০৪. উজ্জ্বল নির্মেঘ দিন

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

৪.১

২৬ শে জুলাই সকাল বয়ে নিয়ে এলো উজ্জ্বল নির্মেঘ দিনের আশ্বাস। সুন্দর সকাল এমন কোনো চূড়ান্ত অলসকেও বিছানা ছাড়তে লোভ দেখায়।

আজ সকাল সকাল উঠেছেন। জলি রজারের সাজের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বাদামী রঙের মোটা বাঁধানো বইটা ভোলা অবস্থাতেই উপুড় করে রাখলো লিডা। তারপর তাকালো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে, এখন সকাল আটটা।

এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত ওর ঠোঁটজোড়ায়, চোখের তারা স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ সঙ্কুচিত। আমাকে পারতেই হবে ও রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করলো।

লিন্ডা পাজামা ছেড়ে সাঁতারের পোশাক পরে নিলো। তার উপর পরলো স্নানের ঢোলা পোশাক। বারান্দা ধরে চলতে শুরু করলো ও ঘর থেকে বেরিলয়ে। বারান্দার শেষে একটা দরজা খুলতেই দেখা গেলো একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি সোজা নেমে গেছে পাথুরে জমিতে। সমুদ্রের জলে একটা ঝোলানো লোহার মই নেমে গেছে। প্রাত্যহিক প্রাতঃরাশ সেরে নেবার আগে হোটেলের যে সব অতিথিরা একটু শরীর ভিজিয়ে নিতে চান, সময় সংক্ষেপ করার জন্য তারাই প্রধান সৈকতে না গিয়ে এই মইটা ব্যবহার করেন।

যখন বারান্দা থেকে সিঁড়িতে নামছে লিন্ডা বাবার সঙ্গে মুখোমুখি হলো তখন। তিনি উপরে উঠছিলেন সিঁড়ি বেয়ে। ওকে দেখে বললেন, দেখছি আজ সকাল সকাল উঠেছ। স্নান করতে যাচ্ছো বুঝি? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লিন্ডা। ওরা পাশ কাটিয়ে চলে গেল পরম্পকে।

কিন্তু ঝোলানো মইয়ের দিকে না এগিয়ে হোটেলের বাঁ পাশ দিয়ে যে পথটা কংক্রিটের সেতুর দিকে চলে গেছে, লিন্ডা সেই পথটা ধরল। সেতু এখন জলের নিচে জোয়ারের কারণে। অতিথিদের পারাপারের নৌকোটা কাছেই পাড়ে বাঁধা রয়েছে। যার উপর ওটার দায়িত্ব তাকে কাছাকাছি পাওয়া গেল না কোথাও। নৌকা ছেড়ে দিল লিন্ডা।

ওপারে পৌঁছে, নৌকা পাড়ে বেঁধে ও ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চললল…গ্যারেজ ছাড়িয়ে থামলো ছোট দোকানটার কাছে। দোকানের মহিলাটা সবেমাত্র দোকান খুলে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। রীতিমতো লিন্ডা অবাক হলো। মিস আপনি খুব সকাল সকাল উঠেছেন। স্নান-পোশাকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো কিছু টাকা লিন্ডা। তারপর তার কেনাকাটায় মন হলো।

.

৪.২

 ক্রিস্টিন রেডফার্ন ওর ঘরে দাঁড়িয়ে। লিন্ডা যখন ফিরে এলো, ক্রিস্টিন বিস্মিত স্বরে বললো, ও এই তো! আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো এখন ঘুম থেকে ওঠোনি।

লিন্ডা বললো, না স্নান করতে করতে লক্ষ্য করলো ক্রিস্টিন একটু অবাক হয়ে বললো বেশ তাড়াতাড়িই পিয়ন আজ ডাক বিলি করে গেছে দেখছি।

লিন্ডা চমকে উঠলো। ওর স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো প্রকৃতির কাগজের জন্য প্যাকেটটা ওর হাত ফস্কে পড়ে গেলো মেঝেতে। পলকা সুতোটা ছিঁড়ে গিয়ে ভেতরের কয়েকটা জিনিস গড়িয়ে পড়লো বাইরে। ক্রিস্টিনের চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়। মোমবাতি কিনেছো কি জন্যে তুমি?

লিন্ডার সৌভাগ্যবশত ক্রিস্টিন ওর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ওর জিনিষগুলো মেঝে থেকে তুলতে তুলতে বলে চললো, জানতে এসেছিলাম তুমি আমার সঙ্গে পাল কোভে যাবে কিনা? আমি সেখানে ছবি আঁকতে যাবো। বিনা দ্বিধায় সম্মতি জানালো লিন্ডা। ক্রিস্টিনকে গত কয়েকদিনে ওর চিত্রাঙ্কন-অভিযানে সঙ্গ দিয়েছেন। ক্রিস্টিন শিল্পী হিসেবে খুবই উঁচু দরের না হলেও, লিন্ডার ধারণা, এই ছবি আঁকার সম্ভবত কপট অজুহাতেই এখনও অক্ষুণ্ণ রেখেছে ওর অহঙ্কারকে। আর্লেনা মার্শালের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেয় ওর স্বামী দিনের বেশির ভাগ সময়। লিন্ডা দিনের পর দিন ক্রমশ খিটখিটে এবং বদ-মেজাজী হয়ে পড়ছে, ক্রিস্টিনের ভালো লাগে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে কারণ ক্রিটিন ছবি আঁকার সময় গভীর মনোযোগে ডুবে থাকে এবং কম কথা বলে অভ্যস্ত। লিন্ডা তাতে একরকম নিঃসঙ্গতার স্বাদ অনুভব করে। ওর মধ্যে থাকে কারও সঙ্গলাভের এক অদ্ভুত আকুলতা। পরস্পরের প্রতি কেমন ওদের যেন একটা সূক্ষ্ম সহানুভূতির যোগ রয়েছে, সম্ভবত বিশেষ একজনকে সমানভাবে অপছন্দের করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কারণ, বারোটায় আমি টেনিস খেলতে যাবো, ক্রিস্টিন বললো। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোলেই ভালো হয়। ধরো সাড়ে দশটা। এই সব বললেন ক্রিস্টিন। আমি তৈরি হয়ে থাকবো ঠিক আছে; হলঘরেই তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

.

৪.৩

 রোজামন্ড ডার্নলি খাবার ঘর ছেড়ে শ্লথ পায়ে বেরোতেই সিঁড়ি বেয়ে ত্বরিতে নেমে আসা লিন্ডার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো ওর। মিস ডার্নলি দুঃখিত। চমৎকার সকাল, রোজামন্ড বললো, গতকালের পর এরকম একটা দিন বিশ্বাসই করা যায় না।

ঠিক বলেছেন। আমি মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে পাল কোভে যাচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করবার কথা সাড়ে দশটায়। হয়তো দেরিই হয়ে গেলো ভাবছিলাম। দশটা পঁচিশ সবে এখন। না তাহলে নিশ্চিন্তে যাক। রোজমন্ড উৎসুক হয়ে তাকালো ওর দিকে লিন্ডাকে একটু হাঁপাতে দেখে। লিন্ডা তোমার জ্বর হয়নি তো! লিন্ডার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল এবং দু-গালে লালচে আশা বেশ স্পষ্ট। আমার…কই না তো কখনও জ্বর হয় না।

আজকের দিনটা এত সুন্দর, রোজামন্ড হেসে বললো, আমি বিছানায় বসে প্রাতঃরাশ খাওয়ার পুরনো অভ্যাস ছেড়ে নিচে চলে এসেছি। এবং বীরপুরুষের মতোই খাওয়ার টেবিলে ডিম ও বেকনের মুখোমুখি হয়েছি। আজকের দিনটা সত্যি অপূর্ব গতকালের পর। গাল কোভে খুব ভালো লাগে সকালে। আমি তেল মেখে শুয়ে থাকবো। হ্যাঁ সকালের দিকে ভালো। রোজামন্ড বললো, সৈকতের তুলনায় অনেক শান্ত, নির্জন এখানকার জায়গাটা। লাজুক স্বরে লিন্ডা বললো, আপনিও চলুন না।

মাথা নাড়লো রোজামন্ড, না অন্য কাজ আছে কতকগুলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। ওর পরনে আবহাওয়ার উপযোগী লম্বা হাতার ঢোলা পোশাক সবুজ কাপড়ের উপর হলদে কাজ করা। ওর গায়ের ফ্যাকাসে পাণ্ডুর রঙের সঙ্গে সবুজ এবং হলদে রঙটাই যে সবচেয়ে বেশি বেমানান, রোজামণ্ডের জিভ পিসপিস করতে লাগলো, সে কথা বলার জন্য পোশাক সম্পর্কে কোনো বোধ শক্তি নেই, এমন কাউকে দেখলে রোজামণ্ডের ভীষণ অস্বস্তি হয়। মেয়েটিকে যদি আমি মনের মতো করে সাজাতে পারতাম, ও ভাবলো ওর স্বামী সচেতন হয়ে ঠিক ওর দিকে নজর দিতো কয়েকদিনের মধ্যেই। আর্লেনা বোকা হলেও সে জানে নিজেকে কিভাবে সাজাতে হয়।

লিন্ডাকে তারপর ও বললো, তোমাদের ভালোই কাটবে সময়টা। একটা বই নিয়ে সানি লজ-এর দিকে যাচ্ছি আমি।

.

৪.৪

 ঘরে বসেই কফি ও রোল সহকারে প্রাতঃরাশ সারলেন এরকুল পোয়ারো যথারীতি। সকালের সৌন্দর্য তাকে অভ্যাস-নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাধ্য করলো হোটেল ছাড়তে। দশটায় সমুদ্রতীরে নেমে এলেন। তার দৈনন্দিন উপস্থিতির সময় হতে তখনও আধঘন্টা দেরি। একজন ছাড়া শুধু বেলাভূমিকে কাউকে নজর পড়লো না। আর্লেনা মার্শাল সেই একজন। আর্লেনার পরনে প্রিয় ওর সাঁতারের পোশাক, সবুজ টুপি মাথায় ও একটা সাদা কাঠের ভেলাকে জলে ভাসানোর চেষ্টা করছিলো। ওকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। পরোপকারিতার পুরস্কার স্বরূপ নিজের ধবধবে সাদা জুতো জোড়াকে সমুদ্রের জলে স্নান করালেন।

পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানালো আর্লেনা–ওর নিজস্ব তির্যক দৃষ্টিতে। ভেলায় চড়ে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আর্লেনা তাকে ডাকলো, মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো তৎপর ভঙ্গীতে নিমেষে হেলের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার জন্যে একটা কাজ করবেন, আর্লেনা বললো। নিশ্চয়ই ও পোয়ারোর দিকে চেয়ে হাসলো। কাউকে বলবেন না আমি কোথায় যাচ্ছি। তারপর মৃদু স্বরে বললো। অন্তর স্পর্শ করা দৃষ্টি ওর চোখে। আমার পিছু করবে প্রত্যেকেই। আমি আজ একটু একলা থাকতে চাই। বৈঠা বেয়ে এগিয়ে চললো নিপুণ হাতে আলেনা। সমুদ্র ছেড়ে উঠে এলেন পোয়ারো। আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, উঁহু অসম্ভব একেবারেই। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

আর্লেনা স্টুয়ার্ট মঞ্চের নামেই ওকে সম্বোধন করা যায়, এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে জীবনে কখনও একা থাকতে চেয়েছেন কিনা। এর আসল কারণ সহজেই অনুমান করলেন এরকুল পোয়ারো। কারও সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন, আলেনা মার্শাল নিঃসন্দেহে। এবং কার সঙ্গে সে বিষয়েও পোয়ারো মনে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে একটা। পোয়ারো দেখলেন ও মনে মনে ভাবলেনও নিজের অনুমানকে ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে দেখলেন পোয়ারো।

যেই পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হলো, সাদা ভেলাটা। তখনই তার নজরে পড়লো প্যাট্রিক রেডফার্ন লম্বা পা ফেলে হোটেলের দিক থেকে সমুদ্র তীরে নেমে আসছে। ঠিক পেছনেই আসছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেনেথ মার্শাল।

ঈষৎ মাথা নোয়ালেন মার্শাল পোয়ারোকে দেখে, সুপ্রভাত মঁসিয়ে পোয়ারো। স্ত্রীকে দেখেছেন, আমার। পোয়ারো কূটনীতিবিদের মতো জবাব দিলেন, তাহলে মাদাম সকালে উঠেছেন আজ। ওকে ওর ঘরে দেখলাম না, মার্শাল বললেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের দিনটা চমৎকার। স্নানটা সেরে ফেলি এখনই। একগাদা কাগজ টাইপ করতে হবে ফিরে গিয়ে। প্যাট্রিক রেডফার্ন অপেক্ষাকৃত চাপা দৃষ্টিতে সমুদ্রতীরের দুপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর পোয়ারোর পাশে বসে তার প্রেমিকের প্রতীক্ষা করতে লাগলো। আর মাদাম রেডফার্ন, পোয়ারো বললেন, তিনিও কি ভোরে উঠেছেন।

জবাব দিলো প্যাট্রিক, ক্রিস্টিন? ছবি আঁকতে বেরোবে। ইদানীং দেখছি ওর ছবি আঁকার ঝোঁক বেড়ে গেছে। প্যাট্রিক রেডফার্নে স্পষ্টই বোঝা গেল, তার মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও, সময় যতোই যেতে লাগলো, ততই প্রকট হতে লাগলো আর্লেনার জন্য তার অসহিষ্ণু ভাব। কোনো পায়ের শব্দ শোনামাত্রই সে উৎসুক হয় ঘুরে তাকিয়ে দেখছে, কে আসছে হোটেলের দিক থেকে। কিন্তু হতাশার পর হতাশা শুধুই। প্রথমে এলেন মিঃ এবং মিসেস গার্ডেনার সেলাই ও সেলাইয়ের বইয়ের সুসজ্জিত হয়ে। মিস ব্রুস্টার এলেন তারপর। তারা চেয়ারে গুছিয়ে বসলেন। মিসেস গার্ডেনার অসীম উৎসাহে বুনতে শুরু করলেন যথারীতি। তার কথার স্রোত সেই সঙ্গে শুরু হলো।

ব্যাপারটা কি? আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো সমুদ্রতীর আজ এত ফাঁকা লাগছে, গেল কোথায় সব। পোয়ারো বললেন, মাস্টারম্যান ও কাওয়ানরা বাচ্চাকাচ্চা সমেত দুটি পরিবারই সারাদিন ব্যাপী নৌকাবিহারে বেরিলয়েছে।

ও, সেই জন্যেই আজ এত চুপচাপ লাগছে, চেঁচামেচি হাসাহাসি করার জন্যে তো নেই ওরা। মাত্র কয়েকজনই দেখছি স্নান করছে, ক্যাপ্টেন মার্শাল।

মার্শাল তার সাঁতার শেষ করে পাড়ে এলেন; তোয়ালে দুলিয়ে সৈকত ছেড়ে উঠে এলেন ওপরে। চমৎকার আজ সমুদ্রের জল। তিনি বললেন, এমনই দুর্ভাগ্য ওদিকে একগাদা কাজ পড়ে রয়েছে। উপায় নেই না গিয়ে।

চমৎকার আজকের মতো দিনেও আপনার কাজ রয়েছে ক্যাপ্টেন মার্শাল? তাহলে তো সত্যিই দুর্ভাগ্য বলতে হয়। কি বিশ্রীই না গতকাল দিনটা গেছে। আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম যে রোজই যদি এইরকম বৃষ্টি বাদলা চলতে থাকে তাহলে আমাদের এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। এইরকম কুয়াশা ঢাকা পরিবেশে কেন যেন আমার মনমরা লাগে, আর অদ্ভুত ভাব মনকে ঘিরে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই আবহাওয়া আর পরিবেশের প্রতি আমি যথেষ্ট সংবদেনশীল। আপনি হয়তো জানেন না। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে শুধু আমি চিৎকার করে যাই। তার মানে বুঝতেই পারছেন, মা-বাবার কাছে এটা একটা সমস্যাই হয় উঠতো। আমার মা কিন্তু খুব ভালো ছিলেন। মা বাবাকে বলতো সিনক্লেয়ার বাচ্চাটার যদি সত্যিই ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে, তাহলে উচিত নয় বাধা দেবার। ওর মনের ভাব প্রকাশ করতে চাইছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে আমার বাবা দ্বিমত করতো না। বাবা-মায়ের অনুগত ছিলো এমনিতেই; মা যা বলতো বিনা দ্বিধায় তাই করতে। সত্যিই তারা সুখী দম্পতি ছিলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিঃ গার্ডেনারও আমার সঙ্গে একমত হবেন। এক কথায় তারা ছিলো অসাধারণ স্বামী-স্ত্রী, ছিলো না ওডেল? সোনা হ্যাঁ, মিঃ গার্ডেনার বললেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল আপনার মেয়ে কোথায় কি জানি, জানি না লিন্ডা? হয়ত দ্বীপে কোথাও এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্যাপ্টেন মার্শাল, জানেন মেয়েটাকে আমার বড় দুর্বল আর রোগা বলে মনে হয়। ভালো মতো ওকে খাওয়া-দাওয়া করানো দরকার, আর খুব দরদ দিয়ে যত্ন-আত্তি করা দরকার। কেনেথ মার্শাল সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিলেন, লিন্ডা ঠিক আছে। কথা শেষ করে তিনি হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন।

প্যাট্রিক রেডফার্ন জলে নামলো না। অলসভাবে সে হোটেলের দিকে চেয়ে বসে রইলো। হতাশা ও অভিমানের কালো ছায়া তার মুখমণ্ডলে নেমে এসেছে। যখন সিম ব্রুস্টার এসেছেন, তাকে দেখে বেশ প্রাণবন্ত এবং হাসিখুশি বলেই মনে হয়েছে।

সেদিন সকালের মতোই চলতে লাগলো আজকের কথাবার্তা। মিসেস গার্ডেনারের শান্ত একঘেয়ে শব্দস্তোতকে কাটা কাটা তীক্ষ্ণ মন্তব্যে যতি চিহ্নিত করতে চাইছেন মিস ব্রুস্টার। মিস স্টার শেষে একসময় মন্তব্য করলেন, আজ সমুদ্রতীর একটু নির্জন মনে হচ্ছে। সবাই কি বেড়াতে টেড়াতে গেছে নাকি? মিসেস গার্ডেনার বললেন, আজ সকালেই তো, আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম আমাদের ডর্টমুরে অবশ্যই একবার বেড়াতে যাওয়া দরকার। জায়গাটা এমনিতেই বেশ কাছে, তার ওপর ওখানকার পরিবেশ চমৎকার অত্যন্ত। আমার তো অপরাধীদের সেই কয়েকখানাটা দেখবার খুব ইচ্ছে, কি নাম যেন প্রিন্সটাউন তাই না? মনে হয় আমার আজই সব ব্যবস্থাপত্র সেরে কাল ডর্টমুরে রওনা দিলে ভালো হয়, কি বলো ওডেল। মিঃ গার্ডেনার বললেন, হ্যাঁ সোনা। এরকুল পোয়ারো মিসস্টারকে লক্ষ্য করে বললেন, স্নান করতে নামবেন আপনি কি এখন, মাদমোয়াজেল? নাঃ, আমি স্নানের পালা প্রাতঃরাশের আগেই সেরে নিয়েছি। একজন পরোপকারী ব্যক্তি সেই সময় একটা শিশি আর একটু হলেই আমার মাথায় বসিয়ে দিয়েছিলো। বোধহয় হোটেলের কোনো জানলা দিয়ে বাইরের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে থাকবে।

উঁহু এ ধরনের ছুঁড়ে ফেলার অভ্যেস রীতিমতো বিপজ্জনক। মিসেস গার্ডেনার বললেন, একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু টুথপেস্টের টিন মাথায় পড়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। পঁয়ত্রিশ তলার জানলা দিয়ে কোনো বাড়ি থেকে কেউ ওটাকে ছুঁড়ে ফেলেছিলো। কিরকম সাংঘাতিক ভাবুন! অনেক ক্ষতি হয়েছিল এর জন্য আমার বন্ধুর। এবার তিনি তার উলের ভাণ্ডার হাতড়াতে লাগলেন, ওজেল, মনে হচ্ছে বেগুনী উলের বলটা আমি ফেলে এসেছি। ওটা শোবার ঘরের টেবিলের দ্বিতীয় কি তৃতীয় টানাতে আছে দ্যাখো তো একবার। হ্যাঁ সোনা দেখছি। অনুগতভাবে মিঃ গার্ডেনার উঠে দাঁড়ালেন এবং রওনা হলেন তার অনুসন্ধানের কাজে। সাদা জুতোজোড়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন পোয়ারো। এমিলি ব্রুস্টার বললেন, জুতো পরেই জলে নেমেছেন আপনি কি মঁসিয়ে পোয়ারো? মৃদু স্বরে পোয়ারো বললেন, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কাজ করার ফল। গলার স্বরকে খাদে নামিয়ে বললেন, এমিলি ব্রুস্টার আমাদের শ্রীমতী কোথায়? এখনও দেখছি না তাকে।

মিসেস গার্ডেনার সেলাই থেকে তার চোখ তুলে প্যাট্রিক রেডফার্নেনের দিকে তাকালেন। তাকে লক্ষ্য করতে করতে চাপা স্বরে বললেন, ওকে দেখে মনে হচ্ছে থমথমে মেঘ বলে। ওঃ বিশ্রী লাগছে না এই পুরো ব্যাপারটা। এ বিষয়ে কি ভাবেন কে জানে ক্যাপ্টেন মার্শাল। এত শান্ত মানুষ ভদ্রলোক এত চমৎকার। একজন সত্যিকারে ইংরেজ এবং বিনয়ী কোনো বিষয় তিনি কি ভাবেন, আপনি তা টের পাবেন না। উঠে দাঁড়িয়ে সমুদ্রতীরে পায়চারি করতে লাগলো প্যাট্রিক। বিড়বিড় করলেন মিসেস গার্ডেনার, ঠিক যেন একটা বাঘ। রেডফার্নকে লক্ষ্য করতে লাগলো তিন জোড়া চোখ। তাকে যেন অস্বস্তিতে ফেললো তাদের পর্যবেক্ষণ। এখন শুধু গম্ভীর নয় তার মুখভাব, তাতে এসে মিশেছে চাপা ক্রোধের কালো ছায়া। এখুনি যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। তাদের কানে এলো এই থমথমে আবহাওয়া। মূল ভূ-খণ্ড থেকে ভেসে আসা ঘণ্টার হাল্কা শব্দ।

মৃদু স্বরে বললেন এমিলি ব্রুস্টার, পূর্ব দিক থেকে আবার হাওয়া বইছে। এখানে সুলক্ষণ এটাই–গির্জার ঘণ্টা শুনতে পাওয়াটা। মিঃ গার্ডেনার বেগুনী উলের বল নিয়ে ফেরা পর্যন্ত কেউ আর কোনো কথা বললেন না। ওডেল, কি ব্যাপার এত দেরি হলো। কিন্তু দুঃখিত সোনা, এটা টেবিলের কোনো টানাতেই ছিল না। খোঁজাখুজির পর অনেক শেষে আনুমারির তাকে পেলাম। কিন্তু ওঃ আশ্চর্য, আমার ধারণা ছিলো, এটা আমি টেবিলের টানাতেই রেখেছি। আমার সত্যি সৌভাগ্যই বলতে হবে কখনও যে কোনো আদালতে সাক্ষী দিতে আমার ডাক পড়েনি। কোনো কথা ঠিকমতো সেখানে মনে করতে না পারলে অস্বস্তি আর চিন্তায় হয়তো আমি মরেই যেতাম। মিঃ গার্ডেনার বললেন, মিসেস গার্ডেনার অত্যন্ত নীতিবোধসম্পন্ন মহিলা।

.

৪.৫

 প্যাট্রিক রেডফার্ন প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে মুখ খুললো, আজ বেরোবেন না। মিস ব্রুস্টার নৌকা নিয়ে আপত্তি আছে আমি সঙ্গে গেলে। আপত্তি..বরং অত্যন্ত খুশি হলো। মিস ব্রুস্টার আন্তরিক সুরে বললেন, তাহলে চলুন আজ গোটা দ্বীপটাকে এক চক্কর দিয়ে আসা যাক। প্রস্তাব করলো রেডফার্ন।

অত সময় পাওয়া যাবে কি? হাত ঘড়ি দেখলেন মিস ব্রুস্টার, ও হ্যাঁ, এখনও সাড়ে এগারোটাই বাজেনি। চলুন বেরিলয়ে পড়া যাক, আর দেরি না করে।

ওরা নেমে চললো সমুদ্রের কিনারার দিকে। প্রথম বৈঠার কাছে বসলো প্যাট্রিক রেডফানই। সে বৈঠা বাইতে লাগলো সবল হাতে। গতিবেগ নিয়ে চলতে শুরু করলো নৌকো।

প্রশংসার সুরে বললেন এমিলি ব্রুস্টার। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এভাবে বাইতে পারেন কিনা। রেডফার্ন মিস ব্রুস্টারের চোখে তাকিয়ে হাসলো। মানসিক অবস্থা তার আগের চেয়ে অনেক হাল্কা হয়ে গেছে।

নৌকো নিয়ে ফিরবো যখন আমরা দেখবেন ততক্ষণে আমার গায়ে এক-গাদা ফোস্কা গজিয়ে গেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে কপালে নেমে আসা কালো চুল স্বস্থানে ফেরত পাঠালো রেডফার্ন। ওঃ আজকের দিনটার তুলনা হয় না। যদি ইংল্যান্ডে কখনও একটা চমৎকার গ্রীষ্মের দিন পান, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না। একটু রুক্ষ স্বরেই জবাব দিলেন এমিলি ব্রুস্টার, সব কিছুই ভালো ইংল্যান্ডের, ওই একটাই পৃথিবীতে থাকার মতো জায়গা।

ঠিক বলেছেন। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পশ্চিমে মোড় নিয়ে এগিয়ে চললো ওরা। প্যাট্রিক রেডফার্ন বাইতে বাইতে হঠাৎই চোখ তুলে তাকালো। কেউ গেছে নাকি সানি লজ-এ আজ। হু, একটা ছাতা দেখতে পাচ্ছি। তাই ভাবছি কে হতে পারে।

মিস ডার্নলি মনে হয়, এমিলি ব্রুস্টার বললেন। ওরকম জাপানী ছাতা ওঁর কাছে আছে। একটা। নৌকা বেয়ে চললো ওরা উপকূল ধরে। ওদের বাঁ দিকে উন্মুক্ত সমুদ্র। বললেন এমিলি ব্রুস্টার, উলটো দিক ধরে যাওয়া উচিত ছিলো আমাদের। এদিকে স্রোতের বিরুদ্ধে বাইতে হচ্ছে। না তেমনি বেশি নেই এদিকে স্রোত। এখানে সাঁতার কেটেছি, আমি তো কখনও টের পাইনি স্রোতের টান। আমরা যেতে পারতাম না ওদিকে। কারণ সেতুটা এ সময় জলের ওপরেই থাকবে। ঢেউয়ের ওপর নির্ভর করছে সেটা অবশ্য। কিন্তু সকলে বলে পিক্সি কোভে স্নান করতে নামলে বেশি দুর সাঁতরে যাওয়া বিপজ্জনক। প্যাট্রিক এখনও সমান উদ্যমে বৈঠা বাইছে। বেশ মনোযোগ সহকারে একই সঙ্গে বেশ পাহাড়ের কোলে প্রতিটি অংশে অনুসন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। এমিলি ব্রুস্টার হঠাৎ ভাবলেন, ও নিশ্চয়ই মিসেস মার্শালের খোঁজ করছে।

নৌকা করে আসতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে। আজ সারা সকালটা আলোর দেখা পাওয়া যায়নি এবং অনুপস্থিতির কারণ প্যাট্রিক ভেবে ভেবে এখন রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এই ছল আর্লেনা সব জেনে শুনেই করছে। ওর প্রতি প্যাট্রিকের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার নিঃসন্দেহে এ এক নতুন চাল।

পিক্সি কোভের দক্ষিণ দিকে সমুদ্রে বেরিলয়ে আসা পাথুরে অংশটার কাছে ওরা বাঁক নিলো। পিক্সি কোভ জায়গাটা বেশি বড় নয়। অজস্র পাথরের টুকরো বেলাভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের কিছুটা অংশ গাড়ি-বারান্দার মতো ঝুলে রয়েছে বেলাভূমির উপর। উত্তর-পশ্চিমে মুখ করে অবস্থিত। অনেকের কাছে এই জায়গাটা অত্যন্ত প্রিয় কারণ পিকনিকের জন্য। পাথরের আড়ালে মাথার উপরটা থাকার জন্য। সকালের দিকে সূর্যের কিরণ এখানে এসে পৌঁছয় না, সেই কারণেই এ সময় কেউ এদিকে আসে না প্রায় বললেই হয়।

কিন্তু আজ একজনকে দেখা গেল এই মুহূর্তে। প্যাট্রিক রেডফার্নের কর্মরত হাত ক্ষণিকের জন্য নিশ্চল হলো আবার বাইতে শুরু করল তারপর। আরে, কে ওখানে? সে স্বাভাবিক এবং সহজ সুরে বললো। নির্লিপ্ত জবাব দিলেন মিস ব্রুস্টার, দেখে তো মিসেস মার্শাল বলেই মনে হচ্ছে।

হঠাৎ-ই খেয়াল হয়েছে, প্যাট্রিক রেডফার্ন এমন ভাবে ঘুরে আবাক হয়ে বললো, হ্যাঁ সত্যি তো! সুতরাং নৌকা চালানোর গতি তার পরিবর্তিত হলো। নৌকা এগিয়ে চললো তীর অভিমুখে। ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে চাইলো এমিলি ব্রুস্টার, আমরা কি ওখানে পাড়ে নামবো? চটপট জবাব দিলো প্যাট্রিক রেডফার্ন, ক্ষতি কি। প্রচুর সময় আছে হাতে এখন।

নিষ্পলকে তাকালো সে মিস ব্রুস্টারের চোখে, তার দৃষ্টিতে যেন সরল আকুতি ঝরে পড়লো। অনেকটা কোনো কুকুরের প্রভুভক্ত নীরব মিনতির মতো। আর কিছু বলতে পারলেন না মিস ব্রুস্টার মুখ ফুটে। হায় বেচারা! তিনি মনে মনে ভাবলেন, একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে প্রেমে। কি উপায়! সময় হলেই ও এটা কাটিয়ে উঠবে।

নিঃশব্দে এগিয়ে চললো তরতর করে পাড়ের দিকে। আর্লেনা মার্শাল নুড়ি-ছাওয়া বেলাভূমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর হাত দুটো দুপাশে বিস্তৃত। অদূরে চোখ পড়লো সাদা ভেলাটা। কিছু একটা এমিলি ব্রুস্টারকে অস্বস্তিতে ফেললো। যেন তার অত্যন্ত পরিচিত স্বাভাবিক কোনো দৃশ্যের দিকে চেয়ে আছেন তিনি, অথচ তার কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়েছে। অসঙ্গতিটা তার নজরে পড়লো। আরও প্রায় মিনিট কয়েক পরে আলেনা মার্শালের শুয়ে থাকার ভঙ্গী কোনো সূর্যনার্থীর শুয়ে থাকার ভঙ্গীর মতো নিখুঁত। সৈকতে ওকে প্রায়ই এই একই ভঙ্গিমায় শুয়ে তাকতে দেখা গেছে হোটেলের সামনে। ব্রোঞ্জ রঙের শরীর সূর্যপিপাসার টান টান, আর সবুজ পিচবোর্ডের টুপিটা ওর মাথা ও ঘাড় প্রখর সূর্যকিরণ থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু সূর্যকিরণের এতটুকু আভামাত্র নেই পিক্সি কোভের বেলাভূমিতে এবং আগামী কয়েক ঘণ্টাতেও থাকবেনা। সূর্যকে বেলাভূমি থেকে সম্পূর্ণ অপসারিত করেছে ওপরের ঝুলন্ত পাথরের আড়াল। আশঙ্কার এক অদ্ভুত ইশারা এমিলি ব্রুস্টারের মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করলো।

নৌকা এসে থামলো ওদের বেলাভূমির পাথুরে কিনারায়, এই আর্লেনা, প্যাট্রিক রেডফার্ন চেঁচিয়ে ডাকলো। এটা নির্দিষ্ট রূপ নিলো। তখনই এমিলি স্টারের ভিত্তিহীন আশঙ্কা। কোনো উত্তর এলো না, কারণ রের্ডফানের আহ্বানে শায়িত শরীরে কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেলো না।

এমিলির চোখে পড়লো প্যাট্রিক রেডফানের মুখের আকস্মিক পরিবর্তনটা। সে এক লাফে নৌকো থেকে নামলো, এমিলি স্টারও তাকে অনুসরণ করলেন, দুজনে নৌকাটাকে টেনে পাড়ে তুললো, তারপর বেলাভূমি ধরে এগিয়ে চললো পাহাড়ের কোলে, নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা নিরুত্তর শুভ্র দেহটার দিকে, প্রথমে এসে পৌঁছালো প্যাট্রিক রেডফার্নেহ, মিস স্টার তার ঠিক পেছনেই।

যেন স্বপ্নে দেখার মতো তিনি দেখলেন, এখটা ব্রোঞ্জ রঙের শরীর, সাদা পিঠ-খোলা সাঁতার পোশাক, সবুজ টুপির সীমানা ছাড়িয়ে বেরিলয়ে আসা লাল চুলের গুচ্ছ আরো একটা জিনিষ দেখলেন। দুবাহুর বিস্তৃত অদ্ভুত অস্বাভাবিক অবস্থান। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে দেহটা ঠিক স্ব-ইচ্ছায় শায়িত নয়, বরং কেউ যেন অবহেলাভরে ওটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে উন্মুক্ত বেলাভূমিতে…।

তিনি শুনতে পেলেন প্যাট্রিকের কণ্ঠস্বর..নিছকই এক আতঙ্ক-বিকৃত ফিসফিসে স্বর। নিথর দেহটার পাশে সে হাঁটু ভেঙে বসলো স্পর্শ করলো একাট হাত-বাহু…।

তার স্বর কেঁপে উঠলো, চাপা ফিসফিসে শব্দ, হায় ভগবান ও মারা গেছে এবং তারপর, সে সবুজ টুপিটা সামান্য তুলে ঘাড়ের কাছ উঁকি মারলো, কেউ গলা টিপে খুন করেছে, ওঃ ভগবান!

.

৪.৬

 এমনি এক মুহূর্ত সেটা, যে মুহূর্তে সময় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃত অনুভূতির সঙ্গে। এমিলি ব্রুস্টার শুনতে পেলেন নিজের কণ্ঠস্বরে, কিছুতে হাত দেওয়া ঠিক হবে না আমাদের, অন্তত যতক্ষণ না পুলিশ আসে।

রেডফার্নের উত্তর যান্ত্রিকভাবে ভেসে এলো, না না, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর ফিসফিসে স্বরে সে বললো, গভীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট। কিন্তু সে কে, কে? কে এই অবস্থা করলো আর্লেনা? ওকে কেউ-ওকে কেউ, খুন করতে পারে না! এ মিথ্যে, সব মিথ্যে।

উত্তর খুঁজে না পেয়ে নীরবে মাথা নাড়লেন এমিলি ব্রুস্টার। রেডফার্নের আচমকা গভীর শ্বাস টানার শব্দ শুনতে পেলেন। ক্রোধে উত্তেজিত সংযত স্বর তার কানে এল, ওঃভগবান, যে এ কাজ করেছে সে শয়তানটাকে যদি একবার হাতের মুঠোয় পেতাম।

শিউরে উঠলেন এমিলি ব্রুস্টার। তার কল্পনায় ভেসে উঠলো কোনো পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওৎ পেতে বসে থাকা কোনো হত্যাকারীর ছবি। তিনি শুনতে পেলেন অনিশ্চয়তায় ভরা নিজের কণ্ঠস্বর, যেই এ কাজ করে থাকুক, এখানে বসে আছে সে কি আর! আমাদের উচিত পুলিশে খবর দেওয়া। অবশ্য তিনি সামান্য ইতস্ততঃ করলেন, আমাদের একজনের থাকা দরকার মৃতদেহের কাছে। আমি থাকছি, প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো।

 ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন এমিলি স্টার, তিনি সেই ধরনের মহিলা নন, নিজেদের ভয় পাওয়ার কথা যারা স্বীকার করেন, কিন্তু বেলাভূমিতে আশেপাশে কোনো উন্মাদ হত্যাকারীর উপস্থিতিরক্ষীণ সম্ভাবনা নিয়ে, তাকে একা থাকতে হবে না দেখে মনে মনে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।

সেই ভালো, তিনি বললেন। আমি যত তাড়াতাড়ি পিরবো ফিরে আসবো। নৌকা নিয়ে আমি যাচ্ছি, ওই মই বেয়ে ওপরে ওঠা আমার কম্ম নয়। লেদারকোম্ব উপসাগরের কাছাকাছি একজন কনস্টেবল আছে তাকেই খবর দিচ্ছি।

যান্ত্রিক স্বরে বিড়বিড় করলো প্যাট্রিক রেডফান, হা-হা আপনি যা ভালো বোঝেন। এমিলি ব্রুস্টার সুপটু হাতে নৌকো নিয়ে এগিয়ে চললেন। যেতে যেতেই দেখলেন, মৃতদেহের পাশে প্যাট্রিক ঝুঁকে পড়ল, দুহাতে মুখ ঢাকলো, এমন একটা তার ভঙ্গীতে সর্বহারা হতাশার ভাব ছিলো যে অনিচ্ছাসত্বেও তিনি প্যাট্রিকের জন্য দুঃখ অনুভব করলেন। মনে হলো তাকে দেখে, যেন কোনো অনুগত কুকুর তার প্রিয় প্রভুর মৃতদেহের পাশে বসে অপলকে তাকিয়ে আছে। মিস ব্রুস্টার কিন্তু তবুও সরল স্বাভাবিক বুদ্ধি তাকে নীরবে বললো ওর স্ত্রীর এবং ওর ভালোর জন্য মার্শাল ও তার মেয়ের জন্যে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেদিক থেকে কখনও ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখবে…বেচারা! এধরনের মহিলা এমনিল স্টার। সর্বদা তৎপর হতে পারেন প্রয়েজানে।