০৬. মিডগে হার্ডক্যাসল

০৬.

মিডগে হার্ডক্যাসল শনিবার সকাল এগারোটার সময় নিচে নেমে আসে। বিছানায় বসেই সে তার প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করেছে, বই পড়েছে, মাঝেমধ্যে ঝিমুনিও এসেছে এবং তারপরেই শয্যা ত্যাগ করেছে।

অলক্ষ্যে কাল কাটানোই সবথেকে বোধহয় উপভোগ করার উত্তম পথ।

সামনের দরজা দিয়ে শরতের মনকাড়া প্রভাতী সূর্যালোক নেমে এল। স্যার হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল একটা সাধারণের আসনে বসে মনোযোগ সহকারে টাইমস পত্রিকা পড়ছিলেন। তিনি একবার মুখ তুলে তাকালেন এবং মুচকি হেসে ওঠেন।

মিডগেকে সত্যি তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।

হ্যালো জামাইবাবু, আমার কি সত্যি খুব দেরি হয়ে গেছে?

হেনরি তেমনি হাসিমাখা মুখে উত্তর দেন, লাঞ্চ তো আছে, সেটা হারিয়ে বসোনি তো!

মিডগে তার পাশটিতে বসে পড়ে এবং দীর্ঘনিশ্বাস নেয়। এখানে আসা তো বড়ই সুখের।

-তোমাকে আজ বড় কৃশ দেখাচ্ছে।

-না, না, আমি বেশ ভালোই আছি। হৃষ্ট-পুষ্ট মহিলাগণ যেখানে তাদের মাপের চাইতে অনেক ছোট একাধিক পোষাক পরার চেষ্টায় না থেকে, সেখানে কি কোনো মজা আসবে।

হেনরি আবার একটু থেমে বলে ওঠেন, সাংঘাতিক তো! পরে হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলেন, এডওয়ার্ড ১২.২৫ নাগাদ আসছে।

-তাই নাকি? মিডগে থেমে যায়, কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে, এডওয়ার্ডের আমি অনেকদিন দর্শন পাইনি।

-তার স্বভাবও ঐরকম, আইন্সউইক থেকে কদাচিৎ বেরোয়-স্যার হেনরি জবাব দেন।

আইন্সউইক! মিডগে ভাবতে থাকে, আইন্সউইক! কথাটা মনে পড়তেই তার অন্তরে কোথায় যেন একটা ব্যথা মোচড় দেয়। আইন্সউইকের মনোরম সেই দিনগুলো। মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। আইন্সউইকের স্মৃতি মিডগের মনের মণিকোঠায় এখন জ্বলজ্বল করছে। আইন্সউইকে চলে যাবার আগে করাত সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন। শুধু কেবল জল্পনা-কল্পনা আর সেখানে যাওয়ার পর করণীয় কী হবে এটাই বোধহয় সকলের একমাত্র চিন্তাভাবনা। দেখতে দেখতে যাত্রার দিনও এসে উপস্থিত। গ্রামের ছোট স্টেশন। গার্ডকে আগে থাকতে নোটিশ দেওয়া থাকলে বড় লন্ডন এক্সপ্রেসকেও থামতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে সুদীর্ঘ বনের পথ অতিক্রম করে তবে আসবে জনমানবশূন্য ফাঁকা মাঠ–সেখানে বিরাজমান সাদারঙের সুন্দর বড় বাড়ি–সে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে, আর দেখা মিলবে বৃদ্ধ কাকা জিওফ্রের। যার পরনে থাকে রঙ-বেরঙের কোট।

যুবক-যুবতীদের মনের সুখে ছুটি উপভোগ করার এটা বোধহয় উপযুক্ত স্থান। যেমন খুশী বিচরণ করতে পারে। আনন্দ উল্লাস করে দিন কাটাতে পারে। সেবারে হেনরিয়েটা আয়ারল্যান্ড থেকে এসে হাজির হল। এডওয়ার্ড তার বাড়ি এটন থেকে এসেছিল এবং সে নিজেই উপস্থিত ছিল উত্তরাঞ্চলের এক শিল্প-প্রধান শহর থেকে। তারা সকলেই ভেবেছিল তারা একত্র হয়েছে বুদ্ধিস্বর্গের নন্দন কাননে।

তাদের সমস্ত আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু একজনকে ঘিরেই ছিল, সে এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড বেশ লম্বা, এবং শান্ত ভদ্র স্বভাবের। মিডগের দিকে সে তেমন ভাবে নজর রাখতে পারেনি, কারণ হেনরিয়েটা স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিল।

এডওয়ার্ড অত্যন্ত চাপা স্বভাবের, বিশেষ করে অতিথিবৃন্দের কাছে, তার এই স্বভাবের জন্য কেউ তাকে ঠিকভাবে বুঝে উঠতেও পারে না। বুড়ো মালীর কাছ থেকে মিডগে যখন শুনেছিল যে এই বাড়িটা একদিন এডওয়ার্ডেরই হবে, শোনামাত্র সে কম অবাক হয়নি। বুড়ো মালীর নাম ট্রিমলেট, বাগানের সেই প্রধান মালী।

মিডগে জানতে চেয়েছিল, কেন ট্রিমলেট কাকা জিওফ্রের কি ছেলেপুলে নেই? জিওফ্রের উত্তরাধিকারী সে কখনোই হতে পারবে না এবং মিস্টার হেনরি, মিস্টার জিওফ্রের ভাইপো, কিন্তু সে যখন বিবাহ করেছে তাই সে এডওয়ার্ডের মতো এত কাছের নয় তাই সেও উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। ট্রিমলেট সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে।

এডওয়ার্ড আইন্সউইক-এ একাই থাকে এখন কদাচিৎ এখানে চলে আসে। মিডগে এই কথা ভেবে অবাক হয়ে যায়, লুসি মনে কিছু না করে থাকেই বা কেন! লুসির হাবভাব দেখেও মনে হয় তার কোনো বিষয়েই ভ্রূক্ষেপ নেই।

আইন্সউইকে তার বাড়ি ছিল এবং তার প্রথম খুড়তুতো ভাই বলতে ঐ এডওয়ার্ড।–একবার বিতাড়িত হয়েছিল এবং বয়সে সে লুসির চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। লুসির বাবা জিওফ্রে এ্যাঙ্গক্যাটেল দেশের এক মহান চরিত্রের লোক বলেই খ্যাত ছিলেন। প্রভূত সম্পত্তির সে অধিকারী ছিল এবং সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশটাই তিনি লুসিকে দিয়েছেন। তাই এডওয়ার্ডকে গরীবই বলা যায় এবং সম্পত্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই তার সব ব্যয় হয়ে যায়।

বাবুগিরি করে যে এডওয়ার্ড সব ওড়ায়, তা নয়। কূটনৈতিক বিভাগে সে চাকরি করত, কিন্তু যে সময় আইন্সউইকের সম্পত্তির সে অধিকারী হল, তখন সম্পত্তি রক্ষার কথা ভেবেই চাকরি ছেড়ে আইন্সউইক-এ বসবাস শুরু করে দিল। বরাবরই সে ছিল বইয়ের পোকা, নতুন বই প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম সংস্করণ সে কিনে ফেলত। মাঝেমধ্যে ছোট পত্রিকায় সে ব্যঙ্গ রচনাও লিখত। সে তার দ্বিতীয় খুড়তুতো বোন হেনরিয়েটা স্যাভারনেককে বিবাহ করার প্রস্তাব বার তিনেক উত্থাপন করেছিল।

শরতের স্বর্ণবিগলিত মোহনকান্তি সূর্যালোকে বসে থেকে মিডগে এই সবই একের পর এক ভেবে যাচ্ছিল। এডওয়ার্ডকে দেখার পর তার মনে খুশীর উদ্রেক হবে কিনা সে জানে না, কারণ এখনও সে নিজেই মনস্থির করতে পারেনি। এডওয়ার্ডের মতো লোককে এড়িয়ে চলা মোটই সম্ভবপর নয়, আইন্সউইক-এ তাকে নিজের মতোই বাস্তব বলে মনে হয়েছে। লন্ডনের এক রেস্তোরাঁয় খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে সে তাকে অভ্যর্থনা করেছিল। যতদূর তার মনে আছে, সেই থেকেই এডওয়ার্ডকে মন দেবার পালা চলেছে তার…স্যার হেনরির কণ্ঠস্বরে তার যেন সম্বিত ফিরে আসে।

-লুসিকে দেখে তোমার কেমন মনে হয়?

–খুবই ভালো, চিরটাকালই সে একইরকম রয়ে গেল। মৃদুহাসি হাসে মিডগে।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্যার হেনরি মন দিয়ে এবার পাইপ টানতে শুরু করে দেন।

অপ্রত্যাশিত ভাবেই তিনি শুধু বলে ওঠেন, মিডগে আমার অনেক সময় লুসির জন্য বড় চিন্তা হয়।

মিডগে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে, উদ্বিগ্নতা? কেন?

স্যার হেনরি কেবল মাথা নাড়েন, লুসির এখনও উপলব্ধি করার মতো সেই বয়েস হয়নি যে, জগতে এমন অনেক জিনিষ আছে, যা তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তিনি তার বক্তব্য অকপটে বলে যেতে থাকেন। জিনিষপত্র নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সরকারী প্রথাকে সে বিদ্রূপ করে-ডিনার পার্টিতে নানাধরনের কটুক্তি ছোঁড়ে-ডিনার টেবিলে বর্ণবৈষম্য-র কথা তুলে ঝগড়া বাধিয়ে শক্রতার সংখ্যা তৈরি করে নেয়! এমন সব কাজ সে করে যাতে ব্রিটিশ সরকারের অসম্মানে মাথা হেঁট হয়–অথচ আমার মতো একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর স্ত্রী বলে তাকে মুখে কেউ কিছু বলে না, মনে মনে অসন্তোষ দানা বাঁধে নিশ্চয়ই। সকলের সঙ্গে মুচকি হাসি হেসে কথা বলে এবং এমন ভাব দেখানো এটা তার স্বভাবের একটা দিক–বড়ই বিরক্তিকর। চাকরগুলোও হয়েছে সেইরকম–সে যতই তাদের অসুবিধার সৃষ্টি করুক-না কেন, তবু তাকে তেল দিয়ে তোয়াজ করে চলাই তার স্বভাব।

মিডগের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, চিন্তিত সুরেই সে বলে ওঠে, আমার অজানা নয়, আপনি কী বলতে চাইছেন, সে কাজ অন্য লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় আপনি সহ্য করতে পারেন না, লুসি সেই একটাই কাজ করলে আপনি শুধু বলেন, ঠিক আছে। এর মানে কী? মোহিনী শক্তি? চৌম্বকত্ব?

নিঃশব্দে শুধু ঘাড় নাড়ে স্যার হেনরি।

তিনি বলতে থাকেন, ছেলেবেলা থেকেই লুসির স্বভাব চরিত্র ঐরকম, অনেক সময় এটাই ভেবে দেখেছি যে, ওর এই দোষটা মজ্জাগত হয়ে যাচ্ছে। সে বোঝে না যে, সব কিছুরই একটা সীমা থাকা ভালো, আমি মনেপ্রাণে এটাই বিশ্বাস করি যে, কাউকে প্রাণে মেরেও সে বোধহয় মুক্তি পেয়ে যেতে পারে!

মিডগে জানত যে, লুসিরও অনেক দোষ আছে, এমন অনেক চপলতা তার সঙ্গী, যেগুলো তার পদমর্যাদার পরিপন্থী। এমন সরকারী কর্মচারীর স্ত্রী হিসেবে তার যেটুকু গাম্ভীর্য থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে সেটা বিন্দুমাত্র ছিল না। সে তার মর্জির মালিক ছিল, নিজের খেয়ালখুশী মাফিক কৌশলের সঙ্গে সে গাড়ি চালাত। লন্ডন থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের বিচার করা পথ দিয়েই যাবে। এমনকি লন্ডনের মতো শহরেও সে গলিঘুজি দিয়ে এবং শর্টকাট রাস্তা ধরেই গাড়ি চালাবে। এই শহরের অলিগলি তার যেন নখদর্পণে, লুসির রাস্তা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, কোনো ট্যাক্সি চালকেরও বোধহয় এমন জ্ঞান নেই। লুসি শহরতলীর নতুন নতুন মোড় এবং রাস্তা সন্ধানী চোখে আবিষ্কার করে ফেলেছে।

হেনরিয়েটা সোভেল ডাইনের কাছে এসে যখন দাঁড়ায়, বেলা তখন সাড়ে বারোটা। এই স্থানটা তার খুব প্রিয়, এখান থেকে হেনরিয়েটা পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসত। তাই এমন জায়গায় এসে সে থামে, যেখান থেকে রাস্তা সোজা নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। চতুর্দিকে এবং তার নিচে পরিবেষ্টিত বৃক্ষরাজির সমারোহ, সেই সঙ্গে সোনালী থেকে কটা রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। শরতের উজ্জ্বল মোহনকান্তি চতুর্দিকে যেন সোনার হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য।

হেনরিয়েটা নিজের মনে ভাবতে থাকে, শরৎ আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের চেয়েও এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। এরকম একটা সুন্দর মুহূর্তের স্পর্শ পেলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিলে সম্ভোগ করতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে অফুরন্ত সুখ। সে ভাবে, এমন আনন্দের স্বাদ সে বোধহয় জীবনে পায়নি আর পাবেও না…

সৌন্দর্যের এই নগরপুরীতে মিনিট কয়েক প্রতীক্ষা করার পর হেনরিয়েটা ফিরে আসে। তার মনে হতে লাগল, সোনার মোহময় জগৎ যেন নিজেকে তৈরি করে আবার অনন্ত শূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিজের রূপের চর্চায় নিজেই অস্থির হয়ে কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না– শুধু গড়ছে আর ভাঙছে।

হেনরিয়েটা সোজা এখান থেকে হলোতে এসে উপস্থিত হল। লুসি তাকে সহর্ষ অভিনন্দন জানায়।

মিডগের মনে পড়ে যায় লুসি তাকে একবার বলেছিল, আমার গাড়ি যেন আমার ঘোড়া। সে আমার অত্যন্ত অনুগত এবং বিশ্বাসের ক্রীতদাস।

মিডগে বলে ওঠে, আমি জানি লুসি সবকিছুরই উচ্ছেদ করে, সে আজ সকালেই আমাকে বলেছে যে, এখানে থাকাকালীন আমি যেন সর্বদাই রূঢ় ভাব দেখাই।

সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা এসে গেছে, জন ক্রিস্টো এবং জার্দা অল্পক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে হাজির হয়ে যাবে। এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।

মিডগে তার নিজের চিন্তাজগতে বিচরণ করতে করতে এটাই ভাবতে থাকে, লুসি সত্যি এক পরী! আমি তার কথামতো সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে সকলের সঙ্গেই রূঢ় ব্যবহার করব–সেই রূঢ়তা এমন হয়ে উঠবে গৌরবোজ্জ্বল! গাড়ি থেকে নামতে হেনরিয়েটা জানতে চায়– কার কার পদার্পণ ঘটেছে? মিডগে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ক্রিস্টোরা হয়তো এখুনি এসে হাজির হবে, এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।

–এডওয়ার্ড? কি মজা কৃতদিন হল এডওয়ার্ডকে দেখিনি! আর কে এসেছে?

-ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল, দাঁতে দাঁত দিয়ে নখ কাটা–তার এই বদভ্যাস তোমার কিন্তু বন্ধ করা চাই!

–আমাকে এমন একটা অপ্রীতিকর কাজ করার কথা বলছই বা কেন? অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনো প্রবণতা আমার নেই, আমি কারো ব্যক্তিগত অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাই না। এ বিষয়ে লুসির কী বক্তব্য? হেনরিয়েটার জানার কৌতূহল ক্রমেই বাড়ে।

-তোমাকে এবার আরও অনেক কাজ করতে হবে। একটা নিষিদ্ধ ফলও আছে, সেটার ব্যাপারেও তদারকের দায়িত্ব কিন্তু তোমার ওপর।

হেনরিয়েটা ভীতকণ্ঠে বলে ওঠে, এইসব কাজ আমার ঘাড়ে চাপানোর অর্থ কী?

-এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, জার্দার প্রতি তোমাকে দয়া প্রদর্শন করতে হবে!

হেনরিয়েটা–আমি যদি জার্দার জায়গায় থাকতাম, লুসিকে আমি ঘৃণার চোখেই দেখতাম।

মিডগে–অপরাধ শাখার একজন লোক কাল আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে।

হেনরিয়েটা–আমরা কি কোনো হত্যাকাণ্ডের খেলায় মেতে উঠেছি?

মিডগে–আমার কিন্তু মনে হয় না। নেহাতই এক প্রতিবেশীর আতিথেয়তা বজায় রাখতেই এডওয়ার্ড এখানে হাজির হয়েছে।

গভীর স্নেহের সুর হেনরিয়েটার কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হয়, প্রিয় এডওয়ার্ড! এডওয়ার্ড যথেষ্ট লম্বা, স্বাস্থ্য মোটেই ভালো নয়-রোগা। যুবতীদের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসার সময়েই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল।

-হ্যালো হেনরিয়েটা, কী ব্যাপার, তোমাকে অনেকদিন পর দেখছি! হেনরিয়েটা হেসে ওঠে, হ্যালো এডওয়ার্ড!

এডওয়ার্ড সত্যি ভীষণ সুন্দর হয়েছে! মুখে সদাদীপ্ত শান্ত হাসি, চোখেমুখে দীপ্তি এবং দেহজ গঠনও বেশ ভালো–সারা শরীর শক্ত-মজবুত হাড়ে গঠিত। হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, এরকম চেহারার যুবক তার দৃষ্টিতে আকর্ষণ করে, এডওয়ার্ডের প্রতি দুর্বলতার এই মূর্তি দেখে সে নিজেই হতবাক। এতদিন সে এই গোপন সত্যটা ভুলে ছিল–এডওয়ার্ডের কাছে তার মন বাঁধা পড়েছে।

লাঞ্চ শেষ হতেই এডওয়ার্ড বলে ওঠে, এসো হেনরিয়েটা, আমরা না হয় কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি।

এডওয়ার্ডের বেড়ানোর অর্থ খানিকটা জায়গা জুড়ে পায়চারি শুরু করা। বাড়ির পেছনের দিককার একটা বনের মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলল। হেনরিয়েটার একবার মনে হল, আইন্সউইকের বন যেন। প্রিয় আইন্সউইক! সেখানে কতই না হাস্যরস লুকিয়ে আছে। এডওয়ার্ডের সঙ্গে সে আইন্সউইকের প্রসঙ্গেই কথা বলতে লাগল। তারা যেন অতীতস্মৃতি রোমন্থন করছে–অতীরে প্রসঙ্গ চলাকালীন সে নিজের অস্তিত্ব–তাদের বর্তমান একেবারেই ভুলে গিয়েছিল।

এওয়ার্ড–আমাদের কাঠবেড়ালিটার কথা তোমার মনে আছে? যার একটা থাবা ভেঙে গিয়েছিল এবং খাঁচার মধ্যে ঢোকাতেই সে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল?

হেনরিয়েটা–অবশ্যই। তার একটা কৌতুকভরা বাহারি নাম-কী যেন?

 এডওয়ার্ড-কলমস্তানী-মার্জারী ব্যাঙ্কস!

হেনরিয়েটা-হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

 তারা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

এডওয়ার্ড–আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের ঐ পরিচারিকা, বুড়ি মিসেস বন্ডী? সে বলত, দেখে নিও চিমনীর ওপরে এটা একদিন উঠে যাবে।

হেনরিয়েটা–আমরা কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হতাম।

এডওয়ার্ড-এটা কিন্তু ঠিক চিমনীর ওপরে উঠে গেল।

হেনরিয়েটা–মিসেস বন্ডী এটাকে তেমনভাবে তৈরী করেছিল। বীই কাঠবেড়ালির মাথায় ওটা ঢুকিয়েছিল। সে না থেমে বলে যেতে থাকে। সবই কী একইরকমের আছে, এডওয়ার্ড? না, পরিবর্তন থেকে থাকেনি–অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে? আমি কিন্তু আমার কল্পনা দিয়ে সব সময়ে এই সত্যিই উপলব্ধি করছি যে আগের মতোই সব ঠিকঠাক আছে।

এডওয়ার্ড–তুমি এক বার চলে এসো না, হেনরিয়েটা, সবই দেখতে পাবে! তুমি সেই কবে ওখানে গিয়েছিলে।

হেনরিয়েটা–আমি জানি।

এডওয়ার্ড-তুমি তো খুব ভালোভাবেই বোঝো যে, সেখানে গেলে তোমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে! তোমার যখন মন চায় চলে যেতে পার।

হেনরিয়েটা-তুমি সত্যি কী মিষ্টি, এডওয়ার্ড! সে ভাবে, এডওয়ার্ডের কী মজবুত হাড়!

এডওয়ার্ড–আইন্সউইককে তুমি নিজের বলে ভালো দেখো বলে আমি সত্যিই ভীষণ খুশী হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা স্বপ্নবিষ্টের মতো বলে চলে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শ্রেষ্ঠ স্থান এই আইন্সউইক।

লম্বা পায়ের মেয়ে…অবিন্যস্ত কটাচুলের কেশর…সুখী বালিকা…জীবন সম্বন্ধে তার কোনো মূল্যবোধ নেই…সে ভালোবাসে শুধু বন আর বন…বৃক্ষের নজরকাড়া শোভা তাকে আকৃষ্ট করে…তার মন হরণ করে…

হেনরিয়েটা ভাবে, সে যদি আবার অতীত স্মৃতির দিনগুলোতে যেতে পারতো তাহলে কত না সুখ হতো! সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠে, ইয়াগড্রাসিল এখনও সেই আগের মতনই আছে?

এডওয়ার্ড-ওটার ওপর তো বাজ পড়েছিল।

হেনরিয়েটা–না, ইয়াগড্রাসিল তো নয়।

তার নামকরণ করা হয়েছিল ইয়াগড্রাসিল–এটা তার বিশেষ নাম। বড় সেই ওক গাছটার নাম ছিল ইয়াগড্রাসিল, সেটাকেও যদি বনদেবতা আঘাত হানতে পারে, তবে জগতে কোনো কিছুরই নিরাপত্তা নেই। তাহলে সেখানে ফিরে যাওয়া মোটেই ভালো হবে না।

এডওয়ার্ড–তোমার কী ইয়াগড্রাসিলের চিহ্ন মনে আছে?

হেনরিয়েটা-হ্যাঁ, টুকরো কাগজে পেনসিল দিয়ে ঐ গাছের আমি ছবি আঁকতাম। আমাকে একটা পেনসিল এনে দাও, আমি এক্ষুনি এঁকে দেখিয়ে দেবো।

এডওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে একটা পেনসিল এবং নোটবুক এগিয়ে দেয়। হেনরিয়েটা হাসিমাখা মুখে কৌতুকপূর্ণ ওক গাছটার ছবি আঁকতে থাকে।

হেনরিয়েটা–চেয়ে দেখো, ইয়াগড্রাসিলের ছবি।

রাস্তার শেষ প্রান্তে বসে তারা মনের সুখে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সুখ দুঃখের কথাই বলে চলছিল। পড়ে যাওয়া একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসেছিল হেনরিয়েটা এবং ঠিক তার পাশে বসে ছিল এডওয়ার্ড। গাছের ফাঁক দিয়ে সে দেখছিল।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, এই জায়গাটা দেখলে আইন্সউইকের কথা মনে করিয়ে দেয় একপ্রকার পকেট আইন্সউক। আমি অনেক সময়ের জন্য এই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছি এডওয়ার্ড এবং লুসি বাড়ি করার জন্য এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছিল।

এডওয়ার্ড–তা হয়তো সম্ভব।

হেনরিয়েটা–কেউ জানতে পারে না, লুসি তার চিন্তাজগতে কী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। লুসির মাথায় কখন কী অদ্ভুত খেয়াল ভর করে তা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে শেষ হওয়ার পরে তুমি কী করেছিলে?

এডওয়ার্ড–কিছুই না হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা-সেটা বেশ শান্তির কথা।

এডওয়ার্ড–অমি কোনো কাজই সুষ্ঠুভবে করে উঠতে পারি না।

চোখের দ্রুত পলক পড়ে হেনরিয়েটার, তার স্বরে যেন লেগে আছে কৈশোরের ছোঁয়াচ। সে হেনরিয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিল। হেনরিয়েটাও তার প্রতি গভীর এক আকর্ষণ অনুভব করে।

হেনরিয়েটা–জ্ঞানী মানুষ তুমি।

এডওয়ার্ড–জ্ঞানী?

হেনরিয়েটা–কিছু না করা বোধহয় জ্ঞানীর লক্ষণ।

এডওয়ার্ড–তুমি আবার সেই পুরানো কথায় ফিরে আসছ হেনরিয়েটা। তুমি তো সব ব্যাপারে ভীষণভাবে কতৃকার্য হয়েছ।

হেনরিয়েটা–তুমি কী মনে কর আমি কৃতকার্য হতে পেরেছি? এটা সত্যি বড হাস্যকর ব্যাপার!

এডওয়ার্ড-তুমি বরাবরই আমার খুব প্রিয়, শিল্পী মানুষ তুমি। এর জন্য তোমার গর্ববোধ হওয়া উচিত।

হেনরিয়েটা–আমি জানি, অনেক মানুষই আছে যারা আমাকে এমনটা ভাবে এবং মুখের ওপর বলেও থাকে। কিন্তু তারা এর বেশি আর কিছু জানে না–এর প্রথম ব্যাপারটাও তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এডওয়ার্ড, তুমিও বোধহয় জানো না। ভাস্কর্য এমন জিনিষ নয়, যা শুরু করলেই কৃতকার্যের শিখরে পৌঁছন যায়। এর এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে যা তোমাকে পেয়ে বসে, তুমি এটাকে অগ্রাহ্য করে এড়িয়ে চলতে পার না, যা তোমার কাছে আশ্রয় পেতে চায়–অনুসরণ করে তোমার সঙ্গে চলতে চায়–তোমার পিছু নেয়–কারণ আজ হোক বা কাল হোক তোমাকে তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়ায় আসতে হবেই। সেই সময়ে হয়তো তুমি মনের দিক থেকে কিছুটা শান্তি পাবে–কিন্তু তুমি যদি আবার নতুন করে শুরু না কর, তোমার মন শান্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে।

এডওয়ার্ড-শাস্তির মুখ দেখার তোমার কী কোনো বাসনা আছে হেনরিয়েটা?

হেনরিয়েটা–কখনো কখনো তোমার মনে এই ভাবনাই জাগে যে, সবকিছুর পরিবর্তে আমি শান্তিতে থাকতে চাই এডওয়ার্ড।

এডওয়ার্ড-আইন্সউইক এসে শান্তির মুখ তুমি দেখতে পার। আমার মন বলে সেখানে তুমি সুখে থাকবে, এমন কী আমার সঙ্গে থাকলেও তুমি মনের দিক থেকে পরম তৃপ্তি অনুভব করবে।

এ বিষয়ে তোমার কী মনে হয় হেনরিয়েটা? তোমার কী মত? আইন্সউইক তো তোমার পথ চেয়ে প্রতীক্ষায় বসে আছে।

ধীরে ধীরে মুখ ঘোরায় হেনরিয়েটা এবং নিচু স্বরে বলে, আমার মনে হয়, তোমাকে একান্তভাবে প্রিয় মনে না করে আমি পারিনি এডওয়ার্ড, তাই তোমাকে মুখের ওপর বোধহয় না বলতে পারিনি।

এডওয়ার্ড-তাহলে এখন কী না বলতে চাইছ?

হেনরিয়েটা–সত্যি আমি দুঃখিত।

এডওয়ার্ড–তুমি আগে না বলেছ–এখনও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি-ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, তোমার মুখ দিয়ে হয়তো অন্য শব্দ বেরোবে। আজ বিকেলের দিকেও তুমি বেশ খুশী এবং প্রফুল্ল ছিলে, হেনরিয়েটা–তুমি নিশ্চয়ই একথা অস্বীকার করতে পার না।

হেনরিয়েটা-হা, আমি বেশ সুখেই ছিলাম।

এডওয়ার্ড–তোমার মুখ অন্য সবার থেকে একটু আলাদা লাগছে; অনেক কচি এবং সরল।

হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়।

এডওয়ার্ড-দেখো আমাদের উভয়ের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ঐ আইন্সউইক–যার সম্বন্ধে কথা বলতে, একসঙ্গে ভাবতেও আমরা ভালোবাসি! তুমি কী বুঝতে পার হেনরিয়েটা, এসবের প্রকৃত মানে কী দাঁড়াচ্ছে?

হেনরিয়েটা–এসবের মানে কী সত্যি তুমি বোঝ না এডওয়ার্ড! সারা বিকেলটা আজ অতীতের গর্ভে আমরা বসে আছি।

এডওয়ার্ড-বাসের পক্ষে অতীত অনেক সময় খুব সুখের।

হেনরিয়েটা–কিন্তু মানুষ অতীতে ইচ্ছে করলেই ফিরে যেতে পারে না, এই ফিরে যাওয়াটাই তার পক্ষে অসম্ভব।

দু-এক মিনিট সে নীরবতা পালন করে, পরে শান্ত আবেগবহির্ভূত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমার কথার মানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ক্রিস্টোর কথা ভেবেই তুমি আমাকে বিবাহ করতে রাজী নও, তাই নয় কী?

জবাব দেবার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না হেনরিয়েটা। এডওয়ার্ড তার বলা থামায় না, বলে চলে–ঠিক বলেছি তো হেনরিয়েটা? জগতে যদি জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আমাকে বিবাহ করতে তোমার কোথাও কোনো দ্বিধা ছিল না।

হেনরিয়েটা এবার রূঢ় কণ্ঠেই বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো নেই, এমন জগত আমি আমার কল্পনাতেও আনতে পারি না। এই সত্যটাই আমি তোমাকে বোঝানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এডওয়ার্ড-তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তোমার কথা যদি সত্যি বলে মেনেই নিই; তাহলে সে ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তোমাকে বিবাহ করে না কেন?

হেনরিয়েটা–স্ত্রীকে ডিভোর্স করার কোনো বাসনা জনের এখনও নেই, যদি সে কোনোদিন স্ত্রীকে ডিভোর্সও করে তবে আমি তাকে বিবাহ করবো কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তুমি যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখছ, বা তাই নিয়ে ভাবছ, আমরা কিন্তু জিনিষটাকে তোমার মতন করে ভাবতে পারছি না।

এডওয়ার্ডের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, সে কোনোরকমে বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো! এ জগতে জন ক্রিস্টোর সংখ্যা কম নেই।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, তুমি আবার একই ভুল করছ এডওয়ার্ড, জগতে জনের মতো লোক কমই চোখে পড়ে।

তাই যদি হয়–তবে এটা তো উত্তম ব্যাপার! অন্তত আমি ভাবি। তার কথা শেষ না করেই এডওয়ার্ড উঠে দাঁড়ায়, বলে ওঠে, এসো আমরা ফিরে যাই।

.

০৭.

 গাড়িতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে হার্লি স্ট্রিটের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হবার পর জাদার যেন মনে হতে লাগল সে যেন বনবাস যাত্রা করছে। চিরকালের জন্য বোধহয় সে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এই সপ্তাহান্তিক ছুটি তার জন্য যেন নতুন কোনো অভিশাপ বহন করে আনছে। অনেক জিনিষ পড়েছিল হ্যাঁ, যাত্রা করার পূর্বে তার যেগুলো করে আসা উচিত ছিল। বাথরুমের কলটা বন্ধ করে আসতে সে ভোলেনি তো? লন্ড্রীর সেই হিসাবটা সে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে কিনা– রাখলেও কোথায় রেখে এসেছে? ছেলেমেয়েরা কি ঘরকন্নার পরিচারিকার কাছে ভালো থাকবে? পরিচারিকাও তো সেই স্বভাবের–ধরে নিন না উদাহরণস্বরূপ বলছি, টরেন্স কি পরিচারিকার কথা মতো চলার পাত্র? সত্যি বলতে কী, ফরাসি পরিচারিকাদের বশ মানানোর শক্তি পর্যন্ত নেই। সে চালকের জায়গায় বসে উদ্বিগ্ন মন নিয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরল, বরাবর সে এটাতে চাপ দিতে লাগল, জন এই সময় বলে ওঠে, ইঞ্জিনের বোতামে হাত পড়লেই গাড়ি খুব ভালো চলবে!

ভীতচকিত দৃষ্টি নিয়ে জাদা জনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, আমি কি এতই বোকা। জার্দা ভেবেছিল যে, জন বোধহয় খুব ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখলো রাগের পরিবর্তে তার মুখে হাসি। এ্যাঙ্গক্যাটেলদের কাছে যাচ্ছে এটা ভেবেই জন খুশিতে ডগমগ, জাদার দোষত্রুটিও তার নজরে আসছে না।

বেচারা জন! সে যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করে, স্বার্থশূন্য এবং পরোপকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন স্বভাবের লোক বড় একটা চোখে পড়েনা! এত পরিশ্রমের পরেও সে যে ছুটি কাটানোর জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী থাকতে পারে! জার্দার মন আজ বড়ই বিষণ্ণ। তার তো বাড়ি, তার ওপর ছেলেমেয়েদের জন্যেও চিন্তার শেষ নেই, এ ছাড়া সবসময় জনের মন জুগিয়ে চলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে পরিশ্রান্ত। লাঞ্চ খেতে খেতে জন যেসব উক্তি করেছে যদিও সেরঙ্গ করেই এইসব বলে উঠেছে যে, রোগীদের দেখার মতো বাসনা তার নেই। জার্দা তার কথার আসল তাৎপর্য বুঝে ফেলেছে, কিন্তু যুক্তিবাদী নন টেরির, বাবার কোনো কথাকে ভ্রান্ত বলে মনে করার প্রবণতা তার মধ্যে নেই। বিশেষ করে সোজা পরিষ্কার এবং অলংকার বর্জিত মনের অধিকারী এই টেরি। জাদা অনেক সময়েই জনের অনেক কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছ, কারণ সে বোঝে জন তাকে বিরক্ত করার জন্যই এইসব বলে। সবকিছু বুঝেও সে নিজের মত থেকে একচুলও এদিক-ওদিক নড়ে না। অনেক সময় জাদা জনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, ছেলেমেয়েদের মনে এই বোধটাও জাগাতে চায় যে, নিঃস্বার্থ, রোগীর সেবায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এক চিকিৎসক রূপেই জনের পরিচিতি, কিন্তু এইকথার সহজ অর্থটুকুই উপলব্ধি করার মতো বোধও নেই। কথাচ্ছলে নিজের অসতর্কতায় এমন সব হালকা ধরনের কথা সে বলে ফেলে যাতে করে আদর্শবাদী এক নামকরা চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ধুলোয় মিশে যেতে পারে।

দূর থেকে ট্রাফিক আলো চোখে পড়তেই জাদা গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়, বহুক্ষণ ধরেই আলোটা সবুজ ছিল, তাই জার্দা ভেবে নিয়েছিল যে, আলোর স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে-না-পৌঁছতে আলো পরিবর্তিত হবে বলে। কিন্তু আলোটা সবুজ সঙ্কেত দিয়েই যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে।

জন ক্রিস্টো তার সব সঙ্কল্পের কথা ভুলে গিয়ে বলে ওঠে, তুমি অকারণে থেমে যাচ্ছ কেন ট্রাফিক-আলো যখন সবুজ জায়গাতেই থেমে আছে? জার্দা বলে, আমি ভেবেছিলাম আলো বোধহয় পরিবর্তিত হবে। জাদা অ্যাকসেলারেটরের ওপর পায়ের চাপ দিল, গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলল, আলোটা সবেমাত্র পেরিয়ে গেছে–ইঞ্জিন হঠাৎ করে থেমে যায়। আলোও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ক্রশ ট্র্যাফিক ধিক্কারজনক বাঁশি বাজাতে শুরু করে দেয়, জন বলে ওঠে, জার্দা, তোমার মতো খারাপ ড্রাইভার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

ট্রাফিক আলো সবসময় আমার কাছে অযথা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারো পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে, কবে সে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনবে–অসহায় কাতরোক্তি কণ্ঠ থেকে ঝড়ে পড়ে জার্দার।

জার্দার উদ্বিগ্নে ভরা অখুশী মুখের দিকে জনের দৃষ্টি চলে যায়। জন ভেবে নেয় যে, জার্দা সব ব্যাপারেই একটু বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, সে কিন্তু বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না যে, এই উদ্বেগ নিয়ে বেঁচে থাকা কত কষ্টকর! তার যদি কল্পনা শক্তি বলে কোনো অস্তিত্ব বেঁচে থাকে তবে তার চোখে পড়ত জার্দার অন্তরের ছবি।

জার্দা প্রায়-প্রায়ই বলে উঠত, দেখো জন, আমি সবসময় ছেলেমেয়েদের এটাই বোঝাবার চেষ্টা করি যে, একজন চিকিৎসকের জীবন শুধু ত্যাগের এবং আত্মোৎসর্গের–অন্যের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ–অন্যের উপকার করা একমাত্র লক্ষ্য। এই মহৎ কাজ করার জন্য আমি মনে মনে গর্ববোধ করি এবং ছেলেমেয়েদেরও এই সত্য বোঝাতে চাই যে, তাদেরও এই জন্য গর্ববোধ হওয়া উচিত।

কিন্তু জন সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা প্রদান করে বলে ওঠে, কেন, তোমার কি কোনোদিন মাথায় আসে না যে, চিকিৎসা করার মধ্যে আমি নিজের অন্তরে একটা সুখ অনুভব করি?–ঐ কাজ আমার কাছে সুখের-ত্যাগের নয়।

কিন্তু জাদা কিছুতেই এই ব্যাপারটা বোঝে না, বোঝার কোনো চেষ্টাও সে করে না, জনের কথা উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি বোধহয় জার্দার নেই। জন যখন মিসেস ক্যাবট্রি এবং হাসপাতালের মার্গারেট রাসেলওয়ার্ডের কথা বলে যায় সেই সময় জন জার্দার কাছে হয়ে ওঠে মহা পরোপকারী গরীবের বন্ধু এবং স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা, জনকে সে গরীবের পরম বন্ধু বলেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।

জন যদি জাদাকে বলতো যে, ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের কাজ এখন তাকে ডুবিয়ে রেখেছে–জাদা সেটা বুঝলেও বুঝতে পারত, কিন্তু রিজওয়ের ব্যাধির জটিলতা তার মাথায় ঢোকেনি। অনেক সময় জার্দার মনে হয় যে, রিজওয়ের আসল অসুখ সম্পর্কে জন নিজেও বোধহয় টের পায়নি। মাঝেমধ্যে তার এমনও মনে হতে পারত যে টরেন্স নেহাৎ-ই ছেলেমানুষ হয়েও রিজওয়ের অসুখের ব্যাপারে তার জানার প্রচেষ্টা আছে, বা ঔৎসুক্য নিয়েও বাবার কথা শোনে, জন কিন্তু জার্দার মত পোবণ করে। জন মনপ্রাণে এটাই চায় যে, তার ছেলে তার বিচার করুক, তার যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ণও সে করুক।

কফি মেসিনটা ভেঙে ফেলার পর থেকে জন ছেলের ওপর বেজায় চটে আছে। অ্যামোনিয়া তৈরি করতে গিয়ে টরেন্স মেসিনটা ভেঙেছে। কি দরকার পড়েছিল অ্যামোনিয়া তৈরির? যতসব বাজে কাজ! ছেলেটার সব বাজে কাজের প্রতি ভীষণ উৎসাহ এবং কৌতূহল…।

জন নীরব আছে দেখে জার্দা মনে মনে বেশ খুশী হয়। জন একনাগাড়ে বকে গেলে সে নিজের জগতেই অন্যমনস্ক হয়ে যেত এবং সেইজন্য গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, চিন্তার জগতে মগ্ন থাকলে ইচ্ছেমতো জার্দার গিয়ার বদল জনের চোখে ধরা পড়তো না। ভালোভাবে গিয়ার বদলে জার্দা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু জন গাড়িতে স্বমহিমায় উপস্থিত থাকলে সে সুষ্ঠুভাবে তা করে উঠতে পারে না। সুষ্ঠুভাবে করার উৎসাহে সে এমনই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, হয় সে বেশি অ্যাকসেলারেট করে, নয় উপযুক্তভাবে শেষ করে না–ফলে সব গোলমাল হয়ে যায়। সে তখন গিয়ার লিভারে গিয়ে ধাক্কা মারে এবং তাতে ঝাঁকুনিও বেশ জোরেই হয়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে হেনরিয়েটাও জার্দাকে কম উপদেশ দেয়নি। হেনরিয়েটা গাড়ি চালানোর সময় জার্দাকে পাশে বসিয়ে নিয়ে বলেছে, তুমি অনুভব করতে পার না জার্দা, গাড়িটা কী ভাবে চলতে চায়!-ওটা কাত হতে চায়–যতক্ষণ ধরে এমন বোধ হবে, তুমি তোমার হাতে চাপটা ধরে রাখার চেষ্টা করবে–ভুলেও কোথাও ধাক্কা লাগাবে না-এই অনুভবটা মনে সর্বক্ষণই ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবে।

কখনোই কিছু অনুভব করার মতো শক্তি জার্দার থাকে না। গিয়ার-লিভার–এর ঠিক কী কাজ জার্দা সেটা কোনোদিন অনুধাবন করতে পারল না! কিন্তু গাড়ি যারা চালায় গাড়ির সঙ্গে তাদের একটা ঐচ্ছিক ভাবের আদান-প্রদান হওয়ার বোধহয় প্রয়োজন থাকে।

জাদার মনে কিন্তু সেরকম অনুভূতি নেই, নিজের মানসিক অশান্তিতেই সে বিভোর থাকে, এইজন্য কোনোদিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় তার কাছে থাকে না। জানেন মন পাবার কাজেই সে এত ব্যস্ত থাকে যে, গাড়ির মন জোগানোর অবকাশ তার মেলে কী? তাই জাদা ভেবে নেয় যে, মারসাম্ পাহাড় পর্যন্ত গাড়ি সে ভালোভাবেই চালিয়ে আনতে পেরেছে। কারণ–এই সময়টা জন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল এবং জার্দাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি। গাড়ির গতিবেগ তাই যখন বাড়তে থাকে জার্দাও গিয়ার বদলে হাত লাগায়, অবশেষে ধীরেসুস্থে গাড়ি চলতে শুরু করে এবং জন হঠাৎ-ই তার বাস্তব জগতে পুনরায় ফিরে আসে। সে রেগে বলে ওঠে, তুমি যখন খাড়া পাহাড়ের নিকটবর্তী চলেই এসেছ তখন গিয়ার বদলানোর কী বা প্রয়োজন থাকতে পারে? জার্দা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত বিচলিত। জন রেগে গেলেই জার্দার কাজে সব ভুল হয়ে যায়। জার্দার কাজ যতই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে জনের মনকে খুশী করতে চায়, প্রতি পদক্ষেপেই তার ভুলের সংখ্যা তত বেশি হয়ে যায়।

সোভেলডাউনের কাছে তারা যখন গাড়ি চড়ে এগোচ্ছে–জ্বলন্ত শরত্বনানী চতুর্দিক থেকে তাকে পরিবেষ্টিত করে আছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে জন চিৎকার করতে থাকে, লন্ডনের বাইরে চলে আসা কী কম খুশীর। একবার ভেবে দেখো জাদা, এই বিকেলবেলা আমাদের অন্ধকার ঘরে বসে চা পানের কথা আর এখানের মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আবছা আলোয় ঘেরা বসার ঘরের কথা মনে আসতেই আকুল হয়ে ওঠে জাদার মনপ্রাণ তার মনে হতে লাগল-হায়, এখনই যদি সে সেখানে পৌঁছে যেতে পারতো। বীরাঙ্গনার মতোই মুখ নিয়ে সে বলে ওঠে, পল্লীর রমণীর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা করা কি চলে?

খাড়া পাহাড় থেকে নীচের দিকে নেমে এসেছে, ফেরার আর কোনো দ্বিতীয় পথও নেই। জাদার যেন মনে হতে লাগল, সে যেন অন্ধকার কারাগারে বন্দী হতে চলেছে। এ বন্দী জীবনের কোনো শেষ আছে কি? হার্লি স্ট্রিটে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব, কারণ সে এখন দুঃস্বপ্নের গহ্বরে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি চালাতে চালাতে জার্দার দৃষ্টি চলে যায় খানিকটা দূরে, যেখানে হেনরিয়েটা এবং মিডগে একটা লম্বা লোকের সঙ্গে বসে কথা বলতে ব্যস্ত। হেনরিয়েটাকে দেখেই সে একটু আশ্বস্ত হয়, হেনরিয়েটার ওপর জার্দার অগাধ আস্থা ছিল, সে ভাবতে থাকে যে-কোনো অবস্থা থেকে উদ্ধার যদি করতে কেউ পারে সে হেনরিয়েটা। হেনরিয়েটাকে দেখে জন মনে মনে খুশী হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে জন এবং জার্দা হেনরিয়েটার অভ্যর্থনায় বড়ই প্রীত হয়। জন মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে এটাই উপলব্ধি করলে যে, হেনরিয়েটা এখানে না এলে ছুটির সমস্ত আনন্দটাই মাঠে মারা যেত।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে আসেন, সাদর অভ্যর্থনা জানান জন এবং জার্দাকে। জাদার ব্যাপারে তিনি একটু বেশি আতিথেয়তা করলেন। যা তিনি সচরাচর অতিথিদের সঙ্গে করেন না। তিনি এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলেন যে, জাদাকে পেয়ে তার খুশীর অন্ত নেই। জনকেও তার উপযুক্ত সম্বর্ধনা জানালেন। তার আচার-ব্যবহারে এটাই প্রস্ফুটিত হচ্ছিল যে, প্রধান অতিথি–জাদাই, সহযাত্রী হিসেবে তার পাশে থাকছে জন। জার্দা এ ব্যাপারটার জন্য মানসিক দিক থেকে একেবারে প্রস্তুত ছিল না, তাই সে মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণই হয়।

লুসি বললেন, এডওয়ার্ডের সঙ্গে তোমাদের চেনা-পরিচিতি আছে তো?

এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল

কে? জন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে ওঠে, না, কই মনে কিছু করতে পারছি না তো।

বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় তার নীল চোখের তারাও সুন্দর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যার চোখে পড়বে সেই বলে উঠবে কোনো এক দিগ্বিজয়ী বীর জাহাজ থেকে ধরণীর বুকে নেমে এসে সকলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, এবং শুভ সংবাদে সকলকে প্রসন্ন করে তুলেছে। তার কণ্ঠস্বরে যেমন রয়েছে আন্তরিকতার ছাপতেমনি হৃদয়কেও ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই চুম্বকের মতো নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে।

জনের প্রতিভা যেন সকলকে আড়ালে রেখে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে। এডওয়ার্ড যে এতক্ষণ কুশানী নায়কের মতো আপন প্রভাব বিস্তার করে বলে উঠেছিল সে যেন হঠাৎ কার নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে, জীবন্ত থেকে ছায়ায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় নিল না।

রান্নাঘর সংলগ্ন উদ্যানে হেনরিয়েটা এবং জাদা বেড়াচ্ছিল। হেনরিয়েটা জাদাকে বলে ওঠে, লুসি হয়তো আমাদের রক গার্ডেন এবং অটাম বর্ডার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে, আমার মনে হয় কিচেনগার্ডেন কিন্তু অনেক ভালো এবং শান্তিপূর্ণ জায়গা। শশার মাচার ওপর। বসে এখান থেকে অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে এবং মনের সুখে গল্পও করা যায়। এদিকটা কেউ বড় একটা মাড়ায় না, সেই জন্যই বোধহয় বেশ নিঝুম নিরিবিলি।

জাদার সঙ্গে মনের কথা বলতে বলতে হেনরিয়েটা কাঁচা মটর তুলে তুলে খেতে থাকে কিন্তু জাদার এসবে কোনো সুখ নেই। সে-যে লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে এতেই তার আনন্দ। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে দেখে এবারও বেশ ভীতিপ্রদ লাগছিল। দশ মিনিট ধরে হেনরিয়েটা তার কাছে এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, চার উত্তর জাদার জ্ঞাত। হেনরিয়েটা তাকে বোকা প্রতিপন্ন করার জন্য তো প্রশ্ন করে না। সে শুধু মন খুলে লোকের সঙ্গে আলাপ জমায়, তাই জার্দাও খুশী হয়, সে ভাবে ছুটিটা বোধহয় খুব খারাপ যাবে না।

জেনা এখন নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, তার জন্য যে নতুন ফ্রকটা কেনা হয়েছে জার্দা তার সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে যায়। সে এমনি আরও সংসারের দু-একটা কথা নিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনায় বসে যায়। হেনরিয়েটাও তাকে সস্নেহে উপদেশ দেয়।

জাদাকে খুশী করা সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার এবং জার্দা খুশী হয়ে তার চেহারার আমুল পরিবর্তন হয়ে যায়।

শশার মাচায় বসে থাকতে থাকতে তারা একই সঙ্গে সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করছে, গ্রীষ্মকালের উত্তাপ মনে মনে সেও উপভোগ করছে।

নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ করে। জাদার মুখের অভিব্যক্তি যে এক লহমায় হারিয়ে যায়। সে যেন দুঃখের ছবির মতোই বসে রইল। হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্রই সে লাফিয়ে ওঠে।

হেনরিয়েটা–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের তুমি যখন ঘৃণার চোখে দেখ, তখন তুমি এখানে আস কোন্ উদ্দেশ্যে?

জাদা–আমি ঠিক সে কথা বলতে চাইনি। তুমি শুধু শুধু এমন ভাবছ কেন যে

একটু থেমে থেমে সে আবার বলতে শুরু করে দিল, লন্ডন শহর থেকে বেরিয়ে পড়া খুবই সুখের এবং দয়াবতী হিসেবে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের খুব পরিচিতি।

হেনরিয়েটাকে লুসি? তার দয়ার লেশমাত্র নেই।

জার্দা-তা কেন হতে যাবে, সে আমার প্রতি যথেষ্ট দয়াবান, আমার তো বেশ ভালোই লাগে।

হেনরিয়েটা–ভদ্রতা বলতে কোনো জিনিষ লুসির মধ্যে নেই, মহত্ত থাকলেও থাকতে পারে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা হিসেবে বাজারে তার যথেষ্ট সুনাম। আমার মনে হয় । তিনি কোনোদিন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। সাধারণ লোকের মতো চিন্তাভাবনা করার শক্তি তার নেই। এখানে আসলে তোমার যে বিরক্তির উদ্রেক করে তা আমার বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না জার্দা। লুসিকে তুমি ঘৃণার চোখে দেখো এটা আমি জানি। সেই জন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, তুমি যখন আহত হও, মনে দুঃখ পাও তখন তোমার এখানে না আসাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত।

জাদা–জন কিন্তু এখানে খুশী মন নিয়ে আসে এবং অবশ্য না এসে পারেও না

হেনরিয়েটা–জনের যখন ভালো লাগবে সে আসবে বৈকি। তুমি তাকে একাই আসতে দেবে।

জার্দা–সে তা পছন্দও করে না, আমাকে না এনে ছুটি উপভোগ করার তার কোনো বাসনা নেই। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে বরাবরই উদাসীন। সে মনে করে মাঝেমধ্যে শহরের বাইরে পা রাখলে আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।

হেনরিয়েটা-পাড়াগাঁয়ে আস তো ভালোই, কিন্তু এ্যাঙ্গক্যাটেলদের এখানেই যে আসতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি?

জার্দা–আমি এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ততটা খারাপ ভাবি না। তুমি আবার এই ভেবে বোসো না যে, আমি এতই অকৃতজ্ঞ!

হেনরিয়েটা–আমি জানি এ্যাঙ্গক্যাটেলরা সত্যি বিরক্তিকর লোক তবু এখানে আসি, আমরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটু আনন্দ উপভোগ করতে চাই–এই যা! যাকগে এবারে না হয় চলল, খাবারের সময়ও হয়ে গেছে।

যেতে যেতে হেনরিয়েটা একদৃষ্টে জাদার মুখের ভাব লক্ষ্য করেই পথ চলছি। হেনরিয়েটা একমনে ভাবতে থাকে, জর্দার একটা অংশ বোধহয় পৃথক হয়ে পড়েছে। তার মনে হল, জাদার চোখে মুখে শহীদের নিগ্রহ যেন সদাই ভাসমান। দেয়াল পরিবেষ্টিত বাগান পেরিয়ে আসার সময় তাদের কানে এল গুলির আওয়াজ। হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ধ্বংস কার্য শুরু হয়ে গিয়েছে।

স্যার হেনরি ও এডওয়ার্ডের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। গুলির শব্দ আলোচনার বাস্তব রূপায়ণ। হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেলদের নেশার জিনিষ ছিল আগ্নেয়াস্ত্র-মনের মতো বন্দুক পিস্তলের ভাণ্ডারও মজুত ছিল।

অনেক গুলিভরা একটা রিভলবার তিনি বার করেছিলেন এবং এডওয়ার্ড মনের সুখে একটার পর একটা গুলিবর্ষণ করে চলছিল। হেনরিয়েটাকে দেখে এডওয়ার্ড বলে উঠেছিল, চেষ্টা করে একবার দেখো না, একটা সিঁধেল চোর মারতে পারো কিনা?

হেনরিয়েটা তার হাত থেকে রিভলবার তুলে নিল এবং গুলি ছুঁড়ে বসল।

স্যার হেনরি বলে উঠলেন, জাদা, তুমি না হয় করে দেখো।

মিসেস ক্রিস্টো, এগিয়ে আসুন, এটা খুবই সোজা ব্যাপার।

চোখ বুজে গুলি ছোঁড়ে জার্দা, গুলি হেনরিয়েটাকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যায়।

মিডগে বলে ওঠে, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।

পরপর বেশ কয়েকটা গুলি ছোঁড়ে, তারপর মুখ খোলে, তোমরা যা ভাবছ গুলি ছোঁড়া মোটেই সহজ কাজ নয়, তবে কৌতুক করার অভিপ্রায়ে এরকম এলোমেলো গুলিবর্ষণ চলতে থাকে।

লুসি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তার পেছনে পেছনে লম্বা দেহের একজন লোক। লুসি বলে ওঠেন, এই ডেভিড।

মিডগের হাত থেকে রিভলবার তুলে নেন তিনি, এবং গুলি ভর্তি করে লক্ষ্যস্থলের পাশে ঠিক তিনটি ছিদ্র মুহূর্তের মধ্যে করে ফেললেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সুরে মিডগেবলে ওঠে, সত্যি খুব ভালো হয়েছে লুসি, আমি জানতাম না যে, গুলি ছোঁড়ার ব্যাপারে তুমি একেবারে সিদ্ধহস্ত।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে স্যার হেনরি বলে ওঠেন, লুসি তার নিজের লোককেই মেরে বসে।

মিডগে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, কেন লুসি কী করেছিল?

ঝাকের মধ্যে দুটো গুলি ছুঁড়ে বসেছিল। আমার জানা ছিল না যে, তার কাছেও একটা পিস্তল আছে, খারাপ-স্বভাবের একটা লোক পায়ে আঘাত পেয়েছিল এবং আর একজন কাঁধে, অল্পের জন্য আমি সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ভাবতেই অবাক লাগে আমি কী ভাবে মুক্তি পেয়ে গেলাম–স্যার হেনরি বলে চলেন।

লেডি এ্যঙ্গক্যাটেল মুচকি হাসি হেসে ওঠেন এবং বলেন, আমার মনে হয় সকলকেই একবার করে বিপদের ঝুঁকি নিতে হয় এবং যা কিছু করণীয় ভাবনা-চিন্তা না করেই চটপট সেরে ফেলাই ভালো।

 স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, সত্যিই প্রশংসনীয় মনোবৃত্তি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারই আলাদা। কারণ ক্ষোভ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আমার আছে, সেবারে অনায়াসেই গুলিবিদ্ধ হয়ে তোমার পাগলামির শিকার হতে পারতাম।

.

০৮.

চা পানের পর জন হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, এসো, একটু না হয় কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন যে, জার্দাকে নিয়ে তিনি রক-গার্ডেন দেখাতে যাবেন, রক্-গার্ডেন দেখার উপযুক্ত সময় এটা নয়।

জনের সঙ্গে পথ চলতে চলতে হেনরিয়েটা ভেবে নেয় যে, জনের সঙ্গে বেড়ানো আর এডওয়ার্ডের সঙ্গে বেড়ানো মোটেই এক কথা নয়। জন্মের সময় থেকেই সে কুমোর, এডওয়ার্ডের সঙ্গে বেড়ানো কুমোরের সঙ্গে বেড়ানোরই সামিল। কিন্তু জনের সঙ্গে বেড়ানো সত্যিই ভীষণ কষ্টসাধ্য, যে-কোনো লোক খুব সহজেই হাঁফিয়ে উঠবে। জন যেন মারাথন দৌড়ে নাম লিখিয়েছে!

হেনরিয়েটার মুখে ম্যারাথন দৌড়ের নাম শোনা মাত্র জন হেসে ফেলে এবং হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। জন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে?

হেনরিয়েটা–না, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না বটে, তবে এত দ্রুতবেগে হাঁটার প্রয়োজনটাই বা কী? আমাদের তো গাড়ি ধরতে হচ্ছে না। তোমার মনে এত উৎসাহ আসছে কোথা থেকে? তুমি কি তোমার সব শক্তি ক্ষয়ের প্রচেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছ নাকি?

জন একদম থেমে যায়, এবং বলে ওঠে, তুমি এরকমভাবে কথা বলছ কেন?

 উৎসুক নেত্রে হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, কিছু ভেবে আমি এ কথা বলিনি।

জন আবার চলতে শুরু করে দেয় তবে তার গতিবেগ অনেক ধীর। জন বলে ওঠে, সত্যি আমি বড় ক্লান্ত, ভীষণই ক্লান্তি অনুভব করছি। জনের কণ্ঠে ক্লান্তির আভাস পেয়েই হেনরিয়েটা জিজ্ঞাসা করে ওঠে, ক্যাবট্রি এখন কেমন আছে?

এই সবেমাত্র কাজে হাত দিয়েছি, এখনও অনেকদিন লাগবে, শুধু কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আমাদের পথ যদি নির্দিষ্ট থাকে এবং আমরা যদি কৃতকার্যের শিখরে পৌঁছতে পারি তবে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হবে–

হেনরিয়েটা বলে, তবে তো রিজওয়ে ব্যাধিমুক্ত হয়ে উঠবে? তাহলে তো জগতে আর লোক মরবে না?

জন বলে ওঠে, অনেকটা প্রায় সেইরকমই।

হেনরিয়েটা নিজের মনে ভাবতে থাকে, এরা কী বলতে চাইছে।

 বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চলেছি, কৃতকার্য যদি হই তবে সুযোগের সকল দরজাই খুলে যাবে।

এসো, আমরা এখানে এসে একটু বসি, বসে বসে মুক্ত বাতাস সেবন করা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল–সেই সঙ্গে বসে থেকে–তোমার দর্শন মেলা আরও উত্তম–বলা শেষ হতেই জন আবার হাসতে শুরু করে দেয়, কিছুক্ষণ বাদে আপনমনেই বলতে থাকে, এমন মুক্ত হাওয়া সেবন করলে জার্দার বরং উপকারই হবে, হোতে আসার জার্দার বেশ প্রবণতাও আছে, কিন্তু বেড়াতে তার মন একদম চায় না।

জন বলে ওঠে, আসতে আসতে এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে আমার একবার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না, তুমি তাকে বার দুই দেখেছ।

 জন–আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

হেনরিয়েটা–এডওয়ার্ডকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। এডওয়ার্ড বরাবরই আমার খুব প্রিয়।

জন–যাকগে, এডওয়ার্ডের গল্প করে আমাদের সময় নষ্ট করা একেবারেই উচিত নয়। এরা আমাদের গণনার মধ্যে পড়ে না।

হেনরিয়েটা–জন, অনেক সময় তোমার জন্য আমার ভয় হয়।

জন–আমার জন্য ভয়? তুমি কী বলতে চাইছ?

 হেনরিয়েটা–তুমি যেন সত্যি বিস্মৃতিপরায়ণ–অত্যন্ত–হ্যাঁ, অন্ধ।

জন–অন্ধ?

হেনরিয়েটা-তুমি জান না, চেয়ে দেখতে পাও না–ভাবপ্রবণতার লেশমাত্র তোমার মধ্যে নেই! তুমি বোধহয় জানো না, অন্য লোকে কী অনুভব করে এবং ভাবতে পারে।

জন–আমি ঠিক বিপরীত।

হেনরিয়েটা–তুমি যার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাক শুধু তাকেই তুমি দু’চোখ ভরে দেখো, একটা অনুসন্ধানী আলো ঠিক পেছনের দিকে, এপাশ-ওপাশ সবই অন্ধকারে ঘেরা সেখানে তোমার চোখে কিছুই পড়ে না।

জন–প্রিয় বান্ধবী আমার, হেনরিয়েটা, তুমি কী বলে চলেছ?

হেনরিয়েটা–সত্যিই এটা বিপজ্জনক, জন! তুমি ভাব সকলে তোমাকে ভালবাসে। লুসির কথাই নাও, তুমি কী মনে কর লুসি তোমাকে ভালো চোখে দেখে?

জন-লুসি আমাকে পছন্দ করে না? আমি তো তাকে একটু বেশি বোধহয় পছন্দ করি।

হেনরিয়েটা–তুমি পছন্দ করা বলে এটাই ভেবে নিয়েছ যে সেও তোমাকে পছন্দ করে। তবে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই, তবে জিজ্ঞাসা না করে পারি না জার্দাকে, এডওয়ার্ড, মিডগে এবং হেনরি তোমার সম্পর্কে কী ভাবে একবার বলতে পার?

জন–আর হেনরিয়েটা? সে কী ভাবে তাই কী আমার অজানা? কথা বলতে বলতে জন হেনরিয়েটার হাত চেপে ধরে এবং বলে ওঠে, তোমার সম্পর্কে আমি একেবারে নিশ্চিত।

হাত সরিয়ে নিয়ে হেনরিয়েটা বলে ওঠে, পৃথিবীতে কারো সম্বন্ধেই পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় কী?

জনের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। পরে বলে ওঠে, না তা একেবারেই বিশ্বাস করি না, আমি তোমার সম্পর্কে নিশ্চিত এবং নিজের সম্বন্ধেও নিশ্চিত। অন্তত–তার মুখের চেহারা, রঙ মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে যায়।

–কি হল জন?–হেনরিয়েটা জিজ্ঞাসা করে। জন বলে, তুমি জান, আমি নিজের সম্পর্কে কী বলি? সত্যি এটা একটা হাস্যকর উক্তি–আমি বাড়ি যেতে চাই। হ্যাঁ, এই কথার পুনরাবৃত্তি আমি আজও করছি। কিন্তু আমি নিজে হয়তো জানি না, যা বলছি তার মানে কী?

হেনরিয়েটা এবারে খুব ধীর-শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমার মনে হয়তো কোনো ছবি আছে?

সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কিছুই না, একদম সব শূন্য।

সেদিন রাতে ডিনার টেবিলে হেনরিয়েটাকে ডেভিডের পরের আসনে বসানো হয়েছিল, টেবিলপ্রান্ত থেকে লুসির যেন টেলিগ্রাফ পাঠাল–আদেশ নয়–অনুরোধ। হেনরি জার্দার সঙ্গে বসে তার না-বলা কথা বলেই চলেছে। লুসির ছাড়া-ছাড়া মনের সঙ্গে যতটা সম্ভব পাল্লা দিয়ে হাসিমাখা মুখে হাসি নিয়ে জন এগিয়ে চলেছে। মিডগের বলার ভঙ্গী ঠিক স্বাভাবিক নয়। এডওয়ার্ডকে অন্যদিনের চাইতে আজকে যেন একটু বেশি অন্যমনস্ক লাগছিল। কম্পিত হাতে রুটি নিয়ে মুখে তুলে ধরছিল ডেভিড।

ডেভিড অনিচ্ছাসত্ত্বেও হলোতে এসে হাজির হয়েছিল। হেনরি এবং লুসির সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত সে বলেনি। এ্যাঙ্গক্যাটেল-সাম্রাজ্যকে যেমন অস্বীকার করে তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্বন্ধও সে স্বীকৃতি দিতে মানসিক দিক থেকে একদম প্রস্তুত থাকে না।

এডওয়ার্ড তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, ললিতকলার অনুরাগী বলে সে তাকে বরাবর অবজ্ঞার চোখে দেখে আসছে। অবশিষ্ট চারজন অতিথিকে সে সমালোচনার চোখ দিয়েই দেখে। আত্মীয়তা তার কাছে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলতেও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে।মিডগে এবং হেনরিয়েটাকে সে কোনোদিন পাত্তা দেয় না। সে মনে করে ওদের মস্তকে কোনো বস্তু আছে বলে মনে হয় না। ডাক্তার ক্রিস্টোও তার কাছে হার্লি স্ট্রিটের হাতুড়ে ডাক্তারদের অন্যতম। তার অবশ্য কেতাদুরস্ত ভাব আছে–কিন্তু তার স্ত্রী সব গণনার বাইরে।

কলারের মধ্যে থেকে ডেভিড ঘাড় নাড়ে এবং সকলকে সে এটাই বোঝাতে চায় যে, সে । কাউকে গ্রাহ্য করে না। তারা সকলেই খুব অকিঞ্চিৎকর।

তিনবার সকলের উদ্দেশ্যে নিজের মনে গালিগালাজ বর্ষণ করে মনটা যেন একটু হালকা হয়। তবু কটাক্ষ চোখে নিয়েই সবার দিকে তাকিয়েছিল। এক এক করে সকলের ব্যাপারেই নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ সমালোচনা সে করে যাচ্ছিল। বহুক্ষণ হয়ে গেল হেনরিয়েটা নীরবে শুনে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে অসহ্য হয়েই ভিন্ন রাস্তা ধরল।

হেনরিয়েটা জানত যে, সঙ্গীত শিল্পে যথেষ্ট দক্ষতা রাখে ডেভিড। তাই ডেভিডকে অকারণে উত্যক্ত করার লোভেই সে তার সুরকার সম্পর্কে অবান্তর মন্তব্য করে বসে। রঙ্গ করে সে বলার পরই লক্ষ্য করল, ওষুধ ধরেছে। ডেভিড নড়েচড়ে বসে। এবং খাওয়া অর্ধ-সমাপ্ত রেখে খুব দীপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, যে, হেনরিয়েটা এ বিষয়ের অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই বোঝে না। ডিনার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে তার বক্তৃতা থামাল না এবং নির্বাক শ্রোতার মতোই হেনরিয়েটা তার আসনে নীরব রইল।

বক্র দৃষ্টিতে লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, মিডগে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ভ্র-কুঞ্চিত করে বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলল। খাওয়া শেষ হলে বসবার ঘরের দিকে যাবার সময় লেডি এ্যাকাটেল হেনরিয়েটার হাত ধরে বলে ওঠেন, মাথায় কিছু না থাকলে এই হাতে আর কত বেশি কাজ করা যায়! তুমি কী মনে কর হরতন অথবা ব্রিজ পাশবিক জোরের ফল?

হেনরিয়েটা–আমার কিন্তু মনে হয় পাশবিক জোরের সঙ্গে তুলনা করলে অপমানটা ডেভিডকেই করা হবে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ, তাহলে ব্রিজের সঙ্গে তুলনা করা চলতে পারে কারণ ডেভিড মনে মনে এটাই ভেবে বসবে যে, ব্রিজের মধ্যে বাজে জিনিষ আর নেই, তাহলে ওটার দ্বারাই তাকে অবজ্ঞা করা চলে।

তারা দুটো টেবিল অধিকার করে নিল এবং টেবিলে বসে তাস খেলতে শুরু করে দিল। জার্দার সঙ্গে খেলার সঙ্গী হল হেনরিয়েটা এবং তাদের প্রতিপক্ষ হন জন ও এডওয়ার্ড। গ্রুপিংটা যদিও ভালো হলো না তবে হেনরিয়েটা একান্ত মনেই চেয়েছিল জার্দাকে লুসির কবল থেকে রক্ষা করতে এবং সম্ভব হলে জনের হাত থেকেও। জন কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয়, সেই সঙ্গে এডওয়ার্ডও এসে যোগ দেয়। হেনরিয়েটার মতো আবহাওয়াটা যে তেমন সুখপ্রদ ছিল না এটা সে জানতে পারেনি, কোনদিক থেকে শান্তিভঙ্গের কারণ এসে হাজির হবে। যাইহোক, এইসব ভেবে আর কী লাভ, তাস যদি সাহায্য করে তবে জাদা জিতে যেতে পারে। কারণ জাদাকে খুব খারাপ ব্রিজ খেলোয়াড় বলা যায় না। তবে জাদার দোষ এটাই সে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে খেলে। জন কোনো রকমে খেলাটা চালিয়ে যেতে পারে, ভালো খেলোয়াড় সেও নয়, মনে সাহস আছে এবং নিজের ওপর আস্থা আছে, তবে ভালো খেলোয়াড় হিসাবে যথেষ্ট সুনামের অধিকারী এডওয়ার্ড।

কোথা থেকে সময় এগিয়ে চলে, হেনরিয়েটার টেবিলে তারা সেই রাবারই খেলে যাচ্ছে। স্কোর লিখে লিখে দুই দিক বেশ ভারী হয়েছে। জোর তালে প্রতিযোগিতা চলছে, কিন্তু একজন লোক এ সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ।

জাদারা এইমাত্র রাবার করল, এইজন্য সে মনের দিক থেকে অত্যন্ত খুশী এবং ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করছে।

জাদার ডাকের ওপর জার্দার রঙেরই হেনরিয়েটা ডাক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমস্যার সমাধান একনিমেষে হয়ে যায়।

জন তেমন সুবিধা করতে না পেরে জার্দার মনোবল ভেঙে দেওয়ার অভিপ্রায় নিয়েই চিৎকার করে। বলে ওঠে, জাদা তুমি হঠাৎ করে ক্লাব লিড দিতে গেলে কেন?

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, বাজে বকা বন্ধ করো জন। ক্লাব ছাড়া লিড দেওয়ার মতো জাদার কাছে আর কিছুই নেই, সে ঠিকঠাক ভাবে তার খেলা খেলে চলেছে।

অবশেষে হেনরিয়েটা তার দিক করে স্কোর করে এবং জার্দাকে বলে, গেইম এ্যান্ড রাবার হলো, আমরা বোধহয় খুব বেশি লাভবান হলাম না।

জন হাসিমুখে বলে ওঠে, লাকি গ্রুপ।

হেনরিয়েটা চট করে জনের দিকে তাকায়, কারণ একমাত্র সেই পারতো জনের ভাষা বুঝতে। জন আর কথা বাড়াল না।

 হেনরিয়েটা ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে, দেখো, খেলাতে দিয়ে লাভ করার পেছনে তেমন কোনো বাহাদুরি নেই।

জন বলে, জার্দাকে জেতাবার জন্য তুমি উঠে পড়ে লেগেছ, লোককে আনন্দ দেবার পরিবর্তে তোক ঠকানোর পথটাই তুমি বেছে নিয়েছ।

হেনরিয়েটা আর চুপ থাকতে পারে না, তুমি তোককে এরকম বাজে কথা বলে ক্ষেপিয়ে তোল কেন? তুমি কি একেবারে সাধু?

জন বলে, তোমাকে পার্টনার করা বোধহয় সার্থক হয়েছে, পার্টনারের মতোই তুমি বুলি আওড়াচ্ছ।

হেনরিয়েটা একটা জিনিষ লক্ষ্য রেখে চলেছে যে, এডওয়ার্ডকে হারানো মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।

ভুল ডাক ফেলেও কেমন সুন্দরভাবে এডওয়ার্ড গেইম করে নেয়। অনেক সময় লিড দিতে গিয়ে ভুল কিছু হয়ে গেলেও খেলা ঠিক করে নেয়। এই ব্যাপারে হেনরিয়েটা সত্যিই বিব্রত বোধ করে। নিয়মমতো খেলা খেলে না এডওয়ার্ড। এলোমেলো ভুল পন্থা অনুসরণ করে হেনরিয়েটাকে হারিয়ে দিচ্ছে। হেনরিয়েটা এটা ভেবেই নিশ্চিত হয় যে, জন ক্রিস্টোর এটা আর এক কিস্তি সাফল্য ডেকে আনল। লুসির খেলাও তার পছন্দ হয় না।

হঠাই নাটকীয়ভাবে জানলা দিয়ে ভেরোনিকার মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল। জানালা ফরাসি কায়দাতেই ভেজানো ছিল, তবে আটকানো ছিল না, কারণ সন্ধ্যের দিকটা বড্ড গরম পড়েছিল। জানালা ঠেলে ভেতরে এল ভেরোনিকা এবং গরাদে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে হাসতে থাকে। কোনো কথা না বলে নীরবে শুধু ঘরের পারিপার্শ্বিক আবহাওয়াটা নিরীক্ষণ করছিল।

আমাকে ক্ষমা করবেন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি আপনার প্রতিবেশী ডাভকোট বাড়ির অধিবাসী–মহা বিপদে পড়েই আপনার শরণাপন্ন হতে হয়েছে!–ভেরোনিকা বলে চলে।

তার হাসি এখন যেন আরও জোরে কানে আসতে লাগল, কৌতুক করেই সে বলে উঠল, একটা দেশলাই পর্যন্ত নেই–আমার ঘরে এখন অভাব পড়েছে দেশলাইয়ের। আপনার কাছে একটা দেশলাই ধার নিতেই হাজির হয়েছি। একমাইলের মধ্যে আমার প্রতিবেশী বলতে এক আপনারাই তো আছেন।

মুহূর্তের জন্য হলেও কারো মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, সকলেই যেন অভিভূত, বধির শ্রোতার দল, ভেরোনিকা নিঃসন্দেহে সুন্দরী, তবে অপরূপা নয়, তাছাড়া চোখ ধাঁধানো রূপের ছটাও ভেরোনিকার ছিল না। তবে সব মিলিয়ে তাকে সুন্দরী বলা চলে। চুলের ঢেউ, মুখের বক্রতা, কাঁধের গড়ন এবং নিতম্বের সৌষ্ঠব তাকে সুন্দরী রমণীর তালিকায় এনে দাঁড় করিয়েছে। সকলেই তাকে দেখে একবাক্যে বলে উঠবে, হ্যাঁ, চমৎকার রূপ বটে।

একটু চুপ থাকার পর ভেরোনিকা আবার বলে ওঠে, আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধূমপান করি–চিমনীর মতো করে ধোঁয়া ছাড়ি, তবে আমার লাইটারটাও এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে–কাজে আসছে না। তাছাড়া স্টোভ জ্বালার ব্যাপার আছে–আমার এমন নীরেট মাথা যে, দেশলাইয়ের কথা আগে মনেই হয়নি, আমার ঘরে বলতে গেলে যে একটি দেশলাইও নেই একথা আগে জানতে পর্যন্ত পারিনি।

আভিজাত্যের ভঙ্গিমায় লুসি এগিয়ে এলেন, চোখেমুখে মৃদু হাসির ছাপ।

-কেন, অবশ্য–দেশলাই দিয়ে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সবে মুখ খুলেছে, কিন্তু মাঝপথে ভেরোনিকা বাধা দেওয়ায় তিনি নীরব থাকলেন।

জন ক্রিস্টোকে দেখা মাত্র ভেরোনিকা অবাক হয়ে যায় এবং তার নিকট এগিয়ে এসে আলাপ জমিয়ে দেয়। মুখে তার অটুট রয়েছে অবিশ্বাস্য খুশীর ছাপ।

করমর্দনের জন্য এগিয়ে এসে সে হাত বাড়িয়ে দেয়।

জন ক্রিস্টো যে! কতদিন হল তোমার দেখা মেলেনি! তোমাকে হঠাৎ করে এখানে দেখতে পেয়ে কী যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারছি না!

ক্রিস্টো এবং ভেরোনিকা গভীর আনন্দের সঙ্গে করমর্দন করে ফেলে। আর লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে চোখ যেতেই বলে ওঠে, এখানে আসার পর জীবনের সবচাইতে বড় আশ্চর্যের জিনিষটা দেখলাম, জন আমার বহুদিনের পুরোনো বন্ধু অথচ তাকে কতদিন হলো চোখের দেখা পর্যন্ত দেখিনি! শুধু পুরোনো বন্ধু বললে বোধহয় ভুল বলা হবে, আমার জীবনে সেই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম, প্রেমে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি জনকে এখনও মনে মনে ভালোবাসি।

ভেরোনিকার মুখে মৃদুমন্দ হাসি লেগেই ছিল–একজন স্ত্রীলোক তার জীবনের প্রথম প্রেমিককে পেয়ে যেমন সুখী হয় তেমন রূপের ছটাও তার চোখেমুখে।

পরে বলে উঠল, আমি ভাবতাম, জন সত্যিই অত্যাশ্চর্য!

স্যার হেনরি যেমন ভদ্র তেমন মার্জিত স্বভাবের। ভেরোনিকার দিকে তিনি গুটিগুটি পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন। মদের গ্লাস বাড়িয়ে ধরলেন, গ্লাসে চুমুক দেবার জন্য আহ্বান করলেন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে মিডগে বলে ওঠেন, বোনটি, ঘন্টা বাজাও।

গাজন আসতেই লুসি বলে উঠলেন, এক বাক্স দেশলাই নিয়ে এসো, পাঁচকের কাছে চাইলে অনেকগুলো পেয়ে যাবে।

–আজ নতুন একডজন এসেছে মহাশয়া,-গাজন বলে ওঠে।

–তাহলে বরং নতুনগুলোর মধ্যে থেকে আধডজন নিয়ে এসো।

ভেরোনিকা মৃদু হেসে প্রতিবাদ জানাতে চায়, না না, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, আর তো মাত্র একটা দিন। ভেরোনিকা মদ্যপান করতে করতে হাসিমাখা মুখ নিয়ে প্রত্যেকের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হেসে সকলকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।

জন ক্রিস্টো জাদাকে দেখিয়ে একবার বলে ওঠে, এই আমার স্ত্রী, ভেরোনিকা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ভেরোনিকা বলে ওঠে, ও, তোমাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! হতবুদ্ধির ন্যায় বধির হয়ে নীরবে রইল জার্দা। গাজন দেশলাইটা এনে একটা রুপোর ডিসের ওপর রাখল। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল দেশলাইয়ের ডিসটা এনে এবার ভেরোনিকার সামনে রেখে দিল।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, প্রিয় লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, এতগুলো দেশলাই আমার কোন প্রয়োজনে আসবে না।

রাজকীয় ভঙ্গিতে লুসি জবাব দেয়, শুধু একটা কেমন অস্বস্তি হয়, আপনি ইচ্ছে করলে সবগুলোই নিয়ে যেতে পারেন, আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। ছটা দেশলাই দেওয়া আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়।

স্যার হেনরি অমায়িকভাবে বলে ওঠেন, ডাভকোটে থাকতে আপনার এখন কেমন লাগছে?

ভেরোনিকা–আমার বেশ ভালোই লাগছে। লন্ডন শহর থেকে এত নিকটে এমন সুন্দর নিঝুম নিরিবিলি জায়গা। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেছে।

ভেরোনিকা, প্ল্যাটিনাম ফক্সেস শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে শক্ত করে এঁটে নেওয়া হলে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিল।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনারা আমার অনেক উপকার করেছেন। স্যার হেনরি ও লেডি এ্যঙ্গক্যাটেলের মধ্যে কথাগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এডওয়ার্ড চুপচাপ কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। ভেরোনিকা বিদায় নিয়ে যাবার সময় জনকে একবার লক্ষ্য করে বলে উঠল, জন, তুমি কিন্তু আমার সাথে অবশ্যই একবার দেখা করবে। আমাদের সেই শেষ সাক্ষাতের পর তুমি এতদিন ধরে কী করছিলে, আমার সব জানতে ইচ্ছে করছে। যদিও সেগুলো এখন অনেক বাসি হয়ে গেছে, তবু আমি শুনতে চাই।

সে জানালার দিকে এগিয়ে গেল এবং জন তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। ভেরোনিকা সকলের দিকে তাকিয়ে এবার বিদায়ের হাসি হেসে ওঠে। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, এমন বোকার মতো অসময়ে আপনাকে উত্ত্যক্ত করার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত।

জনের সঙ্গে ভেরোনিকাও বেরিয়ে যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে তাদের দিকেই তাকিয়ে রইলেন স্যার।

তিনি বলে ওঠেন, চমৎকার এক উষ্ণরাত্রি!

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল হাই তোলেন। তিনি বলেন, ওগো, আমাদের এখন শুতে যাবার সময়। হেনরি, আমরা ওর একটা ছবি দেখতে যাব, আমার মনে হয় আজ থেকেই ওর অভিনয় শুরু। তারা উপরে চলে আসেন। তাদের বিদায় জানাতে এসে মিডগে, লুসিকে জিজ্ঞাসা করলেন, খুব ভালো অভিনয় করে বুঝি।

লুসি–তুমি কী তা মনে করো না, প্রিয় বোন?

মিডগে–তোমার কী মনে হয় লুসি, যে, প্রায়ই তার দেশলাইয়ের অভাব দেখা দেবে এবং নিরুপায় হয়েই সে এখানে উপস্থিত হবে?

লুসি–তা কেন হতে যাবে? তবে আধডজন দেশলাই কিছু কম নয় বোনটি। বদান্যতা না দেখিয়েও তো পারি না। তাছাড়া, শুনে এসেছি চমৎকার অভিনয় গুণও তার আছে।

নিচের এবং অলিন্দের সবকটা দরজা একসাথে বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এলো। স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, জানলাটা আমি ক্রিস্টোর কথা ভেবেই খুলে রেখেছিলাম। বলা শেষ হলে নিজের ঘর বন্ধ করলেন। হেনরিয়েটা জার্দার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, অভিনেত্রীরা কত রঙ্গই না জানেন। তাদের প্রবেশ এবং প্রস্থান দুটোই ভীষণ চমৎকার।

জার্দা হাই তুলে বলে ওঠে, ঘুমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে।

বাদামগাছের বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ ধরে ধীর পদক্ষেপে চলছিল ভেরোনিকা ক্রে। সাঁতারের জলাশয়ের ধার দিয়ে সে ভোলা জায়গাটাতে এসে দাঁড়াল। এই জায়গাটায় ছোট একটা তাবু। দিনে সূর্যের আলোয় ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হতে থাকলে এ্যাঙ্গক্যাটেলগণ এখানে বাস করতেন।

ভেরোনিকা ক্রে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘোরাতেই চোখ গেল জনের ওপর, কিছু পরেই সে হাসিমুখে ঝরাপাতায় পরিপূর্ণ সুইমিং পুলের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, দেখো, ঠিক ভূমধ্যসাগরের মতো নয়, কি বল জন?

সে জানত যে, কেন সে তার প্রতীক্ষায় বসে আছে–সে জানত যে, একটা দুটো বছর নয়, দীর্ঘ পনেরোটা বছর। ভেরোনিকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও সে তার সঙ্গেই আছে–এখনও আছে। নীল সবুজ, মিমোত্মার গন্ধ, উত্তপ্ত ধূলিকণাচলে গিয়েছে, কোন্ দূরে সরে গেছে, দৃষ্টির অন্তরালে চলে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে–তবু মন থেকে যায়, অন্তরের কোনো এক স্থানে রয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দৃষ্টি, ফুলের গন্ধ, আবহাওয়ার মাদকতা–সবকিছুর মূলেই ঐ ভেরোনিকা, সবকিছুর লক্ষ্য কিন্তু একমাত্র সেই। জন চব্বিশ বছরের তখন এক যুবা, কোনো এক সময় ভেরোনিকাকে সে তার মন দিয়েছিল, তার প্রেমের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়েই তাকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের ভালোবাসার ঘর বেশিদিন টিকল না, তাই বিচ্ছেদ হয়ে গেল, জন পালিয়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু আজ আবার এতদিন পরে তাকে সে ফিরে পেয়েছে, তাকে ছেড়ে যেতে মনের দিক থেকে কিছুতেই সাড়া পাচ্ছে না–আজ আর জন পালিয়ে যাবে না।

.

০৯.

 জন ক্রিস্টো বাদামগাছের বন থেকে সবুজ ঘাসের মুক্ত প্রাঙ্গণে ঘরের ঠিক পাশটাতে এসে উপস্থিত হল। আকাশজুড়ে তখন চাঁদের আলো। জ্যোৎস্না-সাত বাড়িটাকে তখন অদ্ভুত লাগছিল। জানলায় পর্দা ঝোলানো ছোট বাড়িটার রূপমুগ্ধকর অপূর্ব সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর! হাত ঘড়ির দিকে জন সময়টা দেখে নিল।

ঘড়িতে তখন ঠিক তিনটে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জন ক্রিস্টো। তখন দেখে মনে হচ্ছিল ভেতর ভেতর সে বড় উদ্বিগ্ন। সে এখন আর প্রেমে অন্ধ চব্বিশ বছরের যুবক নয়। এখন সে একজন বিচক্ষণ বিষয়ী লোক, তার বয়স এখন চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই। তার মনে এখন জলের মতো স্বচ্ছ এবং শান্ত স্থির।

জনের মনের হলল, সে খুব বোকা, সত্যি খুব বোকা ছিল। এই জন্য তার কোনো অনুতাপ নেই। অতীতে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে গেছে তার কোনো সমাধান বোধহয় হয়নি, জন নিজের কাছে হেরে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে–তাই ভেরোনিকাকে মন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুছে ফেলতে পারেনি। ভেরোনিকা আজ এসে উপস্থিত হয়েছিল যেন স্বপ্নের মতোইজন কিন্তু সেই স্বপ্নকে মেনে নিয়ে তাকে অনুসরণ করেই পথ চলতে শুরু করেছে। এখন কি রাত তিনটে, ভেরোনিকার সঙ্গে সে তিনঘন্টা কাটিয়ে এসেছে। সে যেন তার দল থেকে পালিয়ে এসেছে, ভেরোনিকাই যেন তার সম্পূর্ণ মূল্য আদায় করে নিল। জন সম্বন্ধে সকলের ধারণা কোথায় নেমে গেল! জার্দা কী ভাবল? আর হেনরিয়েটা? হেনরিয়েটাকে সে কোনোদিন গ্রাহ্য করেনি। একনিমিষে তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে বোধহয় অসুবিধা হবে না। কিন্তু জাদা? জার্দাকে বোঝনোর ক্ষমতা তার নেই।

জন কিন্তু কিছুতেই হারতে চায় না। জীবনের সব সুযোগই সে হাত পেতে নিতে চায় এইজন্য সে সব ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে সে সব ঝুঁকি নিয়ে এক, পায়ে খাড়া-গবেষণায় কোনো ঝুঁকি নেই, আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও বোধহয় এই ঝুঁকিটা নেই। তবে সে কিন্তু খুব বড় মাপের ঝুঁকি নিতে চায় না–নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, আবার সুবিধেও খুব সহজে মিলে যায়–এমন ঝুঁকিরই সে পক্ষপাতিত্ব করে আসছে বরাবর। জাদা যদি কিছু অনুমান করে থাকে? জার্দার যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থেকে থাকে তবে তো সবই জার্দাকে মুখ ফুটে সে কি কিছু বলবে? জার্দাকে সে আর কতটুকু জানে? তার সম্বন্ধে কোন ব্যাপারে সে কি কোনোদিন আগ্রহ প্রকাশ করেছে? সহজ কথাটা জাদা ভালোই বোঝে। জন যদি জার্দাকে বলেও থাকে যে, সাদাকালো হয়ে গিয়েছে–সেটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, কিন্তু এরকম জিনিষকে সে কী বলে বোঝাবে..সে যখন বিজয়িনীর পেছন পেছন পরাজিতের মতো অনুসরণ করে উপস্থিত। এখন সকলে কী মনে করবে?

ভেরোনিকা তার সুডোল উচ্চ শরীরী গঠন ও সুঠাম দেহসৌন্দর্য নিয়ে জনকে মোহিত করেছিল, পরাস্ত করেছিল, তাকে জয় করে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণী শক্তির টানে টেনে নিয়ে বসাল। জন ভেবে কোনো কিছুরই কুলকিনারা করতে পারল না। খেলার টেবিলে বসে কে কী মনে করল না করল। তারা কী জনের মধ্যে পনেরো বছরের সেই পূর্বের প্রেমে পাগল হওয়া যুবককে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে? অথবা এমনও হতে পারে তার মধ্যে তারা এক কর্তব্যপরায়ণ ভদ্রলোকের দর্শন লাভ করেছে। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই।

জন কিন্তু সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ভীতির কারণ হলো তার শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য, অসামাজিক আচরণের জন্য, নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সে যেন সম্পূর্ণ রূপে এক পাগল হয়ে উঠেছিল–সমস্ত শালীনতার বেড়াজাল টপকে উন্মাদের মতো ভেরোনিকাকে অনুসরণ করেছিল সে, মন্ত্রচালিতের মতো এখন তার দশা। সে যে এতটা পাগল হয়ে উঠতে পারে তাকে কী বিশ্বাস করতে চাইবে? এই গভীর রাতে সকলেই এখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন, বসার ঘরের ফরাসি জানলা তার পথ চেয়েই আধখোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে–জন ফিরে যাবে এই জন্যই ভোলা রাখা হয়েছে। সে আবার মুখ তুলে নিরীহ নিদ্রিত বাড়িটার দিকে একবার তাকাল। বাড়িটাকে দেখে আরও যেন নিরীহ এবং নির্দোষ বলে মনে হতে লাগল।

সে আবার পথ চলতে শুরু করে দেয়। সে শুনতে পেল অথবা কল্পনার জগৎ থেকেই সে শুনতে পেল বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে-দরজা বন্ধ হবার স্পষ্টধ্বনিও তার কানে এসে বাজল।

সে মুখ ঘুরিয়ে সুইমিং পুলের দিকে একবার চেয়ে দেখল, কেউ যদি তাকে অনুসরণ করে সেখানে এসে থাকে। কেউ হয়তো তাকে অনুসরণ করে এসেছিল এবং পরে গিয়ে বাগানের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো দরজা বন্ধ হবার শব্দটাই তার কানে এসেছে।

সে তাড়াতাড়ি করে জানলার দিকে তাকায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে কেউ কি তাকে প্রত্যক্ষ করছিল, পরে হয়তো জানলা বন্ধ করে দিয়েছে। ঐ ঘরটা কি হেনরিয়েটার?

জনের একবার ইচ্ছে হল, কতকগুলো পাথরকুচি জানলায় ছুঁড়ে মারে, তারপর চিৎকার করে হেনরিয়েটাকে ডাক দেয়।

হেনরিয়েটা! জনের প্রাণ হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে। কোনো অবস্থাতেই সে হেনরিয়েটাকে হারাতে পারবে না।

তার চিৎকার করে বলতে মন চাইছিল, এসো হেনরিয়েটা, ঘরে না থেকে বেরিয়ে এসো, আমার সঙ্গেই না হয় বেড়াতে চলল! বেড়াতে বেড়াতে শো ভোনডাউন পর্যন্ত চলে যাব। আমার মনের সব কথা তোমার কাছে উজাড় করে দেব–আমার যত কথা তোমাকে আজ ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। আমার কথা তোমার বোধগম্য হবে কিনা জানি না, আমার জীবনের কোনো কথা তোমার অজানা নয়–যদি কিছু তোমার অজানা থেকেও থাকে, তবে এসো সব খুলে বলবো।

জন হেনরিয়েটাকে তার মনের না-বলা যে কথা বলতে চেয়েছিল : আমি আবার প্রথম থেকেই শুরু করছি। আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হল। সে জিনিষটার আকর্ষণ আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে চলছিল, পঙ্গু অবস্থায় আমাকে ফেলে রেখেছিল, বর্তমানে সেটা এখন পড়ে গিয়েছে। আজ বিকেলে তুমি আমায় ঠিক কথাই বলেছিলে। নিজের কাছ থেকেই আমি পালিয়ে বাঁচতে চাই। বছরের পর বছর ধরে আমি সেটাই করে আসছিলাম। আমি এখনও উপলব্ধি করতে পারিনি, যে এটা শক্তি, না দুর্বলতা, যা আমাকে ভেরোনিকার কাছ থেকে সরিয়ে এনেছিল। নিজেকে দেখেই আমি ভয় পেয়ে যেতাম, জীবনকে ভয় পেতাম, তোমাদের কাছ থেকেও ভয় পাবার আশঙ্কা মনে থেকেই যেত।

যদি সে হেনরিয়েটাকে একবার জাগাতে পারতো, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারতো বনের মধ্যে গিয়ে তাকে নিয়ে যদি কোথাও বসতে পারতো, যেখানে একত্র হয়ে প্রত্যক্ষ করতে পারতো পৃথিবীর বুকে সূর্যের নেমে আসার দৃশ্য।

নিজেকে সে নিজেই পাগল ভাবতে লাগল। থরথর করে কাঁপছিল। সেপ্টেম্বরের শেষের শীত, ভালো ঠান্ডা, তাই সে কাঁপছিল, জন নিজের উদ্দেশ্যেই নিজেকে প্রশ্ন করে, তোমাকে কোনো ভূতে পেয়েছে নাকি? নেহাতই পাগল তুমি! একটা রাত তুমি পাগলের মতোই ব্যবহার করেছ। তুমি যদি অক্ষত থাকতে পার, জানবে তুমি সত্যিই ভাগ্যবান।

সারাটা রাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতে তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে জার্দা কিছু ভাবলেও ভাবতে পারে?

এ ব্যাপারে এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মনের ধারণা কী হবে বা হতে পারে? এ্যাঙ্গক্যাটেলদের জন্য জনের তেমন মাথাব্যথা নেই, কারণ গ্রীনউইচ্ টাইম মেনে তারা চলেন। তাছাড়া, লেডি এ্যঙ্গক্যাটেলের কাছে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার যুক্তিযুক্ত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জার্দা তো আর লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল নয়। জার্দাকে একটু অন্যরকম ভাবে বোঝাতে হবে এবং যত শীঘ্র জার্দাকে বোঝানো যায় ততই মঙ্গলের।

জাদা স্বয়ং যদি তাকে অনুসরণ করে থাকে?

না, ভালো লোকেরা সাধারণত এমন করে না। একজন চিকিৎসক হিসেবে সে শুধু এটাই জানে যে, উচ্চমনা, ভাবপ্রবণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিরা কীভাবে চলে। তারা ডাক্তারের কথাও শোনে আবার পরের চিঠি খোলার ব্যাপারেও অসীম উৎসাহ এবং মাঝেমধ্যে প্রয়োজন পড়লে গোয়েন্দাগিরিও করে থাকে–এই কাজ যে তারা কিছুক্ষণের জন্য মনের দিক থেকে সমর্থন জানায় তা নয়, তীব্র দৈহিক যাতনা বা মনস্তাপও তাদের দুঃসাহসী হয়ে ওঠার ব্যাপারে সাহায্য করে।

শয়তান বেচারা! জন মনে মনে ভাবে যে, শয়তানরূপী মানুষ এরা! ডাক্তার ক্রিস্টো মানুষদের বহু দৈহিক যাতনা ও মানসিক যন্ত্রণার কথা জানে। দুর্বলতার জন্য তার মোটেও দয়ামায়া নেই, মানুষের যন্ত্রণায় সে মোহিত হয়। কারণ সে মনেপ্রাণে এই সত্যে বিশ্বাসী যে, জগতে সবলরাই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে।

জাদা যদি জেনে থাকে?

মূর্খ! সে নিজেকেই নিজের মুখে তিরস্কার করে। জার্দা কেন জানতে যাবে? গভীর ঘুমে সে এখন আচ্ছন্ন। তার কোনো কল্পনা নেই, কোনো কালে অবশ্য ছিলও না।

ফরাসি জানলা দিয়ে সে আবার ঢুকে পড়ল, একটা আলো জ্বেলে ভালো করে জানলা বন্ধ করে দিল। তারপরে ঘরের আলো নিভিয়ে চলে গেল। হলে তখন আলো জ্বলছে–সে তাড়াতাড়ি করে অথচ ধীর পদক্ষেপে উপরে উঠে এল। দ্বিতীয় একটা বোতাম টিপে হলের আলো নিভিয়ে দিয়ে সে শোবার ঘরের দরজায় হাতলের ওপর হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পরে হাতল ঘুরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

সারা ঘর গুমোট অন্ধকার, ঘুমন্ত জার্দার নিশ্বাসের শব্দ তার কানে এসেছিল। জন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই জার্দা নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমের মধ্যে তার অস্পষ্ট স্বর শুনতে পেল।–কে জন?

হা।

এত দেরি হলো কেন? এখন ক’টা বাজল?

সহজ ভঙ্গিতেই জন উত্তর দেয়, ক’টা বাজছে ঠিক বলতে পারবো না, তবে তোমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম বলে আন্তরিক ভাবেই আমি দুঃখিত। ঐ স্ত্রীলোকটির সঙ্গে গিয়ে আমাকে মদ ছুঁতে হয়েছে।

সে নিজের স্বরকে নিদ্রাচ্ছন্ন এবং বিরক্তিকর করেই তোলে।

জার্দা বলে ওঠে, শুভরাত্রি জন!

জন বিছানাটা পাতার সঙ্গে সঙ্গেই স্প্রিং-এর শব্দটা কানে বাজল।

সব ঠিকঠাক আছে। বরাবরই তার ভাগ্য তাকে সব ব্যাপারে সহযোগিতা করে আসছে। মাঝেমধ্যে সে খুব বিপদে পড়ে যায়। এবং প্রতিবারই তার মনে হয়, খারাপ যদি কিছু ঘটে যায়? কিন্তু প্রতিবারই সে বেঁচে গেছে, কোনোবারই কিছু খারাপ হয়নি। ভাগ্যই সবসময় তার পাশে থেকে তাকে রক্ষা করে এসেছে।

তাড়াতাড়ি করে পোষাক পাল্টে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল। মনে মনে ভাবে, কী ভাগ্য! এটা তারই করুণা, যিনি তোমার মাথার ওপর অবস্থান করছেন…আর ভেরোনিকা! আমার ওপরে তার প্রভাব ক্রমেই বিস্তার করে চলেছে, একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু আর নয়, বালিকা! একটা অন্ধ আবেগে অভিভূত হয়ে সে যেন বলেই চলে, সব শেষ হয়ে গেল, আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম।

.

১০.

 পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ জন নিচে নেমে আসে। পাশের টেবিলে তখন প্রাতঃরাশ পর্ব চলছে। জার্দা বিছানাতেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে–তাকে সেখানেই তার খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সে নিচে আসেনি, কারণ তার ব্যবহার কাউকে যদি অপ্রস্তুত করে তোলে এই ভয়েই সে আরো ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করছিল।

জন ভাবে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মতো লোকের দল যারা এখনও খানসামা, পাঁচক, চাকর প্রভৃতি পুষে চলেছে তারা ইচ্ছে করলেই তাদের কিছু কাজ দিতে পারেন।

আজ সকাল থেকে জার্দার জন্য জনের খুব মায়া হচ্ছিল। মনে যে দুর্বলতা এতক্ষণ ধরে তাকে পীড়া দিচ্ছিল, এখন তা মরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

স্যার হেনরি এবং এডওয়ার্ড কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে বাইরে গেছেন, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখ থেকেই তিনি প্রথম শোনেন। তিনি নিজে বাগানের বাস্কেট এবং গাছ নিয়ে ব্যস্ত। জন তার সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিল, এই সময়ে গাজন একটা রেকাবে করে একটা চিঠি এনে হাজির হলো, সে বলে ওঠে, স্যার লোক মারফত এই চিঠিটা এসে পৌঁছেছে।

জন তাকিয়ে দেখে, চিঠিটা খোলে, ভেরোনিকার কাছ থেকেই এসেছে। জ্ব যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে লাইব্রেরির মধ্যে এসে চিঠিটা খোলে, ভেরোনিকা লিখেছে : আজ সকালের দিকে একবার এসো, তোমার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন। ভেরোনিকা।

সে ভাবে, প্রভুত্বব্যাঞ্জক এই চিঠি। তার যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই, কিন্তু চিন্তা করে দেখেছে যে এই ব্যাপারের নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, এক্ষুনি তাকে যেতে হবে।

লাইব্রেরির জানলার ঠিক বিপরীতমুখী রাস্তা ধরে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে সে এগিয়ে চলল, সুইমিং পুলটা ঠিক যেন একটা শাঁস, এর থেকে অসংখ্য রাস্তা বের হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, একটা পাহাড়ের ওপর বনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে, একটা ঘরের ওপর দিককার ফুলের বাগান থেকে, একটা গোলা থেকে, একটা এসে সরাসরি লনের সঙ্গে মিশেছে–এই রাস্তা ধরেই সে এগিয়ে চলেছে। এই লন ধরে কয়েক গজ এগোলেই ‘ডাভকোট’। ‘ডাভকোট’ নামের বাড়িটা।

আধা-কাঠের বাড়ির জানালা থেকে ভেরোনিকা সেইকথাই ভাবছিল। সে অবশ্য আগে থেকেই জনের প্রতীক্ষায় বসেছিল। ভেরোনিকার বাড়িটা দেখতে সত্যিই সুন্দর, শিল্পীমনের পরিচয় ফুটে উঠেছে তার সর্বাঙ্গে। জনের মনে হল, শিল্পসৌন্দর্যের থেকে বিশেষভাবে দাম্ভিকতা যেন আত্মপ্রচারে সদা ব্যস্ত।

ভেতরে এসো জন, আজ সকালটায় বড্ড শীত পড়েছে।

বসার ঘরে আগুন জ্বালানো ছিল। ঘরটা ঈষৎ সাদা রঙের, সারা ঘর পাংশু বর্ণের সোফায় সজ্জিত। তার দিকে তাকিয়ে বিচারের চোখ নিয়ে আজ দিনের আলোতে ভোেনিকাকে ভালোভাবে দেখল। কাল হয়তো এত ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। যে ভেরোনিকাকে সে একদিন জানতো সে ভেরোনিকা আর নেই। তার মধ্যে এখন আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। সপ্তদশী বালিকাকে আজ বত্রিশ বছরের ভেরোনিকার মধ্যে কোন্ মিল চোখে পড়বে।

সত্যি বলতে কী, জনের মনে হয় যে, ভেরোনিকার রূপের ছটা আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর। সে নিজেও সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং সর্বদা সে নিজের সৌন্দর্য বাড়াতে সচেষ্ট। নিজের দেহের কিসে দেহজ সৌষ্ঠব বাড়ে এবং কী কী পন্থায় তার দেহের যত্ন নিতে হবে তা সে ভালোভাবেই বোঝে। তার গাঢ় সোনালি রঙের কেশ এবং রুপোলি প্লাটিনাম রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। তার –যুগলও অন্যরকম ছিল, এখন তাতে প্রকাশের তীব্রতা অনেক বেশি। কোনোদিনই সে নির্বোধ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল না। তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না অভিনেত্রী হিসেবেই তার সুনাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রিও সে অর্জন করেছিল ও স্ট্রিন্ডবার্গ ও সেক্সপীয়ারের ওপর গবেষণাও করেছিল। তার ব্যাপারে একটা জিনিষ বড্ড খারাপ লেগেছিল যে, সে একজন স্ত্রীলোক হয়ে একগুয়ে প্রকৃতির ছিল–জনের কাছে যেটা সত্যিই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল।

ভেরোনিকা নিজের পথেই চলতে অভ্যস্ত এবং মাংসের মসৃণ সুন্দর সীমারেখার মধ্যে তার লৌহসঙ্কল্প জনের কাছে বড়ই কুৎসিত ঠেকে।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি, কারণ আমাদের কিছু কথা হওয়ার আছে, বলতে বলতে সে বাক্স-ভরা সিগারেট জনের দিকে এগিয়ে ধরে। সে বলে ওঠে, আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পরিকল্পনা করার কথা ভেবেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।

জন একটা সিগারেট তুলে ধরায় এবং বেশ ভদ্র ভাবেই তার বক্তব্য শুরু করে, কিন্তু আমাদের সত্যি কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?

ভেরোনিকা তার প্রতি কটাক্ষ দৃষ্টিতে তাকায়, বলে ওঠে…, তুমি কী বলছ জন? আমাদের নিশ্চয়ই একটা ভবিষ্যৎ আছে। পনেরোটা বছর আমরা হেলায় নষ্ট করেছি, এরপর সময় নষ্ট করা বোধহয় উচিত হবে না।

জন নীরব থাকে।

একটু পরে আবার বলে ওঠে, সত্যি আমি দুঃখিত, ভেরোনিকা তুমি আজ যা কিছু বকে যাচ্ছ আমার মনে হয় তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। তোমাকে দেখার পর আমি খুশী আর চেপে রাখতে পারিনি। তোমাকে দেখার আনন্দে আমি আবার পূর্বের জীবনে ফিরে গেছি, আগের মতো অধীর হয়ে পড়েছি। কিন্তু তোমার আর আমার জীবনের চলার পথ এখন একদম পাল্টে গেছে, কোথাও কোন মিল নেই, তারা পরস্পর বিরোধী।

ভেরোনিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি কী আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছে জন। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে দুরে সরে গেলেও আমরা উভয়েই এখনও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। অতীতে তুমি ভীষণ একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলে, কিন্তু সেকথা ভেবে এখন আর লাভ নেই! আমাদের জীবনে সংঘাত হবার কোনো আশঙ্কা নেই, আমি তোমাকে আমেরিকা যাবার জন্য অনুরোধ করছি না, আমি যে ছবিতে কাজ করেছিলাম তা এখন সমাপ্তির পথে, তাই সোজা লন্ডনের মঞ্চে অভিনয় করার জন্য যেতে চাইছি। আমার আশ্চর্যজনক একটা নাটক আছে–এল্ডারটন–আমার কথা ভেবেই এটা রচনা করেছেন। এই নাটকে আমি অতুলনীয় কৃতকার্যতা লাভ করবো–আমার কথা মিলিয়ে নিও।

সে ভদ্রতার সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি যে তোমার কাজে সাফল্য পাবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

ভেরোনিকা–তুমিও তোমার ডাক্তারি চালিয়ে যেতে পারো, আমি তো শুনেছি যে নামকরা চিকিৎসক হিসেবে তোমার এখন যথেষ্ট হাঁকডাক।

জন–কিন্তু প্রিয় বান্ধবী, আমি বিবাহিত, ছেলেমেয়েও আছে।

ভেরোনিকা–আমিও বিবাহিত হয়ে যেতে পারি। এসব ব্যাপার খুব সহজেই হয়ে যায় এবং একজন ভালো উকিল সবকিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বরাবরই তুমি আমার প্রিয়, তোমাকে বিবাহ করার জন্য আমার মন সবসময়ের জন্যই প্রস্তুত ছিল। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, তোমার প্রতি আমার এই উগ্র আকর্ষণের কারণটা কি? এখন সব দিক ভেবে এই সত্যটাই উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, একমাত্র বিবাহেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

জন–আমি সত্যিই দুঃখিত, ভেরোনিকা, কোনো ভালো উকিল এলেও বোধহয় কিছু করতে পারবে না। আমাদের আবার নতুন করে ঘর বসানো যায় না, কারণ দু’জনের মধ্যে মনের মিলের বড়ই অভাব।

ভেরোনিকা–গত রাতের ঘটনার পরেও না?

জন–তুমি শিশু নও ভেরোনিকা। তোমার কমপক্ষে একজোড়া পতিদেবতা এবং কম করে একাধিক প্রেমিক আছে। গতরাতের ঘটনায় এমন কি আর ঘটেছে? কোনো অঘটন যে ঘটেনি তা তোমার থেকে আর ভালো কে জানবে।

ভেরোনিকা–হে আমার প্রিয় জন, সেই গুমোট ঘরে তুমি যদি নিজের মুখটা স্বচক্ষে একবার দেখতে পেতে। তবে তোমার বুঝতে অসুবিধে হতো না যে, তুমি পুনরায় সান মিগুয়েলে ফিরে গেছ কিনা!

জন (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)–সান মিগুয়েলে আমি ফিরে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো ভেরোনিকা, আমার জীবনে তোমার সঙ্গে এভাবে দেখা হওয়া সুদূর অতীতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তুমিও যেন সেই অতীতের এক বাসিন্দা। কিন্তু আজ আজ একেবারেই অন্যরকম। আজ আমি সে সময়ের চেয়ে পনেরো বছরের বড়। আজকে আমার সম্পূর্ণ পরিচয় পেলে তোমার বোধহয় ভালো লাগবে না, পরিচয় না পেলে তুমি হয়তো আমাকে মানুষ বলেই জ্ঞান করতে।

ভেরোনিকা–আমার থেকে তুমি তোমার স্ত্রী এবং সন্তান সন্ততিদের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী এবং তাদেরই তুমি প্রাধান্য দিচ্ছ।

জন–তোমার অসুবিধে হচ্ছে না তো?

 ভেরোনিকা–কিন্তু জন, তুমি তো আমাকে ভালোবেসেছ?

জন–সত্যি আমি দুঃখিত ভেরোনিকা।

ভেরোনিকা–তুমি আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসো না?

জন–এই বিষয়ের একটা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তুমি নিঃসন্দেহে অপরূপা, অনিন্দ্যসুন্দরী রমণী তুমি, কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না।

ভেরোনিকা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো এমনভাবে বসে রইল যে, দেখলে হঠাৎ করে মোমর পুতুল ভেবে ভ্রম হলেও হতে পারে। তার এই ধৈর্য জনকেও বিচলিত করে তুলল।

ভেরোনিকা যখন তার মুখ খুলল, তার মুখ দিয়ে এমন বিষ ঝরতে লাগল যে, জন ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল।

ভেরোনিকা-কে সে?

জন–সে? তুমি কার কথা বলতে চাইছ?

ভেরোনিকা–গতরাতে অগ্নিকুণ্ডের ওপরের তাকের পাশে যে স্ত্রীলোকটি বসেছিল?

জন ভাবতে থাকে, হেনরিয়েটা হবে হয়তো? কিন্তু সে ভেরোনিকার কি ক্ষতি করতে চাইবে?

উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, তুমি কার কথা বলছ? মিডগে হার্ডক্যাসল? ভেরোনিকা-মিডগে? চৌকো দেহের সেই মহিলাটির কথা বলছ?

-না, আমি তার কথা বলিনি, তোমার স্ত্রীর প্রসঙ্গেও কিছু বলছি না। আমি সেই উদ্ধত শয়তানিটার কথা বলছি, শুধু তার মুখ চেয়েই তুমি আমাকে আজ খালি হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে অন্তত নৈতিকতার কোনো ভান কোরো না। তুমি ঐ স্ত্রীলোকটার জন্যই আমার প্রতি বিমুখ হচ্ছ।

ভেরোনিকা উঠে এসে জনের খুব কাছে তার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। আঠারো মাস আগে ইংল্যান্ডে আসার সময় থেকেই তোমার কথা ভেবে চলেছি, তুমি এ সবের কিছুই জান না। আমি বাড়ি করার জন্য এই বিশ্রী স্থানটা বেছে নিলাম তুমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারবে? আমি জেনেছিলাম যে, তুমি মাঝেমধ্যেই এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এখানে উপস্থিত হও। এখানে থাকলে তোমার সান্নিধ্য পাব এই আশা নিয়েই এই জায়গায় আমার বাড়ি করা।

জন–গতরাতে তাহলে পরিকল্পনা করেই এখানে হাজির হয়েছিল?

ভেরোনিকা–জন, তুমি আমার! তুমি চিরকালই আমার ছিলে!

ভেরোনিকার সুন্দর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল অপূর্ব রূপের এক দ্যুতি, অফুরন্ত খুশি জনকে সে আলিঙ্গন করে বসে। বুকের মধ্যে সজোরে টেনে এনে চুম্বন করে।

জন–আমি কারুর নই ভেরোনিকা। জীবনে কি এখনও সে শিক্ষা তুমি পাওনি যে, মানুষের দেহ ও মনের অধিকারী কেউ হতে পারে না? আমি যখন বয়সে যুবা ছিলাম, সেই সময় তাকে ভালোবেসেছিলাম। আমার জীবনের সঙ্গে তোমাকেও কাছে পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তখন ফিরিয়ে দিয়েছিলে!

ভেরোনিকা–আমার জীবন এবং জীবিকা তোমার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। যে কেউ ইচ্ছে করলেই ডাক্তার হতে পারে!

জন একথা শোনার পর ক্রুদ্ধ হয়। তুমি নিজেকে যতটা অত্যাশ্চর্য মনে করো ভেরোনিকা, তুমি আসলে কি তাই?

ভেরোনিকা–তুমি বলতে চাইছ যে, আমি এখনও বৃক্ষের চূড়ায় আরোহণ করতে পারিনি। হয়তো এখনও পারিনি। কিন্তু এবার করব! নিশ্চয়ই করব!

জন বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিয়ে ভেরোনিকার দিকে তাকাল।আমি মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতে পারি না যে, তুমি বৃক্ষচূড়ায় আরোহণ করবে। তোমার মধ্যে একটা জিনিষের বড় অভাব ভেরোনিকা। আমার মনে কী হয় জানতোমার পাশবিক এবং ছিনিয়ে নেওয়ার শক্তি হয়তো আছে–নেই শুধু প্রকৃত উদারতা।

ভেরোনিকা আর বসে থাকতে পারে না, উঠে পড়ে। শান্তকণ্ঠে সে বলে ওঠে–আমাকে তুমি পনেরো বছর আগের ‘আমিতে’ ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আজকে আবার তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার এই কর্মের জন্য তুমি একদিন আপসোস করবে–দুঃখও পেতে পার, তবে তোমাকে আমি দুঃখ দিয়েই ছাড়ব, জন।

জন উঠে দরজার দিকে এগিয়ে চলে। সে বলে, আমি যদি তোমার অন্তরে ব্যথা দিয়ে থাকি তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত ভেরোনিকা। তুমি সত্যিই সুন্দর, তুমি আমার যথেষ্ট প্রিয়, তোমাকে আমি আরও একবার ভালোবাসতাম! তার বলা শেষ হলে জন ভেরোনিকাকে চুম্বন করে। ভেরোনিকার হাত ধরে মিনতির সুরে বলে ওঠে, মনে কিছু কোরো না লক্ষ্মীটি, আমরা কি আমাদের ভালোবাসাকে এই সীমা পর্যন্ত রেখে দিতে পারি না?

ভেরোনিকা–বিদায় জন, আমরা আমাদের ভালোবাসাকে ঠিক এই জায়গাতেই ছেড়ে দিচ্ছি না। একদিন ওটাকে তোমায় গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয়, এই জগতে আমি যদি সব থেকে কাউকে বেশি ঘৃণা করি সে তুমি–মানুষ বোধহয় কোনো মানুষকে এমন ঘৃণা করতে পারে না।

জন নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে। সে বলে, আমি দুঃখিত, বিদায় ভেরোনিকা।

বনের মধ্যে দিয়ে জন আবার ফিরে গেল। সুইমিং পুলের কাছে এসে সে একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল। ভেরোনিকার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তার জন্য সে মোটেই অনুতপ্ত নয়। সে আপন মনেই ভাবতে থাকে, পক্ষপাতশূন্য ভাবে বলতে গেলে ভেরোনিকা মোটেই ভালো স্বভাবের নয়। বরাবরই তার হাবভাবটা এইরকম। এখন তার মন তৃপ্ত এই ভেবে যে, ভেরোনিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে এসেছে, তার জীবনে এটাই বোধহয় সব থেকে ভালো কাজ যা সে করতে পেরেছে। সময় থাকতে থাকতে সে যদি সম্পর্ক ছেদ না করে তো, ভগবান জানেন অদৃষ্টে কি ঘটতো! তবে একটাই সুখ, অতীতের নাগপাশ থেকে এখন সে পুরোপুরি মুক্ত। তাই নতুন ভাবে। জীবন শুরু করার ব্যাপারে তার আর কোনো বাধা থাকতে পারে না। এখন সে মুক্ত বিহঙ্গ। কয়েকটা বছর তাকে কতই না দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। মনে কখনো শান্তি পায়নি। কিন্তু জাদা নিঃস্বার্থভাবে তাকে খুশী করতে, তার মনোরঞ্জন করার আশায়, কত না আপ্রাণ চেষ্টাই সে দিনের পর দিন করে চলেছে। জার্দার ব্যাপারে সে তাহলে আগের থেকে অনেক বেশি সদয় হবে।

হেনরিয়েটাকে সে আর নির্যাতন করবে না। শাসন করা যায় বলেই কি তাকে শাসন করা উচিত?-হেনরিয়েটা তো সেরকম স্বভাবের মেয়ে নয়। তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও নিশ্চল-নিথর হয়েই সে দাঁড়িয়ে থাকে, বিস্ফারিত নেত্রে সে একথাই ভাবতে থাকে।

জন ভাবে, আমি গিয়ে হেনরিয়েটার কাছে সব কথা খুলে বলব। হতচকিত হয়ে সে তাকাল, অপ্রত্যাশিত কোনো ছোট্ট শব্দে সে বিব্রত বোধ করল। বনের মধ্যে থেকে গুলির শব্দ কানে আসছিল, সেই সঙ্গে ছিল বনের স্বাভাবিক শব্দ, পাখির কাকলি, পাতা-ঝরার মৃদু ঝঝর শব্দ, বাতাসের শ-শন্ আওয়াজ। কিন্তু এই শব্দের আওয়াজটা ছিল অন্য ধরনের–ক্ষীণ প্রণালীবদ্ধ একটি টিকটিক ধ্বনি।

হঠাৎ করে বিপদের আশঙ্কায় জন সচকিত হয়ে ওঠে। কতক্ষণ সে এভাবে বসেছিল? আধঘণ্টা? কেউ হয়তো তাকে লক্ষ্য করেছে। কেউ হয়তো

আবার সেই প্রণালীবিদ্ধ টিকটিক্ আওয়াজহা, সেই শব্দ–কিন্তু সে কী করবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না, তাই সে দ্রুততার সঙ্গে কোনো ভূমিকা নিতে পারল না।

বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেল, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করার মতো শক্তি তার ছিল না।

গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত-পা এলিয়ে সুইমিং পুলের কিনারে এসে তার দেহ অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে রইল।

তার বুকের ঠিক বাম দিকের একটা কালো দাগ থেকে ধীরে ধীরে রক্ত নিঃসৃত হয়ে সুইমিং পুলের কংক্রিটের কিনারা থেকে বিন্দু বিন্দু করে নীল জলে এসে মিশতে লাগল।