২. আততায়ী

আততায়ী

 সার্জেন্ট গ্রীন হাস্ট্রীট সাইপ্রিয়ান থানায় রাতের ডিউটিতে বসে হাই তুলছিল। টেলিফোন বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে নিলো…নিমেষে তার ভঙ্গী পাল্টে গেল। তাড়াতাড়ি কাগজ টেনে লিখতে শুরু করল।

হ্যাঁ, মোডোব্যাঙ্ক, আচ্ছা কি নাম, এস.পি. আর এন-জি, জি? গ্রীনে জি? আচ্ছা ই-আর, প্রিন্সার।

মেডোব্যাঙ্কে খোলা দরজা দিয়ে আলোর রশ্মি এসে ঠিকরে পড়ছে। মিস বুলস্ট্রোড নিজে এসে গোয়েন্দা ইনসপেক্টর কেলসিকে অভ্যর্থনা করলেন। মহিলাটি ইনসপেক্টরের মুখচেনা। অবশ্য এ তল্লাটে এমন কেউ নেই যে তাঁকে চেনে না। এত গুণ্ডগোলের মধ্যেও মহিলাটি আচরণের সমতা হারাননি। সম্পূর্ণ পরিবেশ যেন তার আয়ত্তেই রয়েছে।

আমি ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর কেলসি।

প্রথমে আপনি কি করতে চান ইনসপেক্টর? ক্রীড়ামঞ্চে যাবেন, না ঘটনার বিবরণ শুনবেন।

নিশ্চয়ই। আমি সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে এসেছি তাকে আর আমার দুজন লোককে যদি দেখিয়ে দেন মৃতদেহ কোথায় আছে তাহলে আপনার সঙ্গে কটা কথা সেরে নিই।

মিস বুলস্ট্রোডের পেছনে পেছনে কেলসি বসবার ঘরে ঢুকলো।-মৃতদেহ প্রথমে কে দেখেছিল?

মিস জনসন, আমাদের মেট্রন। একটা মেয়ের কানে ব্যথা হয়েছিল, মিস জনসন তার ঘরে গিয়ে দেখাশোনা করছিলো। এমন সময় পর্দাটি ঠিকমতো খোলা নেই দেখে ঠিক করতে গিয়ে দেখে ক্রীড়ামঞ্চে আলো জ্বলছে। তখন রাত প্রায় একটা-ওখানে তো আলো জ্বলবার কথা নয়।

হু! মিস জনসন কোথায়?

 এখানেই আছে ডেকে দেব কি?

এখন থাক… তারপর কি হল বলুন?

মিস জনসন তখন আমার আর এক সহকর্মী মিস চ্যাডউইককে ডেকে তুললো। দুজনে মিলে ওপাশের দরজা দিয়ে যখন নেমে যাচ্ছিল তখন বন্দুকের শব্দ শুনতে পায়। শুনেই একদৌড়ে তারা ক্রীড়ামঞ্চে হাজির হল, সেখানে…।

কিন্তু তার আগে নিহত মহিলাটি সম্বন্ধে কিছু বলুন

ওর নাম মিস গ্রেস স্প্রিঙ্গার।

আপনার এখানে কতদিন ছিলেন।

এই পরেই এসেছিলেন।…আগের ক্রীড়া শিক্ষয়িত্রীটি কাজ ছেড়ে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া।

মিস স্প্রিঙ্গার সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?

তার পরিচয় পত্রগুলো বেশ ভালোই ছিল।

ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না আগে।

না।

 এমন ঘটনা কেন ঘটতে পারে বলতে পারেন। কোনো মতামত? উনি কি অসুখী ছিলেন? কোনো প্রেমঘটিত?

সেরকম আমি কিছু শুনিনি। আমার তা মনে হয় না, ওর ধারণাটাই ছিলো অন্যরকম। দুনিয়ায় যে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।

মিস জনসনকে কি ডেকে দেবো?

আচ্ছা মিস বুলস্ত্রোড় তাহলে আমি মিস জনসনের সঙ্গে কথা বলি কেমন?

মিস বুলস্ট্রোড গিয়ে মিস জনসনকে নিয়ে এলেন।

মৃতদেহ আবিষ্কার করবার পর মিস জনসন ভয় কাটানোর জন্য বেশ খানিকটা ব্র্যাণ্ডি খেয়ে নিয়েছিল। ফলে কথাটথা তার বেড়ে গেছে।

এলসপেথ, ইনি গোয়েন্দা ইনসপেক্টর কেলসি। তুমি মাথা ঠিক রেখে একে সব কথা বলো, যা যা ঘটেছিলো।

মিস জনসন বলে, উঃ সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর, জন্মে কভূ দেখিনি। বিশ্বাস করতেই পারছি না, সত্যি বলছি। বিশ্বাসই হয় না, শেষ মিস স্প্রিঙ্গার

বুদ্ধিমান গোয়েন্দা কেলসি সুরের রেশ বুঝে জেরা করবার রীতি পাল্টে ফেললো। মিস ম্প্রিঙ্গারকে খুন করা হয়েছে দেখে কি আপনি অবাক হয়েছেন?

হু…তা তো হয়েছিই। উনি কেমন শক্তসমর্থ মানুষ ছিলেন, কেমন মেজাজী …দুটো চোর একসঙ্গে এলেও তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারতো না।

 চোর?…ক্রীড়ামঞ্চে চুরি করবার মতো কিছু ছিল।

না…মানে…সাঁতারের পোশাক ও খেলার সরঞ্জাম আছে।

অর্থাৎ ছিঁচকে চোর।…কিন্তু তার জন্য কি কেউ দরজা ভাঙবার মতো কষ্ট স্বীকার করবে? আচ্ছা দরজার তালা কি ভেঙ্গেছিলো।

আঁ! লক্ষ্য করিনি তো, যখন আমরা ওখানে পৌঁছলাম দরজা খোলাই ছিল। কাজেই মিস বুলস্ট্রোড বলেন, না ভাঙেনি।

ও চাবির ব্যবহার করেছে। মিস স্পিঙ্গারের সঙ্গে কি সকলের সদ্ভাব ছিল?

তা–ঠিক জানি না, এখন তো তিনি মারা গেছেন। মিস জনসনের দিকে তাকিয়ে ইনসপেক্টর বলে, অর্থাৎ, তাকে আপনি পছন্দ করতেন না। তাই তো?

আমার মনে হয় কেউই তাকে পছন্দ করতো না। ভয়ানক মূর্খরা ছিলেন তিনি, তবে নিজের কাজে ভীষণ পারদর্শী ছিলেন, কী বলেন–মিস বুলস্ট্রোড?

নিশ্চয়ই

কেলসি এবার বললো, তাহলে কী কী হয়েছিলো। ঠিক করে বলুন তো মিস জনসন?

আমাদের একজন ছাত্রী জীনের কানের ব্যথা হয়েছিল। আমি একটু ওষুধ লাগিয়ে আবার তার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তক্ষুনি দেখি জানালার পর্দা আধখোলা, ভাবলাম হাওয়া লাগানো মেয়েটার পক্ষে ঠিক নয়, তাই পর্দাটি বন্ধ করে দিই। আমাদের মেয়েরা অবশ্য সবাই জানালা খুলেই শোয়। বিদেশী ছাত্রীরা যা একটু গোলমাল করে। আমি জানালা লাগাতে গিয়ে দেখলাম কী আশ্চর্য, তখন দেখি ক্রীড়ামঞ্চে আলো। স্পষ্ট দেখা গেল। আলোটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মানে আপনি বলছেন যে ওটা বিজলীর আলো ছিল না টর্চের আলো।

হা নিশ্চয়ই তাই। ভাবলাম এতরাতে ওখানে

আপনি কী ভেবেছিলেন?

মিস জনসন একবার মিস বুলস্ট্রোডের দিকে দেখে নিয়ে আমি ঠিক বুঝিনি, মানে…আমি… আমি তখন হয়তো জিনিসটা সম্বন্ধে ভাবিইনি

মিস বুলস্ট্রোড বললেন মিস জনসন বোধহয় ভেবেছিলেন যে কোনো ছাত্রী হয়তো ওখানে রাতের অভিসারে গেছে। তাই না…এলসপেথ?

মানে…হা ওরকম একটা ধারণা তখন হয়েছিলো। ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের কোনো ইতালীয় ছাত্রী। বিদেশী মেয়েরা ইংরেজ মেয়েদের তুলনায় অনেক অকালপক্ক।

মিস বুলস্ট্রোড বলেন, অত বিদেশীপনা করো না, বহু ইংরেজ ছাত্রী গোপনে গোপনে কত অযোগ্য পাত্রে মিলিত হয়। এসময় ওরকম ধারণা হওয়া স্বাভাবিক।

তারপর?

আমি ভাবলাম মিস চ্যাডউইকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে দেখে আসি..কী ব্যাপার?

 কেলসি বললো, বিশেষ করে মিস চ্যাডউইককে কেন?

মিস বুলস্ট্রোডকে অত রাতে বিরক্ত করতে চাইনি। কাজেই মিস চ্যাডউইকের কথাই মনে পড়লো। যখনই আমরা মিস বুলস্ট্রোডকে বিরক্ত করতে চাই না। তখনই আমরা মিস চ্যাডউইককে স্মরণ করি। উনি তো কতকাল এখানে আছেন, কত তার অভিজ্ঞতা। তিনি শুনেই বলেন এখুনি সেখানে আমাদের যাওয়া উচিত। কোনোমতো একটা সোয়েটার বা কোট চাপিয়ে পাশের দরজা দিয়ে বেরুলাম। রাস্তায় যেই নেমেছি কানে এল গুলির আওয়াজ। ক্রীড়ামঞ্চের দিকে শব্দটা হতেই আমরা ওদিকে ছুটলাম, হা সঙ্গে একটা টর্চও নিইনি। অন্ধকারে দু-চারবার হোঁচট খেলাম..দরজা খোলাই ছিল, আলোর বোম টিপতেই

দাঁড়া দাঁড়া সেখানে আলো ছিল না? টর্চের বা অন্য কোনো আলো?

না জায়গাটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছিল। বোতাম টিপতেই চোখে পড়লো উনি ওখানে,

উনি–ইনসপেক্টর নরম গলায় বলে, আর কোনো বিবরণ দেবার দরকার নেই। আমি এখুনি ওখানে যাচ্ছি। নিজের চোখেই দেখবো…যেতে যেতে কাউকে দেখেছিলেন? কারো দৌড়ে পালাবার শব্দ পেয়েছিলেন?

না কোনো শব্দ শুনিনি।

 স্কুল দালান থেকে আর কেউ গুলির আওয়াজ পেয়েছিল? মিস বুলস্ট্রোড মাথা নাড়লেন, না। জানি না, গুলির শব্দ শুনেছি বলে কেউ আমাকে বলেনি। ক্রীড়ামঞ্চ এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে তাই হয়তো আওয়াজটা কেউ লক্ষ্য করেনি।

.

পাখির ঝাঁকে বেড়াল

 জেনিয়া সাটক্লিফ তার মাকে লিখলো—

মামনি,
আমাদের এখানে কাল রাতে একটা খুন হয়েছে। আমাদের শরীরচর্চার দিদিমনি মিস প্রিঙ্গারকে হত্যা করা হয়েছে। মাঝরাতে ঘটনাটা ঘটেছিল, পুলিশ এসেছিল। আজ সকাল থেকে সবাইকে জেরা করছে।
মিস চ্যাডউইক কাউকে এসব কথা জানাতে মানা করে দিয়েছেন কিন্তু ভাবলাম তুমি হয়তো জানতে চাইবে।
স্নেহের–
জেনিয়া।

সমাজের উপরতলায় মেডোব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানটির স্থান। কাজেই পুলিশের খোদকর্তা ব্যাপারটায় মনোযোগ দিলেন। মিস বুলস্ট্রোডও চুপচাপ বসে থাকেননি। যখন তদন্ত চলছিল তখনই তিনি দুটো টেলিফোন করেছিলেন। একজন একটি প্রভূত ক্ষমতাবান সংবাদপত্রের অধিকারীকে ও দ্বিতীয়টি স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিবকে। তারা দুজনেই মিস বুলস্ট্রোডের বন্ধু। কাজেই হত্যাকাণ্ডের সংবাদটা বিশেষ প্রচারিত হল না। ক্রীড়া শিক্ষয়িত্রীকে স্কুলের ব্যায়ামাগারে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মৃতদেহে গুলির চিহ্ন আছে কিনা এ বিষয়ে সঠিক বলা যাচ্ছে না। যে ব্যাপারটি নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়।…প্রতিটি কাগজে খবরটা প্রকাশিত হল বেশ বিনীত ভঙ্গিতে।

সেদিন সন্ধ্যায় পুলিশের বড়কর্তা মিঃ স্টোন ও ইনসপেক্টর কেলসির সঙ্গে তিনি এক গোপন বৈঠকে বসেছিলেন। কাগজওয়ালারা যদি ব্যাপারটা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্চ না করে তাতে তো পুলিশেরই সুবিধা..চুপচাপ তদন্ত চালিয়ে যাওয়া যাবে।

পুলিশের প্রধান বলেন, সত্যিই আমি ভয়ানক দুঃখিত মিস বুলস্ট্রোড, বুঝি তো এই ঘটনা আপনার জন্য কতরকম সমস্যা নিয়ে আসতে পারে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, কোনো স্কুলে যদি খুন হয় সমস্যা আসবেই। তা নিয়ে ভেবে কি লাভ, আগেও আমরা বহু সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি, এটাও কাটিয়ে উঠবো।…আমি আশা করছি যে আপনারা শীঘ্রই এর একটা কিনারা করবেন।

পুলিশ সাহেব বললেন, স্কুলবাড়ি খানাতল্লাশি করতে কি আপনার আপত্তি আছে?

 মিস বলুস্ট্রোড বললেন, কিছুমাত্র নয়, আপনারা বোধহয় অস্ত্রটা খুঁজছেন?

হা বিদেশী পিস্তল। আপনি কি জানেন আপনার কোনো কর্মী বা ছাত্রীর কাছে কি পিস্তল আছে?

না, অন্তত আমার জানা নেই, ছাত্রীদের কাছে যে নেই-ই সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কারণ তারা এলে তাদের জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে রাখা হয়। পিস্তল থাকলে তো কেউ না কেউ দেখতোই। তবে ইনসপেক্টর আপনি যা ভালো বোঝেন করুন। আপনার লোকজন তো মাঠে ময়দানে তল্লাশি শুরু করেই দিয়েছে।

হ্যাঁ, এখানকার প্রত্যেক কর্মীদের আমি জেরা করতে চাই, হয়তো এমন কেউ আছেন যিনি মিস স্প্রিঙ্গারের এমন কোনো উক্তি শুনেছেন যা আমাদের অনুসন্ধানে সাহায্য করতে পারে।

আমি ভাবছি আজ সন্ধ্যায় উপাসনার পর মেয়েদের সামনে ছোট্ট একটা ভাষণ রাখবে। তাদের কেউ যদি মিস স্প্রিঙ্গারের এমন কোনো কথা জানে যেন আমার কাছ এসে সেকথা বলে।

পুলিশের কর্তাটি বললেন, বাঃ সুন্দর পরিকল্পনা।

 মিস বুলস্ট্রোড বললেন, কিন্তু মনে রাখবেন কোনো মেয়ে অতিরঞ্জিত করবেই। হয়তো কল্পিত ঘটনাই ফেঁদে বসবে যাতে নিজের গুরুত্ব বেড়ে যায়। জানেন তো মেয়েরা বড়ো অদ্ভুত চরিত্র। আপনারা নিশ্চয়ই এধরনের অনেক প্রচেষ্টাই দেখেছেন।

খেলার ঘরে দেরাজগুলো খুঁজে দেখেছি স্যার।

কিছু পেলে?

আজ্ঞে না, তেমন কিছু না। কিছু মজার জিনিস দেখেছি বটে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন নয়। কোনোটা তালা বন্ধ ছিল?

না। ওগুলোর মধ্যে চাবি ছিলো। কিন্তু তালা বন্ধ ছিল না। ভেতরের কাজ বলে মনে হচ্ছে নাকি স্যার। ওই দুজন মাস্টারনী আর জীন মেয়েটি, যার কানে ব্যথা ছিলো, এরা ছাড়া সবাই তো বিছানায় শুয়ে নাকি ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু প্রমাণ কই। সাক্ষী কই? এমনকি মিস বুলস্ট্রোড নিজেও বাইরে আসতে পারেন। এইখানে মিস স্প্রিন্সারের সঙ্গে দেখা করে থাকতে পারেন অথবা এখানে আসতে পারেন। তারপর গুলি করা হয়ে গেলে হত্যাকারী অতি সহজেই ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে চুপিসারে পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হল্লা ওঠবার আগেই নিশ্চিন্তে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারে। তবে উদ্দেশ্য কী?

কেলসি ক্রীড়ামঞ্চ থেকে স্কুলবাড়ির দিকে হাঁটে। ব্রিগস তখনো একটা ফুলের জমি তৈরি করেছিলো, সে ইনসপেক্টরকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিগস বলে, হা, আজকালকার ছেলেছোকরারা কি জানে, বাগান করা চাড্ডিখানি কথা। তাদের কাছে বাগান করাও যেন আটটা পাঁচটার কাজ। কোনোদিন হয়তো কাজ দেখতেই পারবো না। আবার হয়তো ভোর সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। মোদ্দা কথা হল বাগানে যদি পরাণ ঢেলে না দেন, এর ব্যবহার দেখে খুশী না হন তো কিছু হবে না।

কেলসি বলে, এই বাগানটা নিয়ে তুমি অহঙ্কার করতে পার হে! এত ভালো বাগান আর দেখাই যায় না।

ব্রিগস বলে, তা ঠিক। আমার কপাল ভালো একটা শক্তসমর্থ জোয়ান আমার হাতে হাতে কাজ করে দেয়। তার নাম অ্যাডাম গুডম্যান।

ইনসপেক্টর বললো, কই তাকে দেখলাম না আমি।

আজ ছুটি চেয়ে নিয়েছে কাজকর্ম ঢিলে তাই।

 কিন্তু ওর কথা আমাকে জানানো উচিত ছিল। এখানে যারা কাজ করে সেই তালিকাতে ওর নাম নেই।

ওঃ তাতে কী, কাল তো আবার দেখা পাবেন। যদিও মনে হয় না আপনাকে ও কিছু বলতে পারবে। এই পর্বের শুরুতে একজন শক্তসমর্থ যুবক নিজে এসে যেচে কাজটা নিয়েছে, কেলসির মনে সন্দেহ জাগে।

যথারীতি সেই সন্ধ্যাতে মেয়েরা উপাসনার জন্য হলঘরে এল। উপাসনা শেষ হয়ে গেলে মিস বুলস্ট্রোড হাত তুলে তাদের থামতে বললেন।

তোমাদের কটি কথা বলতে চাই। জানই তো কাল রাতে মিস প্রিন্সারকে গুলি করে ক্রীড়ামঞ্চে হত্যা করা হয়েছে। তোমাদের মধ্যে কেউ গত সপ্তাহে মিস প্রিঙ্গার সম্বন্ধে এমন কিছু শুনে থাক বা দেখে থাক বা তোমাদের অস্বাভাবিক ঠেকেছে, তাহলে আমি চাই যে, সেকথা তোমরা আমাকে এখন জানাও। আজ সন্ধ্যায় যে কোনো সময়ে আমার বসার ঘরে এসে কথাগুলো বলে যেতে পার।

আইলিন রীচকে ইনসপেক্টর বললেন আপনি মেডোব্যাঙ্কে কদিন আছেন?

বছর দেড়েক হল।

আগে কখনও গণ্ডগোল হয়নি।?

আইলিন রীচ চমকে ওঠে। কোথায়, মেডোব্যাঙ্কে! না না, এই পর্বের আগে পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো।

কেন? এই পর্বে কী হয়েছে, খুন হওয়ার কথাটা নিশ্চয়ই বলছেন না। আপনি অন্য কিছু বলতে চাইছেন?

তা কেন, না না, বোধহয় তাই কিন্তু গোটা ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে-বলুন বলুন

আইলিন বলে–ইদানীং মিস বুলস্ট্রোডের মনে সুখ নেই। এই হল একটা ব্যাপার, অবশ্য আপনি সেটা বুঝতেও পারবেন না। আর শুধু তিনি একলাই যে অসুখী তা নয়। আপনি নিশ্চয়ই অন্য কোনো সংবাদের প্রত্যাশায় আছেন, তাই না? আমি যা বলছি সেটা তো মানসিকতার কথা। আইলিন বললেন যে, তার মনে হচ্ছে একটা কিছু গোঁজামিল আছে। এখানে যেন আমাদের মধ্যে এমন একজন কেউ আছেন যার স্থান এখানে নয়। অনুভূতিটা কেমন জানেন যেন মনে হচ্ছে পাখির ঝাঁকে বেড়াল এসে লুকিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু বেড়ালটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

কিন্তু রীজ কথাটা যে ভীষণ অস্পষ্ট।

.

আশ্চর্য কাহিনী

মাদমোয়াজেল অ্যাঞ্জেল ব্লাশকে দেখে পঁয়ত্রিশ বছর মনে হয়, প্রসাধন ছিল না। ঘন বাদামী চুল পরিপাটি করা, মোটা খসখসে কোর্ট আর স্কার্ট পরে আছে। বেশ ঝাঁঝালো সুরে বললেন, যে স্কুলে খুন হয় সেখানে থাকা কি পোয়! তাছাড়া বাড়িটার কোথাও কোনো গুপ্ত সংকেত ঘণ্টা নেই।

এখানে তো আর তেমন দামী জিনিসপত্র থাকে না মাদমোয়াজেল ব্লাশ, যে চোর-টোর আসবে?

কোনো মেয়ের কাছে যদি কোনো দামী জিনিস থাকেও সেটাকেও সে ব্যায়ামঘরে রাখতে যাবে কেন?

কী করে জানলেন? তাদের প্রত্যেকের জন্য একেকটা তালাবন্ধ দেরাজ আছে সেখানে জানেন না?

সে তো শুধু খেলার সরঞ্জাম রাখবার জন্য। আইনত তাই বটে, কিন্তু খেলার বুটের মধ্যে তো কেননা জিনিস রাখতে পারে। অথবা পুলোভারে বা স্কার্ফেও তোত জড়িয়ে রাখতে পারে।

কী ধরনের জিনিস মাদমোয়াজেল? খুব আদুরে বাপেরাও তো মেয়েকে জড়োয়ার হার স্কুলে নিয়ে আসতে দেবে না?

ধরুন পোকার মতো দেখতে ছোটো একটা মণি বা এমন কোনো জিনিস, তার দাম প্রচুর। এখানকার একটি মেয়ের বাবা তো পুরাতাত্ত্বিক।

আমার তো সম্ভব বলে মনে হয় না–মাদমোয়াজেল। আমি তো শুধু একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছিলাম।

ইনসপেক্টর তাকে জিজ্ঞাসা করল, মিস প্রিন্সারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল?

না ভীষণ অভদ্র ব্যবহার বলে পারতপক্ষে কথা বলতাম না। হাড়সর্বস্ব চেহারা, দাগদাগ মুখ, রুক্ষ কর্কশ সুর, যেন ইংরেজ রমণীর ব্যঙ্গ চিত্র। আমার সঙ্গে প্রায়ই বিশ্রী ব্যবহার করত।

বিশ্রী ব্যবহার করবার কারণ?

তার ক্রীড়ামঞ্চে আমাকে আসতে দিতে চাইতো না। একদিন সেখানে গিয়ে ঘুরে দেখছি, কী সুন্দর ইমারত চমৎকার সাজানো গোছানো। মিস প্রিন্সার এসে আমাকে বলে, কী করছেন এখানে, আপনার তো এখানে কোনো কাজ নেই। যে কিনা স্কুলেরই আরেকজন শিক্ষিকা–কি ভেবেছিল কি?

অ্যাঞ্জেল ব্লাশ চলে যেতেই বন্ড বললো, অভিমানী, ফরাসিরা সকলেই অভিমানী।

কেলসি বলে, যাই হোক কিছু খবর তো জানা গেল। মিস স্প্রিঙ্গার চাইতেন না যে লোকে তার ব্যায়ামঘরে আসুক মানে ক্রীড়ামঞ্চে…কিন্তু কেন?

বন্ড বললেন, তিনি হয়তো মনে মনে ভাবতেন যে ফরাসিনী তাকে চোখে চোখে রাখছে।

কিন্তু তাই বা কেন, তার ওপরে যে গোয়েন্দাগিরি করেছে এই ভয়টা তো তখুনি জাগবে যখন অ্যাঞ্জেল ব্লাশ তার কোনো গোপনীয় তথ্য জেনে নেবার সম্ভাবনা থাকবে।

আর কে কে আছে?

দুজন নবীন শিক্ষিকা মিস ব্লেক ও মিস রোয়ান, আর মিস বুলস্ট্রোডের সেক্রেটারি। মিস ব্লেকের বয়স কম, গোলগাল চেহারা, সরল মুখ। উদ্ভিদতত্ত্ব ও পদার্থবিদ্যা পড়ায়।

বিশেষ কোনো খরবই দিতে পারল না। মিস রোয়ানের মনস্তত্ত্বের ডিগ্রি। কাজেই তার নানা অভিমত। খুব সম্ভব স্প্রিঙ্গার আত্মহত্যাই করেছেন।

কেলসি তো অবাক, সে কী! তার মনে সুখ ছিল না?

 ভীষণ তীব্র স্বভাব ছিলো তার।

 বুঝুন তাহলে ওটা তো মানসিক প্রতিরক্ষা। তার সম্বন্ধে এতক্ষণ যতটুকু জেনেছি তাতে তো মনে হয় তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন।

একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী নয় কি, তার অনেক কথা থেকেই আমার সন্দেহ প্রমাণিত হয়।

মিস বুলস্ট্রোড এসে বললেন, ইনসপেক্টর কেলসি, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

সত্যি? কিছু জানে বুঝি?

আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপনি নিজে কথা বলে দেখুন, মেয়েটি আমাদের বিদেশী ছাত্রীদের মধ্যে একজন। আমীর ইব্রাহিমের ভাইঝি, রাজকুমারী শাইস্তা। মনে মনে নিজেকে খুব বড়ো করে ভাবে, বুঝলেন তো?

মাঝারি গড়নের একটি কাল মেয়ে ঘরে ঢুকলো, শান্ত বাদামী চোখে তাকিয়ে বলে, আপনারা পুলিশ?

হ্যাঁ আমরা পুলিশ, বসো, বলো তো তুমি কী জান মিস স্প্রিঙ্গারের সম্বন্ধে।

 হ্যাঁ বলবো আপনাকে।

বসে পড়ে সামনের দিকে ঝুঁকে–এই জায়গাটার ওপর লোকে নজর রেখেছে, তাদের দেখা যায় না বটে কিন্তু তারা আছে।

এই স্কুলের ওপর কেন নজর রাখবে?

 আমার জন্য, আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে।

 তোমাকে তারা চুরি করতে চায় কেন?

 কেন, মুক্তিপণ আদায় করবে আমার আত্মীয়দের কাছ থেকে।

আঁ…ও আচ্ছা…আচ্ছা কিন্তু তার সঙ্গে মিস স্প্রিঙ্গারের মৃত্যুর কি সম্বন্ধ?

শাইস্তা বলে, তিনি হয়তো ওদের দেখে ফেলেছিলেন, তিনি হয়তো সব জানতে পেরেছিলেন বলে তাদের ভয় দেখিয়েছিলেন। তারা হয়তো টাকার লোভ দেখিয়েছিল। তিনি টাকা নিতে ক্রীড়ামঞ্চে গেলেন, ব্যস তখন ওরা তাকে গুলি করল।

নাঃ, মিস স্প্রিঙ্গার কখনও কি ঘুষ নিতে পারেন?

কেন? স্কুলের মাস্টারনী হয়ে থাকাটা কি খুব সুখের…তাও ব্যায়াম শেখানোর মাস্টারনী? তার চেয়ে যদি টাকা থাকে সেটা ভালো না।

তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথাটা তো তোমার নিছক কল্পনাও হতে পারে? ইনসপেক্টর বললো।

শাইস্তা রেগে ওঠে, আপনি কিছু জানেন না। আমার জ্যাঠতুতো দাদা হচ্ছে রামাতের রাজা শাহাজার্দা আলি ইউসুফ। তিনি বিপ্লবে মারা গেছেন। কথা ছিল আমি বড়ো হলে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। কাজেই বুঝেছেন তো আমার গুরুত্ব কতখানি। কমিউনিস্টরা ভীষণ ভীষণ পাজি। ওরা ভাবছে যে রত্নগুলো কোথায় আছে আমি জানি।

রত্ন…কিসের রত্ন?

আমার ওই দাদার কিছু রত্ন ছিলো তার বাবারও ছিল। আমাদের পরিবারে সবসময়েই বহু হীরা জহরৎ থাকতো, বিপদের জন্য–বুঝলেন? ওরা ভাবছে যে আমি জানি রত্নগুলো কোথায়, তাই ওরা আমাকে ধরে নিয়ে খবর আদায় করবে।

জানো নাকি রত্নগুলো কোথায়?

না বিপ্লবের সময় থেকে ওগুলো উধাও। হয়তো কমিউনিস্ট হতচ্ছাড়াগুলো নিয়েছে, আবার হয়তো নিতে পারেনি।

ওগুলো কার সম্পদ?

আমার জ্যাঠতুতো দাদার মৃত্যুর পর ওগুলো আমার হয়ে গেছে, তার বংশে তো আর কেউ নেই। আমার মাও মারা গেছে।

সেই ব্যবস্থাই ছিল বুঝি, বিয়ের পর ওই রত্নগুলো তোমার হতো? তুমি পেতে?

.

আলোচনা চক্র

ইনসপেক্টর কেলসি ফিরতেই থানার সার্জেন্ট জানালো অ্যাডাম গুডম্যানকে।

অ্যাডাম গুডম্যান ও…হা মালি। অ্যাডাম বললো, শুনলাম আমাকে ডেকেছেন, কর্কশ স্বরে বললো।

কেলসি বললো–হ্যাঁ, ঘরে এসো।

খুনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আমাকে কেন? আমি তো বাসায় রাতে ঘুমোচ্ছিলাম। অ্যাডাম বললো ইনসপেক্টরকে যে, সে এইটা দেখাতে চায়।

অ্যাডামের সেই বেপরোয়া ভাবও নেই। মুখ গোমড়ানিও নেই। শান্ত ধীর সশ্রদ্ধ ভাব, কী একটা পকেট থেকে বের করে দেয়, কেলসি সেটা দেখে মাথা তুলে বলে…বারবার তোমাকে এখন দরকার হবে না।

অবাক হয়ে বিচক্ষণ তরুণ পুলিশই উঠে চলে যায়। কেলসি বললো,  এই তবে আপনার পরিচয়?

কিন্তু বলুন তো কোন কাজকর্ম আপনি এখানে—

তারপর অ্যাডাম বললেন ইনসপেক্টরকে যে, তিনি কী ব্যাপারে মেডোব্যাঙ্কে।

আমাদের ঠিক জানা নেই যে মেডোব্যাঙ্কে কি হচ্ছে। আমার কাজ পাহারাদারি বা কাল রাত পর্যন্ত তাই ছিলো। খেলার মাস্টারনী হত্যা? স্কুলের পাঠ্যতালিকায় পড়ে না।

অ্যাডামের কাহিনী কেলসি মন দিয়ে শোনে…ইনসপেক্টর বললো, ওই মেয়েটার ওপর অবিচারই করেছি। কিন্তু এই কাহিনী চট করে বিশ্বাস করা অসম্ভব। পাঁচ থেকে দশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের রত্ন? কার যেন জিনিসটা বললেন? বলা ভীষণ কঠিন। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনার বাঘা বাঘা উকিলের প্রয়োজন। তিনমাস আগে রত্নগুলোর মালিক ছিল রামাতের মহামান্য শাহজা আলি ইউসুফ। রামাতে যদি রত্নগুলো পৌঁছে যায় তার মালিকানা হবে সরকারের। হয়তো আলি ইউসুফ কোনো উইল করে গেছেন। সেই উইল কোথায় করা হয়েছে সেই প্রমাণের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।

কেলসি বললো, অর্থাৎ বলতে চান যে ওগুলো যারা পাবে তাদেরই হয়ে যাবে? না না, একথা ভালো নয়।

অ্যাডম গম্ভীর গলায় বলে, ভালো কথা তো নয়ই, তাছাড়া অনেকগুলো দলও সন্ধানে ঘুরছে। তারা কেউই সাধুসন্ত নয়। গুজবও হতে পারে, সত্যিও হতে পারে।

 কিন্তু মেডোব্যাঙ্কে কেন?

এই ছোট্ট রাজকুমারীর জন্য, যার মুখে এখনো দুধের গন্ধ। রাজকুমারী শাইস্তা আলি ইউসুফের খুড়তুতো বোন। ই, কেউ হয়তো ওকে জিনিসগুলো পৌঁছে দেবার চেষ্টা করবে। আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক চরিত্রের আমদানী হয়েছে।

অ্যাডাম ধীরে ধীরে বললো, প্রিঙ্গার রাত দুপুরে ক্রীড়ামঞ্চে ছিল কেন? কে তাকে হত্যা করেছে। সে প্রশ্ন অবান্তর। যতক্ষণ না আমরা জানতে পারছি কেন সে এত রাতে ক্রীড়ামঞ্চে গিয়েছিলো, বলা যেতে পারে তার অমন নির্দোষ ব্যায়ামপুষ্ট জীবনেও অনিদ্রা রোগ জন্মেছিল। বিছানা থেকে উঠে জানলা দিয়ে ক্রীড়ামঞ্চে আলো জ্বলতে দেখতে পেলো-তার জানলাটাও ওই দিকেই তো। শক্তসমর্থ সাহসী স্ত্রীলোক তাই নিজেই গেল অনুসন্ধানে, তাতে হয়তো কেউ কাজে বাধা পেলো, কাজেই লোকটা এমন মরিয়া হয়ে উঠলো যে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতেও কসুর করলো না।

কেলসি মাথা নাড়ে, আমারও ওভাবেই দেখছি। কিন্তু আপনার শেষের কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। হত্যা করবার জন্য গুলিও ছোঁড়া হয় না বা সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে লোকে আসে না, যদি না..ক্রীড়ামঞ্চে কোন রাজার ধন আছে। কিছু লুকিয়ে রাখবার মতো জায়গাই তো ওটা নয়। ওখানে কিছু পাওয়া যায়নি।

অ্যাডাম বলে, হত্যাকারী সেটা তো রেখে যাবে না, নিয়েই যাবে। অবশ্য অন্য আরেকটা সম্ভাবনা রয়েছে এতে। ক্রীড়ামঞ্চটি হয়তো গোপন আড্ডার স্থান হিসেবেই মিস স্প্রিঙ্গার বা অন্য কেউ ব্যবহার করতো। ধরা যাক মিস স্প্রিঙ্গার ওখানে গিয়েছিলেন কারো সঙ্গে দেখা করতে।… মতের অমিল হতেই গুলি খেয়ে মরলো। অথবা মিস স্প্রিঙ্গার কাউকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে তার পিছু নেয়, এবং এমন কিছু দেখে বা শোনে যা তার পক্ষে অনুচিত।

কেলসি বললো, আমি অবশ্য জীবিত অবস্থায় মিস স্প্রিঙ্গারকে দেখিনি কিন্তু শুনে স্পষ্ট বুঝলাম যে, সব ব্যাপারেই তিনি নাক গলাতেন।

অ্যাডামও একমত। মনে হয় ভদ্রমহিলার মৃত্যুও হয়েছে ওই জন্য।অধিক কৌতূহলে মরিল সিংহ..ক্রীড়ামঞ্চেই নাটকের রঙ্গমঞ্চে।

অ্যাডাম জোরে মাথা নেড়ে বললেন যে, স্কুলেই কেউ আছে, যার ওপর মনোযোগ দিতে হবে, পাখির ঝাঁকে আছে একটা বিড়াল।

কেলসি কথাটা কানে যেতেই থ। আঁ? কী বললে, পাখীর ঝাঁকে বেড়াল? আজও এই কথাটা মিস রীচ বলেছে, স্কুলের একজন শিক্ষিকা। এই পর্বে তিনজন নতুন এসেছে। সেক্রেটারি স্যাপল্যান্ড, ফরাসি শিক্ষিকা ব্লাশ, আর মিস স্প্রিঙ্গার, তিনি তো মারাই গেছেন। পাখির ঝাঁকে বেড়াল যদি থাকেই তবে দুজনের মধ্যে একজনই বেড়াল, কোনজন? তোমার কোনো ধারণা আছে?

অ্যাডাম বলে, আমি একদিন মাদমোয়াজেল ব্লাশকে ক্রীড়ামঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম কেমন যেন দোষী দোষী ভাব নিয়ে। মিস বুলস্ট্রোডও আশ্চর্য নারী। এই ব্যাপারটা আমরা যত শীঘ্র নিষ্পত্তি করতে পারি ততই মঙ্গল। মেডোব্যাঙ্ককে আমরা আবার ঝকঝকে তকতকে করে তুলতে চাই।

আপনি যে কে সে কথাটা এবার মিস বুলস্ট্রোডকে জানানো উচিত। ভয় নেই। তিনি মুখ খুলবেন না।

অ্যাডাম মাথা নেড়ে বলে, ঘটনা যেরকম দাঁড়িয়েছে, তাতে তো বলতেই হবে, আর কোনো উপায় নেই।

.

চাই পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ

আরো একটি গুণ আছে মিস বুলস্ট্রোডের, তিনি চমৎকার শ্রোতা। এই গুণের জন্যই তাকে মহিলা শ্ৰেষ্ঠা বলা যেতে পারে।

অ্যাডামের কথাগুলো শুনে কেলসি বললো, অদ্ভুত! অ্যাডাম ভাবল, আপনিই তো অদ্ভুত! মূলকথায় এসে পৌঁছলেন, ই, তাহলে আমায় কী করতে হবে বলুন?

ইনসপেক্টর কেলসি বলে, দেখুন আমারা ভেবে দেখলাম আপনাকে সব কথা খুলে বলা উচিত…স্কুলের স্বার্থেই।

মিস বুলস্ট্রোড মাথা নেড়ে বললেন, স্বভাবতই স্কুলের স্বার্থই আমি প্রথমে দেখবো। আমার ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আমিই সম্পূর্ণ দায়ী। কর্মীদের জন্যও বটে তবে কম। কাজেই মিস ম্প্রিন্সারের মৃত্যুর প্রচার যত কম হয় ততই আমার পক্ষে ভালো। অবশ্য ওটা স্বার্থপরের মতো হল। অবশ্য এই ঘটনাটার পূর্ণ প্রচার যদি আপনাদের কাজের জন্য আবশ্যক হয় তবে তো করতেই হবে। কিন্তু তার কী দরকার আছে?

কেলসি বলে, না কম প্রচার হলে আমাদের পক্ষেও ভালো। আমরাও জানিয়ে দেবো মনে হচ্ছে ঘটনাটা স্থানীয় ব্যাপার, ছোকরা গুণ্ডার দল…যাকে আজকালকার ভাষায় শিশু অপরাধী বলা হয়…মিস স্প্রিঙ্গার হঠাৎ তাদের চমকে দেওয়ায় ওরা গুলি ছোঁড়ে।…আমি চাই এই ধরনের গল্পই চলুক, তাহলেই আমরা চুপচাপ তদন্ত করতে পারবো।

কেলসি বলে, মিসেস আপজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যত শিগগির সম্ভব, আপনজনের কাছে তার ঠিকানা আছে?

নিশ্চয়।…তবে শুনেছিলাম যে তিনি এখন বিদেশে। আচ্ছা দাঁড়ান এখুনি খোঁজ করছি।

ঘন্টি বোতামটা দুবার টিপে জুলিয়া আপনজনকে একটু পাঠিয়ে দিতে বললেন।

অ্যাডাম বললো, মেয়েটি আসার আগেই আমি কেটে পড়ি। ইনসপেক্টর তদন্ত করছেন, সেখানে আমার থাকাটা ঠিক নয়। ইনসপেক্টর এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন বকাবকি দেবার জন্য, এখন দেখছেন আমি কিছুই জানি না। অতএব চলে যেতে হুকুম দিলেন।

দরজায় টোকা শুনে মিস বুলস্ট্রোড বললেন, ভেতরে এসো। ছুটতে ছুটতে আসার জন্য জুলিয়া আপজন হাঁপাচ্ছে।

এসো জুলিয়া।

 কেলসি গর্জে উঠলো এখন তুমি যেতে পার, গুডম্যান। নিজের কাজ করগে।

জুলিয়া বললো, যে তাকে ডাকা হয়েছে? মিসেস বুলস্ট্রোড বললো, হ্যাঁ তোমার মায়ের ঠিকানাটা দাও। একটা চিঠি লিখতে হবে। জুলিয়া বললো, মা বিদেশে গেছে, ইসাবেল মাসিকে লিখুন। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তোমার মা ইনটেলিজেন্সে কাজ করতেন, তাই না? হ্যাঁ, মায়ের খুব ভালো লাগতো।

আচ্ছা জুলিয়া ধন্যবাদ। যেতে পারো এখন।

.

 বিপর্যয়

স্কুল খোলর পর তৃতীয় সপ্তাহ শেষ। এই শনি-রবিবারেই ছাত্রীরা প্রথম তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে বাইরে বেরুবার অনুমতি পাবে। ফলে সপ্তাহ শেষে প্রায় খালি মেডোব্যাঙ্ক। রোববার দুপুরে খাবার জন্য মোট কুড়িজন মেয়ে কর্মীরাও অনেকে ছুটিতে গেছে। মিস বুলস্ট্রোড নিজেও সপ্তাহের শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মেডোব্যাঙ্কের প্রতিপত্তির দরুন মিস স্প্রিঙ্গারের হত্যাকাণ্ডটি পত্রপত্রিকায় বিশেষ আলোড়ন তুললো না। স্পষ্ট করে না বললেও এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হল যেন কজন মস্তান ছোকরা দরজা ভেঙ্গে ক্রীড়ামঞ্চে ঢুকেছিলো। মিস ম্প্রিন্সারের মৃত্যু হয়তো আকস্মিক ইচ্ছাকৃত নয়। পুলিশ কজন তরুণকে থানায় ডেকেছে পুলিশকে সাহায্য করতে।

..শনিবার সকালে মিস বুলস্ট্রোড.তার সেক্রেটারি অ্যান স্যাপল্যান্ড চিঠিপত্র লেখার কাজ সবে শেষ করেছে–টেলিফোন বাজতেই অ্যান ধরলো।

আমীর ইব্রাহিমের অনুচরের সঙ্গে মিস বুলস্ট্রোড কথা বললেন…রোববার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে শাইস্তা তৈরি থাকবে। রাত আটটার মধ্যে মেয়ে যেন ফিরে আসে। টেলিফোন রেখে বললেন, এই প্রাচ্য দেশের মানুষগুলো ঠিক একটুও সময় দিতে পারে না, কালই শাইস্তা যাবে গ্রিসেলদারের সঙ্গে, সব ঠিক হয়ে গেছে, এখন আবার বদলাও। অ্যান স্যাপল্যান্ডকে বললেন যে চ্যাডউইককে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা।

চ্যাডউইক হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, চ্যাডিকাল আমীর ইব্রাহিম শাইস্তার কাকা ওকে নিতে আসবেন, যদি তিনি নিজে আসেন তো বলে দিও মেয়েটি স্কুলে ভালোই পড়াশুনা করছে।

.

রবিবার সকাল, ঝকঝকে দিন। শনিবারে মিস বুলস্ট্রোড চলে গেছেন। স্কুলে রয়েছে শুধু মিস ভ্যান্সিটার্ট, মিস চ্যাডউইক, মিস রোয়ান আর মাদমোয়াজেল ব্লাশ। মিস ভ্যান্সিটার্ট ও চ্যাডউইক সব অভিভাবকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন আর তাদের মেয়েদের দিচ্ছেন।

সভাঘরে মিস ভ্যান্সিটার্ট ও মিস চ্যাডউইক বসেছিলেন। মিস রোয়ান ঘরে ঢুকেই বললো, শাইস্তা কোথায়, তাকে কোথাও পেলাম না, আমীরের গাড়ি এসেছে তাকে নিতে। চ্যাডি বললো, কী, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। আমীরের গাড়ি তো এসেছিল সেই বলল, প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ হল। আমি নিজে দেখেছি সেই গাড়িতে উঠতে।

ভ্যান্সিটার্ট বললে, হয়তো দু-দুবার করে গাড়িকে বলে দিয়েছে অমনি কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। নিজেই বাইরে গিয়ে শোফেয়ারকে বললো, দেখো গলতি হয়েছে কোথাও। পঁয়তাল্লিশ মিনিট হল মেয়েটি লন্ডনের পথে রওনা হয়ে গেছে। কখনো অমন ভুল হতে পারে না।

হামেশাই হয় এমন।

সাড়ে চারটের সময় টেলিফোন বাজতে চ্যাডি সাড়া দিল, মেডোব্যাঙ্ক স্কুল, মিস বুলস্ট্রোড আছেন? কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল বেশ উঁচু বংশের কোনো ইংরেজ পুরুষ।

মিস বুলস্ট্রোড আজ এখানে নেই, আমি মিস চ্যাডউইক বলছি।

দেখুন আপনাদের এক ছাত্রীর সম্পর্কে আমাদের কিছু বলবার আছে…আমি ক্রারিজ থেকে বলছি আমীর ইব্রাহিমের কামরা থেকে।

হা বলুন?…শাইস্তার সম্বন্ধে তো?

হ্যাঁ, আপনাদের কাছ থেকে আমরা এখনো কোনো খবর পাইনি, আমীর বেশ বিরক্ত হয়েছেন?

খবর? তাকে আমরা কি খবর দেবো?

 কেন বলতে তো পারতেন, শাইস্তা এলো না বা আসতে পারলো না।

এলো না!..মানে আপনি কি বলতে চান যে সে এখনো পৌঁছায়নি? না আসেইনি এখানে, …মেডোব্যাঙ্ক থেকে রওনা হয়ে গিয়েছে, বলছেন!

হ্যাঁ, সকালেই তো একটা গাড়ি এসেছিল। প্রায় সাড়ে এগারোটায়, সেই গাড়িতেই তো গেল।

কী আশ্চর্য এখনও পর্যন্ত কোনো পাত্তা নেই।

মিস চ্যাডউইক বললো, কী কাণ্ড! দুর্ঘটনা না হলেই বাঁচি, না না না, খারাপ কেন ভাবছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এতক্ষণ খবর পেয়ে যেতেন। নইলে আমরাও তো পেতাম।

না…ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে। আচ্ছা…মানে…আমীরকে অবশ্য এখন কোনো সম্ভাবনার কথা বলবো না…তবু আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কোনো…ইয়ে মানে পুরুষ বন্ধু নেই তো? নাঃ থাকতেই পারে না।

দেখুন ওসব কথা মনেও স্থান দেবেন না, একেবারে অসম্ভব। টেলিফোন রেখে চ্যাডি ভাবলো সত্যি কি অসম্ভব? চ্যাডি বলে, মেয়েটি কিন্তু বলেছিল যে কেউ ওকে হরণ করতে চেষ্টা করবে।

.

মিস চ্যাডউকের ঘুম আসে না

 বিছানায় শুয়ে মিস চ্যাডউইক এপাশ ওপাশ করছে ঘুম আসছে না।

আটটা যখন বেজে গেলো তখনও শাইস্তা ফিরলো না। কোনো খবরও পাওয়া গেল না। তখন মিস চ্যাডউইক আর শান্ত থাকতে পারলো না। নিজের হাতেই ব্যাপারটার ভার নিলো। ইনসপেক্টর কেলসিকে টেলিফোন করলো। ইনসপেক্টর বললো যে, মিস চ্যাডউইক যেন তার ওপরেই ব্যাপারটা ছেড়ে দেয়। যা কিছু করার তিনিই করবেন।

কেলসি বললো, দেখুন সবচেয়ে বেশি করে সে জিনিসটা আপনি বা বুলস্ট্রোড এড়িয়ে যেতে চান তা হল প্রচার। মনে হয় না মেয়েটিকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। অতএব ভাবনা করবেন না। আমার উপরেই ছেড়ে দিন।

চ্যাডির ঘুম আসছে না রাতে, খাট থেকে নেমে দুটো অ্যাসপিরিন মুখে ফেলে এক গেলাস জল খায়। ফিরে যেতে যেতে জানলার পর্দা সরিয়ে একনজর দেখে মনকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল, যে সারারাতে আর কখনো ক্রীড়ামঞ্চে আলো দেখা যাবে না।

কিন্তু দেখা গেলো।…চ্যাডি সঙ্গে সঙ্গে জুতোজোড়া পড়ে মোটা কোট গায়ে চরিয়ে টর্চ লাইটটা নিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। কাউকে ডাকবার কথাও মনে হল না। ক্রীড়ামঞ্চে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দেখতে হবে সে রাতের আগন্তুক কে। পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঝোঁপের রাস্তা দিয়ে প্রায় ছুটেই চলে, দুরুদুরু বুকে দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে হাঁটে। দরজা সামান্য ভেজানো ছিলো, ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে তাকালো।

.

হত্যার পর হত্যা

ইনসপেক্টর কেলসি ভীষণ গম্ভীর গলায় ঘরে ঢুকলো, আসুন আবার একটা।

এটা আবার কী? প্রশ্ন করে অ্যাডাম। আবার একটা হত্যা, ইনসপেক্টর কেলসি বলে, তার পিছু পিছু অ্যাডামও বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইনসপেক্টরকে প্রশ্ন করে অ্যাডাম–

আরেকজন শিক্ষার্থী…মিস ভ্যান্সিটার্ট। কোথায়? ক্রীড়ামঞ্চে।

আবার অ্যাডাম বললেন, কী আছে সেখানে। আপনি এবার জায়গাটার তল্লাশি নিন, ইনসপেক্টর কেলসি বলে, বলা যায় না আপনাদের কায়দা অনুসরণ করলে যদি কোনো ফল পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই ক্রীড়ামঞ্চে কিছু আছে নইলে ওখানেই হত্যার পর হত্যা হচ্ছে কেন? ডাক্তার হাঁটু গেড়ে শব পরীক্ষায় ব্যস্ত। ঘরে ঢুকতেই ডাক্তার উঠে দাঁড়ায়।

আধঘণ্টা হল মারা গেছেন। ডাক্তার বললো, বড়োজোর চল্লিশ মিনিট হবে। প্রথম কে দেখেছিল? কেলসি জিজ্ঞাসা করল। তার লোক বলে ওঠে, মিস চ্যাডউইক। কেলসি বললো, কি দিয়ে মারা হয়েছে? আবার গুলি কি?

ডাক্তার মাথা নেড়ে বলে, না, এবারে মারা হয়েছে মাথার পেছনে বালির বস্তা বা হান্টার জাতীয় কিছু একটা দিয়ে।

দরজার কাছে গলফের ডান্ডা পড়েছিল। একমাত্র এটাই ছিল।

ডাক্তার বলে, মৃতদেহে অস্ত্রের কোনো ছাপ পড়েনি। রবার মোড়া হান্টার বা বালির বস্তা হবে। খুনি নিঃশব্দে এসে মাথার পেছনে হেনেছে প্রচণ্ড আঘাত। উনি সামনে পড়ে গিয়েছিলেন, জানতেও পারেননি কিসের আঘাত লাগলো।

কি করেছিলেন তিনি? ডাক্তার বলে এই দেরাজটার সামনে হাঁটু গেড়ে ছিলেন। ইনসপেক্টর এগিয়ে গিয়ে সেটাকে দেখে। মেয়েটির নাম লেখা আছে নিশ্চয়ই। দেখি, হ্যাঁ, এই তো শাইস্তা…ওহো সেই মিশরীয় মেয়েটা। মহামাননীয় রাজকুমারী শাইস্তা। মিস ভ্যান্সিটার্টের উপর আজ স্কুলের দায়িত্ব ছিল। মিস বুলস্ট্রোড তো বাইরে গেছে।

ইনসপেক্টর বললেন, মিস চ্যাডউইকের সঙ্গে তাহলে দেখা করা যাক।

চ্যাডউইক তার ঘরে একটা চেয়ারে বসেছিলেন। রাতটা বেশ গরম তবুও তার ঘরে বিদ্যুঞল্পী জ্বলছে, হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। ইনসপেক্টর কেলসির দিকে বিবর্ণ মুখে তাকিয়ে, মরে গেছে..মরে গেছে না?

কেলসি মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে মিস চ্যাডউইককে বলে, কী ভয়ানক! মিস বুলস্ট্রোডও নেই, স্কুলটা শেষ হয়ে যাবে যে।…বলতে বলতে কেঁদে উঠলো।

সান্ত্বনার সুরে কেলসি বলে, আমার কথা আপনার মনে খুব আঘাত লেগেছে জানি, তবু আমার অনুরোধ সাহস ফিরিয়ে আনুন। মিস চ্যাডউইক আমাকে বলুন কী ঘটেছিল। আমরা যত শিগগিরি জানতে পারি কে অপরাধী ততই মঙ্গল, ততই কম প্রচার হবে এই সব অপকাণ্ডের।

চ্যাডউইক বললো, দেখুন আমি তাড়াতাড়ি শুতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে অন্তত একটি দিনের জন্যও অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোত পারি। কিন্তু ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, ঘুম এল না।

স্কুলের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা?

হ্যাঁ, শাইস্তার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপার। মিস স্প্রিঙ্গারের কথাও মনে হচ্ছিলো। ভাবছিলাম অভিভাবকদের আতঙ্কিত করে তুলবে। তারা কি আর পরের বারে তাদের মেয়েদের পাঠাবেন? তারপর অ্যাসপিরিন খেলাম, আবার শুতে আসবার সময় কেন জানি না পর্দা তুলে বাইরে তাকালাম। বোধহয় তখনো আমার মাথার মধ্যে মিস প্রিন্সারের চিন্তাই ঘুরছিল। আমি দেখলাম –এখানে তো আলো জ্বলছে।

কী রকম আলো?

আলোটা যেন নেচে নেচে উঠলো, টর্চের লাইটই হবে বোধহয়। আগেরবার মিস জনসন ও আমি যেরকম দেখেছিলাম।

 হুবহু একই আলো কী?

 হুঁ, সেইরকমই মনে হচ্ছে। বোধহয় একটু তেজ কম ছিলো, কী জানি ঠিক মনে নেই।

ওঃ তারপর?

হঠাৎ চ্যাডউইকের গলার স্বর তেজালো হয়ে উঠলো। তারপর আমি এবারে সংকল্প করেছিলাম দেখতেই হবে ওখানে কে, আর কি করছে। তাই আমি কোট আর জুতো পরে নিলাম। একছুটে বাইরে চলে গেলোম। কাউকে ডেকে নেবার কথা মনে হয়নি তখনও। এত তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়েছিলাম সে সব কথা মনেও হয়নি। ভেবেছি দেরি হয়ে গেলে হয়তো তাকে পাওয়াই যাবে না। দরজা পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাই দৌড়ে গিয়েছিলাম। তারপর পা টিপে টিপে কোনো আওয়াজ না করে ওখানে গিয়ে দেখতে পাই কে আছে, ওখানে কী করছে। দরজা ভেজানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল, এদিক ওদিক চোখ বোলাতে গিয়েই দেখি…ওকী উপুড় হয়ে পড়ে আছে,…মৃত…তার গা…শিউরে শিউরে উঠলো।

একটা কথা বলতে পারেন, ইনসপেক্টর জিজ্ঞাসা করল, ওখানে একটা গলফের লাঠি দেখলাম, আপনি কি সেটা নিয়ে গেছেন? না–মিস ভ্যান্সিটার্ট?

চ্যাডউইক বললেন যে, তিনি নিয়ে গেছেন, যদি কোনো প্রয়োজন হয়।