দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ১

।। এক।। 

আমার এতটুকু দ্বিধা বা সংকোচ নেই স্বীকার করতে যে এই কাহিনীর সঙ্গে আমি শুরু থেকেই জড়িত। এই কাহিনী লিখতে গিয়ে আজ আমার সবার কথাই মনে পড়ছে। বড় থেকে একেবারে ছোট, সর্বকাজে পারদর্শী পরিচারিকা মৃত এমিলিকে পর্যন্ত। সৌভাগ্যবশত আমার জানার বাইরে যেসব ঘটনাগুলো লিখব সেগুলো স্যার ইউস্টেস পেডলারের দিনলিপি থেকে সংগ্রহ করা। যা তিনি দয়া করে আমার লেখার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। 

এই হল কাহিনীর ভূমিকা। অ্যানি বেডিংফিল্ড ওর অভিযানের কাহিনীর বর্ণনা দিতে লাগল। আমার নেশা অভিযান, দারুণ প্রিয়। এই কারণেই আমার জীবন আতঙ্কে ভরা। আমার বাবা অধ্যাপক বেডিংফিল্ড ছিলেন আদিম মানুষের জীবনধারা আবিষ্কারের ব্যাপারে ইংলন্ডের মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞদের বিশেষ একজন। সত্যি তিনি একজন প্রতিভাবান। প্রাচীন প্রস্তুত যুগের সময় ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়, বাবা কখনো আধুনিক মানুষের পরোয়া করেনি। এমনকি নব্য প্রস্তর যুগের মানুষকেও না। তিনি তাদের গরু-ভেড়ার মতো মনে করতেন। 

দুর্ভাগ্যবশত নব যুগের আধুনিক মানুষকে কেউ চিরতরে খতম করতে পারে না। তা সত্ত্বেও বাবাকে দেখেছি অতীতের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। আধুনিক যুগে পা রাখেনি। খুব ছেলেবেলায় মা মারা যান। আমাকে বাস্তব জীবনের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে মায়ের মৃত্যুটা। আমার তখন মনে হয়েছে বাবার অবহেলাতেই মা মারা গেছে। আর সেই থেকেই আমার মানসিকতা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে। প্রস্তর যুগের মানুষকে আমি আজও ঘৃণা করি। তাই তো বাবার সেই আদিম মানুষগুলোর কথা বার বার কেটে দিয়েছি। 

আমি কি ভাবলাম না ভাবলাম তা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবসর তাঁর ছিল না। অন্য কোনো লোকের পরামর্শ নেওয়ার ধার ধারতেন না তিনি। এইভাবেই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন থেকে তিনি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। সংসার চালাতে গেলে যে টাকার প্রয়োজন হয় সেটা তাঁর খেয়ালই ছিল না। সবসময়ই আমাদের অভাব অনটন লেগেই থাকত। বড় বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর নামডাক ছিল প্রচুর কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব কমই তাঁকে জানত। একদিন ‘ডেলি বাজেট’ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ছিল, ‘আমরা বানরের বংশধর নই, বরং বানররাই আমাদের সৃষ্টি।’ একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক রায় দিলেন, শিম্পাঞ্জীরাই মানুষের পূর্বপুরুষ। 

একজন সাংবাদিক এলেন ও অনুরোধ করলেন, বাবা এই তত্ত্বের ওপর ব্যাখ্যা করে ধারাবাহিকভাবে তাদের পত্রিকায় লেখেন, বাবা তো শুনে আগুন, এমন রাগ আগে কখনো দেখিনি। ‘বাবা’ যুবক সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। তখন আমরা অর্থাভাবে কষ্ট পাচ্ছি। এই সময়ে বাবা এ কী করলেন? হাতের লক্ষ্মী ঠেলে দিলেন? হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, আমি তো কিছু লিখতে জানি। আর এমন লেখা কঠিন ব্যাপার নয়। লেখাটা বাবার নামে চালিয়ে দিলে সংসারে কিছু অর্থের সমাগম হতে পারে। এমন পত্রিকা বাবা বড় একটা পড়েন না। এই ভেবে আমি সাংবাদিকের পিছু ছুটে যাই, এবং তাঁকে বলি, তাঁদের পত্রিকায় বাবা লিখতে রাজি হয়েছেন, যথাসময়ে ওঁর লেখা পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেই লেখা আমি বেশিদিন চালাবার সাহস পাইনি, কারণ ঝুঁকি ছিল, পরে সেটা উপলব্ধি করে লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। তাই দুঃখের সঙ্গে গ্রামে এক রাগী মুদির দোকানে চাকরির জন্য আমাকে যেতে হয়। 

‘ডেলি বাজেট’-এর এক যুবক সাংবাদিক আমাদের বাড়িতে আসতেন, অন্য কোনো যুবকের সংস্পর্শে আমি আসিনি তখনো। আমাদের কিশোরী পরিচারিকা এমিলির ওপর আমার খুব হিংসে হত, সে প্রায়ই তার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হতে যেত, বাবার অধ্যাপক বন্ধুরা যদিও বাড়িতে আসতেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন বয়স্ক। তবে একথা সত্যি যে, একদিন অধ্যাপক প্যাটার্সন হঠাৎ আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে আদর করে বলেছিলেন, তোমার কোমরটা কী সুন্দর সরু, তারপর তিনি আমাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। 

আমি তখন খুব ব্যাকুল, একটু পুরুষের সঙ্গ পাওয়া ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। গ্রামে একটা লাইব্রেরি ছিল, সেখান থেকে প্রেমের উপন্যাস এনে পড়তাম, কৃত্রিম ভালোবাসার স্বাদ অনুভব করার জন্য, কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটানো যায়? আমার একটাই ইচ্ছা, আমার জীবনে একজন পুরুষ আসুক, যে আমাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে কানায় কানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে সেই গ্রামে ভালোবাসা দেওয়ার বা পাওয়ার মতো কোনো পুরুষ আমার চোখে পড়ল না। 

একদিন গ্রামে একটা ছবি দেখলাম,—ছবির নাম পামেলার আতঙ্ক। চমৎকার মেয়ে পামেলা, যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি সাহসী। যে-কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে পা বাড়িয়েই থাকে সে। প্লেন থেকে ঝাঁপ দেওয়া। সাবমেরিনে অভিযান। আকাশ-ছোঁয়া বাড়ির পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠা, হামাগুড়ি দিয়ে পাতালে প্রবেশ করা, এসবই যেন তার ডাল-ভাত, তাই এই বেপরোয়া অভিযানে প্রতিক্ষেত্রে অপরাধ জগতের পাতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু যদি যাদুর বশে যেন ঠিক সময়ে নায়ক এসে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পামেলার চরিত্র আমার মাথার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে সেই ছবি দেখার পর থেকে। এমনই একদিন সেই ছবিটা দেখার পর বাড়ি ফিরে এসে দেখি গ্যাস কোম্পানির পরোয়ানা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বিলের পাওনা টাকা না মেটালে গ্যাসের লাইন কেটে দেওয়া হবে। 

আমার মনে হয়েছে এই বোধহয় আমার জীবনের দুঃসাহসিক অভিযান বুঝি আর দূরে নেই, এগিয়ে এসেছে। সম্ভবত আজও পৃথিবীর বহু মানুষ দক্ষিণ রোডেশিয়ার পুরোনো করোটি পাওয়ার কথা জানে না। একদিন সকালে দেখি বাবা খুব উত্তেজিত, বিষয়- সন্ন্যাস রোগ। 

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, জাভার করোটির সঙ্গে এর মিল থাকতে পারে কিন্তু সেটা ভাসা-ভাসা। অ্যানি, এটা স্বীকার করতেই হবে, জিব্রালটারের করোটিই হচ্ছে সবচেয়ে আদিম করোটি। কারণ আদিম মানুষের বাসস্থান ছিল কেবল আফ্রিকাতেই, পরে সুদূর ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। তাই এখুনি আমাদের সেখানে যেতে হবে। হ্যাঁ, সেখানে কেউ পৌঁছবার আগেই আমাদের হাজির হতে হবে। 

শান্ত গলায় আমি বললাম, কিন্তু টাকার কি হবে বাবা? 

আমার দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকিয়ে বললেন, শেনো অ্যানি, তোমার মতবাদ সবসময়ে আমাকে কেমন হতাশ করে। না, না বিজ্ঞানের স্বার্থে আমরা কখনোই অমন ইতর হব না। 

—কিন্তু বাবা, পেটের স্বার্থে ইতর না হয়ে তো উপায় নেই, আমি তাঁকে বাস্তবের মুখোমুখি হতে আহ্বান জানাই, আমাদের খিদের কি অপরাধ বলো? 

—প্রিয় অ্যানি, তার জন্য তো তোমার কাছে টাকা মজুত আছে। 

—না, নেই বলেই তো বলছি বাবা। 

—সত্যি এই ছেঁদো টাকার প্রশ্নটা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারি না। গতকালই ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, এখনও আমার অ্যাকাউন্টে সাতাশ পাউন্ড আছে। 

—সে তো তোমার ওভারড্রাফ্ট। 

—আঃ বলছি না আছে। এবার রীতিমতো বিরক্ত হয়ে–ঠিক আছে আমার প্রকাশকদের লিখে দাও— 

আমার কিন্তু সন্দেহ বাবার লেখার তুলনায় তার প্রকৃত মূল্য দিয়ে প্রকাশকরা কখনোই মূল্যায়ন করেন না। সারাটা জীবন তিনি কেবল বেগার খেটে গেলেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো আর কি। ইদানীং বাবা ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাই বললাম, আজ খুব ঠান্ডা পড়েছে। গলায় মাফলার লাগাতে ভুলো না যেন। 

তিনি সেদিন সন্ধ্যায় একটু দেরি করেই ফিরলেন। অবাক হয়ে দেখলাম মাফলার এবং ওভারকোট দুটোই তিনি হারিয়ে বসে আছেন। 

—তুমি ঠিকই বলেছ অ্যানি, এ সব কাজ বড় নোংরা। পাহাড় পর্বতে, খাদের নিচে সব সময়ে কাজ, ধুলোয় নোংরা হয়ে যাবার ভয়ে ওগুলো খুলে রেখেছি। 

একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন, তাঁর আপাদমস্তক প্লাস্টারে ঢাকা। সারাটা সন্ধ্যা কাশিতে খুব কষ্ট পেলেন। পরদিন সকালে তাঁর জ্বর দেখে ডাক্তারকে খবর দিলাম। 

বেচারী, চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ পেলেন না, ডাবল নিমোনিয়া। চারদিন পরে বাবা মারা গেলেন। 

।। দুই।। 

সবাই আমাকে দয়া দেখাতে লাগল বাবার মৃত্যুর পর, তাতে আমার কোনো দুঃখ রইল না। বাবা কখনো আমাকে স্নেহ করেননি, ভালোবাসেননি। তবু আমরা দু’জনে একসঙ্গে বসবাস করেছি, তাঁর শিক্ষাদীক্ষার, বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহকে গোপনে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। কিন্তু দুঃখ হল, খ্যাতির শেষ শিখরে পৌঁছানোমাত্র তিনি মারা গেলেন। বাবাকে পাহাড়ের গুহায় সমাধিস্থ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু জনসাধারণের আপত্তিতে হল না। আর এ ব্যাপারে পল্লীযাজকও তেমন উৎসাহ দিলেন না। 

শেষ পর্যন্ত আমার স্বাধীনভাবে চলার ইচ্ছাটা পূরণ হলেও কিন্তু আমি তখন কপর্দকহীন, অনাথ। কিন্তু সবাই অযাচিতভাবে দয়া দেখাতে লাগল, পল্লীযাজক তাঁর স্ত্রীর দেখাশোনার ভার নিতে অনুরোধ করলেন। হঠাৎ পাড়ার লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ স্থির করল, আমাকে সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ করবে। আমাদের চিকিৎসক একদিন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। 

চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে এই প্রস্তাব শুনে অবাক হলাম, তাঁকে কখনোই সেই ছায়াচিত্রের নায়িকা পামেলার নায়ক বলে মনে হয় না, এমনকি মনে হয় না কোনো দরদী রোডেশীয়। তিনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন, একজন চিকিৎসকের কাছে তার স্ত্রীর বড়ই প্রয়োজন। তাছাড়া তিনি আমাকে সুখ ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চান। এখন ভাবছি, সেদিন তাঁর প্রতি আমি বড়ই অবিচার করেছিলাম কারণ আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল না। তখন আমার ভালোবাসা বিদ্রোহ করেছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এ আপনার অসীম দয়া, কিন্তু এ অসম্ভব। কাউকে পাগলের মতো ভালো না বাসলে তাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। 

—তুমি ছেলেমানুষ, তাহলে এখন কি করতে চাও? 

—আনন্দ, স্ফূর্তি, দুঃসাহসিক অভিযান এবং পৃথিবীকে দেখতে চাই। 

—তুমি ছেলেমানুষ তাই তোমার নিজের সুবিধা-অসুবিধার কথা বুঝতে পারছ না। তাই যদি আমার প্রস্তাবটা একবার বিবেচনা করে দেখ— 

—না, আমি পারব না ডাক্তার। আমি এখন লন্ডনে যাচ্ছি, দেখবেন, একটা পরিবর্তন ঠিক আসবেই আমার জীবনে। 

আমার পরবর্তী দর্শনপ্রার্থী হলেন মিঃ ফ্লেমিং, বাবার লন্ডনের সলিসিটার। তিনি নিজে একজন নৃবিজ্ঞানীও বটে। বাবার খুব ভক্ত ছিলেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে তিনি আমার হাত দুটো ধরলেন স্নেহের নিদর্শন হিসাবে। 

—প্রিয় অ্যানি, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। বলতে গেলে তিনি আমাকে একরকম সম্মোহিত করে ফেললেন। তখন কেন বুঝতে পারছি, ওর বিরোধিতা করার ক্ষমতা আমার নেই। 

—যদি শুনতে চাও তাহলে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই— 

—হ্যাঁ, আমি শুনতে চাই বইকি। আপনি বলুন কি বলতে চান। 

—তোমার বাবা একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন। উত্তরপুরুষ তাঁর মূল্যায়ন করবে। কিন্তু তিনি ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন না। 

মার কাছে মাসীর গল্প করা আর কি! আমার বাবা যে ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ সে কথা মিঃ ফ্লেমিং-এর থেকে আমিই ভালো জানি। কিন্তু আপাতত তাঁর কাছে আমি মুখ খুললাম না। 

অযথা তিনি তাঁর বক্তব্য দীর্ঘ করলেন। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, আমার বাবা নাকি আমার জন্য ৮৭ পাউন্ড ১৭ শিলিং ৪ পেন্স রেখে গেছেন। যা আমার জীবধারণের পক্ষে খুবই অল্প। তিনি হয়তো এরপর বলবেন, লন্ডনে তাঁর এক মাসী আছে, যে আমার মঙ্গল কামনা করে, ইত্যাদি। কিন্তু তা আর বললেন না। 

কিন্তু মিঃ ফ্লেমিং আবার বলতে লাগলেন, তোমার ভবিষ্যৎ কি হবে? শুনেছি তোমার আত্মীয়স্বজন এখানে কেউ নেই। 

—কে বললে? এখানে সবাই আমার প্রতি দয়াশীল, সবাই আমার বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী।

—কিন্তু তোমার মতো সুন্দরীর পক্ষে তাদের এই দয়াদাক্ষিণ্য শুভ নাও হতে পারে। তুমি যদি কিছুদিন আমাদের কাছে এসে থাক তো কেমন হয়? 

আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম। লন্ডন! যেখানে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা অপেক্ষা করছে। সত্যি, এ আপনার অসীম দয়া, লন্ডনে গিয়ে আমি বাঁচার জন্য উপার্জন করার জন্য অনেকদিন থেকে সুযোগ খুঁজছিলাম, বুঝলেন? 

—বেশ তো, তোমার জন্য ‘কিছু’ একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব। 

এই ‘কিছু’ একটা ব্যবস্থা করার মানে যে কি হতে পারে তা আমি জানি। তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও এই মুহূর্তে তা প্রকাশ করলাম না। ধন্যবাদ, কিন্তু মিসেস ফ্লেমিং— তোমাকে আন্তরিকভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে পারলে আমার স্ত্রী খুবই খুশী হবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, কোনো স্বামী তার স্ত্রীর মনের কথা সঠিকভাবে জানে না। আমার যদি স্বামী থাকত আর সে যদি এক অনাথ যুবতীকে ঘরে তুলত। আমি আমার স্বামীকে ঘৃণা করতে কসুর করতাম না। 

মিঃ ফ্লেমিং বললেন, ভাবছি স্টেশন থেকে আমি আমার স্ত্রীকে একটা টেলিগ্রাম করে দেব।

মিঃ ফ্লেমিং তাঁর কেনিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়লেন। সব পুরুষরাই বুঝি এমনি ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে থাকে। আর স্ত্রীর মুখোমুখি হতে ভয় পায় মিঃ ফ্লেমিং-এর মতো। কিন্তু মিসেস ফ্লেমিং আমাকে দোতলায় নিয়ে আমার শয়ন ঘর দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, এ ঘরেই তুমি থাকবে। মিনিট পনেরোর মধ্যে আমার জন্য চা পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে গেলেন। 

একটু পরেই একতলার ড্রইংরুম থেকে তাঁর মৃদু চিৎকারের শব্দ ভেসে এল। বোঝা না গেলেও তাঁর কথার ধরন দেখে খুব সহজেই তার অর্থ বোঝা যায়। কয়েক মিনিট পরেই আবার তাঁর কণ্ঠস্বর—মেয়েটি অবশ্যই দেখতে সুন্দরী। 

সত্যি মেয়েরা যদি দেখতে শুনতে না ভালো হয় তাহলেও কোনো পুরুষই অযথা দয়া দেখিয়ে এগিয়ে আসবে না, আর যদি— 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি আমি আমার চুলের পরিচর্যায় মন দিলাম। চুলের একটা আলাদা শ্ৰী আছে। কালো চুল, ঘন, কপাল ও কান সুন্দরভাবে ঢাকা পড়ে। লক্ষ্য করলাম সাজগোজ করে 

দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট

১৯৫ 

মিসেস ফ্লেমিং-এর সামনে দাঁড়াতেই তাঁর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মুখের ওপরে। আর মিঃ ফ্লেমিং স্তম্ভিত, হতভম্ব। 

সারাটা দিন বেশ ভালোভাবেই আমার কাটল। একসময়ে নিজের ঘরে ফিরে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই বিস্মিত। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার সবুজ চোখ দিয়ে আমি অভিযানের স্পষ্ট ছবি যেন দেখতে পাই। 

অভিযানের কথা মনে হতেই নিজেকে নিজেই অভিসারিকার বেশে সাজিয়ে ফেললাম। এখন এক দুঃসাহসিক অভিযানের নেশা আমার রক্তে, আমার চোখে। অ্যানি তুমি অভিসারিকা, ভালোবাসার মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়ো আর তখুনি আমার খেয়াল হল, আমি কেনিংটনের বাড়িতে অতিথি একজন, সত্যি মেয়েরা কতই না বোকা। 

।। তিন ।। 

আমার কাছে একঘেয়ে মনে হল পরের কয়েক সপ্তাহ। মিসেস ফ্লেমিং-এর বন্ধুদের সঙ্গ বড় বিরক্তিকর। ভালো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় মিল্কম্যান ভালো দুধ দিচ্ছে না। এছাড়া অন্য কোনো ভালো কথা নেই। এঁরা বোধহয় কাগজ পড়েন না। জানেন না পৃথিবীটা একটা বিরাট জায়গা। এইসব মহিলারা বেশিরভাগ ধনী পরিবারের। কিন্তু এরাই লন্ডনের নোংরা জায়গায় বসবাস ও নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না। অন্য মানসিকতায় আমার জীবন গড়ে উঠেছিল। আমার তাই ভীষণ অসহ্য লাগে এঁদের। 

আমার কাজ দ্রুত এগোচ্ছে না। বাড়ির আসবাবপত্রগুলো বিক্রি করে বাবার দেনা শোধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার চাকরির কোনো হদিশ পাচ্ছি না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যদি কোনো অভিযানের প্রতি নজর দিই সেটা আমার অর্ধেক চাহিদা পূরণ করতে পারে। কেউ কিছু কামনা করলে তাঁর আশা অবশ্যই পূরণ হয়। এ আমার ব্যক্তিগত ধারণা। 

সম্ভবত ৮ই জানুয়ারি বাড়ি ফিরছিলাম একজন মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে। ব্যর্থ, এবারেও চাকরির কোনো আশা নেই। ভদ্রমহিলা তাঁর সেক্রেটারি এবং সঙ্গিনী হিসেবে একজন মহিলার খোঁজ করছিলেন। কিন্তু আসলে তাঁর দরকার বারো ঘণ্টার জন্য ঠিকা ঝি। বছরে পঁচিশ পাউন্ড বেতন। এডগার রোড থেকে হাইড পার্ক কর্নার টিউব স্টেশনে এসে গ্লুকোস্টার রোডের ট্রেন ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিলাম। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা, আমি এবং একজন লোক, তার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে ন্যাপথালিনের গন্ধ নাকে এল। জানুয়ারি মাস, শীত আসছে। রোগাটে, ছোট বেঁটেখাটো, গায়ে শীতের কোট-প্যান্টে বাক্স বন্দী অবস্থায় ছিল বলেই বোধহয় ন্যাপথালিনের গন্ধটা পেলাম। লোকটা একেবারে টানেলের ধারে দাঁড়িয়েছিল। আমি তার দিকে তাকাতেই সে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। 

ভাবলাম লোকটা সবেমাত্র ভারতবর্ষ থেকে এসেছে তাই তার ওভারকোট থেকে ন্যাপথালিনের গন্ধ বেরুচ্ছে। অফিসার নয় সম্ভবত চা-ব্যবসায়ী হবে লোকটা। 

এই সময়ে লোকটা আমার পিছনের দিকে তাকানো মাত্র ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল। মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। তখন সে পিছু হটতে গিয়ে তার দেহটা টানেলের নিচে রেল লাইনের উপর পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ। তার অন্তিম আর্ত চিৎকারে বহুলোক ছুটে এল। দুজন রেল অফিসার এলেন। পোর্টারের সাহায্যে লোকটাকে তোলা হল। একজন লোক আমাকে একরকম ধাক্কা দিয়েই লোকটার কাছে যেতে যেতে বলল, আমি একজন চিকিৎসক, ওকে পরীক্ষা করতে দিন দয়া করে। 

ঝুঁকে পড়ে ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে শুকনো মুখে বলল, মৃত। করার কিছু নেই। আমার দেহ তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। এমম ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্য যে এখানে দেখব ভাবতেও পারিনি। 

১৯৬ 

আগাথা ক্রিস্টি রচনাসমগ্র

মাতালের মতো টলতে টলতে লিফটে ওঠার জন্য ছুটলাম ওপরে উঠে খোলামেলায় বুক ভরে বাতাস নেওয়ার জন্য। সেই ডাক্তার আমার আগে আগে এগিয়ে যাচ্ছিল। একটা লিফ্ট তখন সবেমাত্র উপরে উঠতে শুরু করেছিল। ডাক্তার ছুটতে শুরু করল এবং সেই অবস্থায় একটা কাগজের টুকরো সে ফেলে গেল। 

সেই কাগজের টুকরোটা হাতে তুলে তার পিছু ধাওয়া করলাম। কিন্তু লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল আর আমার হাতের কাগজ হাতেই রয়ে গেল। তারপর লিফটে চড়ে রাস্তায় পৌঁছে তাকে আর দেখতে পেলাম না। ভাবলাম তাহলে এই কাগজটার কোনো গুরুত্ব নেই এবং সেই প্রথম সেটায় চোখ রাখলাম। কয়েকটা সংখ্যা ও অক্ষর, সেগুলো এইরকম : ১৭, ১.২২ কিলমার্ডেন ক্যাসল। 

একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই কাগজটা মুড়ে ব্যাগে রেখে দিলাম। তারপর হেঁটে বাড়ি ফিরে মিসেস ফ্লেমিংকে সেই বিশ্রী রকমের দুর্ঘটনার কথা বলে আমার ঘরে এসে বিছানায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলাম। 

মনে মনে সেই অস্বাভাবিক ঘটনার ওপর আমার কি করণীয় থাকতে পারে তার একটা ছক করেছিলাম। সেই ডাক্তারের ব্যবহার আমার চোখে ভালো ঠেকেনি। নিহত লোকটার মৃতদেহ পরীক্ষা করার সময় তাঁর চালচলন ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। ডাক্তারের গতিবিধি আমার চোখে এখনও ভাসছে। 

আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সান্ধ্য পত্রিকার একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদের শিরোনামায়। টিউব স্টেশনে একজন লোক নিহত হয়েছে, তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত না কি খুন, এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। 

মিঃ ফ্লেমিং আমার কাছে ঘটনার বিবরণ শুনে আমার ধারণার সঙ্গে একমত হলেন। তদন্তের সময় নিঃসন্দেহে তোমাকে ডাকা হবে। তুমি বলছিলে, দুর্ঘটনার সময়ে তুমি ছাড়া নিহত লোকটির ধারে কাছে আর কেউ ছিল না। 

তবে কাউকে চোখে না পড়লেও আমার মনে হয়েছিল, আমার ঠিক পেছনে কেউ ছিল। আমার অনুমান সত্যি হলেও লোকটার কাছাকাছি বলতে একমাত্র আমিই ছিলাম। 

মিঃ ফ্লেমিংই তদন্তের সব ব্যবস্থা করলেন। তবে এ ব্যাপারে আমি যা জেনেছি, তা পুলিসের কাছে গোপন করতে হবে। অর্থাৎ না জানার ভান করতে হবে। 

এল. বি. কার্টন নিহত ব্যক্তির নাম। তার পকেট থেকে কেবল তার হাউস এজেন্টের একটা চিঠি, মার্লোর কাছে একটা নদীর ধারে তার জন্য একটা বাড়ির খবর দিয়ে লেখা সেই চিঠি। রাসেন হোটেলে এল. বি. কার্টনের নামে ঘর বুক করা ছিল। হোটেলের অফিস ক্লার্ক লোকটাকে সনাক্ত করে জানায়, মৃত্যুর দু’দিন আগে সে হোটেলে এসে তার নামে ঘর বুক করে। হোটেলের খাতায় তার নাম নথিভুক্ত করে এল. বি. কার্টন। কিমবার্লি, দক্ষিণ আফ্রিকা। সোজা সে স্টিমারে লন্ডনে আসে। 

একমাত্র আমিই তার শেষ মুহূর্তের ঘটনার ব্যাপারে জানি। করোনার আমার কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা আপনি কি মনে করেন, তাঁর মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত? 

—হ্যাঁ, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মনে হয় একটা কিছু তাকে দারুণভাবে ভীত করে তুলে থাকবে সেই মুহূর্তে এবং অন্ধের মতো পিছন ফিরে পালাতে গিয়ে তার খেয়াল ছিল না তিনি কি করতে যাচ্ছেন। 

কিন্তু তার সেই ভয়ের কি এমন কারণ ঘটেছিল, যে তা আমি জানি না। তবে নিশ্চয়ই সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল কারণ তখন দারুণ আতঙ্কগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। 

একজন জুরি মন্তব্য করেন, হয়তো কোনো বিড়ালকে দেখে লোকটা ভয় পেয়ে থাকবে। মনে হয় ভদ্রলোকের বাড়ি যাওয়ার খুব তাড়া থাকবে। তাই যারা তার আত্মহত্যার স্বপক্ষে মত পেশ করেছিলেন, তাদের বিরোধিতা করার জন্য অহেতুক বিতর্কের মধ্যে তিনি যেতে চান না। 

করোনার বললেন, এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। আশ্চর্য লাগছে, যে ডাক্তার ভদ্রলোক প্রথমে সেই নিহত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করেছিলেন, তিনি কিন্তু এখনো আমাদের সামনে আসেননি। সেই সময় তাঁর নাম ঠিকানা নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। 

এই ডাক্তারের ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা ধারণা আছে বলে মনে মনে হাসলাম। ভেবেছিলাম পরদিন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার নিজস্ব মতামত জানাব। কিন্তু সকালে এক বিরাট বিস্ময় নিয়ে এল মিঃ ফ্রেমিং প্রতিদিনের মতো সেদিনও ‘ডেলি বাজেট’ পত্রিকা নিয়ে এলেন। সেই কাগজে দুটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছিল : টিউব স্টেশনে বিচিত্র এক দুর্ঘটনা। 

নির্জন বাড়িতে জনৈকা মহিলাকে শ্বাসরোধ অবস্থায় পাওয়া যায়। মার্লোর মিল হাউসে এক চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার। মিল হাউসের মালিক হলেন স্যার ইউস্টেস পেডলার, এম. পি. হাইড পার্ক কর্ণার টিউব স্টেশনে রেললাইনে আত্মহত্যাকারী লোকটির পকেট থেকে এই বাড়িটি দেখার একটি অনুমতিপত্র পাওয়া যায়। মিল হাউসের উপরতলায় গতকাল এক পরম সুন্দরী যুবতীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। সম্ভবত, মেয়েটি বিদেশিনী। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাকে সনাক্ত করা যায়নি। খবরে প্রকাশ, পুলিস নাকি একটি সূত্র খুঁজে পেয়েছে। মিল হাউসের মালিক স্যার ইউস্টেস রিভিয়েরায় শীত উপভোগ করছেন। 

।। চার।। 

কেউ এগিয়ে এল না মেয়েটিকে সনাক্ত করতে। তদন্তে জানা গেল, ৮ই জানুয়ারি একটার ঠিক পরে একজন সুসজ্জিতা মহিলা নাইটব্রিজের এজেন্ট মেসার্স বাটলার অ্যান্ড পার্কের অফিসে এসে প্রবেশ করেন। ভদ্রমহিলার কথায় বিদেশিনীর টান ছিল, তিনি জানান, লন্ডনের কাছাকাছি টেমস নদীর ধারে একটা বাড়ি ভাড়া কিংবা কিনতে চান। মিল হাউস সহ আরও কয়েকটি বাড়ির বিবরণ তাঁকে দেওয়া হয়। ব্রিজের মিসেস দ্য কাসটিনার ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঐ ঠিকনায় সেই নামে কোনো মহিলার অস্তিত্ব নেই, এবং হোটেলের লোকেরা তাঁকে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। 

স্যার ইউস্টেস পেডলারের মালীর স্ত্রী মিসেস জেমস, মিল হাউসের কেয়ারটেকার। মেন রোডের একটা ছোটখাটো লজে থাকত। তার জবানবন্দী এইরকম : 

প্রায় তিনটে নাগাদ ঘটনার দিন একজন মহিলা বাড়ি দেখতে হাউস এজেন্টের চিঠি নিয়ে আসেন। মিসেস জেমস তাঁকে সেই বাড়ির চাবি দেয়। বাড়িটা ছিল লজ থেকে সামান্য একটু দূরে। ভালো ভাড়াটে হলে সাধারণত তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি দেখাতে যায় না সে। বিশ্বাস করে তাঁর হাতে চাবি তুলে দেয়, এক্ষেত্রে তাই করে। কয়েক মিনিট পরে একটি যুবক, লম্বাটে চেহারা, চওড়া কাঁধ, তামাটে রঙের চোখ, সদা দাড়ি গোঁফ কামানো মুখ, পরনে বাদামী রঙের পোষাক, সে এসে মিসেস জেমসের কাছে নিজেকে সেই মহিলার বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। তারা দু’জনে একসঙ্গে বাড়ি দেখতে আসে সেখানে। কিন্তু মাঝপথে একটা পোস্ট আফিসে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। ভদ্রমহিলা তাকে সেখানে আসতে বলে। মিসেস জেমস তাই সে ব্যাপারে তখন মাথা ঘামায়নি। 

সেই যুবকটির পাঁচ মিনিট পরে পুনরাবির্ভাব ঘটে। মিসেস জেমসকে চাবিটা ফেরত দিয়ে জানায় যে বাড়িটা তাদের উপযুক্ত হবে না। মেয়েটিকে না দেখে মিসেস জেমস ভাবল হয়তো এগিয়ে গিয়ে থাকবে। মিসেস জেমস এও লক্ষ্য করেন, যুবকটিকে তখন অত্যন্ত বিচলিত দেখাচ্ছিল। যেন সে ভূত দেখেছে। ভাবলাম হয়তো সে অসুস্থ। 

পরদিন আর-একজন মহিলা ও একজন ভদ্রলোক বাড়ি দেখার জন্য এসে আবিষ্কার করলেন, দোতলার একটি ঘরে মেয়েটির দেহ মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মিসেস জেমস মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারল এই মেয়েটির আগের দিন বাড়ি দেখতে এসেছিল। এমনকি হাউস এজেন্টও তাকে চিনতে পারল। হ্যাঁ, এই মহিলার নামই মিসেস দ্য কাসটিনা। পুলিস সার্জেন্ট পরীক্ষা করে দেখল চব্বিশ ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ‘ডেলি বাজেট’ পত্রিকা মন্তব্য করল, টিউব স্টেশনের লোকটাই হয়তো প্রথমে হত্যা করে এবং পরে সে আত্মহত্যা করে। কিন্তু টিউবের সেই হতভাগ্য লোকটি বেলা দুটোর সময়ে মারা যায়। আর সেই মহিলাটি বেলা তিনটে পর্যন্ত জীবিত ছিল তো বটেই। অতএব দুটি মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। অবশ্য লোকটির পকেটে বাড়ি দেখার জন্য হাউস এজেন্টের যে চিঠি পাওয়া যায় সেটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। এরকম ক্ষেত্রে যা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। 

এর আগে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড হয়। জুরিরা তখন মতামত দিয়েছিলেন, এইসব হত্যাকাণ্ডের পিছনে একাধিক যোগসাজশ থাকতে পারে। এই দুটি আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জুরিদের সেই পুরোনো সন্দেহটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পুলিস (এবং ‘ডেলি বাজেট’) এবার ‘বাদামী পোষাকের সেই লোকটির সন্ধান করার জন্য তৎপর হল। মিসেস জেমসের বিশ্বাস যে, দুর্ঘটনার সময়ে সেই বাড়িতে সেই যুবকটি ছাড়া অন্য কেউ ছিল না, অতএব সেই একমাত্র হত্যাকারী না হয়ে যেতে পারে না, মিসেস দ্য কাসটিনার গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়, মনে হয় অতর্কিতে হত্যা করা হয়, তাই চিৎকার করার সুযোগই পাননি। ভদ্রমহিলার ব্যাগে একটা নোটবই, কিছু মুদ্রা, একটা রুমাল এবং লন্ডনে ফেরার প্রথম শ্রেণীর রেল টিকিট পাওয়া যায়। জিনিসগুলো থেকে খুন হওয়ার কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। 

জনসাধারণের প্রতি ‘ডেলি বাজেটের’ আবেদন, বাদামী পোষাকের সেই লোকটিকে খুঁজে বার করুন। যুদ্ধকালীন ঘোষণার মতো প্রতিক্রিয়া সবার মনে দেখা দেয়। প্রতিদিন প্রায় পাঁচশো লোক চিঠি লিখে জানাতে থাকে। তারা সফল হয়েছে। লম্বাটে চেহারার সেই আততায়ী প্রতিদিনই নাকি এই শহরে তাদের চোখে পড়ে কিন্তু পাঁকাল মাছের মতো ফসকে পালিয়ে যায় সে। টিউবের সেই দুর্ঘটনার ব্যাপারে মিসেস দ্য কাসটিনার খুন হওয়ার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা এখন জনসাধারণের মন থেকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে চলেছে। 

এ দুটো খুনের মধ্যে কি মিল আছে? আমি ঠিক নিশ্চিত নই তবু মনে হয় এই দুটি খুনের মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। দুটি ক্ষেত্রেই সেই একই লোকের আবির্ভাব ঘটতে দেখা যায়। সেই তামাটে মুখ, সেই চোখ, এর ফলে আমার বিবেক তখন তাড়া করে ফিরছিল যেন, একটা ব্যবস্থা নিতে হবে, এভাবে চুপ করে বসে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়ে আমি জানতে চাইলাম, মিল হাউস কেসের ভার কার ওপর দেওয়া হয়েছে। 

ভুল করে আমি ছাতা হারানোর বিভাগে প্রশ্নটা করেছিলাম। যাই হোক ঘটনাক্রমে আমাকে একটা ছোট ঘরে গোয়েন্দা ইনসপেক্টর মিডোজের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

ইনসপেক্টর মিডোজ ছোটখাটো চেহারার মানুষ। খিটখিটে মেজাজ। তিনি সাদা পোষাকে ঘরের এক কোণায় বসেছিলেন। 

ভয়ে ভয়ে কোনোরকমে বললাম, সুপ্রভাত। 

—সুপ্রভাত, দয়া করে ঐ চেয়ারটায় বসুন। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাদের প্রয়োজনীয় কোনো গোপন সংবাদ আপনি দিতে এসেছেন। 

লোকটার সবজান্তা ভাব আমার পছন্দ না হওয়ায়, বিরক্তিভরে বললাম, নিশ্চয়ই। টিউবে যে লোকটা খুন হয়েছিল সে কে আপনি জানেন? যে লোকটার পকেট থেকে মার্লোর একই বাড়ি দেখার জন্য হাউস এজেন্টের চিঠি পাওয়া গেছে। 

—আঃ! ইনসপেক্টরের কথায় উষ্মা ঝরে পড়ে আপনি তো মিস বেডিংফিল্ড, তদন্তের সময় জবানবন্দী দিয়েছিলেন না? লোকটার পকেটে মার্লোর সেই বাড়ি দেখার জন্য এজেন্টের চিঠি অবশ্যই ছিল। এরকম চিঠি তো অনেক লোকেরই পকেটে থাকে। তফাত হচ্ছে তারা এই লোকটার মতো খুন হয়নি। 

বলতে বাধ্য হলাম, লোকটার পকেটে যে রেল ভ্রমণের কোনো টিকিট ছিল না, সেটা কি অদ্ভুত মনে হয়নি? 

টিকিট ফেলে দেওয়াটা যাত্রীদের একটা স্বভাবজাত ধর্ম, আমিও সেরকম করে থাকি। প্রসঙ্গ বদল করে বললাম, কিন্তু সেই ডাক্তার ভদ্রলোক পরে আপনাদের সামনে কেন হাজির হলেন না, একথা কি ভেবেছেন? 

—ব্যস্ত চিকিৎসকরা খবরের কাগজ পড়ার খুব কম সময়ই পেয়ে থাকে। সম্ভবত সেই দুর্ঘটনার কথা তিনি ভুলেই গেছেন। 

এবার শান্ত গলায় বললাম, সত্যি কথা বলতে কি ইনসপেক্টর আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার চোখে কোনো অস্বাভাবিক কিছুই ধরা পড়েনি। 

—হ্যাঁ, মিস বেডিংফিল্ড, আপনি যুবতী, এই বয়সে মেয়েরা একটু বেশি রোমান্টিক ও ভাবপ্রবণ হয়ে থাকে। তারা সবকিছুতেই রহস্যের গন্ধ পায়। এসব কথা ভাববার তাদের অফুরন্ত সময় কিন্তু আমি একজন ব্যস্ত মানুষ- 

কেউ যদি না বোঝার ভান করে আমি কি করতে পারি? বলে আমি উঠে দাঁড়াতেই, ঘরের এককোণ থেকে কে যেন বলল, ইনসপেক্টর, মেয়েটি এ ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতার কথা বললেও বলতে পারে। 

ইনসপেক্টর যেন উৎসাহ পেলেন, হ্যাঁ, মিস বেডিংফিল্ড, কিছু মনে করবেন না। বলুন কেন আপনার একথা মনে হল? 

আমাকে আহত দেখে ইনসপেক্টর আবার প্রশ্ন করলেন, সেদিন আপনি আপনার জবানবন্দীতে বলেছিলেন, লোকটা যে আত্মহত্যা করেনি, এ ব্যাপারে আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। 

—হ্যাঁ, কারণ লোকটা তখন অসম্ভব ভয় পেয়েছিল। কিসের ভয়? কার ভয়? অবশ্য আমি তার ভয়ের কারণ ছিলাম না। মনে হয়, কেউ তখন প্ল্যাটফর্মে আমাদের দিকে হয়তো আসছিল – আর সে তার পরিচিত ছিল। 

—কেন, আপনি কাউকে দেখতে পাননি? 

না, আমি তখন পিছন ফিরে তাকাইনি। তারপর রেললাইন থেকে লোকটার দেহটা তোলামাত্ৰ একজন লোক আমাকে একরকম ধাক্কা দিয়ে মৃত লোকটার কাছে যায়, সে নিজেকে একজন চিকিৎসক বলে পরিচয় দেয়। 

—সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

কিন্তু লোকটা আদৌ চিকিৎসক ছিল না। 

ইনসপেক্টর অবাক হয়ে বলেন, কী বললেন লোকটা চিকিৎসক ছিল না? তা সে কথা আপনি কী করে জানলেন? 

—সঠিক বলা মুস্কিল, তবে যুদ্ধের সময় কিছুদিন আমি হাসপাতালে কাজ করার সময় নানান রুগীদের পরীক্ষা করতে দেখেছি বহু চিকিৎসককে। তাদের মধ্যে সত্যিকারের ডাক্তারিসুলভ মনোভাব ছিল যা এই লোকটার মধ্যে ছিল না। তাছাড়া লোকটা যে চিকিৎসক নয় তার প্রমাণ আমি দেখেছি। কোনো চিকিৎসক আনাড়ির মতো কোনো রুগীর হার্ট কেমন চলছে দেখার জন্য তার ডানদিকে পরীক্ষা করে না। 

—কেন, সে কি তাই করেছিল না কি? 

—হ্যাঁ, তাই করেছিল। বাড়ি ফিরে যতই এসব কথা ভেবেছি, ততই আমার মনে হয়েছে, কোথায় যেন একটা মস্ত গলদ রয়ে গেছে। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। 

লোকটাকে মৃতদেহের ওপরের অংশ হাত বোলাতে দেখে মনে হয়েছে সে যা চাইছিল সেটা হস্তগত করার সুযোগ সে পেয়ে গেছে। 

—হুম! সেরকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। বলে ইনসপেক্টর কাগজ কলম নিয়ে বলেন, সে যাইহোক, লোকটা দেখতে কেমন ছিল, মানে চেহারা কেমন ছিল বলতে পারেন? লম্বাটে চেহারা, চওড়া কাঁধ, পরনে ছিল ঘন কালো ওভারকোট, পায়ে কালো বুট, মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়ের টুপি। মুখে সূক্ষ্ম করে ছাঁটা দাড়ি, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। 

ইনসপেক্টর মন্তব্য করলেন, গায়ের ওভারকোট, মুখের দাড়ি, চশমা সরিয়ে দিলে লোকটাকে আর চেনা যাবে না। 

—এর বেশি আপনি আর কিছু বলতে পারবেন? 

—হ্যাঁ, বলতে পারি। এবার আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। তার মাথাটা ছিল বানরের মাথার মতো, যা সে শত চেষ্টাতেও বদল করতে পারবে না। 

ইনসপেক্টর মিডোজকে লিখতে দেখে খুশি হলাম।