দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ৫

।। ছয়।। 

পরিকল্পনা সফল, তাই স্বভাবতই বাড়িতে ফিরে আমার মন খুশিতে নেচে উঠল। সত্যি লর্ড ন্যাসবি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। ‘ভালো কাজ’ দেখাতে হবে তাই দরজা বন্ধ করে সেই কাগজের চিরকুটটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। এখন এটা আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু। বার বার সেটা পড়লাম। এর মধ্যে রহস্যের ব্লু লুকিয়ে আছে। 

প্রথমেই মনে হল চিরকুটের সংখ্যাগুলো কী হতে পারে? পাঁচটি সংখ্যা, প্রথমে দুটি সংখ্যার পর একটি ফুটকি। সতেরো একশো এবং বাইশ। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে তারপর সংখ্যাগুলো একে একে যোগ করলাম। কখনো কখনো নাকি এভাবে ইন্সিত রহস্য সংখ্যাটা পাওয়া যায়। 

এক আর সাত যোগ করলে আট, আটের সঙ্গে এক যোগ করলে নয়, নয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে এগারো। সবশেষে দুই যোগ করলে তেরো। 

অশুভ তেরো। তাহলে সমস্ত ব্যাপারটা থেকে দূরে সরে থাকার জন্য আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে? খুবই স্বাভাবিক। এও আমার মনে হল, কোনো চক্রান্তকারী সত্যিই যদি আমাকে হুমকি দিয়ে থাকে তাহলে সংখ্যাটি ‘১৩’ লিখতে পারত, অত প্যাঁচের মধ্যে দিয়ে যেত না নিশ্চয়ই। 

অবশিষ্ট থাকে দুটি শব্দ ‘কিলমার্ডেন ক্যাসেল। এটা একটা জায়গার নাম নিশ্চিত। আর সেটা কোনো অভিজাত পরিবারের দোলনাও হতে পারে। কিংবা সম্ভবত ধ্বংসাবশেষ চিত্রবৎ। (যক্ষের ধন?) 

হ্যাঁ, যক্ষের ধনের ঠিকানাটাই হবে। সংখ্যাতত্বের মধ্যে ঠিকানার নির্দেশ দেওয়া থাকে শুনেছি, এইভাবেই কিলমার্ডেন ক্যাসেলের হদিশ করতে হবে। নানা ধরনের বই দেখতে থাকি, কিলমার্ডেন ক্যাসেল নামে কোনো জায়গায় সন্ধান পাওয়া গেল না। বিরক্ত হয়ে শেষের বইটা বন্ধ করে রেখে দিলাম। তবে কি জায়গাটার কোনো অস্তিত্ব নেই? কেনই বা আততায়ী ঐ দুটি শব্দ কাগজে লিখতে গেল? ঐ শব্দ দুটির কী অর্থ হতে পারে? 

তবে আমাকে অন্যদিকে চিন্তা করতে হবে? হ্যাঁ, নিশ্চয়! অপরাধ যেখানে হয়েছে সেখানে আমাকে একবার যেতেই হবে। গোয়েন্দারা নাকি তাই করে থাকে। অপরাধীর ফেলে যাওয়া চিহ্ন খুঁজে পেতে পুলিসের চোখ এড়িয়ে যায়। দেরিতে হলেও ঝানু গোয়েন্দারা একটা-না-একটা কু পেয়েই যায়। জলের মতো পরিষ্কার আমার ধারণা। মার্লোয় আমাকে যেতেই হবে। 

নানা মতলবের কথা মাথায় এল। হয়তো বাড়িটা এখনো খালিই পড়ে আছে, ভাড়া দেওয়া হবে। সেই খালি বাড়ির একজন নকল ভাড়াটে সেজে আমাকে সেখানে যেতে হবে। 

স্থানীয় হাউস এজেন্টের অফিসে গিয়ে জানালাম আমার ভালো বাড়ি ভাড়া চাই। হাউস এজেণ্ট তার খাতা খুলে অনেক বাড়ির উল্লেখ করল কিন্তু আমার কোনোটাই পছন্দ হল না। কাগজে মিল হাউসের বিবরণ পেয়েছি। শেষে তাকে ভাসা ভাসা ইঙ্গিত দিয়ে বললাম, বাড়িটা হবে নদীর ধারে। সঙ্গে থাকবে লাগোয়া বাগান, একটা ছোট লজ— 

— হ্যাঁ, সেরকম বাড়ি আমার হাতে আছে বৈকি। স্যার ইউস্টেস পেডলারের এইরকম একটা লজ আছে। দ্য মিল হাউস, জানেন সেটা কোথায়? 

অজ্ঞতার ভান করলাম, না, জানি না তো? 

—সম্প্রতি এই বাড়িতেই একটা হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। সেই কারণে হয়তো বাড়িটা আপনার পছন্দ হবে না। 

—ওহো, তাতে আমার কোনো বাধা নেই। তাছাড়া মনে হয় এই মওকায় বাড়িটা একটু সস্তায় পাওয়া যেতে পারে। 

সে সঙ্গে সঙ্গে টোপ গিলে ফেলল। কোনো সন্দেহই করল না। 

—হ্যাঁ, তা হতে পারে। যাই হোক, বাড়িটা আগে একবার দেখে আসুন। পছন্দ হলে তারপর ভাড়ার ব্যাপারে দরদস্তুর হবে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে একটা চিঠি লিখে দেব? 

তাহলে তো খুব ভালো হয়। 

মিল হাউসের লজে মিনিট পনোরোর মধ্যে পৌঁছলাম। আমার ডাকে একজন বয়স্কা মহিলা দরজা খুলে খিঁচিয়ে উঠল, এ বাড়ির ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারে না, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আপনাদের মতো সাংবাদিকদের জ্বালায় আমি অতিষ্ট হয়ে উঠেছি। স্যার ইউস্টেসের হুকুম হল- 

—কিন্তু আমি যে শুনেছি বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হবে। হাউস এজেন্টের চিঠিটা দেখিয়ে ঠাট্টার গলায় বললাম, অবশ্য যদি ইতিমধ্যে বাড়িটা ভাড়া হয়ে গিয়ে থাকে— 

—ওহো, তা নয়, বাড়িটা ভাড়া হয়নি নিশ্চিত। আসলে ব্যাপার কী জানেন মিস, সাংবাদিকদের জেরায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। না, বাড়িটা ভাড়া হয়নি—সম্ভাবনাও নেই। 

—কেন, বাড়ির ড্রেনের কোনো গণ্ডগোল আছে না কি? 

—হায় ভগবান, তা হতে যাবে কেন? ড্রেন ভালোই আছে। তবে আপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন এখানে একজন বিদেশিনী খুন হয়েছেন। 

অন্যমনস্কভাবে বললাম, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, খবরের কাগজে যেন কী একটা খবর দেখেছিলাম।

ভদ্রমহিলা আমার সহজ সরল কথা শুনে খুশি হল। আন্তরিকভাবে সে এবার বলল, জানেন মিস, খবরের কাগজের এইসব সাংবাদিকদের বড় হামবড়া ভাব। তারা নিজেদেরকে খুব চালাক মনে করে। তাদের ধারণা ওই কেসের ব্যাপারে পুলিস ব্যর্থ। কিন্তু আমার ধারণা, পুলিস একদিন-না-একদিন অপরাধীকে ঠিক খুঁজে বার করবে—যদিও মেয়েটির সেই ছেলে বন্ধুটি দেখতে ভারি সুন্দর ছিল, তাকে খুনী বলে মনেই হয়নি। মনে হয় ছেলেটি যুদ্ধে একটু আহত হয়ে থাকবে। আর মেয়েটি হয়তো তাকে খারাপ ব্যবহার করে থাকবে। তবে মেয়েটিও বেশ সুন্দরী ছিল। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক ঐখানেই সেদিন সে দাঁড়িয়ে ছিল। 

—মেয়েটির রং ফর্সা নাকি কালো ছিল? 

—ঘন কালো চুল—ফর্সা মুখ, অত্যন্ত ফর্সা বলা যেতে পারে। তার লাল রঙ করা ঠোঁট দুটো দেখে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল। রঙ করা ঠোঁট আমার পছন্দ নয়, জানেন- 

আমরা কথায় কথায় বন্ধুর মতো খোলাখুলি আলোচনা করতে লাগলাম। ভদ্রমহিলা টেরও পেলেন না। কথার ছলে আমি আমার তদন্তের কাজটা কেমন সেরে নিচ্ছি। আচ্ছা, মেয়েটিকে কি তখন খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল? 

—না, একেবারেই নয়। তাই তো পরদিন বিকেলে লোকজন এসে যখন আমাকে বলল, এ বাড়িতে একটা মেয়ে খুন হয়েছে। পুলিস এসেছে, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। 

—আমার অনুমান, স্যার ইউস্টেস পেডলার তখন ভেনিসে? 

—হ্যাঁ, ঠিক তাই মিস, খবরটা শোনার পর তিনি ইংলন্ডে ফিরে এসে তার সেক্রেটারি মিঃ প্যাগট মারফত খবর পাঠান আমরা যেন এখান থেকে না যাই। আমাদের দ্বিগুণ বেতন দেওয়া হবে। জন বলে, বাড়তি টাকা কামানোর এই তো সুযোগ। তাই এখানেই থেকে যাই। 

ভদ্রমহিলা অ্যানির প্রসঙ্গের জের টেনে বলল, সেই যুবকটি কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। তার চোখে মুখে একটা উত্তেজনার ছাপ দেখেছিলাম। কিন্তু তখনও আমার কোনো সন্দেহ হয়নি। এমনকি ফিরে আসার পর তাকে আরও বেশি উত্তেজিত দেখেও আমার মনে কোনো অশুভ চিন্তা আসেনি। 

—এ বাড়িতে সে কতক্ষণ ছিল? 

—খুব বেশি নয়, মিনিট পাঁচেক হবে। 

—লম্বা ছ’ফুট হবে? 

—তা হবে। 

—আপনি বলছেন তাঁর দাড়ি গোঁফ ছিল না? 

—হ্যাঁ, মিস, দাড়ি গোঁফের চিহ্নমাত্র ছিল না তার মুখে। আচ্ছা তার চিবুকটা খুব চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল? 

— হ্যাঁ, মিস, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? 

—এটা এটা রহস্য বলে ধরে নিতে পারেন। তবে প্রায়ই দেখা যায়, খুনীদের চিবুক খুব উজ্জ্বল দেখতে হয়। 

আমার এই মন্তব্যটা মিসেস জেমস সহজেই বিশ্বাস করে নিল। সত্যি মিস, আগে কখনোও এমন কথা আমি শুনিনি। 

—আর একটা কথা মিসেস, তার কথাটা ঠিক কী রকম ছিল, আপনি নিশ্চয়ই সেটা লক্ষ্য করেন-নি। 

—কেন, সাধারণ মানুষের মতোই। বাড়ির চাবি আনিয়ে দেব? 

আমি যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। আমি তো এই চাইছিলাম। চাবি নিয়ে মিল হাউসের দিকে এগিয়ে গেলাম। পথে টিউব স্টেশনের সেই চিকিৎসকের কথা ভাবছিলাম, মাঝ বয়সী, মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ, তবে সে যখন মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছিল, তখন কেন জানি না তাকে আমার সেই যুবক বলেই মনে হয়েছিল। যুবকটির বিবরণ শুনে আমার মনে হল, সেই চিকিৎসকের মুখ থেকে দাড়ি গোঁফ বাদ দিলে তাকে সেই যুবক বলেই ভ্রম হত। 

তাহলে টিউব স্টেশনের দুর্ঘটনার শিকার এবং সেই বিদেশিনী মহিলা—মিসেস দ্য কাসটিনা। তার আসল নাম যাই হোক-না-কেন, এদেশে দু’জনেরই মিল হাউসে এসে মিলিত হওয়ার কথা ছিল গোপনে। হয়তো তার আগেই তাদের জীবনহানির আশঙ্কা করে থাকবে। 

ন্যাপথালিন মানুষটাকে অকল্পনীয়ভাবে হঠাৎ তথাকথিত ‘চিকিৎসককে’ টিউব স্টেশনে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠতে দেখেছিলাম। তারপরের ঘটনা হল—চিকিৎসক তার ছদ্মবেশ বদলে মার্লোয় মেয়েটিকে অনুসরণ করে থাকবে। তাড়াতাড়িতে নকল গোঁফ দাড়ি সরানোর সময় হয়তো তার চিবুকে আঠা লেগে থাকবে। তাই অমন চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। এইজন্যই মিসেস জেমসকে প্রশ্নটা করেছিলাম। 

মিল হাউসে ঢুকে আমার মনে হচ্ছিল, এই নির্জন জায়গায় এসে মেয়েটির কি একবারও মনে হয়নি এ জায়গাটা তার পক্ষে নিরাপদ নয়? নিয়তি কি তার জন্যে এখানে অপেক্ষা করছিল? হঠাৎ আমার বুকটা কেঁপে উঠল, বাড়িটা সত্যিই কি খালি পড়ে আছে? নিয়তি কি আমার জন্যও এখানে আছে? এই প্রথম বহু-ব্যবহৃত ‘আবহাওয়া’ শব্দটার অর্থ আমি উপলব্ধি করলাম। এ বাড়ির আবহাওয়ায় ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা মিশে আছে। শয়তানের দল এ বাড়ির আবহাওয়া বিষাক্ত করে তুলেছে। 

।। সাত ।। 

আমার মনটা দমে গেল কথাটা মনে হতেই। তাড়াতাড়ি উঠে এলাম। সেই অভিশপ্ত ঘরটা পেতে অসুবিধা হল না। মেয়েটির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল। ঘরে বারান্দায় কাদামাটি মাখা জুতোর ছাপ। ভাবলাম হয়তো খুনীর পায়ের ছাপও সেখানে আছে। পুলিশ নিশ্চয়ই এদিকটাও চিন্তা করে থাকবে। তবে কতটা সফল হয়েছে জানি না। 

তেমন কিছু ক্লু আমার মতো যুবতী গোয়েন্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। নোটবুকে লিখে নেবার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু পেলাম না। কেবল ঘরের একটা স্কেচ করে নেওয়া ছাড়া। প্রতিটি জানলার নিচে একটা করে চওড়া কাপবোর্ড। প্রায় সবগুলোই বন্ধ। একটা কাপবোর্ড ঈষৎ খোলা দেখে কৌতূহলবশত ডালাটা পুরো খুলতেই একটা কাগজের রোল চোখে পড়তেই সেটা নিয়ে দেখি, কাগজের নিচে একটা কোডাক ফিল্ম। প্রথমে মনে হল স্যার ইউস্টেস পেডলার ভুল করে সেটা ফেলে গেছেন। পরেই মনে হল, স্যার ইউস্টেসের হলে তার ওপর পুরু ধুলো জমে থাকত কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। সামান্য একটু দু-তিনদিনের ধুলো লেগে রয়েছে। 

তাহলে কে সেটা ফেলে গেল? মেয়েটি, না কি সেই যুবকটি? মনে পড়ে মেয়েটির হাতব্যাগ যেমন ছিল তেমনি আছে। ছেলেটির সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময়ে যদি হাতব্যাগ থেকে ফিল্ম-এর রোলটা পড়ে থাকে তাহলে সেই সঙ্গে খুচরো মুদ্রাও পড়বে কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। না, মেয়েটি সেটা ফেলে যায়নি। 

হঠাৎ সেই ফিল্ম রোল থেকে ন্যাপথালিনের গন্ধ পেতেই নতুন করে আমার মনে চমক জাগল। তবে কি টিউব স্টেশনে নিহত সেই লোকটি এই ফিল্ম রোলটা এখানে ফেলে গেছে? না, সে নয়, সেই চিকিৎসকই নিশ্চয়ই সেটা ফেলে গিয়ে থাকবে। সেই চিরকুটটা মৃত লোকটির পকেট থেকে নেওয়ার সময়ে এটাও সে হাত সাফাই করে থাকবে হয়তো। 

এখন আমি আমার ব্লু পেয়ে গেছি। এখন আমার প্রথম কাজ হল, সেই ফিল্মটা ধোয়ার ব্যবস্থা করা। তারপরে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। 

চাবিটা মিসেস জেমসকে ফেরত দিয়ে বাড়ি ফিরে সেই চিরকুটটার ওপরে চোখ রাখতে গিয়ে হঠাৎ একটা নতুন সূত্রের সন্ধান পেয়ে গেলাম। ধরা যাক, সংখ্যাগুলো একটা তারিখ ১৭/১/২২ অর্থাৎ ১৭ই জানুয়ারি ১৯২২। সত্যিই আমি কি বোকা! আগে কথাটা ভাবিনি কেন? কিন্তু এরপর আমাকে ক্লিমার্ডেন ক্যাসেলের রহস্যটি বার করতে হবে। আজ ১৪ তারিখ। হাতে মাত্র তিনদিন সময়। এরই মধ্যে সেই রহস্যের সূত্রটা খুঁজে বার করতেই হবে। 

তার আগে কোডাক ফিল্মটা ধোয়াতে হবে। মিঃ ফ্লেমিংকে জিজ্ঞেস করলাম, টিউব স্টেশনের নিহত লোকটার হাতে ক্যামেরা ছিল কিনা। মিঃ ফ্লেমিং এ কেসের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তিনি বললেন, না, তার কাছে কোনো ক্যামেরা ছিল না। আমি এখন একটু মুষড়ে পড়লাম। আমার অনুমান তাহলে ব্যর্থ। তার হাতে যদি ক্যামেরাই না থাকে, কেনই বা সে তার কাছে কোডাক ফিল্ম রাখতে যাবে? 

রিজেন্ট স্টুডিওতে গিয়ে আর-একটা ধাক্কা খেলাম। ফিল্মটা ধোয়ানোর জন্য তাদের হাতে দিতেই একজন সেটা পরীক্ষা করে বলল, আপনি ভুল করে ভুল ফিল্ম দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ নতুন ফিল্ম। কোনো ফোটোই নেওয়া হয়নি এতে। 

তখন আমার নিজের ওপর খুব রাগ হল। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি যেন আমার এখনো হয়নি। কী বোকা আমি। 

বাড়ি ফেরার পথে একটা জাহাজ কোম্পানির অফিসের সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অফিসের জানলায় একটা সুন্দর জাহাজের মডেল আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। সেই কোম্পানির জাহাজের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কেনিল-ওয়ার্থ ক্যাসেল’। সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্যচিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল। দ্রুতপায়ে সেই জাহাজ কোম্পানির অফিসের কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিলমার্ডেন ক্যাসেল? 

সাউদাম্পটন থেকে ১৭ই জানুয়ারি ছাড়ছে। তা আপনি কি কেপ টাউনে যাবেন? প্রথম না দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট দেবো? 

প্রথম শ্রেণীর টিকিট—এখন আমি আমার অভিযানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। 

।। আট।। 

(স্যার ইউস্টেস পেডলার, এম.পি.-র দিনলিপির সারাংশ) 

এ এমন এক অদ্ভুত ব্যাপার, আমি কখনো শান্তি পাইনি। অথচ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতেই আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি ক্লাব, ব্রীজ খেলা, ভালোমন্দ খাবার, আর দামী মদ। গ্রীষ্মের ইংল্যান্ড এবং শীতের রিডেরা আমার খুব পছন্দ। আমার উদ্দেশ্য হল নির্ভাবনায় এবং সুখী জীবন-যাপন। এরজন্য আমাকে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে। অর্থোপার্জনের দিকে নজর দিতে হয়েছে। সফলতা সর্বদা হয়নি, হয়তো কখনো অজান্তে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। এই জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা আমি ভীষণ ঘৃণা করি। 

এ সবের কারণে আমার সেক্রেটারি গাই প্যাগট পরশ্রীকাতর, কষ্টসহিষ্ণু, কর্মঠ, সব মিলিয়ে অন্য সকলের প্রশংসার পাত্র হলেও আমার কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। অনেকদিন থেকে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঠিকমতো কাজ করলে, ইচ্ছেমতো সেক্রেটারিকে ছাড়ানো যায় না। একমাত্র মজার ব্যাপার হল তার মুখ। চতুর্দশ শতাব্দীর জেলবন্দীর মতো মুখ তার। 

গত সপ্তাহে ভাবলাম, তাকে ফ্লোরেন্সে পাঠিয়ে কিছুদিন তার হাত থেকে রেহাই পাব, যদিও জানুয়ারি মাসে সেখানে যাওয়ার উপযুক্ত সময় নয়, তবুও কোনোমতে তাকে রাজী করালাম। কিন্তু পরদিন তাকে দেখে চমকে উঠে রসিকতা করে বললাম, কবর দেওয়ার কাজ শেষ, নাকি আগামীকাল সম্পন্ন হবে? 

প্যাগট আমার রসিকতা তেমন বোঝে না। তাই অবাক হয়ে বলল, স্যার ইউস্টেস, তাহলে আপনি দেখছি ব্যাপারটা জানেন। 

—কেন, কী ব্যাপার। তোমার মুখ দেখে আমি তো ভাবলাম, তোমার কোনো নিকট আত্মীয় মারা গেছেন। আর তার কবরের ব্যবস্থা হচ্ছে বুঝি! 

—ভেবেছিলাম, খবরটা আপনি জানতে পারবেন না। একটা টেলিগ্রাম আমার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে সে বলে, আজকের ডাকেই এই টেলিগ্রামটা এসেছে। 

—কী ওটা? 

—মার্লো পুলিসের টেলিগ্রাম। একজন মহিলা আপনার বাড়িতে খুন হয়েছে। মনে হয়, আমাদের ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে। 

—কেন, কেন আমরা ফিরে যাব। 

—আপনার বাড়িতে খুন হয়েছে, পুলিসী ঝামেলা তো আপনাকেই পোহাতে হবে। তাছাড়া ঘটনাটা আপনার নির্বাচনী এলাকায় ঘটেছে। অতএব সব দায়িত্ব তো আপনারই স্যার। 

ভেবে পাই না, কেন এ ব্যাপারে পুলিস আমাকে জড়াতে যাবে? ঠিকই বলেছে প্যাগট। পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া বড় ঝামেলার ব্যাপার। একটা খালি বাড়িতে একজন যুবতী কেন খুন হল, কে খুন করল, তার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী। এইসব অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠতে পারে ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তারা পুলিসকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। 

বিমর্ষভাবে প্যাগট বলে, আর মেয়েটি বিদেশিনী সেটা আরো ঝামেলার ব্যাপার। 

এবারেও সে ঠিকই বলেছে। নিজের দেশের কোনো মেয়ে খুন হলে যত না কলঙ্ক তার থেকে বেশি কলঙ্ক বিদেশিনী খুন হলে। 

হায় ঈশ্বর। আশা করি ব্যাপারটা ক্যারোলিনের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না।

ক্যারোলিন আমার রাঁধুনি আবার সে আমার বাগানের মালীর স্ত্রী, রাঁধে ভালো। মালী হিসেবে জেমস মোটেই কাজের লোক নয়, তবে তার স্ত্রীর ভালো রান্নার জন্য এখনো তাকে কাজে বহাল রেখেছি। 

প্যাগট মন্তব্য করল, মনে হয় না এর পরে সে আর এখানে থাকবে। 

সব ব্যাপারেই মজা উপভোগ করার অভ্যাস তোমার। ইংল্যান্ডে আমার ফিরে যেতে হবে। তাছাড়া সত্যি ক্যারোলিনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করতে হবে। 

তিনদিন পরের ঘটনা : 

শীতের ইংল্যান্ডে এমন জঘন্য আবহাওয়ায় মানুষ যে কী করে এখানে থাকে, আমার কাছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার হাউস এজেন্ট জানিয়ে দিয়েছে। সেই বিদেশিনী মহিলার খুন হওয়ার ব্যাপারটা বেশি প্রচারিত হওয়ায় ভবিষ্যতে মিল হাউস ভাড়া দেওয়া মুশকিল। যাই হোক, দ্বিগুণ বেতনে ক্যারোলিন থাকতে রাজী হয়েছে। 

একদিন পরের ঘটনা : 

ইতিমধ্যে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমেই অনণ্টাস মিলার-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের কথা বলতে হয়। একটা বুড়ো গাধার উপমা সে, বর্তমান সরকারের প্রতিনিধি। সেই লোকটা ঝানু কূটনীতিবিদদের মতো ক্লাবের এক নির্জন জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়ে দেশের বর্তমান হালচাল নিয়ে আলোচনা করল, তখনও তার মতলব বুঝতে পারিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান প্রসঙ্গ থেকে শিল্পসংক্রান্ত পরিস্থিতি, ব্যাণ্ডের ধর্মঘট। কোনো কিছুই বাদ দিল না। সবশেষে সে ফিসফিসিয়ে জানায়, কয়েকটা জরুরী দলিলপত্রের হদিশ পাওয়া গেছে। সেটা জেনারেল স্মার্টস-এর হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু কি করে পাঠাই বলুন তো? আমাদের অবস্থা এ ব্যাপারে অত্যন্ত শোচনীয়। 

সহজভাবে বললাম, ডাকে পাঠালেই তো পারেন, দু’পেনির ডাকটিকিট লাগিয়ে কাছাকাছি চিঠির বাক্সে ফেললেই তো হয়। 

—প্রিয় পেডলার, একই ডাকঘর হয়ে যাবে না? 

—ডাকে পাঠানো পছন্দ না হলে, আপনার কোনো ছেলের মারফত তো পাঠাতে পারেন।

—অসম্ভব, সে অনেক কারণ, এখানে বলা সম্ভব নয়। 

উঠতে গিয়ে আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনার কথাবার্তা খুব আকর্ষণীয় কিন্তু আমাকে যে এখুনি চলে যেতে হচ্ছে— 

—এক মিনিট প্রিয় পেডলার, আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো। খুব শিগগীর আপনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যাচ্ছেন কিনা। রোডেসিয়ার সংযুক্তির প্রশ্নে আপনার একটা বিরাট স্বার্থ আছে। আপনি যদি এ কাজটা করে দেন তো সরকারের খুব উপকার হয়। সরকার আপনার প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবে। 

—তার মানে আপনি আমাকে ডাকপিয়নের কাজ করতে বলছেন? 

—হ্যাঁ, ঠিক তাই। আপনার কাজটা হবে সম্পূর্ণ বেসরকারী। 

—ঠিক আছে, আমার আপত্তি নেই। 

—আঃ! আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব পেডলার, ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমার দূত মারফত প্যাকেটটা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। জেনারেল স্মাস্টার্স-এর হাতে সেটা আপনি নিজে দিয়ে আসবেন, বুঝেছেন? ‘কিলমার্ডেন ক্যাসেল’ আগামী শনিবার জলে ভাসছে—জাহাজটা চমৎকার, সমুদ্র-যাত্রার পক্ষে অত্যন্ত আরামদায়ক। 

পরদিন সন্ধ্যায় আমার খানসামা জার্ভিস জানাল, একজন ভদ্রলোক তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তবে তার নাম বলতে অস্বীকার করে। বীমা সংস্থার দালালদের আমার ভীষণ ভয়, তাই জার্ভিসকে হুকুম করলাম, ওকে বলে দাও আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারব না। কী মুশকিল এই সময় প্যাগটও নেই। আমার প্রয়োজনীয় সময়ে ও ঠিক পেটের অসুখ বাধিয়ে বসে। 

ওদিকে জার্ভিস ফিরে এসে বলে, স্যার ইউস্টেস, বললেন, মিঃ মিলার-এর কাছ থেকে তিনি আসছেন। নিমেষে খবরটা আমার সব চিন্তাভাবনাকে ওলট-পালট করে দিল। কয়েকমিনিট পরে লাইব্রেরিতে আমার দর্শনপ্রার্থীর মুখোমুখি হলাম। বলিষ্ঠ চেহারার যুবক সে, রোদে পোড়া টানটান মুখ, চোখের কোণ থেকে চোয়াল পর্যন্ত একটা তির্যক দাগ। সুপুরুষ বলা যেতে পারে যুবকটিকে। 

—কী ব্যাপার? 

—মিঃ মিলার আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনার সেক্রেটারি হয়ে আপনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাব। 

আমি তাকে জানিয়ে দিলাম, শোনো বৎস, আমার একজন সেক্রেটারি আছে। অন্য সেক্রেটারী প্রয়োজন নেই। 

—জানি স্যার ইউস্টেস। আপনার সেই সেক্রেটারি এখন কোথায়? সে পেটের অসুখে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

—আপনি নিশ্চিত, তার পেটের অসুখ হয়েছে? 

—হ্যাঁ, নিশ্চিত বৈকি। প্রায়ই সে পেটের অসুখে ভুগে থাকে। একটু হেসে দর্শনপ্রার্থী বলে, পেটের অসুখও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সময়েই সব বোঝা যাবে। তবে আপনার সেক্রেটারিকে উধাও করে দেওয়ার চেষ্টা হলে মিঃ মিলার বিন্দুমাত্র অবাক হবেন না। ওহো, ভয়ের কিছু নেই। আপনাকে কোনো হুমকি দেওয়া হচ্ছে না। মিঃ মিলার চান আমি আপনার সাথী হই। জাহাজ ভাড়ার খরচ আমাদের। তবে আমার পাসপোর্টের ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, যাতে করে মনে হয় যে আমাকে আপনি দ্বিতীয় সেক্রেটারি নির্বাচিত করেছেন। 

ছেলেটি নাছোড়বান্দা। একসময় বলি, ঠিক আছে। তাই হবে। 

যাই হোক, ছোকরা সাথে থাকলে মন্দ হবে না। আমার মনে হল, আমি যেন একটু একটু করে গভীর জলে তলিয়ে যাচ্ছি। কথাটা ভাবামাত্র একটু যেন শাস্তি পেলাম। 

ছেলেটি উঠতেই আমি ভাবলাম। আমার নতুন সেক্রেটারির নাম জানতে চাওয়াটা বোধহয় অশোভন হবে না। 

একটু ভেবে বলল, হ্যারি রেবার্ন নামটা বেশ উপযুক্ত হবে। তার কথা বলার ধরনটা আমাকে বেশ অবাক করল। 

—ঠিক আছে, তাই হবে। 

।। নয়।। 

(অ্যানির বর্ণনা আবার শুরু) 

নায়িকা কিংবা মেয়ে গোয়েন্দার ক্ষেত্রে সমুদ্র-যাত্রায় বেরিয়ে সামুদ্রিক অসুস্থতায় কাবু হওয়াটা খুবই বেমানান। জাহাজের সব যাত্রী যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে সে তখন একা একা জাহাজের ডেকে ঘুরে বেড়ায়। সমুদ্রের ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের দৃশ্য উপভোগ করে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য কিলমার্ডেন জলে ভাসামাত্র অসুস্থ হয়ে পড়ি। জাহাজের একজন সহানুভূতিশীলা খাবার পরিবেশিকা আমার তত্ত্বাবধানের ভার নেয়। আমাকে সে পরামর্শ দেয় শুকনো টোস্ট ও আদার কুচি মুখে দেওয়ার জন্য। 

আমার কেবিনে তিনদিন অসুস্থ অবস্থায় থেকে কাজের কথা একেবারেই ভুলে যাই। সেই রহস্যের সমাধানে কোনো আগ্রহই তখন ছিল না। আমি তখন অন্য এক অ্যানি। অথচ জাহাজ কোম্পানির অফিস থেকে কী অদম্য আগ্রহ নিয়েই না সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলাম। সেখানে একা মিসেস ফ্লেমিং বসেছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তিনি বলেছিলেন, শোনো অ্যানি, তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে। 

—বেশ তো বলুন না! 

—মিস এমারি গভর্নেস, আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তুমি তো এখনও কোনো কাজের সন্ধান পেলে না, তাই বলছি কি, তুমি যদি ওর কাজের দায়িত্ব নাও, তাহলে সুন্দরভাবে বরাবরের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে। 

আমার মনে ধরল তাঁর প্রস্তাবটা। গোড়ার দিকে তিনি চাননি আমি ওঁদের বাড়িতে থাকি। হঠাৎ তাঁর পরিবর্তনে খুশি হয়ে ছুটে গিয়ে দু’হাত দিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে আবদারের ভঙ্গিমায় বলি, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজী। তবে আগামী শনিবার আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় যাচ্ছি। ফিরে এসে আমার কাজের ভার নেব। উনি আমার হাতে পাঁচটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রাখা একটা খাম দিলেন। 

আমি তাঁর দয়া দেখে মুগ্ধ হলাম। 

সেই পঁচিশ পাউন্ড হাতে নিয়ে আমার অভিযানে বেরিয়েছি। সেই খাদ্য পরিবেশিকা মেয়েটি চতুর্থ দিন আমাকে অনুরোধ করলে যেন উপরের ডেকে উঠে যাই। তার ধারণা নিচে থাকলে খুব শিগগীর আমার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু আমি যেতে অস্বীকার করলাম। 

তারপর চোখ বুজে ডেক চেয়ারে কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। এক সুদর্শন যুবকের ডাকে চোখ মেলে তাকালাম। 

—হ্যালো, আপনার জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। 

—তাই নাকি? 

—আরও দু-একদিন খুব খারাপ আবহাওয়া যাবে। তারপরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আমাকে নিরুত্তর দেখে বলল, ভাবছেন, আপনি বুঝি কোনোদিন আর সুস্থ হবেন না, তাই না? কিন্তু সমুদ্রপথে আপনার থেকে অনেক বেশি অসুস্থ লোককে দেখেছি, তারা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। 

সে যে মিথ্যুক, কেবল চোখের চাহনি দিয়ে আমার মনের কথাটা প্রকাশ করতেই সে চলে গেল। আমি তখন একা বসে বসে যাত্রীদের চলাফেরা লক্ষ্য করি। বেশির ভাগ যুবক-যুবতী, হাসি ঠাট্টায় মাতোয়ারা। আমার দিকে ফিরে তাকাবার অবসর তাদের নেই। 

বাতাসে তেমন শীতের তীক্ষ্ণতা নেই। মাথার ওপর সূর্য। চমৎকার আবহাওয়ায় মনটা বেশ খুশীই হল। যাত্রীদের মধ্যে একজন মহিলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বয়স তিরিশ ছুঁই-ছুই, বেশি লম্বা নয়, মাঝারি গড়ন, তবে সুন্দরী। গোলাকৃতি মুখ, সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার সুন্দর নীল চোখ, তার পোষাকে ফরাসিদের ছাপ, তার হাবভাবে মনে হয় যেন জাহাজটা তারই।

ডেকের স্টুয়ার্ডরা ঘনঘন তার ফরমাস খাটতে ব্যস্ত। তার ডেক চেয়ারটাও বিশেষ ধরনের। সেটা যে কোথায় রাখবে এ নিয়ে তিন তিনবার তার মত পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। তার চালচলনে পদমর্যাদা ও আভিজাত্যের ব্যাপারে সচেতন। মনে মনে ভাবলাম, যদি কোনোদিন আমি সুস্থ হয় উঠি, তার সঙ্গে আলাপ করলে আনন্দ পাব। 

আমরা দুপুর নাগাদ ম্যাডেই রায় পৌঁছলাম। তখনও আমার নড়বার ক্ষমতা হয়নি। তবু ডেক চেয়ারে বসে নতুন জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি। দু’চোখ ভরে দেখি ব্যবসায়ীদের আনাগোনার দৃশ্য। ফুলের ডালি সাজিয়ে অনেকে ডেকের ওপর বিক্রি করতে আসে। ফুল আমার খুব প্রিয়। দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত—আমার মনে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা জাগে। সেখানে একবার জীবিত অবস্থায় পৌঁছতে পারলেই আমি হয়তো বেঁচে যেতে পারি। জাহাজের খাদ্য পরিবেশিকা চিকেনের জুস দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে খেলেও আমি খুব তৃপ্তি পেলাম। 

আমার সেই আকর্ষণীয়া মহিলাটির সঙ্গে এক দীর্ঘদেহী মাথায় ঘন চুল, তামাটে মুখ, সৈনিকের মতো দেখতে একটি লোকের সঙ্গে উপকূল থেকে উঠে আসতে দেখলাম। আগের দিন লোকটিকে ডেকের ওপর ওঠানামা করতে দেখছিলাম। রোডেসীয় বলেই মনে হল। চল্লিশ বছর হলেও এই জাহাজের সবচেয়ে সুপুরুষ দেখতে সে। 

খাদ্য পরিবেশিকাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে, আরে উনি তো বহু পরিচিত সোসাইটি লেডি, মিসেস ক্লারেন্স ব্লেয়ার। ওর নাম কাগজে নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। 

আমি মাথা দুলিয়ে সমর্থন করলাম। আজকের দিনে মিসেস ব্লেয়ার একজন কেতা-দুরস্ত মহিলা। জাহাজের প্রতিটি যাত্রীর সঙ্গে হেসে তিনি গল্পগুজব করছিলেন। সেই পুরুষটিকে তিনি তাঁর একান্ত অনুগামী পুরুষ হিসেবে গ্রহণ করতে দেখলাম। 

পরদিন সকালে কয়েকবার ডেকের ওপর চক্কর দিয়ে হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার সামনে দাঁড়ালেন। 

—আজ সকালে কি একটু ভালো বোধ করছেন? 

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, সাধারণ মানুষের মতো আমি অনেকটা সুস্থবোধ করছি।

—আপনাকে গতকাল ভীষণ অসুস্থ দেখে কর্নেল রেস আর আমি তো ঠিক করে রেখেছিলাম এই সমুদ্রেই আপনার কবরের ব্যবস্থা করতে হবে বুঝি। কিন্তু আপনি আমাদের নিরাশ করে দিলেন। 

হেসে বললাম, এই উন্মুক্ত আলো-হাওয়াটা আমাকে সুস্থ করে তুলেছে। 

—হ্যাঁ, তা যা বলেছেন, নিচের ঐ বদ্ধ কেবিনের গুমোট আবহাওয়ায় যে-কোনো সুস্থ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। আমার পাশের চেয়ারে বসতে গিয়ে মিসেস ব্লেয়ার বললেন, আপনি নিশ্চয়ই বাইরের কেবিন পেয়েছেন? 

—না, তা ঠিক নয়। 

ইতিমধ্যে মিসেস ব্লেয়ার তাঁর অনুগামীদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন, এমনকি কর্নেল রেসকেও। তারপরে আমাকে বললেন, তাহলে আপনি আপনার ঘর বদলাচ্ছেন না কেন? ম্যাডেইরায় অনেক যাত্রী তো নেমে গেছে। প্রচুর ভালো ঘর খালি পড়ে আছে। জাহাজের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললেই তো পারেন। এ কাজের ভারপ্রাপ্ত ছেলেটি খুব ভালো। আমার অবস্থাও আপনার মতোই ছিল, তাকে বলতেই সে আমাকে একটা ভালো কেবিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মধ্যাহ্নভোজের সময় তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। 

—কিন্তু আমি যে নড়তে চড়তে পারি না। 

—কেন পারবেন না? উঠুন, আমার সঙ্গে একটু হাঁটুন সব ঠিক হয়ে যাবে। 

একটু অসুবিধা হলেও পরে মিসেস ব্লেয়ারের উৎসাহ পেয়ে আমার পা দুটো কেমন সহজ হয়ে গেল। ডেকের ওপর দু’বার চক্কর দেওয়ার পর কর্নেল রেস আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মুগ্ধ চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি বললেন, জাহাজের অন্যপ্রান্ত থেকে আপনি টেনেরিফের গ্র্যান্ড পিক দেখতে পারেন। 

—ফোটো তুলতে পারি? 

—না, ফোটো তোলা নিষেধ। 

—মিসেস ব্লেয়ার হেসে বললেন, তুমি বড় নিষ্ঠুর কর্নেল। 

আমরা কথা বলতে বলতে জাহাজের অপর প্রান্তে চলে এসেছিলাম। মিসেস ব্লেয়ার তাঁর ক্যামেরায় গ্র্যান্ড পিকের অনেকগুলি ছবি ধরে রাখলেন। একসময় ফিল্ম-রোল ফুরিয়ে যেতেই হতাশভাবে তিনি বললেন, এই যাঃ, ফিল্ম শেষ! পরমুহূর্তে তিনি তাঁর সোয়েটারের পকেট থেকে আর একটা ফিল্ম-রোল বের করলেন। তারপর ক্যামেরায় সেটা স্থানান্তরিত করার সময়ে হঠাৎ জাহাজের ঝাঁকুনিতে ফিল্ম রোলটা নিচের ডেকে ছিটকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস ব্লেয়ার চিৎকার করে উঠলেন—কী হবে এখন? 

তিনি বললেন, ওটা জাহাজের নিচের ডেকে গিয়ে পড়বে। তবে নিচে কোনো স্টুয়ার্ড থাকলে আর তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে সেটা ধরার চেষ্টা করতেও পারে। 

মধ্যাহ্নভোজের ঘণ্টা বেজে উঠতেই আমরা সবাই নিচে নেমে এলাম। 

আমার গতকালের বন্ধু মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে আমাকে জানাল, আজ সবাই ঘর বদল করছে। আমার জন্য একটা ভালো ঘরের ব্যবস্থা করে দেবে সে। 

আমরা আমাদের টেবিলে মাত্র চারজন বসেছিলাম। আমি এবং তিনজন বয়স্কা মহিলা, তারা আমাদের বেচারা কালো চামড়ার ভাইদের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিল। অন্য টেবিলগুলোর দিকে তাকালাম। 

মিসেস ব্লেয়ার ক্যাপ্টেনের দিকে বসেছিলেন। তারপরের টেবিলে কর্নেল রেস। ক্যাপ্টেনের পাশে বসেছিলেন ধূসর চুলের একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। কিন্তু একজনকে এর আগে এই জাহাজে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। লোকটার চেহারায় এমন একটা অদ্ভুত কিছু ছিল যা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। 

জাহাজের একজন নাবিকের কাছে জানতে চাইলাম, লোকটা কে? 

—ঐ লোকটা! ওহো, উনি তো স্যার ইউস্টেস পেডলারের সেক্রেটারি প্যাগট। বেচারা, সমুদ্রে এসে একদিন অসুস্থ ছিলেন। স্যার ইউস্টেসের দু’জন সেক্রেটারী। অপরজন এখনো আসেনি। 

স্যার উইস্টেস পেডলার? মিল হাউসের মালিক। তাহলে আমরা একই জাহাজের যাত্রী! আমার সংবাদদাতা আরো জানাল, আর উনি হলেন স্যার ইউস্টেস। ঐ যে ক্যাপ্টেনের পাশে বসে আছে। বুড়ো গর্দভ আর কি! 

সেক্রেটারিকে যতই দেখছি, আমার বিরূপ মনোভাব ততই বেড়ে যাচ্ছে। তার তীক্ষ্ণ লক্ষ্যভেদী চোখ। কৌতূহল জাগানো চওড়া মাথার আকৃতি। এসবই আমাকে তার প্রতি একটা বিজাতীয় ঘৃণার উদ্রেক করছিল 

একই সময়ে আমি তার পিছু পিছু সেলুন থেকে বেরিয়ে এলাম। সে তখন স্যার ইউস্টেসের সঙ্গে কথা বলছিল। মুহূর্তের জন্য তাদের কথায় আড়ালে কান পাতলাম— 

—অন্য একটা কেবিনের ব্যবস্থা এখুনি করা দরকার, চেষ্টা করে দেখব? আপনার কেবিনে কাজ করা অসম্ভব- 

স্যার ইউস্টেস বললেন, শোনো বৎস, আমার কেবিন নেওয়ার উদ্দেশ্য হল, ভালো করে ঘুমোন এবং পোষাক পরিবর্তন করার জন্য। তোমার ঐ টাইপরাইটারের খটখট শব্দ শোনার জন্য আমি ভাড়া নিইনি, বুঝলে! 

—হ্যাঁ, আমি তাই বলছিলাম স্যার ইউস্টেস, অন্য কোনো জায়গায় আমাদের কাজের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। 

আমি তাদের সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। আমার ঘর পাল্টানোর কাজ কতদূর কী হল দেখার জন্য। দেখলাম, আমার স্টুয়ার্ড সেই কাজে ব্যস্ত। 

খুব সুন্দর কেবিন মিস। ‘ডি’ ডেকে, তেরো নম্বর। 

—না, না, তেরো নম্বর আমার চাই না। তেরো নম্বরটা অশুভ, আমি সংস্কারমুক্ত নই কেবিনটা দেখলাম খুবই সুন্দর। কিন্তু ঐ যে সংখ্যাটা তেরো। প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে স্টুয়ার্ডকে বললাম, অন্য কেবিন নেই? 

—হ্যাঁ, আছে বৈকি। সতেরো নম্বর কেবিন আছে। আজ সকালেই খালি হয়েছে কিন্তু সেটা বোধহয় অন্য কারোর জন্য বরাদ্দ আছে। তবে পুরুষরা অত কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। মনে হয় তেরো নম্বর ঘরটা নিতে রাজী হবেন। 

কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে একটু পরে হাসতে হাসতে এসে বলল, ঠিক আছে মিস, চলুন আপনার জিনিষপত্র সতেরো নম্বর কেবিনে রাখার ব্যবস্থা করি। 

তেরো নম্বর কেবিনের মতো অতবড় না হলেও সতেরো নম্বর কেবিনটাও বেশ পছন্দসই। কিন্তু সেই সময়ে অশুভ মুখের একজন লোক দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। 

সে বলল, মাফ করবেন, এই কেবিনটা স্যার ইউস্টেসের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত। স্টুয়ার্ড বলল, কি আছে স্যার, এর পরিবর্তে তেরো নম্বর কেবিন তাঁর জন্য ঠিক করা হয়েছে।

—না, সতেরো নম্বর কেবিনই আমাদের চাই। এই কেবিনটা বিশেষ করে আমি নির্বাচিত করেছি। 

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি দুঃখিত, কিন্তু সতেরো নম্বর কেবিনও যে আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। 

—আমি তাতে রাজী নই। আমার সতেরো নম্বর কেবিন চাই-ই, চাই। 

একটা নতুন কণ্ঠস্বর কৈফিয়ত চায়, এসব কী হচ্ছে? স্টুয়ার্ড, আমার জিনিষপত্র এই ঘরে রাখুন। এ কেবিন আমার। 

মধ্যাহ্নভোজের সময় আগন্তুক আমার টেবিলের সাথী ছিলেন, তার নাম রেভারেন্ট এডওয়ার্ড চিকেস্টার। 

আমি বললাম, মাফ করবেন। এ কেবিন আমার। 

মিঃ প্যাগট বলল, না, এ কেবিন স্যার ইউস্টেস পেডলারের জন্য বরাদ্দ করা আছে।

সবাই তখন উত্তেজিত, কেউ কারোর কথা মানতে চাইছে না। 

—এই ঝামেলার জন্য আমি দুঃখিত, এডওয়ার্ডের মুখে কৃত্রিম ভদ্রতার হাসি ফুটে উঠল। এই হাসিটা বড় বিপজ্জনক। এ ধরনের হাসি সাধারণ লোকের চোখে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকে। 

ঘটনাস্থলে কেবিন-ইন-চার্জ উপস্থিত হতেই আমি তাঁকে বললাম, দেখুন, আপনি তো আমাকে এই সতেরো নম্বর কেবিনটা বরাদ্দ করেছেন। অথচ মিঃ প্যাগট এবং মিঃ এডওয়ার্ড দু’জনেই এর দাবিদার। এখন এই অদ্ভুত সমস্যার সমাধান আপনাকেই করে দিতে হবে। 

আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নাবিকরা সাধারণত মেয়েদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত তাঁর মধ্যস্থতায় সতেরো নম্বর কেবিন আমিই পেলাম। তাঁকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। 

স্টুয়ার্ডকে ক্লান্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার প্রতি আমার কেমন মায়া হল। বেচারা।

—মিস, আপনার নতুন কেবিনে একটা বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছি। আপনি বোধহয় রাত্রে এখানে ঘুমোতে পারবেন না। ‘সি’ আর-একটা কেবিন আছে, পরে সেখানে চলে যেতে পারবেন। একটা রাত্রি কোনোরকম বিশ্রী গন্ধটা সহ্য করে নিতে পারবেন। 

সত্যি ঘরে ঢোকামাত্র একটা বিশ্রী গন্ধে আমার বমি হওয়ার উপক্রম হল। মরা ইঁদুরের গন্ধ থেকেও খারাপ গন্ধ। ভালো করে ঘ্রাণ নিতে গিয়ে আমার মনে হল, গন্ধটা আমার খুব চেনা এরকম গন্ধটা যেন আগেও পেয়েছি। গন্ধটা হিং-এর। যুদ্ধের সময় হাসপাতালের ডিসপেন্সারিতে আমি কিছুদিন কাজ করেছিলাম। তাই এই গন্ধের সঙ্গে আমি পরিচিত। 

কিন্তু এখানে গন্ধটা এল কী করে? 

হাতমুখ ধুয়ে এসে সোফায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকি, মনে হয় কেউ বোধহয় একচিমটে হিং এই কেবিনে কোথাও ফেলে গিয়ে থাকবে। কিন্তু কেন? সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটা আমি পেয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য যাতে এই বিশ্রী গন্ধে অতিষ্ট হয়ে কেবিনটা খালি করে দিই। কিন্তু এই কেবিন থেকে আমাকে হটানোর উদ্দেশ্যেই বা কী থাকতে পারে? এই সতেরো নম্বর কেবিনটা পাবার জন্য সবাই এত লালায়িত কেন? অন্য দুটো কেবিনও তো দারুণ ভালো। 

কেবিন নম্বর সতেরো। বিচিত্র এই সংখ্যা। এই সতেরো তারিখেই সাউদাম্পটন থেকে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম। এই কেবিনের নম্বরও সতেরো। হঠাৎ মনে হতেই সেই চিরকুটটা দ্রুত সুটকেস থেকে বার করলাম। 

১৭.১.২২–প্রথমে আমি এই তারিখটা কিলমার্ডেন ক্যাসেল জাহাজের যাত্রার তারিখ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। এখন এই নতুন পরিস্থিতিতে নতুন করে সবকিছু ভাবতে হচ্ছে। ধরা যাক সতেরো সংখ্যাটা এই কেবিনের নম্বর, এবং এক সংখ্যাটা সময়ের নির্দেশ। একটা। তারপর বাইশ নিশ্চয়ই তারিখের নির্দেশ। সঙ্গে সঙ্গে ছোট টেবিল ক্যালেন্ডারের দিকে দেখলাম আগামীকাল বাইশ তারিখ।