নিজের ছোটো বাগানটির একমনে পরিচর্যা করছিলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। কাজ শেষ করে পরিতৃপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন বাগানের সীমানার বাইরে রাস্তার পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে আসছে জ্যাসন ও মেরিনার সেক্রেটারি এলা।
তার লজ-এর পাশ দিয়ে যাবার সময় এলাকে ডেকে সুপ্রভাত জানালেন মিসেস ব্র্যান্ট্রি। বেশ চমকে উঠলো এলা।
ওঃ সুপ্রভাত। আমি একটু ফোন করতে গিয়েছিলাম, আমাদের ফোনটা আবার বিকল হয়েছে।
-সত্যিই ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর। তোমার যখনই দরকার হবে আমার ফোনটা ব্যবহার করতে পারো।
–ধন্যবাদ। বলেই হেঁচে ফেললো এলা।
–তোমার কি হে-ফিভার হয়েছে? আমার কাছে ভালো ওষুধ আছে।
-না না, আমার এটা প্রায়ই হয়। অ্যাটমাইজার-এর মধ্যে ওষুধ টেনে নিই আমি। ধন্যবাদ আপনাকে।
চলে যাবার পথে আরও বেশ কয়েকবার হাঁচলো সে।
কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন মিসেস ব্যান্ট্রি; তারপর কৌতূহল দমন করতে না পেরে গসিংটন হল-এ ফোন করে জেনে নিলেন ওখানকার ফোন ঠিকই আছে। একান্তে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছিল এলা, মিথ্যে বলছে তাকে। বান্ধবী জেন মারপলকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে কথাটা জানিয়ে দিলেন তিনি।
কথা বলতে সব থেকে আগ্রহী বলে মনে হলো ডোনাল্ড ম্যাকলিনকে। এই সাংবাদিকটি সেদিন গসিংটন-হল এর পার্টিতে উপস্থিত ছিল।
–কেমন তদন্ত এগোচ্ছে ইনসপেক্টর? আমার জন্য ছিটেফোঁটা কিছু খবর নিয়ে এসেছেন নাকি?
-এখন নয়, পরে হয়তো দিতেও পারি।
–এই ঠেকিয়ে রাখার অভ্যেসটা সব পুলিশ অফিসারের মজ্জাগত, তাই না চীফ ইনসপেক্টর। আপনারা আমাদের কিছুতেই কিছু খবর দিতে চান না। তা এখানে কি মনে করে এসেছেন?
-তোমার কাছেই এসেছি।
–কি সর্বনাশ! আপনি কি মনে করেন আমি হিথার বেডকক-কে খুন করেছি, অথবা মেরিনা গ্রেগকে খুন করতে গিয়ে মিসেস বেডকককে খুন করে ফেলেছি?
-আমি ওরকম কিছু বলছি না।
না, আপনি তা বলছেন না, কেননা আপনি সবসময় সঠিক থাকতে চান। ধরে নিলাম, আমার সেদিন খুন করার সুযোগ ছিল, কিন্তু আমার মোটিভটা কি?
–আমি শুধু তোমার মুখ থেকে সেদিনের কথা শুনতে চাই।
-সে তো পুলিশকে আগেই বলেছি। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অপমানজনক। আমার মতো একজন সাংবাদিকের নাকের ডগায় খুনটা হলো, অথচ আমি টেরই পেলাম না যে খুনটা কে করলো? আমি কেবল ঐ মহিলাকে একটি চেয়ারে বসে খাবি খেতে খেতে মরে যেতে দেখলাম। আমার আরও দেখা, আরও জানা উচিত ছিল। তবে আমি নিশ্চিত যে বিষটা মেরিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়েই গ্লাসে মেশানো হয়েছিল, মিসেস বেডকক-এর জন্য নয়।
–সে যাই হোক, তুমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলে, তখন তোমার সঙ্গে কে কে ছিল?
লন্ডনের মার্গট বেনস, তার ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত ছিল।
–তুমি তার সঙ্গে পরিচিত?
-হ্যাঁ, প্রায়ই এখানে ওখানে দেখা হয়ে যায়। বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার পেশায় বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। সিঁড়ির এমন জায়গায় ক্যামেরা রেখেছিল যেখান থেকে মেরিনার সঙ্গে প্রতিটি অতিথির সাক্ষাৎকারের ছবি তোলা যায়। লোলা ব্রিডস্টার আমার আগে আগে উঠছিলেন। আমি অবশ্য চুলের রং ও স্টাইল বদলে যাওয়ার কারণে প্রথমে ওঁকে চিনতে পারিনি।
–আচ্ছা, সেই সময় মেরিনার মধ্যে কি বিশেষ কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন?
-আশ্চর্য, সত্যিই তো! আমার তো এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল মেরিনা এখনই মূচ্ছা যাবেন, আপনি বললেন বলে মনে পড়লো।
-আচ্ছা! ধন্যবাদ। আমাকে আর কিছু বলার আছে তোমার?
–আর কি থাকতে পারে?
–আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, তুমি কোনো কথা খেতেও পারো।
–একথাটা তাহলে বিশ্বাস করেন যে, এই হত্যাকাণ্ডে আমার কোনো হাত নেই। তাই তো? এর জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমিই হয়তো মেরিনা-র প্রথম স্বামী। লোকটা এতই অকিঞ্চিত্বর ছিল যে, তার নামই কেউ জানে না।
–তাহলে তুমি বোধহয় প্রেপ স্কুলে থাকার সময় বা ন্যাপি পরে থাকার সময়ই সেই বিয়েটা করেছিলো। কেননা, সেটা অনেকদিন আগের ব্যাপার। আচ্ছা, চলি তাহলে। আমাকে এখনই ট্রেন ধরতে হবে।
নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে টেবিলের সামনে বসেছিলেন ক্র্যাডক। সামনে স্তূপ করে রাখা কাগজগুলো দেখছিলেন। কাজ করতে করতে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন।
-লোলা ব্রিডস্টার কোথায় উঠেছেন?
–স্যাভয় হোটেলে, স্যার। স্যুট এর নাম্বার ১৮০০। উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
–আর মিঃ ফেন?
–উনি ডরচেস্টারে আছেন, দোতলায় ১৯০ নম্বর ঘর।
–ঠিক আছে।
স্যাভয় হোটেল-এ গিয়ে লোলা ব্রিডস্টার-এর কাছ থেকে সাদর অভ্যর্থনা পেলেন ক্র্যাডক। মহিলা যে একসময়ে দারুণ সুন্দরী ছিলেন, তা এখনও বোঝা যায়। মেরিনা-র মতো শান্তশ্রী নয়, খুবই চটকদার। কড়া প্রসাধন করার অভ্যেস আছে।
স্থানীয় পুলিশের মতো আপনিও কি আবার একরাশ ভয়ংকর প্রশ্ন করবেন নাকি?
আশা করছি খুব ভয়ানক হবে না সেগুলি।
–আমার কিন্তু মনে হয়, তাই হবে। তাছাড়া আমি সন্দেহ করছি, খুব বড়ো রকমের একটা ভুল হয়ে গেছে, এই ঘটনায়।
–আপনিই কি সত্যিই তাই মনে করেন?
–নিশ্চয়, আপনি কি ঐ খবরের কাগজগুলোর মতো সত্যিই মনে করেন, মেরিনাকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল? ওকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে, সবাই ওকে খুব ভালোবাসে।
–আপনিও।
–আমি সবসময়েই মেরিনা-র প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলাম।
-ওঃ সবসময় বলবেন না মিস ব্রিডস্টার, এগারো বছর আগে আপনাদের মধ্যে কি একটা গণ্ডগোল হয়েছিল না?
–সেটা? ও কিছু নয়, তখন আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম অবশ্য। রব আর আমার মধ্যে সাংঘাতিক ঝগড়া হত সেসময়। তখন আমরা কেউই ঠিক স্বাভাবিক ছিলাম না। মেরিনা ওর প্রেমে পড়ে গেল, আর ওকে আমার সংসার থেকে নিয়ে গেল।
–আপনি কি খুব বেশি আঘাত পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, আমার তখন তাই মনে হয়েছিল। এখন কিন্তু মনে হয় আমার পক্ষে সেটা ভালোই হয়েছিল। আমি ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে বেশি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, ওদের কোনো ঘর থাকবে না, এটা আমি ভাবতে পারছিলাম না। ওদের জন্যই বিয়েটা ভাঙতে চাইছিলাম না।
আপনি সেসময় অনেক কথাই বলেছিলেন, তাই না? আপনি তো মেরিনাকে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলেন?
-ওরকম অবস্থায় অনেকেই অনেক কিছু বলে, তাই বলে এতদিন পরে এসে আমি মেরিনাকে খুন করবো নাকি। আপনি জানেন, তারপরেই আমি আবার বিয়ে করেছি, এবং সুখী হয়েছি। ওসব ইমোশান বেশিদিন টিকে থাকে না ইনসপেক্টর। আর তাছাড়া আমাদের বক্তব্য কার্যকলাপ ঐ ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোতে বেশ অতিরঞ্জিত করেই লেখা হয়, জানবেন।
এরপর ডরচেস্টারে গিয়ে মিঃ ফেন-এর সঙ্গে দেখা করলেন চীফ ইনসপেক্টর, তিনি জানালেন একসময় মেরিনার সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল তার, তবে চারবছর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। সেদিন পার্টিতে অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে খুবই খুশী হয়েছিল মেরিনা। আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছিল। এরপর তিনি পানীয়ের টেবিলের দিকে চলে যান, কাজেই মিসেস বেডককের মৃত্যুর কারণ বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা নেই তার। এটা ঠিক, মেরিনা তাকে প্রত্যাখ্যান করে অন্য পুরুষকে বরণ করায় মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা মনে আসে না তার। এছাড়া আর কিছু বলার নেই তার।
নোটবুকে লেখা শেষ নামটির দিকে আর একবার তাকালেন ক্র্যাডক। ঐ মহিলার ফোন নম্বরে বারবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মার্গট বেত্সকে নিজে গিয়েই ধরতে হবে।
মার্গট-কে পাওয়া গেল আউটডোরে বিজ্ঞাপনের ছবি তুলতে ব্যস্ত অবস্থায়। ইনসপেক্টর-এর আগমনে সে কাজ গুটিয়ে তাকে নিজের অফিসে নিয়ে এলো।
–আপনার জন্য আমি কি করতে পারি ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক?
–গসিংটন হল-এর ঐ দুর্ঘটনার বিষয়ে যদি দয়া করে কিছু বলেন। শুনেছি, আপনি সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন।
-হ্যাঁ। আমি ওখানে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। মানে ঐ কাজের জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল।
প্রোফেশনাল ফোটোগ্রাফার হিসেবে?
–হ্যাঁ, আমাকে কয়েকটি বিশেষ ধরনের ছবি তুলতে বলা হয়েছিল। এরকম কাজ আমি প্রায়ই করি। ফিল্ম স্টুডিওর জন্যও অনেক ছবি তুলেছি। তবে, সেদিন আমি মেলা-র কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম। এরপর মেরিনা ও জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে বিশিষ্ট অতিথিদের সাক্ষাৎকারের কয়েকটা ছবি তুলেছি।
-বুঝতে পেরেছি। আপনি আপনার ক্যামেরাটা সিঁড়িতে বসিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য। ওখান থেকে আমি বেশ ভালো করে একটা অ্যাংগেল পাচ্ছিলাম। নিচ থেকে যারা উঠছিলেন তাদের ক্যামেরায় পাওয়া যাচ্ছিল, এবং পরমুহূর্তে ক্যামেরা ঘুরিয়ে তারা মেরিনার কাছে পৌঁছে গিয়ে আপ্যায়িত হচ্ছেন, এটাও ধরা যাচ্ছিল। মানে, আমাকে খুব একটা নড়াচড়া করতে হচ্ছিল না।
–আপনি ওখান থেকে মেরিনাকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন?
–খুব ভালোভাবে।
–আর জ্যাসন হাডকে?
–সবসময় নয়। উনি খুবই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পানীয় এনে দিচ্ছিলেন, অতিথিদের একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। এই ধরনের কাজ আর কি, আর আমি ঐ মিসেস বেডকক-কে পানীয় নিতে দেখিনি। আসলে কোনজন ছিলেন ঐ ভদ্রমহিলা, তা-ই আমি বুঝতে পারছি না।
–মেয়রের আসাটা মনে আছে আপনার?
-হ্যাঁ, মেয়রকে মনে আছে আমার। তিনি তো সরকারী পোশাক পরেই এসেছিলেন, চেন টেন সমেত। তার ছবিও তুলেছি। প্রোফাইলটা বেশ নিষ্ঠুর।
–তার ঠিক আগেই মিস্টার ও মিসেস বেডকক উঠেছিলেন।
–দুঃখিত, তা-ও আমার ওঁদের চেহারা মনে পড়ছে না।
-আপনি কি লক্ষ্য করেছিলেন, মেরিনাকে একটা সময় অসুস্থ দেখাচ্ছিল, বা তার মুখের ভাব অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল?
মার্গট বেনস সামনে ঝুঁকে পড়ে সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে নিল। সেটাকে লাইটার দিয়ে জ্বালালো। যদিও প্রশ্নটার উত্তর দিল না, তবু ইনসপেক্টর তাকে উত্তর দেবার জন্য কোনো চাপ দিলেন না। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। একসময় মেয়েটি হঠাৎই বললো, আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
-কেন না, এই প্রশ্নটার একটা বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাওয়া খুবই দরকার আমার।
–আমার উত্তরটা বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হয় আপনার।
-হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয়, মানুষের মুখের ভাব পরিবর্তন ক্যামেরার চোখ দিয়ে লক্ষ্য করা আপনার অভ্যেস আছে। কেননা, আপনি বিশেষ কোনো মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করার অপেক্ষায় থাকেন। আপনি কি সেদিন সেরকম কিছু দেখেছিলেন?
–আরও কেউ ওটা দেখেছে, তাই না?
–হ্যাঁ একাধিক লোক। কিন্তু সেটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করেছে।
–যেমন?
-একজন বলেছে মেরিনাকে চমকে উঠতে দেখেছিল, আর একজন বলেছে, ওঁর দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত শীতলতা জমাট বেঁধে উঠতে দেখা গিয়েছিল।
-ফ্রোজেন লুক?
-হ্যাঁ। একজন আবার বলেছেন সেই মুহূর্তে মেরিনা-কে দেখে তার টেনিসনের লেডি অব শ্যালটকে মনে পড়ে গিয়েছিল, সেই যে–দি মিরর ক্র্যাকড় ফ্রম সাইড টু সাইড, দি ডুম হ্যাঁজ কাম আপন মি, ক্রায়েড দি লেডি অব শ্যালট।
-ওখানে কোনোও আয়না ছিল না, তবে থাকলে হয়তো সেটা ফেটে যেত।
একথা বলেই উঠে দাঁড়ালো মার্গট,একটু অপেক্ষা করুন। বর্ণনা করার থেকেও ভালো জিনিস দেখাবো।
অফিসঘরের একপ্রান্তের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল মার্গট। একটু পরেই বেরিয়ে এলো সে-দেখুন, দরকারের সময় আসল জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও অবশেষে পেয়ে গেছি।
ক্র্যাডকের কাছে সে তাকে একটি ছবির প্রিন্ট দিল। ক্র্যাডক দেখলেন, মেরিনা গ্রেগ-এর একটি চমৎকার ফোটোগ্রাফ। যে মহিলাটির সঙ্গে তিনি করমর্দন করছেন, ক্যামেরার দিকে পিছন করে থাকায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেরিনা সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে নেই। ক্যামেরার একটু বাঁদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে সেদিকে কোনোও কিছু দেখে তার এমন মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, যা অনুভূতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা অসাধ্য। মরণোন্মুখ একটি মানুষের চোখে একবার এরকমই দৃষ্টি দেখেছিলেন ক্র্যাডক।
–ছবিটা কি আমি রাখতে পারি?
নিশ্চয়ই। এর নেগেটিভটা আছে আমার কাছে।
-এটা আপনি প্রেস-এ পাঠাননি কেন? এরকম নাটকীয় একটি ছবির জন্য কোন কোনো কাগজ ভালো দাম দিতে রাজি হতো।
-যদি হঠাৎ কোনো মানুষের ভেতরটা দেখতে পাওয়া যায়, তার থেকে আর্থিক ফায়দা তুলতে লজ্জা করে না কি?
-মেরিনা গ্রেগকে ভালোভাবে জানতেন?
–না।
–আপনি তো স্টেটস থেকে এসেছেন, তাই না?
-আমি জন্মেছি ইংলন্ডেই। ট্রেনিং নিয়েছি আমেরিকায়। তারপর এই বছর তিনেক হলো এখানে এসেছি।
-কোথায় ট্রেনিং নিয়েছেন?
রেইনগার্ড স্টুডিওতে। কিছুদিন অ্যান্ড্রু কুইল্প-এর সঙ্গে ছিলাম। ওনার কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।
-আপনি সেভেন স্প্রিং-এ থাকতেন, তাই না?
–আপনি তো আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন দেখছি।
–আপনি তো একজন স্বনাম খ্যাত ফোটোগ্রাফার, আপনার সম্বন্ধে কাগজপত্রে তো বহুবার অনেককিছু লেখা হয়েছে। তা, আপনি ইংলন্ডে এলেন কেন?
-ও, আমি এই দেশটাকে পছন্দ করি। এখানেই জন্মেছি। অবশ্য খুব ছোটোবেলাতেই আমেরিকায় চলে গিয়েছিলাম।
–আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে আরো কিছু বলতে পারেন।
–আপনি কি বলতে চাইছেন?
–আপনি যা বলছেন, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে মেরিনা গ্রেগকে চিনতেন।
–প্রমাণ করুন। আপনি কল্পনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
-না, আমি তা করছি না, আর এটা আমি প্রমাণ করতে পারি। আপনার পাঁচবছর বয়েসে মেরিনা আপনাকে দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে আপনি চারবছর ছিলেন। এটা স্বীকার করছেন না কেন?
ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো মার্গটের মুখ, উঠে দাঁড়ালো সে।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। এটা সত্যি। মেরিনা গ্রেগ আমাকে তার সঙ্গে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মায়ের আটটি সন্তান ছিল, কোথাও কোনো বস্তিতে থাকতো সে। বোধহয় প্রায়ই চিত্রতারকাদের নিজের দুঃখ দৈন্যের কথা জানিয়ে চিঠি লিখতো, এরকম বহু লোকেই লিখে থাকে। নিজের সন্তান যাতে সব রকম সুখ সুবিধে পায়, যা সে নিজে কখনো দিতে পারবে না, তার জন্য তাকে দত্তক নিতে অনুরোধ করে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে জঘন্য বলে মনে হয়।
–আপনারা তিনজন ছিলেন। তিনটি শিশুকে ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।
-হ্যাঁ, আমি, রড ও অ্যাংগাস। অ্যাংগাস আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। রড ছিল একেবারেই শিশু। আমরা খুব সুন্দর জীবনযাপন করছিলাম। সব রকমের সুখ-সুবিধে ছিল। তার ওপর মেরিনা ছিলেন আমাদের মা, আমাদের আদর করতেন, আমাদের নিয়ে ছবি তুলতেন। অসাধারণ সুন্দর সেন্টিমেন্টাল সব ছবি।
-কিন্তু তিনি সত্যিই বাচ্চা চেয়েছিলেন, সবটাই পাবলিসিটি স্টান্ট নয়, তাই না?
–হয়তো তাই, তিনি সন্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের চাননি, এটা একটা মহৎ অভিনয় মাত্র। আমার পরিবার, নিজের একটা পরিবার থাকা কত সুখময় ইত্যাদি দেখাতে চেয়েছিলেন। আর ইজি তাকে এটা করতে দিত, তার একটু বোঝা উচিত ছিল।
–ইজি মানে ইসিডোর রাইট?
–হ্যাঁ, মেরিনার তৃতীয় বা চতুর্থ স্বামী। আমি ভুলে গেছি। উনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি মেরিনাকে বুঝতেন, এবং মাঝে মাঝে আমাদের জন্য চিন্তিত হতেন। আমাদের প্রতি খুবই সদয় ছিলেন, কিন্তু কখনও আমাদের পিতা হবার ভান করতেন না। নিজের লেখা নিয়ে থাকতেই ভালোবাসতেন। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে তাকে একজন শক্তিমান নাট্যকার হিসেবে গণ্য করা হবে।
-এটা কতদিন ধরে চলেছিল?
-যখন এই অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন মেরিনা। না, তা অবশ্য পুরোটা ঠিক নয়, তিনি যখন জানতে পারলেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। নিজের সন্তান পেতে চলেছেন, ততদিন পর্যন্ত। তারপর ওঁর কাছে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাদীক্ষার জন্য অনুদানের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফস্টার হোম-এ পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেউ বলতে পারবে না মেরিনা আমাদের জন্য ভালো ব্যবস্থা করে দেননি। কিন্তু সে আমাদের কখনো চায়নি। সে শুধু নিজের গর্ভজাত সন্তান চেয়েছিল।
–এজন্য তাকে দোষ দিতে পারা যায় না।
–নিজের সন্তান চাওয়ার জন্য দোষ দিচ্ছি না তাকে। কিন্তু আমাদের কথা কে ভেবেছিলো? তিনি আমাদের নিজের বাবা-মা-এর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, আমাদের নিজস্ব স্থান থেকে তুলে এনেছিলেন। আমার নিজের মা, কিন্তু তাঁর নিজের সুবিধের জন্য আমাকে বিক্রি করে দেননি। ঐ বোকা মহিলাটি আমার সুখ-সুবিধের কথাই ভেবেছিলেন, আমার শিক্ষাদীক্ষা, সমৃদ্ধিময় জীবনযাপন, ইত্যাদির কথা। ভেবেছিলেন, আমার পক্ষে সবথেকে ভালো জিনিসটাই দিচ্ছেন আমাকে। আমার পক্ষে ভালো? যদি তিনি জানতেন–
–এখনও আপনার মনে তিক্ততা আছে?
-না, এখন আর নেই। পুরোনো কথা বলা মানে সেই তিক্ত অতীতে ফিরে যাওয়া, তাই এরকম মনে হচ্ছে।
-মেরিনার শিশুটির কথা তখনই তোমরা জেনেছিলে?
–নিশ্চয়ই, সবাই জানতো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন মেরিনা তখন। আর শিশুটি জন্মালো জড়বুদ্ধি হয়ে। উপযুক্ত শিক্ষাই হয়েছে মেরিনার। তিনি আর আমাদের ফিরিয়ে নেননি।
–তাকে আপনি খুব ঘৃণা করেন?
–কেন করবো না? কোনো মানুষের প্রতি যতখানি অবিচার করা যায়, তাই করেছেন উনি। প্রথমে আমাদের বুঝতে দিলেন যে আমাদের তিনি চান, ভালোবাসেন। তারপরেই জানা গেল, ঐ সবটাই তাঁর মুখোশ। প্রবঞ্চনা।
–তোমার ঐ দুটো ভাই-এর কি হলো।
–আমরা পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। রড মিক্স ওয়েস্টের কোথাও চাষবাস করছে, তার স্বভাবটাই খুব আনন্দময়, বরাবরই তাই ছিল। অ্যাংগাস এখন কোথায় আছে জানি না।
মেরিনা কি সেদিন আপনাকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন? নাকি আপনাকে খুশি করার জন্যই ফোটোগ্রাফার হিসেবে আপনাকে ডেকেছিলেন?
-আরে, উনি তো এসব ব্যবস্থাপনার কথা কিছুই জানতেন না। আমিই তাকে দেখতে চেয়েছিলাম তাই একটু চেষ্টা করেছিলাম, কাজটা পাওয়ার জন্য। দেখতে চেয়েছিলাম, এখন মেরিনা-কে দেখতে কেমন হয়েছে।
-তারপর কি হলো?
-উনি আমাকে চিনতেই পারলেন না, জানেন? পাঁচবছর বয়স থেকে নবছর বয়স পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম, তবু আমাকে একটুও চিনতে পারলেন না।
–আপনি তাকে আপনার পরিচয় দেননি?
–না, সেটা আমি কোনোদিনই করবো না।
–আপনি কি মেরিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, মিস বেনস?
হেসে উঠলো মেয়েটি।
–কি হাস্যকর প্রশ্ন করছেন ইনসপেক্টর। কিন্তু, আমার মনে হয়, এটা আপনার কাজেরই অঙ্গ। না, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, আমি ওকে হত্যা করতে চেষ্টা করিনি।
-কিন্তু কে ওঁকে হত্যা করতে চায়, সে বিষয়ে কি আপনার কোনো ধারণা আছে?
-না, এ বিষয়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই, যে কেউই হতে পারে। গুডবাই চীফ ইনসপেক্টর। আমার সত্যিই আর কিছু বলার নেই।
ষোলো নম্বর অব্রে রোডে তরুণী মিসেস বেকার তার স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলো। প্রাতরাশ তৈরি করে দুটি প্লেটে সাজালো মিসেস বেকার, ওরফে চেরী। মিক্সড় গ্রীল-এর গন্ধ পেয়ে সচকিত হলো তার স্বামী জিম বেকার।
-কি ব্যাপার চেরী? স্পেশাল খাবার? আজ কি আমার জন্মদিন নাকি, না অন্য কিছু?
–তোমার বেশি করে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া উচিত।
–কে বলেছে?
–মিস মারপল। যদিও আমার মনে হয় ওনার নিজেরই আর একটু পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। ঐ বুড়ী মিস নাইট কেবল ওঁকে কার্বোহাইড্রেট খাইয়ে রাখে।
ইনভ্যালিড-দের জন্য এটাই তো ঠিক পথ্য।
-উনি মোটেই ইনভ্যালিড নন, একটু বুড়ো হয়েছেন মাত্র। আর ঐ মিস নাইট কেবল আমাকে কিভাবে কাজ করতে হয় তা শেখাতে চেষ্টা করে। এমন কি রান্না নিয়েও জ্ঞান দিতে আসে, জানোনা? এ ব্যাপারটা অন্তত আমি ওর চেয়ে ভালো জানি।
নিশ্চয়ই! রান্নায় তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না চেরী। তা তোমার মিস মারপল হঠাৎ আমার খাবার-দাবারের কথা বললেন কেন? যখন ওঁর বাড়িতে কল সারাই করার কাজে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে কি দুর্বল বলে মনে হয়েছিল ওঁর?
স্বামীর কথা শুনে হেসে উঠল চেরী,–না না। উনি আমাকে বললেন, তোমার স্বামী খুবই সুপুরুষ।
-তুমি কি তা মনে কর না?
–আরে শোনোই না। বললেন, ওকে তুমি ভালো ভালো রান্না করে পেট ভরে খাওয়াবে, পুরুষ মানুষদের এটা খুব দরকার। বাজার থেকে টিন ফুট বা রেডিমেট পাই কিনে এনে গরম করে খেতে দিও না। অবশ্য আমি সেরকম খুব কমই করি।
-আমার জন্য সেরকম করা তোমার পক্ষে সম্ভবও নয়। ওগুলোর স্বাদ আমার ভালো লাগে না।
-তোমার ঐ খেলনা জাহাজ তৈরি ছেড়ে খাবারের দিকে মন দাও দেখি। আর শোনো, খেলনা তৈরির ঐ কিটটা তুমি তোমার ভাগনে মাইকেলের জন্য কিনেছে বলে আমাকে ভোলাতে এসো না। ওটা তুমি নিজে খেলবে বলেই কিনেছো।
মাইকেলের এখনও এটা নিয়ে খেলার বয়স হয়নি চেরী। সলজ্জভাবে বললো জিম।
-তার মানে তুমি পুরো সন্ধেটা এটা নিয়েই কাটাবে। কিছু গান শুনলে হত না? যে নতুন রেকর্ডাটার কথা বলছিলে, সেটা কি এনেছো?
-হ্যাঁ। ওইতো।
–ঐ রেকর্ডগুলো ফুল ভলুমে না শুনলে, পুরো মজাটা পাওয়া যায় না। কিন্তু তার তো উপায় নেই। এখনই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা দেওয়ালে আওয়াজ করে শব্দ কমাতে বলবেন। এভাবে কি থাকা যায়?
-হ্যাঁ, ঐ রেকর্ডগুলো আস্তে শোনার কোনো মানে হয় না। সবাই সেটা জানে। আর, ওর বেড়ালটা যে যখন তখন আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে, বাগানে গর্ত করে, তখন?
-সত্যি জিম, প্রথমে বাড়িটা পছন্দ হলেও, এখন আর একটুও ভালো লাগছে না, শুধু ঐ কুচুটে প্রতিবেশীদের জন্যে। একটুও প্রাইভেসি নেই এখানে।
–ট্রে-টা একটু সরিয়ে নেবে চেরী, এগুলো ঠিকমতো বিছিয়ে রাখতে পারছি না।
-তুমি আছো তোমার খেলনা নিয়ে, গান শোনার উপায় নেই, আমি বরং গ্ল্যাডিস ডিক্সনের কাছ থেকে ঘুরে আসি, একটা প্যাটার্ন আনবো ওর কাছ থেকে।
–ঠিক আছে ডার্লিং।
নতুন ড্রেস তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল গ্ল্যাডিস। বান্ধবীকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ফিল্ম স্টুডিও-র ক্যান্টিনে কাজ করে সে।
–স্টুডিওতে আজ নতুন কিছু খবর শুনলে নাকি গ্ল্যাডিস?
–মেরিনা গ্রেগ কাল এসেছিল স্টুডিওতে। ওঃ যা চেঁচামেচি করছিল না।
–কি নিয়ে চেঁচামেচি?
-আরে, একটাই পট থেকে সবাইকে কফি দেওয়া হয়েছিল, অথচ মেরিনা একটু চুমুক দিয়েই বললো, তার সন্দেহ হচ্ছে কফিতে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।
–তারপর কি হলো?
–মিঃ হাড, সবাইকে শান্ত করলেন। সত্যি, এ ব্যাপারে ওঁর তুলনা হয় না। মেরিনার কফিটা সিঙ্কে ঢেলে ফেলে দিলেন।
-কাজটা খুব হয়েছে।
তার মানে? কোন কাজটা?
কফিটা ফেলে দিলেন কেন? যদি সত্যিই ওর মধ্যে কিছু মেশানো থাকে, সেটা তো আর জানা যাবে না।
–তোমার কি মনে হয়, সত্যিই কফিতে বিষ ছিল?
-সেদিন পার্টিতে ওঁর গ্লাসেই তো বিষ মেশানো ছিল। একবার ব্যর্থ হয়েছে খুনী, আবারও তো চেষ্টা করতে পারে!
সেদিন মেরিনা তার চেয়ার থেকে উঠে যাবার পরক্ষণেই ওপর থেকে মার্বেলের একটা মূর্তি ঐ চেয়ারের ওপর পড়ে, চেয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মেরিনা ওখানে থাকলে কি হত বল তো? আমি ভাবছি, স্টুডিও-র কাজটা ছেড়ে দেবো।
-সে কি? কেন?
–আরে, মেরিনাকে মারতে গিয়ে খুনী একবার ভুল করে মিসেস বেডকককে মেরেছে, পরের বার যদি ভুল করে আমাকে মেরে ফেলে!
–হ্যাঁ, কথাটা ভাববার মতো বটে।
–জানো চেরী, সেদিন তো আমি ঐ পার্টিতে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম? মেরিনার কাছে কাছেই ছিলাম।
-যখন মিসেস বেডকক মারা গেলেন?
-না না, যখন ওঁর হাতের পানীয়ের পাত্রটা পড়ে গেল। ওটা ইচ্ছে করে করেছিল, আমি স্পষ্ট দেখেছি। ভদ্রমহিলা কি সুন্দর করে একটা ড্রেস পরেছিলেন, একদম নতুন! সেটা কেউ ওভাবে নষ্ট করে? আমি যদি ওরকম একটা ড্রেস পেতাম! সে যাই হোক, ঐ মজার ঘটনাটা মানে ইচ্ছে করে গ্লাস ফেলার ঘটনাটা ওদের বাটলার গিসিপ্পিকে নিশ্চয়ই বলবো।
–ঐ ইটালিয়ান বাটলারটা, ওকে কেন?
–আরে কিছু একটা কথা বলা যাবে তো ওর সঙ্গে। কি সুন্দর দেখতে না? আর, কেমন অভিজাত চাল চলন, তাই না?
ইটালিয়ানদের চক্করে পড়তে যেও না গ্ল্যাডিস। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
–আমি ওকে শুধু কথাটা বলবো, আর জিজ্ঞেস করবো, এ ব্যাপারে আমার কি করা উচিত।
–তোমার ইচ্ছে। যাই হোক, প্যাটার্নটা দাও, ঐ ভোগ এরটা। চলি গ্ল্যাডিস। বাই।
–বাই চেরী।
ডক্টর হেডক, মিস মারপলকে উলের জট ছাড়াতে দেখে মৃদু হাসলেন,-খুনের রহস্যটারও কি সমাধান করে ফেলেছেন মিস মারপল?
–আমার ব্রেনটা আর আগের মতো কার্যকরী নেই ডক্টর। ওটারও বয়স হয়েছে।
–আমাকে বোকা বানানো যাবে না জেন মারপল। আপনাকে আমি আজ থেকে চিনছি না।
–সত্যিই বুঝতে পারছি না, গ্লাসে বিষটা মেশালো কি করে?
–কোনো আইড্রপের মধ্যে করে বিষটা এনেছিল হয়তো।
–তা, সেটা দেওয়ার সময় কেউ দেখতে পাবে না, এতটা নিশ্চিত হলো কি করে? কুড়ি জনের মধ্যে একজন অন্তত তো দেখেছে, কিন্তু সে কথাটা কাউকে বলেনি।
-কেন বলেনি বলে মনে হয়।
–হয়তো সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। অথবা এইসব চিত্রতারকারা যখন তখন পানীয়ের সঙ্গে নানারকম ওষুধ মিশিয়ে খায় শুনেছি, সেরকমই একজন কেউ এটা করেছে বলে, যে দেখেছে, তারও কোনো সন্দেহ হয়নি।
এছাড়া আর কি হতে পারে?
–সেটাই সবচেয়ে দুশ্চিন্তার। হয়তো যে দেখেছে, সে হত্যাকারীকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য চুপ করে আছে, অথবা এতক্ষণে করতে শুরু করে দিয়েছে। এই ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন আশংকা হচ্ছে আমার।
-সেক্ষেত্রে তো আরও খুন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়?
–ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, সেরকম যেন না হয়।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে নিজের মনেই হাসলো এলা। খুব ভয় পাইয়ে দেওয়া গেছে। চীফ ইনসপেক্টর নিজেকে যতই চালাক মনে করুক না কেন, এলা-র মনের কথা বার করা তার কর্ম নয়। টেলিফোনে খুব ভয় পাইয়ে দেওয়া গেছে খুনীকে। এবার দেখা যাক, কি হয়?
কিন্তু এই হে-ফিভারটা বড় জ্বালাচ্ছে।
অফিসে আসতেই জ্যাসনের গম্ভীর মুখ দেখে বিস্মিত হল এলা।
–কি হয়েছে কি?
–ঐ কফি, যেটা মেরিনার কাপে ছিল, সেটা পরীক্ষা করে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
–কিন্তু ওটা তো তুমি ফেলে দিয়েছিলে?
–না, কাউকে না জানিয়ে একটুখানি পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলাম।
–তাহলে তো মেরিনা ঠিকই বলেছিল। কফিটা ওর বেশি তেতো লেগেছিল।
-না, ঠিক বলেনি। আর্সেনিকের কোনো স্বাদ নেই। কিন্তু ওর ইনস্টিংক্ট ঠিকই সাড়া দিয়েছিল।
-আর, আমরা ভেবেছিলাম ও শুধু শুধু হিস্টোরিক্যাল হচ্ছে।
–ও তো হিস্টোরিক্যালই! চোখের সামনে একটা মৃত্যু দেখেছে, একটার পর একটা ভয় দেখানো চিঠি আসছে, না হয়ে উপায় কি? আজ কি এরকম কোনো চিঠি এসেছে?
-না।
-কে যে এসব করছে। অবশ্য জানলা দিয়ে যে কেউই বাইরে থেকে চিঠি ফেলে দিতে পারে। দেখি, এ বিষয়ে আর কি সতর্কতা নেওয়া যায়। আচ্ছা, কাজের লোকদের কাউকে যদি টাকার লোভ দেখিয়ে মেরিনার খাবারে বিষ দিতে বলে? গিসিপ্পি যদিও আমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন আছে, তবু টাকার ব্যাপারে ওকে বিশ্বাস করা যায় না।
–এভাবে উল্টোপাল্টা সন্দেহ করে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ জ্যাসন!
–সুখ কি চিরদিন মেরিনার কাছে অধরাই রয়ে যাবে এলা? এখানে প্রথম এসে কত আনন্দ পেয়েছিল, তুমি তো জান। খুব নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম আমি। হঠাৎ এই বিনা মেঘে বজ্রপাত।
–তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে মেরিনা এখানে এসে চিরদিনের মতো সুখী হয়ে যাবে?
হাসলো জ্যাসন,–না, তা ভাবিনি, মেরিনাকে অনেকদিন ধরে চিনি তো! তৰৈ ভেবেছিলাম বছর দুইও যদি এখানে শান্তিতে থাকতে পারে, হয়তো ওর আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নতুন এক মেরিনা-র জন্ম হবে। যখন খুশী থাকে, মেরিনাকে ঠিক শিশুর মতো মনে হয়। সেই খুশীটুকু দেখতে চেয়েছিলাম আমি।
-জীবনটা যে গোলাপের শয্যা নয়, তা তো তুমি ভালো করেই জানো জ্যাসন। যাই হোক, তোমাকে জানিয়ে রাখি, গিসিপ্পি আজ লন্ডনে গেছে। ওর কোনো আত্মীয় নাকি মোহে অঞ্চলে থাকে, সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকেই দেখতে গেছে। আজ রাতেই ফিরবে, মেরিনার সঙ্গে দেখা করে অনুমতি নিয়ে গেছে।
-ঠিক আছে।
-এই হাঁচিটা কিছুতেই কমাতে পারছি না। অ্যাটমাইজারের সাহায্য নিতেই হবে। আমি চলি জ্যাসন।
ক্ষুব্ধ মন নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো এলা। মেরিনা, মেরিনা, মেরিনা, এছাড়া অন্য কোনো চিন্তা কি আসতে নেই জ্যাসনের মনে।
অ্যাটমাইজার প্রথম বার স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। তেতো অ্যামন্ড বাদামের গন্ধে ভরে গেল ঘর।
স্থানীয় ইনসপেক্টর কর্নিশ খবর পেলেন, লোলা ব্রিডস্টার, মিঃ ফেন এবং মার্গট বেনস তিনজনেই আজ নিজস্ব কাজে শহরের বাইরে গেছেন। গিসিপ্পিও নাকি সকালেই লন্ডনে চলে গেছে। অবশ্য তার গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য পুলিশের লোক নিয়োগ করা হয়েছে। এলার-র অ্যাটমাইজার-এ সায়োনাইড ঢেলে দেবার কাজটা করা গিসিপ্পির পক্ষে খুবই সহজসাধ্য ছিল। মধ্যরাত্রিরও পরে গসিংটন হল-এ ফিরলো গিসিপ্পি। সেন্ট মেরী মিড-এ আসার ট্রেনটা ধরতে পারেনি সে। তাই, মার্কেট বেসিং থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আসতে হয়েছে।
মনটা খুব খুশী আছে তার। ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হল-এ যাবার সর্টকার্ট রাস্তাটা ধরলো সে।
বাড়ির পেছনের দরজাটা নিজের চাবি দিয়ে খুললো সে। বাড়িটা অন্ধকার নিস্তব্ধতায় ভরা। বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল গিসিপ্পি। নিজের আরামদায়ক ঘরটিতে যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়, একঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগলো তার গায়ে, বোধহয় কোথাও কোনো জানলা খোলা আছে। এখন সেসব দেখার দরকার নেই। নিজের ঘরের দরজায় পৌঁছে চাবি বের করলো গিসিপ্পি। চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢোকার সময়ই সে অনুভব করলো ঘাড়ের ওপর একটা কঠিন জিনিসের স্পর্শ।
ট্রিগারে দুবার চাপ পড়লো। সামনের দিকে ঢলে পড়লো গিসিপ্পি।
নিচের ঘরে পরিচারিকা বিয়াংকার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। গুলির শব্দ হলো কি কোথাও। কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করলো সে। বোধহয় স্বপ্ন দেখছে সে। পরক্ষণেই আবার তলিয়ে গেল অতল নিদ্রায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকলেন মিস নাইট। মিস মারপলকে দেখেই বলে উঠলেন,–কি সাংঘাতিক ঘটনা!
–আবার কিছু ঘটেছে নাকি?
–আমি আপনাকে বলতে চাই না ডিয়ার, এতে মানসিক আঘাত পেতে পারেন আপনি।
–আপনি না বললে, অন্য কেউ বলবে।
–তা অবশ্য খুবই সম্ভব। সবাই এত বেশি কথা বলে আজকাল।
–কি ঘটেছে?
–ঐ ইটালিয়ান বাটলারকে গত রাতে কেউ গুলি করে হত্যা করেছে।
-হ্যাঁ, এরকম একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল। সে কিছু দেখেছিল বা জেনেছিল, এবং সে বিষয়ে মুখ খুলেছিল।
–আপনি কি আগে থেকেই এসব আন্দাজ করতে পেরেছিলেন নাকি? কি আশ্চর্য! কেন খুন করা হলে তাকে?
–সম্ভবত খুনীকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল।
–ওরা বলছিল, গতকাল নাকি সে লন্ডনে গিয়েছিল।
–ওরা নাকি? ইনটারেস্টিং! বাইরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দের সঙ্গে গানের সুর শোনা যেতেই মিস মারপল বুঝতে পারলেন, চেরী বেকার এসে গেছে। ডাকলেন তাকে,-চেরী আসবে একবার?
–কি বলছেন ম্যাডাম?
–গসিংটন হল-এর বাটলার গিসিপ্পি গতরাতে খুন হয়েছে, শুনেছো তুমি?
–কে বললো আপনাকে?
–মিসেস নাইট। বাজার থেকে শুনে এসেছেন।
–তা! এখানে আসার পথে আমার তো কারো সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই খবরটা শুনতে পাইনি। সে খুন করলো ওকে?
জানা যায়নি। কাল সকালে নাকি ও লন্ডনে গিয়েছিল, রাত্রে ফিরেই খুন হয়েছে।
—লন্ডনে গিয়েছিল? তাহলে গ্ল্যাডিস কি ওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল তার আগে? কি জানি!
-গ্ল্যাডিস?
–আমার বন্ধুর মতো, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। স্টুডিও-র ক্যান্টিনে কাজ করে।
–সে কেন বাটলারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে?
-সেদিন পার্টিতে উপস্থিত ছিল তো, তা একটা নাকি মজার জিনিস দেখেছে। মিসেস বেডককের হাতের গ্লাসটা পড়ে যাওয়া নাকি ইচ্ছাকৃত। সেটাই বলবে বাটলারকে। আসলে ওসব একটা বাহানা, জানেন। ও ঐ গিসিপ্পিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে। একটু ঘনিষ্ঠতা করতে চায় আর কি।
মিস নাইটকে জানিয়ে দিলেন জেন মারপল, যে তিনি একটু একা থাকতে চান। একটু ভাবতে হবে তাকে। ঠিক কি দেখেছিল গ্ল্যাডিস? কে ইচ্ছাকৃতভাবে পানীয়টা ফেলেছিল? মিসেস বেডকক? কিন্তু কেন? মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন মিস মারপল। কিছু একটা করতেই হবে। একা বাইরে যাওয়া নিষেধ, কিন্তু সেটা অমান্য করতেই হবে এবার।
সুদর্শন আমেরিকান যুবকটি এই রাস্তায় ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় পাকা চুলের এক ভদ্রমহিলাকে দেখে এগিয়ে এলো সে।
–মাপ করবেন ম্যাডাম। আপনি কি বলতে পারেন ব্লেনহেম ক্লোজটা কোথায়?
এখান থেকে ডানদিকে সোজা এগিয়ে বাঁ দিকে মোড় ঘুরবেন, তারপর ডানদিকে ঘুরে সোজা যাবেন। আপনি কার ঠিকানা খুঁজছেন? কত নম্বর?
-ষোলো নম্বর। গ্ল্যাডিস ডিক্সনকে খুঁজছি।
–ও, সে তো হেলিংফোর্থ স্টুডিওতে কাজ করে। ক্যান্টিনে। সেখানেই ওকে পাবেন।
–সে আজ সকালে কাজে আসেনি। গসিংটন হল-এ আজ কাজের লোক কম, তাই ডাকতে এসেছি ওকে।
-হ্যাঁ, তা তো বটেই। বাটলারকে তো কাল গুলি করে হত্যা করেছে কেউ? তাই না?
–এখানে খবর খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়, তাই না?
-সত্যিই তাই। মিস্টার হাড-এর সেক্রেটারিও কালই কিভাবে যেন মারা গেছেন শুনেছি। কি যে হচ্ছে চারদিকে।
সেই দিনই আর একটু বেলার দিকে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট উইলিয়াম টিলার গ্ল্যাডিসের খোঁজ করতে তার বাড়িতে এলেন।
জানা গেল, গ্ল্যাডিস বাড়িতে নেই, কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে গেছে। কোথায় যাচ্ছে সেটা পৌঁছে ফোন করে জানাবে। শুধু বলে গেছে, বিনে পয়সায় বেড়াতে যাবার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে।
স্টুডিওতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, গ্ল্যাডিস সকালেই ফোন করে জানিয়েছে, সে এক সপ্তাহ কাজে আসতে পারবে না। স্টুডিও মহল থেকে আরও জানা গেল, মেরিনা-র কফি-র কাপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তার স্বামী নিজে পরীক্ষা করিয়েছেন।
চীফ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক দেখা করলেন মেরিনা-র স্বামী জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে। অত্যন্ত বিচলিত দেখাচ্ছিল জ্যাসন হাড-কে।
–আমি যে কফিটা পরীক্ষা করিয়েছি, সেটা আমার নিজস্ব অধিকার বলেই করেছি ইনসপেক্টর।
যদি আপনি কফিতে কিছু মেশানো হয়েছে বলে সন্দেহ করে থাকেন, তবে আপনার উচিত ছিল, আমাদের সে কথা জানানো। আমারই ব্যবস্থা নিতাম।
–সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমি এক মুহূর্তের জন্যেও সেরকম কিছু সন্দেহ করিনি।
–আপনার স্ত্রী বলেছিলেন, কফির স্বাদটা অন্যরকম লাগছে, তা সত্ত্বেও সন্দেহ করেননি?
-ওঃ, ঐ মেলার পরদিন থেকে আমার স্ত্রী তার প্রতিটি খাদ্য এবং পানীয়তেই বিষ মেশানো আছে বলে সন্দেহ করে চলেছেন। তার কারণ অবশ্য ইতিমধ্যেই মেরিনার প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া আরও দুটি চিঠি এসেছে।
চিঠি দুটি দেখলেন ইনসপেক্টর। অত্যন্ত শিশুসুলভ হুমকি বলে মনে হলো তার। অবশ্য তার মানে এমন নয়, যে এগুলো বিপদজনক হতে পারে না। শিশুসুলভ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন কম অপরাধী দেখেননি ক্র্যাডক।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জ্যাসন,এলা এইভাবে হঠাৎ মারা গেল, তার ওপর আবার গিসিপ্পির এই মর্মান্তিক মৃত্যু। আমার স্ত্রী তো ভয়ে পাগল হয়ে যেতে বসেছে। কবে ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবো ইনসপেক্টর?
–ইনকোয়েস্ট তো এখনও বাকি আছে মিস্টার হাড, কাজেই কিছু বলা যাচ্ছে না।
–সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন, মেরিনা-র প্রাণহানির আশংকা এখনও আছে?
–আমরা সবরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবশ্যই নেব মিস্টার হাড।
–একথা তো আগেও শুনেছি। মেরিনাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে আমাকে। যত শিগগির সম্ভব।
শোবার ঘরে নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল মেরিনা। ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। স্বামীকে এসে দাঁড়াতে দেখে অবসন্ন গলায় বললো,-ক্র্যাডক এসেছিলেন, তাই না? কেন? এলা-র জন্য?
–এলা আর গিসিপ্পি?
–গিসিপ্পিকে কে গুলি করেছে, সেটা কি ওরা জানতে পেরেছে?
–এখনও নয়।
–সব কেমন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে জ্যাসন। উনি কি বললেন? আমরা কি এখন এখান থেকে চলে যেতে পারবো? উনি কি বুঝতে পারছেন না, একজন দিনের পর দিন আমাকে খুন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। এই অবস্থায় আর কতদিন কাটানো যায়?
উনি বলেছেন, পুলিশ সবরকমভাবে সতর্ক থাকবে, যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটতে পারে।
-সতর্কতা! একথা তো ওরা আগেও বলেছিল, তাতে কি এলা আর গিসিপ্পিকে বাঁচাতে পারলো? আমি আতঙ্কে মরে যাচ্ছি জ্যাসন। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর, প্লিজ।
এই মৃত্যুগুলো যে ব্যাপারটাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে মেরিনা। এছাড়া পালিয়েই কি বাঁচা যায়?
কিন্তু কে আমাকে এতটা ঘৃণা করে যে, আমাকে হত্যা করতে চায়, সেটা না জানলে আমি শান্তি পাবো কি করে? প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চিত হয়েছিলাম, যে এলা-ই এই কাজ করেছে। কিন্তু
–এলাকে সন্দেহ করেছিলে!
-তুমি বুঝতে পারো না, যে ও তোমার প্রেমে পাগল, আর আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারে না? পুরুষ মানুষের দৃষ্টিশক্তি এত কম! কিন্তু এখন এলা মারা যাওয়াতে সে সন্দেহটাও তো মিথ্যে হয়ে গেল।
–এত চিন্তা করো না ডার্লিং! আমি আছি তো! আমি তোমাকে আগলে রাখবো, চিরদিন।
–সত্যিই থাকবে তত জ্যাসন, আমার পাশে।
নিশ্চয়ই, একেবারে শেষ পর্যন্ত। সে সময়টা যতই কঠিন, যতই তিক্ত হোক না।
-তুমি কেমনভাবে কথাটা বললে জ্যাসন! তোমার হাসিমুখ দেখে মনে হচ্ছে একজন ক্লাউন যেন আগে থেকে একটা বিষাদময় পরিণতি দেখে ফেলেছে, যা আর কেউ দেখতে পায়নি।
ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ইনসপেক্টর পরদিনই দেখা করলেন মিস মারপল-এর সঙ্গে।
–আরাম করে বোসো। বুঝতে পারছি, খুব কঠিন সময় যাচ্ছে তোমার।
–আমি হেরে যেতে ভালোবাসি না আন্টি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো খুন হয়ে গেল। আমার কাজের পক্ষে নিজেকে খুবই অনুপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে।
যথোপযুক্ত সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে, এবং কড়া হুইস্কি পান করিয়ে ক্র্যাডককে একটু চাঙ্গা করে তুললেন জেন মারপল, তারপর জিজ্ঞেস করলেন–নাও। এবার সব কথা বল তো আমাকে। মানে, যতটা বলার অধিকার আছে তোমার।
আমার মনে হয়, আমি যা বলবো, তার সবটাই আপনি জানেন। এছাড়া আরও আমার না জানা কিছু তথ্য নিশ্চয়ই আপনার আস্তিনে লুকোনো আছে। আচ্ছা, আপনার ঐ দেহরক্ষী মহিলা মিস নাইট ও তো খুনী হতে পারে?
–সে কি? ও কেন খুন করতে যাবে?
–কেননা, ওরই খুন করার সম্ভাবনা সব থেকে কম।
-বাস্তবে ওরকম হয় না ডার্মট। সব সময় সে-ই খুন করে, যার পক্ষে খুন করার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। এই কথাটাই তো আমি বারবার বলেছি। এসব ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই থাকে স্বামী, অথবা স্ত্রী। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে-ই খুনী প্রতিপন্ন হয়।
-জ্যাসন হাড! কিন্তু সে তো মেরিনাকে প্রায় পুজো করে।
–কথাটা আমি বৃহত্তর অর্থে বলেছি। মিসেস বেডকককে হত্যা করে তার স্বামী কোন দিক থেকেই লাভবান হতে পারে না, এটা আমরা জেনেছি। এবার যখন মনে হচ্ছে হত্যাকারীর আসল উদ্দেশ্য ছিল মেরিনা; তখন স্বভাবতই জ্যাসন হাড-এর দিকে সন্দেহের কাটাটা ঘুরে যাবে। আমিও তোমার সঙ্গে একমত, যে জ্যাসন তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসে। এছাড়া সে নিজে একজন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত মানুষ। অর্থের প্রয়োজনে কাউকে খুন করার দরকারও নেই তার। স্ত্রীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তাকে খুন করার দরকার কি। চিত্রতারকাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ব্যাপারটা তো একেবারেই রোজকার ঘটনার মতো স্বাভাবিক।
ক্র্যাডক-এর কাছ থেকে মার্গট বেনস-এর কথা শুনে ব্যথিত হলেন মিস মারপল। তিনি জানেন, শিশু মনকে কোনো ঘটনা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, তবে তা সে সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না।
মিস মারপল এবার সেই মেলার দিনের ঘটনার খুঁটিনাটি বিবরণ নতুন করে জানতে চাইলেন। সেদিন যে সব ছবি তোলা হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে একটি ছবি মিস মারপলকে দেখালেন ক্র্যাডক।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেরিনা গ্রেগ-এর একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যাসন। একটু তফাতে আর্থর বেডকককে দেখা যাচ্ছে, সলজ্জভাবে মুখে হাত দিয়ে আছেন। তার স্ত্রী মেরিনা-র হাত ধরে, তার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলছেন। কিন্তু মেরিনা তার মাথার পেছনদিকে তাকিয়ে আছেন, মিসেস বেডকক-এর মুখের দিকে নয়। আর; মেরিনার মুখের ভাব হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।
-হ্যাঁ, মেরিনার মুখে ভাবের এই অভিব্যক্তির কথাই আমি শুনেছিলাম ডলি ব্যান্টিং-এর কাছ থেকে। রিপোর্টার ভদ্রলোকও তোমাকে বলেছিলেন শুনেছি।
–হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন, মনে হয় মেরিনা যেন হঠাৎ শক পেয়েছিলেন।
–আচ্ছা, সেদিন মিসেস বেডক মেরিনার সঙ্গে যে সব কথা বলেছিলেন সে সম্বন্ধে আশেপাশের লোকেরা তোমাকে ঠিক কি কি বলেছিল?
–মোটামুটি সবাই একই কথা বলেছিলেন। মিসেস ব্যান্ট্রি বলেছেন, মিসেস বেডকক বলেছিলেন, তিনি নাকি আশৈশব মেরিনা-র ফ্যান। একবার মেরিনাকে দেখার জন্য চিকেন পক্স নিয়েই বিছানা থেকে উঠে চলে গিয়েছিলেন। জ্যাসন হাড ঐ ধরনেরই কথা বলেছিলেন, তবে অসুখটা বলেছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা। আর্থার বেডককও বলেছিলেন, তার স্ত্রী তাকে ঐ ঘটনার কথা কয়েকবার বলেছেন। সে প্রায় দশ-বারো বছর আগেকার ঘটনা।
এবার, ইচ্ছে করে পানীয়ের পাত্রটি ফেলে দেবার ঘটনাটা নিয়ে ভাবা দরকার। কেন তিনি নতুন জামাটা নষ্ট করেছিলেন?
–কে? মিসেস বেডকক?
-হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, যদি না–আরে তাই তো! কি বোকা আমি, ব্যাপারটা অন্য দিক থেকে ভাবিনি। সেদিকটার দিকে এবার একটু আলো ফেলতে হবে।
–আচ্ছা আন্টি, আপনি তো প্রায় সব ঘটনারই অতীতের কোনো না কোনো ঘটনার সঙ্গে মিল দেখতে পান। এখানে কি সেরকম কিছু পাচ্ছেন?
-ঐ যে লরিস্টনদের পার্লারমেড ছিল যে মেয়েটা, তার কথা মনে পড়ছে। টেলিফোন রিসিভ করা তারই কাজের মধ্যে পড়তো, কিন্তু সে প্রায় সময়ই যা শুনতো, তা ঠিকঠাক লিখে রাখতে পারতো না। এইসব ভুল সংবাদ নিয়ে বহুবার বহু অনর্থ ঘটেছে ওদের পরিবারে! ওঃ,
আমি সময়মতো মেয়েটিকে নিরাপদে বোর্নমাউথে পাঠিয়ে দিতে পেরেছি!
–মেয়েটি? কোন মেয়েটি?
–ঐ যে গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি। যে গিসিপ্পির কাছে গিয়েছিল সেদিন।
–আপনি ওকে বোর্নমাউথে পাঠিয়েছেন? কেন?
–আমি ওর সঙ্গে দেখা করে কিছু টাকা দিয়েছিলাম, আর বলেছিলাম, এখনই কদিনের ছুটি নিয়ে চলে যেতে।
–এটা কেন করতে গেলেন?
–কেননা, আমি চাইনি ঐ মেয়েটিও খুন হোক।
.
দুদিন পরে মিস মারপলকে ব্রেকফাস্ট দিতে এসে মিস নাইট জানালেন, তার এক পরিচিত ভদ্রমহিলা শীতটা একটি বিলাসবহুল হোটেল-এ কাটাবেন। তিনি সঙ্গিনী হিসেবে মিস নাইটকে চেয়ে চিঠি লিখেছেন। যেতে পারলে মিস নাইট যে খুব খুশী হতেন, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু মিস মারপলের ভাইপোকে কথা দিয়েছেন মিস নাইট, যে তিনি এখানেই বরাবরের মতো থাকবেন, কাজেই এই প্রস্তাবটা তার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেত বসলেন মিস মারপল। তিনি এখনও সেরকম স্থবির হননি, এবং হতেও চান না, যে মিস নাইট-এর পরিচর্যা ছাড়া চলবে না। এই অতিরিক্ত পরিচর্যা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।
ডক্টর হেডককে ডেকে পাঠালেন মিস মারপল। তাঁর বক্তব্য, বয়সের পক্ষে যথেষ্ট সুস্থ আছেন জেন মারপল। তবু একা একটা বাড়িতে তার থাকা উচিত নয়। মিস নাইটকে পছন্দ না হয়, অন্য কাউকে নিয়োগ করলেই হবে।
অল্প কয়েকটি কথা বলার পরেই বিদায় নিলেন মারপল। সময় নেই, প্রচুর জার্মান মিসেসের রোগী আছে তার হাতে।
ডাক্তারের এই শেষ কথাটা কেমন একটা নাড়া দিল মিস মারপলকে। জার্মান মিসে? অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ ওটা।
বাইরে চেরী-র ভ্যাকুয়াম ক্লিনার-এর শব্দ শোনা গেল। একমুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে তাকে ভেতরে ডাকলেন মিস মারপল।
-কি ব্যাপার ম্যাডাম? আপনাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?
–আমি খুব অসহায় বোধ করছি চেরী। খুব বুড়ো, আর খুব অসহায়।
–এসব চিন্তা করবেন না, আপনি মোটেই দুর্বল বা অসহায় নন। আমাদের ওখানকার সবাই জানে, আপনি কত অসাধারণ সব সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা কেউ আপনাকে অসহায় ভাবে না। ঐসব চিন্তা আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে ঐ মহিলাটি।
-মহিলা?
-ওই যে আপনার মিস নাইট। সর্বক্ষণ এত পুতুপুতু করে আপনাকে নিয়ে, যে মনে হয় আপনি একেবারেই অথর্ব। ওকে একেবারে পাত্তা দেবেন না।
–ভদ্রমহিলা খুবই সহৃদয় চেরী।
–অতিরিক্ত যত্ন বেড়ালকেও মেরে ফেলে ম্যাডাম। কেউ আপনার ওপর জোর করে দয়া চাপিয়ে দিলে, সেটা আপনার মোটেই ভালো লাগার কথা নয়।
–কি করা যাবে চেরী। আমাদের প্রত্যেককেই নিজের নিজের সমস্যার সঙ্গে সমঝোতা করে চালিয়ে নিতে হয়।
–তা অবশ্য খুবই সত্যি কথা। এই যে আমার প্রতিবেশিনী মিসেস হার্টওয়েল। ওঁর পাশাপাশি বেশিদিন থাকতে হলে, কবে যে একটা দুর্ঘটনাটা ঘটে যাবে। সবসময় পরচর্চা আর অভিযোগ নিয়েই আছে। গতকালই তো আমার জিম-এর সাথে খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে ওনার। কি না আমরা একটু জোরে মিউজিক চালিয়েছিলাম।
-তোমাদের কি মিউজিকটা চালাতেই হবে?
–জিম ওটাই পছন্দ করে। ও বলে ভল্যুমটা পুরো না বাড়িয়ে দিলে টোনটা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আসলে আমাদের বাড়িগুলো একটা অন্যটার সাথে পাতলা দেওয়াল দিয়ে জোড়া। এমনিতে ছোটোর ওপর সুন্দর বাড়ি হলেও, ওখানে নিজের ব্যক্তিত্বকে ঠিকমতো প্রকাশ করা যায় না, এটাই অসুবিধে।
প্রকাশ করার মতো প্রচুর ব্যক্তিত্ব তোমার আছে তাই না চেরী? সস্নেহে বললেন জেন মারপল।
খুশীর সঙ্গে লজ্জা মিশলো চেরীর মুখে। হাতের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলো।
-একটা কথা বলবো ম্যাডাম? আপনি শুনে যদি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না, আমি কিছু মনে করবো না।
–তুমি কি আমাকে কিছু করতে বলছো?
-ঠিক তা নয়। ঐ যে আপনার রান্নাবাড়ির ওপরে যে ঘরগুলো আছে? আজকাল আর ওগুলো ব্যবহার করা হয় না, তাই না?
-না।
–আগে আপনার মালি তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে শুনেছি। তাই ভাবছিলাম, মানে, আমি আর জিম ভাবছিলাম, যদি আমরা ওখানে এসে থাকতে পারি–
–সে কী? তোমরা ঐ নতুন সুন্দর বাড়িটা ছেড়ে দেবে?
–আমরা দুজনেই বিরক্ত হয়ে গেছি। ওখানকার গ্যাজটগুলো আমরা পছন্দ করি। কিন্তু সে তো যে কোনো জায়গায় গিয়েই হায়ার পারচেজ-এ কিনে নেওয়া যায়। এখানে ঘরগুলো কত বড়ো। জিম মনের সুখে একটা ঘর শুধু যন্ত্রপাতি রাখার জন্য ব্যবহার করতে পারে। ওখানে যদি আমরা মিউজিক বাজাই, আপনি এখান থেকে শুনতেই পারবেন না।
-তুমি কি এ ব্যাপারে সিরিয়াস, চেরী?
–নিশ্চয়ই। জিম আর আমি এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। জিম আপনার জলের কল সারানোর বা কাঠের কাজ ইত্যাদি করে দিতে পারবে। আমি আপনার দেখাশোনা করবো। ঘরের কাজ সত্যি যত্ন নিয়ে করবো দেখবেন? আর, ঐ মিসেস নাইটের থেকে আমি অনেক ভালো রান্না করি, জানেন।
এই প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণীটির আগ্রহভরা মুখের দিকে চেয়ে খুব ভালো লাগলো মিস মারপলের।
–ঠিক আছে চেরী, এটা আমি ভাববো।
–আমি অবশ্য মিস নাইটের ক্ষতি করতে চাই না ম্যাডাম।
-না, উনি আর একটা মনের মতো কাজ পেয়েছেন। আমার অনুমতি পেলেই সেখানে যেতে পারেন।
আমি এখন আসি ম্যাডাম। আর্থার বেডককের কথাটা শুনতে গিয়ে আজ আসতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
–আর্থার বেডকক? কি হয়েছে তার?
-আপনি শোনেননি? তাকে যে পুলিশস্টেশনে নিয়ে গেছে! সে-ই নাকি মেরিনা গ্রেগ-এর প্রথম স্বামী!
–বল কি চেরী?
-হা ম্যাডাম। শোনা যাচ্ছে কেরিয়ার শুরু করার আগে আর্থার-এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মেরিনার। এক দেড় বছর টিকেছিল বিয়েটা। তারপরেই মেরিনা একটা ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান, আর্থার তার জীবন থেকে মুছে যায়। ইংলন্ডে এসে, পদবীটা পাল্টে নিয়েছে আর্থার, তবে পুরোনো, রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসাতেই লেগে আছে। পুলিশ এখন তাকেই সন্দেহ করছে।
-না না, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। চেরী, ট্রে-টা নিয়ে যাও, আর মিস নাইটকে ডেকে আনো।
বিছানা থেকে উঠে পোশাক পাল্টে নিলেন মির মারপল। মেডিকেল বুকটা নামিয়ে এনে ঠিক একটা জিনিস দেখে নিলেন। একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে, শুধু যদি কারও সমর্থন পাওয়া যেত। হঠাৎ ভাইকার-এর কথা মনে পড়লো, তিনিও তো সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন। যদি ভাগ্যক্রমে তার কিছু মনে থাকে! টেলিফোন খুলে ভাইকার-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন মিস মারপল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মনে করতে পারলেন মিসেস বেডকককে, মেরিনাকে তার কি ধরনের অসুস্থতার কথা বলেছিলেন। জার্মান মিসসের কথা বলেছিলেন মিসেস বেডকক; নিজের কানে শুনেছেন ভাইকার।
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মিস নাইটের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
গসিংটন হল-এ পৌঁছে জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন মিস মারপল।
গিসিপ্পির জায়গায় যে নতুন বয়স্ক শীর্ণ বাটলারটি নিযুক্ত হয়েছে, সে জানালো,-মিস্টার হাড, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করেন না ম্যাডম, বিশেষত আজ
–আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা নেই। কিন্তু আমি অপেক্ষা করবো।
এগিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসলেন তিনি। অসহায়ভাবে বাটলারটি বললো,আজ সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করাটা একেবারেই অসম্ভব ম্যাডাম।
–সেক্ষেত্রে আমি বিকেল পর্যন্ত বসে থাকবো। ঘাবড়ে গিয়ে আর একজন তরুণকে ডেকে নিয়ে এলো সে। মিস মারপল জানলেন, এ হচ্ছে জ্যাসন হাড-এর সেক্রেটারি হেইলি সেটন।
-আরে, আমি আপনাকে আগে দেখেছি, আপনি ব্লেনহেম ক্লোজ-এ যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন না?
হ্যাঁ, আপনি অবশ্য ঠিক পথটা বলে দিতে পারেননি। সম্পূর্ণ উল্টো দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
–আরে, তাই নাকি? আসলে এত নানারকম ক্লোজ এখানে–আচ্ছা, আমি কি মিস্টার হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে পারি? আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
–আপনি বরং আমাকে বলুন আপনার প্রয়োজনের কথাটা। যাঁরা মিঃ হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমার সঙ্গেই প্রথমে দেখা করতে হয়।
–আমি ওনার সঙ্গেই দেখা করবো। তার জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, করবো।
অগত্যা ডক্টর গিলক্রিস্টকে ডেকে নিয়ে গেল প্রেসটন, ডাক্তার জানালেন ডক্টর হেডকক-এর কাছ থেকে মিস মারপল-এর কথা শুনেছেন তিনি। মিস মারপল জ্যাসন হাড-এর সঙ্গে দেখা না করে এখান থেকে যাবেন না শুনে তিনি বললেন,-জ্যাসন হাড যে আজ কারো সঙ্গে দেখা করবেন না, তার একটা সঙ্গত কারণ আছে মিস মারপল। তার স্ত্রী কাল রাত্রে ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন।
মারা গেছেন। কিভাবে?
বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে। আমরা এখনই প্রেস-কে খবরটা দিতে চাই না। কাজেই আপনাকে অনুরোধ করছি, কথাটা কাউকে বলবেন না।
–নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
–আমার তাই মনে হয়।
–আত্মহত্যাও হতে পারে?
হতে পারে, কিন্তু সেটার সম্ভাবনা কম।
–অন্য কেউ ওঁর ওপর প্রয়োগ করতেও পারে।
–এর সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলেই আমি বিশ্বাস করি। সেটা প্রমাণ করাও অসম্ভব।
-আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু ডক্টর, আমাকে যে এখুনি মিস্টার হাড-এর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
–এখানে অপেক্ষা করুন।
গিলক্রিস্ট ঘরে ঢুকতেই মুখ তুলে চাইলেন জ্যাসন হাড।
নিচে একজন বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা না করে এখান থেকে যাবেন না বলছেন। মনে হয় বিশেষ জরুরী কোনো কারণ আছে। আমার মনে হয় ওঁর সঙ্গে দেখা করাই ভালো।
–ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন এখানে। কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।
রোগা চেহারার বৃদ্ধাটিকে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন জ্যাসন।
-আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন? কি করতে পারি আপনার জন্য?
–আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে খুবই দুঃখিত হয়েছি আমি। এ সময়ে আপনাকে বিরক্ত করার কোনো অধিকার নেই আমার। কিন্তু কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করে না নিলে, একজন নিরপরাধীরা অহেতুক শাস্তি পাবে। তাই এভাবে আসতে বাধ্য হলাম।
-নিরপরাধী? কার কথা বলছেন?
–আর্থার বেডকক। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেছে।
কি আশ্চর্য! সে তো আমার স্ত্রীকে চেনেই না। তার কাছেও আসেনি সেদিন।
–সে আপনার স্ত্রীকে চেনে মিঃ হেড। আপনার স্ত্রীর প্রথম স্বামী ছিল এই আর্থার বেডকক।–কিন্তু তার নাম তো ছিল আর্থার বিডল।
–ইংল্যান্ডে এসে নামটা পাল্টে নিয়েছে সে। আমি আপনাকে কাল্পনিক গল্প শোনাচ্ছি না, এটাই বাস্তব সত্য।
খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা! তা আমি সেজন্য কি করতে পারি?
–সেদিন মেরিনা কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেই জায়গাটা একটু দেখতে চাই।
নিশ্চয় আসুন আমার সঙ্গে।
জ্যাসন দেখালেন কোথায় সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন মেরিনা। সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে দেখলেন মিস মারপল। সিঁড়ির ঠিক ওপরেই আছে হাস্যমুখী মেরী ও শিশু যীশুর একটি প্রাণোচ্ছল ছবি।
–ধর্মীয় ছবি। কিন্তু একটা সুখী মা ও তার সন্তানের ছবিও বটে। তাই না মিস্টার হাড?
–হ্যাঁ।
-এখন আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা সরল, পরিষ্কার হয়ে গেছে। আপনার কাছেও নিশ্চয়ই আর কিছু অস্পষ্ট নেই।
নিচে পায়ের শব্দ ও গলার আওয়াজ শোনা গেল। চী ইনসপেক্টর ক্র্যাডক এসে যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। মিস মারপলকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েই সেদিনের ঘটনার প্রেক্ষাপট, মেরিনার চেহারায় লেডি শ্যালটের মতো ধ্বংস নেমে আসার ইঙ্গিত ইত্যাদি নিয়ে কথা হলো, একটা নতুন কথা বললেন মিস মারপল। তিনি বুঝতে পেরেছেন ধ্বস নেমে আসছিল সেদিন মেরিনার ওপর নয়, মিসেস বেডকক-এর ওপর আর তার বীজ লুকিয়ে ছিল মিসেস বেডককের একটি কথার ওপর।
–সে কথা তো আমার সবাই শুনেছি, তার অসুস্থতা সত্ত্বেও কিভাবে মেরিনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
-হ্যাঁ, কিন্তু তার অসুখটা ছিল জার্মান মিসেস। এই রোগটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের পক্ষে মারাত্মক। আর, সেই সময় মেরিনা গর্ভবতী ছিলেন, তাই না মিস্টার হাড?
-হ্যাঁ। চিকিৎসক ওকে বলেছিলেন, গর্ভাবস্থায় ঐ রোগ হওয়ার জন্যই তার সন্তান সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে জন্মাতে পারেনি। এটা মেরিনা কখনো ভুলতে পারেনি। অবশ্য সে জানতো না, এই অসুখের সংক্রমণটা তার হয়েছিল কার কাছ থেকে।
তাই জানতে পেরেই এতদিনের রুদ্ধ বেদনা ক্রোধের আকার নিল। মিসেস বেডকককে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন মেরিনা। তার গ্লাসটা হাতের ধাক্কায় ফেলে দিয়ে নিজের বিষ মেশানো গ্লাসটি তুলে দিয়েছিল মিসেস বেডককের হাতে। মেরিনার সঙ্গেই থাকতো ঐ ওষুধ। প্রায়শই নিজের পানীয়ে মিশিয়ে নিতে সে, তাই ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করে দেখেনি।
মেরিনা-ই যে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্লাসটা ফেলে দিয়েছিল, সেটা দেখেছিল গ্ল্যাডিস এবং সম্ভবত এলা। গ্ল্যাডিসের কাছ থেকে খবর পেয়ে গিসিপ্পি এবং এলা, এরা দুজনেই মেরিনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। অবশ্য এলা শুধু ভয়ই দেখিয়েছিল টেলিফোন মারফত। গিসিপ্পি চেয়েছিল টাকা। প্রথম দফার টাকাটা সে লন্ডনে ব্যাংকে রেখেও এসেছিল। কাজেই তাদের সরাতে না পারলে মেরিনার বিপদ কাটছিল না। তাই আরও দুটি হত্যা করলো মেরিনা, আর, নিজেই নিজের কফিতে বিষ মিশিয়ে, ভুয়ো চিঠি দেখিয়ে নিজেকে সন্দেহের উর্দ্ধে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। এটা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই না মিস্টার হাড? আর্থার বেডকককে কি চিনেছিলেন আপনার স্ত্রী।
-মনে হয় না। তাহলে আমাকে নিশ্চয় বলতো।
জ্যাসনের সঙ্গে মেরিনাকে দেখতে এলেন মিস মারপল। দুগ্ধধবল বিছানায় শুয়ে থাকা মেরিনাকে দেখাচ্ছে পরীর দেশের মেয়ের মতো। বিছানার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন জ্যাসন, ভাঙা গলায় বললেন,–এটাই কি ভালো হলো না মিস মারপল, অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে। মৃত্যুতে অন্তত শান্তি পেল।
–সেই শান্তি হয়তো আপনিই এনে দিয়েছেন, তাইনা। আপনি তাকে এত ভালোবাসতেন –এত সুন্দর, এত ভালো ছিল মেরিনা অথচ সবাই ওকে কেবল কষ্ট দিয়েছে, কেউ ওর মনের কথা বোঝেনি।