দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট – ২৫

।। পঁচিশ।। 

একসময় আমার জ্ঞান ফিরে আসে। গায়ে এবং মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। জ্ঞান হারাবার আগের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে হয় যেন কতকাল আগে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম, মনে পড়ছে না। হ্যারি রেবার্নের মুখটা একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তারপর আবার সেই দুঃস্বপ্নের ঘন অন্ধকার আমার চোখে নেমে আসে। 

আমি অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেছি, সেটাই আমার ঈশ্বরের আশীর্বাদ। 

কিন্তু আমি এখন কোথায়? 

অনেক কষ্টে দেখলাম একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে শুয়ে আছি। চারিদিকে কাঠের দেয়াল, দেয়ালে নানা জন্তু জানোয়ারদের চামড়া ঝোলানো রয়েছে। ভালো করে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল অদূরে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে, তাকে আমার খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। হঠাৎ সে ঘুরে দাঁড়াতেই আমার হৃদয়ের রক্ত ছলকে উঠল। 

রেবার্ন, সশরীরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 

আমার পাশে এসে সস্নেহে জিজ্ঞেস করল, এখন একটু ভালো বোধ করছ তো? 

আমার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। 

রেবার্ন দু’হাতের চেটোয় আমার অশ্রুস্নাত মুখটা তুলে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কেঁদো না অ্যানি। এখন তো তুমি নিরাপদ। আর কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। এই বলে ও আমার জন্য গরম দুধ আনতে চলে গেল। 

বাচ্চা মেয়ের মতো ওর দেওয়া দুধ আমি পান করলাম। 

এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো অ্যানি। 

ঘুম থেকে উঠে দেখবে তোমার শক্তি বেড়ে গেছে। চাইলে আমি এখান থেকে চলে যেতে পারি। 

ওর একটা হাত আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাতরভাবে বললাম, না, তুমি যেও না, আমার পাশে থাকো। 

—বেশ তাহলে থাকছি। একটা টুল নিয়ে বসে একটা হাত আমার মাথায় রাখল। আমি যেন শান্তি পেলাম। একটু পরেই ওর মধুর স্পর্শে আমার দু’চোখে ঘুমের বন্যা বইল। 

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি রেবার্ন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখন কোথায় আছি? কতদিন এখানে আছি? 

জাম্বেসির একটা ছোট্ট দ্বীপে, ফলস্ থেকে মাইল চারেক দূরে। আর মাস খানেক হল তুমি এখানে আছ 

—সে কি! এতদিন আমার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই? সুজানকে খবর দিয়েছ? 

—না তো! আমি তোমার কিছুই জানি না। তোমাকে একটা তালগাছের নিচে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমি কাঁধে তুলে এখানে নিয়ে আসি। তোমার ভাগ্য ভালো যে সেই পথ দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম। 

— সে কি! কাফ্রি ছোকরা মারফত একটা চিরকুট লিখে তুমি আমাকে সেখানে যেতে বলোনি?

—না, আমি তোমাকে কোনো চিরকুট পাঠাইনি কিংবা সেখানে তোমার আসার কথা জানতাম না। 

—কিন্তু তুমি কি করে এখন সেখানে গেলে? 

আমি এখানে এই দ্বীপে বাস করি। সেদিন রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না, মনে হচ্ছিল অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। নৌকো নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তোমাকে সেখানে গোঙাতে দেখি। 

—তা তুমি হোটেল থেকে সাহায্য না নিয়ে এতটা পথ আমাকে বয়ে আনতে গেলে কেন?

—তুমি তোমার বিপদের কথা এখনো ঠিক উপলব্ধি করতে পারনি। আর তোমার বন্ধুদের কথা বলছ? তাদেরই বা আক্কেলটা কি? তোমাকে একটা অমন বিপদের মুখে ঠেলে দিল? আমি মনে মনে শপথ নিয়েছি, তোমাকে আমি আমার কাছেই রেখে দেব, এখন থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার। বৃদ্ধা বাটালি তোমার দেখাশোনা করবে। আমি তোমাকে মাসের পর মাস রেখে দিতে পারি, কেউ তা জানতে পারবে না। 

আমি মুগ্ধ রেবার্নের আন্তরিকতায়। এর পর ওর কথার অবাধ্য হওয়ার মতো সাধ্য আমার নেই। আমি ওর কাছে নিজেকে সঁপে দিতেই প্রস্তুত। এখন থেকে তোমার সব কথা আমি শুনব রেবার্ন, এবার কী করতে হবে? 

—তোমার স্বামীর জন্য মায়া হয় অ্যানি, রেবার্ন বলে, স্বামীর অবাধ্য হোয়ো না কখনো। 

—তোমাকে ওসব চিন্তা করতে হবে না, সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, কোনো পুরুষকে পাগলের মতো ভালোবাসতে না পারলে বিয়ে করার স্বপ্ন আমি কখনও দেখব না। স্বামীরাও জানে তাদের স্ত্রীরা কী চায়, কী করলে খুশি করা যায়। আর এর ব্যতিক্রম হলেই মনোমালিন্য ঝগড়া, এমনকি বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। 

—সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসায় বিচ্ছেদের কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। এর ব্যতিক্রম হলেই সে জীবন কুকুর-বেড়ালের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। যাই হোক, রেবার্ন বলে, তোমার স্বাস্থ্য ভালো হলে তুমি বেইরায় চলে যেতে পারো এবং সেখান থেকে ইংলন্ডে ফিরে যেতে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না আশা করি। 

মনে ভাবলাম, সবার উপরে আমি নারী, তোমার মতো প্রেমিক পুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। কিন্তু আমার মনের কথাটা প্রকাশ করলাম না। 

এর পর আমি আরোগ্যলাভ করতে থাকি। আমরা তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নির্জন দ্বীপে আদম আর ইভের মতো বসবাস করছিলাম। তবু মনে হয় রেবার্নের মধ্যে কিসের যেন একটা সংকোচ, একটা বাধা যা ওর আর আমার পরিপূর্ণ মিলনের মধ্যে একটা বিরাট প্রাচীর তুলে রেখেছে। সেই বাধার প্রাচীরটা কী করে ভাঙা যায়, সেটাই যেন মস্ত চিন্তা। 

আমাকে চলে যেতে হবে, অবশ্য রেবার্নকে ছেড়ে যাওয়ায় আমার কোনো সায় নেই। রেবার্নই আমাকে যেতে বলেছে। একদিন সন্ধ্যায় সেই চরম মুহূর্ত এল। আমার মনে তখন একটাই চিন্তা, এই বুঝি রেবার্ন ওর কাছ থেকে আমাকে চলে যেতে বলবে। 

ঘরে বসে আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবছি, রেবার্ন তখন আমাকে একটা অদ্ভুত কথা শোনাল। অ্যানি, কেন জানি না তোমাকে ঠিক ডাইনির মতো দেখায়। 

ওর মুখ থেকে এই ধরনের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। 

তারপর হটাৎ ও শপথ নেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, আজই তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমি আর পারছি না। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি জান, এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। 

—হ্যাঁ, আমিও তা জানি। কিন্তু আমাকে এতদিন কাছে পেয়ে তুমি কি একটুও সুখী হওনি রেবার্ন? 

—ওঃ অ্যানি, তুমি আমাকে ওভাবে লোভ দেখিও না। তোমার ব্যবহারে আমি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছি, কিন্তু আমার মতো মানুষের এভাবে দুর্বল হওয়া শোভা পায় না। 

—ঠিক আছে, তুমি যদি আমাকে না চাও তো আমি এখান থেকে চলে যাব।

এবার আরো উত্তেজিত হয়ে রেবার্ন বলল, না, ঠিক তা নয়। আমাকে এভাবে বিচলিত কোরো না। তুমি জান আমি কে? দু-দুবার আমি জঘন্য অপরাধ করেছি। প্রতিশোধ নেবার নেশায় আমি উন্মাদ। ওরা আমাকে এখানে হ্যারি পার্কার হিসেবেই জানে। কিন্তু আমি জানি একদিন-না-একদিন আমি ওদের কাছে ধরা পড়ে যাব। আমার বিপদের সঙ্গে তোমার মতো একটি নিষ্পাপ মেয়েকে জড়াতে চাই না। তুমি যুবতী এবং সুন্দরী। তোমার মিষ্টি রূপ দেখে অনেক পুরুষই তোমাকে জীবন-সাথী করতে চাইবে। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। 

—তোমাকে অত কথা বলতে হবে না। তুমি যদি আমাকে না চাও 

—আমি যে তোমাকে গভীরভাবে চাই, সেকথা তুমি ভালো করেই জান। আর আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে সেদিন তোমাকে কামনা করেছিলাম বলেই তো তুলে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তোমাকে একটু আগে ডাইনি বলেছিলাম, কোনো খারাপ অর্থে নয়। জান অ্যানি, তোমার ঐ মিষ্টি চুলের মধ্যে যে কী যাদু আছে জানি না। তোমার ঐ কালো চোখের তারায় বশ করার কী মন্ত্র আছে জানি না, তোমার সান্নিধ্যে এলে আমি কেমন উন্মাদ হয়ে যাই, ভাবি তুমি বুঝি ডাইনির মতো মায়াজালে আমাকে আচ্ছন্ন করে ভুলিয়ে দিচ্ছ আমার অতীতের সত্তাকে। কিন্তু নিজেকে ওভাবে ভুলে যাওয়াটা আমি ভীষণ অন্যায় বলে মনে করি। আমার হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর জন্য আবার বলছি, তুমি যাও। যাও এখান থেকে। আজ রাতেই তোমাকে বেইরায় চলে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে— 

—না। আমি বেইরায় যাচ্ছি না। আমি ঠিক করে ফেলেছি। তোমার কাছেই থাকব।

—না, তোমাকে ফিরে যেতেই হবে। সেখানে তোমার উপযুক্ত পুরুষকে বিয়ে করে সুখী হতে হবে। সে তোমাকে ভালোবাসা দেবে— 

—হ্যাঁ, তা ঠিক কিন্তু তোমার মতো গভীর ভালোবাসা দিতে পারবে না কখনো। আমাকে নিয়ে তো তোমার খুব চিন্তা, এবার বলো আমি চলে গেলে, তুমি কী করবে? 

—কাজ আমার হাতে তৈরি। আজ আর তোমার কাছে কিছুই লুকবো না, একেবারে আমার জীবনের শুরু থেকে আমার বেদনাময় অতীত কাহিনী শুনবে তুমি? 

কালো মেঘের মতো আফ্রিকার এই ছোট্ট দ্বীপে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার নেমে এল। আমি শান্ত স্বরে বললাম, তার কিছু আমি জানি 

—কী, কী জান তুমি? 

—আমি জানি, তোমার নাম হ্যারি লুকাস। 

একটু ভেবে একসময় ওর গ্লানিময় জীবনের কাহিনী বলতে থাকে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ অ্যানি, সত্যি আমার নাম হ্যারি লুকাস। আমার বাবা ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক খামারের কাজের জন্য রোডেসিয়ায় এসেছিলেন। আমি যখন কেমব্রিজে দ্বিতীয় বর্ষিকের ছাত্র তখন তিনি মারা যান। তারপর এই কেমব্রিজেই একটি ছেলের সঙ্গে আমার আলাপ হয়- 

—যুবক আউমলি? 

—হ্যাঁ, আউমলিই বটে। জান অ্যানি, তার বাবা ছিলেন আফ্রিকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। সেই আউমলির সঙ্গে আমার সম্পর্ক গাঢ় হয়। কেমব্রিজ ছেড়ে আসার পর তার বাবার সঙ্গে একদিন প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। ধনীর দুলাল আউমলি স্ফূর্তি করার জন্য প্রায়ই বাবার কাছ থেকে টাকা নিত। কিন্তু সেদিন তার বাবা টাকা দিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। সেই অবস্থায় দুটি যুবকের বন্ধুত্ব আরো প্রগাঢ় হল। দুজনে তখন হীরের সন্ধানে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে এলাম। অকস্মাৎ মৃত্যু ছাড়া তখন আর কেউ আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারত না। হায়, কর্নেল রেসের কাছে তো আমাদের সেই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার কথা শুনেছ। সেদিন দুই বন্ধুর গলায় সাফল্যের জয়মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন ভাগ্যলক্ষ্মী এও শুনেছ। ব্রিটিশ গায়নার জঙ্গলে আমরা দ্বিতীয় কিমবার্লি আবিষ্কার করে ফিরলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম দামী হীরের কয়েকটা টুকরো—আর সেখানেই সেই মেয়েটির সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

সেই মেয়েটি মানে? আমার সারা শরীরে কেঁপে উঠল, কার কথা বলতে চায় রেবার্ন?

হ্যাঁ। সেই মেয়েটির নাম অ্যানিটা গুনবার্গ। পেশায় অভিনেত্রী। রূপসী এবং যুবতী। দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম। তবে তার মা ছিলেন হাঙ্গেরিয়। সেই মেয়েটির মধ্যে কী একটা রহস্য যেন লুকিয়েছিল, তাতেই আমরা দুই বন্ধু একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতাম। তখন আমরা দুই বন্ধু তার প্রেমে উন্মাদ, তাতে অবশ্য আমাদের বন্ধুত্বে চিড় খায়নি। সেই মেয়েটিও দু’জনকে একসঙ্গে খেলাতে চাইছিল। কাকে বেশি ভালোবাসে বুঝতেই দিচ্ছিল না। কিন্তু এই প্রেম-প্ৰেম খেলাটাই তার সবকিছু নয়। পরে বুঝলাম বিত্তবান স্যার লরেন্স আউমলির একমাত্র পুত্রের সঙ্গে তার ভালোবাসার অভিনয় করার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরে জানতে পারি, অ্যানিটা বিবাহিতা। ডে-বিয়ার্স-এর এক ছোটোখাটো বেঁটে লোককে সে বিয়ে করেছিল। আমাদের কাছে যে দামী হীরে ছিল, সে খবর সে পেয়েছিল। আমাদের হীরে আবিষ্কারের জন্য খুব প্রশংসা করল। 

তারপরেই ডে বিয়ার্স-এর সেই কুখ্যাত হীরে চুরির কথাটা পুলিসের হাতে ধরা পড়ল। ধুমকেতুর মতো অ্যানিটার খোঁজ করতে এসে পুলিস আমাদের হীরেগুলো বাজেয়াপ্ত করল। কিন্তু সেগুলো তো নকল হীরে। আমাদের আস হীরেগুলো হাতসাফাই করে নকল হীরে রেখে অ্যানিটা তখন উধাও। কিন্তু পুলিস আমাদের কোনো কৈফিয়ত শুনল না, চালান করে দিল আমাদের পুলিস হাজতে। 

যুবক আউমলির বাবা স্যার লরেন্স আউমলি-এর সুপারিশে দুই বন্ধু হাজত থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। তারপরেই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, দু’জনে খাতায় নাম লেখাই। তাগিদটা অবশ্য আউমলির-ই ছিল। তখন তো আর জানতাম না, কেন সে যুদ্ধে যেতে অমন উৎসাহী। সে হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে খতম করবে অ্যানিটার বিশ্বাসঘাতকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে তা না হলে সব জেনে শুনে কেনই বা সে পাগলের মতো অমন বিপজ্জনক জায়গায় গিয়ে শত্রুপক্ষের শিকার হতে যাবে? একদিন সে যুদ্ধে নিহত হল। 

জান অ্যানি। আমার বন্ধুর মৃত্যুর পর আমি মনে মনে শপথ নিলাম যেভাবেই হোক অ্যানিটাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। সবার অলক্ষ্যে একদিন উধাও হয়ে গেলাম। কিন্তু সবাই জানল আমি যুদ্ধে নিহত হয়েছি। তাতে আমার বিশেষ সুবিধে হল। 

একদিন আমার নৌকায় যাত্রীদের তুলেছি। হঠাৎ একটা বেঁটে লোককে দেখে আমার দৃষ্টি স্থির হল তার ওপর, সেও আমার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়েছিল। পরে লোকটির হোটেলে গিয়ে খবর নিয়ে জানলাম তার নাম কার্টন। হীরে সংগ্রহকারী ডে-বিয়ার্স-এর লোক। কিমবার্লি থেকে আসছে। 

সঙ্গে সঙ্গে আমি এই দ্বীপ ছেড়ে কিমবার্লি চলে গেলাম। রিভলবারটা নিতে ভুললাম না। কার্টনের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। রিভলবারের নলের সামনে সে স্বীকার করতে বাধ্য হল, হীরে চুরির ব্যাপারে সে আংশিকভাবে দায়ী, এবং অ্যানিটা গুনবার্গ তার স্ত্রী। তবে ইদানীং অ্যানিটা তার কাছে থাকত না। এই প্রথম তার কাছে ‘কর্নেলের’ নাম জানতে পারলাম। কর্নেলের দল থেকে অ্যানিটার তখন বেরিয়ে আসা খুব কষ্টকর। সে আমাকে তার স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকবার রেস্তোরাঁয় নৈশভোজ সারতে দেখেছে। আমাকে সে চিনতো কিন্তু সে জানত আমি যুদ্ধে মারা গেছি। কার্টনের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হল লোকটা জন্ম-অপরাধী নয়। 

আমাকে কার্টুন খবর দিল কর্নেলের ওপর অ্যানিটার আস্থা নেই। তার ধারণা হোটেল থেকে আমাদের হীরেগুলো হস্তগত করলেও অ্যানিটা কর্নেলের হাতে সব হীরে তুলে দেয়নি। আমি ভাবলাম কার্টনের কথা সত্যি হলে সেই হীরেগুলো পেলে পুলিস আমার ওপর থেকে সন্দেহ দূর করবে। কার্টনই আমাকে পরামর্শ দিল অ্যানিটা ওরফে নাদিনার কাছ থেকে সেই হীরেগুলো হস্তগত করার জন্য। তাহলে একঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। পুলিসকে সন্তুষ্ট করতে পারব। সেই সঙ্গে কর্নেলের সঙ্গে নাদিনার সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারব, নাদিনা তখন অবিশ্বাসিনী হতে বাধ্য হবে। 

কার্টনের ওপর আমার সন্দেহ ছিল। সে আমাকে বলেছিল, অ্যানিটাকে টেলিগ্রাম করে বলে দেবে আমি তার সঙ্গে ইংলন্ডে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি জানি কার্টনের মতো লোকেরা সত্য কথা বলতে জানে না। পরদিন কার্টনের বাড়িতে গেলাম, তার টেলিগ্রামের কোনো উত্তর অ্যানিটার কাছ থেকে এসেছিল কিনা। কিন্তু পাখি তখন উড়ে গেছে। দু’দিন পরেই কিলমার্ডেন ক্যাসেল জাহাজে আমি যাত্রী হয়ে গেলাম। কেমব্রিজে পড়ার সময় নাটকে ছদ্মবেশে নিয়ে অভিনয় করার অভ্যাস আমার ছিল। তাই জাহাজে ছদ্মবেশ নিয়ে কার্টনের চোখে ধুলো দিতে আমার অসুবিধে হল না। নির্বিবাদে লন্ডন পর্যন্ত ধাওয়া করলাম। 

—তারপর? 

লন্ডনে গিয়ে প্রথমেই সে নাইট ব্রিজের এক হাউস এজেন্টের কাছে যায় বাড়ির খোঁজে। হাউস এজেন্টকে বলে নদীর ধারে একটা ভালো বাড়ি চাই। সেই সময়ে আমিও সেখানে বাড়ির খোঁজে ছিলাম। হঠাৎ অ্যানিটা ওরফে নাদিনাকে সেখানে দেখলাম। হাউস এজেন্টের কথা শুনতে না পেলেও নাদিনার কণ্ঠস্বর শুনলাম যে-কোনো ভাড়ায় স্যার ইউস্টেস পেডলারের মার্লোর মিল হাউসটা সে পেতে চায়। হাউস এজেন্ট তাকে মিল হাউসে দেখার একটা অনুমতি পত্র লিখে দিল। 

তাহলে? বাড়ি ভাড়ার অছিলায় স্যার ইউস্টেস কি তাঁর দলের লোকদের সঙ্গে দেখা করতে চান ঐ মিল হাউসে? হীরে চুরির সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ছিলেন। আমার মনে হল ‘কর্নেলস’-এর ছদ্মনামে স্যার ইউস্টেস পেডলারই হয়তো সব কলকাঠি নাড়ছেন। সেদিন কার্টন এবং নাদিনার মিল হাউসে আগমন পূর্বপরিকল্পিত। 

অতি সন্তর্পণে আমার দু’জন সন্দেহভাজন লোককে অনুসরণ করলাম। তারপরের ঘটনা তো তুমি জান অ্যানি। হাউড পার্কে টিউব স্টেশনে কার্টনকে প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। হঠাৎ সেই সময়ে যে লোককে সে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার কথা ভাবছিল, তাকে প্ল্যাটফর্মে দেখে তার মাথা ঘুরে যায় এবং ভয়ে উত্তেজনায় টাল সামলাতে না পেরে রেললাইনের ওপর ঢলে পড়ে এবং তার মৃত্যু ঘটে। তারপর এক চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে আমি তার মৃতদেহ পরীক্ষা করেতে গিয়ে সেই চিরকুটটা তার জামার পকেট থেকে আবিষ্কার করি। সেই চিরকুটে সাক্ষাৎকারের কথা লেখা ছিল, ‘২২ তারিখ, কিলমার্ডেন ক্যাসল।’ তাড়াতাড়ির দরুন চিরকুটটা আমার হাত থেকে পড়ে যায় কিন্তু তার ভাষাটা আমার মনে ছিল। 

কাছাকাছি একটা ক্লোকরুমে ঢুকে আমার ছদ্মবেশ বদলে নাদিনাকে অনুসরণ করি মিল হাউসে ঢুকে। নাদিনাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। আমি বেশ বুঝতে পারি। চতুর কর্নেল আমাকে নাদিনা-হত্যার দায়ে দোষী করতে চায়, আমি ফাঁদে পড়ে গেছি। স্যার ইউস্টেস পেডলারই কর্নেলের ছদ্মনামে আড়ালে একটার পর একটা অপরাধ করে যাচ্ছেন। এতএব-

—জান, খুন হওয়ার সময় গাই প্যাগট মার্লোয় ছিল? ফ্লোরেন্সে তার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যায়নি। 

হ্যাঁ। প্যাগটকে আমিও প্রথমে সন্দেহ করতে পারিনি কিন্তু যেদিন সে তোমাকে জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল তখনি আমার কেমন সন্দেহ হল, কেন সে মিল হাউস পছন্দ করল? প্যাগট সেখানে অনায়াসে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসতে পারে কেউ তাকে লক্ষ্য করবে না। বলে রাখি, সেই হীরেগুলো নাদিনা সঙ্গে আনেনি। আমার ধারণা, সেই হীরেগুলো কার্টন কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকবে। এবং যতক্ষণ না সেগুলো কর্নেলের হাতে আসছিল ততক্ষণ কার্টনের বিপদ ছিল। কার্টন কি সত্যিই সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিল?

—সেটা অবশ্য আমার জানা নেই— 

আমি বললাম, সে আর এক কাহিনী, আমার কাহিনী বলছি। 

।। ছাব্বিশ।। 

আমার কথাগুলো হ্যারি খুব মন দিয়ে শুনল। আশ্চর্য হল, আমার ও সুজানের কাছে কি করে এল সেই হীরোগুলো। যাইহোক, নাদিনা এবং কার্টনের প্রশংসা না করে সে থাকতে পারল না। তারা কেমন চালাকি করে কর্নেলের চোখে ধুলো দিল। কিন্তু কে এই কর্নেল? গাই প্যাগট নাকি অন্য কেউ? 

—গাই প্যাগট আমি বলব। তবু কিন্তু থেকে যায়। প্যাগটকে অ্যানিটার হত্যাকারী হিসেবে ভাবতে দ্বিধা হয়। মনে হয় না প্যাগটের মতো একজন অধস্তন কর্মচারীর সঙ্গে অ্যানিটার কোনো লেনদেন থাকতে পারে। অতএব তাকে আমাদের সন্দেহের তালিকা থেকে অনায়াসে বাদ দেওয়া যেতে পারে। 

কিছুক্ষণ নীরবতার পর হ্যারি আবার বলতে শুরু করল : 

আচ্ছা অ্যানি, সেদিন তুমি যখন হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে আস সেইসময় মিসেস ব্লেয়ারকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার ঘরে পড়ে থাকতে দেখছ। আর স্যার ইউস্টেস তখন মিস পেটিগ্রিউকে নোট দিচ্ছিলেন। কিন্তু কর্নেল রেস তখন কোথায় ছিলেন? 

—আমি তাকে কোথাও দেখতে পাইনি। 

—তোমার সঙ্গে আমার যে গভীর বন্ধুত্ব আছে এ কথা তিনি জানেন? 

—হয়তো জানেন। ম্যাটাফেজ থেকে ফেরার সময় রেবার্নের প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় আমি বলেছিলাম। দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ উনি। উনি যে সেই কর্নেল ভাবতে কেমন অবাক লাগে। তাছাড়া আমার বিশ্বাস, ‘সিক্রেট সার্ভিস’-এ উনি জড়িত। 

আগ্রহের সহিত রেবার্ন বলল, এ বিশ্বাস তোমার কি করে হল অ্যানি? সত্যি করে বলবে অ্যানি, তুমি কি ওকে পছন্দ কর? 

—হ্যাঁ, আবার নাও হতে পারে। ঠিক কিছুই বলতে পারি না। কখনো হয়তো লোকটা আমার কাছে বিরক্তিকর বলে মনে হয়। আবার কখনও আগ্রহ জাগায়। তবে সবসময় একটা অজানা ভয় ওর কাছে আশঙ্কা করি। 

হ্যারি বলল, কিমবার্লিতে হীরে চুরির ঘটনার সময় উনি যে দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন, জান সে কথা? 

—তা হতে পারে, কিন্তু একথাও তো ঠিক, কর্নেল রেসই সুজানকে ‘কর্নেলের’ গল্প বলেছিলেন? 

— সে কথাও ঠিক, অতি বাস্তব কাহিনী। নিজের কাহিনী যে কেউ অপরের নামে এভাবেই চালিয়ে দিয়ে থাকে, বুঝলে অ্যানি? 

—কিন্তু এখানে প্যাগটের ভূমিকা তাহলে কী? সে কি শুধু বেতনভুক কর্মচারী? 

হয়তো আদৌ তার কোনো ভূমিকা নেই। সেদিন কিলমার্ডেনের ঘটনার কথা তুমি কি প্যাগটের নিজের মুখে শুনেছ? স্যার ইউস্টেসের মুখে শুনেছ, প্যাগট না কি তাকে জানায় যে, সেদিন ওর কেবিনের ঠিক বিপরীত দিকে কে থাকত? কর্নেল রেস? ধরা যাক, সেদিন কর্নেল রেস ডেকের ওপর তোমাকে আক্রমণ করে। পালাবার সময় প্যাগটকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, কিছু বোঝার আগেই সে তার কেবিনে ঢুকে যায়। 

—হয়তো তোমার কথাই ঠিক হ্যারি। প্যাগটকে প্রথমেই সন্দেহ করি কেপটাউনে একটা রেস্তোরাঁর সামনে আকস্মিকভাবে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে। সেই লোকটাই আমাকে অনুসরণ করছিল। মনে হল লোকটা প্যাগটকে কত সময় জিজ্ঞেস করে থাকবে, প্যাগটকে কব্জি ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখেছি। 

—কিন্তু প্যাগট লোকটা সম্পূর্ণ নির্দোষ। এখন মধ্যরাত্রি, কাল সকালেই তোমাকে বুলাওয়ে চলে যেতে হবে। তারপর লিভিংস্টোন থেকে বেইরার ট্রেন ধরবে। লিভিংস্টোন-এ আমার এক বন্ধু আছে। ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত তোমাকে আড়াল করে রাখবে। 

ওকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিলো না। তবু পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই রেবার্ন আমাকে জাগিয়ে তুলল। বাধ্য মেয়ের মতো আমি ওর পিছন পিছন বাইরে এলাম। মোটর-বোট তৈরি আর সেই সময়ে দূর থেকে জলের ছপ্ ছপ্ শব্দে আমরা সতর্ক হলাম। কী ব্যাপার? রেবার্ন দেশলাই কাঠি জ্বালে অন্ধকার দূর করার জন্য। সেই সময়ে শব্দটা আরও কাছে মনে হল। ছায়ামূর্তিটাকে চিনতে পারলাম। লাল দাড়িওলা সেই হল্যান্ডিয় লোকটা, যাকে সেদিন মুই জেনেবার্গের ভিলায় দেখেছিলাম। 

রেবার্ন তাকে দেখেই আমার হাতে টান দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে চলো। 

সেই কাঠের ছোট ঘরে ফিরে, রিভলবাারে টোটা ভরতে ভরতে আমাকে বলল, রিভলবার চালাতে পার? 

—একবার দেখিয়ে দিলে পারব নিশ্চয়। 

—ঠিক আছে, বাইরে চলো; আমার হাতে গুলি ভর্তি রিভলবারটা তুলে দিয়ে রেবার্ন হুকুম করল ঐ লোকগুলোর মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ো, তাড়াতাড়ি। 

আমাদের দু’জনের রিভলবারের থেকে নীল রঙ ঝলসে উঠে নিস্তব্ধ ভেঙে দিয়ে গুলির আওয়াজে দ্বীপের চারদিকে গুমরে উঠল। হঠাৎ দেখলাম আমাদের আক্রমণকারীর দল পিছু হটে ছুটে পালাচ্ছে। 

রেবার্ন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এই প্রথম এক হাতে কাছে টেনে নিল। ও নিবিড়ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর জয়ের হাসি হেসে বলল, কাপুরুষরা এ যাত্রায় পালিয়েছে। আবার আসবে, আমাদের ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে শয়তানগুলোর মোকাবেলা করার জন্য, কি বল অ্যানি? 

আমার সমর্থন পাওয়ার জন্য ও আমার মুখটা দু’হাতের চেটোয় তুলে ধরল। অ্যানি! কী সুন্দর তোমার রূপ; তুমি আমার এই ছোট্ট প্রাসাদের ছোট্ট রানী। আজ তোমাকে দেখে আমার এই ধারণা হয়েছে। সিংহী থেকে তোমার শক্তি কম নয়। তোমার ঐ মায়াবী চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। গভীরভাবে আমাকে চুমু খেয়ে আমার নরম চুলের মধ্যে মুখ রাখল। এইভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যে কতক্ষণ ছিলাম জানি না, হঠাৎ সামনের জলের দিকে তাকাতেই আমার বুক শুকিয়ে গেল, হ্যারি, ঐ দেখো, ওরা আবার ফিরে আসছে। 

—তাইতো, আমাদের অবস্থা এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমার নৌকাখানা ওরা তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, তুমি সাঁতার জান, অ্যানি? 

—হ্যাঁ। 

ঠিক হল সাঁতরে আমাকে নদীর ওপারে যেতে হবে। সেখান থেকে বেইরার ট্রেন ধরে আমার হোটেলের বন্ধুদের কাছে ফিরে যেতে হবে। রেবার্নের নির্দেশ হল—সুজানকে বুঝিয়ে হীরের টুকরোগুলো ‘পার্কারের’ নামে ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে। তারপর ‘কর্নেল’ নামে লোকটার রহস্য উন্মোচন করতে হবে। 

—কিন্তু কী পরিচয়ে তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হবে তা তো বললে না?

আমার কাছ থেকে যে কোনো টেলিগ্রাম ‘অ্যান্ডির’ নামে তোমার কাছে যাবে। 

হ্যারির বন্ধু নেড এসে বলল, ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এল হ্যারি। 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। 

।। সাতাশ।। 

(স্যার ইউস্টেস পেডলারের দিনলিপি) 

আমি সবসময়েই বলে থাকি আমি শান্তিপ্রেমী, শান্তিতে বাস করতে চাই। রাতে ফলস-এ পৌঁছে মিস পেটিগ্রিউকে নোট দিচ্ছি সেদিন রাতে, হঠাৎ মিস ব্লেয়ার আমার চেম্বারে ঢুকে বললেন অ্যানি কোথায়? 

—নিশ্চয় সে এখন বিছানায় গভীর ঘুমে ঘুমাচ্ছে। 

ততোধিক উত্তেজিত কণ্ঠে মিস ব্লেয়ার বলল, সে তার ঘরে নেই। এইমাত্র তার ঘর থেকে আসছি। 

—তা কর্নেল রেস কী করছেন? তার কাছে একবার খবর নিতে পারেন না? 

—কিন্তু কর্নেল রেসকে তো কোথাও দেখতে পেলাম না। 

—হয়তো ওরা দু’জনে কোথাও বেরিয়েছে- 

—এত রাত্রে? 

যুবক-যুবতীরা সাধারণত গভীর রাতেই এমন ভুল করে থাকে। মিস বেডিংফিল্ডের কাঁচা বয়স, কিন্তু কর্নেল রেস তো অনেক আগেই সেই বয়স পেরিয়ে এসেছেন। তাহলে? 

তখন আমি ভাবলাম জোহান্সবার্গে চলে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময় বটে।

মাসখানেক পরে একদিন একটা গুজব কানে এল। নদীর ওপারে একটা রহস্যময় দ্বীপ আছে। সেখানে বছরের পর বছর ধরে একজন যুবক বাস করছে। কিছুদিন হল, সেখানে একটি মেয়ে তার সঙ্গিনী হয়েছে। সবাই সেই যুবকটিকে কে কোনো এক হোটেলের ম্যানেজার বলে জানে। হোটেলের খদ্দেরা সেই যুবকটির নৌকায় চড়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে যায় সেই দ্বীপে! খবরটা শুনে কর্নেল রেস তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। মনে হয় মেয়েটি অ্যানি। 

আমি কাল সকালেই জোহান্সবার্গে চলে যাচ্ছি, আমার সাথী হচ্ছে মিস পেটিগ্রিউ। প্রথমে মিসেস ব্লেয়ার আমার সাথী হবে বলেছিল, পরে মত বদলায়, সম্ভবত ফলস্ থেকে কর্নেল রেসকে চোখে চোখে রাখতে চায়। শেষে সে আমাকে অনুরোধ করে তার সেই কাঠের খেলনাগুলো হেফাজতে রাখতে হবে। সেগুলোর প্রতি কেন তার এক আগ্রহ ঠিক বুঝি না। কাঠের খেলনাগুলো একটা বড় কাঠের বাক্সবন্দী করে কেপটাউনে প্যাগটের জিম্মায় রাখার ব্যবস্থা হল। 

জোহান্সবার্গ ৬ই মার্চ। 

এখানে একটা ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। কেপটাউনে প্যাগটকে রেখে এসেছিলাম অকেজো করে রেখে। আগামীকালই এখানে আসছে। 

কিউরিও-শপ্ থেকে সুভেনির কেনার জন্য আজ সকালে বেরিয়ে পড়লাম একা। আগে একদিন সেখানে গিয়েছিলাম, মিস পেটিগ্রিউ ছিল। কিউরিও-শপ থেকে বেরবার মুখে কর্নেল রেসের সঙ্গে দেখা হল। 

—আপনি যে জোহান্সবার্গে আছেন, আমি ধারণাই করতে পারিনি। তা কবে এখানে এলেন?

গতকাল রাত্রে। বন্ধুদের সঙ্গে থাকছি। 

হোটেলে ফিরে এসে বললাম, মিস বেডিংফিল্ড কি বেঁচে আছেন? কোনো খবর পেয়েছেন তার? মেয়েটি ভাবিয়ে তুলেছে, না? 

—এতদিন সে একটা দ্বীপে ছিল— 

—কোন্ দ্বীপে? যে দ্বীপে সেই যুবকটি থাকে? 

—হ্যাঁ। যুবকটিকে একবার আমরা হাতের মুঠোয় পেলে ওকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারব।

—না, জানেন, হ্যারি রেবার্ন ওরফে হ্যারি লুকাস তার নাম। একবার সে আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালায়, কিন্তু তার নাগাল আমরা শিগগীর পাবই। মনে হয় না, কোনো দুষ্কর্মের সঙ্গে মেয়েটি জড়িত তবে এটা একটা প্রেমঘটিত ব্যাপার মাত্র। 

আমার মনে হয়েছে, অ্যানির সঙ্গে রেসের ভালোবাসার সম্পর্ক আছে। 

বুলাওয়ে থেকে অ্যানি আমাকে চিঠিতে জানিয়েছে। ওর দেশে ফেরার পথে ও বেইরায় যাচ্ছে। 

—আমার মনে হয় না সে গেছে, এই বলে পকেট থেকে একটা টেলিগ্রাম বার করে তাকে দিয়ে বলি, এটা পড়ে দেখুন তাহলেই আসল ব্যাপারটা জানতে পারবেন। 

—কিন্তু ও যে লিখেছে, ও বেইবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। রেসের চোখে বিস্ময়।

রেস একটা নিরেট বোকা ছাড়া কিছু নয়। মেয়েরা যে সত্যি কথা বলে না, এ ধারণা তার নেই।

—কিমবার্লিতে গেছে? ওখানে ওরা কী করছে? সেখানে দেখার মতো কোনো ভালো জায়গা আছে। 

আমি বললাম, ডেইলি বাজেট পত্রিকা কেনার থাকলে সে তো এখানেই কিনতে পারত।

গম্ভীর গলায় রেস বলে, স্যার ইউস্টেস, যদি কিছু মনে না করেন তো দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে। 

—নিশ্চয়ই, বলুন কী জানতে চান? 

।। আঠাশ।। 

(অ্যানির জবানবন্দী) 

সুজানকে টেলিগ্রাম করেছিলাম কিমবার্লিতে পৌঁছেই। সে সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে চলে আসে। অনেকদিন পর সে আমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। দুজনে ভাবাবেগ কাটিয়ে উঠে আমি তাকে সংক্ষেপে সব ঘটনা বললাম। জান অ্যানি, কর্নেল রেসকে সন্দেহ করতে শুরু করা মাত্র সেই হীরেগুলো নিয়ে আমার ভয় হল। বুদ্ধি করে সেই কাঠের খেলনায় চালনা করে হীরেগুলো স্যার ইউস্টেসের হেপাজতে রেখে দিয়েছি। প্যাগটকে তিনি তার ভার দিয়েছেন। সেই খেলনাগুলো এখন কেপটাউনে নিরাপদে রয়েছে। আজই প্যাগট জোহান্সবার্গ আসছে স্যার ইউস্টেসের সঙ্গে দেখা করতে। 

—হীরেগুলো নিরাপদ স্থানে থাকলেই তো ভালো। এ ব্যাপারে আর কোনো চিন্তা রইল না, কি বলো? এদিকে র‍্যান্ডের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। 

ইতিমধ্যে রেবার্নের একটা টেলিগ্রাম পেলাম, সহজ সরল ভাষায় লেখা—নিরাপদে পৌঁছেছি। সবকিছু ঠিকঠাক চলেছে। এরিক এখানে ভালোই আছে এবং ইউস্টেসও। কিন্তু গাই প্যাগট এখনো পৌঁছায়নি। এখন তুমি যেখানে আছে সেখানেই থাকো। অ্যান্ডি। 

এরিক আমাদের রেসের ছদ্মনাম। নামটা আমিই পছন্দ করি, রেস নামটা আমার অপছন্দ। এখন প্যাগটের অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। 

কিমবার্লি স্টেশনে আমি একাই প্যাগটের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কুশল বিনিময়ের পর তাকে সরাসরি বললাম, গত ৮ই জানুয়ারি মার্লোয় কী করছিলেন? 

তার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল, গম্ভীরভাবে বলল, সে এক বিশেষ পরিস্থিতির কথা আমি বলতে পারব না। বললে আপনি আঘাত পাবেন। ভয়ঙ্কর লজ্জার কথা। না আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না মিস বেডিংফিল্ড। 

ট্রেনটা আবার যাত্রা শুরু করতেই প্যাগট তার কামরায় উঠে বসল। 

প্যাগটের কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তা ঠিক নয়।

হোটেলে ফিরে দেখলাম রেবার্নের টেলিগ্রাম, সে আমাকে এক্ষুনি জোহান্সবার্গ যেতে লিখেছে। আমার জন্য স্টেশনে একটা গাড়ি অপেক্ষা করবে। টেলিগ্রামে অ্যান্ডির সই নেই। তবে সইটা হ্যারির। 

ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। 

।। ঊনত্রিশ।। 

(স্যার ইউস্টেসের দিনলিপি থেকে। জোহান্সবার্গ, ৭ই মার্চ) 

জোহান্সবার্গে এসেই প্যাগট জানান মিসেস ব্লেয়ারের সেই ছোট প্যাকেট দুটো যার মধ্যে খেলনা ছিল খুলেছে। লোকটার মুর্খামির একটা সীমা আছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন তুমি ও দুটো খুললে? ছিঃ ছিঃ, উনি কী ভাববেন বলো তো? 

প্যাগট দুঃখ প্রকাশ করে বলল, স্যার ইউস্টেস, বলব বলব করেও আপনাকে বলা হয়নি। কিন্তু আজ না বলে পারছি না। ব্যাপারটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। মিল হাউসে ঐ মেয়েটি খুন হওয়ার পর দিন আমি মার্লো ছিলাম। ফ্লোরেন্স যাইনি। 

—তা মার্লোয় যাওয়ার কী এমন কারণ ঘটল তোমার? 

—বললাম তো স্যার, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার স্ত্রী— 

—তোমার স্ত্রী? মানে তুমি বিবাহিতা? সে কথা তো আগে বলোনি? 

—প্যাগট মাথা নিচু করে বসে। অপরাধ নেবেন না স্যার, আমাদের বিয়ে হয়েছে আট বছরেরও বেশি হবে। আপনার কাছে চাকরি করতে আসার মাস ছয়েক আগে বিয়ে হয়। সেক্রেটারি হিসেবে আপনার কাছে সবসময় থাকতে হবে, বিয়ে করেছি জানলে নতুন চাকরিটা হারাতে হয়, সে ভয়ে ব্যাপারটা চেপে যাই। 

—উঃ তোমার কথা শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, তা তোমার স্ত্রী রত্নটিকে কোথায় রেখেছ এতদিন? 

—মার্লোয় মিল হাউসের কাছেই নদীর ধারে একটা বাড়িতে। পাঁচ বছর সেখানে আছি। সেদিন আমাকে মার্লোয় ফিরে আসতে হয় স্ত্রীর অসুস্থতার দরুন। সে তখন সন্তানসম্ভবা ছিল— 

—তা তোমার এই বংশবৃদ্ধির কথা অন্য কাউকে বলেছ? 

—হ্যাঁ স্যার, মিস অ্যানি বেডিংফিল্ডকে বলেছি। কিমবার্লি স্টেশনে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। স্যার এখানে এসে রেবার্নকে দেখলাম একটা রাস্তা পার হতে। তারপর তাকে মিস পেটিগ্রিউ-এর সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম নেটিভদের একটা কিউরিও-শপের সামনে- 

—কী বললে, আমার সেক্রেটারি মিস পেটিগ্রিউ-এর সঙ্গে রেবার্নের যোগাযোগ আছে?

—হ্যাঁ স্যার, আর একটা আশ্চর্য কথা। মিস পেটিগ্রিউ-এর হোটেল পর্যন্ত আমি গতরাতে ধাওয়া করি। সেই সময়ে তার ঘর থেকে একজন পুরুষকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। পরে তার ঘরে অনুসন্ধান করে দাড়ি কামানোর সেফটি রেজার এবং সেভিং সোপ পেয়েছি। এগুলো কারা ব্যবহার করে? পুরুষ নিশ্চয়ই। তাহলে এর থেকে মিস পেটিগ্রিউ-এর সেক্স সম্বন্ধে কি সন্দেহ জাগে না? 

—অবশ্যই! আমি মন্তব্য করলাম। 

—তাহলে আপনি বুঝতে পারছেন, মহিলার ছদ্মবেশে পেটিগ্রিউ একজন পুরুষ- 

—সত্যিই সে একজন পুরুষ। হ্যাঁ প্রথমদিন আমি তার পা দেখেই কিছুটা অনুমান করেছিলাম, বুঝলে? আমার ঠোটের রহস্যময় হাসিটা প্যাগট দেখতে পেল না। দেখলে হয়তো সামলানো দায় হত।