ডেসটিনেশন আননোন
০১.
কর্নেল হোয়ারটন খবর আর কাজের ফিরিস্তি দেখে রাগে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিলেন।
কর্নেলের বয়সও বেশ, গায়ের রঙ কালো, মুখে একজোড়া বিরাট গোফ, সারাক্ষণ চিন্তিত এবং বেশ রাশভারী।
ডেস্কের ওপাশে দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি সরকারী কাগজপত্রগুলোর উপর চোখ বুলোতে লাগলেন।
সব ওপরের কাগজে লেখা–টমাস চার্লস বেটারটন-পাশে জিজ্ঞাসাচিহ্ন। ভদ্রলোক চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে, বিবরণগুলো পড়ে দরকারী কথা খুঁজে পেলেন না।
বিরক্তভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন হোয়ারটন, কার সাধ্য বোঝে?
ভদ্রলোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–ই। সত্যিই কার সাধ্য বোঝে! সে খুব চিন্তিতও নয় নির্বিকারও নয়। তার ক্লান্তিময় চোখ এবং চকচকে নিজ মুখ।
ভদ্রলোকের বয়সটা অনুমেয় নয়। বুড়োও নয় ছোকরাও নয়। মাটির তলার কৃত্রিম আলোয় থাকার জন্য গায়ের রঙ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
এদিকে হোয়ারটন রাগে ফেটে পড়েছেন। কত্তো খবর! রোম থেকে, টুরেনের থেকে খবর, আজ রিভিয়েরায় দেখেছি; অ্যান্টওয়ার্পে চোখে পড়েছে; অসলোয় তো একেবারে সামনাসামনি, বিয়ারীজে চিনতে একটুও ভুল হয়নি; স্ট্যাটসবুর্গ-এ সন্দেহজনক অস্ট্যাণ্ডের সমুদ্রতীরে এক সুন্দরী লালচুলওলা মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গেছে। ব্রাসেলস-এর রাস্তায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেছি। এই তো তোমাদের খবর! তবু ভালো যে কেউ লেখেনি, চিড়িয়াখানায় জেব্রার গলা জড়িয়ে প্রেম করতে দেখেছি। বিশ্বাস নেই, তাও হয়তো লিখবে।
আহ, অতো চটছো কেন হোয়ারটন? এ বিষয়ে তোমার নিজস্ব অভিমত থাকলে বলল। আমার কিন্তু এই রিপোর্টে কিছুটা আশা জেগেছে। অবশ্য ইতিমধ্যে যদি না–ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে গেলেন, যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটু পরেই আবার বলতে শুরু করলেন, ই, সম্ভবত তাই। কিন্তু তবুও…আমি ভাবছি?
কর্নেল হোয়ারটন ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, কিন্তু জেসপ, এই সমস্ত প্রশ্ন কোথায়-কেন-কেমন করে উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। প্রতিমাসে এইরকম একজন কৃতী বিজ্ঞানী উধাও হয়ে যাবে আর আমরা কোথায়-কেন-কেমন করে এসবের কিছু না জেনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবো এটা তো হতে পারে না। আমাদের দেখতে হবে যেখানে আমরা সন্দেহ করছি সেটাই ঠিক না অন্য কোথাও! প্রথম থেকেই আমরা যেটাকে সঠিক বলে জায়গা ভেবেছি কিন্তু এখন আর সেটাকে সঠিক জায়গা বলে ভাবতে পারছি না।…ভালো কথা, সবশেষে খবর আমেরিকা থেকে এসেছে বেটারটন সম্বন্ধে সেটা দেখেছো তো?
হুঁ! একটা বয়সে স্বাভাবিক বিপ্লবী হবার ঝোঁক থাকে। তবে বেশিদিন এই ঝোঁক ছিল না। পাকা বিপ্লবী হবারও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। যুদ্ধের আগে উনি ভালো কাজ করেছেন। ম্যানহেইম যখন জার্মানি থেকে পালিয়ে যান বেটারটন তার সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং তার মেয়েকে বিয়ে করেন। ম্যানহেইমের মৃত্যুর পর তার কাজকর্ম বেটারটনই দেখাশুনা করেন। কিছুদিনের মধ্যে শূন্য শক্তির পরমাণু বিভাজন আবিষ্কার করে সারা দুনিয়ায় চমক লাগিয়ে দেন। তাকে সবাই সম্মানে ভূষিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তার স্ত্রী মারা যান। তিনি সোকে আমেরিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। এই দেড় বছর ধরে হারওয়েলে বসবাস করেন এবং ছমাস আগে বিয়ে করেন।
হোয়ারটন প্রশ্ন করেন, ওর বর্তমান স্ত্রী সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া গেছে?
জেসপ মাথা নেড়ে বলেন, খোঁজ নিয়েছি, মেয়েটি এক ব্যবহারজীবীর মেয়ে। বিয়ের আগে একটি বীমাসংস্থায় কাজ করতো। এবং তার রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।
‘শূন্যশক্তি বিভাজন? গলায় বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো হোয়ারটনের। তিনি বললেন–কথাটার মানে কি ভাবছি! আমি সেকেলে লোক এত বয়সেও একটু পরমাণু চোখে দেখলাম না। অথচ শুনছি এই পরমাণুই দুনিয়াটাকে টুকরো করে দিচ্ছে, পরমাণু দিয়ে বোমা তৈরি হচ্ছে, শূন্যশক্তি বিভাজন হচ্ছে।…কালে কালে কত কী হবে! বেটারটন আবার ভাঙাভাঙির পয়লা নম্বর পাণ্ডা। আচ্ছা, হারওয়েলের লোকেদের ওর সম্পর্কে কী মতামত?
হারওয়েলের লোকেরা বলে উনি মাটির মানুষ। বেটারটনের কাজ সম্পর্কে তাদের ধারণা –অনেক কাজই করেন তবে তার লাগাবার মতো তেমন কিছু নয়। শূন্যশক্তির বিভাজনকে কার্যক্ষেত্রে এদিক-ওদিক প্রয়োগ করেন।
দুজনেই খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তথ্যসংবাদীয় আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তিগত আলোচনায় চলে গেছেন দুজনে।
হোয়ারটন স্তব্ধতা ভেঙে বললেন, ইংল্যান্ডে আসার পর তাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল?
হা। সবকিছুই সন্তোষজনক ছিলো।
আঠারো মাস আগেকার কথা, হোয়ারটন চিন্তিতভাবে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো এই সমস্ত মানুষগুলো দিনরাত অন্ধকার ঘরে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে অস্বাভাবিক ভাবে বন্দী জীবন যাপন করে। এরা আদর্শ দুনিয়া গড়ার কথা এবং মানবজাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করে এবং ঠিক সেই সময় এক শ্রেণীর মানুষ সুযোগ বুঝে এদের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। তিনি আবার বললেন, বিজ্ঞানীদের মতো এত প্রতারিত আর কেউ হয় না, তা অবশ্য আমি বলতে পারবো না।
জেসপ ক্লান্তির হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, তাই হবে হয়তো, সবচেয়ে বড় কথা–এরা মনে করে যে, এরা অনেক কিছু জানে। কিন্তু আমাদের ধাঁচটাই আলাদা। সারা দুনিয়ার রক্ষার কথা চিন্তা করি না। শুধু দু-একটা টুকরো নিয়ে, কোনো কাজকর্ম আটকে গেলে তার কলকজাগুলোকে ঢিলে করে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ। তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, শুধু বেটারটন সম্পর্কে যদি বিশদ জানতে পারতাম। তার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই না, তার কাজকর্মের কথাও না–কয়েকটা খুঁটিনাটি কথা। কী ধরনের রসিকতা তার ভালো লাগতো, কোন্ কোন্ কথা তিনি হলফ করে বলতে পারতেন, কার প্রশংসা করতেন এবং কে তাঁকে পাগল করে তুলেছিলো ব্যাস।
হোয়ারটন অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ?
-অজস্রবার।
–তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন না?
জেসপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এখনো তো পারেননি।
-তোমার কি ধারণা–উনি কিছু জানেন?
-কিছু জানেন এটা অবশ্য তিনি স্বীকার করেননি। স্রেফ প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশ পেয়েছে –চিন্তা, দুঃখ আর আকুল উদ্বেগ। স্বামীর জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক, মানসিকতার লক্ষণ ছিল না, এছাড়া কোনো সূত্র বা সন্দেহের কথা বলতে পারেন না। তবে তার নিজস্ব মতামত তার স্বামীকে গুম করা হয়েছে।
–আর তোমার সেটা বিশ্বাস হয় না–এই তো?
–আমি কখনো কাউকে বিশ্বাস করি না–এ বিষয়ে আমার অক্ষমতার কথা স্বীকার করছি।
হোয়ারটন বলতে লাগলেন-ও আচ্ছা! আমার মনে হয় সবকিছু ভোলামেলা আলোচনা করাই ভালো। মহিলাটি কেমন?
–একদম সাধারণ মহিলা, যে-কোনো দিন দেখা যাবে তাসের আড্ডায় ব্রিজ খেলছেন।
কিছু যেন বুঝতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়লেন হোয়ারটন। তার মানে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়লো।
ভদ্রমহিলা এখনই আমার কাছে আসবেন। দেখি, আর একবার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা যাক।
–হ্যাঁ, এটাই একমাত্র উপায়। এসব কাজ আমার দ্বারা হয় না কারণ আমার ধৈর্য কম। হোয়ারটন উঠে পড়লো। ঠিক আছে, তোমাকে আটকাবো না। আমার তো মনে হয় বেশিদূর এগোইনি, কি বলো?
–দুভাগের বিষয় না–তুমি অসলো থেকে পাঠানো খবরটা ভালো করে দেখো। এটাই সম্ভাব্য জায়গা।
হোয়ারটন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জেসপ ফোন তুলে মিসেস বেটারটনকে ওঁর ঘরে পাঠিয়ে দেবার কথা বললেন।
জেসপ ছাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে মিসেস বেটারটন ঘরে ঢুকলেন। সাতাশ বছর বয়স, দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। মাথায় সোনালি চুল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সোনালি চুলের সৌন্দর্যে মুখখানা দেখার যেন প্রয়োজনই হয় না। মুখের উপর লালচে একখানা –এবং তার নিচে সবুজ একজোড়া চোখ। জেসপ লক্ষ্য করলেন–ভদ্রমহিলা কোন প্রসাধন ব্যবহার করেননি। ভদ্রমহিলাকে বসতে বলেজেসপের মনে ক্ষীণ একটা আশার আলো দেখা দিল। মনে হলো মিসেস বেটারটন আরো কিছু বেশি জানেন।
তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, দুঃখে কাতর কোনো মহিলা প্রসাধন করতে ভোলে না। বেদনার ক্ষতগুলো ভেসে উঠলে সেগুলিকে প্রলেপ দিয়ে আড়াল করতে চায়। অথচ মিসেস বেটারটনের ক্ষেত্রে সেটা হলো না কেন? মিসেস বেটারটন কি ইচ্ছে করেই প্রসাধন ব্যবহার করেননি যাতে একজন বিরহিণী স্ত্রীর ব্যথাতুর মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মিসেস বেটারটন জেসপকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি কোনো খবর আছে?
জেসপ নম্রস্বরে ঘাড় নেড়ে সান্ত্বনা দিলেন। আপনাকে আরেকবার ডেকে আনার জন্য খুব দুঃখিত, আপনাকে নিশ্চিত কোনো খবর দেবার নেই বলে আমার লজ্জা করছে।
অলিভ বেটারটন বললেন, আমি জানি। আপনি এই কথা আমাকে চিঠিতে লিখেও জানিয়েছেন। তবু একবার এলাম, এতদিন হলো যদি কোনো খবর থাকে। সারাদিন বাড়িতে বসে চিন্তা করা–সে যে কী ভয়ঙ্কর। এ ব্যাপারে কারো কিছু করার নেই–এটা ভেবে আরো খারাপ লাগে।
জেসপ নম্রস্বরে বললেন, মিসেস বেটারটন, আশা করি, আমি যদি আপনাকে একই কথা একই প্রশ্ন কিংবা একই বিষয়ের উপর জোর দেই তাতে আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এর মধ্যে থেকে একটা মূল্যবান কথা যা আপনার মনে পড়েনি বা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি, সেই কথাটা বেরিলয়ে আসতে পারে।
-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি আবার প্রথম থেকে জিজ্ঞেস করুন।
–আচ্ছা, আপনি আপনার স্বামীকে শেষ দেখেন–গত ২৩শে আগস্ট, তাই তো?
–হ্যাঁ।
তার মানে–প্যারিসে এক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য যেদিন তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন, সেইদিন।
–হ্যাঁ।
জেসপ এবার দ্রুত বলতে লাগলেন, সম্মেলনে প্রথম দুদিন উপস্থিত ছিলেন, তৃতীয় দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি তার এক সহকর্মীকে সম্মেলনে না গিয়ে ব্যাটো ম্যাস-এ চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
-ব্যাটো ম্যাস? ব্যাটো ম্যাসটা কী জিনিস?
জেসপ হেসে বললেন, যেমন নদীতে ছোট ছোট নৌকো তির তির করে ঘুরে বেড়ায়। ভ্রমণার্থীদের বিশেষ আকর্ষণের জন্য এই ব্যাপারটা আপনার স্বামীর পক্ষে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
অলিভ দ্বিধা করলেন, হুঁ, তাই আমার ধারণা ছিল, সম্মেলনের আলোচনা নিয়ে তিনি একাগ্র হয়ে থাকবেন।
–হয়তো তাই, তবু ধরে নেওয়া যেতে পারে সেদিনের আলোচ্য বিষয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিলো না দেখে, তিনি সেদিনের জন্য অবসর নিয়েছিলেন। তবুও এটা আপনার স্বামীর উপযুক্ত কাজ বলে মনে হচ্ছে না।
অলিভ মাথা নাড়লেন।
–সেদিন রাত্রে তিনি আর হোটেলে ফেরেননি। যতদূর খোঁজ পাওয়া যায় তাতে জানা গেছে তিনি নিজের ছাড়পত্র দেখিয়ে কোনো সীমান্ত অতিক্রম করেননি। আপনার কি মনে হয় অন্য কারো নামে তার কাছে দ্বিতীয় ছাড়পত্র ছিল?
-না তা কেন থাকবে?
জেসপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একরকম কোনো জিনিষ তার কাছে আছে। কি না লক্ষ্য করেননি?
অলিভ মাথা নেড়ে বললেন, না, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না টম স্বেচ্ছায় কোথাও পালিয়েছে। যেটা আপনারা প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। আমার বিশ্বাস তার কিছু একটা হয়েছে কিংবা স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে।
-তার স্বাস্থ্য তো বেশ ভালো ছিলো, তাই না?
হা! খুব বেশি প্রশ্ন করতেন দেখে একটু ক্লান্তি বোধ করতেন, এছাড়া আর কিছু না।
–তাকে দেখে কখনো চিন্তিত বা মনমরা মনে হতো?
-কোনো ব্যাপারে তিনি মনমরা থাকতেন না। অলিভ কাঁপা হাতে ব্যাগ খুলে রুমাল বের করলেন। বিশ্রী ব্যাপার সব, তার গলা কাঁপছে। অসম্ভব, আমাকে না বলে উনি কোথাও যেতেন না। নিশ্চয়ই ওকে কেউ গুম করেছে। এরকম ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে। হয়তো বা উনি মারাও যেতে পারেন।
–আহা, দয়া করে শুনুন মিসেস বেটারটন, এতখানি খারাপ চিন্তা করবেন না, তিনি যদি মারা যেতেন তাহলে তার মৃতদেহ পাওয়া যেত।
–নাও হতে পারে। প্যারিসে সবকিছুই সম্ভব, হয়তো তাকে মেরে নর্দমায় খুঁজে দিয়েছে।
–আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, প্যারিসে পুলিশী ব্যবস্থা অত্যন্ত সুষ্ঠু।
রুমালটা সরিয়ে নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন অলিভ। আপনি কী ভাবছেন আমি জানি, কিন্তু সেটা সঠিক নয়। টম কখনোই গোপনীয়তাকে নিয়ে বিক্রি বা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। টম কমিউনিস্ট নয়। তাঁর সারা জীবনের ইতিহাস একটা ভোলা বইয়ের পাতার মতো উন্মুক্ত।
-তার রাজনৈতিক বিশ্বাস কি ছিলো, মিসেস বেটারটন?
আমার ধারণা অ্যামেরিকায় ডেমেক্র্যাট ছিলেন কিন্তু এখানে শ্রমিক দলকে ভোট দিয়েছেন। রাজনীতিতে কোনোদিনই স্পৃহা ছিল না। তিনি শুধু বিজ্ঞানী–প্রতিভাবান বিজ্ঞানী; ব্যাস।
হ্যাঁ, জেসপ বললেন, উনি প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন আর সেটাই ঘটনার মূলবস্তু। হয়তো এরজন্যই তাকে অনেক কিছুর লোভ দেখিয়ে এই দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যায়।
-না, এ ঠিক নয়। অলিভের চোখে ক্রোধের ঝিলিক খেললো। খবরের কাগজ প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে এবং আপনারাও একই প্রশ্ন করছেন। অথচ এ সত্যি নয়। আমাকে আভাস না দিয়ে উনি কোথাও যেতে পারেন না।
–তিনি আপনাকে কিছুই বলে যাননি, তাই তো? জেসপ একথা বলে ওঁকে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
কিছুই বলেননি। উনি কোথায় আছেন, না আছেন আমি কিছুই জানি না। ওকে গুম করা হয়েছে হয়তো বা মেরেও ফেলা হয়েছে। বিশ্বাস করুন, এভাবে আর আমি চলতে পারছি না। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, অসহ্য, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন না?
জেসপ চেয়ার ছেড়ে এসে বলতে লাগলেন, মিসেস বেটারটন, আমি দুঃখিত। আপনার স্বামীর খোঁজ পাবার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। দেশবিদেশের প্রান্ত থেকে রোজই কিছু-না-কিছু খবর আসছে।
অলিভ তীক্ষ্ণ স্বর করে বললো, কোথাকার খবর, কী খবর আসছে?
–অনেকের খবর। খবরগুলো বাছাই করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। জানেনই তো, . এসবের ক্ষেত্রে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ফক্কা।
-কিন্তু আমাকে সবকিছু জানতে হবে, অলিভ বলতে লাগলেন। এভাবে চলা অসম্ভব।
–স্বামীর জন্য খুব চিন্তা করেন, মিসেস বেটারটন?
–অবশ্যই চিন্তা করি। চিন্তা করাই স্বাভাবিক, মাত্র ছমাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।
-আমি জানি, তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি বলে মাফ করবেন–আপনাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি বা অন্য কোনো মহিলাকে নিয়ে মন কষাকষি হয়েছিল?
-মোটেই না–একথা আপনাকে আগেও বলেছি। গত এপ্রিল মাসে মাত্র আমাদের বিয়ে হয়েছে।
–আপনি বিশ্বাস করুন একথা আমি মোটেই বোঝাতে চাইছি না যে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে–কিন্তু একজন মানুষ হঠাৎ উবে গেলে তার সবদিক খুঁটিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে আপনি বলছেন–বর্তমানে আপনার স্বামীকে এখনও উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত বা কোনো বিষয়ে চঞ্চল বলে মনে হয়নি?
আপনি হয়তো জানেন মিসেস বেটারটন, আপনার স্বামী যে ধরনের কাজ করেন বা পরমাণুসংক্রান্ত কাজ, এটাতে কঠোর নিরাপত্তা মেনে চলতে হয়। এই অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
অলিভ না হেসে বললেন, উনি অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলেন।
–নিজের কাজকর্ম সম্পর্কে উনি কি খুব খুশী ছিলেন? আপনার সঙ্গে কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতেন?
-না, ওসব বড়ই কুটচালের ব্যাপার।
–তিনি যে এই আণবিক বোমার বিধ্বংসী সম্ভাবনা সম্পর্কে বিবেকের তাড়নায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন একথা আপনি মনে করেন না, তাই তো? বিজ্ঞানীরা কিন্তু এক-একসময় এই কথাটা খুব বেশি করে অনুভব করেন।
না–তাকে এ ধরনের কথা কখনো বলতে শুনিনি।
জেসপ বললেন, দেখুন মিসেস বেটারটন, আমি যা বলতে চাইছি তা হলো আপনার স্বামীর সম্পূর্ণ ছবি। তিনি কী ধরনের লোক ছিলেন সেটাই জানতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি আমাকে সাহায্য করছেন না।
-আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি-এর থেকে বেশি আমি কী বলতে পারি?
-হ্যাঁ, আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তবে সেগুলি নেতিবাচক, ইতিবাচক উত্তর আপনি দেননি? একজন লোকের সম্পর্কে সব কিছু জানা থাকলে তবে কাজের সুবিধা হয়, লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যায়।
একটু চিন্তা করে অলিভ বললেন, বুঝলাম, হ্যাঁ, টম সবসময়ই হাসিখুশী, নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। এবং বুদ্ধিমানও।
জেসপ হেসে বললেন, এটা তো একজন লোকের গুণের কথা, আমরা এবার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলোচনা করি। আচ্ছা তিনি কি খুব বেশি পড়াশুনা করতেন?
-হ্যাঁ, একটু বেশিই পড়তেন।
–কী ধরনের বই পড়তেন?
–এই জীবনী। মাঝেমধ্যে বুক সোসাইটির সুপারিশ এবং ক্লান্ত থাকলে রহস্যকাহিনী পড়তেন।
–একেবারে রীতিনিষ্ঠ পড়ুয়া, বিশেষ করে কোনো ধরনের বইয়ে আগ্রহ ছিলো না, আচ্ছা উনি কি তাস বা দাবা খেলতেন?
ভালো ব্রিজ খেলতো ও, প্রতি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন আমরা ডাঃ ইভান্স আর তার স্ত্রীর সঙ্গে তাস খেলতাম।
-আপনার স্বামীর কি অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো?
–হা, ও খুব মিশুকে।
-না, ঠিক তা বলছি না আমি। আমি বলতে চাইছি তিনি কি এমন ধরনের লোক ছিলেন, যিনি বন্ধুদের জন্য চিন্তা করেন?
–আমাদের দু-এজন প্রতিবেশীর সঙ্গে ও গলফ খেলতো।
–তার নিজের কোনো বিশেষ বা অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলো না?
না আপনি তো জানেনই তার জন্ম কানাডায়, এবং জীবনের অনেকগুলো বছরই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে বেশি লোকের সঙ্গে ওর পরিচয় ছিলো না।
জেসপ টেবিলের কাগজপত্রগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন, দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে তিনজন লোক টমের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তাদের নামও রয়েছে এখানে। এর থেকে এটুকু বুঝতে পারছি যে বাইরের দুনিয়ার মাত্র এই তিনজনের সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল। এঁদের উপর আমরা নজর রাখছি। প্রথম জন হচ্ছে ওয়াল্টার গ্রিফিথ। ইনি হারওয়েলে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
-হ্যাঁ, উনি ইংলন্ডে বেড়াতে এসে টমের সাথে দেখা করে যান।
–তাতে আপনার স্বামীর প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিলো?
–আমেরিকায় থাকতে ওদের বন্ধুত্ব ছিল, টম ওকে দেখে আশ্চর্য এবং খুশীও হয়েছিলো।
–গ্রিফিথকে দেখে আপনার কেমন মনে হয়েছিল, একটু বর্ণনা দিন তো?
–কিন্তু তার সম্পর্কে আপনার সব কিছুই জানা।
–তার সম্পর্কে আমরা সব জানলেও আপনি তাকে কী ভেবেছেন সেটা জানতে চেয়েছি। মার্জিত ব্যবহার করেছিলেন, এবং মনে হয়েছিল..টমকে উনি খুব ভালোবাসেন। টম ইংল্যান্ড থেকে চলে আসার পর সেখানে কী ঘটেছে সেসব কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, সাধারণ প্রতিবেশীদের গল্প বলে মনে হয়েছিলো। আমি তাদের কাউকে দেখিনি, চিনিও না, এ আলোচনা আমি শুনিওনি। ওরা যখন স্মৃতিচারণে মশগুল, তখন আমি রাতে খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম।
রাজনৈতিক কোনো আলোচনা এসে পড়েনি?
–আপনি কি আবার বলতে চাইছেন তিনি কমিউনিস্ট। অলিভ বেটারটনের মুখটা আরক্ত হয়ে উঠলো। আমি নিশ্চিত যে তিনি এরকম ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত নন। যতদূর জানি সরকারী কাজে জিলা-এ্যাটর্নী অফিসে এসেছিলেন তিনি। টম একবার তাকে আমেরিকায় ‘ডাইনী ধরার ব্যাপারে কী যেন একটা রসিকতা করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, আমেরিকায় ওটার প্রয়োজন আছে, আমরা এখানে বসে সেটা বুঝতে পারবো না। এর থেকেই বোঝা যায় উনি কমিউনিস্ট নন।
মিসেস বেটারটন, অত উত্তেজিত হবেন না।
–আমি হাজারবার বলছি টম কমিউনিস্ট ছিলেন না। আর আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না।
–হ্যাঁ এবার বাইরের দুনিয়া থেকে আসা দ্বিতীয় ব্যক্তি ডঃ মার্ক লুকাস, লন্ডনের ডরসেটে তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয় আপনাদের।
-হ্যাঁ, আমরা ডরসেটে নৈশাহার করছিলাম। রসায়ণশাস্ত্রের গবেষক, নাম লুকাস, এগিয়ে এসে টমকে জড়িয়ে ধরলেন। টম যখন আমেরিকায় থাকতো তখনই তার সাথে শেষ দেখা। পরে ভদ্রলোক আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এসব তো…
-হ্যাঁ, এসব আমি জানি। ভদ্রলোককে দেখে আপনার স্বামী কি খুব খুশী এবং অবাক হয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, ভীষণ খুশী এবং ভীষণই অবাক হয়েছিলেন।
–আপনি নিশ্চিৎ নন? জেসপ বললেন।
–টম যে তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি সেটা পরে ও আমাকে বলেছিল।
–এটা কি নিছকই সাক্ষাৎকার আপনার মনে হয়? পরে কি আবার দেখা-সাক্ষাৎ করার দিন ধার্য হয়নি?
-না, এটা নিছকই হঠাৎ দেখা।
-এবার বাইরে থেকে আসা তৃতীয় ব্যক্তি হলেন একজন মহিলা, নাম–ক্যারল স্পীডার। এঁকে আপনার কেমন মনে হয়েছে?
-ভদ্রমহিলার জাতিসঙ্ঘে কোনো কাজ ছিলো। একদিন টমকে জিজ্ঞেস করেন মধ্যাহ্নভোজে আসতে পারবেন কিনা?
–আপনারা গিয়েছিলেন?
–না।
–আপনি যাননি, কিন্তু আপনার স্বামী গিয়েছিলেন।
–কি বললেন? অলিভ বললেন।
–যেন আপনাকে উনি কিছু বলেননি?
–না।
অলিভ বেটারটন কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেলেন। জেসপ আশার আলো খুঁজে পেলেন। মিসেস বেটারটন বললেন, আমি বুঝতে পারছি না টম এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি কেন?
–হ্যাঁ, ১২ই আগস্ট বুধবার মিসেস স্পীডার যেখানে থাকতেন সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ সারেন।
–বারোই আগস্ট?
হা। হা…ঐ সময়ে ও লন্ডন গিয়েছিল বটে কিন্তু আমাকে কিছুই বলেনি। হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন, ভদ্রমহিলাকে কেমন দেখতে বলুন তো?
জেসপ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, উদ্ভিন্নযৌবনা নন, কর্মদক্ষ এবং চটপটে। সুন্দরী নন, আপনার স্বামীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিলো এরকম খবরও নেই। তাই অদ্ভুত লাগছে এই সাক্ষাৎকার কেন তিনি গোপন করলেন?
–হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।
এবার একটু ভালো করে চিন্তা করে বলুন, প্যারিস সম্মেলনের আগে আপনার স্বামীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছিলেন কি?
না, আমি কিছু লক্ষ্য করিনি।
জেসপ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বেজে উঠল এবং তিনি কথা বললেন।
অন্যপ্রান্ত থেকে কেউ একজন বললো, বেটারটন সংক্রান্ত তদন্তের ব্যাপারে উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। কী নাম?–অন্যপ্রান্ত থেকে বললো, স্যার নামটা বুঝতে পারছি না, বানানটা বলছি।
ঠিক আছে বলো। ফোনের ওপাশ থেকে যে কথাগুলো হলো তা তিনি কাগজে লিখে জিজ্ঞেস করলেন উনি কি পোল্যান্ডের লোক?
–কিছু বলেননি স্যার।
আচ্ছা ওকে বসতে বলল।
এবার জেসপ অলিভকে দেখলেন, বিধ্বস্ত, নিঃস্ব, স্থিরমূর্তির মতো বসে আছেন। জেসপ সদ্যলেখা অংশটুকু অলিভকে দেখালেন। এ নামে কাউকে চেনেন?
নামটা দেখার সাথে সাথে অলিভ ভয় পেয়ে চোখ দুটো বড় বড় করলেন। তারপরেই বললেন, উনি আমার কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন।
কবে?
গতকাল, উনি টমের প্রথমা স্ত্রীর পিসতুতো ভাই, টমের অন্তর্ধান সম্পর্কে খুবই চিন্তিত। আমাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।
-এঁর কথা আগে শুনেছেন বা আপনার স্বামী ওঁর কথা কখনো বলেছেন?
–না।
–উনি আপনার সতীনের পিসতুতো ভাই নাও হতে পারেন।
অলিভ বললেন, একথা মনে হয় না আমার। টমের প্রথমা স্ত্রী প্রফেসর ম্যানহেইমের মেয়ে। ওঁর চিঠি পড়ে মনে হয় টম এবং টমের প্রথমা স্ত্রীর সম্পর্কে উনি সব জানেন। কিন্তু যদি লোকটা আসল না হয় তাহলে কে হতে পারে আপনি মনে করছেন?
–এখানে আমরা এত অজস্র জিনিষ নিয়ে আলোচনা করি, যে কোনো বিষয়ের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশের সামান্য এদিক-ওদিক হলেও আমাদের সন্দেহ হয়।
জেসপ বললেন, বদ্ধ ঘরের একটা আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়া আছে।
অলিভ বেটারটন বললেন, চুপচাপ বসে অপেক্ষা করা–এ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি কোথাও চলে যেতে চাই। যেখানে সাংবাদিকরা টেলিফোন করে বিরক্ত করবে না। বন্ধু-বান্ধব কোনো রকম বিরক্ত করবে না। ডাক্তার দেখিয়েছি। উনি আমাকে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বলেছেন।
ব্যাগ হাতড়ে একটা খাম বের করে তিনি জেসপকে দেখালেন, দেখুন ডাক্তার কী লিখেছেন?
চিঠি পড়ে জেসপ বললেন, নিশ্চয়ই যাবেন।
-না–আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আপত্তি করবেন।
–আপত্তি করবার কিছু নেই। কোনো খবর পেলে যোগাযোগ করতে পারি এরকম ব্যবস্থা করবেন।
নিশ্চয়ই।
–কোথায় যাবার কথা ভাবছেন?
–এমন কোথাও যেখানে সূর্যের আলো আছে এবং বেশি ইংরেজ নেই। যেমন ধরুন-স্পেন, বা মরক্কো।
ভারি সুন্দর জায়গা আপনার ভালো লাগবে।
অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে জেসপকে করমর্দন করে অলিভ চলে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে জেসপ ফোন করে বললেন, মেজর গ্লাইদরকে পাঠিয়ে দিতে।
.
০২.
মেজর গ্লাইদর? জেসপ নামটা উচ্চারণ করে একটু থামলেন। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বললেন, নামটা একটু বেয়াড়া ধরনের। যুদ্ধের সময় সহযোদ্ধারা আমাকে গ্লাইডার বলে ডাকতেন।
-আপনি কি এখন আমেরিকা থেকেই আসছেন?
–হ্যাঁ, আমি এক সপ্তাহ আগে এখানে পৌঁছেছি। আচ্ছা আপনি মিঃ জেসপ?
–হ্যাঁ, আমি জেসপ।
আগন্তুক বললো, আপনার নাম আগেও শুনেছি।
-সত্যি, কার কাছে শুনেছেন?
আগন্তুক মুচকি হেসে বললো, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো এবং আপনাকে একটা চিঠি দেখাবো। তারপর সে চিঠিটা দিল।
সামান্য কয়েকটা লাইনের চিঠি। জেসপ ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। চুলগুলো ছোটছোট করে কাটা। কথা বলেন খুব ধীরে ধীরে। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল তার নিজের প্রতি খুবই আস্থা। এটাই জেসপের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো।
ভদ্রলোককে দেখে নিক্কিার মনে হলো। তার সাথে চালাকি করা বা বিশ্বাসঘাতকতা করা সহজসাধ্য নয়। তাঁর গুণগুলোকে বিচার করে জেসপ খুশি মনেই বললেন, এবার বলুন, আপনার জন্য আমরা কী করতে পারি?
–আমি এসেছিলাম টম বেটারটন সম্পর্কে খবর জানতে! আমি একজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম যাঁর কথায় আস্থা রাখা যায়। তারা আপনার কথা বললেন।
-কিন্তু বেটারটন সম্পর্কে কোনো খবরই আমার কাছে নেই।
আগন্তুক বললেন, বাজারে কীরকম গুজব চলছে জানেন তো? আমার ধারণা ছিল যে, বিশেষ কোনো কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁকে বিশেষ কোনো জায়গায় পাঠানো হয়েছে।
জেসপ একটু আহত হলেন। বললেন, বেটারটন একজন বিজ্ঞানী। তিনি কূটনীতিক বা গুপ্তচর নন।
–আপনি হয়তো ভাবছেন আমার এত মাথাব্যথা কেন? টমের সাথে বৈবাহিকসূত্রে আমার একটা আত্মীয়তা আছে।
–হ্যাঁ! আমার ধারণা আপনি স্বৰ্গত ম্যানহেইমের ভাগ্নে।
–বা! ইতিমধ্যেই সব জেনে ফেলেছেন! আপনাদের এখানে সবই নখদর্পণে থাকে দেখছি।
-কতলোক এখানে আসে। বেটারটনের স্ত্রী একটু আগে এসেছিলেন। আপনার লেখা একটা চিঠিও দেখালেন।
–আমার মা ছিলেন ম্যানহেইমের একমাত্র বোন। দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় ওয়ারশয় থাকতাম বটে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মামারবাড়িতে কাটতো। তার মেয়ে এলসা আমার নিজের বোন ছিল। আমার মা, বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মামা, এলসার কাছে এসে উঠলাম। সুখেই কাটছিলো দিনগুলো। তারপর এল যুদ্ধ। যুদ্ধের পরিস্থিতি আপনাকে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। তখনই মামা আর এলসা পালিয়ে এলেন আমেরিকায়। যুদ্ধ শেষ হবার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। ইউরোপের প্রতি দায়িত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবার পর ঠিক করলাম স্থায়ীভাবে মামা এবং বোনের সাথে আমেরিকায় থাকবো। দুঃখের বিষয় এসে শুনলাম মামা ও বোন দুজনেই মারা গেছে। এলসার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। এরপরেই কাগজে দেখলাম টম বেটারটনের অন্তর্ধানের খবর, খবর পেয়ে এখানে এসেছি।
–ভদ্রলোক, জেসপের কাছ থেকে কিছু শোনার আশায় উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
জেসপ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন–টম কেন উধাও হলেন, সম্ভবতঃ আপনি কিছু জানেন, তাই না?
জেসপ তারিফ না করে পারলেন না যে ভদ্রলোক জেসপকে প্রশ্ন করছেন। জেসপ হেসে উত্তর দিলেন, সত্যই আমরা কিছু জানি না, এ বিশ্বাস রাখতে পারেন।
-কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ তো করছেন?
জেসপ বললেন, তা অবশ্য ঠিক। একটার পর একটা ঘটনা যেভাবে ঘটছে..
–আমি জানি। এক নিশ্বাসে অনেক ঘটনার উল্লেখ করলো ভদ্রলোক। এবং তারপর বললো, এঁরা সবাই বিজ্ঞানী। হ্যাঁ এঁরা কি লৌহযবনিকার অন্তরালে সবাই স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন?
আমার এ ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয়। আমার মাথাব্যথা শুধু বেটারটনের জন্য। আপনার দুশ্চিন্তার কারণটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি এজন্য আমি দুঃখিত। আমি ভেবেছি বেটারটনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অনেক দূরের। তাকে কোনোদিন চোখেও দেখেননি আপনি।
আসলে কি জানেন, পোল্যান্ডের লোকেরা সংসারটাকে খুব বেশি ভালোবাসে। সংসারের প্রতি দায়ও অনেক। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালো। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
জেসপও উঠে দাঁড়ালেন। আপনাকে কোনো কিছু সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। যদি কোনো খবর পাই আপনাকে কোথায় জানাবো?
-মার্কিন দূতাবাসের ঠিকানায় দিলেই আমি পাবো। ধন্যবাদ বলে উনি বেরিলয়ে গেলেন।
ভদ্রলোক বেরিলয়ে যেতে কর্নেল হোয়ারটনকে ঘরে আসতে বললেন।
হোয়ারটন ঘরে ঢুকতে জেসপ বললেন, শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা একটু এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কিরকম?
–মিসেস বেটারটন বাইরে যেতে চান।
হোয়ারটন বললেন, কর্তার সাথে দেখা করতে?
–তাই তো মনে হচ্ছে। সঙ্গে ডাক্তারের একটা চিঠিও এনেছিলেন, বেশ জমেছে। আমরা সত্যি ঘটনাকে কখনও গুরুত্ব দিই না। ভদ্রমহিলা চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ।
ওর কাছ থেকে আর কোনো কথা বার করতে পারোনি।
–খুবই সামান্য। হা–কী হয়েছে?
–বেটারটন এই মধ্যাহ্নভোজনের কথা বলেনি।
এই ক্যারল স্পীডার একবার নাজেহাল হয়েছিল। বেটারটনের উধাও হওয়ার ব্যাপারে আমরা এই একজনকে পেলাম।
মিসেস বেটারটনকে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে পারে এমন কারোর সাথে যোগাযোগ আছে কি?
-ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই। বেটারটনের প্রথম পক্ষের বউয়ের পিসতুতো ভাই যে পোল্যান্ডে থাকে সেই ভদ্রলোক এসেছিলেন। অনেক কথা খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলো।
–কিরকম মনে হলো তাকে?
জেসপ বললেন, আসল লোক বলে মনে হলো না। তার হাবভাব দেখে কেমন যেন মেকী মেকী মনে হলো।
-মিসেস বেটারটনকে বাইরে পাঠাবার মূলে এই লোকটা থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে?
হতেও পারে, লোকটা আমায় যেন কেমন হতভম্ব করে দিয়েছে।
ওর পেছনে টিকটিটি লাগাবার কথা ভেবেছ কি?
–তাই তো মনে হচ্ছে। হোয়ারটন বলে উঠলেন, বেশ, এবার কিভাবে এগোবে?
প্রথমে জানেত-এর কথাই ভাবছি, তারপর স্পেন অথবা মরক্কো।
হোয়ারটন ফাইলের পাতা ওল্টাতে লাগলেন। এবারেও যদি কিছু না করতে পারি
জেসপ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, আমিও কদিন একটু ঘুরে আসি।
.
০৩.
হিথরো বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে থাকা যাত্রীরা সব উঠে দাঁড়ালেন।
হিলারীও কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চললো। তাহলে সে পালাতে পারছে। এক অজানা যুগের গুঞ্জরণ নিয়ে নির্দষ্ট আসনে গিয়ে বসলো হিলারী। মানসিক যন্ত্রণা–এই প্রথম মুক্তির এক রিনরিনে আবেশ সে অনুভব করতে পারলো।
বিমানের ছোট চাকায় তখন গতি এসেছে। বিমানটা যখন শেষ সঙ্কেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো তখন হিলারীর মনে হলো, প্লেনটা যদি মাটি ছেড়ে আর কোনোদিনও না ওড়ে, যদি আচমকা ধাক্কা খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়–তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়, নিমেষে সব দুঃখ-যন্ত্রণা সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ইঞ্জিনটা গর্জন করে উঠলো তারপর তাকে নিয়ে প্লেনটা দ্রুত, আরো দ্রুত ছুটতে শুরু করলো।
ওরা অনেক উঁচুতে উঠতে লাগলো। হিলারীর মনে হতে লাগলো নিচে সবকিছুই খেলনার মতো দেখাচ্ছিল। অনেকটা যাওয়ার পর হিলারী চোখ বুজলো। সে ইংল্যান্ড ছেড়েছে, নাইজেলকে ছেড়েছে। ব্রেন্দার কবরকেও ছেড়ে এসেছে। সবকিছুকে পেছনে ফেলে এসেছে। সে এসব চিন্তা করে ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ ঘুম ভাঙলে হিলারীর খেয়াল হলো, প্লেনটা নিচের দিকে নামছে, প্যারিস। সোজা হয়ে বসে সে হাতব্যাগটা টেনে নিল, কিন্তু বিমানসেবিকা বললো কুয়াশা থাকার জন্য তারা ব্যুভেতে অবতরণ করছে।
কুয়াশার মধ্যে যাত্রীদের একটা পুরোনো কাঠের বাড়িতে এনে তোলা হল। একজন বললো, যুদ্ধের সময়কার পুরোনো বিমানঘাঁটি এটা। ঘর গরম করার বা একটু আরামের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবু বাঁচোয়া, এরা ফরাসি, অতিথিদের জন্য কিছু একটা পানীয়ের ব্যবস্থা করবে। সত্যিই দেখা গেল, যাত্রীদের নানারকম পানীয় পরিবেশন করতে লাগলো।
কয়েকঘন্টা কেটে যাওয়ার পর দেখা গেল আরো একটা প্লেন কুয়াশার জন্য এখানেই নেমেছে।
হিলারীর কাছে সবকিছুই যেন অবাস্তব মনে হচ্ছিল। অবশেষে একটা ঘোষণা শোনা গেল। যাত্রীদের বাসে করে প্যারিসে পৌঁছে দেওয়া হবে। যাত্রীরা লটবহর নিয়ে বাসের দিকে ছুটলো।
মাঝরাতে হিলারী প্যারিসে পৌঁছালো। একটা হোটেলে সে উঠলো।
ক্যাসাব্লাঙ্কা যাওয়ার বিমান পরের দিন সকালে ওরলি বিমানবন্দর থেকে ছাড়ার কথা। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলো সবকিছুই যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। তার প্লেনে আসন সংরক্ষিত আছে জেনেও সে ঐ প্লেনে যেতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরে তাকে জানানো হলো, দাকারগামী একটা প্লেন আজকের জন্য ক্যাসাব্লাঙ্কা হয়ে যাবে। হিলারী কোনোরকম প্রতিবাদ না করে রাজী হয়ে গেলো। হিলারী বেরিলয়ে এলো, তার পাশাপাশি একজন কুলী বললো, খুব জোর বেঁচে গিয়েছেন আপনি মাদাম।
–কেন কী হয়েছে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
সে বললো, প্লেনটা নামার সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মারা গেছে। চার-পাঁচজন যারা বেঁচে আছেন তাদের সবাই হাসপাতালে আছে, তাদের অবস্থা খুব খারাপ।
হিলারী চিন্তা করতে শুরু করলো, কেন আমি ঐ প্লেনে গেলাম না? গেলে–এতক্ষণে সব শেষ হয়ে যেতো–নিশ্চয়ই আমি মারা যেতাম, সব যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটতে। কেন-কেন গেলাম না আমি?
ক্যাসাব্লাঙ্কায় নেমে সে হোটেলে এলো। সে যেমনটি কল্পনা করেছিলো সেইরকমই হলো।
শোবার ঘরের জানালাটা হাট করে দিয়ে সে রাস্তা দেখাতে লাগলো। হ্যাঁ, এমনটাই সে কল্পনা করেছিলো। মুক্তি, মুক্তি ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার পর থেকে মনের মধ্যে এই সুরেরই গুঞ্জরণ চলছিলো। কিন্তু ঠিক তার পরমুহূর্তেই মনে হল মুক্তি মুক্তির কোনো পথই নেই তার। সত্যিই তো, ইংল্যান্ডের মতো এখানেও সবকিছুই রয়েছে। সে নিজে হিলারী ক্র্যাভেনই রয়েছে। কী করে ভাবলাম ইংল্যান্ড থেকে দূরে কোথাও গেলেই আমার মন, আমার চিন্তা, আমার অনুভূতি–সব বদলে যাবে।
সেই ছোট্ট ঢিবিটা ব্রেন্দার কবর–সেটা ইংল্যান্ডেই রয়েছে। আর নাইজেল তার স্ত্রীকে বিয়ে করবে–ইংল্যান্ডেই। সে জীবনে অনেক কিছুই সহ্য করেছে কারণ তখনও ব্রেন্দা বেঁচেছিলো। ব্রেন্দার জন্যই সে সবকিছু সহ্য করেছে। অতীতকে ভুলে গিয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নিয়ে থাকবে বলে আশা করে এতদূর মরক্কোতে এসেছে। অতীত যেন তার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই।
যদি ঘনকুয়াশা পথ আড়াল করে না দাঁড়াত, যদি তার নির্দিষ্ট বিমান না আসতো, এতক্ষণে তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো৷ এতক্ষণে সে হয়তো সরকারী মর্গে শায়িত থাকতো। একই পরিণতি সে নিজেও ঘটাতে পারে, শুধু একটু কষ্ট করতে হবে এই যা। শুধু একটু ঘুমের বড়ি থাকলে কাজটা অনেক সহজ হতে পারতো। এক্ষুনি সে যাবে ওষুধের দোকান খুঁজে বের করবে। চারটে দোকান ঘুরে ঘুরে ঘুমের বড়ি নিয়ে সে হোটেলে ফিরে এলো।
হোটেলে ফিরে পোশাক পালটে নৈশাহারে যাবার সময় হিলারীর নিজেকে বেশ হাল্কা মনে হচ্ছিল।
হিলারী একরাশ দামি খাবার আর আধবোতল মদ আনতে বলে চুপ করে বসে রইলো। কেমন যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলো সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচারক জলের বোতল এনে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলো। দরজায় চাবি লাগিয়ে দেরাজ খুলে ঔষধের বড়িগুলো নিল এবং গ্লাসে জল ভরে নিল। এবার যেন তার একটু ভয় ভয় লাগছিল কিন্তু ভয়টাও সুখের। এতদিনে সে মুক্তির স্বাদ পেতে চলেছে।
হাত বাড়িয়ে সে যখন প্রথম বড়িটা খেতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো। সে বসে রইলো। দ্বিতীয়বার টোকা দেবার পরও হিলারী বসে রইল। তারপর সে দেখলো দরজার চাবিটা উল্টো দিক থেকে ঘুরছে। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে লাগলো। তারপর দেখলো সে, ও যখন দোকানে ঔষধ কিনতে গিয়েছিল তখন সে একজন পেঁচামুখো লোককে দেখেছিল। এখন সেই ভদ্রলোকটিই ঘরে ঢুকলেন। এগিয়ে এসে হিলারীর সামনে এসে বললেন, আমার নাম জেসপ।
হিলারী রেগে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আপনার কী প্রয়োজন, জিজ্ঞেস করতে পারি?
জেসপ বললেন, ভারি মজার কথা, আমিও আপনাকে ঠিক ঐ প্রশ্নটা করতে এসেছিলাম। ইঙ্গিতে তিনি ঔষধগুলোকে দেখালেন।
হিলারী চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ দুটো সরু করে, জোর করে একটু হাসি টেনে আনলো মুখে। কী অদ্ভুত লোক আপনি–ভাবছেন, আমি আত্মহত্যা-টত্যা করতে যাচ্ছিলাম।
-শুধু ভাবছি না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
-আপনি আমাকে আত্মহত্যা থেকে আটকাতে পারেন কিন্তু আগামীকাল বা পরশু যদি আমি কিছু করতে চাই তবে কি আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন? আমার বাঁচার কোনো আকষণই নেই।
জেসপ বললেন, বেশ মজার ব্যাপার।
হিলারী বলেন, মোটেই মজার নয়। আমার স্বামী, যাকে আমি ভালোবাসতাম, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার একমাত্র সন্তান-ম্যানেনজাইটিসে ভুগে মারা গেলো। আমার কেউ নেই। আমি কার জন্য বেঁচে থাকবো। আত্মহত্যা সম্পর্কিত অনেক কথা হওয়ার পর জেসপ আসল কথায় আসলেন। জেসপ বলতে শুরু করলেন হিলারীকে, আপনি নিশ্চয় দৈনিক সংবাদপত্র পড়েন। মাঝে মাঝেই হয়তো বিভিন্ন বিজ্ঞানীর উধাও হওয়ার খবর পড়ে থাকবেন। মাস ছয়েক আগে টমাস বেটারটন নামে এক বিজ্ঞানী উধাও হন।
হিলারী বললো, হ্যাঁ, খবরটা কাগজে পড়েছিলাম।
জেসপ বলতে লাগলো, খবরের কাগজের চেয়ে অনেক বেশি খবর আমাদের কাছে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রসায়নশাস্ত্রের গবেষক, কেউ হয়তো পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে–তখন কেন এই লোকগুলো চলে যাচ্ছে।
হিলারী হাঁ করে চেয়ে রইল।
টমাস বেটারটন দুমাস আগে প্যারিস থেকে উধাও হন।
হিলারী একটু নড়ে চড়ে বসলো। জেসপ বলে চললেন–মিসেস বেটারটন আমাকে এসে বললেন, তার পারিবারিক ডাক্তার তাকে বাইরে গিয়ে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
-হ্যাঁ, এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আমার, শুকনো গলায় বললো হিলারী।
–হ্যাঁ, এই অবস্থা থেকে কিছুদিনের জন্য তিনি মুক্তি চান।
–আমারও তাই মনে হয়।
মিসেস বেটারটনের পেছনে ফেউ লাগাবার ব্যবস্থা করলাম আমরা। গতকাল তিনি ক্যাসাব্লাঙ্কার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ত্যাগ করলেন।
হ্যাঁ, মরক্কোর অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোও ঘুরে নেবেন।
সমস্ত জায়গাতেই তিনি প্লেনে যাবেন। কিন্তু মিসেস বেটারটনকে সম্পূর্ণ এক অজানা জগতের পথে পা বাড়াতে হবে।
–হিলারী বললো, এ সবের মধ্যে আমি কিভাবে আসছি তা আমার মাথায় ঢুকছে না।
জেসপ হাসলেন। এ ব্যাপারে আপনি আসছেন, কারণ আপনার মাথায় একরাশ সুন্দর সোনালি চুল আছে বলে। হ্যাঁ, চুল। মিসেস বেটারটনের মাথায় সোনালি চুল প্রত্যেকটি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। আপনি হয়তো শুনেছেন–আপনি যে প্লেনে এসেছেন ঠিক তার আগের প্লেনটা নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে চুরমার হয়ে গেছে।
জানি, আমার ঐ প্লেনে আসার কথা ছিলো।
–যাক, মিসেস বেটারটনও ঐ প্লেনে ছিলো। মারা যাননি। সাংঘাতিক আহত অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ডাক্তাররা বললেন, কাল সকাল পর্যন্ত তিনি বাঁচবেন না।
হিলারী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
এবার আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, জেসপ বললেন, এবার প্রস্তাব করছি, আপনি মিসেস বেটারটনে রূপান্তরিত হোন।
–কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব। ওরা তো জেনেই ফেলবে আমি মিসেস বেটারটন নই।
–সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে আপনি যাদের ‘ওরা বললেন, তাদের ওপর। আসলে ওরা কথাটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সত্যিই কি এমন কেউ আছে যাদের আমরা ওরা বলে ধরে নিতে পারি? লোকগুলোর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাদের ব্যবস্থার প্রয়োজন। সুতরাং এক্ষেত্রে মিসেস বেটারটনের এই বেড়াতে বেরোনোর যদি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থাকে, এবং তা পূর্বপরিকল্পিত হয় তাহলে জানার কথা নয়। তারা শুধু কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট এক মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে নিজেদের আড্ডায় ফিরে যাবে। মিসেস বেটারটনের দেশভ্রমণের ছাড়পত্রে যেরকম বর্ণনা আছে–সেটাই ওদের যথেষ্ট।
-কিন্তু এখানকার পুলিস মহল? তারা নিশ্চয়ই
জেসপ হেসে বললেন, এদিকটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। ফ্রান্স নিজেও তার অনেকগুলি কৃতী বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদকে হারিয়েছে। সুতরাং এঁরা আমাদেরকে সহযোগিতাই করবে। ব্যাপারটা এরকম হবে–মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আঘাত লাগায় মিসেস বেটারটনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ প্লেনের আরেকজন যাত্রী, ক্র্যাভেনকে ঐ হাসপাতালেই ভর্তি করা হবে। দু-একদিনের মধ্যেই মিসেস ক্র্যাভেন হাসপাতালেই মারা যাবেন এবং মিসেস বেটারটনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। যদিও মিসেস বেটারটন তখনও সামান্য স্মৃতিবিভ্রমে ভুগবেন, কিন্তু তার ভ্রমণসূচী অনুযায়ী চলার কোনো অসুবিধে হবে না। মাথায় আঘাত লাগলে স্মৃতি লোপ পেতে, চালচলনে, কথাবার্তায় অনেক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
তার মানে–পাগলামি।
-তা তো বটেই। এটাই আপনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমাদের সন্দেহ যদি সত্যি হয় আর আপনি যদি এই কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঠিকমতো এগোতে পারেন, তাহলে আপনি বাজিমাত করতে পারবেন। এবার আপনার ওপর নির্ভর করছে। একাজ করতে আপনি ইচ্ছুক কিনা।
আচমকা হিলারী হেসে উঠলো।
–তাহলে রাজী?
নিশ্চয়ই।
.
০৪.
হিলারীর হাসপাতালের ভেতরটায় শীত শীত করছিলো। একটা শয্যার পাশে লোহার চেয়ারে সে স্থির হয়ে বসেছিল।
মাথায় পট্টিবাঁধা অচেতন অবস্থায় অলিভ বেটারটন শুয়ে আছেন। শয্যার পাশে সেবিকা এবং ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু জেসপের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর বেশিক্ষণ বাঁচানো যাবে না। নারী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
–আর একবারের জন্যও কি জ্ঞান ফিরবে না?
ডাক্তার বললেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে একবার ফিরলেও ফিরতে পারে।
–আর কিছুই আপনাদের করার নেই–মানে কোনো উত্তেজক ওষুধ?
মাথা নেড়ে অক্ষমতা জানিয়ে বেরিলয়ে গেলেন ডাক্তার। জেসপ হিলারীকে ইশারায় ডেকে বললেন, ডাক্তার যা বলে গেলেন, শুনেছেন তো?
-হ্যাঁ, কিন্তু কি জিজ্ঞেস করবো?
-যদি জ্ঞান ফেরে যে-কোনো রকম খবর যদি আপনি নিতে পারেন–যেমন, কোনো টুকরো কথা, কিংবা ভুল বলতে বলতে কোনোরকম সঙ্কেত বা কোনোরকম খবর পাঠাতে চায়–যাহোক বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
হিলারী হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে বললো–একজন মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছাটাকে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করবো, তাই চাইছেন আপনি?
বেশ, তাই যদি আপনার মনে হয় তবে আপনি আপনার খুশিমত নিশ্চয় প্রশ্ন করতে পারেন। হিলারী শয্যার পাশে ফিরে এলো। এ নারী তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলো আর…। ভাবতে ভাবতে সময় কেটে গেলো। নার্স ঘড়ি দেখে বললো মনে হচ্ছে শেষ সময় হয়ে আসছে। আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।
মিসেস বেটারটনের জ্ঞান ফিরবার পর তার চোখ পড়লো হিলারীর দিকে। উনি জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায়…? ডাক্তার রোগীকে দেখতে দেখতে বললেন, আপনি হাসপাতালে আছেন মাদাম। ঐ প্লেনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো।
–ওই প্লেনে?…ওই প্লেনে? ফিসফিস করে বারবার বলতে লাগলেন।
–ক্যাসাব্লাঙ্কায় কারো সঙ্গে কি আপনি দেখা করতে চান, মাদাম! কোনো খবর দেবার আছে?
চোখ তুলে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, না। চোখ সরিয়ে আনতে হঠাৎ হিলারীর দিকে তাকিয়ে বললেন-কে-কে?
ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লো হিলারী। নম্রস্বরে বললো, আমিও ইংল্যান্ড থেকে প্লেনে এসেছি। যদি কোনোরকম আপনাকে সাহায্য করতে পারি–আমাকে বলুন।
-না-কিছু নেই–কিছুই বলার নেই–যদি না—
বলুন?
–না, কিছু না। চোখ দুটো আবার বুজে এলো।
জেসপ এসে দাঁড়ালেন, মৃত্যুপথযাত্রী হঠাৎ পরিচিত কাউকে দেখে অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনাকে আমি চিনি।
-হ্যাঁ, মিসেস বেটারটন, আপনি আমাকে চেনেন। আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন।
-না। চোখদুটো আবার বুজে এলো। জেসপ ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
ডাক্তার হিলারীকে বললেন, আর বেশিক্ষণ নেই। মিসেস বেটারটন আবার চোখ মেলে তাকালেন। ঘরের মধ্যে দুটি নারী এখন একা–দুটি বেদনার মূর্তি যেন মুখোমুখি। অলিভ বেটারটন শ্বাস টেনে বলার চেষ্টা করছিলেন, আমাকে–আমাকে বলুন–আমি কি
ও কি জানতে চাইছে হিলারী বুঝতে পেরে আধশোয়া দেহটার ওপর ঝুঁকে পড়লো।
হ্যাঁ, পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বললো, আপনি মারা যাচ্ছেন। এই কথাটাই আপনি জানতে চাইছেন, তাই না? এবার আমার কথাটা শুনুন। আমি আপনার স্বামীর কাছে যাবার চেষ্টা করবো। যদি কোনো খবর থাকে বলুন।
–ওকে বলো–ওকে বলো–সাবধান। বোরিস–বোরিস–সাংঘাতিক…আর বলতে পারলো না, শ্বাস কষ্ট দেখা দিলো।
হিলারী কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন–আমাকে সাহায্য করার মতো–মানে–আপনার স্বামীর কাছে পৌঁছতে সাহায্য করবে এমন কোনো খবর দিতে পারেন না?
-তুষার।
অস্ফুট টুকরো কথাটা হিলারীর বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। তুষার! বরফ! অলিভ বেটারটন ভাঙাভাঙা কথায় আবার বললেন
তুষার, শুধু তুষার, শুভ্র তুষার
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর।
শেষ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন। যাও…যাও…। গিয়ে ওকে বোরিসের কথাটা বললা…আমি বিশ্বাস করিনি। কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু…কিন্তু বোধহয় সত্যি… তা যদি হয়, তা যদি হয়…কী এক নীরব আর্ত প্রশ্নে ছটফট করতে করতে চোখ দুটো স্থির হলো হিলারীর ওপর। সাবধান…সাবধান…
গলা থেকে বিশ্রী ঘড়ঘড় একটা শব্দ বেরিলয়ে এসে ঠোঁট দুটো একবার থরথর করে কেঁপে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
অলিভ বেটারটন মারা গেলেন।
পরের পাঁচটা দিন প্রচণ্ড মানসিক পরিশ্রম গেলো হিলারীর, যদিও শারীরিক কোনো পরিশ্রমই করতে হয়নি। অলিভ বেটারটনের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যতটুকু খোঁজখবর পাওয়া গেছে সেগুলো লিখে হিলারীকে পড়তে দেওয়া হয়েছে। অলিভ যে বাড়িতে বাস করতো সেটা কেমন, আত্মীয়স্বজন কে কে আছে, তার পোষা কুকুর আর পাখিদের নাম–টমাস বেটারটনের সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে ছটা মাসের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তাকে জানতে হবে। একবার সে জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, এসবের কি কিছু দরকার আছে?
জেসপ বলেছিলেন, হয়তো নেই। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই তোমাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করতে হবে। তুমি একজন কাহিনীকার, একটি নারীর জীবনী লিখছো তুমি, সেই নারী-অলিভ।
যতক্ষণ না তুমি অলিভ বেটারটনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে অলিভ বেটারটন হিসাবে চিন্তাই করতে পারো না।
ছাড়পত্রে যে বর্ণনা আছে, তাতে অলিভ বেটারটন আর হিলারী ক্র্যাভেনের মধ্যে যথেষ্ট মিল।
হিলারী জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি বলছেন, অলিভ বেটারটন বলে পরিচয় দিলে আমাকে কেউ অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু এ বিষয়ে আপনি এত নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কেমন করে?
জেসপ বললেন, কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। কিন্তু এ ব্যাপারটা যারা চালাচ্ছে তাদের কাজকর্মের আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি। আমি হলফ করেই বলতে পারি, এখানে ওদের যে ভগ্নাংশটা কাজ করছে তারা শুধু জানে–অমুক দিন অমুক সময় অলিভ বেটারটন প্লেনে করে এখানে আসবে এবং তাকে অমুক অমুক নির্দেশ দিয়ে দিতে হবে–ব্যাস। ওরা চাইছে অলিভ বেটারটনকে যদি তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তবে টমাস বেটারটনকে দিয়ে আরো ভালো কাজ করাতে পারবে। আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে, নকল একজন অলিভ বেটারটন সৃষ্টি করার চিন্তা সম্পূর্ণ আকস্মিক। প্লেনে দুর্ঘটনা এবং তোমার মাথার চুলের রঙ থেকেই তার উৎপত্তি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো অলিভ বেটারটনের গতিবিধির ওপর নজর রাখা আর আমাদের প্রতিপক্ষও তাই জানে। অতএব সেটা দেখার জন্যই তারা বেশি মাথা ঘামাবে।
–এ সমস্ত আগে চেষ্টা করেননি?
-করেছি, সুইজারল্যান্ডে। খুব বোকার মতো–তাতে আমাদের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম অথচ ব্যাপকভাবে করতে হবে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি চালাকির পরিচয় দিতে হবে আমাদের।
তার মানে আমার পেছনে আপনারা লোক লাগাবেন?
–অবশ্যই।
–কী ভাবে?
জেসপ মাথা নাড়লেন, সেটা তোমাকে জানানো হবে না।
হিলারী বললো, বুঝেছি, প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে আপনাদের সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে আমাকে কাজ করতে হবে।
-এবার তোমার অন্য কাজ। অলিভ বেটারটন সম্বন্ধে সবকিছু জেনে তাকে পুরোপুরি নকল করা।
ঠিক পারবে তুমি। সপ্রশংসভাবে তিনি তার কাঁধ চাপড়ালেন। একটা কথা শুধু মনে রেখো হয়তো তোমার কোনো সময় মনে হবে তুমি নিঃসঙ্গ কিন্তু আসলে তা নয়।
হিলারীর প্রশ্ন, যদি আমি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারি, তখন কী ঘটবে?
–তার মানে?
আমি বলতে চাইছি–শেষ পর্যন্ত যদি আমি টম বেটারটনের সামনে পৌঁছই তখন কী ঘটবে?
জেসপ গম্ভীর হয়ে বললেন, তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি-যদি সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয় তাহলে ঠিক ওই মুহূর্তের জন্যই তোমার নিরাপত্তা থাকবে। নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে–এই অভিযানের মূল কথা হচ্ছে, এ যাত্রা থেকে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
–আপনি কি আমার জন্য একটুও দুঃখ করবেন না?
–দুঃখ করবো, তোমার জন্য? একটুও না। বরং ভয়ঙ্কর বিপদ জেনেও এমন একটা কাজের দায়িত্ব নিতে পারে এমন একজনকে হারাতে হচ্ছে বলে মনে মনে অজস্র অভিসম্পাত দেবো।
এবার হিলারী জেসপকে বললো, আমার আরেকটা কথা মনে হচ্ছে, অলিভ বেটারটনকে দেখতে কেমন ছিলো সেটা ওদের না জানারই কথা, কিন্তু আমাকে যদি কেউ হিলারী ক্র্যাভেন হিসাবে চিনে ফেলে। বিশেষ করে প্লেনের যাত্রীরা।
প্লেনের যাত্রীদের নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তারা সোজা চলে গেছে। যা মিসেস বেটারটনের পোশাকগুলো তুমি পরবে, তার মতো করে চুল বাঁধবে আর মুখের একপাশে একটু পুলটিশ এঁকে নিলে তুমি একেবারে অন্য মেয়ে বনে যাবে। আর একজন ডাক্তার আসবেন তোমার গালে একটা আঁচড় কেটে দিতে। ওষুধ দিয়ে জায়গাটা আগেই অসাড় করে নেবেন। দুর্ঘটনার কয়েকটা সত্যিকারের চিহ্ন তোমার মুখে থাকতেই হবে।
–আপনার সবদিকেই দৃষ্টি আছে দেখছি!
–থাকতেই হবে।
হিলারী বললো, আপনি তো আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি, অলিভ বেটারটন মারা যাবার আগে আমাকে কিছু বলে গেছে কিনা।
আমি বুঝেছি, বলতে তোমার সঙ্কোচবোধ হয়েছে। সেজন্য আমি দুঃখিত।
দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। এরজন্য তোমাকে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি নিজে হলেও তাই করতাম।
–তার কথাটা আপনাকে জানোননা দরকার সে বলেছিলো, ওকে বোলো-মানে বেটারটনকে বোলো, সাবধান–বোরিস-সাংঘাতিক
বোরিস নামটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন জেসপ। ওহহ! আমাদের বিদেশী মেজর বোরিস গ্লাইদার!
–আপনি তাকে চেনেন–কে সে?
পোল্যান্ডের লোক। লন্ডনে একবার আমার সাথে দেখা করতে এসে বলেছিল ও নাকি অলিভ বেটারটনের পিসতুতো ভাই।
ভদ্রলোকের একটা বর্ণনা দিতে পারেন, তাহলে আমার পক্ষে তাকে চেনা সহজ হবে।
-হ্যাঁ, বলছি, ছফুট লম্বা। ওজন প্রায় ১৬০ পাউন্ড হবে। বেশ সুন্দর দেখতে। মুখটা একটু কাঠ কাঠ–ভাসা ভাসা চোখ, আচার-ব্যবহার একদম বিদেশী। হা-অলিভ বেটারটন যদি বলে থাকে যে ওই বোরিস গ্লাইদার সাংঘাতিক লোক–আমি বলবো সম্ভবত সে ঠিকই বলেছে।
.
০৫.
সেন্ট লুই হোটেলের বৈঠকখানা ঘরে বসে তিনজন মহিলা যে যার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মিসেস কেলভিন বেকার, খাটো করে গোলগাল দেখতে, তার প্রতিটি কাজে দুরন্ত উৎসাহ, তিনি ঘরে বসে চিঠি লিখছিলেন। তাকে দেখে বোঝাই যায় তিনি পাকা একজন আমেরিকান গিন্নী।
ওদিকে একটা বাদশাহী চেয়ারে বসে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন মিস হেদারিংটন। মিস হেদারিংটন বেশ লম্বা, রোগা চেহারার ওপর লিকলিকে ঘাড়, চুলগুলোও অবিন্যস্ত আর মুখে সারা দুনিয়ার একটা বিতৃষ্ণার ছাপ। এঁকে দেখে বোঝা যায় ভ্রমণ-পিয়াসী ইংরেজ মহিলা। তিনি বসে বসে উল বুনছিলেন।
মাদমোয়াজেল জীন ম্যারিকট হলেন আরেকজন মহিলা যিনি ঘরের জানালার পাশে বসে হাই তুলছিলেন এবং বাইরেটা দেখছিলেন। মাদামোয়াজেল ম্যারিকট দেখতে শ্যামাঙ্গী, মাথায় লালচে চুল, সাধারণ অথচ উগ্র প্রসাধনে মুখটা জ্বলজ্বলে। ঘরের কেকী করছে তাতে কোনো উৎসাহ নেই।
মিস হেদারিংটন এবং মিসেস কেলভিন বেকার দুটো রাত কাটিয়েছেন এই হোটেলে। সুতরাং তাদের মধ্যে আলাপ পরিচয়ও একটু আধটু হয়ে গেছে। মিসেস কেলভিন বেকার তার মার্কিনী বন্ধুসুলভ ব্যবহারে প্রায় সকলের সঙ্গেই আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। মিস হেদারিংটনের খুব ইচ্ছে সকলের সঙ্গে আলাপ করেন, কিন্তু তিনি উঁচু বংশ না পাওয়া পর্যন্ত কারো কাছে ঘেঁষেন না।
এক ফরাসি ভদ্রলোক, ঘরে একবার উঁকি মেরে বেরিলয়ে গেলেন। যাবার সময় জীন ম্যারিকটের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
মিস হেদারিংটন মুখে শব্দ করে বোনের ঘর গুনতে লাগলেন, আটাশ, উনত্রিশ…।
লম্বা মতো একজন মহিলা এই ঘরের দিকে তাকিয়ে আবার খাবার ঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার এবং মিস হেদারিংটন দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠলেন।
মিসেস বেকার ফিসফিস করে বললেন, এই যে লালচুলো মহিলাটি ঘরের দিকে দেখছিলো, ওকে দেখলেন নাকি মিস হেদারিংটন? গত সপ্তায় যে সাংঘাতিক প্লেন দুর্ঘটনা হলো। তার একমাত্র জীবিত যাত্রী নাকি ও-ই।
মিস হেদারিংটন বললেন, বিকেলে আসতে দেখেছি ওঁকে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ওঁকে দিয়ে গেছে এখানে। ওঁকে হাসপাতাল থেকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। মাথায় নিশ্চয়ই জোর চোট লেগেছিলো–
–মুখে তো এখনও পট্টি লাগানো রয়েছে কাঁচে কেটেছিলো বোধহয়। কী ভাগ্য যে পুড়ে যায়নি, এইসব প্লেন দুর্ঘটনায় পুড়েই তো অর্ধেক লোক অকর্মণ্য হয়ে পড়ে।
-ওঃ! ভাবতেও ভয় করে। বেচারা কতই বা বয়েস।
কাগজে লিখেছিলো একজন মহিলাযাত্রী। হ্যাঁ, তাই বটে। নামটাও দিয়েছিলো–মিসেস বেভারলি না বেটারটন।
মাদমোয়াজেল ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন, তার এইসব গালগল্প ভালো লাগছিলো না।
দুর্ঘটনার পাঁচদিনের দিন বিকেলবেলাই মিসেস অলিভ বেটারটন হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে সেন্ট লুই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
অসুস্থ বেটারটনের বিবর্ণ মুখে এখানে-ওখানে পট্টি লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ। হোটেলের ম্যানেজার সহানুভূতির সঙ্গে তাড়াতাড়ি তাঁকে সংরক্ষিত ঘরে পৌঁছে দিলো। খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না মাদাম?
ক্লান্তিভরে একটা চেয়ারে বসে পড়লো হিলারী। বিড় বিড় করে বললো, হ্যাঁ আমার নিজেরই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। দুর্ঘটনার আগের চব্বিশটা ঘণ্টা এখনো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্ধকার।
তা তো হবেই, ম্যানেজার বললো। ম্যানেজার নিচু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর হিলারী নিজেকে আয়নায় দেখে নিল।
ইতিমধ্যেই সে খোঁজ নিয়েছে তার নামে কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। ওঁর হাতে এখন কোনো সূত্রই নেই। শুধুমাত্র অলিভ বেটারটনের ছাড়পত্র, হুণ্ডি আর কুক-এর কাটা টিকিট আর আসন সংরক্ষণের চিঠিই তার সম্বল। ওর কাজ শুধু অলিভ বেটারটনের ভূমিকায় ঠিকমতো কাজ করা। প্লেন দুর্ঘটনা আর তার ফলস্বরূপ স্মৃতিলোপ এবং সাধারণ একটা অস্বচ্ছতাই তার হাতে তুরুপের তাস।
দুর্ঘটনা যেমন সত্যি, তেমনি অলিভ বেটারটনও যে সেই প্লেনে ছিলো সেটাও সত্যি। তার প্রতি যা যা নির্দেশ ছিলো, সেগুলো সে যদি পালন করতে না পারে, স্মৃতিভ্রষ্টতাই তার জন্য দায়ী।
এখন চুপচাপ শুয়ে বসে বিশ্রাম নেওয়াই তার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ হবে। অলিভের মালপত্র সব প্লেনের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকটা জিনিষ ওরা হিলারীকে হাসপাতালে দিয়ে গিয়েছিলো। আস্তে আস্তে সে চুল আঁচড়ে খাবার ঘরে নেমে এলো।
অনেকগুলো চোখ যে তাকে লক্ষ্য করছে এটা বুঝতে ওর দেরি হলো না। তাদের সবার কথাবার্তা কানে আসতেই সচেতন হয়ে উঠলো হিলারী।
নৈশাহার শেষ করেও হিলারী কিছুক্ষণ বসে রইল। যদি কেউ যেচে আলাপ করতে আসে। ঘরে দুটি মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের মধ্যে একজন আমেরিকান কায়দায় আলাপ শুরু করলেন।
-কিছু মনে করবেন না, একটু আলাপ করতে এলাম। আপনি তো সেই প্লেন দুর্ঘটনা থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফিরেছেন, তাই না?
হিলারী বললেন–হ্যাঁ।
–মাত্র তিনজন বেঁচেছেন বলে শুনেছি, সত্যি?
দুজন, তিনজনের একজন হাসপাতালে মারা গেছে।
–কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মিসেস বেটারটন, আপনি প্লেনের ঠিক কোন জায়গাটায় বসেছিলেন? একেবারে সামনে, না পেছনের দিকে?
হিলারীর উত্তরটা জানা ছিল সে বললো, পেছন দিকে।
ঐ ভদ্রমহিলা আরেকজন ভদ্রমহিলাকে ডেকে বললেন, শুনলেন তো মিস হেদারিংটন? যখন প্লেনে চড়বেন কক্ষনো সামনের দিকে বসবেন না।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমার নাম কেলভিন বেকার। আমি মোগাডোর থেকে এখানে এসেছি আর হেদারিংটন এসেছেন তাঞ্জিয়ের থেকে। যা বেড়াতে এসেছেন ম্যারাকেশটা একবার ঘুরে আসবেন মিসেস বেটারটন।
সেইরকমই ব্যবস্থা ছিলো, হিলারী বললো, কিন্তু মাঝপথে সব ওলোট-পালট হয়ে গেলো প্লেন দুর্ঘটনার জন্য।
–তা ঠিক। কিন্তু ম্যারাকেশ যাওয়া বাতিল করবেন না যেন, আপনি কি বলেন, মিস হেদারিংটন?
–আর কোথায় কোথায় যাবেন, মিসেস বেটারটন? কেলভিন বেকার জিজ্ঞাসা করলেন।
-ফেজটা ঘুরে আসার খুব ইচ্ছে; বললো হিলারী, অবশ্য আবার নতুন করে ব্যবস্থাপত্র করতে হবে–
-হ্যাঁ, তাই করুন। ফেজ বা রাবাত কোনোটাই দেখতে ভুলবেন না।
আপনি বুঝি গিয়েছিলেন?
–না এখনও যাইনি। তবে শীগগিরই যাবো ভাবছি। হিলারী মনে মনে ঠিক করলো আগামীকাল সে যদি কোনো খবরাখবর বা কোনো নির্দেশ না পায় তাহলে কুক-এর ওখানে গিয়ে ফেজ বা ম্যারাকেশ যাবার নতুন বন্দোবস্ত করা যায় কি না সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেবে।
পরের দিন সকালে কোনো খবর বা টেলিফোন এলো না। সে ভ্রমণসংস্থা কুক-এর অফিসে চলে এলো। টিকিট ঘরের সামনে আসতেই একজন বয়স্ক কেরানী বললো, আপনি তো মাদাম বেটারটন, তাই না? আমি আপনার সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
–কিন্তু ওগুলোর তো সবদিন পার হয়ে গেছে, হিলারী বললো। আমি কদিন হাসপাতালে ছিলাম আর…
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেসব আমি জানি। আপনার এই পুনর্জন্মের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নতুন করে যাত্রার ব্যবস্থা করার জন্য আপনার ফোন পেয়ে আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বুকের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠলো হিলারীর। যতদূর জানে সে টিকিটের জন্য এদের কাছে কারোও টেলিফোন করার কোনো কথা নেই। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে অলিভ বেটারটনের ভ্রমণসূচীর ওপর কারো তীক্ষ্ণদৃষ্টি রয়েছে। বললো, ও ওরা টেলিফোন করেছে কিনা ঠিক জানতাম না আমি।
-নিশ্চয়ই করেছে, মাদাম। এই যে রেলের টিকিট, হোটেলের ব্যবস্থাপত্র সব।
হিলারী হোটেলে ফিরে এলো। পরদিন হিলারী ফেজ-এর ট্রেনে রওয়ানা হলো।
সেদিনই বিকেলে মিসেস কেলভিন বেকারকে দেখে মিস হেদারিংটন এগিয়ে এসে বললেন, জানেন ভাই, সেই নামটা মনে পড়েছে–বেটারটন–আর সেই যে একজন বিজ্ঞানী হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো। আমি কিন্তু ভাবছি–ওই ভদ্রমহিলাই ওঁর স্ত্রী কিনা–আপনার কী মনে হয়?