০৮. আর্লেনা মার্শালের শোবার ঘরে

অষ্টম পরিচ্ছেদ

৮.১

আর্লেনা মার্শালের শোবার ঘরে দুটো বিশাল জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়েছে সোনালি রোদ। আর্লেনার প্রসাধন টেবিলে সর্বপ্রকার প্রসাধন দ্রব্যই রয়েছে। ইনসপেক্টর ড্রয়ারগুলো দেখতে ব্যস্ত। তিনি একগোছা ভাজ করা চিঠি পেলেন। ওয়েস্টন ও তিনি চিঠিগুলো পড়ে দেখতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে পোয়ারো পোশাকের আলমারি খুলে দেখলেন রাশি রাশি আধুনিক পোশাক। আর রয়েছে অন্তর্বাসের স্তূপ, অসংখ্য টুপি, যার পেছনে কয়েক গিনি করে খরচ করা হয়েছে। তিনি মৃদু স্বরে মন্তব্য করলেন, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম।

কর্নেল চিঠিগুলো ভাঁজ করতে করতে বললেন। তিনটে লিখেছে রেডফার্ন।

আরেকটা চিঠি তিনি পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিলে—

 প্রিয়তমা আর্লেনা–
আমার দুঃখ যদি বুঝতে। সুদূর চীনদেশে চলে যাচ্ছি। কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে এত গভীরভাবে ভালোবাসে ভাবিনি, যেমন তোমাকে বেসেছি। চেকার জন্যে ধন্যবাদ। ওরা এবার আমাকে মুক্তি দেবে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। এতসবের কারণ বড়লোক হতে চেয়েছিলাম শুধু তোমার জন্য। আমাকে ক্ষমা করবে তো? আমি চেয়েছিলাম তোমার সুন্দর নরম কানে হীরের বন্যা বইয়ে দিতে। আর গলায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। একটা বিশাল পান্না, শীতল এবং সবুজ, প্রচ্ছন্ন আগুনে টইটুম্বুর। আমাকে ভুলে যেও না–তুমি চিরকালের জন্য আমার।

বিদায়–বিদায়–বিদায়
জে.এন.।

কলগেট বললেন, এই জে.এন. সত্যিই চীনে গিয়েছিলো কিনা দেখতে হবে। সম্ভবত সে-ই আমাদের প্রার্থিত ব্যক্তি। অন্ধের মতো মহিলাটিকে ভালোবাসত, হয়তো একদিন জানতে পারলো, তাকে ঠকানো হয়েছে। মনে হচ্ছে, মিস ব্রুস্টার এই ছেলেটির কথাই বলেছে।

পোয়ারো ঘরের আসবাবপত্রের দিকে, প্রসাধন টেবিলে, খোলা পোশাকের আলমারির দিকে, শেষ নজর পড়লো উদ্ধত অলস ভঙ্গীতে বিছানায় শুয়ে থাকা একা বড়সড় ডোবার পুতুলের দিকে।

কেনেথ মার্শালের ঘরটা তার স্ত্রীর ঘরের লাগোয়া। মাঝে কোনো দরজা নেই। প্রসাধন টেবিলে রয়েছে দুটো গজদন্তের বুরুশ; একটা পোশাক পরিষ্কারের বুরুশ এবং এক শিশি কেশ প্রসাধনের আরক। ঘরের অন্যপ্রান্তে লেখার টেবিলে রয়েছে একটা টাইপরাইটার পাশে একরাশ কাগজ।

কলগেট বললেন, এই তো সেই চিঠিটা, যেটার কথা উনি বলেছিলেন। ২৪ তারিখ দেওয়া আছে। আর এই যে সেই খামটালেদারকোষ বে ডাকঘরের আজকের ছাপ রয়েছে। এবার আমাদের জানতে হবে, এই চিঠির উত্তর আগেই তৈরি করেছিলেন কিনা!

কর্নেল বললেন, তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য এখানে এ কাজে ছেড়ে যাচ্ছি। বাকি ঘরগুলো আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিই।

ওয়েস্টন লিন্ডা মার্শালের ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, মনে হয় না তেমন কিছু আছে তার। হয়তো মার্শাল তার মেয়ের ঘরে কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

তিনি চলে গেলেন, এরকুল পোয়ারো ঘরেই রয়ে গেলেন। খুব সদ্য সেখানে কোনো কিছু পোড়ানো হয়েছে। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে তার আবিষ্কার একটা সাদা কাগজে গুছিয়ে রাখলেন। অসম আকৃতির বিশাল এক টুকরো গলা মোম–কিছু সবুজ কাগজ অথবা পিচবোর্ডের ছিন্ন অংশ এ ছাড়াও রয়েছে একটা সাধারণ পিন এবং কোনো পশুর দগ্ধ লোম।

পোয়ারো সেগুলো সাজিয়ে মৃদু স্বরে, জীবনের মহৎ কর্ম চিন্তায় ফল নেই, সম্পাদনে ফল আছে। হয়তো এ কথাই লেখা ছিলো। কিন্তু এর অর্থ কি?

এই মুহূর্তে ছোট্ট পিনটা হাতে নিতেই তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো…হু..কিন্তু এও কিসম্ভব? শ্বেতপাথরের তাকে সাজানো কয়েকটা বই। একটা বাইবেল, সেক্সপীয়ারের নাটকের সংকলন। মিসেস হামফ্রি ওয়ার্ড রচিত দ্য ম্যারেজ অফ উইলিয়াম অ্যাস, সালট ইয়ং-এর লেখা দ্য ইয়ং স্টেপ মাদার, দ্য সুপসায়ার ল্যান্ড। ইলিয়টের মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল। ড্রিক কার-এর দ্য বার্নিং কোর্ট।

দ্য ইয়ং স্টেপমাদার ও উইলিয়াম অ্যাস বইদুটোর নামপত্রে বসানো অস্পষ্ট রবার ছাপগুলো দেখলেন। অন্যান্য বইগুলোর পেছনে একটা ছোট অথচ মোটা বাদামী চামড়া দিয়ে বাঁধানো বই রয়েছে।

তিনি বইটা খুলে, আমার ধারণাই দেখছি ঠিক। কিন্তু অন্য ব্যাপারটা কি সম্ভব? যদি না…

.

৮.২

 কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, কি হলো, মঁসিয়ে পোয়ারো, এখনও হয়নি।

পোয়ারো আসছি বলে তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিলয়ে এলেন।

লিন্ডার পাশের ঘরটা রেডফার্নদের। পোয়ারো ভালো করে দেখলেন, দুটো ভিন্ন স্বাতন্ত্রের ছাপ নজরে পড়লো। এছাড়া তেমন কিছুই নজরে পড়লো না।

এর পরের ঘরটা রোজামন্ড ডার্নলির, বিছানার পাশে টেবিলে কয়েকটা বই ও প্রসাধন টেবিলে প্রসাধন সামগ্রী। এই ঘরের ঠিক পরেই, উত্তর প্রান্তে এখটা খোলা দরজা ও তার সংলগ্ন বারান্দা, বারান্দা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে পাথুরে জমিতে।

ওয়েস্টন বললেন, প্রাতঃরাশের আগে স্নান করার থাকলে সবাই এই সিঁড়িটাই ব্যবহার করে

এরকুল পোয়ারো দেখলেন, একটা সরু পথ গিয়ে মিশেছে পাথর কেটে তৈরি আঁকাবাঁকা কয়েক ধাপ সিঁড়িতে। সিঁড়ি শেষ হয়েছে সমুদ্রে। এছাড়া, আরও একটা পথ হোটেলকে ঘিরে বাঁদিকে চলে গেছে। এই সিঁড়ি বেয়ে যে কেউ কংক্রিটের সেতুর কাছে প্রধান রাস্তায় পৌঁছতে পারে।

ওয়েস্টন বললেন, সুতরাং হোটেলের মধ্যে না গিয়েও কারও পক্ষে দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কারো জানলা দিয়ে নজরে পড়ার সম্ভাবনা। সবার স্নানঘরগুলোর জানলা উত্তর দিকে, এছাড়াও কর্মচারীদের স্নানঘর, একতলার মালপত্র রাখার ঘর।

কিন্তু প্রথম জানলাগুলোয় আছে ঘষা কাঁচ। আর সুন্দর সকালে কেউ বিলিয়ার্ড খেলে না। সুতরাং এ যদি তার কাজ হয়ে থাকে, তাহলে সকালে এই পথ ধরেই তিনি গিয়েছিলেন।

মানে ক্যাপ্টেন মার্শাল?

 হা। মনে হচ্ছে, সব কিছু যেন তারই দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে।

 পোয়ারো নীরস কণ্ঠে বললেন, হয়তো–কিন্তু শুধু ব্যবহারের অজুহাতে কাউকে খুনী সাব্যস্ত করা যায় না।

ওয়েস্টন বললেন, দেখা যাক, টাইপরাইটার অ্যালিবাই থেকে কলগেট কদুর কি করতে পারে। এবার হোটেলের পরিচারিকাটির সঙ্গে কথা বলা যাক।

তিরিশ বছরের পরিচারিকাটি চটপটে, কর্মঠ এবং বুদ্ধিমতী।

ক্যাপ্টেন মার্শালের ঘর ঝাড়মোছ করে এগারো বাজতে পাঁচ মিনিটে মিঃ এবং মিসেস রেডফানের ঘরে কাজ করার সময় মার্শালের টাইপরাইটারের শব্দ সে শুনেছে। তারপর মিস ডার্নলির ঘর পরিষ্কার করে সওয়া এগারোটা নাগাদ নিচে যায় প্রাত্যহিক চা জলখাবার খেতে। তারপরে হোটেলের অন্য অংশের ঘরগুলো ঝাড়গোছ করে।

ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা, মিসেস মার্শাল কি তার প্রাতঃরাশ রোজ বিছানাতেই সারতেন?

হা। অবশ্য প্রাতঃরাশ বলতে সামান্য এক কাপ চা, একটু কমলালেবুর রস ও একটুকরো সেঁকা পাউরুটি।

পোয়ারো বললেন, মিসেস মার্শাল সম্পর্কে তোমার ধারণা কি, মাদমোয়াজেল?

গ্ল্যাডিশ ন্যারাকেট বললো, তার মতো বড়লোকের কথা কি আমার ছোট মুখে মানায়?

 হ্যাঁ, মানায়। তোমার নিজস্ব মতামত শুনতে আমরা আগ্রহী।

 মিসেস মার্শাল-ভদ্রমহিলা বলতে যা বোঝায়; ঠিক তা ছিলেন না। মানে কেমন যেন অভিনেত্রী অভিনেত্রী মনে হতো। এই হয়তো হাসি খুশি আছেন, হাসছেন, পরমুহূর্তে হয়তো কিছু খুঁজে না পেলে বা তার ডাকে সাড়া দিতে দেরি করলে অত্যন্ত খারাপ নোংরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু তার পোশাকগুলো ছিলো দারুণ চমৎকার, দেখতে তিনি ছিলেন সুন্দরী–সুতরাং সকলেই তাকে প্রশংসা করতো।

আচ্ছা, মিসেস মার্শাল ও তার স্বামীর মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল বলতে পারো?

 আপনারা নিশ্চয়ই স্বামীকে সন্দেহ করছেন; না ক্যাপ্টেন মার্শাল এত চমৎকার ভদ্রলোক, তিনি একাজ করতে পারেন না।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত নও।

এরকম ঘটনা কাগজে প্রায়ই বেরোয় এ ক্ষেত্রেও সেরকম একটা কানাঘুমো। মানে, মিসেস মার্শাল আর মিঃ রেডফানের ব্যাপার নিয়ে। মিসেস মার্শালের মতো মহিলার কাছে অবশ্য কোনো পুরুষই নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু ক্যাপ্টেন মার্শালের কানে যদি ব্যাপারটা উঠে থাকে–আমার মনে হতো–মিসেস মার্শাল এ সব ঘটনা তার স্বামীর কানে যাবে ভেবে ভয় পেতেন।

তোমার এই ধারণার পেছনে কোনো প্রমাণ নেই। আচ্ছা, আজ সকালে পাওয়া মিসেস মার্শালের চিঠিগুলো কি তুমি তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলে?

হা স্যার। রোজকার মতো সেগুলো তার প্রাতঃরাশের ট্রেতে রেখে দিই।

 চিঠিগুলোর চেহারা তোমার মনে আছে?

মাথা নাড়ল মেয়েটি।

চিঠিগুলো সাধারণ চিঠির মতোই দেখতে ছিল। মনে হয়, তার মধ্যে কয়েকটা বিল ও ইস্তাহার ছিলো, কারণ পরে সেগুলো ছেঁড়া অবস্থায় ট্রেতে থাকতে দেখি

কি হলো সেগুলো?

ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, স্যার। পুলিস অফিসারের একজনকে দেখে এলাম, ডাস্টবিন ঘেঁটে দেখছেন।

সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন ওয়েস্টন।

পোয়ারো সামনে ঝুঁকে, আজ সকালে লিন্ডা মার্শালের ঘর পরিষ্কার করার সময় ফায়ার প্লেসটা পরিষ্কার করেছিলে?

ফায়ার-প্লেসে কোনো আগুন জ্বালানো হয়নি তাই পরিষ্কার করতে হয়নি।

কটার সময় তুমি ও ঘর পরিষ্কার করেছিলে?

এই সোয়া নটা নাগাদ, তিনি তখন প্রাতঃরাশ সারতে গিয়েছিলেন। প্রায় পৌনে দশটায় তিনি ফিরেছিলেন।

তুমি তার ঘরে আর যাওনি?

না, স্যার।

 আচ্ছা, আজ সকালে প্রাতঃরাশের আগে কারা কারা স্নান করেছিলেন?

মনে হয় ক্যাপ্টেন মার্শাল এবং মিঃ রেডফানেই স্নান করেছিলেন। এটা ওদের বরাজের অভ্যাস।

লিন্ডা মার্শাল আজ সকালে স্নান করেনি?

না স্যার। তার সমস্ত স্নানের পোশাকই শুকনো ছিলো।

পোয়ারো বললেন, এটাই জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা এদিকের যেসব ঘর তুমি দেখাশোনা করো, তার কোনোটা থেকে কোনো শিশি খোয়া গেছে কি?

শিশি? কিসের শিশি?

মানে–সাধারণভাবে ব্যাপারটা কি তোমার চোখে পড়তো-যদি কোনো শিশি হারিয়ে যেতো।

মিসেস মার্শালের ঘর থেকে হারালে বলা সম্ভব নয়। তার ঘরে তে শিশি বোতল থাকে। মিস ডার্নলির ঘরেও একগাদা ক্রীম আর লোশনের শিশি আছে। কিন্তু অন্য ঘরেরটা আমার নজরে পড়তো স্যার। মানে যদি আমাকে তেমনভাবে নজর করে দেখতে বলা হতো।

তাহলে যাও। ঘরগুলো একবার ভালো করে দেখে এসো।

 নিশ্চয় স্যার।

ওয়েস্টন বললেন, এসব কি ব্যাপার?

পোয়ারো বললেন, আজ সকালে প্রাতঃরাশের আগে মিস ব্রুস্টার পাথরের ঘাটের কাছাকাছি সমুদ্রে স্নান করছিলেন, তিনি বলেছেন, ওপর থেকে একটা শিশি নাকি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়, অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পান। কে এই শিশিটা ছুঁড়েছিলো এবং কেন?

সে তো যে কেউ ফেলতে পারে।

না, পারে না। যদি কোনো খালি অপ্রয়োজনীয় শিশি আপনার প্রসাধন টেবিলে থাকে, তাহলে সেটা কি আপনি বাজে কাগজের ঝুড়িতে না ফেলে পরিশ্রম করে বারান্দায় গিয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলবেন? সুতরাং এই অসামান্য শ্রমস্বীকার আপনি তখনই করবেন যখন চাইবেন, সেই বিশেষ শিশিটা কারো নজরে না পড়ুক।

ওয়েস্টন বললেন, এই মুহূর্তে আপনি নিশ্চয়ই বলে বসবেন না যে, আর্লেনা মার্শালকে কোনো রহস্যময় শিশি থেকে কোনো রহস্যময় বিষপ্রয়োগে খুন করা হয়েছে।

না, না এই শিশিতে বিষ ছিল না। কি ছিল জানি না বলেই কৌতূহলী হয়ে পড়েছি।

গ্ল্যাডিশ ন্যারাকট ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, দুঃখিত স্যার। কোনো ঘর থেকে কিছু হারিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু মিসেস মার্শালের ঘরটা আমাকে ধাঁধায় ফেলেছে। একগাদা শিশি বোতল।

ঠিক আছে। আচ্ছা, এমন কোনো ঘটনা যা তোমার কাছে অস্বাভাবিক রহস্যময়, অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে–যা দেখে তুমি আপনমনেই অথবা, কোনো সহকর্মীর কাছে বলতে বাধ্য হয়েছে–ভারী অদ্ভুত তো?

কিন্তু ব্যাপারটা খুবই সামান্য। নর্দমা দিয়ে স্নানের জল বয়ে যাওয়ার একটা শব্দ মাত্র। আর সত্যিই নিচের তলায় এলসিকে আমি তখন বলেছিলাম যে বেলা বারোটায় কারও স্নান করাটা অদ্ভুত ঠেকেছে।

কার স্নান ঘর থেকে জলটা আসছিলো তখন?

 সেটা জানি না স্যার। নিচের নর্দমা দিয়ে জলটা যাওয়ার শব্দ শুনেছিলাম, ব্যাস।

 ঠিক জানো, সেটা স্নানের জল?

হা স্যার। স্নানের জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে কারো ভুল হয় না।

গ্ল্যাডিশ চলে গেলে ওয়েস্টন বললেন, এই স্নানের ব্যাপারটার সঙ্গে নিশ্চয়ই মূল ঘটনা জড়িয়ে নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো? কারণ এখানে রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলার ব্যাপার নেই

পোয়ারো বললেন, এটাই হলো গলা টিপে খুন করার সুবিধে কোনো কিছুর দরকার হয় না শুধু দৈহিক শক্তি আর খুনী মন ছাড়া স্নানের ব্যাপারটায় হয়তো কোনো গুরুত্ব নেই। যে কেউ, টেনিস খেলায় যাওয়ার আগে স্নান করতে পারে।

দরজায় টোকা দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল বললো, মিস ডার্নলি আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা করতে চান। কি জরুরী কথা বলতে ভুলে গেছেন।

আমরা নিচে যাচ্ছি–এখুনি।

.

৮.৩

 বিষণ্ণ মুখে কলগেট বললেন, এক মিনিট স্যার।

সুতরাং তাকে অনুসরণ করে ওয়েস্টন ও পোয়ারো মিসেস ক্যাসল-এর অফিসে উপস্থিত হলেন।

কলগেট বললেন, হেল্ড-এর সঙ্গে আলোচনা করে জানলাম এক ঘণ্টার কমে ওটা টাইপ করা অসম্ভব। আর এই চিঠিটা দেখুন।

প্রিয় মার্শাল–ছুটির মাঝে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত, কিন্তু বালি অ্যাণ্ড টেন্ডারের চুক্তি নিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে…। তারিখ ২৪ শে–অর্থাৎ গতকালের খামে পোস্ট অফিসের ছাপ। গতকাল সন্ধ্যে, ই, শি-১-এর এবং আজ সকালের লেদারকোম্ব-এর চিঠিতে এবং খামে একই টাইপরাইটার ব্যবহার করা হয়েছে। এ চিঠির কয়েকটা সংখ্যা থেকে মার্শালের চিঠির সংখ্যাগুলো তৈরি–ব্যাপারটা ভীষণ জটিল।

ওয়েস্টন, হুম–মার্শালকে তাহলে সন্দেহ থেকে বাদ দিতে হচ্ছে, এবার মিস ডার্নলির সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হবে।

রোজামন্ড সাবলীল ভঙ্গীতে ঢুকে অপরাধী মন নিয়ে বললো, দুঃখিত। হয়তো ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, খুবই সামান্য। আমি বলেছিলাম যে আজ সকালটা আমি সানি লজ-এ কাটিয়েছি। সেটা ঠিক নয়। আমি একবার হোটেলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম, রোদ-চশমাটা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই হোটেলে গিয়ে ওটা নিয়ে এসেছি।

আপনি সোজা আপনার ঘরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, তবে একবার মার্শালের ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম। ওর টাইপ করার শব্দ শুনে ভাবলাম, আজকের মতো একটা সুন্দর দিন ও টাইপ করে নষ্ট করছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখলাম এত গভীর মনোযোগে দুহাত দিয়ে টাইপ করছে যে, ওকে কিছু বলতে পারলাম না। ও আমাকে হয়তো দেখতেও পায়নি।

এটা ঠিক কটার সময় হয়েছে মিস ডার্নলি?

 এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ।

.

৮.৪

 কলগেট বললেন, পরিচারিকা তাকে দেখেছে এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত টাইপ করতে আর মিস ডার্নলি এগারোটা কুড়িতে দেখেছে। মিসেস মার্শাল নিহত হন পৌনে বারোটা নাগাদ। সুতরাং মার্শাল এখন এসব সন্দেহের বাইরে।

চিন্তাচ্ছন্ন ভাবে পোয়ারো বললেন, মিস ডার্নলি কেন যে এই অতিরিক্ত সাক্ষ্যটুকু যেচে দিলেন সেটাই ভেবে অবাক হচ্ছি।

আচ্ছা ধরে নেওয়া যাক, মিস ডার্নলি আজ সকালে সানি লজ-এ ছিলেন না। সুতারং তিনি চট করে একটা নতুন গল্প বানিয়ে আমাদের কাছে বিবৃত করলেন। তিনি কিন্তু বেশ সতর্কভাবেই বলেছেন ক্যাপ্টেন মার্শাল তাকে দেখতে পাননি।

ওয়েস্টন অবিশ্বাসের সুরে, আপনি কি বলতে চান! মিস ডার্নলি এর মধ্যে জড়িয়ে আছন?

ইনসপেক্টর কলগেট কেশে, ঐ মার্কিন ভদ্রমহিলার কথাগুলো নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছিলেন, ক্যাপ্টেন মার্শালের ওপর মিস ডার্নলির যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে।

ওয়েস্টন অধৈর্য হয়ে বললেন, আর্লেনা কোনো মহিলার হাতে খুন হননি। সুতরাং পুরুষদের পেছনে আমাদের আবার আঠার মতো লেগে থাকতে হবে।

কলগেট বললেন, হ্যাঁ, আমরা বার বার একই জায়গায় ফিরে আসছি, তাই না?

পুলিসপ্রধান বললেন, এবার মনে হয়, আমার একবার পিক্সি কোভে যাওয়া দরকার। তাছাড়া পিক্সি গুহাটাও একবার দেখা দরকার। কোনো পুরুষ অপেক্ষা করার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা? আপনি কি বলেন সঁসিয়ে পোয়ারো?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

ওয়েস্টন বললেন, যদি বাইরে থেকে কেউ এসে থাকে তাহলে পিক্সি গুহাই হচ্ছে তার লুকোবার পক্ষে চমৎকার জায়গা–তবে স্থানীয় লোকেরা হয়তো গুহার খবরটা জানে।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো জানে না। কারণ হোটেল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এই দ্বীপ ও দ্বীপ সংলগ্ন কোভগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর হোটেলের লোকদের স্থানীয় অধিবাসী বলা যায় না। মিসেস ক্যাসল লন্ডনের লোক।

ওয়েস্টন বললেন, রেডফার্নকে সঙ্গে নিতে হবে, উনিই গুহার খবরটা দিয়েছেন। আর মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনিও।

আমি? আমার অবস্থাও মিস ব্রুস্টার ও মিসেস রেডফার্নের মতো, খাড়া মই বেয়ে ওঠানামা সয় না।

আপনি তাহলে নৌকা করে যেতে পারেন।

আমরা পাকস্থলী আবার সমুদ্রে সুস্থ বোধ করে না।

এই শেষ সময়ে আমাদের এভাবে ডোবাবেন না।

সেই মুহূর্তে মিসেস ক্যাসল দরজায় উঁকি মেরে, আশা করি বিরক্ত হবেন না, সেই ধর্মযাজক মিঃ লেন এইমাত্র ফিরে এসেছেন।

ধন্যবাদ মিসেস ক্যাসল, আমরা এখুনি যাচ্ছি। কয়েক পা এগিয়ে মিসেস ক্যাসল, বেলা একটা নাগাদ একজন ভদ্রলোক ও একজন ভদ্রমহিলা এখানে এসেছিলেন। দ্বীপের ওপার থেকে মধ্যাহ্নভোজ সারতে। তাদের বলা হয়েছে, এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করা সম্ভব না। মনে হয়, তারা উঁচুদরের ট্যুরিস্ট, গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে বেরিলয়েছেন।

ঠিক আছে। এবারে মিঃ লেনকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।

.

৮.৫

 আমি এ অঞ্চলের পুলিসপ্রধান, মিঃ লেন। আশা করি এখানকার দুর্ঘটনার কথা আপনাকে জানানো হয়েছে।

হা, ফিরেই শুনলাম ব্যাপারটা। কি ভয়ানক..তার শরীর কেঁপে উঠলো…যেদিন থেকে এখানে এসেছি–অশুভ শক্তির উপস্থিত স্পষ্ট টের পেয়েছি। বর্তমানে অশুভ শক্তিকে আমরা বিশ্বাস করি না। নরকাগ্নিকে নির্বাসনে দিয়েছি। শয়তান বিশ্বাস করি না। কিন্তু শয়তান অতীতে যেমন শক্তিমান ছিলো, আজও তেমনি আছে।

ওয়েস্টন বললেন, হ্যাঁ হয়তো তাই। কিন্তু আমার এলাকা নীরস, বাস্তববাদী একটা খুনের কিনারা করা।

খুন, বড় নিষ্ঠুর শব্দ। বলুন, কিভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।

আজ সারা সকালটা আপনি কিভাবে কাটিয়েছেন?

বরাবরের মতো আজও আমি সকালে পদব্রজে ভ্রমণে বেরিলয়ে পড়ি, হাঁটতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আজ গিয়েছিলাম সেন্ট-পেট্রক-ইন-দ্য কোম্ব-এ প্রায় সাত মাইল দূরে। সঙ্গে কিছু খাবার নিয়েছিলাম। তাই খেয়েছি। ওখানকার গীর্জাটাও দেখে এলাম।

ধন্যবাদ, পথে আপনার সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিলো?

দেখা হলেও কথা হয়নি। গীর্জার খাতায় আমার নামটা লিখে এসেছি। খোঁজ করলে দেখতে পাবেন।

ওয়েস্টন বললেন, ভাববেন না যে আমরা আপনাকে সন্দেহ করছি। নেহাৎই নিয়মমাফিক কাজ। মৃত মহিলা সম্পর্কে আপনি কি এমন কিছু তথ্য জানেন যা আমাদের সাহায্য করবে?

এইটুকু বলতে পারি, আর্লেনা মার্শালকে দেখা মাত্রই ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভব করতে পারি যে, তিনি এক অশুভ শক্তির উৎসবিন্দু। পুরুষের চরিত্রের সব কটি হীন নিচ প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে তিনি তুলনাহীন। শেষ পর্যন্ত বিচারের দণ্ড নেমে এসেছে তার পাপাচারের সমাপ্তি ঘটাতে।

পোয়ারো বললেন, বিচারের দণ্ড না কোনো মানুষের হাত তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে।

ধর্মযাজকের হাত কেঁপে উঠলো, চাপা কণ্ঠে বললেন, কি ভয়ংকর–আপনার বর্ণনা, বড় নৃশংস

আপনি বলতে পারেন, সেই অদৃশ্য হাত দুটোর মালিক কে?

জানি না–আমি কিছুই জানি না..

ওয়েস্টন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবারে আমাদের পিক্সি কোভে যাওয়া দরকার।

লেন বললেন, ওখানেই কি ব্যাপারটা ঘটেছে? আমি আপনার সঙ্গে গেলে কি আপত্তি আছে?

পোয়ারো বললেন, নিশ্চয়ই যাবেন। আপনি আমার সঙ্গে নৌকায় চলুন, মিঃ লেন। আমরা এখুনি রওনা হবো।