দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ৩০

।। ত্ৰিশ।। 

(অ্যানির জবানবন্দী) 

সুজান আমার সাথী হতে চাইলেও আমি রাজী হইনি। অনেক অশ্রুপাতের পর সে আমাকে একা অভিযানের সায় দিয়েছিল। সে আমাকে চোখের জলে বিদায় জানাল। 

আমার গন্তব্যস্থলে পরদিন সকালে পৌঁছলাম। একজন বেঁটে, মুখে কালো চাপ দাড়ি হল্যান্ডীয় লোক আমাকে নিতে স্টেশনে এসেছিল। আগে তাকে দেখিনি। লোকটা গাড়ি চালিয়ে শহরতলীর দিকে ছুটে চলল। তার মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু হ্যারীর লোক হলে অনর্গল কথা বলত। আমার মনে হল আমি এখানে দ্বিতীয়বার ফাঁদে পড়লাম। 

এক জরাজীর্ণ বাড়ি, এক কাফ্রি যুবক দরজা খুলল। 

হল্যান্ডীয় লোকটি হেসে, মিঃ হ্যারি রেবার্নের সঙ্গে এই মেয়েটি দেখা করতে চান।

ঘরটায় তামাকের গন্ধ, ডেস্কের পিছনে একজন লোক কী যেন লিখছিল। লোকটা কুঁচকে বলল, তাহলে ইনিই মিস বেডিংফিল্ড? 

আমি বোধহয় একজন লোকের মধ্যে দু’জনের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, উনি কি মিঃ চিকেস্টার, না কি মিস পেটিগ্রিউ? এদের দু’জনের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে দেখছি। যাই হোক, আমি কি তাহলে ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি? 

বিদ্রূপের হাসি মুখে, আপনার ভাষাতেই বলতে হয়। মিস বেডিংফিল্ড, দ্বিতীয়বার আপনি ফাঁদে পড়লেন। 

—হয়তো সেটা আমার পক্ষে খুব একটা সুখকর নয় মিঃ চিকেস্টার 

পেটিগ্রিউ, শ্লেষের হাসি হেসে বললাম, সত্যি আপনার মেক-আপ অপূর্ব। মিস পেটিগ্রিউ-এর ভূমিকায় আপনাকে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। এমনকি স্যার ইউস্টেস পেডলের নোট নেওয়ার সময় কেপটাউনে তার ট্রেনের কামরায় আমাকে দেখে আপনি যখন ভয় পেয়ে পেন্সিল ভাঙলেন তখনও আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। 

—আপনার দুর্ভাগ্য। যাক, যে প্রয়োজনে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি, সে ব্যাপারে আলোচনা করতে পারি? 

—প্রয়োজন? আপনার মতো লোকের সঙ্গে? 

—না, কাজটা ঠিক আমার সঙ্গে নয়। আসলে স্যার ইউস্টেস আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান মিস বেডিংফিল্ড। 

—কার নাম করলেন? 

—হ্যাঁ, স্যার ইউস্টেস—হুকুম করার ভঙ্গিতে বলে, মিস বেডিংফিল্ড, আমার সঙ্গে এই পথে আসুন। 

পাশের ঘরের দরজায় নক করতেই উত্তর এল। ভিতরে এসো— 

ঘরে ঢুকতেই স্যার ইউস্টেস ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন সম্ভাষণের জন্য। 

তোমার সঙ্গে মিলিত হয়ে আমি খুব খুশী মিস বেডিংফিল্ড। আমাকে বসতে বলে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, পথ ভ্রমণে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না তোমার? না হলেই ভালো। 

নিচে মিন্ধুসকে দেখেছ নিশ্চয়ই? এখন বলো, তুমি কবে থেকে আমাকে কর্নেল বলে মনে করতে শুরু করলে? 

—মিঃ প্যাগট যেদিন আমাকে বলল, সে আপনাকে মার্লোয় দেখছে। অথচ সেই সময়ে আপনার ভেনিস্-এ থাকার কথা। 

—হ্যাঁ, এই একটা জায়গায় প্যাগট আমাকে টেক্কা দিয়েছে। আমার কথামতো ফ্লোরেন্সে না গিয়ে মার্লোয় ফিরে গিয়ে— 

—আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল যখন আপনি কিলমার্ডেন জাহাজের ডেক থেকে আমাকে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। 

তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সেদিন সত্যি আমি তোমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কেন জান? প্রথমত তোমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলেন, ইচ্ছে তোমাকে বিয়ে করব। কিন্তু তুমি সাড়া দিলে না। তারপর আমার সব পরিকল্পনা বানচাল করে দেওয়ার জন্য আমার পিছু নিয়েছিলে তাই। নাদিনা বড্ড বেশি জেনে ফেলেছিল আমার ব্যাপারে। আমার শান্তির পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াক সেটা আমি কোনোদিনই চাই না। তাই আমি তাকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি জানতাম তাকে সরিয়ে দিতে পারলে, হীরেগুলো আমার অধিকারে এসে যাবে। তবে দীর্ঘদিন প্যাগটকে আমার সঙ্গে রেখে আমি ভুল করেছিলাম। 

স্যার ইউস্টেস একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, কিন্তু এখন তোমাকে নিয়ে কী করব? তোমার বক্তব্যের মধ্যে কোনো ফাঁকি নেই। একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যেই আজ আমি তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি। এবার বলো সেই হীরেগুলো এখন কোথায়? 

—হীরে রেবার্নের কাছে, কথাটা বলে আমি তাঁর মনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তাকালাম।

—হুম, সেই হীরেগুলো আমার চাই-ই। 

—আমার মনে হয় না সেই হীরেগুলো ফিরে পাওয়ার আপনার কোনো সুযোগ আছে।

—নেই বলছ? শোনো সুন্দরী, আমি কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে তোমাকে জড়াতে চাই না। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, নাদিনা খুন হওয়ার সময় তোমাকে মিল হাউসে দেখা গিয়েছিল। নাদিনা-হত্যার ব্যাপারে তোমাকে অনায়াসে জড়িয়ে ফেলতে পারি। তুমি বুদ্ধিমতী, অতএব আমার অবাধ্য হবে না। এখন আমার প্রস্তাব হল, তোমার প্রেমিক হ্যারি রেবার্নকে তুমি চিঠি লিখে জানিয়ে দাও। সে যেন হীরেগুলো সঙ্গে নিয়ে এখুনি এখানে চলে আসে। আমার এই সৎপ্রস্তাব তোমার মানা না মানার ওপরে তোমার বেঁচে থাকার সবকিছু নির্ভর করছে। 

।। একত্রিশ।। 

হ্যারি রেবার্ন আমাকে স্যার ইউস্টেসের সামনে দেখে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। স্যার ইউস্টেস বুঝতে পেরে বলে ওঠেন, ওর কোনো দোষ নেই হ্যারি। আমার নির্দেশে ও তোমাকে এখানে আসতে বলেছে। এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার তৃতীয় সাক্ষাৎকার। দু’দুবার তুমি আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছ, কিন্তু এবার আর পারবে না— 

হ্যারি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, আপনি ভুল করছেন স্যার ইউস্টেস, আপনার খেলা শেষ। তুরুপের তাস এখন আমার হাতে। আমি একা আসেনি— 

কর্নেল রেস তার দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। স্যার ইউস্টেস চমকে আমার দিকে ফিরলেন। তার চোখে হাজার প্রশ্ন। আর আমার চোখে জয়ের হাসি। 

—আমি এখানে আসার আগে ওদের খবর দিয়ে আসি। স্যার ইউস্টেস, আপনি নিজেকে যত চালাকই ভাবুন-না-কেন, একটা জায়গায় আপনি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। টেলিগ্রামে ‘অ্যান্ডির’ নাম সই করার বদলে হ্যারির সই করেছিলেন। রেবার্নের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল সব টেলিগ্রাম সে ‘অ্যান্ডির’ ছদ্মনামে পাঠাবে। সেই কারণে এখানে আসার আগে সব আটঘাট বেঁধে রেখে আসি। আপনি তো জানেন, কর্নেল রেস সিক্রেট সার্ভিসের লোক। আপনার সব খেলা শেষ, তাই না স্যার ইউস্টেস পেডলার? এখন লক্ষ্মীছেলের মতো হীরেগুলো আমাদের হাতে তুলে দিন। 

—হীরে! 

—হ্যাঁ, সেই হীরেগুলো? মিসেস ব্লেয়ার সেই হীরেগুলো একটা বড় কাঠের জিরাফের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর সেটা অন্য খেলনার সঙ্গে আপনার কাছে গচ্ছিত রেখে যায়। কী ভুল বলছি? 

— না, ভুল বলিনি, ভুল তুমি কোনোদিন করনি। তবে, বিদ্রূপের হাসি তার ঠোঁটে। সেই হীরেগুলো তুমি কোনোদিন পাবে না। সেই কাঠের জিরাফটা কোনোদিনও কেউ খুঁজে পাবে না- 

অভিযান শেষে ফেরার পথে কর্নেল রেস একান্তে নিরালায় আমাকে এক অদ্ভুত কথা শোনালেন। অ্যানি, তুমি আমাকে পছন্দ না করলেও আমি তোমাকে একান্তে ভালোবাসি। আর আমার মনের কথা তোমার বন্ধু সুজানও জানত। সে নিশ্চয়ই তোমাকে বলে থাকবে— 

কিন্তু আমি যে হ্যারি রেবার্নকে— 

তুমি যাকে হ্যারি রেবার্ন ভাবছ সে আসলে হ্যারি রেবার্ন নয়— 

—কে, কে সে তাহলে? 

হ্যারি সেই সময় আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত, সে বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। ওকে আমার আসল নামটা এবার বলে দিন। 

অ্যানি, হ্যারি লুকাস ওর নাম নয়। যুদ্ধে হ্যারি লুকাস মারা যায়। আসলে ও হল জন হ্যারল্ড আউমলি। 

—নামে কী এসে যায়? ওর নাম হ্যারি কিংবা জন যাই হোক-না-কেন, আমি তো এই মানুষটাকেই ভালোবেসেছিলাম। তাই কোনো দ্বিধা না করে আমি ওকে আমার সিদ্ধান্তে অটল রেখে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করে নেওয়ার জন্য স্বাক্ষর রাখতে দু’হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে মুখটা ওপর দিকে তুলে ধরলাম। 

জনের মুখটা ধীরে ধীরে আমার ঠোটের ওপর নেমে আসে। ওর মনের সব দ্বিধা, সব জড়তা তখন কেটে গেছে। 

আকাশে তখন ভোরের আলো আর আমাদের নতুন করে আবার জীবন শুরু হল।