৩০. আতঙ্কের চিহ্ন

৩০.

পোয়ারো রিসিভার নামানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় টম দারুণভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল। তার মুখে একটা আতঙ্কের চিহ্ন।

পোয়ারো তাড়াতাড়ি উঠে টমের কাছে আসে।

পোয়ারো বলে–টম তুমি একটু বিশ্রাম কর আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।

এই বলে পোয়ারো কিচেন থেকে কয়েকটা শুয়োরের স্যান্ডউচ আর দুধে কিছুটা ব্র্যান্ডি মিশিয়ে নিয়ে আসে।

টম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। পোয়ারো নিজের কৌতূহল দমিয়ে রেখে টমকে খেয়ে নিয়ে তারপর কথা বলতে বলে। খাওয়া শেষ হলে টম বলে-স্যার আপনাকে আগে একদিন ফোনে বলেছিলাম, মিস শার্লটের জুতোয় একটা বড়ো পেরেক উঠেছে।

-হ্যাঁ, সে পরে গিয়ে তুমি সারিয়ে নিয়ে এসেছিলে।

-এরপর দেখা গেল মিস শার্লটের জুতোয় আরো কয়েকটা পেরেক বেরিয়ে পড়েছে। তাতে তার বড়ো লাগছে। সে আমায় ডেকে বললো, টম, আবার পেরেক বেরিয়েছে তুমি কী সারালে?

-তারপর?

–আমি বলি, মিস শার্লট আমি তো মুচিকে ভালো করেই সারাতে বললাম। বলে আমি মাথা চুলকাই, যেন অপরাধটা আমারই।

-এবার খুব ভালো করে বলবে।

–আচ্ছা।

হঠাৎ ডিনসমেড এসে বলে–তোমায় যেতে হবে না। যতসব কারবার!

মিস শার্লট যে পড়তে পারছে না। ওনার বড়ো কষ্ট হচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বলি।

–আমি শহর থেকে ভালো করে সারিয়ে আনবো। এখানকার মুচি ভালো না।

–সেটাই ভালো হবে বাবা।

 –টম তুই জুতোটা প্যাক করে গাড়িতে তুলে দে।

–এক্ষুনি যাচ্ছি, স্যার।

ডিনসমেড সন্ধ্যের মুখে জুতো এনে শার্লটকে দেয়–এই নাও ভালো করে সারাই করে এনেছি।

শার্লট খুশী, বলে-বাবা চমৎকার সারানো হয়েছে। শহরের সঙ্গে কী গ্রামের তুলনা চলে?

 তারপরই একটা ঘটনা ঘটল। শার্লট ও মেরী একই ঘরে শোয়। পাশের ছোটো ঘরে টম শোয়।

একদিন টম লক্ষ্য করে তাদের ঘরের কাছে জুতোর র‍্যাকের সামনে একটা ছায়ামূর্তি এসে জুতোর কাছে কী যেন করে আবার চলে যায়, যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমন করেই।

টম কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলতে সাহস পায় না, যদি ছায়ামূর্তি আবার আসে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে ভালোভাবে দেখে নেয় কেউ তাকে দেখছে কি না আর তারপর জুতোর কাছে ভালোভাবে খোঁজে কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায় না।

টম ঐ চাদরে জড়ানো ছায়ামূর্তির উচ্চতা আর হাঁটার ভঙ্গী দেখে বুঝতে পারে যে ওটা ডিনসমেড।

তারপর টম নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরে আসে। ভাবে ওখানে কিছু একটা ঘটবেই। তাই ভালোভাবে লক্ষ্য রাখে। তা না হলে ডিনসমেড অত রাতে ওখানে আসবে কেন? হয়তো তার জন্যই পোয়ারো তাকে ওখানে রেখেছে।

টম ওঁৎ পেতে থাকে কিন্তু পরদিন তেমন কিছু ঘটল না।

এর মাঝে কয়েকদিন গেল কিছু হল না। কিন্তু দিন দশেক পরে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

–টম জানলা দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলতে গিয়েছিল, পেছন ফিরে তাকাতে দৃশ্যটা চোখে পড়ে। দৃশ্যপটের আবার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ডিনসমেড পকেট থেকে কিছু একটা বার করে জুতোর র‍্যাকের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেল।

তারপর টম সেদিনের মতোই করল। একটা পেনসিল টর্চ মেরে জুতোর র‍্যাকের কাছে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় তার চোখে পড়ল শার্লটের জুতোর পেরেকের উপর কয়েক জায়গায় একটু জলের মতো দাগ। টম ভাবে হয়তো শিশিরের জল গড়িয়ে জুতোর উপর পড়েছে। আর ঠিক তার উপরে ছাদে ড্যামের মতো দাগ। বর্ষাকালে নাকি এখান দিয়ে জল পড়ে।

টম বিছানায় শুয়ে পড়ে। হঠাৎ মনে হয় যে ডিনসমেড় দিনের বেলা তো ওখানে যায় না তাহলে রাতে ওরকম করে ওখানে যায় কেন? যে মানুষ সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে তার তো রাতে মরার মতো ঘুমানোর কথা আর সে কী না! সারারাত সে বিছানায় পোয়ারের কথা ভাবে, কিছু ঘটবে।

তারপর টম ভাবে কাল এমন ঘটলে সে ডিনসমেডকে চোর চোর বলে জড়িয়ে ধরবে। তারপর যা থাকে কপালে। আর পোয়ারোর কাজ শেষে হলেই এখান থেকে বিদায় নিতে হবে।

টম ভাবে রহস্যের গন্ধ যখন পাওয়া গেছে তখন তো চুপ করে থাকা যায় না। একটা কিছু করতেই হবে হয় এসপার নয় ওসপার।

আবার ভাবে ডিনসমেডকে হাতেনাতে ধরা ঠিক হবে না। তাহলে সে সজাগ হয়ে যাবে, তাহলে ঘটনাই ঘটবে না।

একথা সে বাড়ির কাউকে বলবে না। তার কথায় কেউ সন্দেহ করুক সে চায় না।

জর্জ হয়তো কাউকে বলবে না। সে টমকে ভালোবাসে। শার্লট কাউকে বলবে না। সে ভালো মেয়ে। আর একটা ব্যাপার সেই র‍্যাকে জর্জ, মেরী আর শার্লটের জুতো থাকে। শার্লটের জুতো থাকে একধারে। ছায়ামূর্তি সেই ধারেই প্রত্যেকদিন কী করে?

যাক, তারপর দিন টম উঠে ঘরের কাজকর্ম সেরে ডিনসমেড অফিস বেরিয়ে যেতে একটা প্লাসটিক কভারে খবরের কাগজ জোগাড় করে টেবিলের উপর রেখে দেয়। যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করে।

তারপর রাতে একই ঘটনা ঘটল। টম শার্লটের জুতোর পেরেকের উপর জলের দাগ দেখল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল সেই দাগে এক ফোঁটা জল নেই। আর বৃষ্টিও হয়নি। টম শার্লটের জুতোর পাটিটা নাকের কাছে তুলে ধরে, কেমন যেন একটা গন্ধ। তারপর টম দ্রুত প্লাসটিকের কভারে খবরের কাগজের মধ্যে শার্লটের জুতোর পাটিটা পেঁচিয়ে নেয় আর ভোরের প্রতীক্ষায় থাকে। একটু আলো ফুটলেই পাঁচিল টপকে পালিয়ে আসে পোয়ারোর কাছে।

-স্যার, এই সেই জুতো।

পোয়ারো তো যা বোঝার বুঝেই গেছে। তাই নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে, কই দেখি?

–এই যে স্যার বলে, টম জুতোয় হাত দিচ্ছিল।

 পোয়ারো বলে-থাক ওটা আর খুলতে হবে না। ওটা বরং দরজার কাছে রাখো।

পোয়ারোর তেমন আগ্রহ না থাকায় টমকে মুষড়ে পড়তে দেখে পোয়ারো টমের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে–সাবাস টম। তোমার কাজ তুমি ভালোভাবেই করেছ।

-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, কিন্তু আজ থেকে আমি যে আবার বেকার হয়ে গেলাম।

–সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমার ঐ কলেজেই চাকরি হবে। পিরের সঙ্গে দেখা করো; তাকে সব বলা আছে।

যাও এবার একটু কোণের ঘরে ঘুমোও আর রাস্তায় বেরোবে না।

-কেন স্যার?

–তাহলে অ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারো।

টম ভয় পেয়ে যায়–অ্যারেস্ট?

-হ্যাঁ, কারণ পুলিশ তোমায় খুঁজছে।

–তাহলে স্যার, আমার কী হবে?

–ধরা পড়লে দেখা যাবে।

টম শুয়ে পড়তেই পোয়ারো জুতো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সোজা হাজির হয় ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে। এখানকার মিঃ সার্টক্লিফ তাকে নানাভাবে সাহায্য করে। তিনি কী একটা টেস্টে ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু পোয়ারোকে দেখেই বলেন– আরে মিঃ পোয়ারো যে।

–আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম।

–বিরক্ত কী? আপনার হাতে ওটা কী?

–জুতো।

–ও, তা এবার জুতোরহস্য সমাধান। তা এটাকে কী করতে হবে? সার্টক্লিফ হাসতে থাকে।

–এর পেরেকের জায়গাগুলো টেস্ট করে দেখতে হবে ওখানে কী আছে।

–ঠিক আছে আপনি একটু বসুন, কফি খান। আমি ততক্ষণ এই জুতো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কী বলেন?

–উত্তম প্রস্তাব। পোয়ারো জানে সার্টক্লিফ খুব দক্ষ। এ কাজ সে পনেরো মিনিটে করে ফেলবে।

ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে পোয়ারোর হাতে একটা রিপোর্ট দেয় সার্টক্লিফ। তাতে আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ধন্যবাদ জানিয়ে পোয়ারো যেতে যেতে ভাবে তার ধারণাই ঠিক। আর্সেনিক দিয়ে শার্লটকে স্লো পয়জন করা হচ্ছিল। তাই টম বলেছিল শার্লটকে নির্জীব দেখায়। এখন পোয়ারো নিশ্চিত শার্লটই রবার্টের মেয়ে, ডিনসমেডের পালিতা কন্যা।

এবার পোয়ারোর কাছে পরিষ্কার হয় পরচুলা রহস্য। শার্লটের সোনালি চুল। যা তার পরিবারে কারো নেই। এতে লোকের সন্দেহ হতে পারে তাই ডিনসমেড ঐ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আর শার্টকে বলে তোমার সোনালি চুল দেখে বন্ধুরা ক্ষেপাবে। সে তাই বিশ্বাস করে, সে বোঝেনি এর পেছনে এতবড়ো রহস্য।

হঠাৎ পোয়ারোর মনে হয় তাহলে এতদিন ডিনসমেড শার্লটকে বাঁচিয়ে রেখেছিল কেন? হয়তো যদি কোনক্রমে ফাঁস হয়ে যায় রবার্টের মেয়ে জীবিত নয়, তবে টাকা হাতে পাবে না তাই। একদিকে শার্লটকে জীবিত রেখে মেরীকে দিয়ে কাজ হাসিল করছিল আর অন্য দিকে একটু একটু করে শার্টকে সরিয়ে দিচ্ছিল।

রবার্টের মেয়ে যে শার্লট তা সুসান জানত। কিন্তু ডিনসমেডের হত্যার প্ল্যানটা হয়তো জানত না।

পোয়ারো ভাবে রবার্টের মৃত্যুও স্বাভাবিক নয় রহস্যপূর্ণ। হয়তো এর পিছনেও ডিনসমেডের কালো হাত আছে।

একবার স্থানীয় থানায় যাওয়া দরকার। ডিনসমেডের অফিস সংলগ্ন এলাকায় হয়তো কোনো হদিশ পাওয়া যেতে পারে। যা বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয় তা অফিসে রাখলেও রাখতে পারে, কারণ অফিসে লোকের আনাগোনা কম। আর যদি সে রবার্টের ব্যাপারে জড়িত থাকে তবে রবার্টের মৃত্যু যেদিন হয় সেদিন সে নর্থ রোড স্টেশনে গেছিল এবং একজন ব্যবসায়ী তার হিসেব সে কি কাগজে কলমে রাখবে? আর রাখলেও অন্য ভাবে রাখবে। অথবা কোন সাংঘাতিক উপায় যা সে একাই বুঝবে।

রবার্ট যেদিন মারা যায় সেদিন সকালে আকাশ ভালো ছিল। দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ থেমে থেমে বৃষ্টি ঝড় শুরু হয়। পোয়ারো আগেই এসব খবর আবহাওয়া অফিস থেকে জেনেছিল।

তাই এমন দিনে বিশেষ করে লোকাল ট্রেনে লোক কম হওয়া স্বাভাবিক, এটা তার অনুমান মাত্র। পরের কথায় যৌক্তিকতা আছে কী না জানতে নর্থ রোড স্টেশনের মাস্টারের সঙ্গে কথা বলায় সে ঐ একই কথা জানিয়েছে।

এটা ডিনসমেডের কাজ কিনা জানার জন্য এবং নিঃসন্দেহ হবার জন্য তার অফিস ঘরটা খোঁজা দরকার। হয়তো ডিনসমেড নিজের অফিস ঘরেই রহস্যের চাবি কাঠি লুকিয়ে রেখেছে।

.

৩১.

 পোয়ারো সেখানকার স্থানীয় থানার সামনে গাড়ি পার্ক করে রেখে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে তার ঘরে যায়।

অফিসার পরিচিত না হলেও বয়স্ক অফিসার পোয়ারার নাম জানে এবং চেনে কারণ একাজে তার যেমন অভিজ্ঞতা, তেমন ব্যাপক পরিচিত গণ্ডী। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বলে-মিঃ পোয়ারো? আমার এখানে?

–আমায় একটু সাহায্য করতে হবে।

 নিশ্চয়ই আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়েই বসে আছি।

-হিল ভিউ রোড আপনার এরিয়ার মধ্যে তো তাই না। ওখানকার একটা দোকানে সার্চ করতে যেতে হবে।

–আচ্ছা দোকানটা কী এখন ভোলা পাবো?

–এখন একটা বাজে, ভোলা থাকারই কথা।

–তাহলে একটু অপেক্ষা করুন আমি সব ব্যবস্থা করছি।

 তারপর মিনিট দশেকের মধ্যে বেরিয়ে ডিনসমেডের দোকানের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখে দোকানের একটা পাল্লা ভেজানো আর দারোয়ান বেচারা টুলে বসে ঝিমচ্ছে।

-এই। অফিসার পুলিশী মেজাজে রুল দিয়ে দারোয়ানকে একটা গোত্তা মারে।

–স্যার, বলে লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু ডিনসমেডের বদলে পুলিশকে দেখে ভিমরি খাবার যোগাড় এবং কাঁদো কাঁদো গলায় বলে–আমি চুরি করিনি।

–মানছি তুমি চুপি করোনি, আমরা এ দোকান সার্চ করতে এসেছি।

–ও কিন্তু এখানো..দারোয়ান ইতস্তত করে-তো স্যার আসেনি।

–অন্যদিন কখন আসে?

–এই ধরুন দশটার মধ্যে।

–যা মাইনে ঠিক মতো পাও?

–না স্যার দুমাসের মাইনে বাকি। খাতাতেও তাই আছে।

হিসেবের খাতাগুলো কোথায়?

–ঐ আলমারিতে। কিন্তু চাবি স্যারের কাছে।

–সত্যি বলছ?

–হ্যাঁ স্যার।

পোয়ারো দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে–এখানকার চাবির দোকানটা কোথায়?

কয়েকটা দোকানের পরেই।

–চাবিওয়ালাকে আমাদের কথা বলে ডেকে আনো। ওর সঙ্গে একটা পুলিশ দিন।

 একটু পরেই চাবিওয়ালা মাস্টার-কি নিয়ে এল এবং একটু পরেই আলমারি খুলে দিল।

পোয়ারো দেখল আলমারিতে বেশ কিছু ফাইল ও কাগজপত্র। তবে আলমারির চারিদিকে অপরিষ্কার ও অব্যবহারের চিহ্ন জানিয়ে দিচ্ছে ব্যাবসার দুরবস্থার কথা।

এর মধ্যে কোথায় খুঁজবেন? এ তো দেখছি খড়ের গাদায় আলপিন খোঁজার মতো ব্যাপার।

-তা ঠিক তবু একবার চেষ্টা করতে হবে। পোয়ারো দারোয়ানকে বলে-মাইনে নেবার সময় কী কর?

-খাতায় স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে মাইনে নিই।

–তাহলে তো খাতাটা চেনো। বার করো তো।

–স্যার এক্ষুণি বার করছি।

পোয়ারো ভাবে রবার্ট মারা গেছে দশই মার্চ, সোমবার। তাহলে মার্চ মাসের হিসেবটা দেখতে হবে।

এদিক ওদিক-খুঁজে একটা খাতা বার করে দারোয়ান বলে–ওটা তিন বছর আগের খাতা স্যার।

–এইরকমই পনেরো ষোলো বছরের পুরোনো খাতা তোমায় বার করতে হবে।

–ওরে বাবা।

–তবে বেশি খুঁজতে হবে না। একটা খাতায় বছর তিন-চারেকের হিসেব আছে।

–হা স্যার।

–তাহলে সেই ভাবে খোঁজ।

তারপর ময়লা ঝুলে ভর্তি একটা খাতা মুছে দারোয়ান বলে, এটা হতে পারে।

থ্যাঙ্ক ইউ। পোয়ারো একটা টেবিলে বসে বসে আগ্রহের সাথে খাতাটা দেখতে থাকে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি করে সে মার্চ মাসে এসে থমকে দাঁড়ায়। এ মাসের দশ তারিখে কী লেখা আছে সেটাই তার জানা দরকার।

পোয়ারা বেশ উত্তেজিত হয়ে দশ তারিখের ব্যয়ের জায়গাটা দেখে–একটাই হিসেব লেখা আছে–টি, এক্সপেন্টা–বাইশ টাকা দশ পয়সা। তবে পোয়ারোর তীক্ষ্ণ নজরে আরো একটা জিনিস স্পষ্ট হল–টি, একপেন্ট লেখাটা একসঙ্গে হয়নি। হয়েছে বেশ কয়েকদিন পর। কারণ দশ তারিখে যে কালির ব্যবহার করা হয়েছে তার দাগ এগারো, বারো, তেরো, চোদ্দোতে নেই। পোয়ারোর মনে সন্দেহে ভরে ওঠে। এবার তাকে বাইশ টাকা দশ পয়সার হিসাব বার করতে হবে। অফিসারের দিকে তাকিয়ে–এই খাতাটা সিজ করুন।

–কিছু পেয়েছেন বুঝি?

–হ্যাঁ, আর একটা সিজার্স লিস্ট তৈরি করে দারোয়ান এবং স্থানীয় কয়েকজনকে রেসপেক্টেবল লোক দিয়ে সই করিয়ে নিন। অবশ্য আপনি একজন অভিজ্ঞ অফিসার এগুলো ভালোই জানেন।

থ্যাঙ্ক ইউ। আর দোকানটাও সিল করছি।

–হা আর একটা অনুরোধ।

এই কথাটা শুনে অফিসার লজ্জিত হয় এবং নিজেকে ধন্য বলে জাহির করে। পোয়ারো বলে-খাতাটার আট থেকে পঁচিশ তারিখ পর্যন্ত একটা ফটো স্টার্ড করে নিতে। অফিসার নিজে গিয়ে তাকে দিয়ে আসবে জানায়। তারপর পোয়ারো বিদায় নিয়ে চলে যায়।

পোয়ারো গাড়িতে বসে পকেট থেকে একটা ছোটো ডায়েরি বার করে নির্দিষ্ট জায়গাটা পেয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো আনন্দে চিকচিক্ করে ওঠে।

পোয়ারো ভাবে ডিনসমেডই যে রবার্টের খুনী তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার একমাত্র ক্লু ঐ টি, এক্সপেন্টা-বাইশ টাকা দশ পয়সা।

পোয়ারোর বিশ্বাস রবার্ট উঠেছে হিল রোড থেকে আর নেমেছে নর্থ রোডে। অবশ্য যদি নামতে সেদিন পেরেছিল। কারণ এর মধ্যে একটা অ্যাক্সিডেন্টের প্রশ্ন জড়িত ছিল। হয়তো ডিনসমেড সেদিন পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছে, কিংবা কাজটা নিজেই ঘটিয়েছে।

হিল রোড থেকে নর্থ রোড এগারো মাইল দূরে আর ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া বাইশ টাকা দশ পয়সা। এটা সেদিন স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে জেনে ডায়েরিতে লেখা।

সুতরাং পোয়ারোর দৃঢ় বিশ্বাস এতে বড় ধরনের টাকার ব্যাপার জড়িত আছে। তা না হলে ডিনসমেড এতোটা বেপরোয়া হত না। সেদিনের কাণ্ডটার পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে? আর এই রবার্টই তার প্রাণের বন্ধু।

আর সেই টাকা নিশ্চয়ই কোনো উকিল বা সলিসিটারের কাছে গচ্ছিত আছে। তাই মেরীকে নিয়ে সে প্রায়ই যেত। তাহলে মেরী ব্যাপারটা জানতে চায়নি কেন? অর্থাৎ প্রথম থেকেই অতি সাবধানে পা ফেলে এগিয়েছে।

পোয়ারো হাসে, কিন্তু ভবিতব্য? চার্লসই বা কেন সেই দুর্যোগের রাতে ডিনসমেডের বাড়িতে হাজির হবে? একেই বলে শাস্ত্রের বিধান।

.

৩২.

 পোয়ারো খবরের কাগজের অফিসে উপস্থিত হয়। জানে পেনিকে পাবে না। রোজিকে পেলেই ভালো। মেয়েটা বেশ কাজের।

আরে ঐ তো রোজি বসে আছে। রোজির বয়স তেইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে, উগ্র প্রসাধন, পরনে হাল্কা গোলাপী রংয়ের মিনি স্কার্ট আর তার উপর একটা ফুল স্পীডের সাদা সোয়েটার।

–আরে রোজি যে।

–আপনাকে কিন্তু আমি মোটেই আশা করিনি। হেসে বসতে বলে পোয়ারাকে।

–তোমায় কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে। ডেটিং আছে নাকি?

–উঁহু।

–বিশ্বাস হয় না। যাক আমার একটা কাজ করে দেবে?

নিশ্চয়ই কিন্তু কাজটা কী?

–শোনো, এ মাসের আট তারিখ থেকে এগারো তারিখ পর্যন্ত বাইরে ছিলাম। এর মধ্যের কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে?

–এক মিনিট। তারপর ইনডেক্স কার্ডের দিকে যায়, তারপর জানায় জন মুখ মারা গেছেন।

–ভালো হয়েছে আশি বছর ভুগে খুব কষ্ট পাচ্ছিল।

–কতগুলো হিপি শেষ রাতে বারে ঢুকে ক্যাবারে ডান্সারকে ছিনতাই করতে গিয়ে স্পটে পুলিশের গুলিতে দুজন মরে।

-ভালো হয়েছে। আর?

–ফুটবল সম্রাট পেলে বলেছেন–খেলাধূলার মান বজায় রাখতে ছোটোদের দিকে নজর দিতে হবে।

–আর কিছু?

–আর পথ দুর্ঘটনা, ছিনতাই ইত্যাদি।

থ্যাঙ্ক ইউ। সন্ধ্যের পর আসতে পারি।

 –ইউ আর দি লায়ার। আগে দুবার কথা দিয়েও আসেননি।

–আই অ্যাম সো সরি। হাওয়া বেগতিক দেখে পোয়ারো তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পড়ে।

.

৩৩.

 দুটোর সময় গ্রীন উড থানায় ডিনসমেডকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিনসমেড কিছুতেই তার দোষ স্বীকার করছে না। বলছে আমায় এভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে আমি এর জন্য মানহানির মামলা করবো। আমার লইয়ার বন্ধু আছে, আমায় না ছাড়লে আমি তাকে ফোন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তারপর তরুণ অফিসার টমসনকে বলে–তুমি অন্তত এসব আজেবাজে কথা বিশ্বাস করো না।

–আমি বাধ্য। ওপরওয়ালার নির্দেশ না মানলে আমার চাকরি যেতে পারে। আপনি এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন?

-হ্যাঁ, আমার মেয়েরা তো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

–সেই আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বলেছেন।

–কিন্তু কেন?

–মিঃ ডিনসমেড আপনি সব দোষ অকপটে স্বীকার করুন। নইলে আমি অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।

ডিনসমেড ফ্যাকাসে মুখে জানতে চায়–কী ব্যবস্থা নেবে? টমসন আমি শার্লটকে তোমার সাথে অবাধে মিশতে দিয়েছি আর তুমি…। আমি কিছুই জানি না।

আবার অনুরোধ করেও ডিনসমেড মুখ খুলল না। পরের দিন তাকে আদালতে পাঠানো হল।

দুদিন পরের ঘটনা। কনফেশন রুমে ডিনসমেডের উপর অত্যাচারের পর সে বলে, বলছি আর পারছি না।

পাশের ঘরে পোয়ারো আর চার্লস বসে আছে। চার্লস বলে–এখন আমার ডিনসমেডের কাছে যেতেই লজ্জা করছে।

পোয়ারো বলে–হ্যাঁ তা তো ঠিক–সেদিন তোমায় আশ্রয় না দিলে তো তুমি বাঁচতে না। আর উপরি হিসাবে পেয়েছিলে মেরীর উষ্ণ সান্নিধ্য।

–সত্যি সব মিলিয়ে তুমি মার্ডার করলে।

–আমি না তুমি? আসলে এস. ও. এস. কথাটা আমার মনে সন্দেহের ছায়া ঢুকিয়েছে।

–তাও ঠিক কিন্তু তুমি যে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার করবে তা কে জানত?

হঠাৎ টমসন এসে বলে–স্যার, মুখ খুলেছে।

–আমি আসছি। পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়।

–আমি আসতে পারি?

–হ্যাঁ, পারো।

ওদিকে ডিনসমেড আর অত্যাচার সহ্য করতে পারে না। যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। তারপর পোয়ারো আর চার্লসকে দেখে বলে–আপনারা? দয়া করে চলে যান।

টমসন বলে–উনি হলেন এরকুল পোয়ারো।

–মাপ করবেন মিঃ ডিনসমেড।

–এবার বলুন আপনি কী জানেন?

–আ-আমি কিছুই জানি না।

তারপর আরেক দফা অত্যাচারের পর ডিনসমেড মুখ খুলতে বাধ্য হয়।

স্ত্রী মারা যাবার পর রবার্ট দারুণভাবে ভেঙে পড়ে। মেয়ে নিয়ে তার খুব চিন্তা হয়। তারপর সে ভাবে যে সেও আর বেশি দিন বাঁচবে না। তখন মেয়ের কী হবে বলে বন্ধু ডিনসমেড রবার্টকে সান্ত্বনা দেয়।

-না ডিনসমেড আমি ভালো বুঝছি না।

–কেন? তোমার মরে যাবার মতো বয়স হয়নি।

 লিজার কি মরে যাবার মতো বয়স হয়েছিল?

–তা ঠিক। তবে তোমার সঙ্গে আমি আছি, অত মুষড়ে পড়ছ কেন?

রবার্ট বলে বিছানায় শুয়ে না ঘুমোতে পারলে যে কী জ্বালা! মনে হয় ভোর না হলেই এখুনি মরে যাবো।

রবার্ট আমার একটা কথা রাখবে?

–কি কথা?

–মিস জুলিয়েটকে বিয়ে করো।

–লিজার জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারি না।

–জানি, কিন্তু সে তো নেই।

–না। ও আছে

–রবার্ট পাগলের মতো কথা বল না। তুমি জুলিয়েটকে বিয়ে করো। দেখবে নতুন জীবন মধুর হবে।

-না। আজ আর তা সম্ভব নয়।

–কেন নয়? মেয়ের কথা ভাববে না?

 –সে ভার তো মিস জুলিয়েটের।

এদিকে ডিনসমেড এসেছিল কিছু টাকা ধার করতে। কিন্তু এ অবস্থায় কী করে বলবে? না বললে মেরী, জর্জ এদের অনাহারে রাখতে হবে।

রবার্ট বলে–আমি একটু বেরুবো।

–কোথায়?

দরকার আছে।

–তা যাবে কার কাছে?

-বললাম তো একটু দরকার আছে। রবার্টকে দেখে বন্ধু কষ্ট পায়। তাই বলে–তুমিও চলো। তোমার হাতে সময় আছে?

–এখন তো আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ডিনসমেড সংসার, ব্যাবসা, বাড়ির খারাপ অবস্থার কথা বলে…রবার্ট একটা অ্যাটাচি আনছে দেখে–এটা নিয়ে কোথায় যাবে? কী আছে এতে?

লিজার দাদার কাছে। এতে শেয়ারের কাগজ আছে।

-শেয়ার? ডিনসমেডের বিশ্বাস হয় না। কারণ রবার্ট বরাবরই শেয়ারের ব্যাপারে এড়িয়ে যেত তাই এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।

–হ্যাঁ চলো বেরিয়ে পড়ি।

 তারপর মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা বার্জের বাড়িতে পৌঁছায়। বয়স ষাট পেরিয়েছে। আগে সলিসিটার ছিল এখন খালি বইপত্র নাড়াচাড়া করে মাত্র। বার্জ ব্যাচেলার মানুষ তাই চারিদিকে একটা অগোছালো ভাব!

রবার্ট ডিনসমেডকে বলে তুমি একটু বৈঠকখানার ঘরে বস, আমরা কয়েকটা কথা সেরেনি। ডিনসমেড ভেবে কূল পায় না। যে রবার্ট তাকে সামান্য কথাও না বলে থাকতে পারে না আজ সে কেন এমন গোপন করছে। বৈঠকখানার লাগোয়া ঘরেই বার্জের স্টাডিরুম।

–এসো রবার্ট আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

-হ্যাঁ, একটু বিশেষ দরকারেই এসেছি। এই অ্যাটাচিতে আমার জীবনের যথাসর্বস্ব লাখ তিনেক টাকা আর দু-লাখ টাকার গহনা আছে আর উইল আছে। এগুলো আপনার কাছে রাখুন আর মেরী সাবালিকা হলে তাকে দেবেন।

-কিন্তু আমি কেন? আমার তো কেউ নেই।

-তাই জন্যই তো আপনার কাছে রাখছি। আপনি নির্লোভ। চার্চের কাছে সব দান করে দরিদ্রের মতো থাকেন। আমার শারীরিক অবস্থা ভালো না। যেকোনো মুহূর্তে…

-না ওভাবে বলা না।

–আর আপনার কাছে রাখার অর্থ হল কেউ কিছু জানবে না। আর জানলে টাকার লোভে… আজ উঠি।

-তা অবশ্য ঠিক।

 –চলি।

এসো। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।

ওদের কথা ডিনসমেড আড়াল থেকে শুনে ভাবতে লাগল-রবার্ট তার সাথে এমন ব্যবহার কেন করল?

সারা রাত ডিনসমেড ঘুমতে পারে না। চোখের সামনে অ্যাটাচিটা ভেসে ওঠে। মনে মনে সঙ্কল্প করে ওটা তার চাই-ই। সকালে উঠে সুসানকে ডাকে। সুসান কিচেনে কাজ করছিল, তাড়াতাড়ি আসতে বলায় কাজ ফেলে চলে আসে।

-কী বলছ?

–আজ থেকে মেয়েকে সোফিয়া বলে ডাকবে না। আর জর্জকে বারণ করবে।

 –কেন নামটা তো তুমি দিয়েছিলে?

–হ্যাঁ, তবে বড্ড বড় নাম।

–কী নামে ডাকব?

–মেরী। ছোট্ট দুঅক্ষরের।

–কিন্তু বড্ড কমন।

–তা হোক।

 সুসান তার কথায় সায় দিয়ে চলে যায়। ডিনসমেড অ্যাটাচিটার কথা ভাবতে থাকে তারপর বার্জের বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখে। কোথা দিয়ে ঢুকবে তারও ছক করে নেয়।

একরাতে ডিনসমেড পাঁচিল টপকে সেখানে গিয়ে দেখে অদূরে একটা বুলডগ বাঁধা। প্রাণের ভয়ে ডিনসমেড যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনই পাঁচিল টপকে বাইরে চলে যায়। তারপর অন্য মতলব আঁটে।

ডিকি নামে একটা লোকের সাথে ডিনসমেডের আলাপ ছিল। সে সার্কাসে বাঘের খেলা দেখাত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চাকরি চলে যায় তবুও তার গায়ে অসুরের জোর। তাকে ডিনসমেড সাড়ে তিন হাজার টাকায় রাজী করায় আর ধার দেনা করে অ্যাডভান্স পাঁচশো টাকা দেয়।

কিন্তু পরদিন সকালে দেখে কুকুরটা তার দেহ ছিঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। এতে বার্জ সজাগ হয়ে যায়। তখন কুকুরের সঙ্গে একটা পঁচিশ বছরের যুবককেও তার হাতে রাইফেল দিয়ে পাহারায় লাগিয়ে দেয়।

ডিনসমেড স্থির করে সে বন্ধুকে হত্যা করবে, তাই স্থির করে যায় রবার্টের বাড়ি। শোনে সে নর্থ রোডে যাবে পরের দিন। এই সুযোগে আগে গিয়ে স্টেশনে বসে ডিনসমেড। বৃষ্টি পড়ায় ট্রেন ফাঁকা। যথারীতি রবার্ট আসে। ডিনসমেড তাকে দেখে একটা কামরায় উঠে যায়। তার পাশের কামরায় বসে রবার্ট। রবার্ট গাড়িতে বসে ঝিমোতে থাকে আর সেই ফাঁকে ওভারকোট, হাতে দস্তানা, চোখে সানগ্লাস, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ডিনসমেড সে কামরায় আসে। তাকে যেন অশরীরী আত্মা ভর করেছে। নর্থ রোড ছেড়ে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দরজার কাছ দাঁড়ায় রবার্ট। নামবে কী না ভাবছে, ডিনসমেড তাকে তখনই ধাক্কা দেয়।

তারপরেই আবার একটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে একটা ভিড় কামরায় বসে চলে যায় অফিসে। তারপর জোন্স-এর ফোন আসে। তাকে সান্ত্বনা জানিয়ে জুলিয়েটকে জানাতে বলে।

পরদিন রবার্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ডিনসমেডকে সকলে প্রকৃত বন্ধু বলতে লাগল। মেয়ের ভারও আমাকেই নিতে বলল। ডিনসমেড গেল বার্জের কাছে। সেও ডিনসমেডকে ভালো বলেই মনে করল। মেয়েকেও নিজের কাছে নিয়ে রাখতে বলল। বার্জ জানায় জোন্সের শিক্ষাদীক্ষা তেমন না, তাই ওর কাছে মেয়েকে কিছুতেই রাখতে দেওয়া হবে না। তোমার কাছে মেয়েকে রাখতে হবে। ডিনসমেডের ইচ্ছা সফল হল।

এদিকে জোন্স ডিনসমেডকে মেয়ে দিতে রাজী হল না। পিটার এর মধ্যে গ্রীন উডে একটা বাড়ি ঠিক করে, পঞ্চাশ হাজার টাকায়। কিন্তু অত টাকা পাওয়া মুশকিল। এদিকে রজার বাড়ি ছাড়ার জন্য তাড়া দেয়। এই সুযোগে তার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা চায় ডিনসমেড। বলে এই টাকা দিলেই সে বাড়ি খালি করে দেবে।

প্রথমে রজার তা দিতে রাজী হয় না। কিন্তু তাকে ব্ল্যাকমেল করতে থাকে ডিনসমেড। মাটির তলা থেকে একটা পুরোনো প্যাকেট থেকে কোকেন বের করে তাতে রজারের নাম ঠিকানা দেখায় ডিনসমেড, বলে পুলিশকেও জানাবে।

তারপর রজার তাকে টাকাটা দেয় আর দুজনের মধ্যে কথা হয় এই টাকার কথা কেউ জানবে না। আর রজারের ব্যাবসার কথাও গোপন থাকে। রজার যাবার পর পিটারকে ডিনসমেড বলে মাত্র চল্লিশ হাজার হয়েছে পরে আরো তিন হাজারে রফা।

দশ বছর কেটে যায়। সোফিয়া ছয় বছর মেরী দশ। আসল মেরীর নাম রাখা হয়েছিল শার্লট। তার বয়স সাড়ে আট। সে তাদেরই বাবা-মা বলে জানে।

তখন থেকেই শার্লট, জর্জ আর মেরীকে নিয়ে সে ঘুরপথে বার্জের বাড়ি যেত। মুখে বলত আমার দুই মেয়ে কিন্তু আসলে মেরী সাজিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে গিয়ে রবার্টের সম্পত্তি গ্রহণ করতে চাইতো।

হঠাৎ যীশুর দিকে তাকিয়ে চোখে জলে ভর্তি করে ফেলত। তাই দেখে বার্জ তাকে খুব ভালো মানুষ বলে মনে করতে লাগল। সত্যিই সে এমন দৃষ্টান্ত কম দেখেছে।

মেরীর সাথে গল্প করে বার্জ জানতে পারে সে ডিনসমেড আর তার স্ত্রীকেই বাবা-মা বলে জানে। এ দেখে সে আরো খুশী হয়। ডিনসমেড তাকে বলে সেই তো একদিন জানবেই। তাই আগে থেকে দুঃখ দেবো কেন? বড়ো হোক তখন নিজেই জানবে।

এদিকে শার্লট বড়ো হচ্ছে তাকেও পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। না হলে সে যদি বড়ো হয়ে জানতে পারে তবে তো আর রক্ষে নেই এতে। এতদিনের পরিকল্পনা একবারে মাটি হয়ে যাবে। তাই শার্লটের জুতোর পেরেকে আর্সেনিক লাগিয়ে তাকে স্লো পয়জন করতে থাকে।

বার্টের বন্ধু ল্যাবোরেটরিতে কাজ করত তার কাছ থেকেই ভয় দেখিয়ে আর্সেনিক আনত। তাই নিস্তেজ হয়ে গেছে শার্লট। তাকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। সে এখন ভালো আছে।

সবশেষে যখন ডিনসমেড স্বীকার করে তখন সে মুখ থুবড়ে টেবিলের উপর পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

তখন পোয়ারো তরুণ অফিসার টমসনকে বলে–ডিনসমেড দোষী, তার তত শাস্তি হবেই কিন্তু শার্লট কোনো দোষ করেনি, সে কিছু টাকার উত্তরাধিকারিণী হয়েছে। আমি চাই তুমি ওকে বিয়ে কর। আর দেখ ঐ সংসার যেন ভেসে না যায়। আমার এই অনুরোধ তুমি রেখো।

–অনুরোধ না, স্যার আদেশ বলুন। আপনি না থাকলে এ কেসের সমাধান হত না।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চার্লস আর পোয়ারো গাড়ি করে চলে যায়। যেতে যেতে পোয়ারা বলে–এই ব্যাচেলার জীবনই ভালো। দ্যাটস লাইফ ইজ গুড।