১১.
হারকিউল পৈরট জুতো থেকে সর্বশেষ ধুলোকণাটি ঝেড়ে ফেলে দিল। সে খুব যত্নসহকারে লানচন-পার্টির জন্য পোষাক চড়িয়েছে, তার বেশভূষা ভালো হওয়ায় মনের দিক থেকে সেও খুশী। সে জানত, ইংল্যান্ডের গ্রামে রবিবারে কেমন পোষাক ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ইংরেজি ধারণার বশবর্তী সে নয়। তার কাছে শহরতলীর চতুরতা অনেক বেশী পছন্দের। ইংল্যান্ডের পল্লীর ভদ্রলোক সে নয়। সে হারকিউল পৈরট! সে অবশ্য এটাই স্বীকার করে যে, পল্লীগ্রাম তার কোনোদিন পছন্দের ছিল না। কিন্তু বন্ধুদের অনুরোধ সে উপেক্ষা করতে পারেনি বলেই বিশ্রামাগার কিনতে সে দ্বিধা বোধ করেনি। এই বিশ্রাম আশ্রয়ের আকারটাই তার খুব পছন্দ, আর কোনো বিষয়ে তার আসক্তি নেই। চৌকো বাক্সের মতোই এই বাড়িটা, পারিপার্শ্বিকের দৃশ্যও খুব মনোরম, হারকিউল জানতো যে, প্রাকৃতিক দৃশ্য যখন ভালো তো হবেই–তাতেও তার মন ওঠে না, কারণ গাছপালার বিন্যাসে তার রুচি কোনোদিনই ছিল না–কেমন যেন বুনো-বুনো। গাছের পাতা ঝরানোকে সে ভাবে নোংরা স্বভাব–এই জন্যই সে গাছ তেমন কোনোদিনই পছন্দ করে না, পপলার গাছকে সে বরদাস্ত করতে পারে। এই অবসর বিনোদনের পোতাশ্রয়ের মধ্যে তার কাছে সব থেকে আকর্ষণীয় হলো–ছোট সবজির বাগানটি–বেলজিয়ামের মালী ভিক্টরের নিপুণ হস্তের পরিচ্ছন্ন কাজ। ইতিমধ্যে ফ্রাঙ্কয়েস, মালীর স্ত্রী, সযত্নে মালিকের পাকস্থলির সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে।
হারকিউল পৈরট সদর দরজা পেরিয়ে যায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর একবার নিজের চকচকে জুতোজোড়ার দিকে তাকাল, পাংশু-ধূসর হমবর্গের হ্যাঁটের সঙ্গে কোনো মিল হচ্ছে কিনা পুনরায় আরও একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, এবং রাস্তার এদিকে-ওদিকে তাকাতে থাকল।
ডাভকোট দেখার পর সে চমকে ওঠে। ডাভকোট এবং রেস্টহেভন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই নির্মাতার তৈরি। একটা বাক্সে ছাদ দিয়ে নানাধরনের আধুনিক কলাকৌশলে বানানো হয়েছে রেস্টহেভন। অর্ধেক কাঠ ব্যবহার করে প্রাচীন যুগের সব কারুকার্য যেন একত্র করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট ডাভকোট বাড়িটাতে। ন্যাশনাল ট্রাস্ট আর তার বেশি কিছু করতে দেয়নি, তার কারণ, তাদের মনে ভয় ছিল, পল্লীর শ্রী এতে বিঘ্নিত হতে পারে। দুটি বাড়ি যেন চিন্তাশীল দুই ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টির ফল।
হারকিউল পৈরট আপন মনেই মহড়া দিতে শুরু করে দেয়, সে কীভাবে ‘হলোতে গিয়ে উপস্থিত হবে। তার অজানা ছিল নামে, একটু উপরের দিকে একটা গেট এবং একটা পথও আছে। এই পথ সদর রাস্তার চাইতে অন্তত আধমাইল দূরত্ব কমিয়ে দিতে পারে। আদবকায়দায় পটু হারকিউল পৈরট দীর্ঘপথটা ধরেই এগিয়ে চলল এবং সদর দরজা দিয়েই অন্দরমহলে প্রবেশ করল।
স্যার হেনরি এবং লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের বাড়ি পৈরটের এটাই বোধহয় প্রথম আগমন। যেভাবে নিমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিদের সদর দরজা দিয়ে আসাটাই আধুনিক কালের ফ্যাশন।
নিমন্ত্রিত হয়ে পৈরট মনে মনে বেশ খুশীই হয়েছিল। তাছাড়া, বাগদাদ থেকে এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ওপরই বরাবরই তার ধারণা খুব ভালো ছিল, বিশেষ করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের ওপর।
ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মিলিয়ে পৈরট এসে হাজির হল। সে যখন সদর দরজার ঘন্টায়। হাত রাখল, ঘড়িতে তখন একটা বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি। মনে মনে সে খুবই খুশী কারণ সময় বুঝেই সে উপস্থিত হতে পেরেছে। এতটা পথ হেঁটে আসার জন্য শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগছিল, হাঁটার ব্যাপারে কোনোদিনই অভ্যাস নেই।
সুসজ্জিত পোষাকে গাজন এসে দরজা খুলে দিল, পৈরট মনে মনে বেশ খুশীই হয়। কিন্তু যেমন অভ্যর্থনা সে মনে মনে আশা করেছিল, অভ্যর্থনাটা তেমন ভাবে না পেয়ে সে একটু মুষড়ে গেল।
গৃহকত্রী সুইমিং পুলের কাছে একটা তাবুতে আছেন, আপনি কী স্যার কষ্ট করে এদিকে একবার আসবেন? গাজন বলে ওঠে!
ইংরেজদের বাড়ির বাইরে বসে থাকার প্রবৃত্তি দেখে হারকিউল পৈরট বরং ক্ষুব্ধই হয়। গ্রীস্মাধিক্যের সময় এই খেয়াল সহ্য করা গেলেও এই সেপ্টেম্বরের শেষে সে সুযোগ কোথায়! দিনটায় ঠান্ডার আমেজ থাকলেও হাওয়ায় যেন একটা আর্দ্রতা–শরতে প্রায়ই এমনটা দেখা যায়। এই সময়টা অগ্নিকুণ্ড মুক্ত বসবার ঘরটাই যথেষ্ট আরামদায়ক। কিন্তু ফরাসি জানলা দিয়ে একটা মুক্ত জায়গার ভেতর দিয়ে রকারি পেরিয়ে একটা ছোট দরজার মধ্যে দিয়ে বাদাম গাছের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা গিয়েছে তাকে সেই পথেই নিয়ে যাওয়া হল।
এ্যাঙ্গক্যাটেলদের বরাবরই অভ্যাস একজন অতিথিকেই নিমন্ত্রণ করা এবং আবহাওয়া ভালো থাকলে ককটেল পার্টিও সুইমিং পুলের পাশের তাবুতেই অনুষ্ঠিত হয়। লাঞ্চ টাইমের সময় অবশ্য একটা তিরিশ মিনিটে, তাই এ সময়ের মধ্যে অনিয়মানুবর্তী অতিথিও এসে উপস্থিত হবে।
হারকিউল পৈরটের কাছে ব্যবস্থা বেশ ভালো বলেই মনে হয়। নিমেষের মধ্যে তার মনে হল যে, যেখান থেকে সে শুরু করেছে সেখানে আবার ফিরে যাবে।
নিজের জুতোর প্রতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সে গাজনকে নিঃশব্দ অনুসরণ করল।
ঠিক এই সময়ে সামনের দিক থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল। এরজন্য পৈরটের বিরক্তি বোধহয় আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। এই ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অযৌক্তিক অনুচিত মনে হতে থাকল। পরে যখন সে এই অবস্থার কথা ভাবল, সেই সময়ে ভয়, হাতাশা আর বিস্ময়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল। সে শুধু এইটুকু বলতে পারে যে, এই ব্যাপারটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত।
হারকিউল পৈরট সুইমিং পুলের চতুর্দিকের মুক্ত স্থানে পা রাখতেই চমকে ওঠে। ক্রোধে সে তখন শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। পৈরটের মনে হয়, বাড়াবাড়ির মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে–হ্যাঁ, খুব বেশিই মনে হচ্ছে। এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সে এত সস্তা মনের ভাবে না। অনেকদূর হেঁটে আসা-বাড়িতে বিমুখ হওয়া–এখন আবার সেই একইরূপের বাহার। ইংরেজদের সত্যিই কী অশোভন কৌতুক।
সে এত ভীষণভাবে রেগে গিয়েছিল এবং এমনভাবে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে এই কৌতুকের মাধ্যমেই।
সে যেন একটা কৃত্রিম হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। পুলের পাশে কৃত্রিমভাবে সজ্জিত হয়ে পড়ে আছে একটি প্রাণহীন দেহ, বাইরে থেকে হাতটা এলিয়ে পড়েছে এবং লাল প্রসাধন যেন কংক্রিট থেকে পুলের নীল জলে গড়িয়ে পড়েছে। মৃতদেহটা এক সুদর্শন পুরুষের যার মস্তকে সুন্দর চুলের কেশরাজি। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী বেঁটে সুডোল এক স্ত্রীলোক যার হাতে ধরা রিভলবার। তার মুখ জুড়ে বিরাজমান অদ্ভুত উদাস এক অভিব্যক্তি।
আরও তিনজন অভিনেতা ছিলেন। দূরে পুলের ঠিক ধারে দাঁড়িয়েছিল এক যুবতী, যার মাথার কেশ গাঢ় বাদামী রঙা শরতের পাতার সাদৃশ্য টেনে আনছিল, তার হাতে ধরা ছিল ঝুড়ি ভরা ডালিয়া ফুল। একটু দূরত্বে লম্বা দেহের একজন ভদ্রলোককে চোখে পড়েছিল, পরনে ছিল শিকারীর কোট। বন্দুক হাতে সে দাঁড়িয়েছিল। তার ঠিক বামদিকে দাঁড়িয়ে আছে এক বাস্কেট ডিম হাতে গৃহকত্রী, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল। হারকিউল পৈরটের কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সুইমিং পুলের চতুর্দিক থেকে অনেক রাস্তা এসে সেখানে মিশেছিল। ব্যাপারটা ছিল কিছুটা গাণিতিক এবং কিছুটা কৃত্রিম। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে এখন কী করবে? তারা তার কাছ থেকে কি আশা নিয়ে এসেছিল? সে কি এই অপরাধ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে না বিশ্বাসের ভান করবে? সে কি হতাশা না ভয় প্রকাশ করবে? সে কি তার গৃহকর্তাকে বলবে, আঃ, ইহা খুব রমণীয়, আমার জন্য আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আসলে, সমস্ত ব্যাপারটা ঘটেছে অনেকটা নির্বোধের মতোই। রানী ভিক্টোরিয়া নাকি বলেছিলেন, আমরা হাসি-তামাসা-আনন্দটুকু পর্যন্ত করতে পারলাম না। পৈরটের মুখে ঠিক ঐ ভাষাই এসে উপস্থিত হয়েছিল, আমি পৈরট, কৌতুক বা আনন্দ বোধ অনুভব হয় না।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মৃতদেহের দিকেই এগিয়ে গেলেন। তাকে অনুসরণ করতে করতে গাজন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। পুলের অন্যদিক থেকে দুজন লোক এগিয়ে আসছিল, তারা এখন নিকটে এসে দাঁড়ায়।
পৈরটের একবার মনে হলো, সে যেন ছায়াচিত্রের ছবি দেখানোর উদ্দেশ্যে এখানে হাজির হয়েছে। কিন্তু তবু সে উপলব্ধি করল, কৃত্রিমতার মধ্যেও একটা সত্য লুকিয়ে আছে।
নিচে পড়ে থাকা লোকটির দিকে তার চোখ গেল, সে ভালোভাবে তাকে প্রত্যক্ষ করল মৃত, না হলেও মৃতের সমান।
রিভলবার হাতে যে লোকটি মৃতদেহের পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল, পৈরট একবার তার দিকে তাকাল। তার মুখে অনুভূতির লেশমাত্র নেই–সম্পূর্ণ উদাস দৃষ্টি। নেহাতই এক নির্বোধের মতন মুখ করে সে দাঁড়িয়েছিল।
সে ভাবে, সত্যি কী অদ্ভুত!
গুলি ছুঁড়ে সে কি সবকিছু হারিয়ে বসেছে? সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতি কি নিঃশেষ হয়ে গেল? বর্তমানে তার অবস্থা কি একটা গুলির মতোই মূল্যহীন ও অসাড়? এখন হয়তো তার হাবভাব ঐরকমটাই হয়ে গিয়েছে।
পরে সে গুলিবিদ্ধ লোকটার দিকে একবার দৃষ্টি দিল। মৃত্যুপথযাত্রীর হা-হা করছিল চোখগুলো। তার সুগভীর নীল চোখে অভিব্যক্তির এমন বিচিত্র রূপ ফুটে উঠেছিল যেটা পড়তে পৈরটের মতো লোকেরও অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু তাকে সে গভীর সতর্কতা বা অবগতি বলেই বর্ণনা করেছিল।
কিন্তু হঠাৎ করে পৈরটের মনে হলো যে, এখানে উপস্থিত সব লোকের মধ্যে একজনকে দেখেই জীবন্ত বলে মনে হচ্ছিল–যে লোকটি মৃতপ্রায় তাকে এই মুহূর্তে প্রকৃত জীবন্ত বলেই মনে হচ্ছিল পৈরটের। জীবনের এমন সুন্দর অভিব্যক্তি, এমন নিখুঁত প্রকাশ এর আগে আর কোনো লোকের মধ্যে পৈরট প্রত্যক্ষ করেনি। অন্যসব অভিনেতা যেন বিবর্ণ, শ্রীহীন এবং ছায়ার মতো। কিন্তু প্রকৃত লোক বলতে ছিল এই ব্যক্তিই।
জন ক্রিস্টো মুখ খুলল এবং কথা বলল। তার স্বর ছিল সবল, বিস্ময়হীন এবং দরকারী। সে বলে ওঠে-হেনরিয়েটা
এই কথা বলার পরে তার চোখের পাতা বুজে গেল, তার মাথা পাশে ঝুলে পড়ল।
হারকিউল পৈরট হাঁটু গেড়ে বসল, নিশ্চিত হওয়ার পরেই উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রচালিতের মতো নিজের পোযাকের ধুলো ঝেড়ে সে বলে ওঠে, হা, সে আর বেঁচে নেই।
ছবি ভেঙে গেল, কেঁপে উঠল এবং নতুন রশ্মিসম্পাতে পুনর্গঠিত হল। এখন তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হল ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া–খুব সাধারণ তুচ্ছ ঘটনাসমূহ। পৈরট নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট সজাগ ছিল। কান আর চোখ খোলা রেখেছে–এই দুটোর সাহায্যেই সে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে।
একটা ব্যাপার সে লক্ষ্য করছিল যে, লেডি এ্যাক্যাটেলের হাত থেকে ডিমের ঝুড়িটা পড়ে যাচ্ছিল–তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এসে গাজন ধরে নেয়। যন্ত্রচালিতের মতো গাজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইতস্তত হয়ে বলে ওঠেন, জার্দা
রিভলবার হাতে স্ত্রীলোকটি নড়ে চড়ে বসল। সে তার চারপাশে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। সে কথা বলছিল–কিন্তু ভাষা কিছুই বোধগম্য হল না–অবিন্যস্ত কতগুলো বিক্ষিপ্ত আওয়াজ শুধু শোনা গেল।
সে বলে ওঠে, জন মারা গেছে, জন আর বেঁচে নেই।
তড়িৎগতিতে কটা চুলের লম্বা যুবতীটি আভিজাত্যের ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলে ওঠে, জার্দা, ওটা আমার কাছে দাও।
পৈরট কোনোরকম বাধা দেবার আগেই জার্দা ক্রিস্টোর হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিল।
পৈরট তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবার আশায় অগ্রসর হল। সে বলে ওঠে, আপনার এমন করা মোটই উচিত নয় মহাশয়া।
যুবতীটি তার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ চমকে যায়, তার হাত থেকে রিভলবারটা সোজা এসে পুলের জলে পড়ে।
অত্যন্ত অপ্রস্তুতের সঙ্গেই সে ওঃ!’ বলে পৈরটের দিকে ক্ষমাপ্রার্থীর মতোই তাকিয়ে রইল। পরে শুধু বলল, আমি কি এতই বোকা! আন্তরিকভাবে অমি দুঃখিত!
কিছুক্ষণের জন্য কোনো কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না পৈরট। সে একজোড়া জলভরা চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল এবং ভেবেও নিল, তার সাময়িক সন্দেহ অমূলক কিনা। সে আস্তে আস্তে ধীরে সুস্থে কোনোরকমে উচ্চারণ করে, কোনো জিনিস স্পর্শ করা বোধহয় উচিত হবে না। সবকিছু যেমন আছে, ঠিক তেমনি ভাবে রেখে দিতে হবে–পুলিস এসে স্বচক্ষে দেখবে।
সবার মধ্যে তখন চাপা উত্তেজনা দেখা দিল–একটা অস্বস্তি যেন চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মৃদুস্বরে বলে ওঠেন, অবশ্য–আমার মনে হয়, হা, পুলিসই
শিকারীর কোট পরনে লোকটা বলে ওঠে, আমার ভয় হচ্ছে, লুসি, এই ঘটনাটা হয়তো ঘটতই।
সেই নীরবতার মধ্যেও পদশব্দ এবং গোলমাল কানে এল। সেই পথ ধরে সার হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং মিডগে হার্ডক্যাসল হাসতে হাসতে এদিকেই এগিয়ে আসছিলেন।
পুলের ধারে লোকদের দেখামাত্র তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি? কী হয়েছে?
তার স্ত্রী বললেন, জার্দা–পরে তাড়াতাড়ি করে বলে ফেললেন, আমি বলছি–জন—
হতবুদ্ধির মতো মুখ করে বলে ওঠে, গুলি করে জনকে মারা হয়েছে। সে আর বেঁচে নেই।
সকলে বিব্রত হয়ে তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠেন, আমার মনে হয়–এই সময়ে জার্দার গিয়ে শুয়ে পড়া উচিত। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের সকলেরই উচিত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। হেনরি তুমি আর পৈরট এখানে হাজির থেকে পুলিসের জন্য অপেক্ষা করতে পার।
সেটাই বরং একপক্ষে ভালো হবে। গাজন, তুমি বরং পুলিসকে একটা ফোন করে দাও, যা যা ঘটেছে তা বলে দিও, পুলিসকে এখানেই নিয়ে আসবে।
লম্বা দেহের লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, এসো জাদা, এই বলেই সে অন্য স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। জার্দা যেন স্বপ্নের ঘোরে তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। গাজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সকলকে যাবার নির্দেশ দিয়ে ডিমের ঝুড়ি হাতে নিঃশব্দে তাদের অনুসরণ করল।
স্যার হেনরি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন, এসব কী ব্যাপার? আসলে কী ঘটেছে?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মিছিমিছি হাত-পা নেড়ে অসহায়ের ভঙ্গি করলেন। হারকিউল পৈরট মাধুর্য এবং আবেদন উপভোগ করছিল।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ঠিক কী ঘটেছে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কারণ মুরগী নিয়ে আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বেশি দূরে, নয় খুব কাছ থেকেই একটা গুলির আওয়াজ কানে এসেছিল, তখন আমি এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছুই ভাবতে পারিনি, পরে পুলের কাছে আসতে চোখে পড়ল জনের নিথর দেহ এবং জার্দা রিভলবার হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এইসময় হেনরিয়েটা এবং এডওয়ার্ড সেখানে এসে উপস্থিত হল।
পুলের অন্য প্রান্তে যেখানে বনের রাস্তা দুটো এসে এক হয়েছে, সেই স্থানটা তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
হারকিউল পৈরট এবার মুখ খোলে। সে জানতে চায়, এরা কারা? জন এবং জার্দা? আমি . কি জানতে পারি?
-হা, হা নিশ্চয়ই। এই দুর্ঘটনার জন্য কারো সঙ্গেই আর পরিচয় হয়ে ওঠেনি। জন হল ক্রিস্টো, ডাক্তার ক্রিস্টো। জাদা ক্রিস্টো তার স্ত্রী, জবাবে বলে ওঠেন লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল।
যে স্ত্রীলকোটি মিসেস ক্রিস্টোর বাড়ি গেলেন, তবে উনি কে?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমার খুড়তুতো বোন, হেনরিয়েটা স্যাভারনেক।
পৈরটের বাঁ-দিক থেকে একটা গোলমাল কানে আসতে লাগল। পৈরট ভেবে নেয়, হেনরিয়েটার এটা বলা বোধহয় উচিত নয়, সে অবশ্য ভবিতব্য রূপেই জেনে ফেলেছে।
মুমুর্মু লোকটা ‘হেনরিয়েটা’ কথাটা কোনোক্রমে উচ্চারণ করেছিল। তার বলার কায়দাটা ছিল সত্যিই অদ্ভুত…বলার ভঙ্গিটা এমন ছিল যে পুরোনো অনেক কথা পৈরটকে স্মরণ করিয়ে দেয়…এই সময়ে একটা ঘটনার কথা তার মনে পড়ে যায়…একথার অর্থ কী? মৃত্যুপথযাত্রী কী বলতে চেয়েছিল?..হেনরিয়েটাকে জন কি কিছু বলতে চেয়েছিল?…লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ইনি আমাদের এক খুড়তুতো ভাই এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং মিস হার্ডক্যাসেল।
পৈরট মাথা নত করে তাদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব সারলেন। বিকারের মতো হাসি হাসছিল মিডগের মুখে, সে কোনোরকমে অতিকষ্টে হাসি দমন করে। স্যার হেনরি বলে ওঠেন, আমার মনে হয়, আমার পরামর্শ অনুযায়ী তোমাদের এখন বাড়ি যাওয়াই উচিত। আমার মিস্টার পৈরটের সঙ্গে দু-একটা বিষয়ে আলোচনায় বসা প্রয়োজন।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল চিন্তিতমুখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বলে ওঠেন, জার্দা বোধহয় শুয়ে পড়েছে। এর থেকে বেশি আর কী বলা যেতে পারে তাকে? আমার কিছুতেই মাথায় আসছে না। এরকম একটা ঘটনা সত্যি বড় একটা ঘটে না। যে স্ত্রী লোক ঠান্ডা মাথায় এইমাত্র তার স্বামীকে খুন করেছে, তাকে আর কী বলা যায়?
প্রশ্নের জবাবের আশায় তিনি তার দিকে উদগ্রীব নয়নে তাকিয়ে রইলেন। পরে অবশ্য বাড়ি ফিরে গেছেন। মিডগে তাকে অনুসরণ করেছে।
পৈরট স্যার হেনরির সঙ্গেই থেকে গেল।
হেনরি সর্বপ্রথম কথা বললেন, তিনি কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলেন না, কী বলা তার উচিত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ক্রিস্টো নিঃসন্দেহে উপযুক্ত ব্যক্তি–খুবই ভালো এবং অত্যন্ত উপযুক্ত…।
পৈরট আরও একবার মাটিতে পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকাল। তার এখন মনে হচ্ছে যে, মৃতলোকটি এখনও জীবন্ত লোকদের থেকে অনেক বেশি জীবন্ত। সে এই ভেবে অবাক হয় যে, তার মানে কেন এমন ধারণা হল! ভদ্রমুখেই সে হেনরিকে বলে, এমন একটা ঘটনা সত্যিই বড় মর্মান্তিক।
স্যার হেনরি বলে ওঠেন, এসব ব্যাপার সম্পূর্ণ আপনার লাইনে পড়ে, আমার লাইনের নয়। আমার তো কেবলই মনে হচ্ছে এরকম একটা হত্যাকাণ্ডের এত কাছে এসে এর আগে কোনোদিন বোধহয় আসিনি। আশা করি, এতক্ষণ ধরে আমি যে পথে হেঁটে চলেছি, সেটা ঠিক পথই ছিল। কি বলেন?
পৈরট বলে ওঠে, হা, নিয়মানুসারে ঠিক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। পুলিসকে খবর দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না পুলিস এসে পৌঁছচ্ছে, আমাদের কিছুই করণীয় নেই–শুধু একটা বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কেউ যেন মৃতদেহটার নিকটে না যেতে পারে বা সাক্ষ্য প্রমাণের অবলুপ্তির কোনো কারণ না ঘটে।
শেষ শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ই পৈরট একবার মৃতদেহটার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, রিভলবারটা ঠিক জলের নিচে কংক্রিটের ওপর পড়ে আছে, নীল জলে কিছুটা হয়তো বিকৃত হয়েছে।
সে ভাবে, সে বাধা দেবার আগেই পূর্বের প্রমাণাদি সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু না–সেটা একটা নিছক দুর্ঘটনা।
স্যার হেনরি বিরক্তির সুরে মৃদুকণ্ঠে বলে ওঠেন, তাহলে একবার ভেবে দেখুন, আমাকে কী ব্যাপার না সামলাতে হচ্ছে? ঠান্ডা বোধহয় একটু বেশি পড়েছে, আসুন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে বরং বসি। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা বহুক্ষণ ধরে পায়ে এসে ঠেকায় অত্যধিক শীতে সে কাঁপছিল, এই প্রস্তাবে তাই সে সানন্দেই রাজী হয়ে যায়।
তাবুটা পুলের ঠিক পাশেই ছিল এবং তাবু থেকে পুল, মৃতদেহটা এবং বাড়ি যাওয়ার রাস্তা–যে পথ দিয়ে পুলিস আসবে, সবই চোখে ধরা পড়ছিল।
তাবুটা সুন্দরভাবে চেয়ার-টেবিল দিয়ে সজ্জিত এবং মদ্যপানের সুবন্দোবস্তও এখানে মজুত ছিল। সুচিত্রিত টেবিলে ট্রেতে গ্লাস রাখা এবং তার পাশেই ছিল শেরি ইত্যাদি মদের বোতল। ককটেল হওয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত স্থান, এখানে ককটেল হওয়ার কথা ছিল।
স্যার হেনরি বলে ওঠেন, একটু পান করলে কেমন হয়? না থাক, পুলিস না আসা পর্যন্ত আমাদের এখানকার কোনো জিনিষই স্পর্শ করা উচিত নয়। অবশ্য এই কনকনে ঠান্ডায় একটু কিছু পান না করলে পুলিসের খুব অসুবিধার কারণ কিছু ঘটবে না, তবু কিছু না করাই সবদিক থেকে নিরাপদ। গাজনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে এখনও ককটেলের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। সে বোধহয় আপনাদের প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল।
দু’জনে দুটো কঞ্চির চেয়ার অধিকার করে দরজার কাছে এসে বসলেন, পুলিসের আবির্ভাবের দৃশ্যটা যাতে তাদের চোখে ধরা না পড়ে।
তারা নীরবে বসে রইলেন। এমনও অনেক সময় আসে, কোনো কিছু বলার মতো ক্ষমতা যখন মানুষের থাকে না।
পৈরট তাবুর সর্বত্র খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার কাছে অস্বাভাবিক ধরনের কিছু নজরে পড়ে কিনা। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে, একটা চেয়ারের পেছন দিককার পোষাকের গলদেশের অংশে–একটা প্ল্যাটিনাম ফক্স। সে এই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, এটা কার হতে পারে। বাহ্যাড়ম্বরপ্রিয়, আত্মপ্রচারকারি, জাঁকজমকপ্রিয় লোকদেরই এই জিনিস থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত সে যাদের দর্শন করেছে এ জিনিষ তাদের থাকার কথা নয়। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের কাঁধে এমন পদার্থ সে কল্পনাতেও আনতে পারে না।
এই জিনিষটা হাতে লাগার পর থেকে পৈর ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করে। আত্মপ্রচারে নেমে যাদের সুখ একমাত্র তাদের কাছেই এই জিনিষটা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের সে দেখছে, তাদের কারোরই এমন স্বভাবের থাকা সম্ভব নয়।
হেনরি বলে ওঠেন, আমরা নিশ্চয়ই ধুমপান করতে পারি। তিনি তার সিগারেটের কেসটা পৈরটের দিকে এগিয়ে ধরলেন।
সিগারেট নেওয়ার আগে পৈরট একবার নিঃশ্বাস টেনে দেখল–ফরাসি সুগন্ধ–দামী মূল্যের ফরাসি সৌরভ। সে যাদের এতক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছে তাদের কারো পোষাক থেকেই এমন সুগন্ধ আসছিল না।
পৈরট চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করার সময়েই তার দৃষ্টি চলে যায় চেয়ারের ঠিক পাশেই একটা ছোটমাপের টেবিলের ওপর। কতগুলো দেশলাই–মোট ছটা দেশলাই।
পৈরট খুব অবাক হয়–তার ধারণা এগুলো থেকেই সে হয়তো কোনো অজানা ব্যাপার জেনে যাবে।
.
১২.
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ঘড়িতে এখন আড়াইটে। বসার ঘরে মিডগে এবং এডওয়ার্ডকে সঙ্গে নিয়েই বসেছিলেন। পেছন থেকে যার হেনরির পড়ার ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ কানে আসছিল। হারকিউল পৈরট, স্যার হেনরি এবং ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, আমি এখনও এটাই ভেবে চলেছি লাঞ্চের জন্য এ ব্যাপারে কারো উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিছুই ঘটেনি, এই মনে করে ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ খেতে বসে গেলে বড় নিষ্ঠুরতা হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু অন্য দিকটা দেখারও প্রয়োজন আছে। পৈরটকে তো লাঞ্চের জন্য এখনই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল–সে হয়তো ক্ষুধার্ত পেটেই বসে থাকবে। তাছাড়া, জনের নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের নিকট যতটা হৃদয়বিদারক তার কাছে ততটা নাও হতে পারে। আমি অবশ্য নিজের আহার নিয়ে ভাবছি না, কিন্তু সারাটা বিকাল শিকার করে হেনরি এবং এডওয়ার্ডের ক্ষুধার্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, লুসি আমার জন্য অযথা চিন্তা কোরো না।
তুমি তো বরাবরই বিচার-বিবেচনা করে কাজ করো, এডওয়ার্ড, তোমার কথা না হয় ছেড়ে দিলাম–কিন্তু ডেভিড–আমি গতরাতে ডিনারের সময় লক্ষ্য করেছি যে, সে ভালোই খেতে পারে। যাদের মস্তিষ্কের কাজ বেশি হয় তাদের বেশি পরিমাণ খাদ্যেরও প্রয়োজন হয়। হা। হ্যাঁ, ভালো কথা, ডেভিড কোথায়? দেখছি না তো।
মিডগে বলে ওঠে, সে এই ঘটনা শোনার পর সোজা নিজের ঘরে চলে গেছে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, হ্যাঁ, তার চিরকালই হাভভাবটা এইরকম, এসব ব্যাপারে সে বড্ড বিরক্ত হয়। অবশ্য হত্যাকাণ্ড বিরক্তিকর ব্যাপারও বটে–এই ব্যাপারে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে চাকরের দল, সব কাজে অগোছালো ভাব! আমাদের লাঞ্চে হাঁসের মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল –সৌভাগ্যের বিষয় এটাই যে, ওটা ঠান্ডা খেতেও সুস্বাদু লাগবে। জার্দার জন্য কী ব্যবস্থা করেছ? একটা কিছুর স্ট্রং স্যুপ?
সত্যিই, লুসি বড়ই অমানুষ।–মিডগে মনে মনে ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে আপনমনেই মুক্তির অনুসন্ধানে নেমে পড়ে নয়তো লুসি সবই ভাবে সব জিনিষ গ্রহণে ব্যথিত হয়েও সকলের কথাই ভেবে চলেছে। চাকরদের কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি, খাওয়ার জন্য চিন্তা, ক্ষুধার উদ্রেক ইত্যাদি সকল বিষয়ে উপস্থিত সবাই মনে মনে ভাবছে–কিন্তু লুসি সবার মনের ভাবকে ভাষায় রূপান্তরিত করছে। এই মুহূর্তে সে নিজের ক্ষুধার্ত এবং ভেতরে ভেতরে অসুস্থ বোধ করছে।
আসলে যে সমস্যাটা এখন স্ত্রীলোকদের নিকট সম্মুখীন হয়েছে যারা তাকে বেচারী জার্দা বলে ভাবত, আজ সে খুনে-আসামী! সত্যিই বিপজ্জনক-বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি। একবাক্যে সকলেই বিব্রত।
মিডগে ভাবে, অন্য লোকের ক্ষেত্রে যদি এমনটা ঘটতে পারে, তবে আমাদের মতো মানুষের জীবনে এই ঘটনা ঘটতে পারে না?
সে এডওয়ার্ডের ঘরের দিকে একবার তাকাল। সে ভাবে, এডওয়ার্ডের মতো মানুষের এমনটা কখনোই হতে পারে না। এডওয়ার্ডকে তার মায়া হয়। সে কত শান্ত, বিচার-বুদ্ধিশীল, দয়ালু এবং ভদ্র।
গাজন ঘরে প্রবেশ করে গৃহকত্রীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, মহাশয়া খাবার টেবিলে আমি স্যান্ডউইচ এবং কফি রেখে দিয়েছি।
ওঃ, তোমাকে ধন্যবাদ গাজন!
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, গাজন সত্যিই অবাক করে দেয়। আমি ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারি না, সে না থাকলে আমার যে কী উপায় হবে। গাজন ঠিক সময় মতো তার কাজ করে যায়। স্যান্ডউইচ-লাঞ্চের-ইত্যনুরূপ এবং এতে হৃদয়হীনতারও কোনো কারণ ঘটতে পারে না। আমার বক্তব্য কি তোমাদের বোধগম্য হয়েছে?
মিডগে হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে, তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অবাক হয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন, তিনি বলেন, প্রিয় বোনটি, তুমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছ।
এডওয়ার্ড সোফায় এসে মিডগের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখে। সে সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠে, ধৈর্য হারিও না, মিডগে। এডওয়ার্ডের কাঁধে মুখ লুকিয়ে হাপুস নয়নে অবিরাম ধারায় চোখের জল ফেলতে থাকে মিডগে। তার মনে পড়ে যায় একবার আইন্সউইক-এ বড়দিনের ছুটিতে তার শশক মারা গেলে এডওয়ার্ড তাকে কতই না প্রবোধ দিয়েছে।
এডওয়ার্ড ধীরে ধীরে বলে ওঠে, একটা বড় আঘাত সে পেয়েছে। তাকে একটু ব্র্যান্ডি দেওয়া যায় কি, লুসি?
বোধহয় খাবার টেবিলে পাওয়া যাবে। আমি ঠিক করতে…হেনরিয়েটা ঘরে পা রাখতেই কান্নায় সে ভেঙে পড়ে। মিডগে চুপচাপ বসেছিল। তার মনে হল, এডওয়ার্ড কাঠ হয়ে শান্ত মনে নীরবে বসে আছে। মিডগে ভাবে, হেনরিয়েটার মনের কী অনুভব? সে ভেবেছিল যে, সে তার দিদির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না–কিন্তু সেরকম কোনো কিছুই দৃষ্টিতে পড়ল না। হেনরিয়েটার মুখে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না। সে দীপ্তকণ্ঠে মাথা উঁচু করে এসে প্রবেশ করল, তার মুখে বিবর্ণতার চিহ্ন মাত্র নেই, বরং চাতুর্যের ছাপটাই পরিস্ফুট। তাকে দেখে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ওঃ তুমি এসেছ, হেনরিয়েটা? তোমার কথাই বসে আমি ভাবছিলাম। পুলিস, হেনরি আর পৈরটের সঙ্গে বসে কথা বলছে। জার্দাকে তুমি কি দিতে পেরেছ? ব্র্যান্ডিং অথবা চা এবং অ্যাসপিরিন?
আমি তাকে একটু ব্র্যান্ডি এবং গরম জলের একটা বোতল দিয়ে এসেছি।
সম্মতির সুরে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ভালো কাজ করেছ–এই জন্যই তোমাকে ফাস্ট-এইড ক্লাসের বলা যেতে পারে। আঘাতের জন্য গরম জলের বোতল–ব্র্যান্ডি নয় কারণ এতে একটা প্রতিক্রিয়া হয়–তবে জাদার কাছে ওটা কোনো আঘাত নয়–আমি ঠিক বলতে পারি, না, স্বামীকে হত্যা করার পর স্ত্রী-মনের যে কী অনুভূতি হয়–এটা এমনই একটা মনের ব্যাপার যা কেউ ভাষা দিয়েও ব্যক্ত করতে পারে না–তবে আর যাই হোক–এটা তেমন কোনো আঘাত নয়, এতে অবাক হবার কিছু নেই।
হেনরিয়েটার স্বর বরফের মতোই শান্ত হিম শীতল, ঘরের গুমোট ভাব যেন এক লহমায় দূর করে দেয়।
সে বলে ওঠে, তোমরা সকলে এতটা জোর দিয়ে কী করে বলছ যে জার্দাই জনকে হত্যা করেছে?
ক্ষণকালের জন্য সবাই চুপচাপ। পরিস্থিতির পরিবর্তনটাও যেন মিডগের দৃষ্টিতে এড়ায় না। হতবুদ্ধি–অস্পষ্টতা–সন্দেহ এবং অনুসন্ধিৎসা সবগুলোই যেন সম্মিলিত হয়ে ঘরময় বিরাজ করেছে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমাদের তো দেখেশুনে তাই মনে হচ্ছে। তোমার মনে কী হচ্ছে?
হেনরিয়েটা সমবেদনার সুরে এটাই বোঝাতে চাইছে যে, এমনটা কি অসম্ভব নয় যে, জাদা পুলের কাছে এসে দেখে জন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, রিভলবারটা সেই সময়েই হয়তো সে মাটি থেকে তুলে হাতে নিয়েছে। অথবা তখনই হয়তো সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে?
পূনরায় ফিরে আসে সেই নীরবতা। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, জাদার কি ঐ একই বক্তব্য?
হেনরিয়েটা শুধু বলে, হ্যাঁ।
ওটা সরল স্বীকৃতি কখনোই নয়। তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শক্তি লুকিয়ে আছে। ঠিক রিভলবারের গুলির মতো। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল উপরে তোলেন, পরে স্পষ্ট অসঙ্গতির সঙ্গেই অবশ্য বলে ওঠেন, খাবার ঘরে স্যান্ডউইচ এবং কফি দুই আছে।
খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে জাদা অনুনয়ের স্বরে বলে ওঠে, আমি আর ঘরে শুয়ে থাকতে পারছি না–আমার ভেতর একটা অস্থিরতা–আমি ভয়ানক…
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, বেচারা প্রিয় জার্দা। তিনি জোর দিয়ে দীপ্তকণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বটে, তবে কথাগুলো অর্থহীন মনে হল।
এডওয়ার্ড কপালের উপরের অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো বিড়বিড় করতে লাগল।
–আমি–আমি একটু একটু হয়তো উপলব্ধি করতে পারছি। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না–এখনও ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি যে ব্যাপারটা কি সত্যি?–জন মৃত? সে একটু কেঁপে ওঠে, কে তাকে মেরেছে? কে তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে মারতে পারে?
স্যার হেনরির ঘরের দরজা খুলে যায়। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। লম্বা-বলিষ্ঠ সুগঠিত মজবুত দেহের অধিকারী গ্র্যাঞ্জ। তার গোঁফ জোড়া নিচের দিকে বাঁকানো– অর্থাৎ ঠিক যেন দুঃখবাদী গোঁফ।
হেনরি লুসিকে দেখিয়ে বলে ওঠেন, এই আমার স্ত্রী ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ নত মুখে নমস্কার জানিয়ে বলে ওঠে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, আমি মিসেস ক্রিস্টোর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি কী-লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সোফায় উপবিষ্ট জাদাকে দেখিয়ে দিলেন। মিসেস ক্রিস্টো?
জার্দা উৎসাহের সঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাঁ, মিসেস ক্রিস্টো আমি।
–আপনাকে ব্যথা দেবার কোনো বাসনা আমার নেই, তবে চাকরি-টাই এমন, আমি আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনি চাইলে সলিসিটারকে উপস্থিত রাখতে পারেন–
স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, সেটা বোধহয় একপক্ষে ভালো হয় জার্দা—
–সে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, সলিসিটার? সলিসিটার আবার কেন। সলিসিটার কেমনভাবে জানবে যে জনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে?
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ একটু কাশলেন। স্যার হেনরি কিছু বলতে চাইছিলেন। হেনরিয়েটা এই সময়ে বলে ওঠে, আজ সকালে কী ঘটেছে, ইন্সপেক্টর সেটা জানতে চাইছেন।
জাদা তার দিকে ফিরে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে, আগাগোড়াই এটা একটা নিছক দুঃস্বপ্ন–বাস্তব নয়! আমি–আমি–আমি একবিন্দু চোখের জল ফেলতে পারছিলাম না বা অন্য কিছু করার মতো ক্ষমতা তখন ছিল না। কারো পক্ষেই বোধহয় এই অবস্থায় কিছু করা সম্ভব নয়..
গ্র্যাঞ্জ সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠে, আঘাত দেবার জন্যই বোধহয় এটা ঘটেছে মিসেস ক্রিস্টো।
জাদা-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বোধহয় তাই। এটা সত্যিই খুব আকস্মিক, আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পথ ধরে সুইমিং পুলের দিকে…।
গ্র্যাঞ্জ–কটার সময়, মিসেস ক্রিস্টো?
জাদা–একটার আগে হবে হয়তো–একটা বাজার মিনিট দুই আগে, ঘড়িটা তখন আমি দেখেছিলাম। সেখানে পৌঁছে সত্যিই চোখে পড়ে জনের নিপ্রাণ দেহ, কংক্রিটের ধারে রক্তে ভেসে যাচ্ছে…
গ্র্যাঞ্জ–গুলির শব্দ কি আপনার কানে এসেছিল?
জার্দা-না-না–আমি জানি না। আমি শুনেছিলাম, স্যার হেনরি এবং মিস্টার এ্যাঙ্গক্যাটেল শিকারের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন…আমি…আমি শুধুমাত্র জনকে দেখেছি
গ্র্যাঞ্জ–হ্যাঁ, মিসেস ক্রিস্টো?
জার্দা–জন, রক্ত এবং পাশে পড়ে থাকা একটা রিভলবার। রিভলবারটা আমি মাটি থেকে তুলে নিজের হাতে নিয়েছিলাম।
গ্র্যাঞ্জ-কেন?
জাদা–আমাকে মাপ করবেন।
গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টো, আপনি রিভলবারটা তুলতে গেলেন কেন?
জাদা–আমি নিজেও ঠিক বলতে পারব না।
গ্র্যাঞ্জ–ওটাতে হাত ঠেকানো আপনার বোধহয় উচিত হয়নি।
জার্দা–আমার উচিত হয়নি? উদাস চোখের দৃষ্টি মুখের বিমূঢ় ভাব জার্দার। কিন্তু আমি ধরেছিলাম। ওটা আমি আমার নিরাপদ আশ্রয়ে হাতের মধ্যে রেখেছিলাম। জার্দা নিজের হাতের দিকে একবার তাকাল, এখনও যেন-রিভলবারটা তার হাতের মধ্যেই ধরা আছে।
সে তাড়াতাড়ি ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল, তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে কেমন যেন তীব্র হয়ে উঠেছে–তবে নিদারুণ মনস্তাপপূর্ণ। জনকে কেই বা মারতে পারে? কেউ তাকে মারতে চাইবে না। সে ছিল–নিতান্তই সাধাসিধে ভালো মানুষ। এত দয়ালু–এত–এত স্বার্থশূন্য অন্যের জন্য সে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারত। সকলে তাকে ভীষণ ভালোবাসত ইন্সপেক্টর। সে একজন অদ্ভুত প্রকৃতির চিকিৎসক ছিল। সকল স্বামীদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং দয়ার অবতার। এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!
সে একটা হাত ছোড়। যে-কোনো লোককে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখুন ইন্সপেক্টর। জনকে কেউ মারতে চায়নি। চেয়েছে কি? সকলের কাছে সে আবেদন জানায়।
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ তার নোটবই বন্ধ করল। শুধু বলে, সহযোগিতা করার জন্য সত্যি ধন্যবাদ, মিসেস ক্রিস্টো। গ্র্যাঞ্জ আবেগহীন কণ্ঠে বলে ওঠে, আপাতত এতেই কাজ চলে যাবে।
হারকিউল পৈরট এবং গ্র্যাঞ্জ বাদাম বনের মধ্যে দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে ধীর পদব্রজে অগ্রসর হল। জন ক্রিস্টোর প্রাণহীন-নিঃসাড় দেহের ফোটো তোলা হল, মাপ-জোক করা হল, পরক্ষা-নিরীক্ষা করে বিস্তারিত সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হল। এই সবকিছুই পুলিস সার্জেন করে গেছে, পরে মৃতদেহ মর্গের উদ্দেশ্যে পাঠানো হল। পৈরটের সুইমিং পুলটাকে দেখে সত্যি কী নির্দোষ মনে হচ্ছিল! তার মনে হল, এখানকার সবকিছুই আজ তরল, একমাত্র জনকেই তরল-এ ফেলা যায় না। যে মৃত্যুর মধ্য দিয়েও উদ্দেশ্য-নিষ্ঠ এবং বাস্তুতান্ত্রিক। সুইমিং পুল আজ আর নেহাতই এক পুল নয়–সেটা আজ এমন একটা নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে যে এইস্থানে জন ক্রিস্টোর দেহ শায়িত আছে, তার দেহ থেকে রক্ত নির্গত হয়ে পুলের ধারে কংক্রিটকে ভিজিয়ে দিয়েছে এবং সবশেষে পুলের নীল জলে এসে মিশেছে। পুলের কৃত্রিম নীল জল। কৃত্রিমতা সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত।
কৃত্রিমতা শব্দটাকে পৈরট যেন আঁকড়ে ধরে। স্নানের পরে স্যুট পরা একজন লোক এসে রিভলবারটা পুল থেকে তুলে ইন্সপেক্টরের হাতে জমা করে।
সে বলে ওঠে, আঙুলের ছাপ পরীক্ষার আর কোনো সুযোগ নেই, অবশ্য এখানে তার প্রয়োজনও নেই বললেই চলে। মিসেস ক্রিস্টো নিজের হাতে এটা ধরেছিলেন, তাই না মিস্টার পৈরট?
পৈরট-হ্যাঁ।
গ্র্যাঞ্জ–রিভলবারটা সনাক্তকরণ করা হলো দ্বিতীয় কাজ। আমার মনে হয় হেনরি, আমাদের জন্য ইচ্ছে করলে তাই করতে পারেন, তার কাছ থেকেই ওটা সংগ্রহ করেছে। জিনিষটা এখন পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। পুলের নীচ থেকে যে পথটা এসেছে সেটা সোজাসুজি ফার্ম থেকে। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ঐ পথ ধরেই এসেছিলেন। অন্য দু’জন মিস্টার এডওয়ার্ড এবং মিস স্যাভারনেক–বন থেকে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু একত্রে আসেননি। এডওয়ার্ড এসে উপস্থিত হয়েছিলেন বাঁ-দিকের পথ ধরে এবং এই পথটাই উপরের দিকে ফলের বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আপনি যখন এখানে এলেন তখন তারা পুলের ধার ঘেঁষে একটু দূরে উভয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই না মিস্টার পৈরট?
পৈরট-হ্যাঁ।
গ্র্যাঞ্জ–এই পথটা তাবুর পাশে পোদ্দার লেন বরাবর চলে গিয়েছে। ঠিক আছে–আসুন, আমরাও না হয় ঐ পথেই যাই। পথ চলতে চলতে গ্র্যাঞ্জ নির্লিপ্ত ভাবে নিজের অভিজ্ঞতা এবং দুঃখবাদ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন।
ঠিক এরকমটা না হলেও প্রায় ঐ ধরনের একটা ঘটনা গত বছর ঘটে গিয়েছিল আশারিজের কাছে। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বিভাগের একজন–উল্লেখযোগ্য চাকরি জীবনের কৃতিত্ব স্ত্রী খুব ভালো, শান্ত, সুন্দরী, পুরোনো ভাবধারার মানুষবয়স প্রায় পঁয়ষট্টির মতো। একদিন স্ত্রী ভদ্রলোকের চাকরি করার সময়কার রিভলবারটা নিয়ে এসে বাগানে ভদ্রলোককে গুলি করে মেরেছেন ঠিক এমনটি ভাবে। অবশ্য এই ঘটনার পেছনে অনেক কিছু রহস্য লুকিয়ে ছিল, এটা অবশ্য আমাদের খুঁজে বার করতে হয়েছে। প্রথমে অবশ্য ভাওতা দেবার উদ্দেশ্যে নানা গল্প শোনানো হয়েছিল–আমরাও সেটা বাহ্যত বিশ্বাস করে ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান চালিয়ে আসল ব্যাপারের সন্ধান পেয়ে গেলাম।
পৈরট–আপনারা কি তাহলে এটাই মেনে নিয়েছেন যে, মিসেস ক্রিস্টোই তার স্বামীকে হত্যা করেছেন?
গ্র্যাঞ্জ—(অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে) আপনি কি তাহলে এটা মন থেকে মানতে পারছেন না?
পৈরট–অবশ্য অসম্ভব কিছুই নয়! আবার মিসেস ক্রিস্টো নিজের মুখে যা বলছেন তা সত্য হলেও হতে পারে।
গ্র্যাঞ্জ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়েন। হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু গল্পে সে-রকম কোনো জোর নেই–বড়ই ক্ষীণ। তাছাড়া সেখানে উপস্থিত একবাক্যে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি হত্যা করেছেন। আমাদের থেকে তাদের পক্ষেই বেশি জানা সম্ভব।
গ্র্যাঞ্জ সাথীর মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। জিজ্ঞাসা করল, আপনি যখন এলেন, মিসেস ক্রিস্টোকে দেখে আপনার কী মনে হয় না যে, নিজের কাজ তিনি ভালোভাবেই সমাপ্ত করতে পেরেছেন?
পৈরট আপন মনেই জাল বুনতে থাকে…পথ ধরে এসে…পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে গাজন..জার্দা ক্রিস্টো স্বামীর মৃতদেহের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে…হাতে রিভলবার, চোখে উদাস করা দৃষ্টি..হা হতে পারে…মিস্টার গ্র্যাঞ্জ যা ভাবছেন তা ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে..প্রাথমিক ধারণা অবশ্য তাই…হ্যাঁ, কিন্তু পুরোটা নয়…আবার আসল ব্যাপার ঢাকবার চেষ্টাও হতে পারে… সবই হয়তো সম্ভব…।
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এটাই জানতে চান যে, জার্দা ক্রিস্টোর মুখের চেহারা সে সময় ঠিক কেমন হয়েছিল।
পৈরটের এবারে সত্যিই অবাক হবার পালা। তার এতদিনকার অপরাধ শাখার কাজের অভিজ্ঞতায় সে কোনোদিন এমন অদ্ভুত স্ত্রীলোকের মুখোমুখি হয়নি যে, সবে মাত্র তার স্বামীর প্রাণ নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবস্থায় একজন স্ত্রীলোকের মুখের ভাব কেমন হওয়া উচিত? বিজয়িনী, ভীতা, আত্মতৃপ্তা, হতবুদ্ধি, শূন্য দৃষ্টি? হয়তো এগুলোর যে-কোনো একটা হবে।
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ কথা বলে যাচ্ছিল, পৈরট কথার শেষাংশে নিজের বক্তব্য জুড়ে দেয়।
পৈরট–ঘটনার পেছনের সব কথা জানতে হবে এবং চাকরদের কাছ থেকেও সব জানা যেতে পারে।
গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টো কি শেষ পর্যন্ত তাহলে লন্ডনেই ফিরে যাবেন?
পৈরট–হ্যাঁ, তার দুটো সন্তান, তাই তাকে যেতে দিতেই হবে। আমরা অবশ্য তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছি, তাকে এ বিষয়ে কিছু জানতে দেওয়া যাবে না। সে ভাবে, সে ভালোভাবেই মুক্তি পেয়ে যাবে..আমার কিন্তু তাকে খুব বোকা স্বভাবের স্ত্রীলোক বলেই মনে হয়…।
জার্দা ক্রিস্টো কি বুঝতে পারে যে তার সম্বন্ধে পুলিসের মতামতটা কি? পুলিস কী ভাবছে? এ্যাঙ্গক্যাটেলরা মনে মনে কী ভাবছে?
সে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে, সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে এমন এক স্বভাবের স্ত্রীলোক যাদের প্রতিক্রিয়া হয় অনেক দেরিতে, এখন সব গুলিয়ে ফেলেছে, স্বামীর মৃত্যুতে তার হৃদয় এখন ভেঙে গেছে।
তারা লেনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। পৈরট তার দরজার কাছে এসে থেমে যায়। গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, এই ছোট্ট বাড়িটা আপনার? সুন্দর এবং নিরিবিলি! আচ্ছা, এখনকার মতো বিদায়! আপনার সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ মিস্টার পৈরট। আবার যে-কোনো সময়ে এসে হাজির হয়ে যাব এবং আমরা কীভাবে অগ্রসর হচ্ছি, আপনাকেও সে কথা জানাব। তার চোখ লেনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আপনার প্রতিবেশী কে?
পৈরট–মিস ভেরোনিকা ক্রে, অভিনেত্রী, সপ্তাহান্তিক ছুটিতে বোধহয় এসে উপস্থিত হয়েছে।
স্যার হেনরির সম্মুখে ডেস্কের ওপর রিভলবারটা রেখে দিয়ে ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।
গ্র্যাঞ্জ–এটা পুলের মধ্যেই ছিল। আঙুলের ছাপ যা কিছু ছিল সবই বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে। এটা বড়ই দুঃখের যে, মিস স্যাভারনেকের হাত থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল।
হেনরি-হা, হা-কিন্তু সে-সময়টা আমাদের সবার কাছেই একটা উত্তেজক মুহূর্ত ছিল, বিশেষ করে স্ত্রীলোকেরা দুর্বল চিত্তের হন বলেই একটু অল্পেই ঘাবড়ে যান এই অবস্থায় তাদের হাত থেকেই সেইজন্যই হয়তো পড়ে যাওয়া সম্ভব।
গ্র্যাঞ্জ–(মাথা নেড়ে) কিন্তু মিস স্যাভারনেক তত বেশ শান্ত ধীর এবং যথেষ্ট ধৈর্যশালী চতুর এক মহিলা। কথাগুলোর মধ্যে তেমন জোর না থাকলেও এমন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যার জন্য স্যার হেনরি মুখ না তুলে পারলেন না।
-এটা কী চিনতে পারলেন স্যার?
স্যার হেনরি রিভলবারটা পরীক্ষা করে নম্বরটা টুকে নিয়ে নিজের চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবইয়ে লেখা নম্বরের সঙ্গে মেলাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে বই বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, হ্যাঁ ইন্সপেক্টর, এটা আমার সংগ্রহেরই অন্যতম।
গ্র্যাঞ্জ–আপনি শেষ এটাকে কখন দেখেছিলেন?
হেনরি–গতকাল বিকেলে, আমরা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বুঝে বাগানের মধ্যে গুলি ছুঁড়েছিলাম এবং আমরা যতগুলো রিভলবার ব্যবহার করেছিলাম এটাও তাদের মধ্যে একটা।
গ্র্যাঞ্জ–আসলে এটা তাহলে কে ব্যবহার করেছিল?
হেনরি–আমার মনে হয় প্রত্যেকেই একটা করে গুলি ছুঁড়েছিল।
গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টোও কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?
হেনরি-হ্যাঁ।
গ্র্যাঞ্জ–গুলি ছোঁড়ার পর কী করেছিলেন?
হেনরি–যথাস্থানের জিনিষ যথাস্থানেই রেখে দিলাম।
স্যার হেনরি একটা ডেস্কের দেরাজ খুলে দেখালেন। দেরাজের অর্ধেক স্থান জুড়ে রাখা আছে বন্দুক।
গ্র্যাঞ্জ–আপনার আগ্নেয়াস্ত্রের বেশ বড় সংগ্রহ দেখছি স্যার হেনরি।
হেনরি–এটা আমার বহুদিনের শখ।
ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের দু’চোখের দৃষ্টি হলোয়েন দ্বীপের ভূতপূর্ব গভর্নরের দিকেই নিবিষ্ট হল! সুদর্শন, নামজাদা বিখ্যাত পুরুষ, এমন লোকের অধীনে কাজ করতে তার বড়ই ভালো লাগে–নিজের চিফ কনস্টেবলের স্থানে হেনরি থাকলে তার বরং ভালোই লাগত। এইসব ছেড়ে চকিতে সে নিজের উপস্থিত কাজেই মন দিল।
গ্র্যাঞ্জ–স্যার হেনরি, আপনি যখন তুলে রাখলেন, গুলিভর্তি তো ছিল না?
হেনরি–নিশ্চয় না।
গ্র্যাঞ্জ–আপনি গুলি ঠিক কোথায় রাখেন?
হেনরি–এখানে (স্যার হেনরি চাবি দিয়ে ছোট একটা কুঠরি খুলে গ্র্যাঞ্জকে দেখালেন)।
গ্র্যাঞ্জ ভেবে নেয়, কোথাও কোনো জটিলতা নেই, খুব সহজ ব্যাপার। ক্রিস্টো স্ত্রীলোকটি নিশ্চয়ই দেখে থাকবে কোথায় গুলি রাখা হয়। সে শুধু এসে তুলে নিয়েছে। সে ভাবে ঈর্ষা শয়তানিবুদ্ধির স্ত্রীলোকদের সঙ্গেই খেলায় মেতে ওঠে। দশটার মধ্যে একটা কেস ঈর্ষার জন্য। সব জিনিষটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখানকার গতানুগতিক কাজ সারা হলে হার্লি স্ট্রিটে গিয়ে না হয় অনুসন্ধানে নামবে। কিন্তু সব ব্যাপারটাই নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই সারতে হবে।
সে উঠে পড়ে আর বলে ওঠে, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার হেনরি। অনুসন্ধানের খবর আপনাকে জানাতে ভুলব না।
.
১৩.
নৈশভোজনের জন্য হাঁসের মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, ঠান্ডা মাংস। সেই সঙ্গে ছিল ক্যারামেল কাস্টার্ড। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মতে মিসেস মেডওয়ের মনোভাবের প্রতিফলন প্রস্ফুটিত হয়েছিল তাদের ব্যবস্থাপনায়। তার মতে রাঁধুনীর সদিচ্ছার প্রতিফলন থাকে রন্ধনে।
ক্যারামেল কাস্টার্ড সাধারণভাবে বেশ উপভোেগ্য, কিন্তু তেমন মনের মতো প্রিয় খাদ্য নয়।
কোনো বন্ধুবান্ধব মারা গেলে প্রিয় আহারগুলো খাওয়া যায় না, তাই এগুলো ব্যবহৃত হয়।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বলে ওঠেন, জাদাকে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে একদিকে ভালো। কাজই করা হয়েছে।
হেনরির সঙ্গে ওর যাওয়া বোধহয় ঠিক কাজই হবে।
স্যার হেনরি নিজে গাড়ি চালিয়ে জার্দাকে হার্লি স্ট্রিটে পৌঁছে দেবার জন্য অযথা জিদ ধরেন।
ক্যারামেল কার্ড খেতে খেতে তিনি বলে ওঠেন, তাকে অনুসন্ধানের জন্য এখানে একবার আসতেই হবে। সে তার সন্তান-সন্ততিদের কাছে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে চায়–কারণ কাগজ দেখামাত্র তারা ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে পড়বে–তাদের সান্ত্বনা জানাবার মতো কেউ নেই। ফরাসি এক মহিলা এবং ঘরকন্নার পরিচারিকা ছাড়া। হেনরি ঠিকঠাকভাবেই ব্যবস্থা নেবে এবং আমার মনে হয় জার্দা তার মনের ব্যাধি কাটিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভালো হয়ে উঠবে। সে বোধহয় তার আত্মীয়দের–বোধহয় দিদিদের সংবাদ পাঠাবে। জাদার নিশ্চয়ই তিন-চার বোন থেকে থাকবে–খুব সম্ভব তারা টুমব্রিন ওয়েলস্-এ থাকে।
মিডগে–তুমি অত্যন্ত দরকারী কথাগুলো বলেছ, লুসি।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা প্রিয় বোন, টর্কওয়েও হলে হতে পারেন, না টকওয়ে নয়।
টর্কওয়েতে উপস্থিত থাকলে তাদের বয়স অন্ততপক্ষে বছর পঁয়ষট্টি তো হবেই। ইস্টবোর্ন বা সেন্টলিওনার্ডসও হতে পারে। ডেভিড শুধু সুস্বাদু আহার খাবারেই বেশি ভক্ত, বিষণ্ণ মন নিয়ে সে তার খালি প্লেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল উঠে পড়েন। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, আমার মনে হয় আজ সকাল সকাল শুতে যাওয়া উচিত।
অনেক কিছুই ঘটে গেছে, তাই না? কাগজ দেখে এই খবর চোখে পড়লে সত্যি বড় খারাপ লাগে-খবরের কাগজগুলো সত্যি বড় একঘেয়ে। আমার মন বলে কিছু না করে মাইল পনেরো হাঁটাও বোধহয় একপক্ষে ভালোতবে বসে থাকা মোটেই ভালো কথা নয়–অবশ্য এটাও বিরক্তিকর, কিন্তু খবরের কাগজ পড়া বা বইপড়া–অনেকের কাছেই সুখের নয়–এটা বড়ই নির্দয়। আমি যদিও মনে করি যে, অবজার্ভার-এর প্রবন্ধ ঠিকই, কিন্তু ‘নিউজ অব দি ওয়ার্লড’-এ ঠিক নয়। আমার সঙ্গে তোমার মনের মিল নাও হতে পারে, ডেভিড? আমার জানতে বড় ইচ্ছা হয় তরুণেরা এ সম্বন্ধে কীভাবে এর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
রুক্ষকণ্ঠে ডেভিড বলে ওঠে যে, ‘নিউজ অব দি ওয়ার্ড’ সে পড়ে না।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমি সর্বদাই তার করে যাই, ভান করে বলে থাকি, চাকরদের জন্যই ঐ কাগজ রাখা হয়। গাজন অবশ্য এটা বোঝে, চায়ের পর ছাড়া এটাতে হাত লাগায় না। এই কাগজটা মেয়েদের কাছে বড় মজার–তাদের কথাতেই ওটাতে থাকে গ্যাসচুল্লীতে যারা মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে–তাদের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হলেও সংখ্যাও একটু বেশি।
এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল মুচকি হাসি হেসে রহস্যের কণ্ঠে বলে উঠে, গ্যাস উঠে গিয়ে সর্বত্রই যদি বিদ্যুতের প্রসার হয়ে থাকে তবে ঐ স্ত্রীলোকরা ঘরের অন্য কী কাজে লাগবে?
ডেভিড-আমি এ বিষয়ে কিছুতেই একমত হতে পারছিলাম না, বিদ্যুতের প্রসার সর্বত্র হবেই বা কেন? কেন্দ্রের সরবরাহ থেকে সর্বত্র সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উত্তাপের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রত্যেক শ্রমজীবীর গৃহ বাঁচানোর প্রচেষ্টাও হতে পারে।
এডওয়ার্ড–আমি এই বিষয়ে একটু কাঁচা।
ডেভিডের ঠোঁট ব্যাঙ্গের ভঙ্গিতে বেঁকে যায়।
গাজন ট্রেতে কফি এনে ধীরে ধীরে পরিবেশন করে যাচ্ছে শাকপ্রকাশের আশায়।
লেডি এ্যঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ওহে গাজন, সেই ডিমগুলোর কী ব্যবস্থা করলে, আমি বলি কি ডিমের গায়ে পেনসিল দিয়ে তারিখটা লিখে রাখতে বলবে মিসেস মেডওয়েকে।
গাজন বলে ওঠে, মহাশয়া, আপনি এ নিয়ে কিছু ভাববেন না, সন্তোষজনকভাবেই সবকিছু করা হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটা আমি নিজে লক্ষ্য রেখে চলেছি।
–তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ গাজন।
গাজন যেতে যেতে এ্যাঙ্গক্যাটেল আপনমনেই বিড়বিড় করে বকতে শুরু করে দেন, গাজন অত্যাশ্চর্য। সব চাকররাই বেশ ভালো, পুলিস এসে যাওয়ায় একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের কাছে আতঙ্কের বিষয় হল পুলিস। ভালো কথা, কেউ থেকে গেল নাকি?
মিডগে জিজ্ঞাসা করে, তুমি পুলিসের কথা বলছ?
–হ্যাঁ, তাঁরা সর্বদাই একজন-না-একজনকে হলে দাঁড় করিয়ে রেখে যায়। অথবা ঝোঁপের আড়াল থেকে কেউ হয়তো সামনের দরজায় পাহারায় বসে যায়–লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন।
মিডগে–সামনের দরজায় পাহারা দিচ্ছে কেন?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি নিজেও জানি না। তবে রাতে যদি আর কারো প্রাণহানি ঘটে এই আশঙ্কায়।
মিডগে–লুসি, এমন কথা মুখেও এনো না।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকালেন। বলে উঠলেন, আমি সত্যিই অনুতপ্ত বোন, বোকার মতোই বলে চলেছি আমি। তবে আর কারো নিহত হবার সম্ভাবনা নেই। আমি বলছি জার্দা বাড়ি চলে গেছে–ওঃ হেনরিয়েটা, আমি সত্যিই দুঃখিত, সেকথা বলার কোনো ভাষা আমার ছিল না।
হেনরিয়েটা কোনো জবাব দেয় না। সে গোলটেবিলের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, গত রাতে সে ঐ টেবিলটাতেই ব্রিজ খেলায় স্কোর করেছিল।
সে যেন তার মধ্যে হঠাৎকরে সম্বিত ফিরে আসে এবং বলে ওঠে, কী যেন বলছিলেন, লুসি?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি এটাই জানতে চেয়েছিলাম যে পুলিস এখনও আছে কী?
হেনরিয়েটা-নীলামের ঝড়তি-পড়তির মতোই। আমার তো মনে হয় তারা সব থানায় চলে গেছে। আমরা সারাদিন ধরে যে সব কথা বলেছি তা পুলিসী ভাষায় রূপান্তরের জন্য তারা চলে গেছে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–তোমার চোখে কী পড়েছে হেনরিয়েটা?
হেনরিয়েটা–না, কিছুই নয়। হেনরিয়েটা অগ্নিকুণ্ডের উপরের কারুকার্য করা তাকের কাছাকাছি চলে গেল। সে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, আজ রাতে ভেরোনিকা ক্রে কী করছে বলে তোমার অনুমান?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখের ওপর বিষাদের করুণ ছায়া নেমে আসে। তিনি বলেন, তোমার কী মনে হয় বোন, সে কি এখানে থাকতে চাইবে? এতক্ষণে হয়তো তার কানে সব পৌঁছে গিয়ে থাকবে।
হেনরিয়েটা–আমারও তাই মনে হয়। সে নিশ্চয়ই সব শুনে থাকবে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আচ্ছা, আমি যদি ক্রের কাছে টেলিফোনে আগামীকাল লাঞ্চের জন্য নিমন্ত্রণ করি, কিছুই যেন হয়নি এই ভেবে, তবে কেমন হয়?
ঘর ছেড়ে তিনি চলে যান।
আত্মীয়রা ডেভিডের চোখে ঘৃণার পাত্র। বলে, সে গিয়ে হয়তো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখবে। সে ভেবে নেয় লাইব্রেরিটা সত্যিই শান্তিপূর্ণ স্থান।
হেনরিয়েটা ফরাসি জানলার কাছটায় এগিয়ে যায় এবং জানলা খুলে চলে যায়। মিনিট কয়েক ইতস্তত করে এডওয়ার্ড তাকে অনুসরণ করল। সে দেখল, হেনরিয়েটার দৃষ্টি এখন বাইরের আকাশপানে। সে বলে, গতরাতের মতো গরমের প্রকোপ নেই, তাই না?
সান্তনার সুরে এডওয়ার্ড বলে ওঠে, না বেশ ঠান্ডা!
হেনরিয়েটা একদৃষ্টে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার দুচোখের দৃষ্টি এক ছুটে জানলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, পরে সে দৃষ্টি রাখে বনের পানে। তার মন কি ভাবে, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে খোলা জানলার দিকে একবার চলতে শুরু করে দেয়।
এডওয়ার্ড বলে ওঠে, ভেতরে চলো, বাইরে বেশ শীত।
হেনরিয়েটা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। সে বলে, আমি সুইমিং পুলের ধার থেকে একবার না হয় ঘুরে আসি। এডওয়ার্ড এক পা এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, আমি সঙ্গে আসব নাকি?
হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, না কোনো দরকার নেই, তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ এডওয়ার্ড। আমি মৃতের সঙ্গে একাকী থাকতে চাই।
-হেনরিয়েটা! আমি কিছু বলিনি। তুমি তো জান আমার কাছে এটা কত বড় একটা আঘাত হয়ে এসেছে।
হেনরিয়েটা–দুঃখিত! জন ক্রিস্টো ইহজগৎ ত্যাগ করেছে বলে? তার স্বরে সেই পুরোনো কথা বেশ।
এডওয়ার্ড-আমি বলছি, তোমার জন্য আমি আন্তরিকভাবেই দুঃখিত হেনরিয়েটা–আমি বুঝি এটা তোমার কাছে কত বড় একটা আঘাতের বিষয়।
হেনরিয়েটা–আঘাত? আমি মনের দিক থেকে যথেষ্ট শক্ত এডওয়ার্ড। আঘাত সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। তোমার কাছে এটা কোন আঘাত? তুমি যখন জনকে ঐভাবে পড়ে থাকতে দেখলে তোমার মনে তখন কী হয়েছিল? আমার কেন জানি না, মনে হচ্ছে তুমি খুশি হয়েছিলে, কারণ তুমি তাকে একদম সহ্য করতে পারতে না।
এডওয়ার্ড আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে, আমাদের মধ্যে অনেক জিনিষেরই বেশ মিল।
হেনরিয়েটা–তুমি কী সুন্দর সুন্দর করে কথা বলতে পার। তবে একটা জিনিষ কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যেই বর্তমান ছিল, সেটা আমি। তোমরা দুজনেই আমাকে ভালোবাসতে, তাই না? কিন্তু তোমাদের মধ্যে কোনো বন্ধনই হয়নি তাতে, বরং তার বিপরীতটাই ঘটে গেছে।
চাঁদ মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল। এডওয়ার্ড চমকে ওঠে, সে যখন লক্ষ্য করল যে, হেনরিয়েটা একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আইন্সউইকে যে হেনরিয়েটাকে সে দর্শন লাভ করেছে তার অভিক্ষেপণ হিসাবে সে অজ্ঞাতসারে হেনরিয়েটাকে দেখেছে। সে চিরদিনই তার কাছে হাস্যময়ী এক বালিকা ছিল যার নৃত্যচঞ্চল চোখে যেন অফুরন্ত প্রত্যাশা! যে স্ত্রীলোকটিকে এখন সে দেখতে পাচ্ছে সে যেন তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিতা। তার সেই উজ্জ্বল চোখ এখনও বর্তমান কিন্তু তার প্রীতিহীন দৃষ্টি এবং তার প্রতি যেন শত্রুভাবাপন্ন।
এডওয়ার্ড আগ্রহ সহকারে বলে ওঠে, হেনরিয়েটা, প্রিয়তমে, আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, আমি তোমার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলতোমার দুঃখে, তোমার শোকে এবং তোমার ক্ষতিতে আমি বরাবরই সংবেদনশীল।
–এটাকে কি দুঃখ বলা যায়?
প্রশ্নটা তাকে সচকিত করে তোলে। হেনরিয়েটা বোধহয় প্রশ্নটা তাকে নয়, নিজের কাছেই নিজেই জবাবদিহি করছে।
হেনরিয়েটা ধীরেসুস্থে বলে ওঠে, এত তাড়াতাড়ি–এত তাড়াতাড়ি ওটা ঘটে যেতে পারে। এখন জীবন্ত, নিশ্বাস ফেলছে এবং পরমুহূর্তে-মৃত–গত–খালি। ও শূন্যতা। এইটুকুই যা পার্থক্য!
আমরা সকলেই এখন ক্যারামেল ক্যাস্টার্ড খেতেই ব্যস্ত এবং আমাদিগকে প্রাণবন্ত বলছি–আর জন, যে আমাদের থেকে বেশি জীবন্ত ছিল, সে আজ মৃত। কথাটা বার বার আমি নিজেকেই বোঝাতে চাইছি। মৃত-মৃত-মৃত তার কোনো অর্থ নেই–একটা গাছের পচা ডাল ডাঙার মতোই কৌতুকভরা বিষয়–এ যেন ঠিক জঙ্গলে ঢোল বাজানো, তাই না? মৃত-মৃত-মৃত-মৃত।
-হেনরিয়েটা, থামো! ঈশ্বরের দোহাই, থামো! এডওয়ার্ডের দিকে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।
হেনরিয়েটা–তুমি কি জানতে না যে, আমার চিন্তাধারাটাও একইরকম? তুমি কি ভেবেছিলে? তুমি ভেবেছিলে, একখানা রুমাল চাপা দিয়ে আমি চোখের জল মুছব এবং তুমি আমার হাত ধরে থাকবে? সেটা হয়তো খুব সুখের হবে এবং তাকে খুব সহজে ভুলেও যাওয়া যায়–অর্থাৎ দুঃখের ভাবটা কাটিয়ে ওঠা যায় এবং তাতে হয়তো সান্ত্বনাও মিলে যায়। তুমি খুব ভালো এডওয়ার্ড। তুমি খুব ভালো, একটু বেশি–অত্যন্ত অপ্রতুল।
এডওয়ার্ড পিছু হটতে শুরু করে, তার মুখও কঠিন হয়ে যায়। শুষ্ক কণ্ঠে সে শুধু বলে ওঠে, হা, আমি তা জানতাম।
হেনরিয়েটা তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমরা এত কী ভাবছ? অন্যান্য সন্ধ্যার মতো আজকের সন্ধ্যাতেই সবাই একত্র হয়েছে, জনের মৃত্যুতে কেউ তাদের হিসেবের মধ্যে আনতে চাইছে না, ব্যতিক্রম শুধু আমি আর জার্দা। তুমি খুশী, ডেভিড বিব্রত, ব্যথিত মিডগে, আর লুসি ‘নিউজ অব দি ওয়ার্ড’-এর সংবাদ উপভোগ করছে! তোমার স্বপ্নে আসতে শুরু করে দিয়েছে নাকি আজগুবি-ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন?
এডওয়ার্ড মুখে কিছু না বলে এক পা এগিয়ে ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটা বলে ওঠে, আজ রাতে আমার কাছে কোনো কিছুই বাস্তব নয়–কেউই বাস্তব নয়, শুধু একজন ছাড়া।
এডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, আমি জানি..বাস্তবের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই।
হেনরিয়েটা–আমি কী তাহলে পাষণ্ড, এডওয়ার্ড। কিন্তু আমি না বলে পারছি না যে, জন এত বেশি জীবন্ত ছিল–আজ সে মৃত?
এডওয়ার্ড–আমি সে অর্ধমৃত, সে জীবন্ত।
হেনরিয়েটা–আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইছি না এডওয়ার্ড।
এডওয়ার্ড–তুমি সেই কথা বলতে চেয়েছ হেনরিয়েটা এবং সেটাই বোধহয় ঠিক।
কিন্তু হেনরিয়েটা পুরোনো রেশ টেনে বলতে থাকে, এটা মোটেই দুঃখের নয়, আমি বোধহয় একটু বেদনা অনুভব করছি না, কোনোদিন হয়তো পারবও না–জনের কথা আলাদা, তার জন্য শোকপ্রকাশ করতে আমার মন চাইছে।
হেনরিয়েটার কথা এডওয়ার্ডের কাছে অবাস্তবই মনে হয়, সে আরও বেশি অবাক হয়, হেনরিয়েটা যখন বলে ওঠে, সুইমিং পুলের কাছে নিশ্চয়ই যাব।
হেনরিয়েটা গাছের মধ্যে মিলিয়ে যায় এবং ভোলা জানালার মধ্যে দিয়ে স্বমহিমায় ফিরে আসে এডওয়ার্ড।
মিডগে এডওয়ার্ডের দিকে তাকায়। তার মুখ ফ্যাকাসে, এবং গম্ভীর ও মিডগের দীর্ঘশ্বাস তার কানে পৌঁছয় না। এডওয়ার্ড যন্ত্রচালিতের মতো একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ে এবং বলে ওঠে, আজ বড্ড ঠান্ডা।
–তোমার কি খুব শীত করছে, এডওয়ার্ড? আমরা কি–আমরা কি তাহলে আগুন জ্বালাব?
এডওয়ার্ড–কি?
মিডগে একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে অগ্নিকুণ্ড ধরিয়ে দেয়। সে আরো বলে, আগুন বেশ আরামদায়ক, শরীরও গরম হয়। তাকে দেখে মনে হয় যেন সে শীতার্ত। মিডগে ভাবে, তাকে এমন দেখাচ্ছে, হেনরিয়েটা কি তাকে এ বিষয়ে কিছু বলছে? তোমার চেয়ারটা বরং আরও কাছে এগিয়ে আনো, আগুনের একদম কাছে নিয়ে এসো এডওয়ার্ড।
এডওয়ার্ড–কি?
মিডগে–তোমার চেয়ারটা আগুনের কাছে নিয়ে এসো, সে এত জোরে জোরে কথা বলছিল শুনে মনে হবে সে হয়তো কোনো বধির লোকের সঙ্গে আলাপ করছে।
সে যেন হঠাৎ করে নিজের মধ্যে ফিরে আসে। এডওয়ার্ড, বাস্তবের এডওয়ার্ড যেন পুনরায় ফিরে এল। মৃদু হেসে বলে ওঠে, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছিলে মিডগে? আমি সত্যিই দুঃখিত, আমি হয়তো অন্য কোনো চিন্তায় মগ্ন ছিলাম, তাই হয়তো তোমার কথা আমার কানে প্রবেশ করেনি।
মিডগে–কিছু নয়, আগুন।
এডওয়ার্ড-খুব ভালো আগুন।
মিডগে–আমাদের আইন্সউইকে সর্বদা আগুনের ব্যবস্থা থাকত। মিডগে অর্ধনিমীলিত চোখে এই স্থানে এডওয়ার্ডের কথা কল্পনা করছে। বাড়ির পশ্চিম পাশের লাইব্রেরি ঘরে এডওয়ার্ড বসত। একটা ম্যাগনেলিয়া একটা জানলা প্রায় ঢেকে দিয়েছিল, সারাটা সোনালি সবুজ রঙে ঘরটাকে ভরিয়ে দিত। অন্য জানলাটা দিয়ে যে-কেউ বাইরে মুক্ত প্রাঙ্গণের দিকে তাকাতে পারত ওয়েলিঙ্গটনিয়া প্রহরীর মতো সেখানে দাঁড়িয়েছিল, তার ডান দিক করে ছিল বড় একটা কপার বী। ওঃ আইন্সউইক–আইন্সউইক!
মিডগে যেন তার কল্পনা জগৎ থেকে আইন্সউইকের সুগন্ধি ঘ্রাণ নিচ্ছে, এই সেপ্টেম্বরেও মোমের মতো শ্বেত-শুভ্র ম্যাগনোলিয়া ফুল ফোটে। আগুনে পাইনের কাঠিগুলো জ্বলছিল, তার গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল এডওয়ার্ডের পুঁতির গন্ধ। পেছনের গদি আঁটা চেয়ারে সে বসেছিল। মাঝে মধ্যে বই থেকে মুখ তুলে সে আগুনের দিকে তাকাচ্ছিল এবং একমনে ভেবে যাচ্ছিল হেনরিয়েটার প্রসঙ্গ। মিডগে জিজ্ঞাসা করে, হেনরিয়েটা এখন কোথায়?
এডওয়ার্ড-সুইমিং পুলের ধারেই সে গেছে।
মিডগে-কেন?
এডওয়ার্ড–প্রিয় মিডগে, তোমার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, ক্রিস্টো কতখানি তার মন জুড়ে ছিল।
মিডগে–একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না যে, যেখানে গুলি করা হয়েছে সেখানে বসে থাকার কী কারণ থাকতে পারে? হেনরিয়েটার ক্ষেত্রে এটা শোভা পায় না। রঙ্গ-নাটকীয়তা তো কোনোকালেই তার মধ্যে ছিল না।
এডওয়ার্ড-কী করে জানবে কার মধ্যে কী আছে? হেনরিয়েটাকে দেখে বুঝতে পারছ না?
ভ্রূ কুঞ্চিত করে মিডগে বলে ওঠে, এডওয়ার্ড, তুমি আর আমি তো সারাটা জীবন ধরেই হেনরিয়েটাকে জেনে আসছি।
এডওয়ার্ড–তারও পরিবর্তন হয়েছে।
মিডগে–আমার কিন্তু সেটা একবারের জন্যেও মনে হয় না। সত্যি কি আশ্চর্যভাবেই না মানুষের পরিবর্তন ঘটে যায়?
এডওয়ার্ড-হেনরিয়েটাও আর আগের হেনরিয়েটা নেই, তার মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে।
মিডগে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এডওয়ার্ড-তোমার আর আমার তুলনায় তাদের মধ্যে বোধহয় একটু বেশি পরিবর্তন এসেছে।
মিডগে–আমি কিন্তু একদম বদলাইনি, আগের মতোই আছি, আর তুমি?
এডওয়ার্ড-মিডগে, তোমার দর্শন যদি প্রায়ই মিলত।
মিডগে–(সহাস্যে) আমি জানি, আমি বুঝি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগ রেখে চলা আজকাল সত্যিই বড় মুস্কিল হয়ে পড়ে।
এডওয়ার্ড-লুসির কথাই ঠিক, দিনটা কী খারাপ ভাবেই না শুরু হয়েছে, হত্যার মধ্যে দিয়েই যদি দিন শুরু হয়, তবে আর ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি! আমার এখন শুতে যাবার সময়, আচ্ছা, শুভরাত্রি।
এডওয়ার্ড বেরিয়ে যাবার পরেই হেনরিয়েটা জানলা দিয়ে এসে প্রবেশ করে। মিডগে তার দিকে একবার তাকাল।
মিডগে–এডওয়ার্ডের সঙ্গে তুমি কী করেছ?
কপালে ভাঁজ পড়ে হেনরিয়েটার, সে যেন একটু বেশি ভেবে ফেলেন।
মিডগে–হ্যাঁ, এডওয়ার্ড যখন ঘরে প্রবেশ করেছিল তাকে দেখে মনে হয়েছিল সে যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এবং চোখমুখও কেমন যেন ফ্যাকাসে।
হেনরিয়েটা–এডওয়ার্ডের জন্য তোমার মনে যখন এতই সহানুভূতি, তবে তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছ না কেন তুমি?
মিডগে–কিছু করব? তুমি বলতে কী চাইছ?
হেনরিয়েটা–আমি কিছুই জানি না। একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তোমার বক্তব্য বলতে পার। নিজের দিকে একটু দৃষ্টি দাও। তোমরা কি বোঝো না যে, সেটাই এডওয়ার্ডের মতো লোকের একমাত্র আশা?
মিডগে–তুমি ছাড়া আর কাউকে সে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করতে পারে না হেনরিয়েটা।
হেনরিয়েটা–তাহলে তো এটা তার পক্ষে বড় নির্বোধের মতোই কাজ হল।
মিডগের দিকে চকিত দৃষ্টিতে হেনরিয়েটা একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, নিজের অজান্তে যদি তোমার মনে দুঃখ দিয়ে থাকি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। আজ রাতে আমি এডওয়ার্ডকে এই ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝিয়ে দিয়েছি যে, মনে মনে আমি তাকে কতটা ঘৃণা করি।
মিডগে–ঘৃণা? এডওয়ার্ডকে? তোমার পক্ষে এটা কখনোই সম্ভব নয়।
হেনরিয়েটাওঃ হ্যাঁ, আমি সব পারি। তুমি জান না—
মিডগে–কি?
হেনরিয়েটা–এমন কিছু জিনিষ আছে যেগুলো আমার মনকে বড় নাড়া দেয়, সে আমাকে বারংবার সেই জিনিষগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমি মনে রাখতে চাই না, ভুলে যেতে চাই।
মিডগে–কি জিনিষ?
হেনরিয়েটা–ধরে নাও না–আইন্সউইকের কথা।
মিডগে–আইন্সউইক? তুমি আইন্সউইককে ভুলে যেতে চাও?
হেনরিয়েটা–হ্যাঁ, হা, হা! আমি সেখানে বেশ সুখী ছিলাম, এই মুহূর্তে সে আনন্দের কথা সহ্য পর্যন্ত করার ক্ষমতা আমার নেই।
তুমি কি কিছুই বুঝতে পার না? এমন অনেক সময় এসে দাঁড়ায় যখন সে জানতেও পারে না ভবিষ্যতে কি হবে? আবার এমনও অনেক সময় আসে যখন সবকিছুই বেশ ভালো লাগে, সবকিছুই তখন ভীষণ অপরূপ, রমণীয় রূপেই চোখের সম্মুখে ধরা দেয়। এ জগতে জ্ঞানী লোকের সংখ্যাও খুব কম নয়, যারা কখনও সুখের স্বপ্ন দেখে না, আশা করে না তাদের জীবনে সুখের।
কিন্তু আমি করেছিলাম।
হেনরিয়েটা তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠে, আইন্সউইকে ফিরে যাবার বাসনা আমার নেই, আশা করি ভবিষ্যতেও হবে না।
মিডগে ধীরে ধীরে শান্ত কণ্ঠে শুধু বলে, আমার সত্যি বড় অবাক লাগছে।
.
১৪.
সোমবার সকালে মিডুগের একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু বিছানা ত্যাগ করার আগে কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে থাকল, চোখে তখনও ঘুমের রেশ। কিন্তু তার দৃষ্টি বার বার চলে যেতে লাগল দরজার দিকে। কারণ সে ভেবে রেখেছিল লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল হয়তো এসে দাঁড়াবে। প্রথম দিন সকালে লুসি এসে কী বলে গিয়েছিল?
দুঃসহ সাপ্তাহান্তিক একটি ছুটি? সে ভেতর ভেতর যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল–তার যেন কেবলই মনে হচ্ছিল অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে। হ্যাঁ তার আশঙ্কা মিথ্যে ছিল না–অপ্রীতিকর কিছু তো ঘটেই ছিল–এমন কিছু ঘটল, যা এখনও মিডগের অন্তর বিদ্ধ করছে এবং তার মনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কালো মেঘের মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে এইসব ভাবতে চায় না, এইসব চিন্তা থেকে সে দূরে থাকতে চায়, স্মরণ করতেও তার মনের প্রবৃত্তি হয় না। যা ঘটেছিল সে সত্যিই ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শুধু সেই নয়, এডওয়ার্ডের মতো মানুষকেও ঘটে যাওয়া সব কিছু স্পর্শ করতে পেরেছিল।
স্মৃতি খুব দ্রুত মনের পর্দায় এসে ভেসে ওঠে। কুৎসিত-ভয়ঙ্কর একটা শব্দ–হত্যা।
মিডগে ভাবে, ওঃ না, ওটা বোধহয় সত্য নয়। ওটা কখনোই সত্য হতে পারে না। আমি যেন স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছি! জন ক্রিস্টো নিহত–গুলিবিদ্ধ তার প্রাণহীন দেহটা পুলের ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, রক্ত এবং নীল জল যেন হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা কাহিনীর জ্যাকেট। কাল্পনিক, অসহ্য। এরকম ঘটনা বোধহয় সচরাচর খুব কমই ঘটে। এই সময়ে যদি আমরা আইন্সউইকে উপস্থিত থাকতাম, তাহলে এরকম অঘটন আইন্সউইকে নাও ঘটতে পারত।
ওটা স্বপ্ন-বাস্তব-সত্য ঘটনা–’নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ড’-এ একটা ঘটনা বটে। সে, এডওয়ার্ড, লুসি, হেনরি এবং হেনরিয়েটা সকলেই এই ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
অন্যায়-নিঃসন্দেহে অন্যায়-কারণ কারো সঙ্গে ওর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না, জার্দা যদি সত্যি সত্যিই ওর স্বামীকে হত্যা করে থাকে।
মিডগে অস্থিরভাবেই নড়ে-চড়ে বসে।
শান্ত, মূর্খ, আংশিক করুণ জার্দা–জাদাকে এরকম একটা হাস্যকর নাটকের সঙ্গে জড়াতে পার না-উৎপীড়নের সঙ্গে তাকে জড়ালেও জড়ানো যেতে পারে।
সত্যি সত্যি কাউকে গুলি করে মারা জার্দার পক্ষে সম্ভব নয়।
আবার সেই অন্তঃস্থ অস্থিরতার তাগিদ। না, না, এভাবে ভাবাটা বোধহয় কারো উচিত নয়। আর কেই বা জনকে গুলি করে মারতে পারে? জনের মৃতদেহের পাশেই দাঁড়িয়েছিল জার্দা তার হাতেই ধরা ছিল রিভলবার।
রিভলবারটা সে হেনরির পড়ার ঘর থেকেই সংগ্রহ করেছিল। জার্দা নিজের মুখেই এই বিবৃতি দিয়েছিল যেজনকে সেই প্রথম মৃতরূপে আবিষ্কার করে, রিভলবারটা সে তার পাশ থেকে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল। ভালো, এর থেকে আর কী বা সে বলতে পারে? নিরুপায় হয়েই মুখ খুলতে হয়েছে-নেহাতই অনুর্বর দুর্বল কথা। হেনরিয়েটাই জার্দাকে একমাত্র সমর্থন করতে পেরেছে। সেই শুধু প্রথম থেকে বলে যাচ্ছে জার্দার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তার বক্তব্য সত্য হতেও পারে। অন্য কোনো বিকল্প বা কোনো পন্থা হেনরিয়েটা এখনও পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। গতরাতে হেনরিয়েটা খুব মুষড়ে পড়েছিল, মুষড়ে পড়ার একমাত্র কারণ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু।
বেচারা হেনরিয়েটা–জনের জন্য আজ সে কত কিছুই না ভাবছে।
সময় কারো জন্যই থেমে থাকে না, সময়ান্তরে সে হয়তো সামলে উঠতে পারবে–সকলেই সব সামলাতে পারে, সব শোকই মানুষের সয়ে যায়। সবাই তার অতীত ভুলেও যায়। হেনরিয়েটা এডওয়ার্ডকে বিবাহ করবে এবং আইন্সউইকে গিয়ে বসবাস করবে। এডওয়ার্ডের মন খুশীতে ভরে উঠবে।
হেনরিয়েটা বরাবর এডওয়ার্ডকে ভালোবাসত। জন ক্রিস্টোর ব্যক্তিত্বই মাঝখানে পড়ে বাধ সাধল। এডওয়ার্ডকে বরং নিষ্প্রভ এবং অপদার্থ করে তুলল।
সেদিন সকালে প্রাতঃরাশের সময় মিডগের মনে হতে লাগল যে, জন ক্রিস্টোর আধিপত্যের রেশ ছিন্ন করে এডওয়ার্ড নিজের ব্যক্তিত্ব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। সে নিজের সম্বন্ধে বরাবরই একটু বেশি সচেতন। কোনো ব্যাপারেই সে আর বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না, বা থেমেও থাকে না। অল্পভাষী ডেভিডের সঙ্গে সে খুশী মনেই কথা বলে যাচ্ছিল।
–ডেভিড, তুমি মাঝে মধ্যে আইন্সউইকে আসবে। সেখানে আমি তোমার জন্য বাড়ির মতোই পরিবেশ সৃষ্টি করব এবং সেখান থেকে তুমি ঐ স্থান সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে।
কমলালেবুর আচার খেতে খেতে ডেভিড নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, এই বড় এস্টেটগুলো সত্যি বড় হাস্যকর। এগুলোকে ছোট-ছোট করে ভাগ করাও উচিত।
এডওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, আমি আশা করছি আমার জীবনে আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, আমার প্রজারা সন্তুষ্ট।
ডেভিড বলে, তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়, কারোরই সন্তুষ্ট মনে থাকা বোধহয় উচিত নয়।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, এপ যদি তার লেজ নিয়ে খুশী থাকতে পারত।
কিডনির একটা ডিমের দিকে তাকিয়ে এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, নার্সারিতে থাকাকালীন এই সম্পর্কে একটা কবিতাও আমি পাঠ করেছিলাম, কিন্তু কবিতাটা ঠিক কেমন ছিল, মনে করতে পারছি না। আমি তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে প্রস্তুত ডেভিড এবং সেইসঙ্গে বোধহয় শিখে নেব নতুন চিন্তাধারা। যতদূর আমার চোখ যাচ্ছে, একের অপরকে ঘৃণার চোখেই দেখা উচিত–বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং শিকার ব্যবস্থাও করা উচিত।
মিডগের মনে হয় লুসির আচার-ব্যবহারে স্বাভাবিকতার ছাপই স্পষ্ট। জাদা চলে যাবার পরে হলের মধ্যে সেই পূর্বেকার স্বাভাবিক পরিবেশটা স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। জার্দা ক্রিস্টোর ব্যাপারটা যেন নিছক স্বপ্ন। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ এল এবং গাড়ি থেকে নেমে এলেন স্যার হেনরি। লুসি বলে ওঠেন, প্রিয় হেনরি, সব ঠিকঠাক আছে তো?
হেনরি সঙ্গে সঙ্গে জবাবে বলে, হ্যাঁ, সেক্রেটারি সেখানেই উপস্থিত ছিল–বেশ বুদ্ধিমতী উপযুক্ত মেয়ে। সে নিজের তাগিদে সমস্ত জিনিষের ভার নিয়ে নিল। মনে হল, একটা বোনও আছে। সেক্রেটারি তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমি তো জানতাম, টুনব্রিজওয়েবস-এ থাকে।
স্যার হেনরি বলেন–বেক্সিল হবে বোধহয়?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন–হ্যাঁ, খুব সম্ভব বেক্সিলই হবে।
গাজন এসে বলে ওঠেন যে, ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের টেলিফোন এসেছিল, বুধবার বেলা এগারোটা নাগাদ বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু হবে।
স্যার হেনরি নীরবে মাথা নাড়েন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন, মিডগে, তুমি তোমার দোকানে একটা ফোন করে দাও। বাধ্য সন্তানের মতো মিডগে ধীর পদক্ষেপে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে যায়।
তার জীবন এখন এমনি একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে যে, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কিভাবে তার মালিককে সে বুঝিয়ে বলবে যে, চারদিন ছুটি নেবার পর আজও সে কাজে যেতে পারবে না কারণ সে একটা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের অজান্তে জড়িয়ে পড়েছে। সবকিছু শোনার পরেও এটাকে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য রূপে মানা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল না। বক্তব্যের মধ্যে সত্যিকারের কোন আসল সত্য লুকিয়ে আছে কিনা।
ম্যাডাম আলফ্রেজ এমনই এক মহিলা কোনো কিছু বোঝানো যাকে সত্যি খুব কষ্টকর। মিডগে দৃঢ়চিত্তে টেলিফোনের রিসিভার তুলল।
ইহুদী মহিলাটিকে মিডগে বুঝিয়ে বলল যে, সে কিছুতেই কিছু বোধগম্য করে উঠতে পারছে না। সে কেবলই একটা বুলি আওড়ে চলেছে, তুমি কী জান না আমার লোকবল কম? তোমার এমন কি হয়েছে যে, আরও দুটো দিন তোমার টিকি মিলবে না, সব ঝামেলা এসে পড়বে আমার ঘাড়ে? মৃত্যু? কবর দেওয়া? তুমি কী বিশ্বাস কর যে, আমি তোমার সাজানো এইসব বাজে অজুহাত মেনে নেব?
মিডগের কণ্ঠস্বরে এতটুকু জড়তা নেই, সে মুক্ত কণ্ঠেই এই কথা বলে ওঠে।
আলফ্রেজ–কি? পুলিস? তুমি পুলিসের হাতে পড়েছ নাকি?
মিডগে পুনরায় বোঝতে শুরু করে দেয়। সে ধৈর্যের সীমা হারিয়েছে, আর সে চিৎকার করে উঠেছে। ভাবে, মিডগে একটা খারাপ ব্যাপারে পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। একটা খারাপ পুলিস কেস!
এডওয়ার্ড দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু মিডগের জন্যই তাকে থেমে যেতে হয়।
এডওয়ার্ডের উপস্থিতি তার মনে অনেক সাহস এনে দেয়। অনুনয় বিনয় করে ইহুদী রমণীর উদ্দেশ্যে সে বলে ওঠে, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত মহাশয়া, কিন্তু দেখুন এ ব্যাপারে আমার কোনো দোষ নেই।
ইহুদী রমণীর ক্রুদ্ধ আর্তচিৎকার যেন কিছুতেই থামে না। সে বলে, ওরা তোমার বন্ধু? ওরা কেমন অদ্ভুত চরিত্রের লোকরে বাবা, একটা লোককে গুলি করে নিজেরাই পুলিসে খবর দেয়? আমি বহুক্ষণ চিন্তা করার পর একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পেরেছি যে, তোমাকে আর কোনোভাবেই নেওয়া যায় না, আমি কিছুতেই আমার নিজের সংস্থার মান ডোবাতে পারি না।
মিডগে এবারও তাকে অনুরোধের সুরে কাকুতি-মিনতি করে আসলে ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সেটাই বোঝাতে সক্ষম হল, রিসিভারটা যথাস্থানে রেখে দেবার পর সে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।
দেখো, এমন স্থানে আমি কাজ করি। আমাকে বলতে হল যে, বৃহস্পতিবারের আগে আমার পক্ষে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না-পুলিস এবং বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধানের জন্য–মিডগে বলে ওঠে।
এডওয়ার্ড–আমার মনে হয় এরা লোক হিসেবে প্রত্যেকই বেশ ভালো। এই পোষাকের দোকানটা তোমার কেমন লাগে? যে মহিলার দোকান, তিনি তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল?
মিডগে–এই মুহূর্তে সেভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। সে একজন হোয়াইট চ্যাপেল ইহুদী স্ত্রীলোক, কলপ করা কেশ, কণ্ঠস্বরও বেশ কর্কশ।
এডওয়ার্ড–কিন্তু প্রিয় মিডগে–এডওয়ার্ডের বলার ভঙ্গিমা এমন ছিল যে, মিডগে হেসে ফেলে।
এডওয়ার্ড আবার বলে–কিন্তু প্রিয় বোন–খুব ভালোভাবে এইটুকু সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি যে এমন আচার-আচরণ তুমি মোটেই সহ্য করতে পার না। তোমাকে যদি কোনোদিন অন্যের অধীনে চাকরি করতেই হয়, তবে এমন জায়গায় চাকরি নেবে যেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারবে, যাদের সঙ্গে তোমাকে একসঙ্গে বসে চাকরি করতে হবে তারা তোমার পছন্দমতোই হবে।
মিডগে তার মুখের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। একটা চিন্তাই তাকে বড় উতলা করতে থাকে, এডওয়ার্ডের মতো লোককে কী করলে বোঝানো সম্ভব? শ্রমের বাজার, চাকরি প্রভৃতি সম্বন্ধে সে কতটুকুই বা জানে?
তার মধ্যে হঠাৎ করে একটা বিরক্তির জোয়ার দেখা দেয়। সে অনুভব করতে পারে, লুসি, হেনরি, এডওয়ার্ড এবং এমনকি হেনরিয়েটাও তার থেকে পৃথক। তার মধ্যে এবং ওদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যেন এক দুস্তর ব্যবধান। যে উপসাগরের ব্যবধান–যে উপসাগর পার হওয়া কোননামতেই সম্ভব নয়–যে উপসাগর চাকুরিজীবী মানুষ আর আরামে-বসে-থাকা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে পেরেছে এক ব্যবধান। একটা চাকরি পাবার এবং তা বজায় রাখা যে কত কষ্টের, সে সম্বন্ধে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কেউ হয়তো বলবে যে, জীবনধারণের জন্য তার চাকুরী করার কোনো প্রয়োজন নেই। লুসি এবং হেনরি খুশিমনেই তাকে একটা বাড়ি দেবেন সেই সঙ্গে কিছু ভাতাও। এডওয়ার্ড হয়তো স্বেচ্ছার সঙ্গেই কিছু ভাতা দিতে রাজী হবে।
কিন্তু মিডগের মধ্যে একটা শক্তি বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধনী আত্মীয়দের এই দানের বিরুদ্ধে। কালেভদ্রে লুসির এই শৃঙ্খলাবোধ প্রাচুর্যের মধ্যে দিন কয়েক কাটাতে বেশ ভালোই লাগে মনের সুখে আনন্দও করা যায়। কিন্তু অপরের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে চিরটাকাল এইভাবে বেঁচে থাকা তার আত্মসম্মানে আঘাত করে। সেই একই অনুভূতি তাকে ধনী আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে স্বাধীনভাবে কোনো ব্যবসায় নামতে বাধা দিয়েছে। এমনটি তার জীবনে বহুবার ঘটেছে। মিডগে টাকা ধারও করে না–কোননা প্রভাব বিস্তার করার মতো প্রবৃত্তিও তার নেই। সে নিজের কথা ভেবে সপ্তাহে চার পাউন্ড বেতনের একটা চাকরিও জোগাড় করেছে।
ম্যাডাম আলফ্রেজ তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন এই মনে করে যে, মিডগে তার চতুর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হবে তার দোকানে এবং যাতে করে হয়তো তার ব্যবসাতেও উন্নতি হবে, কিন্তু মিডগে তাকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ করেছে। সে কখনও তার বন্ধুদের দোকানে হাজির হবার জন্য উৎসাহ প্রদান করত না। চাকরি করার ব্যাপারে তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। দোকান সে কোনোদিনই পছন্দ করত না, ম্যাডাম আলফ্রেজও তার পছন্দের তালিকায় পড়ে না, বদমেজাজী এবং অভদ্র-খরিদ্দারের দল বরাবরই তার চোখের বিষ, কিন্তু তার মনে একটাই সন্দেহ উঁকি দিতে থাকল যে এই চাকরি সে ছেড়ে দিলে আরও একটা নতুন চাকরি সে আদৌ যোগাড় করতে পারবে কি না সন্দেহ। কারণ অন্য চাকরির উপযুক্ত যোগ্যতা তার কোনোদিনই ছিল না।
এডওয়ার্ড অনুমান করে যে, পছন্দ অপছন্দের যথেষ্ট সুযোগ তার আছে–সকাল বেলা এই কথাটাই তাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত করে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। বাস্তবতার স্পর্শবর্জিত এই জগতে বসবাস করার কোনো অধিকার এডওয়ার্ডের আছে কি?
তারা সকলেই এ্যাঙ্গক্যাটেল! কেবল সেই অর্ধ এ্যাঙ্গক্যাটেল!
কখনো কখনো, যেমন আজ সকালেই, তার মনে হয়েছিল যে সে মোটেই এ্যাঙ্গক্যাটেল নয়। সে পরিপূর্ণরূপেই তার পিতার কন্যা। তার পিতার কথা মনে হতেই মনের অজানা এক ক্ষতই বেদনামিশ্রিত স্নেহ জেগে ওঠে। পিতার সেই ধূসর রঙের কেশ এবং মধ্যবয়সী চেহারার শান্ত মুখশ্রী সত্যি বড় করুণ!
একজন লোক বছরের পর বছর ধরে ছোটখাটো একটা পারিবারিক ব্যবসা চালাতে তার দেহের সর্বশক্তি, প্রচেষ্টা এবং নিজের মতো করে দেখা এই সব জিনিষগুলো একত্র হলেও যেটা ঢিমেতালে চলার সেটা সেভাবেই চলত। এটা তার অক্ষমতা নয়–এটা ছিল তার উন্নতির অগ্রগতি।
বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, মিডগের শ্রদ্ধাভক্তি যিনি এতটাকাল ধরে পেয়ে এসেছেন তিনি কিন্তু তার দীপ্তিমতী এ্যাঙ্গক্যাটেল মাতা নন, বরং তার পরিচয় হল শান্ত এবং ক্লান্ত তার পিতারূপে। মিডগে প্রতিবারই আইন্সউইকে যেতই-সেখানে গিয়ে সে জীবনের উদ্দাম আনন্দ অনুভব করত।
প্রতিবার সে বাবার গলা জড়িয়ে আদর করে বলে উঠত, বাড়ি ফিরে আসার আনন্দই আলাদা–এখানে আসতে পেরে আমার সত্যি কী ভালো যে লাগছে।
মিডগে যখন তেরো বছর বয়সের তখন তার মা মারা যান। অনেক সময় তার মনে হয়েছে যে, সে তার মায়ের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। তিনি ছিলেন অস্পষ্ট, লাবণ্যময়ী এবং প্রফুল্ল স্বভাবের। তার বিবাহ হয়েছিল এ্যাঙ্গক্যাটেল আভিজাত্যের পরিধির একেবারে বাইরে। তিনি এই বিবাহে মনের দিক থেকে অসুখী ছিলেন কিনা, মিডগের সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। স্ত্রীর মৃত্যুতে তার বাবা যেন আরও চুপচাপ এবং ধূসর হয়ে গেলেন। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রমের বিরুদ্ধে তার অবিরাম সংগ্রাম যেন কোনো কাজেই এল না। মিডগের যখন মাত্র আঠারো তখন তার বাবা নিঃশব্দে নীরবে এই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান।
মিডগে বিভিন্ন এ্যাঙ্গক্যাটেল আত্মীয়দের কাছেই থাকত, তাদের হাত থেকে সে উপহার গ্রহণ করত, তাদের সঙ্গে মনের সুখে আনন্দ করত, তবে তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হতে সে বরাবরই অস্বীকার করত। সে তাদের খুবই ভালোবাসত, কিন্তু এমনও অনেক সময় এসে উপস্থিত যখন সে নিজেকে তাদের থেকে পৃথক বলেই মনে করত।
সে তীব্র ঘৃণার সঙ্গে ভাবত, তারা বোধহয় কিছুই জানে না।
আভিমানী এডওয়ার্ড তার দিকে হতবুদ্ধির মতো অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে, জিজ্ঞাসা করে, আমি কি তোমাকে কোনোভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছি? কেন?
কথার মাঝে লুসির প্রবেশ ঘটে।
মিডগে উদাস ভরা নেত্রে একবার তার দিকে আর একবার এডওয়ার্ডের দিকে তাকাতে থাকে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন,এডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আর কী হবে মিডগে, বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুমি চল তাই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী তোমার আছে, সেইজন্যেই হয়তো তোমার কথা সে বুঝবে না।
বাধা দিয়ে এওয়ার্ড তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, লুসি তুমি যে কী বল তোমার কথাও আমার বোধগম্য হয় না।
লুসির চোখে মুখে অবাক বিস্ময়।
লুসি বলল-বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধানের কথা আমি বলতে চাইছি। এইজন্য জার্দাকে এখানে একবার হাজিরা দিতে হবে। আমি জানতে চাইছি, সে কি এখানে থাকবে, না ‘হোয়াইট হার্ট’-এ চলে যাবে? এখানকার সংসর্গ তার মন আরও ভারাক্রান্ত করে তুলবে। হোয়াইট হার্ট’-এর লোকেরাও তাকে ভালো চোখে দেখবে না বরং কুটি করেই তাকাবে। সেইসঙ্গে থাকবে সাংবাদিক বন্ধুদের ভিড়। বুধবার এগারোটা কি এগারোটা তিরিশে বোধহয় হবে (একটা মৃদু হাসির রেখা লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের ঠোঁটে ভেসে ওঠে)।
–জুরির বিচারের অনুসন্ধান আজ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য তার জীবনে ঘটেনি। আমার গায়ে অবশ্য ধূসর রঙের পোষাক, গির্জার উপযোগী টুপিও আছে–নেই শুধু দস্তানা।
ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলতে তুলতে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, বাগান করার দস্তানা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো দস্তানা নেই। আগে অবশ্য ছিল, তখন গভর্মেন্ট হাউসে থাকতাম। কিন্তু যাই বলা, দস্তানা পরা সত্যিই বোকামির লক্ষণ, কি বলো তাই না?
এডওয়ার্ড মৃদু হাসি হেসে বলে ওঠে, অপরাধ করার পেছনে একটা সুবিধা কিন্তু থেকে যায়, কারণ দস্তানা পরে কোনো অপরাধ করলে আঙুলের ছাপের ভয় থাকে না।
লুসি বলে ওঠে–বেশ মজার কথা বলেছ কিন্তু এডওয়ার্ড। টেলিফোনের রিসিভারটা কেন তুলেছিলাম বলতে পারবে?
এডওয়ার্ড-বোধহয় কাউকে ফোন করার উদ্দেশ্যে! ফোনের দিকে এগিয়েছিলে!
লুসি–না, তেমন ভাবে তো কিছু মনে পড়ছে না (রিসিভারটা রেখেছিলেন)।
এডওয়ার্ড-প্রিয় লুসি, মিডগের কাজের জায়গার কথা চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। সেখানকার সব কিছুই আমার খারাপ লাগে।
মিডগে–এডওয়ার্ড মনে মনে আশা করে যে, আমার একজন সহানুভূতিসম্পন্ন মালিক পাওয়া উচিত, যে আমার সঠিক মূল্য বুঝতে পারবে, আমার প্রতি দয়া-পরবশ!
লুসি–প্রিয় এডওয়ার্ড। আমি তোমার অভিমতের সঙ্গে একমত।
এডওয়ার্ড–আমি ভেতরে ভেতরে সত্যি বড় উদ্বিগ্ন–গভীর ভাবে ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করছি।
মিডগে-অভদ্র মহিলার কাছ থেকে বেতন রূপে মাত্র চার পাউন্ড আমার হাতে এসে ঠেকে–সমস্ত অসুবিধার মুখ্য কারণ কিন্তু এটাই।
বলা না থামিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মিডগে।
স্যার হেনরি নিচু দেয়ালের ওপর তার সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে বসে। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে মিডগে ফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। তার আত্মীয়দের মধ্যে একটা আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আজ সকালে তাদের সে আকর্ষণের কোনো মূল্যই তার নেই।
ডেভিড এ্যঙ্গক্যাটেল পথের শেষ প্রান্তে একটা আসনের ওপর বসেছিল। বিশেষ ভাবে আকর্ষিত হবার মতো কোনো জিনিষ তার মধ্যে ছিল না, মিডগে এসে তার পাশে বসে পড়ে। হতাশা ভরা মুখের দিকে ঈর্ষা-পরায়ণ দৃষ্টি নিয়েই সে তাকিয়ে রইল।
ডেভিড মনে মনে ভাবে, লোকের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো সত্যি খুব কঠিন! শোবার ঘর থেকে ঝি তাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে ন্যাতা, বুরুশ এবং ঝাড়ন দিয়ে ঘর মুছতে এবং ঘর পরিষ্কার করার বাসনা নিয়ে। লাইব্রেরি ঘরটিও মোটেই নিরিবিলি নয়, যেমনটি সে কল্পনা করে রেখেছিল। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সেখানে দু’বার প্রবেশ করে দয়া-পরবশ হয়ে এমন উপদেশ দিলেন যে প্রকৃতঅর্থে যার কোনো সদুত্তর হয় না। এখানে সে উপস্থিত হয়েছিল নিজের ব্যাপারে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করার আশায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটাতে এসেছিল, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্যজালে জড়িয়ে পড়ার জন্য ছুটি আরও দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে।
শিক্ষাগত অতীত এবং লেফটউয়িং-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসতে এবং ভাবনা-চিন্তা করতে বরাবরই ডেভিড ভালোবাসে। বাস্তব এবং অস্থির চঞ্চল এই বর্তমানকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের উদ্দেশ্যে সে বলেছে যে, নিউজ অব দি ওয়ার্ড’ সে খুলেও দেখে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে যে নিউজ অক্ দি ওয়ার্লড ‘হলো’তে এসে সে হাজির হয়েছে।
হত্যা! ডেভিড যেন অজানা এক ঘৃণায় শিউরে ওঠে। তার বন্ধুবান্ধবরাই বা কী ভাববে? ‘হত্যা’ কথাটাকে লোকেরাই বা কী মনে গ্রহণ করবে? এ সম্বন্ধে অভিমত কী দাঁড়াবে? একঘেয়ে, বিরক্তি? হালকা খুশির ছোঁয়া?
এইসব সমস্যা মনে মনে সমাধানের প্রচেষ্টায় সে উঠে পড়ে লেগেছিল। মিডগের উপস্থিতি এই মুহূর্তে তার কাছে বড় বিরক্তিকর লাগল। মিডগে তার পাশের আসনে বসতে যাচ্ছিল তখন সে তার দিকে বক্রদৃষ্টিতে একবার তাকাল।
মিডগে ডেভিডের বক্রদৃষ্টিতে নির্ভীক চাহনির সাহায্যে প্রত্যুত্তর দিয়ে দিল–ডেভিড সঙ্গে সঙ্গে আরো সচকিত হয়ে ওঠে। তার মনে হতে লাগল মিডগের মতো বালিকা সত্যি বড় বিরক্তিকর আর বুদ্ধির লেশমাত্র নেই।
মিডগে–তোমার আত্মীয়দের ঠিক কেমন মনে হয়?
ডেভিড-কেউ তার আত্মীয়-বন্ধুদের ব্যাপারে কি কোনো চিন্তা-ভাবনা করে?
মিডগে–প্রকৃতপক্ষে কোনো জিনিষ সম্পর্কে কারো মাথা-ব্যথা আছে কি?
ডেভিড-তুমি বোধহয় কারো না! আমি হত্যাকাণ্ডকে বিশ্লেষণ করছিলাম।
মিডগে–এটা সত্যি বড় বিরক্তিকর!
ডেভিড–শুধু বিরক্তিকর নয় সেই সঙ্গে ক্লান্তিকরও বটে! গোয়েন্দা কাহিনীর মতো সকল রহস্যের জট পাকিয়ে আছে!
মিডগে–তুমি কি এখানে এসে দুঃখ পেয়েছ?
ডেভিড-হ্যাঁ, আমি লন্ডনে আমার এক বন্ধুর সঙ্গেই থাকতাম। তার লেফটউইং’-বইয়ের দোকান আছে।
মিডগে–আমার কিন্তু মনে হয় এখানে একা থাকার আনন্দই আলাদা সেই জন্য কথাটাও বেশ আরামদায়ক।
ডেভিড–(অবজ্ঞার সুরে) আরামের জন্য কেউ যে এতটা লালায়িত হয় তা আগে শুনিনি।
মিডগে–আমার জীবনে এমনও অনেক সময় এসেছে যখন কিছুই আমি গ্রাহ্য করি না।
ডেভিড–তুমি যদি শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করে থাকো তবে তোমার জীবনের প্রতি এটা হয়ে উঠবে প্রশ্রয়ের এক অনন্যভঙ্গী।
মিডগে–চাকরি করে দুমুঠো অন্নের সংস্থান আমাকেই করতে হয়, তাই ভোগবিলাসের ওপর আমার এত লোভ। বাক্সবিছানা, নিচু বালিশ, দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বিছানার পাশে চা–চীনামাটির স্নানাগারে গরম জলের সুবন্দোবস্ত–তৃপ্তিকর বাথটব। সে আরামকেদারায় বসতে তোমার মন নেচে উঠবে…
মিডগে তার তালিকা আর দীর্ঘ করে না।
ডেভিড-শ্রমজীবী মানুষের জীবনে এসব থাকার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। কিন্তু খুব ভোরে বিছানার পাশে চা-রাখা সত্যি অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়। এটা নিছকই ভোগসুখপরায়ণতা। তাই বর্তমান বিশ্বে এর কোনো স্থান থাকতেই পারে না।
মিডগে–আন্তরিকভাবে আমি তোমার মতকে সমর্থন করতে পারলাম না ডেভিড।
.
১৫.
সকাল বেলা হারকিউল পৈরট যখন চকোলেট পানে ব্যস্ত সেই সময়ে টেলিফোনের ঘণ্টা বেজে ওঠে।
পৈরট তাড়াতাড়ি গিয়ে রিসিভারটা তুলে বলেন, হ্যালো। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তরও এল-পৈরট?
–কে? লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলছেন? আপনার কণ্ঠস্বর আমি ঠিক চিনতে পেরেছি, তাই না?
উত্তর এল–আপনাকে বোধহয় একসময়ে বিরক্ত করলাম।
পৈরট–একটুও নয়।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি আপনার কাছে জানতে চাইছি যে, আপনি যদি দয়া করে এখানে একবার আসতে পারেন তবে বড়ই ভালো হয়। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
পৈরট–আপনি কি এক্ষুনি যাবার জন্য বলছেন?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা, আমি এক্ষুনি একবার আপনাকে আসার জন্য অনুরোধ করছিলাম। আপনার পক্ষে যত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব।
পৈরট–তাহলে আমি বনের পথটাই ধরব?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-নিশ্চয়ই, ওটাই তো সবচেয়ে সোজা পথ।
পৈরট কোটে লেগে থাকা ধুলো আলতো করে বুরুশ দিয়ে তুলে পাতলা ওভার কোট গায়ে চাপিয়ে লেন পার হয়ে বাদাম বনের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে শুরু করে দিল। সুইমিং পুলটা বেশ পরিত্যক্ত, ফাঁকা নির্জন–পুলিশ তার কাজ গুছিয়ে চলে গিয়েছে। এটাকে দেখে বেশ শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ বলেই মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন শরতের আবছা আলো এসে পড়েছে তার জলে।
পৈরট তাবুর দিকে একটা তড়িৎ-দৃষ্টি ফেলে দেখল যে, প্ল্যাটিনাম ফক্স মুক্ত গলাবন্ধটি নেই কিন্তু দেশলাই ছ’টা এখনও সেই আগের মতোই পড়ে আছে। এটা তো দেশলাই রাখার উপযুক্ত জায়গা নয়, এই স্যাঁতসেতে স্থানে কি দেশলাই রাখা যায়। হয়তো একবাক্স থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু ছ’বাক্স! চিত্রিত লোহার টেবিলের দিকে একবার সে তাকাল।
গ্লাসের ট্রে-টা নিয়ে গেছে। কে যেন টেবিলের ওপর পেনসিল দিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো একটা গাছের ছবি এঁকেছে–পৈরট সত্যি খারাপ লাগল–তার পরিষ্কার মনে এই ব্যাপারে আঘাত পায় সে। ঘাড় নেড়ে, জিভের শব্দ করে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের হঠাৎ করে ডেকে পাঠানোর কারণ মনে মনে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে দ্রুত পথ চলতে শুরু করে দিল।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ফরাসি জানলায় চুপচাপ নীরবে বসেছিলেন এবং পৈরটকে দেখামাত্রই নিঝুম-নির্জন বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আপনাকে কাছে পেয়ে সত্যি বড় ভালো লাগছে। কথা বলতে বলতে তিনি পৈরটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।
পৈরট এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন, দেখুন, কি মুস্কিলে না পড়া গেল, পুলিস ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করছেন–বিবৃতিও নিচ্ছেন–কিসব পুলিসী-ভাষা বর্ষণ করছেন, সবশেষে এখন গাজনকে নিয়ে পড়েছেন। গাজনকে না হলে একমুহূর্ত আমাদের চলে না। পুলিসের প্রশ্ন শুনে সে মনে মনে বেশ ঘাবড়েই গেছে। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ অবশ্য ভালো, আমার মনে হয়, তিনি বেশ সংসারী -ছেলেপুলে-স্ত্রী নিয়েই তার বাস, স্ত্রীর সব কাজই বেশ টিহীন
ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের পারিবারিক জীবনেরকল্পিত চিত্র লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখে নীরবে শুনে যাচ্ছিল পৈরট বিনাপ্রতিবাদে এবং বিনামন্তব্যে। আপনার দয়ার শরীর, আপনি আমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি অবশ্য পুলিসকে গ্রাহ্য করি না। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই খুব হাস্যকর। মিস্টার গ্র্যাঞ্জকে বলে রেখেছি–আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব সাধ্যমতো সাহায্য করে যাব।
গ্র্যাঞ্জ যেন একেবারেই বিমূঢ় হয়ে গেছেন। তবু তিনি নিয়মমাফিক তার কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকদিন আগে একটা ব্যাপার কানে এসেছিল যে জন ক্রিস্টো এবং হাসপাতালের এক নার্সের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, ব্যাপারটা বহু পুরোনো বলে এ বিষয়ে পুলিসের তেমন কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে। কেউ অবশ্য এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। জার্দাকে তাহলে কত না ঝামেলার সম্মুখীন হতে হতো। স্ত্রী হিসেবে সে যথেষ্ট বিশ্বাসী, তাই না? আবার অনেকের মুখ থেকে এও বলতে শোনা গেছে যে, জার্দার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই বলেই তার আজ এই হাল।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল পড়ার ঘরের দরজা খুলে পৈরটকে নিয়ে হঠাৎ করে ঢুকে পড়লেন। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এবং গাজন দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিল। ঘরের এককোণে এক তরুণ একটা নোটবই হাতে নিয়ে কি সব লিখে যাচ্ছে। লুসি ও পৈরটকে দেখে গাজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। পৈরট তাড়াতাড়ি করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সে বলে ওঠে, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি, আমার জানা ছিল না যে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল…
গ্রাঞ্জের গোঁফ যেন আরো বিকট এবং দুঃখবাদী রূপেই চোখের সামনে ফুটে উঠল। পৈরট, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের গ্র্যাঞ্জ সম্বন্ধে কল্পিত গল্পে সে খুব ক্রুদ্ধ হয়। গ্র্যাঞ্জ বলেন, বসুন, পৈরট, আমার এখানকার কাজ প্রায় শেষ বললেই চলে। আমার আপনাকে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
গাজনের দিকে তাকিয়ে গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠেন, তাহলে এই পর্যন্তই তোমার স্মরণে আছে?
গাজন–হ্যাঁ স্যার, সবকিছুই বেশ স্বাভাবিক ছিল। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
গ্র্যাঞ্জ–লোমের তৈরি একটা জিনিস আমাদের হাতে এসেছে। সেটা হয়তো এখানে উপস্থিত কোনো মহিলার হবে।
গাজন–আপনি স্যার প্ল্যাটিনাম ফক্সের কথা বলছেন? ওটা আমি গতকাল তাঁবু থেকে গ্লাসগুলো নিয়ে আসার সময় পাই। কিন্তু স্যার, ওটা এখানকার কোনো মহিলার হবে না।
গ্র্যাঞ্জ–তাহলে এটা কার হতে পারে?
গাজন–ওটা খুব সম্ভব মিস ক্রের হবে। মিস ভেরোনিকা ক্রে, এক সিনেমা অভিনেত্রী, ওনার হলেও হতে পারে স্যার। আমার যতদূর মনে আছে ওরকম একটা জিনিষ তার গায়ে চাপানো ছিল।
গ্র্যাঞ্জ–কখন?
গাজন–গতরাতের আগের রাতে তিনি হঠাৎ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন স্যার।
গ্র্যাঞ্জ–তিনি এখানকার অতিথি ছিলেন না। মিস ক্রে ‘ডাভকোট’-এ বাস করতেন, ঐ দিকে লেনের মধ্যে। সে রাতে ডিনারের পর তিনি এখানে এসেছিলেন একটা দেশলাই নিতে।
পৈরট বলে ওঠে–তিনি কি ছটা দেশলাই নিয়েছিলেন?
গাজন–পৈরটের দিকে একবার তাকিয়ে) আপনার অনুমানই ঠিক স্যার। আমাদের গৃহকত্রী অনেক অনুসন্ধান করার পর জানালেন যে, আমাদের কাছে অনেক দেশলাই আছে, তখন তিনি ক্রে’কে ছ’টা দেশলাই বাক্স নিয়ে যাবার জন্য অযথা জিদ ধরে বসলেন।
পৈরট–তাবুতে তিনি সেগুলো ফেলে চলে গেলেন।
গাজন-হ্যাঁ স্যার, গতকাল সকালের দিকেই সেগুলো আমি তাবুতে স্বচক্ষে দেখে আসছি।
গাজন চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করতে করতে পৈরট বলে ওঠে, এমন কিছু আছে বলে তো মনে হয় না যে, ঐ লোকটার দৃষ্টিতে কিছু এড়িয়েছে বলে।
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ শুধু বলেন, চাকরেরাই সব শয়তানির মূলে। প্রফুল্ল মনেই গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, রান্নাঘরের ঝিও-তো আছে, তার কথাবার্তার ধরন-ধারণ এমন উঁচুদরের চাকরদের মতো নয়।
গ্র্যাঞ্জ আবার তার বক্তব্য শুরু করে, হার্লি স্ট্রিটে অনুসন্ধানের জন্য অমি সেখানে একজন লোক নিযুক্ত করেছি, আমি পরে একদিন সময় করে চলে যাব। আমাদের সেখানে অবশ্য কিছু না কিছু পাওয়া খুবই প্রয়োজন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ক্রিস্টোর স্ত্রীকে নাকি অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুখ বুজে সেগুলো তাকে সহ্য করতে হয়েছে..
এমন সব কায়দা-দুরস্ত ডাক্তারদের তাদের রোগিণীবৃন্দের সম্পর্কে এমন সব মুখরোচক ঘটনা শুনলে আপনি আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অবশ্য বলেছিলেন যে, হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে ডাক্তার ক্রিস্টোর কি সব গোলমাল নাকি হয়েছিল। যদিও তিনি সঠিক কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি, বা নাম, ধাম ইত্যাদির বিবরণও তাঁর কাছে অজ্ঞাত। গুজবের মতো এই কথাটা তার কানে ভেসে এসেছিল।
ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে বা অন্য কোনো সুচারুরূপে গঠিত এক সুন্দর চিত্র…ডাক্তার এবং হাসপাতালের নার্স…ডাক্তারের জীবনের সুযোগ…জার্দা ক্রিস্টোর ঈর্ষার যথেষ্ট কারণ…তার শেষ পরিণতি…হত্যা…হ্যাঁ, এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমি…হার্লি স্ট্রিট হতে পারে…হলো থেকে দূরে…কিছু মুহূর্ত দূরে বা অন্যত্র হেনরিয়েটা স্যাভারনেকের জার্দার কল্পিত হস্ত থেকে রিভলবার নেবার অভিনয়…রিভলবার সুইমিং পুলের জলে ফেলে দেওয়া বা পড়ে যাওয়া থেকেও একটু পৃথক ধরনের হতে পারে…জন ক্রিস্টোর শেষ কথা…হেনরিয়েটা…অনেক কিছু হতে পারে… কোথায়…কেন..বা কে হত্যাকারী?…আধবোজা চক্ষুজোড়া হঠাৎ খুলে পৈরট জিজ্ঞাসা করে ওঠে, আপনার ছেলেরা কি মোনো বাজায়?
–এ্যা, কি? ভ্রুকুটি করে গ্রাঞ্জের চোখ চলে যায় পৈরটের দিকে। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন? গ্রাঞ্জের কণ্ঠে পূর্বের মতোই বিস্ময়ের সুর। আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে জানেন, ওরা সবাই বেশ ছোট। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে বড়দিনের ছুটিতে টেডিকে এক সেট মোনো উপহার দেবার। এবারে বলুন তো আপনার জিজ্ঞাসা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? গ্র্যাঞ্জ সহজ কণ্ঠেই বলে যায়।
পৈরট নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, জবাবে কিছু বলে না। সত্যি কী সাংঘাতিক চরিত্রের স্ত্রীলোক লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল। আপন মনে কী সুন্দরই না গল্প ফেঁদেছেন। এই সর্বনাশা কাহিনীর যদি এক অংশ সত্য হয় তবে অপর অংশটাও সত্য হতে বাধ্য…আপনি অনায়াসেই সত্য বলে মেনে নেবেন।…
ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, একটা কথা আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্য আছে, পৈরট, এই মিস ক্রে–পেশায় অভিনেত্রী, তার দেশলাইয়ের প্রয়োজন পড়লে তিনি আপনার কাছে গেলেন না কেন? কয়েক পা গেলেই যখন আপনার বাড়ি। কিন্তু আপনার বাড়ি না গিয়ে আধমাইল দূরে যাবার কি প্রয়োজন ছিল?
হারকিউল পৈরট শুধু মাথা নাড়েন।
কারণ অবশ্যই একটা আছে। আমার বাড়ি আকারে বেশ ছোট, তাই চোখে না পড়াটাই স্বাভাবিক, আমি হপ্তাহান্তের আগন্তুক মাত্র–কিন্তু, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং স্যার হেনরি নামজাদা ব্যক্তি, এখানেই তাদের বাস, তারা পল্লীর অধিবাসী। এই মিস ভেরোনিকার হয়তো বাসনা ছিল যে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হবার এটাই আসল পন্থা।
ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এবার উঠে পড়ে।
সে বলে, তা হয়তো হতে পারে, কিন্তু কোনো ব্যাপারকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না এবং উচিতও নয়। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সবকিছুই বেশ সহজ ভাবে ঘটে গেছে। স্যার হেনরি তাঁর বন্দুক সনাক্ত করতে পেরেছেন। যতদূর মনে হয়, আগের দিন ঠিক বিকেলে তারা এই নিয়ে অনুশীলনও করেছিলেন। জাদা ক্রিস্টোর চোখে সবকিছুই ধরা পড়েছে এবং শুধু বন্দুক আর টোটা তাকে তুলে আনতে হয়েছে, খুবই সহজ সাদাসিধে কাজ। হা পৈরট, সত্যিই সহজ কাজ।
এটাও কী সম্ভব? এক স্ত্রীলোক, আবার জাদা ক্রিস্টোর মতো সরল স্বভাবের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে এমন অপরাধ করা কি সম্ভব? হঠাৎ করে ঈর্ষান্বিত হয়ে পতিদেবতাকে, যাকে সে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, যাকে নিয়ে সে মনে মনে গর্ব অনুভব করে, তাকে সে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারে?
আত্মরক্ষার প্রস্তুতিও তত থাকবে–অথবা সে কি অন্ধের মতোই এই কাজ করে ফেলেছে? ভালো-মন্দ, হিতাহিত কিছুই সে একবারের জন্যেও চিন্তা করে দেখেনি?
পৈরটের স্মৃতির পর্দায় এবার ভেসে ওঠে, জার্দার চোখের সেই উদাস দৃষ্টি এবং হতভম্ব বধির অবস্থা। সে জানত না–সহজভাবে কথা বলতে গেলে বলতে হয়–সে কিছুই জানত না। কিন্তু এবারে তার মনে হলো যে তার জানা হয়তো উচিত ছিল। কেন সে জানতে পারল না? বহুদিন ধরেই সে অপরাধ বিভাগের কাজের ব্যাপারে যুক্ত ছিল, কিন্তু জাদাকে দেখেও তার মনে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন জাগেনি কেন?
জার্দা কি তাহলে সত্যি-সত্যি খুনী? অথবা জার্দা কি জনকে হত্যা করেনি? তবে? আসলে হত্যাকারী কে? প্রকৃত খুনীর সন্ধান করাই কি তার একমাত্র কাজ নয়?