দ্বিতীয় অধ্যায়
খ্রিস্টানদের পরবের দিন
২.১
আজ সকাল থেকেই লুসিলা ড্রেককে একটু মেজাজি মনে হচ্ছিল। এই বিশেষ দিনটিতে তার অনেক কাজ। কোন ব্যাপারে আগে মাথা গলাবেন সেটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সবচেয়ে জরুরী যে কাজ তার কাছে বিশেষ মনে হলো সেটা হচ্ছে আইরিসের ভালমন্দের প্রতি নজর রাখা।
প্রিয় আইরিস, তোমায় দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তোমার কতদিন যেন ঘুম হয়নি। তোমার এখন দরকার ইটনের সিরাপ। ছোটবেলায় আমাকেও ঐ টনিক খেতে দেওয়া হতো। আর শাক খাওয়া জরুরী। রাঁধুনিকে বলে দেবো, আজ দুপুরে খাওয়ার সময় যেন শাক ভাজা পরিবেশন করে।
মিসেস ড্রেকের যত্নের ঠেলায় আইরিস ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তার কিছু ভালো লাগছিল না। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ না করে দৃঢ় কণ্ঠে বললো–লুসিলা পিসি, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
–কিন্তু মা, তোমার চোখের কোলে কালি পড়েছে। স্নেহার্দ্র কণ্ঠে মিসেস ড্রেক বললেন, তোমার বয়সের মেয়ের পক্ষে অতিরিক্ত টেনিস খেলা সহ্য হবে কেন? মনে হয়, এখানকার জল হাওয়া তোমার পক্ষে উপযুক্ত নয়। জর্জ যদি ঐ মেয়েটার সঙ্গে পরামর্শ না করে–
–কোন মেয়েটা?
—ঐ যে মিস লেসিং, যাকে নিয়ে জর্জের ভীষণ চিন্তা। মেয়েটিকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। অফিসে তুমি যা খুশী করো তাই বলে বাইরে। এ ভাবা যায় না। আমাদের পরিবারের একজন ভাবতে দেওয়াটা মস্ত বড় ভুল।
-তুমি বোধ হয় জানো না, ও সত্যি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে।
–সে তাই ভাবে নাকি? মিসেস ড্রেক জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। এর থেকেই তার মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। জর্জের জন্য দুঃখ হয়। আইরিস, জর্জকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। মিস লেসিং সুন্দরী হতে পারে, তাই বলে জর্জ ওকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারে না।
আইরিস মিসেস ড্রেকের কথা শুনে থ হয়ে গেল।
–রুথকে জর্জ বিয়ে করবে এ তো আমার কল্পনার বাইরে।
-তুমি কি কিছু দেখতে পাও না বাছা। তোমার চোখের সামনে সব কিছু ঘটে যাচ্ছে। অবশ্য তোমার তো আমার মতো অভিজ্ঞতা নেই। তুমি জানো না, আইরিস, মেয়েটা জর্জকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আইরিস হেসে বলে–তাহলে তো ভালোই হবে। রুথের ব্যাপারে তুমি যা বললে আমার মনে হয় সেটা ঠিকই। জর্জ ওর খুব প্রিয়। তাছাড়া রুথ হবে ওর আদর্শ স্ত্রী।
-ভালো খাবার এবং এবং তার ভালো মন্দের দেখার ভার নিতে পারে এমন একটি মেয়ের কথা তুমি বলছো তো? সেক্ষেত্রে তোমার মতো আকর্ষণীয় এক যুবতীই তার পক্ষে উপযুক্ত। তুমি বাড়ির বাইরে ভেতরে দুদিক দেখতে পারবে। তার জন্য জর্জকে তো ঐ মেয়েটাকে প্রয়োজন নেই।
আইরিস মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। তর্ক করলো না। রুথের কথা সে তখন ভাবছিল। রুথ দেখতে শুনতে ভালো। অফিসের কাজে উপযুক্ত। গৃহস্থলি কাজেও সে যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না এটা বিশ্বাস হয় না আইরিসের। লুসিমা পিসি কেবল ঘর গৃহস্থলির কথাই ভাবতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে একটা ভালোবাসা, রোমান্স আছে সেটা যেন তিনি বুঝতে চান না।
কে জানে তার পিসেমশাই লুসিলা পিসিকে বিয়ে করার সময় এই দিকটা ভেবেছিলেন কি না।
লুসিলার বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি, তখন তার স্বামী রেভারেন্ড ক্যালেব ড্রেকের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। মাত্র দুবছর পিসি তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন। একটি পুত্রসন্তান কোলে নিয়ে তিনি বিধবা হন। পরবর্তীকালে ঐ পুত্র ভিক্টর ড্রেক হয়ে ওঠে তার প্রধান চিন্তা এবং দুঃখের কারণ। ক্রমাগত চাপ দিয়ে তার ছেলে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। কিন্তু মহিলা কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। বরঞ্চ তার ছেলের নামে কেউ অভিযোগ করলে বা অপবাদ দিলে তিনি ভীষণ রেগে যেতেন। কিছুতেই মেনে নিতেন না। এ ছিলো তার অন্ধ স্নেহের দুর্বলতা। ভিক্টর ছিলো অতি বিশ্বাসী। সেই সুযোগ নিয়ে অনেকে তাকে ঠকিয়েছে, তাকে প্রতারিত করেছে। তার বন্ধুরা তার প্রতি তার মায়ের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে অনেক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিতো।
ঠিক এমনি সময়ে আইরিসকে দেখাশোনার জন্য জর্জ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। কারণ তখন লুসিলা পিসি আর্থিক দিক থেকে খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। তার পর থেকে একটি বছর এখানে তার সুখেই কেটেছে। বয়স্কা নারী হিসাবে সংসারে সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ছিলো। যদি সেই কর্তৃত্ব তার থেকে কম বয়সের মেয়ে এ বাড়িতে এসে কেড়ে নেয় তার হাত থেকে তাহলে তো রুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু লুসিলা পিসি বোঝেন না, রুথ কেন জর্জকে বিয়ে করতে চায়। রুথ হলো অর্থলোভী। তার ওপর জর্জের মতো অনুগত স্বামী পাবে। আসলে রুথ লেসিং বুদ্ধিমতী। সে আগে থেকে ঘরদোর সাজিয়ে গুছিয়ে জর্জকে বোঝাতে চেয়েছিল যে জর্জের পরিবারে সে কত অপরিহার্য। কিন্তু এ সংসারে একজনের কাছে রুথের চাওয়াটা ধরা পড়ে গেছে।
একদিন একটা কম্বল হাতে নিয়ে লুসিলা পিসি আইরিসের সামনে এসে দাঁড়লেন–আমার হয়েছে এক জ্বালা। আগামী বসন্তের আগে আবার এখানে ফিরে আসবে কিনা সেটা স্পষ্ট ভাবে জানালো না। সেই মতো ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে হবে। নতুবা পোকায় কেটে দেবে।
–আমার মনে হয় তিনি নিজেই জানেন না। আইরিস বললো, ভালোই হলো, আমরা যদি কখনো সখনো এখানে অসি! আমরা আসতে চাইলে বা না চাইলেও তবু এ বাড়িটা এখানে থাকবেই।
-হ্যাঁ, বাছা, সঠিক খবরটা জানতে হবে। সেই মতো ন্যাপথালিন দিয়ে রাখতে হবে। ন্যাপথলিনের গন্ধটা বাপু আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
বেশ তো ন্যাপথলিন দিয়ো না।
–যা গরম পড়েছে পোকামাকড়ের উৎপাত হবেই। আর আছে ভীমরুল। গতকাল হকিনস বলছিল।
হকিনস?
আইরিসের মন ছুটে চলে গেল অতীতে। অন্ধকারে সগর্বে পা ফেলতে ফেলতে, হাতের মুঠোর মধ্যেই সায়ানাইড, রোজমেরি–সায়ানাইড, কেন এইসব ভাবনা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে জড়ো হয়?
লুসিলা পিসি তখনো বলে চলেছন, গয়নাগুলো কাউকে দিয়ে ব্যাঙ্কে পাঠাবে? লেডি আলেকজান্ডার সেদিন বলেছিলেন আজকাল নাকি চুরি ছিনতাই খুব বেড়ে গেছে। তার মুখ কি কঠিন মনে হলো! হয়তো অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। আমরা সবাই এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছি। জর্জের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারি না। মনে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হবে। আবার ব্যাবসার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। মাঝে মাঝে আমার দিকে যখন তাকায়, মনে হয় ওর মনে কিছু আছে।
আইরিসের শরীরটা কেঁপে উঠতে দেখে মিসেস ড্রেক সোল্লাসে জোরে বলে উঠেন– নিশ্চয়ই তোমার ঠান্ডা লেগেছে, আইরিস।
.
২.২
–তারা এখানে যেন না আসে একথা আমি কি করে ভাবতে পারি।
কথাগুলো অস্বাভাবিক তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারিত হলো সান্দ্রা ফ্যারাডের মুখ থেকে। তার স্বামী চকিতে তার দিকে ফিরে তাকালো। সান্দ্রা তো তার মনের কথাগুলোই উচ্চারণ করলো। তাহলে কি সান্দ্রার ভাবনার সঙ্গে তার ভাবনার মিল আছে? তাহলে ও-ও কি অনুভব করছে, পার্কের ওধারে মাইনখানেক দূরে নবাগত প্রতিবেশীদের আগমনে তাদের ফেয়ারহেভেনের সুখ শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে।
আবেগপূর্ণ কণ্ঠে স্টিফেন ফ্যারাডে বলে–ওদের সম্বন্ধে তোমারও যে ঐ ধারণা আমি জানতাম না।
–এখানে লন্ডনের মতো প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না। এখানে কেউ রুক্ষ স্বভাবের কেউবা বন্ধুভাবাপন্ন।
-না, লন্ডনের মতো কেউ আজকাল করতে পারে না। স্টিফেন বলে।
এই বিশিষ্ট অতিথিদের কাছে আমরা এখন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তারা দুজনে নীরবে সেই নৈশভোজের দৃশ্যটা চোখের আয়নায় দেখছিল। জর্জ বারটন ছিলেন উচ্ছ্বাসে ভরপুর, কথা-ব্যবহার বন্ধুত্বসুলভ আচরণ ছিল তার মধ্যে। কিন্তু ফ্যারাডে পরিবার তার মধ্যে সবসময় একটা চাপা উত্তেজনা দেখতে পায়। যেটা তাদের সর্বদাই ভীত করে রেখেছে। রোজমেরির মৃত্যুর পর থেকে জর্জকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। আগে জর্জ ছিলেন বোকা গোবেচারা গোছের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর বয়স্ক স্বামীর যেরকম অবস্থা হয় ঠিক সেইরকম। স্টিফেনের সেইসময় একবারও সন্দেহ হয়নি, জর্জ বারটন তার স্ত্রী রোজমেরির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন এবং বলা যেতে পারে জর্জের মতো স্বামীরদের জন্ম হয় বারবার প্রতারিত হওয়ার জন্য। স্ত্রীর থেকে তার বয়সের ফারাক ছিল যথেষ্ট, ঐ কারণে বা অন্য কোনো কারণে হোক খেয়ালী সুন্দরী যুবতীর মনোরঞ্জন করার মতো শক্তি তার ছিলো না। তাহলে কি জর্জ বারটন প্রতারিত? স্টিফেনের তা মনে হলো না। জর্জ রোজমেরিকে ভালোবাসতেন, তিনি তার ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন, স্ত্রীর স্বার্থই তিনি বেশি করে দেখতেন।
রোজমেরির মৃত্যুতে জর্জের মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে স্টিফেন।
রোজমেরির মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে জর্জের খুব একটা দেখা হয়নি। তারপর হঠাৎ একদিন লিটল প্রায়রসে তাদের প্রতিবেশী হয়ে এলেন জর্জ।
আজ যেন জর্জকে বেশ বিচিত্র মনে হলো। হঠাৎ তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন। অষ্টাদশী আইরিসের জন্মদিনের পার্টি। সেই পার্টিতে জর্জ তাদের কামনা করেন।
অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও সান্দ্রা এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলো।
নিশ্চয়ই যাবো, খুব আনন্দ হবে।
–তাহলে দিনটা ঠিক করে নেওয়া যাক।
উজ্জ্বল হাসিতে জর্জের মুখ ভরে গেল।
–ভাবছিলাম, আগামী সপ্তাহের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ দোসরা নভেম্বর আপনাদের ঐদিন কোনো কাজ নেই তো? তা না হলে অন্য কোনোদিন ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
স্টিফেন আইরিস মারলের দিকে তাকালো। ওর মুখ কেমন লাল হয়ে উঠেছে। একটা অস্বস্তিবোধ ধরা পড়লো স্টিফেনের চোখে।
কিন্তু সান্দ্রার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। ঐ দিনই উপযুক্ত বলে তার বিবেচনা করে জানালো।
কিন্তু স্টিফেন তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলো–আমাদের যাওয়ার দরকার নেই।
সান্দ্রা তার দিকে ঘুরে তাকালো। সান্দ্রার চোখে প্রশ্ন লক্ষ্য করে স্টিফেন বলেনা যাওয়ার অজুহাত দেখানোটা কি খুব সহজ হবে?
-খুব হবে, বড় জোর অন্য আর একদিন যাওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করবেন। মনে হয় আমাদের যাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী।
–এটা আমার মাথায় ঢুকছে না যে ওঁর অত আগ্রহ কেন? তাছাড়া আইরিসের জন্মদিনের পার্টি। অথচ আমাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য আইরিস যে খুব বেশি আগ্রহী তা তত মনে হয় না।
-না, তা মনে হয় না। আচ্ছা তুমি কি জানো, পার্টিটা ওঁরা কোথায় দিচ্ছেন?
–লুক্সেমবার্গে।
কথাটা শোনামাত্রই স্টিফেনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোলো না। নিজেকে সে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সেই মুহূর্তে সান্দ্রার চোখে তার চোখ পড়লো।
–ভদ্রলোক নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছেন। মনের অভিব্যক্তি চাপা রেখেই স্টিফেন জোরে কথা বলে উঠলো। লুক্সেমবার্গ। সেই পুরোনো স্মৃতি ঘেঁটে আর কি হবে?
সান্দ্রা স্বামীর কথায় সায় দিলো।
–তাহলে আমরা নিশ্চয়ই এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করবো। সমস্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত অপ্রীতিকর। এক্ষেত্রে আমাদের রাজী হওয়া সম্ভব নয়।
-স্টিফেন, এ ব্যাপারে তিনি আমাকে একটা কারণ অবশ্য দেখিয়েছেন। সান্দ্রা বলে। নৈশভোজের পর তিনি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে এই আমন্ত্রণের ব্যাখ্যা করে বলেন, আইরিস তার দিদির মৃত্যুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেনি।
-হ্যাঁ, নৈশভোজের পর আইরিসকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল বটে।
–জর্জ বারটন আরো বলেছিলেন যে তার দিদির মৃত্যুর পর থেকে আইরিস লুক্সেমবার্গে যাওয়ার কথা হলে এড়িয়ে যায়।
তার কথা শুনে আমার মনে হয়, উনি কোনো নার্ভ স্পেশালিস্টের সঙ্গে আইরিসের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। আজকালের আধুনিক চিকিৎসকদের চিকিৎসার ওষুধ হলো যদি কোনো লোক অপ্রীতিকর ব্যাপারে মানসিক আঘাত পায় তাহলে তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য ঠিক সেইরকম অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে দেওয়া উচিত। এড়িয়ে যাওয়া নয়।
–সেই স্পেশালিস্ট কি আর একটি আত্মহত্যার পরামর্শ দিয়েছেন?
-না, তবে মিঃ বারটনের মতে, লুক্সেমবার্গে আবার সেই জমায়েতের ব্যবস্থা করলে আইরিস হয়তো কিছুটা স্বাভাবিকত্ব লাভ করবে। জর্জ চান, এক বছর আগে ঐ আসরে যারা এসেছিলেন তারা প্রত্যেকে যেন দোসরা নভেম্বর আসেন।
–আমার মনে হয়, এটা একটা জঘন্য চক্রান্ত। স্টিফেন বললো, অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিছু বলতে চাই না। সত্যি কথা বলতে কি আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। তুমি যদি কিছু না মনে করো
কথার মাঝখানে সান্দ্রা বলে উঠলো–আমি মনে করি এবং খুব ভালোভাবে মনে করি। কিন্তু মিঃ বারটনের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেদিনের সেই ঘটনার পর আমরা লুক্সেমবার্গে অনেকবার গিয়েছি।
–ঠিকই বলেছো, প্রত্যাখ্যান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া এখন অস্বীকার করলে পরে আবার এই আমন্ত্রণ পুনরাবৃত্তি হতে পারে। বেশ ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি কেন এটা সহ্য করতে যাবে। আমি একাই যাবো। গিয়ে বলবো
–না স্টিফেন, তুমি গেলে আমিও যাবো। সান্দ্রা তার নরম হাতটি স্বামীর হাতের ওপর রাখলো। আইনত আমরা স্বামী-স্ত্রী। পরস্পর পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা ভাগ করে নেওয়া হলো স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য।
সান্দ্রার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো স্টিফেন। কিন্তু সান্দ্রার কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগ আছে। তাই সে বললো-তুমি ওকথা বলছো কেন, তুমি জানো না, তোমায় পেলে আমি যেন পৃথিবীটা হাতের মধ্যে পেয়ে যাই।
স্টিফেনের দুহাতের মধ্যে আবদ্ধ সান্দ্রার কাঁপা কাঁপা দেহ। বুকের আরো কাছে টেনে নেয় স্টিফেন। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তার লাল ঠোঁট।
সান্দ্রা, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি প্রিয়তমা। কিন্তু তোমাকে হারাবার ভয় আমার ভীষণ!
-কেন, রোজমেরির জন্য।
স্টিফেন বিবর্ণ মুখে বলে-হা, তুমি রোজমেরির ব্যাপারটা জানো?
–সবটাই জানি। প্রথম থেকে।
–কি মনে হয়েছে?
–আমার কিছুই মনে হয়নি। কিছু বুঝিওনি। জানি না কখনো বুঝতে পারবো কিনা। তুমি তাকে ভালোবাসবে।
-না, আমি তোমাকেই শুধু ভালোবাসি।
অদ্ভুত তিক্ততায় ভরে গেল সান্দ্রার অন্তর। তুমি মিথ্যে বলল না। সেই প্রথম দেখার দিন থেকে তুমি আমায় এ ব্যাপারে মিথ্যে বলে এসেছে।
স্টিফেন কিন্তু একটুও না ঘাবড়ে সান্দ্রার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর অকপটে স্বীকার করলো এমন সন্দেহজনক পরিস্থিতিতেও আমি বলবো, ওটা মিথ্যে নয়। সান্দ্রা দয়া করে তুমি বোঝার চেষ্টা করো। ক্ষমতার লোভে সব মানুষই একসময় অন্ধ হয়ে যায়, সেটা আমি স্বীকার করছি। ক্ষমতার শিখরে উঠে তখন আর মানুষের নিচের দিকে তাকানোর অবসর থাকে না। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে সময় সময় কঠিন হতে হয়, হয়তো কঠিনতার মুখোসের আড়ালে নিজেকে সে ঢেকে রাখতে চায়। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি এটুকু বলতে পারি, তোমার মতো মেয়েকেই আমি সেই ছোটবেলা থেকে খুঁজেছি। আমি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করি, অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমার মনে হয়, যদি সেটা সত্যি না হতো তাহলে সেই পথ দিয়ে আমি এতটা পথ উঠে আসতে পারতাম না, কিছুতেই না।
–আমাকে তুমি ভালোবাসোনি।
সান্দ্রার মনে তখনও তিক্ততা।
-না, প্রথমে আমি তোমার প্রেমে পড়িনি। আমি তখন সেই পুরুষ যে নিজের গর্বেই গর্ব অনুভব করে। তারপর একদিন ঘরের গণ্ডি পেরোতেই আমার দণ্ডশীল যুবকের লজ্জাকর সেই প্রেম আমায় ঘিরে ধরে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নিমেষের প্রেম।
তারপর এই ফেয়ারহেভেনে আমার সত্যিকারের জাগরণ হলো। উপলব্ধি করলাম আমার জীবনের যা কিছু সত্যি তা হলো তুমি, তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়া, আর সব মিথ্যে।
-তুমি তাকে নিয়ে পালাবার কথা ভেবেছিলে না?
–রোজমেরির সঙ্গে, তাহলে সেটা অবশ্যই আমার জীবনে সান্দ্রার কারাদণ্ডের সামিল হতো।
–কেন তিনি চাননি, তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে?
চেয়েছিলেন।
–তাহলে কি হলো।
স্টিফেন বলে, তারপর লুক্সেমবার্গের সেই বেদানায়ক ঘটনা সব এলোমেলো করে দেয়।
তারপরের কথা না বললেও চলবে। সায়ানাইড বিষে নীল হয়ে গেছে রোজমেরির সুন্দর মুখ। তার চোখ দুটি তখনো জ্বলজ্বল করছিল। সে চোখে অনেক জিজ্ঞাসা অনেক প্রত্যাশা।
একটু থেমে স্টিফেন প্রশ্ন করলো, তাহলে আমাদের কি করা উচিত?
চলো, সেই পার্টিতে অংশ নেওয়া যাক, তার অন্তরালে যে কারণই থাক না কেন।
–জর্জ বারটন আইরিস সম্বন্ধে যা বলে গেলেন তা কি ঠিক? তোমার কি ধারণা?
–জানি না স্টিকেন, তবে আমার মনে হয় তিনি জানেন।
–কি জানেন? প্রশ্ন করে স্টিফেন।
ফিসফিস করে উঠলো সান্দ্রা।
–আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়। সাহস সঞ্চয় করা দরকার। তুমি একজন বিরাট প্রতিভাবান পুরুষ হতে চলেছে। মানুষ যেমন চায়। তার জন্য কোনো কিছু বাধা হতে পারে না। স্টিফেন, আমি তোমার স্ত্রী, তোমায় আমি ভালোবাসি।
-ঐ পার্টির ব্যাপারে তোমার কি ধারণা, সান্দ্রা?
-ওটা একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছেন জর্জ বারটন। তবে আমরা যে ঐ ফাঁদের কথা জেনে গেছি–সেটা আমরা বুঝতে দেবো না।
-না, তা অবশ্য ঠিক।
সহসা সান্দ্রা হেসে ওঠে।
–তুমি জিততে পারো না, স্টিফেন। তোমার রোজমেরিই হবে তোমার সর্বনাশের মূল কারণ। স্টিফেন দুহাত দিয়ে সান্দ্রার কাধ আঁকড়ে ধরে।
সান্দ্রা দয়া করে থামো। তাছাড়া রোজমেরি মৃত।
–তিনি কি সত্যিই মারা গেছেন? সান্দ্রার কখনো কখনো মনে হয়, রোজমেরি বেঁচে আছেন।
.
২.৩
পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন জর্জ বারটন, সঙ্গে আইরিস। কিছুটা হাঁটার পর আইরিস বললো–জর্জ, কিছু মনে করো না। আমি একটু একা ঘুরতে চাই। মাথাটা ভীষণ ধরেছে।
-বেশ, আমি ফিরে যাচ্ছি।
জর্জকে বিদায় জানিয়ে আইরিস যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলল। অক্টোবরের শেষের দিক কিন্তু শীত ভালো পড়েনি।
একটা ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছের ওপর বসে আইরিস নিচে উপত্যকার দিকে তাকালো। গালে হাত দিয়ে বিষণ্ণ নেত্রে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলো। হঠাৎ পাতার খসখস শব্দ। সে পেছন ফিরে তাকালো। গাছের ডালপালা সরিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন তার দিকে উঠে আসছে।
প্রায় রেগে গিয়ে আইরিস চিৎকার করে বললো–তুমি সবসময় চোরের মতো চুপি চুপি আসো কেন টমি?
এ্যানথনি ওর পাশে মাটির ওপর বসে একটা সিগারেট ধরালো। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললো আমার স্বভাব যেখানে সেখানে আবির্ভাব হওয়া। কাগজগুলো আমাকে রহস্যজনক মানুষ বলে ডাকে।
–বেশ বুঝলাম, কিন্তু তুমি কি করে জানলে, আমি এখানে আছি?
-তোমাকে পাহাড়ের ধারে আসতে দেখে আমি চুপি চুপি তোমার পেছন ধরি। কেন, এখানে এসে কোনো অন্যায় করেছি?
-অবশ্যই নয়। আইরিস একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, টমি, আমি এখানে থেকে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাটা আমার একদম পছন্দ হয় না। আমি লন্ডনে ফিরে যেতে চাই।
–তোমরা কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে যাচ্ছো, তাই না?
–হ্যাঁ, আগামী সপ্তাহে।
–তাহলে ফ্যারাডেদের সঙ্গে এখানে এটাই শেষ বিদায়ের পার্টি।
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা, ফ্যারাডেদের তুমি পছন্দ কর?
-আমার মনে হয় না খুব একটা পছন্দ হয়। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করা যায় না। কারণ তারা আমাদের সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেন।
–আচ্ছা আইরিস, তোমার কি মনে হয় ওঁরা তোমায় পছন্দ করে?
-মনে হয় পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে তারা আমাকে পছন্দ করেন। আসলে তারা ছিলেন রোজমেরির বন্ধু। বন্ধু বলতে যা বোঝায় আমরা তেমন ছিলাম না।
-ঠিক বলেছো তুমি। তবে আর একটা কথা, সান্দ্রা ফ্যারাডে আর রোজমেরির মধ্যে বন্ধুভাবাপন্ন অন্তরঙ্গতা ঠিক ছিল না।
একবার সিগারেট টান দিয়ে এ্যানথনি বললো–জানো, ফ্যারাডেদের সম্পর্কে আমার কি ধারণা?
কি?
–তারা যেন তোমাদের কাছে একটি অভিন্ন ফ্যারাডে পরিবার। তারা একই উদ্দেশ্য, একই মনোভাব, একই লক্ষ্য নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এগুলো হলো তাদের বাইরের খোলস। আসলে তাদের দুজনের মনের দিক থেকে চরিত্রের দিক থেকে অনেক তফাৎ রয়েছে, এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। আমার মতে স্টিফেন ফ্যারাডে হলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অন্যের মতামতের ওপর সহানুভূতিশীল। ওর চরিত্রের দোষ হলো, ভীষণ আত্মবিশ্বাসী এবং নৈতিকি সাহসের অভাব। অপর দিকে সান্দ্রা ফ্যারাডের মন ভীষণ সংকীর্ণ, ধর্মভীরু, মধ্যযুগীয় বেপরোয়া মনোভাব।
–তবে আমার মনে হয় স্টিফেন বোকা এবং ভীষণ অহঙ্কারী–আইরিস বলে।
–বোকা ঠিক নয়। তবে সাফল্যের দোড়গোড়ায় এসেও তিনি অসুখী।
–এর কারণ?
-তারা অবশ্য এ দিক থেকে সার্থক। কিন্তু তারা পরস্পরের মধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই তাঁরা এমন একটা কিছু দেখাতে চান, যা দেখার জন্য সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন।
..আইরিস, তুমি একটু চিন্তা করলেই দেখবে, কথাগুলো সত্যি এবং খাঁটি। তুমি লক্ষ্য করে দেখবে, সুখী মানুষদের জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। কারণ তাদের নিজেদের মধ্যে এমন বোঝাঁপড়া থাকে যে কেউ কারোর নিন্দে করতে পারে না। যেমন আমি।
–তোমার নিজের প্রশংসা তুমি নিজেই করছো?
হঠাৎ কি খেয়াল হতে আইরিস হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো।
–এসো, আমাদের বাড়িতে তোমার চায়ের নেমন্তন্ন রইলো।
–আজ নয়। এ্যানথনি মাথা নাড়লো। কাজ আছে, ফিরে যেতে হবে।
–কি ব্যাপার বলো তো?
আইরিস তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো–আমাদের বাড়িতে তুমি আমো না কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?
তোমার জামাইবাবু আমাকে ঠিক পছন্দ করেন না, সেটা তার হাবভাবে পরিষ্কার বুঝেছি আমি।
-জামাইবাবুর কথা বাদ দাও। লুসিলা পিসি আর আমি যদি বলি তাহলে তোমার আপত্তি করার কিছু নেই বলো।
-তোমার ভালো লাগলেও আমার আপত্তি থেকেই যাচ্ছে।
–কিন্তু রোজমেরির সময় তো আসতে।
–সেটা আলাদা ব্যাপার।
এ্যানথনির এ ধরনের কথা শুনে আইরিস আহত স্বরে বলে–তুমি এখানে এসেছো কেন? এখানে কি তোমার অন্য কাজ ছিলো?
-হ্যাঁ তোমার সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন আছে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। আইরিস কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
–কি কথা বলো?
–আমাকে তুমি বিশ্বাস করো, আইরিস? সত্যি করে বলবে?
এ ধরনের প্রশ্ন শুনে আইরিস চমকে উঠলো।
–এ প্রশ্ন তোমার ধারণার বাইরে তাই না? এ্যানথনি বলতে থাকে। এই একটা মাত্র জরুরী প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই আইরিস। বলল, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো?
ক্ষণিকের জন্য আইরিস ইতস্ততঃ বোধ করে। তারপর ধীরে ধীরে বলে-হ্যাঁ।
–তাহলে লন্ডনে এসে কাউকে না জানিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আইরিস তাকালো–আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করতে আমি পারি না।
-তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, কি ভালোবাসো না?
–হ্যাঁ, তোমায় আমি ভালোবাসি।
–তাহলে তুমি ব্লুমসবেরিলর সেন্ট এলফ্রিডা চার্চে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতে পারো।
-কি করে সম্ভব হবে? এভাবে বিয়ে করলে জর্জ মনে কষ্ট পাবে, লুসিলা পিসিও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তাছাড়া আমার বয়স মাত্র আঠারো। সেটাও একটা সমস্যা।
-বয়সের ব্যাপারে তোমাকে একটু মিথ্যা বলতে হবে। এর জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাকে জানি না। তোমার অভিভাবক কে?
–জর্জ। উনি আমার ট্রাস্টিও বটে।
তবে বিয়েতে যত রকম ঝামেলা পোহাতে হোক না কেন, আমার আশা, আমাকে তুমি ফিরিয়ে দেবে না।
-আচ্ছা, তুমি এ ব্যাপারে আমাকে এতো চাপ দিচ্ছো কেন? তোমার মতলবটা কি?
-আমি বলতে চাই যে, আমার কাজের ওপর তোমাকে অবশ্যই আস্থা রাখতে হবে। তাই তো তোমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো কিনা।
-তোমার সম্পর্কে জর্জের কিছু জানার দরকার। তুমি আমার সঙ্গে চলো। জর্জ এখন বাড়িতে আছেন।
-মনে হয় না উনি এখন বাড়িতে আছেন। কারণ এখানে আসার সময় দেখলাম একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। মিঃ জর্জ তার দিকে এগিয়ে গেলেন। মনে হয় লোকটি কর্নেল রেস।
-হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম আমি, কর্নেল রেস জর্জের পরিচিত। সেদিন রাতের পার্টিতে তার আসার কথা ছিলো, রোজমেরি যখন–
একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আইরিসের কণ্ঠ রোধ করে আসে।
–এ্যানথনি, তুমি কখনো এরকম নৃশংস পরিস্থিতির সামনে পড়েছে। কিন্তু রোজমেরি আত্মহত্যা করেননি। তিনি হয়তো খুন হয়ে থাকবেন। তোমার কি একবারও মনে হয়নি?
–এসব তুমি কি বলছো? তুমি এমন উদ্ভট চিন্তা কি করে করলে? আমার তো বিশ্বাস, রোজমেরি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছিল।
আইরিস চুপ করে রইলো।
-ওসব বাজে চিন্তা বাদ দাও প্রিয়তমা। আইরিসকে কাছে টেনে নিলো এ্যানথনি। ওর গালে চুমু দিলো। রোজমেরির কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাও। তুমি কেবল আমার কথা ভাবো, আইরিস।
.
২.৪
পাইপ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লো কর্নেল রেস। তারপর কি যেন অনুমান করার জন্য জর্জ বারটনের দিকে তাকালো।
বারটনের কাকা ছিলেন রেসদের প্রতিবেশী। সেই সূত্রে কর্নেলের সঙ্গে জর্জের পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে বয়েসের ফারাক যথেষ্ট। কর্নেলের বয়স এখন ষাটের ওপর। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ, কালো চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি।
জীবনের বেশির ভাগ সময় কর্নেলের কেটেছে বিদেশে। জর্জ মূলতঃ কেতাদুরস্ত শহুরে মানুষ। কখনো সখনো তাদের মধ্যে দেখা হয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে পরস্পরের মধ্যে মত বিনিময় করেছে, ছেলেবেলার কথা মনে করেছে। তারপর নীরব থেকেছে।
কর্নেল এই মুহূর্তে জর্জের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, কেন যুবক জর্জ আজকের এই সাক্ষাতের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে। জর্জকে সব সময় মনে হয়েছে অত্যন্ত সাবধানী, বাস্তববাদী, যার মধ্যে কল্পনার কোনো স্থান নেই। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো সঙ্গতি নেই। হাবভাবে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। যে বারটন সিগারেট পছন্দ করতো না সে আজ অল্প সময়ের মধ্যে তিনটে সিগারেট ব্যবহার করেছে।
-বলো, যুবক জর্জ, তোমার কি সমস্যা?
–আমি তোমার পরামর্শ ও সাহায্য চাই কর্নেল। তোমার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, আজ থেকে এক বছর আগে আমাদের সঙ্গে এক নৈশভোজে তোমার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তোমাকে বিদেশে চলে যেতে হয়। ঐ নৈশভোজের আসরে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
-খবরটা আমি কাগজে পড়েছিলাম। ঐ অপ্রীতিকর প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছা ছিল না বলেই তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলিনি। আমি তার জন্য দুঃখিত।
-ধরে নেওয়া যেতে পারে, আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলো?
–কেন একথা বলছো?
–এটা পড়ে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে আমি একথা বলছি কেন?
দুটি চিঠি কর্নেলের হাতে তুলে দিতে ভ্রু কুঁচকে দেখে বললো–বেনামা চিঠি দেখছি।
-হ্যাঁ, বেনামা চিঠি। কিন্তু চিঠির লেখাগুলি আমি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি।
–সেটাই তো আরো বেশি বিপজ্জনক। ধীরে ধীরে রেস মাথা নাড়লো। শুনলে তুমি অবাক হবে, খবরের কাগজ প্রচারের জন্য এরকম কোনো ঘটনা ঘটে যাবার পর এ ধরনের অনেক চিঠি পাওয়া যায়।
-জানি। কিন্তু চিঠিগুলো সেই সময়কার লেখা নয়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে অন্তত ছমাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত লেখা হয়নি।
-হ্যাঁ, এটা একটা দিক বলতে পারো, কারা এই চিঠি লিখতে পারে বলে তোমার ধারণা হয়।
–জানি না, তবে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, আমার স্ত্রী সেদিন খুন হয়েছিল।
–তোমার কি কোনো সন্দেহ হয়েছিল?
—আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। তাই তদন্তের ফলাফল আমি যন্ত্রের মতো মেনে নিয়েছিলাম। সদ্য ফুঁ থেকে উঠে আমার স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বলতে যা বোঝায় তা ছিলো না। তাই আমার মনে হয় সেই মুহূর্তে কোনো সন্দেহ জাগেনি। তাছাড়া তদন্ত করার সময় তার হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁড়ো জাতীয় কিছু পদার্থ পাওয়া যায়, সেই গুঁড়ো হলো সায়ানাইড।
-শ্যাম্পেনের সঙ্গে সায়ানাইডের গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
–আমারও তাই মনে হয়। তাছাড়া রোজমেরি কখনো আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি পর্যন্ত দেয়নি। ওর বাঁচার ইচ্ছে ছিলো ভীষণ, জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিল সে।
রোজমেরির সঙ্গে রেসের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, প্রেমিকা হিসাবে এই নারী হলেন অদ্বিতীয়া।
–মেডিক্যাল রিপোর্টে কি বলেছিল।
–মারলে পরিবারের বয়স্ক ডাক্তার তখন সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিল। ছেলেবেলা থেকে সে-ই রোজমেরিকে চিকিৎসা করে আসছিল। তার অবর্তমানে তারই সহযোগী ডাক্তার রোজমেরির ফ্র হওয়ার সময় চিকিৎসা করেছিল। আমার যতদূর মনে আছে সে বলেছিল, ওই ধরনের ফ্লু থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর প্রায় প্রতিটি রুগী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে রোগভোগের যন্ত্রণায়।
জর্জ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–ঐ চিঠিগুলো পাওয়ার পর আমি রোজমেরির বয়স্ক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করি। সবকিছু শুনে সে বিস্মিত হলো। তার কাছে এটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। তার ব্যক্তিগত ধারণা, রোজমেরি আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিলো না। আমারও মন সায় দিলো, জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার মেয়ে তো সে ছিল না। হয়তো কখনো রাগে চেঁচামেচি করেছে, বাড়ির সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে, ব্যস, এই পর্যন্ত।
রেস ফিসফিসিয়ে বলে এমন কোনো ঘটনার কথা তুমি জানো, যা ওর মনকে ভেঙে দিতে সাহায্য করেছে। মানে আমি বলতে চাইছি কোনো কিছুর ব্যাপারে ও নিশ্চয়ই অসুখী ছিলো।
–আমি জানি না, মনে হয় একটু দাম্ভিক প্রকৃতির ছিলো। তবে আমি বলবো, সায়ানাইড ব্যবহার করার সম্ভাবনাটা একেবারে নেই বললেই চলে। এটা এমন কোনো জিনিস নয়, যেটা সহজে ব্যবহার করা যায়। এটা সবাই জানে।
–এটা আর একটা দিক। তবে ধরে নেওয়া যাক, রোজমেরি নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সে চাইবে না নিশ্চয়ই এমন যন্ত্রণাদায়ক কুৎসিত মৃত্যু।
-বুঝলাম, কিন্তু রোজমেরি যে সায়ানাইড কিনেছিল বা পেয়েছিল তার কোনো প্রমাণ আছে।
–না। তবে কিছুদিন ও বন্ধুদের সঙ্গে ছিলো। তারা তখন বোলতার বাসা নিয়ে আসে। তখন হয়তো পটাসিয়াম সায়ানাইড ক্রিস্টাল একটু ব্যবহার করে থাকবে।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে অসুবিধা হবে না। একটু থেমে রেস বলতে থাকে–এবার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা একবার খতিয়ে দেখা যাক। এক নম্বর হলো, আত্মহত্যা করা কিংবা তার প্রস্তুতির কোনো প্রমাণ আপাততঃ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এদিকে দেখা যাচ্ছে, খুন করার কোনো প্রমাণ নেই আমাদের হাতে বা পুলিশও খুন হিসাবে সন্দেহ করেনি।
-আমার ধারণা, আমার অবচেতন মনটা এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিচ্ছিল নিজেকে। তারপরে এই চিঠি পাওয়ার পর সন্দেহ আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।
–বেশ, তোমার কথাই মেনে নিলাম। রেস বললো, কাকে তোমার খুনি বলে মনে হয়, জর্জ।
জর্জের মুখে কুঞ্চনের রেখা ফুটে উঠলো–আমিও নিজের কাছে ঐ একই প্রশ্ন করি। যদি রোজমেরি সত্যিই খুন হয়ে থাকে তাহলে সেদিন রাতে আমাদের নিমন্ত্রিত বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন খুনী হবে। যারা টেবিলের সামনে বসেছিল তাদের মধ্যে কেউ
-কেন ওয়েটারদের মধ্যেও কেউ একাজ করতে পারে।
–লুক্সেমবার্গের প্রধান ওয়েটার চার্লসকে তুমি চেনো নাকি?
–চার্লসকে সবাই চেনে। সে ইচ্ছা করলে যে কোনো ব্যক্তির গ্লাসে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। এটা তার পক্ষে কোনো অসম্ভব কাজ নয়। এছাড়া আছে গিউসেজ।
-সেদিন পার্টিতে কে কে ছিল?
–এম.পি.স্টিফেন ফ্যারাডে, তার স্ত্রী লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডে, আমার সেক্রেটারি, রুথ লেসিং, এ্যানথনি ব্রাউন, রোজমেরির ছোট বোন আইরিস আর আমি। সব মিলিয়ে সাতজন ছিলাম। তুমি এলে আটজন হতাম।
-এবার বল, তুমি সেদিন কি ভাবে বসেছিলে?
-সান্দ্রা ফ্যারাডে বসেছিল আমার ডানদিকে, সান্দ্রার পাশে এ্যানথনি ব্রাউন, তার পাশে রোজমেরি, তারপর স্টিফেন ফ্যারাডে। আমার বাঁ পাশে ছিল আইরিস আর রুথ লেসিং।
-তোমার স্ত্রী আগে সন্ধ্যার সময় শ্যাম্পেন পান করেছিল?
-ক্যাবারে শো যখন চলছিল, তখন কয়েক গ্লাস পান করেছিলো। আলো নেভার আগে রোজমেরি টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে। হয়তো অস্ফুটে কিছু বলে থাকবে। কিন্তু আমরা সেটা শুনতে পাইনি। ডাক্তার জানায়, ওর মৃত্যুটা নাকি আকস্মিক।
-তাহলে সব দিক থেকে বিচার করে বলা যায়, রোজমেরির গ্লাসে সায়ানাইড মিশিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বেশি সুবিধা ছিলো স্টিফেন ফ্যারাডের। যদি তাই হয়, তাহলে খুনের কারণ কি সেটা জানতে হবে। কেন খুন করবে?
-ওরা দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। জর্জ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকেন, হয়তো এমন হতে পারে রোজমেরি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধ স্টিফেন এমন নৃশংস হত্যার মাধ্যমে নিয়েছে।
–এবার দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, কোনো মহিলা আসামী। তোমাদের সাতজনের মধ্যে চারজন ছিলো মহিলা। তোমরা যখন জোড়ায় জোড়ায় ক্যাবারের সাথে নাচছিলে তখন একজন মহিলা কি করছিলো এবার মনে করে দেখো, কোনো মহিলা একা টেবিলের ধারে বসেছিল।
একটু সময় ভেবে জর্জ বললেন, প্রথমে আইরিস, তবে দুর্ঘটনার আগে রুথকে দেখেছি।
-তোমার স্ত্রী শ্যাম্পেনের গ্লাসে শেষ চুমুক কখন দিয়েছিলো?
ব্রাউনের সঙ্গে রোজমেরি তখন নাচছিল। তখন ওকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তারপর ও ওর গ্লাসে চুমুক দেয়। এরপরে রোজমেরি আর আমি নাচতে থাকি। রুথের সঙ্গে ফ্যারাডে এবং লেডি আলেকজান্ডারের সঙ্গে ব্রাউন নাচতে থাকে। তখন টেবিলের ধারে আইরিস একা একা বসেছিল।
-তাহলে তোমার স্ত্রীর বোনকেই সন্দেহ করা যায়। রেস বেশ গম্ভীর গলায় বললো, এই মৃত্যুর সঙ্গে আইরিসের কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে বলে তোমার মনে হয়?
কথাটা শুনে জর্জ রেগে গেলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললেন–রেস, আইরিস ছেলেমানুষ। তাছাড়া রোজমেরিকে ও ভালোবাসতো। ও ওর বোনের দারুণ অনুগত ছিলো।
–আমি জানি, তোমার স্ত্রী ধনী ছিলো। ওর টাকা কি তুমি পাবে?
-না, ওর সব টাকা আইরিস পাবে। তার নামে একটা ট্রাস্ট আছে। তারপর জর্জ সবিস্তারে সমস্ত কিছু রেসকে বললো।
আশ্চর্য ব্যাপার। যে কোনো মেয়ে এর ফলে ক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু তুমি বলছো ত হয়নি। তবুও তার মোটিভটা ঠিক থেকে যাচ্ছে। সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়া আর কার মোটিভ থাকতে পারে?
-রোজমেরির কোনো শত্রু ছিল না, আমি নিশ্চিত করে জানি। ফ্যারাডেদের বাড়ির কাছে আমার বাড়ি নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেককে প্রশ্ন করে কাউকে সন্দেহের তালিকায় ফেলা যায় কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে মন দিলো রেস।
খানিক বাদে বললো-জর্জ, তুমি কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে। তোমার স্ত্রীর সুনাম রাখতে কিংবা সে খুন হলো কি না হলো, সেটা চেপে যেতে তুমি চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু তোমাকে সব পরিষ্কার করে বলতে হবে।
জর্জ চুপ করে থাকে।
-তোমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে রোজমেরির একজন প্রেমিক ছিলো। সে কি স্টিফেন ফ্যারাডে।
–আমি ঠিক জানি না এ ব্যাপারে। ও ছাড়া এ্যানথনি ব্রাউনও হতে পারে।
–ব্রাউন নামটা কেমন শোনা মনে হচ্ছে। তুমি কি ওর সম্বন্ধে কিছু জানো?
-জানি না, ওর ব্যাপারে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। তবে আমুদে। আমেরিকান হতে পারে। কিন্তু তার কথাবার্তায় সেটা প্রকাশ পায় না।
বেশ, এবার ধরা যাক, স্টিফেন ফ্যারাডে তোমার স্ত্রীর প্রেমিক ছিলো। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে আলেকজান্ডার ফ্যারাডের নাম জড়িয়ে পড়ে। কারণ স্বামীকে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হতে দেখে কোনো নারীর পক্ষে মাথা ঠিক রাখা সম্ভব নয়। পরিণামে রোজমেরিকে সেই নারী খুন করেছে। তাহলে আপাততঃ এই রহস্যময় খুনের সঙ্গে ফ্যারাডে দম্পতি এবং আইরিসের নাম সন্দেহের মধ্যে আনতে পারি। আচ্ছা, রুথ লেসিং সম্পর্কে এবার কি বলল।
-রুথকে এই খুনের সন্দেহের বাইরে রাখা যায় অনায়াসে। জর্জ বলেন, রুথ আমার সব কাজ দেখাশোনা করে। বলতে গেলে ও আমাদের পরিবারের একজন। ওর সবকিছুতেই আমি নির্ভরশীল। জানো রেস, ওর মধ্যে যেরকম সততা, আন্তরিকতা এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ভাব আছে, পৃথিবীর কোনো মেয়ের মধ্যে তুমি একসঙ্গে এতগুলো গুণ দেখতে পাবে না।
–জর্জ, আমার ধারণা, রেস বলতে থাকে, তোমার মোটিভও এখানে কাজ করেছে।
–আমি? জর্জ হতবাক।
–হ্যাঁ, ওথেলা আর ডেসডেমোনাকে তোমার মনে পড়ে?
–তোমার বক্তব্য আমি বুঝেছি। কিন্তু রোজমেরি এবং আমার মধ্যে সেরকম সম্পর্ক ছিলো না। ও একটু বেপরোয়া ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার যে অনুগত ছিলো না, সেটা ভাবা ভুল, ও আমার প্রিয় ছিলো। তবে রোমান্টিক ছিলো না। তবু সে অঘটন ঘটে যাওয়ার পর আমি ভীষণ ভেঙে পড়ি।
তাছাড়া যদি ধরা যায় আইরিস ওকে খুন করেছে, তাহলে আমি কেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করবো।
আমি জানি। তুমি যদি সত্যিই ওকে খুন করবে, তাহলে ঐ চিঠিগুলো পুড়িয়ে না ফেলে নিজের কাছে রেখে দেবে কেন? নিশ্চয়ই তুমি এ নিয়ে আর জল ঘোলা করতে না। যাই হোক, এখন ভাবনা হচ্ছে, চিঠিগুলো লিখলো কে?
তবে খুনী যে স্বয়ং লেখেনি, সেটা নিশ্চয় নিশ্চিত। কারণ তুমি যখন বললে রোজমেরির আত্মহত্যা করার পর সবকিছু শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে গেছে আর যখন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়েছে রোজমেরি আত্মহত্যা করেছে, তখন মনে হয় না, চিঠিগুলো খুনী লিখেছে? সমস্ত ব্যাপারটা নতুন করে, খুঁচিয়ে তোেলার পেছনে কার স্বার্থ থাকতে পারে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
একসময় রেস বলে ওঠে–সব কিছু শুনে যা বুঝলাম, তা হলো তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিলাম, রোজমেরি খুন হয়েছিল। তবে সেটা আবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে গেলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া তোমার স্ত্রী গোপনে যাদের সঙ্গে প্রেম করতেন সেইসব কেচ্ছা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
-তাই বলে, তোমার কি ইচ্ছা, একজন খুনী ছাড় পেয়ে যাবে? না, আমি তা হতে দেবো না। আসল সত্যি কি, আমাকে জানতেই হবে।
–বেশ, এই চিঠিগুলি আমি পুলিশের হাতে দিচ্ছি। তারাই চিঠির লেখক বা লেখিকাকে খুঁজে বের করবে। তবে পুলিশ একবার তদন্ত শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না।
-আমি কিন্তু পুলিশের দ্বারস্থ হতে চাই না। তাই তো, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটা পরিকল্পনা করেছি খুনীর জন্য।
–কি রকম? রেস কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে।
-ঐরকম একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছি লুক্সেমবার্গে। সেদিনকার সব অতিথিরাই সেখান আসবে। আমার ইচ্ছা, তুমিও আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করবে।
-কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য?
-সেটা একান্ত গোপনীয় ব্যাপার। তোমাকে আমি ভোলা মনে আসার অনুরোধ করেছি। এলে দেখতে পাবে।
কিন্তু বন্ধু, তুমি আমাকে এই সব ঘটনার মধ্যে জড়াচ্ছে ঠিকই। তবে আমাকে এখনো তুমি অন্ধকারে রেখে দিয়েছে।
-সেটার প্রয়োজন আছে।
-তোমার পরিকল্পনা আমি নেনে নিতে পারছি না জর্জ, দুঃখিত। তোমার পার্টিতে আমি যেতে পারবো না। তুমি এই অবাস্তব পরিকল্পনা থেকে বিরত হও।
–কিন্তু এখন পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। অতএব
-দেখো আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, এ কাজের পরিণতি ভালো হবে না। দারুণ বিপজ্জনকও হতে পারে। তোমাকে আমি বারবার সাবধান করে দিচ্ছি, এই পরিকল্পনা ত্যাগ করো।
জর্জ বারটন নীরবে মাথা নাড়লেন।
.
২.৫
দোসরা নভেম্বরের সকাল।
বাতাসে কেমন স্যাঁতসেঁতে ভাব। থমথমে হয়ে আছে চারদিকে, মনে হয় যে কোনো সময় ঝড় উঠতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জর্জ বার বার ঘড়ি দেখছিল, খাবার খেতে খেতে প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মুখ ভার করে বসে রইলো আইরিস। লুসিলা পিসি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন আর ঘন ঘন রুমালে চোখ মুছছিলেন।
–প্রিয় জর্জ, আমি জানি, এটা একটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সে তো কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। মিসেস ড্রেক বলতে লাগলো, তুমি যে তদন্তের কথা বললে সেটা সময় লাগবে যথেষ্ট, তার মধ্যে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তাহলে আমি নিজের কাছে দোষী হয়ে থাকবো আজীবন।
-আপনাকে তো আমি কথা দিয়েছি। জর্জ বলে উঠলেন। আপনি ভাববেন না। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি, তখন আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
জর্জ উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস ড্রেকের পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলোতে গিয়ে বললেন, আনন্দ করুন। আমি রুথকে এক্ষুনি টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি।
জর্জ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, ওর পেছন পেছন আইরিস এলো।
–জর্জ, আজ রাতের পার্টিটা বাতিল করে দেওয়া তোমার উচিত বলে মনে হয় না। লুসিলা পিসি যেমন ভেঙে পড়েছেন, আমার মনে হয়, আমাদের তার বাড়িতে তার সঙ্গে থাকা উচিত।
–কখনোই নয়। রাগে জর্জের মুখ লাল হয়ে উঠলো। ঐ ধাপ্পাবাজটা আমার জীবনই কেন তিক্ততায় ভরিয়ে দেবে? ও আমাকে একের পর এক ব্ল্যাকমেল করে যাবে, আর আমি মুখ বুজে তা মেনে নেব? আমার মতে, আর একটা পেনিও ওকে দেওয়া উচিত নয়।
-কিন্তু লুসিলা পিসি কি রাজী হবে?
-এটা ওঁরই রোকামির ফল। প্রথমেই যদি ভিক্টরকে বলতেন, নিজের পথ নিজে দেখে নিতে তাহলে আজ এই পর্যায়ে ও এসে পৌঁছাতো না। যাক, তুমি ওকে উৎসাহ দাও। আমি এমন একটা ব্যবস্থা করবো যাতে রাতে তোমরা ভালো করে ঘুমোতে পারো।
জর্জ চলে গেলেন, আইরিস ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো, টেলিফোন বাজচ্ছে।
-হ্যালো কে? আইরিসের হাতাশা ভাবটা একটু একটু করে কেটে গিয়ে মুখ হয়ে উঠলো নির্মেঘ আকাশের মতো। এ্যানথনি কথা বলছে।
-হ্যাঁ, তোমার প্রিয়তম এ্যানথনি। আজ রাতে পার্টিতে যাওয়ার জন্য জর্জ খুব পীড়াপীড়ি করছেন। কি ব্যাপার প্রিয়তমা, তোমার কি হয়েছে বলো তো? দূরভাষে তোমার দীর্ঘশ্বাস আমার কানে ভাসে, একটা চাপা বেদনা তোমার নিঃশাসে। তোমার কি কিছু হয়েছে?
-না না, কিছু হয়নি এ্যানথনি, আচ্ছা, তুমি একটা সত্যি কথা বলবে আমায়? আইরিসের কণ্ঠে কাতর অনুরোধ।
-শুনে তারপর তো উত্তর দেবো।
–তুমি কখনো রোজমেরির প্রেমে পড়েছিলে?
অপরপ্রান্ত কিছুক্ষণের জন্য নীরব থাকে। তারপরেই আইরিসের কানে ভেসে আসে এ্যানথনির হাসির ধ্বনি।
-এই জন্য কি তোমার মন বিষণ্ণ। তোমার কাছে স্বীকার করছি, রোজমেরির সঙ্গে আমার একটু-আধটু প্রেম হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু যেদিন তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম, তখন তোমাকে দেখে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে যে পৃথিবীতে একমাত্র তুমি-ই আছো আমার জন্য। এর থেকে নির্ভেজাল সত্যি কথা আর কিছু হতে পারে না।
–শুনে সুখী হলাম, এ্যানথনি, ধন্যবাদ।
–ঠিক আছে, আজ রাতে তোমার জন্মদিনের পার্টিতে আমি আসছি। তবে ঐ একই জায়গায় তোমার জন্মদিনের পার্টি বসছে এটা মাথায় ঠিক আমার ঢুকছে না। জর্জ কি করতে চলেছে, একমাত্র ঈশ্বর জানেন। যাই হোক, একটা সুন্দর উপহার নিয়ে আমি যাচ্ছি।
ওদিকে অফিসে এসে জর্জ রুথকে ডেকে পাঠালেন। ওর শান্ত হাসি ভরা মুখ জর্জের চিন্তা কিছুটা প্রশমিত করে।
জর্জ তার হাতে টেলিগ্রামটা দিয়ে দেখতে বললেন। রুথ টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে একটু চুপ করে থাকে।
–আচ্ছা, বছরখানেক আগে ওকে জাহাজে করে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম না?
রুথ মনে করার চেষ্টা করে।
-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেদিন ছিল ২৭শে অক্টোবর।
–আশ্চর্য তোমার স্মরণশক্তি।
রুথের স্মরণশক্তি যে প্রখর সেটা নিজে সে ভালো করে জানে। তার মনে আছে একদিন ফোনে রোজমেরিকে ভিক্টর ড্রেকের সঙ্গে অসতর্কভাবে কথা বলতে শুনেছিল। তারপর থেকে রোজমেরির ওপর তার একটা ঘৃণা জন্মেছে।
-কিন্তু তিনশো পাউন্ড। বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। রুথ বললো, তার চেয়ে বরং মিঃ অগিঁলভির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করবো ভাবছি।
তাদের বুয়েন্স আয়ার্সের এজেন্ট হলেন আলেকজান্ডার অর্গিলভি।
-বেশ, তবে দেরি করো না। ওর মা এখন হিস্টিরিয়া রুগীর মতো করছে। আর রাত কাটানো মুশকিল।
–আমি কি ওঁর সঙ্গে থাকবো?
-না, কঠিন কণ্ঠে জর্জ বললেন। এখনই তার প্রয়োজন হবে না। তবে রুথ, তোমাকে আমার একান্ত প্রয়োজন। রুথের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, তুমি একেবারে স্বার্থপর নও।
অর্গিলভির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুথ হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অফিসের কাজ শেষ করে জর্জ এলেন লুক্সেমবার্গে। তাকে দেখে প্রধান ওয়েটার চার্লস মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলো। চার্লসের কাছে জেনে নিলেন, আজ রাতের ব্যবস্থা সব ঠিক আছে কিনা। চার্লস জানালো, মেনু পর্যন্ত তৈরি। তারপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালেন।
তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে চালর্স বললো, মিঃ বারটন, আপনি যে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসছেন, তাতে আমরা ভীষণ খুশী।
সেই ভয়ঙ্কর হাসিটা জর্জের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো–আমরা অতীতকে ভুলতে চাই, চার্লস।
তিনি ওখান থেকে অফিসে ফিরে এলেন। রুথ তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো।
-সকালে মিঃ অগিঁলভির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম। প্রায় দশ মিনিট আগে তিনি ফোনে জানান যে, ভিক্টর যদি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেয় তাহলে তার নামে আদালতে কোনো অভিযোগ করা হবে না। আর আমাদের পাওনা একশো পঁয়ত্রিশ পাউন্ড।
তার মানে টাকাটা ভিক্টর আত্মসাৎ করতে চাইছে।
–আমারও তাই ধারণা। ভিক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মিঃ অর্গিলভিকে বলেছি। ঠিক করেছি কি?
–আমি নিজেও তাই চাই। কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে অস্থির হচ্ছি। দুষ্টু ছেলে হলেও সে তো মায়েরই ছেলে। লুসিলা পিসি কিভাবে তার ছেলের জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা নেবেন তাই ভাবছি।
-তোমার মতো এতো ভালো লোক আর বোধহয় পৃথিবীতে নেই।
রুথের কথায় জর্জ খুশী হলেন। রুথের একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেলেন।
রুথ ভাবলো, জর্জকে পেলে তারা দুজনেই সুখী হবে।
এদিকে তখন জর্জ ভাবছিলেন, রেসের পরামর্শ মেনে নেবে কি না? সব ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেবে কি না? পরক্ষণেই মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনামাফিকই কাজ হবে।
লুক্সেমবার্গ।
অতিথিদের সবাইকে উপস্থিত দেখে জর্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে একটু খটকা ছিলো, শেষ পর্যন্ত সবাই আসবে কি না। অবশেষে সবাই তার জালে ধরা পড়েছে। এখন কেবল নাটক শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
হলের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা নিরালা জায়গায় তিনটি টেবিল পাতা ছিলো। মাঝের টেবিলটা বড়। দুপাশে দুটি ছোট টেবিল। একটি টেবিলে বসেছিল মাঝবয়সী একজন বিদেশী এবং এক সুন্দরী যুবতী। অপর টেবিলে বসেছিল দুটি যুবক-যুবতী। মাঝের টেবিলটি বারটন পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
জর্জ অতিথিদের বসার নির্দিষ্ট আসনগুলি অমায়িক ভঙ্গিতে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
জর্জের ডানদিকে বসলো সান্দ্রা, তার পাশে ব্রাউন। তার বাঁদিকে বসলো আইরিস, তারপর স্টিফেন, তার পাশে রুথ।
রুথ আর এ্যানথনির মাঝখানে একজনের বসার জায়গা ফাঁকা রইলো। সাতজন বসার উপযোগী টেবিল।
–আমার বন্ধু রেসের আসতে একটু দেরি হতে পারে। তার জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গা সে ঘুরেছে। আলাপ হলে অনেক চমকপ্রদ গল্প তোমরা শুনতে পাবে।
আইরিস কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ হলো ব্রাউনের পাশে না বসতে পেরে। জর্জ ইচ্ছে করেই, এই ব্যবস্থা নিয়েছে। তার মানে জর্জ তাকে বিশ্বাস করেন না এবং পছন্দ করেন না।
আইরিস দেখলো, এ্যানথনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।
একটু পরেই তারা নাচের আসরে যায়।
এ্যানথনির সঙ্গে আইরিস যখন নাচ শুরু করলো, তখন আইরিস ফিস ফিস করে তার কানে কানে বললো, এর থেকে বোঝা যায়, জর্জ চায় না, আমরা দুজনে পাশাপাশি বসি।
-তাই তো আমি তোমাকে আড় চোখে লক্ষ্য করছিলাম।
-কিন্তু তুমি যে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছে, সেটা হবে না। তুমি জানো, কর্নেল রেসের এখানে আসার কথা আছে।
–আমার ধারণার বাইরে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
–উনি কি ধরনের লোক তুমি জানো?
–ওঁর সম্বন্ধে সঠিক খবর কেউ জানে না।
প্রত্যেকে আবার টেবিলে ফিরে এলো। বাইরে তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। টেবিলের চারধারে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু জর্জ নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না।
হঠাৎ ড্রাম বাজার শব্দ। ঘরের আলো স্তিমিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে তিনজোড়া নারী-পুরুষ নাচে মেতে উঠলো। নাচের সঙ্গে সঙ্গে একজন বহুরূপী মুখে নানারকম আওয়াজ করে তাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ বাদে ঘরের আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো।
সেই সময়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে অবচেতন মন কথা বলে উঠলো–একটা অঘটন কিছু আবার বোধহয় ঘটে যাচ্ছে। যখন আলোগুলো ম্লান করে দেওয়া হয়েছিল সেই দৃশ্য তাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দিলো। কেন সেই বিপদ ভরা অতীত তাদের মনে আসছে? তবে কি এর আড়ালে কোনো ইঙ্গিত আছে? বীভৎস ছায়াটা একসময় মিলিয়ে গেল।
কেবল জর্জ তার দৃষ্টি স্থির করে বসে আছেন তার উল্টোদিকের খালি চেয়ারটায়। যে কোনো মুহূর্তে সেই খালি চেয়ারে কেউ একজন এসে বসতে পারে। সামনে শ্যাম্পেনের গ্লাস।
–ওঠো জর্জ। আইরিসের ডাকে চমক ভাঙলো জর্জের। আজ এখনো পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে নাচোনি। এসো, আমরা নাচ করি।
জর্জ উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।
–আজ আমরা আইরিস মারলের জন্মদিনের উৎসবে এখানে মিলিত হয়েছি। আমরা সকলে তার জীবনের শুভ কামনা করি। আসুন, আমরা এবার একটু পান করি।
প্রত্যেকে হাসতে হাসতে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দেয়। তারপর তারা নাচতে শুরু করলো –জর্জ-আইরিস, স্টিফেন-রুথ এবং এ্যানথনি-সান্দ্রা।
কিছুক্ষণ বাদে সকলে যার যার আসনে এসে বসলো।
জর্জ হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
–তোমরা সকলে জানো, একবছর আগে এখানে এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে। আমরা সেই বিষাদভরা অতীতকে স্মরণ করতে চাই না। কিন্তু রোজমেরিকে আমরা সকলে ভুলে গেছি, একথা আমরা ভাবতে পারি না। তাই বন্ধু, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, রোজমেরির আত্মার উদ্দেশ্যে স্মরণ করে এসো আমরা শ্যাম্পেনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াই।
জর্জ গ্লাস তুলে নিল হাতে। প্রত্যেকে তাকে অনুসরণ করলো। গ্লাস ঠোঁটে স্পর্শ করল। সবাই।
কয়েক মুহূর্ত পরে দেখা গেল জর্জের দেহটা কেঁপে উঠলো। ওঁর ভারী দেহটা চেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়লো। তিনি তার উত্তেজিত দুটি হাত কণ্ঠের ওপর চেপে ধরলেন। ধীরে ধীরে তার মুখের রঙ পাল্টে গেল। নিঃশ্বাস নেবার জন্য আকুলিবিকুলি করলেন।
কিন্তু মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে জর্জের জীবন্ত দেহটা পরিণত হলো একটি নিথর নিস্পন্দ মৃতদেহ।