ক্রীড়ামঞ্চে ধাঁধা
মনে মনে অ্যাডাম বলে, মাথা দেবো তবু মাথা নোয়াবো না।
মিস বুলস্ট্রোডকে দেখে আশ্চর্য হলেন–এর আগে কোনো নারীকে এত বিস্ময়কর মনে হয়নি। ধীর স্থির মূর্তি অথচ চোখের সামনে তার সারা জীবনের কীর্তি চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। প্রায়ই টেলিফোন বাজছে, অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন…আরো একজন মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মিস বুলস্ট্রোড অবশেষে কর্তব্য নির্ধারণ করলেন। পুলিশ অফিসারদের কাছে মাপ চেয়ে নিয়ে তিনি অ্যান স্যাপল্যান্ডকে ডেকে একটা ছোট্ট ঘোষণা লেখালেন, এই পর্বের শেষপর্যন্ত স্কুল বন্ধ রইল। যাদের পক্ষে মেয়েদের এখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা আছে তারা ইচ্ছে করলে মেয়েদের এখানে রাখতে পারেন, স্কুল থেকে তাদের দেখাশোনা করা হবে।
দরজা দিয়ে বেরুতে গিয়ে অ্যান থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ক্ষমা করবেন মিস বুলস্ট্রোড। একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন…এখুনি কি এরকম একটা কিছু করা ঠিক? মানে…আতঙ্ক একটু কমে গেলে লোকে যখন বিবেচনা করে দেখবে…তখন নিশ্চয়ই মেয়েদের নিয়ে যেতে চাইবে না। জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে তারা বুঝতে পারবে।
কেলসির দিকে তাকিয়ে, এখন সবই আপনার উপর নির্ভর করছে ইনসপেক্টর। হত্যাকাণ্ড গুলির সমাধান করুন…যারা এসবের জন্য দায়ী, তাদের ধরুন…আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
কেলসি অখুশি মনে বললো, আমরা যথাসাধ্য করছি।
টেলিফোন বাজতেই মিস বুলস্ট্রোড রিসিভার তুলে নেন, বলুন? ইনসপেক্টরকে ইশারায় ডেকে বললেন, আপনার ফোন।
টেলিফোন না রেখে একমুহূর্ত চিন্তা করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে–মহামান্য আমীর আজ সকালে একটা চিঠি পেয়েছেন, মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছে তার কাছে। পোর্টমাউথ ডাকঘরের মোহর, তবে ওটা ধোঁকা।
অ্যাডাম বলে, কোথায় কীভাবে টাকাটা দিতে হবে?
অ্যাণ্ডারটন প্রীয়র্সের দুমাইল উত্তরে চৌরাস্তা, চারিদিকে শুধু ধুধু মাঠ। কাল রাত দুটোয় ঐ চৌরাস্তায় অটোমোবাইলের অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাক্সের পাশেই টাকাটা একটা খামে পুরে রেখে দিতে হবে, পাথর চাপা দিয়ে।
কত?
কেলসি বলে, বিশ হাজার, মনে হচ্ছে আনাড়ি লোকের কাজ। মিস বুলস্ট্রোড বলেন, আপনি কী করবেন?
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, সফল হবেন আশাকরি।
অ্যাডাম বলে ওঠে, সহজ কাজ?
.
অ্যাডাম ক্রীড়ামঞ্চে একা..নিপুণ হাতে দেরাজগুলো আঁতিপাঁতি করে খোঁজে। বৃথা আশা কিছুই পাওয়া যাবে না। যেখানে পুলিশে কিছু পেলো না, সেখানে সে আর কী পাবে? তবু বলা কী যায় একেকটা বিভাগের একেক রকম পদ্ধতি। এখানেই কিছু লুকানো আছে। বারবার তারই খোঁজে হত্যাকারী আসে। গুপ্তধন নিশ্চয়ই নেই, সে সম্ভাবনা কেটেই দেওয়া আছে। কোনো চোরকুঠুরী বা ভুয়ো দেরাজ কি স্প্রিং দেওয়া হাতল-টাতলও নেই। দেরাজগুলোতেও কোনো রহস্য নেই। কিন্তু সেগুলো নেহাতই স্কুল জীবনের গোপনীয়তা, সুদর্শন নায়কদের ফটো। কদাচিৎ এক-আধটা অশ্লীল চটি বই। শাইস্তার দেরাজটা আবার খুঁজে খুঁজে দেখে। এটার ওপর ঝুঁকে পড়া অবস্থাতেই তো মিস ভ্যান্সিটার্ট মারা গেছে? কি দেখতে এসেছিলো মিস ভ্যান্সিটার্ট? পেয়েছিল সেটা? তার হত্যাকারী কি তার দেরাজ থেকে সেটা নিয়ে মিস চ্যাডউইক আসার আগেই সরে পড়েছে?
বাইরে যেন কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উঠে সিগারেট ধরিয়ে অ্যাডাম মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। দরজার সামনে জুলিয়া আপজনকে দেখা গেলো।
অ্যাডাম বলে, মিস কিছু চাই আপনার? ভাবছিলাম আমার টেনিস র্যাকেটটা যদি এখান থেকে নিয়ে যাই।
অ্যাডাম বললো, নিয়ে যেতে পারবে না কেন?…পুলিশ কনস্টেবল আমাকে এখানে বসিয়ে গেলো থানায়, যেতে হলো কিনা কী একটা কাজ, বলে গেলেন ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি যেন এখানে থাকি।
জুলিয়া বলে, দেখতে যদি আবার ফিরে আসে।
কে? পুলিশ কনস্টেবল?
না হত্যাকারী, ওরা ফিরে আসে, তাই না? যে জায়গাটায় হত্যা করে, আসতেই হবে। ওরা যে আসতে বাধ্য হয়।
অ্যাডাম বললো, বোধহয় ঠিকই বলেছেন। সবকটা র্যাকেটগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় আছে আপনারটা। জুলিয়া জানালো, এই সারিতে। ওই কোণায় শেষের দিকে, আমাদের নাম লেখা আছে। অ্যাডাম র্যাকেট যখন দিল তখন তার নাম সাঁটা ফলকটা তাকে দেখিয়ে বোঝায় জুলিয়া।
টেনিসে জুলিয়ার সামনের হাতের মারটা জেনিয়া ফিরিয়ে দিলো না, বল ওদিকেই রয়ে গেলো, কেন না, ততক্ষণে জেনিয়ার চোখে পড়েছে, চেঁচিয়ে বললো ও মা, মা আসছে যে।
ওদিকে দুজনেই চেয়ে দেখে মিসেস সাটক্লিফ বেশ উত্তেজিত, তা দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে। মিস রীচ তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে।
জেনিয়ারের হতাশ ভঙ্গী, এই রে এক্ষুনি শুরু হবে। ওই খুনের ব্যাপারটাই বোধহয়। তোমার ভাগ্য ভালো জুলিয়া তোমার মা তো নিরাপদে বাসে চড়ে ককেশাস।
কেন ইসাবেল মাসি তো আছে?
ধ্যাৎ মা আর মাসী এক হলো।
মিসেস সাটক্লিফ এসে পৌঁছতেই জেনিয়া বলে উঠলো, এই যে মামনি।
জেনিয়া শিগগিরি চলে আসো, জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাও। আমার সঙ্গে বাড়ি চলল।
বাড়িতে? হ্যাঁ।
একেবারে; আর আসব না?
বারে তা কী করে হয়।…এখানে আমার টেনিস খেলায় কত উন্নতি হয়েছে। সিঙ্গলসে আমি জিতবোই। ভীষণ সম্ভাবনা। জুলিয়া আর আমি হয়তো ডাবলসেও জিতবো, অবশ্য ততটা আশা করছি না আমি।
তুমি আজ আমার সঙ্গে বাড়ি আসছো কেন?
প্রশ্ন করো না।
মিস স্প্রিঙ্গার আর ভ্যান্সিটার্ট খুন হয়েছে বলে, কিন্তু কোনো মেয়ে তো খুন হয়নি।
আমি জানি মেয়েদের কেউ খুনটুন করবে না। তাছাড়া তিন সপ্তাহের মধ্যে খেলার প্রতিযোগিতা আসছে। লংজাম্পে আমার জেতার আশা আছে।
তর্ক করো না জেনিয়া, তুমি আজ আমার সঙ্গে ফিরে যাবে, তোমার বাবা বলে দিয়েছেন।
কিন্তু মা,
মায়ের সঙ্গে প্রবল তর্ক জুড়ে দেয়, তর্ক করতে করতে তার সঙ্গে স্কুলবাড়ির দিকে চলে গেলো। হঠাৎ জেনিয়া একদৌড়ে টেনিস মাঠে ছুটে এলো।
বিদায় জুলিয়া। মা দেখছি ভয়ে একেবারে সিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাবাও তাই।
জুলিয়া আস্তে আস্তে ক্রীড়ামঞ্চের দিকে হাঁটতে থাকে। ক্রমশ বলতে বলতে একেবারেই থেমে যায়। দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবে…গভীর চিন্তা।
মধ্যাহ্নভোজের ঘণ্টা বাজলো তবু জুলিয়ার হুঁশ নেই। হাতের র্যাকেটটাকে একদৃষ্টিতে দেখে। রাস্তা দিয়ে দু-এক পা এগোয়। তারপরে একপাক ঘুরে স্কুলবাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। এবারে পদক্ষেপ দৃঢ় সুনিশ্চিত, সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা নিষেধ তবু সে নিষেধ না মেনে সামনের দরজা দিয়ে ঢোকে। যাতে অন্য মেয়েদের এড়ানো যেতে পারে। হলঘর শূন্য সিঁড়ি দিয়ে চলে আসে নিজের ছোটো শোবার ঘরটায়। চকিতে চারিদিকে ভালো করে দেখে চট্ করে হাতের র্যাকেটটাকে বিছানার গদির নিচে শুইয়ে দেয় তারপর চুল ঠিক করে নিয়ে গম্ভীরভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে খাবার ঘরে চলে যায়।
.
আলাদীনের গুহা
সেই রাত্রে মেয়েরা শুতে চলে গেলো। হৈ-হট্টগোল অনেক কম। তিরিশ জনের মতন তো বাড়িতে চলে গেছে। যারা রয়ে গেছে তাদের উপর ঘটনার প্রভাব যথেষ্ট। যার যেমন স্বভাব, সেইরকম প্রতিক্রিয়া করে।
কেউ উত্তেজিত, কেউ ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, কেউ হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে বাইরে সেটা প্রকাশ না করে কেবল খিলখিল করে হাসছে। অনেকে আবার একেবারেই চুপ হয়ে ভাবছে। সবাই নিজের নিজের ঘরে শুতে গেলো। জুলিয়াও তাদের মধ্যে ছিলো, ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, কান পেতে শোনে দরজার বাইরে কত ফিসফিস কথা। খিলখিল হাসি, পায়ের শব্দ, রাতের শুভেচ্ছা, তারপরেই সব চুপ হয়ে গেলো, প্রায় নিস্তব্ধ। দূরেই শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে আর কখনো কখনো স্নান ঘর থেকে আসা-যাওয়ার পায়ের আওয়াজ।
দরজায় একটা হুড়কো নেই। একটা চেয়ার দিয়ে দরজার সঙ্গে এমনভাবে রাখলো যাতে চেয়ারের মাথাটা দরজার হাতলের ঠিক নিচে শক্ত হয়ে এঁটে থাকে, কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে…যাতে টের পাওয়া যায়, কিন্তু কারো আসার সম্ভাবনা খুবই কম কারণ মেয়েদের একে অন্যের ঘরে যাওয়া কড়া নিষেধ। মাস্টারনীদের মধ্যেও শুধু মিস জনসনই আসতেন–যখন কারো অসুখ হত। শরীর খারাপ হত।
তোশকের তলায় হাত বাড়িয়ে জুলিয়া টেনিস র্যাকেটটা বের করে এনে সেটা হাতে নিয়ে একমিনিট দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ঠিক করলো, এখুনি ওটাকে দেখতে হবে, সব ঘরে যখন আলো নিভে যাবে তখন তার ঘরে যদি আলো দেখা যায়। তবে সন্দেহ জাগতে পারে। ঘরে সাড়ে দশটা পর্যন্ত আলো জ্বলতে পারে। কাজেই এখুনি দেখা যাক। মেয়েরা এই সময়টাতে পোশাক-টোশাক বদলায় আবার বিছানায় শুয়ে বই পড়ে।
র্যাকেটটাকে খুঁটিয়ে দেখে ভালোভাবে। এর মধ্যে কী লুকোনো থাকতে পারে।
কিন্তু থাকতেই হবে যে। থাকতে বাধ্য। জেনিয়াদের বাড়িতে চুরি হল…ওই মেয়েছেলেটা এসে একটা আজেবাজে গল্প ছুঁড়লো নতুন র্যাকেট নিয়ে…।
…জেনিয়া ছাড়া আর কেউ অমন গল্প বিশ্বাস করে। নাঃ এ নিশ্চয়ই পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ। তার মানে আলাদীনের কাহিনীর মতো এই র্যাকেটটাতে কিছু আছে। জেনিয়া বা জুলিয়া কেউই র্যাকেট বদলাবদলি করে নেবার কথা কাউকে বলেনি। অন্তত, ও তাই বলে। তবে কি এই র্যাকেটটাকেই ক্রীড়ামঞ্চে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কেন? কারণটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সুন্দর র্যাকেট অনেক, ব্যবহারে জীর্ণ কিন্তু নতুন করে বেঁধে নেওয়ায় এখনো বেশ ব্যবহারযোগ্য। জেনিয়া কিন্তু বলতো এটার নাকি ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
টেনিস র্যাকেটে যদি কিছু লুকিয়ে রাখতে হয় তাহলে হাতলটাতে ছাড়া অন্য কোনো জায়গা নেই। হাতলের গোড়া অবশ্য জুড়ে দেওয়া থাকে। ওটা খুললে কেমন হয়।
কাজের টেবিলে বসে জুলিয়া একটা পেনসিল ছুরি নিয়ে খুলতে চেষ্টা করে, চামড়াটা কেটে একটানে খোলে। ভেতরে পাতলা কাঠের গোল মতন কী একটা বেরোয়। হাতলের ভেতরে থাকে নাকি অমন? মনে তো হয় না, তার চারপাশটায় আবার জোড়া। ছুরি বিধিয়ে দেয় জুলিয়া। ফলাটা মট করে ভেঙ্গে যায়।
নখ কাটার কাঁচি দিয়ে কিন্তু কাজ হয়। অনেক ধস্তাধস্তি করে ফল হয়। লাল-লাল নীল-নীল একটা পদার্থ দেখা গেল। জুলিয়া ওটাকে খোঁচাতেই বুঝতে পারে জিনিসটা কী, পুতুল গড়ার আঠালো মাটি। টেনিস র্যাকেটের হাতলে এমন মাটি। নখকাটার কাঁচি দিয়ে কাচিয়ে এই মাটি তুলে আনে। ওগুলো দিয়ে বোধহয় কোনো একটা জিনিস মোড়া আছে। মনে হল বোতামের মতো কিছু নুড়িও হতে পারে।
আরো জোরে জোরে পুতুল-মাটি তুলে আনে। টেবিলে গড়িয়ে পড়লো একটা জিনিস…তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে ছোট্ট একটা সুপ হয়ে গেলো।
জুলিয়া জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
তরল আগুন, লাল সবুজ, ঘন নীল, ঝকঝকে সাদা।
জুলিয়া সেই মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে গেল। ছোটো মেয়েটি আর রইলো না। নারীত্ব বিকশিত হল, রত্ন দেখছে এক নারী…মাথায় রাশি রাশি চিন্তা খেলে গেল। আলাদীনের গুহা…কালো ভেলভেটের গাউন পরে আছে সে, গলায় দুলছে চোখ ধাঁধানো হীরের হার। বসে বসে স্বপ্ন দেখে, চকচক চোখ মেলে দেখে। আঙুলে তুলে রত্নগুলো দেখে ছেড়ে দিতেই আগুনের নদী হয়ে ওগুলো পড়ে যায়..বিস্ময় ও আনন্দের উজ্জ্বল ঝর্না। তারপর সে বেসিনের কাছে যায়। তার স্পঞ্জ ব্যাগের মধ্যে সেগুলো ঠুসে তার ওপর স্পঞ্জ আর নখের ব্রাশ ভরে দেয়। বিছানার কাছে ফিরে এসে টেনিস র্যাকেটের ভেতরে পট্টিটাকে ভরে দিয়ে কাঠের মাথাটা আবার এঁটে দেয়। চামড়াটাকে তার ওপরে জোড়বার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা ওপর দিকে বেঁকে ওঠে। ওটাকে ঠিক করবার জন্য কাঠের গোল চাকতির ওপর উল্টো করে সরু সরু আঠালো টেপ রেখে তার ওপর চামড়াটাকে চেপে ধরে।
র্যাকেটটাকে এখন প্রায় আগের মতোই দেখতে লাগে। হাতে নিয়ে ওজনের তারতম্য বোঝা যায় না। র্যাকেটটাকে নেড়ে চেড়ে দেখে, একটা চেয়ারের ওপর অযত্নে ফেলে রাখে।
সুন্দর পাতা বিছানার দিকে দেখে, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। জুলিয়া কিন্তু পোশাক ছাড়লো না।
কান পেতে শোনে…বাইরে কি? হঠাৎ ভীষণ ভয় হলো, দুজন খুন হয়ে গেছে। যদি কেউ জানতে পারে তাহলে সেও খুন হয়ে যাবে…
ঘরের মধ্যে কাঠের বেশ ভারি একটা দেরাজ আলমারি আছে। জুলিয়া সেটাকে কোনমতে টানতে টানতে দরজার সামনে নিয়ে আসে। মেডোব্যাঙ্কের কী রীতি, মেয়েদের ঘরের ভেতর থেকে তালা দেবার ব্যবস্থাই নেই। জানালার কাছে গিয়ে ওপরের পাল্লা টেনে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগায়, তার জানালার কাছে অবশ্য কোনো গাছ নেই, তাই তার ঘরে ঢোকা সম্ভব নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
টেবিলের ঘড়িতে দেখলো দশটা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে দিলো, তার ঘরে যেন অস্বাভাবিক কিছু না দেখা যায়, জানালা থেকে পর্দাটা সামান্য একটু সরিয়ে দিল। চুপ করে খাটের একপাশে জুলিয়া বসে থাকে। হাতে ধরে রেখেছে খুব শক্ত একপাটি বুট।
ভাবতে থাকে যদি কেউ ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে, আমি এই দেওয়ালে এত জোরে বুটটা ঠুকে দেব যে পাশের ঘরের মেরী কিং জেগে যাবে। ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠবো। তারপর যদি অনেক লোক এসে জড়ো হয় বলবো দুঃস্বপ্ন দেখা কিছু অসম্ভব নয়, কেউই কিছুই ভাববে না।
অনেকক্ষণ বসার পর শুনলো…প্যাসেজে মৃদু পায়ের শব্দ, ঘরের সামনে এসে শব্দটা থামলো…ও শুনতে পেলো। তারপর দেখলো দরজা খোলার হাতলটা আস্তে আস্তে কে ঘোরাচ্ছে। চিৎকার করবে? না এখন নয়। দরজাটাকে ঠেললো–সামান্য একটু ঠেলা। কিন্তু দেরাজ আলমারিতে ঠেকে গেলো। এতে নিশ্চয়ই বাইরের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। আবার বিরতি, তারপর একটা ছোট্ট মৃদু টোকা পড়ল দরজার ওপরে।
জুলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। আবার টোকা–কিন্তু এবারও খুব আস্তে নরম হাতে। জুলিয়া নিজের মনে ভাবে আমি এখন ঘুমোচ্ছি, আমি কিছু শুনিনি।
জুলিয়া অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলো। আর টোকা পড়লো না বা হাতটাও ঘোরালো না। কিন্তু জুলিয়া অত্যন্ত সজাগ হয়ে বসে রইলো।
এরকম ভাবে বসে থাকতে থাকতে জানতেও পারলো না কখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে পড়েছে। স্কুলের ঘণ্টাই তাকে জানিয়ে দেয়। কোঁচকানো বিছানায় এক কোণে কোনোরকমে কষ্টেসৃষ্টে সে শুয়েছিলো।
প্রাতঃরাশের পর মেয়েরা ঘরে গিয়ে বিছানা গুছিয়ে রাখলো। তারপর বড়ো হলঘরে প্রার্থনার জন্য সমবেত হল। প্রার্থনার পরে যে যার ক্লাসে চলে গেলো।
যখন সবাই নিজের নিজের ক্লাসে যেতে ব্যস্ত জুলিয়া একটা ক্লাস ঘরের মধ্যে ঢুকে ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেয়েদের একটা দল দালানের দিকে বেশ তাড়াতাড়ি হেঁটে আসছিল তাদের সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়াও ওপাশটা দিয়ে এগুতে থাকে। একটা রডোডেনড্রন গাছের পেছনে হঠাৎ লুকিয়ে পড়ে। এদিক-ওদিক দিয়ে লাফ-টাফ মেরে অবশেষে বাইরের দেওয়ালের কাছে এসে পৌঁছায়। সেখানটায় একটা বাতাবিলেবু গাছের ঘন ঝোঁপ। যার ডালপালা প্রায় মাটি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুলিয়া গাছে চড়তে ওস্তাদ। গাছে উঠে অনেকক্ষণ ঘন পাতার আড়ালে গুটি মেরে বসে রইলো। হাতের ঘড়িটার দিকে বার বার দেখে। ঠিক জানতে কিছুক্ষণের জন্য কেউ অন্তত তার খোঁজ করবে না, আজ স্কুলের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। দুজন শিক্ষিকা নিহত, অর্ধেকের বেশি মেয়ে বাড়ি চলে গেছে।
সরসর করে গাছ থেকে দেওয়ালের মাথা পর্যন্ত নেমে আসে। অনায়াসে দেওয়াল ডিঙিয়ে ওধারে লাফ দেয়, শখানেক গজ দূরেই বাসস্টপ। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস আসবে…এলোও তাই। জুলিয়া হাত দেখিয়ে বাসে চড়লো। সুতি ফ্রকের নিচে একটা ফ্লেট-হ্যাট নিয়ে এসেছিল, অগোছালো চুলের ওপর টুপিটা পরে নিল। স্টেশনে নেমে জুলিয়া লন্ডনের ট্রেনে চড়লো।
আসবার আগে জুলিয়া ওর ঘরে বেসিনের ওপর বুলস্ট্রোডের নামে চিঠি লিখে রেখে এসেছিল।
শ্রদ্ধেয় মিস বুলস্ট্রোড,
আমি পালিয়েও যাইনি বা আমাকে কেউ চুরি করে নিয়েও যায়নি। অতএব চিন্তা করবেন না। যতশীঘ্র সম্ভব আমি ফিরে আসবো।
আপনার পরম বিশ্বস্ত ছাত্রী
জুলিয়া আপজন
আটশো নম্বর হোয়াইট হাউস ম্যানসনের দরজা খুলে দিলো। এরকুল পোয়ারোর নিজের খানসামা ও চাপরাশি জর্জ খুলেই অবাক, ময়লা মুখ নিয়ে নেহাতই একটি স্কুলের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিঃ এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে পারি? জর্জের জবাব দিতে একটু দেরিই হয়। এখন একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী–বিশ্বাসই হয় না।
মিঃ পোয়ারো আগে থাকতে খবর না দেওয়া থাকলে কারোর সঙ্গে দেখা করেন না।
অত সময় আমার নেই, এখুনি তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। ভীষণ জরুরী কয়েকটা হত্যা, একটা ডাকাতি। এইরকম আরো কিছু ব্যাপার।
জর্জ বলে, আচ্ছা জিজ্ঞাসা করে আসি, মিঃ পোয়ারো আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা। মেয়েটিকে হলঘরে রেখে ভেতরে গেলো সে মনিবকে শুধাতে।
স্যার আপনার সঙ্গে অল্পবয়সী মহিলা এখুনি দেখা করতে চান।
হু, তা তো চান। কিন্তু চাইলেই কি আর অত সহজে হয়।
সে কথা তো আমি ওকে বললাম।
কি ধরনের মহিলা?
মানে বাচ্চা মেয়ে স্যার।
কি বলতে চায়?
তিনি আপনার সঙ্গে কয়েকটি হত্যা ও একটি ডাকাতির সম্বন্ধে আলোচনা করতে চান। পোয়ায়োর ভ্রূ-গুলো এবারে উর্ধ্বে উঠে যায়।
কয়েকটা হত্যা এবং একটা ডাকাতি, বল কি হে! যাও যাও ভেতরে নিয়ে এসে বাচ্চা মেয়েটিকে।
জুলিয়া ঘরে এসে ঢুকলো, বেশ মার্জিত-স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। নমস্কার মিঃ পোয়ারো, আমার নাম জুলিয়া আপজন। শুনেছি আপনি আমার মায়ের একজন বিশেষ বন্ধুকে চেনেন। তার নাম মিসেস সামারহেইস। গতবছর গরমের ছুটিতে ওর বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম। তখন উনি আপনার কথা বলেছিলেন।
মিসেস সামারহেইস, পোয়ারো মানসচক্ষে দেখতে পেলেন, পাহাড়ের ওপরে একটা গ্রাম আর সেই পাহাড়ের চূড়ায় একটা বাড়ি…দাগভরা একটু মধুর মুখ…ভাঙাভাঙা স্প্রিংয়ের সোফা, বহু কুকুর…ভালোয়-মন্দয় মেশানো কত টুকরো টুকরো ছবি।
আমি তাকে মরিন মাসি বলি, মাসি হয় না অবশ্য। উনিই তো আমাদের গল্প করেছিলেন আপনি কি চমৎকার লোক! মিছিমিছি হত্যার অপরাধে একটি লোকের জেল হয়ে গিয়েছিলো, আপনি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, তাইতো আমি যখন বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত, কার কাছে যাওয়া উচিত, আপনার কথাই মনে এলো।
পোয়ারো গম্ভীর সুরে বললেন, আমি সম্মানিত বোধ করছি, ধন্যবাদ। মেয়েটিকে একটা চেয়ার দিলেন বসতে–আচ্ছা শুরু করে দেখি তোমার কাহিনী। আমার চাপরাশি জর্জ বললো, তুমি নাকি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাও একটা ডাকাতি আর কয়েকটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে; তাহলে কি একটার বেশি হত্যা?
জুলিয়া বলে, হ্যাঁ মিস স্প্রিঙ্গার ও মিস ভ্যান্সিটার্ট তার ওপরে বালিকা হরণও আছে–অবশ্য মনে করি না যে ওটা আমার ব্যাপার।
আশ্চর্য, তুমি যে আমাদের একেবারে হতবাক করে দিলে! তা এইসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো কোথায়।
আমার স্কুলে মেডোব্যাঙ্কে।
মেডোব্যাঙ্কে? পোয়ারো যেন এবারে বুঝতে পারলেন। সযত্নে রাখা খবরের কাগজ থেকে একটা তুলে নিলেন। ভাঁজ খুলে সামনের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে বুলাতে মাথা নাড়লেন।
পোয়ারো বললেন, এতক্ষণ বুঝতে পেরেছি, বল দেখি প্রথম থেকে, জুলিয়া।
-গতরাতে আমার শোবার ঘরে র্যাকেট পরীক্ষা করা পর্যন্ত প্রথম বলে থেমে, বুঝলেন, আমি ভেবেছিলাম যে ঠিক আলাদিনের গল্প.পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ, কাজেই টেনিস র্যাকেটেই নিশ্চয় কিছু আছে।
ছিলো? হ্যাঁ!
মিথ্যা লজ্জা করার মেয়ে নয় জুলিয়া, স্কার্ট তুলে প্রায় উরু পর্যন্ত ইজেরটাকে গুটিয়ে নিলো, দেখা গেলো আঠালো ফিতে দিয়ে হাঁটুর খানিকটা ওপরে ছাই রঙের পুলটিশ লাগানো আছে। আঠালো ফিতেগুলো টান দিয়ে খুলতে গিয়ে ব্যথায় উঃ আঃ করে ওঠে। পুলটিশটা খুলে নিতে পোয়ারো দেখলো ওটা একটা মোড়ক। ছাই রঙের প্লাস্টিকের স্পঞ্জ ব্যাগের মধ্যে ভরে রাখা মোড়কটা খুলে, কোনো কিছু না জানিয়েই, একগাদা ঝলমলে পাথর হঠাৎ টেবিলের ওপর ঢেলে দিলো।
পোয়ারো হতচকিত গলা দিয়ে স্বর ফুটলো না–আঁ একি..একি, কি না কি নাম।
তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেন। নাম বলো…নাম বলো সত্যিকারের। জুলিয়া মাথা নেড়ে-হতেই হবে, নইলে কি আর কেউ খুন করে? এগুলোর জন্য মানুষ খুন করা..বোঝা যায়? আবার হঠাৎ গতরাতের মতো শিশু চোখে ফুটে উঠলো নারীর ছবি।
তীক্ষ দৃষ্টিতে ওকে দেখে পোয়ারো ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ বুঝেছো দেখছি…যাদুর মায়া তোমাকে পেয়েছে।…শুধু রঙীন খেলনা নয়…এগুলো তোমার কাছে সেটাই তো কথা।
আবেশে জুলিয়া বলে, ওগুলো যে রত্ন।
বলছে যে তুমি এগুলো একটা টেনিস র্যাকেটের ভেতর পেয়েছো?
জুলিয়া কাহিনীর শেষপর্যন্ত শুনিয়ে দিলো। সবকিছু বলেছো, কিছু বাদ যায়নি তো? নাঃ একটু বাড়িয়ে হয়তো কোথাও একটু-আধটু বলেছি। আমার স্বভাব ওই। আমার বন্ধু জেনিয়া কিন্তু একেবারে উল্টো। তার মুখে লোমহর্ষক কাহিনীও কেমন ভেজা ভ্যাজভেজে শোনায়। আবার ঝলমলে রত্নের স্তূপটার দিকে তাকিয়ে, মঁসিয়ে পোয়ারো এগুলো কার?
বলা শক্ত। কিন্তু তোমারও না আমারও না। এক্ষুনি ঠিক করে ফেলতে হবে কি করা উচিত।
জুলিয়া তার দিকে আশার চোখে তাকায়। তুমি নিজেকে আমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছো তো, বেশ এরকুল পোয়ারো চোখ বোজেন। হঠাৎ চোখ খুলেই ভীষণ চটপট হয়ে পড়লেন।
আর চেয়ারে বসে থাকা যাচ্ছে না। প্রতিটি বিষয়েই শৃঙ্খলা থাকা চাই। তুমি যে কাহিনী বললে তাতে না আছে শৃঙ্খলা না আছে বিনাশের কারণ। কারণ এইখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক সুতো অনেক গুচ্ছ।
তোমার স্কুলে খবর দিচ্ছি। প্রধান শিক্ষিকাকে বলে দিই যে তুমি এখানে আমার কাছে নিরাপদে আছো আর আমরা দুজনেই মেডোব্যাঙ্কে যাচ্ছি।
উনি জানেন যে আমি ভালোই আছি। আমি চিঠি লিখে রেখে এসেছি। আমাকে কেউ চুরি-টুরি করেনি।
তবু খবরটা পেলে শান্তি পাবেন। টেলিফোনে মিস বুলস্ট্রোডকে পাওয়া গেল। আমার নাম এরকুল পোয়ারো, আমার কাছে আপনার ছাত্রী জুলিয়া আপজন এসেছে।…যে পুলিশ অফিসার তদন্ত করছেন তাকে জানিয়ে দেবেন যে একটা দামী মোড়ক ব্যাঙ্কে জমা করে দেওয়া হয়েছে।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আমাদের এতো তাড়াতাড়ি টেলিফোন করে আপনি যে আমাদের উদ্বেগ দূর করেছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। অত্যন্ত সুবিবেচনার কাজ করেছেন।
…জানো জুলিয়া, আজ মধ্যাহ্নভোজে তুমি যে নেই সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি।
জুলিয়া বলে, নইলে আপনি হয়তো ভাবতেন আমাকেও চুরি করে নিয়ে গেছে।
হা ভালোই করেছিলে, তবুও আমি বলবো, তোমার মতলবটা আগেই আমাকে জানানো উচিত ছিল জুলিয়া।
একমিনিট, বলে দরজার কাছে চলে এলেন এরকুল পোয়ারো, দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর খুব ঘটা করে দরজা বন্ধ করে চোখে মুখে ঝিলিক তুলে রহস্যঘন কণ্ঠে বললেন, এখন আমরা একা, এবার শুরু করা যাক।
একবার তার দিকে আরেকবার দরজার দিকে মিস বুলস্ট্রোড তাকিয়ে দেখলেন, জুলিয়া কি ব্যাপার? জুলিয়া পুরো ঘটনাটা আনুপূর্বিক বলে গেল। টেনিস র্যাকেটের বদলাবদলি রহস্যময়ী রানী…র্যাকেটের ভেতরে অবশেষে খুঁজে পেলো মিস বুলস্ট্রোড। পোয়ারোর দিকে তাকাতে তিনি বললেন, মাদমোয়াদেল জুলিয়া সবকিছু ঠিকই বলল, ও যে জিনিসগুলি নিয়ে এসেছিল তার ভার এখন আমার ওপর। সেগুলি ব্যাঙ্কে নিরাপদে রাখা হয়েছে। কাজেই মনে হয় না এখানে আর কিছু ঘটবে।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ওঃ…আচ্ছা জুলিয়ার এখানে থাকা কি ভালো হবে? বলেন তো লন্ডনে ওর মাসির বাড়িতে পৌঁছে দিই।
জুলিয়া প্রতিবাদ করে, না না, আমাকে এখানে থাকতে দিন।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, তোমার এখানে ভালো লাগে?
হ্যাঁ ভীষণ ভালো লাগে, কত অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে এখানে।
সেগুলো মেডোব্যাঙ্কের বিশেষত্ব নয়।
এরকুল পোয়ারো বলেন, এখনি আর এখানে কোনো বিপদ নেই জুলিয়ার। বলতে বলতে দরজার দিকে তাকালেন।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, বুঝেছি।
পোয়ারো সাবধান করে দিলেন, কিন্তু তা হলেও বিচক্ষণতার প্রয়োজন আছে। জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিচক্ষণতা বোঝ?
মিস বুলস্ট্রোড বুঝিয়ে দিলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো বলতে চাইছেন যে তুমি যা খুঁজে পেয়েছো সে সম্বন্ধে কোনো কথা কাউকে বলবে না। অন্য মেয়েদেরও না। পারবে চুপ করে থাকতে?
হুঁ।
পোয়ারো বলেন, বন্ধুদের কাছে গল্প করার চমৎকার বিষয়, গভীর রাতে টেনিস র্যাকেটের মধ্যে খুঁজে পেলে সাত রাজার ধন। তবু ও নিয়ে গল্প না করার অনেক যুক্তিপূর্ণ কারণ আছে।
জানি।
জুলিয়া তোমার ওপর ভরসা করতে পারি?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই…দিব্যি করছি। এই দেখুন বুকে ক্রশ আঁকলাম।
মিস বুলস্ট্রোড হেসে বললেন, তোমার মা বোধহয় শিগগিরি ফিরবেন।
মা? আশা তো করি।
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ইনসপেক্টর কেলসির কাছে শুনলাম তোমার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা হচ্ছে।…কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানো?…আনাতানি বাসগুলো ভীষণ দেরি করে, সবসময় আবার সময়-টময় মানে না।
মাকে তো বলতে পারি?
হা নিশ্চয়।…আচ্ছা জুলিয়া ওই কথা রইলো, যাও তুমি এখন দৌড় লাগাও।
জুলিয়া ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মিস বুলস্ট্রোড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোকে দেখেন, আমি বোধহয় আপনার কৌশলটা বুঝতে পেরেছি।
একটু আগে দরজা বন্ধ করার ভান করলেন। আসলে কিন্তু দরজাটা আপনি ইচ্ছে করেই একটু ফাঁক করে রেখেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নাড়ে, যাতে বাইরে থেকে শোনা যায় আমরা কী বলছি? হ্যাঁ…অবশ্যই আড়িপাতার মতো যদি কেউ থাকে।…মেয়েটির নিরাপত্তার জন্যই এগুলি করতে হল।…ওর কাছে এগুলো এখন নেই, ব্যাঙ্কে রাখা আছে। সে খবরটা প্রচার করা আবশ্যক।
মিস বুলস্ট্রোড গম্ভীরভাবে ঠোঁটে চেপে বললেন, কবে যে এসব শেষ হবে।
পুলিশের বড়োসাহেব বললেন, এখন আমাদের কর্তব্য হল প্রথমেই সব খবরগুলো একত্রিত করে যত রকম ধারণা আছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা…। আপনাকে পেয়ে আমারা খুব খুশি। মিঃ পোয়ারো..ইনসপেক্টর কেলসির আপনার কথা খুব মনে আছে।
কেলসি বলে, সে অনেকদিন আগের কথা, মামলার ভার চীফ ইনসপেক্টর ওয়ারেণ্ডারের ওপর। তখন সবে ঢুকেছি। একেবারে আনকোরা সার্জেন্ট।
কাজের সুবিধার জন্য এই যে ভদ্রলোক এখানে বসে আছেন তার নাম আমরা দিয়েছি মিঃ অ্যাডাম গুডম্যান। একে হয়তো আপনি চেনেন না মিঃ পোয়ারো, কিন্তু এর বড়োকর্তাকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চ।
পোয়ারো বলেন, কর্নেল পাইক্যাওয়ে? ওঃ, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, এখনও তার সেই ঘুম ঘুম ভাব আছে নাকি?
অ্যাডাম হাসে, তাকে জানেন দেখছি মিঃ পোয়ারো। আমি কখনো তাকে পুরো জাগা অবস্থায় দেখিনি…যখন দেখবো তখন বুঝবো তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন না।
পুলিশ সাহেব বললেন, আসুন ব্যাপারটা নিয়ে এবারে আলোচনা করি। আমি অবশ্য আমার নিজের ধারণা আপনাদের ওপর চাপিয়ে দেবো না। যারা এই কেস নিয়ে কাজ করছেন তারা কী কী জানতে পেরেছেন, কী কী ভাবছেন, সেটা জানতেই আমি এখানে এসেছি।…ব্যাপারটার নানান দিক রয়েছে, তার মধ্যে একটা দিকের কথা জানিয়ে দেওয়া উচিত। ধরে নেওয়া যাক একটি ছোটো মেয়ে মানে একটি স্কুলের ছাত্রী আপনার কাছে চমৎকার একটি গল্প নিয়ে এলো। সে নাকি কোনো একটা টেনিস র্যাকেটের ফাঁকা হাতলে কীসব পেয়েছে। হয়তো সে যা পেয়েছে আসলে হচ্ছে রঙীন পাথরের একটা সংগ্রহ…বেশ সুন্দর নকল পাথর বা বড়োজোর আধদামী পাথর। যাইহোক শিশুমনে উত্তেজনা জন্মাবার পক্ষে ওই যথেষ্ট। কিন্তু ওগুলোর দাম সম্বন্ধে মেয়েটার মনে ভীষণ উঁচু ধারণা। কী বলেন এমন কাণ্ড হতে পারে না? পোয়ারোর দিকে কটমট করে তাকালেন। হওয়াই তো উচিত।
পুলিশ সাহেব বলেন, বেশ যারা এই ইয়ে মানে..রঙীন পাথরগুলো অজান্তেই এদেশে নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা চাই না যে বেআইনিভাবে ওগুলো আমদানী করার কোনো মামলা ওঠে। তার ওপর আবার আছে বৈদেশিক নীতির কথা। আমাকে বলা হয়েছে যে, কতগুলো এমন ব্যাপার আছে যা এই মুহূর্তে বেশ গোলমাল। তেল বা খনিজপদার্থ বা ওই ধরনের কোনো বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সবসময়েই প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। কোনো বোস প্রশ্ন আমার চাই না। হত্যাকাণ্ডকে কখনো চেপে রাখা যায় না। পরামর্শ চলছে
চিন্তান্বিত গলায় পোয়ারো আবার বললেন, মেডোব্যাঙ্কে দুটি হত্যা!
কেলসি বলে, আমরা আপনাকে সব তথ্যই জানালাম এখন যদি কোনো ধারণা হয়ে থাকে আপনার।
পোয়ারো বলেন ক্রীড়ামঞ্চে কেন? আপনার মনে সেই প্রশ্নই ছিলো তাই না? উত্তরটা আমরা পেয়ে গেছি, কারণ ক্রীড়ামঞ্চে ছিলো একটা টেনিস র্যাকেট, যার মধ্যে ছিল বহুমূল্য রত্ন। র্যাকেটের খবরটা নিশ্চয়ই কেউ জানতো। কে সে?…মিস শ্রিঙ্গারও হতে পারেন। আপনারাই তো বলেন ক্রীড়ামঞ্চ সম্বন্ধে তার অদ্ভুত একটা মনোভাব ছিলো। ওখানে কারো আসা তিনি পছন্দ করতেন না। মাদমোয়াজেল ব্লাশের ক্ষেত্রেই তা তো দেখা গেলো।
এরকুল পোয়ারো আবার অ্যাডামকেই বললেন, আপনিই তো বলেছিলেন ক্রীড়ামঞ্চে মাদমোয়াজেল ব্লাশের আচরণটা যেন আপনার কাছে কেমন কেমন ঠেকেছিল।
অ্যাডাম বলে, তিনি আমাকে কৈফিয়ৎ দিচ্ছিলেন। বেশ ঘটা করে কৈফিয়ৎ..অত করে যদি না বোঝাতেন তবে আমার কোনো সন্দেহই হত না।
মাথা নেড়ে পোয়ারো বলেন, বটেই তো। চিন্তার উদ্রেক করবারই কথা। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি তা হচ্ছে রাত একটায় ক্রীড়ামঞ্চে মিস স্প্রিঙ্গারকে খুন করা হয়েছিল অথচ সেই সময় ওর তো ওখানে থাকবার কথা নয়।
কেলসির দিকে ফিরে, মেডোব্যাঙ্কে আসাবার আগে মিস স্প্রিঙ্গার কোথায় ছিলেন? জানা যাচ্ছে না, তার শেষ চাকরিস্থল ছিলো বেশ নামকরা একটা স্কুলের, নাম বলেছিলো। গতবছর গ্রীষ্মকালে ওখানেই ছিলেন। কিন্তু তারপর কোথায় ছিলেন জানা নেই। মরার আগে তো প্রশ্ন করার দরকার হয়নি। তার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পোয়ারো বলেন, তবে তো রামাতে থাকাটা অসম্ভব নয়। অ্যাডাম বলে, শুনেছি যখন বিপ্লব হচ্ছিলো তখন ওখানে নাকি একদল স্কুল শিক্ষিকা ছিলো।
তাহলে ধরা যাক তিনি এখানে ছিলেন এবং কোনো উপায়ে র্যাকেটটার খবর জেনেছেন। মেডোব্যাঙ্কে কিছুদিন চুপচাপ নিত্যনৈমিত্তিক কাজের ধারা লক্ষ্য করলেন তারপর একদিন রাতে ক্রীড়ামঞ্চে গিয়ে র্যাকেটটা থেকে মণিরত্নগুলো বের করে নিতে যাবেন মনস্থির করলেন। ঠিক সময়ে কেউ তাকে বাধা দিল। যে কেউ তার গতিবিধির অনুসরণ করছিলো। সে যাই হোক তার কাছে পিস্তল ছিলো। …তাকে গুলি করলো…কিন্তু রত্নগুলো সরিয়ে নেবার সময় পেলো না। কারণ ততক্ষণে গুলির শব্দে ক্রীড়ামঞ্চে লোকজন ছুটে আসছে।
পুলিস সাহেব বললেন, তাহলে আপনার ধারণা ঘটনাটা এরকমই ঘটেছিলো।…এটা শুধু একটা সম্ভাবনা। বিকল্পে এমনও হতে পারে যে পিস্তলধারীই ওখানে প্রথম গিয়েছিলো এবং মিস স্প্রিঙ্গার আসাতে সে বাধা পেলো। হয়তো এমন কোনো মানুষ যার সম্বন্ধে মিস স্প্রিঙ্গার সন্দেহ পোষণ করতেন।…আপনারাই তো বলেছেন অন্যের চরিত্রের দোষ তিনি খুঁজে বেড়াতেন।
অ্যাডাম বলে, আর দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটি আপনিও জানেন না আমিও জানি না…হয়তো বাইরের কোনো লোকও এসে থাকতে পারে।
কেলসি মাথা নেড়ে বলে, না, তা মনে হয় না। গোটা অঞ্চলটা আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, আগন্তুকদের তো আমরা খুঁটিয়ে যাচাই করেছি। কাছাকাছি থাকার মধ্যে আছেন মাদাম কোলেনস্কি অ্যাডাম চেনেন। কিন্তু তিনি দুটোর মধ্যে একটা খুনেও জড়িত থাকতে পারেন না।
তবে তো আবার মেডোব্যাঙ্কেই ফিরে আসতে হচ্ছে!..সত্য আবিষ্কারের একমাত্র পন্থার কথা বিবেচনা করে অসম্ভবগুলোকে বাদ দিয়ে সম্ভাবনা আগামীতে পৌঁছানো। কেলসি বলে, হা…তাই তো দাঁড়াচ্ছে। দেখুন প্রথমে যে খুনটা হল সেখান প্রশস্ত ক্ষেত্র :
কেউই মিস স্প্রিঙ্গারকে হত্যা করতে পারে। ব্যতিক্রম শুধু মিস জনসন, মিস চ্যাডউইক আর যে মেয়েটির কানে ব্যথা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খুনের বেলায় ক্ষেত্র অনেক সংকীর্ণ। মিস রীচ, মিস ব্লেক ও মিস স্যাপল্যান্ড এতে জড়িত নেই। কারণ সে সময়ে মিস রীচ বিশ মাইল দূরে অ্যাসিনে গ্র্যাঞ্জ হোটেলে ছিলেন।
ইনসপেক্টর বলে, মিস বুলস্ট্রোড তখন ওয়েলশ্যমের ডাচেসের বাড়িতে ছিলেন।
পোয়ারোও গম্ভীর, তবে মিস বুলস্ট্রোডও বাদ পড়লেন। এখন কে কে রইলো?
বাঁধা ঝি দুজন। তারা রাতে থাকে, মিসেস গিবসন আর আরেকটা মেয়ে উরিস হগ। তাদের আমি সন্দেহ করি না, বাকি রইলো মিস রোয়ান ও মাদমোয়োজেল ব্লাশ।
ছাত্রীরাও তো।
চমকে ওঠে কেলসি। নিশ্চয় তাদের আপনি সন্দেহ করেন না।
করি না কিন্তু সঠিক কে বলতে পারে।
কিন্তু কোনো মনোযোগই ছিলো না, কেলসি বললো। মিস রোয়ান আছেন গত একবছর ধরে। ওঁর ইতিহাস ভালো। তার ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই।
তাহলে এসে ঠেকেছি মাদমোয়াজেল ব্লাশে। ওখানেই আমাদের যাত্রা শেষ।
এবার সবাই চুপ থাকে।
কোনো প্রমাণ নেই, পরিচয়পত্রগুলো বেশ ভালো।
সে তো হবেই, পোয়ারো বললেন।
উনি আড়ি পাততেন, অ্যাডাম বলে ওঠে, কিন্তু আড়ি পাতা তো হত্যার প্রমাণ নয়। এক মিনিট, কেলসি বলে, চাবি নিয়ে কি যেন বলছিলেন…চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই স্প্রিঙ্গার তাঁকে মারেন এক ধমক।
রাতে র্যাকেট খুঁজতে যে যাবে, তার চাবি দরকার হবেই। পোয়ারো বলেন, চাবি বানাতে হলে চাবির ছাপ দরকার।
অ্যাডাম বললো, আগ বাড়িয়ে চাবির কথা বলবেন না।
কেলসি বললো, চাবির ঘটনা প্রিঙ্গার কাউকে বলেছিল। কাজেই ইনি ভাবলেন ঘটনাটা উল্লেখ করে রাখা ভালো।
মনে রাখার মতো বিষয়। পোয়ারো বলেন, এতে আমরা কদ্দূর যেতে পারি, কেলসি পোয়ারোর দিকে তাকায়।
পোয়ারো বলেন, যা বলা হয়েছে তা যদি সত্যি হয়, হয়তো একটা সম্ভাবনা আছে।
.
কথোপকথন
মিসেস সাটক্লিফ বলে, দেখুন বুঝতে পারছি না কি বলবো, সত্যি ঠিক বুঝতে পারছি না। এরকুল পোয়ারোর দিকে বিরক্তভাবে তাকিয়ে বললেন, হেনরি অবশ্য বাড়ি নেই।
পোয়ারো ঠিক বুঝতে পেরেছেন কেন তিনি এই কথা বললেন…উনি ভাবছেন হেনরি থাকলে ভালো হত ব্যাপারটা সুরাহা করে দিত। হেনরির কত বিদেশী নিয়ে কারবার। কখনো দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা কখনো জেনেভাতে। ও প্যারিসে গেছে দু-একবার।
মিসেস সাটক্লিফ বলেন, ব্যাপারটা এত বিশ্রী বুঝলেন, জেনিয়াকে যে নিরাপদে বাড়ি নিয়ে যাই সেটাই বাঁচোয়া। কিন্তু জেনিয়া ভীষণ বিরক্ত করছে। মেডোব্যাঙ্কে যাবার আগে তো সেখানে যাবে না বলেই নাকে কাঁদলো, ওটা নাকি বড়ো লোকদের ন্যাকা ন্যাকা স্কুল।
পোয়ারো বললেন, ওটা যে খুব ভালো স্কুল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ছিল, এখন আর নেই।
মিসেস সাটক্লিফ সংশয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, আপনার তাই মনে হয় বুঝি।
তখন পোয়ারো ব্যাখ্যা করলেন, মেডোব্যাঙ্কে তো এখন একটা দুঃসময় চলছে।
মিসেস সাটক্লিফও যেন ওঁত পেতেই ছিলো, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
শুধু দুঃসময় বলছেন তার চেয়েও অনেক বেশি। দুজন খুন হল। একটি মেয়ে চুরি হল। যেখানে শিক্ষয়িত্রীরা একের পর এক খুন হচ্ছেন সেই স্কুলে আপনি আপনার মেয়েকে পাঠাতে পারেন।
.
জেনিয়া থমথমে মুখে ঘরে ঢুকলো। ঘোর সন্দেহের চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। এই যে কেমন আছ?
পোয়ারো বলেন, আমি জুলিয়া আপজনের পুরানো বন্ধু, ও আমাকে খুঁজতে লন্ডনে এসেছিল।
জেনিয়া একটু আশ্চর্য হল, জুলিয়া লন্ডনে গিয়েছিল কেন?
পোয়ারো বললেন, আমার উপদেশ নিতে। জেনিয়ার কিন্তু বিশ্বাস হয় না। পোয়ারো বললেন, আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি। ও এখন আবার মেডোব্যাঙ্কে ফিরে গেছে।
জেনিয়া বলে, তাহলে ইসাবেলা মাসি ওকে নিয়ে যাননি।
পোয়ারোও মিসেস সাটক্লিফের দিকে তাকাল, কিন্তু ততক্ষণে জেনিয়ার মা ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। যখন পোয়ারো এবাড়িতে আসেন তখন তিনি ধোপার কাপড় মেলাতে ব্যস্ত ছিলেন।
পোয়ারো বললেন, ও…আচ্ছা মেডোব্যাঙ্কে এমন কাউকে দেখেছো কী যাকে রামাতে দেখেছিলে?
রামাতে, না..কই মনে হচ্ছে না। কিন্তু জেনিয়া তুমি নিঃসন্দেহ নও, তাই না? জেনিয়া কপাল চুলকোয়, মানে সবসময় তো চেনা মুখের মানুষ দেখা যায় কিন্তু কার সঙ্গে তার মুখের মিল, তা তো তার মনে থাকে না। কখনো হয়তো এমন হয় যে চেনা মানুষদের দেখলেন কিন্তু
মনে করতে পারলেন না, তারা কে? কোথায় দেখেছেন।
রাজকুমারী শাইস্তার কথাই ধরো, তাকে তুমি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছিলে। রামাতে তো তাকে দেখেছে।
রামাতে ছিলো বুঝি। খুব সম্ভব রাজ-পরিবারের মেয়ে তো, তাকে তুমি ওখানে দেখে থাকবে, কী বল।
না, মনে পড়ে না, তাছাড়া ওখানে ওরা মুখের কাপড় খুলে রাস্তায় বেরোয় না। বিদেশে এসে খুলে ফেলে বলে শুনেছি।
সে যাক। তাহলে মেডোব্যাঙ্কে কাউকে তুমি আগে দেখেছে বলে মনে হয় না।
না, দেখিনি…অবশ্য বেশির ভাগ মানুষের মুখই হয়তো যে কোনো জায়গাতেই তাদের দেশে থাকতে পারেন। যখন মিস রীচের মতো কোনো অদ্ভুত মুখ আপনার নজরে আসে, তখনই তো আপনি লক্ষ্য করেন।
মিস রীচকে আগে কোথাও দেখেছো? ঠিক দেখিনি, ওর মতোই কেউ হবে। কিন্তু অনেক বেশি মোটা।
অনেক বেশি মোটা, চিন্তায় ডুবে যান পোয়ারো। খিলখিলিয়ে হেসে জেনিয়া বলে-মিস রীচকে আপনি মোটা কল্পনা করতে পারবেন না। উনি এত রোগা পাতলা ছিপছিপে তাছাড়া মিস রীচ রামাতে যাবেন কী করে? গতবার তো তার অসুখ ছিল।
পোয়ারো বললেন, আর অন্য মেয়েরা তাদের দেখোনি আগে?
দু-একজনকে দেখেছি, তাদের আগেই জানতাম। আমি তো মোটে তিন সপ্তাহ ওখানে ছিলাম। অর্ধেক মেয়েকে তো আমি চোখেই দেখিনি।
.
সুতোর গুচ্ছ
মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে আইলিন।
আইলিন রীচ তার পেছনে বসার ঘরে এসে ঢোকে। মেডোব্যাঙ্ক এখন অদ্ভুত শান্ত। মোটে জন পঁচিশ ছাত্রী আছে যাদের বাপ-মা কোন কারণে হয়তো তাদের নিয়ে যেতে পারেনি। আতঙ্ক উদ্বেগ অনেক কেটে গেছে মিস বুলস্ট্রোডের কৌশলে। তাকে দেখে মনে হয় না যে তার মনে কোনো উদ্বেগ আছে। অনায়াসে তিনি শান্ত মুখচ্ছবি বজায় রেখে চলেছেন।
অ্যানি স্যাপল্যাণ্ড মিস বুলস্ট্রোডকে বললো কিছু লোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এই স্কুল টিকবে কিনা জানিনা। জনমত কি দাঁড়াবে তা তো বলা যায় না। একেক জন মানুষ একেক রকম। শেষে দেখা যায় তার মতামত বেশি সেই নিজের মতকেই জনমতে রূপান্তরিত করে। কাজেই মনে হয় মেডোব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবে।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন–আপনার দেখছি ভীষণ দৃঢ় মনোভাব।
হা, এই বিষয়ে তাই। দুনিয়ায় কী আছে যার দাম এক কানাকড়িও নয়।
কিন্তু মেডোব্যাঙ্ক অমূল্য, আমি এসেই তা অনুভব করছি।
মিস বুলস্ট্রোড বলেন, আপনি যোদ্ধা। যোদ্ধাদের আমার খুব ভালো লাগে। বিশ্বাস করুন আমি সহজেই হার স্বীকার করবো না, এই যুদ্ধ আমার ভালোই লাগবে। যখন সবকিছু অত্যন্ত সহজ হয়ে ওঠে হাতের মুঠোর মধ্যে, তখন মানুষ কী বলবো-আত্মপ্রসঙ্গে চুর হয়ে থাকে?
ফলের জমি থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অ্যানি স্যাপল্যান্ড বললো, ওই যে এলোচুল দুলিয়ে আসছে, বুঝি না বাপু সামলাই কি করে।
অ্যাডাম বলে ওকে, সে কথাটা বলুন।
স্যাপল্যান্ড বলে, আমাদের মধ্যে মাখামাখি নেই। আচ্ছা আপনার কী মনে হয় স্কুল আবার চলবে? কঠিন প্রশ্ন। তাছাড়া আমি উত্তর দেবার কে?
কেন আপনার তো একটা মতামত থাকতে পারে, চলবে বোধহয় জানে।
ফরাসি সাহিত্য পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে মাদমোয়াজেল ব্লাশ বেরিয়ে এল। হাতঘড়িতে সময় দেখে…অনেক সময় আছে। আজকাল তো সময়ের কমতি নেই। ছাত্রী নেই। নিজের ঘরে গিয়ে টুপি পরে নেয়। টুপি না পরে চলাফেরা করা তার একদম ভালো লাগে না। আয়নায় চেহারা দেখে পছন্দ হয় না। চোখে লাগার মতো ব্যক্তিত্ব নেই।..মনে মনে হাসে দিদির পরিচয় পত্রগুলো কেমন সুন্দর কাজে লাগানো গেল। হাত-পা এর ফটো দেখে কেউ সন্দেহ করেনি।…অ্যাঞ্জেল তো মারাই গেছে, ওগুলো ফেলে দিয়ে কী কোনো লাভ হত। তার চেয়ে এই বেশ। অ্যাঞ্জেল পড়াতে সত্যিই ভালোবাসতো। ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বাইরে এল। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে দেখে, হাঁটু মুড়ে নতুন একজন ঝি কাজ করছে। নিশ্চয় পুলিশের চর…লোকে যেন বোঝে না।
ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি খেলে।
.
আনাতোলিয়ার ঘটনা
গভীর খাদের ওপর দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তার এক পাশে মিসেস আপজন বসে আছে। বিশাল চুল এক তুর্কী রমণীর সঙ্গে গল্প জুড়েছে।
.
অনাবরণ
সবাই একটা ছোটো ক্লাসঘরে এসে জমা হল। মিস বুলস্ট্রোড দেখলেন সবাই এসেছে। মিস চ্যাডউইক, মিস জনসন, মিস রীচ ও অল্প বয়সী শিক্ষিকা দুজন। অ্যানি স্যাপল্যান্ড খাতা পেন্সিল নিয়ে বসেছে। যদি মিস বুলস্ট্রোডের কিছু লেখার দরকার হয়। মিস বুলস্ট্রোডের পাশে ইনসপেক্টর কেলসি বসেছে, আর তার পেছনে এরকুল পোয়ারো বসে আছেন।
বেশ কর্তৃত্বের সুর নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন।
আমার মনে হয় এই তদন্ত কতদূর এগিয়েছে সেটা জানতে আপনারা সকলেই উৎসাহী। কারণ আপনারা সকলেই এই স্কুলের কর্মী। এবং এই স্কুলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সুইজারল্যান্ড থেকে অমূল্য সাফল্য পেয়েছেন মিঃ পোয়ারো।
…আপনারা জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি এই বিষয়ে নিজেই আপনাদের বলবেন।
আমি দুঃখিত যে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, কিন্তু আজ একথা বলার সময় এসেছে যেগুলো খোলসা হওয়া দরকার। কাজেই আমার কতদূর এগিয়েছি সেটা যদি আপনাদের জানানো যায় তবে নিশ্চয়ই আপনারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
মিস বুলস্ট্রোড কেলসির দিকে তাকায়। ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দেখুন সরকারীভাবে আমি যা জানি সবটাই আপনাদের বলতে পারি না, তবে আমরা যথেষ্ট এগিয়েছি এবং এই স্কুলের অপরাধগুলো কে বা কারা সংঘটিত করেছিলো সে সম্বন্ধেও একটা স্পষ্ট ধারণা এসে গেছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার বন্ধু মিঃ পোয়ারো সরকারী গোপনীয়তায় আবদ্ধ নন। তিনি তার বক্তব্য আপনাদের জানাতে পারেন। আমি জানি আপনারা সবাই মেডোব্যাঙ্কের একনিষ্ঠ কর্মী।
মিস বুলস্ট্রোডের ওপরও আপনাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি ভালোবাসা রয়েছে। সুতরাং আমি আশা করবো যে, মিঃ পোয়ারো যে সব বিষয়ে আপনাদের জানাবেন সেগুলো আপনারা গোপন রাখবেন। কারণ বাজারে যত কম গুজব ছড়াবে ততই মঙ্গল। অতএব আপনাদের অনুরোধ করবো যেন খবরগুলো বাইরে প্রকাশ না হয়, এতে আপনারা সকলেই রাজী…।
পোয়ারো বললেন, আপনাদের সকলেরই এই কটাদিন বেশ অশান্তিতে কাটলো। আপনাদের অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা আমি বুঝি, বিশ্বাস করুন। মিস বুলস্ট্রোডের কষ্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আপনারাও কম কষ্ট পাননি। তিনজন সহকর্মীকে আপনারা হারিয়েছেন যাদের একজন বহুদিন ছিলেন। আমি মিস ভ্যান্সিটার্টের কথা বলছি। মিস স্প্রিঙ্গার ও মাদমোয়াজেল ব্লাশ অবশ্যই নবাগত। পোয়ারো বললো যে, আপনাদের সামনেই বসে আছে সেই নির্মম হত্যাকারী।
একটা ফটো পকেট থেকে বের করেন। প্রথমে আমি এই ফটো আপনাদের দেখাতে চাই, কেলসি ফটোটা নিয়ে মিস বুলস্ট্রোডকে দেয়। মিস বুলস্ট্রোডের হাত থেকে সবাই নিয়ে দেখে।
আপনাদের সকলকেই জিজ্ঞাসা করছি…কেউ কী আপনারা ফটোর মেয়েটাকে চিনতে পেরেছেন?
সকলেই ঘাড় নাড়িয়ে বললো, না। পোয়ারো বললো, চেনা উচিত। আমি জেনেভা থেকে ফটোটা পেয়েছি…রাজকুমারী শাইস্তার।
মিস চ্যাডউইক চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু এতো শাইস্তা নয়।
পোয়ারো বললেন, সেই তো কথা, আমাদের এই কাহিনীর যবনিকা উঠেছিল রামাতে সেখানে আপনারা সকলেই জানেন।
উত্তর দিকে পাহাড়ে রাজকুমার আলির বিমান ধ্বংস হয়ে পড়ে। বহুদিন সেটার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজকুমার আলির দেহে একটি মূল্যবান বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেটি রাজকুমার সবসময় সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। গুজব সেটি নাকি এদেশে এসেছে।..রাজকুমার আলি ইউসুফের একমাত্র ঘনিষ্ঠ জীবিত আত্মীয়ার কাছে ছিলেন। মেয়েটি তার খুড়তুতো বোন–সুইজারল্যান্ডে স্কুলে পড়তো। ধরে নেওয়া যাক সে বস্তুটি যদি নিরাপদে রামাতের বাইরে নিয়ে আসা হয়ে থাকে তো সেটি আসলে রাজকুমারী শাইস্তার কাছে বা তার কোনো আত্মীয় বা অভিভাবকদের হাতে থাকবে, তাই কিছু কিছু অনুচর লেগে রইলো। তার কাকা আমীর ইব্রাহিমের পেছনে আর রাজকুমারীর পেছনে। জানা ছিল এর পরে সে মেডোব্যাঙ্কে আসবে, কাজেই খুবই স্বাভাবিক যে, এখানে কাউকে চাকরি নিতে পাঠানো হবে। যাতে রাজকুমারীর সাক্ষাৎপ্রার্থী সব লোকের ওপরে কড়া নজর রাখা যায়। তার চিঠিপত্র টেলিফোনের সব সংবাদ জানা যায়। কিন্তু এর চেয়েও আরো সহজ কিন্তু আরো কার্যকরী একটা পথ রাজকুমারী শাইস্তাকে চুরি করে তাদেরই কাউকে একজনকে রাজকুমারী সাজিয়ে এই স্কুলে পাঠানো হল। কাজটা মোটেই কঠিন নয় কারণ আমীর ইব্রাহিম মিশরে ছিলেন। গরমকালের শেষদিকের আগে ইংল্যান্ডে আসার তার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। মেয়েটিকে মিস বুলস্ট্রোড চোখে দেখেননি। রাজকুমারীর অভ্যর্থনার সব ব্যবস্থাই তো তিনি লন্ডনের দূতাবাসের মাধ্যমে করেছিলেন।
.
পোয়ারোর বিশ্লেষণ
মিসেস আপজন মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে গেলো যে এইমাত্র তার চোখের সামনে এক রোমহর্ষক নাটকের অভিনয় হলো। এই মুহূর্তে মা শুধু তার সন্তান খুঁজছে। পরিত্যক্ত ক্লাসঘরে তার দেখা পেলো। জুলিয়া ডেস্কের ওপরে ঝুঁকে, একটু দেখি জিভ বার করে রচনা লেখবার দারুণ পরিশ্রমে ব্যস্ত।
মাকে দেখেই একছুটে মায়ের কাছে গিয়ে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাগো।
পরমুহূর্তে সচেতন হল এখন তো বড়ো হয়েছে। জুলিয়া বললো, ওঃ, ভীষণ ভালো লাগছে তুমি ফিরলে বলে। জুলিয়া বলে, মিস রীচের রচনা লিখছি। অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় কিন্তু এটা কি লিখছো দেখি? মিসেস আপজন ঝুঁকে পড়ে লেখাটা দেখে।
পৃষ্ঠার ওপরেই শিরোনাম লেখা-রচনার বিষয় তার নিচে। নয়-দশ লাইন লেখা হয়েছে, জুলিয়ার আঁকা-বাঁকা অক্ষরে। মিসেস আপজন পড়ে দেখে হত্যার প্রতি ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের মনোভাবের তুলনামূলক বৈষম্য।
.
উত্তরাধিকার
মিঃ রবিনসন নামে একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে এসেছেন স্যার।
ওঃ, পোয়ারো সামনের টেবিলে চিঠিটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বেশ চিন্তান্বিত হলেন, বললেন ভেতরে নিয়ে এসো জর্জ…।
শুধু কয়েক লাইনের চিঠি। পোয়ারো চিঠি রাখলেন..মিঃ রবিনসন ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়ান। মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে করমর্দন করলেন তারপর চেয়ারে বসতে বললেন।
মিঃ রবিনসন বসে রুমাল দিয়ে তার মস্ত বড়ো হলুদ মুখটা মুছে মন্তব্য করলেন যে দিনটা বেশ গরম…।
মিঃ রবিনসন বলেন, কত কিছুই তো শোনা যায়…সেই বেচারী মেয়ের ছোটোবেলা থেকেই নাকি স্কুলে শিক্ষিকার ওপর প্রবল ভীতি, মনের সমীক্ষকেরা বেশ ভালো বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে। তবে অন্তত লঘু দায়িত্বের অনেকবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে।
পোয়ারো বলেন, হ্যাঁ যুক্তিটা মন্দ না তবে আমার ধারণা…মাপ করবেন ওসব যুক্তি ধোপে টিকবে না।
আমিও একমত..ঠাণ্ডা মাথায় খুন একেবারে, তবু..ওর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের কথাটা ওরা বড় গলায় ঘোষণা করবে। দেখাবে কত বিখ্যাত লোকের ও সেক্রেটারি ছিলো। ওর যুদ্ধে চাকরির কথা বলবে। সেখানে তো কোনো দাগ নেই। অন্য পক্ষের চর সেজে গুপ্তচর বৃত্তি করতো। এত অল্পবয়স…কিন্তু দারুণ চালাক। কি প্রচণ্ড লোভ…একা একা কাজ চালিয়ে বিরাট লোভের ধন হস্তগত করা। বিরাট লাভ।
মিঃ রবিনসন সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, ওগুলো কোথায় মিঃ পোয়ারো?
আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন। হ্যাঁ তা তো বটেই। ব্যাঙ্কগুলো বেশ উপকারী প্রতিষ্ঠান কী বলেন। পোয়ারো হাসলেন, আমাদের কি শিবের গীত গাওয়ার প্রয়োজন আছে?
রবিনসন উঠে দাঁড়ালেন…
আমার কাজের জন্য আমি পারিশ্রমিক নেবো বুঝলেন। আমার পারিশ্রমিকও কিন্তু বেশ মোটা অঙ্কের, তবে ঠকবো না।
মেয়েটি তার চোখে চোখ রেখে তাকালো, জানি আপনি ঠকবেন না। আমার সাহায্যেরও প্রয়োজন আছে। আমি এসব কিছু বুঝি না।
মনে হচ্ছে আপনি বেশ বুদ্ধিমতী। আচ্ছা, এগুলো তাহলে নিয়ে যাই? আপনি একটাও রাখবেন না?
অ্যালিশ বলে, না আমি রাখতে চাই না। মুখ লাল করে বললে, আপনি ভাবছেন অদ্ভুত তাই না, কেন রেখে দিচ্ছি না একটা চুনী একটা পান্না অন্তত। আমার আপত্তি ছিল না, একদিন আমরা সেই অনুচ্ছেদটা পড়লাম–সেখানে আছে একজন নারীর কথা যার মূল্য চুনীর চেয়েও বেশি।…তাই আমার কোনো রত্ন চাই না। না থাকাই বোধ হয় ভালো।
মনে মনে রবিনসন বললো, বিচিত্র নারী।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রোলসের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আবার বললেন বিচিত্র নারী।