দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ১৫

।। পনেরো।। 

হীরে! এক টুকরো হীরে হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। তার ওজন অনুভব করে একবার মনে হয় ওগুলো কাঁচের বোতলের ভাঙা টুকরো না তো? 

—ওগুলো যে হীরে তুমি ঠিক জান তো সুজন? 

—হ্যাঁ সোনা। অসমতল হীরে প্রায়ই আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখতে খুব সুন্দর। এসব হীরের পেছনে একটা ইতিহাস আছে— 

—আজ রাতে আমরা কর্নেলের কাছে যে ইতিহাস শুনলাম। কিন্তু এর সঙ্গে তার কোনো মিল থাকতে পারে না। তবে তিনি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই বলেছিলেন। 

—তার মানে তুমি বলতে চাইছ তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য? 

মাথা নেড়ে সায় দিলাম। হ্যাঁ ঠিক তাই। 

কিন্তু তারপর আমার কোনো একটা সন্দেহ থেকেই যায়। সেটা কি কেবল পরে ইউস্টেসের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য? নাকি আমার সুবিধের জন্যেই বলেছিলেন! যে কারণেই হোক কর্নেলকে কেমন যেন আমার সন্দেহজনক ব্যক্তি বলেই মনে হয়। কে জানে কোথা থেকে আসছে সে! আর সেই ঘটনার সঙ্গে তার কী-ই বা সম্পর্ক থাকতে পারে? 

আমি বললাম, কে এই কর্নেল রেস? 

সুজান বলল, সেটা একটা প্রশ্নের ব্যাপার। তিনি যে একজন বড় শিকারী সে তো আজ রাতে শুনলে। স্যার লরেন্স আর্ডসলের দূর সম্পর্কের ভাইপো তিনি। এই সমুদ্র-যাত্রার আগে তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। ওর আফ্রিকায় যাতায়াত আছে। হয়তো তিনি কোনো গোপন কাজকর্ম করে থাকেন। তবে তিনি একজন রহস্যময় পুরুষ। 

—আমার অনুমান স্যার লরেন্স আর্ডসলের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক, তাই না? 

—সোনা মেয়ে উনি নিশ্চয় তোমার জন্য পাগল। আমার দৃষ্টি অত্যন্ত সজাগ, তাছাড়া তোমাদের দু’জনকে চমৎকার মানাবে। 

—তুমি থাকতে ওর চোখে আমি কিছুই নয়। তোমার মতো বিবাহিতা মহিলা— 

—কী যে বল তুমি। আমার একটা পছন্দ বলে কথা আছে, আর তাছাড়া সবাই জানে আমি আমার স্বামী ক্লারেন্সের প্রতি কতটা অনুগত— 

—সত্যি ক্লারেন্স ভাগ্যবান বটে তোমাকে বিয়ে করে—। 

—ঠিক আছে, কর্নেল রেসকে আমি ভাগ্যবান হিসেবে দেখতে চাই। ক্লারেন্সকে টেলিগ্রাম করে কর্নেল সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করে নেব। তার আগে তোমাদের জুটির ব্যাপারটা পাকা করে ফেলতে হবে। সমুদ্র-যাত্রায় এভাবেই প্রত্যেকে প্রেমে আবদ্ধ হয়ে থাকে। 

—কিন্তু আমি যে বিয়ে করতে চাই না। 

—করতে চাও না? কিন্তু কেন? ক্লারেন্সকে তো আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছি। আমি দৃঢ়স্বরে বলি, আমি কী জানতে চাই জান? এ ব্যাপারে কর্নেল রেসের কী করার থাকতে পারে? এর সঙ্গে কোথায় যেন তার একটা যোগাযোগ আছে। 

—কেন, গল্প বলার মধ্যে তোমার মন জয় করার যে একটা প্রচেষ্টা থাকতে পারে তা কি তুমি মনে কর না? 

—না, আমি তা মনে করি না। সে আমাদের ওপর নজর রাখছে। মনে রেখো সবগুলো হীরের টুকরো এখানো উদ্ধার হয়নি। সম্ভবত এগুলো সেই হারিয়ে যাওয়া হীরে কিংবা হয়তো— 

—হয়তো কী? 

—অপর এক যুবকের সম্বন্ধে আমি আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে চাই। কী যেন নাম তার? লুকাস? 

—আমরা মনে হয় আলো খুঁজে পাচ্ছি। এইসব হীরের সন্ধানে বহুলোক হন্যে হচ্ছে। ব্রাউন রঙের স্যুট পরা লোকটাই নাদিনাকে খুন করে থাকবে এই হীরেগুলোকে নেবার জন্য। 

আমি বললাম। না, নাদিনাকে সে খুন করেনি। 

—হ্যাঁ, নিশ্চয় সে তাকে খুন করেছে। তাছাড়া অন্য আর কে-ই বা এ কাজ করতে পারে?

—তা জানি না। তবে আমি নিশ্চিত সে লোকটা তাকে খুন করেনি। 

—কিন্তু নাদিনা সেই বাড়িতে ঢোকার তিন মিনিট পরেই সেই লোকটা সেখানে প্রবেশ করে এবং যখন ফিরে আসে তার মুখটা সাদা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। 

—কারণ সে মেয়েটিকে মৃত অবস্থায় দেখেছিল বলে। 

—কিন্তু সে ছাড়া অন্য কাউকে তো বাড়িতে ঢুকতে দেখা যায়নি। 

—এমনও হতে পারে হয়তো খুনী সেই বাড়িতে লুকিয়ে থাকবে কিংবা অন্য পথ দিয়ে ঢুকে থাকবে। 

—বাদামী রঙের পোষাকের লোকটা তাহলে কে? যাই হোক, টিউব স্টেশনের সেই ডাক্তারের সঙ্গে তার চেহারার সাদৃশ্য ছিল। মনে হয় সে তার ছদ্মবেশ বদলে মার্লো পর্যন্ত মেয়েটিকে অনুসরণ করে থাকবে। সেখানে মেয়েটি ও কার্টনের দেখা করার কথা ছিল। তাদের দু’জনেরই বাড়িটা দেখার অনুমতি ছিল। কিন্তু তারা জানত না যে, কেউ তাদের অনুসরণ করছে। সেই একই ভাবে কার্টন জানত না যে তার সেই ছায়াটা তার অনুসরণকারী সেই বাদামী পোষাকের লোকটির, আর যখনই সে টের পেল তখন ভয়ে আঁতকে রেললাইনের ওপরে পড়ে যায়। তাই না অ্যানি। 

আমার উত্তর না পেয়ে সুজান আবার বলতে শুরু করল, হ্যাঁ ঠিক তাই। মৃত লোকটির কাছ থেকে সেই চিরকুটটা সে সংগ্রহ করে নেয় এবং তাড়াতাড়ির জন্য ভুলে সেটা সে ফেলে যায়। তারপর সেই মেয়েটিকে মার্লো পর্যন্ত সে অনুসরণ করে, মেয়েটিকে খুন করার পর সে গেল কোথায়? আমার আশঙ্কা স্যার ইউস্টেস পেডলারকে সে তার সেক্রেটারি হিসেবে এই জাহাজে উঠতে পরামর্শ দিয়ে থাকবে। ইংলন্ড থেকে বেরিয়ে আসার এই সুযোগ। আসল ব্যাপারটা চাপা দিয়ে অন্য লোকের পিছনে লোক লেলিয়ে দিয়ে শোরগোল তোলার এটাই তো আদর্শ জায়গা। কিন্তু কী করে মিঃ পেডলারকে রাজী করালো? মনে হয় ওর ওপর তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। 

আমি বললাম, কিংবা প্যাগটের ওপরে। 

—অ্যানি, মনে হয় তুমি প্যাগটকে পছন্দ কর না। কিন্তু মিঃ পেডলার কী বলেন জান? প্যাগটের মতো যোগ্য এবং কর্মক্ষম লোক না কি হয় না। আমাদের সন্দেহমতো সেই-ই দোষী। আমার ধারণা মতো রেবানই সেই বাদামী পোষাকের মানুষ। সেই চিরকুটটা তার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার আগে সে হয়তো পড়ে থাকবে সেটা। তাই এভাবে আগের দিন ভুল করে ২২ তারিখে ১৭ নম্বর কেবিন দখল নিতে চেয়েছিল। যাওয়ার পথে হয়তো কেউ তাকে ছুরিবিদ্ধ করে থাকবে। 

—কে সে? 

চিকেস্টার। হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক। লর্ড ন্যাসবিকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিও ব্রাউন রঙের স্যুট পরা লোকটাকে তুমি খুঁজে পেয়েছ এবং এতেই তোমার ভাগ্য ফিরে যাবে অ্যানি। 

—এমন অনেক জিনিস আছে যা তোমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। 

—কী সে সব? আমি জানি রেবার্নের দেহে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। তবে সেই ক্ষতচিহ্ন খুব সহজেই ঢেকে দেওয়া যায়। দেহের গঠন এবং উচ্চতায় সেই সঠিক লোক। তার মাথার বিবরণটা কী যেন? যার বর্ণনা দিয়ে তুমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলে? 

হঠাৎ আমার শরীরটা কেঁপে উঠল। ভালো শিক্ষা-দীক্ষা আছে সুজানের। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম, সে যেন নরবিদ্যায় প্রযুক্তি-বিষয়ক খুঁটিনাটি ব্যাপারটায় বেশি যেন ওয়াকিবহাল না হয়। 

—হ্যাঁ, লম্বা মাথার লোক সে, বুঝলে? মানে যার মাথা চওড়ায় তার দৈর্ঘ্যের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কম। 

—আর ঠিক বিপরীত যদি হয়? 

—মানে মাথাটা পঁচাত্তর ভাগেরও কম প্ৰস্থ থাকে? 

—হ্যাঁ, তাই ঠিক। আমি যা অনুমান করেছিলাম সেটাই তুমি বললে— 

—আমি বলেছি নাকি? না, না, ফসকে বেরিয়ে গেছে। 

আমার মুখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় সুজান। তারপর হেসে বলে, জিপসী মেয়ে, তুমি খুব সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারো। কিন্তু তুমি অসুবিধা দূর করার জন্য দয়া করে সব খুলে বলবে এখন? 

বলার কিছু নেই, এমন ভাব দেখালাম। 

—কেন, কিছুই বলার নেই? জিজ্ঞেস করল সুজান। 

তোমাকে আমার কিছু বলা দরকার, এই মুহূর্তে আমার সব জোর ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ল সুজানের সামনে, যে কথা আমি সযত্নে গোপন করে রেখেছিলাম এখন দেখছি সুজানের সান্নিধ্যে এসে কিছুতেই চেপে রাখা সম্ভব নয়। তাই আমার সব গোপনীয়তা প্রকাশ করে দিলাম, তাই আমি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নই। আমার মতো অবস্থায় পড়লে তুমিও লজ্জা পেতে না। তবু সে ঘৃণার কাজই করেছিল। তবু আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। চেন-বাঁধা কুকুরের মতো খারাপ ব্যবহার করলেই সে তোমাকে কামড়ে দেবে। এমনি বিশ্রী স্বভাবের লোক ছিল সে। তবু যে আমি তাকে কেন কামনা করি নিজেই জানি না। আমি তাকে ভালোবাসি, কেন জান? তাকে দেখামাত্র আমার জীবনের সবকিছু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। আমি ভালোবাসি, তাকে চাই। আফ্রিকায় আমি তাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এবং আমার জন্য তার যত্ন আমি নেব। তার জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। আমি তার জন্য কাজ করব, দাসীবৃত্তি করব, চুরি করব, এমনকি তার জন্য ভিক্ষা করব। তার প্রতি এমনি ভালোবাসা আমার। আশা করি তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছ। 

অনেক সময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে সুজান। তারপর সরব হল সে জিপসী মেয়ে, তুমি ইংরেজ মেয়েদের মতো নও। তোমার মতো দরদী মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। তোমার মতো এভাবে আমি দয়া দেখাতে পারব না। তবু, তোমার ওপর ভীষণ হিংসে হয় জিপসী মেয়ে। তার প্রতি তোমার যে প্রেম ভালোবাসা, এরকম খুব কম লোকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। সত্যি কথা বলবে জিপসী মেয়ে, সেই খুদে ডাক্তারের প্রতি তোমার এমন কী দয়া ছিল যে, তাকে তুমি বিয়ে করলে না? যাই হোক, তুমি বলছ, লর্ড ন্যাসবিকে টেলিগ্রাম পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই? 

আমি সায় দিলাম। 

—আর তুমি বিশ্বাস কর, নির্দোষ সে? 

—এও আমি বিশ্বাস করি, নির্দোষ লোকই ফাঁসিকাঠে ঝুলে থাকে। 

—হুঁ, কিন্তু সোনামণি অ্যানি। তুমি এখনও বাস্তবের মুখোমুখি হতে পারো, তুমি যা বললে তা সত্ত্বেও সেই মেয়েটিকে সে হয়তো খুন করে থাকতে পারে। 

—না, সে খুন করেনি। 

—সেটা তোমার অনুভূতির ব্যাপার। 

—না, তা নয়। হয়তো সে খুন করার মনোভাব নিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করে থাকবে। কিন্তু তার গলায় ফাঁস লাগানোর জন্য কালো দড়ি নিয়ে সে কখনোই যেতে পারে না। তা যদি তার করার ইচ্ছা থাকত, সে নিশ্চয়ই হাত দিয়ে মেয়েটির গলা টিপত। 

মদু হেসে সুজান বলে, হ্যাঁ অ্যানি। এখন বুঝছি কেন তুমি তোমার প্রতি এই যুবকটির এত আকর্ষণ বোধ কর। 

।। ষোল।। 

সৌভাগ্যবশত পরদিন সকালেই কর্নেল রেসের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। দু’জনে কিছুক্ষণ ডেকের ওপর বেরিয়ে একসময় নেমে এলাম। 

—আজকের সকালটা কেমন লাগছে জিপসী মেয়ে? ইচ্ছে হচ্ছে মাটিতে নামার, তাই না?

মাথা নেড়ে বললাম, সমুদ্রের ব্যবহার এখন খুব সুন্দর, মনে হচ্ছে চিরদিনের জন্য এখানে থেকে যাই। 

—আশ্চর্য! কী তোমার উৎসাহ? 

—কেন, আজকের সকালটা কি সত্যি সুন্দর নয়? 

আমরা সমুদ্রের দিকে তাকালাম। শান্ত উজ্জ্বল, যেন কেউ তেল ছড়িয়ে দিয়েছে, এখন অনেক রঙ সমুদ্রের, কোথাও নীল, ফিকে সবুজ, রক্তবর্ণ, গাঢ় কমলা রঙ, যেন বহু রেখাচিত্রে আঁকা জ্যামিতিক ছবি। মাঝে মাঝে রুপোলি মাছের আস্ফালন। আদ্রতায় ভরা উষ্ণ আবহাওয়া, বাতাসে মিষ্টি প্রসাধনের ঘ্রাণ। 

নীরবতা ভেঙে বললাম, গতকাল রাত্রে যে কাহিনী তুমি আমাদের শুনিয়েছিলে ভারি চমৎকার।

—কোন্ কাহিনী? 

—হীরের কাহিনী। হ্যাঁ, ভালোকথা সেই যুবকটির ভাগ্যে কী ঘটল তারপর? তুমি বলেছিলে হীরে চুরির দলের দু’জনের একজন সে। 

—হ্যাঁ, লুকাস তার নাম। আর-একজনকে না পেয়ে তারা তাকে অভিযুক্ত করতে পারেনি। তাই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। 

—তারপর তার জীবনে কী ঘটল? কেউ কি তার হদিশ জানে? 

কর্নেল রেস এ-কথায় সমুদ্রের দিকে তাকাল। তার মুখের রঙ কেমন যেন বদলে গেল। মানে আমার প্রশ্নটা তার মনঃপূত হয়নি। 

—যুদ্ধে সে খুব সাহসের সঙ্গে লড়াই করে। খবর আছে সে নাকি নিখোঁজ এবং সাংঘাতিক ভাবে আহত—কিন্তু আমার ধারণা সে মৃত 

এই উত্তরটাই আমি চাইছিলাম। মনে হল কর্নেল বেশ আরো কিছু জানে। তার ভূমিকা যেন আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছিল। সেই রাতেই স্টুয়ার্ডসের সঙ্গে দেখা করলাম। 

কথার ছলে আমি তার কাছ থেকে সব খবরই সংগ্রহ করে নিলাম, জাহাজে কেপটাউন থেকে ইংল্যান্ড পাড়ি দেবার সময় একজন যাত্রী একটা ফিল্মের রোল তার হাতে তুলে দেয় এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ২২শে জানুয়ারি রাত একটায় সেটা ৭১ নম্বর কেবিনের বাঙ্কে ফেলে আসতে হবে। একজন মহিলা সেই কেবিনটা দখল করে থাকবে এবং তাকে বলা হয়েছিল এ কাজের জন্য সে নাকি বাজি ধরেছে। আর এর জন স্টুয়ার্ডকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেই মহিলার নাম তার কাছে প্রকাশ করা হয়নি। অবলা মিসেস ব্লেয়ার সেই ৭১ নম্বর কেবিনের দখল নিতে গেলে স্টুয়ার্ডের একবারও খেয়াল হয়নি যে, তিনি সেই ঈপ্সিত মহিলা নন। 

কার্টুনের নামে সেই কেবিনটা সংরক্ষণ করা হয়। টিউব স্টেশনের লোকটার সঙ্গে কার্টনের চেহারার হুবহু মিল আছে। 

অতএব এর থেকে একটা রহস্যের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সেই হীরেগুলোই হচ্ছে আসল চাবিকাঠি। 

কিলমার্ডেন জাহাজের শেষের দিনগুলি খুব দ্রুত কাটতে থাকে। কেপটাউনের দিকে যত এগোতে থাকি, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ততই যেন দানা বাঁধতে থাকে। মিঃ চিকেস্টার, স্যার ইউস্টেস এবং তার সেক্রেটারি, কর্নেল রেস, এদের পরে আমি নজর রাখতে চাই। প্রথমেই চিকেস্টারের ওপরে আমার সন্দেহ হয়। সঙ্গে সঙ্গে স্যার ইউস্টেস ও তার সেক্রেটারির নাম সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিই। 

তবে ফ্লোরেন্সের নাম শুনে মিঃ প্যাগটের ভাবান্তর ঘটার কথা আমি ভুলিনি। শেষের দিন আমদ্দা সবাই ডেকের ওপর বসে আছি। ইটালির রেলওয়েতে ট্রেনের বিলম্ব হওয়ার প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করা মাত্র প্যাগট আগের মতো অস্বস্তি বোধ করল। তারপর মিসেস ব্লেয়ারকে স্যার ইউস্টেস নাচের জন্য আহ্বান করতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে প্যাগটের পাশে গিয়ে বললাম ব্যাপারটা সম্পূর্ণ করে জানার জন্য। 

—ইটালিতে যাওয়ার আমার খুব ইচ্ছে, বিশেষ করে ফ্লোরেন্সে। তা আপনি কি সেখানে খুব বেশি উপভোগ করতে পারেননি? 

—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করেছিলাম বৈকি। কিন্তু এখন আমাকে মাফ করবেন। স্যার ইউস্টেসকে জরুরী চিঠিগুলো দেখাতে হবে- 

তার হাতটা চেপে ধরে বলি, দয়া করে আপনি এখান থেকে যাবেন না। আমি জানি, স্যার ইউস্টেস চাইবেন না। আমি লক্ষ্য করেছি, ফ্লোরেন্সের কথা উঠলেই আপনি এড়িয়ে যান। আমার ধারণা, আপনার মধ্যে হয়তো একটা কোনো গোপন অপরাধ আছে। 

হঠাৎ তার হাতটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। না না, সেরকম কিছুই নয় মিস বেডিংফিল্ড, তার কথায় আন্তরিকতা। এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলতে পারলে আমি খুশী হতাম। কিন্তু সত্যি কতগুলো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। তাই আমাকে— 

—ওহো মিঃ প্যাগট, দয়া করে আপনি এড়িয়ে যাওয়ার ভান করবেন না। আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না। মিঃ পেডলারকে আমিই না হয় বলে দেব- 

আমি আর কথা বাড়ালাম না। গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়ল, তার মুখে আতঙ্কের ছায়া।

—বেশ, আপনি কি জানতে চান বলুন? 

—আমি চাই ইটালিয়দের সম্বন্ধে আপনি কিছু বলুন। 

—দুঃখের বিষয় তাদের সম্বন্ধে তেমন কিছুই বলার নেই—দু-একজন পোর্টার আর গাইড ছাড়া বলার কিছুই নেই। 

আমার প্রথম অভিনয় সফল। প্যাগট যে ইটালি কিংবা ফ্লোরেন্স কোথাও যায়নি সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারি। তাহলে সেই সময়ে সে কোথায় ছিল? ইংলন্ডে? বিশেষ করে মিল হাউসের সেই রহস্যময় খুনের সময়? সব থেকে আশ্চর্য কি জানেন। কয়েকদিন আগে আমি আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি। আমি বোধ হয় ভুল করছি—কারণ আপনি তো তখন ফ্লোরেন্সে ছিলেন। তবু— 

তাকে আড়চোখে লক্ষ্য করলাম, তার সন্ধানী দৃষ্টি তখন জ্বলজ্বল করছিল। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়, কোথায় আপনি দেখেছেন আমাকে বলুন তো? 

—মার্লোয়, বুঝলেন মার্লোয়। সত্যি আমি কি বোকা, মিঃ পেডলারের বাড়ি রয়েছে সেখানে।

কিন্তু আমার শিকার একটা মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল।

সেই রাত্রেই উত্তেজিত হয়ে আমি সুজানের কেবিনে হানা দিই। 

—দেখ সুজান, আমার কাহিনী শেষ করে বলি। খুন হওয়ার সময় সে ইংলন্ডের মার্লোয় ছিল। তুমি কি এখনো নিশ্চিত যে বাদামী পোষাকের লোকটিই অপরাধী! 

—তুমি একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিষ আবিষ্কার করেছ। খানিক আগে পর্যন্ত জানতাম মিঃ প্যাগটের একটা অ্যালিবি আছে। কিন্তু এখন জানলাম সেটা ভুল। 

—হ্যাঁ, ঠিক তাই, তার ওপর আমাদের কড়া নজর রাখতে হবে। 

—শুধু তার ওপর নয়। সবার ওপরেই নজর রাখতে হবে, অ্যানি। এখন থেকে তুমি ও আমি অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু বা পার্টনার। নতুন কাজ শুরু করার জন্য আমার খরচায় তুমি আমার সঙ্গে মাউন্ট নেলসন হোটেলে গিয়ে উঠবে, তারপর সেখানে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা করব। কেমন? 

আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সুজানের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। 

একটা বড় হাই তুলে সুজান উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তাহলে অবশেষে ঐ কথা রইল। এবার আমাদের নিজের কথাতেই আসা যাক কি বল? মিঃ চিকেস্টার ডার্বানে যাচ্ছে। স্যার ইউস্টেস উঠছেন কেপটাউনের মাউন্ট নেলসন হোটেলে। সেখান থেকে উনি রোডেসিয়ায় যাবেন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে। সেদিন রাত্রে চতুর্থ গ্লাস শ্যাম্পেন পেটে পড়ার পর হয়তো নেশার ঝোঁকে তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে সহযাত্রিণী হতে বলেছিলেন। আমি সেই সুযোগটাই নিতে চাই। 

খুব ভালো কথা। স্যার ইউস্টেস ও প্যাগটের ওপর তুমি নজর রাখো। আর আমি চিকেস্টারের ভার নিচ্ছি। কিন্তু কর্নেল রেসের ব্যাপার কি হবে। অবাক হয়ে সুজন বলে, কর্নেল রেসকে সম্ভবত সন্দেহ করতে পার না অ্যানি- 

—হ্যাঁ, আমি সবাইকে সন্দেহ করি। আমি কোনো ফাঁক রাখতে চাই না। 

—ঠিক আছে কর্নেল রেসও রোডেসিয়ায় যাচ্ছেন। চিন্তা করে বললে সুজান। স্যার ইউস্টেসকে রাজী করিয়ে তাঁকে যদি সঙ্গে নিতে পারি— 

—তা তুমি পার। সবকিছুই ব্যবস্থা তুমি করতে পার।— 

সুজান হাসল, তোষামোদ আমার খুব পছন্দ। 

নিশ্চিন্ত হয়ে তখনকার মতো সুজনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমারও তখন খুব ঘুম পাচ্ছে। অবশ্যই শেষ রজনী। পরদিন সকালে আমরা টেবল বেয়তে পৌঁছাচ্ছি। জাহাজের শেষ রাতটা উপভোগ করার জন্য ডেকে এসে দাঁড়ালাম। 

অন্ধকার জনহীন ডেক। তখন মধ্যরাত্রি পেরিয়ে এসেছি। রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে অন্ধকার সমুদ্রের জল কেটে আমরা আফ্রিকার দিকে এগিয়ে চলেছি। চমৎকার এই পৃথিবীর শোভা আমি একা উপভোগ করতে চাইলাম। এমন সময় আমার কাছে কোনো একটা ব্যাপার নয়। বুঝি আমি স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছিলাম। 

হঠাৎ একটা বিপদের সংকেত পেলাম, কি মনে করে চকিতে পিছন ফিরে তাকাই। একটা ছায়ামূর্তি আমার পিছনের জমিটা দখল করে নিয়েছিল। পিছন ফিরে তাকাতেই সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি বোধহয় চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম, তাই সে একহাত দিয়ে আমার গলাটা চেপে ধরল। আমার তখন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাঁচার কোনো পথ না দেখতে পেয়ে মরীয়া হয়ে কোনোরকমে ঘাড়টা এক দিকে একটু কাত করে যে হাত দিয়ে আমার গলা টিপে ধরেছিল সেটা সজোরে কামড়ে দিতেই লোকটা অস্ফুট চিৎকার করে আমাকে ছেড়ে দিল। সফল না হতে পারলে আমি বেশ বুঝতে পারছি সে আমাকে অনায়াসে সমুদ্রের গভীর জলে ফেলে দিতে পারত। আমার বাকি ভবিষ্যতের ভার হাঙরের ওপর দিয়ে হয়তো নিশ্চিত হতে পারত। 

আক্রমণকারী নিঃশব্দে পালাবার চেষ্টা করতেই আর একটা ছায়ামূর্তি সেখানে অনুভব করলাম। তার একটা ঘুষির আঘাতে আক্রমণকারী ডেকের ওপর ছিটকে পড়ল। তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ামাত্র আমি ডেকের রেলিং-এর ওপরে আছড়ে পড়লাম। অসুস্থ শরীরটা আমার তখন কাঁপতে থাকে। 

আমার উদ্ধারকারী বলল, আপনি কি আহত? 

তার কণ্ঠস্বর শোনার আগেই আমি তাকে চিনতে পেরেছিলাম। আমার সেই লোক— যার দেহে ক্ষতচিহ্ন আছে। 

ইতিমধ্যে আমার আততায়ী উঠে দাঁড়াতেই রেবার্ন তার দিকে ছুটে গেল। বোধ হয় মারধর করবার জন্য। আমি এসব পছন্দ করি না বলে তার পেছন পেছন ছুটে গেলাম। রেবার্ন তখন তার ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল। 

—আপনি কি আবার ওকে মারলেন? 

—না, তার দরকার হয়নি। তার আগেই সে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এখন দেখতে হবে লোকটা কে? 

কাঁপা কাঁপা পায়ে লোকটার কাছে এগিয়ে গেলেন। আন্দাজে অন্ধকারে বুঝলাম আমার আক্রমণকারী চিকেস্টারের থেকেও সাহসী ও বেপরোয়া। এসব ব্যাপারে চিকেস্টার সাধারণত ছুরি জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে, সামান্য একটু আঘাতেই সে তৃপ্ত হয়। 

রেবার্ন দেশলাই জ্বালে। সেই আলোতে আমরা দু’জনেই চমকে উঠলাম। লোকটা প্যাগট।

হতবাক রেবার্ন অস্ফুট স্বরে বলে, প্যাগট, হায় ঈশ্বর। 

—আপনি দেখছি অবাক হয়েছেন? 

—হবারই তো কথা। আমি যে কখনো সন্দেহই করিনি-আপনি-আপনি হননি? আমার ধারণা, লোকটা আক্রমণ করার সময়েই আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন? 

— না, পারিনি, কিন্তু আপনার মতো আশ্চর্য হইনি। 

সে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে, আপনি যে কোত্থেকে আসছেন জানি না। এ ব্যাপারে আপনি কতটুকুই বা জানেন, তাও জানি না। 

হেসে বললাম, বেশ ভালো রকমই জানি— মিঃ লুকাস। 

তখন সে অসহায় ভাবে আমার হাতটা চেপে ধরে, এ নাম আপনি জানলেন কী করে?

—কেন, এ নাম কি আপনার নয়, আপনি কি নিজে বাদামী পোষাকের সেই লোকটি হিসেবে পরিচিত হতে চান? 

তারপর হাতের বন্ধন ছিন্ন করে দু’পা পিছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মেয়ে না ডাইনি?

—আমি তোমার বন্ধু, মনে আছে তোমার; একবার আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম, আবার সাহায্য করতে চাই। নেবে আমার সাহায্য? 

—না, তোমার সঙ্গে কেন, কোনো মেয়ের সঙ্গেই আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না।

তার এই অহেতুক ভয় দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, হয়তো তুমি বুঝতে পারছ না, আমার কি ক্ষমতা। আমার ওপর তোমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এখুনি যদি আমি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে তোমার সব কথা বলে দিই- 

সে খিঁচিয়ে উঠল, বলেই দেখো না। আমার দিকে এগিয়ে—খুকুমণি, তুমিও হয়তো জান না এই মুহূর্তে আমার কি ক্ষমতা। ইচ্ছে করলে তোমার গলা টিপে—সত্যি সত্যি সে তার দু’হাত বাড়িয়ে আমার গলা টিপে ধরে—এইভাবে তোমাকে খুন করে জলে ভাসিয়ে দেব। হিংস্র হাঙরে তোমার দেহটা গিলে ফেললে কেউ টের পাবে না তোমার অস্তিত্ব, বুঝলে খুকুমণি। বলো, একটু আগে তুমি কি যেন বলছিলে? 

কেবল হাসলাম। আমি জানি, তার কাছ থেকে সত্যিকারের বিপদ তখনো কাটেনি। এই মুহূর্তে সে আমাকে ঘৃণা করে তবু আমি, যে-কোনো বিপদকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় তার হাত দুটো আবার আমার কণ্ঠনালীতে বসলো। একসময় আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে, কী নাম তোমার? 

—অ্যানি বেডিংফিল্ড। 

—তোমার কি কোনো কিছুতেই ভয় নেই অ্যানি? 

শান্ত মেজাজে বললাম, ও হ্যাঁ, ভীমরুল, যে সব মহিলারা সবসময় ব্যঙ্গ করে কথা বলে, বয়স্ক লোক, আরশোলা এবং সহকারী দোকানী। এদেরকে আমার ভীষণ ভয়। 

সে হেসে প্যাগটের দিকে তাকিয়ে, এই শয়তানটাকে নিয়ে কি করা যায় বলো তো! সমুদ্রে ফেলে দেব! 

—তোমার যদি তাই মনে হয় তো করো! 

—তোমার আন্তরিকতার প্রশংসা না করে পারছি না বেডিংফিল্ড। না, ওকে জ্ঞান ফিরে পেতে সুযোগ দেওয়া উচিত, ঐভাবে ও কিছুক্ষণ থাক। আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়। 

শান্ত গলায় বললাম, তাহলে দেখছি, দ্বিতীয় খুন থেকে তুমি সরে দাঁড়ালে। 

—দ্বিতীয় খুন, তার মানে? 

—মার্লোর সেই মেয়েটি, বলে তার মনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম তার মুখটা কেমন যেন বিকৃত মনে হল। আমার উপস্থিতির কথা সে ভুলেই গেল। হয়তো আমি তাকে খুন করে থাকবো—অকপটে স্বীকার করল। কখনো কখনো বিশ্বাস করি তাকে আমি খুন করব বলে মনে করেছিলাম— 

তবে কি সে সেই মেয়েটিকে ভালোবাসত? হ্যাঁ, অবশ্যই সে ভালোবাসত। তা না হলে সে মেয়েটিকে খুন করার কথা চিন্তাই করতে পারে না। 

কোনোরকমে নিজেকে সংযত রেখে বললাম, আমরা সবকিছুই তো বললাম। কেবল শুভরাত্রি জানানো ছাড়া 

— শুভরাত্রি, বিদায় মিস বেডিংফিল্ড। 

—এই দেখা শেষ দেখা নয়- 

—কেন, তুমি এ কথা বললে কেন? 

—কারণ তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা করার ইচ্ছে আছে। 

—আমি না চাইলে তা কি করে সম্ভব? 

সাহস করে বললাম, আশা করি আমরা দু’জনে দেখা করার চেষ্টা করব। 

—কেন? 

আমি মাথা নাড়লাম, মনের কথাটা ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। 

সে কেমন উত্তেজিত হয় বলল, কিন্তু কখনোই তোমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আমার হবে না। আমি মিষ্টি করে হেসে অন্ধকার পথে পা বাড়ালাম। আমার পিছন পিছন তার পায়ের শব্দটা আসতে আসতে থেমে গেল। তার একটা কথা এখন ডেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যেন। মনে হয় সেটা ‘ডাইনি’। 

।। সতেরো।। 

(স্যার ইউস্টেস পেডলারের দিনলিপির সারাংশ, মাউন্ট নেলসন হোটেল কেপটাউন)

আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম কিলমার্ডেন জাহাজ থেকে নেমে। সেখানে আমাকে ঘিরে সবসময় একটা বিরাট ষড়যন্ত্র চলছিল। সে সব চাপা দেওয়ার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ছিল প্যাগটকে মদ খাইয়ে মাতাল করে রাখা। সমস্ত ব্যাপারটাই একটা রহস্যের মধ্যে যেন ঢেকে রাখতে চায়। যেমন আজ সে এমন একজন সন্দেহজনক লোককে আমার কেবিনের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল, তার মনে সে সব কাহিনী না কি একমাত্র জার্মান গুপ্তচর কাহিনীতেই দেখতে পাওয়া যায়। 

যাই হোক, আমি তাকে বোঝালাম। সেই মানসিক ভারসাম্য হারানো লোকটার তো তোমার ওপর আক্রমণের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি না। 

প্যাগট শান্ত হয়েছিল। সে বলল স্যার ইউস্টেস, আমি হলফ করে বলতে পারি, নিশ্চয়ই কোনো কিছুর সন্ধানে সে আপনার কেবিনের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। ঐ পথে দুটি কেবিন মাত্র। একটি আপনার অন্যটি কর্নেল রেসের। 

রেস তোমার কোনো সাহায্য না নিয়েই সে নিজের দিকে নজর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তার জন্য চিন্তা করতে হবে না প্যাগট। 

—স্যার ইউস্টেস, আমার ধারণা সেই লোকটা অবশ্যই রেবার্ন, মনে হয় কর্নেল রেসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল, গোপন ষড়যন্ত্র- 

—আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা কোরো না প্যাগট, অবাস্তব তোমার ধারণা। তারা যদি কোনো গোপন আলোচনা করতে চাইবে দিনের বেলায় কফির টেবিলেই সারতো। ওভাবে রাতের অন্ধকারে চোরের মতো তা করতে যাবে কেন? 

—স্যার ইউস্টেস, আপনি জানেন না, গতকাল রাতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছিল। তা না হলে কেনই বা রেবার্ন আমাকে অমন বিশ্রীভাবে অপমান করতে যাবে বলুন? 

এ কথা ঠিক যে জাহাজ থেকে নামার পর তার সঙ্গে আর আমাদের দেখা হয়নি। একবারের জন্যও সে হোটেলে আসেনি, তাই মনে হয় প্যাগটকে তার এমন ভয়। আমার একজন সেক্রেটারি; নীল সমুদ্রে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আর একজন পাগলের প্রলাপ বকতে ব্যস্ত। এ অবস্থায় প্যাগটকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও গেলে কেপটাউনের লোকদের কাছে আমি হাসির খোরাক হয়ে যাব। তাই ঠিক করলাম, এখানকার প্রধানমন্ত্রীকে মিলরের চিঠি পৌঁছে দিতে প্যাগটকে সঙ্গে নেব না। 

পরে একটা ভয়ঙ্কর বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল। মিলরের শীলমোহর করা খামটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে গেলাম কথামতো। দেখা গেল সেই খামের মধ্যে একটা সাদা কাগজের টুকরো ছাড়া কিছু নেই। আশ্চর্য, মিলর কেন যে এরকম একটা বিশ্রী ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলল আমায়? 

আমার সেই দুরবস্থা দেখে প্যাগট নিজে হামবড়া ভাব দেখাবার সুযোগ পেয়ে গেল। 

—মনে করুন স্যার ইউস্টেস, রাস্তায় মিঃ মিলরের সঙ্গে আপনার আলোচনা করার সময় দু-একটা কথা সে আড়ি পেতে শুনে থাকবে। মনে রাখবেন, মিঃ মিলরের কাছ থেকে কোনো লিখিত অনুমতি পত্র আপনি পাননি। রেবার্নকে আপনি তার নিজস্ব গুণের জন্য গ্রহণ করেছিলেন। 

—তাহলে তোমার কি মনে হয় রেবার্ন এক ষড়যন্ত্রকারী। 

প্যাগট মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার মতামত হল এব্যাপারে কোনো গুরুত্ব না দেওয়া নিজেকে যে বোকা বানাবার চেষ্টা করে, তার কথায় কান না দেওয়াই ভালো। তবে লোকটা করিৎকর্মা বটে। পুলিসে খবর দেওয়া, মিলরকে টেলিগ্রাম করা। মুহূর্তে সব সেরে ফেলল। সেই দিন সন্ধ্যায় মিলরের জবাব পাওয়া গেল। আমার নিহত সেক্রেটারির ব্যাপার সে কিছুই জানে না। এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে একটা সুখকর খবরের কথা মনে করে আমি প্যাগটকে বললাম, তোমার ওপর তো বিষ প্রয়োগ করা হয়নি। সাধারণ পৈত্রিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলে তুমি। কি বলো? 

তার মুখে হঠাৎ কেমন একটা সংকোচের ভাব লক্ষ্য করলাম। এটাই আমার একমাত্র জয়।

প্যাগট এখন তার নিজের ধান্দায় আছে। সে তার নিজের ধ্যান-ধারণায় বিভোর। তার অনুমান, সেই বাদামী পোষাকের লোকটাই রেবার্ন। হয়তো তার অনুমান মিথ্যে নয়। কিন্তু তাকে রোডেসিয়ায় সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। হাজার হোক আমি লোকসভার ইংরেজ সদস্য, আমার আলাদা মর্যাদা আছে। ওর মতো ঝগড়া করা লোককে আমার সেক্রেটারি হিসাবে নিয়ে গেলে আমার মান-মর্যাদা থাকে কোথায়? তাই রোডেসিয়ায় থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিলাম। ওকে বললাম, যে-কোনো মুহূর্তে রেবার্নকে সনাক্তকরণের জন্য তোমার হয়তো ডাক পড়তে পারে। 

প্যাগটের কপালে চিন্তার রেখা পড়তে দেখা যায়। 

—আপনার চিঠিপত্র, বক্তৃতা কে লিখবে স্যার ইউস্টেস?

—এ নিয়ে ভাবতে হবে না, আশাকরি মানিয়ে নিতে পারব। 

—আগামীকাল এগারোটায় আপনার গাড়িটা ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সব ব্যবস্থা আমি পাকা করে রেখেছি। সে যাই হোক, এখন কাজের কথায় আশা যাক। মিসেস ব্লেয়ার কি তাঁর পরিচারিকা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন? 

—মিসেস ব্লেয়ার? এবার সত্যিই অবাক হলাম। 

—শুনেছি, আপনি তাকে গাড়িতে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন! কথাটা কি সত্য?

—হয়তো মদের নেশায় বলে থাকব। হয়তো, তাই উনি আমার সঙ্গে রোডেসিয়ায় যাবেন নাকি? পথে নারী বিবর্জিতা, প্রবাদ আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আর কাউকে কথা দিয়েছি?

—মিসেস ব্লেয়ারের ধারণা, কর্নেল রেসকেও আপনার সহযাত্রী হতে আহ্বান করেছেন।

চমকে উঠলাম! সেকি। রেসকে যদি আহ্বান করে থাকি, তা হলে নেশার ঝোঁকে। কারণ খাতির করা আমার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি এখনো পর্যন্ত। রেগে বললাম, প্যাগট, তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করো? বন্ধ করবে তোমার ঐ চোখের দৃষ্টি আমার ওপর ফেলা? 

প্যাগটকে যত ধমকাই-না-কেন, এটা যে, মিস বেডিংফিল্ডকে আমি রোডেসিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কথা দিয়েছি। ওকে সাময়িক সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করার কথাও আমি ভাবছি। ও বলেছে, ভালো টাইপ জানে। 

ওর কথা বলতেই প্যাগট আমার প্রস্তাবের বিরোধিতা করল। সে মোটেই পছন্দ করে না। সেই রাতে অপ্রীতিকর অ্যানির প্রসঙ্গ উঠলেই বিরক্তি প্রকাশ করত সে। আজকাল প্যাগট রহস্যময় পুরুষ হয়ে উঠছে। 

রাগাবার জন্য আমি মিস বেডিংফিল্ডকে প্রস্তাবটা দেব। আগেও বলেছি, এখনো বলছি, অ্যানির সুডৌল পা দুটো ভারী চমৎকার। 

(অ্যানির কাহিনী আবার শুরু হল) 

।। আঠারো।। 

যতদিন বেঁচে থাকি কোনোদিনও টেবল মাউন্টেনের কথা ভুলতে পারব না। সবেমাত্র টেবল বেয়-তে আমাদের জাহাজ প্রবেশ করেছিল। দূর থেকে টেবল মাউন্টেনের চারপাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ঢেকে থাকতে দেখলাম। নিচে সমুদ্রের নীল জলরাশি, দূরে মেঘের ফাঁকে উঁকি মারা সূর্যের আলো। আমি সাহিত্যিক নই, আমার ভাষা নেই ভালো করে প্রবেশ . করার সেই মনোরম দৃশ্যের বর্ণনা লিটল হ্যাম্পস্নে ছেড়ে আসার পর থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়েছিলাম। আমার সেই ইচ্ছেটা বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। স্বভাবতই মনটা এক রোমাঞ্চে ভরে উঠল যেন। 

এ যেন একটা স্বপ্ন, আমার জাহাজটা স্বপ্নের দেশে স্পর্শ করতে চলেছে! 

এই হল দক্ষিণ আফ্রিকা, নিজের মনেই গুনগুনিয়ে ওঠে গানের কলির মতো, দক্ষিণ আফ্রিকা। অ্যানি বেডিংফিল্ড, এটাই তোমার স্বপ্নের পৃথিবী, এতদিন যে পৃথিবী নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করতে চাইছিলে, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা— 

এমন দৃশ্য একা কারই বা ভালো লাগে? এখন রেবার্নকে এই ডেকে দেখতে পেতাম, তাকে বিরক্ত বা উপস্থিতির কথা প্রকাশ করতে যেতাম না। 

—মিস বেডিংফিল্ড। গতকাল তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। তুমি ক্ষমা করবে না? 

নিঃশব্দে একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। গভীর আবেগে সে আমার হাতটা স্পর্শ করল। তার হাত আমার মুঠোয় অসম্ভব কাঁপছিল। 

—তোমাকে কিছু বলতে চাই আমি, মিস বেডিংফিল্ড, তুমি জান না, কি বিপজ্জনক জালে জড়িয়ে যাচ্ছ। 

—জানি আমি অনেক কিছুই, আমি বললাম, বুঝলে? 

—তাই তোমাকে সতর্ক করে দিতে চাই। অন্যের ব্যাপারে মাথা গলাতে যেও না, অনেক বিপদ ও ঝুঁকি আছে। না, রাগ কোরো না, আরও আছে, শোনো এরা কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর। তুমি বিপজ্জনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছ—গতকালের কথা ভাবো-না। তাদের ধারণা, তুমি জান। এখন কাজ তাদের বোঝানো, তাদের ধারণা ভুল, সব সাবধান, যে-কোনো মুহূর্তে তুমি শিকার হয়ে যেতে পার। তাই বলি চোখ-কান খুলে এগিও। 

—তুমি আমাকে সাবধান করতে এলে কেন? 

—হয়তো এটাই আমার শেষ উপকার করা। একবার সমুদ্রের তীরে পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই আমার, ভয় হয় আমি আর পৌঁছতে পারব না। 

—কেন? বলে উঠলাম আমি। 

—দেখ, আমি, যে বাদামী পোষাকের সেই লোকটা এ কথা তুমিই কেবল জান না, আমার ধারণা, এই জাহাজের অন্য আর-একজন লোকও জানে। 

—তোমার সন্দেহ, আমি তাকে বলেছি? 

—না, তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। যাইহোক, সেই লোকটা আমাকে খেলাতে চায়। কিন্তু আমি জানি, যে মুহূর্তে পুলিসে ধরা পড়ব, তার কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। হয়তো আমি মুক্তি পেয়ে যাব, মাত্র ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার। 

শুনছিলাম তার কথা। নিজেই আবার বলে, আমাদের আবার দেখা হবে। 

তার কথা ধরে বললাম, আমারও তাই ধারণা। 

—অতএব—বিদায়। 

বিদায়। 

সে হঠাৎ হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর চকিতে ঘুরে আমাকে ছেড়ে চলে গেল সে। কেন জানি না তার পায়ের শব্দ আমি বেশ শুনতে পাই সব সময়, সব যেন একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে আমার জীবন থেকে। 

ইতিমধ্যে সমুদ্রতীরে জাহাজ ভিড়ল এক সময়। তখন আমার আশঙ্কা, এই বুঝি সে ধরা পড়ল। কিন্তু কী সৌভাগ্য সে গ্রেপ্তার হল না। এই মুহূর্তটা এক স্বর্গীয় সুখের। 

এই রাতটা হোটেলে কাটাতে হবে আমাকে সুজানের সঙ্গে। তাই ট্যাক্সি ডেকে আমরা মাউন্ট মেলসনে চলে গেলাম। 

এখানকার আলো, বাতাস, ফুলের সুবাস, যেন স্বর্গীয় জিনিস বলে মনে হয়। ইংলন্ডের বাইরে এমন সুন্দর লাগবে ভাবতে পারিনি। তবে সুজানের উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম না। অবশ্য প্রাতঃরাশের আগে প্রাণ খুলে হাসতে দেখা যায় না কখনও 

পরে দোতলাতে দেখা গেল। সুজানের ঘরের পাশেই আমাকে ঘর দেওয়া হয়েছিল।

সুজানের সাথে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম, স্যার ইউস্টেসকে দেখেছ তুমি? প্রাতরাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। মাছটা একটু পচা ছিল, তারপর দেখা নেই। কি ব্যাপার বলো তো? 

সুজান হাসল! সকালে ওঠা পছন্দ নয় স্যার ইউস্টেসের। কিন্তু অ্যানি, মিঃ প্যাগটকে তুমি দেখেছ? তাকে ধরতে পারিনি। তার চোখ দুটো ঘোলাটে, কৃষ্ণবর্ণ। সে কী করছে? 

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালাম। তার কেবল চিন্তা আমাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া।

সুজান বলে, ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে উঠছে, স্যার ইউস্টেসকে জানানো দরকার। আর রেভারেন্ড এডওয়ার্ড চিকেস্টারের সঙ্গে তুমি খুব হাসিঠাট্টা করো। তার ভার তোমার ওপর রইল। তবে মনে হয় না, রাতের অন্ধকারে প্যাগট আমাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেবে। 

—সুজান, তুমি তো সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তবে একান্তই যদি কিছু ঘটে তবে ক্লারেন্সকে জানিয়ে দেব। 

সুজান বলে, ভালো কথা। একটা টেলিগ্রাম ফর্ম দাও তো। দেখি কী করতে পারি।

টেলিগ্রাম ফর্মে সুজান লিখল- 

ভয়ঙ্কর এক রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েছি, এখুনি হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দাও। 

বেলা এগারোটায় সুজান তার বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারতে গেল। হোটেলে একা বসে না থেকে বেরিয়ে এসে রেললাইন পার হলাম। রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর হোটেলে ফিরতেই দেখলাম যাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কের লেখা একটা চিরকুট রয়েছে আমার জন্য। কিলমার্ডেন জাহাজে আমার আসার খবর তিনি পেয়েছেন এবং প্রফেসর বেডিংফিল্ড-এর মেয়ে আমি। তিনি আমার বাবার খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, আমি ওঁদের বাড়িতে গেলে উনি এবং ওঁর স্ত্রী খুশী হবেন। মুই জেনবার্গের ভিলায় যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ সেই চিরকুটে লিখে দিয়েছেন। 

বাবাকে যে এখানে কেউ কেউ গভীরভাবে মনে রেখেছে, সেটা জেনে খুশীতে আমার মন ভরে উঠল। 

পাহাড়ের ওপর এক নির্জন জায়গায় সেই ভিলাটা, বেল টিপতেই একজন কাফ্রি ছোকরা দরজা খুলে হাসিমুখে দাঁড়াল। 

আমি বললাম, মিসেস রাফিনি কোথায়? 

লোকটা ফিরে দাঁড়িয়ে, মিস বেডিংফিল্ড, আপনি যে দয়া করে আমাদের বাড়িতে এসেছেন, তার জন্য আমরা খুব খুশী। 

।। উনিশ।। 

‘পামেলার বিপদ’ উপাখ্যানের কথা আমার মনে পড়ে গেল। মনে হয় আমাকে ঘিরে আর এক পামেলার বিপদের কাহিনী শুরু হল, অবশ্য রেবার্ন গতকাল সকালে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। জানি না এ কাহিনীর শেষ কোথায়? এদের হাত থেকে আদৌ রেহাই পেতে পিছন ফিরে দরজায় হাতলে হাত রাখতে গেলাম। আমি যার হাতে বন্দী সে হেসে, মিথ্যে পালাবার চেষ্টা কোরো না, তুমি এখানেই থাকবে। 

মরিয়া হয়ে আমি বললাম, কেপটাউন যাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক আমাকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাই এসেছি, আমি যদি ভুল করে থাকি— 

সে হেসে, ভুল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মস্ত বড় ভুল— 

আমাকে এখানে ধরে আনবার কী অধিকার আছে তোমার? আমি পুলিশে জানাব-

 কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ কোরো না। 

তোমাকে আমি একজন বিপজ্জনক পাগল ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। আমার বন্ধুরা জানে আমি কোথায় আছি। সন্ধ্যার মধ্যে না ফিরলে তারা এখানে আসবে। বুঝলে? 

তোমার বন্ধুরা তাহলে জানে, তুমি কোথায় আছ? তা তোমার সেই বন্ধুরা কারা? 

এই সুযোগ, একবার ভাবলাম, স্যার ইউস্টেসের নাম বলব। কিন্তু প্যাগটের সঙ্গে যদি এদের যোগাযোগ থাকে, তাহলে মুশকিল। 

হাল্কাভাবে বললাম, তাদের মধ্যে মিশেল ব্লেয়ার একজন। 

কিন্তু মনে হয় না, সে জানে তুমি এখানে আসবে। বেলা এগারোটার পর থেকে তার সঙ্গে তোমার দেখা নেই। আমার আমন্ত্রণের চিঠিটা তুমি পেয়েছ মধ্যাহ্নভোজের সময়। 

মনে হল, আমার গতিবিধি লোকটার নখদর্পণে। তাই বললাম, আমাকে নিয়ে তোমরা কি করতে চাও? 

আগামীকাল সকালে তোমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তারপর ঠিক করব, তোমাকে নিয়ে কি করা যায়। 

আপাতত কাল সকাল পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে। লোকটা তার ওপরওয়ালার আজ্ঞাবাহক মাত্র। সেই ওপরওয়ালাই কি প্যাগট? 

দু’জন কাফ্রি এসে আমার হাত-পা বেঁধে ওপরতলার একটা ঘরে নিয়ে এল। ঘরভর্তি ধুলো। হল্যান্ডবাসী সেই লোকটা মাথা নিচু করে আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বেরিয়ে যায়। আর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল সে। 

ধুলোমলিন মেঝের ওপর অসহায় অবস্থায় হাত-পা-এর বন্ধন শিথিল করার জন্য গড়াগড়ি খেলাম, কিন্তু কিছুই হল না, আমার তখন ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। নিচে দরজা বন্ধ করার শব্দ হল, সেই লোকটা নিশ্চয়ই বেরিয়ে গেল। 

ক্লান্তিতে নোংরা মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে দেখলাম ঘরটা অন্ধকার, একটুকরো চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে পড়েছে। সেই আলোয় এক জায়গায় একটুকরো কাঁচ পড়ে থাকতে দেখে আমার চোখ উজ্জ্বল হল, আমার বন্ধন মুক্তির হাতিয়ার। সারা দেহে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে সেই কাঁচের টুকরোর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। একসময় হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও গেলাম। কিন্তু হাতটা যে দড়ি দিয়ে বাঁধা, খুলি কি করে? পেছনের দেওয়ালে জোরে জোরে একটা হাত ঘষতে লাগলাম। দড়িটা ছিঁড়ে যেতেই আমার একটা হাত বন্ধন মুক্ত হল। এবার সেই কাঁচের টুকরো দিয়ে আমার হাত পায়ের বন্ধন ছিন্ন করে ফেললাম। অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম, দারুণ খিদে পেয়েছিল। ক্লান্ত পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখলাম ভেজানো ছিল। উঁকি মেরে বাইরে একবার দেখে নিলাম। 

শান্ত, নির্জন জায়গা, জানলা পথে সিঁড়ির মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ছিল। সেই আলোতে নিচে নামতে লাগলাম। কিন্তু দুটো ধাপ নামতেই নিচতলা থেকে সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালাম। দেওয়াল ঘড়িতে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করল। 

পালাবার ঝুঁকি মস্ত বড় জেনেও নেমে সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিতে গিয়ে দেখলাম হলঘরে একজন কাফ্রি যুবক বসে আছে। ভালো করে তার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি সে অঘোরে ঘুমচ্ছে। নিশ্চিন্ত হলাম ঐ যুবকটির কাছ থেকে আমার বাধা পাওয়ার আশঙ্কা নেই। 

দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে নিঃশব্দে অতি সন্তপর্ণে যে ঘরটা থেকে কথাগুলো ভেসে আসছিল সেদিকে এগিয়ে গেলাম। বিকেলে এই ঘরেই আমি প্রথম এসেছিলাম। দরজাটা বন্ধ। নিচু গলার কথা কিছু বুঝতে না পেরে চাবির গর্তে চোখ রাখলাম। 

বিকেলের হল্যান্ডবাসী লোকটা দরজার দিকে মুখ করে বসেছিল কিন্তু অপর ব্যক্তি পিছন ফিরে বসেছিল বলে দেখতে পাচ্ছিলাম না। একসময়ে সে মদ খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ওর মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। 

সে কি! এ যে মিঃ চিকেস্টার। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের কথা শুনতে চেষ্টা করলাম। 

হল্যান্ডবাসী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছিল, মেয়েটার সঙ্গে যদি ওর পরিচিত কেউ দেখা করতে আসে? 

—না, সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই। মেয়েটা তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইছে। আমাদের কোনো ভয় নেই। এটাই কর্নেলের হুকুম। আমার বিশ্বাস, তুমি তাঁর হুকুমের বিরোধিতা করবে না। কিন্তু তার মাথায় আঘাত করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিল না কেন? জাহাজ তো আমাদের প্রস্তুত হয়েই ছিল। 

হ্যাঁ, তা ঠিক, মেয়েটি অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। কিন্তু কর্নেল চান না, আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি ও ব্যাপারে কিছু জানুক। তাই তিনি মেয়েটার কাছ থেকে কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করতে চান— 

মনে মনে বললাম, হীরের খবর? 

চিকেস্টার বলল, আমাকে সেই তালিকাটা দাও। 

তারা সেই তালিকাটা উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করে মাঝে মাঝে, যেসব জায়গার নাম বলাবলি করছিল আমার অজানা। চিকেস্টার বলে, এই তালিকাটি কর্নেলকে দেখানোর জন্য নিয়ে যাব। কাল সকাল দশটায় আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। 

—কেন, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে যাবেন না? 

—না, কর্নেলের কড়া হুকুম, তাঁর এখানে না আসা পর্যন্ত কেউ সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। সে ঠিক আছে তো? 

নৈশভোজ সারার আগে আমি নিজে তাকে দেখে এসেছি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গভীরভাবে ঘুমোচ্ছে। বলে সে হাসল। চিকেস্টারও তার সঙ্গে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল। 

তারপর আমি ওপরতলার সেই ঘরে এসে নিজেই দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেললাম, কে জানে। ওরা যদি আসে তাই সতর্ক হওয়া ভালো। 

ইতিমধ্যে রাতের প্রহরী সেই কাফ্রি যুবকটি জেগে উঠেছিল। অতএব রাতের অন্ধকারে পালানো অসম্ভব। 

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ শেষ করে চিকেস্টার ও সেই হল্যান্ডীয় লোকটি চলে গেল। এই সুযোগ, অতি সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। হলঘর তখন ফাঁকা; নিঃশব্দে দ্রুত পায়ে বাইরে রাস্তায় নেমে এলাম। অনেকক্ষণ পরে মুক্তি পেয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। রাস্তার লোক কৌতূহলী চোখে আমার ধুলোমলিন পোষাকের দিকে তাকাতে থাকে, আমি গ্যারেজে এসে ঢুকলাম। 

সংক্ষেপে গ্যারেজের লোককে বললাম, দেখুন, হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় পড়তে হয় আমাকে। এখুনি আমাকে কেপটাউনে পৌঁছাতে হবে, একটা গাড়ির খুব প্রয়োজন। ডার্বান যাওয়ার জাহাজ ধরতে হবে। 

একটু পরেই একটা গাড়ি আমাকে নিয়ে কেপটাউনের দিকে ছুটল। আমাকে জানতে হবে চিকেস্টার সেই জাহাজে উঠল কিনা। মুই জেনবার্গের ভিলায় সে আমাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু এবার সে আমাকে অত সহজে ধরতে পারবে না। কারণ, আমি তার স্বরূপ জেনে গেছি। সে রহস্যময় ‘কর্নেলের’ হয়ে হীরের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

কিন্তু আমার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেল। বন্দরে পৌঁছে দেখলাম সেইমাত্র লিমাৰ্ডেন জাহাজটা বন্দর ছেড়ে সমুদ্রে ভাসতে শুরু করেছে। চিকেস্টার গেল কিনা বোঝার কোনো উপায় রইল না।