সেভেন ডায়ালস-এর অধিবেশন
ভেতরে ঢুকে বান্ডল ভাবছে, হয়তো, এখান থেকে বেরোতে ছটা বেজে যাবে। খুব কষ্ট হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু কিছু করার নেই। হঠাৎ দরজার তালা খুলে গেল।
বৈদ্যুতিক আলোতে ঘর ভরে গেল। অনেক লোক যে ঘরে ঢুকেছে সেটা বান্ডল বুঝতে পারলো। দরজায় খিল দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলো।
একজন লম্বা, শক্তিশালী, কালো দাড়িওয়ালা মানুষকে বান্ডল ফুটো দিয়ে দেখলো যাকে গতরাতে জুয়ার টেবিলে দেখেছিল।
এই তাহলে সেই মিঃ মসগোরোভস্কি, ক্লাবের মালিক। উত্তেজনায় বান্ডলের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
লোকটি পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। মাথা দুলিয়ে পকেট থেকে আবার কি বের করলেন। তারপরের ব্যাপারটা বান্ডলের দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না।
পরক্ষণে লোকটি যখন দৃষ্টি বরাবর এলো তখন বান্ডল চমকে উঠলো, লোকটার মুখে একটা মুখোস। আলগা হয়ে চোখের ওপর পরদার মতো ঝুলছিল। অনেকটা ঘড়ির ডায়ালের মত মুখোসটা। ছটার দিকে ঘড়ির কাটা রয়েছে।
–সেভেন ডায়ালস! বান্ডল এবার নিশ্চিত।
দরজায় সাতবার টোকা মারার শব্দ।
বান্ডল যে আলমারির মধ্যে বসে ছিল তার পাশের চেয়ারে মসগোরাভস্কি বসলেন।
ঘরে এসে ঢুকলো দুজন, তাদরে প্রত্যেকের মুখে মুখোস, মুখোসে ঘড়ির কাঁটা চারটে আর পাঁচটায়। তাদের পোশাক ভদ্র অভিজাত সম্পন্ন।
এদের মধ্যে একজন বিদেশী। অন্যজনকে বান্ডল ফরাসি ভেবেছিল। কিন্তু কথা শুনে বুঝলো, অস্ট্রিয়ান বা হাঙ্গেরিয় হতে পারে। রাশিয়ান হবে হয়তো।
–এক নম্বর দারুণ সফল হওয়ায় আপনাকে ঝুঁকি নেবার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। ভদ্রলোক বললেন।
পাঁচটা কাঁধ ঝাঁকালেন।
ঝুঁকি না নিলে…
কথা শেষ হলো না। দরজায় আবার সাতটা টোকা পড়লো।
বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা শুনতে পেলো না বান্ডল। কারণ ওরা ওর দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল।
–আমরা তাহলে কাজ শুরু করতে পারি। রুশ ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
টেবিলের মাথায় যে চারটি ছিল সেখানে গিয়ে বসলেন। ফলে বান্ডলের একেবারে মুখোমুখি হলেন তিনি। তার পাশে বসে পাঁচ নম্বর। তৃতীয় চেয়ারটি বান্ডল দেখতে পাচ্ছে না। চার নম্বর আমেরিকান ভদ্রলোক।
টেবিলের ধারে দুটি চেয়ারই বান্ডলের নজরে পড়ছিল।
মসগোরোভস্কির উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন একজন, যার পেছনটা বান্ডলের দিকে। বান্ডল তার পেছনটাই ভালো করে দেখছিল। কারণ তিনি একজন মহিলা।
–আমরা আজ রাতে পাঁচ নম্বরের দেখা পাবো না। মহিলার সুরেলা বিদেশী ছোঁয়া লাগানো কথা শোনা গেল। আপনারা সত্যি করে বলুন তো কোনো কালে আদৌ ওর দেখা পাবো আমরা?
–চমৎকার প্রশ্ন। আমেরিকানটি বললো, বান্ডল সম্মোহিতের মতো মহিলার পিঠের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলো। ডানদিকের ঘাড়ের পাশে ছোট্ট একটা আঁচিল, ফর্সা চামড়ায় ওটা ঠিক মানাচ্ছে না।
রুশ ভদ্রলোকের কর্তৃত্বব্যাঞ্জক কণ্ঠস্বর শুনে বান্ডলের চমক ভাঙলো।
–যদি দুই নম্বর আমাদের আজ থাকতেন। কিন্তু কিছু ঘটনা ঘটে গেছে আর অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে।
–বিপদ ঘটার সম্ভবনা আছে। পাঁচ নম্বর বললো।
–হ্যাঁ, আমাদের এই জায়গা সম্পর্কে খুব বেশি জানাজানি হয়ে গেছে।
–তাহলে চিমনি সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যায়নি?
–না, মসগোরোভস্কি উত্তর দিলেন।
–আমাদের প্রেসিডেন্ট কোথায় সাত নম্বর? কখনো আমরা ওর দেখা পাই না কেন?
–ওর নিজস্ব কর্মপদ্ধতি আছে। রুশ উত্তর দিলেন।
–আপনি আগাগোড়া ঐ কথাই বলে আসছেন।
কিছুক্ষণের জন্য থমথমে নীরবতার মধ্যে কাটলো।
-এবার আমরা কাজ শুরু করবো। মসগোরাভস্কি বলে উঠলো। তিন নম্বর, আপনি কি ওয়াইভেন অ্যাবীর নকসা পেয়েছেন?
তিন নম্বরকে বান্ডল না দেখলেও গলার স্বরে বুঝতে পারল, একজন শিক্ষিত ইংরেজের গলা। মিষ্টি ও নরম।
টেবিলের ওপর কিছু রাখার আওয়াজ হলো।
–এই যে সেই নক্সা, আর এটা অতিথিদের তালিকা।
রুশ ভদ্রলোক পড়তে লাগলেন।
-স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, মিঃ টেরেন্স ও’রুরকে, স্যার অসওয়াল্ড, লেডি কুট, মিঃ বেটম্যান, কাউন্টেস অ্যানা র্যাজকি, মিসেস মার্কাটা, মিঃ জেমস থেসিজার। পড়া থামিয়ে বললেন, এটি আবার কে?
-ওটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ও আজম্মের গাধা একটা। আমেরিকান ভদ্রলোক হেসে বললেন।
-হের এবারহোর্ড আর মিঃ বিল এভারসলে।
–তাহলে ধরে নিতে পারি এবারহোর্ডের আবিষ্কারের ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই?
–না নেই।
–দামের দিক থেকে এর মূল্য লক্ষ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন দেশের লোভের মাত্রা কতখানি সেটা আন্তাতিক দিক থেকে বুঝতে পারছেন।
একটু থেমে আবার বললেন–হ্যাঁ, এটা হলো সোনার খনি। যাইহোক, আপনারা নকসাটা পেয়েছেন। আমার মনে হয় না, আমাদের আগের পরিকল্পনা আরো ভালো করা সম্ভব। একটা কথা, জেরি ওয়েডের লেখা একটি চিঠির কথা শুনলাম, যাতে এই সমিতির নাম উল্লেখ আছে। চিঠিটা কে পেয়েছে?
-লর্ড কেটারহ্যামের মেয়ে, লেডি এইলিন ব্রেন্ট।
–বাওয়ারের কাজে গাফিলতি দেওয়ার ফল। চিঠি কাকে লেখা?
–সম্ভবতঃ ওর বোনকে, তিন নম্বর জবাব দিলো।
–তবে আর কিছুই করার নেই। আগামীকাল রোনাল্ড ডেভেয়োর ইনকোয়েস্ট। সব ব্যবস্থা করা আছে নিশ্চয়ই।
স্থানীয় ছেলেদের রাইফেল ছুঁড়ে অনুশীলন করার কাহিনী চারদিকে রটানো আছে। আমেরিকান উত্তর দিল।
–আর কিছু বলার নেই আমার। এক নম্বর যে ভাবে একাজে অংশ নিয়েছেন, আমার মনে হয় সকলে তাকে অভিনন্দন জানানো উচিত।
সমস্ত হাত অদ্ভুত ভঙ্গীতে চেয়ারের কাছে এগিয়ে এলো। বিদেশী কায়দায় এক নম্বর তা স্বীকার করলেন।
এবার বান্ডল তিন নম্বরকে দেখতে পেলো, বিরাট চেহারার দীর্ঘকায় এক পুরুষ।
সবাই এক এক করে বেরিয়ে যেতে মসগোরোভস্কি দরজায় তালা দিলেন। কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করার পর আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সভা শেষ হওয়ার প্রায় দুঘন্টা পর অ্যালফ্রেড এলো। আলমারির দরজা খুলতেই বান্ডলের শরীরটা তার দিকে ঝুঁকে পড়লো।
–শরীর কাঠ হয়ে গেছে। বান্ডল বললো, একটু বসিয়ে দাও।
হাত-পা মালিশ করতে করতে বান্ডল বললো, খুব মজার মানুষ ওরা। অ্যালফ্রেড, শিক্ষার বোধহয় শেষ নেই।
.
ইনকোয়েস্ট
ভোর ছটায় বাড়ি পৌঁছে সাড়ে নটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলো বান্ডল। তারপর জেমি থেসিজারকে ফোন করলো।
ফোনে জিমি দ্রুত কথা বলতে চাইলো। ইনিকোয়েস্টে যাবে বলে তাড়া আছে।
–আমিও যাচ্ছি। বান্ডল বললো, অনেক কথা তোমাকে বলার আছে।
–তাহলে তোমাকে আমি গাড়িতে নিয়ে যাবো। যেতে যেতে কথা হবে।
–বেশ, তবে চিমনি হয়ে যেতে হবে। চিফ কনস্টেবল আমাকে নিতে আসবেন।
–কেন?
–তিনি একটু দয়ালু।
গতরাতে তুমি কি করছিলে বান্ডল?
–ভাবছিলাম, সেটার কথাই বলবো। যেতে যেতে কথা হবে। এখন রাখছি।
বান্ডলের কর্মক্ষমতার ওপর জিমির অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে ঠিকই, কিন্তু আবেগ ছিল না তার মধ্যে এতটুকু।
প্রায় কুড়ি মিনিট পর জিমি তার টু-সীটার নিয়ে হাজির ব্রুকলিন স্ট্রিটে। বান্ডল দ্রুত নেমে এলো নিচে। জিমি লক্ষ্য করলো, বান্ডলের চোখে রাত জাগার ছাপ।
গাড়ি চালাতে চালাতে মন দিয়ে বান্ডলের গত রাতের কাহিনী শুনলো। অবশ্য পথে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকেও সে সজাগ।
-বান্ডল, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছে না তো?
–কি বলছো?
–মাপ চাইছি, জিমি বললো, আসলে সব যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ঘটছে।
–বিদেশিনী উত্তেজনা শিকারী, আন্তর্জাতিক দস্যুদল, রহস্যময় ৭ নম্বর, যাকে কেউ কখনো দেখেনি। এরকম তো বইয়ে পড়েছি।
-বইয়ের পড়া কখনোও বাস্তবে রূপ পায়। বান্ডল বলে উঠলো।
–একটা খিচুড়ি মার্কা জমায়েত বলা যেতে পারে। একজন রুশ, একজন আমেরিকান, একজন ইংরেজ, এক অস্ট্রিয়ান বা হাঙ্গেরিয়, আর সেই মহিলা যে কোনো জাতি হাতে পারে।
–আর একজন জার্মান। বান্ডল মনে করিয়ে দিলো। আর দুনম্বর হলো বাওয়ার, যে গতরাতে সভায় ছিল না।
-ওরা চিঠির খবরটা জানে তাই তো? আগামী সপ্তাহে ওয়াইভের্ন অ্যাবীতে আমার যাওয়ার কথা, সেটাও অজানা নয় ওদের, তাই না?
–হ্যাঁ, রুশ না আমেরিকান বললো, ভাববার কারণ নেই। কারণ ওদের মতে তুমি একটা গর্দভ।
-কথাটা বলে ভালোই করলে। ঘটনাটা আমার আগ্রহ বেশি করে জাগিয়ে তুলছে। আর ঐ জার্মান লোকটির নাম এবারহোর্ড।
-হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
দাঁড়াও একটু ভেবেনি। হ্যাঁ মনে পড়েছে।
….এবারহোর্ড হলো একজন আবিষ্কারক, যিনি জিনিষ আবিষ্কার করে সেটা পেটেন্ট নিয়ে বিক্রি করতে ইচ্ছুক। তবে তার আবিষ্কার হলো একটা তার ইস্পাতের চেয়ে শক্ত আর তাপসহ হয়ে যায়। উড়োজাহাজ আবিষ্কার করার পরে সে ভাবে, ওটার ওজন দারুণভাবে কমিয়ে দেবে। দামের দিক থেকে এ হবে বৈপ্লবিক। আমার ধারণা, তিনি এই আবিষ্কারকে জার্মান সরকারের কাছে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা নিতে রাজী হয়নি। ওরা কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করে। ওদের ব্যবহারে সে আঘাত পায়। মনে মনে ঠিক করে, কোনোভাবেই ওদের এই আবিষ্কারের ফল ভোগ করতে দেবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম, এসব বাজে কথা। এখন দেখছি উল্টো ব্যাপার।
-তোমার কথাই ঠিক জিমি, বান্ডল বলে উঠলো। এবারহোর্ড নিশ্চয়ই আমাদের সরকারের কাছে ওটা বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। স্যার অসওয়াল্ড কুটের বিশেষজ্ঞের অভিমত সরকার নিশ্চয়ই যাচাই করে নিতে চাইছে। তাই এই বেসরকারী সভার আয়োজন। ওখানে থাকছেন স্যার অসওয়াল্ড, জর্জ, বিমানমন্ত্রী আর এবারহোর্ড। নিশ্চয়ই ওর কাছে পরিকল্পনাটার খসড়া আছে।
-একে ফর্মুলা বলে।
-হ্যাঁ, ঐ বিশেষ ফর্মুলাটা সেভেন ডায়ালস হস্তগত করতে চাইছে। ঐ রুশ লোকটা যার দাম লক্ষ লক্ষ টাকা বলছিল, মনে পড়েছে।
রনি কি জানতো; একবার যদি জানতে পারতাম, জিমি বললো। তবে আমরা আবিষ্কার করেছি, জেরি ওয়েডের মৃত্যুর জন্য ফুটম্যান বাওয়ার দায়ী। পরের শিকার কে হবে? এরকম ব্যাপারে কোনো মেয়ের জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়।
বান্ডল বুঝলো, জিমি তাকে লোরেনের দলে ফেলতে চায়।
–আমার চেয়ে তোমার শিখার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বান্ডল হাসতে হাসতে বললো।
–তা যা বলেছো। আচ্ছা, আমরা যদি অপর পক্ষের কয়েকটা মৃত্যু ঘটাতে পারি, কেমন হয়? বান্ডল, ওদের কাউকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে?
–পাঁচ নম্বরটাকে চিনতে পারি। বান্ডল ইতস্ততঃ করে বললো। ওর হিস-হিস শব্দটাই চিনিয়ে দেবে।
–দলে একজন মহিলা রয়েছে। সে নিশ্চয় তার শরীর দেখিয়ে কামুক ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের হাতের মুঠোয় নিয়ে গোপন কাগজপত্র বের করে নেয়। আচ্ছা, সাত নম্বর সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা আছে কি?
-একটুও না।
–ওরা সময়মত চিমনিতে পৌঁছে গেল। কর্নেল মেলরোজ অপেক্ষা করছিলো। বান্ডল জিমির পরিচয় দিলো।
সমস্ত ব্যাপারটা ভালো ভাবে মিটলো, বান্ডল সাক্ষী দিলো, ডাক্তার দিলেন। রায় দেওয়া হলো দুর্ঘটনাতেই রনি ডেভেরো মারা যায়।
কাজ শেষ করে কর্নেল মেলরোজ বান্ডলকে নিয়ে চিমনিতে ফিরে গেলেন, আর জিমি থেসিজার লন্ডনের দিকে রওনা হলো।
জিমি লোরেনেকে ফোন করে জানালো যে দুর্ঘটনা বলেই রায়ে বেরিয়েছে।
–লোরেন, আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটে চলেছে। তুমি সাবধানে থেকো, অন্ততঃ আমার জন্যে।
-তোমার পক্ষেও তো বিপদের সম্ভাবনা আছে। লোরেনের কণ্ঠে ভয়
–ও নিয়ে ভেবো না। এখন রাখছি।
জিমি স্টিভেনসকে ডাকলো।–স্টিভেনস, আমার জন্যে একটা অটোমেটিক আর নীলচে নলওয়ালা পিস্তল কিনে আনতে পারো। দোকানদার আর তোমার যদি এ সম্বন্ধে জ্ঞান থাকে কিছু, ঠিক আমেরিকান গল্পে নায়ক যেমন পেছনের পকেট থেকে পিস্তল বের করে সেইরকম।
স্টিভেনসের মুখে হাসি খেলে গেল–বেশির ভাগ আমেরিকান কিন্তু তাদের পকেট থেকে পিস্তলের বদলে অন্য কিছু বের করে।
জিমি না হেসে পারলো না।
.
অ্যাবীতে পার্টি
শুক্রবার বিকেলে ঠিক সময়ে বান্ডল এসে হাজির হলো ওয়াইভেন অ্যাবীতে চায়ের আমন্ত্রণে। জর্জ লোম্যাক্স তাকে বেশ খাতির করে অভ্যৰ্তনা জানাতে এগিয়ে এলেন।
প্রিয় এইলিন, তোমার যে এ ধরনের পার্টিতে আসতে ইচ্ছে করে সেটা আমার জানা ছিল না। রাজনীতিতে তোমার আগ্রহ আছে শুনলাম লেডি কেটারহ্যামের কাছ থেকে। শুনে যেমন খুশি হয়েছিলাম তেমনি অবাক হয়েছি।
–আমার খুবই ভালো লাগে। বান্ডল বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তর দিলো।
মিসেস মার্কাটা গত রাতে ম্যানচেস্টারে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। উনি পরের ট্রেনে আসছেন। তুমি জিমি থেসিজারকে চেনো? ওর ওপরটা দেখলে বোঝা যায় না। আসলে বিদেশের রাজনীতিতে একদম পাকাঁপোক্ত।
জিমি এই দিকেই এগিয়ে আসছিল। বান্ডল, তারদিকে হাত বাড়িয়ে বললো–আমি তাকে চিনি।
জর্জ একটু দুরে সরে যেতেই জিমি বললো-বান্ডল, আমি বিলকে সব বলেছি। একটু একটু করে ওর মাথায় সব ঢুকিয়েছি। অতএব আমৃত্যু ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।
জর্জ হঠাৎ হাজির হলেন। তিনি এক এক করে বান্ডলের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন–স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, হাসিখুশী ভরা একজন বিমানমন্ত্রী, মি ও’রুরকে, লম্বা চেহারা, মুখে আইরিশ আদল স্পষ্ট।
মিসেস মার্কাটার জন্য বান্ডল অপেক্ষা করছিল। তিনি কালো লেস লাগানো ফ্রক পরে গম্ভীর মুখে হল ঘর পেরিয়ে এলেন। সেখানে ফুটম্যানের পোশাকে একজন উপস্থিত ছিল। বান্ডল চিনতে পারলো ইনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল। ছদ্মবেশে নিজেকে ঢাকতে পারেনি।
–সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, বান্ডল ফিসফিস করে বললো।
-হ্যাঁ, সবকিছুর ওপর নজর রাখতে এসেছি। মিঃ লোম্যাক্স ঐ সাবধানী চিঠি পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গেছেন। আমার ওপর ওর ভীষণ বিশ্বাস। তাই আমাকে আসতে হলো।
কিন্তু আপনি কি ভাবেন, বান্ডল বলতে গিয়েও বলতে পারলো না, ছদ্মবেশের। আড়ালে একজন পুলিস অফিসারের ভাব স্পষ্ট ফুটে আছে।
–আপনি কি ভাবছেন, অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যাবে? কিন্তু এটা করলে ক্ষতিই বা কি?
–ক্ষতি কি? বোকার মত বান্ডল কথাটার পুনরাবৃত্তি করে এগিয়ে গেল। ড্রয়িং রুমে একটা কমলা রঙের খাম হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন।
–খুবই বিরক্তিকর। জর্জ বললেন, টেলিগ্রাম এসেছে, মিসেস মার্কাটার ছেলেমেয়েরা মাম্পসে আক্রান্ত, তাই তিনি হাজির হতে পারছেন না।
কথাটা শুনে বান্ডল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, ওর মুখোমুখি হতে সে চায় না।
–এইলিন, তুমি দুঃখ করো না, আমি জানি কত আগ্রহ নিয়ে তুমি এখানে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করবে বলে। জর্জ বলতে থাকেন, এজন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কাউন্টেস বেচারি শুধু
বান্ডল আচমকা বলে উঠলো, উনি হাঙ্গেরিয় না?
-হ্যাঁ, কাউন্টেস ঐ তরুণ হাঙ্গেরীয় দলের নেত্রী। শিশু মৃত্যুর সমস্যা নিরসনে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্যবতী, অল্প বয়সে স্বামী হারান। আরে, ঐ এবারহোর্ড এসে গেছেন।
তেত্রিশ বা চৌত্রিশ বছরে এক সপ্রতিভ হাসিখুশী মানুষ এই জার্মান ইঞ্জিনীয়ার এবারহোর্ড। ভদ্রলোকের চেহারা দেখলে মনে হয় রক্তশূন্যতায় ভুগছেন।
ওরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন এসে হাজির হলেন মিঃ ও’রুরকে। এর একটু পরেই হাঁফাতে হাঁফাতে বিল এলো।
হ্যালো বান্ডল, তুমি এসেছো শুনেছি আগে, বিল বলতে থাকে। কিন্তু সারা বিকেল নাকে দড়ি দিয়ে যা ঘুরিয়েছে যে আগে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।
–সেই কাউন্টেসের সেবায় মনোনিবেশ করেছিলে নিশ্চয়ই। জিমি বললো।
–মানে, ইয়ে, আমি বাধা দেবো কি করে বলো? বিলের গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে। তবে ভদ্রমহিলা বেশ মজার, বুদ্ধিমতী। বাড়িটা যখন ঘুরে দেখছিলেন তখন বান্ডল, তুমি দেখলে পারতে, কতরকম প্রশ্ন করছিলেন।
–কি রকম প্রশ্ন?
বান্ডলের প্রশ্ন শুনে বিল হচকচিয়ে গেল। ঠিক সরাসরি জবাব দিলো না। বললো, বিশেষ কিছু নয়। এই বাড়ির ইতিহাস জানতে চাইছিলেন। আসবাবপত্র সম্পর্কেও আগ্রহ তার। এইরকম অদ্ভুত প্রশ্ন আর কি।
ঠিক এই সময় কালো মখমলের আঁটোসাঁটো পোশাক পরে কাউন্টেস ঘরে ঢুকলেন। সেই সময় চশমা পরা গম্ভীর মুখে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক যিনি পঙ্গো নামে পরিচিত।
.
নৈশভোজের পর
নৈশভোজের পর মহিলারা ড্রয়িংরুমে ঢোকার পর সান্ধ্য পোশাকে বেশ অপ্রতুল বলেই ভাবতে লাগলেন। অ্যাবীতে আধুনিক তাপ বিকিরণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা ঘরে যে কাঠের চুল্লির ব্যবস্থা ছিল, তার পাশে গিয়ে বসলেন।
লেডি কুট বলে উঠলেন–মিসেস কার্টার ছেলেমেয়েদের মাম্পস হওয়াটা বেশ আশ্চর্য ব্যাপার।
–মাম্পস কি? কাউন্টেস জানতে চাইলেন।
বান্ডল ও লেডি কুট দুজনে মিলে বেশ কায়দা করে মাম্পসের বর্ণনা তাকে দিলেন।
-হাঙ্গেরিয় শিশুদের বোধহয় এ রোগ হয়, লেডি কুট বললেন।
–আমি জানি না, কাউন্টেস বললেন।
-সে কি! আপনি শুনেছি শিশুদের মধ্যে কাজ করেন, লেডি কুট আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকালেন।
–এই কথা, কাউন্টেস পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে বলতে আরম্ভ করলেন–কত ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার দেখেছি শুনলে স্তম্ভিত হবেন।
যুদ্ধের পর অনাহার আর অন্যান্য ভয়ানক পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন, কাউন্টেস একটানা বর্ণনা করে গেলেন, বান্ডলের মনে হলো যেন গ্রামোফোনে রেকর্ড বেজে চলেছে।
লেডি কুট প্রায় মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তার কথা।
একসময় কাউন্টেস বললেন–আমাদের সমস্যাটা কোথায় জানেন? আমাদের টাকা আছে, কিন্তু ভালো সংগঠন নেই।
-আমার স্বামীও তাই বলেন, লেডি কুট সায় দিলেন। তার মনের পরদায় স্যার অসওয়াল্ডের জীবনের নানা ঘটনার ছবি ফুটে উঠতে চাইছিল।
কি মনে করে তিনি বান্ডলকে বললেন, আচ্ছা, লেডি এইলিন, বলুন তো, আপনাদের বাগানের ঐ প্রধান মালীকে পছন্দ করেন আপনি?
–কে? ঐ ম্যাকডোনাল্ড? মানে, একটু ইতস্ততঃ করলো বান্ডল, ওকে নিজের কাজ করতে দিলে ও ঠিক আছে।
এমন সময় জিমি এসে ঢুকলো। বান্ডলকে লক্ষ্য করে বললো, সেই ছবিগুলো দেখবে নাকি? তোমার অপেক্ষায় আছে।
জিমিকে অনুসরণ করে বান্ডল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
–কোনো ছবির কথা বললে?
-ধৎ ওসব বাজে কথা। জিমি উত্তর দিলো। লাইব্রেরিতে বিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে আর কেউ নেই।
বিল চঞ্চল মনে লাইব্রেরি ঘরে পায়চারি করছিল।
বান্ডলকে লক্ষ করে বললো–তুমি যে এ ব্যাপারে ঢুকে পড়েছো, এটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এ বাড়িতে একটা ঝামেলা সৃষ্টি হতে চলেছে। তারপর
বান্ডল জিমির দিকে তাকালো-ওকে কি বলেছো?
–সবই বলেছি।
–তোমার ঐ সেভেন ডায়ালসে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বিল কাতরভাবে বান্ডলের দিকে তাকালো, কাজটা তুমি ভালো করোনি বান্ডল।
-কোনো কাজ?
–এই সব ব্যাপারে জড়ানো।
-হ্যাঁ, বান্ডল বললো, আমি যখন জড়িয়েছি তখন তোমার আর চেঁচিয়ে তোক জানাতে হবে না।
-ওসব কথা না ভেবে পরিকল্পনা তৈরি করে নাও চটপট। জিমি বললো।
বান্ডল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
বিল আর কথা না বাড়িয়ে রাজী হয়ে গেল।
-ফর্মুলার ব্যাপারে তোমার কথাই ঠিক। বিল বললো। বোধহয় ফর্মুলাটা হয় এবারহোর্ড নতুবা স্যার অসওয়াল্ডের কাছে আছে। ওরা সবাই এখন স্টাডিতে, তার মানে আসল কাজ শুরু করতে চলেছেন।
-স্যার স্ট্যানলি ডিগবি কতদিন থাকবেন? জিমি জানতে চাইলো।
–তিনি আগামীকাল শহরে ফিরবেন।
–তাহলে কোনো ঝামেলা রইলো না। জিমি বললো, আমার ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে স্যার স্ট্যানলি ফর্মুলাটা সঙ্গে নিয়ে যাবেন। অতএব বিশেষ মজার যা ঘটার তা আজ রাত্রিতেই অবশ্যই ঘটবে।
-প্রথম কথা হচ্ছে ফর্মুলাটা রাত্রিতে কোথায় থাকবে? এবারহোর্ডের কাছে না অসওয়াল্ডের কাছে থাকবে?
–আমাদের যদি ধারণা হয়ে থাকে যে আজ রাতে কেউ ওটা চুরি করার ধান্দায় আছে তাহলে আমাদের কাজ হলো সতর্ক দৃষ্টি রেখে সেটা বন্ধ করা।
-তাহলে সে কথাই রইলো। তবে রাতে পাহারা থাকার জন্য টস করে ভাগাভাগি করে নিতে হবে।
বান্ডল চুপ করে শুনছি, কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও বললো না।
–বেশ, টস করো। হেড হলে তোমার আগে, আমার পরে। টেল হলে ওর উল্টোটা হবে। একটা কয়েন বের করে টস করা হলো। প্রথম রাতের দায়িত্ব পড়লো জিমির ওপর।
এতক্ষণে বান্ডল মুখ খুললো–আমি কি করবো?
–তুমি বিছানায় গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোও
–খুব উত্তেজনার ব্যাপার বলে মনে হলো না। বান্ডল বললো।
-কে বলতে পারে, তুমি হয়তো ঘুমের মধ্যে খুন হয়ে গেলে, জিমি বললো, আর আমরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবো।
–জিমি, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছো। কাউন্টেসের ভাবভঙ্গী আমার কাছে কেমন বেখাপ্পা লাগছে। ওকে আমার সন্দেহ হয়।
-না, উনি সমস্ত রকম সন্দেহের বাইরে। বিল খুব উৎসাহ নিয়ে কথাটা বললো। কারণ হাঙ্গেরির দূতাবাসের একজন ওর ব্যাপারে সবই আমাকে বলেছে।
-বেশ, তোমার বিশ্বাসের কথাটা ওর কানে কানে বলে এসো। বান্ডল বিরক্ত হয়ে বললো, আমার মাথা ধরেছে, শুতে চললাম।
বান্ডল চলে গেলে বিল জিমির দিকে তাকালোবান্ডলের বুদ্ধি আছে বলল। কখন কোনো ব্যাপার অসম্ভব, সেটা ও ভালো বোঝে। একটা কথা এই ধরনের কাজে নামতে গেলে একটা জোরালো অস্ত্র লাগে। আমাদের সঙ্গে সেই জাতীয় কিছু থাকা দরকার।
আমার কাছে একটা নীল নলের অটোমেটিক আছে। জিমি বললো, কি মনে হলো, তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তোমার পাহারা দেওয়ার সময় তোমাকে ওটা দেবো।
.
জিমির অ্যাডভেঞ্চার
তিনজন মানুষের তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দৃশ্যমান হবে আজকের এই রাত।
-তাহলে জিমি, ঐ কথাই রইলো, রাত তিনটে। বিল বিদায় নেবার সময় জিমিকে বললো। কিন্তু কডার্স দেখলাম আমার চেয়েও বোকা। বান্ডলের কথা ও পুরো বিশ্বাস করে বসে আছে। যাক, শুভরাত্রি। আমার ঘুম ভাঙাতে তোমার কষ্ট হবে হয়তো, তবুও সময়মত ভাঙিও বিল ওর দিকে তাকালো। আশা করি তুমি ঠিক মতো থাকবে। যখনই বেচারি জেরি আর রনির কথা ভাবি–
জিমি ভাবলো, বিল তার মনের কথাই বলেছে। তারপর সে পকেট থেকে অটোমেটিক রিভলবার বের করে ওকে দেখালো–এটা সত্যি ভালো জিনিস।
বিল মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
-শুধু ট্রিগার টানার অপেক্ষা। তারপরের কাজটুকু এটার দায়িত্বে। জিমি গর্বের সঙ্গে কথাটা বললো।
বিল আবার শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলো।
জিমি পাহারা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো।
পশ্চিমের একেবারে শেষ প্রান্তে স্যার স্ট্যানলি ডিগবির ঘর। এই ঘরের একদিকে বাথরুমে, অন্যদিকে আর একটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় ছোট্টো একটা ঘরে যেটা দখল করেছেন মিঃ টেরেন্স ও’রুরকে। এইসব ঘরের বাইরে ছোট্ট বারান্দা। যেখানে সহজেই পাহারা দেওয়া যায়। একটা ওক কাটের আসবাবের আড়ালে শরীর লুকিয়ে রেখে সহজে সম্পূর্ণ জায়গার ওপর নজর রাখা যায়। পশ্চিমে যেতে হলে এই পথ দিয়েই সকলকে যেতে হবে। একটা বৈদ্যুতিক আলোও জ্বলছে।
হাঁটুর ওপর লিওপোন্ড নিয়ে বেশ আরাম করে বসলো জিমি।
চারদিক নিস্তব্ধ। ঘড়িতে একটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি।
এইভাবে বসে থাকা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার সন্দেহ নেই। ওর মনে পড়লো প্ল্যানচেটের কথা। এই সময় নাকি অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে। রনি ডেভেরো আর জেরি ওয়েড, ওরা এখন কোথায় আছে কে জানে? ভয়ঙ্কর চিন্তা তার মনে উদয় হলো।
ঘড়িতে একটা বেজে কুড়ি হয়েছে। সময় যেন অত্যন্ত ধীর পায়ে এগোচ্ছে।
সত্যি, বান্ডলের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। না হলে সেভেন ডায়ালসের মতো জায়গায় গিয়ে সে ঢোকে।
সাত সম্বর কে হতে পারে? সে কি এখন তার বাড়িতে আছে? নাকি চাকরের ছদ্মবেশ নিয়েছে।
ঘুমে চোখ বুজে এলো। চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করলো। হাই তুললো, ঘড়ির দিকে তাকালো, দুটো বাজতে দশ।
ঠিক এই সময় কানে এলো কিছু। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঝুঁকে পড়লো। কান খাড়া করলো।
শক্ত কাঠের ওপর ঠুকলে যেমন শব্দ হয় তেমন আওয়াজ। শব্দটা আস্তে কিন্তু ভয় জাগানো। নিচে কোনো লোক নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে-লাইব্রেরি থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে।
সে সন্তর্পণে লিওপোল্ডকে ডান হাতে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। লাইব্রেরির দরজার সামনে এসে দরজায় কান পাতলো। কোনো শব্দ নেই। সে আচমকা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালো।
ঘর খালি। ঘরটি বেশ বড়ো। তিনদিকে তিনটে জানলা। বারান্দার দিকে সব জানালাই খোলা। মাঝখানের জানালাটার খিল খোলা।
সে সেটা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে সজাগ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখলো। না, কিছুই নেই।
মুহূর্ত খানেক পর আবার লাইব্রেরিতে ঢুকলো। দরজার তালা বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখে আলো নিভিয়ে কান পেতে রইলো, চট করে খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
খুব হালকা পায়ে চলার আওয়াজ বারান্দায় শোনা যাচ্ছে?
না, কিছুই নেই। এটা কি তার কল্পনা মাত্র।
রাত দুটো বাজার ঘন্টা পড়লো।
.
বান্ডলের অ্যাডভেঞ্চার
বান্ডল ব্রেন্ট যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি কল্পনাশক্তি প্রবল। সে বুঝতে পেরেছিল, বিল এই রাতের বিপজ্জনক কাজে ওকে অংশ নিতে দেবে না। তাই আগে থেকে নিজের মনে পরিকল্পনা করে রেখেছিল। সে তার শোবার ঘর থেকে বাড়ির বাইরেটা এ ঝলক দেখে নিয়েছিল। ওর ঘরের জানলার পাশে চমৎকার আইভি লতার ঝোঁপ রয়েছে, সেইরকম লতার অ্যাবী সাজানো আছে।
বিল আর জিমির কাজে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পায়নি। ওদের দুজনকে যে এত সহজে বোকা বানাতে পারলো সেটা ভেবে ও মনে মনে অবাক হলো।
সে নিজের ঘরে এসে চট করে সান্ধ্যপপাশাক ছেড়ে পরে নিলো একটি পোশাক যেটি সে স্যুটকেসে করে নিয়ে এসেছিলো। ঘোড়সওয়ারের ব্রিচেস, রবারের সোলের জুতো আর গাঢ় রঙের একটা পুলওভার পরে বান্ডল তৈরি হয়ে নিলো। রাত একটাতে কাজ শুরু করবে সেটা সে আগেই ভেবে রেখেছিল। কারণ ততক্ষণে সকলে ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে পারবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সে জানলার কাঁচ তুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। বিড়ালের মতো গাছে উঠতে বান্ডল অভ্যস্ত। তাই নিঃশব্দে কিছু ফুলগাছের ঝোঁপের ওপর সে লাফিয়ে পড়লো।
পশ্চিম দিকের ঘরে আছেন বিমানমন্ত্রী আর তার সেক্রেটারি। বাড়ির দক্ষিণে আর পশ্চিমে একটা লম্বা বারান্দা আছে।
বাড়ির ছায়ার আড়ালে নিজেকে গোপন রেখে সে পায়ে পায়ে দক্ষিণের বারান্দার দিকে এগোলো। দ্বিতীয় কোনটা পার হতেই সে বাধা পেলো। সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ, সে তার পথ রোধ করতে চায়।
বান্ডল চিনতে পারলো।
–সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটল, আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
–সেইজন্যই এখানে রয়েছি।
–আপনি এখানে কি করছেন?
–যাদের বাইরে আসার কথা নয়, তারা যেন না আসে, সেটা দেখছি। যেমন আপনি, আশা করি এত রাতে আপনি যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবেন না?
–আপনি আমাকে ফিরে যেতে বলেছেন? বান্ডল বললো। ভাবছিলাম একটু পশ্চিম দিকটায় যাবো। না যেতে পারলে বড় মন খারাপ হয়ে যাবে।
বেশ তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে ব্যাটল, লেডি এইলিন। আপনি জানলা দিয়ে না দরজা দিয়ে বাইরে এসেছেন?
–জানলা দিয়ে। আইভি লতা বেয়ে সহজেই নিচে নেমেছি।
এবার আপনার পক্ষে শুতে যাওয়াই মঙ্গল, লেডি এইলিন দৃঢ়তা স্পষ্ট। বান্ডল হতাশ হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। আইভি লতা বেয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো, আচ্ছা সুপিরন্টেন্ডেন্ট ওকে সন্দেহ করবে না তো?
অবশ্য ব্যাটলের হাবভাব সেটা বেশ স্পষ্ট। জানলার কার্নিসে পা রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আপন মনে হেসে উঠলো। উনি ওকে সন্দেহ করেন এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর হয় না।
বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর মেয়ে বান্ডল নয়। আবার অন্যদিকে যখন কোনো দুঃসাহসিক আর উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটতে চলেছে তখন চুপচাপ বসে থাকার মত মেয়ে সে নয়।
ঘড়িতে তখন দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে চুপচাপ দরজা খুললো। নিঃশব্দে বারান্দা দিয়ে এগোলো।
যেতে যেতে একটু থমকে দাঁড়ালো। কিসের যেন আওয়াজ আসছে। পরক্ষণে কিছু নয় ভেবে আবার পা বাড়ালো। এবার প্রধান বারান্দায় উঠে পশ্চিম দিকে চললো। ঠিক এখানেই কিছু একটা সামনে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল।
জিমির তো এখানে থাকার কথা। কিন্তু ও গেল কোথায়?
রাত দুটো বাজার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলো তখনই।
কি করবে ভাবছে এমন সময় তার হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠলো। টেরেন্স ও’রুরকের ঘরের দরজার হাতলটা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছিল।
সে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে হাতলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু দরজাটা খুললো না। হাতলটা আবার নিজের জায়গাতেই ফিরে এলো। এ সবের মানে কি?
বান্ডল আচম্বিতে সচেতন হলো। জিমি যে কারণে হোক ওর জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। বিলকে ডাকতে হবে।
সে দ্রুত পায়ে বিলের ঘরে চাপা স্বরে বিলকে ডাকতে লাগলো। কয়েকবার ডাকার পর বিলের সাড়া না পেয়ে আলো জ্বালালো। একি বিছানা খালি! বিল কোথায় গেল তাহলে?
হঠাৎ খেয়াল হলো সে ভুল করে অন্য ঘরে ঢুকে পড়েছে। কারণ পাতলা রাত্রিবাস, টুকিটাকি মেয়েলি জিনিষ পড়ে আছে। কালো ভেলভেটের কিছু পোশাক ড্রেসিং টেবিলে রয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলো না, এটা কাউন্টেস র্যাডকির ঘর। কিন্তু তিনিই বা কোথায়?
বান্ডল হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে নিচ থেকে উঠে আসা গোলমালের আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে এলো।
শব্দ লক্ষ্য করে বান্ডল দ্রুত নিছে নেমে লাইব্রেরির দিকে ছুটলো, কেউ যেন প্রচণ্ড শব্দে চেয়ার টেবিল আছড়ে ফেলছে।
লাইব্রেরির দরজা বন্ধ। দরজায় আঘাত করলো। খুললো না। ভেতরে লড়াই যে ভালো চলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না বান্ডলের।
তারপরেই পরপর দুটো গুলির আওয়াজে আর স্পষ্টভাবে খান খান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা।
.
লোরেনের অ্যাডভেঞ্চার
ঠিক রাত সাড়ে নটার লোরেন শুতে গিয়েছিল। একটা বাজতে দশ-এ তার ঘুম ভাঙলো। কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে তার শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে।
ঐ ঘরে ওর সঙ্গে কুকুরদুটোও ঘুমোচ্ছিল। ওদের একজন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লোরেনের দিকে তাকালো।
-চুপ করে ঘুমো, লার্চার। কুকুরটা মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো।
লোরেন ওদের কথা মতো যুক্তি মেনে চুপ করে থাকাই ঠিক ভেবেছিল। কিন্তু ওর মুখ দেখে, ওর শক্ত ছোট্ট চোয়লের দৃঢ়তার ছাপ দেখলে যে কেউ বুঝে নিতে পারবে ওর মনের জোর কতখানি।
একটা টুইডের কো আর স্কার্ট পরে পকেটে সে চট করে পুরে নিলো একটা টর্চ। হাতির দাঁতের হাতলের ছোট্ট একটা পিস্তল নিলো।
লোরেনকে তৈরি হতে দেখে লার্চার সামনে এসে ল্যাজ নাড়তে লাগলো।
-না, লার্চার, এখন নয়। চুপ করে ঘরে থাকো।
বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করলো সে। তারপর বাইরে একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে টুসীটারে উঠে বসলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে সে এসে পৌঁছালো ওয়াইভার্ন অ্যাবীর বাগানে।
ধীর পায়ে বাড়িটার দিকে এগোলো। দুটো বাজলো কোথাও। বারান্দার কাছে আসতেই তার বুকের ওঠানামা বেড়ে গেল। বারান্দায় উঠে চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি দিলো।
আচমকা তার পায়ের সামনে একটা কি এসে পড়লো। সে নিচু হয়ে তুলে নিলো। বাদামী রঙের একটা কাগজের প্যাকেট। ওপর দিকে তাকালো।
ওর ঠিক মাথার ওপরের দিকে খোলা জানলা দিয়ে একটা পা বেরিয়ে এলো আর একটা লোক আইভি লতা বেয়ে নামতে শুরু করলো।
এক মুহূর্ত দেরি না করে প্যাকেট হাতে নিয়ে লোরেন ছুটতে লাগলো। পেছন থেকে ভেসে আসা হুটোপাটির শব্দ ও তখনও শুনতে পাচ্ছে। ভয়ে সিঁটিয়ে পড়িমড়ি করে তখন ছুটছে লোরেন। বারান্দা পেরোতে গিয়ে সে বাধা পেলো। একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ ওকে জাপটে ধরেছে।
–ভয় নেই, সুপারিন্টেন্ডেন্টের দয়ার্দ্র কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
লোরেন হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, তাড়াতাড়ি চলুন, ওরা বোধহয় পরস্পরকে মেরে ফেলেছে।
সেই সময় দুবার গুলির আওয়াজ ভেসে এলো।
দুজনে দ্রুত পায়ে লাইব্রেরির খোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যাটল টর্চ জ্বালাতে গিয়ে ধাক্কা খেল।
জানালার প্রায় নিচে রক্তের স্রোতের মধ্যে পড়ে আছে জিমি থেসিজারের অচৈতন্য দেহ, ডানহাতটা অদ্ভুতভাবে বাঁকানো।
লোরেন নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। কান্না জড়ানো গলায় বললো, ও মনে গেছে। জিমি–জিমি মরে গেছে।
–উনি মারা যাননি। ঠিক আছে। ব্যাটল ওকে আশ্বস্ত করলেন। দেখুন আলোটা জ্বালতে পারেন কিনা।
লোরেন ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতেই সারা ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো।
ততক্ষণে দরজার বাইরে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন কণ্ঠের কোলাহল। তারা ঘরে ঢুকতে চাইছিল।
একটা রুমাল বের করে জিমির ডান হাতে যেখানে গুলি লেগেছে, সেখানে বেঁধে দিতে দিতে ব্যাটল বললেন–বেশি রক্তপাত হওয়ার জন্য উনি জ্ঞান হারাননি। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন।
দরাজায় তখন উধ্বশ্বাসে করাঘাত হচ্ছে। ব্যাটল ঘরের চারিদিকে একবার খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। একটা অটোমেটিক পিস্তল জিমির পাশে পড়েছিল। সেটা তুলে টেবিলের ওপর রেখে দরজার খিল খুলে দিলেন।
একসঙ্গে কয়েকজন লোক ঢুকে পড়লো। জর্জ লোম্যাক্স বললেন, সুপারিন্টেভেট ব্যাটল, আপনি এখানে? মানে, কি হয়েছে?
মেঝেতে পড়ে থাকা জিমির দিকে তাকিয়ে বললো-হা ঈশ্বর!
দামী রাত্রিবাস পরিহিতা লেডি কুট বললেন–উঃ বেচারী।
বান্ডল বললো লোরেন!
হের এবারহোর্ড মন্তব্য করলেন–হা ভগবান!
স্যার স্ট্যানলি ডিগবিহা ঈশ্বর, এসব কি?
অত রক্ত দেখে বাড়ির এক পরিচারিকা নরম উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, উঃ কি রক্ত দেখেছেন।
ততক্ষণে প্রধান পরিচারক অন্যান্য ঝি-চাকরদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে ভিড়টা হালকা করে নিলো।
জর্জ লোম্যাক্স বলে উঠলেন–ব্যাটল, কি ঘটেছে?
ব্যাটল বললেন–এখানে একটা ইয়ে মানে, আপনারা যে যার ঘরে শুতে যান দয়া করে। তারপর একটু সহজ ভাবে বললেন, এখানে একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে।
-হা মানে এটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবাই শুতে গেলে খুশী হবো।
কিন্তু কেউ ঘর ছাড়তে রাজী নয় বোঝা গেল।
এই সময় জিমি নড়েচড়ে উঠে বসলো-হ্যাল্লো, ও গম্ভীর গলায় বসে উঠলো, কী হয়েছে?
এবার ঘরের চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
–আপনারা লোকটাকে ধরতে পেরেছেন? আইভি লতা বেয়ে লোকটা যখন উঠছিল তখন আমি জানলার তলায় ছিলাম। ধরে ছিলাম লোকটাকে প্রচণ্ড মারামারি করেও
-এই সেই খুনী বদমাইস নিশ্চয়ই, লেডি কুট মন্তব্য করলেন।
–মনে হছে, আমরা সব ভণ্ডুল করে দিয়েছি, যা ষাড়ের মতো শক্তি লোকটার।
ঘরের চেহারা দেখলে তা মালুম পাওয়া যায়।
জিমি কি যেন খুঁজছিল। হঠাৎ বললল–আমার লিওপোল্ড?
ব্যাটল টেবিলের ওপরে রাখা পিস্তলটা ইঙ্গিত করলেন। আশা করি এটাই আপনার লিওপোল্ড?
–হ্যাঁ, জিমি বললো, এটার ওপর ভরসা করেছিলাম খুব। ঠিক মত ট্রিগার টানতে পারলে একটা কেন, আরো কয়েকটা গুলি চালানো যেত। লোকটা জানলার কাছে দৌড়ে যেতে আমি গুলি ছুঁড়ি প্রথমে। সে ঘুরে আমাকে গুলি করে।
স্যার স্ট্যানলি ডিগবি এতক্ষণে শিরদাঁড়া সোজা করলেন।
–লোম্যাক্স, ওরা সেটা নিয়ে পালায়নি তো? হা ভগবান!
তিনি ঘর থেকে ছুটে বেরোলেন, একটু পরে ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এলেন। -ও’রুরকে নিশ্চয়ই কেউ ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে। কিছুতেই ওর ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। কাগজগুলোও নেই। নিশ্চয়ই ওরা হাতিয়েছে।