ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৩.১
পোয়ারো বললেন, কোনো এক সকালে সৈকতে আমরা বসে আলোচনা করছিলাম কসাইয়ের দোকানে সাজানো মাংসের মতো পড়ে থাকা সূর্যস্নান শরীরগুলো নিয়ে। তখনই আমার মনে হয়েছে, দুটো ভিন্ন শরীরের মধ্যে কী সামান্যই না পার্থক্য যদি সতর্ক দৃষ্টিতে দেখা যায়। একজন মোটামুটি স্বাস্থ্যের তরুণীর সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো তরুণীর মিল প্রচুর। দুটো তামাটে পা। তামাটে বাহু, দুয়ের মাঝে এক টুকরো সাঁতার পোশাক–সূর্য কিরণে শুয়ে থাকা শুধুই একটা দেহ, যখন কোনো মহিলা চলাফেরা করেন,হাসেন, কথা বলেন-তখন একটা ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে-চোখে পড়ে স্বতন্ত্র। কিন্তু সূর্যসাধনার সময়–না।
সেইদিনই আমরা অশুভ শক্তির প্রভাব নিয়ে মিঃ লেনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তিনি অত্যন্ত সচেতন মানুষ–অশুভের প্রভাব তিনি অনুভব করেন। তাঁর মতে অশুভ শক্তি লুকিয়ে ছিলো আর্লেনার ব্যক্তিতে।
কিন্তু অশুভ শক্তি উপস্থিত থাকলেও সে আর্লেনা মার্শালের মধ্যে আদৌ কেন্দ্রীভূত ছিলো মা। যেহেতু উনি সুন্দরী ও চটক ছিলো চেহারায়, পুরুষরা যেহেতু ওর দিকে চোখ ফেরাতে, যেহেতু তার মতো মহিলারাই ঘর ও জীবন নষ্ট করেন। কিন্তু সে সর্বনাশা আকর্ষণে কখনোও পুরুষদের টানতো না–বরং পুরুষরাই তাকে টানতো। তার সম্পর্কে প্রথমে যে কথাটি শোনা যায় তা হলো, কিভাবে সেই লোকটি, যার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় উনি জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে। আর ঠিক তখন উপস্থিত হয় আমাদের কাপ্টেন মার্শাল। যার বিপদাপন্ন রমণী সেবার ব্রত চিকিৎসার অযোগ্য, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব জানালেন। ক্যাপ্টেন মার্শালের মতো লাজুক নিঃশব্দ মানুষের প্রকাশ্য বিচার ছিলো এক চরম যন্ত্রণা–সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই প্রথম স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা এবং করুণা, যাকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো খুনের অপরাধে, যে খুন তিনি করেননি। তার মৃত্যুর পর আর একজন সুন্দরী মহিলা। হয়তো একই ধরনের অভিযুক্ত হলেন প্রকাশ্য কলঙ্কে। আবার মার্শাল তার প্রাণকার্য সম্পন্ন করলেন। আলেনা নির্বোধ। তার করুণা ও প্রতিরক্ষার অযোগ্য এবং হৃদয়হীনা, তা সত্ত্বেও স্ত্রীর মোটামুটি ছবিটা তার অজানা ছিলো না। স্ত্রীর সঙ্গে ভালোবাসা শেষ হয় কিন্তু তারপরে আর্লেনার প্রতি একটা দুঃখবোধ তার ছিলো। তার কাছে আর্লেনা ছিলো একটা শিশুর মতো, যিনি জীবন কেতাবের একটা বিশেষ পৃষ্ঠা কোনোরকমেই অতিক্রম করতে পারছিলেন না।
এক বিবেকহীন পুরুষের অনিবার্য শিকার হিসেবে আর্লেনাকে আমি দেখেছিলাম। আর সেই পুরুষকে আমি খোঁজ করে পেয়েছিলাম প্যাট্রিক রেডফার্নের মধ্যে। এ ধরনের ফটকাবাজ পুরুষেরা যেভাবেই হোক মহিলাদের মূলধন করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। অশুভের কেন্দ্রবিন্দুতে আমি প্যাট্রিককেই দেখেছি, আর্লেনাকে নয়।
আর্লেনার জনৈক বয়স্ক প্রেমাস্পদ, যিনি তার বিশাল অঙ্কের অর্থ আর্লেনার জন্য রেখে গেছেন। সাধারণতঃ অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো পুরুষের হাতে অনিবার্যভাবে প্রতারিত হয়ে থাকেন ও ধরনের মহিলারা। মিস ব্রুস্টার একজন যুবকের কথা বলছেন। সে আর্লেনার জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তার যে চিঠিটা মিসেস মার্শালের ঘরে পেয়েছি, সে আর্লেনাকে হীরে জহরত দিয়ে সাজাতে চাইলেও, প্রকৃতপক্ষে তার কাছ থেকে পাওয়া একটা চেকের প্রাপ্তিসংবাদ জানিয়েছে। যার সাহায্যে সে আদালত এড়াতে পারবে বলে আশা করে। সুতরাং তার কাছ থেকে ব্যবসায়িক লগ্নীর নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করাটা রেডফানের কাছে নিতান্তই ছেলেখেলা ছিলো। লম্বা গল্প ফেঁদে আর্লেনাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন–বলেছিলেন কিভাবে তিনি তার স্ত্রীর বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে কি কাণ্ডটা হচ্ছে, তাহলে প্যাট্রিকের অর্ধচন্দ্র প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিলো প্রবল।
রেডফার্ন ঠাণ্ডা মেজাজে স্থির করেছিলেন প্রয়োজন বুঝলেই আর্লেনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন–অতীতের একটা খুনের সাফল্য তাকে আরও বেশি সাহসী করে তুলেছিলো–যে মেয়েটিকে তিনি খুন করেছিলেন, তাকে তিনি করিগান নাম নিয়ে বিয়ে করে এক বিশাল অঙ্কের জীবনবীমা করাতে মেয়েটিকে রাজি করান।
তার পরিকল্পনায় সবরকম সাহায্য করেছেন যিনি এখানে রেডফানের স্ত্রীর পরিচয়ে আছেন এবং যার সঙ্গে রেডফার্নের সত্যিকারের সম্পর্ক রয়েছে যার অবিশ্বাস্য অভিনয় ক্ষমতাকে অবহেলা করা যায় না। ক্রিস্টিন রেডফার্ন একটা বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন। হতভাগিনী বেচারা স্ত্রীর ভূমিকায় দুর্বল হলেও বুদ্ধিমতী। সূর্যানে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে, যে কারণে তার গায়ের রঙ সাদা ফ্যাকাসে, উঁচু জায়গায় উঠলে তার মাথা ঘোরে, সব মিলিয়ে নিজের দুর্বল ভাবটাকে ফুটিয়ে তোলা–অথচ তিনি আর্লেনা মার্শালের সমান লম্বা। ক্রিস্টিন বলেছেন, তিনি স্কুলের দিদিমণি ছিলেন কিন্তু সেখানে তার চাকরি ছিলো খেলার দিদিমণি। নিজের হাতঘড়ি লুকিয়ে রেখে এগারোটা পঁচিশে লিন্ডাকে জিজ্ঞেস করলেন কটা বাজে। লিন্ডা পৌনে বারোটা বলে সমুদ্রে স্নান করতে নামে আর ক্রিস্টিন ছবি আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে লিন্ডার হাতঘড়িটা তুলে নেন। কাটা ঘুরিয়ে সময়টা আবার ঠিক করে দেন। তারপর পাহাড়ি পথ ধরে সরু জমিটুকু একছুটে পার হয়ে মইটার কাছে পৌঁছে যান। ঢোলা জামা পাজামা ছেড়ে। সেগুলো এবং ছবি আঁকার সরঞ্জাম একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে তরতর করে মই বেয়ে নেমে যান।
তখন আর্লেনা সৈকতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন প্যাট্রিকের এত দেরি হচ্ছে কেন। হঠাৎ মইয়ের সামনে প্যাট্রিকের স্ত্রীরত্নটিকে দেখে তাড়াতাড়ি সৈকত পার হয়ে পিক্সি গুহায় ঢুকে পড়ে।
ক্রিস্টিন লুকানো জায়গা থেকে টুপিটা বের করে। টুপিটার পেছনের কানায় লাল রঙের পরচুলার গুচ্ছ আলপিন দিয়ে আঁটা ছিলো। তারপর টুপি ও পরচুলায় ঘাড় ও মুখ ঢেকে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। সময়ের হিসেব একেবারে নিখুঁত। কারণ মিনিট দুয়েক পরেই প্যাট্রিক ও এমিলি ব্রুস্টার নৌকো নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। মনে রাখবেন যে ব্যক্তি নিচু হয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করেছেন তিনি প্যাট্রিক। প্যাট্রিকই আঘাত পেয়েছেন–ভেঙে পড়েছেন তার প্রেমিকার মৃত্যুতে। তিনি জানেন মিস ব্রুস্টারের মাথা ঘোরে, তিনি কখনোই মইটা বেয়ে উপরে উঠবেন না। তিনি গেলে নৌকো নিয়েই যাবেন আর প্যাট্রিক থাকবেন মৃতদেহের কাছে কারণ খুনী হয়তো আশেপাশে কোথাও। লুকিয়ে আছে। মিস ব্রুস্টার চলে যেতে ক্রিস্টিন উঠে পড়লেন। প্যাট্রিকের লুকিয়ে আনা কাচিটা দিয়ে টুপিটাকে টুকরো করে ফেললেন আর টুকরোগুলো সাঁতার পোশাকের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন এবং ছুটে গিয়ে মই বেয়ে উঠে ঢিলে জামা পাজামা পরে হোটেলের দিকে ছুটে চললেন। কোনোরকমে স্নান সেরে নকল সূর্যস্নানের প্রলেপ ধুয়ে। টেনিস খেলার পোশাক পরে বেরোবার মতো সময়টুকু হাতে রয়েছে। আরও একটা কাজ উনি করেছেন। পিচবোর্ডের টুপির টুকরোগুলো এবং লাল পরচুলার গুচ্ছ উনি লিন্ডার ঘরের তাপচুল্লীতে পুড়িয়ে ফেলেন–সঙ্গে একটা ক্যালেন্ডারের পাতা যাতে পোড়া পিচবোর্ডর সঙ্গে ক্যালেন্ডারের একটা যোগসূত্র রয়েছে। যা পোড়ানো হয়েছে সেটা ক্যালেন্ডার, টুপি নয়। তার সন্দেহানুযায়ী লিন্ডা যাদুবিদ্যা নিয়ে পরীক্ষা করছে–মোমের পিণ্ড ও আলপিন তারই সাক্ষী।
তারপর তিনি টেনিস কোর্টে উপস্থিত হলেন। আর ইতিমধ্যে প্যাট্রিক পিক্সি গুহায় ঢুকলেন। আর্লেনা কিছুই দেখেননি খুব সামান্য শুনতে পেয়েছেন। এখন তাকে প্যাট্রিক ডাকছেন।
আর ভয় নেই সোনা আর্লেনা, বাইরে বেরিলয়ে এলে প্যাট্রিকের হাত চেপে বসল তার গলায় –সেই হলো বেচারা নির্বোধ সুন্দরী আর্লেনা মার্শালের জীবনকাহিনীর পরিসমাপ্তি…
ডার্নলি শিউরে ওঠে, আপনি সবকিছু ছবির মতো দেখিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু আপনি এখনও বলেননি কি করে আপনি আসল সত্যিটা জানতে পারলেন?
সেই প্রথম থেকেই আমার মনে হয়েছে যে সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যক্তিই আর্লেনা মার্শালকে খুন করেছেন এবং সম্ভবতঃ প্যাট্রিক রেডফার্ন, তিনি সেই ধরনের লোক যারা কোনো মহিলার সত্ত্বা শুনে নিয়ে তার গলা কাটতে পারেন। সেদিন সকালে আর্লেনা কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার হাসি মুখই জানিয়ে দিয়েছে সে প্যাট্রিক। সুতরাং আর্লেনাকে প্যাট্রিক খুন করেছেন।
কিন্তু প্যাট্রিক রেডফার্নের পক্ষে আর্লেনাকে খুন করা সম্ভব ছিলো না কারণ মৃতদেহ আবিষ্কার করা পর্যন্ত তিনি মিস ব্রুস্টারের সঙ্গে ছিলেন। তাই আমাকে অন্যদিকে নজর দিতে হলো। তাদের সংখ্যা একাধিক। একবার মনে হয়েছিলো লিন্ডাকে কিন্তু পরে ওর সঙ্গে এক আলোচনায় একটা বিষয়ে আমার বিশ্বাস স্থির হয় যে লিন্ডা নিজেকে অপরাধী মনে করে। ও নেহাতই সিক্ত। ডাকিনীবিদ্যার বইটা পড়ে ও সেটা প্রায় বিশ্বাস করে বসে। ও আর্লেনাকে ঘৃণা করতো। সুতরাং মোমের পুতুল তৈরি করে তার হৃদপিণ্ড আলপিনবিদ্ধ করে। পুতুলটা গলিয়ে ফেললো–সেই দিনই আর্লেনা মারা গেলেন। স্বাভাবিকভাবে লিন্ডা বিশ্বাস করেছে যে যাদুবিদ্যার ক্ষমতায় ওর সম্মাকে ও খুন করেছে।
রোজামন্ড ডুকরে উঠলো, ও বেচারা লিন্ডা! আর আমি ভেবেছি–ও এমন কিছু জানতো যাতে
পোয়ারো বললেন, আপনি কি ভেবেছিলেনে আমি জানি। আপনার ব্যবহার লিন্ডাকে আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। ক্রিস্টিনও ওর কানে মন্ত্র যোগান। ওর মনে গেঁথে দেন ঘুমের বড়ির কথা, দেখিয়ে দেন ওর অপরাধের দ্রুত যন্ত্রণাহীন প্রায়শ্চিত্তের পথ। একবার যদি প্রমাণিত হয় ক্যাপ্টেন মার্শালের অ্যালিবাই রয়েছে তাহলেই নতুন কোনো সন্দেহ হবে। ক্রিস্টিন অথবা তার স্বামী মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ব্যাপারটা জানতেন না। সুতরাং বলির পাঁঠা হিসেবে লিন্ডাকেই বেছে নিলেন।
রোজামন্ড বললো, কি শয়তান!
পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমি পড়লাম মহা মুস্কিলে। আমি চেষ্টা করেছি ওর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে কিন্তু সবই বিফলে গেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি আবার সন্তর্পণে খতিয়ে দেখতে লাগলাম সব। প্রথমেই রয়েছে বেলাভূমিতে পাওয়া একটা কাচি–জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা একটা শিশি–একটা স্নানের খবর যা কেউ স্বীকার করেননি–সেগুলির তাৎপর্য একটা রয়েছে। ক্যাপ্টেন মার্শাল, লিন্ডা অথবা চোরাচালানকারীদের দায়ী করলে ঐ ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। সুতরাং আমি ফিরে গেলাম আমার প্রথম সমাধানে–যে প্যাট্রিকই খুনটা করেছেন। আর্লেনার তহবিল থেকে যে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা উধাও হয়েছে আমরা জানি। আর্ণেনা ছিলেন সেইরকম মেয়ে যাদের সুন্দর চেহারায় যুবকেরা সহজেই ঠকিয়ে নিতে পারে কিন্তু সে ব্ল্যাকমেল হবার মতো মেয়ে নয়। প্রয়োেজনের বেশি খোলা মন ছিল তার, গোপন কথা উনি গোপন রাখতে পারতেন না। কিন্তু হঠাৎ শুনে ফেলা ব্ল্যাকমেলের গল্পটা শুনেছেন প্যাট্রিক রেডফানের স্ত্রী। এটা সম্পূর্ণ তার গল্প–দ্বিতীয় কোনো সাক্ষ্য নেই। এর উত্তর বিদ্যুতের মতো আমার মনে ঝলসে উঠলো।
প্যাট্রিক ও ক্রিস্টিন রেডফার্ন দুজনেই এর সঙ্গে জড়িত। আর্লেনাকে গলা টিপে খুন করার মতো দৈহিক শক্তি ক্রিস্টিনের ছিলো না; তাহলে নায়ক প্যাট্রিক নিজে–
দেহ–এই দেহ শব্দটা আমার মনে নাড়া দিল–সৈকতে শুয়ে থাকা সব দেহই একইরকম। প্যাট্রিক ও ব্রুস্টার পিক্সি কোভে গিয়ে একটা দেহ বেলাভূমিতে শুয়ে থাকতে দেখেছেন। যদি
কিন্তু একটা মৃতদেহই আমরা পেয়েছি–তাহলে সেই দেহ ছিল জীবন্ত–যিনি মৃতের ভান করে শুয়ে আছেন। তাহলে কার জীবন্ত দেহ–তার স্ত্রীই রেডফার্নকে সাহায্য করতে পারেন। তার গায়ের রঙ সাদা হলেও সূর্যস্নানের নকল প্রলেপ লাগানো যেতে পারে-শিশি–একটা শিশি আমার টুকরো ছবির ধাঁধার একটা টুকরো। তারপর প্রয়োজন একটা স্নানের–টেনিস খেলতে যাবার আগে সর্বনাশা প্রলেপের দাগ ধুয়ে ফেলতে হবে। আর তাড়াহুড়োতে কঁচিটা থেকে যায় অকুস্থলে-এই একটা জিনিষ যেটা আমাদের খুনী দম্পতি ভুল করে রেখে আসেন।
কিন্তু আর্লেনা এতক্ষণ কোথায় ছিলো? পিক্সির গুহায় সুগন্ধী আমাকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পিক্সির গুহায় আর্লেনা লুকিয়ে ছিলেন যতক্ষণ না পথ পরিষ্কার হয়।
যখন ব্রুস্টার নৌকা নিয়ে চলে গেলেন তখন সৈকতে একা খুন করার পুরোপুরি সুযোগ। আর্লেনা খুন হয় পৌনে বারোটার কিছু পরে। কিন্তু পৌনে বারোটায় আর্লেনা মৃত ছিলেন, ডাক্তারী সাক্ষ্য সময়টা নিয়ে তাই মাথা ঘামায়।
আর দুটো রহস্য সমাধানের তখনও বাকি। লিন্ডার সাক্ষ্য ক্রিস্টিনকে অ্যালিবাই জুগিয়েছে। সে সাক্ষ্য লিন্ডার হাতঘড়ি। কিন্তু এখন প্রমাণ করা যে ওই হাতঘড়ির সময়ের বদল করার সুযোগ ক্রিস্টিন দুটো পেয়েছিলেন। সকালে যখন লিন্ডার ঘরে একা ছিলেন–এছাড়াও একটা পরোক্ষ প্রমাণ ছিলো। লিন্ডাকে বলতে শোনা গেছে যে ওর ভয় হচ্ছিলো হয়তো দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্রামকক্ষের ঘড়িতে তখন মাত্র দশটা পঁচিশ। দ্বিতীয় সুযোগ–লিন্ডা যখন পিছন ফিরে সমুদ্রে স্নান করতে নামে তখন ঘড়ির সময়টা আবার পিছিয়ে দেয় ক্রিস্টিন।
এরপর মইয়ের প্রশ্ন, ক্রিস্টিন বরাবরই বলেছেন যে, উঁচু জায়গা তার ধাতে সয় না। এটা সাজানো মিথ্যে।
প্রতিটি টুকরো এবার নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে গেছে নিজের নিজের জায়গায়। কিন্তু আমার হাতে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।
তখনই আমার মাথায় এলো এই খুনের মধ্যে নিহিত রয়েছে একটা আত্মবিশ্বাসের ভাব –একটা পরিপাটি ছিমছাপ পরিকল্পনা। প্যাট্রিক যে ভবিষ্যতে তার দুষ্কর্মের পুনরাবৃত্তি করবেন তার কোনো সন্দেহ নেই। এই খুনের পদ্ধতি, শাসরোধ করে হত্যা করা। শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, নিছক আনন্দের জন্যও তিনি খুন করেন। যদি এটা তার প্রথম খুন না হয় তাহলে অতীতেও তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। আমি কলগেটের কাছে শ্বাসরোধ করে খুন হয়েছে এমন মেয়েদের একটা তালিকা চাইলাম। নির্জন ঝোঁপের পাশে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় নীলি পার্সলের খুন হয়তো প্যাট্রিকের কাজ। কিন্তু অ্যালিস করিগানের মৃত্যুতে আমি ঠিক যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেলাম। একই পদ্ধতি, সেই সময় নিয়ে কারচুপি। সওয়া চারটের আবিষ্কৃত হয় মৃতদেহ। আর একজন স্বামী, যার অ্যালিবাই রয়েছে চারটে পঁচিশ পর্যন্ত।
বলা হয়েছে যে এডওয়ার্ড করিগান পাইন রিজে গিয়ে তার স্ত্রীকে পায় না, তখন বাইরে এসে পায়চারি করতে থাকে। কার্যত সে প্রাণপণে ছুটে যায় সীজার্স গ্রোভে, স্ত্রীকে খুন করে কাফেতে ফিরে আসে। পথচারী যে মেয়েটিকে খবর দেয়, সে ছিলো একজন সম্ভ্রান্ত যুবতী, এক বালিকা বিদ্যালয়ের দিদিমনি। পুলিসের ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে পৌনে ছটা নাগাদ। এবারের মতো তখনও খুনের সময়টা সকলেই বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়।
আমাকে সঠিকভাবে জানতে হবে মিসেস রেডফার্ন মিথ্যাবাদী কিনা। সুতরাং ডার্টমুরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। উচ্চতা যার ধাতে সয় না এমন কেউ কখনও সুস্থভাবে জলের ওপর সরু সাঁকো পার হতে পারবে না। মিস স্টার প্রকৃত রোগী নিজেকে সুস্থ রাখতে পারেননি। কিন্তু ক্রিস্টিন নির্বিকারে ছুটে সাঁকোটা পার হয়ে যান। বিনা প্রয়োজনে যদি মিথ্যে বলতে পারেন তাহলে অন্যান্য মিথ্যেগুলোও অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে কলগেট সারে পুলিসকে দিয়ে ছবিটা সনাক্ত করিয়েছেন। আর রেডফার্নকে করিগান বলে সনাক্ত করা হয়েছে শুনেই তার আত্মসংযম হারিয়ে যায়।
আমি যা করেছি তা অত্যন্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করেছি কিন্তু জিতেছি।
মিসেস গার্ডেনার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সত্যি, মঁসিয়ে পোয়ারো–কী ভীষণ ভালো লাগলো, শুনতে কিভাবে আপনি ধাপে ধাপে সমাধানে পৌঁছলেন–সত্যিই এটা একটা অপরাধ বিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা, আনন্দে আমি যে কি বলবো–ঠিক করতে পারছি না।
পোয়ারো বললেন, মিঃ গার্ডেনারও আমাকে সাহায্য করেছেন। আমি মিঃ গার্ডেনারকে প্রশ্ন করেছিলাম যে মিসেস মার্শালকে তার কিরকম মহিলা মনে হয়? তিনি বলেছিলেন আমার সেই মহিলাকে কেমন যেন বোকা-সাকা বলে মনে হয়েছে।
.
১৩.২
লিন্ডা মার্শাল গালকোভে পোয়ারোর কাছে বললো, ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত আমি মরে যাইনি। কিন্তু, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার অপরাধ তো খুন করারই সমান, তাই না? আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম। পোয়ারো বললেন, না, দুটো এক জিনিস না। যদি তোমার শোবার ঘরে সেই ছোট্ট মোমের পুতুলের বদলে তুমি তোমার সম্মাকে বন্দী অবস্থায় পেতে, আর তোমার হাতে আলপিনের বদলে ছুরি থাকতো, তাহলেও তুমি তার বুকে বিধিয়ে দিতে পারতে না। মোমের পুতুল বানিয়ে আলপিন ফুটিয়ে তোমার মনের ঘৃণা চলে গেছে সেই পুতুলের ওপর। তার মৃত্যুসংবাদ পাবার আগেই তুমি নিজেকে শুদ্ধ মনে করেছ–অনেক হাল্কা হয়ে গেছ–তুমি হয়েছ অনেক সুখী।
আপনি কি করে জানলেন? সত্যিই আমার সে রকম মনে হয়েছিলো।
সুতরাং ভবিষ্যতে এরকম বোকামি আর কোরো না। এর পরের সম্মাকে যাতে ভালোবাসতে পারো তার জন্য এখন থেকেই মনকে তৈরি করে নাও।
লিন্ডা চমকে বললো, ও বুঝেছি। আপনি কি রোজামন্ডের কথা বলছেন। ওকে আমার ভালো লাগে। ওর যথেষ্ট বুদ্ধি আছে।
.
১৩.৩
কেনেথ মার্শাল বললেন, রোজামন্ড তোমার মাথায় কি উদ্ভট চিন্তা ঢুকেছিলো যে আমি আর্লেনাকে খুন করেছি।
আমার মতো বোকা নেই। কিন্তু কেন তুমি ঝিনুকের মতো নিজেকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখো যে, আলেনা সম্পর্কে তোমার সত্যি কি ধারণা কখনও বুঝিনি। আমি ভেবেছি তুমি যদি হঠাই জানতে পারো যে ও তোমাকে ঠকাচ্ছে তাহলে তুমি হয়তো রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে। তুমি সবসময়েই ভীষণ শান্ত থাকো, কিন্তু সময়ে সময়ে দেখলে ভয় হয়।
আর তাই তুমি ভেবেছো আমি ওকে গলা টিপে খুন করেছি।
হ্যাঁ, আর তোমার অ্যালিবাইটাও কেমন যেন হালকা ঠেকছিলো। তাই ঠিক করলাম তোমাকে সাহায্য করবো, তোমাকে টাইপ করতে দেখেছি বলে বোকার মতো একটা গল্প ফেঁদে বসলাম। পরে যখন শুনলাম তুমি বলেছো যে তুমি আমাকে দরজায় উঁকি মারতে দেখেছো-ইয়ে–ধরেই নিলাম আমার সন্দেহ, পুরোপুরি সত্য। এছাড়া রয়েছে লিন্ডার অদ্ভুত ব্যবহার।
সে কথাতো তোমার গল্পকে সমর্থন করবার জন্যেই বলেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি চাও যে তোমার গল্পটা আমি সমর্থন করি।
তার মানে তুমি ভেবেছো তোমার বউকে আমি খুন করেছি?
কেন, রোজামন্ড মনে নেই, একটা কুকুরের জন্য তুমি কিভাবে সেই ছেলেটাকে প্রায় খুন করে বসেছিলে? কিভাবে তুমি ওর গলা টিপে ধরেছিলে?
কিন্তু সে তো বহু বছর আগের কথা। তাছাড়া আর্লেনাকে খুন করার পেছনে আমার কোনো উদ্দেশ্যটা থাকতে পারে বলো? তুমি ভেবেছো তোমার সুখে জন্য আমি ওকে খুন করেছি? নাকি-নাকি ভেবেছো আমি তোমাকে চাই বলে আমার পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছি?
না, মোটেও তা ভাবিনি, কিন্তু সেদিন তুমি কি বলেছিলে–লিন্ডার সম্পর্কে আমাদের সম্পর্কে–আর তখন তোমাকে আমার চিন্তিত মনে হয়েছিলো।
এ নিয়ে সবসময়ই আমি চিন্তা করেছি।
আমি তো তোমাকে অবিশ্বাস করিনি কিন্তু একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই। আর্লেনাকে আমি কখনো নিজের করে ভাবিনি–শুধু প্রথমদিকে একটু ভালোবেসেছিলাম–এছাড়া ওকে নিয়ে দিনের পর দিন কাটানো–সে যে কি দুঃসহ কষ্ট যেন এক নরকবাস। ও এত সরল আর বোকা ছিলো-পুরুষ দেখলেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না–আর পুরুষেরাও ওকে ঠকাতে এবং ওর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতো। আমি ওকে বিয়ে করেছি সুতরাং ওর দেখাশোনা করা আমারই কর্তব্য। আর সে জন্যে আমার কাছে ও সত্যিই কৃতজ্ঞ ছিলো। ওকে দেখে আমার করুণার পাত্র বলে মনে হতো।
জানি কেন, এখন আমি সব বুঝতে পারছি।
তুমি–তুমি সব কিছু চট করে বুঝতে পারো।
আচ্ছা, তুমি কি এখনই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, কেন, না কি ছমাস অপেক্ষা করবে বলে কিছু ঠিক করেছো?
কেনেথের ঠোঁট থেকে পাইপটা খসে পড়লো, নিচের পাথরে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো।
যাঃ, এখানে এসে এ নিয়ে আমার দুটো পাইপ গেলো। সঙ্গে আর পাইপও নেই। কিন্তু কি করে জানলে যে অপেক্ষা করার পক্ষে ছমাসই মোটামুটি আমি ভেবে রেখেছি।
কারণ সত্যিই সেটা ঠিক সময়। কিন্তু দয়া করে এখনই আমাকে স্পষ্ট করে কথা দাও। নয়তো আগামী ছমাসের মধ্যে তুমি হয়তো আবার কোনো নির্যাতিত অসহায় মেয়ের দেখা পাবে আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করতে বীরের মতো ছুটে যাবে।
সশব্দে হেসে, এবার সেই নির্যাতিতা অসহায় মেয়ে তুমি, রোজামন্ড। তবে তোমার ওই হতচ্ছাড়া পোশাক তৈরির ব্যবসা তোমাকে ছাড়তে হবে, তারপর আমরা গ্রামে গিয়ে থাকবো।
ওইও ব্যবসা থেকে আমার অনেক আয়। বুঝতে পারছে না, ওটা আমার নিজস্ব ব্যবসা–আমি নিজে ওটা সৃষ্টি করেছি আর তার জন্যে আমার যথেষ্ট গর্ব আছে। তোমার এত সাহস, হঠাৎ বলে বসলে, ওসব ছেড়ে দাও, সোনা।
হা। আমার এতই সাহস।
আর তোমার বিশ্বাস তোমার জন্য এককথায় আমি রাজী হয়ে যাবো?
যদি রাজী না হও, তাহলে তুমি আমার আর কোনো উপকারেই আসবে না।
অস্ফুট স্বরে রোজামন্ড বললো, ওঃ কেন, সোনা, তোমাকে নিয়ে আমি সারাটা জীবন শুধু গ্রামেই কাটাতে চেয়েছি। আমার সে স্বপ্ন এখন সত্যি হবে…।