২. পরিকল্পনা

পরিকল্পনা

 শুরু হলো আলোচনা। সেভেন ডায়ালস একমাত্র সূত্র। কিন্তু এটাকে লক্ষ্য করে এগোতে গেলে সারা দেশ তোলপাড় করতে হয়।

–আচ্ছা সেটা না হয় ধরে নিলাম, জিমি বললো, প্রথমে যেখানে রনিকে গুলি করা হয়েছে সে জায়গাটা পরীক্ষা করতে পারি। অবশ্য পুলিস সে কাজ আগেই করে ফেলেছে।

-আপনি অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক কথা বলেন। বান্ডল বলে উঠলো।

–ধৈর্য ধরুন। সেরা গোয়েন্দারা এইভাবে এগোয়। তিন নম্বর প্রশ্ন হলো, জেরির মৃত্যু যে খুন এ ব্যাপারে আপনারা আমার সাথে একমত, তাই তো?

-হ্যাঁ, লোরেন বললো।

–তাহলে জেরি যদি নিজের হাতে ক্লোরাল না খেয়ে থাকে কেউ তার গ্লাসে জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। যাতে জেরি ঐ জল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরজীবনের মত ঘুমিয়ে পড়বে। এটা নিশ্চয়ই বাইরের কেউ করেনি। তাহলে লোকটা ঐ বাড়িতেই ছিল।

–ঠিক বলেছেন। বান্ডল সায় দিল।

–বাড়ির লোকজন আপনাদের বেশ পুরোনো তাই না?

-হ্যাঁ, বান্ডল বললো, ভাড়া দেবার সময় সবাই ছিল। তবে নতুন দুএকজন ছাড়া বাকিরা সবাই রয়েছে।

-কতজন চাকর-বাকর আছে, কারা নতুন এসেছে, কারা গেছে, তাদের নামের একটা তালিকা আপনাকে করতে হবে।

-কিন্তু চাকরদের মধ্যে কেউ, নাকি অতিথিদের মধ্যে কেউ?

 –তিনজন মেয়ে ছিল, ন্যান্সি, হেলেন আর শকস। আর ছিল জেরি ওয়েড, আমি, বিল এভারসলে ও রনি। স্যার অসওয়াল্ড আর লেডি কুট তো ছিলেনই। তাছাড়া ছিলো পঙ্গো, যার আসল নাম বেটম্যান, স্যার কুটের সেক্রেটারি।

এদের মধ্যে সন্দেহজনক কেউ নেই। লোরেন বললো।

-আমারও তাই মনে হয়। বান বললো, বাড়ির চিত্রকরদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। আচ্ছা, যে ঘড়িটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে?

-হ্যাঁ, সাতটা ঘড়ি পরপর সাজানো ছিল। জিমি বলে উঠলো। আটটা নয়। ভাবলেই কেমন লাগে। ঐরকম ঘড়ি অন্ধকার কোনো ঘরে থাকলে আমি ঢুকছি না সেই ঘরে।

-যদি রেডিয়াম বসানো না থাকে তাহলে অন্ধকারে তো দেখতে পাবেন না। বান্ডল বললো, সে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বললো, আমি নিশ্চিত, এটা হবে। একটু চুপ করে আবার বললো, ঘড়িগুলো কে কিনেছিল?

–আমরা সবাই মিলে?

–মতলবটা কার?

আমরা সবাই ভেবেছিলাম। আসলে জেরি ওয়েডকে কিভাবে ঘুম ভাঙিয়ে তোলা যায়, তারই শলা পরামর্শ চলছিল। অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির কথা প্রথম বলেছিল পঙ্গো। আমরা রাজী হয়েছিলাম। খুব সম্ভব বিল বলেছিল, বারোটা ঘড়ি কেনার জন্য। শেষ পর্যন্ত আটটা ঘড়ি কেনা হয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে, বাকি দুটো পঙ্গো আর লেডি কুটের জন্য। কিছু ভেবে চিন্তে এটা করা হয়নি। নিছক ঘটে গিয়েছিল।

বান্ডল ঠিক মেনে নিতে পারলো না। কিন্তু চুপ করে রইলো।

জিমি সমস্ত ঘনা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলো।

-মাফিয়া গোষ্ঠীর গন্ধ রয়েছে এর মধ্যে নিঃসন্দেহে। জেরি ওয়েডের কাছে এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে যায়। তবে এটা যে বিপজ্জনক কিছু সেটা সে বুঝতে পারেনি। অথবা পরে এমন কিছু ঘটেছিল যা ওর ধারণাকে পালটে দিয়েছিল। মনে হয় রনি ডেভেরোকে এ বিষয়ে কিছু বলেছিল। ফলে জেরিকে প্রাণ দিতে হলো। যতটুকু রনি জানতে পেরেছিল সেটাকে সম্বল করে সে এগোবার চেষ্টা করেছিল। সে-ও খুন হলো। কিন্তু ওরা দুজন যা জেনেছে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এগোতে হবে।

-মনে হয় এটা ভালোই হবে। ওরা আমাদের সন্দেহ করতে পারবে না। লোরেন বললো। ফলে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা কম হবে।

হঠাৎ কি মনে হতে জিমি দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ করে দরজা খুলে স্টিভেনসনকে ডাকলো মাধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করার জন্য।

প্রথমে ওমলেট দিয়ে খাওয়া শুরু হলো। এছাড়া রয়েছে পাখির মাংস ও হালকা একটা স্যুপ।

খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।

হঠাৎ বান্ডল চিৎকার করে উঠলো।আমি একটা গাধা, ভাবতে ভাবতে কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।

-কি?

–আপনি নিশ্চয়ই কর্ডাসকে চেনেন, যার নাম জর্জ লোম্যাক্স?

–হ্যাঁ, নামটা নিশ্চয় শুনেছি। বিল আর রনি দুজনেই বলেছিল।

–তিনি সেভেন ডায়ালস-এর কাছ থেকে একটা সাবধানী চিঠি পেয়েছেন।

–এটা কি সত্যি? জিমি ঝুঁকে পড়লো।

-সত্যি, বাবাকে তিনি কথাটা বলেছেন, এবার বুঝেছেন, এটা কোনো ব্যাপার নির্দেশ করছে?

জিমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে খুব ভালো ভাবে চিন্তা করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, তাহলে কর্ডাসের দেওয়া পার্টিতে কিছু একটা হতে চলেছে।

-হ্যাঁ। আমার ধারণাও তাই। বান্ডল বললো।

এবার জিমি লোরেনের দিকে তাকিয়ে বললো, যখন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন মনে হয় জেরির বয়স ছিল কুড়ি বছর। সবাই ঐ বয়সে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু জেরি করেনি। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত জেরি ইংল্যান্ডে ছিল না। ঐ সময় ও কোথায় ছিল তা কেউ জানে না। কিন্তু আমি বেশ খুঁটিয়ে দেখেছি। ও ঐ সময় জার্মানিতে ছিল। কারণ ও জার্মান ভাষা বেশ ভালো বলতে পারতো।

লোরেনের গালদুটো লাল হয়ে উঠলো।

 জিমি আবার বলতে শুরু করলো, জেরি পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরি করতো। সে ছিল হাসিখুশী, বোকা বোকা গোছের। কিন্তু এটা তার ওপরের আবরণ। আমার ধারণা ভেতরে ও ঐ দপ্তরে বেশ উঁচু পদে বহাল ছিল।

-এর থেকে কি বোঝা যাচ্ছে? বান্ডল জানতে চাইলো।

–এটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। লোম্যাক্সের বাড়ির ঐ পার্টিতে নামকরা কেউ একজন থাকছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বিল নিশ্চয়ই সেখানে কর্ডাসের ডান হাত হয়ে হাজির থাকবে। ও আমাকে কায়দা করে সেখানে নিয়ে যেতে পারে।

তার আগে বিলকে তালিম দিয়ে নিতে হবে। কারণ ও এ ব্যাপারে একদম আনাড়ী।

–আপনিই বলুন, সরল মনে জিমি বললো।

–বিল আমাকে এক ধনী তরুণ রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচয় দেবে। এই সব পার্টিতে ওরা ধনীদের কবজা করতে ব্যস্ত থাকে। আমি আগামীকাল বিলের সঙ্গে ডিনারে দেখা করছি। ওর কাছ থেকে জেনে নেবো কারা কারা পার্টিতে আসছেন।

–আপনি তো ঐ পার্টিতে থাকছেন না?

-কার্ডস আমাকে বিষের মতো ঘেন্না করে জানি। তবে এটাও ঠিক, উপায় অনেক আছে।

ঠিক হলো লোরেন যাবে না। বাইরে থাকবে। তাকে এখন বাড়ি গিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকতে হবে।

–তাহলে ঐ কথাই রইলো, জিমি বললো, তুমি কিছু করছে না।

–আমি কিছুই করছি না। লোরেন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলো।

লোরেন যেমন ভীরুর মতো কথাটা উচ্চারণ করলে, বান্ডলের কাছে সেটা অস্বাভাবিক ঠেকলো।

.

বান্ডল গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে

সবাই সব কথা বলে না, এটা একটা প্রবাদ বাক্য আছে। জিমি থেসিজার, বান্ডল ও লোরেনের মধ্যে কথাবার্তা হলো ঠিকই, কিন্তু তারা পরস্পরের কাছে কিছু কথা গোপন করে রেখেছে, এটা স্পষ্টতই বলা যেতে পারে।

জিমি থেসিজারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বান্ডল সোজা চলে গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সারে অফিসে।

সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটল বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। গোপন রাজনৈতিক কাজকর্ম দেখা তার প্রধান দায়িত্ব। এই ধরনের একটা তদন্তের কাজে জিমি চিমনিতে বছর চারেক আগে এসেছিলেন।

যখন বান্ডলকে সুপারিন্টেন্ডেটের ঘরে নিয়ে আসা হলো তখন তিনি জানলা দিয়ে বাইরে চড়াইপাখির খেলা লক্ষ্য করছিলেন।

-শুভ সন্ধ্যা, লেডি এইলিস। উনি জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন।

ধন্যবাদ।

বান্ডল কোনো ভূমিকা না করে কাজের কথায় এলো।

–স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে লন্ডন বা তার আশেপাশে যতগোপন ডেরা আছে তার একটা তালিকা আপনাদের কাছ থেকে শুনেছি। এদের মধ্যে অনেকগুলো বিপজ্জনক বলে মনে হয় না। আপনাদের?

এ ব্যাপারে একটা চমৎকার নিয়ম আছে। ব্যাটল বললেন। যারা যত বেশি কথা বলে, তারা তত কম বিপজ্জনক হয়ে থাকে।

–তাই আপনারা তাদের কাজে বাধা দেন না।

-ঠিক তাই। ওরা নিজেদের বুদ্ধির দূত বলে। সপ্তাহে যদি কোথাও গোপনে বসে রক্তের নদী নিয়ে কথাবার্তা বলে, তাহলে বাধা কোথায়। এতে আমাদের বা ওদের কারো ক্ষতি হয় না।

-কিন্তু কখনও কখনও এমনও তো হতে পারে যে, কোনো সমিতি যা তারা চায় তার চেয়েও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে? বান্ডল প্রশ্ন করলো।

হতে পারে।

-সুপারিন্টেভেট ব্যাটল, আপনি এমন একটা তালিকা আমাকে দিতে পারেন…যাদের সদর দপ্তর সেভেন ডায়ালস-এ আছে?

কথাটা শুনে ব্যাটল একটু চমকে উঠলেন। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, লেডি এইলিন, বর্তমানে ঐ নামে কোনো জায়গা নেই। জায়গাটা আগে বেশ খারাপ ছিল। বর্তমানে বেশ কিছু অংশ ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। জায়গাটা কখনোই কোনো সমিতির তীর্থক্ষেত্র নয়। তবে রোমান্টিক জায়গাও বলা যায় না।

–ওহ! বান্ডল কি বলবে বুঝতে পারলো না।

–আচ্ছা, এই জায়গাটার কথা আপনার মনে এলো কেন, বলতে পারেন?

বান্ডল একটু ইতস্ততঃ করে বলে ফেললোগতকাল একজন লোককে কেউ গুলি করেছিল। আমার ভয় হচ্ছিল লোকটি আমার গাড়িতে চাপা পড়েছে ভেবে।

–মিঃ রনি ডেভেরো কি?

–আপনি ব্যাপারটা জানেন, অথচ কাগজে কিছু ছাপা হয়নি।

–আমরা ঘটনাটা চব্বিশ ঘন্টা চেপে রাখতে চেয়েছিলাম। আগামীকাল সব কাগজেই এই ঘটনা প্রকাশিত হবে।

বান্ডল বললো, উনি মারা যাওয়ার আগে সেভেন ডায়ালস কথাটা বলেছিলেন।

মনে রাখবো।

 বান্ডল এবার অন্য পথে এগোল।

–গতকাল আপনার কাছে একটা ভয় দেখানো চিঠি নিয়ে মিঃ লোম্যাক্স এসেছিলেন। চিঠিটা সেভেন ডায়ালস-এর লেখা।

হতে পারে।

বান্ডল ভাবলো, বৃথায় ওঁর সঙ্গে কথা বলছে, যেন একটা শক্ত কাঠ।

সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল বললেন, আপনাকে একটা কথা বলবো, লেডি এইলিন।

–আমি জানি, আপনি কি বলতে চান। আমি বাড়ি গিয়ে চুপ করে বসে থাকবো। আর এই ব্যাপারটা আপনাদের হাতে ছেড়ে দেবো। বান্ডল বললো, তবে মনে রাখবেন, আপনাদের মত পেশাদারী জ্ঞান বা দক্ষতা আমার নেই। কিন্তু আমি আড়ালে থেকে সব কিছু কাজ করতে পারি। সেটা ভালো করে জানবেন।

সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল যেন একটু মর্মাহত হলো।

–অবশ্য, বান্ডল বললো, আপনি যদি গোপন রহস্যময় সমিতিগুলোর ঠিকানা আমাকে না দেন।

–নিশ্চয়ই দেবো।

ব্যাটল চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজায় মুখ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। বান্ডলের কেমন সন্দেহ হলো, ব্যাটলের তৎপরতা লক্ষ্য করে।

একসময় একজন লোক একটা টাইপ করা কাগজ সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটলের হাতে দিয়ে গেল।

কাগজটি হাতে নিয়ে ব্যাটল বললেন, নামগুলো শুনুন, ব্লাড ব্রাদার্স অব সেবাস্তিয়ান। দি উলফ হাউন্ডস, দি কমরেডস্ অপ পিস, দি কমরেডস ক্লাব, দি ফ্রেন্ডস অব অপ্রশেন, দি চিলড্রেন অব মস্কো, দি রেড স্কটল্যান্ড বেয়ারার্স, দি হেরিংস, দি কমরেডস অফ দি ফলস, এমনই আরো অনেক।

বান্ডল চিন্তা করল, এই নামগুলো দিয়ে ওর কোনো কাজ হবে না। তাই তাকে ওগুলো দেওয়া হলো। তাই সে বললো–আপনি কি চান, সব ব্যাপারটা আপনাদের ওপর ছেড়ে দিই?

-হ্যাঁ, আমি সেটাই চাই।

বান্ডল উঠে দাঁড়ালো। এই শক্ত কাঠকে কিছুতেই গলানো গেল না। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়লো। তুরুপের তাসের মতো কাজে লাগালেন।

সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, আমি আপনার কাজে বাধা দিতে চাই না। কিন্তু আপনি জানেন, আমি সব কিছুতেই নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। চার পছর আগে চিমনির ব্যাপারটার জন্য আপনি আমাকে সাহায্য করতে দিয়েছিলেন, তাই বলছি, যদি কোনো আপেশাদারের পক্ষে কিছু করার থাকে তাহলে সেই দায়িত্ব আমাকে দিন।

সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল চুপ করে রইলেন খানিক্ষণ। তারপর বললেন, আপনার জন্য একটা ছোট্ট ইঙ্গিত দিচ্ছি। আপনি বলি এভারসলের সঙ্গে দেখা করুন। সেভেন ডায়াল-এর ব্যাপারে ও আপনাকে অনেক কথা বলতে পারবে। ওর কাছ থেকে জেনে নিন। আর এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

.

বিলের সঙ্গে ডিনার

পরদিন সন্ধ্যায় কথামত বান্ডল এলো ডিনার খেতে। বিল ওকে দেখে খুশীতে উপচে পড়লো। সে তার খুশী নানারকম ভঙ্গী করে প্রকাশ করলো।

-বিল, তুমি কিছুদিন ধরে কি কাজ করছিলে? বান্ডল প্রশ্ন করলো।

–তোমাকে সেই কথাটাই বলার চেষ্টা করছিলাম। তোমার বুদ্ধি আছে যথেষ্ট। তাই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। জুটেছে এক ইয়াঙ্কি মেয়ে, নাম সেন্ট মাউর। ওর আসল নাম গোল্ড স্মিথ বা আব্রোসিয়ার।

বিলের বান্ধবীদের বায়নার ব্যাপারটা নানারকম। ওদের সংখ্যাও কম নয়। ওসব উড়িয়ে দিয়ে বান্ডল কাজের কথায় এলো, বললো–বিল, গতকাল আমি জিমি থেসিজারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয়?

–আজই সকালে দেখা হয়েছে। বিল নিজের কথায় ফিরে এলো। জানো, বেবকে যেমন সুন্দরী দেখতে, তেমনি গুণের। অন্য মেয়েরা হিংসে করে ভীষণ।

ইচ্ছা না থাকলেও বান্ডলকে বিলের কথা শুনতে হলো।

–আচ্ছা বিল, জিমি কি আগামী সপ্তাহে অ্যাবীতে আমার কথা কিছু বলেছিলো?

এতক্ষণে বিল বান্ডলের কথায় কান দিলো।

-হ্যাঁ, কর্ডাসকে বলতে হবে সেই ধরনের অনেক কথা বলে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকির।

–ঐটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। এবার বলল কারা কারা আসছে?

–সব সাধারণ মানুষ। তবে পার্লামেন্টের সদস্য মিসেস মাকাটা থাকছেন। আর থাকছেন সেই তরুণ হাঙ্গেরির বিমান পরিবহন মন্ত্রী স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, ও তার সেক্রেটারি টেরেন্স ও’রুরকে। এছাড়া রয়েছেন হের এবারহোর্ড, একজন বিষাক্ত জার্মান ভদ্রলোককে বার দুই লাঞ্চে নিয়ে যাওয়ার হুকুম পেয়েছিলাম আমি। তবে তার সম্পর্কে নানারকম গুজব শোনা যায়। লোকটা সারাক্ষণ দাঁত দিয়ে নিজের আঙুলের নখ কাটে।

-ইস, কি নোংরা, বান্ডল বললো।

–আর হ্যাঁ, স্যার অসওয়াল্ড কুট থাকবেন। লেডি কুটও আসতে পারেন।

বান্ডলের এখন চিন্তা করার অবকাশ নেই। সময় নষ্ট করতে যে চায় না। তাই সরাসরি বিলকে প্রশ্ন করলো–বিল, সেভেন ডায়ালস-এর ব্যাপারটা কি? এ ব্যাপারে তুমি সব জানো।

বিল তার দৃষ্টি বান্ডলের দিক থেকে সরিয়ে নিলো।

বান্ডল বুঝলো, ও এড়িয়ে যেতে চায়। তাই বললো, এত গোপনীয়তার কি আছে, বুঝি না।

-গোপনীয়তার কিছু নেই। মাঝে লোকের হুজুগ উঠেছিল তাই যেতো। বেশি দিন ভালোও লাগতো না।

–জায়গাটা কি?

বিল এবার ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল–তার মানে? তুমি তো সেভেন ডায়ালস-এর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলে, তার কথাই বললাম।

-ওর যে ঐ নাম জানতাম না।

—-ওটা একটা নোংরা জায়গা, টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের দিকে। পুরানো সবকিছু ভেঙে বর্তমানে নতুন করে সবকিছু বানানো হয়েছে। তবে সেভেন ডায়ালস ক্লাবটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাছ আর আলু ভাজা পাওয়া যায়। তবে কোনো অনুষ্ঠান দেখে আসার পর বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। নানারকমের লোক আসে। বিভিন্ন রকম মজার আলোচনা হয়। সস্তায় সময় কাটাবার বেশ উপযুক্ত জায়গা।

-বাঃ বেশ ভালোই। বান্ডল বললো, তাহলে আমরা আজ রাতে ওখানেই যাবো।

-না না, ওখানে যাওয়া চলবে না, বিল অসহায় ভাবে কথাটা বললো। আগেই তো বলেছি, আজকাল ওখানে কেউ যায় না।

কেউ যাক বা না যাক, আমাকে তুমি আজ রাতে ওখানে নিয়ে যাবে। কথাটা মনে রেখো, বান্ডল জেদ ধরলো, নিশ্চয়ই কোন গপন রহস্য আছে, তাই আমাকে নিয়ে যেতে তোমার আপত্তি?

– গোপন রহস্য? ওসব কিছু নয়। বিল বলতে থাকলো, মানে, একদিন রাতে বেব সেন্ট মাউরকে নিয়ে আমি ওখানে গিয়েছিলাম।

-তারপর? বান্ডল উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

-বেব গলদা চিংড়ি খাওয়ার বায়না ধরলো। একটা গলদা চিংড়ি লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। টানাটানিতে সেটা বেরিয়ে পড়লো।

গলদা চিংড়ির গল্প আর শেষ হয় না। অধৈর্য হয়ে বান্ডল বললো, ওসব গলদা চিংড়ির কথা বাদ দাও। তুমি জেনে রাখো, আজ আমরা ওখানে যাচ্ছি-ই।

বিল বার বার আপত্তি জানিয়ে বান্ডলের একগুঁয়েমির কাছে হার স্বীকার করলো।

জায়গাটা দেখে বান্ডল চমকে উঠলো, অবিকল তার ভাবনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সব। ১৪ নং হ্যাঁন্স্যামটন স্ট্রিটের একটি উঁচু বাড়ি। বাড়ির নম্বর বান্ডল লিখে রাখলো।

একটা অপরিচিত লোক দরজা খুলে দিল। বান্ডলকে দেখে সে একটু চমকে উঠলো। সঙ্গে বিলকে লক্ষ্য করে একটু ধাতস্থ হলো। লোকটার লম্বা চেহারা, গায়র রঙ ফর্সা, চঞ্চল দুটি চোখ। কোথায় যেন বান্ডল এই লোকটাকে দেখেছে।

ধোঁয়ায় ভর্তি একটা ঘরে ওরা নাচতে শুরু করলো। ধোঁয়ার জন্য ঘরটা নীলচে দেখাচ্ছিল। কিছু বিদেশী ইহুদী এছাড়া নানাধরনের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক মহিলাও ছিল, যাদের মধ্যে অনেকে প্রাচীন জীবিকা নির্বাহ করে।

বিল দোতলার যে ঘরে জুয়া খেলা হচ্ছিল সেখানে বান্ডলকে নিয়ে গেল, সেখানেও ঐ লোকটিকে দেখে আচমকা ওর স্মরণে এলো তার পরিচয়।

–আরে এ তো চিমনিতে কিছুদিনের জন্য ফুটম্যানের কাজ করেছিল। অ্যালফ্রেড, ভালো আছো তো? বান্ডল প্রশ্ন করলো।

-হ্যাঁ, ভালো আছি, মাদমোয়াজেল।

–তুমি চিমনির চাকরি কবে ছাড়লে?

একমাস আগে। এটা ভালো চাকরি। খুব ভালো মাইনে পাই।

ঘরে পা দিয়েই বান্ডল বুঝতে পারলো ক্লাবটির আসল বৈশিষ্ট্য। টেবিলের চারপাশে যারা জড়ো হয়েছিল তারা প্রত্যেকে জাত জুয়াড়ি নিঃসন্দেহে।

বিল প্রায় অধঘন্টা পর অধৈর্য হয়ে বান্ডলকে নিয়ে নিয়ে নেমে এলো। মাছ ভাজা, আলু ভাজা খাওয়া হলো।– তারপর ওরা বাড়ির দিকে রওনা হলো।

.

.

চিমনিতে খোঁজখবর

বান্ডলের মেজাজ ও চরিত্র ওর বাবার ঠিক উল্টো। ওর বাবা ঠান্ডা ধরনের অলস প্রকৃতির মানুষ। বান্ডল মনে মনে তিনটে মতলব তৈরি করেছিল। একদিনেই সেগুলো করতে হবে।

ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা বান্ডলের বরাবরের অভ্যাস। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে সে হিসপানোয় চড়ে চিমনির দিকে রওনা হলো।

–যাক, তুই এসে আমাকে বাঁচালি। ওর বাবা ওকে দেখে খুব খুশী। টেলিফোন করতে আমার ভীষণ বিরক্তি জানিস তো। গতকাল কর্নেল মেলরোজ ইনকোয়েস্টের জন্য এসেছিলেন। আগামীকাল বেলা বারোটায় রনি ডেভেয়োর ইনকোয়েস্ট হবে। মৃতদেহ যেহেতু তুই আবিষ্কার করেছিস, অতএব সনাক্ত করার দায়িত্ব তোর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মেলরোজ তোকে নিতে আসবে।

-বারোটা। বান্ডল বললো, ঠিক আছে তৈরি থাকবো।

–আর একটা কথা। জর্জ লোম্যাক্স আগামী সপ্তাহে প্যারীতে যাওয়ার কথা বলেছিল। আমি ওটা নাকচ করে দিয়েছি।

-ভালো করেছে। কোনো উদ্ভট ব্যাপারে না জড়ানোই ভালো।

-কেন সেরকম কিছু ঘটার আশঙ্কা আছে নাকি? আচমকা লর্ড কেটারহ্যাম আগ্রহ প্রকাশ করলেন?

-না, তুমি তো কি যেন ভয় দেখানো চিঠির কথা বলছিলে।

— বোধ হয় জর্জ খুন হতে চলেছে। বান্ডল, আমার কি যাওয়া উচিত?

-তুমি বরং বাড়িতে চুপ করে বসে থাকো। আমি মিসেস হাওয়েলের সঙ্গে কথা বলবো। বান্ডল বললো।

চিমনির আসল গৃহকত্রী হলেন মিসেস হাওয়েল। বান্ডল যখন ফ্রক পরে খেলা করতো তখন থেকে তিনি এখানে আছেন।

বেশ অনায়াসে বান্ডল তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল মিসেস হাওয়েলের কাছ থেকে। বাড়ির চাকর-বাকরদের সম্পর্কে বান্ডল যা জানতে পারলো, তাতে ওদের সন্দেহ করার কিছু নেই। তবে লেডি কুটকে যে বেগ দিয়েছিল মিসেস হাওয়েল তা তার কথা শুনে বোঝা গেল।

-স্যার অসওয়াল্ড কুটকে আমি কখনও দেখিনি। বান্ডল বললো।

-খুব চালাক ভদ্রলোক। অবশ্য সমস্ত কাজ দেখাশোনা করতেন মিঃ বেটম্যান। কোন কাজ কেমন ভাবে করা উচিত সে বিষয়ে তিনি দক্ষ ছিলেন।

বান্ডল এবার কৌশলে জেরি ওয়েডের মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে আনলো।কিন্তু মিসেস হাওয়েলের কাছ থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করা গেল না। বান্ডল নিচে নেমে এসে ট্রেডওয়েলকে ডেকে পাঠালো।

–ট্রেডওয়েল, আর্থার কেন এবং কবে চলে গিয়েছিলো, বলতে পারো।

–ও একমাস আগে নিজের ইচ্ছাতেই চলে গেছে, মাই লেডি। মনে হয় ও লন্ডনে গেছে। তবে নতুন যে এসেছে, জন সে-ও ভালো কাজ করে।

-ও কোথা থেকে এসেছে?

–আগে জন লর্ড মাউন্ট ভারননের কাছে কাজ করতো।

–ওর পদবী কি?

–বাওয়ার, মাই লেডি।

–বান্ডল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। সেই অবসবে ট্রেডওয়েল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একটু পরেই জন ঘরে এসে ঢুকলো। বান্ডল তাকে লক্ষ্য করলো। একজন পাকা চাকর বলে মনে হয়, হাবভাব একজন দক্ষ সৈনিকের মত। কিন্তু ওর পেছন মাথার দিকটা কেমন যেন অদ্ভুত।

বান্ডল একমনে একটা ব্লটিং পেপারে বাওয়ার নামের বানান লিখে চললো।

 হঠাৎ ওর দৃষ্টি ব্লটিং-এর এক জায়গায় আটকে গেল। ডেকে পাঠালো ট্রেডওয়েলকে।

–ট্রেডওয়েল বাওয়ার বানানটা কি রকম? –বি.এ.ইউ.ই.আর, মাই লেডি। এটি সম্ভবতঃ সুইশ নাম। ট্রেডওয়েলকে বিদায় দিয়ে সে আবার ভাবতে লাগলো, এটা জার্মান নাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। মাথাটা ঐরকম। তাছাড়া জেরি ওয়েড মারা যাওয়ার পনেরো দিন আগে ও চিমনিতে এসেছিল।

বান্ডল বাবার কাছে ফিরে এলো।

-বাবা, আমি মার্সিয়া কাকিমার কাছে যাবো।

–এমন মতলব মাথায় এলো কেন তোর? লর্ড কেটারহ্যাম মেয়ের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালেন।

মর্সিয়া অর্থাৎ মার্সিওনেস হলেন তার ভাই হেনরির বিধবা স্ত্রী। একসময় এই মহিলার নামডাক ছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারিরপদ তার ভাই পেয়েছিল। ওর স্ত্রীর গুণে এটা নিশ্চিত। আবার এদিকে লর্ড কেটারহ্যাম ভাবেন, অমন চোরের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে তার ভাই অকালে মৃত্যু হয়ে শান্তি লাভ করেছে। মহিলাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক। কেনসিংহের গুহায় বান্ডল বোকার মতো মাথা গলাতে যাচ্ছে, বুঝে পেলেন না লর্ড কেটারহ্যাম।

-বাবা, তোমাকে আবার বিরক্ত করছি, বান্ডল বললো, স্যার অসওয়াল্ড কি ভাবে ধনী হলেন?

ইংল্যান্ডে যে ইস্পাতের কারখানা আছে সেটা ওর। বর্তমানে লিমিটেড কোম্পানী হয়ে গেছে। তার একটার ডিরেক্টার ওর অনুরোধে আমি হয়েছি। কাজকর্ম কিছু থাকে না। বছরে কেবল দু একবার ক্যাসন স্ট্রিটে বা লিভারপুল স্ট্রিটের বড় হোটেলে খাওয়াদাওয়া ছাড়া।

এসব শোনার আর প্রয়োজন নেই বান্ডলের। সে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

শিশু পরিচর্যা আর ইস্পাতের সঙ্গে খাপ খায় না। অর্থাৎ মিসেস মার্কাটার সঙ্গে স্যার অসওয়াল্ডকে মেলানো যায় না। হাঙ্গেরির কাউন্টেসকে বাদ দেওয়া যায় বোধহয়। হের এবারহোর্ড হল আসল। তিনি এমন কোন কেউকেটা নন যে জর্জ লোম্যাক্স তাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। ইস্পাত সম্রাট স্যার অসওয়াল্ড তো আছেনই

এরকম আকাশ-পাতাল ভেবে কিছু থৈ পাওয়া যাবে না ভেবে বান্ডল তার কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলো।

বিশাল চেহারা লেডি কেটারহ্যামের। লন্ডনের উচ্চবিত্ত এলাকায় একটি মস্ত বড় গোমড়ামুখো বাড়িতে তিনি থাকেন।

বাড়িতে ঢুকতেই বান্ডলের নাকে ভেসে এলো মোমবাতি, পাখির দানা আর শুকনো ফুলের গন্ধ।

বান্ডলকে দেখে লেডি কেটারহ্যাম অবাক হলেন একটু।

-এইলিন, তুমি হঠাৎ দারুণ আনন্দের ব্যাপার। ঠান্ডা কণ্ঠস্বর লেডি কেটারহ্যামের।

–আমরা সবে ফিরেছি, কাকিমা। বাবা চিমনিতে এখন রয়েছেন।

–চিমনি ভাড়া দেওয়া আমরা কোনো কারণেই পছন্দ নয়। কত ঐতিহাসিক চিহ্ন আছে ঐ বাড়িতে। একে সস্তা করে দেওয়া উচিত নয়।

-বাবার রাজনীতি ভালো লাগে না। কিন্তু রাজনীতির মধ্যে কত ভালো ভালো ব্যাপার আছে সেটা জানতে পারলে আরো কত সুন্দর হয়।

বান্ডল আহ্লাদে আটখানা হয়ে মিথ্যে বলে গেল কায়দা করে। লেডি কেটারহ্যাম অবাক চোখে তাকালেন।

-তোমার ভাবনার ধরন দেখে খুব অবাক লাগছে। মনে হয় তোমার ভালো ঘরে বিয়ে হলে তুমি একসময় রাজনীতিতে বেশ চমৎকার জায়গা করে নিতে পারবে।

-ধন্যবাদ কাকিমা। বান্ডল এবার তার দিক পরিবর্তন করলো, ভাবছিলাম, তুমি মিসেস মার্কাটকে চেনো কিনা।

খুব চিনি। দারুণ বুদ্ধিমতী মহিলা। তবে, সাধারণতভাবে মেয়েরা পার্লামেন্টে দাঁড়াক এটা আমার পছন্দ নয়। লেডি কেটারহ্যাম বলে চললেন, অবশ্য তিনি যে কাজ করেন, তার দাম এখন খুব। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তোমার পরিচয় হওয়া দরকার।

বান্ডল ছদ্ম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, জর্জ লোম্যাক্সের বাড়ির এক পার্টিতে উনি যাচ্ছেন, আমি জানি বাবাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু যাবেন না, অবশ্য আমাকে নেমন্তন্ন করেননি। উনি মনে কবেন আমি একটা গবেট।

ভাসুরঝির এত উন্নতি দেখে লেডি কেটারহ্যাম খুশী হলেন।

–তুমি চিন্তা করো না এইলিন, তুমি যে বড়ো হয়েছে, এটা জর্জ লোম্যাক্স ভাবতেই পারছে না। আমি জর্জকে দিয়ে একাজ করাবোই। রাজনীতিতে অল্পবয়েসী মেয়েদের প্রয়োজন আছে, ওটা ও বুঝবে। দেশের স্বার্থে এটা দরকার।

লেডি কেটারহ্যামের পছন্দ করা কিছু বইপত্র নিয়ে বান্ডল ব্রুক স্ট্রিটের দিকে রওনা হলো।

জিমি থেসিজারকে ফোন করলো। রাজনীতি গুলে খাওয়া মার্সিয়া কাকিমার কথা বান্ডল জানালো। পড়ার জন্য অনেক বই দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা জর্জের পার্টিতে নেমন্তন্ন করাচ্ছেন।

জিমি জানালো, সে বিলকে শেষপর্যন্ত বোঝাতে পেরেছে। একগাদা কাগজপত্র দিয়েছে পড়ার জন্য। একেবারে নীরস ব্যাপার। সান্টা ফে সীমান্ত বিরোধ কেউ কোনো কালে শুনেছে নাকি সন্দেহ।

লোরেনকে এসব না বলাই ভালো। জিমি বললো, এরকম মেয়েকে বিপদের মুখে ফেলা ঠিক নয়।

–বোধ হয়।

–কাল ইনকোয়েস্টে যাচ্ছেন তো?

–হ্যাঁ, আপনি?

–আমিও যাবো। আজই সন্ধ্যার কাগজে এককোণে খবরটা ছাপা হয়েছে। খুব হৈ চৈ পড়ে গেছে।

-এবার পড়ায় মন দেবো, আপনি?

–আমিও তাই। শুভরাত্রি।

দুজনেই মিথ্যেবাদী নিঃসন্দেহে। লোরেন ওয়েডকে নিয়ে জিমি এখনই নৈশভোজে যাবে, সেটা সে ভালো ভাবে জানে। ওদিকে বান্ডল একজন সাধারণ পরিচারিকার পোশাক পরে সোজা রাস্তায় এলো। সেভেন ডায়ালস-এ যেতে বাসে না টিউবে গেলে সুবিধা হবে সেটাই ভাবছিল।

.

দি সেভেন ডায়ালস ক্লাব

১৪ নং হ্যান্সস্ট্রামট স্ট্রিটে যখন বান্ডল পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে ৬টা। ওর উদ্দেশ্য ছিল ফুটম্যান আলফ্রেডের সঙ্গে দেখা করা। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে বাকি কাজটা সহজ হয়ে যাবে। বেশি লোকের মুখোমুখি হতে ও চায় না।

মেঘ না চাইতেই জল।

দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো অ্যালফ্রেড।

বান্ডল মিষ্টি হেসে বললো-শুভসন্ধ্যা, অ্যালফ্রেড।

অ্যালফ্রেড প্রথমে চমকে উঠলো। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো, শুভসন্ধ্যা, মাদমোয়াজেল। আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি।

বান্ডল নিজের মনে মনে ঐ পোশাকের জন্য তারিফ করলো।

–অ্যালফ্রেড, তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। কোথায় গেলে ভালো হয়? ক্লাবে এখন কারা আছে?

-এখন কেউই নেই লেডি।

অ্যালফ্রেড চাবি বের করে দরজা খুললো। বান্ডল ভেতরে ঢুকলো। অ্যালফ্রেড গোবেচারীর মত তার পেছন পেছন এলো।

অ্যালফ্রেড, তুমি নিশ্চয়ই জানো, এখানে যা হয় সব বেআইনী।

 অ্যালফ্রেড ভীত পায়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

–এর আগে দুবার পুলিস এসেও আপত্তিকর কিছু পায়নি। কারণ মিঃ মসগোরোভস্কির চালাকি ছিল। এখানে কেবল জুয়া খেলা হয় না। অনেক কিছুই হয়, যা তোমার হয়তো জানা নেই। আমি তোমার থেকে জানতে চাই যে চিমনির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তুমি কত টাকা পেয়েছিলে? বান্ডল স্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

অ্যালফ্রেড চুপ করে শুনছিল। সাহস সঞ্চয় করছিল মনে হয়। কয়েকবার ঢোক গিললো।

–বলছি, মাই লেডি, যেদিন অনুষ্ঠান ছিল মিঃ মসগোরাভস্কি সেদিন কিছু লোক নিয়ে চিমনিতে এসেছিলেন। মিঃ ট্রেডওয়েলের পায়ে সেদিন পেরেক ফুটে যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে আমাকে সব দেখাশোনা করতে হয়েছিলো। মিঃ মসগোরোভস্কি বিশ্রাম করার অজুহাতে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকেন। তিনি আমাকে একশো পাউন্ড হাতের মধ্যে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে যেন চিমনি ছেড়ে চলে যাই এবং তার ক্লাবের দায়িত্ব নিই। ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে আমি মেনে নিলাম। বর্তমান মাইনে তিনগুণ টাকা। কথাটা মিঃ ট্রেডওয়েলকে বলতেই সব ঠিক হয়ে গেল।

বান্ডলের সন্দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, সে মাথা নুইয়ে সায় দিলো।

–মিঃ মসগোরোভস্কি কে?

–এই ক্লাবটা চালান। রাশিয়ান। খুব বুদ্ধিমান লোক।

–এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে বলে তোমার মনে কোন সন্দেহ হয়নি?

–রহস্য, মাই লেডি?

–অ্যালফ্রেড, জেল খাটতে রাজী নও নিশ্চয়ই।

–হায় ঈশ্বর, আপনি সেরকম কিছু ভাবছেন না তো?

বান্ডল গম্ভীর ভাবে বললো–গত পরশু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়েছিলাম। কিছু অদ্ভুত কথা শুনলাম। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। যদি সাহায্য করো, তাহলে তার বিনিময়ে তুমি পাবে নিরাপত্তা।

অ্যালফ্রেড রাজী হতেই বান্ডল প্রথমে সারা বাড়ি ঘুরে দেখতে লাগলো। তারপর এসে পৌঁছলো জুয়াখেলার ঘরে। চোখে পড়ে না, এমন একটা দরজা বান্ডলের দৃষ্টি এড়াতে পারলো না। তালা দিয়ে দরজাটি বন্ধ।

দরজাটা সম্পর্কে অ্যালফ্রেড বলতে শুরু করলো,-পুলিসের ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকটা দেয়াল আলমারীর মতই এই দরজা করা হয়েছে। দরজার ওপাশে একখানা ঘর আর সিঁড়ি আছে। পাশে রাস্তা। পুলিস হামলা করলে লোকেরা ঐ পথ দিয়ে পালায়।

–আমি ভেতরে ঢুকবোই। বান্ডল উত্তেজনা অনুভব করলো।

–আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, মাই লেডি। চাবি রয়েছে মিঃ মসগোরোভস্কির কাছে। বান্ডল বুঝেছিল, তালাটা অত্যন্ত সাধারণ। অন্য চাবি দিয়েও খোলা যায়। বান্ডলের চাপে পরে আলফ্রেড খুঁজে নিয়ে এলো। কয়েকবারের চেষ্টার ফলে তালা খুলে গেল।

ঘরের মধ্যে বান্ডল ঢুকলো। মাঝখানে একটা টেবিল, কয়েকখানা চেয়ার চারপাশে। ফায়ার প্লেসের দুপাশে দুটো গা-আলমারি। বিশেষ ধরনের তালা লাগানো আছে। অতএব চেষ্টা করা বৃথা।

অ্যালফ্রেড বুঝিয়ে দিলো, সাধারণ তাক বলে মনে হয়, কখানা লেজার রয়েছে। কিন্তু ঠিক বোতামটা টিপলেই ওটা খুলে যাবে।

ঘরের চারপাশে ও চিন্তিত মুখে দেখতে লাগলো। শব্দ নিরোধক ঘর। সাতখানা চেয়ার সাজানো। টেবিলের দুপাশে তিনটে করে আর টেবিলের মাথায় একটি।

বান্ডলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এটাই সেই গোপন সমিতির জায়গা, ও নিশ্চিত। আপাতদৃষ্টিতে কিছু বোঝার উপায় নেই।

–অ্যালফ্রেড, বান্ডল বললো, আমার লুকিয়ে থাকার মত একটা জায়গা তোমার ব্যবস্থা করতে হবে।

অ্যালফ্রেড মাথা নেড়ে বললো, এ অসম্ভব, মাই লেডি। আমার চাকরি তাহলে বাঁচাতে পিরবো না।

যখন তুমি জেলে ঢুকবে, তখন এমনিতেই চাকরি যাবে। তুমি চিন্তা করো না, কেউ কোনো কিছু জানতে পারবে না।

বান্ডলকে এখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পেয়ে বসেছে।

বান্ডল ঝুঁকি নেবেই। সে খুব ভালো ভাবে ঘরের চারদিকে আবার তাকালো। এগিয়ে গেল দ্বিতীয় আলমারির কাছে। তালা লাগানো ছিল। বান্ডল পাল্লা খুলতেই একরাশ বাসন বেরিয়ে এলো। তাকগুলো খালি করার ইচ্ছাতে সে বললো–অ্যালফ্রেড, সময় খুব কম, তুমি একটা ট্রে নিয়ে এসে বাসনগুলো নিচে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে তর্ক করলে বিপদে পড়ে যাবে।

অগত্যা অ্যালফ্রেড বাধ্য ছেলের মত বান্ডলের আদর্শে অনুযায়ী কাজ করলো।

তাকগুলো খুলে ফেলা যায়। বান্ডল দ্রুত হাতে তাকগুলো খুলে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে ভেতরে ঢুকে গেল।

–হু, বড় ছোট, ভেতরে কাঠ হয়ে থাকতে হবে। অ্যালফ্রেড, এবার একটা তুরপুনের ব্যবস্থা করো। যদি এখানে না পাও তাহলে কিনে আনতে হবে।

অ্যালফ্রেড দ্রুত চলে গিয়ে আবার ফিরে এলো কতগুলো যন্ত্র নিয়ে। ঐসব যন্ত্রের মধ্যে থেকে একটা বাছাই করে নিয়ে নিজের চোখ বরাবর কাঠের পাল্লায় একটা ফুটো করলো। ফুটোতে চোখ লাগিয়ে বান্ডল বললো, এতেই কাজ হবে। আমি ভেতরে ঢুকছি, তুমি তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে যাও।

-যদি মিঃ মসগোরোভস্কি চাবি চান?

–কেউই চাবির জন্য মাথা ঘামাবে না। আর যদি চায় বলবে হারিয়ে গেছে। আর শোন, একটু চকোলেট এনে দাও। ওতেই কাজ হবে। সবাই চলে গেলে খুলে দিয়ো। আর একটা কথা মনে রেখো, বেশি করতে যেয়ো না, কোনো গোলমাল হলে তোমার কিন্তু রেহাই নেই।

অ্যালফ্রেড চকোলেট রেখে দিয়ে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেল।