১১. তদন্তের বিবরণ

একাদশ পরিচ্ছেদ

১১.১

কলগেট তার তদন্তের বিবরণ দিচ্ছিলেন, একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা স্যার। ব্যাপারটা মিসেস মার্শালের টাকা সম্পর্কে। ব্ল্যাকমেলের গল্পটার সমর্থনে আমার হাতে প্রমাণ এসেছে। স্যার আরস্কিন পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মিসেস মার্শালকে দিয়েছিলেন, তা এখন মাত্র পনেরো হাজারে দাঁড়িয়েছে।

পুলিসপ্রধান শিস দিয়ে, তাই না কি! তাহলে বাকি টাকাগুলো গেলো কোথায়?

 মাঝে মাঝে কিছু সম্পত্তি হাত বদল করেছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই লেনদেন হয়েছে ঋণপত্রের বিনিময়ে–অর্থাৎ সে টাকা তিনি এমন কারো হাতে তুলে দিয়েছেন যার পরিচয় প্রকাশ পাক তিনি চাননি। সেই ব্ল্যাকমেলার এই হোটেলেই রয়েছে। নিঃসন্দেহে ওই তিনজনের একজন।

কিন্তু তেমন জোরালো কিছু তথ্য পাইনি স্যার। মেজর ব্যারী, তার নিজের কথা অনুযায়ী একজন অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি অফিসার। আয় পেনশনের টাকা আর কিছু কোম্পানির শেয়ারের লভ্যাংশ। কিন্তু গতকয়েক দফায় বেশ মোটা টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছেন, ওগুলা বাজী জেতা টাকা। সত্যি তার ছোট বড় সবরকমের রেসের মাঠে যাতায়াত আছে।

ধর্মযাজক স্টিফেন লেনের পরিচয়ে কোনো বুজরুকি নেই। ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য বছরখানেক হলো জীবিকা ত্যাগ করেছেন। এই কারণে মানসিক রুগীদের এক নার্সিংহোমে ছিলেন। ডাক্তারদের থেকে কাজের কথা আদায় করা কঠিন। কিন্তু ধর্মযাজকের প্রধান রোগ শয়তান সম্পর্কে আচ্ছন্নতা–বিশেষ করে স্ত্রীলোকের বেশে-রক্তবর্ণ স্ত্রীলোক–ব্যাবিলনের বেশ্যা। স্টিফেন লেনকে সন্দেহ করা যেতে পারে। নিহত মিসেস মার্শাল ছিলেন রক্তবর্ণ স্ত্রীলোক লাল চুল, সুতরাং এই অশুভ মেয়েটিকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।

ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারে খাপখাওয়ার মতো কিছু পাওনি?

না স্যার। তবে নিজস্ব আয় আছে। আর খুনের দিন কেউই রাস্তায় কোনো পাদরিকে দেখেনি। গীর্জার খাতায় শেষ নামটা লেখা রয়েছে তিনদিন আগে। ধরুন দিন দুই গীর্জায় গিয়ে হয়তো নামটা ২৫ শে সই করে অসেন। দিন পনেরো খাতাটা নাকি কেউ খোলেওনি।

আর আমাদের তৃতীয় জন?

ওখানেই নির্ঘাত কোনো গোলমাল রয়েছে। ভদ্রলোক যে আয়কর দেন তা তার লোহার ব্যবসার তুলনায় অনেক বেশি। তিনি শেয়ার বাজারেও যাতায়াত করেন। তবে তিনি অজ্ঞাত কোনো উপায়ে বেশ রোজগার করেছেন।

ওয়েস্টন বললেন, তাহলে মিঃ ব্ল্যাট একজন পেশাদার ব্ল্যাকমেলার?

তা না হলে হেরোইনের মামলায় জড়িয়ে আছেন। যিনি মাদকদ্রব্যের চালানোর তদন্তে রয়েছেন তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সম্প্রতি চোরাপথে বেশ কিছু হেরোইন এদেশে আসছে। কিন্তু কিভাবে আসছে সেটা এখনো খাজ পায়নি।

হেরোইন চালানোর দলে যদি জড়িয়ে পড়ায় মার্শাল মহিলার মৃত্যু হয় তাহলে উচিত হবে ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দেওয়া।

বড় দুঃখের কথা, মার্শালের দু-দুটো জোরালো খুনের উদ্দেশ্যে থাকা সত্ত্বেও সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে বসে রইলো।

ওয়েস্টন হাসলেন, দুঃখ করো না কলগেট। আমাদের কৃতিত্ব দেখাবার সুযোগ এখনও রয়েছে। ব্ল্যাকমেল সূত্র এবং উন্মাদ ধর্মযাজক-সমাধানের এ দুটো পথ আছে। আমার ধারণা মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত সমাধানটা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। যেভাবেই ধরো না কেন আমরা যথেষ্ট

কলগেট বললেন, ও, ভালো কথা, মিসেস মার্শালের জে.এন. সই করা যে চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিলো তার খোঁজ নিয়েছি। ভদ্রলোক চীন দেশে নিরাপদেই আছেন। মিস ব্রুস্টার এই মক্কেলের কথাই বলছিলেন। সবকিছুই আমাদের খোঁজ নেয়া হয়ে গেছে; সব ফলাফলই শূন্য।

ওয়েস্টন বললেন, আমাদের বেলজিয়াম বন্ধুর খবর কি?

ভদ্রলোক অদ্ভুত ধরনের মানুষ, তাই না? পরশুদিন আমাকে বললেন যে গত তিন বছরে শ্বাসরোধে ঘটা প্রতিটি খুনের মামলার তথ্য তার চাই।

তাই নাকি? আচ্ছা আমাদের পাদরিসাহেব কবে নাগাদ ওই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন।

গত ইস্টারের একবছর আগে, স্যার।

ওয়েস্টন বললেন, একটা ঘটনা আমার মনে আছে–ব্যাগশট-এর কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে একটা যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেয়েটা ওর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে কোথায় যেন গিয়েছিলো আর ফেরেনি। আরও একটা ঘটনার নাম দিয়েছিলো। নির্জন জঙ্গলের রহস্য। দুটো ঘটনাই সারের।

কলগেট বললেন, সারে? তাহলে তো পুরোপুরি খাপ খেয়ে যাচ্ছে। যদি তাই হয়…

.

১১.২

 এরকুল পোয়ারো দ্বীপের সর্বোচ্চ শিখরেবসেছিলেন, তিনি ইস্পাতের মইটা লক্ষ্য করছিলেন, মইয়ের শীর্ষপ্রান্তের কাছে কতগুলো বিশাল রুক্ষ পাথর পড়ে রয়েছে। যেগুলো নিচের সৈকতে নামতে ইচ্ছুক যে কোনো ব্যক্তিকে আড়াল করতে পারে। পোয়ারো মনে মনে টুকরো ছবির ধাঁধার টুকরোগুলো মিলিয়ে নিলেন। আর্লেনা মার্শালের মৃত্যুর দিন কয়েক আগে স্নান সৈকতে কাটানো একটি সকাল। ব্রিজ খেলার একটি সন্ধ্যা। কে কে ছিলেন তখন।

খুনের আগের দিন সন্ধ্যা। সমুদ্রের সামনের পাহাড়ের কিনারায় ক্রিস্টিনের সঙ্গে তার কথাবার্তা হোটেলে ফেরার পথে তার দেখা একটি দৃশ্য।

প্রতিটি টুকরো একই সম্পর্কহীন তথ্যগুলির প্রতিটি নিজের নিজের জায়গায় খাপ খেয়ে যেতে বাধ্য। তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিষ্ঠিত তথ্যগুলো হাতে নিয়ে তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলবেন।

অশুভ শক্তি…

হাতের টাইপ করা কাগজটায় চোখ রাখলেন পোয়ারো। নীলি পার্সল–শবহ্যামে-এর কাছাকাছি এক নির্জন জঙ্গলে তাকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত সেই খুনীর কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

নীলি…?

অ্যালিস করিগানের মৃত্যুর প্রতিটি শব্দ তিনি গভীর মনোযোগে পড়তে লাগলেন।

.

১১.৩

 ইনসপেক্টর কলগেট বসে থাকা পোয়ারোর কাছে এগিয়ে এলেন। পোয়ারোর হাতের কাগজগুলো এক পলক দেখে বললেন, ওই মামলাগুলো নিয়ে কিছু করলেন স্যার?

হ্যাঁ, ওগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি।

আমি নিজেও ওগুলো সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়েছি–বিশেষ করে অ্যালিস করিগানের ব্যাপার পড়ে পুলিসের সঙ্গে দেখা করেছি।

বলুন বন্ধু, আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।

অ্যালিস কারিগানকে ব্ল্যাকরিজ হিথ-এর সিজার্স গ্রোভ-এ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়–মলে কম্প যেখানে নীলি পার্সেলকে পাওয়া গিয়েছিলো। সেখান থেকে মাত্র মাইল দশেক দূরে–এবং দুটো জায়গাই হোয়াইটরিজের বারো মাইলের মধ্যে মিঃ লেন যেখানে ধর্মর্যাজক ছিলেন।

পোয়ারো বললেন, অ্যালিস করিগানের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বলুন।

ওর মৃত্যুর সঙ্গে নীলি পার্সলের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই কারণ পুলিস খুনী হিসেবে অ্যালিসের স্বামীকেই সন্দেহ করে, কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ উঠতেই আমাদের স্বামীদেবতাটি সন্দেহের থেকে একেবারে মুছে গেলেন। অ্যালিসের মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিলো পল্লী অঞ্চলে ভ্রাম্যমান একজন শক্তসমর্থ খাটো প্যান্ট পরিহিতা যুবতী। মেয়েটি ল্যাংকাশায়ারে এক স্কুলের খেলার দিদিমনি। ঠিক সোরায় চারটেয় মৃতদেহটি সে আবিষ্কার করেছিলো এবং তার মতে মেয়েটি দশ মিনিট আগে মারা যায়। পুলিস সার্জন পৌনে ছটা নাগাদ মৃতদেহটি পরীক্ষা করে মেয়েটির মতে সমর্থন জানান। নীলি পার্সল মানে সেই অস্থিরমনা পরিচারিকা যাকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় মর্লে কম্পে পাওয়া যায়। ওদের বিশ্বাস, একই লোক এই দুটো খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই লোককে ওরা ধরতে পারেনি। আর এখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তৃতীয় একজন মহিলা মারা গেলেন–জনৈক ভদ্রলোক একইভাবে সন্দেহের দৃশ্যপটে উপস্থিত।

পোয়ারো তখন অস্ফুট কণ্ঠে বললেন,-কোন টুকরোটা লোমের কম্বলের আর কোন টুকরোটা বেড়ালের লেজের বুঝে ওটা ভারী শক্ত।

কলগেট চমকে উঠলেন, কি বলছেন স্যার?

ক্ষমা করবেন। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। বলুন ইনসপেক্টর, যদি আপনার সন্দেহ হয় যে কেউ একজন মিথ্যে বলছে-কিন্তু আপনার হাতে প্রমাণ নেই, তাহলে কি করবেন?

ইনসপেক্টর কলগেট চিন্তা করলেন।

তবে আমার মনে হয়, অনর্গল কেউ যদি মিথ্যে কথা বলে যায়, তাহলে শেষের দিকে তালগোল পাকিয়ে ধরা পড়ে যেতে বাধ্য।

পোয়ারো জানালেন, হ্যাঁ, আপনার কথা সত্যি। কিছু বিবৃতি পুরোপুরি মিথ্যে।

আপনার মন অদ্ভুতভাবে কাজ করে, তাই না স্যার? তাহলে একটা প্রশ্ন করছি, শাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াগুলোর দিকে আপনার নজর গেলো কি কারণে? কখনও ভেবেছি এটাই খুনির প্রথম অপরাধ নয়।

কিন্তু অ্যালিস করিগানের মৃত্যু–বলুন, ইনসপেক্টর কলগেট, এই খুনের সঙ্গে এই মৃত্যুর একটা অদ্ভুত মিল আপনার নজরে পড়েছে না?

পোয়ারো হালকা স্বরে বললেন, ও আপনার নজরে পড়েছে?

.

১১.৪

 পুলিসপ্রধান বললেন, একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

 ঠিক করেছি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে ডেকে মামলাটা ওদের হাতে দেবো। আমার মতে, পুরো ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ওপর। পিক্সি গুহাই ছিলো অন্যতম আস্তানা। তবে ব্যক্তিটি কে, তা আমি বলতে পারি। হোরেস ব্ল্যাট।

পোয়ারো বললেন, তাহলে আপনার বিশ্বাস ব্ল্যাটই খুনী?

সেটাই মনে হচ্ছে। এও হতে পারে আর্লেনা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন, সে সম্পর্কে ব্ল্যাটকে কিছু বলেছিলেন, মিথ্যে সাক্ষাৎকারের নাম করে আর্লেনাকে ডেকে পাঠায় ও তাকে খুন করে। সুতরাং যা বললাম। আমার মতে সবচেয়ে ভালো পথ হলো গোটা ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দেওয়া। কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

চিন্তান্বিত ভাবে পোয়ারো বললেন, হয়তো ঠিক হবে।

ওয়েস্টন বললেন, অবশ্য জানি, আপনার ও কলগেটের ধারণা অন্যরকম। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ মামলা আমাদের জন্য নয়।

পোয়ারো বললেন, এখন একটা পিকনিকে গেলে মন্দ হয় না।