দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ২০

।। কুড়ি।। 

সোজা সুজানের ঘরে ঢুকলাম হোটেলে ফিরে, আমাকে দেখে উদ্বিগ্নভাবে বলল, প্রিয় অ্যানি, তুমি কোথায় ছিলে? কি করছিলে এতক্ষণ? 

—রোমাঞ্চকর এক অভিযানে বেরিয়েছিলাম, এই বলে সবিস্তারে সব বললাম। 

সুজান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, বারবার তোমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটে কেন? কেন, কেউ আমাকে বন্দী করে পাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে না? 

হেসে বললাম, কারণ সেটা তোমার পছন্দ হত না। ঘটনাচক্রে এমন অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম তাই। তা না হলে— 

—কিন্তু এখন কি করবো ঠিক করলে? 

—আমি ঠিক জানি না, আমার পরিকল্পনা মতো রোডেসিয়ায় অবশ্যই তোমাকে যেতে হবে প্যাগটের ওপর নজর রাখার জন্য। 

—আর তুমি? 

—ঠিক এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। ভাবলাম, কিলমার্ডেন জাহাজের যাত্রী কি চিকেস্টার হয়েছে নাকি সে তার মত বদলেছে? এই জেনবার্গের ভিলায় তার পরিকল্পনা যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে আমাকে ট্রেন পথে ডার্বানে যেতে হবে। জাহাজ পৌঁছনোর আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে। আর আমার পালানোর খবর যদি সে পেয়ে থাকে তাহলে মাঝপথে এলিজাবেথ কিংবা ইস্ট লন্ডন বন্দরে নেমে পড়বে। তাহলে একটা বিভ্রান্তিকর সমস্যা হবে। 

রেলওয়ে অফিসে গিয়ে জানা গেল সেদিন রাত আটটা পনেরোয় ডার্বান যাওয়ার ট্রেন আছে। সুজান চায়ের টেবিলে হাসতে হাসতে বলে, তুমি কি আর চিকেনস্টারকে চিনতে পারবে? বড় অভিনেতা সে। কখন কি ছদ্মবেশ নেয় কে জানে? এবার হয়তো সে কোনো নাবিকের ছদ্মবেশে তোমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে তুমি তাকে চিনতেও পারবে না সেই অবস্থায়। 

—তুমি দেখছি খুব মজায় আছ। 

কর্নেল রেস তখন ঘরে ঢুকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। 

সুজান বলল, স্যার ইউস্টেস এখন কি করছেন জানেন? আজ সারাদিন ওর দেখা পাইনি।

—উনি ওর নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন। 

—ও ব্যাপারে কিছু যদি বলেন- 

—মানে আপনি সেই ‘বাদামী রঙের পোষাকের লোকটার’ কথা জানতে চাইছেন, এই তো?

—কি বললেন? 

—হ্যাঁ, এটাই সত্য। প্রতিটি বন্দরে তার ওপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। আর তাকে নিয়েই যত মাথা ব্যথা স্যার ইউস্টেস পেডলারের, কারণ সে তার সেক্রেটারিকে ছিনিয়ে নিয়েছে। 

—মিঃ প্যাগটকে? 

—না, না, মিঃ প্যাগটকে নয়। অন্য আর একজন। নিজেকে যে রেবার্ন বলে পরিচয় দিয়েছিল।

—আচ্ছা তারা কি তাকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে? প্রশ্নটা করে সুজান টেবিলের তলা দিয়ে আমার হাতে চাপ দিল। তা এই ব্যাপারটা স্যার ইউস্টেস কিভাবে নিলেন? 

—তাঁর কাছে এটা একটা ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, ব্যক্তিগত অপমানও বলতে পারেন। পরে স্যার ইউস্টেসের মুখ থেকেই শোনার সুযোগ এসে গেল। হোটেল-বয় এর মারফত তার ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। বেচারা, সত্যি খুব মুষড়ে পড়েছিলেন, সুজান তাকে সান্ত্বনা দেয়। 

দুঃখ করে আমাদের কাছে অভিযোগ করে স্যার ইউস্টেস বলতে থাকেন, প্রথমেই ধরো-না এক অজানা মেয়ে বলা নেই কওয়া নেই আমার বাড়িতে খুন হল—আমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ কথা ঠিক নয়। গ্রেট ব্রিটেনে অত বাড়ি থাকতে আমার মিল হাউসে কেনই বা এমন বিশ্রী ঘটনা ঘটতে যাবে বলুন? কী ক্ষতি করেছি আমি মেয়েটির? 

সুজান আবার তাঁকে সান্ত্বনা দেয়। ফলে তিনি ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন? 

—কী আশ্চর্য! কী ঔদ্ধত্য সেই মেয়েটির খুনীর! তা না হলে সেই খুনী লোকটাই আবার আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজে যোগ দিতে আসে। ঘেন্না ধরে গেল আমার সেক্রেটারিদের ওপরে। আপনারা সম্প্রতি প্যাগটের কালো চোখের ভয়ঙ্কর চাহনি লক্ষ্য করেছেন? এরপরও কি ওকে আপনার সেক্রেটারি হিসাবে রাখা উচিত, আপনারা বলুন। নিশ্চিন্তে কাজ করার জন্য আমি এখন একটি মেয়ে সেক্রেটারি চাই। সুন্দরী মেয়ে, শান্ত, নম্র, যে আমার দুঃখের সময়ে সান্ত্বনা দিতে পারবে। তা মিস অ্যানি, তোমার কি খবর? এই কাজের ভারটা নেবে তুমি? 

—তা এতক্ষণ আপনাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য হাত ধরে বসে থাকতে হবে? হাসতে হাসতে বললাম। 

—ধরো সারাদিন। প্যাগটকে আমি কেপটাউনের পিছনে ফেলে রেখে যেতে চাই। আর এ জায়গাটা ও চুটিয়ে উপভোগ করবে রেবার্নের ওপরে সন্ধানী দৃষ্টি রাখার জন্য। এ কাজটা ওর খুব পছন্দ। তুমি আমার সঙ্গে রোডেসিয়ায় যাবে অ্যানি? সেখানকার জঙ্গলে সিংহ আছে। সব মেয়েরাই সিংহ পছন্দ করে। 

হেসে বললাম, তারা কি ছোট ছোট লাফ দেওয়ার অভ্যেস করবে? না, আপনার সাথে যাওয়া আমার ভাগ্যে নেই। আমাকে ডার্বানেই যেতে হবে। অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যার ইউস্টেস দরজা খুলে প্যাগটকে ডেকে নির্দেশ দিলেন ট্রেড কমিশনারের অফিস কিংবা চেম্বার অব মাইনস-এর অফিসে গিয়ে রোডেসিয়ায় তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য একটি মেয়েকে আনার জন্য। আর শোনো, মেয়েটি যেন স্বপ্নালু হয়। আর তার হাত ধরলে সে যেন আপত্তি না করে বুঝলে? 

—হ্যাঁ স্যার, আমি একজন অভিজ্ঞ শর্ট-হ্যান্ড-টাইপিস্টের কথাই বলব। 

আমি একরকম জোর করেই সুজানের হাত ধরে ফিরে এলাম তার ঘরে। 

—দেখ সুজান, এই মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনা ছকে ফেলতে হবে। শুনলে তো প্যাগট এখানেই থাকছে। 

—তার মানে রোডেসিয়ায় আমার যাওয়া হচ্ছে না? অথচ তুমি তো জান, অ্যানি, রোডেসিয়ায় সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য আমি কেমন উদগ্রীব হয়ে আছি। লন্ডন থেকে এখানে আসার উদ্দেশ্য আমার তাই ছিল– 

—চমৎকার! আমি তাকে হাসতে হাসতে বললাম, অত চিন্তা কিসের? রোডেসিয়ায় তুমি যাচ্ছ। জানি না তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কি করে ফিরে আসবে। আমার অনুমান, ইউস্টেস হয়তো প্যাগটকে সেখানে পাঠাতে পারেন। কি ভাবে প্যাগটকে সামলাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়। 

—চিন্তা নেই। বরং আমার পক্ষে অত্যন্ত সম্মানজনক ব্যাপার, সুজান বলে, সে রকম কিছু হলে আমি প্রেমের অভিনয় করে সব পরিকল্পনা ওলট-পালট করে দিতে পারব, আশা করি। 

—তাছাড়া আর দু’জনকেও চোখে রাখা যাবে। 

—ওঃ অ্যানি, কর্নেল রেস কিংবা স্যার ইউস্টেসকে তুমি কখনোই সন্দেহ করতে পার না।

—সবাইকে আমি সন্দেহ করি, আমি বললাম, সুজান, তুমি যদি গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে পেতে, আসামী এমন একজন লোক যাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করা যায় না। বহু অপরাধীকে স্যার ইউস্টেসের মতো সদা হাস্যময় দেখায়। 

সেই সঙ্গে আমি তাকে এও বললাম, তাই নয় যে, খুব গভীরভাবে আমি ওঁদের কাউকে সন্দেহ করি। তবে মনে রাখতে হবে, মেয়েটি স্যার ইউস্টেসের বাড়িতে খুন হয়েছিল। 

—ঠিক আছে, ও নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তোমার জন্য তাঁর ওপরে নজর রাখব। ওঁকে যদি উৎফুল্ল দেখায় সঙ্গে সঙ্গে আমি তোমাকে টেলিগ্রাম করে জানাব, স্যার ইউস্টেসকে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এখুনি চলে এসো। 

—সত্যি সুজান, একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, সবই তুমি খেলা বলে ধরে নাও। 

আমি জানি অ্যানি। তুমিই দায়ী। তোমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আমি হাল্কা অভিযান মনে করেই তোমার কাজে আমি সায় দিয়েছিলাম, এর বেশি গুরুত্ব আমি দিতে চাইনি। জান অ্যানি, আমার স্বামী ক্লারেন্স যদি জানতে পারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে অপরাধীর সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাহলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। 

—তাহলে তাঁকে টেলিগ্রাম করে অভিযানের কথা জানিয়ে দিলেই তো পার। 

সুজানের মুখের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেল। কেন জানি না। ক্লারেন্সকে টেলিগ্রাম করার কথা উঠলেই সুজানের মুখটা যেন বিবর্ণ হয়ে যায়, যেন গম্ভীর হয়ে পড়ে সে। এবারেও তাই হল। সে বলল, না, দরকার নেই। তুমি জান না অ্যানি, সব স্বামীরাই তাদের স্ত্রীদের আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারে নাক গলিয়ে থাকে। 

প্রসঙ্গটা চাপা দিতে বললাম, তাহলে তোমার কাজ হবে স্যার ইউস্টেস এবং কর্নেল রেসের ওপর নজর রাখা— 

—স্যার ইউস্টেসের ওপর সন্দেহ হতে পারে, কিন্তু কর্নেল রেস কী দোষ করলেন? আমার মনে হয় এ ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করে দেখলে কেমন হয়। হয়তো আমাদের সাহায্যও করতে পারেন, কি বলো? 

—না, না, কক্ষনো তুমি ভুলেও করতে যেও না সুজান, সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে বাধা দিয়ে ভাবলাম, সুজান বিবাহিতা বলেই কি নিঃসংকোচে অপর এক পুরুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে বিদেশে এসে, আর এই মেয়েদের মাধ্যমেই দুনিয়ায় এক গুপ্তচরবৃত্তি খুন জখম- রাহাজানির কাজ নির্বিঘ্নে সমাধা হয়ে থাকে। 

এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, এখানে থাকতে হবে প্যাগটের ওপর নজর রাখার জন্য, তবে ডাবানে যাওয়ার ভান করে একবার স্টেশনে যেতেই হবে। এসেই ছোটোখাটো একটা হোটেলে আশ্রয় নেব। সেই সঙ্গে চেহারা ও পোষাকের পরিবর্তন ঘটাতে হবে, যাতে সে চিনতে না পারে। ভাবছি মুখে ভেল চাপিয়ে নেব, পরিচিত কেউ মুখ দেখতে পাবে না, অথচ আমি অনায়াসে দেখতে পাব। 

আমার পরিকল্পনা সুজান সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করল। নৈশভোজ সেরে আসছি, স্যার ইউস্টেস অনেকবার অনুরোধ করলেন, প্যাগটের গাড়িতে স্টেশনে যাওয়ার জন্য। কারণ সে নাকি ঐ দিকেই যাচ্ছে। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে, বললাম, আমরা ইতিমধ্যে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে রেখেছি। 

স্যার ইউস্টেস দুঃখ করে বললেন, ঐ গাধাকে কেউ পছন্দ করে না। আমার জন্য এমন এক নতুন সেক্রেটারি এনেছে, বয়স চল্লিশের বেশি। মুখের ছিরি দেখলে তো আর তাকাতেই ইচ্ছে করে না। আর চোখ? যেন আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে, তাকালেই হয়তো আমাকে ভস্ম করে দেবে। 

হাসতে হাসতে বললাম, তা আপনার হাত সে ধরেনি? তিনি বিষণ্ণ গলায় বললেন, আমার সেই ইচ্ছেটা মরে গেছে। তুমি যাচ্ছ, বিদায়, তবে রোডেসিয়ায় গিয়ে সিংহ শিকার করলে তার চামড়া আমি তোমাকে দিচ্ছি না। কারণ, তুমি আমাকে একবুক শূন্য মরুভূমিতে ফেলে রেখে গেলে। তোমার ঐ স্বপ্নালু চোখ অনেকদিন দেখতে পাব না বলে কিন্তু কম দুঃখ নয়। 

তিনি আবেগে আমার হাত দুটো তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরলেন। কোনোরকমে তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে হলঘরে সুজানের কাছে চলে এলাম। 

এসে সুজানকে বললাম, চলো, এখুনি রওনা হওয়া যাক। আর দেরি নয়।

—ট্যাক্সি ডাকতে যাব। পেছনে থেকে ডাক শুনে ফিরে চমকে তাকালাম। 

মাফ করবেন মিস বেডিংফিল্ড, স্টেশনের দিকেই আমি যাচ্ছি। আপনাকে এবং মিসেস ব্লেয়ারকে স্টেশনে ছেড়ে দেব। আপনার মালপত্র পোর্টারকে বলুন আমার গাড়িতে তুলতে। 

—ধন্যবাদ, আপনাকে কষ্ট করতে হবে, না, আমি— 

—না, না। কোনো কষ্ট হবে না। আপনার মালপত্র তুলুন তো। 

অসহায়ভাবে সুজানের দিকে তাকাতেই, সুজান আমার গা টিপে ভরসা দিয়ে ইঙ্গিত করল, প্যাগটের গাড়িতে আরোহী হবার জন্য। 

—ধন্যবাদ মিঃ প্যাগট, বলে গাড়িতে উঠে বললাম। 

আমি বুঝতে পারছি, প্যাগট আমাকে সন্দেহ করছে। আমি সত্যিই ডার্বানে যাচ্ছি কিনা, শেষ পর্যন্ত আমি ট্রেনে উঠি কিনা নিজে দেখতে চায়। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে নড়ল না। 

ট্রেন ছাড়তে মাত্র তিন মিনিট বাকি আমরা ট্রেনের কামরায় উঠে বসেছি। নকল অভিনয়। কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিলে তখন আমি কী করব? অসহায় দৃষ্টিতে সুজানের দিকে তাকালাম। সে তখন কামরা থেকে নিচে নামতে উদ্যত কিন্তু বেশ চিন্তিত বলে মনে হল। 

অ্যানি, তোমার ট্রেন জার্নিটা খুবই কষ্টের হবে দেখছি। তারপর আজ আবার প্রচণ্ড গরম, তোমার তো আবার একটুতে মাথা ধরে, সঙ্গে তোমার ওডিকোলন বা ল্যাভেন্ডার আছে তো? নেই? 

না তো। হোটেলের ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি। এখন উপায়? 

তা উপায় একটা বার করতেই হবে। সুজান প্যাগটকে অনুনয় করে বলে, মিঃ প্যাগট, যদি কিছু মনে না করেন তো। স্টেশনের সামনের সেই ওষুধের দোকান থেকে এক ফাইল ওডিকোলন এনে দেবেন? 

প্রথমে প্যাগট একটু ইতস্তত করেও সুজানের মতো সুন্দরী মেয়ের কথা ফেরাতে পারল না। ছুটল ওডিকোলন আনার জন্য। 

সে চোখের আড়াল হওয়ামাত্র প্ল্যাটফর্ম থেকে কামরার দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় সুজান আমাকে ব্যস্ত হয়ে বলল, গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকের কামরার দরজা খুলে নেমে পড়ো। প্যাগটের মতো গর্দভের ওপর নজর রাখার ভার আমি নিলাম, কেমন! বিদায়! বিদায়! 

—বিদায় বন্ধু, বিদায়! 

।। একুশ।। 

পরবর্তী পরিকল্পনার রূপরেখা টানতে খুব একটা অসুবিধে হল না। একটা ছোট হোটেলে উঠেছি। অনেকদিন পর একটু আরাম করে পা ছড়িয়ে একা ঘুমিয়েছি। পরদিন সকালে মফঃস্বল টাউন দেখতে বেরিয়েছিলাম। পথে জুতোর লেস ছিঁড়ে যাওয়ায় একটা মুচির দোকানে জুতো পরেছি, হঠাৎ একটা লোক হুমড়ি খেয়ে আমার সামনে এসে পড়ল। তার মাথার টুপি ঈষৎ সামনে ঝোলানো। ভালো করে দেখতেই মনে হল লোকটা আমার পরিচিত। আগে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু তখন এর বেশি কিছু ভাবিনি। ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটার রোডেসিয়াগামী ট্রেন ছেড়ে দিলে আমি নিশ্চিন্ত হই। সবাই ঐ ট্রেনে রোডেসিয়ায় যাচ্ছে। কেবল এখানে থাকছে প্যাগট, তাকে নিয়েই এখন যত চিন্তা-ভাবনা। একটু পরে কেপটাউনের দিকে ফিরে চললাম। ট্রামে উঠতে যাব, পিছনে পরিচিত পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকাই। সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠলো, একটু আগে এই লোকটাই রাস্তায় আমার ঘারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা এই লোকটাই কি আগের দিন রাত্রে আমার পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল? বেঁটে-খাটো লোক, লম্বা নাক 

আচ্ছা লোকটা কি আমাকে অনুসরণ করছে? পরীক্ষা করার জন্য পরের স্টপেজে নেমে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। লোকটা সেই স্টপেজে না নেমে পরের স্টপেজে নেমে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই বুঝলাম নিঃসন্দেহে সে আমাকে অনুসরণ করছে। গাই প্যাগটের কাছে আমার জয়টা একটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে যাচ্ছে। 

সামনে একটা ট্রাম পেতেই তাতে উঠে বসলাম। আমি নিশ্চিত আমার অনুসরণকারী আমার পেছন পেছন ট্রামে উঠেছিল। কিন্তু আমার চিন্তা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। মনে হল মার্লোয় স্যার ইউস্টেসের বাড়িতে সেই মেয়েটির খুন হওয়া কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। এর পিছনে বিরাট এক চক্র আছে। আমি সেই চক্রের সূত্র খুঁজে পেয়েছি। সুজানের কাছে কর্নেল রেসের রহস্যোদ্ঘাটনের জন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর মুই জেনবার্গের সেই ভিলায় চিকেস্টারের কথাবার্তা শুনে আমার ধারণা হয়েছে, হীরে উদ্ধারের ব্যাপারটা কোনো একক ঘটনা নয়। এই চক্রের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে আর এই চক্রের নায়ক ‘কর্নেল’। তার নির্দেশেই সবাই কাজ করছে। যেমন এই মুহূর্তে ঐ লোকটা আমাকে অনুসরণ করছে। আমার সামনে এখন ভীষণ বিপদ। তারা পথের কাঁটা ভেবে আমাকে সরাতে চায়। তারা ভাবছে, তাদের অনেক গোপন খবর আমি জেনে গেছি। তাই আমাকে সরানোর জন্য তারা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এখন যে আমাকে একদিন প্রাণে বাঁচিয়েছিল, সেই এই ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারে, তার নাম হ্যারি রেবার্ন ‘বাদামী’ পোষাকের সেই লোকটি। এ ঘটনার অর্ধেক কাহিনী সে আমাকে বলেছে, বাকি অর্ধেক কাহিনী তার অবশ্যই জানা আছে। কিন্তু তাকে এখন পাই কোথায়? উধাও হয়ে গেছে সে। 

এখন আমার কি করা উচিত? এই আমি প্রথম ভয় পেলাম। আমার চার পাশে আমার শত্রুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বস্তুত, আমি এখন নজরবন্দিনী। এই অবস্থায় এক একা। পরক্ষণেই ভাবলাম, ভাবলাম কী? আমার চারপাশে যেমন শত্রুপক্ষ ছড়িয়ে আছে, তেমনি তো রাস্তায় দু’হাত অন্তর পুলিসও রয়েছে। মুই জেনবার্গের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে না। এখন আমি অনেক বেশি সতর্ক। 

ভাবতে ভাবতে এ্যাডেনি স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে আইসক্রীম-সোডার ফরমাস করলাম। তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছিল। একটু পরেই সেই নাক উঁচু লোকটা প্রবেশ পথের পাশে একটা টেবিল দখল করে বসল। আমি দ্বিতীয়বার আইসক্রীম সোডার ফরমাস দিলাম। 

হঠাৎ দেখি লোকটা হন্তদন্ত হয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল। দরজা পথে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম লোকটা অদূরে প্যাগটের সঙ্গে কী যেন বলছে। একটু পরেই সেই লোকটা রাস্তা পেরিয়ে একজন পুলিসম্যানের সঙ্গে কথা বলল। তাহলে? ওরা কি আমাকে পুলিস দিয়ে গ্রেপ্তার করতে চায়? ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বিলের টাকা দিতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। আমার ব্যাগে পুরুষদের একটা পার্স, পার্সের মধ্যে অনেকগুলো টাকা। কী আশ্চর্য, অন্য লোকের পার্স আমার ব্যাগে এল কি করে? তাহলে নিশ্চয়ই ঐ নাক উঁচু লোকটা ট্রাম থেকে নামবার সময় তার পার্সটা আমার ব্যাগে চালান করে থাকবে। 

লোকটা তখন পুলিসের সঙ্গে কথা বলছিল আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে। আমি তাড়াতাড়ি একটা চলন্ত গাড়ি থামিয়ে উঠে বসলাম। 

স্টেশনে পা দিতেই লক্ষ্য করলাম, সেই লোকটা আমাকে অনুসরণ করতে গিয়ে রাস্তায় এক পুলিসম্যানের সঙ্গে কথা বলছে। আমি তখন পাগলের মতো ছুটছি। তখন ঠিক এগারোটা, সেইমাত্র ট্রেনটা রোডেসিয়ার উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করেছে। ট্রেনটা আমাকে ধরতেই হবে। স্টেশনের পোর্টার আমাকে বাধা দিল, আমি তাকে একরকম ধাক্কা দিয়েই ট্রেনের কামরায় প্রবেশ করলাম। প্ল্যাটফর্মে প্যাগটকে দেখে হাত নেড়ে বললাম, বিদায় প্যাগট। সে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। 

আমাকে দেখে কর্নেল বেশ বিস্মিত হয়ে, হ্যালো অ্যানি, ডার্বান থেকে কখন ফিরলে?

সুজান তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। 

আমি বললাম, আমাকে এক্ষনি চীফের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি কোথায়? 

তিনি তার অফিস ঘরে সেক্রেটারিকে নোট দিচ্ছেন। মাঝের কম্পার্টমেন্টে। 

স্যার ইউস্টেস অসময়ে আমাকে দেখে বিস্মিত ও খুশী হলেন। 

স্যার ইউস্টেস বললেন, ঈশ্বর আমার আত্মাকে আশীর্বাদ করুন। ডার্বানে সেই যুবকটির কি খবর? 

নরম গলায় বললাম, আমি আপনাকেই পছন্দ করি। 

—প্রিয়তমা, তুমি এখুনি আমার হাত ধরো। তারপর তিনি তার নতুন সেক্রেটারি মিস পেটিগ্রিউকে বললেন, পড়ো, কতদূর বললাম দেখি— 

—হ্যাঁ পড়ছি, মেয়েটি তার শর্টহ্যান্ডের চিহ্নগুলো দেখে বলতে শুরু করে, টাইলম্যান রুজ তাঁর ভাষণে— 

স্যার ইউস্টেস খিঁচিয়ে উঠলেন, কি ব্যাপার? পুরো নোট নাওনি তুমি? 

—আমার ধারণা, কর্নেল রেস কখন যেন কম্পার্টমেন্টে ঢুকে বলে ওঠেন, মিস পেটিগ্রিউ তার পেন্সিল ভেঙে ফেলেছে। 

বিস্ময়ভরা চোখে স্যার ইউস্টেস কর্নেল রেসের দিকে তাকালেন এবং আমিও কর্নেলের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা আমি বুঝতে পারলাম না। 

।। বাইশ।। 

(স্যার ইউস্টেস পেডলারের দিনলিপি থেকে 

বৃহস্পতিবারের রাত : 

সবেমাত্র আমরা কিমবার্লি ছেড়ে এসেছি। সারাটা পথ হীরে চুরির আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছেন কর্নেল রেস। মেয়েরা হীরের ব্যাপারে কেন যে এত আগ্রহী বুঝতে পারি না। 

তড়িঘড়ি করে মিস অ্যানির ট্রেনে ওঠাটা এখনো আমার কাছে একটা বিরাট রহস্য বলে মনে হয়। এই সময়ে ওর তো ডার্বানে থাকার কথা। এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসে কি করে ও?

ওর রহস্য আমি কিছুটা উদঘাটন করতে পেরেছি। মনে হয় কোনো সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা ও। আজ সকালে ‘দে আর’ থেকে একটা জুরুরি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। মিসেস ব্লেয়ারের কেবিন থেকে সারারাত ধরে একটা বিশেষ রচনা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সব দেখে শুনে মনে হয় ‘বাদামী পোষাকের লোকটির’ সন্ধানে ও রয়েছে। আপতত কিলমাৰ্ডেন ক্যাসেলে তাকে সনাক্ত করতে না পারলেও এখন সে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠাতে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, ‘কিভাবে একজন খুনীর সঙ্গে ভ্রমণ করেছি’ এবং ‘যে আমাকে বলেছে’—সত্য-মিথ্যা মেশানো এইসব কাহিনী আর কি! প্যাগট যখন আমাকে জানাবে, আমিও তখন এসবের স্মৃতিচারণ করব। অবশ্যই তখন ন্যাসবির অভিজ্ঞ কর্মচারী এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবে এবং ‘ডেইলি বাজেট’ পত্রিকায় খবরটা বেরোলে রেবার্ন নিশ্চয়ই নিজেকে চিনতে পারবে না। 

মেয়েটি অত্যন্ত চতুর। তবে আমার বাড়িতে খুন হওয়া মেয়েটিকে চেনা মুশকিল। রুশী মেয়ে, নাম নাদিনা। অ্যানি বেডিংফিল্ডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত কিনা? ও বলেছিল সেটা কেবল একটা বিয়োগের ব্যাপার। আমার কাছে খবর আছে। ও ওর বাড়িতে ন্যাসবির কাছে টেলিগ্রাম করে সব জানিয়ে দিয়েছে। তার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু এক্ষেত্রে ওর শার্লক হোমসের কায়দা করাটা সম্পূর্ণ অবান্তর বলেই আমার ধারণা। 

আমি আবার বলছি, মেয়েটি মহা ধুরন্ধর, তা না হলে কায়দা করে আমার ব্যক্তিগত কম্পার্টমেন্টে উঠে বসতে পারে? 

কর্নেল রেস রেবার্নের ওপর পুলিসের সন্দেহের কথা বলছিল। সম্ভবত সোমবারের ট্রেনেই রোডেসিয়ায় সে চলে গিয়ে থাকবে। আফ্রিকা তার পরিচিত। মনে হয় সে কাফ্রি মেয়ের ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকবে। ওদিকে একজন সুপুরুষ যুবককে পুলিস খোঁজ করে থাকবে, 

যার কপালে ক্ষত চিহ্ন আছে। পরনে ইউরোপীয় পোষাক। এইভাবেই অনায়াসে সে পুলিসের চোখে ফাঁকি দিতে পারবে। 

অ্যানি বেডিংফিল্ড তার খোঁজে আছে। তাকে খুঁজে বার করার কৃতিত্ব নিতে চায় ও ‘ডেইলি বাজেট’ পত্রিকার মাধ্যমে। আমি ওকে বলেছি, এ কাজ মেয়েদের নয়। হেসে ও বলেছে, পুরুষদের গোঁড়ামি ও ভেঙে দিতে চায়। রেবার্নকে ধরিয়ে দিয়ে ও ওর ভাগ্য ফেরাতে চায়। রেসের কিন্তু এসব পছন্দ নয়। রেবার্ন যদি এই ট্রেনেই থাকে। তাহলে আমরা যে যার বিছানায় খুন হতে যাচ্ছি। মিসেস ব্লেয়ারকে কথাটা বলতেই হেসে বলেছে, সেই মৃত্যুকে সে সর্বান্তঃকরণে হাসিমুখে আহ্বান জানাবে, আর সে নিজে খুন হলে অ্যানির পক্ষে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করতে সুবিধে হবে। 

আমরা আগামীকাল সকালে বেচয়ানাল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে যাব। প্রতিটি স্টেশনে কাফ্রিছেলেরা কাঠের খেলনা বিক্রি করতে আসবে। মিসেস ব্লেয়ার এইসব খেলনার লোভ নিশ্চয়ই সামলাতে পারবে না। 

শুক্রবার সন্ধ্যা : 

শেষ পর্যন্ত আমার আশঙ্কা সত্য হল। দেখা গেল, মিসেস ব্লেয়ার এবং অ্যানি ঊনপঞ্চাশটা কাঠের খেলনা কিনেছে। 

(অ্যানির কাহিনী) 

।। তেইশ।। 

আমি রোডেসিয়ায় যাওয়ার পথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করলাম। এতদিন আফ্রিকা আমার স্বপ্নের দেশ ছিল। এখন আমি নিজের চোখে এই মনোরম দৃশ্য যতই দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি। হেক্র নদীর উপত্যকা সব থেকে বেশি আমার মন জয় করেছে। 

স্যার ইউস্টেসের সঙ্গে ভ্রমণ করতে গিয়ে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে, তাঁর দলের সঙ্গে ভ্রমণে আমার নিরাপত্তার দিকটা অনেক সুদৃঢ়। স্যার ইউস্টেসের পাশে পাশে থাকলে আমার বিপদের সম্ভাবনা নেই। তিনি এবং কর্নেল রেস আমার সদা সতর্ক প্রহরীর ভূমিকা নিয়েছেন। তাছাড়া এখানে থাকলে গাই প্যাগটকে খুব কাছ থেকে নজর দিতে পারব। মনে হয় এই প্যাগট লোকটাই সব রহস্যের মূল কারণ। সুজানের মনে কি আছে জানি না। মনে হয়, এই প্যাগট লোকটাই হয়তো তথাকথিত কর্নেল। সেক্রেটারি হিসেবে স্যার ইউস্টেসের মাধ্যমে সে রাতারাতি পাদপ্রদীপের আলোর সামনে এসে দাঁড়াতে চায়। 

যাই হোক, সুজানের মতামত ভিন্ন। তার ধারণা, সত্যিকারের ‘কর্নেল’ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে। হয়তো সে ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় পৌঁছে গিয়ে থাকবে। সুজানের অনুমান আমি একেবারে উড়িয়ে দিতে চাই না। সেইসঙ্গে আমার ধারণাটাও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে প্যাগটের গতিবিধি কখনোই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। 

আমি সুজানকে বললাম, আমার জানতে ইচ্ছে হয়, স্যার ইউস্টেস কি করে এত টাকা করলেন? 

—আবার ওঁকে সন্দেহ করছ? 

আমি এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে সবাইকে সন্দেহ করতে হয়। ওকে ঠিক সন্দেহ করি না, কিন্তু উনি যে প্যাগটের নিয়োগ কর্তা সে কথা ভুলি কি করে? তাছাড়া উনি বিরাট মিল হাউসের মালিক। 

—স্যার ইউস্টেস কিভাবে এই অর্থ উপার্জন করেছেন। তার কৈফিয়ত দিতে তিনি চিন্তিত নন, তবে তার মানে এই নয় যে, তাঁর রোজগার কোন অসৎ পথ দিয়ে হয়েছে। 

—একথা আমি বিশ্বাস করি না। 

সুজান বলল, কিন্তু তিনি তো সবকিছুই ব্যাখ্যা করেছেন। 

— হ্যাঁ, কিন্তু সে সব আমার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেমন সেদিন কিলমার্ডেন জাহাজ থেকে প্যাগট আমাকে ফেলে দিতে গিয়েছিল। এই ঘটনায় প্যাগটের সমর্থনে স্যার ইউস্টেসের ব্যাখ্যা হল—প্যাগট না কি রেবার্নকে অনুসরণ করছিল। রেবানই নাকি তাকে জাহাজ থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। আমরা জেনেছি, এসব কথা সত্য নয়। 

—কিন্তু আমার ধারণা প্যাগটের মুখ থেকে শুনলে হয়তো অন্য কাহিনী শুনতে পেতাম। কারণ মুখে মুখে অনেক কথা ছড়ায়, প্রকৃত ঘটনা ঠিক জানা যায় না। 

—না, আমি তা মনে করি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। প্যাগট নিঃসন্দেহে অপরাধী।

নিরালায় দুজনে পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলাম। এখন সব রহস্যের সমাধান আমার হাতের মুঠোয়। আর ‘ডেইলি বাজেট’ পত্রিকায় তো আমরা প্রচার মাধ্যমে কাজ করতে পারি। তবে এখুনি এগোতে চাই না। সে যে ‘বাদামী পোষাকের সেই লোকটি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী। আড়াল থেকে তাকে সাহায্য করলেও বাইরে থেকে আমি যে তার ঘোরতর বিরোধী এই ভাবটা ‘কর্নেল’ এবং তার লোকজন জানবে, রেবার্ন এবং আমার মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই সেই মার্লোর নিহত মেয়েটির খুনীর সঙ্গে। 

নিহত মেয়েটির পরিচয় এখনও অজ্ঞাত। লর্ড ন্যাসবিকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দেব, নিহত মেয়েটি রুশী নর্তকী নাদিনা। সেই মেয়েটি প্যারিসে নাচ দেখিয়ে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে দর্শনার্থীদের কাছে সে অপরিচিতা। নিহত মেয়েটির বিকৃত মুখের যে ছবি কাগজে প্রকাশিত হয়, তা দেখে তাকে সনাক্ত করা যায় না। তাছাড়া নাদিনা তার ইংলন্ডে যাওয়ার খবরটা গোপন রেখেছিল। খুন হওয়ার পরদিন তার ম্যানেজার তার কাছে থেকে একটা চিঠি পায়। তাতে লেখা, ব্যক্তিগত কারণে সে রাশিয়ায় ফিরে যাচ্ছে। সে যেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার চুক্তি খেলাপের ব্যাপারে বোঝাপড়া করে। 

অনেক পরে আমি এসব খবর পেয়ে সুজানের সঙ্গে পরামর্শ করে ‘দে আর’ থেকে টেলিগ্রাম পাঠাই লর্ড ন্যাসবির কাছে। এই চাঞ্চল্যকর খবরের সংস্পর্শে আসে ‘ডেইলি বাজেট’। এই পত্রিকায় এই প্রথম এমন চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করে লেখে, মিল হাউসের খুনের শিকারকে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা চিনতে পেরেছে। আমাদের সংবাদদাতা খুনীর সঙ্গে একই জাহাজে ভ্রমণ করেছে। বাদামী পোষাকের সেই লোকটি, তার সত্যিকারের রূপ কী? কে সে? 

আসল ঘটনাটা দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদপত্রগুলোতে টেলিগ্রাম করে জানানো হয়। বুলাওয়েতে টেলিগ্রাম মারফত আমি আমার কাজের সম্মতি এবং নির্দেশ পাই। আমি এখন ‘ডেইলি বাজেটের’ একজন বিশেষ সংবাদদাতা। লর্ড ন্যাসবি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। আমাকে অবশ্য প্রকৃত খুনীর পিছনে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। আমি, কেবল আমিই জানি যে, হ্যারি রেবার্ন খুনী নয়। পৃথিবী জানুক সে-ই খুনী—বর্তমান অবস্থায় সেটাই হবে সব থেকে ভালো ব্যবস্থা। 

।। চব্বিশ।। 

আমরা শনিবার সকালে বুলাওয়ে পৌঁছলাম, জায়গাটা আমাকে নিরাশ করল। স্যার ইউস্টেসও বিরক্তবোধ করলেন। তারপর থেকে স্যার ইউস্টেস ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো সবার ওপর রাগে ফেটে পড়লেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে মায় তার নতুন সেক্রেটারি মিস পেটিগ্রিউ-এর ওপরেও। 

আমরা সবাই ম্যাটা পোজ-এ যাব রোডেসের সমাধিক্ষেত্র দেখতে কিন্তু যাত্রার সময় স্যার ইউস্টেস বেঁকে বসলেন তিনি যাবেন না। অতএব তার সেক্রেটারিও জানাল, সে-ও যাচ্ছে না। কারণ স্যার ইউস্টেস কখন তাকে নোট দিতে ডাকে কে জানে। সুজান মাথা ধরেছে বলল। শেষ পর্যন্ত আমি এবং কর্নেল রেস রওনা হলাম। 

কর্নেল রেস অদ্ভুত লোক, লোকের ভিড়ে তাকে ঠিক চেনা যায় না, তাকে একা পেয়ে চিনতে পারলাম। এখন তার মুখে কোনো কথা নেই। লোকটাকে আমার আদৌ পছন্দ হয় না। ম্যাটাপোজের মতো নির্জন জায়গায় তার সান্নিধ্য আমাকে ভাবিয়ে তুলল, হঠাৎ কোনো বিপদ এলে কে আমাকে রক্ষা করবে। পথে একটা পাথরের টিলা পার হতে পারছিলাম না, সে আমাকে খেলার পুতুলের মতো তুলে হাল্কা চালে সেই টিলাটা পার করতেই আমি চমকে উঠলাম, কে এত শক্তির অধিকারী লোকটা? তার পরবর্তী প্রকাশ ভঙ্গিমার অপেক্ষায় থাকলাম। 

—হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রশ্ন করল, মিস বেডিংফিল্ড, সত্যি করে বলুন তো এখানে আপনি ঠিক কী করতে এসেছেন? 

—কেন, আমি তো আগেই বলেছি, আমি জিপসী মেয়ে, পৃথিবী দেখতে এসেছি। 

—হ্যাঁ, সেটা যথেষ্ট সত্য বটে। খবরের কাগজের সংবাদদাতার ভূমিকাটা একটা মিথ্যে ওজর মাত্র। সাংবাদিকতা আপনার পেশা নয়। আপনার নিজের খেয়ালে, পৃথিবীতে জানতে এখানে এসেছেন, কিন্তু আমি বলব সেটাই সবকিছু নয়। 

দারুণ ভয় পেয়ে ভালো করে তার মুখের দিকে তাকালাম। তার মতো আমার চোখ কোনো কিছু গোপন রাখতে পারে না। তবে শত্রুর দেশে এসে যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারে। 

—আর কর্নেল রেস, আপনি এখানে কী করতে এসেছেন? 

প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও পরে সামলে নিয়ে সে বলল, আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য, কেবল তার জন্য। 

—কিন্তু ওরা যে বলে, আপনি সরকারের সঙ্গে যুক্ত, আপনি সিক্রেট সার্ভিসে আছেন, এ কথা কি সত্য? 

—মিস বেডিংফিল্ড, আমি এখানে এসেছি আমার ব্যক্তিগত আনন্দ উপভোগ করতে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। 

তারপর ফেরার পথে চুপচাপ জানালা পথে আফ্রিকার আদিম যুগের মানুষের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি, আর ভাবি কী আশ্চর্য। আজও এখানে সভ্যতার আলোকপাত ঘটেনি। হঠাৎ রেস আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, মিস বেডিংফিল্ড, আপনি কি কখনো কারোর প্রেমে হতাশ হয়েছেন? 

—না, ঠিক তা নয়, তবে আপনি সেরকম ভেবে নিতে পারেন। 

না, আমার তা মনে হয় না, আপনি কারো প্রেমে পড়েছেন? 

আমাকে নিরুত্তর দেখে একসময় সে আমার একটা হাত তার কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, অ্যানি, আমি তোমাকে চাই। তুমি আমাকে বিয়ে করবে? 

আমি তার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরে সরে বসলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম। না, না, আমি পারব না। আমি আপনাকে ঠিক ওভাবে চিন্তা করতে পারি না। আমি 

আপনি কি অন্য কারোর অনুরক্ত— 

হ্যাঁ, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। ক্ষমা করবেন। 

—তাই বুঝি? আর সেই ভালোবাসার সূত্রপাত কিলমার্ডেন জাহাজ থেকে। এই তো? 

—সেই রকমই ধরে নিতে পারেন। 

—তাই নাকি? কেমন যেন ব্যাঙ্গের সুরে বলল। 

—তার মানে আপনি কি বলতে চান? 

দুর্ভেদ্য চাহনিতে এমনভাবে তাকাল যেন সেই দৃষ্টি দিয়ে আমাকে গিলতে চাইছে। 

—ভাবছি। এখন আমার কী করা দরকার? 

দারুণ ভয় পেয়ে গেলাম। এক অজানা আশঙ্কায় আমার শরীরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। বাকি পথ আর কোনো কথা হল না। হোটেলে ফিরে সুজানের কাছে এসে আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা নামল। 

—কী ব্যাপার, অ্যানি সোনামণি, তোমার চোখে জল কেন? 

—ও কিছু নয়, রোডেসের সমাধির কথা মনে হতে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হয় আমার জীবনেও সেইরকম অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসছে। 

ছিঃ ছিঃ! ওরকম ছেলেমানুষী কোরো না। তার চেয়ে এসো, হীরেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমি তোমার বন্ধু, তাই সবাই আমাকেও সন্দেহের চোখ দেখছে। হীরেগুলো কোথায় রাখা যায় ভাবতে হবে। 

—নতুন করে ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই। ফিল্ম রোলের মধ্যেই ওগুলো যথেষ্ট নিরাপদে আছে। প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চাইলাম। 

আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আমার জীবনে একটা অশুভ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, বেশি দেরি নেই। ঘুম আসছিল না। 

হঠাৎ দরজায় ‘নক্’ করার শব্দে চমকে উঠে দরজা খুলতেই দেখি, একজন কাফ্রি যুবক দাঁড়িয়ে, হাতে একটা চিরকুট। আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কিন্তু সেই লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। সেটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে নিজের বিছানায় ফিরে ছোট্ট চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম : 

“তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তোমার হোটেলে গিয়ে দেখা করার ভরসা পেলাম না। ১৭ নম্বর কেবিনের ঘটনার কথা স্মরণ করে এসো। হ্যারি রেবার্নকে মনে আছে তো? আমি সেই লোক….” 

তখন আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়, তাহলেও এখানেই আছে? ও হ্যাঁ, সে তো অনেক আগে থেকেই জানতাম। তাহলে আমি ওর কাছাকাছি এসে গেছি। স্বৰ্গীয় এক আনন্দে আমার মনটা নেচে উঠল। হ্যাঁ, আমি যাব প্রিয়তম। রেবার্ন আমাকে সামনে তালগাছের বনে যেতে লিখেছে। জায়গাটা নির্জন তা হোক, আমি অবশ্যই যাব। 

নিঃশব্দে পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম। সুজান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্যার ইউস্টেস তখন তার অফিস ঘরে মিস পেটিগ্রিউকে নোট দিচ্ছেন। নিঃশব্দে সেখান থেকে রেসের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি ঘর ফাঁকা। লাউঞ্জেও তার দেখা পেলাম না। লোকটাকে আমার ভীষণ ভয় হয়। তবু দ্রুতপায়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কিনা। 

কিন্তু কয়েক পা এগোতেই মনে হল আমাকে কেউ অনুসরণ করছে। মনে হয় সে এখানেই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। তখনি কিলমার্ডেনে সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা আমার মনে পড়ে গেল। বিপদের গন্ধ পেয়েও আমি আমার গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে গেলাম। 

অন্ধকার অমাবস্যার রাত, কিছুই চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকাই, অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাই না। এক সময়ে খুব কাছাকাছি একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখে শিউরে উঠলাম। লম্বাটে চেহারা ইউরোপীয় সে, আমি তখন লোকটার ওপর দৃষ্টি রেখে ছুটতে লাগলাম। 

হঠাৎ আমার পা দুটো আর যেন নড়তে চাইল না। আমার পিছনের লোকটা তখন শব্দ করে হেসে উঠল, বিকট সেই হাসির শব্দ। কানে তালা লেগে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আর ঠিক তখনি আমার মাথার পিছনে প্রবল একটা আঘাত পেলাম। আর কিছু মনে নেই।