০৬.
ক্যাসাব্লাঙ্কা হিলারীকে খুবই হতাশ করেছে। কোথায় সেই প্রাচ্যের ছাপ, কোথায়ই বা তার সেই বহুশ্রুত অলৌকিক মায়া! সবকিছুই যেন জমজমাট একটা ফরাসি শহরের মতো–তফাত শুধু রাস্তার মানুষগুলো।
এক ফরাসি লোকের সঙ্গে তার আলাপ হলো। সে হিলারীকে বললো, রাবাতটা একবার ঘুরে আসবেন, মাদাম, চমৎকার জায়গা। রাবাত না যাওয়া মানে মস্ত ভুল করা।
হিলারী হাসলো। বললো, যাবার তো ইচ্ছে, কিন্তু আমার হাতে আর সময় নেই বেশি। তাছাড়া টাকাপয়সাও খুব কম। জানেনই তো, বিদেশে আসার সময় কত অল্প টাকা আনতে দেয়।
-এরজন্য আর ভাবনা কী! খুব সোজা ব্যাপার। এখানে একজন বন্ধুর সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিলেই হলো।
ইংল্যান্ড থেকে এখানে আপনার একটু হাওয়া বদল হবে, মাদাম, যেমন ঠান্ডা, তেমনি কুয়াশা-কী বিশ্রী আবহাওয়া আপনাদের ওখানে।
–যা বলেছেন-সত্যি চমৎকার হাওয়া বদল হয়ে এলো। ওরা সন্ধ্যে নাগাদ ফেজ-এ পৌঁছলো।
আপনার কোনো সাহায্যে লাগতে পারি, মাদাম?
স্টেশনে হৈ-হট্টগোল আর হুটোপাটির মধ্যে কেমন দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিলারী। কৃতজ্ঞ চোখে সদ্যপরিচিত বন্ধুটির দিকে তাকালো।
–আপনি তো জামা প্যালেসে উঠবেন তাই না? ঠিক আছে। ওটা কিন্তু এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে, জানেন তো?
–আট কিলোমিটার! হিলারী যেন আঁতকে উঠলো। হোটেলটা শহরের মধ্যে নয়?
যদি বলেন, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
খুব মহানুভব আপনি, কিন্তু…।
ফরাসি বন্ধুটি দ্রুত আরবিভাষায় কুলিদের কী সব যেন বললো আর মুহূর্তে হিলারী একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো। সে হিলারীকে একটা কার্ড দিয়ে বললো, আমার কার্ড, মাদাম, যদি কখনো আপনার কোনো উপকারে লাগতে পারি, আমাকে জানাবেন। আরও চারদিন আমি এখানে গ্র্যান্ড হোটেলে থাকবো।
হিলারী কার্ডটা একবার চোখের সামনে মেলে ধরলো, মসিয় হেনরি লরেল।
শহর ছাড়িয়ে, গ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পাহাড়ের দিকে দ্রুতবেগে চলতে লাগলো ট্যাক্সিটা। ট্যাক্সিটা তাকে জামা প্যালেসের সামনে নামিয়ে দিলো। বিশাল তোরণের উঁচু খিলানের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রাচ্যের হাতছানি দেখে মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠলো হিলারীর। অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে তাকে একটা চত্বরে নিয়ে এলো একজন কুলি এবং সেখান থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে চমৎকার একটা শোবার ঘরে। কুলিটি জানালো সাড়ে সাতটার সময় নৈশাহার। বাক্সপ্যাটরা খুলে, হাতমুখ পরিষ্কার করে, চুলটা একটু আঁচড়ে সে নিচে খাবার ঘরে এলো। চমৎকার খাবার। খেতে খেতে হিলারী অনেককেই যেতে আসতে দেখলো। নিজেকে এত ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল যে খাবার ঘরের লোকগুলো সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করার কোনো চেষ্টা করলো না সে। নৈশাহার শেষ করে চত্বরে এসে কফি নিয়ে বসলো হিলারী। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, কিন্তু বাতাসে শীতের কামড় নেই। চমৎকার ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কফি শেষ করে সে ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে, চত্বরে একটা বিরাট ছাতার তলায় বসে হিলারী ভাবছিলোআগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অবান্তর। এখানে একজন মৃতা মহিলার নাম নিয়ে তার ভূমিকায় সে অভিনয় করছে। বেচারী অলিভ বেটারটনের জন্য খুবই দুঃখ হচ্ছে হিলারীর।
এখানেও কোনো অপরাধের গন্ধ বা কার্যকরী কোনো সূত্র পেলো না হিলারী। নিচের বাগানের দিকে তাকালো, দেখলো চমৎকার শান্ত বাগানটা। একজন সুন্দরী সুইডিস মহিলাও বাগানে বসেছিলেন। তার স্বামী না অন্য কেউ একজন ভদ্রলোক এসে মেয়েটির পাশে বসলো এবং কিছু একটা বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলো আবার ক্ষমাও চাইলো।
হিলারী মার্টিনী নিয়ে আসতে বললো পরিচারকটিকে। তারপর পরিচারকটির সাথে হিলারীর অনেকক্ষণ গল্পগুজব হলো। সবাই খেতে চলে গেছে কিন্তু হিলারী বাগানে বসেছিল। হঠাৎ পানশালা থেকে একজন ফরাসি যুবক বেরিলয়ে এলো। হিলারীর পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা ফরাসি ছবির গান গাইতে গাইতে নামলো
লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে।
মিষ্টি ছায়া মধুর লাগে।
গানের কথাগুলো হিলারীর মাথায় আস্তে আস্তে যেন গেঁথে বসতে লাগলো। লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে। লরেল। ট্রেনে আলাপ হয়েছিলো ঐ ফরাসি ছেলেটির নামও লরেল। এরসঙ্গে কি তার কোনো যোগসূত্র আছে? ব্যাগ খুলে কার্ডটা বের করে দেখলো লেখা আছে–হেনরি লরেল। কার্ডটা উল্টে দেখলো-পেছনে অস্পষ্ট পেনসিলের লেখা। মনে হয় আগে কিছু লেখা হয়েছিলো, পরে ঘষে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে, সঙ্কেতলিপিটা এই কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। মাঝখানের শব্দগুলোর পাঠোদ্ধার করা গেলো না। শেষদিকে আর একটা শব্দ পরক্ষণেই মনে হলো এটা কোনো গল্প বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতিও তো হতে পারে। কার্ডটা ব্যাগে রেখে দিলো।
হঠাৎ চোখের ওপর একটা ছায়া পড়তে সে আঁতকে উঠে চোখ তুললো। একটু দূরে সূর্য আড়াল করে মিঃ অ্যারিস্টাইডস দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিচের বাগান ছাড়িয়ে দুরের আবছা পাহাড়ের শোভায় দৃষ্টি নিমগ্ন।
খাবার ঘরে এসে দেখলো হিলারী মিঃ অ্যারিস্টাইড আজও সেই একই টেবিলে বসে খাচ্ছেন।
বিকেলটা সাদামাটাভাবে কেটে গেলো। বাগান থেকে চত্বরে আবার বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়ালো হিলারী।
জামা প্যালেসের বাগানের সৌন্দর্য, হিলারীর মনের এই একাকিত্বে হাজার গুণ সুন্দর হয়ে ফুটে উঠল। যখন শান্তির শেষ অংশটুকুও সে ত্যাগ করেছে, তখনই শান্তির দেখা পেলো। মনের শান্তিটাও তখনই এলো, যখন সে মরণখেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ। একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে হিলারীকে একটু ঝাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর হয়তো এই সুন্দর বাগানে কটা দিন নিশ্চন্তে কাটবে।
বিকেল যখন ফুরিয়ে এলো চত্বরের পর চত্বর পেরিয়ে হিলারী হোটেলে ফিরে এলো।
হিলারী হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলো লাউঞ্জে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন যাকে হিলারী চেনে। তিনি কেলভিন বেকার। আসুন ভাই, আসুন, বেকার সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমিও চলে এলাম। এইমাত্র প্লেন থেকে নামছি।
যাক, বলুন কেমন বেড়াচ্ছেন? পুরোনো শহর দেখে ফিরলেন মনে হচ্ছে।
-না–কই আর গেলাম, কিছুই দেখা হয়নি এখনও, হেসে হিলারী বললো। একটা রোদ্দুর পুইয়ে এলাম শুধু।
-ও, হা হা-সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে বেরিলয়েছেন আপনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। যাক,
আমরা দুজন একসঙ্গে বেরোবোখন। বেরোবার মতো মনের অবস্থা না থাকলেও বেকারের উৎসাহকে তারিফ না করে পারলো না।
মিসেস বেকার আবার বললেন, ক্যাসাব্লাঙ্কার সেই মিস হেদারিংটনের কথা মনে আছে? উনি ট্রেনে করে এখানে আসবেন।
রাতে খাবার ঘরে ঢুকেই হিলারী দেখলেন দেওয়ালের ধারে একটা টেবিলে মিস হেদারিংটন খাচ্ছেন। আহারের পর তিন মহিলা একসাথে বসে কফি খেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার পরের দিন কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবেন তার পরিকল্পনা শুরু করে দিলেন। এবার আর পুরোনো শহরে যাবার ইচ্ছে নেই। গতবারই সব খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছি। খুব মজার জায়গা। যেন একটা গোলকধাঁধা। আমার সঙ্গে যদি একজন পথপ্রদর্শক না থাকতো, রাস্তা চিনে হোটেলে ফিরতে পারতাম না। আমাকে যে লোকটা নিয়ে গিয়েছিলো সে খুব ভালো লোক। সে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো–শহরের ঠিক মাথার ওপরে পাহাড়ের দিকটায় চমৎকার জায়গাটা।
.
০৭.
মিসেস বেকার, মিস হেদারিংটনকে নিয়ে ফেজ-এর পুরোনো শহর দেখতে গেলেন আর হিলারীকে হোটেল থেকে একজন পথপ্রদর্শক ঠিক করে দিলো, হিলারী তাকে নিয়ে ফেজ শহর ঘুরতে বেরিলয়ে পড়লো।
চত্বর থেকে চত্বর আর বাগান পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ধনুকের খিলান যুক্ত এক বিশাল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। পথপ্রদর্শক চাবি দিয়ে দরজা খুলে হিলারীকে ভেতরে যেতে ডাকলো।
যেন এক নতুন জগতে পা রাখলো হিলারী, তার চারপাশে এখন শুধু ফেজ শহরের টানা পাঁচিল। আঁকাবাঁকা সরু পথ, দুধারে উঁচু দেওয়াল। মাঝে মাঝে একটা দরজা, এক চিলতে উঠোন–সরু সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবকিছু ভুলে গেলো হিলারী। তার গুপ্তচর বৃত্তির কথা, অতীত দিনের দুঃখ-যন্ত্রণা, এমনকি নিজেকেও সে যেন হারিয়ে ফেললো। তার মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্নপুরীতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাত্র তার পথপ্রদর্শকই এটা ওটা কেনার জন্য বিরক্ত করছিলো।
এই পাঁচিল ঘেরা শহরের কোথায় কোন দিকে চলেছে, উত্তর না দক্ষিণে, নাকি একই রাস্তায় বারবার ঘুরছে সে। অসীম ক্লান্তিতে পা দুটো যখন আর চলতে চাইছে না, ঠিক তখনই তার পথপ্রদর্শক বেড়ানোর শেষ অংশটুকু উপভোগ করার প্রস্তাব রাখলো। এবার আপনাকে একটা চমৎকার বাড়িতে নিয়ে যাবো। খুব সুন্দর বাড়ি। সব্বাই আমার চেনাজানা ওখানে। বসে বসে চা খাবেন, আর হরেকরকম সুন্দর সুন্দর জিনিষ দেখাবে ওরা।
হিলারীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, মিসেস কেলভিন বেকার এই গলাকাটা দোকানটার কথাই বলেছিলেন। তবুও তার ইচ্ছে হলো, ওরা যা দেখতে চায় তা দেখাতে। মনে মনে হিলারী ঠিক করলো আগামীকাল আবার তিনি এখানে আসবেন। হিলারী লোকটার পেছন পেছন পথ বেয়ে উঠে এলো। জায়গাটা শহরের প্রাচীরের প্রায় বাইরে। অনেকখানি উঠে বাগানঘেরা একটা চমৎকার এদেশী ধাঁচের হাঁড়ির সামনে হাজির হলো। একটা বড়সড় ঘরের একটা কফির টেবিলে বসতে অনুরোধ করা হলো তাকে। ঘর থেকে বাইরের শহরটাকে মনোরম দেখায়। সেই পুদিনাপাতার গন্ধে ভরপুর চা এলো একসময়। তারপর নানাধরনের জিনিষ দেখানো হলো-কম্বল, পোশাক-পরিচ্ছদ, মুক্তো, আরও নানা জিনিষ। ভদ্রতার খাতিরে দু-একটা কমদামী জিনিষ কিনলো সে।
সব সারা হলে পথপ্রদর্শক বললো, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি, ঘণ্টাখানেক ঘুরে হোটেলে ফিরবো আমরা। একটু থেকে কী যেন আঁচ করে সে আবার বললো, তার আগে–এই মেয়েটি আপনাকে মহিলাদের প্রসাধন ঘরে নিয়ে যেতে পারে।
পাশেই একটা মেয়ে চা পরিবেশন করছিলো, হাসিমুখে এগিয়ে এলো। বললো, হা হা, মাদাম। আসুন আমার সঙ্গে। চমৎকার পরিচ্ছন্ন প্রসাধন ঘর আছে আমাদের।
মুচকি হেসে হিলারী মেয়েটিকে অনুসরণ করলো। প্রসাধন ঘরের উচ্চতা হাত দিলে ছোঁয়া যায়। তা হোক, বেশ পরিষ্কার। সর্বক্ষণ জল পড়ছে, দুর্গন্ধও নেই। হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমালে মুখ মুছে বেরোবার জন্য সে দরজার সামনে এলো। হঠাৎ তার মনে হলো, দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন আটকে দিলো। প্রসাধন ঘরে তাকে আটকে রাখার কী কারণ থাকতে পারে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, ঘরের এককোণে আরেকটা দরজা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে দরজার হাতল ধরে টানতেই দরজাটা সহজেই খুলে গেলো।
দরজা দিয়ে বেরিলয়ে সে একটা অন্ধকার ঘরে এসে পড়লো, সামান্য আলো আসছে দেওয়ালের ওপর দিকের ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে। ঘরের একধারে বসে এক ফরাসি ভদ্রলোক সিগারেট টানছে, ভদ্রলোক আর কেউ নন, সেই ট্রেনে আলাপ–মঁসিয়ে হেনরি লরেল।
লরেল তাকে অভ্যর্থনা না জানিয়ে একটু মেকি গলায় শুধু বললো, শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।
মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিজেকে সংযত করে নিল হিলারী। সাহসী মনটা বললো–যাও, এগিয়ে যাও। অলিভ যা করতে বলে তোমার মনে হয়, ঠিক তেমন অভিনয় করো। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো আমার জন্য কোনো খবর আছে? আপনি আমায় কোনো সাহায্য করতে পারেন?
লরেল মাথা নাড়লো, তারপর যেন একটু ভৎর্সনার সুরে বললো, ট্রেনে আপনাকে দেখে কেমন অদ্ভুত মনে হয়েছিলো আমার, সারাক্ষণ শুধু আবহাওয়ার কথাই বলে গেলেন।
–আবহাওয়া! চোখ বড়বড় করে হিলারী তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ট্রেনে এই লোকটা আবহাওয়া সম্পর্কে কী বলেছিলো যেন? ঠান্ডা? কুয়াশা? না–বরফ?
বরফ। হা-তুষার। মৃত্যুকালে অলিভ বেটারটনও ফিসফিস করে এই কথাটাই বলেছিলো-বারবার। গুনগুন করে সেই ছোট্ট ছড়াটাই সে মনে করার চেষ্টা করলোকী যেন ছড়াটা…? হ্যাঁ
তুষার, শুধু তুষার শুভ্র সুন্দর
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর!
বারবার আউড়ে ছড়াটা মনে গেঁথে নিল।
-হা,–আবহাওয়া–আপনার প্রতি যেমন নির্দেশ ছিলো, সেইমতো উত্তর দেননি কেন? লরেল এবার সরাসরি ধমক দিলো।
–আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না–আমি ভীষণ অসুস্থ হয়েছিলাম। প্লেন দুর্ঘটনায় সাংঘাতিক আহত হই আমি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ফলে আমার স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পায়। অনেকদিন আগের কথাবার্তা সব মনে পড়ে, কিন্তু তারপর–তারপর সব যেন ফাঁকা-বিরাট শূন্যতা। আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না কী ভয়ঙ্কর সেই অবস্থা।
-হঁ, লরেল বললো, প্লেন দুর্ঘটনাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একেবারে সাদামাটা ব্যবসায়ীর গলা–সহানুভূতির চিহ্নমাত্র নেই। এর পরেও–ভ্রমণসূচী অনুযায়ী চলার মতো মনের জোর আর সাহস আপনার থাকবে কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
–অবশ্যই আমি যাবো–চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমি। আমার স্বামী-বলতে বলতে কান্নায় তার গলা বুজে এলো।
লরেল শৃগালের মতো ধূর্ত হাসি হেসে বললো–আপনার স্বামীহা, যতদূর জানি, আপনার জন্য তিনি অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন।
হিলারী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, আপনি বুঝতে পারবেন না, ও চলে আসার পর এই কটা মাস আমার কীভাবে কেটেছে
–আপনি এ ব্যাপারে কতটুকু জানেন না জানেন, সে সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কি সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে আপনার মনে হয়?
হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করলো হিলারী, তা আমি কি করে জানবো…? তবে মনে হয়, ওরা বেশ সন্তুষ্ট।
–তার মানেই, হঠাৎ সে চুপ করে গেলো।
-আমার মনে হয় এটার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, আস্তে আস্তে বলতে লাগলো হিলারী, ওরা হয়তো আমার পিছু নিয়ে এখানে এসেছে। স্পষ্ট করে কাউকে চিনতে পারিনি বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড ছাড়ার পর থেকেই আমার যেন মনে হয়েছে, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।
-খুবই স্বাভাবিক, আমরাও এটাই আশা করেছিলাম, লরেল বললো।
–আমার মনে হয়েছে আপনাদের সাবধান করে দেওয়া দরকার।
মিসেস বেটারটন, আমরা কচি খোকা নই, আমরা যা করি বুঝে শুনেই করি।
হিলারী বললো, আমি দুঃখিত। আমি খুব বোকা, তাই না?
–আমাদের কথামতো যদি চলেন তাহলে আপনি বোকা হলেও কিছু যায় আসে না।
আপনার স্বামী চলে যাবার পর থেকেই যে ইংল্যান্ডে আপনার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, তাছাড়া–খবরটা আপনার কাছেই এসেছিল, তাই না?
-হ্যাঁ।
লরেল এবার সরাসরি কাজের কথা বললো, আপনার প্রতি যে নির্দেশ আছে তা আপনাকে জানাচ্ছি। আগামী পরশু এখান থেকে আপনি ম্যারাকেশের পথে রওয়ানা হবেন, সেইমত সব ব্যবস্থাপত্র করা আছে।
-বেশ।
ম্যারাকেশ পৌঁছাবার পরদিন ইংল্যান্ড থেকে একটা তারবার্তা পাবেন। তাতে কী-লেখা থাকবে তা আমি জানি না, কিন্তু তক্ষুনি ইংল্যান্ড ফিরে যাবার ব্যবস্থা করার মতো যথেষ্ট যুক্তি তাতে থাকবে।
আমাকে আবার ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে!
–আহা–আগে শুনুন। পরদিন ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে ইংল্যান্ডের টিকিট কাটবেন।
–যদি টিকিট না পাই–ধরুন সব আসনই ভর্তি থাকে?
-না–সব আসন ভর্তি থাকবে না। তার জন্যও সব ব্যবস্থা করা থাকবে, এখন কী কী আপনাকে করতে হবে-বুঝলেন তো?
বুঝেছি।
তাহলে এবার দয়া করে আপনার পথপ্রদর্শক যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে ফিরে যান। অনেকক্ষণ হলো আপনি প্রসাধন ঘরে ঢুকেছেন। হ্যাঁ ভালো কথা–জামা প্যালেসের যে একজন আমেরিকান এবং একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে তাদের একজনকে যদি আপনার সাথে ম্যারাকেশ যেতে রাজি করাতে পারেন, খুব ভালো হয়। আচ্ছা বিদায়, মাদাম।
–বিদায়, মঁসিয়ে।
-আপনার সঙ্গে আর আমার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই-লরেল বললো।
হিলারী এবার প্রসাধন ঘরে ফিরে এলো। দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে প্রথপ্রদর্শকের সঙ্গে মিলিত হলো।
পরিকল্পনা মতো অভিযানের পথে এগিয়ে চললো হিলারী।
মিস হেদারিংটন বললেন, তাহলে কাল আপনি ম্যারাকেশ চললেন? ফেজ-এ বেশিদিন থাকলেন না, তাই না? তার চেয়ে প্রথমে ম্যারাকেশ হয়ে ক্যাসাব্লাঙ্কা ফেরার পথে ফেজ ঘুরে গেলেই পারতেন।
–তা করলেই ভালো হতো, হিলারী বললো, কিন্তু টিকিট পাওয়া মুশকিল। যা ভিড় এখানে।
–ইংরেজদের ভিড় নয় কিন্তু, মিস হেদারিংটন দুঃখের সঙ্গে বললো। নিজের দেশের লোক দেখতে পাওয়া যায় না। চারিদিকে দেখুন, কেবল ফরাসিদের ভিড়।
মুচকি হাসলেন হিলারী, মরক্কো যে একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিলো একথা মিস হেদারিংটন বোধহয় ভুলেই গেছেন।
এবার হিলারী বললেন, আপনারা যদি আমার সঙ্গে ম্যারাকেশ যান খুব খুশি হবো আমি। এখানে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি, সত্যি একা একা বেড়ানো খুবই বিরক্তিকর।
-ম্যারাকেশ আমার ঘোরা, মিস হেদারিংটন বললেন, কিন্তু মিসেস বেকার এই প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলেন। বেকার বললেন, আমি বরং একবার অফিসঘর ঘুরে দেখি আপনার সঙ্গে যাওয়ার কী বন্দোবস্ত করা যায়।
মিস হেদারিংটন উল কাটার ব্যাগ গুছিয়ে বেরিলয়ে গেলেন। হিলারী তার ঘড়ির টাইম দেখছিলেন–নৈশাহারে যাবার আগে সে আর পোশাক পাল্টাবেন না। সে ডিভানে গা এলিয়ে ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভাবছে।
গতকাল তার মনে হয়েছিল যে কাজে সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে তার সবটাই মিথ্যে। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। এখন সে আসল অভিযানের জন্য পা বাড়াতে প্রস্তুত। তাকে সাবধান হতে হবে। তাকে পুরোপুরি অলিভ বেটারটনে রূপান্তরিত হতে হবে।
না, কোনোরকম ভুল করবো না আমি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে শপথ নিলো হিলারী।
মরক্কোর এক নির্জন, আধো অন্ধকার ঘরে সম্পূর্ণ একা বসে থাকা কী অদ্ভুত! তার পাশেই একটা পেতলের প্রদীপ। আচ্ছা–সে যদি ওই পেতলের প্রদীপটা হাতে নিয়ে ঘষে তার থেকে সেই জীনটা বেরিলয়ে আসবে না তো! চিন্তাটা মাথায় আসতেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠলো আর তখনই প্রদীপের পেছন থেকে একটা বলিরেখা চিহ্নিত ছাগলদাড়িওলা মুখ দেখা দিল, মিঃ অ্যারিস্টাইডস! এগিয়ে এসে বসার অনুমতি চাইলেন। হিলারী সম্মতি জানালো।
সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন, হিলারী নিলো, নিজেও একটা ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ দেশটা আপনার ভালো লাগছে তো, মাদাম?
-খুব অল্প সময় এসেছি আমি, তবুও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।
–বা! পুরোনো শহর দেখেছেন? ভালো লাগেনি?
–অপূর্ব-অপূর্ব লেগেছে।
-হ্যাঁ, সত্যিই অপূর্ব। অতীতের অনেক কিছুই ওখানে রয়েছে। ফেজ-এর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার লন্ডনের গ্রেট ওয়েস্ট রোডের কথা মনে পড়ে যায়। সেই রাস্তার দুধারে বড় বড় কারখানা বড় বড় বাড়িতে ঝলমলে আলো জ্বলছে। কিছু লুকোনো নেই সেখানে, কোনোকিছুই রহস্যময় নয়।
হিলারী বললো, আপনি বলতে চাইছেন, এই বৈসাদৃশ্যটাই আপনাকে আকৃষ্ট করে?
মিঃ অ্যারিস্টাইডস ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, ওখানে সবকিছু উন্মুক্ত আর ফেজ-এর পুরানো রাস্তায় কোনো কিছুই প্রকাশ্য নয়। সবকিছু লুকোনো, অন্ধকার…, কিন্তু কিন্তু সবকিছুই আগের মতো চলছে। সেই নৃশংসতা, সেই নির্মম অত্যাচার, সেই ক্ষমতার আসনে বসার লোভ, সেই দরকষাকষি, ঝগড়া বিবাদ।
–আপনি বলছেন, সর্বকালে সর্বদেশে মানবপ্রকৃতি একই রকম?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। সবদেশে এই হয়। আগে যেমন হতো, এখনও ঠিক তাই–দুটো জিনিষ নিয়ে শাসনকার্য চলে। এক–নৃশংসতা এবং দুই-মহানুভবতা। একটু থেমে তিনি বললেন, আমি শুনেছি মাদাম, কদিন আগে আপনি ক্যাসাব্লাঙ্কায় এক ভয়ঙ্কর প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন?
-হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
–আপনাকে দেখে আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। অবাক চোখে তাকালো হিলারী। মিঃ অ্যারিস্টাইডস আবার বললেন, হ্যাঁ আপনাকে হিংসা করা উচিত। কারণ আমি একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। মৃত্যুর এত কাছাকাছি পৌঁছবার এমন অভিজ্ঞতা পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। আচ্ছা, সেই থেকে আপনার চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন হয়নি, মাদাম?
হয়েছে, তবে সেটা খুব সুখকর নয়, হিলারী বললো। মাথায় খুব জোর চোট লেগেছিলো আমার। সেই থেকে সাংঘাতিক মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো, আর স্মরণশক্তিও কেমন যেন গুলিয়ে গেলো।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস হাত নেড়ে বললেন, এগুলো তো সাধারণ কথা কিন্তু আপনার আত্মা যে একটা ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছে, এটা তো স্বীকার করবেন?
তা সত্যি। সত্যিই এক ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছি আমি। সেই ঘুমের ওষুধের মোড়ক আর জলের গ্লাসের কথা হিলারীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
-কত কী-ই হলো, কিন্তু এ অভিজ্ঞতা আমার কপালে জুটলো না। মিঃ অ্যারিস্টাইডস বললেন।
তিনি উঠে পড়লেন। আনত অভিবাদন করে, আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি, মাদাম, বলে ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
.
০৮.
সব বিমানবন্দরগুলোর মধ্যেই কী অদ্ভুত সাদৃশ্য, ভাবছিলো হিলারী। প্রত্যেকটাকে ঘিরেই কেমন যেন অদ্ভুত এক অজানার হাতছানি। সবগুলোই শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যেখানে গেলে অদ্ভুত একটা কথা বারবার মনে হয়-মনে হয় যেন সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বহুদূরে এক শূন্যতার মাঝে এসে পড়েছি।
বিমানবন্দরের বিশ্রামঘরে প্রায় আধঘণ্টা আগে এসেছে ওরা। মিসেস কেলভিন বেকার শেষপর্যন্ত হিলারীর সঙ্গে ম্যারাকেশ যাওয়া ঠিক করলেন। এখানে এসে কেলভিন বেকার আরো দুজন ভদ্রলোকের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। একজন আমেরিকান অন্যজন ডেনিস বা নরওয়ের নোক।
মিসেস বেকার হিলারীকে দেখে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু, ইনি মিসেস বেটারটন।
একজন বললো, আমার নাম ‘অ্যান্ড্রু পিটার্স, আরেকজন বললো আমার নাম ‘টরকুইল এরিকসন।
তাহলে আমাদের সকলের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো, মিসেস বেকার বললেন, আপনারাও ম্যারাকেশ যাচ্ছেন? আমার বন্ধুও এই প্রথম ওখানে যাচ্ছেন
হঠাৎ ঘোষণা শোনা গেল প্লেন ওঠার সময় হয়ে এসেছে। মোট ছজন যাত্রী। হিলারী, মিসেস বেকার, পিটার্স আর এরিকসন ছাড়া একজন লম্বা মতো রোগাটে ফরাসি ভদ্রলোক, আর একজন কদাকার সন্ন্যাসিনী।
বেশ সুন্দর ঝকঝকে সকাল, প্লেন ওড়ার আদর্শ আবহাওয়া। নিজের আসনে গা এলিয়ে দিয়ে আধবোজা চোখে হিলারী তার সহযাত্রীদের লক্ষ্য করছিলো, আর নিজের মনের দুশ্চিন্তা দূর করছিলো। মিসেস কেলভিন বেকার মাঝের চলাচলের পথের ওপাশে একটা আসনে রয়েছেন। ঠিক সামনে বসেছেন এরিকসন এবং তার পেছনে বসেছেন কদাকার সেই সন্ন্যাসিনী।
ছয়জন লোক মাত্র কঘন্টার জন্য একসঙ্গে চলেছে, ভাবছিলো হিলারী। ছজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলেছে।
চোখ বন্ধ করে হিলারী সহযাত্রীদের কথা ভুলে গিয়ে গতকাল সারারাত ধরে তাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিন্তা করেছে সে–আজও সেই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে লাগলো। তাকে ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে। পাগল! নাকি সেই কোথাও ভুল করলো। ওরা হয়তো তাকে বিশ্বাস করেনি! দুশ্চিন্তায় নড়েচড়ে বসলো হিলারী। মনে মনে বললো, মরুকগে, যা করছি তার বেশি আর কিছু করতে পারব না আমি। তাতে যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি হয়েছি।
সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মত আর একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেলো। মরক্কোয় যে হিলারীর ওপর নজর রাখা হয়েছে এটা খুবই স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করেছে লরেল। তবে কি পুলিসের সন্দেহ মিথ্যে এটাই প্রমাণ করার জন্যই তাকে ইংল্যান্ড ফেরত পাঠাতে চায় ওরা! মিসেস বেটারটন হঠাৎই ইংল্যান্ড ফিরে গেলে তার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে-তাকে একজন সত্যিকারের ভ্রমণার্থী বলেই মেনে নেবে ওরা।
এয়ার ফ্রান্সের বিমানে প্যারিস হয়ে ইংল্যান্ড ফিরতে হবে–আর সম্ভবতঃ প্যারিসেই টম বেটারটন উধাও হয়েছিল। এখান থেকে কাউকে উধাও করে দেওয়া নিশ্চয়ই খুব সহজ। টম বেটারটন নিশ্চয়ই কখনোই প্যারিস ত্যাগ করেননি। এসব আজগুবি চিন্তায় মাথা ভরে এলো হিলারীর। কখন যেন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে মনে হলো প্লেনটা দ্রুতগতিতে নিচে নামছে আর চক্কর দিচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনও তো পৌঁছবার সময় হয়নি। তাছাড়া, বাইরে তাকিয়ে নিচে কোনো বিমানবন্দরের চিহ্ন চোখে পড়ল না।
মুহূর্তের জন্য অজানা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরলো। মিসেস কেলভিন বেকার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হিলারী বললো, আমরা পৌঁছে গেছি বোধহয়।
প্লেনটা নিচে নেমে চক্কর দিচ্ছে–জনহীন মরুভূমির মতো জায়গা। অনেক দূর পর্যন্ত কোনো গ্রাম বা বাড়ির চিহ্নমাত্র পড়লো না। ইঞ্জিনের কোনো গোলমাল হলো না তো! ভাবছিলো হিলারী। সামনের দরজা দিয়ে কালো চামড়ার এক যুবক নিঃসন্দেহে প্লেনের চালক, বেরিলয়ে এসে বললো, দয়া করে আপনারা নেমে পড়ুন। পেছনের দরজা খুলে একটা সিঁড়ি নামিয়ে দিয়ে সে সকলের নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলো, চালক নিজেও নেমে এসে ফরাসী ভাষায় বললো : আপনারা সবাই এখানে আছেন?! আপনাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে এখানে, সেজন্য মাফ করবেন।-ওই তো এসে গেছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দেখলো, দিগন্তের গায়ে একটা বিন্দু ক্রমশঃ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হিলারী হতচকিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এখানে আমাদের নামার কারণ কী? এতক্ষণ এখানে আটকে থাকতে হবে আমাদের?
ফরাসি ভদ্রলোক বললো, মনে হচ্ছে একটা মালগাড়ি আসছে এদিকে, আমাদের কি ওতে চেপে যেতে হবে?
-ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে নাকি? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
অ্যান্ড্রু পিটার্স সকৌতুকে বললো, মোটেই না, ইঞ্জিন তো বেশ ভালোই চলছিলো। যাইহোক, মনে হচ্ছে এরা আমাদের যাত্রার এইরকম ব্যবস্থা করেছে।
হিলারী হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। মিসেস কেলভিন বেকার গজগজ করতে লাগলেন, উঃ কী ঠান্ডা! এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়!
বিমান চালক মনে মনে অভিশাপ দিচ্ছিলো। হিলারীর মনে হলো সে যেন বলছে রোজ রোজ এই দেরি–সহ্য হয় না আর!
মালগাড়িটা দূরন্ত গতিতে এসে থামলো। দেহাতী চালকের সাথে বিমানচালকের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো। ওদের মাঝে মিসেস বেকারকে মধ্যস্থতা করতে দেখে হিলারী আশ্চর্য হলো। ওদের প্রায় ধমক দিয়ে ফরাসিতে বলছেন, সময় নষ্ট কোরো না। তর্ক করে লাভ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এখান থেকে বেরিলয়ে যেতে চাই।
মালগাড়ির চালক হতাশভঙ্গি করে গাড়ির কাছে ফিরে এলো। পেছনের দরজাটা খুলে ফেলে, বিমানচালক, এরিকসন আর পিটার্সের সাহায্যে একটা বিরাট বাক্স বাইরে বের করে আনলো। দেখে মনে হলো দারুণ ভারি। দেহাতী লোকটা যখন বাক্সের ডালা খুলছে, কেলভিন বেকার হিলারীর একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন। বললেন, আমি দেখতে পারবো না ভাই। দৃশ্যটা নিশ্চয়ই খুব সুখকর হবে না।
হিলারীকে ধরে তিনি মালগাড়ির উল্টোদিকে চলে গেলেন। সেই ফরাসি ভদ্রলোক আর পিটার্সও তাদের সঙ্গে এলো। ফরাসি লোকটি তার দেশীয় ভাষায় বলছিলেন, এতে কী এমন আছে, যা নিয়ে ওরা এত কসরৎ করছে?
মিসেস বেকার বললেন, আপনি তো ডাঃ ব্যারন, তাই না? আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বলে মিসেস বেকার আপ্যায়নের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
হিলারী জিজ্ঞেস করলো, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ওই বাক্সে কী আছে? ওটা না দেখাই ভালো কেন?
অ্যান্ড্রু পিটার্স বললো, ওতে কী আছে আমি বলতে পারি, প্লেনের চালক আমাকে বলেছে মনোরম কিছু নয়, তবে খুব প্রয়োজনীয় জিনিষ বোধহয়। একটু হেসে শান্ত গলায় বললো, ওর মধ্যে কটা মানুষের দেহ আছে।
–মানুষের দেহ! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হিলারী। না না, এখনও ওদের মারা হয়নি। সান্ত্বনার হাসি হাসলো সে, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ওদের আনা হয়েছিলোগবেষণা, মানে শারীরবিদ্যা গবেষণার জন্য।
হিলারী হা করে তাকিয়ে রইল–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-ও! দেখুন মিসেস বেটারটন আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ হলো। মানে–একপ্রস্থ যাত্রা।
শেষ হলো? মানে?
–হ্যাঁ। ওরা এবার ওই দেহগুলোকে আমাদের প্লেনে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেবে। তারপর এই বিমানচালক কী সব কলকাঠি নেড়ে দেবে আর আমরা যখন এই মালগাড়িতে চেপে অনেকদূর এগিয়ে যাবো, দেখবো দূর আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা। যেন একটা প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে–তার কেউ বাঁচেনি।
–কিন্তু কেন? কী সাংঘাতিক কথা!
–কিন্তু–এবার ডাঃ ব্যারন তাকে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মিসেস বেকার কাছে এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, জানেন বৈকি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি–এটা হয়তো উনি আশা করেননি।
হিলারী এবার ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখে বললো, আমরা সবাই সেখানে যাচ্ছি?
পিটার্স বললো, আমরা সবাই সহযাত্রী যে। এরিকসন সোৎসাহে সমর্থন করলো, হ্যাঁ আমরা সব্বাই এক পথের পথিক।
.
০৯.
বিমানচালক এগিয়ে এসে বললো, আপনারা এবার এগোন, দেরি করবেন না, অনেক কাজ এখনও বাকি, তাছাড়া আমাদের নির্দিষ্ট সময়ও পার হয়ে গেছে।
মুহূর্তের জন্য চমকে এক পা পিছিয়ে এল হিলারী। ভয়ে, উত্তেজনায় একটা হাত আপনা থেকেই তার গলার কাছে চলে এলো। সবাই সেই গাড়িতে উঠলো। হিলারী একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছে, একপাশে পিটার্স, অন্যপাশে মিসেস বেকার। আমেরিকান মহিলার দিকে ফিরে হিলারী বললো, তাহলে–আপনি-মানে আপনাকে যোগাযোগকারী অফিসার বলেই ডাকবো। কী বলুন, মিসেস বেকার?
–এক্কেবারে ঠিক জিনিষটি আপনি ধরে ফেলেছেন। আর নিজের মুখে বলা ঠিক নয়, তবুও বলছি এ কাজে আমি বেশ পটু। একজন আমেরিকান মহিলাকে, ঘুরে ঘুরে বেড়াতে দেখলে কারো সন্দেহ হবে না।
সহসা এদের পরিকল্পনার চাতুরী ধরে ফেললো হিলারী। বিড়বিড় করে বললো, আর এরা? এরা নিজের নিজের যা পরিচয় দিয়েছেন সত্যিই কি এঁরা তাই?
নিশ্চয়ই, ডাঃ ব্যারন একজন রোগজীবাণুবিদ বলে আমি জানি। মিঃ এরিকসন একজন প্রতিভাবান তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী, মিঃ পিটার্স একজন ফলিত রসায়নের গবেষক, মিস নীডহেইস না উনি সন্ন্যাসিনী নন, উনি একজন স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ। আর আমি-আপনি ঠিকই বলেছেন, কেবল যোগাযোগকারী অফিসার। খানিক হেসে বললেন, বেচারা হেদারিংটন, একটুও সুযোগ পেলো না।
মিস হেদারিংটন–তিনি কি
মিসেস বেকার বললেন, ও আপনাকে অনুসরণ করছিলো। ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকেই ও আগের লোকের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয়।
আপনি যখন ম্যারাকেশে পৌঁছবেন। দারুণ মজার ব্যাপার, তাই না? আর দেখুন দেখুন। ওই যে আমাদের প্লেনটা যাচ্ছে।
মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাদের গাড়িটা ছুটে চলছিলো। হিলারী ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে তাকালো। পেছনের আকাশে অনেকখানি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। বিস্ফোরণের মতো একটা আওয়াজও তার কানে এলো–অনেক দূর থেকে। পিটার্স হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লো। বললো–ম্যারাকেশগামী একটা প্লেন দুর্ঘটনায় ছজন যাত্রী নিহত হয়েছেন।
হিলারী শিউরে উঠে বললো, উঃ! কী ভয়ঙ্কর!
-কোনটা–অজানার পথে পা বাড়ানো? পিটার্সই বললো। এখন তাকে বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, খুবই ভয়ঙ্কর, কিন্তু এটাই একমাত্র পথ। অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যতের পথে আমরা পা বাড়াচ্ছি। সহসা দারুণ আগ্রহে তার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। যত কিছু পুরোনো, খারাপ জিনিষ আমাদের ত্যাগ করতেই হবে। দুর্নীতিপরায়ণ সরকার আর যুদ্ধবাজদের শেষ করতে হবে। নতুন জগতে প্রবেশ করতে হবে আমাদের–সে জগৎ বিজ্ঞানের জগৎ, যা সব কিছু মালিনা থেকে মুক্ত।
একটা লম্বা শ্বাস টানলো হিলারী। আমার স্বামীও ঠিক এই ধরনের কথা বলতেন, ইচ্ছে করেই সে কথাটা বললো।
-আপনার স্বামী? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পিটার্স। আপনার স্বামী কি টম বেটারটন? হিলারী সম্মতি জানালো।
-আচ্ছা!–তিনি তত বিরাট লোক। শূন্যশক্তি পরমাণু বিভাজন–এ যুগের এক চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার-হ্যাঁ, অজস্র প্রণাম জানাই তাঁকে। বৃদ্ধ ম্যানহেইমের সঙ্গে কাজ করতেন তাই না?
-হ্যাঁ।
–আমি যে শুনেছিলাম উনি ম্যানহেইমের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু আপনি নিশ্চয়
–আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী, লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো হিলারী। সে-মানে-ওর স্ত্রী এলসা আমেরিকাতেই মারা যায়।
-হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। এরপরই উনি কাজকর্ম চালিয়ে যাবার জন্য ব্রিটেনে চলে আসেন। তারপরই হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়ে ফাঁপরে ফেলে দেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো, প্যারিসের এক সম্মেলন থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ, ওঃ! যাই বলুন, এদের ব্যবস্থাপত্তর কিছু বেশ সুষ্ঠু স্বীকার করতেই হবে।
হিলারীও স্বীকার করলো, এদের সংস্থার নিখুঁত কাজের কথা ভেবে বুকের মধ্যেটা একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে উঠলো। যতকিছু পরিকল্পনা, সঙ্কেতা, চিহ্ন রেখে যাওয়া, যা কিছু সে শিখেছে, সবকিছু একেবারে অকেজো মনে হলো, কারণ এখন আর খুঁজে পাবার মতো কোনো চিহ্নই ওরা পাবে না। সমস্ত ব্যবস্থাটা এমনই নিখুঁত যে, শেষপর্যন্ত দেখা গেল, ওই প্লেনের প্রতিটি যাত্রীই অজানা ঠিকানার যাত্রী, যে পথে টমাস বেটারটন অনেক আগেই পাড়ি দিয়েছে। ওই পোড়া প্লেনটা ছাড়া কোনো চিহ্নই পড়ে থাকবে না। প্লেনের মধ্যে কটা ঝলসানো মৃতদেহও থাকবে। জেসপ আর তার লোকজনেরা কি এটা বুঝতে পারবে যে–ঐ ঝলসানো মৃতদেহগুলোর মধ্যে হিলারী নেই? যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দুর্ঘটনাটা এক চতুরভাবে–এত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ঘটানো হয়েছে
পিটার্স বলছিলো, ভাবছি-এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো? অদ্ভুত শান্ত তার গলা, এতটুকু ভয় নেই, পিছু তাকানো নেই, শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া।
হিলারীও ঠিক এই কথাই ভাবছিলো। ও মিসেস বেকারকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা? এরপর কী হবে?
দেখতেই পাবেন, মিষ্টি হেসে বললেও বেকারের কথাগুলোরমধ্যে কেমন যেন আতঙ্কের আভাস ছিলো। রাত্রি নামলো, ওরা প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে মেঠোপথ, কখনো কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।
অনেকক্ষণ জেগে থাকায় অজস্ব চিন্তা আর দুর্ভাবনায় মাথার মধ্যেটা ঝিমঝিম করছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়লো।
গাড়িটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো, পিটার্স আস্তে আস্তে ওর হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে, উঠে পড়ুন। আমরা মনে হচ্ছে কোনো একটা আস্তানায় পৌঁছে গেছি।
সবাই নেমে পড়লো। অন্ধকারে মনে হলো পামগাছে ঘেরা একটা বাড়ির সামনে নিয়ে এলো। দুটি দেহাতী মেয়ে খিলখিল করে বেকারের দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। তিনজন মহিলাকে ওপরের একটা ঘরে নিয়ে আসা হলো। ঘরের মেঝেয় তিনটে মাদুর পাতা আর কম্বল চাদরের একটা গাদা।
মিসেস বেকার হিলারীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন বোধ করছেন মিসেস বেটারটন? গাড়ির ঝাঁকুনিতে আপনার মাথার ব্যথাটা নিশ্চয়ই বেড়ে গেছে?
-হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, হিলারী বললো।
-এক্ষুনি আমাদের খাবার এসে পড়বে, খেয়ে নিয়ে কটা অ্যাসপিরিনের ব্যবস্থা করে দেবো-চটপট শুয়ে পড়বেন।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ এবং নারীকন্ঠের খিলখিল হাসি শোনা গেল। দেহাতী মেয়ে দুটো খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। একজন হিলারীর পশমের কোটটায় হাত বুলোতে লাগলো।
–এই, যা–ভাগ, ভাগ এখন, মিসেস বেকার তাদের তাড়া করলেন। মিসেস বেকার বললেন, খুব নিরীহ ওরা। মাঝে মাঝে ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠতে হয়।
যাক এখন যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন আমাদের।
চা এলো সেই পুদিনাপাতার গন্ধ। হিলারী চা দিয়ে কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলো। তারপর চা খেয়ে শুয়ে পড়লো।
পরদিন অনেক বেলা করে উঠলো ওরা। মিসেস বেকার আগেই বলে দিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যার আগে আর কোথাও যাওয়া যাবে না।
ঘুম থেকে উঠে মিসেস বেকার দরজার কাছে জড়ো করা একরাশ পোশাক দেখিয়ে বলেছিলেন, এখন থেকে আমরা এই দেহাতী পোশাক পরবো। আমাদের জামাকাপড় এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।
তিনজন আধুনিক মহিলা এখন দেহাতীদের পোশাক পরে মরোক্কোবাসিনী হয়ে ছাদে গল্প করছেন।
আগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল হিলারীর। মিস নীডহেইমকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। তার চেয়ে বয়েসে ছোট হবে। গায়ের চামড়া বিবর্ণ, ক্ষুদে ক্ষুদে আঙুল। আকর্ষণীয় চেহারা নয়।
মিসেস বেকারকে বিচার করতে গিয়ে, তাকে আরও জটিল প্রকৃতির মনে হলো হিলারীর।
সন্ধ্যে পেরিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো, এবার আর মালগাড়িতে নয়। মাথাখোলা একটা বড় গাড়িতে, প্রত্যেকের পরনে দেহাতী পোশাক, পুরুষদের গায়ে জড়ানো আলখাল্লা, মেয়েদের মুখটাকা বোরখা। ছজন যাত্রী নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি চলছিল।
-এখন কেমন বোধ করছেন, মিসেস বেটারটন? অ্যান্ড্রু পিটার্সের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো হিলারী। তখন সবে সূর্য উঠেছে। প্রাতরাশের জন্য থামলো ওরা।
-মনে হচ্ছিলো যেন একটা স্বপ্নের নাটকের পাত্রপাত্রী আমরা, হিলারী বললো।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই মনে হচ্ছে।
—এখন আমরা কোথায় আছি?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন পিটার্স, কী জানি? একমাত্র মিসেস কেলভিন বেকারই জানেন, আর কেউ না।
–এ দেশটা বড় ফাঁকা ফাঁকা।
–হ্যাঁ, প্রায় মরুভূমি বলা যায়। সে তো হতেই হবে, তাই নয় কি?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যাতে কোনোরকম সূত্র পড়ে না থাকে সেই জন্যে?
-হ্যাঁ। সমস্ত ব্যবস্থাটা যে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করা হবে এটাই কি ভাবা ঠিক নয়। আমাদের যাত্রাপথে একটার সঙ্গে একটার কোনোও মিল নেই। প্রথমে একটা প্লেন–সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। দ্বিতীয়ত, একটা পুরোনো মালগাড়িতে সে রাত্রির যাত্রা। গাড়িটা যদি কেউ লক্ষ্যও করে থাকে দেখবে, এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির কাজে ব্যস্ত রয়েছে গাড়িটা। তারপর এই ভোলা গাড়িতে দেহাতী লোক এ অঞ্চলের রাস্তার অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এরপর হয়তো–কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো সে, কী জানি!
–কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
অ্যান্ড্রু পিটার্স মাথা নেড়ে বললো, জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। এক সময় নিজেরাই দেখতে পাবো।
ডাঃ ব্যারন এসে তাদের আলোচনায় যোগ দিলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমরা দেখতে পাবো বৈকি। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমরা জিজ্ঞেস করতেও পারছি না? সবসময় আগামীকাল কী হবে, আগামীকাল কোথায় থাকবে এই নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা।
পৃথিবীটাকে খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলতে চান আপনি, তাই না ডাক্তার? পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
–কত কী পাবার রয়েছে, ডাঃ ব্যারন বলতে লাগলেন, অথচ জীবনটা কত ছোট্ট। জীবনটা আরও দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিলো–আরও অনেকদিন যদি বাঁচতে পারতাম–
হিলারীর দিকে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আপনাদের দেশে চার রকমের কী স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন যেন? অভাব থেকে মুক্তি, ভয় থেকে মুক্তি…
–আপনি তো একজন রোগজীবাণুবিদ, তাই না ডাঃ ব্যারন?
–হ্যাঁ, আমি একজন রোগজীবাণুবিদ। এই পাঠক্রম যে কত মনোগ্রাহী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই আপনাদের নেই।
ব্যক্তির সুখে কিছু যায় আসে না, পিটার্স গভীর আলোচনার সূত্রপাত করলো। সমষ্টির সুখই হচ্ছে আসল মুখ, সেখানেই ভ্রাতৃত্ববোধ। যখন মজুররা স্বাধীন এবং সংঘবদ্ধ, যখন উৎপাদন যন্ত্রের মালিক তারাই, যখন যুদ্ধবাজ লোভী শোষকদের মুঠো থেকে তারা ছিনিয়ে আনে মুক্তি–তখনই আসে আসল সুখ।
–সুতরাং! তারিফ করে সমর্থন জানালো এরিকসন। ঠিক বলেছেন আপনি, বিজ্ঞানীরাই হবে আসল মালিক। তারা শুধু হবে সর্বোচ্চ শক্তি।
হিলারী এই আলোচনার মাঝ থেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে এলো। একটু পরে দেখলো পিটার্সও চলে এসেছে। মজা করার জন্য পিটার্স বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব ভয় পেয়েছেন?
তা পেয়েছি, নিঃশব্দে হাসলো হিলারী। ডাক্তার ব্যারন যা বলেছে খুব সত্যি। আমি বিজ্ঞানী নই, আমি সামান্য একজন নারী। গবেষণা করি না কিংবা রোগজীবাণু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি না। আমার বোধহয় অতখানি মানসিকতা নেই। ডাঃ ব্যারন যেমন বলেছেন, আমি সেই সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছি–ঠিক আর পাঁচটা বোকা মেয়ের মতো।
–তাতে অন্যায়টা কী হলো? পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
-কী জানি, আমি হয়তো এই দলের গুরুত্ব ঠিক উপলব্ধি করতে পারছি না! বুঝতেই পারছেন–একজন সাধারণ নারী আমি, স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।
-এটা কিছু অন্যায় আপনি করেননি।
–আপনি আমার মনের কথা বুঝেছেন বলে খুব ভালো লাগছে।
–বোঝার কিছু নেই, এটাই তো সত্যি। পিটার্স একটু গলা নামিয়ে বললো, স্বামীর জন্য আপনি খুব চিন্তিত, তাই না?
–না হলে কি আজ আমি এখানে থাকতাম?
–হয়তো থাকতেন না। আচ্ছা, আপনি আপনার স্বামীর রাজনৈতিক মতামত সমর্থন করেন? আমি ধরে নিচ্ছি তিনি নিশ্চয়ই কমিউনিস্ট।
সরাসরি উত্তরটা এড়িয়ে গেলো হিলারী। বললো, কমিউনিস্ট হওয়ার কথা যদি বলেন আমি জিজ্ঞেস করবো, আমাদের এই ছোট্ট দলটার কোনোকিছু কি আপনার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।
তার মানে?
–মানে–আমি বলছি যদিও আমরা সবাই এক পথের যাত্রী কিন্তু সকলের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।
পিটার্স কী যেন চিন্তা করে বললো, নয় কেন বলছেন? নিশ্চয়ই আপনি কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছেন?
হিলারী বললো, ডাঃ ব্যারনকে আমি ঠিক রাজনৈতিক মতাবলম্বী বলে আদৌ মনে করিনি। উনি ওঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অর্থ চান শুধু।
হেলগা নীডহেইমের কথাবার্তা ঠিক স্বৈরাচারীর মতো, মোটেই কমিউনিস্টের মতো নয়। আর এরিকসন?-ওঁকে আমার কেন ভীতিকর মনে হচ্ছিলো–মানে ভয়ঙ্কর রকমের স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী উনি।
-আমি কিন্তু মানবজাতির ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাসী। আর আপনি একজন পতিপ্রাণা স্ত্রী। আর মিসেস কেলভিন বেকার?–অন্যদের তুলনায় ওকে বিচার করা খুব কঠিন।
হিলারী বললো, বেকার কিন্তু আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। উনি এত সাধারণ বলেই ওঁকে আমার ভয়, অথচ এইসব কিছুর সঙ্গে উনি জড়িত।
পিটার্সের গলার স্বর এবার কঠিন হলো। বললো, আপনি হয়তো জানেন, পার্টি সম্পূর্ণ বাস্তববাদী। পার্টির কাজের জন্য সবসময় বাছাবাছা লোকই কেবল নিয়োগ করা হয়।
হঠাৎ শীত করছে বলে কেঁপে উঠলো হিলারী। চলুন একটু পায়চারি করে আসি। দুজনে অনেকক্ষণ পায়চারি করলো। ঘুরতে ঘুরতে পিটার্স উবু হয়ে বসে কী যেন কুড়িয়ে নিলো, হিলারীকে দেখিয়ে বললো, দেখুন তো আপনার কিছু বোধহয় পড়ে গেছে।
হিলারী হাতে নিয়ে বললো, আমারই মুক্তোর হারটা সেদিন ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে একটা।
–আসল মুক্তো নয় আশাকরি।
হাসলো হিলারী, বললো সব ঝুটো পোশাকী গয়না। টুকটাক অনেক কথা বলার পর হিলারী জিজ্ঞেস করলো, ঠিক কোথায় যাচ্ছি আমরা বলুন তো? কেউ কিছু বলেনি আমাকে। আমরা কি
পিটার্স তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আন্দাজে কিছু ধরে না নেওয়াই ভালো, যেখানে আপনাকে যেতে বলা হবে যান, যা করতে বলা হবে করে যান–ব্যস।
হিলারী হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে বললো, আপনাকে কেউ কঠিন বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রাখুক বা কেউ হুকুম তামিল করতে বাধ্য করুক, নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে নিষেধ করুক এটা কি আপনার ভালো লাগবে?
-বিশ্বশান্তি, বিশ্বশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের পুনর্বিন্যাসের জন্য সবকিছু করতে আমি প্রস্তুত।
–তা কি সম্ভব? তা কি পাওয়া যায়? এই পঙ্কিল জীবনের চেয়ে যে-কোনো জিনিষই ভালো। একথা মানেন তো?
এক মুহূর্তের জন্য যেন পারিপার্শ্বিক নির্জনতা আর ভোগের নরম আলোয় মানসিক জড়তা কাটিয়ে উঠলো হিলারী। না-না-না বলে চিৎকার করে ফেটে পড়তে চাইলো। বলতে চাইলো, যে পৃথিবী আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাকে কেন নিন্দে করছো তুমি? আমার এই বিশ্ব থাক, যেখানে স্নেহ মমতা আর ভুলভ্রান্তিতে ভরা মানুষ আছে। দয়াহীন মায়াহীন যন্ত্রমানবে ভরা সুন্দর বিশ্ব আমার চাই না–চাই না।
নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো, আপনার কথাগুলো বর্ণে বর্ণে সত্যি। আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি। হ্যাঁ, ওদের কথা শুনে এগিয়েই যেতে হবে আমাদের।
পিটার্স হেসে বললো, হ্যাঁ সেটাই ভালো।
.
১০.
এ যেন স্বপ্নিল পথে যাত্রা, মাঝে মাঝে হিলারীর মনে হচ্ছিল, সে যেন সারাজীবন ধরে বাছা বাছা পাঁচজন সহযাত্রীর সঙ্গে চলেছে। রাস্তা ছেড়ে গাড়ি এখন চলেছে প্রায় শূন্য প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হতো–এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা সব্বাই অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
হিলারীর নিজের ক্ষেত্রে এটা বর্ণে বর্ণে সত্যি। যে হিলারী ক্র্যাভেন ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলো সে এখন অলিভ বেটারটনে পরিণত হয়েছে। এইসব রাজনৈতিক আলোচনা সে এখন কত সহজে করতে পারে। প্রতিদিনই সে যেন আরও বেশি করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে–নবরূপে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে।
মাঝে মাঝে এই লোকগুলোকে ভয়ও করে। প্রতিভাবান লোকদের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠভাবে আর কখনও সে মেশেনি। এরা যেন সাধারণ মানুষের মতো নয়, অনেক উপরে। এই পাঁচজন–প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা। হিলারীর মনে হয়েছে–এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আবেগপ্রবণ আদর্শবাদের শিকার।
ডাঃ ব্যারন একদিন বলেছিলো–একটা ছোট্ট শিশির মধ্যে এমন বিধ্বংসী শক্তি ধরে রাখা যায়, যা একটা বিশাল মহাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
হিলারী তাকে জ্ঞিজ্ঞেস করেছিলো, এমন কাজকে কি আপনি সমর্থন করেন? সত্যিই কি একাজ করতে পারেন আপনি?
কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই পারি–যদি প্রয়োজন হয় হাজারবার করতে প্রস্তুত আমি। কত কী জানার আছে ও কত কীই আবিষ্কার করার রয়েছে…
হেলগা নীডহেইমের প্রতি তার বিতৃষ্ণা আরও প্রকট। মেয়েটার এই প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য তাকে আরও বেশি করে জ্বালা ধরিয়েছে। আর পিটার্সকে তার ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে তার চোখে ভয়ঙ্করের আগুন দেখে সে ভয় পেয়েছে, গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? বারবার এই কথাটা ভাবছিলো হিলারী। এসবের শেষ কোথায়? এই লোকগুলো পাগল, এদের মাথামুণ্ডু নেই। প্রত্যেকেই যেন এক-একটা মরীচিৎকার পেছনে ছুটছে।
তৃতীয় দিনটাও শেষ হয়ে গেলো। ছোট্ট একটা শহরের গ্রাম্য হোটেলে এসে উঠেছে ওরা। এখানে এসে তারা আবার পাশ্চাত্যের আধুনিক পোশাক পরলো। ছোট্ট একটা ফাঁকা ঘরে সে-রাতটা ঘুমালো হিলারী। খুব ভোরে মিসেস পেকার তাকে ডেকে তুললেন। উঠে পড়ুন এক্ষুণি আমাদের বেরোতে হবে। প্লেন অপেক্ষা করছে।
-প্লেন?
–হ্যাঁ-প্লেন। বাব্বাঃ! এতদিন পর এবার একটু ভদ্রভাবে ঘোরা যাবে।
ঘন্টাখানেক গাড়ি পথে এসে বিমানবন্দরে পৌঁছলো ওরা। দেখে মনে হয়–সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত একটা বিমানঘাঁটি।
প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ ওরা নামলো। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা সমতল জায়গা। আগে যে একটা কর্মব্যস্ত বিমানবন্দর ছিলো তা স্পষ্ট। পাশে একটা বেশ বড়সড় সাদা বাড়ি।
মিসেস বেকার তাদের সেই বাড়িতেই এনে তুললেন। এটা যে সম্পূর্ণ কারো ব্যক্তিগত বিমানবন্দর সেটা বোঝা যায়, কারণ কোনরকম সরকারী অভ্যর্থনা পেলো না যাত্রীরা।
এতদিনে যাত্রা শেষ হলো, দারুণ খুশির মেজাজে আচমকা বলে উঠলেন মিসেস বেকার, এখন ভেতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া যাক। তার মধ্যে গাড়ি তৈরি হয়ে থাকবে।
–যাত্রা শেষ?–হিলারী হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু এখনও তো আমরা সাগর পার হইনি।
আপনি তাই আশা করেছিলেন নাকি? মিসেস বেকার কৌতুকের স্বরে বললেন।
অবাক হয়ে হিলারী বললো, হ্যাঁ–মানে সত্যিই তাই আশা করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম… থেমে গেলো সে।
-সব লোকেই তাই ভাবে। বোকা লোকগুলো লৌহ যবনিকা নিয়ে কত কী-ই না কল্পনা করে কিন্তু আমি বলি, পৃথিবীর যে-কোনো জায়গাতেই লৌহ যবনিকার অন্তরাল সৃষ্টি হতে পারে।
দুজন ভৃত্য আবার এসে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। হাত-মুখ পরিষ্কার করে কফি, স্যান্ডউইচ, বিস্কুট–জলযোগ। খাওয়া শেষ হতে মিসেস বেকার ঘড়ি দেখলেন। আচ্ছা, এবার আমি উঠি, ভাই। আমি এখান থেকেই ফিরে যাবো।
হিলারী অবাক হয়ে বললেন, আপনি আবার মরক্কোয় ফিরে যাবেন?
ওটা ঠিক হবে না, কারণ ঐরকম একটা প্লেন দুর্ঘটনার পর আর কি সেখানে ফেরা উচিত। না, এবার আমাকে অন্য শিকারের পেছনে ছুটতে হবে।
কিন্তু কেউ তো আপনাকে চিনে ফেলতে পারে। ক্যাসাব্লাঙ্কা বা ফেজ-এর হোটেলের পরিচিত কেউ।
হ্যাঁ পারে, বললেন মিসেস বেকার। কিন্তু তারা ভুল লোককে চিনবে। আমার এক বোন, মানে আরেক মিসেস কেলভিন বেকার প্লেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আর আমার বোনের সঙ্গে আমার মিল থাকাটাই স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, একথা খুবই সত্যি, মনে মনে ভাবলো হিলারী। সমস্ত কর্মের বাহ্যিক গুণগুলোই মিসেস বেকারের মধ্যে বর্তমান। সারা দুনিয়ার সামনে, পরিচিত লোকজনের সামনে মিসেস কেলভিন বেকার নিজেকে এমন স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করেছে যে, তার সেই বিশালত্বের পেছনে কী আছে জানা কঠিন।
বেকার বললেন, আচ্ছা চলি মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন সুখের হোক এই কামনা করি।
সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে হিলারী বললো, আমি যে কোথায় আছি তাও জানি না–পৃথিবীর ঠিক কোন্ জায়গায়?
এই কথা! এতো খুব সোজা না, এখন আর লুকোছাপার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সুউচ্চ অ্যাটলাসের দুর্গম স্থান একটা, এর খুব কাছেই–কথাটা শেষ না করেই মিসেস বেকার একে একে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সেই প্লেনটা তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো। কেমন যেন একটা ঠান্ডা শিরশিরানী অনুভব করছিলো হিলারী। মনে হলো, বহির্জগতের সঙ্গে শেষ যোগসূত্রটুকু এখানে ছিন্ন হয়ে গেলো।
পিটার্স হিলারীর মনের কথা বুঝেই বোধহয় এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে বললো, এমন জায়গা যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হ্যাঁ, আমাদের কথাই বলছি।
ডাঃ ব্যারনও এগিয়ে এসে বললেন, এখনও আপনাদের মনের জোর আছে তো? নাকি আপনারা ওই মার্কিনী বন্ধুটির সঙ্গে প্লেনে উঠে নিজের চেনা জগতে ফিরে যেতে চাইছেন?
-ইচ্ছে করলেই কি যেতে পারবো? হিলারী বললো।
–কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফরাসি ভদ্রলোক বললেন, কী জানি!
–ওঁকে ডাকবো? অ্যান্ড্রু পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
হিলারী উত্তর দিলো, কক্ষনো না।
হেলগা নীডহেইম ব্যাঙ্গ করে বললো, দুর্বলচিত্ত মেয়েদের এখানে আসা কেন?
–মোটেই উনি দুর্বলচিত্ত মেয়ে নন, ডাঃ ব্যারন জবাব দিলেন। উনি নিজের কাছেই কিছু জবাব চেয়েছেন, যা যে-কোনো বুদ্ধিমতী মেয়েই করে।
এরিকসন তখন বলেছেন, হুঃ, স্বাধীনতার দোরগোড়ায় এসে লোকে ফিরে যাবার কথা ভাবে কী করে!
হিলারী এবার না বলে পারলো না, যদি ফিরে যাবার উপায় না থাকে অথবা ফিরে যাবার চিন্তা করার স্বাধীনতা না থাকে, তবে এ স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়।
এই সময়ে ভৃত্য এসে জানালো গাড়ি তৈরি।
বাইরে এসে ওরা দেখলো, দুটো ক্যাডিলাক গাড়ি, পাশে দাঁড়িয়ে দুজন ধোপদুরস্ত চালক। হিলারী চালকের পাশে সামনের আসনে বসতে চাইলো। বড় গাড়ির পেছনের ঝাঁকুনিতে গা গুলোয় তার। গাড়িতে বসে টুকিটাকি কথা বললো হিলারী, কী চমৎকার আবহাওয়া–সুন্দর গাড়িটা–স্বচ্ছন্দ ফরাসিতে সে বলছিলো, ড্রাইভার খুশি হয়ে জবাব দিচ্ছিলো। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?
বিমানবন্দর থেকে হাসপাতাল? তা–প্রায় ঘন্টাদুয়েকের রাস্তা মাদাম।
হিলারী চমকে উঠলো, হাসপাতাল! তাই হবে বোধহয়। এখন মনে হচ্ছে হেলগা নীডহেইম আগেই নার্সের পোশাক পরে নিয়েছে সম্ভবতঃ এই জন্যই। ড্রাইভারকে বললো, হাসপাতালটা কেমন আমাকে একটু বলো।
–সে মাদাম–চমৎকার। পৃথিবীর আধুনিকতম যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম রয়েছে এখানে। কত বড়বড় ডাক্তার আসেন এই হাসপাতাল দেখতে আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফিরে যান। মানবজাতির কল্যাণের জন্য এখানে যা করা হচ্ছে-অতুলনীয়।
-তা তো হতেই হবে-হা হা তাই তো হওয়া উচিত।
–কী যন্ত্রণাময় জীবন এদের-ড্রাইভার বললো। আগেকার দিনে নির্জন দ্বীপে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মরার জন্য পাঠানো হতো এদের। কিন্তু এখানে, ডাঃ কোলিনির চিকিৎসায় প্রায় সবাই রোগমুক্ত হচ্ছে। এমনকি শেষ অবস্থা থেকেও অনেকে সেরে উঠেছে।
হিলারী বললো, হাসপাতালের পক্ষে জায়গাটা খুবই নির্জন বলে মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ, মাদাম, কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে নির্জন জায়গাই তো বেছে নিতে হবে। ওপরওয়ালারাই এই বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু জল হাওয়া খুব ভালো এখানে, চমৎকার বাতাস। ওই যে, এইবার দেখুন মাদাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হিলারী দেখলো, অদূরে পর্বতমালা, সেইদিকেই দ্রুত চলেছে ওরা। পাহাড়ের ওপাশে একটা বিরাট সাদা ঝকঝকে অট্টালিকা।
-ওঃ, এখানে এমন একটি বাড়ি তৈরি করা কি চাট্টিখানি ব্যাপার, ড্রাইভার বলতে লাগলো। কতকত্তো টাকা যে খরচ করা হয়েছে। সরকারী কাজের মতো সস্তা কাজ নয়। জলের মতো টাকা ঢেলেছে। ওরাও বলেন–আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেদের একজন। ঠিকই বলেন, নিজের চোখেই দেখুন–মানবজীবনের দুঃখমোচনের জন্য কী বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি উঠে একটা বিরাট উঁচু লোহার ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
এখানেই আপনাদের নেমে যেতে হবে, মাদাম। ভেতরে গাড়ি নিয়ে যাবার হুকুম নেই।
নেমে পড়লো ওরা। ফটকের গায়ে ঘন্টা বাজাবার দড়ি ঝুলছে। কিন্তু দড়িটা ছোঁয়ার আগেই দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেলো। সাদা পোশাক পরা একজন লোক হাসিমুখে তাদের ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলো। দরজা দিয়ে ঢুকে, একপাশে উঁচু তারের জাল দিয়ে ঘেরা একটা বাগান। সেখানে কয়েকজন পায়চারি করছে। আগন্তুকদের দেখার জন্য তারা মুখ ফেরাতেই, হিলারীর গলা দিয়ে চাপা আতঙ্কের একটা চিৎকার ফেটে পড়তে চাইলো, ওকি! ওরা যে কুষ্ঠরোগী! কুষ্ঠরোগী!
আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হিলারী।