১. স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর

এ হলিডে ফর মার্ডার (এরকুল পোয়ারো)

০১.

 ২২ শে ডিসেম্বর।

স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোটের কলারটা উঁচু করল। স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া আকাশে বাতাসে আর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্ম। এখন সমস্ত কিছু নোংরা আর ধোঁয়া ধোঁয়া।

হঠাৎ এই পরিবর্তন স্টিফেনকে একটু চিন্তান্বিত করে তুলেছে। যেমন নোংরা দেশ–তেমনি নোংরা শহর। এই প্রথম তার লণ্ডনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া হল, এখানকার দোকান, রেস্তোরাঁ, সুবেশা মহিলারা সমস্ত কিছু মলিন হয়ে গেছে। মনে করা যাক এখন সে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেছে।.স্বদেশে ফেরার জন্য কিছুক্ষণের জন্য সে উতলা হয়ে উঠল। রোদ ঝলমলে আকাশ…ফুলের বাগান…সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস–আর এখানে আছে শুধু অগণিত মানুষের ভিড় এবং কয়লার ধোয়া আর গাদাগাদি ব্যস্ততা।

কিছুক্ষণের জন্য সে চিন্তা করল। তারপর দরকারের কথা মনে পড়ল। সে বহুবছর ধরে প্ল্যান করে আসছে।

সে ইচ্ছা স্বল্পস্থায়ী, সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করল : কী জন্য? এতে তার কোন লাভ আছে? আর কেনই বা অতীতের দিকেমনোসংযোগ করা? সে কেন সমস্ত মুছে ফেলতে পারছে না? এ-সমস্ত কিছুই কী দুর্বলতা? সে বাচ্চা ছেলে নয় যে সে খেয়ালের বশে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার বয়স এখন চল্লিশ। সে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

যে কাজের জন্য ইংল্যাণ্ডে আসা সেই কাজ সে করবেই।

সে ট্রেনে উঠে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বসবার জায়গার সন্ধানে চারিদিকে তাকায়। একটির পর একটি কামরা পার হয়ে যায় সে। ট্রেনটা যাত্রী বোঝাই, তিন দিন বাকী আছে খ্রস্টমাস আসতে।

সে হঠাৎ দক্ষিণ আমেরিকার মুক্ত অরণ্যের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। নির্জন সূর্যস্নাত একখণ্ড জমির জন্য।

পরক্ষণেই কামরার দিকে দেখতে গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে যায়। এই মেয়েটি আর সমস্ত মেয়ের থেকে আলাদা। কালোচুল, বিবর্ণ চোখে গভীরতা, নিশীথ রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃস্তব্ধতা। সুখের না হলেও অহংকার করার মতো ছিল সেই চোখ। এইসব রসকষহীন লোকগুলোর মধ্যে বসে থাকা মেয়েটার মানায় না। তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের এই জায়গা; যেখানে কোনো আনন্দ নেই–সেই জায়গায় যাওয়াটা তার ঠিক নয়। অন্য জায়গা হলেও তাকে ভালোই মানাতে, তৃতীয় শ্রেণীর কামরার এক কোণে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা তার ভালো দেখায় না।

সে একজন পর্যবেক্ষক। মেয়েটির পরণে কালো কোট এবং মলিন স্কার্ট, সস্তা ফেব্রিকের দস্তানা। রংচটা জুতো এবং বহুদিনের পুরোনো হাতব্যাগ–কোনো কিছুই তার নজর এড়িয়ে গেল না। তা সত্ত্বেও তার শরীরে সৌন্দর্য্য এতটুকু ম্লান হয়নি। ভারী সুন্দর এবং আশ্চর্য মেয়ে সে…

এত মানুষের ভিড়ে, ঠাণ্ডা কুয়াশায় সে কী করছে? সে চিন্তা করল মেয়েটি কে? আমাকে জানতেই হবে এখানে সে কী করতে এসেছে? হ্যাঁ, আমায় অবশ্যই জানতে হবে…

জানলার ধারে কুঁকড়ে বসে থাকা পিলার তখন চিন্তা করছিল, কী আশ্চর্যরকম গন্ধ ইংরেজদের গায়ে।

হুইসেল দেওয়া হয়ে গিয়েছিল একটা উচ্চ কণ্ঠস্বর কী যেন বলল। একসময় ট্রেনটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। যাত্রা আরম্ভ মেয়েটি তার পথে এগিয়ে চলেছে।

তার বুক ধড়ফড়ানি বাড়তে লাগল। সমস্ত কিছু ঠিক ঠিক বলবে তো? সে যে কাজে যাচ্ছে তাতে সে অসফল হবে না তো? নিশ্চয়ই এত বেশী সতর্কতার সঙ্গে সে চিন্তা করছিল। যে কোনো চরম অবস্থার জন্য তৈরী সে। তাকে সফল হতেই হবে…সফল সে হবেই।

মেয়েটি সরল সাদাসিধে শিশুর মত চারপাশে দেখল–সমস্ত লোকগুলোর মধ্যে সাতজন…এই ইংরেজরা কীরকম মজার লোক। তারা সবাই বড়লোক। তাদের জুতো জামাকাপড় সব দামী…ওঃ? সে সবসময় শুনে এসেছে ইংল্যাণ্ড খুব ধনী দেশ, কিন্তু তারা সুখী নয়।

ঐ যে করিডোরে একজন সুপুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে–পিলার ভাবল সে খুব সুন্দর। তার গায়ের রঙ তামাটে, টিকালো নাক, চৌকো কাধ সে পছন্দ করে। সে তাকে সামনাসামনি একবারও দেখেনি, কিন্তু সে বেশ ভালো করেই জানে, প্রায় প্রতিক্ষণই সে তাকে দেখেছে। আর ঠিক কী ভাবেই বা সে দেখেছে?

মেয়েটি খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। তাদের দেশে পুরুষেরা মেয়েদের দিকে দেখে আচমকা চোখ পড়ে যাবার মতো, অযথা দেখে না দেখার ভান করে। তাই ভয় হয় লোকটি বোধহয় ইংরেজ না। পিলার ঠিক করল, যা হোক সে তাকে সত্যিকারের ইংরেজ বলে মেনে নেবে। লোকটিকে তবু ভালো বলতে হয়, সে একজন আমেরিকানও হতে পারে।

সে চিন্তা করল লোকটিকে অনেকটা চিত্রাভিনেতাদের মতো দেখতে। সে পাশ্চাত্য ছায়াছবিতে যেমন দেখেছিল।

প্রথম রাত্তিরের আহারের ডাক পড়তেই কামরায় সেই সাতজন যাত্রী ডাইনিংকারের দিকে চলে যেতেই সেখানে মরুভূমির নির্জনতা এবং শান্ত ভাব লক্ষ্য করল পিলার। খোলা জানালা দিয়ে লণ্ডনের দক্ষিণ শহরতলীর দৃশ্য চোখে পড়ল তার। ওপারে দরজা খোলার আওয়াজ হওয়া সত্ত্বেও পিলার ফিরে দেখল না। যেমন ভাবে জানালার উপর চোখ রেখে পিছনে হেলান দিয়ে বসেছিল সেই ভাবেই বসে রইল। পিলার অনুভব দিয়ে বুঝল যে, নিশ্চয়ই করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য কামড়ায় ঢুকেছে।

স্টিফেন ফারই প্রথম কথা বলল–ট্রেনে খুব ভিড়।

-ও, হা, তা ঠিক। আমার মনে হয় লণ্ডন থেকে এখন সবাই চলে যাচ্ছে, কারণ এখানে এখন ব্ল্যাকআউট চলছে।

স্টিফেন দেখল মেয়েটি নির্ভুল ইংরাজী বলে তবে একটু জোর দিয়ে কথা বলে সে।

অপর দিকে পিলার চিন্তা করছে ট্রেনে একজন আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলাটা অপরাধ। আবার স্টিফেন যদি নতুন হয় তাহলে একজন যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার অস্বস্তিবোধ করা উচিত ছিল। কিন্তু স্টিফেনের কথাবার্তা ছিল বন্ধুর মতো, তাই সে ভাবল, যে কোনো মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে সে।

স্টিফেন নিজে সচেতন না হয়েই বলল-এই লণ্ডন শহরটা খুবই ভয়ঙ্কর জায়গা তাই না?

-হ্যাঁ, আমিও অপছন্দ করি।

–আমারও পছন্দ নয়।

–তুমি কী ইংরেজ?

–আমি ব্রিটিশ, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসছি।

–হ্যাঁ, তোমার কথায় সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।

–তুমিও কী বিদেশ থেকে আসছে?

পিলার মাথা নেড়ে বলল-স্পেন থেকে।

স্টিফেন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল–তুমি স্পেন থেকে আসছ, তাহলে তো তুমি স্প্যানিশ?

–বলতে পারেন আধা স্প্যানিশ। আমার মা ইংরেজ সেই কারণে আমি ভালো ইংরাজী বলতে পারি।

-যুদ্ধের খবর কী? স্টিফেন বলল।

–খুব খারাপ, ভয়ঙ্কর। তুমি কোন দিকে?

পিলারের রাজনীতির বক্তব্য স্পষ্ট নয়–যে গ্রাম থেকে আসছি সেখানে কেউ যুদ্ধের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।

–তার মানে সেখানে তোমাদের কারো মধ্যে কোনো বিবাদ নেই?

পিলার তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল।

–তুমি তাহলে তোমাদের শত্রু সেনোরিটারদের ক্ষমা করবে?

 পিলার মাথা নেড়ে বলল–আমার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু যদি আমার একজন শত্রু থাকত কিংবা আমাকে ঘৃণা করত তাহলে আমি সেই শত্রুর গলা এইভাবে কাটতাম। বলে হাত নেড়ে শত্রুর গলাকাটা দেখাল।

-তুমি তো দেখছি রক্তের নেশায় পাওয়া তরুণী।

–কেন, তুমি তোমার শত্রুর সঙ্গে কেমন করে মোকাবিলা করবে জানতে পারি কী?

-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে…প্রসঙ্গ বদলে ফেললো স্টিফেন।-তুমি কী জন্য ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছ?

পিলার গম্ভীর হয়ে বলল–আমি আমার এক ইংরেজ আত্মীয়ের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি।

স্টিফেন আশ্চর্য হয়ে গেল–নম্র, ভদ্র একটি ব্রিটিশ পরিবার খ্রীস্টমাসের সময় এই স্প্যানিশ আগন্তুককে নিয়ে কী করতে পারে? তার একটা ছবি মনে মনে এঁকে নিল।

পিলার জিজ্ঞাসা করল–দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটা খুব সুন্দর, তাই না?

সেই উত্তর দিতে গিয়ে স্টিফেন দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প এমন করে শুরু করল যেমন করে ঠাকুরদা নাতনীকে রঙচরিয়ে রূপকথার গল্প বলে।

কিছুক্ষণ পর যাত্রীরা ফিরে আসতে থাকলে স্টিফেন রূপকথায় ইতি টেনে করিডোরে ফিরে এলো। চলে আসার সময় স্টিফেনের চোখে পড়ল লাগেজের ওপরে লেখা নামটার উপর–মিস পিলার এস্ট্রাভাজেস। তারপর ঠিকানার উপর চোখ পড়তেই চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় বড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটা আশ্চর্যরকমের প্রতিক্রিয়া হল–গারস্টন হল, লংডেল, এ্যাডেলসফিল্ড।

মুখটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে স্থির চোখে মেয়েটিকে সে এক নতুন অনুভূতিহতভম্ব, বিরক্ত সন্দেহভাবে দেখল।

গারস্টন হলে বিরাট নীল ও সোনালী রং-এর ডাইনিং রুমে বসে অ্যালফ্রেড লী এবং তার স্ত্রী লিডিয়া আসন্ন খ্রীস্টমাসে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল। আলফ্রেডের চেহারা ছিল মাঝামাঝি, মুখটা নষ, চোখ দুটো ফিকে বাদামী রং-এর। তার গলার স্বরে ছিল স্পষ্টতা, শান্ত এবং সংযত ভাব। তার স্ত্রী লিডিয়ার চোহারা ছিল তোগাটে। তার রোগা মুখে কোনো সৌন্দর্যের চিহ্ন না থাকলেও কণ্ঠস্বরটা ছিল খুব সুন্দর।

অ্যালফ্রেড বলে উঠল-বাবার মতামতটা একবার নেওয়া প্রয়োজন।

লিডিয়া খুব সতর্কতার সঙ্গে উত্তর দিল–তুমি কিছু মনে করো না, তোমার বাবা খুব খেয়ালী আর অত্যাচারীও।

–তিনি বুড়ো।

–আর তার বয়স যত বাড়বে অত্যাচারের মাত্রাও তত বাড়বে? এর শেষ কোথায় বলতে পারো? আমরা যা করি না কেন সব ব্যাপারেই তিনি খবরদারি করেন, আমরা নিজের ইচ্ছামতো কোনো কাজই করতে পারি না, যদি বা কখন করতে যাই উনি সব ভণ্ডুল করে দেন।

-কিন্তু একথা ভুলো না যে, তিনি আমাদের কাছে খুব ভালো।

–ওহো, উনি আমাদের কাছে খুব ভালো তাই না? তুমি কী আর্থিক দিক দিয়ে বলতে চাইছ? শান্ত কণ্ঠে বলে লিডিয়া।

-হ্যাঁ, ওনার নিজস্ব চাহিদা খুবই অল্প। কিন্তু টাকা দেবার ব্যাপারে এতটুকুও কৃপণতা করেন ।না তুমি তোমার ইচ্ছামতো জামাকাপড় কিনতে পারো, মনের মতো করে বাড়ি সাজাতে পারে। তাতে যতো টাকাই লাগুক না কেন তিনি এতোটুকুও দ্বিধা করেন না। তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে গত সপ্তাহতেই তিনি আমাদের একটা নতুন গাড়ি কিনে দিয়েছেন।

আমি তা অস্বীকার করছি না, যে তিনি টাকার ব্যাপারে উদার। কিন্তু তার বদলে তিনি আমাদের সঙ্গে চাকরের মতো ব্যবহার করবেন?

–চাকর?

তাছাড়া, আর কী? হ্যাঁ, অ্যালফ্রেড তুমি ওঁর চাকর ছাড়া আর কী? আমরা যদি কোথাও যাবো বলে স্থির করি, তক্ষুনি উনি বাধা দিয়ে বলবেন, না ওখানে যাওয়া হবে না। ওনার ইচ্ছা মতো উনি আমাদের যেখানে পাঠাবেন সেখানে যেতে হবে। আর তুমিও তো তাই মেনে নাও, ওঁর অন্যায় হুকুম মেনে নেওয়া চাকরের কাজ নয় কী? আমাদের জীবন, স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।

অ্যালফ্রেড বিরক্ত হয়ে রুক্ষস্বরে বলল–লিডিয়া, আমার ইচ্ছা নয় যে, তুমি এধরনের কথা বল। এটা একটা অকৃতজ্ঞের পরিচয়। আমার বাবা আমাদের জন্য সমস্ত কিছুই করেছেন। তাছাড়া, তুমি ভালো করেই জানো, তুমি ঐ বুড়ো মানুষটির অত্যন্ত প্রিয়।

-না, মোটেই আমি তার প্রিয় নই।

ছিঃ ছিঃ লিডিয়া, তোমার মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনতে খুবই খারাপ লাগছে। অবিবেচকের মতো কথাবার্তা। বাবা যদি বুঝতে পারেন।

–তোমার বাবা খুব ভালো করেই জানেন, আমি ওনাকে অপছন্দ করি। আমার মনে হয় তিনি তাতে আনন্দ পান।

-তুমি খুব ভুল করছো লিডিয়া। জানো তিনি আমাকে প্রায়ই কী বলেন? তোমার স্বভাব তার কাছে খুব মিষ্টি।

অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার স্বভাব সবসময়েই নষ থাকে এবং চিরকাল থাকবেও। শোন, অ্যালফ্রেড ওঁর সম্পর্কে আমার মনোভাব কী তা আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমার বাবাকে পছন্দ করি না। আমার মতে উনি একজন খেয়ালী আর অত্যাচারী বুড়ো। ওঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আর দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন উনি। তাই অনেক আগেই তোমার ওনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত ছিল।

অ্যালফ্রেড তীক্ষ্ণ স্বরে বলে–আমি তাই করবো লিডিয়া। দয়া করে তুমি ওঁর সম্বন্ধে আর কিছু বল না।

আমি দুঃখিত, মনে হয় আমি ভুল করছি-ওসব কথা বাদ দিয়ে এসো আমরা সামনে খ্রস্টমাসের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করি। তা তুমি কী মনে করো তোমার ভাই ডেভিড কী সত্যি সত্যই এখানে আসবে?

–আসবে নাই বা কেন?

লিডিয়া সন্দিগ্ধ চোখে দেখল–বড় আশ্চর্য মানুষ এই ডেভিড। জেনে রাখো বহু বছর হল এ বাড়ির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে তোমার মায়ের খুব ভক্ত ছিল। জায়গাটার প্রতি তার একটু ভালোবাসা ছিল।

অ্যালফ্রেড বলল–এও আমার জানা আছে, যে, উত্তেজনার বশে বাবা হয়তো কোন সময়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকবেন। তবু আমার মনে হয় ডেভিড আর হিলডা খ্রীস্টমাসের সময় ঠিক আসবে। তুমি দেখো।

লিডিয়া মুখটা বিরক্ত করে বলল–জর্জ আর ম্যাগজলেন সম্ভবতঃ আগামীকালই এসে পৌঁছাবে। আমার ভয় যে, ম্যাগজলেনের একঘেয়ে লাগবে।

কেন? জর্জ কী তার থেকে কুড়ি বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছে? এটা আমি ভাবতেও পারি না, কারণ, জর্জ খুব একটা চালাক ছিল না।

–না, সে তার জীবনে খুবই সফল। নির্বাচন কেন্দ্রের লোকেরা তাকে খুব ভালোবাসে। আমার বিশ্বাস রাজনীতির ক্ষেত্রে ম্যাগজলেন তার হয়ে খুবই পরিশ্রম করে।

-ম্যাগজলেনকে আমার খুব ভালো লাগে। তাকে দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু মাঝে মাঝে তার কী মনে হয় জানো? গোলাপের মতো সুন্দর সুন্দর মেয়েদের ও একজন। আরো ভালো করে বলতে গেলে ওর মিষ্টি চেহারা, মিষ্টি ব্যবহারের উপর যেন একটা মেঘের আস্তরণ ছড়ানো আছে।

–মানে তারা ভেতরে ভেতরে খুব খারাপ। লিডিয়া তাকে বলল–অ্যালফ্রেড তুমি এইরকম আশ্চর্য কথা বলতে পারলে? আমি জানতাম তোমার ভেতরটা ভদ্র, খারাপ কথা তুমি কাউকে বলতে পারো না। আমার মাঝে মাঝে তোমার উপর রাগ হয় কেন জানো? তুমি কোনো কোনো ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ নও এবং এই পৃথিবী সম্পর্কে তোমার জ্ঞানও খুব সীমিত।

তার স্বামী হাসল।–তোমার মতো এ পৃথিবী সম্পর্কে সবসময়েই আমি। না! একজনের মনের মধ্যেই কেবল অসৎ বাসা বাঁধেনি, অসৎ চারিদিকেই ছড়িয়ে আছে। এ পৃথিবীর অসৎ অন্যায়, অসাধুতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু তা আমার আছে।

আমি সেটা সবসময়ই উপলব্ধি করতে পারি এই বাড়িতে, এইখানে। লিডিয়া মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

-লিডিয়া..অ্যালফ্রেড তার কথা শেষ না করতেই ঘাড় ঘোরাতে দেখল মসৃণ মুখের একজন কালোলোক তার দিকে সশ্রদ্ধচিত্তে তাকিয়ে আছে।

লিডিয়া কঠিন স্বরে বলল-খবর কী-হারবারি:

হারবারি নীচু গলায় বিনীতভাবে বলল–ম্যাডাম, খ্রীস্টমাসের সময় আরো দুজন অতিথি আসবে সেকথা আপনাকে বলতে বললেন, আর তাদের জন্য ঘর ঠিক করে রাখতে বললেন।

লিডিয়া চমকে উঠে বলে আরো দুজন অতিথি?

হারবারি নরম গলায় বলল-ম্যাডাম একজন ভদ্রলোক ও আর একজন তরুণী।

অ্যালফ্রেড অবাক হয়ে বলল-তরুণী?

-হ্যাঁ, স্যার মি. মিলি সেই কথাই বলছিল।

লিডিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল–আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে ওপরে যাচ্ছি।

–ম্যাডাম, আমায় ক্ষমা করবেন। মিঃ লী এখন ঘুমোচ্ছেন তিনি আমায় একথাও বলে দিয়েছেন যে এখন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।

হারবারি চলে যেতেই লিডিয়া বলল–এবার বুঝতে পারলে তো কেন আমি লোকটাকে পছন্দ করিনা। বেড়ালের মতো কেমন চুপচাপ বাড়িতে চলাফেরা করেন। তার চলার শব্দ কেউ শুনতেও পায় না।

লোকটিকে আমিও অপছন্দ করি। কিন্তু একটা কথা কী জান আজকালকার দিনে একটা ভালো পুরুষ নার্স পাওয়া কঠিন। আর তাছাড়া লোকটা ভালো কাজ জানে। আসল যে ব্যাপারটা হল বাবা ওনাকে পছন্দ করেন।

-সেটা না হয় হল কিন্তু অ্যালফ্রেড ঐ তরুণী লেডিটি কে?

 তার স্বামী মাথা নেড়ে বলল তারও অজানা, তারা দুজনে দুজনকে দেখল। লিডিয়া আবার বলল–আমি কী চিন্তা করছি জান অ্যালফ্রেড? আমার ধারণা তোমার বাবা একঘেয়েমিতে ভুগছেন। তাই খ্রীস্টমাসে একটা নতুন বৈচিত্র্য আনতে চান।

আমাদের পরিবারে দুজন নুতন লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে? বেচারা বুড়ো হয়েছে তাছাড়া খোঁড়া পায়ের জন্য পঙ্গু হয়ে আছেন অথচ কিছুদিন আগেও তার জীবন ছিল নানা অভিযানে পূর্ণ।

লিডিয়া আচমকা রাগে চিৎকার করে উঠল, তার কপাল যে তোমার মতো ছেলে পেয়েছিলেন। তুমি ওঁর এতো প্রিয় কেন জানো, তুমি ওঁকে পুজো কর বলে।

অ্যালফ্রেড উল্টে প্রতিবাদ করল।–তোমার বাড়াবাড়ির মাত্রাটা একটু বেড়ে যাচ্ছে। এটাতো অস্বাভাবিক কিছু নয়, ছেলে তার বাবাকে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, করাটাই স্বাভাবিক। অ্যালফ্রেড লিডিয়ার হাতের উপর হাত রেখে নরম ভাবে বলল–তোমার চিন্তার সঙ্গে সবকিছু আগে আগে যায়। এতে তোমার ঈর্ষার তো কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।

লিডিয়া অনুশোচনা ভরা ঠোঁটে তাকে একটা চুমু খেল।

লিডিয়া বলল–এখন অবধি যখন আমি জানতে পারলাম না, আমার সেই রহস্যজনক অতিথি কে? তখন আমি বাগান পরিচর্যা করতে চললাম।

–প্রিয়া, বাইরে খুব ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া কীরকম তীরের মতো গায়ে ফুটছে দেখছ না?

–সারা শরীর গরম জামাকাপড়ে ঢেকে নিলেই হবে।

লিডিয়া ঘর থেকে চলে গেল। অ্যালফ্রেডের একা একা ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না। লিডিযা খেয়াল করেনি কখন সে চুপচাপ গলায় মাফলার গায়ে কোট চাপিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লিডিয়া ততক্ষণে দুটো পাথরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটা ক্যাকটাস গাছের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এটাই আমি চাইছিলাম।

তোমার কাজের শেষ নিদর্শন লিডিয়া। একটু ইতস্তত করে সে বলল–এই যে এগুলো? তোমার কী এগুলো পছন্দ, অ্যালফ্রেড?

এগুলো রোদে পুড়ে শুকনো হয়ে গেছে তাই না?

এগুলো আমার মতে মৃত সমুদ্র।

এগুলো অন্য সব ফুলের মতো তেমন আকর্ষণীয় নয়।

 ঠিক সেই সময় জোরে একটা পদশব্দ শোনা গেল। বৃদ্ধ খানসামা, একমাথা সাদা চুল সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। তাদের দিকে তাকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।

-ম্যাডাম, মিস জর্জ লী ফোন করে জানতে চাইছেন তিনি এবং মিঃ জর্জ আগামীকাল ৫টা ২০ মিনিটে এলে অসুবিধা হবে?

-না না, ওকে বল ঐ সময় আসতে।

—ধন্যবাদ ম্যাডাম।

খানসামা তাড়াতাড়ি চলে যেতেই লিডিয়া বলে-বুড়ো ট্রেসিলিয়ান, এই বয়সেও কী পরিশ্রম করতে পারে, দেখেছে। ওকে ছাড়া আমি কিছু চিন্তাই করি না।

অ্যালফ্রেডও মাথা নেড়ে সায় দিল।

কথার ফাঁকে লিডিয়া তার বাগান পরিচর্যার কাজও শেষ করলো।

ক্যাকটাস গাছগুলোর ওপর ছাউনির কাজ শেষ করে সে বলে উঠল–এবার আমি তৈরী।

 অ্যালফ্রেড বোকার মতো বলল-তৈরী!

 লিডিয়া হেসে ফেলল।

খ্রস্টমাসের জন্য। আমাদের এই চিন্তাশীল পরিবারের জন্য আমরা বারে আমাদের খ্রীস্টমাসের আয়োজন করতে যাচ্ছি।

ডেভিড তার পত্রখানি আর একবার পড়ে দেখছিল। তার স্ত্রী তাকে চুপচাপ নিরীক্ষণ করছিল। দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ার পর সে বলল-ডেভিড শোন, সবকিছু তোমার উপলব্ধির উপর নির্ভর করছে।

হিলডা খুব সুন্দর না হলেও তার মনটা ছিল উদার এবং তার মধ্যে একটা যাদুকরী গুণ ছিল। অনেকটা জলছবির মতো। এছাড়া স্বীকার করতেই হয় হিলডা লীর মধ্যে বাড়তি একটা তেজ ছিল।

ডেভিড চারদিকে পায়চারি করতে থাকে। তার চুল এখনো পাকেনি। তার ছেলেমানুষী চেহারাটা সত্যিই আশ্চর্যের।

ডেভিড বলল–হিলডা তোমাকে বারবার আমার মনোভাবের কথা জানিয়েছি। আমি আমাদের বাড়ি দেশের পরিবেশ সবকিছুকে ঘৃণা করি। আমি যখন আমার বাবার কথা চিন্তা করি তখন আমার মার কথা মনে পড়ে যায়। আমার মার বিষণ্ণতার মূলে ছিলেন তিনি। প্রেমঘটিত ব্যাপার। আমার মার প্রতি ওনার বিশ্বাসঘাতকতা আমার ঘৃণাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

হিলডা বলে ওখানে তার পড়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। অনেক আগেই তার চলে যাওয়া উচিত ছিল তাহলে তিনি আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারতেন।

ডেভিডের মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, যেটা সে সময় অসম্ভব ছিল–তুমি জানো না, ঐ সময় মহিলারা ওরকম ব্যবহার করতে পারত না, তাছাড়া আমার মার চিন্তাধারা হল সব স্ত্রীদের স্বামীর ঘরেই থাকা উচিত। এছাড়া এটা তার নিজের ঘর। তিনি যাবেনই বা কোথায় আর ডিভোর্স করলেই বা কী হতো, বাবা হয়তো আবার বিয়ে করতেন। আর একটা পরিবারের জন্ম হতো; তখন আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হতো। মা এইসব কথা চিন্তা করেছিলেন।

হ্যাঁ, তবে আমার মনে হয় তুমি বিশেষ কিছু জানোনা ডেভিড।

-হ্যাঁ, তিনি আমাকে সব কিছু বলে গেছেন। আমি যে তাকে কী রকম ভালোবাসতাম তা তিনি ভালো করেই জানতেন। যখন তিনি মারা যান, তার গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলেন। জানো হিলডা, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার একেবারে একাকী জীবন। তিনি তখন প্রায় যুবতী। তাঁর মৃত্যুর কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁকে খুন করেছিলেন।…আমার বাবা। তাঁর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তিনি আমার মার বুক ভেঙে ছিলেন। সেই সময় আমি ঠিক করি যে, তার ছত্রছায়ায় আর থাকব না।

হিলডা তাকে সমর্থন জানিয়ে বলে–তুমি বিবেচকের মতো কাজ করেছ। তুমি ঠিক করেছ।

-বাবার ইচ্ছা ছিল আমি ওয়ার্কস-এ যাই। তার বাড়িতে থাকি। কিন্তু আমি তাকে একদম সহ্য করতে পারিনি। তার প্রস্তাবটা আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কিন্তু জানিনা অ্যালফ্রেড কী করে এতদিন ধরে সহ্য করে আসছে। অ্যালফ্রেডের আর্মিতে যাবার সব ব্যবস্থাই বাবা করে দিয়েছিল। অ্যালফ্রেড বড় ছেলে ক্যালভোনরি রেজিমেন্ট যাওয়ার কথা। হ্যারির যাওয়ার কথা ছিলো ওয়াকর্স-এ যেমন আমার আর জর্জের রাজনীতিতে প্রবেশ করার কথা।

-কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি এই তো?

ডেভিড মাথা নাড়ল-হ্যারিই সমস্ত ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়। তাকে সর্বক্ষণ ভয়ঙ্কর বলে মনে হতো। তার অনেক ঋণ হয়ে গিয়েছিল। আরো অনেক গণ্ডগোল ছিল। অবশেষে একদিন সে কয়েক হাজার পাউণ্ড নিয়ে পালিয়ে যায়। টাকাটা অবশ্য ওর ছিল না। একটা ছোট্ট চিঠি লিখে সে বলে যায়, অফিসের কাজ তার ভালো লাগছে না, তাই সে পৃথিবী পরিক্রমায় বেরোচ্ছে।

-তার আর কোনো সংবাদ পাওনি?

 ডেভিড হেসে বলল–যা পেয়েছি। প্রায় সংবাদ পেতাম, টাকার জন্য খবর পাঠাতত সেটা পেয়েও যেত।

–আর অ্যালফ্রেড।

আমার বিশ্বাস সে বাবার কলের পুতুল হয়ে গেছে।

–আর তুমি তার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছ, তাই না?

–আমি তার পর লণ্ডনে গিয়ে পেন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করি। বাবা আমাকে হুমকি দেন যে, বাড়ি ছাড়লে আমি ঠিক করব না। শুধু তিনি বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে মাসোহরা বাবদ কিছু টাকা পাবে। এছাড়া তার মৃত্যুর পর তার কাছ থেকে আর কিছুই পাবো না। আমি যে মূর্খ সেটা আমায় জানিয়ে দিলেন। এরপর আমি আর তাকে দেখিনি।

হিলডা সহজভাবে প্রশ্ন করল তার জন্য তোমার দুঃখ হয় না?

-না, আমি হয়তো কোনোদিনই বড় শিল্পী হতে পারব না। তবে আমি আমার এই ছোট্ট কুটীরে বেশ সুখেই আছি। তুমি আমার মৃত্যুর পর তোমার নামে জীবন বীমা করা মোটা টাকা পাবে। সে আবার বলতে থাকে, চিঠিতে সে খ্রীস্টমাসের সময় স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি যাবার জন্য লিখেছে। তার আশা আমাদের পরিবারের সবাই আবার একসঙ্গে হই। এর মানেটা কী বলতে পারো?

-তোমার বাবা এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। তার পরিবারের এরকম অচল অবস্থা বোধহয় ওনাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছে, তিনি তার অবসান ঘটাতে চান। এইরকম হয়েই থাকে।

ডেভিড আস্তে আস্তে বলে–আমারও তাই মনে হয়। এখন হিলডা তুমিই বল আমায় যেতে দেবে, না দেবে না?

প্রশ্নটা খুবই স্পর্শকাতর। আমি একটু সেকেলে গোছের মেয়ে, বলতে সাহস হয় না তবু বলছি খ্রীস্টমাসের সময় যদি একটু সুখ আর শান্তি হয় তবে কী কোনো অসুবিধা হবে?

-আমি তো তোমায় অতীতের সব ঘটনার কথাই বলেছি। তবু তুমি কী আমায়…

হিলডা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–প্রিয়তম আমি জানি। তবে অতীত অতীতই, যা হবার তো হয়েই গেছে। আমি বলি কী তুমি তোমার মধ্যে অতীতকে জীবন্ত রেখে বর্তমানের কথা ভাব।

-কিন্তু হিলডা আমি যে আমার অতীতকে কোনোমতেই ভুলতে পারছি না।

–অতীতকে ভুলে যেতেই হয়। আমার মনে হয় আমরা যদি অতীতকে ধরে বসে থাকি তাহলে আমরা একদিন শেষ হয়ে যাবো। তাছাড়া আমার ধারণা তখন তুমি ছোট ছিলে, তোমার বোঝার ক্ষমতাও তখন ভালো করে হয়নি। তাই তুমি আমার বাবাকে ঠিক বুঝতে পারোনি। এখন বোঝার বয়স হয়েছে। এখন তুমি তোমার চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পাবে। আমার মনে হয় তুমি যদি এখনকার চোখ দিয়ে তাকে দেখ তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তখন হয়তো তার মধ্যে কিছুটা আবেগ ছিল। সেই আবেগই তাকে ছুটিয়েছে শুধু। তিনি হয়তো সেরকম মানুষ। যার ওপর কোনো দোষ দেওয়া যায় না। এছাড়া, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ, অমানুষ নন।

-তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না, আমার মার প্রতি তার ব্যবহার।

 হিলডা গম্ভীর ভাবে বলে-নম্রতা, ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে, যা হয়তো কোনো কোনো কারণে একটা সময় মানুষের মন খারাপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। হয়তো অন্যের সঙ্গে একটা পার্থক্য থাকতে পারে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

তার মানে তুমি বলতে চাও দোষটা আমার মারই।

 হিলডা আপত্তি জানিয়ে বলে–না আমি তা বলছি না। আমি নিঃসন্দেহ যে, তোমার মার প্রতি তোমার বাবা দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তবে একটা ব্যাপার কী জান, বিয়েটা কোনো সাধারণ জিনিষ নয়, আমার সন্দেহ বাইরের কেউ, এমন কী নারী পুরুষের বিবাহের ফসল অর্থাৎ তাদের একটা ছেলেরও এ ব্যাপারে বিচার করার অধিকার নেই। তাছাড়া তোমার এখনকার দুঃখবোধ কোনোভাবেই তোমার মাকে এখন সাহায্য করতে পারবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। সেসব ঘটনা তুমি পেছনে ফেলে এসেছ। এখন আছে এক পঙ্গু, বৃদ্ধ মানুষ যিনি শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। তিনি তার ছেলেকে খ্রীস্টমাসের সময় বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন।

–তাহলে তুমি আমায় যাবার অনুমতি দিচ্ছ?

হিলডা একটু চিন্তা করে নিয়ে মনটা ঠিক করে নিল, সে বলল-হা, আমি চাই তুমি তোমার সব মান অভিমান ভুলে চিরকালের মতো ওখানে যাও।

ওয়েস্টারিংহামের এম.পি. জর্জ লী যথার্থ ভদ্রলোক। একচল্লিশ বছর বয়স, তার চোখ দুটো নীল, স্বচ্ছ এবং ফ্যাকাশে। তবে চোখে একটু সন্দেহের ছাপ থেকেই যায়। তার কথাবার্তার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ধরা পড়ে।

–আমি তো তোমায় বলেছি ম্যাগজলেন, যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বলি, আমার মনে হয় যাওয়াটা কর্তব্য।

তার স্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে গা ঝাঁকালো। তার গড়নটা ছিল রোগা, চুলটা সোনালী, জ্বটা প্লাক করা, মুখটা ডিম্বাকৃতি। এক এক সময় তার মুখটা ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে। এখনও তাকে সেইরকম দেখাচ্ছিল।

সে বলে উঠল-প্রিয়তম আমি নিশ্চিত যে সেটা দুর্দান্ত হবে।

হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখ দেখে মনে হল তার মাথায় যেন একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। সে বলল-হা, খ্রীস্টমাসের সময় আমরা আমাদের খরচ কমাতে পারব। খ্রীস্টমাস যে একটু ব্যয়বহুল সেটা সবাই জানে। আমরা যদি সেইসময় চাকর বাকরদের ছুটি দিয়ে দিই তাহলে ব্যয় কিছুটা কমবে।

ম্যাগজলেন বলল–সেটা তো খুব ভালো কথা। সব জায়গাতেই খ্রীস্টমাস খুব বড় ব্যাপার। ম্যাগজলেন একটু থেমে তারপর বলে–জর্জ তোমার বাবা খুব বিত্তবান, কোটিপতি বলা যায়। যায় না?

–আমার মনে হয় ডবল কোটিপতি।

ম্যাগলেজ একটু ঈর্ষার ভাব মেশানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–এত টাকা তিনি কী করে পেলেন? দক্ষিণ আফ্রিকায়?

-হ্যাঁ, প্রথম জীবনে তিনি হীরের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা করেছেন। তারপর ইংলণ্ডে এসে নতুন করে ব্যবসা ফেঁদে সেই টাকা দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ করেন।

–তার মৃত্যুর পর এত অর্থ সম্পত্তি কীভাবে ভাগ হবে তুমি জানো?

-বাবা এই সব ব্যাপারে খুব একটা কথা বলেন না। তবে আমার ধারণা তার অর্থের সিংহভাগ পাবে অ্যালফ্রেড আর আমি। অ্যালফ্রেড অবশ্য আমার থেকে একটু বেশী পাবে। আমার আর এক ভাই ডেভিড, সে বিশেষ কিছু পাবে না, কারণ, সে বাবার অমতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় চিত্রশিল্পী হওয়ার জন্য। বাবা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে বলে শাসিয়েও ছিল। উত্তরে সে বলেছিল ওঁর টাকার তোয়াক্কা সে করে না। আর আছে আমার বোন জেনিফা। একজন বিদেশী আর্টিস্টের সঙ্গে দেশ ছেড়ে সে চলে যায়। কিছুদিন আগে সে মারা গেছে। তার একটা মেয়ে আছে। আমার মনে হয় বাবা তাকে কিছু দিয়ে যাবেন। আরো একজন আছে তার নাম হ্যারি।

একটা অস্বস্তিবোধ তাকে থামিয়ে দেয়।

 ম্যাগজলেন অবাক হল-কে এই হ্যারি?

–আঃ আমার ভাই সে।

–কিন্তু তোমার যে আরো একটা ভাই আছে সে কথা তো আগে শুনিনি।

শোন প্রিয়তমা, সে খুব একটা বিখ্যাত লোক নয়। সেই কারণে তার নাম তোমার কাছে আমরা করিনি। অনেকদিন তার কোনো খবর নেই। মনে হয় সে মারা গেছে।

ম্যাগজলেন হঠাৎ হেসে উঠল।

–তুমি হাসছ কেন? কী ব্যাপার?

–ম্যাগজলেন হাসতে হাসতে বলে-হাসির কথা বললে হাসব না? আমি এখন তোমার ভাই হ্যারির কথা চিন্তা করছি। সে অখ্যাত আর তুমি কতই না বিখ্যাত। কিন্তু জর্জ তোমার বাবা তো খুব একটা বিখ্যাত নন। শেষে অভিমানের সুরে বলেন, মাঝে মাঝে তিনি আমাকে এমন এমন কথা বলেন যে আমার শুনতে খুব খারাপ লাগে।

-ম্যাগজলেন তোমার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। লিডিয়াও কী এই রকম কিছু ভাবে?

-না, লিডিয়াকে সেরকম কিছু বলে না। ম্যাগজলেন ক্রুদ্ধ স্বরে বলে–জানি না কেন তাকে কিছু বলেন না।

সে যা হোক এই বয়সে বাবাকে সবার ক্ষমা করা উচিত। তাছাড়া, ওনার শরীর খুব একটা ভালো নয়।

-আচ্ছা, জর্জ, তোমার বাবার শরীর সত্যিই কী খারাপ?

–আমি তা কী করে জানাব? তবে তিনি যখন পরিবারের লোকদের একসঙ্গে দেখবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন আমাদের সবার যাওয়াই উচিত। হয়তো এটাই তার শেষ খ্রীস্টমাস। অতএব আমরা যে বাড়িতে গিয়ে ঠিক কাজই করবো। তাতে সন্দেহ নেই।

-কিন্তু আমার ঘেন্না করে। অ্যালফ্রেড একটা গবেট। লিডিয়া কথায় কথায় আমাকে ধমকায়। আর ঐ জানোয়ারের মতো চাকরটা।

-কে বৃদ্ধ ট্ৰেলিলিয়ান?

–না, হারবারি। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা করে আর বোকার মতো হাসে। সে যাই হোক ঐ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই ওই বুড়ো লোকটিকে কোনো অজুহাতে অপমান কোরো না। আমি বরং লিডিয়াকে জানিয়ে দিচ্ছি, আগামীকাল ৫-২০ মিনিটে আমরা যাচ্ছি। ম্যাগজলেন মাথা নীচু করে ঘর থেকে চলে গেলো।

গরস্টন হলের দোতলায় লম্বা বারান্দা পার হয়ে একটা বিরাট ঘর। পুরোনো ফ্যাশানে ঘর সাজানো। সবকিছুই চমৎকার, দামী এবং মজবুত। ঐ বৃদ্ধ মানুষটা আরাম কেদারায় বসে থাকেন। তাঁর পরনে নীল রং-এর নোংরা ড্রেসিং গাউন। পায়ে কার্পেট চটি। তার চুল সাদা এবং তার মুখের চামড়া হলদেটে। তাঁর চেহারাটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁর নাকটা ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো, চোখ দুটো গভীর এবং ভয়ঙ্কর জীবন্ত। এসব দেখেশুনে প্রত্যক্ষকারীকে মত পরিবর্তন করতে হবে। আগুনের মত তেজদীপ্ত প্রাণশক্তিতে তার জীবন ভরপুর।

রাজহংসের মতো ভক-ভক আওয়াজ করে বললেন-সাইমন লী, মিসেস অ্যালফ্রেডকে সংবাদ দিয়েছে।

হারবারি তার চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর দিল-হ্যাঁ, স্যার, আপনি আমাকে যা যা বলতে বলেছিলেন আমি তাই তাই বলেছি ওদের।

-খুব ভালো…ওরা সারাটা বিকেল নিশ্চয় খুব ভেবেছে। আমি ওদের জন্য বসে আছি। ওদের নিয়ে এসো।

-হা স্যার। বলে সে চুপচাপ চলে গেলো।

হারবারির দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বৃদ্ধ লী নিজেই নিজেকে অভিশাপ দেয়। লোকটি সত্যিই নিঃশব্দে বেড়ালের মতো হাঁটে, কোথায় কখন থাকে বোঝা যায় না।

তিনি শান্ত ভাবে চেয়ারে বসেছিলেন, ঠিক সেই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। অ্যালফ্রেড ও লিডিয়া ভেতরে ঢুকলো।

-আহ, তোমরা এসে গেছ? লিডিয়া এসো, আমার কাছে এসে বস।

 –অ্যালফ্রেড জিজ্ঞাসা করল–কেমন আছ বাবা? দুপুরে তোমার ঘুম হয়েছিল তো?

-খুব সুন্দর, পুরোনো দিনের স্বপ্ন দেখলাম। এখানে চিরকালের মতো স্থিত হয়ে আর সমাজের স্তম্ভ হয়ে বসার আগে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখলাম, কক-কক আওয়াজ করে তিনি হেসে উঠলেন।

তার পুত্রবধূ নিঃশব্দে হাসতে লাগল।

অ্যালফ্রেড এবার কাজের কথাটা বলল–বাবা ব্যাপারটা কী? শুনলাম খ্রীস্টমাসের সময় আরো দুজন অতিথি আসছে। তারা কারা?

-হ্যাঁ, তাদের সম্পর্কে আমি তোমাদের অবশ্যই বলব। এবছরটা আমার কাছে হবে গ্র্যাণ্ড খ্রস্টমাস। আমাকে একবার দেখতে দাও এখানে কে কে আসছে। জর্জ আর ম্যাগজলেন আসছে।–বুড়ো সাইমন বলেন-বেচারা জর্জ গ্যাসব্যাগ ছাড়া সে আর কিছুই নয়। তবু সে আমার পুত্র।

অ্যালফ্রেড বলে-তার নির্বাচন কেন্দ্রের লোকেরা তাকে পছন্দ করে।

সাইমন আবার কক কক করে আওয়াজ করলেন-তারা মনে করে সে সৎ! এখনো কোনো লী-ই সৎ হতে পারেনি।

-ওঃ বাবা…

–হা পুত্র, তুমি অবশ্য তার ব্যতিক্রম। লিডিয়া প্রশ্ন করল–আর ডেভিড?

বহুবছর পরে ওকে দেখার কৌতূহল আমার অনেক। বেচারা বড় ছেলেমানুষ আর অভিমানী। আমি ভাবছি ওর স্ত্রী কেমন হবে? সে তার বয়স থেকে কুড়ি বছরের ছোট কোনো মেয়েকে বিয়ে করেনি তো? ঐ বোকা জর্জের মতো।

লিডিয়া বলল–খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখেছে হিলডা। এইমাত্র তার একটা বার্তা পেলাম। তারা অবশ্যই আগামীকাল এসে পৌঁছাবে।

শ্বশুরমশাই কৌতূহল সহকারে তার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তো কখনো লিডিয়ার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই না। লিডিয়া, আমি তোমাব সম্বন্ধে কী বলি জান, তুমি একজন ভালো বংশের সুশিক্ষিতা মেয়ে, এটাই তোমার প্রকৃত পরিচয়। তুমি ভালো ভালো কথা বল, এটা একটা বংশের ব্যাপার। তুমি আমার প্রতি যেরকম যত্ন নাও আর কেউ তা নেয় না।

এবার তার চোখদুটো আনন্দে নেচে উঠল–এখন অনুমান করে বলত খ্রীস্টমাসের সময় কারা কারা আসছে? তোমাকে আমি তিনটে নাম বলতে বলব। কিন্তু আমি বাজী রেখে বলতে পারি তুমি তা পারবে না। তিনি তিনজনের মুখের দিকে তাকাতে থাকেন। অ্যালফ্রেড ক্রু কুঁচকে বলে–আপনি নাকি একটা যুবতী মেয়েকে চঞ্চল করে দিয়েছেন?

-আমি আন্দাজ করতে পারি তোমার সেটাই হয়েছে। তবে বলি শোন, পিলার যে কেননা সময় এখানে এসে পরবে।

অ্যালফ্রেড রুস্বরে জিজ্ঞাসা করল–পিলার?

–পিলার একটা ভাডোস। জেনিফারের একমাত্র কন্যা, আমার নাতনী। তার কী পছন্দ তাই চিন্তা করছি।

অ্যালফ্রেড উঁচু গলায় বলল–তুমি তো আগে আমায় একথা জানাওনি কখনো।

বৃদ্ধ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলেভেবেছিলাম গোপন রাখব। এখানে আসার জন্য চার্লটনকে দিয়ে ওকে পত্র লেখাই। এই বাড়ির একই ছাদের তলায় ঐ তরতাজা মেয়েটাকে কেমন দেখায় তাই দেখতে চাই একবার। পিলারকে আমি কখনো দেখিনি। জানি না তাকে কার মতো দেখতে হয়েছে? বাবা না মার মতো।

অ্যালফ্রেড সবদিকে বিচার করে তার মতামত জানায়–বাবা তুমি কী মনে কর কাজটা ঠিক হচ্ছে?

বৃদ্ধ তার কথায় বাধা দিয়ে বলে–নিরাপত্তা আর নিরাপত্তা–তুমি খুব বেশী নিরাপত্তার কথা চিন্তা করছ অ্যালফ্রেড। আমার সেটা ভাববার বিষয় নয়। তুমি যাই চিন্তা করো না কেন আমার একটাই কথা যে, সে আমাদের পরিবারের একমাত্র নাতনী এবং আমার নাতনী। ওর বাবা কী করেছিল কে ছিল তা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। ওর সঙ্গে যে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে এটাই বড় কথা। আর একথাও বলছি সে আমার বাড়িতে বাস করতেই আসছে।

লিডিয়া তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল–ও এখানে বসবাস করতে আসছে?

–তিনি তার চেয়েও তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কেন তাতে তোমার আপত্তি আছে?

লিডিয়া মৃদু উত্তর দিল–আপনার বাড়িতে কেউ এসে থাকবে তাতে আমার আপত্তির কী আছে–আমি শুধু মেয়েটি সম্পর্কে চিন্তা করছি।

তুমি মেয়েটি সম্পর্কে কী বলতে চাইছ? এখানে কী ও সুখে থাকবে? এই পৃথিবীতে কী ওর এক পেনিও নেই? ওকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। তারপর অ্যালফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বলল–এটা একটা বড় খ্রীস্টমাস হতে চলেছে। আমার সব ছেলেরা ওকে ঘিরে থাকবে। তোমাকে একটা সংকেত দিয়ে রাখলাম। বলতো অপর অতিথিটা কে?

অ্যালফ্রেড তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখল।

–আমার সব ছেলেরা মানে তার মধ্যে তোমার ভাই হ্যারিও আসছে।

অ্যালফ্রেডের মুখটা চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল–কিন্তু আমরা তো জানি সে আর বেঁচে নেই।

-না সে মরেনি।

–এতকিছুর পরও তুমি তাকে ফিরিয়ে আনছ?

–তুমি ঠিকই বলছ ও একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। তবুও আমরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবো।

–কিন্তু সে আমাদের সবাইকে বিরক্ত করে তুলেছিল।

–তার অপরাধের ময়লা ঘাটাবার প্রয়োজন নেই। শুধু একটা কথাই মনে রাখো যে, খ্রীস্টমাস উৎসব হচ্ছে ক্ষমা করার উৎসব। ওকে আমরা আমাদের বাড়িতে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবো।

অ্যালফ্রেড উঠে দাঁড়ালো এবং মনে মনে বলল–এটা নেহাৎই একটা সখ। আমি কোনো দিনই ভাবিনি হ্যারি আবার এই চার দেওয়ালের মধ্যে ফিরে আসবে।

সাইমন সামনের দিকে মাথা নোয়ালেন। নরম স্বরে বললেন–আচ্ছা, তুমি তো হ্যারিকে কোনোদিন পছন্দ করতে না করতে কী? সে যাইহোক অতীতের ঘটনা এখন অতীতই, খ্রীস্টমাসের এটাই মূলনীতি। তাই না লিডিয়া?

লিডিয়ার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। সে শুকনো গলায় বলল–দেখা যাচ্ছে, এবার খ্রস্টমাসে আপনি ভালো ব্যবস্থাই করছেন।

–আমার ইচ্ছা আমার পরিবারের সকলে শান্তি আর শুভেচ্ছা নিয়ে আমার চারপাশে ঘিরে থাকুক। তোমরা কী চলে যাচ্ছ?

অ্যালফ্রেড ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। লিডিয়া তাকে অনুসরণ করল।

অ্যালফ্রেড উত্তেজিত হয়ে চলে যেতে দেখে, সাইমন বলে উঠলেন–হ্যারির ফিরে আসার সংবাদে অ্যালফ্রেডের মাথা গরম হয়ে গেছে। হ্যারি আর ও কখনো মিলেমিশে থাকতে পারেনি। হ্যারি সবসময় ওকে ঠাট্টা করে বলতে শ্লথ তবে নিশ্চিত।

লিডিয়া কিছু একটা বলবে বলে ভেবেছিল কিন্তু বুড়ো লোকটা কষ্ট পাবে ভেবে চুপ করে গেল।নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। সে কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলল-কচ্ছপ আর খরগোসের দৌড়ে শেষপর্যন্ত কিন্তু কচ্ছপেরই জিৎ হয়।

সাইমন বলে উঠল–না লিডিয়া সব সময় তা হয় না।

লিডিয়া মৃদু হেসে বলল–আমাকে ক্ষমা করবেন, আমাকে এক্ষুনি অ্যালফ্রেডের কাছে যেতে হবে। ও উত্তেজনা হলে ঘাবড়ে যায়।

সাইমন কক কক করে হেসে উঠলেন–অ্যালফ্রেড কোনো পরিবর্তন অপছন্দ করে।

লিডিয়া বলল-ও কিন্তু আপনার খুব অনুরক্ত।

–তোমার কাছে সেটা স্বাভাবিক নয় তাই না?

অনেক অনেক আনন্দের ব্যাপার। এখনো অনেক মজার ঘটনা ঘটতে বাকী আছে। তিনি নিজের মনে বলে উঠলেন–আমি এই খ্রীস্টমাসটা উপভোগ করতে যাচ্ছি।

সাইমন চেয়ার থেকে উঠে লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরের এক কোণে আলমারীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁপতে কাঁপতে আলমারীর তালাটা খুলে একটা হরিণের চামড়ার ব্যাগ বের করলেন। ব্যাগটা খুলতেই হীরের টুকরোগুলো ঝলসে উঠল। তিনি কাঁপা কাঁপা আঙুলগুলো দিয়ে হীরেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।

আমার সৌন্দর্য সেই এক ঔজ্জ্বলতা এখনো পুরোনো বন্ধুর মতো রয়ে গেছে। আমার পুরোনো দিনের সাথী। ওরা কাটবেও না, ছিলবেও না।

আমার পুরোনো দিনের সাথীরা তোমরা নারীদের গলায়, কানে, আঙুলে ঝুলে আর কোনো দিন শোভাবর্ধন করবে না, তোমরা শুধু আমার, আমার সাথী হয়েই তোমরা থাকবে। আমি আর তোমরা শুধু একটা ব্যাপার জানি, ওরা বলে আমি নাকি বুড়ো হয়ে গেছি, সুস্থ নই, পঙ্গু। তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমার জীবনের অনেকটা পথ বাকী পড়ে আছে। আমি এখন তোমাদের বৃদ্ধ কুকুর প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছি। আরো অনেক মজার ঘটনা বাকী রয়ে গেছে।