ক্যাট অ্যামঙ্গ দ্য পিজিওনস (এরকুল পোয়ারো)
পূর্বাভাস–গ্রীষ্ম পর্ব
গ্রীষ্মপর্বের প্রথমদিন মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের কাকড় বিছানো চওড়া পথটা পাক খেয়ে ঘুরে গেছে। শেষবিকেলের রোদ যেখানটায় চকচক করছে ঠিক তার ভেতরে মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে মিস ভ্যান্সিটার্ট। পরনে তার ছিল কোট আর স্কার্ট। তার মাথার চুল সুবিন্যস্ত।
প্রথমেই দেখে অজানা লোকেরা তাকে মিস বুলস্ট্রোড বলে ভুল করে। তারা যদি জানত যে মিস বুলস্ট্রোডের ঘরটি ঈশ্বরের বেদী, পুণ্যাত্মা না হলে সেখানে প্রবেশ নিষেধ তাহলে অবশ্যই তারা ভুল করত না।
স্কুলের কাজকর্মে মিস ভ্যান্সিটার্টের পাশেই মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের মিস চ্যাডাউইনের স্থান। বেশ স্বচ্ছন্দ চরিত্রের মহিলা। মেডোব্যাঙ্ক ওকে ছাড়া কখনই করা যায় না। স্কুলটির গোড়াপত্তন করেন তিনি আর বুলস্ট্রোড সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটেন। কথাবার্তা তার ভাসা ভাসা কিন্তু অংকে ভীষণ মাথা।
মিস ভ্যান্সিটার্টের স্বাগত অভ্যর্থনা ভেসে বেড়াচ্ছে, তিনি জিজ্ঞাসা করছেন মিসেস আর্নল্ডকে, তিনি ভালো আছেন কিনা। লিডিয়াকেলকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বেশ জাহাজে চড়ে গ্রীস বেরিয়ে এলেন, ভালো ফটো তুলেছেন কিনা।
তিনি বললেন লেডি গারনেটকে, নিশ্চয়ই! আটক্লার্কের ব্যাপারে তিনি বুলস্ট্রোডকে যে চিঠি দিয়েছেন, তা তিনি পেয়েছেন–সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস বার্ডকে যে তিনি কেমন আছেন। তারপর তিনি বললেন যে তার মনে হয় না আজ মিস বুলস্ট্রোড একটুও সময় পাবেন আলোচনা করার। তিনি বললেন যে একটা কাজ করা যাক তিনি মিস বোয়ানের আলোচনা করেন।
পামেলাকে বললেন যে তার ঘরটা বদলে দিয়েছেন আপেল গাছের কাছে। তারপর বললেন যে এবার বসন্তকালটা ভীষণ বাজে যাচ্ছে। তারপর তিনি বলনে যে তার এরোপ্লেনটা ভাল। তারপর বললেন মাদামকে যে, তার সৌভাগ্য যে তিনি এসেছেন।
মাদাম বললেন, ওইটা সম্ভব হবে না। তিনি ভয়ানক ব্যস্ত।
প্রফেসারকে নমস্কার করলেন, নতুন কিছু খুঁড়ে তুললেন কিনা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মিস বুলস্ট্রোডের সেক্রেটারি অ্যান শ্যাপল্যান্ড দোতলায় একটি ছোটো ঘরে টাইপ করছে। সে বেশ ভালো, চাইলে মনোরমা হয়ে উঠতে পারে কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। জীবন তাকে শিখিয়েছে কাজে মন দেওয়া। দক্ষতা দেখাতে। তাহলেই অনেক বেদনা অনেক জটিলতা এড়ানো যাবে। এই মুহূর্তে তার একমাত্র লক্ষ্য এই বিখ্যাত মেয়েস্কুলের বিখ্যাত হেড মিস্ট্রেসের নিপুণা দেখেছে জানালা দিয়ে। অস্টিন এসে ঢুকলো। গাড়ি থেকে বাপ আর মেয়ে নামে। বাপটির ভঙ্গী বিব্রত। মেয়েটি শান্ত।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে থেকে মিস ভ্যান্সিটার্ট এসে বলে, মেজর হারগ্রীভস! আর এই বুঝি অ্যালিসন! তারপর তিনি ভেতরে আসার কথা বললেন অ্যালিসনের ঘরটা দেখে যেতে বললেন।
মুচকি হেসে অ্যানি টাইপ করতে করতে মনে মনে আওড়ায় যে ভ্যান্সিটার্ট কি সুযোগ্য সহকারী সব কায়দাকানুন তার রপ্ত।
দোরঙা গাড়ি মেটে লাল ও আকাশী। মেজর অনারেবল অ্যালিস্টোয়ার হারগ্রীভসের প্রাচীন অস্টিনখানার পেছনে দাঁড়ালো।
ঘরের দরজা খুলে দিতেই এসে দাঁড়াল এক পেল্লায় মানুষ। কালো চাপাদাড়ি ঝোলা আলখাল্লা। আর তার পেছনে একটা ছিপছিপে কালো মেয়ে।
ইনিই বোধহয় প্রিন্সেস, স্কুলের পোশাকে ভাবা যাচ্ছে না।
মিস ভ্যান্সিটার্ট আর মিস চ্যাডউইক দুজনেই আসেন। তাদেরকে দেবী দর্শনে নিয়ে যাওয়া হবে। মিস বুলস্ট্রোডকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করার কথা কারোর কানেই ওঠে না। তিনি একেবারে অনন্যা।
সাধারণত অ্যানি কাজে ভুল করে না। এই তো সেইদিন সে ছিল এক বিরাট তেল কোম্পানির উচ্চতম অফিসারের একান্ত সচিব। অসহিষ্ণুতা এবং বিশ্রী হাতের লেখার কথা সবাই জানে। প্রাক্তন মনিবদের মধ্যে আছে দুজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং একজন বড় সরকারী অফিসার, তার কাজের জগত ছিল পুরুষ ঘেঁষা। এখন এই বিচিত্র নারী জগত এও এক নারী জগত। মালয়, বার্মা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে ফিরে আসছে মাঝে মাঝে, সব সময়ে ওকে বিয়ে করতে চাওয়া কিন্তু তার বউ হওয়ার মধ্যে যে কোনো বৈচিত্র্যেই নেই।
একমাত্র আশি বছরের বুড়ো মালীটি ছাড়া এখন চারপাশে শুধুই মাস্টারনী। এখানেই অ্যানের জন্য কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
বাইরে তাকালে নজরে পড়লো গাড়িবারান্দায় একটা নোক বেড়ার গাছ ছাঁটছে। গায়ের রং রোদে পোড়া। রজারগে জোয়ান। অ্যান অবাক। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বোধ হয় কাজটা দিয়েছে বা প্রাণধারণের জন্য।
এখানকার মেট্রন মিস জনসন তিনি খুব ব্যস্ত, কাকে কোন ঘরে দিলে হবে, নতুন নতুন মুখদের ডেকে ডেকে আপ্যায়ন করা, পুরানো ছাত্রীদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলা, কাজের কি আর শেষ আছে।
ছুটির দিনগুলো নিয়েই তার ভীষণ মুশকিল। দুটি বোন আছে, পালা করে কখনো এর কাছে, কখনো তার কাছে যান বটে কিন্তু বোনেরা নিজেদের সংসারের কথাই বলে, সাতকাহন মেডোব্যাঙ্ক নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। স্কুল আবার শুরু হয়েছে তাতেই তার আনন্দ।
পামালা জিজ্ঞাসা করলেন মিস জনসনকে যে, রাত্রে তার বোধ হয় কিছু ভেঙ্গে গেছে, বোধহয় তার মাথার তেল। মিস জনসন গোছাতে লাগলেন।
মাদমোয়াজেল ব্লাশ, নতুন ফরাসি শিখছে। যে লোকটা, বেড়া ছাঁটছে তাকে দেখে মনে মনে তারিফ করলেন।
ছিপছিপে শরীর তার। লোকের চোখ পড়ে না কিন্তু তার চোখ সর্বত্র।
ইংরেজি আর ভূগোলের মাস্টারনী মিস রীচ দালানের দিকে তাড়াতাড়ি চলতে চলতে মাঝে মাঝেই হোঁচট খাচ্ছেন।
ভাবতে-ভাবতে চলছেন, জমিতে মই দেবার আকশিটায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে যাবার সঙ্গেই সেই জোয়ান মালীটা ধরে ফেললো। সে বললো, সামলে চলুন।
আইলিন রীচ তার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।
মিস বোয়ান ও মিস ব্লেক নতুন স্পোর্টস প্যাভিলিয়ানটার দিকে চলেছেন। দুজনেই জুনিয়ার টিচার। মিস বোয়ান ছিপছিপে কালচে, অথচ দীপ্তিময়, মিস ব্লেক মোটা আর ফর্সা। দুজনেই ফ্লোরেন্সের গল্প করছিল। এবার সেখানে গিয়ে কী কী অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে।
মিস বোয়ান মিস ব্লেককে বললেন যে তিনি মনোবিজ্ঞান ও অর্থনীতি পড়েছেন, বেশি বাধানিষেধ তারা মানে না। তাই তো তাঁদের অমন সুন্দর দেখায়। রিপু দমন নেই। কিন্তু জিউসেপ যেই শুনেছে যে তিনি মেডোব্যাঙ্কে পড়ান অমনি সে যথেষ্ট ভদ্র হয়ে গেল।
মিস বোয়ান দারুণ খুশি, মেডোব্যাঙ্ক একটা স্কুল বটে। তার স্পোর্টস প্যাভিলিয়ন ভালো। তিনি তো ভাবতেই পারেননি এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে। তারপর তিনি একটু আফশোস করে বললেন, যে মিস বুলস্ট্রোড বলেছিলেন না…হতেই হবে। মিস বোয়ান তখন চমকে উঠল। স্পোর্টস প্যাভিলিয়নের দরজা খুলে একটি ছিপছিপে মেয়ে বেরিয়ে এসে তাদের দুজনের দিকে রুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
মিস ব্লেক বললে, এটা হয়তো নতুন গেমটিচার, কী বিশ্রী। তারপর বললেন, মিস জোনস কি সুন্দর ছিলেন। যেমন সুন্দর তেমনি মিশুকে। মিস বুলস্ট্রোড বেশ প্রভাবশালী অভিজাত চোহারা। তার চোখের তারা কটা, কিন্তু তাতে কৌতুকের দৃষ্টি। হেড মিস্ট্রেসের ব্যক্তিত্বের জন্যই এই স্কুলের এত সাফল্য, অবশ্য এখানে পড়ানো ভয়ানক ব্যয়সাধ্য। দলবদ্ধভাবে শিক্ষা দেওয়া এখানকার পদ্ধতি নয়। শিক্ষা ব্যক্তিমূলক হলেও শৃঙ্খলার ওপরেই জোর দেওয়া হয়। মিস বুলস্ট্রোডের শিক্ষানীতি হল, জোর করে দেওয়া নয়। তরুণীদের কাছে শৃঙ্খলা জিনিসটার আশ্বাস নিয়ে আসা। ওরা তাতে নিশ্চিত হয়। তার ছাত্রীরা সমাজের নানা স্তরে নানা দেশের। কিছু বিদেশী আছে, যারা উঁচু বংশের ও ধনী পরিবারের। এছাড়া আরো ছাত্রীরা আছে যারা প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে চায় ও ডিগ্রী নিতে চায়। তাছাড়া কিছু মেয়ে আছে তাদের কাছে স্কুল গণ্ডীটাই বাধা। তাছাড়া বুলস্ট্রোডের নানারকম নিয়মকানুন আছে–যেমন তিনি জড়বুদ্ধিদের নেন না, শিশু অপরাধীদেরও নয়। যে সব মেয়ের বাপ-মাকে তার পছন্দ হয় যাদের মধ্যে তিনি বিকাশের সম্ভাবনা দেখেন তাদের তিনি ভর্তি নেন।
এতক্ষণ ফায়ার প্লেসের ধারে দাঁড়িয়ে গেরাণ্ড হোপের প্যানপ্যানানি শুনছেন, তারপর তিনি বললেন, মিস বুলস্ট্রোডকে যে ডাক্তার তাদের বলে জেদী, মিস বুলস্ট্রোড মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন মনে মনে, ন্যাকা। তারপর বলেন সব মেয়েরাই ভালোবাসে তাদের নিয়ে বিদঘুঁটে কল্পনা করতে। মিস বুলস্ট্রোডের মুখে সমবেদনা, কিছু ভাবেন না তিনি। তারপর গেরা বললেন যে দু একদিনের মধ্যেই হেনরিয়েটা এমন বদলে যাবে যে অবাক হতে হবে। তারপর মিস বুলস্ট্রোড মনে মনে আওড়ালেন যে তার চেয়ে তার মেয়ে বুদ্ধিমতী। তারপর গেরা বললেন যে তারা মাস দেড়েকের মধ্যে দক্ষিণ ফ্রান্সে যাচ্ছে। তখন হেনরিয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তার একটা পরিবর্তন হবে।
তার খিটখিটে মুখটা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। মিসেস হোপের গলায় মেজাজের ঝাঁঝ ফুটে ওঠে, তিনি বলেন মেয়ে তারই। তারপর তিনি বললেন যে তার যখন খুশি মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।
তারপর হোপ বললেন যে, পারবেন না কেন। তাহলে তিনি আর তাকে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। তারপর বললেন যে তার মেয়ের জন্য তিনি কাড়িকাড়ি টাকা দিচ্ছেন।
হোপ বললেন, সেটাই তো কথা, তার স্কুল তিনিই তো বেছে নিয়েছেন। তারপর হেনরিয়েটাকে দেখে বললেন যে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আদরমাখা চোখে তাকাল, কী সুন্দর চালাক চতুর মেয়ে, ওর ভাগ্যে এমন মা জুটেছে, তারপর মিস বুলস্ট্রোড মার্গারেটকে বললেন, হেনরিয়েটাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। তারপর তিনি নিজের ঘরে ফিরে আসেন।
এরপর যারা বুলস্ট্রোডের ঘরে ঢুকলো তাদের গা দিয়ে দামী সুগন্ধ বেরুচ্ছিল। কালো বেশভূষা পরা কালো মেয়েটিকে আপ্যায়ন জানাতে মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন, রোজই বোধহয় গোটা বোতল গায়ে ঢালে তারপর মিস বুলস্ট্রোড মাদামকে আসতে বললেন, মাদাম সুন্দর । ভঙ্গীতে হেসে উঠলেন।
আরবী জোব্বা গায়ে দাড়িওলা দশাশই লোকটা মিস বুলস্ট্রোডের হাত টেনে নিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, প্রিন্সেস শাইস্তাকে নিয়ে আসার সৌভাগ্য তার হয়েছে।
নতুন ছাত্রীটি সুইজ্যারল্যান্ড স্কুল থেকে সবে এসেছেন তার কথা বুলস্ট্রোড জানেন। জানতেন না লোকটির সঙ্গে তার পরিচয় আছে। মিস বুলস্ট্রোড মেয়েটির বয়স পনেরো বলেই জানেন, বেশ বড়সড় দেখতে। প্রায় যুবতীই, প্রাচ্য দেশের মেয়েরা অমনিই হয়, পড়াশোনা নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে মিস বুলস্ট্রোড কথা বলেন, মেয়েটি ইংরেজিতে বলে, মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন যে ইংরেজ মেয়েদের দূর বিদেশে পাঠালে বেশ হয়, প্রাচ্য দেশে না হলেও মধ্যপ্রাচ্যে। মিস বুলস্ট্রোড আলোচনা শেষ করে বিদায় নিল।
মিস বুলস্ট্রোড জানালা খুলে দেন, ঘরে ঢুকলো মার্গারেট ও তাঁর মেয়ে জুলিয়া, বয়স তিরিশের শেষ কোঠায়, ঝরঝরে চুল মুখভরা দাগ। টুপিটা বেমানান তার অভ্যাস নেই, মেডোব্যাঙ্কে আসছেন মেয়েকে ভর্তি করাতে। সাদাসিধে মেয়ে, ললাটে বুদ্ধির ছাপ, হাসিখুশি মেয়ে। তাড়াতাড়ি ভূমিকা শেষ করে মার্গারেট হাত দিয়ে জুলিয়াকে চালান করে দিলেন জনসনের কাছে, মেয়েটা কিন্তু তার মাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে সে থাকবে না। গ্যাসট্যাসগুলো সাবধানে জ্বালাতে বললো। জুলিয়া একেবারেই সাধারণ মেয়ে, স্বাস্থ্য ভালো, বুদ্ধিসুদ্ধি রাখে, মিস বুলস্ট্রোড গম্ভীরভাবে বললেন জুলিয়া যে এখানে আসতে পেরেছে সেটাই বিরাট ব্যাপার।
হঠাৎ জানালা দিয়ে কী যেন দেখে মিসেস আপন অবাক হয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে বললেন, আরে কী অদ্ভুত, মিস বুলস্ট্রোডের কানেও গেল না। সামনের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন রডোডেনড্রন গুচ্ছ পেরিয়ে স্কুলবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন লেডি ভেরোনিকা কার্লটন, মদে চুর, তার পা টলছে। একটা আপদ বিশেষ লেডি ভেরোনিকা। যমজ মেয়েদুটির ওপরে খুব টান, কিন্তু মহিলা খুব ভালো কিন্তু প্রায় তিনি তা থাকেন না, তখন তিনি আরেক মানুষ হয়ে যান, কখন যে চুর হয়ে যান তিনি নিজেও জানেন না। স্বামী মেজর কার্লটন খুব চেষ্টা করেন তার স্ত্রীকে আয়ত্তে আনার জন্য। কিন্তু পারেন না। স্কুলে স্পোর্টসের দিন তারা সবাই এসেছিলেন, লেডি ভেরোনিকাকে সঙ্গে নিয়ে মেজরসাহেব ও তার বোন সেদিন প্রকৃতিস্থ অবস্থায় চমৎকার পোশাক পরে এসেছিল। তার বাৎসল্য প্রেম দেখে মনে হচ্ছিল আদর্শ এক মাতৃমূর্তি। কিন্তু যখন স্বামী ও ননদের চোখ এড়িয়ে মদে চুর হয়ে স্কুলে আসতেন যমজ মেয়ে দুটোকে স্নেহ জানাতে তখনই হত বিপদ, আজ সকালের ট্রেনে এসেছে।
মিস বুলস্ট্রোড মিসেস আপভানের কথা কিছুই শুনছেন না। তখন তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার কথা ভাবছেন, হঠাৎ মিস চ্যাডউইক জোর কদমে পা চালিয়ে লেডি ভেরোনিকার কাছে গেল। আরামে নিঃশ্বাস ফেললেন তখন বুলস্ট্রোড। চ্যাডিকে সব সময় বিশ্বাস করা যায়। কোনো মেয়ের রগ ছিঁড়ে রক্ত পড়ুক বা মাতাল বাপ-মা আসুন চ্যাডিই পরম ভরসা। লেডি ভেরোনিকা জোরেই মিস চ্যাডাইককে বলেছিলেন কি বিচ্ছিরি! বলে কিনা তাকে সরিয়ে রাখবে, আসতে দেবে না। তারপর তিনি বললেন, বুলস্ট্রোডকে গিয়ে তিনি বলবেন যে তার বাচ্চাদের নিয়ে যাবে কত আদর-টাদর করবে মায়ের স্নেহ দিয়ে। চ্যাডউইক বললেন, নিশ্চয়ই তারা খুব খুশি হয়েছে। নতুন স্পোর্টস প্যাভিলিয়নটা তাকে দেখাবেন বললেন, লেডি ভেরোনিকা কায়দা করে দালানের উল্টো দিকের পথটা ধরল, টলটলে পায়ে ভদ্রমহিলা মিস চ্যাডউইকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলবাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যান। তারপর চ্যাডউইক বলেন যে তার মেয়ে দুটোকে তিনি ওখানেই পাবেন। কি চমৎকার স্পোর্টস প্যাভিলিয়ন, ঝকঝকে নতুন নাম্বার, সাঁতারের পোশাক শুকিয়ে নেবার জন্য আলাদা ঘর আছে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, সত্যিই চ্যাডি অতুলনীয়া–ওর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। মেয়ে হিসাবে মোটেই আধুনিকা নয়। অঙ্ক ছাড়া কোনো বিষয়ে মাথা নেই। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আজ স্কুলে গ্রীষ্মপর্ব শুরু হলো, এখন অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
.
রামাতে বিপ্লব
গ্রীষ্মপর্ব আরম্ভ হবার মাস দুয়েক আগে মেডোব্যাঙ্কে কতকগুলো অসাধারণ ঘটনা ঘটেছিল। নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটি মেয়ের স্কুলটার ওপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। দুজন যুবক রাজপ্রাসাদে বসে অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল, তাদের মুখে পাইপ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল। একজনকে দেখতে তেলতেলে মসৃণ, মুখ ভাসা ভাসা, উদাস চোখ। ইনিই শাহজাদা আলি ইউসুফ, ছোটো হলেও রামাত দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের ধনবান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্য লোকটির শুকনো চুল, দাগ দাগ মুখ, মহামান্য শেখসাহেবের নিজস্ব বৈমানিক। মাইনে কয়েকটি টাকা মাত্র, এতটা সামাজিক বিভেদ সত্ত্বেও তারা দুজনে বন্ধু, কারণ দুজনে ইংল্যান্ডে একই পাবলিক স্কুলের ছাত্র।
বিশ্বাস করতে পারা যায় না রাজকুমার আলি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, বব রবিনসনের কোনো দ্বিধা নেই, নির্ঘাত আমাদের বিমানটি নিচে ফেলে দিতে চাইছিল, বব দাঁত চেপে কথাটি বললো। একটু ভেবে আলি বলেন, বোধহয় আর তারা কোনো চেষ্টা করবে না। আমি ভীষণ দেরি করে ফেলেছি নসীবের ওপর আর কতবার ভরসা করা যায়।
রামাতে রাজা বলেন, পালিয়ে যেতে কি মন করে ববের কথা সে বোঝে। রুদ্ধকণ্ঠে যুবরাজ বলে–এই দেশের লোকের জন্য তিনি কি না করেছেন। কতটাকা ঢেলে গড়া হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যবিভাগ। বব বললো দূতাবাস কিছু করতে পারে না, সে সেখানে আশ্রয় নেবে সেটা জিজ্ঞাসা করলে, ও বললো সে কখনো ও আশ্রয় নেবে না। তাহলে চরমপন্থীরা তাদের দূতাবাস গুঁড়িয়ে দেবে। আমার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগই তো যে, সে বড় ইউরোপীয় ঘেঁষা। তার মনটা যেন দূরদূরান্তে চলে যায়। তার পিতামহ ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। শয়ে শয়ে তার ক্রীতদাস ছিল। আর সে যদি পিতামহের মতো নিষ্ঠুর অত্যাচারী হন সেটা বানানোই বোধহয় তাদের কাম্য ছিল। ববের ধারণা আলির এই অনাড়ম্বর নিরুত্তাপ চেহারাটা ইংল্যান্ডে মানিয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে তেমন চলে না।
শাহজাদা আলি ইউসুফ বললেন, তারা কি বর্বর। তারা তো এখন সভ্য হয়েছে। তাছাড়া তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা বর্বর দানব লুকিয়ে থাকে। যে কোনো ছুঁতোতেই সেটা গর্জে ওঠে। বব তখন বললো, যাদের বেশ ভালো সাধারণ বুদ্ধি তেমন লোকের আজকাল চাহিদা নেই। এখন যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার নাম সাধারণ বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞান নয়। বব বললো, প্রত্যেকটা অলি-গলিতে চর আছে সবকিছু শোনে, সবকিছু জানে। বব বললো, আলিকে যদি পালাতে হয় তো এখুনি অবিলম্বে।..আলি বললো যে সে বুঝতে পারছে এখানে থাকা মানেই মৃত্যু–তাকে হত্যা করা হবে। বব বললো, মরবার সম্ভাবনাটাই বেশি, উত্তর দিকে লক্ষ্য করে বিমান চালাতে হবে। আলি ইউসুফের মুখ করুণ হয়ে উঠলো ববের যদি কিছু হয়। বব তখন বললো, যে তার আছেটা কি, না চাল না চুলো, তার কাজকর্মের ধারাই তো অদ্ভুত। কথাটা তাকে নিয়ে নয় আলিকে নিয়ে। আলি বললো যে তার পালাতে ইচ্ছে করছে না।
বব বললো যে, সেও কি চায় পালাতে কিন্তু হিংস্র জনতা যখন আলির প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে নেবে আর সে শহীদ বনে যাক।
আলি বললে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে, বেশ তবে তাই হোক।
বব বললো যে, সে সঙ্গে কিছু নিতে চায় না শুধু একটা জিনিস ছাড়া। শাহজাদা অদ্ভুতভাবে হাসলেন, পলকে যেন গোটা মানুষটা পালটে গেল। ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষা বেশভূষা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়লো প্রাচ্যদেশীয় চাতুর্য আর কৌশলের ইঙ্গিত। আলি বটুয়ার বন্ধনী খুলে সেটা টেবিলে ঢাললেন।
বব বললো, এগুলি কি আসল? আলি বললে, প্রত্যেকটা সাচ্চা পাথর। বেশিরভাগই তার বাবার সংগ্রহ, প্রতিবছর তিনি নতুন রত্ন আনতেন বিশ্বের নানা জায়গা থেকে। আলি বললো, তাদের বংশের এটা একটা রীতি, প্রয়োজনের সময় যাতে কাজে লাগে। বর্তমান বাজার দরে এর দাম প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড। বহু রক্তপাত হত্যাকাণ্ড যে তার পেছনে জড়িয়ে আছে, আর স্ত্রীলোকেরা আরো সাংঘাতিক। কারণ রত্ন তাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়, যে কোন নারীকে পাগল করে তোলে। আলি বললো যে, ববকে সে বিশ্বাস করে, আলি চায় না এই রত্নগুলো তার শত্রুর হাতে পড়ুক। হয়তো আজ বিকালে আলি বিমানযাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। কাজেই এই পাথরগুলো এখুনি নিয়ে রেখে দিতে বললো আলি।
বব বললো, এগুলি নিয়ে তিনি কি করবেন। আলি বললো, যেমন করে তোক এগুলো নিয়ে দেশের বাইরে যাবার ব্যবস্থা করবে। দরদ ভরা কণ্ঠে আলি বলেন, ববকে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে না।
.
অলিন্দে সুন্দরী
বব রবিনসনের মাথায় চিন্তা, প্যান্টের পকেটে সাড়ে সাত পাউন্ড। ভীষণ তার অস্বস্তি, প্রাসাদের প্রত্যেকেই বোধহয় খবরটা জানে, হয়তো তার চোখ মুখেও খবরটার ছায়া। মনটা তার উদ্ভ্রান্ত, কোথায় যাচ্ছে কে জানে, কী তার পরিকল্পনা তার জানা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড দামের জহরত তাকে সঁপে দেওয়া হয়েছে, এদেশ থেকে পাচার করবার জন্য সময় বিশেষ নেই। যে কোনো মুহূর্তে বিদ্রোহ হতে পারে।
বব বললো, এখন এমন একজন লোকের দরকার যে এ দেশ থেকে চলে যাচ্ছে পালিয়ে নয় হয়তো ভ্রমণ শেষে নয়তো কোনো কারণে দেশের বাইরে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী বা ভ্রমণকারী পেলেই ভালো হয় যে রাজনীতিতে নেই, রাজপরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে তার মালপত্র তল্লাশী করা হবে না। শুধু চোখ বুলিয়ে নিয়ম রক্ষা হবে।
হঠাৎ ববের মনে পড়লো অনর্থক এতক্ষণ ভেবে মরছে, তার দিদি জোয়ান তো রয়েছে মেয়ে জেনিয়াকে নিয়ে দুমাস হলো, এসেছে আবহাওয়া বদলাতে, ডাক্তার এমন দেশে যেতে বললেন যেখানে সূর্যালোক প্রচুর, আবহাওয়া শুষ্ক। চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তারা জাহাজে পাড়ি দেবে। বব বললো, যে আলি বলেছিল নারী ও রত্ন কদাপি বিশ্বাস করিবে না। জোয়ান অমন ভালো মেয়ে রত্ন দেখে কি তার মাথা ঘুরে যাবে, নিশ্চয় না। কিন্তু জোয়ানের পেটে কথা থাকে না। জোয়ান কখনও ভালো কথা চেপে রাখতে পারে না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে জোয়ান নিজেও না জানতে পারে, সঙ্গে করে কী নিয়ে যাচ্ছে, সেটা ওঁর পক্ষেও নিরাপদ। পাথরগুলো নিয়ে একটা পুটলি বাঁধতে হবে।
রামাতে সবচেয়ে নামী রিজ স্যাবয়ের সামনে বব এসে দাঁড়ালো, অতি আধুনিক হোটেলটি। সেখানকার কেরানী তাকে চেনে। হাসিখুশী মুখে ববকে সে বললো, সুপ্রভাত, দিদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বোধহয়, তিনি তার মেয়েকে নিয়ে চড়ুইভাতি করতে গেছেন। বব মনে মনে বললো, আর সময় পেল না। এখন ফিরতে তার দিদির কঘণ্টা সময় লাগবে, বরং বব তার দিদির ঘরের চাবিটা দিতে বললো। চাবি নিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢোকে বব। বেশ বড় দুটি বিছানা, ঘরময় জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। তারপর বব ভাবলো কি করলে ভালো হয়, একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে ভালো হয়, জোয়ানকে কেউ সন্দেহ করবে না, তারপর কারুর হাত দিয়ে ইংল্যান্ডে জোয়ানকে খবর পাঠালেই হবে। বব লিখলে—
জোয়ানদি,
ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে গল খেলতে যেতে রাজি আছ কিনা, দেখলাম তুমি নেই, শুনলাম বাঁধ দেখতে গেছ, তাই কয়েকঘণ্টার জন্য পৃথিবীর বাইরে চলে যাওয়া। কাল আসবে কি বিকেল পাঁচটায়।
ইতি
তোমাদের বব।
এতে ববের দুটো কাজ হবে, চিঠিটায় মনে হবে দেশ ছেড়ে চলে যাবার মতলবই ছিল না ববের। একটু ভেবে ব্রিটিশ দূতাবাসকে ডাকলো, তৃতীয় সচিব জন এডমাণ্ডসনের-ববের পুরানো বন্ধু। এডমাণ্ডুসনের সুরে বড় মেজাজ, শুকনো ভদ্রতা নেই সমর্থন কি মুশকিল, বব তুমি আর তোমার মেয়েরা দুটোর সময়, কেমন, লাইন ছেড়ে দেয়, বব বুঝতে পারল লাইনে কেউ ওদের কথাবার্তা শুনেছিল সেও রিসিভার রেখে দিল। খাঁটি বন্ধু এডমাণ্ডুসন রামাতে সব টেলিফোনেই যন্ত্র লাগানো আছে, তাই বব আর জন এডমাণ্ডুসন মিলে নিজেদের একটা সঙ্কেত বানিয়ে নিয়েছিল। মেয়েটি আশ্চর্য, যেন এই জগতের নয়–এটা বললে বোঝা যাবে ভীষণ জরুরী বরং সাংঘাতিক ব্যাপার। মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে দুটোর সময় জন এডমাণ্ডুসন ববকে গাড়িতে তুলে নেবে। বব তখনই তাকে গোপন কথাটা জানাবে। জোয়ান কিছু জানে না, মাস দেড়েক লাগবে জোয়ানের ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে। তখন নিশ্চয়ই রামাতে বিপ্লব শেষ হয়ে যাবে, হয়তো আলি ইউসুফ তখন ইউরোপে থাকবেন। অথবা ওরা দুজনেই তখন মৃত। আরেকবার বব ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, সেই একই চেহারা, টেবিলে চিঠিটাকে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বব বেরিয়ে এলো।
জোয়ান সাটক্লিফের পাশের ঘরের রমণীটি অলিন্দ থেকে পা টিপে টিপে ফিরে এলে, তার হাতে একটা আয়না। মহিলাটির চিবুকে একটা চুল গজিয়েছে তাই আয়না হাতে মহিলাটি অলিন্দে এসে অনেক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, সেটা উপড়ে ফেলে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে যখন বেশ তৃপ্তি পেল ঠিক তখুনি চোখে পড়লো পাশের ঘরের আয়নায় ঝুলন্ত লোশাক, আলমারির আয়নায় স্পষ্ট প্রতিফলন ফুটে উঠেছিল, আর সেই প্রতিবিম্বে ধরা পড়লো একজন অদ্ভুত পুরুষ কিছু করছে। সেই অবাস্তব ব্যাপারটা দেখে রমণীটি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষটি তাকে দেখেনি। নারী মূর্তিটি শুধু দুই আয়নার প্রতিফলনে ব্যাপারটাকে দেখলো। পুরুষটি যদি একবারও ঝুলন্ত আয়নায় চোখ রাখতো তাহলেই দেখতে পেতে পাশের ঘরে লাগোয়া ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন সুন্দরী রমণী হাতে আয়না নিয়ে কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। লোকটি যতক্ষণ কাজ করল ততক্ষণ অলিন্দে দাঁড়িয়ে রমণীটি আয়না হাতে সব দেখলো, কাজ শেষ করে লোকটি চিঠি লিখে রেখে টেলিফোন করছে। একটু পরেই দরজা বন্ধ হল। রমণীটি নিজের ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে। বারান্দায় শেষ প্রান্তে পালকের ঝাড়ন দিয়ে একজন আরবীয় মন্থর হাতে ময়লা ঝাড়ছিল, মোড় ঘুরে সে চলে গেল। যেতেই মেয়েটি চট করে পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তালা বন্ধ ছোটো চাকুর ফলা আর চুলের কাটা দিয়ে নিপুণ হাতে তালা খুলে ফেললো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিঠিটা তুলে নেয়, চিঠি পড়তেই ভুরু কুঁচকে ওঠে। কোনো ব্যাখ্যা নেই, যথাস্থানে রেখে ঘরের এপাশে এসে দু-হাত বাড়িয়ে হঠাৎ জানলা দিয়ে একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
জোয়ান চেঁচিয়ে বলছিলো, এ যে একেবারে অসম্ভব ব্যাপার মশাই, এমন পাগলামি কেউ কখনো শুনেছে? চারিদিক শান্তিপূর্ণ, হৈচৈ নেই, গণ্ডগোল নেই, আতঙ্ক নেই, প্রত্যেকের সুন্দর ব্যবহার…না-না এসব আপনাদের অহেতুক বাড়াবাড়ি।
তাই যেন হয় মিসেস সাটক্লিফ। কিন্তু মাননীয় রাজদূত মনে করেন যে বিপদের ঝুঁকি এত বেশি যে তার দায়িত্বে…তার মালপত্র প্রচুর, আমরা সমুদ্রপথে বাড়ি যাব, আগামী বুধবারে আমাদের জাহাজ ছাড়বে। সব পরিকল্পনা ছুঁড়ে ফেলে হুট বলতেই উড়ি এখন ইংল্যান্ডে, প্রতিনিধিটি বিব্রত মুখে আশার বাণী শোনালো, সাটক্লিক ও তার মেয়েকে বিমানে ইংল্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে না, পথে এডেনে নামিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে জাহাজ ধরতে হবে। রমণীটি কথাটি শোনামাত্র দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল। সবার আগে স্যুটকেসের ওপরে ঠিকানা লেখা কাগজটা ভালো করে দেখে নেয়। তার পিছনে পিছনে কেরাণীটি ছুটতে ছুটতে এসে বলে, মিসেস সাটক্লিক আপনার ভাই এসেছিলেন একটু আগেই। আপনার ঘরেও গিয়েছিল, চলে গেছেন বোধহয়। সাটক্লিক ধন্যবাদ জানালো। তারপর তিনি আফশোস করে বললেন, বব মনে হয় বিপ্লবের কথা বলতে এসেছিল। তারপর তার ঘরের দরজা খোলা কেন, কী অসাবধানতা এই লোকগুলোর।
জেনিয়া বলল, বোধহয় বব মামার কাণ্ড।
মিসেস সাটক্লিক বললেন, যে ববের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। তারপর সে চিঠিটা পেল।
চিঠিটা পড়ে যা মনে হয় বব মোটেই ব্যস্ত হয়নি, মনে হল। আমার তো মনে হয় না কোনো কূটনৈতিক ঝগড়া-টগরা বেঁধেছে।
.
মিঃ রবিনসনের পরিচয়
মাস দেড়েক পড়ে একজন যুবক ব্রুমনবেরীর কোনো একটা ঘরের দরজায় সাবধানে টোকা দিতেই ভেতর থেকে আহ্বান এলো। ছোটো ঘরটিতে বড়ো একটা টেবিলের পেছনে মোটাসোটা একজন মাঝবসয়ী ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন, তার স্যুটে ভাজ পড়ে গেছে, সামনের দিকে চুরুটের ছাই লেপটে আছে, জানলা বন্ধ থাকায় ঘরে অসহ্য গুমোট। ঢুলুঢুলু চোখে ভদ্রলোক বলেন, কি হে এবার কিসের দরকার? আজ্ঞে বিদেশ দপ্তর থেকে এডমাণ্ডুসন এসেছেন। আবার চোখ মিটমিট করে বিড়বিড় করে বললেন, রামাতে বিপ্লবের সময় তিনি আমাদের দূতাবাসে তৃতীয় সচিব ছিলেন তাই না, আজ্ঞে হ্যাঁ। কর্নেল বলেন, তাহলে তো দেখা করতেই হবে।
মিঃ এডমাণ্ডুসন বেশ লম্বা, ফর্সা, চমৎকার পরিপাটি পোশাক। কর্নেল পাইক্যাওয়ে আমি জন এডমাণ্ডুসন। ওরা বললো, আপনি নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? এডমাণ্ডুসন বললেন। বলেছেন বুঝি, তা বসুন।
পাইক্যাওয়ের চোখ বুজে আসে। তা বিপ্লবের সময় আপনি রামাতে ছিলেন? এডমাণ্ডুসন বলেন, হ্যাঁ বিশ্রী ব্যাপার। তারপর পাইক্যাওয়ের বলেন, আপনি বব রবিনসনের বন্ধু ছিলেন না, তার সঙ্গে আমার বেশ ভালোই জানাশোনা আছে।
এখানে সতর্ক হয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা সব খবর রাখি। যেদিন বিপ্লব হলো সেদিন বব শাহজাদা ইউসুফকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল। তখন থেকেই বিমানটা নিখোঁজ, হয়তো ওরা কোনো দুর্গম স্থানে নেমেছে নয়তো বিমানখানা ধ্বংস হয়েছে। আরলেজ পাহাড়ে একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে আর দুটি মৃতদেহও ছিল। সেখানে কালকের কাগজে খবরটা বেরুবে কী বলেন।
বড়ই দুঃখের! কী করুণ কাহিনী, শাহজাদা যদি বেঁচে থাকতেন তো রাজার মতো রাজা হতেন, আলোকপ্রাপ্ত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কর্নেল পাইক্যাওয়ে বলেন, হয়তো সেইজন্যই বেচারাকে মরতে হল। স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল থেকে অনুরোধ এসেছে যে কয়েকটি ব্যাপারে আমরা যেন অনুসন্ধান চালাই তাতে আমাদের সরকারের অনুমোদনও রয়েছে। এডমাসন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো, তা হ্যাঁ কিছু কিছু তিনি শুনেছেন বটে। তারপর পাইক্যাওয়ে বলেন যে মৃতদেহের কোনোটা থেকেই কোনো মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়নি, ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও না।
এডমাণ্ডুসন বলেন, যেদিন কাণ্ডটা শুরু হলো সেদিন বব আমাকে টেলিফোন করে কথাগুলো বললো, একটা ব্যাঙ্কের সামনে আমরা দেখা করতাম। কিন্তু ঠিক ওই জায়গাটায় দাঙ্গা আরম্ভ হল, পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিলো, ববের সঙ্গে আর সংযোগ করা গেল না। সেই বিকেলেই আলিকে নিয়ে আকাশে উড়লো। কর্নেল পাইক্যাওয়ে বললেন, বব কোত্থেকে ফোন করেছিল, এডমাণ্ডুসন বললেন না। আচ্ছা মিসেস সাটক্লিফকে চেনেন, এডমাসন বললেন, ববের দিদি, ওখানে দেখা হয়েছিল বটে।ইস্টার্নকুইন জাহাজে টিলবেরী বন্দরে মিসেস সাটক্লিফ ও তার মেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর দেশে ফিরছেন। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর কর্নেল একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, এখানে আসবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। জন এডমাণ্ডুসন চলে গেলে বিচক্ষণ যুবকটি ঘরে ঢুকলো। পাইক্যাওয়ে বললেন, ভেবেছিলাম ওকে টিলবেরী পাঠাবো। কিন্তু স্বভাবটি একেবারেই শুকনো বৈদেশিক দপ্তরের, শিক্ষাটাই অমনি।
যখন রনি এসে ঘরে ঢুকলো তখন কর্নেলকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। কালচে পেশীবহুল চেহারা, দীর্ঘদেহ, স্ফুর্তিবাজ মন, বেপরোয়া স্বভাব। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বলেন, মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে পারবে?
রনি তখন ভুরু নাচিয়ে বলে, মেয়েদের স্কুল, মেডোব্যাঙ্ক একেবারে অভিজাত স্কুল। শিস দিয়ে রনি বলে, মেডোব্যাঙ্ক কল্পনাই করা যায় না। রনি বললো, তাকে কি করতে হবে, নারীহরণ।
কর্নেল বললো যে, তিনি চান যে রনি চারিদিক নজর রাখবে কি হচ্ছে না হচ্ছে আমাকে জানাবে। মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটার উপর দৃষ্টি পড়বে, কে বা কারা ওখানে গিয়ে জুটবে তা এখনো বলা যায় না। তোমার কাজ হল চোখ খুলে দেখা আর কান পেতে শোনা। সেখানে তুমি মালি সেজে ঢুকবে। তারপর কর্নেল বললো, মালির কাজে যা জ্ঞানের দরকার পারবে তো?
রনি তখন বললো, ছোটোবেলায় সে এসব অনেক করেছে। রনি বললো, মেডোব্যাঙ্কে মালির কাজ খালি আছে? কর্নেল বললো, থাকতেই হবে, ইংল্যান্ডে প্রত্যেকটা বাগানে এখন লোকের অভাব। তোমাকে কতগুলো প্রশংসাপত্র যোগাড় করে দেবো তাহলেই তারা লাফিয়ে উঠবে, উনত্রিশ তারিখে স্কুল খুলবে।
রনি বলল, তখন তার নাম কি হবে?
কর্নেল বললেন, অ্যাডাম।
রবিনসনকে দেখে মনে হবে না যে তিনি কস্মিনকালের, বরঞ্চ কোনো বিদেশী নামই হওয়া উচিত। পরিপাটি পোশাক, নাদুসনুদুস চেহারা, হলুদ চুল, উদাস চোখ, চওড়া কপাল, ঝকঝকে দাঁত একটু বেরিয়ে আছে। খাঁটি ইংরেজী উচ্চারণ। কর্নেলের সঙ্গে দেখা হতেই দুজনের সম্ভাষণ আপ্যায়ন দেখে মনে হয় দুই দেশের দুই রাজা, প্রচুর সমাদর হল।
মিঃ রবিনসন মুখে একটা চুরুট দিয়ে কর্নেলকে বললো যে তিনি যে সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। রবিনসন বললো কর্নেলকে যে তিনি শুনতে পেয়েছেন যে, শাহজাদা আলি ইউসুফের বিমানটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
কর্নেল বললেন, গত বুধবার বিমানটা খুঁজে পাওয়া গেছে। উড়ানপথটা ছিল খুবই কঠিন। বিমানটাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ ঘটেছিল আহমেদ নামে এক পুরানো মিস্ত্রীর সম্পূর্ণ বিশ্বাসী লোক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মোটেই তা নয়। নতুন শাসনতন্ত্রে লোকটা বেশ ভালো পদ পেয়েছে।
তারপর রবিনসন একটু আফশোস করে বললেন, আহা বেচারী তরুণ রাজা আলি ইউসুফ, অসাধুতার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে যে লড়বে সে শক্তি কই। পাবলিক স্কুলে শিক্ষাটাই তার কাল।
পাইক্যাওয়ে জানালো, হ্যাঁ আমরা বব ও তার দিদির ওপর ব্যবস্থা করবো। রবিনসন চোখবুজে বলেন, রত্নগুলো যদি তার কাছে এখনো থাকে তো বিপদ ঘটতে পারে। গুণ্ডামি দাঙ্গা মারামারি এসব আমার সহ্য হয় না।
.
যাত্রী এলো ফিরে
মিসেস সাটক্লিফ হোটেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে বিরক্ত হয়। কী অদ্ভুত যখন ইংল্যান্ডে আসব তখুনি বৃষ্টি হতে হবে। পাশে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠলো, মিসেস সাটক্লিফ রিসিভার তোলে। হ্যালো আমি মিসেস সাটক্লিফ বলছি, দরজায় টোকা মারল কে। ফোনটা রেখে দরজা খুলে দেখে একজন বিজলী মিস্ত্রী, বাতি ঠিক নেই, ঠিক করতে এসেছে। ছোকরা ঘরে ঢুকলো। সে বললো, গোসলখানা কোনদিকে? সাটক্লিফ বললো, শোবার ঘরের পেছনে। ফিরে টেলিফোন তুলে নেয়, দুঃখিত…কী যেন বললেন? আমি ডোরেক, আপনার সঙ্গে দেখা হবে কি? মিসেস সাটক্লিফ আমি আপনার ভাইয়ের বিষয়ে–কে বব? তার কি খবর পাওয়া গেছে। হা ফোনে অসুবিধা আছে। ও আচ্ছা আসুন, ওপরে চলে আসুন তিনশো দশ নম্বর ঘরে। আবার দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দেয়। কম বয়সী এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে করমর্দন করেন। আপনি কি বৈদেশিক দপ্তরের? আমার নাম ডোরেক ওকোনর, আমারই ওপরওয়ালারা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, আর কাউকে পাওয়া গেল না সংবাদটা দেওয়ার জন্য। মিসেস সাটক্লিফের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বলুন মারা গেছে, না?
হা মিসেস সাটক্লিফ..রাজকুমার আলি ইউসুফকে উড়োজাহাজে রামাতে বাইরে নিয়ে আসছিলেন, পথে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে তিনি মারা যান।
আমাকে জানানো হয়নি কেন? আমার জাহাজে বেতারবার্তা পাঠানো হয়নি।
ডোরেক ওকোনর বললেন মিসেস সাটক্লিফকে, তার ভাই কি কোনো জিনিস দিয়েছিল ইংল্যান্ডে নিয়ে আসবার জন্যে? মানে বব কোনো ছোটো পুঁটুলি আপনাকে দিয়েছিল। ডোরেক বললেন যে আর একটা কথা তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, একটা ভীষণ দরকারী প্যাকেট ছিল। আমাদের ধারণা দেশে নিয়ে যাবার জন্য আপনার ভাই বিপ্লবের দিন কাউকে দিয়েছিলেন। আর সেইদিনই তো তিনিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
তা জানি কিন্তু তার দুলাইন চিঠির মধ্যেও কিছু ছিল না। শুধু পরের দিন টেনিস না গলফ খেলার কয়েকটা তুচ্ছ কথা..আমার তো মনে হয়না তখন ও জানতো যে সেই বিকেলেই ওকে রাজকুমারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
শুধু ওই কটা কথাই লেখা ছিল তাতে? আপনার কাছে কি সেই চিঠিটা আসে মিসেস সাটক্লিফ?
না ও চিঠি থাকবে কেন? ওটা কি কোনো দরকারের? তক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলেছি।
রাখতে যাবই বা কেন বলুন? মিসেস সাটক্লিফ মাঝের দরজা খুলে ভেতরে যেতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ান, দেখে এক ছোকরা একটা স্যুটকেসের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, আমি বিজলী মিস্ত্রী, ওদিককার আলোগুলোর কিছু হয়েছে?
আলোর বোতাম টিপে বললো, না ঠিক আছে ভাই। তাহলে বোধহয় ঘরের নম্বর ভুল, তাড়াতাড়ি যন্ত্রপাতি নিয়ে দরজার দিকে চলে যায়। সাটক্লিফের দিকে চেয়ে, মাপ করবেন, বলেই চলে যায়।
টেলিফোনটা তুলে নিল সাটক্লিফ। আমি ৩১০ নম্বর থেকে বলছি, কোনো মিস্ত্রী পাঠিয়েছিলেন এ ঘরে, হা…আচ্ছা ধরছি, টেলিফোনটা রেখে সাটক্লিফ বলে এঘরে কোথাও কোনো আলো খারাপ হয়নি, হোটেল থেকেও কোনো মিস্ত্রী পাঠায়নি।
আঁ এ লোকটা চোর-টোর নাকি, তাড়াতাড়ি তার ব্যাগ খুলে দেখে, না, ব্যাগ থেকে কিছু নেয়নি। টাকাকড়ি সব ঠিক আছে।
রাজকুমার আলি ইউসুফ বোধহয় আপনার ভাইকে একটা জিনিস রক্ষা করতে দিয়েছিলেন। তাই তিনি হয়তো ভাবছিলেন নিজের কাছে রাখার চেয়ে আপনার মালপত্রের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা বেশি নিরাপদ।
না না, হতেই পারে না।
একবার খুঁজে দেখলে হয়।
খুঁজে দেখবেন মানে, আঁ, আমার সব জিনিসপত্র আবার সব খুলবেন, যেন কান্নার সুরে আঁতকে ওঠে।
ঝামেলা অনেক জানি। অসুবিধাও প্রচুর হবে। কিন্তু সমস্যাটা যে গুরুতর, কিছু ভাববেন না। আমার মায়ের জিনিসপত্র বেঁধে দিয়েছি। মালপত্তর গোছাতে আমি ওস্তাদ। অতএব মিসেস সাটক্লিফ প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হল, আচ্ছা যা ভালো বোঝেন করুন। অতই যদি জরুরী।
ভীষণ জরুরী বিশ্বাস করুন।
জেনিয়া এসে অবাক। মালপত্তর আবার খুলেছই বা কেন আবার গুছোচ্ছেও কেন? মিসেস সাটক্লিফ বললেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করছো? এরা ভাবেন যে তোমার বব মামা আমার মালপত্তের ভেতরে কিছু ঢুকিয়ে রেখে গেছেন।
ডোরেক ওকোনর বেশ হাসিখুশি মুখ করে বলে, সব খুলে দেখলাম কিছুই পাওয়া গেল না। সব গুছিয়ে রাখা যাক। টেলিফোনে এক কাপ চায়ের কথা বললেন মিসেস সাটক্লিফ। ওকোনর মালপত্র গোছাতে বসে নিপুণ হাতে চটপট কাজ করে। মিসেস সাটক্লিফ প্রশংসার চোখে বলে আপনার মা তো আপনাকে বেশ শিখিয়েছে।
স্থানীয় সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ : গতকাল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক ব্যক্তিকে পেশ করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, সে চুরি করার উদ্দেশ্যে মিঃ হেনরি সাটক্লিফের বাড়িতে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করেছিল। মিসেস সাটক্লিফের শয়নকক্ষে ঢুকে লোকটা সব জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করে রেখেছিল। সেই রবিবার সকালে বাড়ির বাসিন্দারা সবাই গীর্জায় গিয়েছিলেন, এবং সেই অবসরে লোকটা অতসব কাণ্ড করতে পেরেছিলো। প্রকাশ্য আদালতে লোকটা বলেছে যে তার নাম অ্যানড বল এবং তার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। সে স্বীকার করেছে। সে কোনো কাজকর্ম না থাকায় অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় ওই কাজে সে রত হয়েছিল। জেনিয়া তখন বললো, কিছুতেই বুঝতে পারছি না পুলিশ কি করে টের পেলো আমাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে। স্বামী বললো, তুমি ঠিক জানো তো জোয়ান একেবারে নিঃসন্দেহ। তারপর জোয়ান জেনিয়াকে বললো, মেডোব্যাঙ্ক কিন্তু সাধারণ স্কুল নয় আর তোমাকে যেন কেউ লোভী না বলে। জেনিয়া বললো যে তার মেডোব্যাঙ্কে যেতে ভালো লাগছে না। আমার এক বন্ধুর জ্যাঠার মেয়ে সেখানে পড়ত। সেখানে রানীর সঙ্গে যদি নেমন্তন্ন খেতে বসে তো কেমন করে বসবে, কথা বলবে খাবে, বিচ্ছিরি।
বুঝতে পারছ না তোমার কত ভাগ্য, মিস বুলস্ট্রোড কি আর সব মেয়েকে নেন। নেহাত তোমার বাবার প্রতিষ্ঠা আর তোমার মাসীর প্রতিপত্তি ছিলো তাই।
.
মেডোব্যাঙ্ক স্কুলের পত্রগুচ্ছ
জুলিয়া আপনজন মাকে লিখলো মা এতদিনে আমার সব চেনা হয়ে গেছে। বেশ ভালো লাগছে। আরেকজন নতুন মেয়ে এসেছে জেনিয়া, আমরা দুজনে বন্ধু হয়েছি, দুজনে টেনিস খেলি…। ইত্যাদি।
জেনিয়া সাটক্লিফ তার মাকে লিখলো—
মামনি,
অতটা খারাপ লাগছে না। এখানে যতটুকু আশা করেছিলাম তার চেয়ে ভালো সময় কাটছে, আবহাওয়া চমৎকার…ইত্যাদি।
সবশেষে তোমাদের আদরের জেনিয়া।
.
প্রারম্ভের দিনগুলো
কতরকম গল্পগুজব হয় শিক্ষয়িত্রীদের ঘরে। কে কোন দেশে গিয়েছিল কি দেখেছিল। একসময়ে শুরু হল অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা। নতুন তৈরি ক্রীড়ামঞ্চে সবাই উৎসাহিত, দালানটা যে বেশ সুন্দর হয়েছে সেকথাও মোটামুটি সবাই স্বীকার করলেও প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বক্তব্য আছে। বড়ো গলায় মিস প্রিয়ার বললো, দুনিয়ার অকৃতজ্ঞতার কি শেষ আছে…মানুষ এত ভীরু যে সত্যি কথাটা স্বীকার করে নেবার মতো সাহস নেই–আমি কিন্তু সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কতবার যে কত লোকের কলঙ্ক ফাঁস করে দিয়েছি। ওসব আমি গন্ধে গন্ধে টের পাই।
আঃ কী আশ্চর্য সেসব কাহিনী…মাদমোয়াজেল ব্লাশ যেন অবাক, আপনার ভালো লাগে এইসব করতে?
না, তবু কর্তব্য কিন্তু সমর্থন পাইনি।
মিস বুলস্ট্রোড কর্তৃত্বের সুরে বলেন, ব্যাস ঢের হয়েছে শাইস্তা, তোমার বাড়ির লোকেরা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন ইংরেজদের আচার-ব্যবহার শেখবার জন্য। এইসব শারীরিক কসরতে তোমারই ভালো, রঙও ভালো হবে, বুকের গড়নও।
চ্যাডির একটা অসামান্য গুণ যে সবসময় ওকে হাতের কাছে পাওয়া যায়। যখনই প্রয়োজন। হয় তখনই এগিয়ে আসে। সংঘর্ষের আঘাত বহন করে নেবার জন্য পরম বিশ্বস্ততায় মাথা পেতে দেয়। যেমন দিয়েছিলো গ্রীষ্মপর্বের আরম্ভ হবার দিনটিতে লেডি ভেরোনিকার বেলায়, মিস বুলস্ট্রোড জানেন যে এই বিপুল প্রাসাদের ভিত্তি চ্যাডির অবিচল দৃঢ়তার ওপরেই।
এই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে এরা দুজনে ভালোই আয় করেন। এখন অবসর নিলেও বাকি। জীবনটা, ভালোভাবে কাটাবার একটা আয় তাদের থাকবে। সম্ভবত তিনি অবসর নিলেও চ্যাডি নেবে না, তার কাছে স্কুলটাই ঘরবাড়ি। তিনি চলে যাবার জন্য মনস্থির করে নিয়েছেন।
মিস বুলস্ট্রোড রচনাগুলো দেখে দেখে নম্বর দেওয়া শেষ করলেন। খাতা দেখতে দেখতে মনে হল আপনজন মেয়েটি বেশ মৌলিক। জেনিয়ার সাটক্লিফের কল্পনাশক্তি একেবারেই নেই কিন্তু তথ্যজ্ঞান বেশ ভালো। মেরী ভাইজের স্মরণশক্তি আশ্চর্য।
.
.
ঝড়ের মুখে কুটো
বিড়বিড় করে ওঠে বুড়ো ব্রিগস, মন্দ নয় হে মন্দ নয়। পছন্দ হয়েছে নতুন সাকরেদটির মাটি কোপানো, এটা তারই স্বীকৃতি। ভেবেছে ছোকরার বেশি তারিফ করবে না, নইলে পেয়ে বসে।
জোয়ান মানুষটা বুঝে ফেলেছে যে কাজে ব্রিগসের নিজের যে গতি তার চেয়ে তার কাজ হয়েছে অনেক দ্রুত আর অনেক ভালো।
অ্যাডাম জানে ব্রিগসের এই বক্তৃতায় মেয়ে মানুষ কথাটার অর্থ মিস বুলস্ট্রোড।
হেঁটে আসেন মিস বুলস্ট্রোড, সুপ্রভাত ব্রিগস।
সুপ্রভাত–মেমসাহেব, অ্যাডাম ওই জায়গাটা চমৎকার খুঁড়েছে..টেনিস কোর্টে তারের জালটা ঝুলে গেছে ব্রিগস, এখনই ঠিক করে দাও।
এই সামনেটায় কি ফুল লাগাচ্ছো, অ্যাস্টার লাগিও না, ডালিয়া লাগিও বলে হাঁটা দিলেন। তারপর মিস বুলস্ট্রোড হেসে মেয়েদের স্বাধীনতার সঙ্গে চাই কিছু কড়া নজর, কি বলল ইলিয়ানর?
হু
উপায় বের করে ফেলবো।
নিশ্চয়ই…মেডোব্যাঙ্কে কী কখন কোনো অপকীর্তি ঘটেছে।
মিস বুলস্ট্রোড হেসে বললেন, ঘটেনি অবশ্য। তবে স্কুল চালাতে গিয়ে কি আর ঘটনার অভাব ঘটে। জীবন কখনও একঘেয়ে হয়ে ওঠে না। ইলিয়ানর এখানকার জীবন কি তোমার একঘেয়ে ঠেকে?
মিস ভ্যান্সিটার্ট বললো, না মোটেই না। এখানকার কাজ আমার খুব ভালো লাগে।…কী যে তৃপ্তি পাই। তুমি যে রকম সাফল্য অর্জন করেছে তাতে তোমার গর্ববোধ করা উচিত অনোরিয়া।
জানি…অবশ্য সংসারে কোনো জিনিসকেই কেউ কল্পনার মাপে মাপতে পারে না…
আচ্ছা ইলিয়ানর একটা সত্যি কথা বলবে?..যদি এখন আমার জায়গায় তুমি বসো তুমি কী কী পরিবর্তন করতে চাইবে? আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
আমি কোনো পরিবর্তন করতে চাই না। তুমি যে প্রাণ সঞ্চার করে গেছ, গোটা প্রতিষ্ঠানটাই এখন সর্বাঙ্গসুন্দর।
অর্থাৎ তুমি একইভাবে স্কুলটা চালাতে চাও। |||||||||| নিশ্চয়ই। মনে হয় না আর কিছু করা যায়। মিস বুলস্ট্রোড ভাবেন : আমাকে সন্তুষ্ট করবার
ওই কথাগুলো বললো। কে জানে, মানুষ চেনা বড়ো শক্ত তা যতই তুমি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হও। যত বছরের পরিচয়ই থাক। গড়ার ইচ্ছে যাদের থাকে, তারা কোনো না কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবেই। অবশ্য সে কথা মুখ ফুটে বলা শশাভন নয়…ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের মা-বাবাদের সঙ্গে স্কুলকর্মীদের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রেই শোভন আচরণ কাম্য।
আচার ব্যবহারে ইলিয়ানর বেশ পটু, তিনি বললেন, তবু সবসময়েই তো সমন্বয় সাধন করে যেতে হয়, নয় কী? মানে আদর্শের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে। মিস ভ্যান্সিটার্ট বলে, ও হা সে তো হবেই। স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠতেই ভ্যান্সিটার্ট বলেন, আমার জার্মান ক্লাস আছে চলি। বলে মিস ভ্যান্সিটার্ট চলে গেলেন। তাড়াতাড়ি পা চালালো ও তার পদক্ষেপে স্থৈর্য আছে…পেছনে মিস বুলস্ট্রোডও চললেন। আরেকটু হলেই আইলিন রীচের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগতো, সে পাশের সরু গলি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বোধহয় বেরিয়ে আসছিল।
জেনিয়া রেগে তার র্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে, নাঃ অসম্ভব, এটা দিয়ে খেলা যায় নাকি? যাচ্ছে তাই।
আঃ কি হচ্ছে জেনিয়া।
দেখো না ক্ষমতাই নেই, ভারসাম্য একেবারেই গেছে।
জুলিয়া বলে, তবুও আমার পুরানোটার চেয়ে অনেক ভালো। আমারটা তো একেবারে ন্যাতা। নতুন করে টানা দেবার কথা ছিল। কিন্তু মা ভুলেই গেছে।
অ্যাডাম টেনিস মাঠে তারের জাল টেনে টেনে সোজা করছিল। কাজ করতে করতে মনের আনন্দে শিস দেয়। হঠাৎ ক্রীড়ামঞ্চে দরজা খুলে ফরাসি শিক্ষিকা মাদমোয়াজেল উঁকি মারে।
অ্যাডাম অবাক, কী করে কী ওখানে? তার অমন চোর চোর ভঙ্গী দেখে সন্দেহ জাগে।
এখানকার মাঠগুলো সুন্দর তার ওপর সাঁতার দীঘি আছে। খেলা দেখবার আসল সিঁড়ি আছে। মাদমোয়াজেল ব্লাশ বললেন অ্যাডামকে যে ইংল্যান্ডে খেলাধূলাকে খুব বড়ো করে দেখ। অ্যাডাম বললেন, তা হবে মিস।
তুমি টেনিস খেল? চোখ দুটোকে ঈষৎ আহ্বান, মাদমোয়াজেল ব্লাশকে দেখে মনে হয় না যে, সে মেডোব্যাঙ্কের মতো স্কুলে ফরাসি শিক্ষিকা হবার যোগ্য।
না আমি টেনিস খেলি না, সময় পাই না। তবে কি ক্রিকেট খেল।
সে ছোটোবেলায় খেলতাম।–অ্যাডাম মনে মনে ভাবতে লাগল যে তিনি কোন মতলবে ক্রীড়ামঞ্চে এসেছিলেন।