২. বেল বাজার সঙ্গে

০২.

 ২৩ শে ডিসেম্বর।

বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেসিলিয়ান এগিয়ে গেল। সে এমনিতেই একটু শ্লথ; আবার বেল বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল সে, লোকটা যে কী তার ঠিক নেই ভদ্রলোকের বাড়িতে কীভাবে বেল বাজাতে হয় তাও জানে না। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার কাঁচে চোখ রেখে দেখল। তার অনুমানই ঠিক। লোকটার চেহারায় একটা কাঠখোট্টা ভাব। মুখে এতটুকু মিষ্টতা নেই। চেহারাটা তার বিশাল, মাথায় স্নাউট টুপি। দরজা খুলতেই সে আগন্তুককে দেখতে পেল। সামনাসামনি দেখলে তার পোষাকের মধ্যে একটা নোংরা ভাব একটা ঔদ্ধত্য ভাব দেখা যাবে।

আগন্তুক তাকে বলে–তুমি ট্রেসিলিয়ান না?

ট্রেসিলিয়ান এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে আগন্তুককে ভালোভাবে দেখল। হ্যাঁ সেই চোখ, সেই নাক, বহু বছর আগে সে মানুষটিকে দেখেছিল। তখন সে আরো বেশী ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-মিঃ হ্যারি।

হ্যারি হেসে বলল–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাকে দেখে তুমি শক পেয়েছ কেন তুমি কী আমার আসা পছন্দ করোনি?

-হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই স্যার।

–তাহলে তুমি আমাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলে কেন?

 দুতিন পা পিছিয়ে গিয়ে সে বাড়িটাকে ভালো করে দেখল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই পুরোনো কুৎসিত ম্যানসন।–আমার বাবা কেমন আছেন ট্রেসিলিয়ান?

-স্যার, তিনি অনেকটা পঙ্গুর মতো আছেন। তিনি তার নিজের ঘরেই থাকেন, বড়ো একটা বাইরে বেরোতে চান না। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও মনের দিক থেকে তিনি সতেজ।

হ্যারি ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন–পুরোনো পাপী, আমার ভাই অ্যালফ্রেড কেমন আছেন?

–তিনি এখন খুব ভালো আছেন।

 হ্যারি দাঁত বের করে হাসল-আশাকরি আমায় দেখার জন্য সে উঁচিয়ে আছে।

–বাউণ্ডুলেটা আবার ফিরে এসেছে। মনে রেখো ভালো মানুষটি সেজে বসে আছে। মনে রেখো এ সবকিছুই তার অপছন্দ। আমি হলফ করে বলতে পারি সে সুস্থ হয়ে থাকুক অ্যালফ্রেড তা চায় না। একটু থেমে সে বলে–আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেন এই পথে তিনি সেখানে যাবেনই।

সে মাথা নেড়ে ট্রেসিলিয়ানকে অনুসরণ করল ড্রইংরুমে যাবার জন্য। হ্যারি বলল–তুমি এখন তোমার কাজে যেতে পারো ট্রেসিলিয়ান। দেখি মিঃ এবং মিসেস অ্যালফ্রেডকে খুঁজে পাই নাকি?

হ্যারি ড্রইংরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ সে জানলার ধারে একটি মেয়েকে বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেল। মেয়েটির কালো চুল, সুন্দর মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে তার চোখ দুটো বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো।

সে বলে উঠলো-হায় ঈশ্বর। তুমি কী আমার বাবার সপ্তম এবং পরমাসুন্দরী স্ত্রী?

পিলার তার দিকে এগিয়ে এসে বলল–আমি পিলার এস্ট্রাভাডোস; তুমি নিশ্চয় আমার মায়ের ভাই, হ্যারি মামা।

হ্যারি মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল–ও, তাহলে তুমি জেনির মেয়ে।

–তাহলে কেন তুমি আমাকে তোমার বাবার সপ্তম স্ত্রী কী না জিজ্ঞাসা করলে?

হ্যারি হেসে বলল–আমার মনে হয় ওর সরকারী স্ত্রী একজনই। পিলার তোমাকে মৌসেলিয়ামে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি যেন একটা সুন্দর ফুলের কুঁড়ি।

-কি যেন একটা বললে মৌস?

-হ্যাঁ, ঠিক তাই। তুমি একটা মিউজিয়াম ছাড়া আর কী? এখানে যতসব বাজে জিনিষ ভর্তি।

পিলার অত্যন্ত আহত কণ্ঠে বলল–আমার তো তা মনে হয় না। আমার মনে হয় সব জিনিষগুলো সুন্দর, কার্পেটগুলো অতি উচ্চমানের আর ফার্নিচারগুলোও।

হ্যারি দাঁত বের করে বলল–তুমি ঠিককথাই বলেছ। পিলারের দিকে চেয়ে সে বলল তোমাকে এর মাঝে দেখে লাথি মেরে বের করে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারছি না।

লিডিয়াকে ছুটে আসতে দেখে হ্যারি চুপ করে গেল।

-হ্যারি তুমি কেমন আছো? আমি লিডিয়া, অ্যালফ্রেডের স্ত্রী।

 হ্যারি লিডিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল-লিডিয়া তুমি ভালো আছো তো?

লিডিয়াও তাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সে চিন্তা করে দেখল-রুক্ষ স্বভাবের মনে হল তাকে। যদিও সে শ্যামবর্ণীয়, তবু তাকে আমি অবিশ্বাস করব।

এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। যদি না তুমি তাকে দেখলে তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখতে পাবে কী না।

–আর সব ভায়েরা ইংল্যাণ্ড শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

–না তারা সকলে খ্রীস্টমাসের জন্য এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

হ্যারি স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মানে এটা একটা পারিবারিক মিলনের ব্যবস্থা। তা ঐ বুড়ো লোকটির সংবাদ কী? আগে তো তিনি মানুষের অনুভূতির মর্যাদা দেননি, এরকম ভাবে কারো জন্য তিনি মাথা ঘামাননি। এখন নিশ্চয়ই ওনার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

-লিডিয়া বলে–তাই তো মনে হয়।

পিলার চোখ দুটো বড় বড় করে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল।

জর্জের খবর কী? পকেট থেকে আধ পেনি বের করতে হলে এখানো কী আগের মতো হৈ চৈ করে?

লিডিয়া উত্তরে বলে–জর্জ এখন পার্লামেন্টের সদস্য–ওয়েস্টারিংহ্যামের।

–কি বললে? ঐ পাজীটা এখন পার্লামেন্টের সদস্য। ঈশ্বর ওকে ক্ষমা করুন। হ্যারি শব্দ করে হেসে উঠল।

একটা সময় তার হাসি থেমে গেল। আর কারো পদশব্দ শুনতে পায়নি সে।…

অ্যালফ্রেড কখন যে চুপ করে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি। সে শুধু শান্ত হয়ে হ্যারিকে দেখছিল।

হ্যারি মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পর এক-পা তার দিকে এগিয়ে গেল। তার ঠোঁটে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। সে বলল–কেন তুমি অ্যালফ্রেড নও?

অ্যালফ্রেড মাথা নেড়ে বলল–হ্যালো হ্যারি।

তারা একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। লিডিয়া জোরে নিঃশ্বাস নিল। কী অবাস্তব ঘটনা। দুটো কুকুরের মতো, তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।

পিলারের চোখ দুটো আরো বড় বড় হল। সে নিজের মনে চিন্তা করল, তারা ওরকম ভাবে একে অপরের দিকে চেয়ে না থেকে কেন দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরছে না? ইংরেজরা অবশ্য তা করে না। কিন্তু তারা তো বলতে পারে, তবে কেন কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে?

শেষকালে হ্যারিই মুখ খুলল,–অনেকদিন পর আবার বেশ আনন্দ পেলাম।

-আমারও তাই মনে হয়। বহু বছর তুমি বাইরে ছিলে।

হ্যারি এমন ভাবে চোয়ালে আঙুল ঠেকাল যে তাকে দেখে মনে হল সে যেন যুদ্ধের জন্য তৈরী। সে বলল–হ্যাঁ, আমি আমার বাড়িতে ফিরে এসে খুব খুশী।

সাইমন লী বলে ওঠেন–আমার খালি মনে হয় আমি খুব বাজে লোক ছিলাম। তিনি চেয়ারের উপর হেলান দিয়ে বসলেন। তার পাশে বসেছিলেন নাতনী পিলার।

মনে হয় তিনি মেয়েটি ছাড়া নিজের সাথে আরো কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু কী ভেবে আবার চুপ করে গেলেন।

তিনি বলেন–আচ্ছা, আমি যে খুব বাজে লোক ছিলাম, সে সম্বন্ধে তোমার মতামত কী পিলার?

পিলার কাঁধ নাচিয়ে বলল–সবমানুষই খারাপ। একথা নানেরা বলেন। তাই জন্য তাদের সবার জন্য আমার প্রার্থনা করা উচিত।

সাইমন হেসে বলেন–কিন্তু আমি যে সবার থেকে খারাপ কাজ করে এসেছি। তার জন্য আমার এতটুকু অনুশোচনা হয় না। একেবারেই তা হয় না। আমি প্রতিটা মিনিট নিজে উপভোগ করছি। সবাই বলে বয়স হলে তোমার অনুশোচনা হবে। ওসব শুধু আমাকে দেওয়া সান্ত্বনা। আমার অনুশোচনা হয় না। আমি অনেক ভালো ভালো পাপ করেছি। আমি চুরি করা, লোক ঠকানো, মিথ্যা বলা..কী না করেছি আমি।…হা ঈশ্বর। এছাড়া, সর্বদা মেয়েদের সঙ্গও আমার ভালো লাগত। একদিন একজন আমাকে একটা কথা বলেছিল। একজন আরব চীফের চল্লিশটা ছেলে ছিল তার দেহরক্ষী, সবকটাই প্রায় এক বয়সের। আহা! চল্লিশটার ব্যাপার যদিও আমি কিছু জানি না তবুও আমি হলফ করে বলতে পারি যদি আমি বাচ্চার কথা ভাবতাম তাহলে খুব সহজেই বেশ কিছু দেহরক্ষী জন্ম দিতে পারতাম। পিলার তুমি নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভাবছ? তুমি কী আঘাত পেলে?

-না, আমি কেন আঘাত পেতে যাবো, সব পুরুষরাই সবসময়েই মেয়েদের কামনা করে। আমার পিতাও সেই কারণে সেইরকমই ছিলেন। আর সেইজন্যই তাদের স্ত্রীরা কখনই সুখী হয় না। এবং তার জন্যই চার্চে গিয়ে প্রার্থনা জানায়।

বৃদ্ধ সাইমন ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে–আমি এডেলডাকে সুখী করিনি। তিনি নিজের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার মত বলল, হায় ঈশ্বর মেয়েছেলে জাতটা যেন কেমন। এডেলডাকে যখন আমি বিবাহ করি তখন সে হাসিখুশীতে ভরা ছিল। কিন্তু বিবাহের পর সে সম্পূর্ণ বদলে গেল। সর্বক্ষণ সে খালি কাদত। এখানেই এডেলডার দুর্বলতা সে যদি একবার আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। কিন্তু কোনোদিন একবারের জন্যও সে তা করেনি। আমার বিশ্বাস আমি তাকে বিয়ে করে স্থিতি হতেই চেয়েছিলাম। মনে আশা ছিল–একটা সুখী পরিবার গড়ে তুলব এবং আমার পুরোনো জীবন পরিত্যাগ করব।

তার কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে এল। তিনি তার বুকের আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন।

–ঈশ্বর যে সুখী পরিবার গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম সেটা কেমন পরিবার? বলে সে দুঃখের হাসি হেসে উঠল।

-আমার ছেলেদের দিকে তাকিয়ে দেখ তাদের একটাও মানুষ হয়নি। কেন? তারা কী ধমণীতে রক্তের স্বাদ পায়নি? তারা বৈধ না অবৈধ জানি না। যেমন প্রথমেই ধরা যাক অ্যালফ্রেডের কথা। অ্যালফ্রেডের সঙ্গ আমার কাছে একঘেঁয়ে এবং ভয়ঙ্কর লেগেছে। সে তার কুকুরের চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি তাকে যে কাজই বলি না কেন ও ঠিকই করে দেবে। হায় ঈশ্বর কী বোকা সে। ডেভিড অবশ্য সবসময়ই বোকা ছিল। স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো। ও আসলে ঠিক ওর মায়ের মতো ছিল। সে তার জীবনে একটাই ভালো কাজ করেছে। সুন্দরী একটি মেয়েকে বিবাহ করেছে। তিনি চোয়াল থেকে হাতটা নামিয়ে চেয়ারের উপর রাখলেন। হ্যারি অবশ্য এদের থেকে আলাদা এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে। সে যে এখন জীবিত আছে সেটা খুবই আনন্দের।

পিলার তার কথায় সায় দিল।

-হা সে খুব সুন্দর ছেলে, মন খুলে সে হাসতে পারে। আমি তাকে খুব ভালোবাসি।

বয়স্ক লোকটি পিলারের দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যারিই আমার উপযুক্ত ছেলে। তার মেয়েদের সঙ্গে একটা গোপন সম্পর্ক ছিল। আমার জীবনটাও খুব ভালো ছিল। সবকিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল।

পিলার বলে উঠল–আমাদের স্পেনে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেটা এইরকম–ঈশ্বর বলেছেন তোমার যা পছন্দ নিয়ে নাও তার দাম দিয়ে দাও।

–এটাই ভালো। তোমার যা পছন্দ নিয়ে নাও..আমি তাই করেছি। আমার সারা জীবন যখন যা মনে হয়েছে…

–হঠাৎ পিলার গম্ভীর গলায় বলে উঠল–তার দাম দিয়েছিলেন?

 সাইমনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল–এ তুমি কী প্রশ্ন করছ?

-ঠাকুরদা আমি প্রশ্ন করছি–আপনি তার দাম দিয়েছিলেন?

 তিনি আস্তে আস্তে বললেন–আমি জানি না। তিনি তার মুঠো করা হাতটা চেয়ারে ঠুকে বললেন-তুমি একথা কেন বলতে গেলে নাতনী?

পিলার উত্তরে বলল–আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

 সাইমন বললেন-তুমি একটি শয়তানের বাচ্চা।

পিলার ঠাণ্ডা গলায় বলল–আপনিই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

-হ্যাঁ, তুমি আমার কন্যা জেনিয়ার মেয়ে। তোমার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে। আর তাছাড়া, অনেকদিন তোমার মতো সুন্দরী যুবতী দেখিনি তাই।

পিলার মুচকি মুচকি হাসছিল।

সাইমন বলে উঠলেন–কিন্তু মনে রেখো তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। আমি জানি তুমি কেন এতক্ষণ ধরে ধৈর্য ধরে আমার পাশে বসেছিলে–শুধু আমার টাকার লোভে। অথবা তুমি তোমার ঠাকুর্দাকে ভালোবাসার ভান করো।

না, আমি আপনাকে ভালোবাসিনা আপনাকে অপছন্দ করি। এটা সত্য এবং আপনার বিশ্বাস করা উচিত। আমি ভালো করেই জানি আপনি তোক ভালো নন। আমি সেটা পছন্দ করি আর এটাও ঠিক আপনি বাড়ির অন্য সব লোকেদের চেয়ে খাঁটি। এছাড়া, আমার যেটা সবচেয়ে পছন্দ যে, আপনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। যাকে বলে অ্যাডভেঞ্চারস লাইফ।

–জানো পিলার, আমাদের মধ্যে জিপসির রক্ত আছে যাকে বলে ভবঘুরে বা যাযাবর। তবে হ্যারি ছাড়া আর কারো ওপর এ প্রভাব পড়তে দেখিনি। দরকার হলে আমি ধৈর্য ধরতে পারি। আমার যে ক্ষতি করেছে তাকে ধরার জন্য পনেরো বছর অপেক্ষা করে আছি। এটাই লী বংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমি পনেরো বছর পরে সুযোগ পেয়েছি তাকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তিনি খুব হাল্কা ভাবে হাসলেন।

পিলার প্রশ্ন করল–ঘটনাটা নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটেছিল?

হ্যাঁ, খুব ভালো দেশ। বিয়ের পাঁচ বছর পর আমি সেখানে ফিরে গিয়েছিলাম।

-কিন্তু বিয়ের বহুবছর আগেও আপনি ওখানে থাকতেন।

–হ্যাঁ।

–আমাকে সেই সম্বন্ধে কিছু বলুন।

 তিনি কাহিনীটা বলতে শুরু করলেন। পিলার অবাক হয়ে কাহিনীটা শুনতে লাগল। তারপর তিনি একটা বড় আলমারীর কাছে এগিয়ে গেলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। আলমারীর পাল্লাটা খুলে হরিণের চামড়ার ব্যাগটা খুলে পিলারের করুণ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন–এগুলো কী জান? অখচিত সব হীরের টুকরো। এখন এগুলো এ অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলো কাটার পর আসল হীরে বেরিয়ে পড়বে। তখনি সেগুলো চমকে দেবে, ঝলসে উঠবে।

পিলার বাচ্চা মেয়ের মতো অবাক হয়ে বলল-ও আমি অবিশ্বাস করি।

 তিনি খুব মজা পেলেন, বললেন,-এ একেবারে খাঁটি হীরে।

—খুব দামী?

কয়েক হাজার পাউণ্ড হবে। এগুলো বড় বড় হীরে। নয় কিংবা দশ হাজার ধরতে পারো।

–এগুলো বিক্রি করছেন না কেন?

–আমার টাকার প্রয়োজন নেই তাই। আমি এগুলোকে আমার কাছেই রেখে দিতে ভালোবাসি।

তিনি আবার ঐগুলোকে আলমারীতে রেখে দিলেন এবং হারবারিকে ডাকলেন–এসো।

হারবারি ভেতরে এসে বলে–চা তৈরী।

হিলডা বলে উঠল–তাহলে সত্যিই তুমি এখানে এলে ডেভিড। আমি তোমায় কত খুঁজেছি। ঘরটা ভীষণ ঠাণ্ডা। চল এখান থেকে চলে যাই।

ডেভিড তার কথায় কান না দিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল–এই সেই চেয়ার, যেখানে আমাদের মা সবসময় বসে থাকতেন। এটা তেমনি তাই আছে; শুধু রঙটা একটু চটে গেছে। ডেভিড বলে চলল–তিনি সবসময় এখানে বসে থাকতেন আর আমাদের বই পড়ে শোনাতেন। আমি তখন বছর ছয়েকের শিশু ছিলাম।

হিলডা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল–চলো, ড্রইংরুমের দিকে যাওয়া যাক। এখন ওরা কোথায় আছে, চায়ের সময় হয়ে গেছে।

ডেভিড বহুদিন পর পিয়ানোটার ওপর হাত রাখল, তার খুব সখ ছিল পিয়ানো বাজানোর। কিছুক্ষণ বাজাবার পর হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। সে খুব কাঁপছিল। হিলডা দৌড়ে তার কাছে গেল।

–কী হয়েছে ডেভিড?

–না না, তেমন কিছু নয়। ডেভিড উত্তরে বলল।

কর্কশভাবে বেলটা বেজে উঠল দরজার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই ট্রেসিলিয়ানের স্ত্র জোড়া কুঁচকে উঠল বাইরে দাঁড়ানো আগন্তুককে দেখে। সে কপালে হাত দিয়ে চিন্তা করল। মনে হয় সবকিছুই যেন দ্বিতীয়বার ঘটে। এর আগে আরো একবার এরকম ঘটনা ঘটে থাকবে। সে নিশ্চিত মনে করে দরজা খুলে দিল।

তারপরই দরজার ওপারে থাকা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন–এটা কী মিঃ সাইমন লীর বাড়ি?

-হা মহাশয়।

–ওনার সঙ্গে আমি একটু সাক্ষাৎ করতে চাই।

ঠিক তক্ষুনি ট্রেসিলিয়ানের মনের স্মৃতিতে একটা অস্পষ্ট স্মৃতি ভেসে উঠল। বহুদিন ধরে সে এই গলার স্বর শুনে এসেছে। মিঃ লী তখন ইংল্যাণ্ডে থাকতেন।

ট্রেসিলিয়ান দ্বিধা চিত্তে মাথা নেড়ে বলল–কিন্তু স্যার মিঃ লী যে এখন অথর্ব। তিনি এখন খুব একটা লোকের সংগে দেখা-সাক্ষাৎ করেন না। আপনি যদি আপনার দরকারটা

তাকে বাধা দিয়ে আগন্তুক বলল–ঠিক আছে আপনি শুধু মিঃ লীকে এটা দিয়ে আসুন। বলে পকেট থেকে একটা খাম বের করে তার হাতে দিল।

–ঠিক আছে।

কাগজটা খামের ভেতর থেকে পড়তে গিয়ে সাইমন লী অবাক হয়ে গেলেন। তার স্ত্র জোড়া কুঁচকে উঠল ঠিকই তবুও তিনি হেসে উঠলেন। বললেন–সবদিক দিয়েই তাহলে ভালোই হল।

এই মূহুর্তে আমি এবেনেজাপকারের কথাই ভাবছিলাম। সে আমার পার্টনার ছিল কিম্বারলীতে। তার ছেলে এসেছে এখন।

স্টিফেন ফারকে খুব নার্ভাস লাগছিল। ওর কথা বলার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার একটা টান লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।

–তুমিই তাহলে এদের ছেলে। তোমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। বুড়ো পিলারের দিকে তাকিয়ে বলল–আমার নাতনী, পিলার এস্ট্রাভাডোস।

পিলার গম্ভীর স্বরে বলল–কেমন আছ তুমি?

ফার মেয়েটির আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। মিস এস্ট্রাভাডোস, তোমার পরিচয় জানতে পেরে আমি খুব খুশী হলাম।

পিলার ধন্যবাদ জানাল।

সাইমন কী বলল–বস স্টিফেন, বড় দিনের সময় তোমার কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। অবশ্য যদি তোমার অন্য কোনো প্ল্যান না থাকে।

না না, আমার তেমন কিছু নেই এবং আমার পছন্দও নয়।

বুড়ো পিলারের দিকে তাকিয়ে বলল–সব ঠিক হয়ে যাবে, লিডিয়া বল আমাদের একজন অতিথি এসেছে।

পিলার চলে যেতেই সাইমন লী তার কাছ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটার খবর নিতে থাকে।

 কিছুক্ষণ পর লিডিয়া ঢুকতেই সাইমন লী ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল–এ আমার এক বন্ধুর ছেলে। আমাদের সঙ্গে বড়দিনের উৎসব উপভোগ করতে চায়। তার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করো।

আগন্তুককে ভালো করে দেখে নিয়ে লিডিয়া বলে–অবশ্যই।

 সাইমন বলে–এটি আমার পুত্রবধূ।

–এইরকম পারিবারিক উৎসবে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে।

সাইমন বলল–কেন বাছা, তুমি তোমাকে আমাদের পরিবারের একজন ভাবার চেষ্টা করো।