১. ভোরে ওঠার ব্যাপার

সেভেন ডায়ালস মিস্ট্রি

ভোরে ওঠার ব্যাপার

 হাসিখুশী জিমি থেসিজার আজও দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য দুটো সিঁড়ি টপকে প্রায় লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে ঢুকতেই ধাক্কা খেলো বাটলার ট্রেডওয়েলের সঙ্গে।

ঘরে তখন কেবল বসেছিলেন গৃহকত্রী লেডি কুট। তার মুখে বিরক্তির ছাপ। দেরি করে প্রাতঃরাশ সারা তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। বিয়ের প্রথম দশ বছর স্যার অসওয়াল্ড কুট প্রাতঃরাশ আটটার আধ মিনিট দেরি হলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। সেই থেকে এটা একটি নিয়মের মধ্যে হয়ে গেছে। দেরি করে প্রাতঃরাশ করা লেডি কুটের কাছে মারাত্মক অপরাধের সামিল।

খুব অল্প বয়সে লেডি কুট ছিলেন ভারী সুন্দর। ভারিক্কি গুরুগম্ভীর চেহারা। স্বামী-স্ত্রীর সুখেই দিন কেটেছে। অসওয়াল্ড কুটের যখন ধীরে ধীরে উন্নতি হলো তখন সারা ইংল্যান্ডের মধ্যে বিখ্যাত এই চিমনি নামের প্রাসাদটি দুবছরের জন্য ভাড়া করলেন। স্যার অসওয়াল্ড বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন–মার্কুইস অব কেটারহ্যামের কাছ থেকে। তার পরেই তার আশা-আকাঙ্ক্ষায় যবনিকা পড়েছে।

লেডি কুট যেন একাকীত্বে ভোগেন, প্রথমে তার সময় কাটতো মেয়ের সঙ্গে কথা বলে। এখন তো অনেক লোক। পাত্রীর মত বাটলার, বাড়ির দেখাশোনার জন্য বিশাল দেহের এক মহিলা, ফাইফরমাস খাটার জন্য বেশ কয়েকজন চাকর। তিনি যেন বানের জলে দ্বীপে আটকা পড়া একজন।

চেয়ার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন লেডি কুট। জিমি থেসিজার হাঁফ ছেড়ে খাওয়ায় মন দিলো।

খাওয়া শেষ করে জিমি এসে দাঁড়ালো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা লেডি কুটের পাশে।

–বাকিরা কোথায় গেল? নৌকা চড়তে? জিমি জানতে চাইলো

–সম্ভবতঃ তাই। দ্বিতীয় প্রশ্নের অপেক্ষায় না থেকে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

সামনে ট্রেডওয়েলকে দেখে জানতে চাইলেন, মিঃ ওয়েড প্রাতঃরাশ করতে নিচে নেমেছেন কিনা? আদৌ নামবেন কিনা সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করলেন।

নিশ্চয়ই মাদাম। উনি নামবেন। ট্রেডওয়েল জবাব দিলো। গতকাল উনি সাড়ে এগারোটায় নেমেছিলেন।

এই মুহূর্তে চশমাপরা এক যুবক ঘরে এসে ঢুকলো।

লেডি কুট দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলেন।

অন্য দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে স্যার অসওয়ার্ল্ডের প্রাইভেট সেক্রেটারি রিউপার্ট বেটম্যানের সঙ্গে জিমির দেখা হয়ে গেলো। ও একটু মাথা ঝাঁকিয়ে লাইব্রেরির দিকে চলে গেল। বেটম্যানের ডাকনাম পঙ্গো।

জিমি অলস পায়ে লেকের দিকে এগোতেই তিনজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। হেলেন, যার স্বভাব-কথায় কথায় হেসে ফেলা, দ্বিতীয় জন হলো ন্যান্সি, বাকি মেয়েটিকে শকস নামে ডাকা হয়।

-হ্যালো জিমি। ন্যান্সি বলে উঠলো। কিন্তু সে কোথায়?

–এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি জেরি ওয়েড? কিছু একটা না করলেই নয়। বিল এভারসলে বলে উঠলো।

–এরপর কোনদিন দেখবে ওর সকালের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফোড়ন কাটলো রনি ডেভোরো।

–চলো ওকে বিছানা থেকে চ্যাংদোলা করে টেনে তুলি। বিল প্রস্তাব দিলো।

তার চেয়ে ওর গায়ে কবালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিলে কেমন হয়? জিমি মত প্রকাশ করলো।

কিন্তু ঠিক কি করা উচিত সেটা ওরা ভেবে ঠিক করতে পারলো না। সবাই মিলে এলো পঙ্গোর কাছে। সে এই দিকেই এগিয়ে আসছিলো।

সমস্যাটা গম্ভীর মুখে শুনে পঙ্গো বললো–ঘুম ভাঙাতে যার জুড়ি নেই সেই অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ি চাই। পঙ্গো অপেক্ষা না করে চলে গেল।

পঙ্গোর কথাটা সকলের মনে ধরলো। তার মানে একডজন ঘড়ি লাগবে জেরির ঘুম ভাঙাতে। বিল আর রনি ঘড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়তেই জিমি খাওয়ার ঘরে উঁকি মেরে দেখলো, জেরি গোগ্রাসে মার্মালেড আর টোস্ট খাচ্ছে। কিন্তু ও যাতে ওদের দলে এসে না ভেড়ে তার পরিকল্পনা শুরু হলো আবার।

আলোচনা অনুযায়ী ওরা লেডি কুটকে সব জানালো

-জেরিকে নিয়ে তোমরা মজা করতে চাও? বেশ, কিন্তু দেখো, কোনো জিনিসপত্রের কোনো ক্ষতি যেন না হয়, সামনের সপ্তাহে লর্ড কেটারহ্যামকে বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। লেডি কুট বললেন।

-না না, আপনি চিন্তা করবেন না। বিল বলে উঠলো। লর্ড কেটারহ্যামের মেয়ে বান্ডল ব্রেন্ট আমার খুব বন্ধু।

জেরি ওয়েড প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে এলো।

 সুপ্রভাত লেডি কুট। জেরি বললো, বাকিরা কোথায়?

–মার্কেট বেসিং-এ গেছে। নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন লেডি কুট।

এই সময় সেখানে?

–মজা করতে।

 –এত সকালে মজা, আশ্চর্য।

–এখন আর সকাল নেই, আর…

–আজ আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। একটু হেসে জেরি বললো, তাই বলে আমি কুড়ে নই। সকাল এগারোটাতে আমাকে পররাষ্ট্র দপ্তরে হাজির হতে হয়।

এদিকে দোকানদার বেশ কয়েকটা অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির প্রয়োজন জেনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।

দোকানের মালিক মিঃ মার্গাটরয়েড ওদের বোঝালেন একটু দামী জিনিষই ভালো।

–না, আমাদের দামী জিনিষের প্রয়োজন নেই। কাজে লাগলেই হলো। ন্যান্সি বললো।

–কেবল একদিনের জন্য দরকার। হেলেন বলে উঠলো।

 জিমি সবকটা ঘড়ি অ্যালার্ম দিয়ে একসঙ্গে বাজাতে শুরু করলো। সেই আওয়াজ কান পাতা দায় হয়ে উঠলো।

ঘড়িগুলো পকেটে নিয়ে সবাই ফিরে এলো।

.

অ্যালার্ম ঘড়ি নিয়ে

ইতিমধ্যে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকেছে।

ব্রিজ খেলতে বসেছেন স্যার অসওয়াল্ড, তার পার্টনার হলেন রিউপার্ট বেটম্যান। অন্যদিকে লেডি কুট ও জেরি ওয়েড। মাঝে মাঝে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল, দুটো নো ট্রামস, ডাবল, তিনটে ইস্কাবন..ইত্যাদি।

অন্যদিকে জেরির ঘরে ঘড়িগুলি লুকিয়ে রাখার তোড়জোড় চলছে। সেই সঙ্গে চলছে চাপা হাসির মস্করা।

এবার শুরু হলো ঘড়িগুলি কিভাবে রাখা হবে এবং কটার সময় অ্যালার্ম দেওয়া হবে তার জল্পনা-কল্পনা। অনেক তর্কবিতর্কের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সাড়ে ছটা থেকে পর পর অ্যালার্ম বাজতে শুরু করবে।

কারো এদিকে এগিয়ে আসার আওয়াজ পেয়ে সকলে সচকিত হলো।

–ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জিমি বললো, পঙ্গো আসছে।

এবার সকলে পঙ্গোকে চেপে ধরলো; উপায় বলে দেওয়ার জন্য।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পঙ্গে বললো, অতগুলো ঘড়ির একসঙ্গে টিকটিক শব্দ শুনে জেরি আগেই ধরে ফেলবে।

শেষে স্থির হলো, জেরি ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি ওর ঘরে ঢুকে ঘড়িগুলি মেঝেতে বসিয়ে দিলেই চলবে।

অন্যদিকে ব্রিজ খেলা বেশ পুরোদমে চলছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় বসেছেন স্যার অসওয়াল্ড ও লেডি কুট। অন্যদিকে জেরি ওয়েড আর বেটম্যান।

-তোমাকে কতবার বলেছি, লিড দেওয়ার সময় অত সময় নেবে না।

স্যার অসওয়াল্ড তখন ডামি। তার কথা বলা উচিত নয় জেনেও লেডি কুট মুখে কিছু না বলে একটু হাসলেন।

–আবার আমিই জিতলাম।

 হাতের তাস নামিয়ে রেখে লেডি কুট বাজির টাকা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হলেন।

রাত সাড়ে বারোটায় শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার ঘরের দিকে এগোলেন। জেরি ওয়েডের পাশে রনি ডেভোনোর ঘর। ততক্ষণে ষড়যন্ত্রকারীরা নৈশ-পোশাক পরে জমা হয়েছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ফিসফিসানি আর চাপা হাসি।

-ওর ঘরে কুড়ি মিনিট আগে আলো নিভেছে। জেরির ঘরে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল রনির ওপর–এখন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

পঙ্গোর ওপর দায়িত্ব পড়লো ঘরে ঢুকে ঘড়িগুলো রেখে আসার। কারণ পঙ্গে বেড়ালের মত নিঃশব্দে চলতে পারে। তাছাড়া ধরা পড়ে গেলে সামলে নেওয়ার কায়দাও সে জানে।

অবশেষে একটি একটি করে আটখানা ঘড়ি পঙ্গো জেরির ঘরে যথাস্থানে বসিয়ে রেখে চলে এলো। জেরি তখন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে।

.

যে মজা ব্যর্থ হলো

বেলা বারোটার সময় জেরি ওয়েডের দেখা পাওয়া গেল না।

ব্যাপারটা মজার হলো না মোটেও। ঠিক ভোর সাড়ে ছটায় এক এক করে আটটা ঘড়ির আলার্ম বেজে উঠলো। রানি এগিয়ে শিগগির দরজায় কান পাতলো।

কোনো সাড়াশব্দ নেই ঘরে। আটটা অ্যালার্ম ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দেবার ক্ষমতা জেরির আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আবার মিটিং বসলো।

মনে হয় কানের কোনো রোগ আছে। ওর ডাক্তার দেখানো উচিত।

—আমার মনে হয়, ওর ঘুম ঠিকই ভেঙেছে, শকস বলে উঠলো। কিন্তু ও আমাদের সেটা বুঝতে দিয়ে চায় না।

-আচ্ছা, পঙ্গো ঘড়িগুলো কোথায় রেখেছিলে? রনি জানতে চাইলো।

–ওর কানের কাছে একটা ছোট টেবিলের ওপর।

-আমি হলেও তাই করতাম। কিন্তু অন্য কেউ হলে কি করতো? রনি সংশয় প্রকাশ করলো। এবার বোঝা যাচ্ছে, সত্যিই ওর কানে কোনো অসুখ আছে।

এ সময়ে ঘরে ঢুকলো ট্রেডওয়েল। জিমি আর রনির দিকে তাকাতেই ওরা উঠে এলো বাইরে।

–কি ব্যাপার, ট্রেডওয়েল? রনি প্রশ্ন করলো।

–মিঃ ওয়েড এখনও নিচে নামেননি দেখে উইলিয়ামকে উপরে পাঠিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে উইলিয়াম ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলো। ট্রেডওয়েল কপালের ঘাম মুছলো। মনে হয় মিঃ ওয়েড ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন?

–কি যা তা বলছো? রনি ধমকে উঠলো। উইলিয়াম একটা গণ্ডমূর্খ। দাঁড়াও আমি গিয়ে দেখে আসছি।

ট্রেডওয়েল তার যাওয়ার পথ আটকে দিলো। বললো, ঘরের দরজা এখন বন্ধ, ডাঃ কার্টরাইটকে খবর দিয়েছি। এখন স্যার অসওয়াল্ডকে জানাতে হবে। তার আগে বেটম্যানকে প্রয়োজন।

ট্রেডওয়েল চলে যেতেই রনি বিড়বিড় করে উঠলো–জেরি…

 জিমির ধারনা ছিল না, রনির সঙ্গে জেরির বন্ধুত্ব কত গভীর ছিল।

ঘড়ির ব্যাপারটা বিশ্রী লাগছে। জিমি উত্তর দিল। একটা মজা করতে গিয়ে সেটা এমন মর্মান্তিক ব্যাপারে দাঁড়াবে সেটা কে জানতো।

রনি তখনও নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি।

–কি করে জেরি মারা গেল সেটা জানতে চাই।

–হয়তো হার্টের ব্যাপার। জিমি ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বললো।

 এমন সময় ট্রেডওয়েল ঘরে এসে ঢুকলো।

-স্যার, আপনাদের দুজনের সঙ্গে ডাক্তারবাবু কথা বলতে চান।

ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল।

পঙ্গো ডাক্তারের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। ডাঃ কার্টরাইট, রোগা চেহারার অল্পবয়সী মানুষ। চোখে বুদ্ধির ছাপ।

রনিকে লক্ষ্য করে ডাক্তার বললো–আপনি তো মিঃ ওয়েডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু?

-হ্যাঁ, ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।

–আচ্ছা, আপনি কি জানেন আপনার বন্ধু ঘুমের জন্য বড়ি ব্যবহার করতেন?

রনি যেন আকাশ থেকে পড়লো।ঘুমের ওষুধ। ও তো নাক ডেকে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোত।

–অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ ব্যাপার। ওর পাশে ওষুধের বোতল ও গ্লাস পাওয়া গেছে। অত্যাধিক বেশি মাত্রায় ক্লোরাল পান করার ফলে ওর মৃত্যু ঘটেছে।

–এই মৃত্যুর পেছনে কারো কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না?

 কথাটা জিমি বলতে চেয়েছিল। তার আগে রনি সন্দেহ প্রকাশ করলো।

ডাক্তারের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।-কেন, সন্দেহের কিছু আছে নাকি? নাকি মনে করেন যে এটি একটি আত্মহত্যা?

-না, ওসব কিছু নয়।

ডাক্তার ঠিক খুশী হতে পারলেন না রনির জবাব শুনে–ওর নিকট আত্মীয় থাকলে তাকে খবর দিন।

-হ্যাঁ, ওর এক সৎ বোন আছে। এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে। শহরে না এলে জেরি ওখানেই থাকতো।

-বেশ, তাকে জানান।

রনির ব্যবহারে জিমি একটু অবাক হলো। ও যদি কিছু সন্দেহ করে থাকে সেটা প্রকাশ করছে না কেন?

দুজনে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লো। পথে যেতে যেতে রনি বললো–জিমি, এখন থেকে তুমি আমার প্রিয় বন্ধু। তাই তোমকে কিছু কথা বলতে চাই। সেটা তোমার জেনে রাখা প্রয়োজন।

জিমি একটু বিস্মিত হয়ে বললো–জেরি ওয়েড সম্পর্কে?

–হ্যাঁ, আমি শপথ করেছিলাম কাউকে বলবো না বলে। কিন্তু তবু বলতে হবে কারণ তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখো।

বেশ বল।

হঠাৎ রনি চেঁচিয়ে উঠলো-না, আমি পারবো না।

জিমি ওকে বলার জন্য অনুরোধ করলো না। ডিন প্রিয়রি পৌঁছনো পর্যন্ত ওরা চুপ করে রইলো। খবর পেলো জেরির বোন জিম লোরেন বাগানে আছেন।

ওরা পায়ে পায়ে সেই দিকে এগোলো।

দুটো কালো স্প্যানিয়েলের সঙ্গে ফর্সা ছোটখাটো চেহারার একটু পুরোনো টুইডের স্কার্ট পরা। একটি মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো।

জিমি দ্রুত কথা বলে উঠলো–এ হলো রনি ডেভেরো। জেরি নিশ্চয়ই ওর কথা বলেছে?

-হ্যাঁ, মিস লোরেন জবাব দিল। আপনাদের সঙ্গে জেরি এলো না কেন?

মিস ওয়েড, একটা দুঃসংবাদ আছে।

লোরেন সতর্ক হয়ে উঠলো। অস্থির ভাবে জিজ্ঞাসা করলো, ওর কি হয়েছে? বলুন, চুপ করে থাকবেন না। ও রনির দিকে তাকালো, আপনি বলুন।

-জেরি মারা গেছে।

 কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠলো লোরেন, তার চোখে সপ্রশ্ন ব্যথা।

রনির মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে লোরেন বললো, জেরি ঘুমের ওষুধ খেয়েছে? অবিশ্বাস ঝরে পড়লো ওর কথায়।

মিস লোরেন, ওদের সঙ্গে আসতে চাইলো না। ওরা আবার চিমনিতে ফিরে এলো।

লেডি কুট বারবার চোখ মুছছিলেন।

 জেরির ঘর থেকে রনিকে বেরোতে দেখে জিমি অবাক হলো।

–একবার ওকে দেখে এলাম। রনি বললো, শেষ সম্মান জানানো উচিত।

মন না চাইলে রনির সঙ্গে জিমি ঢুকলো জেরির ঘরে।

শ্বেত ফুলে ঢেকে আছে জেরির নিশ্চল দেহ। জিমির ভেতরটা একটু কেঁপে উঠলো। এই সেই জেরি ওয়েড।

ঘড়িগুলো পরপর সাজানো রয়েছে। কিন্তু আটটার পরিবর্তে সাতটা। আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা ঘড়ি কোথায় গেল?

.

একখানা চিঠি

–যারা নিজের ক্ষমতায় বড় হয় তারা প্রচুর টাকা করতে পারে। লর্ড কেটারহ্যাম শান্ত ভাবে বললেন।

বাবার কথা শুনে মেয়ে লেডি এইলিন ব্রেন্ট, বন্ধুদের কাছে যে বান্ডল নামে পরিচিত, হেসে উঠলো।

–তোমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তবে বুড়ো কুটকে জায়গাটা ভাড়া দিয়ে ভলোই লাভ করেছে।

-হ্যাঁ, তবে লোকটা ভীষণ বিরক্তিকর। আমার ওরকম লোক পছন্দ হয় না।

–এরকম লোক না হলে তোমার ঐ ভাঙাচোরা বাড়িটার জন্য এত টাকা পেতে?

–আঃ, জ্বালাতন করিস না। আগের ঘটনা মনে পড়ে যায় লর্ড কেটারহ্যামের। একজন অচেনা লোক তাই বলে আমার বাড়িটা মৃত্যুর জন্য বেছে নেবে? এই নিয়ে দুবার হলো। চারবছর আগের ঐ ঘটনার জন্য অবশ্য জর্জ লোম্যাক্স দায়ী।

তবে এবারে দোষ পড়লো স্টিম রোলার কুটের ওপর। অবশ্য এটা আগের মত খুন নয়।

–ঐ তো মোটা ইনসপেক্টর যেমন ভাব করছিলেন যে মনে হচ্ছিল, এখানে যত মানুষ মরে সবগুলোই খুন। আমি ট্রেডওয়েলের কাছ থেকে সব শুনেছি।

জেরি ওয়েডকে আমি একবারই দেখেছি। ভারি হাসিখুশী ছেলে। বান্ডল বললো, ওকে কেউ খুন করবে ভাবতেই পারি না।

-কিন্তু ঐ গাধা ইনসপেক্টরের গবেট মাথায় সেটা তো ঢুকছে না।

বান্ডল উঠে পড়ল–যাই, ম্যাকডোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

বাগানে ম্যাকডোনাল্ডের মুখোমুখি হলো বান্ডল–ম্যাকডোনাল্ড, আমার এক থোকা আঙুর চাই, আধপাকা হলেও চলবে।

সে আবার ঘরে এসে ঢুকলো।

-আচ্ছা বাবা, লেডি কুটকে কেমন লাগে তোমার?

–অনেকটা মিসেস সিডন-এর মতো। ঐ ঘড়ির ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। বান্ডল ঘড়ির ব্যাপারটা জানত না। তাই তাকে বুঝিয়ে সব বললো।

-বান্ডল একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, লর্ড কেটারহ্যাম বললেন। ছেলেটা তোর ঘরে মারা যায়।

বান্ডল মুখ কুঁচকে নিলো-কেন যে লোকে আমার ঘরে মরে।

নিজের ঘরে সন্ধ্যেবেলা আগুনের সামনে বসে বান্ডলের বারবার জেরি ওয়েডের কথা মনে পড়লো।

তাকের দিকে চোখ যেতেই ঘড়ির কথা মনে পড়লো। ওর পরিচারিকার মুখে শুনেছে, সাতটি ঘড়ি ছিল, একটি ঘড়ি বাগানের ঝোপে পাওয়া গেছে। বাগানের মধ্যে ঘড়ি আসবে কি করে? তবে কি জেরি প্রথমটির অ্যালার্ম শুনে বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল বাগানের দিকে। ব্যাপারটা খুব ভাবিয়ে তুললো বান্ডলকে। না, এ ব্যাপারে বিল এভারসলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সে লেখার টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো। কি মনে করে ডেস্কের তলার দিকটা টানলো। কিন্তু আটকে গেল। একটা ছুরি দিয়ে চাপ দিতেই একটু ফাঁক হলো। একটা কাগজের অংশ দেখতে পেয়ে টেনে বের করলো। একটা চিঠি।

২১ শে সেপ্টেম্বর, চিঠির তারিখটা দেখে বান্ডলের চোখ ঐখানেই আটকে রইলো, তার মানে জেরি যেদিন মারা যায় তার আগের দিন চিঠিটা সে লিখেছে। চিঠিটা সম্পূর্ণ লেখা হয়নি।

সে চিঠিটা পড়তে লাগলো।

আমার প্রিয় লোরেন,
আগামী বুধবার আমি তোমার কাছে যাচ্ছি। বেশ আছি। খুব মজা হবে। আর সেই সেভেন ডায়ালের যে কথা বলছিলাম সেটা ভুলে যেও। ব্যাপারটা ঠাট্টা মনে করে তোমাকে বলেছিলাম। কিন্তু সে ধারণা আমার নষ্ট হয়েছে। তুমি কিছু মনে করো না। তোমার মত ছোটদের এই ধরনের ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত নয়।

ভীষণ ঘুম পেয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও আর লিখতে পারছি না।

ঐ লার্চারের ব্যাপারে আমার ধারণা…

সেভেন ডায়ালস। জায়গাটা কোথায়? মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু বান্ডল পারলো না। তার মানে চিঠির কয়েকটা কথা খচখচ করে বিধতে লাগলোবেশ আছি, ভীষণ ঘুম পেয়েছে কথাগুলো খাপ খাওয়াতে পারছে না বান্ডল। চিঠির কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে ঘুমের ওষুধ খাবে কেন?

নিঃস্তব্ধ ঘরে বান্ডল বসে ভাবছে। কেবল শোনা যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দ। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বান্ডল একটু কেঁপে উঠলো।

.

পথের সেই লোকটি

বান্ডল তাড়াহুড়ো করে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলো। তাড়াহুড়ো করা তার স্বভাব। এতে যে বিপদে পড়েনি কখনোও তা নয়। অবশ্য সে ভালো গাড়ি চালায়।

অক্টোবর মাস। রোদ্দুর ঝলমল করছে। বান্ডল তাই যেন চঞ্চলতায় মুখর।

জেরি ওয়েডের অর্ধসমাপ্ত চিঠির সঙ্গে দুলাইন লিখে সকালেই লোরেনের কাছে সে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার সে বিল এভারসেলের সঙ্গে দেখা করে সেদিনের পার্টির সব কথা জানবে।

মাইলের পর মাইল পার হলো বান্ডলের হিসপানো। বান্ডল নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল।

হঠাৎ একটা লোক ঝোঁপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে টলতে টলতে রাস্তায় পড়লো। লোকটাকে বাঁচানোর জন্য বান্ডল প্রাণপণে ব্রেক কষলো। একটা নয়ানজুলির মধ্যে গিয়ে পড়তে পড়তে দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেলো বান্ডল। লোকটাকে বাঁচাতে পেরেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হলো।

কিন্তু পেছনে তাকাতেই তার চক্ষু বিস্ফারিত হলো। লোকটি চাপা পড়েনি ঠিকই, কিন্তু ধাক্কা খেয়েছে মনে হয়। নতুবা উপুড় আর স্থির হয়ে আছে কেন?

সে প্রায় ছুটে এলো লোকটির কাছে। তার বুকে তখন হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ হচ্ছে।

 লোকটাকে চিৎ করলো। সুন্দর চেহারার এক যুবক। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। বান্ডল নিশ্চিত যে লোকটা মারা গেছে বা মরতে চলেছে। এমন সময় লোকটির দুটি ঠোঁট নড়ে উঠলো। অস্ফুট স্বরে কিছু বলার চেষ্টা করলো। বান্ডল ঝুঁকে পড়লো একটু।

-সেভেন ডায়ালস…ওকে বললেন…

 বান্ডল আরো একটু কান নামিয়ে আনলোবলুন, কি বলবো?

–জিমি থেসিজারকে…বলবেন

লোকটির মাথা একপাশে হেলে পড়ে স্থির হয়ে গেল।

এরকম ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে সেটা জানা ছিল না বান্ডলের। একটা মানুষকে সে চাপা দিয়ে মেরে ফেললো। কিছুক্ষণের মধেই নিজেকে সংযত করল। লোকটা জ্ঞানও হারাতে পারে। সে লোকটাকে টানতে টানতে গাড়িতে তুললো।

দুমাইল পার হয়ে একটা ছোট শহরে একজন ডাক্তারের দেখা পেল।

ডাঃ ক্যাসল তার চেহারা দেখে একটু বিচলিত হলেন।

–মনে হয় আমি একজন লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি। বান্ডল বলে উঠলো।

 ডাক্তার তাকে ওখানে বসতে বলে নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকলেন। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এলেন।

-এবার বলুন তো, ঠিক কি ঘটেছে?

ডাক্তারের প্রশ্নে বান্ডল সব ঘটনা গুছিয়ে বললো।

-না, গাড়িটা ওর দেহের ওপর দিয়ে যায়নি। লোকটা কি টলছিল?

–হ্যাঁ, আমি মনে করেছিলাম, লোকটা মাতাল।

-লোকটাকে গুলি করা হয়েছে। তাতেই ওর মৃত্যু হয়।

.

 আবার সেভেন ডায়ালস

এতক্ষণে বান্ডল একটু ধাতস্থ হলো।

-কিন্তু ওকে কি করে কেউ গুলি করলো? বান্ডল জানতে চাইলো।

-সেটা বলতে পারবো না। ডাক্তার জবাব দিলেন। রাইফেলের বুলেট বিঁধেছে ওর শরীরে। ভিতরে রক্তপাত হয়েছে। আচ্ছা, ওর পেছন পেছন কেউ কি ছুটে এসেছিল?

–না, কাছাকাছি কাউকে দেখিনি।

–মারা যাওয়ার আগে কিছু বলেছে?

-খুব অস্পষ্ট ভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল। ও একজনকে কিছু বলতে বলেছিল। সেভেন ডায়ালস কথাটা সে বলেছিল।

-হুম। ডাক্তার একটু চিন্তিত হলেন, এই ধরনের মানুষের ওটা জায়গা নয়। মনে হয় খুনী সেখান থেকে এসেছিল। পুলিসকে জানানো দরকার। আপনি বরং আমার সঙ্গে থানায় চলুন।

পুলিশ ইনসপেক্টর বান্ডলের পরিচয় পেয়ে শিরদাঁড়া টান করে বসলো। তাকে বিস্তারিত জানানো হলো।

–মৃতের নাম জানেন? ইনসপেক্টর জানতে চাইল।

–ওর নামের কার্ড সঙ্গে ছিল। রনি ডেভেলরা। ঠিকানা আলবাম।

নামটি শুনে বান্ডলের ভুরু কুঁচকে গেল। নামটা নিশ্চয়ই আগে কোথায় শুনেছে।

.

 চিমনির কাছাকাছি আসতেই বান্ডলের পরিস্কার মনে পড়লো রনি ডেভেরো ছিল বিল আর জেরি ওয়েডের বন্ধু। পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করতো। এই মৃত্যুর পেছনে একটা রহস্যের গন্ধ পেল সে।

সেভেন ডায়ালস–শব্দ দুটি তাকে বার বার ভাবিয়ে তুললো। জেরির চিঠিতে এবং রনির মুখে এই শব্দটা সে পেয়েছে।

বাড়িতে ঢুকে সে সোজা বাবার কাছে এগিয়ে এলো। এই মুহূর্তে তাকে ভীষণ প্রয়োজন। লর্ড কেটারহ্যাম তখন বইয়ের নতুন একখানা ক্যাটলগ দেখতে ব্যস্ত ছিলেন।

পথে যা যা ঘটেছে সমস্ত সে তার বাবাকে শোনালো।

-বুঝলাম। লর্ড কেটারহ্যাম একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। যারা ঝামেলায় জড়াতে চায় তাদের কপালে ঠিক জুটে যায়।

-বাবা, সেভেন ডায়ালস কোথায় জানো?

 –সম্ভবতঃ ইস্ট এন্ডের কাছে। শুনেছি ওখানে বাস যায়। আমি কোনদিন যাইনি।

–তুমি জিমি থেসিজার নামে কাউকে জানো?

 লর্ড কেটারহ্যাম ক্যাটালগের দিকে চোখ রেখে বললেন, কোন থেসিজার? কত তো থেসিজার আছে। তোর ঠাকুরমার বাবা এক থেসিজারকে বিয়ে করেছিলেন।

-ওঃ, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। বিলকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

–সেই ভালো। লর্ড কেটারহ্যাম এবার ক্যাটালগের দিকে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন।

বান্ডলকে চলে যেতে দেখে তিনি আবার ডাকলেন, সেভেন ডায়ালস-এর কথাটা মনে পড়লো। জর্জ লোম্যাক্স এসেছিল। তুই তো ওকে চিনিস। পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি। আর ক্যাবিনেট মন্ত্রী। সামনের সপ্তাহে প্যারিতে কি একটা রাজনৈতিক সভা আছে। ও একটা চিঠি পেয়েছে, যাতে সাবধান এমন ধরনের কিছু লেখা আছে। চিঠিটা পাঠিয়েছে সেভেন ডায়াল। স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে যাবে পরামর্শ করতে।

বান্ডল অন্যমনস্ক হয়ে জেরির চিঠিটার কথা ভাবতে লাগলো। যতই ভাবলো ততই ওর মনে হলো, এ ধরনের চিঠি কোনো বোনকে লেখা সত্যিই আশ্চর্য।

-বাবা, জেরি ওয়েডের বোন লোরেন ওয়েডের কথা তুমি বলেছিলে। বান্ডল প্রশ্ন করলো।

-সত্যি কথা বলতে কি লোরেন ওর বোন নয়। ওয়েড দ্বিতীয়বার যে মহিলাটিকে বিয়ে করেছিলেন তার প্রথম স্বামীর মেয়ে লোরেন। লোকটি মেয়েকে দেখাশোনা করতো না। তাই ওয়েড তাকে বড়ো করে তোলে এবং তার পদবী দেয়।

-বুঝলাম। এবার সব পরিষ্কার হলো।

.

দেখা করলো বান্ডল

পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে বান্ডল সোজা এলো শহরে। ফোনের মাধ্যমে বিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। ওর ফোন পেয়ে বিল আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। সিনেমা বা রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু বান্ডল জানালো, সে খুব ব্যস্ত। কয়েকদিন পরে ওসব নিয়ে ভাববে।

–বিল, কাজের কথা শোন। জিমি থেসিজার নামে কাউকে চেনো?

–অবশ্যই চিনি। তুমিও চেনো।

–না, আমি চিনি না।

 –নিশ্চয়ই চেনো। গাধার মতো লালচে মুখ। তবে আমার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি ধরে।

–কি করে? বান্ডল জানতে চাইলো।

কাজকর্মের কথা বলছো? কিছু করে না। ঘোরা ওর চাকরি। আর চাকরি করার প্রয়োজন ওর নেই।

বান্ডল একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। জিমি থেসিজার কি তাকে সাহায্য করতে পারবে, অবশ্য মৃত লোকটি তার নাম-ই উচ্চারণ করেছিল।

রনি ওর বুদ্ধির প্রশংসা করতো। বিলের কণ্ঠ ভেসে এলো বান্ডলের কানে। রনি ডেভেরো, জিমি থেসিজারের প্রিয় বন্ধু।

বান্ডল বুঝলো, বিল এখনো রনির মৃত্যুর খবর জানে না। কোনো কারণে পুলিস হয়তো সেটা চেপে রেখেছে।

-রনির সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। সপ্তাহখানেক আগে তোমাদের বাড়িতে শেষ দেখা হয়েছিল। ঐ সময়ে বেচারী জেরি মারা গেল। বান্ডল, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছে।

রনির ব্যাপারটা ফোনে জানাতে চায় না বান্ডল।

–তুমি কি জিমি থেসিজারের ঠিকানা জানো?

জারমিন স্ট্রিট। একটু ধরো, নম্বরটা দেখে দিচ্ছি।

 খানিকক্ষণ নীবর রইলো ফোনের দু প্রান্ত।

-বান্ডল, নম্বরটা লিখে নাও। ১০৩, জারমিন স্ট্রিট। তুমি যে বললে ওকে চেনো না। তবে ওর ঠিকানা নিয়ে কি করবে?

চিনি না ঠিকই। তবে আধঘণ্টার মধ্যে চিনে নেবো। আর শোন, আগামীকাল রাতে ডিনারে তোমার সঙ্গে দেখা করছি।

বান্ডল ঘড়ি দেখলো। এগারোটা পঁচিশ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সে জারমিন স্ট্রিটের দিকে ছুটলো।

একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলো। তাকে বসবার ঘরে নিয়ে গেল। বড় ঘর। কয়েকটা সোফা রয়েছে। একটি সোফায় ছোটখাটো চেহারার কালো পোষাক পরে একটা ফর্সা মেয়ে বসে আছে।

বান্ডল লোকটিকে জানালো জিমি থেসিজারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। নাম তাকে না বললেও চলবে।

লোকটি ঘাড় কাত করে ভেতরে চলে গেল।

বান্ডল মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল। কারণ সে চায় না কোনো অপরিচিতার সামনে জিমির সঙ্গে কথা বলতে। সে মেয়েটিকে খুঁটয়ে দেখতে লাগলো। পরনে শোকের পোশাক। তবে কি এই মেয়েটিই সে?

বান্ডল সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন করলো, আপনি কি মিস লোরেন ওয়েড?

-হ্যাঁ, আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?

–আমি বান্ডল ব্রেন্ট। গতকাল আপনাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছি।

–ধন্যবাদ, জেরির চিঠিটা আমি পেয়েছি, কিন্তু আপনি এখানে?

–আপনি রনি ডেভোরোকে চিনতেন?

–হ্যাঁ, যেদিন জেরি–যাক, ও সেদিন এসেছিল। জেরির কাছের বন্ধু ছিল।

–সে মারা গেছে।

লোরেন হাঁ করে তাকিয়ে রইলো, বান্ডল গতকালের ঘটনার বিবরণ দিলো।

লোরেনের চোখে ভয়ের ছায়া–তাহলে গত একসপ্তাহ ধরে যা ভাবছিলাম তাই। জেরির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ওকে কেউ খুন করেছে।

-আপনারও ধারণা এইরকম?

কারণ জেরি ছিল ঘুম কাতুরে। তাকে ঘুমের জন্য ওষুধ খেতে হতো না। আপনার পাঠানো চিঠিটা নিয়ে রনির কাছে এসেছিলেন। ওকে না পেয়ে জিমির কাছে এসেছি। আমার এখন কি করা উচিত ওর কাছ থেকে পরামর্শ নেবার আশায়।

.

জিমির অতিথি

–স্যার, আপনার সঙ্গে একজন তরুণী দেখা করতে চাইছেন।

ঘুম জড়ানো গলায় জিমি বললো, কি বললে স্টিভেনস? আর একবার বলো।

–একজন অল্পবয়স্কা সুন্দরী তরুণী, স্যার। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

জিমি বিরক্ত হলো–কেন?

কারণ কিছু বলেননি। স্যার, এই চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আপনার জন্য আর এক কাপ আনছি।

স্টিভেনস খানিক বাদেই এক কাপ গরম চা এনে জিমির সামনে ধরলো।

দরজায় ঘন্টার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেল। ফিরে এসে বললো–স্যার, আর একজন মহিলা এসেছেন।

-কি? জিমি দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।

–নাম বলেন নি, জরুরী দরকার আছে বললেন।

–স্টিভেনস, কাল রাতে কটায় ফিরেছি।

–পাঁচটায়, স্যার।

-একটা কথা ভাবছিলাম আমি। গভর্নেসের জন্য আমি কি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। দু-দুজন তরুণী আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী।

পোশাক পরে তৈরি হয়ে জিমি বসবার ঘরে এসে ঢুকলো। অজানা অতিথিদের দিকে নজর বোলালো। সোফায় সে বসে আছে সে লোরেন। কিন্তু গাঢ় রোগাটে চেহারার ঐ তরুণী?

পরমুহূর্তেই লোরেনের কাছ থেকে সে তার প্রশ্নের জবাব পেলো।

–আমাকে দেখে অবাক হচ্ছো, তাই না? বিশেষ প্রয়োজনে আসতে হলো, আর ইনি হলেন লেডি এইলিন ব্রেন্ট।

–আমি বান্ডল নামে পরিচিত। এই নাম আপনি বিল এভারসলের কাছ থেকে শুনে থাকবেন।

–ও হ্যাঁ, শুনেছি। বসুন। বলুন কি ব্যাপারে এসেছেন? জিমি বললো।

–আগে জেরি, লোরেন বললো, এবার রনি। গতকাল কেউ ওকে গুলি করেছে।

কথাটা শুনে জিমি চিৎকার করে উঠলো। সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনলো বান্ডলের কাছে। সে চুপ করে সব শুনে গেল। বসে রইলো অনেকক্ষণ গুম হয়ে। একসময় মুখ খুললো।

একটা ব্যাপার আপনাদের জানা দরকার। যেদিন জেরি মারা যায়, লোরেন, সেদিন তোমার বাড়িতে খবর দিতে যাওয়ার সময় রনি একটা কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি, কারণ সে নাকি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।

আমি তাই ওর কাছ থেকে জানার আর চেষ্টা করিনি। তবে রনির মনে একটা সন্দেহ ছিল। ডাক্তারকেও সে সেটা বোঝাতে চেয়েছিল।

-রনির সন্দেহ ছিল, এটা আপনি এখনও মনে করেন? বান্ডল প্রশ্ন করল।

–হ্যাঁ, আমার ধারণা তাই। রনি একাই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছিল হয়তো। হত্যাকারী সেটা টের পেয়ে ওকেই খুন করেছে। ও নিশ্চয়ই আমাকে ঐ দুটো কথা বলতে চেয়েছিল।

-সেভেন ডায়ালস!

–আমাদের এগোতে হবে সেভেন ডায়ালসকে লক্ষ্য করে। জিমি জানালো।

এইবার লোরেন ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে জিমির হাতে দিলো, যেটি লোরেনকে উদ্দেশ্য করে জেরি ওয়েডের অর্ধসমাপ্ত লেখা, বান্ডল তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

চিঠিটা পড়ে নিয়ে জিমি বললো, আপনিই এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, আপনাকে কি ভুলে যেতে লিখেছিল?

লোরেন একটু বিহ্বল চোখে তাকালো–ঠিক মনে পড়ছে না। তবে একদিন আমি ভুল করে একটা খাম থেকে চিঠি বের করে ফেলেছিলাম। অশিক্ষিতের মত হাতের লেখা। বিশেষ কিছু লেখা ছিল না। ওপরে ছিল সেভেন ডায়ালসের ঠিকানা। আর কিছু নাম আর তারিখ। আমি ভয়ে না পড়ে ওটা আবার খামের মধ্যে রেখে দিই।

-কেবল নাম আর তারিখ? জিমিকে কেমন চিন্তিত দেখালো।

–জেরি কিছু মনে করেনি। ও কেবল জানতে চেয়েছিল, মাফিয়ার নাম আমি শুনেছি কিনা। ইংল্যান্ডে এরকম একটা মাফিয়া দল খুললে কেমন হয় আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। আমাদের দেশের অপরাধীদের কল্পনা শক্তির অভাব, এ কথাও বলেছিল।

-এবার বুঝতে পেরেছি। জিমি একটু উৎফুল্ল হয়ে বললো। প্রথমে জেরি ভেবেছিল ওটা একটা কোনো মজার ব্যাপার, পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে ওটা স্মরণে রাখতে নিষেধ করেছিল। তাহলে সেভেন ডায়ালস হলো ঐরকম কোনো দলের প্রধান কার্যালয়।

জিমি বান্ডলের দিকে তাকালো-আপনারা যা করার করেছেন। এবার আমার পালা। এ ব্যাপারে আপনারা আর এগোবেন না।

–আমার প্রিয় জেরিকে যারা খুন করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াবো না? লোরেন বলে উঠলো। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝতে পারছো।

-তাহলে আমরা কি ভাবে এগোবো? জিমি ওদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো।