল ঠিকই তবে ভয় পাবার কিছু নেই। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি একটা পেসমেকার বসিয়ে নেন তাহলে কোনো চিন্তা থাকবে না।
রোজ সকালে একটু ব্যায়াম করবেন, পাহাড়ে উঠবেন না, মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখবেন তাহলেই হবে। মিসেস হার্টারের ভাইপো চার্লস রিডাওয়ের কাছে ডাক্তার আরও কিছুটা বিশদ করে বললেন। তিনি বললেন, আপনার পিসীর বহু বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে তবে তাকে যেগুলি বললাম সেগুলি পালন করতে অবশ্যই হবে।
চার্লস একজন বিবেচক যুবক, সে নিজের বিবেচনা প্রয়োগ করে ঐদিন সন্ধ্যায় একটা রেডিও সেট আনবার প্রস্তাব করল।
কিন্তু মিসেস হার্টার আপত্তি করলেন। তিনি বললেন, ঐসব বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আমার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। চার্লস তার যুক্তি দিয়ে পিসীর অযৌক্তিকতা প্রমাণ করল। মিসেস হার্টার শেষ পর্যন্ত চার্লসের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন।
ডঃ মেনেলের ব্যবস্থামত পেসমেকার বসানো হল। পেসমেকারের পর রেডিও এসে হাজির হল। চার্লস এসে তাকে সব বোঝাল।
মিসেস হার্টার একটা হাইব্যাক চেয়ারে শান্ত, সংযত ভাবে বসে রেডিও শুনতে লাগলেন; তবু তাঁর মনে হতে লাগল যে এসব জিনিষ কোনো কাজের নয়।
রেডিওতে নানা সেন্টার ঘুরিয়ে চার্লস পিসীর সাথে ঠাট্টা করতে লাগলেন। পিসীও তাতে যোগ দিলেন। মিসেস হার্টার চার্লসকে খুব ভালোবাসেন। কয়েক বছর আগে ভাগ্নী মিরিয়াম হার্টার তার সঙ্গে এই বাড়িতে থাকত কিন্তু সে বেশীদিন থাকতে পারেনি তার মামীর সঙ্গে থাকতে ভালো লাগত না। সে অবশেষে একটা ছোকরার প্রেমে পড়ে। বিয়ে হয়ে যায় তার।
চার্লস কিন্তু পিসীর প্রতি সদয়। সে কখনও পিসীর সান্নিধ্যে বিরক্ত বা একঘেয়ে বোধ করেনি। দিনের মধ্যে অনেকবারই সে পিসীকে বলে আন্টি তুমি একটি দারুণ মহিলা।
ভাইপোর উপর সন্তুষ্ট হয়ে মিসেস হার্টার তার উকিলকে নির্দেশ দিলেন একটা নতুন উইল তৈরী করতে। তিনি উইলটা পড়ে সন্তুষ্ট হয়ে সই করে দিলেন।
এবার রেডিও সম্বন্ধে ও নতুন করে পিসীর প্রশংসা পেল। প্রথম প্রথম মিসেস হার্টার রেডিওটাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু এখন সে ভালো ভাবে উপভোগ করছে রেডিও নিয়ে। তিনি দুটো সুইচ ঘুরিয়ে দিয়ে হাইব্যাক চেয়ারে বসে মনের সুখে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান শোনেন।
রেডিওটা কেনার তিন মাস পরে এই প্রথম একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল। চার্লস ঐ সময় ব্রীজ খেলতে বাইরে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠান ছিল ব্যালাড কনসার্ট। একজন বিখ্যাত গায়িকা গাইছিলেন। গানের মাঝে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। গানটা হঠাৎ থেমে গেল তারপর একজন লোকের পরিষ্কার গলার আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে মেরি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? আমি প্যাট্রিক কথা বলছি। আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসব তুমি নিশ্চয়ই প্রস্তুত থাকবে, একটু পরেই আবার অ্যানি লবির সুরে ঘর ভর্তি হয়ে গেল।
মিসেস হার্টার নিথর হয়ে চেয়ারে বসে রইলেন তিনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
না-কি তার দুর্বল মনের প্রতিক্রিয়া যাই হোক তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বললেন না, তবে তিনি দু-দিন ধরে কিছুটা চিন্তিত ও মনমরা হয়ে রইলেন।
তারপর ঘটনাটা আবার ঘটল ঐদিনও তিনি ঘরে একা ছিলেন রেডিওতে অর্কেস্ট্রা বাজছিল সেটা হঠাৎ থেমে প্যাট্রিকের গলা শোনা গেল।
মিসেস হার্টার ঘড়ির দিকে তাকালেন না, আজ তিনি মোটেই ঘুমিয়ে পড়েননি। পুরোপুরি সজাগ থেকে প্যাট্রিকের গলা শুনেছেন। তিনি মনে করলেন চার্লস বলছিল, তরঙ্গের মাপদণ্ডে অনেক ফাঁক থাকে খুব সম্ভব এসব হারিয়ে যাওয়া তরঙ্গই মনোবৈজ্ঞানিক ঘটনার ব্যাখ্যা করে। না এই রকম ধারণা অসম্ভব নাও হতে পারে।
মিসেস হার্টার ঘন্টা বাজিয়ে তার মেড এলিজাবেথকে ডাকলেন। সে মিসেস হার্টারকে খুব যত্ন করে তার প্রতি দরদ আছে।
এলিজাবেথ ঘরে ঢুকতে মিসেস হাটার তাকে তার কবরের জিনিষপত্র ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি অসংলগ্ন কথা বলতে লাগলেন। এলিজাবেথ বলে উঠল, ম্যাডাম আপনি এসব চিন্তা করবেন না। আমার তো মনে হয়েছিল আপনি এখন একটু ভালো আছেন?
মিসেস হার্টার বললেন, আমার এখন সত্তর পার হয়ে গেছে। একদিন না একদিন আমাদের সবাইকে তো ওপারে যেতে হবে।
এলিজাবেথ তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে গেল।
মিসেস হার্টার স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। খুব বিশ্বাসী ওকে আমি উইলের কত দিয়েছি। ওকে একশ পাউণ্ড দেওয়া উচিত।
পরের দিন তিনি উকিলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন উইলটা দেখানোর জন্য। একদিন চার্লস তার পিসীকে বলল, গেস্টরুমে ঐ গোবদা মুখো ফটোটা কার? গালে দাড়ি লম্বা জুলফি মাথায় টুপি উনি কে?
মিসেস হার্টার চার্লসের কথায় খুব রেগে গেলেন। এবং বললেন, ওটা তোমার পিসেমশাইয়ের ফটো।
চার্লস ক্ষমা চেয়ে বলল, সরি আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি। তবে একটা কথা আমি পিসেমশাইকে মানে ফটোর ঐ ব্যক্তিকে যেন দেখেছি। আমাদের বাড়িতে তিনি যেন শেষের জানালার ধারে বসে আছেন।
শেষের জানালায়? মিসেস হার্টার চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
চার্লস বলল, হ্যাঁ কেন?
মিসেস হার্টার ভাবলেন তিনি আজ নিয়ে মোট তিনদিন সেই রহস্যময় গলা শুনতে পেয়েছেন। তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই তার সঙ্গে অন্য এক জগতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তিনি রেডিওতে তার স্বামীর গলায় শুনতে পেয়েছেন। তিনি বলছেন, মেরি তুমি নিশ্চয়ই এখন প্রস্তুত শুক্রবার আমি তোমার জন্য আসব…সাড়ে নটার সময়…ভয় পেও না, কোনো যন্ত্রণা অনুভব করবে না…প্রস্তুত থেকো।
মিসেস হার্টারের মুখটা সাদা হয়ে গেছে, ঠোঁট দুটো নীল শুকনো দেখাচ্ছে।
তিনি কাঁপা হাতে নীচের লাইন কটা লিখলেন,
আজ রাতে সওয়া নটায় আমি আমার মৃত স্বামীর গলার স্বর পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি। সে রাত সাড়ে নটায় শুক্রবার আমার কাছে আসবে।
আমি যদি ঐদিন মারা যাই তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে
বিদেহী জগৎ আছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব। মেরি হার্টার।
মিসেস হাটার চিঠিটা লিখে এলিজাবেথকে দিয়ে চিঠিটা পোষ্ট করালেন ডাঃ মেনেলের কাছে। এলিজাবেথকে কোনো কথা বলতে দিলেন না। তিনি বললেন, আমি অপার্থিব ব্যাপার অনুভব করছি।
আমি তোমাকে একশ পাউণ্ড দিতে চাই তবে মৃত্যুর আগে ব্যাঙ্কে যেতে যদি না পারি চার্লস তার ব্যবস্থা করবে।
এলিজাবেথ কোনো কথায় কান করলেন না।
মিসেস হার্টার বললেন, মনে রেখো চার্লস যদি আমার কিছু হয় তবে এলিকে অতিরিক্ত পঞ্চাশ পাউণ্ড দেবার ব্যবস্থা করবে।
চার্লস গলায় খুশির স্বর আনার চেষ্টা করল, তোমার কি হতে যাচ্ছে। ডাঃ মেনেল বলেছেন, তুমি আরও কুড়ি বছর বাঁচবে। তখন শততম জন্মদিন পালন করব।
মিসেস হার্টার স্নেহমাখা হাসি হেসে বললেন শুক্রবার তুমি কি করছ?
চার্লস অবাক হয়ে বলল, সন্ধ্যাবেলা ইউইং আমাকে তাস খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে তুমি যদি চাও তাহলে আমি থাকতে পারি।
মিসেস হার্টার দৃঢ়ভাবে বললেন, না। আমি ঐ রাতে একদম একা থাকতে চাই। তার ইচ্ছা তিনি একাই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হবেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িটা খুবই নিস্তব্ধ মনে হল। মিসেস হার্টার চেয়ারে বসে আছেন তাঁর সব প্রস্তুতি শেষ।
তিনি চার্লসের জন্য একটা নির্দেশের তালিকা করলেন। তাঁর সব আত্মীয়দেরও কিছু কিছু জিনিস দেয়ার কথা লিখলেন। উইলের বক্তব্য খুব একটা দীর্ঘ নয়। মিসেস হার্টার ঘড়ির দিকে তাকালেন সাড়ে নটা বাজতে তিনি মিনিট বাকি। তিনি প্রস্তুত হয়ে আছেন শান্ত, সংযত। শেষ কথা কটি নিজের মনে বার বার বলার সময় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, কি যেন এখনি ঘটবে।
সাড়ে নটা, রেডিওটা তিনি চালিয়ে দিলেন। তিনি এবার কি শুনবেন?
কেউ কি আবহাওয়ার খবর বলতে নাকি পঁচিশ বছর আগে মারা গেছে এমন একজনের গলা শুনবে।
তিনি কিছুই শুনতে পেলেন না। তার বদলে সামনের দরজায় একটা যেন হাতড়ানো শব্দ। তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। দরজার বাইরে যেন মৃদু পায়ের শব্দ, দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মিসেস হার্টার টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন, তার দুচোখ ভোলা, দরজার দিকে নিবদ্ধ। তিনি চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন।
আলোয় দেখলেন পুরোনো আমলের কোট গায়ে বাদামী রঙের দাড়ি ও লম্বা জুলফি সমৃদ্ধ পরিচিত মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
প্যাট্রিক তাকে নিতে এসেছে। তার হৃদযন্ত্র শেষবারের মতো লাফিয়ে উঠে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন।
প্রায় একঘন্টা পরে কত্রীকে ঐ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল এলিজাবেথ। সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ মেনেলকে খবর পাঠিয়ে আনা হল। আর কিছু করার নেই। মিসেস হার্টার চিকিৎসার বাইরে চলে গেছেন।
এলিজাবেথের মিসেস হার্টারের ডাক্তারকে লেখা সেই চিঠিটার কথা মনে পড়ল। সে ডাঃ মেনেলেকে চিঠিটা পড়তে দিলো। ডাঃ মেনেলে চিঠিটা আগ্রহ সহকারে পড়ে চার্লসকে দেখালেন।
তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনার পিসী তার স্বামীর গলা শুনেছিলেন ভেবে নিয়ে ঐ বিশেষ সময়টিতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়।
চার্লস বলল, অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া?
কিছুটা ঐরকম যতশীঘ্র পারি ময়না তদন্তের ফল আপনাকে জানাব।
চার্লস মাথা নাড়ল।
আগের দিন রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন সে রেডিওর ক্যাবিনেটের তার সরিয়ে নিল। ঐ তারটা চার্লসের শোবার ঘর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পিসেমশাইয়ের কিছু পোক কর্পূরের গন্ধ ভরা আলমারিতে রেখে দিল। এলিজাবেথকে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে বলেছিল। ঐ আগুনে বাদামী রঙের দাড়ি ও জুলফি পুড়িয়ে দিল।
চার্লস ভাবল এবার সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যখন ডাঃ মেনেলে তার পিসীকে সাবধানে থাকতে এবং আরও কুড়ি বছর বাঁচবে বলেছিলেন তখনই সে পরিকল্পনাটা এঁটে ফেলেছিল। এখন সে এই কাজে কৃতকার্য। চার্লস এবার যা যা করণীয় সব যন্ত্রচালিতের মত করে চলল। কবর দেবার ব্যবস্থা, আত্মীয়স্বজন যাবে তার ব্যবস্থা, কয়েক জন রাতে থাকবে তার ব্যবস্থা ইত্যাদি। সে যে কি সাংঘাতিক অবস্থার মধ্যে আছে তা মৃত আন্টি এবং অন্য কেউ-ই জানে না। তার কাজকর্ম সবই গোপন আছে। এখন আর সে ভয় নেই। চার্লস নিজের মনে হাসল। সে যা করেছে এতে অপরাধের কিছু নেই। শুধু পিসীর সাথে পিসেমশায়ের গলা নকল করে একটু ঠাট্টা করেছে। ব্যস এতেই সব সমাধান হয়ে গেল। এখন সে একজন ধনী ব্যক্তি।
এইসব চিন্তা করতে করতে এলিজাবেথ জানিয়ে গেল হপকিনস এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
হপকিনস গত পঁচিশ বছর ধরে মিসেস হার্টারের উকিল। সে ঠিক সময়ে এসেছে।
চার্লস গম্ভীর মুখে লাইব্রেরী রুমে ঢুকল এবং মিঃ হপকিনসকে চেয়ারে বসার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমি আপনার লেখা চিঠি ঠিক বুঝতে পারিনি মিঃ রিডাওয়ে। আপনার ধারণা হয়ত ভুল কারণ মিসেস হার্টারের উইলটা আমার হেপাজতে নেই। আমার কাছে ছিল কিন্তু তিনি মারা যাবার আগে গত মঙ্গলবার উইলটি চেয়ে পাঠান।
চার্লস অবাক হয়ে গেল তার শরীর কেমন হতে লাগল তার মনে হচ্ছে কোথাও গণ্ডগোল আছে।
সে তার আন্টির কাগজপত্রের মধ্যে উইলটা খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও পেলো না।
মিঃ হপকিনসের ইচ্ছানুসারে এলিজাবেথকে ডাকা হলো। সে বলল, মৃত্যুর দিন সকাল পৰ্য্যন্ত তার কত্রীর হাতে উইলটা ছিল।
কিন্তু ম্যাডাম মারা যাবার পরদিন শুধু নীল খামটা টেবিলের উপর পড়েছিল।
দুজনই এলিজাবেথের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
এলিজাবেথ অনুমতি নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেল।
মিঃ হপকিনস চার্লসকে প্রশ্ন করলেন, আপনার সাথে পিসীর কোনো মনোমালিন্য হয়নি তো?
চার্লস জোর গলায় বলে উঠল, আমাদের দুজনের সম্পর্ক মধুর ছিল।
চার্লসের এই সব কথা ভাবতে ভাবতে মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, যদি উইলটা আর কখনও না পাওয়া যায় তাহলে কি হবে?
মিসেস হার্টারের আগের উইলটা রয়েছে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করা ঐ উইল অনুযায়ী তার ভাগ্নী মিরিয়াম সব পাবে।
মিরিয়াম সব পাবে?
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল,
ডাঃ মেনেলে মিঃ রিডাওয়ে বললেন এইমাত্র শব ব্যবচ্ছেদ শেষ হল। তাঁর হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জন্যই মৃত্যু হয়েছে। তিনি দুমাসের বেশী আর বাঁচতেন না।
চার্লস কিন্তু ইতিমধ্যে রিসিভারটা দুম করে নামিয়ে রেখেছে।
সে বুঝতে পারল তার সঙ্গে কেউ যেন চালাকি করছে। তার সামনে আর কোন আশা নেই। জেল ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
.
০৫.
সে বুঝতে পারল অলক্ষ্যে কেউ যেন তাকে দেখে হাসছে।
অ্যালিকসের স্বামী হেঁটে চলল গ্রামের দিকে যতক্ষণ না স্বামী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ততক্ষণ সে কাঠের গেট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যালিকস মার্টিন সুন্দরী নয়, চেহারাটা নজর ধরাও নয় তবে একটা চটক আছে। ওর বাদামী চুল ওর গর্বের বিষয়। তার কথা বলার ধরনটিও বেশ মধুর। পোশাক পরিচ্ছেদে বেশ ছিমছাম, যে পোশাকটি পরলে তাকে মানায় সেই পোশাকটিই সে পরে।
আঠারো বছর বয়সে লেখাপড়া শেষ করে তাকে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে।
অ্যালিকস নামী ইস্কুলের গ্র্যাজুয়েট। তার রুগ্ন মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে শর্টহ্যাণ্ড টাইপিস্টের চাকরি করতে হয়েছে।
এই পনেরো বছরের মধ্যে বিয়ে না হলেও প্রেম হয়েছে। প্রেমিক তার সহকর্মী কেরানী ডিক উইনডিফোর্ড। কিন্তু তারা কেউ পরস্পরের কাছে প্রেম নিবেদন করেনি। তবু অ্যালিকস ভাবত তারা দুজনে স্বামী স্ত্রী হবে।
এদিকে হঠাৎ অ্যালিকসসের কপাল খুলে গেল। তার দূর সম্পর্কের এক কাজিন মারা গেছে। সে তার সঞ্চিত বেশ কয়েক হাজার পাউণ্ড উইল করে গেছে তাকে।
অ্যালিকস ভাবল এবার তা হলে সে মিসেস অ্যালিকস উইনফোর্ড হবে। এই সুসংবাদে ডিকের কিছুই হলো না উল্টে সে অ্যালিকসকে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু এর কারণ কি? ধনী পত্নীর স্বামী হতে তার পৌরুষে বাঁধছে? এইসব ভেবে ডিক নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। অ্যালিকস তাকে ভালোবাসে সে শুধু অপেক্ষা করছে ডিকের হয়তো ভুল ভাঙবে।
এমন সময় সব উল্টে গেল, অ্যালিকসসের এক বান্ধবীর বাড়িতে ডোরাল্ড মারটিনের দেখা হল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রণয় সৃষ্টি হল। সে প্রেম নদীতে ঝাঁপ দিল। সে ডিককে ভুলে গেল।
কয়েকদিন পরে ডিককে সে সব বলল এবং শীঘ্র তারা বিয়ে করবে একথাও বলল।
ডিক বলল, লোকটি তোমার অপরিচিত। তুমি ওর বিষয়ে কিছু জান না। মাত্র কদিনের পরিচয়ে তুমি জেনে গেলে।
অ্যালিকস এবার রেগে গিয়ে বলল, আমি জানতাম না যে কোনো পুরুষ এগারো বছরেও জানতে পারে না ভালোবাসা কি?
অ্যালিকস-এর কথা শুনে ডিক অনেক অনুনয় করল, তবু অ্যালিকস শুনল না। তখন সে ভয় দেখাল শান্ত শিষ্ট এই মানুষটার মধ্যে এত আগুন লুকিয়েছিল।
ডিক বলে ডোরাল্ডকে সে খুন করবে? অবশ্য সে যা বলছে রাগের মাথায় বলছে।
আজ সকালে স্বামীকে বিদায় দেবার পর ডিকের শাসানি তার মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর অ্যালিকস তিনবার একই স্বপ্ন দেখেছে। ডিক তার স্বামীকে খুন করছে। ডোরাল্ড মরে পড়ে আছে, আর ডিক তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সে স্বামীর মৃত্যুতে যেন খুশী। কি বাজে স্বপ্ন ডিকের কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? নাকি সে অ্যালিকসকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
এই সব কথা অ্যালিকস ভেবেই যাচ্ছে এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। সে টেলিফোন তুলে জিজ্ঞাসা করল, কে কথা বলছ? আমি ডিক, আমি এখন ছুটিতে আছি। তোমাদের গ্রামের সরাইখানাটা বেশ, এখানে মাছ ধরতে এসেছি, আমি যদি তোমার ওখানে যাই তাহলে আপত্তি আছে?
না, কড়া সুরে অ্যালিকস বলল, আসবে না তুমি।
ডিক থতমত খেয়ে বলল, আমাকে মাপ কর, আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
অ্যালিকস ভাবল এতটা রূঢ় না হওয়াই উচিত ছিল, সে স্বর কোমল করে বলল, আরে না, আজকে আমাদের বাড়িতে অন্য লোকের আসবার কথা আছে তুমি না হয় কাল রাত্রে ডিনারে এসো।
ডিকস বলল, সরি কাল আমি থাকব না, গুডবাই অ্যালিকস, বেস্ট অফ লাক টু ইউ মাই ডিয়ার। অ্যালিকস কোনো উত্তর না দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল। মনে মনে বলল, ভাগ্যিস ডিনারের নেমন্তন্ন নেয়নি। অ্যালিকস উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ভাবল, যাই একটু বাগান ঘেরা কটেজে ঘুরে আসি। কটেজটি ভারি সুন্দর ফুলে ফুলে ভরা হট ওয়াটার, ইলিকট্রিক টেলিফোন, মর্ডান রাথরুম চওড়া বারান্দা সব আছে।
কটেজটি অ্যালিকস ও ডোরাল্ড দুজনে মিলে কিনে নিয়েছে। কটেজটি সুন্দর তবে ভারী নির্জন। এতদুরে কাজের লোক পাওয়া যায় না।
বাগানটা পরিচর্যা করার জন্য একজন মালী রাখা হয়েছে, তার নাম জর্জ।
বৃদ্ধ জর্জ সপ্তাহে দুদিন আসে সোমবার ও শুক্রবার। কিন্তু জর্জ আজকে বুধবার এসেছে। কেন?
জর্জকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, শুক্রবার তাদের বাড়িতে উৎসব তাই, তাছাড়া আপনি নাকি কাল লণ্ডন যাচ্ছেন? মিঃ মার্টিন বললেন।
অ্যালিকস অবাক হয়ে বলল, না, আমরা তো লণ্ডন যাচ্ছি না, তুমি হয়ত ভুল শুনেছ তাছাড়া আমার লণ্ডন ভালো লাগে না। জর্জ তাড়াতাড়ি উত্তর দিল আমারও লণ্ডন একদম ভালো লাগে না। সেখানে বড়বেশী মোটরকার।
এই বাড়ির আগের মালিক দুহাজার পাউণ্ড দিয়ে এই কটেজ বিক্রী করে চলে গেছে লণ্ডনে। কিন্তু আমরা তা তিন হাজার পাউণ্ডে কিনেছি।
না, আপনি তাহলে জানেন না আমি যতদূর জানি এই কজেট মিঃ মাটিন দু হাজার পাউণ্ডে কিনেছেন। মালীর সঙ্গে কি তর্ক করবে? সে ভাবল ডোরাল্ড কি তাকে মিথ্যা কথা বলেছে? ফুল তুলতে তুলতে সে সব ভুলে যেতে চেষ্টা করল।
অ্যালিকস হঠাৎ একটা সবুজ মত কি দেখতে পেল আরে এটা তো ডোরান্ডের পকেট ডায়েরি। অ্যালিস্ ডায়েরিটা পড়ে দেখল তাতে লেখা ১৫ মে তারিখে সেন্ট পিটার্স চার্চে বেলা ১-৩০ টায় অ্যালিকসের সাথে তার বিয়ে হল।
তারপর লেখা ১৮ জুন সে তো আজকে রাত্রি নটা, তারপর আর কিছু লেখা নেই। সে আরও দেখল ব্যবসা সংক্রান্ত অনেক নোট বা ঠিকানা ফোন নম্বর ইত্যাদি কিন্তু কোনো মিস বা মিসেসের নাম নেই।
যাই হোক অ্যালিকস আজকে ডিকের ফোনের কথা গোপন রাখল।
লাঞ্চের সময় ডোরান্ডকে বাড়ি ফিরতে দেকে অ্যালিকস কিচেনে ঢুকে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সন্ধ্যায় ডিনারের পর জানালা খুলে দিয়ে ওরা দুজনে লিভিং রুমে বসল। সাদা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।
অ্যালিকস বলল, আজ রাত্রি নটায় কি করবে গো? ডায়েরীতে লেখা
ও ডায়েরীটা বুঝি তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ?
হ্যাঁ, তার সঙ্গে তোমার অনেক সিক্রেট জেনে ফেলেছি।
আমার কিছুই গোপন নেই। আর নটার সময় ডার্করুমে কাজ করব। তুমি আমাকে হেল্প করবে। ডোরাল্ডের ফটো তোলার শখ আছে। ছবি তোলার পর নেগেটিভ ডেভেলপ করা। এনলার্জ করা সব ডোরান্ড নিজে করে। সে সব কাজ ঘড়ি ধরে করে।
অ্যালিকস কিছু না ভেবে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ডোরাল্ড আমি তোমার বিষয় কিছুই জানি না কেন?
ডোরাল্ড চমকে উঠল, সে কি আমি তো সব বলেছি। নর্দাম্বারল্যাণ্ডে ছেলেবেলা, তারপর সাউথ আফ্রিকা সেখান থেকে কানাডা সেখানেই সাফল্য লাভ করেছি।
অ্যালিকস এবার ঠাট্টা করে বলল, এতদিন বিয়ে না করে প্রেম নিশ্চয়ই করেছ।
ডোরাল্ড গম্ভীর হয়ে বলল, একজনকেই আমার ভালো লেগেছিল কিন্তু তার সঙ্গে প্রেমের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ডোরাল্ড জিজ্ঞাসা করল, আজ রাত্রেই তোমার এসব বাজে কথা মনে হলো কেন? কে জানে? আমার মনে হচ্ছে সবাই যেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
সবাই বলতে? এই যে বড় জর্জ বলল, কাল নাকি আমরা লণ্ডন যাচ্ছি। তারপর কটেজটা নাকি দু-হাজার পাউণ্ডে কেনা হয়েছে?
ডোরাল্ড ভীষণ রেগে গেল। চিৎকার করে বলল, লোকটা আস্ত বোকা আমি জানি লণ্ডন ওর কাছে খারাপ শহর, তাই চটাবার জন্য ওকে বলেছিলুম। আর এমসকে যখন টাকা দিচ্ছিলাম তখন ও হাজির ছিল। মিঃ এমসকে এক হাজার পাউণ্ড ক্রস চেকে দিয়েছি সেটা ও জানে না। আমাদের ব্যাপারে ও নাক গলায় কেন?
যাকগে বুড়ো হয়েছে তো! যেতে দাও। নটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি আমি কিন্তু ডার্করুমে যাচ্ছি না।
আমিও যাব না। ডোরাল্ড বলল।
মেয়েরা কত কি ভাবে? তারপর স্বামীর সাথে শোবার পর সব মেঘ সরে গেল।
পরদিন সকালটা বেশ ভালো রোদে ঝলমল দিন। বাগানে সব গাছে ফুল ফুটেছে। সারাদিন কাজ করল। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই ঘাড়ে আবার ভূত চাপল ডিকের সেই কথা খালি মনে পড়ল। তার স্বামীকে সন্দেহ হলো আবার অজানা নারীর প্রতি হিংসা ও ঘৃণা জন্মাল। সে ভাবল পুরুষদের সে হাড়ে হাড়ে চেনে। জর্জের কথা শুনে সে সেদিন অত রেগে গেল কেন? তারপর একদিন কিছু কেনাকাটার জন্য গ্রামে যাবার দরকার কিন্তু ডোরাল্ড অ্যালিকসকে না যেতে দিয়ে সে নিজে গেল। সে ভাবতে বসল ডোরাল্ডের এত জেদ কেন? তাহলে তার স্বামী কি তাকে সন্দেহ করছে ডিককে নিয়ে? অ্যালিকসের মাথার ভেতর যেন একটা পোকা ঢুকেছে কিছুতেই তাকে তাড়ানো যাচ্ছে না। এইসব ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল। ডোরাল্ডের বাড়ি ফিরতে দেরি আছে।
এক কাজ করা যাক, ওর রাইটিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখা যাক যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি, ব্যাঙ্কের বই ইত্যাদি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ সব থেকে নীচের ড্রয়ারে একটা বড় খাম পেল তাতে অনেকগুলো ক্লিপিং পেল।
চার্লস ল্যামেটার নামে বিখ্যাত এক নারী হন্তাকারীর বিচার সংক্রান্ত। সে ধনী বিধবা ডিভোর্সী রমণীকে বিয়ে করত। তারপর সুযোগ বুঝে খুন করে ফেলত। প্রমাণ অভাবে সে খালাস পেয়ে যেত। ল্যামেটার ছবি ছাপা হয়েছে। তার লম্বা দাড়ি, খাড়া নাক, জ্বলজ্বলে চোখ কিন্তু মানুষটার ভুরু জোড়া, চোখ আর নাক যেন ডোরাল্ডের মতো, দাড়ি কামালেই আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে।
তাহলে ল্যামেটার আমেরিকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে ডোরাল্ড মার্টিন সেজে বসে নেই তো! সর্বনাশ এখন কি হবে? বুধবার রাত্রি নটায় সে বেঁচে গেছে।
না এখানে আর থাকা চলবে না কিন্তু সে পালাবার আগেই ডেরাল্ড ফিরে এসেছে।
জানালা দিয়ে দেখল ডোরাল্ডের হাতে সদ্য কেনা নতুন একটা বেলচা। তার শরীর বেলচা দেখেই হিম হয়ে গেল তখন সে উদভ্রান্তের মত নীচে নেমে এল কিন্তু ডোরাল্ড তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, আমি রাস্তায় একটু বেড়িয়ে আসি।
তোমার কিছু একটা হয়েছে, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
অ্যালিকস বাধা দিল না, দুজনে রাস্তায় কিছুক্ষণ বেড়িয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফেরার পর ডোরাল্ড অ্যালিকসের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে লাগল। সে রাত্রে কোনো রকমে সাপার শেষ করল। তারপর অ্যালিকস মনে সাহস নিয়ে ভাবল, সে আজ রাত্রে এই বাড়িতে কিছুতেই এই খুনীর সাথে থাকবে না। সে সুযোগ বুঝে ডিককে ফোন করবে।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ডোরাল্ড বলল, আজ নটা বাজলেই আমরা কিন্তু ডার্করুমে ঢুকব।
প্লিজ ডোরাল্ড আজ আমি ক্লান্ত আমায় মাপ কর তুমি, একা ম্যানেজ কর।
বেশিক্ষণের কাজ নয়, তুমি দেখো তোমার মাথা ধরবে না।
অ্যালিকস ভয় পেয়ে গেল, সে উঠে দাঁড়াল। আমি একটা বুচারকে ফোন করে আসি। অ্যালি তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে ট্রাভেলাস আমর্স-এর নম্বর বলল। মিঃ উইণ্ডিপোর্ডকে চাইল। ধরুন, ঠিক সেই সময়ে ডোরাল্ড ঘরে ঢুকল। অ্যালিকস বিরক্ত হলো।
কিন্তু ডোরাল্ড ঘর থেকে বেরোলো না, সে একটা বই মুখে দিয়ে বসে রইল।
এদিকে অ্যালিকস যতটা সম্ভব চালাকি করে আসল কথাটা জানিয়ে দিল।
সে বলল, ফিলোমেনা কটেজ থেকে কথা বলছি প্লিজকাম, ব্রিজটিপে এবং ছেড়ে সে কথা বলল যত শীঘ্র সম্ভব লাইফ অর ডেথ।
অ্যালিকস রিসিভার নামিয়ে রাখল। ডোরাল্ড তার বই রেখে বলল, বাঃ তুমি তো বেশ বুচারের সঙ্গে কথা বললে। ডোরাল্ড জিজ্ঞাসা করল, মাথা ধরা ছেড়েছে?
হা ছেড়েছে।
দুজনে আবার বসল। ডোরাল্ড সেই বইখানা পড়তে লাগল আর অ্যালিকস তার জামায় বোম বসাতে লাগল।
দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে একটা শব্দ হতেই ডোরাল্ড বলল, সাড়ে আটটা বাজল। চল অ্যালিকস আমরা ডার্করুমে যাই।
না, নটার সময় যাব।
কিন্তু আমার টাইম যে সাড়ে আটটা।
আজ আমার ভালো লাগছে না। তা বললে চলবে না তোমায় যেতেই হবে। অ্যালিকস এবার বুদ্ধি খাটাল যেভাবে হোক ওকে নটা পৰ্য্যন্ত আটকাতে হবে কারণ ডিক আসতে অন্তত আধঘন্টা লাগবে। কিন্তু ডোরাল্ড অ্যালিকসকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ডার্করুমের দিকে চলল।
অ্যালিকস ভয় পেয়ে চীৎকার করে আবার থেমে ডোরাল্ডকে জরুরী কথা বলার অছিলায় ঘরে নিয়ে গেল।
তারপর সে বলল, আমি আমার বিষয় তোমাকে কিছুই বলিনি। আমি আগে দুবার বিয়ে করে ছিলুম। আমি যাকে বিয়ে করি তার বয়স আমার ডবল তার নামে দুহাজার পাউণ্ডের ইনসিওরেন্স করাই যাতে সে মারা গেলে টাকাটা আমি পাই। তাছাড়া আমি একটা হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে কাজ করতুম সেখান থেকে তীব্র বিষ সংগ্রহ করি। বিষটার নাম হয়োসিন। কফির সাথে এক চিমটে মিশিয়ে দিলেই মানুষ একমিনিটে মরে যাবে। কিন্তু পোস্টমর্টেম করলে বিষের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে না।
আমি সেই লোকটিকে কফির কাপে এক চিমটে বিষ মিশিয়ে দিয়ে দেখি লোকটি কিভাবে মরে। এক চুমুক খাবার পর দেখি লোকটি শুধু বলল, আমার শরীর কেমন করছে ব্যস এই তার শেষ কথা।
তার টাকাগুলি হাতিয়ে আবার অন্যগ্রামে গিয়ে পরিচয় গোপন করে অন্য এক ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করলুম। তবে এবারে বেশী টাকা পাইনি তবে লোকের সহানুভূতির জোরে এই টাইপিস্টের কাজটা যোগাড় করি।
ঘড়িতে ঠিক নটা বাজে। ডোরাল্ড চীৎকার করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শয়তানী তুই তাহলে আমাকে কফিতে বিষ মিশিয়েছিস? ও মাইগড!
অ্যালিকস উঠে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছোরাল্ডকে বলল, হ্যাঁ লামেটার আমি তোমার কফিতে বিষ মিশিয়েছি। তুমি একাই মানুষ খুন করতে পারো?
ডোরাল্ড কি বলতে লাগল কিন্তু তার কথা গলায় আটকে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে গেট খোলার আওয়াজ হলো। ডিক আসছে সঙ্গে একজন পুলিশ ম্যান।
ডিক বলল, কি হয়েছে মাই লিটল গার্ল। অ্যালিকস থর থর করে কাঁপছে। ঘরে গিয়ে ডিককে দেখতে বলল। ডিক দেখলো চেয়ারে একজন লোক বসে রয়েছে। কিন্তু সে মৃত।