তৃতীয় অধ্যায়
৩.১
নিউ স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে আবার মিলিত হলো দুই পুরোনো বন্ধু, কর্নেল রেস এবং চীফ ইনসপেক্টর কেম্প।
-মনে হয় এই তদন্ত আমাদের খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছতে সাহায্য করবে, রেস বলে ওঠে।
গম্ভীর হয়ে কেম্প বলে, মনে রেখো এই কেসের সঙ্গে ফিডারমিনিস্টারের সম্পর্ক জড়িত। অতএব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
রেস মাথা নাড়ে। লেডি ফ্যারাডের সঙ্গে সে বহুবার কথা বলেছে। ভদ্রমহিলার বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিটা দারুণ। জনসাধারণের মনে আঁচড় কেটে যায়। জনসাধারণের কাছে তার একটা আলাদা পরিচিতি আছে। দেশবাসীর জন্য তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে এমন ভাব। কিন্তু তাদের মনেও যে প্রতিহিংসার স্পৃহা জাগে, সেটা কেউ ভাবতেও পারে, না।
-কেম্প, মনে করো লেডি আলেকজান্ডার যদি খুনী হয়? রেস কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। অথবা তার স্বামীও হতে পারে যার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ফিডারমিনিস্টার পরিবারের সংস্পর্শে এসে।
ওদের মধ্যে যে কেউ অপরাধী হোক না কেন, তাকে চরম শাস্তি পেতেই হবে। তার আগে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে পাবলিক প্রসিকিউটর যাতে আসামীর বিপক্ষে ঠিকমত সওয়াল করতে পারে। একবছর আগে সায়ানাইড বিষক্রিয়ায় জর্জ বারটনের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, ঐ একইভাবে জর্জ বারটন মারা যান। সত্যি সত্যি তুমি ঐ সন্ধ্যায় লুক্সেমবার্গে ছিলে?
-হ্যাঁ, বারটন আমাকে ঐ পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি ওর মতো সময় দিতে পারি না। কারণ ও এমন একটা পরিকল্পনা করেছিল খুনীকে ধরার জন্য যেটা তিনি আমাকে পরিষ্কার করে জানাননি। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। তাঁকে তোমার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি।
রেস বলে চলে, এসব সত্ত্বেও আমি গতকাল ঐ রেস্তরাঁয় হাজির হয়েছিলাম। ওদের থেকে একটু দূরে আমার টেবিল ছিল। কেউ যেন আমাকে দেখতে না পায়, তাই এই ব্যবস্থা। টেবিলের ধারে ওয়েটারের দল আর বারটনের অতিথিদের দেখেছিলাম। কোনো সন্দেহজনক দৃশ্য বা ঘটনা আমার নজরে পড়েনি।
যাই হোক, তবে ওদের মধ্যে কেউ একজন বা ওয়েটার গিউসেজ বোলমানো হতে পারে। কেম্প বলে, ওর সঙ্গে সকালে দেখা করেছিলাম। ও লুক্সেমবার্গে বারো বছর ধরে চাকরি করছে। স্ত্রী, তিনটি সন্তান নিয়ে তার সংসার। সুনাম আছে যথেষ্ট। তাকে ঠিক সন্দেহ হয় না আমার।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখনো পর্যন্ত আমরা আশাব্যঞ্জক কোনো ফল হাতে পাইনি। হতে পারে জর্জ বারটন তাঁর স্ত্রীর খুনীকে অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং সেই খুনীকে ধরার জন্য জাল ফেলেছিলেন। কিন্তু খুনী সেটা আগেই টের পেয়ে যায় ফলে আর একটা খুন করে বসে।
তোমার অনুমানটি কিছুটা সত্যি, রেস বলে। তবে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, টেবিলের সামনে একটা চেয়ার খালি। মনে হয় আসনটি এমন কোনো একজনের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিলো যাকে আশা করা যায় না।
–তাহলে আমাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে পাঁচজনের নাম। প্রথমে আমাদের মিসেস বারটনের খুনীকে খুঁজে বের করতে হবে। পরবর্তী খুনের জের ধরে বলা যায় রোজমেরিও খুন হয়েছিলেন, আত্মহত্যা করেননি। অবশ্য পুলিশমহল অর্থাৎ আমরা এটাকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করেছিলাম। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় দশজনের মধ্যে নয়টি মেয়েই প্রেমঘটিত ব্যাপারে তাদের জীবনে সমাপ্তি টেনেছে। আর পুরুষরা বেশিরভাগ আর্থিক কারণে আত্মহত্যা করে থাকে।
–তাহলে তুমি দেখছি মিসেস বারটনের প্রেমঘটিত ব্যাপারে কিছু জানো। তার সেই প্রেমিকাটি কে? স্টিফেন ফ্যারাডে?
–হ্যাঁ, আর্লস কোর্টের একটি ফ্ল্যাটে তাদের দুজনকে গোপনে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। প্রায় ছমাস ধরে এই গোপন প্রেম চলে। মনে হয় তারপরেই তাদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে, সম্ভবতঃ ফ্যারাডে মিসেস বারটনের সান্নিধ্যে এসে একসময় ক্লান্তি বোধ করে। যার পরিণতি
-সান্দ্রা ফ্যারাডে কি এসব কিছুই জানতো না? রেস বললো, আমার মনে হয় সে জেনেও চেপে ছিল। কারণ তাহলে তাদের পরিবারের কলঙ্ক বাইরে প্রকাশ হয়ে যাবে।
–তাহলে দুজনকেই এক্ষেত্রে সন্দেহ করা যেতে পারে। কেম্প বলে। আচ্ছা, জর্জের সেক্রেটারি মিস রুথ লেসিং সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
-সে-ও হতে পারে। তবে জর্জের সঙ্গে মেয়েটির খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো বলা যেতে পারে। রুথ প্রায় বারটনের পরিবারের একজন। এবং জর্জ তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অবশ্য মিসেস বারটনের অন্য আরো ছেলে বন্ধু ছিল।
-তুমি কি তার সম্বন্ধে কিছু জানো? কেম্প বলে।
–বিশেষ কিছু নয়। আমেরিকান নাগরিক, তাই খুবই বেশি খবর জানা মুশকিল। প্রথমে এখানে সে ক্লারিজে থাকতো। পরে লর্ড ডিউসবারির বাড়িতে থাকে। আকর্ষণীয় চেহারা। মেয়েরা ওর সংস্পর্শে আসে সম্ভবতঃ ওর ঐ সুন্দর চেহারার জন্য।
একটুক্ষণ দুজনেই চুপ।
একসময় কে জিজ্ঞেস করে, জর্জ বারটনের পাওয়া চিঠিগুলো তুমি পড়ে দেখেছো?
-হ্যাঁ দেখেছি, গতকাল রাতে ওঁর বাড়িতে তদন্ত করতে গিয়ে চিঠিগুলো টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাই। সস্তার কাগজে, সাধারণ কালিতে লেখা, চিঠিগুলো টাইপ করা, মনে হয় বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান লোকের লেখা। চিঠিগুলোর ওপর জর্জ বারটন, এবং আইরিস মারলের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, সেগুলো সম্ভবত ডাক বিভাগের লোকেদের হবে।
–তাহলে ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু চিঠিগুলো যে লিখেছে সে কি নিজের হাতে লিখতে পারতো না?
-হ্যাঁ, পারতো। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?
–তার উদ্দেশ্য ছিলো আত্মহত্যাকে প্রাথমিক পর্যায়ে খুনের কেস হিসাবে চালিয়ে দেওয়া।
–তাহলে স্টিফেন ফ্যারাডেকে ফাঁসি কাঠে ঝোলানো যায়? এটা প্রথম দিকে ধারণা হয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, তাকে অভিযুক্ত করার পক্ষে তেমন জোরালো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
তা না হয় হলো। সায়ানাইডের কোনো প্যাকেট বা শিশি কি পাওয়া গেছে।
-হ্যাঁ, টেবিলের নিচ থেকে একটা সাদা প্যাকেট পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সায়ানাইডের ক্রিস্টাল ছিলো।
–গতকাল রাতে কেউ কিছু লক্ষ্য করেনি।
–আমি গতকাল রাতে প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জবানবন্দী নিয়েছিলাম। আজ আবার তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। তবে ঐ রেস্তরাঁয় ওদের দুপাশে যে টেবিল দুটি ছিলো তাদের থেকেও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা হলো জেরাল্ড টলিংটন, গ্রেনাডায়ার গার্ডস এবং অনারেবল প্যাট্রিসিয়া ব্রি-উডওয়ার্থ। এছাড়া মেক্সিকোর মিঃ পেড্রো মোরেলম এবং মিস ক্রিস্টিন স্যামনের ঠিাকানাও নিয়েছি। অবশ্য এ ব্যাপারে তারা কোনা আলোকপাত করতে পারবে না তবু যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায়।
.
৩.২
গিউসেজ বোলমানো ষোলো বছর ধরে শহরে আছে। মধ্য বয়স্ক লোক, বানরের মতো মুখ। তবে চোখে বুদ্ধির ছাপ। ভালো ইংরাজি বলে।
কেম্প তার কাছে গতকালের রাতের ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলে, ঐ টেবিলের লোকেদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল আমার। তাই ঘটনার কথা ভেবে মনে ভীষণ দুঃখ হয়। লোকে বলবে, এই লোকটাই জর্জ বারটনের মদের গ্লাসে বিষ ঢেলে দিয়েছে। জানি, এর পেছনে কোনো সত্যতা নেই, তবু লোকে বলবে। মিঃ গোল্ডস্টেন খুব ভালো লোক। আমাকে বলেছেন কয়েকদিনের জন্য লোকের দৃষ্টির অন্তরালে থাকতে। আমি যে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সেটা আমার কল্পনার অতীত। সত্যি, এটা আমার দুর্ভাগ্য।
কেম্প তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলো যে চার্লসের সঙ্গে মিঃ বারটন আগে থেকে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন ফরমাসের ব্যাপারে।
–টেবিলের সেই খালি চেয়ারটার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?
–মিঃ জর্জ বারটন আজ আমাকে বলেছিলেন সন্ধ্যার সময় ঐ আসনে একজন যুবতী মেয়ের আসার কথা আছে।
-যুবতী মেয়ে? কেম্প এবং রেস দুজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
-আচ্ছা, তুমি শেষ কখন মিঃ জর্জকে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দেখেছিলে বলতে পারো?
বলছি, গিউসেজ একটু ভেবে নিয়ে বললো, মিস আইরিস মারলের জন্মদিনের পার্টি উপলক্ষ্যে তারা শ্যাম্পেন পান করে নাচে যোগ দেন। তারপর ফিরে এসে শ্যাম্পেনে পরিপূর্ণ গ্লাসটি হাতে তুলে নেন। প্রত্যেকের গ্লাস শ্যাম্পেনে ভর্তি ছিল। মিঃ বারটন গ্লাসে চুমুক দেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে ঘটে যায় সেই মর্মান্তিক ঘটনা।
-ওরা যখন নাচ করছিল তখন অন্য কেউ টেবিলের সামনে এসেছিলো?
–না। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। গিউসেজ বলতে থাকেন, আমাদের নজর এড়িয়ে তার গ্লাসে বিষ মেশানো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়, স্যার, আমার ধারণা, মিঃ বারটন নিজেই বিষ নিয়ে থাকবেন গ্লাসে। গতবছরে তার স্ত্রীর মৃত্যুর আঘাত ভুলতে তিনি এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন হয়তো।
গিউসেজকে বিদায় জানিয়ে কেম্প ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে বারোটায় সময় ফিডার মিনস্টার যাওয়ার কথা। তার আগে টেবিলের লোকেদের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।
.
৩.৩
আমেরিকান ভদ্রলোক মিঃ মোরেলসকে পাওয়া গেল রিজে। তাঁর স্মরণশক্তি প্রখর। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় এমন কিছু তার নজরে পড়েনি, যেটা সন্দেহ করার মতো।
সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রেসকে সঙ্গে নিয়ে কেম্প এলো ব্রুক স্ট্রিটে।
জেনারেল লর্ড উডওয়ার্থ স্বনামধন্যা প্যাট্রিসিয়া ব্রিস উডওয়ার্থের পিতা। খিটখিটে মেজাজের ভদ্রলোক এবং স্পষ্টভাষী। এইরকম একটা বিশ্রী ব্যাপারে তার মেয়ের জড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেন সব জানে এমন তাদের ভাব। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি তার সলিসিটারের বিনা পরামর্শে মেয়েকে তাদের প্রশ্নের মুখে ছেড়ে দিতে নারাজ।
এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢুকলো মিস প্যাট্রিসিয়া ব্রিস উডওয়ার্থ।
-হ্যালো, আপনারা তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আসছেন তাই না? আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। গতকালের রাতের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন তাই তো? বাবা, তুমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত? কিন্তু ডাক্তারের কথা কি তোমার মনে নেই? আমি বরং ওঁদের নিয়ে আমার ঘরে যাচ্ছি।
প্যাট্রিসিয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলো সকলে। আলোচনা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে চললো। কিন্তু কথা বলে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না।
-সত্যি ব্যাপারটা ভাবলে অবাক হতে হয়। প্যাট্রিসিয়া বললো। এটা একটা খুন তাই না? কি আশ্চর্য দেখুন, চোখের সামনে খুন হলো, অথচ কিছু টের পেলাম না। ফোন করে মেরিকে জানিয়ে দিয়েছি যে এটা খুনের কেস।
–আপনার কিছু নজরে পড়েনি?
–না, তেমন কিছু মনে হয় না।
এরপর ওরা এলো ক্রিস্টিন স্যামনের কাছে। রীতিমতো সুন্দরী মহিলা। সোনালি চুল এলোমেলো হওয়ায় কপালে উড়ে আসছে। লালচে আঙুল দিয়ে বারে বারে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। ইনসপেক্টর কেম্প বলেছিল, ওর নাকি একটা দারুণ গুণ আছে, সেটা হলো বোবার অভিনয় করতে সে ওস্তাদ।
চীফ ইনসপেক্টর, আপনার যেমন খুশী প্রশ্ন করতে পারেন। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশী হবো।
মাঝের টেবিলের পার্টির লোকেদের গতিবিধি এবং আচরণ কি রকম ছিলো জানতে চাইলে ক্রিস্টিন অস্বাভাবিক ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করলো।
–ওদের চোখ-মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওরা যেন কোনো কঠিন ব্যাপারে মুখোমুখি হতে চলেছে। জর্জ বারটনের চেহারায় ছিল সংশয়, দ্বন্দ্ব এবং ভয়ের ছাপ। তার ডান পাশে যে লম্বা চেহারার মহিলাটি বসেছিল তার মুখটা পাথরের মতো কঠিন লাগছিল। তার বাঁ পাশের মেয়েটি যেন রাগে ফুঁসছিল, মনে হয় গভীর কালো চোখের যুবকটির পাশে বসতে না পারার জন্য। তার পাশে যে লম্বা চেহারার যুবকটি বসেছিল, তাকে মনে হচ্ছিল, পেটে ভীষণ যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাকে জোর করে খেতে আনা হয়েছে।
…সত্যি কথা বলতে কি তখন আমার মনটা ভালো ছিল না। আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তিনরাত্রি সমানে বাইরে কাটিয়ে ছিলাম। একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর লাগছিল। তাছাড়া আমার পুরুষ বন্ধু পেড্রো এমন একজন লোক যার সঙ্গ পাওয়ার জন্য মেক্সিকোর অনেক মেয়েই পাগল। বারবার যদি ওর মুখ থেকে অন্য মেয়ের নাম উচ্চারিত হয় তাহলে কোন মেয়ের মেজাজ ঠিক থাকে না। তাই আমি ওর কথায় কান না দিয়ে খেতে থাকি এবং খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।
তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকম প্রশ্ন করা হলো কিন্তু বিশেষ ফল পাওয়া গেল না।
–তাকে আপনি বলছেন, ওরা যখন নাচতে গিয়েছিল তখন ঐ টেবিলের সামনে কেউ আসেনি, মিঃ বারটনের গ্লাস কেউ স্পর্শ করেনি?
-না, কেউ নয়, অবশ্য একজন ওয়েটার ছাড়া।
–একজন ওয়েটার? কি নাম তার?
–এ্যাপ্রন, বয়স মনে হয় ষোলো-সতেরো হবে। সে হচ্ছে ওয়েটারের মতন, মনে হয় সে ইটালিয়ান, অতিরিক্ত বিনয়ীভাব তার ঐ বানরাকৃতি মুখে।
গিউসেজ বোলমানো তাহলে এই লোকটির কথা বলেছিল। দুজনের বর্ণনা প্রায় মিলে যাচ্ছে।
–ঐ ছেলেটি কি করেছিল?
–টেবিলের নিচে কোনো মহিলার সান্ধ্যভ্রমণের একটি ব্যাগ পড়েছিল। সেটা সে তুলে টেবিলে রেখে দিয়ে চলে যায়।
মিস স্যামন, ব্যাগটি কার বলে আপনার মনে হয়?
একটু থেমে তারপর বললো–সেই কম বয়েসের মেয়েটির হবে। সবুজ জমির ওপর সোনালি কাজ করা ছিলো। আমার পরিষ্কার মনে আছে অন্য দুজন মহিলার ব্যাগের রঙ ছিলো কালো।
–টেবিলের সামনে কে প্রথম ফিরে এসেছিল? ভালো করে ভেবে বলুন।
-সবুজ পোশাক পরা ঐ কিশোরী এবং সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তারপর একে একে টেবিলের সামনে এসে যে যার চেয়ারে বসে। তারপর ঐ পোঢ় ভদ্রলোকটি সকলের উদ্দেশ্যে কি যেন বক্তৃতা দিলো। এবং সকলে হাতে গ্লাস তুলে নিলো। তার কয়েক মুহর্ত পরেই সেই দুর্ঘটনা ঘটলো।
মিস স্যামনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেম্প ও কর্নেল ফিরে এলো।
প্রত্যেকের কাছে একই জবাব পাওয়া গেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সেখানে দেখার কিছু ছিল না, তাই তাদের নজরে পড়েনি। কিন্তু জর্জ বারটনের গ্লাস ভর্তি সায়ানাইড বিষ। বিষের তো হাত পা গজাবে না যে নিজে হেঁটে গিয়ে পড়বে। অতএব যে কোনো একজন এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এবার তাহলে সেই ওয়েটারের মতন ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে হয়। মনে হয়, এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই ছেলিটিই মিঃ বারটনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ ঢেলে দিয়ে থাকবে।
–সেইরকম একটা কিছু ঘটে থাকবে সেটা আমারও বিশ্বাস। তবে তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জোর গলায় বলতে পারি কেম্প, ওটা যে সায়ানাইডের গুঁড়ো ছিল সেটা সে জানতো না।
–অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে কেউ ওর হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়েছিল হজমের ওষুধ বা ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ বলে। তাহলে প্রশ্ন হলো কে বা কারা তার হাতে দিয়েছিল? ফ্যারাডে দম্পতিরা হয়তো নয়।
-না, ওদের কথা ভাবা অবান্তর।
-এ্যানথনি ব্রাউনকেও সন্দেহ করা যায় না। তাহলে বাকি রইলো মিঃ বারটনের শ্যালিকা এবং ওর সেক্রেটারি।
যাই হোক, আমি এখন ফিডারমিনস্টার হাউসে যাচ্ছি। তুমি নিশ্চয় মিস মারলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে? কেম্প জানতে চায়।
-হ্যাঁ, সেখানেই যাবো। তবে মিস মারলের অনুপস্থিতিতে সেখানে যাবো। সেখানে এমন একজন আছে যে তার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু বলতে পারবে। বলা যায় না, কাজে লাগাতে পারে।
.
৩.৪
জর্জ বারটনের অফিসের উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি করে কর্নেল রেস ছুটলো।
ওদিকে ফিডারমিনস্টার হাউসে এসে বেল টিপতে গিয়ে চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের মুখ কঠিন হয়ে উঠলো। ব্রিটিশ আইনের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছে। যদি দেখা যায় স্টিফেন এবং আলেকজান্ডার জর্জ বারটনের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত তাহলে মনে হয় না ফিডারমিনস্টার পুলিশ এবং বিচারকদের ওপর তার প্রভাব খাটাতে পারবেন। আর তারা যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের তদন্তের কাজ খুব সাবধানে করতে হবে নতুবা ওপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এইসব চিন্তা মনে আসতেই কেম্প আপাততঃ কি করণীয় সেটা ঠিক করে নিলো। পুলিশের লোকদের কথার জালে ফেলে কিভাবে বোকা বানাতে হয় সেটা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ লর্ড ফিডারমিনস্টার খুব ভালো করেই জানেন।
একজন বাটলার তাকে বাড়ির পেছনে একটা ঘরে নিয়ে এলো। লর্ড ফিডারমিনস্টার এবং তার মেয়ে-জামাইকে সেখানে দেখতে পেলো।
সান্দ্রার পরনে গাঢ় লাল রঙের পোশাক। শান্ত মুখের ওপর এসে পড়েছে এক টুকরো রোদ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, পবিত্র দেবকন্যা যেন।
ভাবলেশহীন মুখে স্টিফেন ফ্যারাডে তার পাশে বসে আছে। দৃষ্টি স্বাভাবিক তার।
–চীফ ইনসপেক্টর, আপনার কাছে আমি কোনো কিছুই গোপন করতে চাই না। লর্ড ফিডারমিনস্টার বলেন। একই রেস্তরাঁয়, একই পরিবারের দুজন লোক খুন হলো। এর সঙ্গে আমার মেয়ে-জামাই দুবারই জড়িয়ে পড়ে। এই কেস যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তার জন্য ওরা আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত।
-ধন্যবাদ লর্ড ফিডারমিনস্টার।
-আর একটা কথা চীফ ইনসপেক্টর। আমার বন্ধু কমিশনারের কাছ থেকে জানতে পারি, সেই প্রৌঢ় লোকটির আকস্মিক মৃত্যু হত্যাকাণ্ডজনিত, আত্মহত্যা নয়। তবে সান্দ্রা, তুমিও তো প্রথমে এটাকে আত্মহত্যা বলেই মনে করেছিলে, তাই না?
গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলো সান্দ্রা, চিন্তিত কণ্ঠে বলতে থাকে–হ্যাঁ, গত গ্রীষ্মকালের পর থেকে মিঃ বারটনের মধ্যে একটা স্বাভাবিক অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিলাম। আমরা তখন ধরে নিই যে তিনি স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুটা ভুলতে পারছেন না। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। তাই মনে হয় স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা ভোলার জন্য তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু একথা মনেই আসে না যে কেউ ওঁকে খুন করেছে।
স্টিফেন ফ্যারাডেও স্ত্রীর কথায় সায় দিলো।
–আপনারা আপনাদের ধারণা নিয়ে থাকুন, মনে মনে উচ্চারণ করলো চীফ ইনসপেক্টর কেম্প। কিন্তু মুখে বললো, লেডি আলেকজান্ডার আমার মনে হয় কয়েকটা ব্যাপার আপনি এখনো জানেন না। মৃত্যুর আগে জর্জ বারটন তার দুই বিশ্বাসী লোকের কাছে দুটি গোপন তথ্য প্রকাশ করে যান। তার স্ত্রী সেদিন রাতে আত্মহত্যা করেননি, তাক কেউ বিষ খাইয়ে খুন করেছে, এটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এটি হলো প্রথম তথ্য। আর দ্বিতীয়টি হলো, গতকাল লুক্সেমবার্গে মিস আইরিস মারলের জন্মদিন উপলক্ষে জর্জ বারটন যে নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন সেটার অন্তরালে ছিলো একটি উদ্দেশ্য সেটি হলো আড়াল থেকে তার স্ত্রীর খুনীকে সনাক্ত করা।
মুহূর্তের মধ্যে ঘরের মধ্যে একা নীরবতা নেমে এলো। তবে একটা কিছু গোপন করার প্রবণতা তাদের মনের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, সে ব্যাপারে কেম্প নিশ্চিত।
-কিন্তু মিঃ বারটনের মাথায় এমন একটা উদ্ভট চিন্তা নতুন করে উদয় হলো। স্টিফেন ফ্যারাডে বলে। বিশেষ করে মিসেস বারটন যখন আত্মহত্যা করেছিলেন।
–কিন্তু মিঃ বারটন সেটা মানেন না।
-কেন? লর্ড ফিডারমিনস্টার প্রশ্ন করেন। পুলিশ তো এটাকে আত্মহত্যা ছাড়া কিছু বলেনি। এরকম কোনো সন্দেহের কথা তারা প্রকাশ করেনি।
–কারণ পুলিশের হাতে কোনো প্রমাণ আসেনি, তাই তারা ঐরকম ধারণা করেছিল।
কেম্প দৃষ্টি ঘুরিয়ে এবার সরাসরি প্রশ্ন করে সান্দ্রাকে।
–মিসেস ফ্যারাডে, এক বছরে আপনি কোনো উড়ো চিঠি পেয়েছেন কিনা বলুন তো।
-উড়ো চিঠি? মুহূর্তের মধ্যে সান্দ্রার সুন্দর মুখ পাঁশুটে হয়ে ওঠে। মানে বেনামা চিঠি। না, সেরকম কোনো চিঠি আমি পাইনি।
–বেশ, এবার পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর খুব ভেবে দিন। জর্জ বারটনের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন?
–তার মনোভাবে ছিলো বন্ধুসুলভ, তিনি নিজে আমাদের বাড়ির কাছে বাড়ি কেনেন। তাঁর অনুরোধেই আমরা বাড়ি কেনার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।
-এবার বলুন, মিসেস বারটনের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক ছিলো?
–আমার সঙ্গে তেমন কিছু ছিল না। একটু ইতস্ততঃ করে মিসেস ফ্যারাডে বলে, বন্ধুত্বটা ছিল আমার স্বামীর সঙ্গে। অবশ্য আমার স্বামী যেহেতু একজন ভালো রাজনীতিবিদ, এবং রাজনীতির ব্যাপারে মিসেস বারটনের আগ্রহ ছিলো। ঐ একটা জায়গায় ওদের মিল ছিলো।
-আপনি ভীষণ চতুর মহিলা, মনে মনে কেম্প প্রশংসা না করে পারলো না। মুখে বললো, ওঁদের দুজনের সম্পর্ক সম্বন্ধে আপনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন জানি না, তবে একটা প্রশ্ন করি, মিঃ বারটন কি আপনাকে কখনো বলেননি, তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেননি।
-না, সেই কারণেই আমি বেশ অবাক হচ্ছি।
–আচ্ছা, লেডি আলেকজান্ডার, মিঃ এ্যানথনি ব্রাউন সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?
–তেমন কিছু নয়। ওর সঙ্গে বিশেষ আমার দেখা হয় না।
–মিসেস বারটনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিলো বলে আপনার মনে হয়?
–আমি ওঁদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশতে দেখেছি। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারি না।
স্টিফেন ফ্যারাডের কাছ থেকেও প্রশ্ন করে বিশেষ কোনো সুফল পাওয়া গেল না।
আরো দুএকটা প্রশ্ন করে কেম্প চলে এলো আসল প্রসঙ্গে।
এবার আমরা গতরাতের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। কথাটা বলে কেম্প তিনজনের মুখের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
বলা বাহুল্য গতরাত্রের বিয়োগান্তক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কেম্প প্রশ্ন রাখলো পরপর। তাদের মধ্যে কেউই বলতে পারলো না, সেই খালি চেয়ারটা আসলে কার জন্য নির্দিষ্ট করা ছিলো। তবে ফ্যারাডে দম্পতির কথা থেকে জানা যায়, ক্যাবারের পর ঘরের আনোগুলো নেভা মাত্র জর্জ নাকি সেই খালি চেয়ারের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য।
তবে বিভিন্নরকম প্রশ্নের মাধ্যমে কেম্প জানতে পেরেছে যে ফেয়ারহেভেনে আইরিসের জন্মদিনের ডিনার পার্টি সফল করার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য সান্দ্রাকে জর্জ অনুরোধ করে, সে এবং তার স্বামী যেন তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
কেম্প এবার ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো–মিঃ ফ্যারাডে, একসময় আপনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করবেন। আপনাকে জানিয়ে দেবো কখন আমি আবার আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবো।
কেম্প বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো, স্টিফেনও জরুরী কাজ আছে বলে সেখান থেকে চলে গেল।
লর্ড ফিডারমিনস্টার কোনো দ্বিধা না করে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, মিসেস বারটনের সঙ্গে স্টিফেনের কি কোনো গোপন সম্পর্ক ছিলো বলে তোমার মনে হয় সান্দ্রা?
সান্দ্রা একই উত্তর দিলো–এ ব্যাপারে সে কিছু জানে না। সেরকম কিছু হলে সে নিশ্চয়ই টের পেতো।
লর্ড ফিডারমিনস্টার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি এবার স্ত্রীর ঘরে এসে ঢুকলেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
-তোমার মুখে সব শুনে যা বুঝতে পারছি যে একজন খুনীকে আমরা আমাদের পরিবারে গ্রহণ করেছি। তাই তো? লেডি ফিডারমিনস্টার বললেন।
-জানি না। এই মুহূর্তে এককথায় তার বিরুদ্ধে এ মন্তব্য করতে পারছি না। পুলিশের ধারণা মিসেস বারটনের সঙ্গে স্টিফেনের নিশ্চয়ই কোনো অভেদ সম্পর্ক ছিলো। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তার জন্যই মিসেস বারটন আত্মহত্যা করেছে নয়তো সে। সে যাই হোক, মিঃ বারটন দারুণ কঠোর প্রকৃতির লোক। তিনি তার স্ত্রীর কেচ্ছা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য আয়োজন করেছিলেন। আমার ধারণা, স্টিফেন স্বাভাবিক কারণেই সেই ব্যবস্থাটা মনে নিতে না পেরে– যাই হোক, অন্যায় যদি সে করেই থাকে, তাহলেও তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
দায়িত্ব। তুমি এসব কি বলছো?
–হ্যাঁ, ওদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। যেভাবেই হোক আইনের বেড়াজাল ছিঁড়ে ওদের উদ্ধার করতে হবে। আর সে দায়িত্ব তোমার।
তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমার মেয়ে খুনী হলেও আমার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে তাকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার মান-সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে।
–আর সান্দ্রা গ্রেপ্তার হলে, তার বিচার হলে, তুমি নিশ্চয়ই একজন দামি ব্যারিস্টার হবে।
নিশ্চয়ই, সেটা আলাদা ব্যাপার। তোমার মেয়ে কেন যে সেটা বুঝতে চায় না।
নীরব হলেন লেডি ফিডারমিনস্টার। কি করে বোঝাবেন তিনি, ছেলেমেয়েদের স্বার্থে যে কোনো অপ্রিয় কাজ করতে দ্বিধা হওয়া উচিত নয় কোনো বাবা-মার।
লর্ড ফিডারমিনস্টার বললেন, আমি বিশ্বাস করি না, সান্দ্রা খুন করেছে। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার জন্য বলতে থাকেন, যাই হোক নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকলে সান্দ্রার বিরুদ্ধে যাতে কোনো অভিযোগ দায়ের না হয় সেদিকটা আমি অবশ্যই দেখবো।
.
৩.৫
কর্নেল রেস যখন অফিসে এসে ঢুকলো তখন রুথ লেসিং একটা বড় ডেস্কের ওপর স্তূপাকারে কাগজের মধ্যে ডুবে ছিলো। পরনে কালো কোট, চোখের কোণে কালো কালি। হাজার চেষ্টাতেও সেটা ঢাকা পড়েনি।
–আপনি এসে ভালো করেছেন, রুথ বলে। আপনার পরিচয় আমি জানি। গতকাল সন্ধ্যায় ডিনার পার্টিতে চেয়ারে বসার পর মিঃ বারটন আপনার কথা বলতে একটু অবাক হয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত আসবেন তো? কারণ গত বছর রোজমেরির জন্মদিনের পার্টিতেও আপনার আসার কথা ছিলো, কিন্তু আপনি আসেননি।
-কিন্তু আপনি তো এসেছিলেন?
–নিশ্চয়ই। রুথ মনে হয় একটু আঘাত পেলো। তাছাড়া ওটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে।
–আপনার ওপর জর্জ যে নির্ভরশীল সেটা তার কাছ থেকে আমি শুনেছি।
মেয়েটির ভাবভঙ্গী দেখে রেসের মনে হয়, ও নির্দোষ। অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে।
রুথ ওর দিকে তাকিয়ে বললোহা, আট বছর ধরে ওঁর কাছে কাজ করছি। আপনার সঙ্গে কয়েকটি জরুরী কথা ছিলো। চলুন বাইরে কোথায় মধ্যাহ্ন ভোজন করা যাক। সেসময় কথা বলা যাবে।
রেস্তরাঁর বয়কে খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনে বসলো।
–চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে নিশ্চয়ই।
কর্নেল রেস প্রশ্ন করলো।
-হ্যাঁ, গতরাতে দেখা হয়েছে। চতুর এবং অভিজ্ঞ ভদ্রলোক। একটু চুপ করে থেকে রুথ বলে, আপনার কি মনে হয় সত্যিই তিনি খুন হয়েছেন?
–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি বোধহয় একটু সংশয়ের মধ্যে আছেন যে এটি খুন না আত্মহত্যা, রেস তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনি গতকাল মিঃ বারটনের সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলেন। ওঁকে কি স্বাভাবিক বা উত্তেজিত কিংবা চিন্তিত মনে হয়েছিল আপনার?
-বলা মুশকিল। তবে একটু নিশ্চিন্ত দেখেছিলাম।
রুথ ভিক্টর ড্রেকের ব্যাপারটা সবিস্তারে জানালো। তারপর বললো, সেদিন মিসেস ড্রেকের চোখেও জল দেখেছিলাম। কিন্তু মিঃ বারটনকে ওভাবে ভেঙে পড়তে কখনো দেখিনি, তাই আমার মনে হয়েছিল–
-বলুন, কি মনে হয়েছিল–
–গত বছর ভিক্টর ড্রেককে দক্ষিণ-আমেরিকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন মিঃ বারটন। এর আগেও অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, মিঃ বারটন রেগে গেছেন, বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু সেদিনের রাগ ছিল অন্যরকম। গত জুন মাসে একটা টেলিগ্রাম আসে, ভিক্টর তিনশো পাউন্ড দাবি করে। অথচ পরের দিনই ডিনারের পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ফলে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এছাড়া টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু এমন বিশ্রী ধরনের ছিলো যে তাকে অত্যন্ত খারাপ দেখাচ্ছিল।
এবার রুথ প্রশ্ন করলো–আপনি কি মনে করেন গতবছর যে পার্টির দিনে মিসেস বারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এটা তারই পুনরাবৃত্তি।
-হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিক, তবে জর্জ এ ব্যাপারে আপনাকে সবকিছু খুলে জানায়নি বা যে কোনো কারণেই হোক ব্যাপারটা আপনার কাছে গোপন রেখেছিলেন। কারণ তার বিশ্বাস ছিলো, তার স্ত্রী খুন হয়েছেন।
–কেন, আপনি জানেন না, জর্জ কতগুলি বেনামি চিঠি পেয়েছিলেন?
–না, এ সবের কিছুই জানি না।
রেস ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো, আপনি কি এখনও বলবেন এটা খুন নয়, আত্মহত্যা? ওঁরা দুজনেই আত্মহত্যা করেছেন?
রুথ ভুরু কুঁচকে বলে, এছাড়া কি আর ভাবতে পারি? স্বাভাবিক ভাবে এটাই তো মনে আসে।
একটু চুপ করে থেকে রুথ বলতে থাকে, তবে মিসেস বারটন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ওঠার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। দুর্ঘটনার দিন তার মাথার যন্ত্রণায় তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, আমি তখন ক্লোক রুমের বাইরে ছিলাম। লেডি আলেকজান্ডারকে তিনি মাথার যন্ত্রণার কথা বলছিলেন। মিসেস ফ্যারাডে হাত ব্যাগ থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে মিসেস বারটনকে দেন।
কর্নেল রেস নির্বাক হয়ে শুনতে থাকে–তিনি সেটা দিলেন?
–হ্যাঁ দিলেন বৈকি।
তাহলে এ কাজ সান্দ্রার। টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে মিসেস বারটনের গ্লাসের নাগাল পাওয়া তার পক্ষে কষ্টকর ছিলো না। তাই সে বিশেষ ট্যাবলেট ব্যবহার করে, পরে যেটা মিসেস বারটন তার শ্যাম্পেনের গ্লাসে ফেলে দিয়েছিলেন। অবশ্য এ সবই অনুমান হতে পারে।
-ও হ্যাঁ, রুথ বলে ওঠে, মনে পড়েছে, কেন তিনি চিঠিগুলোর কথা আমাদের বলেননি বা ফ্যারাডেদের বাড়ির কাছে বাড়ি কিনেছিলেন কেন? আসলে তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তার ধারণা ছিল আমাদের মধ্যে কেউ একজন তার স্ত্রীর হত্যাকারী।
-কেন, আপনার দিক থেকে কোনো কারণ আছে রোজমেরিকে খুন করার ব্যাপারে?
এরকম কঠিন একটা প্রশ্নের সামনে পড়ে রুথ একটু ঘাবড়ে গেল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, সে তো আপনিই ভালো জানেন। জর্জকে আমি ভালোবাসতাম। তিনিও আমাকে ভালোবাসতেন তবে আমার মতো নয়। রোজমেরির আগে আমি ওঁকে ভালোবাসি। আমার মনে হতো, আমি ওঁর আদর্শ স্ত্রী হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু তিনি রোজমেরিকে ভীষণ ভালোবাসতেন, তবু তিনি অসুখী ছিলেন।
..সবাই বলতো, রোজমেরি আকর্ষণীয়, সুন্দরী। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করতাম না। তার মৃত্যুর খবরটা আমাকে দুঃখ দিয়েছিলো বটে তবে আমার মন দুঃখে ভরে যায়নি। তাই মনে হয় ওঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমি খুশী হয়েছিলাম।
–আচ্ছা মিস লেসিং, এমন তো হতে পারে, বাইরের কেউ গোপনে জর্জের গ্লাসে সায়ানাইড মিশিয়ে সরে পড়েছিল। গতকাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করুন, মিস লেসিং।
হঠাৎ রুথের মুখের রঙ পাল্টে গেল। কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় বললোনা, কিছুই মনে পড়ছে না।
জর্জ কি তবে জানতে পেরেছিলেন কে ঐ চিঠি পাঠিয়েছিল? তার উদ্দেশ্য কি ছিল? তাই কি জর্জ খুনীকে ধরার জন্য গতকাল ফাঁদ পেতেছিলেন? আর সে জন্যই কি রুথ তার মুখ চিরজীবনের মতো বন্ধ করে দিলো?
সঙ্গে সঙ্গে রেস একথাও ভাবে, না রুথ ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে নয়। জর্জের থেকে সে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে। প্রয়োজন হলে সে অনায়াসে সেই ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারতো?
অতএব রুথের নাম সন্দেহের তালিকা থেকে আপাততঃ বাদ দেওয়া যেতে পারে।
.
৩.৬
কর্নেল রেসকে দেখে লুসিলা ড্রেক চোখের জলে রুমাল ভিজিয়ে দিলেন। জর্জ বারটন ছিলেন বাড়ির কর্তা। তার মৃত্যুর পর বাড়িতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে আর কেউ নেই। দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক?
মিসেস ড্রেক চেয়েছিলেন এই গ্রীষ্মে আইরিস যেন জর্জের দেখাশুনা করার ভার নেয়। কিন্তু সে নিজেই যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এ বাড়িতে, তার রক্তহীন সাদা মুখ দেখে মনে হয় সব সময় যেন সে ভয়ে সিটিয়ে আছে।
এরপরে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র ভিক্টর ড্রেকের গুণকীর্তন শোনালেন।
তারপ তিনি ফিরে এলেন অন্য প্রসঙ্গে। রোজমেরির মৃত্যু এবং তার উইলে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে যাওয়াটা বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। অবশ্য টাকাটাই সব নয়। বেচারি রোজমেরির সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর স্মৃতি আজও কেউ ভুলতে পারেনি। এমন কি আইরিসের ব্যাপারেও তিনি চিন্তিত।
রেস তার দিকে কৌতূহলী দৃটিতে তাকায়।
-রোজমেরির বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী যে আইরিস, এটা এখন সবাই জানে। তাই আমি আইরিসের যুবক বন্ধুদের প্রতি কড়া নজর রাখি ভয়ে ভয়ে। অথচ তাদের বাড়িতে আসতে বললে আসবে না, জর্জও আইরিসের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলো। তাই তো আইরিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ্যানথনি ব্রাউনকে ঠিক পছন্দ করতেন না।
এমন সময় দরজায় মদু আওয়াজ হলো।
কর্নেল রেস সেদিকে তাকালো। মিস আইরিস মারলে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে একটা উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। তার শান্তশিষ্ট চেহারাটা। সেই উত্তেজনাকে কিছুতেই আড়াল করতে পারছে না।
-প্রিয় আইরিস, তুমি এসে গেছো? লুসিলা বললেন, তুমি কর্নেল রেসকে চেনো। ভারী চমৎকার লোক।
আইরিস এগিয়ে এসে রেসের সঙ্গে করমর্দন করে।
–আপনাদের কোনো সাহায্যে যদি লাগতে পারি, সেইজন্যই আমার আসা।
–আপনার মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ। আইরিস বললো, আপনারা কি নিয়ে যেন আলোচনা করছিলেন?
লুসিলা করুণ চোখে তাকালেন। তিনি যে আইরিসের কাছে ব্রাউনের প্রসঙ্গ চাপা দিতে চাইছেন সেটা বুঝতে রেসের দেরি হলো না।
আইরিস ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি টেনে বললো, আমার ধারণা, আপনারা বোধহয় এ্যানথনি ব্রাউনকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
–হ্যাঁ, লুসিলা এবার জবাব দিলেন, তার সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না এই কথাই আমি বলছিলাম।
আমি তাকে খুব শীগগির বিয়ে করতে যচ্ছি, অতএব পরে অনেক কিছু জানার সুযোগ পাবো।
-ওঃ আইরিস, তোমার কি হয়েছে বলো তো? এখনও জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়নি। তুমি বারবার এ কঠিন কথা বলছো কেন?
আমি দুঃখিত। ক্লান্ত স্বরে আইরিস বলে।
এ প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার জন্য কর্নেল রেস বলে উঠলো–মিস মারলে, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো আমার।
আইরিস অবাক চোখে তাকালো তার দিকে। তারপর বললো–আসুন।
একটা ছোট ঘরে তারা এসে বসলো।
কয়েক মুহূর্ত রেসের দিকে তাকিয়ে থেকে আইরিস বললোগতকাল আমাদের পার্টিতে আপনি এলেন না কেন। জর্জ আপনাকে আশা করেছিল।
-না, আমি জানি, জর্জ আমাকে আশা করতে পারে না। কারণ তিনি বেশ ভালো ভাবেই জানতেন, আমি আসছি না।
-তাহলে ঐ খালি চেয়ারটা? ওটা কার জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল কর্নেল রেস?
–আমার জন্য নয় এটা বলতে পারি।
–তাহলে কি ঐ খালি চেয়ারটা রোজমেরির জন্য নির্দিষ্ট ছিল? হ্যাঁ, রোজমেরি।
আইরিস কথা বলতে বলতে জোরে জোরে শ্বাস নেয়–ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। ঐ চিঠিগুলোই জর্জের মনে বিশ্বাস এনে দিয়েছিল যে রোজমেরি আত্মহত্যা করেনি। সেইজন্য সে গতকাল রাতে পার্টির ব্যবস্থা করেছিল।
…আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয় রোজমেরি আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার যতদূর মনে হয়, কতকাল জর্জ রোজমেরির স্বাস্থ্য পান করেছিল। তারপর সে মারা যায়। খুব সম্ভব রোজমেরি এসে তাকে নিয়ে যায়।
কিন্তু মৃত ব্যক্তির আত্মা শ্যাম্পেনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ মেশাতে পারে না মিস মারলে।
–জর্জ খুন হয়েছে। পুলিশের ধারণা এইরকম। কারণ অন্য কিছু ভাবা যায় না। কিন্তু রোজমেরি খুন হয়নি। সেই কারণেই এটা অবান্তর। রোজমেরি যে আত্মহত্যা করেছিলেন, তার স্বপক্ষে প্রমাণ আছে যথেষ্ট। আমি আসছি।
আইরিস ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে কর্নেলের হাতে একটা ভাঁজ করা চিঠি দিলো।
-এটা পড়লেই সব বুঝতে পারবেন।
দুবার চিঠিটা পড়লো কর্নেল, প্রিয়তম লিওপার্ড।
চিঠিটা ফেরত দিয়ে রেস বললো-কার উদ্দেশ্যে চিঠিটা লিখেছিলেন আপনি জানেন?
স্টিফেন ফ্যারাডেকে। রোজমেরি তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু স্টিফেন তার সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাই মনে হয় সেদিন সবার সামনে সে তার নিজের জীবনকে নষ্ট করে দেয়। তার একটা পুরোনো ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে প্রায় ছমাস আগের চিঠিটা পেয়েছিলাম। জর্জকে জানাতে সাহস হয়নি। কারণ জর্জের বিশ্বাস ছিলো, রোজমেরি জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ভালোবেসে গিয়েছিল। তাই তো আমি তার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে চাইনি। তবে আপনি জর্জের বন্ধু, চীফ ইনসপেক্টর কেম্প আপনার বন্ধু। আপনাদের ব্যাপারটা জানানোর জন্যই চিঠিটা দেখালাম।
–এটা একটা প্রমাণপত্র বুঝলেন? চিঠিটা আমাকে দিলে ভালো হয়।
চিঠিটা কর্নেলের হাতে তুলে দিলো আইরিস।
.
৩.৭
কর্নেল রেসকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো মেরি ব্রিজ ট্যালবট।
প্রিয় বন্ধু, কি খবর তোমার? সেই যে এলাহাবাদ থেকে পালালে আর দেখা পেলাম না। নিশ্চয়ই কোনো কারণে আবার আবির্ভূত হয়েছে।
রেস হাসলো, বললো-যে পরিচারিকাটি আমাকে তোমার কাছে দিয়ে গেল সে-ই বেটি আর্কডেল?
-হ্যাঁ, তবে বলো না যেন ও একজন গুপ্তচর কিংবা রাজনৈতিক—
না না, সেরকম কিছু নয়।
এমন সময় হুইস্কির ট্রে হাতে বেটি আর্কডেল ঘরে এসে ঢুকলো, মিসেস ব্রিজ ট্যালবট তাকে বললো, তোমাকে কর্নেল রেস কিছু জিজ্ঞাসা করতে চায়। ঠিক ঠিক উত্তর দিও।
সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–তুমি তো মিঃ জর্জ বারটনের বাড়িতে কাজ করতে। আজকের কাগজটা পড়েছো?
-হ্যাঁ, পড়েছি। কি রকম আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই জায়গায় মারা যান। আমি মিসেস বারটনের মৃত্যুর পর সেখান থেকে চলে আসি। তবে সত্যি বলছি স্যার, মিসেস বারটনের আত্মহত্যার কথা আমি ভাবতে পারি না।
-কেন, একথা বলছো? তুমি এমন কোনো খবর জানো নিশ্চয়ই যেটা আমাদের কাজে হয়তো খুব জরুরী হতে পারে।
বেটি একটু ইতস্ততঃ করে বললো–এরকম ধারণা হওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে। সেদিন মিসেস বারটনের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। আমি তার ঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। এ্যানথনি ব্রাউন, যেটা তার আসল নাম নয়, তার সঙ্গে তিনি তখন কথা বলছিলেন। লোকটির যেমন ভদ্র চেহারা তেমনি নম্র কথাবার্তা। সে নিচু গলায় মিসেস বারটনকে কি যেন বললো। তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে একটা বিশ্রী কথা বললো যেটা তার মুখ থেকে আশা করা যায় না। তার কথামতো কাজ না করলে মিসেস বারটনকে খতম করে দেবে। পরক্ষণেই সিঁড়ি দিয়ে মিস আইরিসকে আসতে দেখে আমি সেখান থেকে চলে যাই। এই প্রথম আপনাকে আমি কথাটা বললাম।
তুমি কি লোকটির আসল নাম বলতে শুনেছিলে?
–ব্রাউনকে বলতে শুনেছিলাম, টনির কথাও ভুলে যাও। টনি কিন্তু সম্পূর্ণ নামটা বলতে পারবে না। চেরী জ্যাম প্রস্তুতকারকরা বলতে পারবে।
-ঠিক আছে। মনে পড়লে আমাকে খবর দিয়ো। একটা ঠিকানা লেখা কার্ড এবং এক পাউন্ডের একটা নোট রেস তার হাতে তুলে দিলো।
বেটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মেরি ব্রিজ ট্যালবট ঘরে এসে ঢুকলো। চেরী জ্যাম তৈরি করতে কি কি উপকরণ লাগবে রেস তার কাছে জানতে চাইলো। উত্তরে জানতে পারলো যে চেরী জ্যাম মিহি করতে হলে মোরেলো চেরীজ অবশ্যই লাগবে।
ঠিক নামটা তাহলে খুঁজে পেয়েছে কর্নেল। সে ওখান থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলো। দেখলো বেটি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
–আচ্ছা তার নাম কি টনি মোরেলো ছিল?
-হা হা, ব্রাউনকে বলতে শুনেছি, মিসেস বারটন যেন ঐ নামটা ভুলে যান। ব্রাউন একথাও বলেছিল যে সে জেলও খেটেছে।
একটু হেসে কর্নেল ওখান থেকে চলে এলো, কাছাকাছি পাবলিক টেলিফোন বুথে ঢুকে কেম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
.
৩.৮
প্রায় আধঘণ্টা পরে ভীত সন্ত্রস্ত ষোলো বছরের এক ওয়েটারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে চীফ ইনসপেক্টর কেম্প বিরক্ত হয়ে ওঠেন। লুক্সেমবার্গ রেস্তরাঁর ছেলেটি তার কাকা চার্লসের সৌজন্যে চাকরিটা পায়। তার কাজে ছিলো না ক্লান্তি, ছিল না কোনো অভাব অভিযোগ। খুব শীগগির তার পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মিঃ জর্জ বারটনের খুনের ব্যাপারে পুলিশ তাকে সন্দেহ করে।
-বিশ্বাস করুন আপনি, ছেলেটি বলে। পাশের টেবিলে মঁসিয়ে রবার্ট সসের জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। সসের শিশি নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যেতে চোখে পড়লো একটা লেডিজ ব্যাগ মেঝের ওপর মিঃ বারটনের টেবিলের সামনে পড়ে আছে। আমি ঐ টেবিলে খাবার দিতে গিয়ে দেখেছিলাম ব্যাগটা মিস মারলের হাতে। তাই তাড়াহুড়োতে মিস মারলের চেয়ার ভেবে ব্যাগটা হয়তো ভুল করে অন্য কোথাও রেখে থাকবো। অন্য কোনো মতলব আমার ছিলো না।
কেম্প তাকে সাবধান করে দিলো–ভবিষ্যতে যেন এরকম ভুল হয়।
সার্জেন্ট পোলক তাকে জানালো, লুক্সেমবার্গের মিঃ বারটনের রহস্যজনক মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু বলার জন্য মিস কেলা ওয়েস্ট দেখা করতে চায়।
দূর থেকে মিস কেলা ওয়েস্টকে দেখে কেম্পের মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছে। পরিচিত মনে হচ্ছে? ভদ্রমহিলা সামনে আসতে তার ভুল ভাঙলো।
গতকাল রাতে লুক্সেমবার্গে একজন লোক মারা গেছেন, কাগজে পড়লাম মিঃ জর্জ বারটন। অবশ্য ভদ্রলোককে আমি আদৌ চিনি না।
-তাহলে?
-শুনুন ইনসপেক্টর কেম্প, স্পটলাইটে আমার ছবিসহ নাম ঠিকানা ছাপানো হয়। ঐ ছবিটা মিঃ ববারটনকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি আমাকে যোগাযোগ করে বলেছিলেন যে লুক্সেমবার্গে একটা ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করেছেন। ঐ পার্টিতে একটা দারুণ চমক দিতে চান। তারপর একটা ছবি আমাকে দেখিয়ে বলেন, এই ছবির সঙ্গে আপনার অদ্ভুত মিল আছে, একটু আধটু অমিল যেটা আছে সেটা মেক-আপ করে পার্টিতে যেতে বলেন।
হ্যাঁ ঠিকই রোজমেরির ফটোর সঙ্গে এই তরুণীর অদ্ভুত একটা মিল আছে। কেম্প মনে মনে ভাবলো।
-কিন্তু আপনি গতকাল রাতে ঐ পার্টিতে এলেন না কেন?
–গতকাল রাত আটটার সময় মিঃ বারটন বা অন্য কেউ আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল, পার্টি বাতিল করা হয়েছে। পরের দিন আমাকে খবর দেওয়া হবে। অথচ আজ সকালেই কাগজ দেখে চমকে উঠলাম।
মিস ওয়েস্ট বিদায় নিলো।
এবার সার্জেন্ট প্রশ্ন করলো–কে ওঁকে পার্টিতে আসতে বারণ করেছিলো বলে আপনার মনে হয়?
–সেটা কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর?
তা মনে হয় না। তবে ফোনে দ্রুত কথা বললে গলার স্বর চেনা দুষ্কর হয়ে ওঠে।
.
৩.৯
দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্টিফেন ফ্যারাডে চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের ঘরে এসে ঢুকলো। তার পাশে বসে আছে একজন ইউনিফর্ম পরা লোক, যার হাতে প্যাড আর পেনসিল।
মিঃ ফ্যারাডে, আজ আপনাকে ডেকেছি আপনার জবানবন্দী নেওয়ার জন্য, তারপর ওটা আপনি সই করে দেবেন। আপনি মনে করলে আপনার সলিসিটারের সামনেও দিতে পারেন।
–আমি বুঝতে পারছি না, আমার নতুন করে জবানবন্দী নেওয়ার কি আছে।
-হ্যাঁ, এর আগে যেটা নিয়েছিলাম সেটা একটা প্রাথমিক মামুলি আলোচনা মাত্র। তাছাড়া মিঃ ফ্যারাডে, এ কেসের ব্যাপারে আপনারও কিছু জানার থাকতে পারে।
এবার টাইপ করা একটি চিঠির নকল কেম্প তার হাতে দিয়ে বলে-পড়ে দেখুন। মিসেস বারটনের পোশাকের মধ্যে থেকে এই চিঠি পাওয়া যায়। মিস আইরিস মারলের কাছ থেকে চিঠিটা আমরা পাই। আপনি নিশ্চয়ই এবার অস্বীকার করবেন না, মিসেস রোজমেরির সঙ্গে আপনার কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিলো না।
চিঠিটার ওপর চোখ রাখে স্টিফেন।
-এটা যে আমাকে লেখা হয়েছে তার কোনো উল্লেখ নেই। প্রতিবাদ করে ওঠে স্টিফেন।
–আর্লস কোর্টের ২১, ম্যালাড ম্যানসনের জন্য আপনি একসময় ভাড়া গুণে যেতেন তাই নয় কি?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, প্রথমে মিসেস বারটনের সঙ্গে প্রেম করি এবং পরে তাকে খুন করি। কিন্তু পুলিশের রিপোর্টে, এটি আত্মহত্যা হিসাবে অভিযুক্ত হয়েছে।
–কিন্তু মিঃ বারটন সেটা মেনে নেননি। তাই তিনি নিজেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছিলেন।
এবার কেম্প অন্য প্রশ্ন করলো–আচ্ছা মিঃ ফ্যারাডে, আপনার স্ত্রী কি এসব ব্যাপার জানতেন?
-না, নিশ্চয়ই না।
–আপনি কি কখনো সায়ানাইড ব্যবহার করতেন? মানে ফটোগ্রাফির কাজে লাগানোর জন্য?
-না, একেবারেই নয়। কারণ ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার মোটেই ধারণা নেই।
তখনকার মতো স্টিফেন ফ্যারাডেকে বিদায় দিলো কেম্প।
কেম্প এবার তার সহকারীর উদ্দেশ্যে বলে-কর্নেল রেস যেভাবে এ কেসের ব্যাপারে এগোচ্ছেন, তার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে ফ্যারাডে দম্পতিকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
.
৩.১০
এ্যানথনি ব্রাউনের ঘরে এসে ঢুকলো কর্নেল রেস। অস্বাভাবিক লম্বা চেহারা, ধূসর লোহা রঙের চুল, মুখটা যেন ব্রোঞ্জে খোদাই করা।
-কর্নেল রেস গতকাল রাতে আপনি এক বিশেষ অতিথি ছিলেন, কিন্তু আপনি এলেন না। বারটন বলেছিল—
না, ঐ খালি চেয়ারটা আমার জন্য ছিলো না। রেস বলতে থাকে। জর্জের পরিকল্পনা ছিলো অন্যরকম। ক্লো ওয়েস্ট নামের এক অভিনেত্রীর জন্য ঐ চেয়ারটা ছিলো।
এ্যানথনি ব্রাউন বিস্মিত হলো।
–একজন নবাগতা অভিনেত্রী যার চেহারার এবং মুখের সঙ্গে মিসেস বারটনের দারুণ মিল আছে। তাকে রোজমেরির একটা ফটো দেওয়া হয়। এমন কি মৃত্যুর দিন তিনি যে পোশাক পরেছিলেন সেই পোশাক তাকে গতকাল রাতে পরার জন্য দেওয়া হয়। তার মানে জর্জের পরিকল্পনা ছিলো, মিসেস রোজমেরির প্রেতাত্মার অভিনয় করিয়ে সেদিনের প্রকৃত ঘটনার আলোকপাত করা।
-কর্নেল রেস না হেসে পারছি না। আমি অনুভব করি, বেচারা রোজমেরির আত্মা অমন যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবার নয়।
-কেন, একথা বলছেন?
–তিনি খুন হয়েছিলেন, আত্মহত্যা নয়।
তাকে মৃত্যু ভয় দেখানো হয়েছিল, এটাও বলা যেতে পারে? মিঃ ব্রাউন আপনি কি টনি মোরেলোর খবর জানেন?
এ্যানথনির মুখ শুকিয়ে যায়। সে চেয়ারে বসে পড়ে। সে আস্তে আস্তে বলে, আপনি জানলেন কি করে? আমার এই গোপন পরিচয় আপনি আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন নিশ্চয়ই?
সে যাই হোক, আপনার আসল নাম টনি মোরেলো কিনা বলুন? আর মিসেস বারটন আপনার গোপন পরিচয় জেনে ফেলেছিলেন বলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেন। কি, আমি ঠিক বলছি তো?
–আমি তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য একথা বলেছিলাম। টনি খোলখুলি স্বীকার করলো।
এত সহজে যে কাজ হাসিল হবে সেটা ভাবতে পারেনি রেস। তবু তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বললো, আপনার সম্বন্ধে সব কিছু জানি আমি, মিঃ মোরেলো।
বড়ই দুর্ভাগ্য তাহলে আমার। এ্যানথনি ব্যঙ্গ করে বলে, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে এরিকসন এরোপ্লেনে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার জন্য আমার যে শাস্তি হিসাবে জেল হয়েছিল সেটা মিসেস বারটন জানতেন বলে তাকে আমি খুন করি। তারপর জর্জ বারটন আমাকে সন্দেহ করতেন বলে তাকেও আমি খুন করি? তারপর বিরাট ধন সম্পত্তির লোভে এবার খুন করার চেষ্টায় আছি মিস আইরিস মারলেকে, তাই তো? কিন্তু এসবের কোনো প্রমাণ আপনার হাতে নেই।
–আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে আপনাকেই দোষী হিসাবে সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গে এখন কথা বলে আমার সে ধারণা পাল্টে গেছে। আপনি আমাদের বন্ধু। খুন আপনি করতে পারেন না।
এক বুক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো মিঃ ব্রাউন। মুখে হাসি ফুটলো।
-এবার বলুন মিঃ ব্রাউন, মিঃ এবং মিসেস বারটনকে কারা খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়?
-কে বা কারা তাদের খুন করতে পারে এরকম কোনো ধারণা আমার নেই। যদি সন্দেহ করতে হয় তাহলে গতকাল পার্টির সকলকে দোষী মনে করতে হয়। তবে মিস রুথ লেসিংকে আমার সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়।
–এরকম সন্দেহর মূলে কোনো কারণ আছে?
-না, তবে তাকেই আমার সম্ভাব্য খুনী বলে মনে হয়। অবশ্য দুটি ব্যাপারের ক্ষেত্রে সে এমন একটা জায়গায় বসেছিল যে সেখান থেকে ওঁদের শ্যাম্পেনের গ্লাসে সায়ানাইড মেশানো অসম্ভব। এদিক থেকে বিচার করলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ওঁরা আত্মহত্যা করেছিলেন। তবে যখন ওদের কথা মনে ভাবি, একান্তে বসে নিজের মনে আলোচনা করি, ঐ বেনামী চিঠিগুলো কে লিখেছিল? আর তার চিঠি লেখার উদ্দেশ্য-ই বা কি?
.
৩.১১
লুসিলা ড্রেক তার এক প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে অন্য জায়গায় চা খাওয়ার জন্য বেরিয়েছেন। সেই অবসরে এ্যানথনি ব্রাউন এলভারস্টন স্কোয়ারে এসে হাজির হলো। উদ্দেশ্য আইরিসের সঙ্গে নিভৃতে কিছু কথা বলা।
-এ্যানথনি, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আইরিসের কণ্ঠে অনুযোগের ছোঁয়া। তোমার সঙ্গে যে অনেক কথা ছিল এ্যানথনি।
আইরিসের কাছে বসে এ্যানথনি বলে–কি হয়েছে প্রিয়তমা? তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে?
গতকাল রাতের কথা, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের অভিযোগ, লুক্সেমবার্গের সেই অভিশপ্ত টেবিলের নিচে ছোট্ট একটা কাগজের প্যাকেট পাওয়া গেছে, তাতে সায়ানাইডের গুঁড়ো লেগে ছিল।
-এর জন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে? এ্যানথনি হাল্কা ভাবে কথাটা বলে। খুনী নিশ্চয়ই জর্জের সামনের গ্লাসে সায়ানাইডের গুঁড়ো ঢেলে দেবার পর প্যাকেটটা সবার অলেক্ষ্য টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে থাকবে।
–আসলে তা নয়। আইরিসের চোখে ভয়। ঐ প্যাকেটটা আমিই টেবিলের নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।
এ্যানথনি চমকে ওঠে।
–শোন এ্যানথনি, মৃত জর্জকে নিয়ে যখন সকলে ব্যস্ত তখন চোখের জল মুছতে গিয়ে হাত-ব্যাগ খুলে রুমাল বের করতে যাই। কিন্তু ব্যাগ খুলে আমি হতবাক হয়ে পড়ি। কাগজের খালি প্যাকেট। তখনি আমার মনে পড়ে রোজমেরির মৃত্যুর পর হাত-ব্যাগ থেকে পাওয়া সায়ানাইডের খালি প্যাকেটটার কথা। কিন্তু কি করে এটা এলো? কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমার সেই হাত-ব্যাগে কেবল প্রসাধনের কিছু জিনিস ছিল। এছাড়া অন্য কিছু ছিল না, আমার ভালো করে মনে ছিল। রুমাল বের করতে গিয়ে কাগজের প্যাকেটটা টেবিলের নিচে পড়ে যায় ব্যাগ থেকে। ওটা তোলার ইচ্ছা হলো না। কেবল মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এটা যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে তাহলে আমাকেই সকলে খুনী বলে ধরবে। কিন্তু এ্যানথনি, আমি তো তাকে খুন করিনি?
–এটা কেউ লক্ষ্য করেনি।
–হ্যাঁ, রুথ লেসিং এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন কোনো উদ্দেশ্য নেই তার।
প্যাকেটের ওপর তোমার হাতের ছাপ থাকতে পারে?
–না, রুমাল দিয়ে সেটা ধরেছিলাম।
–তাহলে তুমি যখন ক্যাবারে নাচের জন্য টেবিলে হাত-ব্যাগটা রেখেছিলে তখনই তোমার অনুপস্থিতিতে কেউ এই কাজটা করে থাকবে। তুমি একবার ক্লোকরুমেও তো গিয়েছিলে। সেখানে তোমার সঙ্গে কে ছিলো?
সান্দ্রা ফ্যারাডে আর রুথ লেসিং ছিলো। হাত ধোয়ার জন্য ব্যাগটা কাঁচের টেবিলে রেখে বেসিনের সামনে একবার গিয়েছিলাম।
তাহলে ও দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন এই কাজ করেছে। তবে দুজনের মধ্যে রুথের সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু রুথের যদি তোমার প্রতি সায়ানাইড প্রয়োগের কোনো ইচ্ছা থাকতো, সে তোমার অজান্তে অবশ্যই করতে পারতো। কিন্তু সেটা সে করেনি। তার মানে রুথ একাজ করেনি। তাহলে কি কোনো ওয়েটার? রুথ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কোনো ওয়েটার ভাড়া করেছিল?
এ্যানথনির মন তখন দ্বিধা সংকোচে ভরে গেছে। সে বললো–আমাদের এখুনি চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের কাছে যেতে হবে। নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে রাখা যায় না। তাছাড়া আইন বলতেও কিছু আছে।
-এ্যানথনি, তুমি এটা করতে পারো না। আইরিস ভয়ে আঁৎকে ওঠে। তাহলে ওরা আমাকেই খুনী বলে ধরে নেবে।
-না, তুমি ভুল ভাবছে। সত্যি কথা বললে ওরা বিশ্বাস করবে। তাছাড়া পরে যদি জানাজানি হয় তাহলে হাজার যুক্তি দেখালেও তুমি রেহাই পাবে না। ওরা বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো।
-এ্যানথনি আমার যাওয়া হবে না, জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে রুথের সঙ্গে আলোচনা আছে। এটা তোমাকে বলা হয়নি।
-আইরিস কাজটা অত্যন্ত জরুরি। মিসেস ড্রেকের সঙ্গে রুথ এ ব্যাপারে আলোচনা করতে পারে। তুমি যদি এখন না যাও তাহলে দুঃখের সীমা থাকবে না তোমার। রুথকে অতকথা বলার পর সে বলে–ঠিক আছে মিঃ ব্রাউন, আপনারা যান। আমি মিসেস ড্রেকের সঙ্গে আলোচনা করে নেবো।
.
৩.১২
গোল মার্বেল পাথরের টেবিলের সামনে বসেছিল তারা তিনজন।
কর্নেল রেস, চীফ ইনসপেক্টর কেম্প এবং এ্যানথনি ব্রাউন।
এ্যানথনি ওদেরকে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করছিল। কেম্প তার যুক্তিগুলি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো।
-এটা এমন একটা কেস, তুমি জানো, অপরাধী কে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারো না। চীফ ইনসপেক্টর বলে ওঠে।
তার মানে আপনি জানেন, খুনী কে? এ্যানথনি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে।
–হ্যাঁ, লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডেকে আমার ধারণা।
কারণ? রেস জানতে চায়।
-ভদ্রমহিলা অত্যন্ত পরশ্রীকাতর ও অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। কেম্প বলতে থাকে। মনে হয় মিঃ বারটনকে কেউ ইঙ্গিত করে থাকবে। ফলে তার মনে সন্দেহ জাগে। অবশ্য সন্দেহটা হওয়া স্বাভাবিক। ফ্যারাডে পরিবারের ওপর নজর রাখার প্রয়োজন না হলে কেউ তাদের পাড়ায় বাড়ি কিনতে আসে? ধৈর্য ধরার মতো মহিলা তিনি নন। আমার যতদূর ধারণা, একমাত্র তার পক্ষেই মিঃ বারটনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ মেশানো সম্ভব। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছে বলে কারো নজরে পড়েনি।
এবার কেম্প এ্যানথনির দিকে তাকালো। মিঃ ব্রাউন, মিস মারলেকে তার কাহিনী শোনাবার জন্য এখানে নিয়ে আসাতে আমি খুব খুশী হয়েছি।
–আমি কাজটা দ্রুত করতে চেয়েছিলাম। ব্রাউন জবাব দেয়। তবে একটা কথা আপনি ঠিকই বলেছেন চীফ ইনসপেক্টর, এ কেসের বিচার কখনো হতে পারে না। বেনামী চিঠিগুলো কে লিখলো, কোন উদ্দেশ্যে লিখেছিলো, জর্জ বারটন কেন খুন হলো ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে পারলাম না। তবে এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই বলে আমার মনে হয়।
–এ সন্দেহ কি আপনার এখনো আছে মিঃ ব্রাউন? রেস প্রশ্ন করে।
–রুথ লেসিংকে আমার সন্দেহ হয়। এ্যানথনি জবাব দেয়।
-হ্যাঁ, আপনার সন্দেহ অমূলক নয়। মিসেস বারটনকে খুন করে জর্জ বারটনকে বিয়ে করার পথ পরিষ্কার করেছিল সে। কিন্তু দ্বিতীয় খুনের বেলায় তাকে তো দায়ী করা যায় না। সে কেন তার প্রেমিককে খুন করবে। তাছাড়া মিস মারলের হাত থেকে প্যাকেটটা পড়ে যেতে দেখে সে কেনই বা মুখে হাত চাপা দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়েছিল? তবে আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে কে জর্জ এবং রোজমেরি বারটনকে খুন করেছে সেটা বলতে পারি।
–আপনি জানেন? কে সে?
এ্যানথনি বড় বড় চোখে তাকায়।
–আমার মনে হয় মিস মারলেই অপরাধী। শান্তস্বরে রেস বলে।
এ্যানথনি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সে সংযত করে। যুক্তি দিয়ে ওদের কাছ থেকে সব জানতে হবে। সে বলে–কেন তাকে আপনার সন্দেহ হলো কর্ণেল রেস?
–ভাগ্যগুণে মিসেস বারটন বিরাট সম্পত্তির একমাত্র অংশীদার ছিলেন। মিস মারলের ঐ সম্পত্তির ওপর কোনো দাবী ছিলো না। মিস মারলে ভালো করেই জানতেন যে মিসেস বারটন কেবল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সব সম্পত্তি আইরিস পাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় যখন মিসেস বারটনের মানসিক অবস্থা দারুণ বিপন্ন তখন সুযোগ বুঝে মিস মারলে কাজটি হাসিল করেন।
..এছাড়া আর একটা কারণ আছে। আচ্ছা মিঃ ব্রাউন, এই কেসের সঙ্গে ভিক্টর ড্রেককে জড়িয়ে দিতে পারেন না?
–ভিক্টর ড্রেক? অবাক হয় এ্যানথনি।
–হ্যাঁ, এটা মারলে পরিবারের দুর্বলতা বলে আমি জানি।
–যাই হোক, এখন ব্যাপার হলো জর্জের গ্লাসে সে কি করে সায়ানাইডের গুঁড়ো মেশালো?
এ্যানথনির চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলছিল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়।
এতক্ষণ চীফ ইনসপেক্টর কেম্প ওদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সব শুনছিলেন।
এ্যানথনি রাগে গজরাতে থাকে–এখন দেখছি সমস্ত ব্যাপারটা উল্টে গেল। নতুন করে প্রথম থেকে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে। জর্জ বারটন আমার চোখের সামনে বসেছিল। তারই মাঝখানে অঘটন ঘটে গেল। কিন্তু কি করে হলো, আমাকে জানাতেই হবে। হতে পারে যখন সবাই নাচে ব্যস্ত ছিল তখন অপরাধী কাজটা সম্পন্ন করে। কিন্তু জর্জ তার গ্লাসে চুমুক দিয়েছিলেন এবং স্বাভাবিক ছিলেন। অতএব তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়নি অথচ বিষক্রিয়ার ফলেই তার মৃত্যু হয়।
ঘরের অন্য দুজন এ্যানথনিকে নীরবে লক্ষ্য করছিল। সে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে মাথার ওপর হাত দুটো রেখে আর বিড়বিড় করছে
-হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই…সেই ব্যাগ..সেই ওয়েটার…
ওয়েটার? কেম্প সতর্ক হয়েই ছিলো। হ্যাঁ, ওয়েটার। তবে সে ঠিক ওয়েটার নয়। যাদু কিংবা কোনো সম্মোহন শক্তির দ্বারা আমাদের মধ্যে কেউ সেই মুহূর্তে ওয়েটারের ছদ্মবেশে কাজ হাসিল করে থাকবে। একটু থেমে কেম্পের হাত ধরে বলে-বিশ্বাস হলো না, না? আসুন আমার সঙ্গে। দেখুন বাইরের জগৎটা কি ভয়ঙ্কর।
ওদের দুজনকে নিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন ঘর থেকে বেরিলয় করিডোরের সামনে টেলিফোনের সামনে এগিয়ে গেল।
.
৩.১৩
চীফ ইনসপেক্টর কেম্প এবং কর্নেল রেস কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে ছিলো এ্যানথনির দিকে। সে কি করতে চায় সেটাই দ্রষ্টব্য। এ্যানথনি কিছুটা খুশী হয়েছে এই ভেবে যে ওদের দুজনকে সে বোঝাতে পেরেছে। তাই তারা শ্রদ্ধা ও যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে। হঠাৎ অশুভ একটা আশঙ্কায় সে চমকে উঠলো। আইরিসকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আইরিস একটু আগে ভয়ে ভয়ে তাকে জানিয়েছিল। আর একটু হলে সে গাড়ি চাপা পড়তো। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যই ড্রাইভার ইচ্ছে করে অসতর্ক ভাব দেখিয়ে ওকে চাপা দিয়ে খতম করতে চেয়েছিল। তার মানে ওর মুখ চিরকালের জন্য কেউ বন্ধ করতে চাইছে।
আমাদের এক্ষুনি একবার এলভারস্টন স্কোয়ারে যেতে হবে।
এ্যানথনি রাস্তায় নেমে সংক্ষেপে আইরিসের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার কথা ওদের জানায়। একটা ট্যাক্সিতে তারা উঠে বসলো।
–ঈশ্বর আপনাকে সময় মতো মনে করিয়ে দিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানাই। এতো তাড়াতাড়ি তৃতীয়বার আক্রমণ করাটা কিন্তু বাঞ্ছনীয় নয় কেম্প মন্তব্য করে।
সে যাই হোক, রেস বলে, তৃতীয় বার আক্রমণের ফলে আসল অপরাধীকে ধরার সুযোগ আমাদের এসে গেছে।
জর্জ বারটনের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
পারলার মেড সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলো।
মিস আইরিস বাড়ি ফিরেছে?
এ্যানথনি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে প্রশ্ন করলো।
–হ্যাঁ, স্যার। তিনি আধঘণ্টা হলো বাড়ি ফিরেছেন। ইভান্স গভীর বিস্ময়ে কথাটা বললো।
এ্যানথনি ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢোকে। পেছনে কেম্প এবং রেস।
ড্রয়িংরুমে তখন লুসিলা ড্রেক ড্রয়ারে কি যেন খুঁজছিলেন আর আপন মনে বলছিলেন– কোথায় যে গেল মিসেস মারকাসের চিঠিটা?
–আইরিস কোথায়?
এ্যানথনির আচমকা প্রশ্ন শুনে তিনি ফিরে তাকালেন। অবাক দৃষ্টি তার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সহজভাবে বললেন, মাফ করবেন, আপনার পরিচয়?
রেস এবার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তাকে দেখে লুসিলা ড্রেক খুশীতে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।
-ওঃ আমার প্রিয় কর্নেল। আমি আপনাকে আরো একটু আগে আশা করেছিলাম। আপনার সঙ্গে জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল।
মিসেস ড্রেক একবার কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। তার কথার মাঝখানেই রেস জানাতে চাইলো-মিস মারলে কোথায়?
-আইরিস? বেচারি। এত ঝামেলা সহ্য করার মতো তার কি বয়েস হয়েছে? মাথা ধরেছে বলে ওর ঘরে চলে গেছে। বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি ওকে বললাম, যাও তুমি বিশ্রাম নাও গিয়ে। আমি আর রুথ সব সামলে নেবো। রুথের একটুও ক্লান্তি নেই। মুখ বুঝে সব হুকুম মেনে কাজ করছে।
–মিস লেসিং এখন কোথায়?
কেম্প জানতে চায়।
মিনিট দশেক আগে চলে গেছে সে বেচারী। ওর হাতে এখন…
ইতিমধ্যে এ্যানথনি কখন যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে কেউ টের পায়নি। সে বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, আপনারা কি গল্প করবেন, না কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন।
অতএব ওরা দুজন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে।
তিনজনে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে আসে। চরাতলায় উঠতে গিয়ে এ্যানথনি থমকে দাঁড়ায়, মৃদু পায়ের শব্দ সিঁড়ির ধাপে ধাপে নিচে নেমে আসে। সে দেরি না করে ঝট করে কেম্পকে নিয়ে পাসের বাথরুমে ঢুকে যায়।
পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করলো। তারপর চারতলায় উঠে আইরিসের ঘরের দরজায় এসে ধাক্কা দেয়।
কোনো সাড়া না পেয়ে এ্যানথনির সন্দেহটা আরো ঘনিয়ে ওঠে। চাবির গর্তে চোখ রাখলো সে। সারা ঘর ধোয়ায় ভর্তি।
ততক্ষণে কর্নেল রেস হন্তদন্ত হয়ে চারতলায় উঠে এলো।
দরজা ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর দরজা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে দ্রুত চোখে বুলিয়ে নিয়ে রেস চিৎকার করে ওঠে–ঐ তো মিস মারলে ফায়ারপ্লেসের কাছে পড়ে আছেন। আপনি ওঁকে দেখুন। আমি ততক্ষণ ঘরের জানলাগুলো খুলে দিই।
গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে আইরিস। মনে হয় ইতিমধ্যে অনেক গ্যাস তার পেটের মধ্যে চলে গেছে। মুখ এবং নাক কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছিল। এ্যানথনি আর রেস তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো ঘরের মাঝখানে।
ততক্ষণে জানলাগুলি খুলে দেওয়ায় ঘরের গ্যাস বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা।
–মিঃ এ্যানথনি, ঘাবড়াবার কিছু নেই। রেস তাঁকে পরীক্ষা করে বলে, আপনি বরং ডাক্তারকে খবর দিন।
হলঘরে চলে এলো এ্যানথনি। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে বাধা পায়। পেছনে লুসিলা ড্রেক। এ্যানথনি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
-কি হয়েছে? আমি জানতে চাই? লুসিলা ড্রেক অস্থির হয়ে ওঠেন। আইরিস কি অসুস্থ?
বন্ধ এবং গ্যাসপূর্ণ ঘরে গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আইরিস।
–আইরিস? মিসেস ড্রেকের গলা থেকে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ও কি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো? এটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। আমি মানতে রাজী নই।
–আপনাকে জানতেও হবে না। এ্যানথনির ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। শ্লেষের সুরে বললো, কেন, এটা কি মিথ্যে?
.
৩.১৪
আইরিস ক্লান্ত চোখে এ্যানথনির দিকে তাকায়।
–এত সব কাণ্ডকারখানা কি করে হলো দয়া করে আমায় বলবে কি, টিম?
আইরিস সোফার ওপর শুয়েছিল। নভেম্বর মাস। সূর্যের প্রখর আলোয় হঠাৎ যেন লিটল প্রায়রস সাহসী হয়ে উঠলো।
কর্নেল রেস বসে আছে উইনডো সীলের ওপর। এ্যানথনি তাকে একবার লক্ষ্য করলো। তারপর বলতে শুরু করলো।
–আমি এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে না। নিজের বুদ্ধির জাহির যদি না করি তাহলে সেটা নিজের ওপর ভীষণ অবিচার করা হবে।
..রোজমেরির মৃত্যু আত্মহত্যা বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু আসলে ওটা আত্মহত্যা নয়। তাই জর্জ ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে পারেননি বলে নিজেই গোপনে তদন্ত শুরু করেছিলেন। রোজমেরির খুনীও তাকে খুন করলো। তবে এর পাশাপাশি কয়েকটি প্রশ্ন বিতর্কের সৃষ্টি করে। যেমন, (ক) বিষপ্রয়োগে জর্জের মৃত্যু হতে পারে না, (খ) জর্জকে বিষপ্রয়োগ করেই খুন করা হয়েছে, (গ) জর্জের গ্লাস কেউ স্পর্শ করেনি, (ঘ) জর্জের গ্লাস নিশ্চয়ই কারো হাতের মধ্যে এসে থাকবে।
..ব্যাপারটা খুব ভালো করে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে–সেই রাতের পার্টির সমস্ত গ্লাস এবং কফির কাপগুলো ছিলো একই মাপের এবং একই ডিজাইনের। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে।
যেমন, আমি, কেম্প আর রেস তিনজনে একটা গোল মার্বেল টেবিলের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম। ঘরে ঐ ধরনের আরো টেবিল আছে। রেস চা খাচ্ছিলেন বিনা চিনিতে, কেম্প চিনি মেশানো চা খাচ্ছিলেন আর আমি কফি পান করছিলাম। কোনো একটা অজুহাতে আমি ওদেরকে টেবিল ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কেম্প তার হাতের পাইপটা তার চায়ের প্লেটের পাশে রেখে বাইরে গেলেন। আমি তাদের অলক্ষ্যে পাইপটা নিয়ে আমার প্লেটের পাশে রাখলাম। পরে সবাই ঘরে ফিরে এলো। কেম্প তার ফেলে যাওয়া পাইপ লক্ষ্য করে সেই চেয়ারটায় বসলেন। চায়ের কাপে ঠোঁট লাগালেন। কেমন বিস্বাদ ঠেকলো। সেইরকমই রেস তার কাপে ঠোঁট লাগিয়ে মুখ বিকৃত করবেন। এক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বিকৃতির আদান-প্রদান দেখা যাবে। এবার বিতর্ক হলো, চায়ের কাপে চিনি ছিলো না, আবার বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, চিনি ছিলো। এই বিতর্কের মূলে কাজ করছে কেম্পের কাপটা। কারণ ঘর ছেড়ে তিনি যখন চলে যান তখন ছিলো এক কাপ, পরে তিনি এসে বসেন অন্য কাপের সামনে। তার মানে এখানে কাপের প্রভেদ দেখা যাচ্ছে।
…সেদিন রাতে লুক্সেমবার্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। আইরিস, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ক্যাবারে নাচে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তুমি ভুল করে তোমার ব্যাগটি টেবিলের নিছে ফেলে রেখে যাও। সেটা তুলে দিয়েছিলো রেস্তেরাঁর একটি অনভিজ্ঞ ছেলে। পরিচিত ওয়েটার হলে ঠিক খেয়াল করে তোমার জিনিস তোমার চেয়ারের সামনে টেবিলে রাখতো। কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটি না জেনে ব্যাগটি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ভুল করে তোমার বাঁ পাশে রেখে দেয়। ফলে ক্যাবারে থেকে ফিরে তুমি যথারীতি তোমার ব্যাগ লক্ষ্য করে যে চেয়ারটায় বসলে আসলে ওটা নির্দিষ্ট চেয়ার নয়। তুমি বসেছিলে জর্জের চেয়ারে। আর জর্জ বসলেন তোমার চেয়ারে। এবার জর্জ গ্লাসে চুমুক দিলেন, যেটি তোমার জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। ঐ গ্লাসে অনায়াসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
…এবার সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখো। আসলে তুমি ছিলে আততায়ীর দ্বিতীয় লক্ষ্য। কিন্তু জর্জের দুর্ভাগ্য। একটু ভুলের জন্য তার প্রাণটা গেল। এই ভুল শব্দটা পাল্টে দিলো সব কিছু। নতুবা সৃষ্টি হতো একই রকম, গতবছর পার্টির পুনরাবৃত্তি ঘটা এবং তোমার দিদির মতো তোমার খুন হওয়াটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। ব্যাপারটা আরো সত্যি বলে প্রমাণিত হতো, এই কারণে, যে তোমার ব্যাগে সায়ানাইডের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। তুমি যে আত্মহত্যা করেছে সেটাই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেতো।
…এ সবের মূলে কি জানো, অর্থ। অর্থই অনর্থের মূল। রোজমেরির মৃত্যুর পর তুমি পেয়েছে তার বিশাল সম্পত্তি। তারপর তুমি যদি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যেতে তাহলে এই সম্পত্তির মালিক হতো তোমার নিকট আত্মীয়া লুসিলা পিসি। তাই সব দিক থেকে বিচার করে আমি বলছি, এই খুনের জন্য দায়ী লুসিলা ড্রেক। মিসেস ড্রেকের মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি আইনগতভাবে পাবে ভিক্টর ড্রেক। অতএব স্পষ্ট ভাবে বলা যায়, প্রথম খুনের জন্য দায়ী হলো ভিক্টর ড্রেক।
-কিন্তু আমি জানি, প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সে দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করছে।
-সেটা কি সত্যি? ঘুরে ফিরে সেই চিরন্তন প্রেম কাহিনী এসে যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে। রুথ লেসিং এবং ভিক্টর মেলামেশা করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে প্রেমে পড়বে। তাদের মধ্যে ভালোবাসা বিনিময় হবে।
রুথ বলেছে, রোজমেরির মৃত্যুর আগেই ভিক্টরকে দক্ষিণ আমেরিকাগামী এস.এস. ক্রিস্টোবল জাহাজে তুলে দিয়ে এসেছে সে। এবং এই ব্যাপারটা একমাত্র রুথ জানতো। ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে রোজমেরির মৃত্যুর আগে সে ইংলন্ডে ছিলো। তাছাড়া জর্জের মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে বুয়েন্স এয়ার ছেড়ে ভিক্টর নিউইয়র্ক চলে যায়। টেলিগ্রাম পাঠানো কোনো দুষ্কর ব্যাপার নয়। যে টেলিগ্রাম লুসিলা পিসি পেয়েছিলেন, যাতে টাকা দাবী ছিলো, সেটা ভিক্টর কোনো বন্ধুকে দিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থাকতে পারে। এর থেকে সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল সে আছে অনেক অনেক দূরে। অথচ
…অথচ সেদিন রাতে লুক্সেমবার্গে সে আমার টেবিলের পাশে বসেছিল। ঠিক আমার টেবিলের পেছনে। জেলে থাকার সময় ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল অল্প। আমি তাকে মাংকি কলেমন হিসাবে জানতাম। কিন্তু সে যে ভিক্টর ড্রেক সেটা আমার অজানা ছিলো। বহুদিন দেখা না হওয়ার ফলে সে আমাকে চিনতে পারলো না।
..একসময় সে উঠে পাবলিক টেলিফোনের বুথের দিকে এগিয়ে গেল। আপনাদের এক প্রস্থ ওয়েটারের পোশাক দেখিয়েছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই। ওয়েটারের পোশাক পরে সে সহজেই একটা গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালার অজুহাতে সায়ানাইড বিষ মিশিয়ে দেয়। যেহেতু সে ওয়েটার তাই কেউ তাকে সন্দেহ করলো না।
–আর রুথ? আইরিসের কণ্ঠে দ্বিধা।
-হ্যাঁ, রুথও এই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছে। তুমি যখন ক্লোকরুমে গিয়েছিলে তখন রুথ তোমার ব্যাগে পাকেটটা ঢুকিয়ে দেয়, ঠিক রোজমেরির ক্ষেত্রে এটা হয়েছিলো। বেনামে চিঠিগুলো লিখেছিলো জর্জ। সে চেয়েছিলো জর্জের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে, যে তুমি রোজমেরিকে খুন করেছে। ফলে রুথের পরামর্শে জর্জ দ্বিতীয়বার লুক্সেমবার্গে পার্টির ব্যবস্থা করেছিল। ওয়েটারের ভুল হয়েছিল বলে তুমি এ যাত্রা রক্ষা পেলে আইরিস। নতুবা জর্জের পরিবর্তে তোমার চিরতরে ঘুমোনোর কথা ছিল। এর থেকে রুথ প্রমাণ করতো যে রোজমেরিকে তুমি খুন করেছিলে বলে অনুশোচনায় ভুগছো। শেষে সহ্য করতে না পেরে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
–কিন্তু মেয়েটিকে আমি এখনও পছন্দ করি। ও জর্জকে বিয়ে করবে বলেছিলো।
আইরিস বললো।
-হ্যাঁ, ওর ঐ ভালো স্বভাব হয়তো চিরদিন অটুট থাকতো, জর্জ বারটনের আদর্শ স্ত্রী হতে পারতো, যদি না সে ভিক্টরের সঙ্গে মেলামেশা করতো। আসলে কি জানো, মেয়েরা প্রথম দিকে ফুলের মতো সুন্দর পবিত্র থাকে।
-তাহলে এতসব ব্যাপার ঘটানো হলো টাকার জন্য?
আইরিস আঁৎকে ওঠে।
–তুমি টাকার মর্ম বুঝবে না, আইরিস। তোমার মনে তো কোনো প্যাঁচ নেই। তুমি কি করে বুঝবে। কিন্তু এ দুনিয়ায় টাকাই সবার মূলে। টাকা থাকলে যে কোনা লোক দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় আনতে পারে। ঐ টাকার জন্য ভিক্টর হয়ে উঠেছিলো জঘন্য নরকের কীট। কিছুটা টাকার মোহে এবং রোজমেরিকে ঘৃণা করতে বলে রুথও আংশিকভাবে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তোমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিল এই রুথ লেসিং।
এ্যানথনি একটুক্ষণ থেমে আবার বলতে থাকে–জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা সেরে সে লুসিলা পিসির কাছ থেকে বিদায় নেয়। সে কিন্তু নিজের বাড়িতে ফেরে না। সোজা চলে আসে তোমার ঘরে। তোমাকে একা পাওয়ার সুযোগটা সে খুঁজছিলো। পেয়েও গেল সে। সে তোমাকে জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সব আয়োজনের কথা শোনাতে থাকে।
-হ্যাঁ, আইরিস বলতে থাকে। রুথ তারপর একটা রবারে জড়ানো টর্চ হাতে নিয়ে বললো, বাঃ, জিনিসটা ভারী সুন্দর দেখতে তো! তারপরের কথা আমার মনে নেই।
জানি, তুমি কিছু বলতে পারবে না। এ্যানথনি বলে–পরেরটুকু আমি বলছি। তোমার হাতের টর্চ নিয়ে তোমাকে সে আঘাত করে। তুমি জ্ঞান হারাও। তোমার সংজ্ঞাহীন দেহটা সে তখন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় গ্যাস ফায়ারের কাছে। তোমার মুখটা ঘুরিয়ে দেয় গ্যাস ফায়ারের দিকে, তারপর সুইচ অন করে দেয়। মনে হয়, এসব কাণ্ডের কথা লুসিলা পিসি টের পাননি। তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ছুটে এসে বাধা দিতেন।
-পুলিশ কি ভিক্টর ড্রেককে ধরতে পেরেছে?
-হ্যাঁ, আজ সকালে সে নিউইয়র্ক থেকে ফিরছিল। তখন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। জবাব দিলো কর্নেল রেস।
–এ্যানথনি এক কাজ করলে হয় না, আইরিস বলে। রোজমেরির সম্পত্তি নিয়ে কম তো অঘটন ঘটলো না। এতই যখন ঝামেলা ঐ অর্থ নিয়ে, তখন আমার ইচ্ছে, ওর থেকে একটা পেন্সও নেবো না।
-খুব ভালো কথা বলেছো, বরং ঐ অর্থ আমরা কোনো সৎ কাজে ব্যয় করবো। তাছাড়া আমার নিজের আয় নেহাত মন্দ নয়। তোমাকে স্ত্রী হিসাবে যথেষ্ট সুখে রাখতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।
কর্নেল রেসের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখা দিলো।
চীফ ইনসপেক্টর কেম্প তখন যাওয়ার জন্য এগিয়ে ছিলেন। মুখ ঘুরিয়ে বললেন–আমার যতদূর মনে হয়, আপনারা নিশ্চয়ই ফ্যারাডেদের চায়ের নিমন্ত্রণে যোগ দিচ্ছেন না।
এ্যানথনি মাথা নাড়লো, অর্থাৎ তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এতদিন পর মন থেকে তার দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। খুশীতে ভরে আছে তার হৃদয় মন। বহুদিন পর আইরিসকে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছে। সে এই মুহূর্তটিকে নষ্ট হতে দিতে চায় না।
রেস ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলো।
-আচ্ছা এ্যানথনি, আইরিস সরাসরি তাকালো এ্যানথনির চোখের দিকে, তুমি কি করে বুঝলে, আমি খুন করিনি, অথচ ওঁরা তো ধরে নিয়েছিলো, আমি খুনী।
শোন প্রিয়তমা, আমার ভালোবাসাই আমার মনে এ বিশ্বাস এনেছে। এ্যানথনি বলে, আমার অন্ততঃ অনুমান তাই।
এ্যানথনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আইরিসের নীল চোখ আর রক্ত লাল কম্পমান ঠোঁটের দিকে। আইরিস লজ্জা পায় চোখ নামিয়ে নেয়।
অনেকক্ষণ নীরবে কেটে যায়। একসময় স্বপ্ন ভঙ্গ হয় এ্যানথনির।
–আশা করি তিনি আর আমাদের কাছাকাছি নেই, তাই না?
–তিনি মানে কে? কার কথা বলছো এ্যানথনি?
-এই প্রশ্নের উত্তর তো তোমার কাছে আছে আইরিস। রোজমেরি…আমার ধারণা, তিনি জানতেন যে, তখন তুমি ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে আছে।
রোজমেরি, তোমাকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ, বিদায়। –একেই বলে স্মৃতিচিহ্ন। কান্না ভেজা কন্ঠে আইরিস বলে, তার ভালোবাসা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।