১১.
পোয়ারো একটা কলেজের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘড়িতে তখন বেলা এগারোটা। পরিচয়পত্র দেখে দারোয়ান পোয়ারোকে সম্মানের সাথে ভেতরে যেতে বলে। সামনে একটা বিরাট লন। সেখানে মৌসুমি ফুলের জটলা। তারপরই একটা বাড়ি, সেটা কলেজ বিল্ডিং নয়, কিছু কেরানি ধরনের লোক সেখানে কাজ করছে। তাদেরই একজনকে পোয়ারো মেরী ডিনসমেডকে ডেকে দিতে বলে।
-কীসে পড়ে?
–তা ঠিক বলতে পারছি না।
–ঠিক আছে ঘড়ির নিচে বসে আছেন জ্যাকসন, আপনি ওর কাছে যান।
জ্যাকসনের সামনে গিয়ে পোয়ারো তাকে সুপ্রভাত জানায়। জ্যাকসন খুশী নয়। কারণ সামনের মাসে তাকে অডিটের মুখোমুখি হতে হবে। তবে পোয়ারোর সম্ভ্রান্ত পোশাক দেখে সে কথা না বলে পারে না। শুধু কথাই নয় তিনটে খাতা খুঁজে সে মেরী আর শার্লটের খোঁজ বার করে। মেরী বি.এ. সেকেন্ড ইয়ার, সেকশন-বি, রোল নং ৩১ আর শার্লট বি.এ. ফাস্ট ইয়ার, সেকশন-এ, রোল নং-২৫।
তাদের সঙ্গে দেখা করতে তিনটে বাজবে তাই একটা স্লিপে নাম লিখে পোয়ারো ভিজিটার্স রুমে বসে।
এখানেও মিথ্যে। স্লিপে লেখা চার্লসের বন্ধু এলবার্ট জোন্স। হলুদ বাড়ির একতলায় সে অপেক্ষা করছে।
পোয়ারো দুজনের নামে স্লিপ লিখে নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেরী আসে, চার্লস না তার বন্ধু? তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছে।
ভিজিটার্স রুমে ঢুকে মেরী দেখল বেশির ভাগ পুরুষ তাদের বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করতে এসে খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। দূরে কোণায় একজন সম্ভ্রান্ত পোশাকের মানুষকে দেখে মেরী বোঝে সেই চার্লসের বন্ধু।
ওদিকে পোয়ারো বুঝতে পারে না, এটা মেরী না শার্লট। পরনে সবুজ মিনি স্কার্ট, গায়ে লাল সোয়েটার ফুলহাতা, স্লিম ফিগার, চোখ কটা, চুল ধূসর, পায়ে হাই হিলের জুতো। কালো স্ট্রাপ, হাঁটু পর্যন্ত মোজা পরেছে। পোয়ারো বলে–আমার নাম…
-শুনেছি।
–আপনি মিস ডিনসমেড তো?
–হ্যাঁ, মেরী ডিনসমেড।
–চার্লস তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
–কেন? মুখে হাসি।
–তার জবাব তো আপনি নিজেই।
–কী সে?
–আয়নায় তো রোজই নিজেকে দেখেন তাও বলতে হবে কেন। চার্লস আবার আপনাকে দেখার জন্য আগ্রহী।
-উনি এলে খুশী হতাম। আসতে বলবেন।
–আর ওর বন্ধু হয়ে আমি বুঝি বাদ?
–না না, তা কেন?
–মুখে বলছেন বটে তবে আমার কপালটা খারাপ। নইলে এই বয়সে ঘরণী জুটল না।
মেরী জানায় ঠিক বয়সে বিয়ে না করার জন্য দুই বন্ধুর চালচলন একেবারে এক।
আস্তে আস্তে চর্লস চিন্তিত বলে পোয়ারো জানতে চায় এস.ও.এস. লেখার অর্থ। মেরী ওটা লিখেছে বটে। কিন্তু সঠিক মানে সে জানে না। হঠাৎ লিখলই বা কেন তাও একটা রহস্যজনক।
জাহাজ বিপদে পড়লে…এই সঙ্কেত লেখা হয়। পোয়ারো আরো জানায়, চার্লস মেরীকে সাইক্রিয়াস্টিকে দেখাতে ইচ্ছুক। মেরী লাজুকভাবে দেখাতে রাজী হয় না। তারপর এস.ও.এস. লেখার কারণ মনে পড়লে জানাতে বলে বিদায় নেয় পোয়ারো। যাবার আগে বলে যায় এই কথা বাড়িতে গিয়ে যেন সে না জানায়।
যাবার আগে মেরী জানায় তার বোন শার্লট সেদিন যায়নি।
.
১২.
চার্লস অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিল। দিন তিনেক পর ফিরে পোয়ারোকে ফোন করে। এই ট্রিপে সে পেনিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। সে চার্লসের ঠাকুরমা।
পোয়ারো মেরীর সাথে দেখা করার ঘটনা সব বলল। চার্লস প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না। পোয়ারো বলে সে একবার তাদের বাড়ি যাবে। আরো জানায় পোয়ারো, মেরীকে বলেছে চার্লস তার প্রেমে পড়েছে আর শার্লটের সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন বলবে পোয়ারো নিজেই তার প্রেমে পড়েছে।
চার্লস বলে–দেখো কিছু অঘটন করো না।
-তোমার হিতোপদেশ মনে রাখব। তবে আজ সন্ধ্যার পর আসছ তো?
–ও নিশ্চয়ই, ছাড়ি।
–হু।
.
১৩.
পোয়ারো কলেজে গিয়ে সোজা জ্যাকসনের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। জ্যাকসন আজ বান্ধবীর সাথে দেখা করার জন্য একটু তাড়ায় আছে। সে একটা কাগজে লিখে পাঠায় শার্লটের কাছে।
ভিজিটার্স রুমে ভিড় নেই। আজও পোয়ারো সুন্দর পোশাক পরে এসেছে।
শার্লট লাজুক হলেও তার মধ্যে জড়তা নেই। তবে প্রেমিক থাকে গ্রীন উডে আর কলেজে কোনোদিনই আসে না। তাই একটু অবাক হয়ে সে ভিজিটার্স রুমে ঢুকলো।
সতেরো বছর বয়স, পাতলা চেহারা, পান পাতার মতো মুখ, সত্যিই সে সুন্দরী। পোয়ারো চিনতে পারে শার্লটকে কিন্তু তার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে হল মুশকিল। আগের দিনের নাম ভুলে গেছে সে। এক ফুটবল প্লেয়ারের নাম মনে পড়তে বলে ববি চালটন তার নাম।
পোয়ারো ডিনসমেড বাড়ির প্রশংসা করে কথা শুরু করল। শার্লটের হাসিমাখা মুখ দেখে পোয়ারো ভাবল কাজ হচ্ছে। এবার শার্লটের প্রশংসা মানে শার্লটের সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করতে করতে আসল কথায় আসে। সেই এস.ও.এস.-এর কথায়।
শার্লট প্রথমে বলে সে লেখেনি, পরে বলে সেই লিখেছে।
শার্লটের এমন লেখার কারণ কী তার মনের দুঃখ, না, শার্লট জানায় বাবা-মার গম্ভীর মুখ দেখে তার মনে হয় বাড়িতে কোনো বিপদ হবে তাই এমনটা লিখেছে। পোয়ারো বলে–আপনাদের বিয়ের জন্য হয়তো চিন্তা করেন। আপনি তাই নিয়ে চিন্তা করবেন না। চার্লস তো খুব চিন্তা করছিল তাই আমায় জোর করে পাঠালো। নিজে অফিসের কাজে আটকে গেছে। যাক এবার উঠি।
কিন্তু চুল? যাবার সময় ইচ্ছা করে পড়ে গেল শার্লটের গায়ে এবং এতে তার চুলেও টান লাগল।
.
১৪.
চার্লস পোয়ারোকে ফোন করে। তখন পোয়ারো চার্লসকে তার বাড়ি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতে বলে। কেসের সম্বন্ধে অনেক কথা শুনে চার্লস ধন্যবাদ জানায় পোয়ারোকে। কিন্তু আগেই সে ধন্যবাদ নিতে রাজী নয়, যদি কেস সমাধান না হয়? সেটা অসম্ভব জানায় চার্লস, আর অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে।
চার্লস পোয়ারোর বাড়ি আসে। কেস কতদূর এগোল তা পোয়ারো চার্লসকে জানায় না। চার্লস জিজ্ঞাসা করে না কারণ সে জানে তাকে পোয়ারো সময় হলেই জানাবে। পোয়ারো ডিনসমেডের বাড়ি যেতে চায় এমনই একদিন যেদিন সকলে বাড়ি থাকবে। তাই ফোন করতে বলল চার্লসকে, যুক্তি হল চার্লস ফোনে বলবে তার বন্ধু ওখানকার সুন্দর জায়গা আর বিশেষতঃ তাদের আতিথ্যের কথা শুনে ওখানে যেতে খুবই ইচ্ছুক, তাই ফোন করেছে।
পোয়ারো বলেসেদিন যার সঙ্গে কথা বলব তুমি তখন অন্যদের ব্যস্ত রাখবে।
সব কথা ঠিকঠাক। এতক্ষণে ডিনসমেড বাড়ি ফিরেছে তাই এইবার ফোন করা ঠিক ভেবে ফোন করল।
.
১৫.
ডিনসমেড পোয়ারো ও চার্লসকে আমন্ত্রণ জানায়।
ব্রেকফাস্টের পর মামুলি আলোচনা হয়, আর জর্জকে নিয়ে পোয়ারো যায় বাগানে। চার্লস ডিনসমেডের সঙ্গে কথা বলে।
বাগানের প্রশংসার পর পোয়ারো জানতে চায় জর্জের প্রিয় বিষয় সম্বন্ধে। জানে বিজ্ঞান আরো জানে বাড়িতে জর্জ একটা ল্যাবরেটরি খুলেছে আর বর্তমানে আর্সেনিক পাওয়ার চেষ্টায় আছে, কলেজের বেয়ারা ম্যানেজ করে দেবে বলেছে। পোয়ারো জর্জকে বাড়িতে আর্সেনিক আনতে বারণ করে। জানায় বাড়িতে বিপদের সম্ভাবনা। টেস্টের অসুবিধা হলেও কিছুদিন ওই জিনিস বাড়িতে আনতে মানা করে পোয়ারো আর গোপন রাখতে বলে তাদের কথোপকথন।
বাগানে যখন পোয়ারো একা ঘুরছে সেখানে আসে মেরী। চার্লস চালাকি করে মেরীকে পাঠিয়েছে পোয়ারোর কাছে, বলেছে, পোয়ারো গাছ সম্বন্ধে কিছু জানে। অনেক কথার শেষে পোয়ারো আসে একই কথায় এস.ও.এস.।
মেরী জানালো এখনও তার মনে পড়েনি কেন সে ওরকম লিখেছিল তবে তার বছরখানেক ধরে এমনি মনে হচ্ছে কোনো বিপদ ঘটবে। কিন্তু সঠিক কারণ জানে না।
মেরী অবশেষে জানালো একটা অচেনা রাস্তার উপর তার বাবা তাকে একদিন এক ভদ্রলোকের বাড়ি নিয়ে যায়, মনে হয় সেই ভদ্রলোক উকিল। তবে তার বাবা তাকে একই রাস্তা অনেকবার ঘুরিয়ে ঐ বাড়িতে নিয়ে যায় বলে ব্যাপারটা তার কাছে আশ্চর্যজনক ঠেকে। যে লোকটির কাছে নিয়ে গিয়েছিল তার বয়স ষাট, মাথায় টাক, রোগা লম্বা।
পোয়ারো কথাটা গোপন রাখতে বলে এবং মেরী চলে যায়।
এরপর চার্লস শার্লটকে পাঠায় ধূমায়িত কফির ট্রে হাতে। বারবার কফি খাওয়ার জন্য মাফ চেয়ে নেয় পোয়ারো। তারপর শুরু হয় শার্লটের চুলের বর্ণনা। চুলে হাত দিতে চায় পোয়ারো। আর টানও লাগে চুলে। ক্লিপ খুলে যায়। পোয়ারো এতক্ষণ শার্লটকে লম্বা চুল কাটতে বারণ করেছিল এবং বলে উঠল–এ কী মিস শার্লট আপনি ফলস হেয়ার পরেন?
শার্লট চমকে যায়-কই না তো।
.
শার্লট ভেতরে যেতে চাইলে পোয়ারো তাকে বাহুডোরে বন্দী করে জানায় সে শার্লটকে ভালোবাসে। তারপর জানতে চায় পরচুলা পরার কারণ।
শার্লট বলে তাদের বাড়ির সকলের ধূসর চুল তারই শুধু সোনালি চুল। তাই মার কথামতো এই চুল পরে। আরও জানায়, তার দুটো পরচুল পনেরো দিন অন্তর দোকানে পাঠায় ধোয়ার জন্য। আর ছোটোবেলার কথা জানতে চাইলে সে জানায় রজারের ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে ওরা থাকত। আবার এস.ও.এস.-এর কথা। এবং একই উত্তর এমনই। শার্লটের কাছ থেকে পোয়ারো জানতে পারে বাবা-মা এখনও তাকে দেখলে আলোচনা বন্ধ করে দেয়। সাবধানে থাকতে বলে বাবা তাকে কোথাও নিয়ে গেলে জানাতে বলল শার্লটকে এবং বিদায় নেয়।
এরপর পোয়ারো আসে মিসেস ডিনসমেডের কাছে।
-আপনার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেশ মিল। কেবল জর্জ বাদে।
–হ্যাঁ। ও বাবার মতো দেখতে হয়েছে।
–তবে মিস শার্লট আপনার চুল পেলেও রং পায়নি।
একথায় সুসান স্বাভাবিক দেখে পোয়ারো ভাবে ইঙ্গিতটা সরাসরি ধরতে পেরেছে। এতে শার্লটের ওপর নির্যাতন হবে না তো? সোনালি চুল তো অনেকের থাকে এতে লুকোবার কী আছে? পেছনে কোনো রহস্য আছে। তবে কী শার্লট ডিনসমেডের দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে?
হঠাৎ পোয়ারো বলে–শার্লটের বয়স কত?
–মেরী আঠারো আর শার্লট সতেরো।
–দেখলে শার্লটকে বড় মনে হয়।
–হ্যাঁ, অনেকেই বলে।
এরপর পোয়ারো যে কলেজের প্রফেসার বলে নিজেকে জাহির করেছে সেই কলেজের একটা ছেলের কথা জানালে তার বয়স ছিল কুড়ি। ছেলেটি টেম্পোরারি চাকরি করত কলেজে কিন্তু তার চাকরি চলে গেছে। চার্লস আর পোয়ারের বাড়িতে কাজের লোক আছে তাই মিসেস ডিনসমেডের বাড়িতে তাকে রাখতে বলে। সে রাজী হয়।
খাবার আগে মিঃ ডিনসমেডকে সপরিবারে পোয়ারোর বাড়িতে যেতে বলে। গত দুবছর ব্যাবসার চাপে সে বেরোতে পারেনি শুনেও পোয়ারো তাকে যেতে অনুরোধ করে। ওরা চলে যায়।
.
১৬.
সকাল সাড়ে দশটায় রজারের বৈঠকখানায় পোয়ারো আর রজার কথা বলছে, হঠাৎ রজার তার পরিচয় চাইলে পোয়ারো বলে তার নাম বিলি জোন্স আর সে আসছে ইনকাম ট্যাক্স থেকে।
পোয়ারো জানতে পারে বাড়িটা ষাট-সত্তর বছরের এবং ভাড়াটেতে ভর্তি। দোকান থেকে কম টাকা পেলেও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেশ ভালোই টাকা পায়। রজার রিটার্ন সাবমিট করেনি জেনে পোয়ারো তাকে একটু ভয় দেখায়। রজার তাকে কিছু টাকা খরচ করে একটা উপায় বের করতে বলে। এই সুযোগ গ্রহণ করে পোয়ারো। সে টাকা চায় না, জানতে চায় মিঃ ডিনসমেডের কথা।
জানতে পারে আর্থিক অসঙ্গতির মধ্যেই তাদের জীবন কাটত। তাকে যখন এখান থেকে চলে যেতে বলা হয় তখন সে রজার-এর কথা শুনে চলে যায় বাড়ি কিনে। তবে গ্রীন উডের সেই বাড়িতে রজার যায়নি।
ডিনসমেডের পরিবার সম্পর্কে জানা যায় যখন সে এখানে থাকত তখন তার পরিবারে সদস্য বলতে ছিল তার স্ত্রী আর একটি ছেলে, বয়স দেড় বছর আর একটি মেয়ে, বয়স তিন বছর, এছাড়া আর কেউ ছিল না। ব্যাবসা আর বাড়ি এছাড়া লোকটা কিছুই জানত না। তবে একটি মাত্র বন্ধু ছিল রবার্ট। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, তার বাড়ি যাতায়াত ছিল। রজার রবার্টের সম্পর্কে কিছু জানত না। আর তার বাড়ি থাকাকালীন ডিনসমেড কোনো কন্যা সন্তানকে আশ্রিতা হিসাবে রাখেনি।
সমস্ত কিছু জানা শেষ হলে পোয়ারো রজারের কাছ থেকে বিদায় নেয়।
.
১৭.
পোয়ারো হেনেসের অ্যাপার্টমেন্টের কলিং বেলটা পুস করে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পোয়ারো আবার বেল বাজালে হেনেস এসে দরজা খুলে দেয়। হেনেসের বয়স পঁচাত্তর ছিয়াত্তর হবে, লম্বা শীর্ণ চেহারা, মোটা কাঁচের চশমা চোখে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে।
–গুড মর্নিং, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
–আসুন, ভেতরে আসুন।
একটা জীর্ণ বৈঠকখানার ঘরে বসিয়ে,–আপনার পরিচয়টা জানতে পারলে ভালো হত।
–আপনার উপরের অ্যাপার্টমেন্টে মিঃ রবার্ট থাকতেন, আমি তার বন্ধু।
–মিঃ রবার্ট তো আর বেঁচে নেই।
–হ্যাঁ, মাঝে দশ বছর ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, এসে শুনলাম।
–বাইরে ছিলেন বুঝি?
–হ্যাঁ, আচ্ছা রবার্টের মৃত্যু কী করে হয়?
রেল অ্যাক্সিডেন্টে। স্টেশনের নামও বলল।
আরো আলোচনার পর পোয়ারো জানতে পারে রবার্টের বেঁচে থাকাকালীন ওর স্ত্রী মারা যান। আর এও জানতে পারে যে, ওদের একটা কন্যাসন্তান ছিল যার বয়স ছিল তিন বছরের কাছাকাছি।
–মেয়েটার নাম জানেন?
হেনেস চিন্তিতভাবে বলল–মনে করতে পারছি না।
–আচ্ছা, মেয়ের নাম কী শার্লট ছিল?
–শার্লট? হতেও পারে। বয়স হয়েছে স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে।
–মেরী হতে পারে কী? এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
–তাহলে তো ভেবেচিন্তে বলতে হবে। তবে মনেই পড়ছে না।
–আচ্ছা, মিসেস রবার্ট মারা যাবার পর মেয়েকে কে দেখাশোনা করত?
–মিঃ রবার্টের চাকর জোন্স আর একজন শিক্ষয়িত্রী মিস জুলিয়েট, ভারী মিষ্টি মেয়ে, আমায় অনেক কাজে সাহায্য করত। সে নিয়মিত পড়াতে আসত।
-আচ্ছা, তার সাথে কী মিঃ রবার্টের কোনো সম্পর্ক ছিল?
–অনেকে তো বলে তবে আমার মনে হয় সব বাজে কথা। আর সত্যি কথা বলতে রবার্ট তখন তাকে বিয়ে করলে আমি সবচেয়ে খুশী হতাম।
–জুলিয়েট কোথায় থাকে?
–শুনেছিলাম ধারে-কাছে। তবে এতদিন পর কী তার খবর পাবেন?
–ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, রবার্টের মৃত্যুর পর ওর মেয়ের কী হল?
-ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু মেয়েটাকে নেবার কথা বলেছিল। এতে জোন্স রাজী হয়েছিল আর তাকে আসতেও বলেছিল কিন্তু সে আসার পর দেখে জোন্স মেয়ে নিয়ে উধাও আর ফার্নিচার সহ অ্যাপার্টমেন্ট বেচে দিয়েছে।
-কোথায় গেছে জানেন?
–না, মিঃ ডিনসমেড বহু খোঁজ করেও ব্যর্থ হন।
–আচ্ছা, মিঃ ডিনসমেড এখানে প্রায়ই আসতেন?
–হ্যাঁ, শুনেছি একই কলেজে পড়তেন। সেই সুবাদে
–রবার্টের মৃত্যুর কতদিন পর জোন্স উধাও হয়?
–তা দশ-পনেরো দিনের মধ্যে।
–সে পালাবার পর কী থানায় জানানো হয়েছিল?
–সেটা ঠিক মনে নেই।
–আচ্ছা, জোন্স যার কাছে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করেছে এখন গেলে তাকে পাওয়া যাবে?
–না, স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে।
–ধন্যবাদ, উঠি।
.
১৮.
নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে পোয়ারো নক করতেই প্রায় পঞ্চাশ বছরের ভারী চেহারার, চোখে চশমা, মাথায় সাদচুলের রাশি, একজন মহিলা দরজা খুলল।
–আপনি মিসেস ম্যাকডোনাল্ড?
–হ্যাঁ।
–মিঃ ম্যাকডোনাল্ড বাড়িতে আছেন?
–না।
–তাহলে একটু বিরক্ত করব।
–ভেতরে আসুন।
–আপনারা এই ফ্ল্যাটে তো রবার্টের চাকর জোন্স-এর কাছ থেকে কিনেছেন। লেখাপড়া কার সাথে হয়েছিল?
–জোন্সের সাথেই। তখন রবার্টের তো কেউ ছিল না।
–হ্যাঁ, তখন রবার্টের মেয়ে তো দুধের শিশু।
–হ্যাঁ, গুটিগুটি পায়ে হাঁটত। তবে তখনই সুন্দরী ছিল।
–জোন্স টাকা নিয়ে কী করল জানেন?
-না। তবে ও দেশে চলে যাবে বলেছিল। ওর বাড়ি বিক্রির জন্য খুব তাড়া ছিল। কেন জানি না।
–ওর সঙ্গে আপনাদের আর দেখা হয়েছে?
–না।
–আচ্ছা বাচ্চার নাম মনে আছে–শার্লট না মেরী?
–শার্লট না। ফুলের মতো বাচ্চা মেরী হতেও পারে।
–আচ্ছা, একটু মনে করে বলুন তো ওই বাচ্চার কোনো বিশেষ চিহ্ন…কাটা দাগ বা অন্য কিছু…
–অপরিচিত বলে দেখা দিয়ে ও পালাত, তাই খেয়াল পড়ছে না।
–আচ্ছা, এবার চলি।
–
-আপনাকে এক কাপ কফিও খাওয়াতে পারলাম না। আচ্ছা আপনি ওই মেয়ের সম্বন্ধে এতো খোঁজ নিচ্ছেন কেন?
আবার মিথ্যে–মানে..আমার ছেলে ঐ মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে কিনা তাই একটু খোঁজ নিচ্ছিলাম।
-ও তাই বলুন।
–চলি।
.
পোয়ারো সেখান থেকে বেরিয়ে রবার্টের বাড়ির কাছে একটা স্কুলে গেল। এখানকার হেডমিস্ট্রেস মিসেস বার্জ তার বিশেষ পরিচিত।
পোয়ারোকে দেখামাত্র তিনি বেল বাজিয়ে কফি আনতে বলেন। হেসে–হঠাৎ আমার স্কুলে মতলব কী?
-এমনি, স্কুল দেখতে এসেছিলাম।
–সত্যি করে বলুন তো মতলবটা কী? আপনাকে দেখলে ভয় হয় কখন কোনটা নাড়া দিয়ে কী বার করে বসবেন তার ঠিক নেই।
–আপনার এক শিক্ষয়িত্রীর প্রেমে পড়েছি।
–প্রেম? তাও আবার আপনার ক্ষেত্রে? এই তো বেশ কাটিয়ে দিচ্ছেন। এবার দয়া করে আসল কথাটা বলুন তো।
–ব্যস্ত আছেন?
–তা ঠিক নয় আসলে আপনার কথাটা না শোনা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
–আপনার এখানে কত বছর হল?
–তা ধরুন কুড়ি বছর হবে।
–আপনার এখানে জুলিয়েট নামো কোনো মহিলা কী কাজ করতেন?
–আচ্ছা এটা কী অনেক বছর আগের কথা?
–হ্যাঁ।
–না, তবে ইদানিং ও-নামে পারমানেন্টলি কেউ নেই।
–টেম্পোরারি?
–তাহলে রেজিস্টারটা দেখতে হবে।
–তাই দেখুন, ঘটনাটা কিন্তু বছর পনেরোর কথা।
–ও গড। আপনার জন্য কুড়ি বছর ব্যাকেও যেতে রাজী।
–শুনে খুশী হলাম।
–তা আর এককাপ কফি চলবে?
–হ্যাঁ, একটু অপেক্ষা করতে হবে বুঝি?
মিসেস বার্জের নির্দেশে একজন ক্লার্ক তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না। পোয়ারো অন্য এক স্কুলে গেল, সেখানে জুলিয়েট টেম্পোরারি কাজ করত। সেখান থেকে জুলিয়েটের ঠিকানা নিয়ে পোয়ারো চলে গেল।
.
১৯.
এবার আর জুলিয়েটের সঙ্গে দেখা করা কষ্টের হবে না। হয়তো ছুটির দিনগুলোতে জুলিয়েট রবার্টকে কাছে পেত, মেয়ে তো তখন ছোট্ট। রবার্টের মৃত্যুতে জুলিয়েটের হাত নেই তো?–এই সব ভাবতে ভাবতে পোয়ারো সুইন স্ট্রিটে পৌঁছায়। পথের মাঝে গাড়ি থামিয়ে দুপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এগোয়, খুঁজতে থাকে তেষট্টি নম্বর বাড়ি।
সহসা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তেষট্টি নম্বর বাড়ি। একতলা, সামনে ছোটো মাঠ, তাতে একপাশে দোলনা, স্লিপ, এককোণে ফুলের বাগান অনেকটা শিশু উদ্যানের মতো। বাড়ির রং হলদে।
বাড়ির সামনে গিয়ে বেল টিপতেই লম্বা গাউন পরা, তার উপর নীল হাইনেক সোয়েটার, বুকের বোম খোলা–বেরিয়ে দরজা খুলল জুলিয়েট।
–গুড মর্নিং।
–গুড মর্নিং, আমায় আসতে দেখে অবাক হয়েছেন।
–হ্যাঁ, তা একটু হয়েছি। জুলিয়েটের ঠোঁটে হাসি।
পোয়ারো খুবই চতুর, সেও হেসে–আপনার সঙ্গে দরকার ছিল।
দরকার! আসুন ভেতরে আসুন। জুলিয়েটের মনে সন্দেহ হয়।–বলুন কী করতে পারি?
তার অফিসঘরে অসংখ্য ফাইলপত্তর। আলমারি ভর্তি খাতা বই। পোয়ারো বসতে বসতে বলে–আমার মনে হচ্ছে আমি একটা স্কুলে বসে আছি।
-হ্যাঁ, এখনো ঠোঁটে হাসি। কিন্তু চাউনি তীক্ষ্ণ।
–এটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল বুঝি? চারিদিকে পোয়ারোর সতর্ক দৃষ্টি।
–হ্যাঁ, আপনার ধারণাই ঠিক। সে ভাবে সব কিছু জেনেই এসেছে।
–আপনিই চালান? আপনিই কী মালিক?
-হ্যাঁ, আমি একাই চালাচ্ছি, আর আমিই মালিক। জুলিয়েট অসহিষ্ণু। বয়স চল্লিশ, চুল বব করা, মাঝারি লম্বা চেহারা, চুলের রুপোলী রং তাকে আরও বৈশিষ্ট্যময়ী করে তুলেছে আর ভারিক্কি করে তুলেছে যা তাকে হেডমিস্ট্রেস হতে সাহায্য করে। চোখের চশমা তাকে ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলেছে।
–স্কুলটা কত বছর চালাচ্ছেন?
–তা প্রায় পনেরো বছর। তা আপনার আসার কারণটা যদি…
-ভুল হয়ে গেছে ওটা আমার আগেই বলা উচিত ছিল। আপনার মিঃ রবার্টকে মনে আছে? আমি তারই বন্ধু। বিদেশ থেকে ফিরে ওর মৃত্যুর সংবাদ পাই। বছর পনেরো আগে আপনি তার শিশুকন্যাকে পড়াতেন।
রবার্ট শুনে চমকে ওঠে জুলিয়েট, পরে বলে–হ্যাঁ মনে পড়েছে। তার একটা সুন্দর মেয়ে ছিল তিন বছরের, আমার কাছে পড়ত। তারপর আর কোনো খবর জানি না।
-কেন?
–চাকর জোন্স ফার্নিচার সহ অ্যাপার্টমেন্ট বেচে মেয়ে নিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।
–আমায় দয়া করে খুলে বলুন তো।
-ঐ মেয়েকে জোন্সের মিঃ ডিনসমেডের কাছে দেবার কথা ছিল কিন্তু সে তার কথা না রেখে সর্বস্ব বেচে পালিয়ে যায়। মিঃ ডিনসমেড বহু খোঁজ করেন জোন্সের দেশেও যান। কিন্তু কোনো লাভই হয় না। সেখানেও জোন্সকে পাওয়া যায় না।
–আচ্ছা, তারপর কী জোন্সের সাথে আপনার দেখা হয়েছিল?
–না।
–সেই মেয়েটার মুখ বা ওর চেহারার কোনো বৈশিষ্ট্য কিছু মনে পড়ে?
–তিন বছর বয়স ছিল যখন পড়তাম এখন সতেরো আঠারো হবে এর মধ্যে চেহারার কত পরিবর্তন হয়। তেমন কিছু মনে পড়ছে না। আচ্ছা আপনি ওর ব্যাপারে এত কথা জানতে চাইছেন কেন?
–মেয়েটাকে ফিরে পেতে চাই।
–ফিরে পেয়ে আপনার লাভ?
–লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন অবান্তর। অসহায় মেয়েটাকে আমার হেফাজতে রেখে মানুষ করতে চাই।
-ও।
-আচ্ছা আপনি রোজ সেখানে যেতেন?
–না, ছুটির দিনে যেতাম না।
–ঐ বাড়িতে তখন কার বেশি যাতায়াত ছিল?
মিঃ ডিনসমেডের। রবার্টের বন্ধু। আর কেউ বড় একটা আসত না। মিঃ রবার্ট মিশুকে ছিলেন না।
-আচ্ছা তার কোনো লইয়ার বন্ধু ছিল?
–না, আমি কোনোদিন দেখিনি, বাড়িতে দেখিনি।
–ওদের কথার সময় কী আপনি ওখানে থাকতেন? কী কথাবার্তা হত জানেন?
-মামুলি কথা। আবার অনেক সময় আমিই ওদের বিষয়বস্তু হতাম। মানে মিঃ ডিনসমেড চাইতেন আমার আর মিঃ রবার্টের…মানে আমাদের বিয়ে হয়।
লজ্জায় রাঙা হয় জুলিয়েটের মুখ।
–আচ্ছা আপনি কী রবার্টকে ভালোবাসতেন?
-সত্যিই আমি তাকে ভালোবাসতাম। প্রথমে তাকে এড়িয়ে চলতাম পরে ঐ অসহায় মানুষটার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করি।
–মিঃ রবার্ট সে কথা জানতেন?
–আমি তাকে কোনোদিন বলিনি। তবে যেদিন মনে মনে স্থির করলাম তার পরেই তো শুনি ওর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
–কিন্তু আমি ভাবছি অ্যাক্সিডেন্ট হল কী করে?
–চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে।
–কী এমন তাড়া যে চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গেল।
–শুনেছিলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর জেগেই স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে শুনে ধড়মড় করে নামতে গিয়ে নাকি দুর্ঘটনা ঘটল।
–আচ্ছা, পরের দিন কাগজে লেখা হয়েছিল?
–সামান্য,-চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে জনৈক ট্রেনযাত্রীর মৃত্যু।
–আপনি জানতেন রবার্ট সেদিন ট্রেনে করে কোথাও যাবে?
–হ্যাঁ, মিঃ রবার্ট আমায় বলেছিলেন। নইলে হয়তো জোন্স বলত। ও আমায় সব কথা বলত।
রবার্ট কীসে অফিসে যেত?
–গাড়ি করে।
–সেদিন রবার্ট অফিস যাবার পর আপনি কী করছিলেন?
–এই প্রশ্ন কেন? আপনি কী আমায় সন্দেহ করেন?
–না, তা নয়। আচ্ছা আপনি বিয়ে করেছেন?
–হ্যাঁ, তবে সে বিয়ে সুখের হয়নি ডিভোর্স হয়ে যায়।
–আচ্ছা বাচ্চাটার নামটা বলতে পারবেন?
-হ্যাঁ, রোজি, আমিই ঐ নামটা রেখেছিলাম। ওকে যে যা ইচ্ছে নামে ডাকত, বিশ্রী লাগত। আমি জোন্সকে বলেছিলাম সবাইকে বলে দিতে হবে যে, ওকে রোজি বলে ডাকতে। আর আমি কেন জানি না ওকে নিজের বাচ্চা বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম। সেই বাচ্চা কিনা…জুলিয়েটের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো।
–আচ্ছা তার আগে বাচ্চাকে কী কী নামে ডাকা হতো মনে আছে।
–একশত নামে ডাকা হত এখন কী আর মনে থাকে?
–আচ্ছা ওর মেরী বলে কোনো নাম ছিল বা শার্লট?
–না, ওরকম নাম হলে আমিই নাকচ করে দিতাম।
–আচ্ছা, মিঃ রবার্ট তো ভালো ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। মেয়ের জন্য নিশ্চয়ই কিছু রেখে গেছেন?
–তা আমার জানা নেই।
–আচ্ছা, তার কোনো শত্রু।
–না, ওরকম মানুষের কিছুতেই শত্রু থাকতে পারে না, আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
–সব কিছু কী আর নিয়ম মেনে চলে?
–হ্যাঁ, তা যে চলে না তার নিদর্শন মিঃ রবার্ট।
.
২০.
একজন গোয়েন্দার কাছে কেসের মেরিট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পোয়ারো অন্য কেস বাদ দিয়ে এই কেসের কথাই ভাবছে।
কফি খেতে খেতে পোয়ারো অনেক কথাই ভাবছে। জোন্স কেন পালিয়ে গেল? এর পেছনে কী রহস্য? জোন্স বাচ্চাকে বাবা-মায়ের ভালোবাসা দিয়েছে। সে বাচ্চাকে খুবই ভালোবাসত। এখানে থেকেও তো তা হত, তাহলে চোরের মতো গা ঢাকা দিল কেন? শুধু কী অ্যাপার্টমন্টে বিক্রির টাকার লোভে? তাও তো মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা। তা দিয়ে কীই বা হবে, তা কী সে জানত না? নাকি ভেবেছে ঐ টাকা দিয়ে জমিজমা কিনে চাষবাস করবে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করবে, এইভাবে দুজনের পেট চলে যাবে। হয়তো ভেবেছে অন্যের কাছে থাকলে মেয়ের অবহেলা হবে আর এখানে থাকলে যদি মেয়েকে তার কাছে থেকে কেড়ে নেওয়া হয় তাই ভয়ে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে পোয়ারা নিশ্চিত ডিনসমেডের একটি মেয়ে হয় মেরী না হয় শার্লট। কিন্তু কে? মেরীর সাথে তাদের পরিবারের মিল নেই। তবে সে যে ঐ পরিবারের নয় এমন বলা যায় না। একই পরিবারে সকলের মিল থাকবেই এমন কথা নেই। শার্লটের সাথে মিল থাকলেও অমিলও আছে। তাই নিশ্চিত হবার জন্য পোয়ারো হেনেসের কাছে ওদের ছবি চেয়েছিল কিন্তু পায়নি।
-আচ্ছা জোন্সকে দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?
–তা হয়তো পারি কারণ পরিণত বয়সে মানুষ বড়ো একটা পালটায় না। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, স্বাস্থ্য ভালো, কথাবার্তায় মার্জিত ভাব, চুল ছোটো করে ছাঁটা।
–জাতে কী?
–মেক্সিকান। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।
পোয়ারো তারপর সেখান থেকে চলে এসেছিল।
কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে এবার ভাবে–মিস জুলিয়েটের বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি কেন? জুলিয়েট রবার্টকে ভালোবাসত। রবার্ট নির্বিকার ছিল। শেষে কী একরকম ক্ষিপ্ত হয়েই কী ট্রেন থেকে ধাক্কা মারে…। প্রেমের জন্য মানুষ সব কিছু করতে পারে। জুলিয়েট ভেবেছে রবার্ট তার হবে না। তাই হয়তো ভীষণ পরিণতি।
পোয়ারো রবার্টের চলন্ত ট্রেন থেকে নামা বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ রবার্ট বড়ো তাই সে জানত আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়।
লোকাল ট্রেনে তিন মাইল অন্তর স্টেশন। পরের স্টেশনে নামতে পারত। অফিসের কাজে একটু দেরি হলে কী হত। সে একজন অফিসার, সামান্য বুদ্ধি কী ছিল না! ধোঁয়াটে লাগছে। পোয়ারোকে কুয়াশা ঘিরে ধরেছে।
জোন্স জানতো অ্যাপার্টমেন্টটা রবার্টের তাই কী সে এইভাবে রবার্টকে সরিয়ে সব নিজের করে নিয়েছিল….
মেরী না শার্লট ডিনসমেডের মেয়ে? তবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বলেছে ওরা তাদের সন্তান এবং সন্তানরাও একই কথা বলছে। হয়তো ওরা তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে তাই ওভাবে চলেছে। সেদিন ওরা এস. ও. এস. তাও মুখ খোলেনি। শুধু বলেছে একটা ভয়ের সংকেত পাচ্ছে।
বিপদ আসতে পারে। কিন্তু এখন কী ওদের ভুল ভেঙেছে? ওরা কী জানতে পেরেছে ওরা পরস্পরের বোন নয়।
আর শার্লটের পরচুলের ব্যাপার। কী কারণে সে পরচুল ব্যবহার করে? ওর সোনালি চুল গর্বের ব্যাপার। মেরী ও শার্লট–কে ডিনসমেডের মেয়ে? আর কেই বা রবার্টের মেয়ে হতে পারে?
হেনেস আর মিসেস ম্যাকডোনাল্ড দুইজনেই বলেছে শার্লট নয় মেরী হতে পারে।
জুলিয়েট বলেছে মেরী বা শার্লট না রোজি। রোজি থেকে মেরী হওয়া আশ্চর্যের নয়। কারণ রোজমেরী বলে কথা আছে। তাই এদিক ওদিক করে কার নাম রোজি হতে পারে?
পোয়ারো ভাবে মেরীর মধ্যে যে দুশ্চিন্তা তা শার্লটের মধ্যে কিন্তু বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না।
সব মিলিয়ে পোয়ারো পড়েছে একটা গোলকধাঁধার মধ্যে; কোনো কূলকিনারা নেই।