তৃতীয় পরিচ্ছেদ
৩.১
রোজামন্ড ডার্নলি ও কেনেথ মার্শাল গাল কোভ-এর নরম ঘাসের সমতলে পাশাপাশি বসেছিলেন।গাল কোভ দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত। ভোরের দিকে লোক এসে গেছে নির্জনে স্নান করতে। রোজামন্ড বললো, নির্জনে কাটাতে বেশ ভালো লাগে নোকজনের সঙ্গ ছেড়ে। মার্শাল নিচু স্বরে বিড়বিড় করলেন,—হুঁ। তিনি উপুড় হয়ে ছোট ছোট ঘাসের গন্ধ নিলেন। শিপলির সেই মাঠগুলোর কথা মনে পড়ে, চমৎকার গন্ধ।
কি সুন্দর ছিলো দিনগুলো। হু। রোজামন্ড তুমি বেশি বদলাওনি।
বদলে গেছি হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছি।
তুমি সেই রোজামন্ডই আছে। এখন তোমার অনেক নাম হয়েছে, টাকা পয়সা হয়েছে অনেক। মৃদুস্বরে বললো-রোজামন্ড যদি তাই থাকতে পারতাম। তার মানে? ছেলেবেলাকার সুন্দর স্বভাব কিছু না। ভাবতেও অবাক হয়। কোনোটাই চিরকাল ধরে রাখতে পারি না, উঁচু আদর্শ তাই না?
কোনোকালেই সুন্দর ছিলো না তোমার স্বভাব। বৎসে তার পরিচয় আমি পাই। তুমি মাঝে মাঝে যে ভাবেই রেগে উঠতে একদিন তো আমার গলাই টিপে ধরেছিলে রাগে ঝাঁপিয়ে।
সশব্দে হাসলো রোজামন্ড, সেদিন ভোঁদর ধরতে গিয়েছিলাম, টোবিকে নিয়ে। তোমার মনে আছে সেদিনটা। বেশ কিছু সময় কেটে গেল অতীত অভিযানের স্মৃতিচারণে। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা অবশেষে নেমে এল। রোজামন্ড ব্যাগের ফিতে নিয়ে খেলা করতে লাগলো, কেনেথ, অবশেষে বললো। অস্পষ্ট স্বরে উত্তর এলো কেনেথ মার্শালের, তখনও তিনি সবুজ ঘাসে মুখ লুকিয়ে আছেন।
এমন কিছু বলি আমি হয়তো যা পুরোপুরিই অনধিকার চর্চা তুমি তাহলে কি আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না, ঘুরে উঠে বসলেন কেনেথ মার্শাল। আমার মনে হয় না, আন্তরিক সুরেই বললেন তিনি। তোমার কোনো কথাকেই অনাধিকার চর্চা বলে ভাবতে পারি? তোমার সে অধিকার আছে, তুমি তো জানেনা।
কেনেথ মার্শালের শেষ কথাগুলোর অর্থ মেনে নিলো রোজামন্ড, ও গোপন করলো ক্ষণিকের পাওয়া সুখটুকু।
কেনেথ তুমি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছ না কেন তোমার স্ত্রীর কাছে? কেনেথ মার্শালের মুখমণ্ডলে পরিবর্তন এলো। খুশি খুশি অভিব্যক্তিটুকু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে নেমে এলো কঠিনতার ছোঁয়া। তামাক ভরতে লাগলেন পকেট থেকে পাইপ বের করে। রোডমন্ড বললো, দুঃখিত তোমায় আঘাত দিয়ে থাকলে।
তিনি বললেন শান্ত স্বরে, না আঘাত তুমি দাওনি। কেন তা করছি না, বুঝবে না তুমি।
খুব ভালোবাসো তুমি কি ওকে?
আমি ওকে বিয়ে করেছি, এটা শুধু ভালোবাসার প্রশ্ন নয়, ওর অনেক বদনাম আছে জানি। কিছুক্ষণ কথাটা ভাবলেন তিনি সতর্ক হাতে তামাক ঠুকতে ঠুকতে। হয়তো আছে, কি জানি তুমি ওকে ডিভোর্স করতে পারো না কেন।
মার্শাল বললেন, সোনা এ নিয়ে তোমার মাথা না ঘামানোই ভালো। এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। পুরুষরা ওকে দেখে জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলে বলে, ওর ঐ একই অবস্থা হয়। মুখের মতো একটা জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলো রোজামন্ড। তারপর বললো, এমন একটা ব্যবস্থা করো, যাতে তোমাকে ডিভোর্স করে তুমি যেভাবেই চাও।
সম্ভব নয় বোধহয়।
পারতেই হবে তোমাকে ঠাট্টা করে বলছি না। মেয়ের কথাটা তত তোমায় ভাবতে হবে। লিন্ডা, লিন্ডা হা। লিন্ডার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? আর্লেনা মোটেই ভালো নয় লিন্ডার পক্ষে। আজকাল লিন্ডা অনেক কিছু বেশ বুঝতে পারে।
দেশলাই জ্বেলে পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন কেনেথ মার্শাল। সে মিথ্যা কথা নয়, ধোঁয়া ছাড়বার ফাঁকে তিনি বললেন। আমার মনে হচ্ছে আর্লেনা ও লিন্ডা মানিয়ে চলতে পারছে না। এটা ভালো নয়, ছোট মেয়ের পক্ষে। দুশ্চিন্তা সেই জন্য আমার।
লিন্ডাকে আমার খুব ভালো লাগে। রোজামন্ড বললো, ওর মধ্যে ভালো লাগার মতো কি যেন একটা আছে।
ও ঠিক ওর মায়ের মতো, কেনেথ বললেন, সব কিছুই ভীষণ গভীরভাবে নেয়, যেমন রুথ নিতো। এরপর মনে হয় না, রোজামন্ড বললো, আর্লেনাকে ত্যাগ করা উচিত তোমার মামলা সাজিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের। হা, সবাই তাই করে আজকাল। কেনেথ মার্শাল রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন। হ্যাঁ, এ জিনিষটা সব চেয়ে ঘেন্না করি। ঘেন্না করো? ও ভীষণ চমকে গেলো। আজকাল জীবন যেন বড়ো খেলো হয়ে গেছে। যদি কোনো জিনিষ নিয়ে পড়ে সেটা ভালো লাগে না। সেটাকে ত্যাগ করতে আজকাল আর বাধা নেই। আশ্চর্য, মানুষের মনে বিশ্বাস বস্তুটা থাকা উচিত। একমাত্র তোমারই দায়িত্ব যদি কোনো মেয়েকে বিয়ে কর তাহলে তার ভরণপোষণের ভার একমাত্র তোমার। কারণ এ খেলা তুমিই শুরু করেছে। আমার ঘেন্না ধরে গেছে, বিয়ে হচ্ছে সহজ এবং আরও সহজ বিবাহ বিচ্ছেদ। আমার কাছে সব চেয়ে বড় কথা আর্লেনা আমার স্ত্রী।
রোজামন্ড সামনে ঝুঁকে নিচু স্বরে বললো, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমের তোমার কাছে অনেকটা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন কেনেথ মার্শাল। হ্যাঁ ঠিক তাই, তিনি বললেন। ও রোজামন্ড বললেন।
.
৩.২
একটা সঙ্কীর্ণ সর্পিল পথে লেদারকোম্ব উপসাগরে ফেরার পথে একটা বাকের মুখে মিসেস রেডফার্নকে একটু হলেই চাপা দিচ্ছিলেন হোরেস ব্ল্যাট। ক্রিস্টিন রাস্তার পাশে সারি দেওয়া গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই সশব্দে ব্রেক কষে থামলেন মিঃ ব্ল্যাট। বিশাল চোহারার পুরুষ মিঃ ব্ল্যাট। লালচে আভাস মুখের রঙে, তার চকচকে টাককে বৃত্তাকার পথে ঘিরে রেখেছে হালকা লাল চুলের আস্তরণ। সে জায়গার মধ্যমণি হয়ে থাকার ইচ্ছেটাই মিঃ ব্ল্যাটের একমাত্র উচ্ছ্বাস। যে জায়গাতেই নিয়ে যাক না কেন, তিনি এ মত প্রকাশ করেছেন সোচ্চারই। জলি রজার আনন্দ সঞ্জীবনীসুধার কিঞ্চিত প্রয়োজন আছে। ঘটনাস্থলে যখনই উপস্থিত হন, সেখানকার লোকেরা যে পদ্ধতিতে নিজেদের ক্রমশ অদৃশ্য এবং দ্রবীভূত করে ফেলে। রীতিমতো অবাক লাগে তার।
স্ট্রবেরিলর আচার বানিয়ে ফেলেছিলাম, আরেকটুকু হলেই বলেন কি? মিঃ ব্ল্যাট খুশির সুরে বললেন, হ্যাঁ সে আর বলতে, ক্রিস্টিন জবাব দিলো। মিঃ ব্ল্যাট বললেন, ঝটপট উঠে আসুন। আমার হাঁটতে ভালো লাগছে, ধন্যবাদ।
মিঃব্ল্যাট বললেন, যত্তো সব। তাহলে গাড়ির জন্ম হয়েছে কি করতে? ক্রিস্টিন রেডফার্ন নিরুপায় হয়েই উঠলো গাড়িতে।
ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আচমকা ব্রেক কষে রাখার ফলে। বোতাম টিপে আবার চালু করলনে। মিঃ ব্ল্যাট প্রশ্ন করলেন, আপনি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কেন বলুন তো? আপনার মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে ব্যাপারটা ঠিক নয়।
উঁহু একা থাকতে আমার ভালো লাগে, ক্রিস্টিন বললো। এক খোঁচা মারলেন কনুই দিয়ে ওকে মিঃ ব্ল্যাট। একই সঙ্গে গাড়িটা নিয়ে আর একটু হলে পাশের ঝোপে ধাক্কা মারছিলেন। ওই কথাই বলে মেয়েরা সবসময়–তিনি বললেন। ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মনের কথা আসলে ওটা ওদের। জলি রজার হোটেল, আমাদের ওটাকে ঘষে মেজে চাঙ্গা করে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কোনো মিল নেই, মনের সঙ্গে চরিত্রে প্রাণ নেই কোন। শুধু ভিড় করেছে একগাদা বাজে লোক এসে। প্রথমেই একপাল বাচ্চাকাচ্চা ধরুন। আর নীরস বুড়োবুড়িগুলি। এছাড়া রয়েছে বিরক্তিকর বুড়োটা ভারতবর্ষ ঘুরে আসা। আমাদের পাদ্রীসাহেব আর ঐ বিদেশীটা গোঁফওয়ালা। আমার হাসি পায় ওর গোঁফ দেখলেই। লোকটা নাপিত-টাপিত না হয়ে যায়। মাথা নাড়লো ক্রিস্টিন, উনি একজন গোয়েন্দা। উঁহু, মিঃ ব্ল্যাটের গাড়ি অল্পের জন্য সংঘর্ষের জন্য হাত থেকে রেহাই পেলো।
উনি ছদ্মবেশে রয়েছেন, আপনি বলতে চান গোয়েন্দা? হালকাভাবে হাসলো ক্রিস্টিন। না ও বললো, ওকে দেখতেই ওইরকম এরকুল পোয়ারো, শুনে থাকবেন আপনি নিশ্চয়ই ওঁর নাম।
নামটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, মিঃ ব্ল্যাক বললেন, হ্যাঁ ভদ্রলোকের নাম শুনেছি। যাই বলুন, আমার ধারণা ছিলো তিনি মারা গেছেন। উনি এখানে এসেছেন কি মতলবে? এরকম গোঁফওয়ালা গোয়েন্দারা মরে যাওয়াই উচিত। এমনিই ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি।
হতে পারে হু। মিঃ ব্ল্যাটকে এ ব্যাপারে মনে হয় লোকটা একটু কাঠখোট্টা ধরনের তাই না?
ইতস্ততঃ করে বললো, হ্যাঁ। মানে–অদ্ভুত ধরনের একটু বলতে পারেন।
মিঃ ব্ল্যাট বললেন, আমার কথা হলো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কি ঘুমিয়ে রয়েছে? আমি আর কাউকে ভরসা করি না শুধুমাত্র ইংরেজ ছাড়া।
মিঃ ব্ল্যাট বিজয়ীর ভঙ্গীতে ঘনঘন হর্ণ বাজিয়ে জুলি রজারের গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিলেন, গ্যারেজটা হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে মূল ভূ-ভণ্ডে অবস্থিত।
.
৩.৩
লেদারকোম্ব উপসাগরের একটা বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল লিন্ডা মার্শাল। দোকানে সারি সারি বই সাজানো কতকগুলো বইয়ের তাক। বই পড়ে নিতে পারেন দু পেনির বিনিময়ে। বইগুলো দশ বছরের পুরানো। আবার অনেকগুলো বিশ বছরের পুরানো আর বাকিগুলো আরো পুরানো।
লিন্ডা তাক থেকে বই নামানো প্রথমে একটা, তারপর আর একটা। মনে হল দি ফোর ফেদার অথবা ভাইসি ভার্সা কোনোটাই ভালো লাগবে না ওর পড়তে। তাই বাদামি মলাটের একটা ছোট বই নামিয়ে নিলো।
ক্রিস্টিন রেডফার্নের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই চমকে উঠলো লিন্ডা, তাকে আবার বইটাকে গুঁজে রাখলো নিমেষের মধ্যে। লিন্ডা কি বই পড়ছো?
লিন্ডা জবাব দিলো তাড়াতাড়ি, না কিছু না। খুঁজছি এখটা ভালো বই, দি ম্যারেজ অফ উইলিয়াম অ্যাশ বইটা ভালো করে না দেখেই টেনে বার করল। কাউন্টার দুপেনি দিলো। মিঃ ব্ল্যাট আমাকে পৌঁছে দিলেন, ক্রিস্টিন বললো, আমার সাহসে কুলোবে না সেতুটা পার হওয়া। কেনাকাটা করার বাকি আছে বলে তাই চলে এসেছি।
ভদ্রলোক বড় সাংঘাতিক তাই না। লিন্ডা বললো, যত সব বীভৎস রসিকতা করেন। আর শুধু টাকার গরম দেখান।
বেচারা। ওঁর জন্য দুঃখ হয়, ক্রিস্টিন বললো, একমত হতে পারলাম না। লিন্ডা মিঃ ব্ল্যাটের জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওঁর জন্য দুঃখিত কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ও কিশোরী এবং নির্মম। লিন্ডা দোকান ছেড়ে বেরিলয়ে পড়লো। ক্রিস্টিন রেডফার্ন কংক্রীটের সেতুর দিকে এগিয়ে চললো ঢালু রাস্তা ধরে।
লিন্ডা তখন নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। ওর ভালো লাগে ক্রিস্টিন রেডফার্নকে। মনে হয় ওর ক্রিস্টিন রেডফার্নকে এবং ক্রিস্টিন এই দুজনকেই সহ্য করা যায় কেবল। প্রথমত লিন্ডার সঙ্গে বেশি কথা বলে না ওরা। ওর পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিস্টিন নীরবে। বুদ্ধিমতীর পরিচয় এটাই। লিন্ডা ভাবলো, সত্যি যদি কিছু বলার না থাকে শুধু শুধু বকবক করার দরকার কি আছে।
কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল নিজের জটিলতায় নিজেই।
মিসেস রেডফার্ন হঠাৎ এক সময় বললো, কখনও মনে হয়নি আপনার। এত বিশ্রী এত ভয়ঙ্কর যেন ঠিক ফেটে পড়ার মতো এখানে সবকিছু।
প্রায় কথাগুলো হাস্যকর, চিন্তা-কুটিল কঠিন মুখে হাসির লেশমাত্র নেই লিন্ডার। ওর দিকে তাকালো ক্রিস্টিন রেডফার্ন, অনিশ্চিত অবুঝ কিন্তু ওর নজরে পড়লো না ও কিছু উপহাস করার মতো। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস স্তব্ধ হল মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক এই জিনিষটাই ও বলছে।
.
৩.৪
আঁ আপনি মশাই বিখ্যাত গোয়েন্দা। ওঁরা বলেছিলেন জলি রজারের পানশালায়। মিঃ ব্ল্যাটের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র।
এরকুল পোয়ারো স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে ব্ল্যাটের বক্তব্যকে সমর্থন করলো। বলে চললেন মিঃ ব্ল্যাট, কোনো কাজের জন্য এখানে এসেছেন? না-না এমনি ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। আমারও তো মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন। চোখ টিপলেন মিঃ ব্ল্যাট। মশাই ঐ কথাই বলবেন তাই না?
মিথ্যা বলে লাভ কি বিনা প্রয়োজনে–জবাব দিলেন পোয়ারো।
সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, হোরেস ব্ল্যাট বললেন, বলেই ফেলুন না বহু বছরের বিদ্যেটা মশাই যা শুনি হজম করে দিই। এ কাজ যদি না পারতাম আজকে এই অবস্থায় পৌঁছতে পারতাম না। বেশির ভাগ লোক কিছু কথা শুনলে যতক্ষণ না সেই শোনা কথা উগরে দিতে পারে ততক্ষণ সেই লোকেদের স্বস্তি পায় না। জিনিষটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। সেই কারণেই আপনাকে ভান করতে হবে যে, আমি শুধু এখানে ছুটি কাটাতেই এসেছি। আর অন্য কোন কারণ নেই।
আপনি এর উল্টোটাই বা ভাবছেন কেন? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন। মিঃ ব্ল্যাট মশাই ঘোড়েল লোক, চোখ টিপে বললেন। চরিত্র চেহারা দেখেই বুঝতে পারি। স্বাভাবিক ছিলো আপনার মতো লোকের পক্ষে দভিল লা টোকে অথবা জুয়ান-লা-পিন্স আত্মিক যোগ থাকা সম্ভব। জায়গাগুলোর সঙ্গে আপনার মন কি বলে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পোয়ারো, তিনি জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলেন। অঝোর বর্ষণ কুয়াশা ঘেরা দ্বীপে শুধু হয়েছে। আপনার কথাই ঠিক, তিনি বললেন। সেখানে বর্ষার আবহাওয়ার আয়োজন রয়েছে ভিন্ন। জুয়ার আড্ডা আমার প্রিয়, মিঃ ব্ল্যাট বললেন। কঠোর পরিশ্রমে বেশির ভাগ সময় কেটে গেছে, জীবনের কোনো সময় নেই আজ তা পেয়েছি, চেয়েছিলাম সম্মান, আমার টাকার দাম কারোর থেকে কম না, আমার যা মন চাইবে তাই করব বা করতে পারি। এটুকু বলতে পারি এ বছরে কিছু কিছু সুখ আনন্দ আমি দেখেছি।
অস্পষ্ট স্বরে পোয়ারো বললেন, তাই নাকি? মিঃ ব্ল্যাট বলে চললেন, কেন আমি এলাম। আমিও ভেবে অবাক হয়েছি, পোয়ারো বললেন। কি বললেন আঁ?
অর্থপূর্ণভাবে হাত নাড়লেন পোয়ারো। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কিঞ্চিৎ আমারও নেই তা না নয়। আমার পছন্দের প্রশ্ন উঠলে, এ জায়গার চেয়ে আপনি সহজেই ভিল বেছে নিতেন। আর আমরা তার বদলে দুজনে এসে হাজির হয়েছি এখানে। মিঃ ব্ল্যাট কর্কশ স্বরে হেসে উঠলেন। কেন এলাম সত্যিই ভেবে পাই না। তিনি বলে চললেন আনমনাভাবে, মনে হয় নামের সঙ্গে কেমন যেন অলীক গন্ধ জড়িয়ে ছিলো। জলি রজার হোটেল, স্মাগলার্স দ্বীপ আপনাকে চঞ্চল করে তোলে, ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয় তাই না। চোরাচালান, জলদস্যু এই সব।
নৌকা নিয়ে প্রচুর ঘুরে বেরিলয়েছে ছেলেবেলা থেকেই। পূর্ব উপকূল অঞ্চলে। এমনই পেশা এক পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায় না। ইচ্ছে করলে প্রমোদতরীও কিনে ফেলতে পারতাম একটা সাজানো গোছানো। আমার মনে ধরে না, এই জিনিষটা ঠিক তার চেয়ে ভালো নৌকায় ভেসে বেড়ান। রেডফার্নও ভালোবাসে নৌকা বইতে। এখন তো পাত্তা নেই ওর, বার তিনেক আমার সঙ্গে বেড়িয়েছে, মার্শালের বউয়ের পিছনে শুধু দিনরাত ঘুরছে।
ব্ল্যাট গলা নামিয়ে বলে চললেন, বেশির ভাগ লোক হোটেলের রসকষহীন শুকনো মাল। মিসেস মার্শালের প্রাণের ছোঁয়া একটু পাওয়া যায়। ওর পুরো দিনটা পার হয়ে যায় ওর বউয়ের পিছনে। মিসেস অভিনয় জগতে যখন ছিলেন গপ্পো চালু ছিল তার নামে। এখন যে নেই তা নয়। পুরুষদের মাথার ঠিক থাকে না ওকে দেখলে; কেলেঙ্কারী না বাধিয়ে ছাড়বে না এখানে।
কি কেলেঙ্কারী? প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। সেটা অবস্থার উপর নির্ভর করছে, হোরেস ব্ল্যাট উত্তর দিলেন। আমার মনে হয় মার্শাল একটু বদ মেজাজের লোক। আমি এটা ভালোভাবেই জানি। ওর সম্বন্ধে কয়েকটা কথা আমার কানে এসেছে, এদের মুখভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না। শান্ত লোক আর খুব কম কথা বলে সাবধান থাকা উচিত। গল্পের নায়ককে পানশালায় প্রবেশ করতে দেখেই থেমে গেল মাঝপথে তিনি।
বলেছিলাম না আপনাকে, সমুদ্রে নৌকা চালিয়ে সত্যিই মজা আছে..আসুন রেডফার্ন এক গ্লাস হয়ে যাক। আচ্ছা ড্রাই মার্টিনি খাবেন মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি? মাথা নেড়ে পোয়ারো অসম্মতি প্রকাশ করলেন। প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, পৃথিবীতে নৌকা চালানোর মতো নেশা আর কিছু নেই; এর পেছনে আমি অনেক সময় দিতে পারি। ছেলেবেলা থেকেই আমার এই সখ ছিলো। বেশির ভাগ সময়ই তো এই নৌকা নিয়ে থাকতাম। এ দিকটা তাহলে আপনি ভালোভাবেই জানেন, পোয়ারো বললেন। বলতে পারেন, হোটেল তৈরি হবার আগেই জায়গাটা চেনা আমার। এই দ্বীপে কেউ ছিলো না। লেদারকোম্ব উপসাগরে পুরানো আমলের বাড়ি। বাড়ি ছিলো এখানে একটা। এক পোডড়া বাড়ি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। প্রায় ধ্বংসাবশেষই বলা যায়। নানারকম গল্প চালু ছিলো, ওই বাড়ি থেকে পিক্সির গুহায় অনেকগুলো যাওয়ার পথ নাকি আছে। গুপ্ত পথ খুঁজে বেড়াতাম সব সময় মনে পড়ে। হোরেস ব্ল্যাটের গ্লাস কেঁপে উঠলো, পানীয় ছলকে পড়লো। তিনি প্রশ্ন করলেন, এই পিক্সির গুহাটা কি জিনিষ?
ও আপনি জানেন না? প্যাট্রিক বললো, চট করে খুঁজে পাবেন না গুহার ঢোকবার পথটা, পিক্সি কোভে আছে। পথটা একগাদা পাথরের মাঝে লুকানো রয়েছে। শুধু লম্বা একটা সরু ফাটল। কোনো মতে একজন ঢুকতে পারবে। গুহাটা সৃষ্টির কারণ, গুহার ভেতরটা বেশ বড়বড় চওড়া। ছোট ছেলেদের কাছে কেমন মজার ছিল বুঝতেই তো পারছেন, আমাকে বলে দিয়েছিল এক বুড়ো জেলে। ওখানকার জেলেরাও এ খবর জানে না। কেউ জবাব দিতে পারে না কেন এই জায়গাটাকে পিক্সি কোভ বলা হয়।
এরকুল পোয়ারো বললেন, ঠিক এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি কি জিনিষ?
প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, খাস ডেভনশায়ারের চীজ বলতে পারেন আপনি। শীপস্টোরের জলাভূমিতেও পিক্সির গুহা আছে একটা। পিক্সির জন্যে উপহার হিসেবে লোকে একটা করে আলপিন রেখে আসে। এ ধরনের আত্মা হল পিক্সি জলাভূমিতে বাস করে যারা।
হুঁ, বেশ কৌতূহলের ব্যাপার, এরকুল পোয়ারো বললেন।
প্যাট্রিক রেডফার্ন বলে উঠলেন, ডর্টমুরে এই পিক্সি নিয়ে অনেক কিংবদন্তী চালু আছে। মনে করা হয় পাহাড়ের চূড়ায় অনেক পিক্সি আছে। শোনা গেছে, কৃষকরা কুয়াশা ঘেরা রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরার পথ ভুলিয়ে দিয়েছিলো।
হোরেস ব্ল্যাট বললেন, তার মানে তারা দু-এক বোতল চড়িয়ে টং হয়ে থাকে।
হাসলো প্যাট্রিক। এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে বলুন। ব্ল্যাট চোখ রাখলেন হাত গাড়িতে, বললেন, এবার আমি চলি ডিনার সারতে। রেডফার্ন যা-ই বলুন, পিক্সিদের জলদস্যুদের আমি ঢের বেশি পছন্দ করি।
তিনি বেরিলয়ে যেতেই প্যাট্রিক রেডফার্ন সশব্দে হেসে বললো, আমার দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে ভদ্রলোকের কি দশা হয় পিক্সির পাল্লায় পড়ে।
পোয়ারো মন্তব্য করলেন আত্মগতভাবে, একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে মঁসিয়ে ব্ল্যাটের চিন্তাধারা একটু বেশি মাত্রায় কল্পনাবিলাসী।
তার কারণ ভদ্রলোক অর্ধশিক্ষিত, রেডফার্ন বললো। আমার স্ত্রী অন্তত তাই বলেন। এখন পর্যন্ত ভদ্রলোক যেসব বই পড়েন দেখুন, শুধু রহস্য রোমাঞ্চ আর কাউবয়দের কাহিনী।
আমার মন কি এখনও ছোট ছেলের মতো আপনি এই কথাই বলতে চান। আপনার কিন্তু তা মনে হয় না কেন? আমি ওকে কতটুকুই বা জানি। বারকয়েক তার সঙ্গে নৌকা নিয়ে বেরিলয়েছি। আমিও জানি না। একা একা থাকতেই ভালোবাসেন, সঙ্গীসাথী খুব একটা পছন্দ করেন না।
আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগছে। তার ডাঙার ব্যবহারের সম্পূর্ণ বিপরীত।
রেডফার্ন সশব্দে হাসলো, বললো, জানি, ওঁর কাছ থেকে সর্বদা শত হস্তেন থাকতে আমাদের রীতিমতো অসুবিধেয় পড়তে হয়। জায়াটাকে ম্যারগেট এবং লা টোকে-র মাঝামাঝি কিছুতে তৈরি করতে পারলে তিনি খুশি হন।
পোয়ারো নীরব রইলেন কয়েক মিনিট; তিনি মনোযোগর সঙ্গে হাস্যময় মুখমণ্ডলে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারপর আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বলে বসলেন, মঁসিয়ে রেডফার্ন আমার মনে হয় আপনি জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন।
প্যাট্রিক তার দিকে চেয়ে রইলেন অবাক হয়ে, ভালোবাসি, নিশ্চয়; কেন বাসবো না? কেন বাসবো না কেন?
পোয়ারো সমর্থন করলেন, আপনাকে আমি এ জন্মের জন্যে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রেডফার্ন মৃদু হেসে বললো, ধন্যবাদ এই প্রসঙ্গে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে, ছোট উপদেশ দিতে সাহস করছি আপনাকে বলুন? পুলিস বাহিনীর বিচক্ষণ বন্ধু বহু বছর আগে বলেছিলেন আমাকে, ভাই এরকুল যদি তুমি শান্তি চাও তাহলে স্ত্রীলোকদের এড়িয়ে চলবে।
প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, আপনার একটু দেরি হয়ে গেছে, আমি বিবাহিতা আপনি তো জানেন।
হ্যাঁ, জানি আপনার স্ত্রী একজন সুন্দরী মহিলা, এক মার্জিত রুচির; তিনি আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, আমার ধারণা।
প্যাট্রিক রেডফার্ন বলে উঠলো তীব্র স্বরে–আমিও ওকে যথেষ্ট ভালোবাসি।
এ কথা শুনে বড় সুখী হলাম। বললেন এরকুল পোয়ারো। রাগে ফেটে পড়লো প্যাট্রিক, আপনি কি বলতে চাইছেন?
হেলান দিয়ে চোখ বুজে চেয়ারে বসলেন পোয়ারো। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে ওদের সম্পর্কে। ওরা জীবনটাকে জটিল করে তুলতে পারদর্শিনী। তাদের ইংরেজরা প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে বড় অদ্ভুতভাবে আচরণ করে। মঁসিয়ে রেডফার্ন, আসাটা যদি এতোই জরুরী ছিলো আপনার, আপনি তাহলে আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না কেন?
রেডফার্ন বললো রাগী সুরে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলছেন।
এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললো, স্পষ্টই বুঝতে পারছি আমি। তর্ক করার মতো নির্বোধ আমি নই; আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি।
তাহলে আপনি ওই বেহদ্দ মেয়েছেলেগুলোর কথা শুনেছেন। মিসেস গার্ডেনার ওই রুস্টার মেয়েটা দিনরাত জিভ চালানো ছাড়া ওদের আর কোনো কাজ নেই। মেয়েটি যেহেতু ওদের মধ্যে বেশি সুন্দরী, সেহেতু ওকে ঘিরে যত সব নোংরা গাল-গল্প মুখিয়ে তুলেছে।
পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললেন, এখনও কি আপনার এ সব করার বয়স আছে? পোয়ারো মাথা নেড়ে পানশালা থেকে বেরিলয়ে গেলেন। প্যাট্রিক রেডফান আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো তার গমনপথের দিকে।
.
৩.৫
এরকুল পোয়ারো খবার ঘর ছেড়ে হলঘরে এসে দাঁড়ালেন থমকে। সবকটা দরজাই ভোলা। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এক ঝলক অনধিকার প্রবেশ করলো ঘরে।
ঘন কুয়াশাও মিলিয়ে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। তারা ঝলমলে রাত যেন আত্মপ্রকাশ করছে। পাহাড়ের কিনারায় ওর প্রিয় আসনে ক্রিস্টিন রেডফার্নকে আবিষ্কার করলেন এরকুল পোয়ারো। ওর পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, মাদাম আপনি ভিজে আসনে বসছেন, ঠান্ডা লাগবে আপনার এখানে বসা ঠিক নয়।
কিছু হবে না আর হলেই বা কার কি আসে যায়।
মাদাম আপনি তো আর শিশু নন, একজন শিক্ষিত মহিলা আপনি। অন্তত আপনার সব বুঝে শুনে করা উচিত।
উত্তর দিলো শীতল স্বরে, মঁসিয়ে পোয়ারো নিশ্চিত থাকুন ঠান্ডায় আমার কিছু হয় না।
আজকের দিনটা ছিলো বৃষ্টি ভেজা দিন, পোয়ারো বললেন। উঠেছিলো ঝড়, বর্ষা এসেছিলো, ঘন কুয়াশা আমাদের করে দিয়েছিলো অন্ধ। এখন কিন্তু মিলিয়ে গেছে কুয়াশা, আগের মতো আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চিকমিক করছে আকাশের তারারা জীবনটাও এইরকমের মাদাম।
ক্রিস্টিন চাপা স্বরে বললো, অসহ্য লাগে আমার সবচেয়ে কোন জিনিষটা বলবো।
মাদাম কি?
দয়া জিনিষটা। ওর শব্দটা যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়লো তীক্ষ্ণ স্বরে। ও বলে চললো, আমি কিছু বুঝিনা আপনারা ভাবেন? সর্বক্ষণ বলে বেড়াচ্ছে কিছু দেখি না? ইস্ বেচারা মিসেস রেডফার্নকে দেখে কষ্ট হয়, আমি এই জিনিষটা দেখে সহ্য করতে পারি না। আমাকে দেখে ওঁদের কষ্ট হচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে সাবধানে পাথরের আসনে বিছিয়ে দিলেন পোয়ারো, বসলেন। তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য রাখলেন, মিথ্যে নয় আপনার একথাটা।
মেয়েদের মাঝপথেই থেমে গেলো, ক্রিস্টিন। গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন-যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে মাদাম, কয়েকটা কথা বলি। কথাটা উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মতোই সত্যি? এই পৃথিবীর আলেনা স্টুয়ার্টরা অথবা মার্শালরা ধর্তব্যের মধ্যে কখনও আসে না।
বাজে কথা। ক্রিস্টিন রেডফার্ন বললো।
উঁহু, আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি সত্যি। কয়েক মুহূর্তের জন্য, তাদের রাজত্ব হয় ক্ষণস্থায়ী। এক মাত্র তারাই, সত্যিকারের স্থায়ী দাগ কাটেন তারাই; একমাত্র প্রশংসনীয় গুণ আছে, বুদ্ধি আছে, যাদের মধ্যে।
ক্রিস্টিন বললো ঘৃণাভরা স্বরে, আপনি কি ভাবেন পুরুষেরা গুণ বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব দেয়? এ সবের নিশ্চয়ই দেয় শান্ত স্বরে বললেন পোয়ারো। আমি কিন্তু একমত হতে পারলাম না, ক্রিস্টিন সংক্ষেপে হেসে বললো এইসব কথাগুলো! আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেন, পোয়ারো বললেন, তা জানা সম্ভব নয় আপনার পক্ষে।
হ্যাঁ, আমি তাকে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি জানি, ক্রিস্টিন ভেঙে পড়লো। হঠাৎ-ই ফুলে কাঁদতে লাগলো পোয়ারোর কাঁধে মাথা রেখে। ও বলে উঠলো, আর সইতে পারছি না…আর সইতে পারছি না…পোয়ারো সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন। ওর পিঠে হাত রেখে। ধৈর্য ধরুন, মাদাম ধৈর্য ধরুন শুধু একটু, আশ্বাসের সুরে বললেন।
ও উঠে বসলো অবশেষে। নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালে চোখ মুছে রুদ্ধ স্বরে বললো, মঁসিয়ে পোয়ারো এখন আপনি যান। আমি একটু একা থাকতে চাই।
ক্রিস্টিনকে একা রেখে পোয়ারো আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চললেন। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ কানে এল এক চাপা কথাবার্তার শব্দ।
কিছুটা এগোতেই তিনি দেখলেন আর্লেনা মার্শাল ও প্যাট্রিক রেডফার্ন ঝোঁপের সারির মাঝে ফাঁকা অংশে পাশাপাশি বসে আছে। পুরুষটির আবেগকল্পিত কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন, আর্লেনা আমি সবকিছু ভুলে যেতে বসেছি তোমার জন্য। আমাকে তুমি পাগল করে দিয়েছো, তুমি কি আমায় ভালোবাসো না। আমার জন্য একটুও ভাব না তুমি বলো। আর্লেনা মার্শালের মুখমণ্ডল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন পোয়ারো। তার মনে হলো, যেন কোনো বেড়াল আদরের উত্তাপে বসে অনুভব করছে, সুখ ভঙ্গীর সঙ্গে মানুষের চেয়ে পশুর সাদৃশ্য অনেক বেশি। আর্লোর হালকা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, নিশ্চয়ই প্যাট্রিক সোনা তোমাকে আমি ভালোবাসি তুমি তা জানো।
প্রথম তার অপশ্রবণে ক্ষান্তি দিলেন পোয়ারো। সরু ঢালু পথ ধরে হোটেলের দিকে আবার ফিরে চললেন। হঠাৎ মাঝপথে একজন সঙ্গ নিলেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল। মার্শাল বললেন, চমৎকার রাত কি বলেন? বিশেষ করে ওরকম একটা জঘন্য দিনের পর। চোখ তুলে তাকালেন আকাশের দিকে তিনি। মনে হচ্ছে কালকের আবাহাওয়া ভালোই থাকবে।