দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ১০

।। দশ।। 

তখন আমার প্রচণ্ড উত্তেজনা। শেষপর্যন্ত আমি বোধহয় ঠিক জায়গায় আঘাত দিয়েছি। এই কেবিন ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আমার ঠিক হবে না। হিং-এর গন্ধ আমায় সহ্য করতেই হবে। সমস্ত কেবিনটা আমি আবার পর্যালোচনা করতে বসলাম। 

আগামীকাল বাইশ তারিখ। বেলা একটা কিংবা রাত একটা কিছু একটা ঘটবে। আমি রাত একটার অপেক্ষায় আছি। এখন সন্ধ্যা সাতটা। আর ছ’ঘণ্টার মধ্যেই আমি সবকিছু জানতে পারব। জাহাজের পেটা ঘণ্টায় এক-একটা সময় নির্দেশক ঘণ্টা পড়েছে আর আমার উৎকণ্ঠা যেন বেড়ে যাচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়িতেই বিছানায় শুতে গেলাম। চোখে ঘুম নেই। কান খাড়া করে শুয়েছিলাম। রাত একটায় কিছু-না-কিছু একটা ঘটবেই। 

বাইরের করিডরে যাত্রীদের আনাগোনা ক্রমশ কমে আসছে। এক এক ঘরে কেবিনের আলো নিভে যাচ্ছে। একসময় একটা বাজার ঘণ্টা বাজতেই আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। 

এক, দুই, তিন, হঠাৎ করিডরে এক জোড়া পায়ের শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠলাম। তারপর বোমা পড়ার শব্দের মতো আমার কেবিনের দরজাটা খুলে গেল এবং একটা লোক আমার কেবিনের ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। 

লোকটা ভয়ার্তকণ্ঠে বলল, আমাকে বাঁচান, ওরা আমার পিছু নিয়েছে। দয়া করে আমাকে বাঁচান। 

এটা কোনো তর্কের সময় নয়। বাইরে পায়ের শব্দ। মাত্র চল্লিশ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত উঠে কেবিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখোমুখি হলাম। 

তার মতো ছ’ফুট দীর্ঘদেহী পুরুষকে কেবিনে লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিলের ব্যাপার। একহাতে কেবিন ট্রাঙ্কটা তুলে ধরলাম। লোকটা তার পিছনে বাঙ্কের উপর তার দেহটা বিছিয়ে দিতেই ট্রাঙ্কের ডালাটা তুলে ধরে তাকে আড়াল করলাম আর অপর হাতটা মুখ ধোয়ার বেসিনে মেলে ধরলাম এমন করে যে, কেউ যদি এই মুহূর্তে আমার কেবিনে আসে তাহলে তার ধারণা হবে, একজন মহিলা তার হাত ধোয়ার জন্য ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে সাবানের খোঁজ করছে। 

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় নক্ হতেই আমি বললাম, ভেতরে আসুন, দরজা খোলাই আছে।

ভেবেছিলাম, রিভলবার হাতে মিঃ প্যাগট ঘরে ঢুকবে। কিংবা আমার মিশনারি বন্ধু ঢুকবে বালির ব্যাগ হাতে নিয়ে, তার চোখে একরাশ প্রশ্ন। 

কর্তব্যপরায়ণ স্টুয়ার্ডের মতো বিনীত সুরে সে বলে, মাফ করবেন মিস, আমি ভাবলাম 

আপনি বুঝি আমাকে ডাকলেন। 

—না, আমি তো ডাকিনি। 

—আপনার ব্যাঘাত ঘটার জন্য আমি দুঃখিত মিস- 

—না, না, তাতে কি হয়েছে। ঘুম আসছিল না, তাই ভাবছিলাম, চোখেমুখে জল দিলে উপকার পাব। 

—আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিস, একজন মাতাল মেয়েদের কেবিনে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমাদের আশঙ্কা সে তাদের ভয় দেখাতে পারে। 

—ওঃ কী ভয়ঙ্কর! আমার ঘরে আসবে না তো? 

—না, তা মনে হয় না। যদিই বা আসে ঘণ্টা বাজাবেন। আমি এখন চলি। শুভরাত্রি।

—শুভরাত্রি। 

লোকটা চলে যাওয়ার পর দরজা খুলে করিডরে উঁকি মারলাম। না কিছু নেই। ভাবলাম, এই তার কৈফিয়ত। দরজা বন্ধ করে কেবিনে এসে ট্রাঙ্কটা সরিয়ে বললাম, দয়া করে এবার বেরিয়ে আসুন। 

কোনো সাড়াশব্দ নেই। পিটপিট করে বাঙ্কের দিকে ভালো করে তাকাতে দেখি আগন্তুকের দেহের কোনো নড়ন-চড়ন নেই। মনে হয় লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তার কাঁধে ঝাঁকুনি দিলাম। তবু সে একটুও নড়ল না। 

তবে কি মাতালটা মারা গেল? এখন আমি কি করি? 

তারপর কেবিনের মেঝের ওপর রক্তের দাগ দেখে শিউরে উঠলাম। কোনোরকমে লোকটাকে বাঙ্কের উপর থেকে নিচে নামালাম। না, লোকটা মরেনি। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম তার বাঁ-কাঁধে কেউ ছোরা দিয়ে আঘাত করে থাকবে। তাড়াতাড়ি তার দেহ থেকে কোটটা খুলে তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টায় মন দিলাম। 

ঠান্ডা জলের ঝাপটায় সে উঠে বসল চোখ মেলে। 

তাকে বললাম, দয়া করে একটু শান্ত হয়ে বসুন। 

কিন্তু সে উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, ধন্যবাদ! আমার জন্য আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। 

অমন উগ্র স্বভাব দেখে আমার খুব রাগ হল। আমি যে তার প্রাণ রক্ষা করলাম। তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকা দুরে থাক, একটা শুকনো ধন্যবাদ জানিয়েই শেষ। তবু আমি নিজের থেকে তাকে বললাম, ক্ষতটা বিশ্রীভাবে হয়েছে দেখছি। ওটা আমাকে ড্রেস করতে দিন। 

আপনি আমার কোনো উপকারে আসতে পারেন না। এমনভাবে কথাটা সে বলল, যেন আমি তার অনুগ্রহ ভিক্ষা করছি। বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনার এমন ব্যবহারের জন্য আমি আপনার প্রশংসা করতে পারব না। তা সত্ত্বেও আমার একান্ত অনুরোধ এভাবে সারাটা জাহাজে আপনার ক্ষতস্থানের রক্ত ছড়াতে ছড়াতে যাবেন না। দয়া করে আমাকে একটু সুযোগ দিন- এবার সে ফিরে এসে সোফায় বসতেই আমি আমার সাধ্যমতেই তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। 

এখনকার মতো এই ব্যান্ডেজটা কাজ দেবে। এখন আপনার একটু ভালো মনে হচ্ছে না? এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলার নেই আপনার? 

—আমি দুঃখিত। আপনার এই স্বাভাবিক কৌতূহল মেটাতে আমি পারছি না। 

কেন পারছেন না? 

সে হেসে, কোনো মহিলার কাছে যদি আপনি সেটা প্রচার করে দেন? 

আমি যে এটা গোপন রাখতে পারি ভাবতে পারলেন না কেন? 

সে উঠে দাঁড়িয়ে, মেয়েদের স্বভাব আমার বেশ ভালো করেই জানা আছে। 

—আজকের রাতের ঘটনা আমি প্রচার করে দিতে পারি। জানেন? 

বেসুরো গলায় লোকটি বলল, হ্যাঁ, আপনি যে তা করবেন তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

—উঃ, আপনার কী দুঃসাহস, চিৎকার করে বললাম। 

স্থির দৃষ্টিতে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকালাম। ভালো করে দেখতেই তার সারা অঙ্গের একটা পূর্ণ অবয়ব আমার চোখের সামনে ভাসছিল। ঘন কালে। কোঁকড়ানো চুল। ঝুলে পড়া গালের চোয়াল, হাল্কা কৌতূহলী চোখ তখন আমাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। দারুণ ভয়ঙ্কর লোক বলে মনে হতেই আমার মনোভাবটা গোপন রাখলাম। 

—আপনার জীবন রক্ষার জন্য আপনি কিন্তু এখনও আমাকে ধন্যবাদ জানাননি। আমি তাকে মাথায় আঘাত দিতে চাইলাম। এরজন্য আমি তোয়াক্কা করি না। তবু আমি তাকে আঘাত দিলাম। 

—ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা ছিল—এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। 

—আমার ঋণ স্বীকার করার জন্য আমি খুব খুশি। আমাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে আপনি এখান থেকে কিছুতেই যেতে পারবেন না। 

মানুষের দৃষ্টি যদি কাউকে খুন করতে পারত, তাহলে মনে হয় সে আমায় তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে তাই করত। তারপর সে আমাকে বিশ্রীভাবে ধাক্কা দিয়ে দরজার দিকে গেল। দরজার সামনে গিয়ে বলল, আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাব না। এখন তো নয়ই কোনো সময়েই নয়, তবে আপনার ঋণ আমি স্বীকার করি। একদিন এই ঋণ আমি শোধ করে দেব। সে চলে গেল, আমার হাতের মুষ্টি দৃঢ় হল এবং আমার বুকের স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। 

।। এগারো।। 

সেই রাত্রে আর কোনো উত্তেজনার কারণ ঘটেনি। পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর ডেকে গিয়ে বসতেই মিসেস ব্লেয়ার আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। 

সুপ্রভাত জিপসী মেয়ে, আসুন, আমার পাশে বসুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। 

তার পাশে বসতে বসতে বললাম, আপনি আমাকে কী নামে যেন সম্বোধন করলেন? 

—কেন, আপনি তাতে কিছু মনে করলেন নাকি? নামটা আপনার বেলায় খুব খাটে। শুরুতে আপনাকে দেখেই এই নামে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল। অন্য মেয়েদের থেকে আপনি যেন একটা আলাদা, জিপসী মেয়েদের সব গুণ আপনার মধ্যে দেখতে পেয়েছি। আমার কেমন যেন মনে হয়, আপনি এবং কর্নেল রেসের সঙ্গে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কথা বললেও এতটুকু বিরক্তবোধ করব না। 

—ভারি মজার ব্যাপার তো। আমি বললাম, আপনার সম্বন্ধেও আমি ঠিক একই ধরনের কথা ভেবেছিলাম। সত্যি, আপনি কী দারুণ মিশুকে, কেমন সুন্দর কথা বলে মানুষের মন জয় করতে পারেন। আপনি যেন একটা পূর্ণ আনন্দধারা। 

—খুব একটা খাবার উপমা তুমি দাওনি, এই দ্যাখো। তোমাকে তুমি বললাম বলে মনে কিছু কোরো না। তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট বলে তাই— 

—না, না, কিছু মনে করিনি। আপনি অহেতুক ব্যস্ত হচ্ছেন মিসেস ব্লেয়ার। 

—যাক, তুমি আমাকে বাঁচালে, তা জিপসী মেয়ে, বলো, তোমার নিজের সম্পর্কে কিছু বলো। তুমি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেন যাচ্ছ। তাই আগে বলো। 

বাবার জীবন সম্বন্ধে কিছু বললাম ওঁকে। 

ও, তুমি তাহলে চার্লস বেডিংফিল্ড-এর মেয়ে? আমি ভাবলাম তুমি অতি সাধারণ একজন কুমারী মেয়ে। তা তুমি কি আরও করোটির সন্ধানে ব্লোকেন হিলে যাচ্ছ? 

—যেতে পারি, অন্য আরও পরিকল্পনা আছে আমার। 

সত্যি, কী রহস্যময়ী তুমি। কিন্তু আজ সকালে তোমাকে যেন বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ভালো ঘুম হয়নি নাকি? অথচ আমার জাহাজে উঠলে ভীষণ ঘুম পায়। ওরা বলে, আমি নাকি বোকার মতো দশ ঘণ্টা ঘুমাই। ইচ্ছে করলে কুড়ি ঘণ্টাও ঘুমোতে পারি। দেখো-না, গতকাল রাত্রে একটা গর্দভ স্টুয়ার্ড আমার ঘুম ভাঙিয়ে সেই ফিল্ম রোলটা দিতে এসেছিল। সে নাকি খুব কায়দা করে হাতের মুঠোর মধ্যে সেটা ধরে ফেলেছিল ওপর থেকে পড়তে দেখে। 

—ঐ যে আপনার কর্নেল সাহেব আসছেন। 

—না, উনি আমার কর্নেল সাহেব নন। সত্যিই কি জান জিপসী মেয়ে, উনি তোমার খুব প্রশংসা করেন। তাই বলে তুমি আবার লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যেও না। 

—ঠান্ডায় গলাটা খুসখুস করছে, কেবিন থেকে মাফলারটা নিয়ে আসি। ছুতো করে পালিয়ে এলাম। যে কারণেই হোক কর্নেল রেসের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না। 

কেবিনে ঢুকে একটা অগোছালো ভাব লক্ষ্য করলাম। আমার বরাবরের অভ্যেস সবকিছু পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা, ড্রায়ার খুলেই বুঝতে পারলাম কেউ আমার ড্রয়ার খুলেছে কারণ ড্রয়ারের ভেতরের জিনযপত্র তছনছ করা। অন্য ড্রয়ারগুলো এবং ঝুলন্ত কাপবোর্ডটা খুলে দেখি সেখানেও কারোর হাত পড়ে থাকবে। কেউ কিছুর সন্ধানে আমার কেবিনে ঢুকেছিল এবং তাড়াহুড়োর জন্য ড্রয়ারের জিনিষপত্র এমন বিশ্রীভাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে গেছে। 

কে আমার কেবিনে অনুসন্ধান চালাতে পারে? আর কিসের খোঁজেই বা সে এসেছিল? সেই চিরকুটটার জন্যে? তা কী করে হয়? সে তো এখন অতীত। তার প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। গতকাল রাতের সেই উত্তেজনার মুহূর্তের কথা ভাবলাম, সেই যুবকটি যে আমার কেবিনে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করেছিল কে হতে পারে সে? আগে কখনও তাকে এই জাহাজে দেখিনি। তবে কি সে জাহাজ কোম্পানির লোক, না কি শুধুই যাত্রী? আর কেই বা তাকে ছোরা মারতে গেল? যাই হোক, সতেরো নম্বর কেবিন তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। বড় অদ্ভুত, বড় বিচিত্র, বড় রহস্যময় সব যেন। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। কিলমার্ডেন ক্যাসল-এ একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের কোথায় গিয়ে ফেলবে কে জানে। 

আমাকে সতর্ক হতে হবে। আমার সন্দেহের তালিকায় নামগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথমেই স্যার ইউস্টেস পেডলারের নাম মনে হল। ভদ্রলোক মিল হাউসের মালিক। তাঁর কিলমার্ডেন ক্যাসেল জাহাজে ভ্রমণ কাকতালীয় বলে মনে হলেও একটা যোগসূত্র যেন কোথাও থেকে যায়। 

মিঃ প্যাগটকেও সন্দেহ হয়। লোকটার বিশ্রী মুখ দেখলেই মনে হয়, লোকটা যেন ঘাঘু আসামী। সতেরো নম্বর কেবিনের দখল নিয়ে কেন যে সে অমন বিশ্রী ব্যবহার করল? জানতে হবে যে সত্যিই কি সে স্যার ইউস্টেস পেডলারের সঙ্গী হয়ে এখানে এসেছে? 

রেভারেন্ট এডওয়ার্ডও সন্দেহের তালিকাভুক্ত। সতেরো নম্বর কেবিনের দাবিদার সেও ছিল। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হচ্ছে হয়তো আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। গলায় রুমাল জড়িয়ে আবার ওপরের ডেকে উঠে এলাম। মিঃ এডওয়ার্ডকে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ওঁর সামনে গিয়ে গতকালের সেই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে তারপর বললাম, আপনি কি এই প্রথম আফ্রিকায় যাচ্ছেন? 

—হ্যাঁ, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই প্রথম, তবে পূর্ণ আফ্রিকায় নরমাংসভোজী আদিবাসীদের মধ্যে বছর দুই কাটিয়ে এসেছি। 

—দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার তো! আপনি নিশ্চয়ই অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন।

—বেঁচে গেছি মানে? 

—মানে—ওরা যে আপনাকে খেয়ে ফেলেনি এই যথেষ্ট। 

—মিস বেডিংফিল্ড, ওদের মতো পবিত্র মানুষের সম্বন্ধে এরকম বিশ্রী ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। 

নরমাংসভোজী মানুষরা যে পবিত্র হয়, আমার তা জানা ছিল না। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগল, মিঃ এডওয়ার্ড যদি সত্যিই আফ্রিকার ভেতরে দু’বছর কাটিয়ে থাকেন তাহলে তো ওর মুখটা আরো বেশি রোদে পোড়া তামাটে হত। ওর গায়ের চামড়া শিশুদের মতোই নরম এবং ফর্সা সাদা। তাই যদি হয়, কেন উনি আমার কাছে এমন মিথ্যে ভাষণ দিতে গেলেন? এই মিথ্যে ভাষণের কী প্রয়োজন ছিল? 

আমার মনের মধ্যে যখন মিঃ এডওয়ার্ডকে নিয়ে একরাশ প্রশ্নের ঝড় উঠেছিল, ঠিক সেই সময়ে ইউস্টেস পেডলারকে ডেকের পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখলাম। মিঃ এডওয়ার্ডের সামনে এসে তিনি মেঝের ওপর একটা কাগজের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সেটা ওর হাতে দিয়ে বললেন, ভুল করে এটা বোধহয় আপনি ফেলে দিয়ে থাকবেন। 

তিনি চলে গেলেন, সম্ভবত মিঃ এডওয়ার্ডের ইতস্তত ভাবটা তিনি দেখতেও পেলেন না। মিঃ এডওয়ার্ড যে জিনিসই ফেলে থাকুন-না সেটা পেয়ে তার মনে দ্বিধা, শঙ্কা দেখা দিল। তার মুখ দেখে মনে হল এই কয়েক সেকেন্ডে তার বয়স বেড়ে গেছে অনেকটা। সেই কাগজের টুকরোটা হাতের চেটোয় দলা পাকিয়ে ছোট্ট একটা বলের আকারে পরিণত করলেন, তাতে আমার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল। 

মিঃ এডওয়ার্ড বললেন, গীর্জায় বক্তৃতা দেবার জন্য একটি উপদেশবাণীর খসড়া তৈরি করেছিলাম। 

—তাই নাকি? গীর্জায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উপদেশবাণী। না, মিঃ এডওয়ার্ড, আপনার কৈফিয়তটা অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে হল আমার। 

একটু পরেই আমার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তিনি পালিয়ে বাঁচলেন। এইরকম একটা চিরকূট আমিও একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। পেডলার আমাকে তুলে দেননি। আমার সন্দেহের তালিকা থেকে মিঃ এডওয়ার্ডকে কখনোই বাদ দেওয়া যায় না। বরং তিনজনের মধ্যে তাকে এক নম্বর সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবেই ভাবলাম। 

মধ্যাহ্নভোজের পর কফি পান করার জন্য লাউঞ্জে গিয়ে দেখি স্যার ইউস্টেস এবং প্যাগট বসে আছেন মিসেস ব্লেয়ার এবং কর্নেল রেসের সঙ্গে। ল্যাটিন ও ইতালির ভাষার মধ্যে কোনটা শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে জোর বিতর্ক চলছে। মিসেস ব্লেয়ারের বক্তব্য, ইতালিয় ভাষা তার সব থেকে প্রিয়। 

—আচ্ছা প্যাগট। স্যার ইউস্টেস তার সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, ফ্লোরেন্সে গিয়ে তোমার অভিজ্ঞতাও কি একইরকম? 

হঠাৎ এই প্রশ্নটা প্যাগটকে বেশ উত্তেজিত করে তুলল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠি-ঠি-ঠিক—তা-তা-তাই—তারপর তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে চলে গেল। 

—বোধহয় প্যাগট ছোকরাটা ফ্লোরেন্স গিয়ে কোনো গর্হিত কাজ করে থাকবে। স্যার ইউস্টেস মন্তব্য করলেন, এর আগেও আমি কয়েকবার লক্ষ্য করেছি, ফ্লোরেন্স বা ইতালির প্রসঙ্গ উঠলেই হয় সে সেই প্রসঙ্গটা পাল্টাবার চেষ্টা করে, তা না হলে পালাবার চেষ্টা করে। 

—সম্ভবত সে হয়তো সেখানে কাউকে খুন করে থাকবে। মিসেস ব্লেয়ারের কথায় সন্দেহের ছায়া পড়ে, আমি আপনার বিশ্বাসে আঘাত করতে চাই না, তবু না বলেও থাকতে পারছি না, এক এক সময়ে ওকে ঠিক খুনীর মতো দেখায় 

—আমারও একথা মনে হয়েছে, সেই সঙ্গে আবার মজাও উপভোগ করেছি এই ভেবে যে, ওর মতো, আইন-সচেতক এবং কর্তব্যপরায়ণ লোক কী করে খুনী হতে পারে? 

কর্নেল রেস বলল, আচ্ছা স্যার ইউস্টেস, ও আপনার কাছে বেশ কিছুদিন ধরে আছে, তাই না? 

স্যার ইউস্টেস বললেন, বছর ছয় তো হবেই। 

মিসেস ব্লেয়ার মন্তব্য করলেন, তাহলে তো আপনার কাছে সে একজন অপরিহার্য ব্যক্তি বলুন। 

—হ্যাঁ, অপরিহার্যই বটে। কথাটা বলতে গিয়ে বেচারা ইউস্টেসের সারা মুখে বিমর্ষ ভাবের ছাপ পড়তে দেখা গেল। মিঃ প্যাগট তার যত না অপরিহার্য তার থেকেও বুঝি বেশি যন্ত্রণার। তবে তার মুখ দেখে আপনার মনে হবে, সত্যি লোকটা বিশ্বাসী। কোনো খুনীকে এমন বিশ্বাসী বলে মনে হয় না। 

তারপরেই আমাদের আলোচনার পর মিসেস ব্লেয়ার নিচে গেলেন ঘুমাবার জন্য, আর আমি ডেকের উপরে উঠে এলাম। কর্নেল রেস আমাকে অনুসরণ করল। 

 —আপনি বড় ছলনাময়ী মিসেস বেডিংফিল্ড। গতকাল রাতে নাচের আসরে আমি আপনাকে খুব খুঁজেছিলাম। 

—একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। 

—তা আজও গা ঢাকা দেবেন নাকি? নাকি আমার সঙ্গে নাচে যোগ দেবেন?

—আপনার সঙ্গে নাচতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম। একটু ইতস্ততঃ করে বললাম, কিন্তু মিসেস ব্লেয়ার- 

—আমাদের বন্ধু মিসেস ব্লেয়ার নাচের ব্যাপারে মাথা ঘামান না। 

—আর আপনি বুঝি মাথা ঘামান? 

—হ্যাঁ, বিশেষ করে আপনার সঙ্গে নাচতে আমার খুব আগ্রহ।

ওঃ! তাই বুঝি? 

আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত দুর্বলতা আছে কর্নেল রেস সম্বন্ধে। আমার আদর্শ পুরুষ। শান্তশিষ্ট স্বভাবের রোডেশীয় ভালোমানুষ যেন সে। আমি সম্ভবত ওকে বিয়ে করতে পারি। অন্য সব মেয়ে যেমন তার মনের মতো পুরুষের সান্নিধ্যে এসেই তাকে স্বামী কিংবা প্রিয় বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না, আমার মনের অবস্থাও ঠিক তাদেরই মতো, নারীর এই বিশেষ ধর্ম থেকে সরে থাকি কী করে? 

তাই সেদিন সন্ধ্যায় আমি ওর সঙ্গে নাচলাম। নাচ শেষ হওয়ার পর আমি যখন বিছানায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম তখন ও প্রস্তাব দিল ডেকে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবার জন্য। আমি রাজী হলাম। দুটো চেয়ারে আমরা পাশাপাশি বসলাম। 

কর্নেল বলল, জানেন মিস বেডিংফিল্ড, আমার মনে পড়ছে যেন আমি একবার আপনার বাবার সাথে মিলিত হয়েছিলাম। ভারি চমৎকার মানুষ তিনি। ওঁর রিসর্টের বিষয়বস্তু আমার খুব প্রিয়। 

এরপর আমাদের আলোচনা প্রত্নবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ হল। কিন্তু এ ব্যাপারে কয়েকটা ভুল তথ্য উচ্চারণ করাতে আমার মনে ওর সম্বন্ধে কেমন যেন সন্দেহ জাগল। 

নিজের কেবিনে ফিরে এলাম রাত বারোটা হবে তখন। তখনও আমার কানে কর্নেল রেসের ভুল তথ্যগুলো ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ভাবছি ও কি এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান যাচাই করার জন্য বার বার ভুল তথ্য প্রকাশ করে আমাকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। নাকি যাচাই করে জানতে চায় আমি সত্যি সত্যি অ্যানি বেডিংফিল্ড কিনা? 

কিন্তু হঠাৎ কেন ওর এমন মনোভাব হল? 

।। বারো।। 

(স্যার ইউস্টেসের দিনলিপির সারমর্ম ) 

বেশ শান্তিময় জাহাজের জীবন। তবু এরই মধ্যে চোলস্টার বার-এ ঢুকে অহেতুক হৈ-হুল্লোড় করে মানুষ যে কী আনন্দ পায়, সেটা আমার কাছে সবসময় রহস্যময় মনে হয়। যাই হোক পৃথিবীতে এমন অনেক বোকা লোকও আছে। এরাই আবার ঈশ্বরের প্রশংসা করে তাদের এভাবে টিকে থাকার জন্য। 

আমি একজন চমৎকার নাবিক। কিন্তু বেচারা প্যাগট ঠিক আমার মতো নয়। সোলেণ্ট ছেড়ে আসার পরেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার ধারণা আমার আর-একজন সেক্রেটারিও সামুদ্রিক অসুস্থতায় ভুগছে। তবে সে এখন বেপাত্তা। এই কারণেই মনে হয়, তার অসুস্থতার পিছনে কোনো রাজনৈতিক চাল থাকলে থাকতেও পারে। হয়তো অসুখটা তার একটা অছিলা মাত্র। 

সামগ্রিক ভাবে প্রায় সবাই অসুস্থ বলা যায়। তবু এরই মধ্যে দু’জন চমৎকার ব্রিজ খেলোয়াড় এবং একজন সুন্দরী মহিলা মিসেস ক্লারেন্স ব্যতিক্রম। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগেই টাউনে আমি মিলিত হয়েছিলাম। ওর সাথে কথা বলে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। তবে কর্নেল আনন্দ পান কিনা জানি না। হয়তো সে দেখতে ভালো তবে মাথা মোটা লোক। 

কোনো কাজের কাজ হয় না জাহাজে। আমি আবার প্রকাশককে গ্রীষ্মকালে আমার ‘স্মৃতিচারণ ‘ লিখে দেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু কি হবে লিখে, ‘স্মৃতিচারণ’ কে-ই বা পড়ে? প্যাগটের সাহায্যে আমি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি, সত্য কাহিনীর ব্যাপারে তারা বড় বেশি নিরাসক্ত। প্যাগটের সততার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। 

কেমন যেন মায়া হল, বললাম, বৎস, তোমাকে এখনো খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে। তোমার এখন সূর্যের আলোয় ডেক চেয়ারে বসে বিশ্রাম নেওয়া উচিত। সম্পূর্ণ বিশ্রাম, তার জন্য আমার কাজ থেমে থাকলেও আমার পরোয়া নেই। তুমি এখন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারো। 

তারপরেই জানলাম। বাড়তি কেবিনের ব্যাপারে সে উদ্বিগ্ন। 

—স্যার ইউস্টেস, আপনার কেবিনে কাজ করার মতো একটুও জায়গা নেই। বাক্স-প্যাটরায় ভর্তি। 

ওর কথার ধরন দেখে মনে হচ্ছে বাক্স-প্যাটরাগুলো বুঝি গুবরে পোকায় ভর্তি। যার জন্য সেখানে কাজ করা অসম্ভব। 

—ঠিক আছে, তোমার জন্য একটা বাড়তি কেবিনের ব্যবস্থা করব। 

প্যাগটের যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে সবকিছুকে জটিল ও রহস্যময় করে তোলা। পরদিন সে এক চক্রান্তকারীর মতো মুখ করে আমার সামনে এসে বলল, আপনি আমাকে ১৭ নম্বর কেবিনটা অফিস ঘর করার কথা বলেছিলেন? 

—বলেছিলাম বৈকি! কেন বাক্স-প্যাটরাগুলি কি দরজার সামনে জ্যাম হয়ে গেছে?

না, তবে আপনাকে আগে থেকে বলে রাখি। ঐ কেবিনটা সম্বন্ধে একটা ভয়ঙ্কর গুজব শোনা যাচ্ছে। 

—কিসের গুজব? ভূতের? ভয় নেই, লোহার টাইপরাইটার ভূত কখনো স্পর্শ করে না, হাসতে হাসতে বললাম। 

তারপরেও প্যাগট যা বলল, এই রকম : ভূতের ভয়ের জন্য আতঙ্কিত নয় সে। আসলে সে আদৌ ১৭ নম্বর কেবিনের দখল পায়নি। সে আমাকে সুদীর্ঘ কাহিনী শোনালো। শেষপর্যন্ত মিস বেডিংফিল্ডই নাকি সেই কেবিনের অধিকার পায় এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে প্যাগট ফিরে আসে। 

—অত ঝগড়ার কি দরকার ছিল বৎস, ১৭নং কেবিনের কথা বলেছিলাম তখন সেটা খালি ছিল বলে। কিন্তু তার জন্য মারমারি করার কথা আমি বলিনি। ১৩ কিংবা ২৮নং কেবিন পেলেও আমাদের চলে যেত। 

—কিন্তু আপনি জানেন না স্যার, ঐ কেবিনের একটা বিরাট রহস্য আছে নিশ্চয়ই। কেবিনটা মিস বেডিংফিল্ড পেলে কি হবে। আজ সকালে চিকেস্টারকে চোরের মতো সেই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। 

তার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালাম। লোকটা খৃষ্টধর্ম প্রচার করে বেড়ায়। যদিও তার দৃষ্টিতে এমন এক যাদু আছে যা বেডিংফিল্ডের মতো কিশোরীদের আকর্ষণ করে, তবু বলব, তার নামে কোনো কুৎসা রটালেও আমি তা বিশ্বাস করি না। ঠান্ডা গলায় বললাম, তাছাড়া অ্যানি বেডিংফিল্ডের মতো নিষ্পাপ ফুলের মতো সুন্দর মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। আহা, ওর পা দুটোই বা কী চমৎকার। 

প্যাগটের আদৌ পছন্দ নয় আমি ওর প্রশংসা করি। আরও বিরক্ত করার জন্য প্যাগটকে বললাম, মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হলে ওকে বোলো, কাল রাতে আমাদের টেবিলে যেন নৈশভোজ সারে ও। কাল এখানে ফ্যান্সি পোষাকের নাচের ব্যবস্থা আছে। ভালো কথা, এখুনি তুমি জাহাজের নাপিতের কাছে গিয়ে আমার জন্য একটা ফ্যান্সি কসটিউম পছন্দ করে নিয়ে এসো। 

—না, আপনি কখনোই ফ্যান্সি পোষাকে সেখানে যেতে পারবেন না। প্যাগট যেন আতঙ্কিত স্বরে বলল। 

সে আমার মর্যাদা হানির কথা ভাবছে সেটা আমি বুঝতে পারি। সত্যি বলতে কি ফ্যান্সি পোষাক পরার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই ছিল না কিন্তু এ-ব্যাপারে প্যাগটের অহেতুক উন্নাসিকতায় আমার একটা অদ্ভুত জেদ চেপে গেল ওর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। 

আমি জোর গলায় বললাম, কী বলতে চাইছ তুমি? আমি অবশ্যই ফ্যান্সি পোষাক পরব। অতএব এখুনি সেই পোষাকের ব্যবস্থা করো। 

—কিন্তু আমার মনে হয় না, আপনার মাপের কসটিউম পাওয়া যাবে। 

প্যাগটের ঐ স্বভাব—সব কাজেই বাধা সৃষ্টি করা। তাই বললাম, আর সেই সঙ্গে একটা সেলুনে ছ’জনের মতো একটা টেবিল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করো। ক্যাপ্টেন, সুন্দর সুডৌল পায়ের সেই মেয়েটি এবং মিসেস ব্লেয়ার আমাদের- 

—কিন্তু কর্নেল রেসকে বাদ দিয়ে মিসেস ব্লেয়ারকে আপনি পারবেন না, তাছাড়া আমি জানি কর্নেল রেস ওকে আগেই নৈশভোজে আপ্যায়ন করেছেন। 

প্যাগটের এই সবজান্তা ভাব আমার আদৌ পছন্দ নয়। তাই বললাম, কে এই রেস?

সবাই বলে, উনি নাকি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। বন্দুকের নলের মতোই তিনি ভয়ঙ্কর। অবশ্য কতটা সত্যি তা আমার জানা নেই। জানেন স্যার ইউস্টেস, সমস্ত ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। এই ধরুন না যাত্রার শুরুতেই আমার অসুখটা একটা বিরাট রহস্য। 

—শোনো বৎস, ওটা তোমার পিত্তজ্বর। এরকম অসুখে তুমি প্রায়ই আক্রান্ত হয়ে থাকে।

—না, এবার আমার সে অসুখ নয়। আমার বিশ্বাস ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ আমার সুস্থ শরীরটা বিষাক্ত করে দিয়ে থাকবে। 

—আঃ, কী যা তা বকছ? রেবার্ন–এর সঙ্গে দেখা করেছ? অনেক দিন ওকে দেখিনি। প্যাগট ঘাড় নেড়ে বলল, উনিও আমার মতো তাই মনে করেন। ওর কথায় মনে হয়েছে। এ ব্যাপারে উনি খুব ভালোই নজর রাখেন। 

—নজর? 

—হ্যাঁ, নজরই বটে, আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে স্যার, যদি আপনার ওপর কোনোরকম আক্রমণ হয় সেই জন্য। 

বিদ্রূপ করে বললাম, সত্যি কী চমৎকার লোক তুমি, প্যাগট। আমি যদি তোমার অবস্থায় পড়তাম তাহলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মনের সুখে একবার নেচে নিতাম। 

এবার কাজ হল, তার মুখ বন্ধ হল। আমি ডেকে ফিরে এলাম। মিস বেডিংফিল্ড তখন সেই ধর্মপ্রচারক চিকেস্টারের সঙ্গে গভীরভাবে কী যেন আলোচনা করছিল। মেয়েরা সবসময় একটু তোষামোদপ্রিয় হয়ে থাকে। 

দীর্ঘদেহী বলে নিচের দিকে ঝুঁকতে আমার খুব অসুবিধে হয়। তা সত্ত্বেও ওদের সামনে একটা কাগজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে একরকম বাধা হয়েই সেটা কুড়িয়ে ওদের দিলাম। কিন্তু আমার এই কষ্ট স্বীকারের বিনিময়ে সামান্য একটু ধন্যবাদও পেলাম না। ভালো করে দেখিনি তবে কেবল একটি বাক্যই ছিল : 

অযথা নাক গলানোর চেষ্টা কোরো না। ফল ভালো হবে না। 

প্রাপকের কাছে লেখাটা চমৎকার নিশ্চয়ই। আশ্চর্য হয়ে ভাবি। কে এই চিকেষ্টার? ছোকরা দেখতে তো দুধের মতন নরম। প্যাগট লোকটা সবজান্তা, মনে হয় তার ব্যাপারে সে কিছু জানতে পারে। 

মিসেস ব্লেয়ারের পাশে চেয়ারে দেহটা এলিয়ে দিয়ে বললাম, জানি না, আজকাল কী কারণে যে ধর্মপ্রচারকরা জাহাজে ভ্রমণ করে। তারপর মিসেস ব্লেয়ারকে নাচের ফ্যান্সি পোষাকে রাতের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালাম, সঙ্গে রেসকে বললাম। 

মিস বেডিংফিল্ড মধ্যাহ্নভোজের পর আমাদের টেবিলে এসে বসল। তার পা দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, বাস্তবিকই ওর পা দুটো সুন্দর সুডৌল এবং মসৃণ। এমন সুন্দর পা জোড়া এই জাহাজে অন্য কারোর নেই। আমি অবশ্যই ওকে নৈশ্য ভোজে আমন্ত্রণ জানাব। 

ফ্লোরেন্সে সে এমন কী গর্হিত কাজ করে এসেছে যে কারণে ইতালির প্রসঙ্গে উঠলেই কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাকে আমার অনেক আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল। 

আশ্চর্য হয়ে ভাবি তাকে আমি একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে কী করে চিহ্নিত করলাম?

প্যাগট—অপরাধী একজন। হয়তো সে তার কোনো গোপন অপরাধ আড়াল করতে চাইছে। অপূর্ব! 

।। তেরো।। 

এ যেন এক রহস্যময় সন্ধ্যা, এমন সন্ধ্যা বুঝি জীবনে আসেনি আমার। একমাত্র টেডি বিয়ারের কসটিউমই আমার দেহের সঙ্গে মানানসই হল। ইংলন্ডে শীতের সন্ধ্যায় কোনো সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে ভল্লুকের কসটিউম পরে নাচতে আমার সংকোচ হয় না। তবে এখানে এমন নরম আবহাওয়ায় ঠিক মানায় না। 

মিসেস ব্লেয়ার কসটিউম পরতে রাজি হননি। আর কর্নেল রেস তার একান্ত অনুগামী। তবে অ্যানি বেডিংফিল্ড-এর পছন্দ জিপসী কসটিউম এবং সেই পোষাকে ওকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। মাথা ধরেছে বলে প্যাগট অনুপস্থিত ছিল। তার পরিবর্তে রীভসকে আমি আহ্বান জানাই। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রমিক পার্টির সে একজন নামী সদস্য। বেঁটে চেহারার বিচিত্র মানুষ সে। তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খবরাখবর পাই বলে তাকে সঙ্গী করে নিয়েছি। 

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড আলোড়ন এনে দেয় নাচ। অ্যানি বেডিংফিল্ড-এর সঙ্গে দু’বার নাচ করলাম। মিসেস ব্লেয়ারের সঙ্গে একবার নাচলাম। অন্য সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ হলেও নিরাশ করতে হল। 

আমরা তারপরে নৈশভোজে মিলিত হলাম। শ্যাম্পেনের ফরমাস দিলাম। কিন্তু স্টুয়ার্ড পরামর্শ দিল ক্লিকোট ১৯১১-এ। তার পরামর্শে আমি রাজি হয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ড্রিঙ্ক করার পর কর্নেল রেস কথা বলায় যেন আমাকেও ছাড়িয়ে গেল। সে তখন আমাদের পর্যটক নায়ক। অনেক ঠাট্টা তামাশা করল সে আমার দিনলিপি লেখার ব্যাপারে। 

 —মিঃ পেডলার, আজকের দিনে আপনার অতীতের সব অদূরদর্শিতার কথা মনে করিয়ে দেবে।

প্রিয় রেস, আপনি আমাকে যতটা বোকা ভাবছেন, আমি ঠিক তা নই। হয়তো আমার কাজে ভুলচুক হতে পারে। কিন্তু সেসব কথা নিশ্চয়ই আমার দিনলিপিতে লিখব না। আমার মৃত্যুর পর আমার উত্তরাধিকারীরা দুনিয়ার মহান ব্যক্তিদের মতো আমার মতামত জানতে পারবে আমার দিনলিপি প’ড়ে। দিনলিপি অন্য লোকেদের মন মেজাজ সম্বন্ধে লিপিবদ্ধ করে রাখার পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক, কিন্তু কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে অবশ্যই নয়! 

একে কখনো কখনো অবচেতন মনে কেউ কেউ আত্মজীবনীও লিখে থাকে, থাকে না?

গম্ভীরভাবে বললাম। মনোবিজ্ঞানীদের চোখে সবকিছুই জঘন্য! 

মিস রেডিংফিল্ড বিস্ফারিত চোখে বলল, কর্নেল রেস, আপনার জীবনটা দেখছি দারুণ বৈচিত্র্যে ভরা। 

এইসব মেয়েদের স্বভাবই এইরকম। ডেসডেমোনার কাছে তার গল্পের জাল বুনে ওথেলো তাকে মোহিত করেছিল। কিন্তু ডেসডেমোনা যেভাবে গল্প শুনেছিল তাতে কি ওথেলোকে অবাক হতে হয়নি? 

মেয়েটির কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে কর্নেল একটা সিংহের কাহিনী বলতে শুরু করল। একটা লোক অনেক সিংহকে গুলি বিদ্ধ করে, আবার সেই লোকটাই নাকি অন্যায় সুযোগ নিয়ে বহু লোককে প্রতারণা করে। এইসময় আমারও কেন যেন একটা সিংহের গল্প বলতে ইচ্ছে হল। 

আমি মন্তব্য করলাম—এই প্রসঙ্গে একটা চমকপ্রদ গল্প আমার মনে পড়ল। আমার এক বন্ধু পূর্ব আফ্রিকায় শিকার করতে গিয়েছিল। কোনো কারণে একরাত্রে টেণ্ট থেকে বেরিয়ে আসে এবং সেই সময়ে মৃদু গর্জন শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে একটা সিংহ তার ওপর লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। ওদিকে তার রাইফেলটা টেণ্টে ফেলে এসেছিল। দ্রুত সে টেন্টের দিকে লাফ দিতেই সিংহটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সিংহটা দ্বিতীয়বার আবার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে আবার টেন্টের সামনে এসে গেছে। মুহূর্তে সে টেন্টের ভেতর গিয়ে তার রাইফেলটা তুলে নেয়। ততক্ষণে সিংহটা উধাও। বন্ধু তখন স্তব্ধ, হতবাক টেন্টের চারধারে অনেক খুঁজেও সিংহের সাড়াশব্দ পেল না। 

মনে হল আমার কাহিনী তাদের মনে ধরেছে। তাই শ্যাম্পেনের গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম। এই বন্ধুটির দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা আরও বেশি রোমাঞ্চকর এবং চমকপ্রদ। শিকার শেষে যখন বাড়িতে ফিরছিল গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য তাড়াতাড়ি করছিল। তাই বন্ধু তার অনুচরদের গাড়িতে খচ্চর জোড়ার জন্য হুকুম করল। তারপর হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে শুরু করল রাতের অন্ধকারে। পরে দিনের আলো ফুটে উঠতে দেখা গেল গাড়িতে একটা সিংহকেও জোড়া হয়েছিল। 

শ্রোতাদের এ গল্প ভালো লাগল, কিন্তু আমার সন্দেহ, আমার বন্ধু শ্রমিকদের এই কাহিনী তেমন মনঃপুত হয়নি। তাদের মুখ থমথমে এবং গম্ভীর দেখাচ্ছিল। 

সে উদ্বেগের সঙ্গে বলল, হায় ঈশ্বর, কে, কে তাকে বন্ধনমুক্ত করল? 

মিসেস ব্লেয়ারকে কেমন উত্তেজিত মনে হল, আমাকে রোডেসিয়ায় যেতেই হবে। কর্নেল, আপনার গল্প শোনার পর আর তো বসে থাকা যায় না। আমাকে যেতেই হবে। যদিও পাঁচদিনের ট্রেন যাত্রা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, তবু আমি যাবই। 

—তা আপনি আমার গাড়িতে গেলেই তো পারেন। 

—আহা, আপনি কি ভালো মিঃ পেডলার। সত্যি আপনি আমাকে আপনার গাড়িতে নিয়ে যাবেন? 

—সত্যি কি আমি তাই চেয়েছি? স্বগতোক্তি করে-আর এক গ্লাস শ্যাম্পেন পান করলাম।

–মিসেস ব্লেয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মাত্র এক সপ্তাহ পরেই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছি। 

আবেগের গলায় বললাম, আঃ! দক্ষিণ আফ্রিকা। সারা পৃথিবীকে দেখানোর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার কত কী না আছে। কী নেই? তার ফলের বাগান। কৃষিজাত দ্রব্য, তার উল, তার সোনা, তার হীরে- 

তখন আমি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, কারণ আমি জানি, এখুনি রীভস এসে পড়বে, আর ও আমাকে কানে কানে জানিয়ে দেবে, আমার সব গোপনীয়তা ব্যর্থতার পর্যবসতি হয়ে যাবে, কারণ সেখানকার জন্তু-জানোয়াররা এখন আর খাঁচার বাইরে থাকে না, তারা বন্দী হয়ে আছে। অতএব আমার গল্প মার খেতে বাধ্য। যাইহোক হীরের প্রসঙ্গে সেটা চাপা পড়ে গেল। 

—হীরে! কোনোরকমে দম নিতে নিতে মিসেস বেডিংফিল্ডও কৌতূহল প্রকাশ করল।

—আমার অনুমান, আপনি নিশ্চয়ই কিমবার্লিতে গিয়েছিলেন? 

গিয়েছিলাম বৈকি, কিন্তু সে কথা বলার সুযোগ পাইনি। মহামূল্যবান সোনা আর হীরের খনি। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের মুখ বন্ধ, তাদের কোনো দাবি নেই, নেই কোনো অধিকার ঐ সব মূল্যবান খনিজ সামগ্রীর ওপরে, প্রতি মুহূর্তে তাদের ওপর কড়া নজর পড়ে। ডে বিয়ার্স সবরকম সতর্কতা নিয়ে থাকে। 

মিসেস ব্লেয়ার বললেন, তাহলে কি কোনো হীরে চুরি করা কি একেবারেই অসম্ভব?

—কোনোকিছুই অসম্ভব নয় মিসেস ব্লেয়ার। যে-কোনো মুহূর্তে চুরি হতে পারে। কেন, আমি আপনাদের সেই কাফেরের গল্পটা বলিনি? কেমন করে সে তার দেহের ক্ষতস্থানে একটা হীরের টুকরো লুকিয়ে রেখেছিল? 

—হ্যাঁ, তবে একটা-দুটো হীরে চুরির কথা বলছি না। অনেক হীরে চুরি করা যায় কি? কর্নেল বলে, যুদ্ধের ঠিক আগে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে পেডলার, সেই সময়ে আপনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। 

মাথা নেড়ে সায় দিলাম। 

মিস বেডিংফিল্ড বলল, বলুন, সেই গল্প। 

কর্নেল হেসে, তাহলে শুনুন, স্যার লরেন্স আর্ডসলের নাম আপনারা সবাই নিশ্চয়ই শুনেছেন? দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিরাট স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে তাঁর ছেলের মাধ্যমে রাতারাতি তাঁর নাম সবার মুখে মুখে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের ঠিক আগে, একটা গুজব রটে যায় যে ব্রিটিশ গায়নার জঙ্গলে আর-এক নতুন কিমবার্লি লুকিয়ে আছে। সেখানে মূল্যবান হীরে খনি আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। দু’জন আবিষ্কারক সেই অংশ থেকে বড় বড় সাইজের দুটো হীরের টুকরো নিয়ে আসে। এই দুই যুবক জন আর্ডসলে এবং তার বন্ধু লুকাস দাবি করে বসে, তারা সেই জায়গায় বিরাট কার্বনের খনি আবিষ্কার করেছে। তারা কিমবার্লিতে এল সেই হীরেগুলো যাচাই করে দেখার জন্য। সেই সময়ে ডে বিয়ার্সে এক লোমহর্ষক ডাকাতি হয়ে যায়। ইংলন্ডে হীরে পাঠানোর সময় হীরেগুলো কয়েকটা প্যাকেটে মোড়া হয়ে একটা সেফে রাখা ছিল। যার দুটি চাবি দু’জন ভিন্ন লোকের কাছে থাকত। অপরদিকে তৃতীয় ব্যক্তি সেই সেফের চাবি খোলার রহস্যটা জানত। একদিন এই হীরের প্যাকেটটা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয় এবং সেই ব্যাঙ্ক সেগুলো ইংলন্ডে পাঠিয়ে দেয়। এক-একটা প্যাকেটের মূল্য প্রায় এক লক্ষ পাউন্ড। 

তবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কেমন যেন সন্দেহ হয়, আসল হীরেগুলো সেইসব প্যাকেট থেকে হয়তো চুরি গিয়ে থাকবে। প্যাকেটগুলো খোলা হল, তাদের অনুমান মিথ্যে নয়, প্যাকেটের ভেতরে কেবল চিনির গুঁড়ো পাওয়া গেল। যাই হোক, এ ব্যাপারে কিভাবে যে জন আর্ডসলের ওপরে সন্দেহ হল তা আমার জানা নেই। তবে তার স্বভাব চরিত্র নাকি ছেলেবেলা থেকেই বিগড়ে যায়। কেম্ব্রিজে থাকার সময়ে তার বাবাকে তার অনেক দেনা অনেক সময় শোধ করতে হয়েছে। জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিস তার কাছ থেকে ডে বিয়ার্সের কিছু হীরে উদ্ধার করে, কিন্তু সেই হীরে চুরির মামলা আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে না। জনের বাবা স্যার লরেন্স আর্ডসলে মামলাটা আদালতে ওঠার আগেই হীরের দাম মিটিয়ে দেন এবং ডে বিয়ার্সও তাকে অভিযুক্ত করতে চায়নি। কিন্তু সেই ডাকাতি যে কি করে হল তার খবর কেউ জানে না। তবে তাঁর ছেলে চোর—সেই দুঃখে তাঁর হার্ট খারাপ হয়ে গেল। তারপরেই তাঁর স্ট্রোক হয়। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জন একদিন সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখালো এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হল। মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্র লরেন্সের তৃতীয়বার স্ট্রোক হয় এবং গত মাসে তিনি মারা যান। তিনি কোনো উইল না করেই মারা যান। তাঁর বিরাট সম্পত্তি এবং অর্থের উত্তরাধিকারী এমন এক আত্মীয় হয়, যাকে তিনি খুব একটা ভালো চিনতেন না। 

কর্নেল থামল কিন্তু মিস বেডিংফিল্ডকে কেমন যেন চঞ্চল মনে হল। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার নবাগত সেক্রেটারি রেবার্ন তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই মুহূর্তে তার মুখ দেখে মনে হল যেন ভূত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে আছে কর্নেলের দিকে। মনে হয় কর্নেলের গল্পটা তার মধ্যে হয়তো আলোড়ন সৃষ্টি করে থাকবে। 

আমরা যে তাকে লক্ষ্য করছি সেটা খেয়াল হতেই দ্রুত সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল। মিস বেডিংফিল্ড আচমকা প্রশ্ন করল, লোকটাকে আপনি জানেন? 

—হ্যাঁ, ও আমার আর-একজন সেক্রেটারি, মিঃ রেবার্ন, এখনো ও অসুস্থ।

—উনি কি আপনার দীর্ঘদিনের সেক্রেটারি? 

—না, খুব বেশি দিনের নয়। 

—তা, কতদিনের? 

জাহাজে ওঠার ঠিক সময়েই আমি ওকে আমার সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করি। আমার এক পুরনো বন্ধু ওর হয়ে সুপারিশ করে পাঠিয়েছে আমার কাছে। 

মিস বেডিংফিল্ড নীরবতার মধ্যে ডুবে গেল। ওর মুখ দেখে মন হল ও কী যেন ভাবছে। অগত্যা আমি কর্নেল রেসের দিকে ফিরে তাকালাম। এবার আমার গল্প বলার পালা। 

স্যার লরেন্সের সেই আত্মীয়টি কে কর্নেল? আপনি জানেন? 

—হ্যাঁ, জানি বৈকি। তার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটল, আমি, হ্যাঁ আমি— 

।। চৌদ্দ।। 

(অ্যানির গল্পের শুরু)

ফ্যান্সি ড্রেসের রাত্রে আমি ঠিক করলাম কোনো একজনের ওপর আস্থা রাখার সময় হয়েছে। এতদিন আমি একা একা অভিযান চালিয়ে এসেছি। আমার সেই অভিযানের সুখ-দুঃখের একমাত্র দাবিদার আমি একা। কাউকে ভাগ নিতে দিই না। কেন জানি না এখন ভাবতে বসলেই আমার মনে হয়, আমার বিচারবুদ্ধির ওপর যেন আর আমার আস্থা নেই। এই প্রথম নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ বলে মনে হল। 

সেই জিপসী পোষাকে বাঙ্কের ওপর বসে বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবছিলাম। কর্নেল রেস মনে হয় আমাকে পছন্দ করে। লোকটা নিশ্চয় ভালো হবে। বেশ চালাক চতুর তো বটেই আর তার মধ্যে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব আছে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার ওপর আস্থা রাখা যায়। সে আমার সব চিন্তা-ভাবনা নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারবে এবং ওটাই আমার একমাত্র রহস্য। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে মনের দিক থেকে যেন সাড়া পাচ্ছি না। তাহলে কর্নেল রেসের ওপর আস্থা রাখা ঠিক হবে না। 

তারপর মিসেস ব্লেয়ার আমার প্রতি বিশেষ সদাশয়। তবে ওর ব্যাপারে আমি যে একেবারে গদগদ ঠিক তা নয়, হয়তো মুহূর্তের দুর্বলতা মাত্র। যাইহোক ভদ্রমহিলার জীবনে চাঞ্চল্যকর অভিজ্ঞতা, অমায়িক ব্যবহার, ঠুনকো মান-অভিমান নিয়ে মাথা ঘামানো, এইসব বাড়তি গুণের জন্যই বোধহয় ওকে আমি একটু বেশি মাত্রায় পছন্দ করে ফেলেছিলাম। 

সেই মুহূর্তেই ঠিক করলাম ওঁর সঙ্গে দেখা করব। তিনি নিশ্চয়ই এখনও বিছানায় আশ্রয় নেননি। কিন্তু ওঁর কেবিনের নম্বর তো আমি জানি না। হয়তো আমার রাতের স্টুয়ার্ডস নিশ্চয়ই ওঁর কেবিন নম্বরটা জানে। 

হ্যাঁ, সেই বন্ধু স্টুয়ার্ড-এর কেবিনের বেল টিপলাম। অনেকক্ষণ পর সাড়া পাওয়া গেল। মিসেস ব্লেয়ারের কেবিন নম্বর ৭১। দেরিতে সাড়া দেওয়ার জন্য ও ক্ষমা চাইল। 

আমি জানতে চাইলাম, তা অন্য স্টুয়ার্ডসরা কোথায়? 

—দশটায় সবার ছুটি হয়ে গেছে। 

—না, আমি রাতের স্টুয়ার্ডসের কথা বলছি। 

—রাতে কোনো স্টুয়ার্ডস থাকে না- 

—কিন্তু অন্য আর—একদিন যে, রাত তখন একটা হবে। একজন স্টুয়ার্ডসকে ডিউটি দিতে দেখেছিলাম। 

—আপনি নিশ্চয় তখন স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফিরে আসার সময় এই অদ্ভুত খবরটা আমার মনে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল। তাহলে? ২২ তারিখের রাত্রে আমার কেবিনের সামনে যে স্টুয়ার্ডটির আবির্ভাব ঘটেছিল, ও কে? আমার সেই অপরিচিত শত্রু কে হতে পারে? এইসব ভাবতে ভাবতে মিসেস ব্লেয়ারের কেবিনের সামনে হাজির হয়ে দরজায় নক করতেই সাড়া পেলাম, কে? 

—আমি, অ্যানি বেডিংফিল্ড। 

—ওহো তুমি, ভেতরে আসো জিপসী মেয়ে। 

ওর কেবিনে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করেই বলে ফেললাম, মিসেস ব্লেয়ার, আমি আপনাকে আমার জীবনের কাহিনী বলতে চাই। মনে হয় শুনতে আপনার একঘেয়েমি লাগবে না। 

—না, মোটেই না। তোমার জীবনের কাহিনী শুনতে আমার ভালো লাগারই কথা। তোমার সম্বন্ধে আমার আমার আলাদা একটা ধারণা আছে। জিপসী মেয়ে, তোমার জীবনে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য অবশ্যই আছে। তাই শুনতে ভালোই লাগবে আশা করি। এসো, আমার পাশে বসে তোমার মনের প্রকাশ ঘটাও 

আমার সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি প্রথমে একটা কথাও বললেন না। বরং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে বললেন, জান অ্যানি, তুমি অত্যন্ত অস্বাভাবিক মেয়ে একজন। তুমি কখনও অসহায়বোধ করনি? 

হতভম্বের মতো বললাম, অসহায়বোধ? 

—হ্যাঁ, কপর্দকশূন্য অবস্থায় একা একা জীবন শুরু করা। তার ওপর এমন অচেনা অদ্ভুত জায়গায় এসে তোমার সব টাকা যদি আত্মসাৎ হয়ে যায়। কী করবে তুমি? 

—সে পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত মাথা না ঘামানোই ভালো। এখনও আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। মিসেস ফ্লেমিং আমাকে পঁচিশ পাউন্ড দিয়েছিলেন। সেটা এখনও আমার হাতে আছে। তারপর গতকাল লটারিতে পনেরো পাউন্ড পেয়েছি। চল্লিশ পাউন্ড যথেষ্ট নয়? 

—তুমি ভাগ্যবতী, বিচক্ষণ, তাই চল্লিশ পাউন্ড হাতে পেয়ে অনেক টাকা ভাবছ। আমি তো সামান্য এই টাকায় বিদেশ ভ্রমণের কথা ভাবতেই পারতাম না। 

আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, এখন বলুন, এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন মিসেস ব্লেয়ার?

—এরকম রোমাঞ্চকর ঘটনা এর আগে আমি কখনো শুনিনি, এখন থেকে তুমি আমাকে মিসেস ব্লেয়ার বলবে না। সুজান বললে অনেক ভালো লাগবে। কী রাজি আছো তো? 

—হ্যাঁ, আমারও খুব পছন্দ, সুজান। 

—লক্ষ্মী মেয়ে। এখন কাজের কথায় আসা যাক। তুমি বলছ মিঃ পেডলারের অপর সেক্রেটারিকে তুমি ঠিক চিনতে পেরেছ। অর্থাৎ, ঐ লোকটাই ছুরিবিদ্ধ হয়ে তোমার কেবিনে আসে আশ্রয় নিতে, এই তো? 

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। 

—তার মানে, দুটি ঘটনার সঙ্গে মিঃ পেডলার জড়িত। প্রথম ঘটনা তার বাড়িতে একজন মহিলার খুন হওয়া এবং দিতীয়টি, রহস্যময় রাত একটার সময় তার সেক্রেটারির ছুরিবিদ্ধ হওয়া। মিঃ পেডলারকে আমি সন্দেহ করছি না। কিন্তু এ দুটি ঘটনা আবার কাকতালীয় বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোথায় যেন এর সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। হয়তো এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এমনও হতে পারে। 

তারপর সেই মহিলা স্টুয়ার্ডসের রহস্যজনক গতিবিধি। 

চিন্তিতমুখে সুজান বলতে থাকে, কিরকম সে? 

আমি তখন খুবই উত্তেজিত থাকার ফলে তাকে খুব একটা ভালো করে দেখার অবসর পাইনি। তবে হ্যাঁ, কেন জানি না মনে হয়েছিল তার মুখটা আমার খুবই পরিচিত। 

কি বললে, তার মুখটা তোমার পরিচিত বলে মনে হয়েছিল? এ নিশ্চয়ই পুরুষ ছিল, না? 

—অস্বাভাবিক লম্বা ছিল ও। 

—হুঁ! মিঃ পেডলার বা প্যাগট কাউকেই এ ব্যাপারে সন্দেহ করা যায় না। এই বলে একটা কাগজের টুকরো নিয়ে সুজান আপন মনে তার ওপর আঁকতে লাগল। 

—রেভারেন্ড এডওয়ার্ড চিকেস্টারের সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে। স্বগতোক্তি করে কাগজটা আমাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই কি তোমার সেই স্টুয়ার্ডস? 

—হ্যাঁ, এই তো। কিন্তু কে বল তো? তুমি কী বুদ্ধিমতী সুজান। 

রেভারেন্ড এডওয়ার্ড-এর ওপর শুরু থেকেই আমার সন্দেহ ছিল। মনে আছে আগের দিন আমাদের আলোচনার সময় সে কিরকম নার্ভাস হয়ে যায়, তার হাত থেকে কফি পড়ে যায়। 

—হ্যাঁ, তারপরে সে জোর করে ১৭ নম্বর কেবিনে প্রবেশ করতে চায়। 

—হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু আসলে রাত একটার সময় ১৭ নম্বর কেবিনে কী ঘটার ছিল? সেক্রেটারিকে ছুরি মারার জন্য নয় নিশ্চয়ই। কারণ তার জন্য নির্দিষ্ট সময়, বিশেষ দিনে, বিশেষ জায়গার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মনে হয়, তার সঙ্গে কারোর সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে থাকবে এবং যাওয়ার পথে সে ছুরিকাহত হয়। কিন্তু কার সঙ্গে? নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে নয়। হয় রেভারেন্ড এডওয়ার্ড নয় প্যাগটের সঙ্গে। 

—সেরকম কোনো সম্ভাবনা নয়, যে-কোনো সময়ই তো তারা দেখা করতে পারত। প্রসঙ্গের জের টেনে সুজান বলল, তাহলে কি সেই কেবিনে কোনো গোপন জিনিস লুকোনো আছে? 

—হ্যাঁ, সেটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, আগামীকাল সকালে তার প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেখানে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা হয়নি। 

—কেন, আগেরদিন রাতে যুবকটি ড্রয়ারে কিছু লুকিয়ে রাখেনি তো? 

—তাহলে নিশ্চয়ই আমার চোখে পড়ত। 

—তবে কি তারা তোমার সেই মূল্যবান চিরকুটটার খোঁজ করছে? 

—তা হতে পারে। কিন্তু তাতে কেবল সময় ও তারিখ লেখা আছে। আর সেই সময় ও তারিখ দুটোই এখন অতীত। 

—হ্যাঁ, তা বটে, যাইহোক। সেই চিরকুটটা কি তোমার সঙ্গে আছে? আমি সেটা একবার দেখতে চাই। 

এক নম্বর প্রমাণ পত্রটি আমি তার হাতে দিলাম। সে অবাক হয়ে সেটা পরীক্ষা করে বলে ১৭-এর একটা ফুটকি আছে। অথচ ১-এর পর ফুটকি চিহ্নটা নেই কেন? 

—কিছু জায়গার ছাড় আছে। 

—হ্যাঁ, দেখেছি, কিন্তু 

সেই চিরকুটটা যতটা সম্ভব বেশি আলোর সামনে মেলে ধরে মনোযোগ সহকারে সুজান সেটার ওপর দৃষ্টি দিল। তাঁর মুখে উত্তেজনার ছাপ ফুটল। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, অ্যানি, ওটা কাগজের একটা খুঁত। দেখো ভালো করে দেখো। অতএব ওটা তোমাকে এড়িয়ে যেতে হবে। তার মানে তিনটি সংখ্যার মাঝে দু’টি ছাড়— 

আমি তাড়াতাড়ি উঠে নতুন আলোয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই চিরকুটের সংখ্যাগুলো পড়লাম। ১১৭ ২২। 

সুজান বলল, দেখলে? এবার এর অর্থটা অন্য বলে মনে হয় না? সময় একটা তারিখ ২২, তবে কেবিন নম্বর ৭১। আমার কেবিন নম্বর! 

আমাদের নতুন আবিষ্কারে দু’জনেই তখন খুব খুশি। আমরা তখন এতই উত্তেজিত যেন সমস্ত রহস্যটা সেই মুহূর্তে সমাধান করে ফেলেছি। তারপর ধাক্কা খাওয়ার মতো মাটিতে পড়ে গেলাম। সামলে উঠে বললাম। কিন্তু সুজান, ২২ তারিখে কই এখানে তো কিছু ঘটেনি? 

—না, তা তো ঘটেনি বুঝতেই পারছি। 

তখন আর একটা সম্ভাবনার কথা আমার মনে পড়ল। 

—এটা তো তোমার কেবিন ছিল না। মানে জাহাজে ওঠার আগে তুমি তো এই কেবিনটা তোমার নামে সংরক্ষণ করনি? 

—না, জাহাজ কর্তৃপক্ষ পরে আমাকে এই কেবিনটা বরাদ্দ করে দেয়। 

—আগে এটা অন্য কারো নামে বরাদ্দ ছিল। কে, কে সে? 

এ ব্যাপারে আমাদের খোঁজখবর নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। জিপসী মেয়ে, আমি জানি, কে সে? জাহাজের সেই কর্মচারীটি আমাকে তার কথা বলেছিল, মিসেস নে-এর নামে কেবিনটা সংরক্ষিত হয়েছিল। মনে হয় বিখ্যাত মাদাম নাদিনার ছদ্মনাম। জান, সে একজন রুশী নর্তকী, লন্ডনে কোনোদিন তার আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু প্যারিস তার জন্য পাগল। যুদ্ধের সময় সেখানে তার অভূতপূর্ব সাফল্য ঘটে। সমস্ত ব্যাপারটায় একটা কুরুচির ছাপ থাকলেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় অবশ্যই, সেটা অস্বীকার করা যায় না। জাহাজের কর্মচারী আমাকে জানায় মেয়েটি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় জাহাজে আরোহণ করার ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করে। তার সম্বন্ধে কর্নেল রেস অনেক কথা বলে আমাকে। প্যারিসে সেই মেয়েটির নানান বিচিত্র কাহিনী প্রচলিত আছে। গোয়েন্দারাও তাকে সন্দেহ করে কিন্তু কোনো প্রমাণ পায়নি। কর্নেল রেস সেখানে উপস্থিত ছিল বলে আমাকে অনেক মজাদার কাহিনী শুনিয়েছে। সেখানে একটা সুসংগঠিত দল কাজ করে থাকে, তবে জার্মান নয়। সেই দলের প্রধানকে উল্লেখ করা হয় দ্য কর্নেল, সে সম্ভবত ইংরাজ। সে যে একজন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দাচক্র বলতে গেলে তার হাতের মুঠোয়। ডাকাতি, গোয়েন্দাগিরি, হঠাৎ কারোর ওপর চড়াও হয়ে আক্রমণ করা—এসব কাজ পরিচালনা করার ভার তার ওপর আর এসব ব্যাপারে একজন অতি নিরীহ মানুষকে খেসারত দিতে হয়। দারুণ চতুর, তাই মনে হয় এই মেয়েটি তার কোনো এজেন্ট। কিন্তু তাকে ধরার কোনো সুযোগই তারা পাচ্ছে না। হ্যাঁ, অ্যানি, আমরা এখন ঠিক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। এসব ব্যাপারে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পক্ষে নাদিনা আদর্শ মেয়ে একজন। ২২ তারিখের সকালে সেই মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় নাদিনা? কেনই বা সে জাহাজে আরোহণ করেনি? 

কারণ সে মৃত। নাদিনা মার্লোয় খুন হয়। 

আমার মনটা তখন উড়ে যায় এক নির্জন বাড়ির ততোধিক নির্জন একটা কক্ষে। মনে পড়ে যায় একটা পেন্সিল পড়ে যাওয়া ঘন্টার কথা। আর সেই ফিল্ম রোলের কথা। হয়তো সেই রোলে শেষ কোনো নির্দেশ পাঠানো হতে পারে। 

কথাটা মনে হতেই মিসেস ব্লেয়ারের গা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করি, তোমার সেই ফিল্মটা কোথায় সুজান, যেটা তোমার ঘরের ভেন্টিলেটারের মাধ্যমে তোমার ঘরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের তারিখটা ২২ ছিল না? 

—যেটা আমি হারিয়ে ফেলি, তার কথা বলছ? 

—সেই ফিল্মের রোলটাই যে, তা তুমি কী করে জানলে? মাঝ রাতে ঐ ভাবে কেউ তোমাকে কেনই বা সেটা ফেরত দিতে যাবে বলো? না, তা নয়, আসলে হলুদ টিনের বাক্স থেকে ফিল্মটা সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তার মধ্যে কোনো গোপন সংবাদ পাচার করা হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই। সেটা কি এখনও তোমার কাছে আছে? 

—হ্যাঁ, আছে বৈকি। বাঙ্কের র‍্যাক থেকে সেই তথাকথিত ফিল্ম রোলটা বার করে সুজান আমাকে দিল। 

সেটা ছিল একটা টিনের গোলাকৃতি কৌটো। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ফিল্ম রাখার উপযুক্ত। অনুভব করলাম, ওজনটা যেন একটু বেশি ভারি। অ্যাডহেসিভ টেপ দিয়ে কৌটোটো মোড়া ছিল বায়ুশূন্য রাখার জন্য। সেই টেপটা সরিয়ে ঢাকনা খুলেই বিরক্ত হয়ে আমার মুখ থেকে একটা ছোট্ট অস্পষ্ট শব্দ বেরিয়ে এল—পাথরের নুড়ি কয়েকটা! 

সুজান উত্তেজনায় চিৎকার করল, পাথরের নুড়ি না অ্যানি, এগুলো পাথরের নুড়ি নয়। হীরের টুকরো।