০১. ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং

ইভিল আনডার দ্য সান (এরকুল পোয়ারো)

প্রথম পরিচ্ছেদ

১.১

ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং যখন লেবারকোম্ব উপসাগরের এক দ্বীপে ১৮৭২ সালে একটা বাড়ি তৈরি করলেন, তার খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিলো তখন সেটাকে। একজন ব্যক্তির পক্ষে নদী বয়ে যাওয়া সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তরে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করাই বেশি স্বাভাবিক ছিল।

এর পরম ভালোবাসা ছিল, ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং বাড়িটা তৈরি করলেন বেশ শক্ত কাঠামোয়। জোয়ারের সময়ে সেটা মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো, চঞ্চল বাতাস ও গাঙচিল ছোট পাথুরে অন্তরীপের ওপর।

তাঁর প্রথম ও শেষ সঙ্গিনী ছিলো সমুদ্রই। সেই বাড়ি এবং দ্বীপের মালিক হলেন তার মৃত্যুর পর। তাদের নিজেদের জমি-জমা ক্রমশ কমে আসছিলো, এই সম্পত্তি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালেন না। খারাপের দিকে তাদের উত্তরাধিকারীদের অবস্থা ক্রমে ক্রমে কমে যেতে লাগলো।

সমুদ্রতীরে অবসর যাপনের সৌখিন রীতি যখন ১৯২১ সালে। ডেভন ও কর্ণওয়াল উপকুল গ্রীষ্মকালেও আর অসহ্য বলে মনে হলো না। তার বাড়ি বিক্রি হবার নয়, কিন্তু তিনি ভালো দামই পেলেন। কারণ সমুদ্রচারী ক্যাপ্টেন রজারের সংগ্রহ করা সম্পত্তির বিনিময়ে।

একটা কংক্রীটের সেতু মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপ পর্যন্ত। দ্বীপের সর্বত্র তৈরি হলো পরিকল্পনা মাফিক। তৈরি হলো মনোরম পথ ও অবসর যাপনের নিভৃত স্থান। জলি রজার হোটেল, স্মাগলার্স দ্বীপ দুটো টেনিস কোর্ট, ভেলা ও স্প্রীং-পাটাতনে সাজানো সৈকতের দিকে নেমে আসা খোলা চত্ত্বর। বিজয়ীর ভঙ্গিতে লেদারকোম্ব উপসাগর একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করলো। জলি রজার হোটেলে সাধারণত তিলধারণের জায়গা থাকতো না, এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাথা পিছু থাকার খরচও বেড়ে গেল।

লেদারকোম্ব উপসাগরে গেছেন কখন, জায়গাটা একটা দ্বীপের মতো। ওখানে ভীষণ ভালো একটা হোটেল আছে। জায়গাটা খুব আরামের, কোনো উটকো লোক বা শ্যারাব্যাং-গাড়ির ঝামেলা নেই। ওখানে যাওয়া উচিত আপনার।

.

১.২

 রজারে বাস করছেন একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি জলি। তিনি আসল দৃষ্টি মেলে দিয়েছেন সামনের সমুদ্রতীরের দিকে, ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। গোঁফজোড়া বাঁকানো রাজকীয় পদ্ধতিতে, পরনে তার দুধ-সাদা ধবধবে স্যুট, মাথায় পানামা টুপি চোখের উপর নামানো।

সমুদ্রতীরের দিকে সিমেন্ট বাঁধানো একাধিক চত্ত্বর ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। রবার ও ক্যাম্বিশের তৈরি নৌকো, পলিথিনের বল, খেলনা এবং কয়েকটা ভেলা ও একটা দীর্ঘ স্প্রীং পাটাতনের সামনের দিকে ছড়িয়ে রেখেছে।

কথাবার্তার স্রোত ভেসে আসছে, পোয়ারোর বাঁ দিক থেকে মিসেস গার্ডেনারের অবিশ্রান্ত একঘেয়ে বুলি মুহূর্তের জন্যেও বিচলিত হচ্ছে না মিসেস গার্ডেনারের কর্মব্যস্ত হাত। কথার স্রোত এবং উল বোনার কাটার দক্ষতায় তাল রেখে এগিয়ে চলেছে। একটা দোলনা-চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন তাঁর স্বামী ওডেল সি. গার্ডেনার। মাথার টুপিটা টেনে নামানো নাকের ওপর এবং কোনোরকম উৎসাহ পেলেই তিনি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে সরব হচ্ছেন।

মিস ব্রুস্টার পোয়ারোর ডান পাশে বসে। তার মাথায় ধূসর চুল; মুখমণ্ডলে প্রকৃতি-সহিষ্ণুতার ছাপ; শরীরের গঠনটা অনেকটা অ্যাথলেটিকদের মতো।শিকারী হাউন্ড যেন কোনো পমেরেনিয়ান কুকুরের যতিহীন তীক্ষ্ণ চীৎকারকে কর্কশ ধমকের সাহায্যে বাধা দিতে চেষ্টা করছে।

মিসেস গার্ডেনার তখন বলে চলেছে, আমি বললাম মিঃ গার্ডেনারকে, প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা খুব ভালো, যে কোনো জায়গা তন্ন তন্ন করে ঘুরে দেখতে চাই। আমি বললাম, মোটামুটি ভালোভাবে ঘুরে দেখেছি গোটা ইংলন্ডটা। সমুদ্রের কাছাকাছি শান্ত পরিবেশে গিয়ে বিশ্রাম করতে আমি চাই। আমি ওকে বলেছি, আমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।

হ্যাঁ সোনা, বলে টুপির নিচ থেকেই অনুচ্চ কণ্ঠে জবাব দিলেন।

তার কাহিনীর পশ্চাদ্ধাবনে মনোনিবেশ করলেন মিঃ গার্ডেনার। বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি যেচে, আর সে কারণেই যখন আমি কুক-এর মিঃ কেলসোকে একথা জানালাম। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তিনি না থাকলে আমরা যে কি করতাম। এর চেয়ে ভালো জায়গা নেই, মিঃ কেলসোকে এ জায়গাটার কথা বলা মাত্রই তিনি বললেন। জলি রজার অন্য সব হোটেলের চেয়ে আলাদা। নির্জন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সঙ্গে পরিচর্যার সুব্যবস্থা, জল কলের ব্যবস্থার কথা জানতে চেয়েছিলেন, মিঃ গার্ডেনার, মিঃ গার্ডেনারের এক বোন একবার এই জাতীয় একটি অতিথিশালায় দিন কয়েক ছিলেন, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, শুনলে অবাক হবেন নিতান্তই গ্রামের মতো, কলঘরের ব্যবস্থা ছিলো মাটির তৈরি। এ ধরনের নির্জন সুন্দর জায়গা সম্পর্কে মিঃ গার্ডেনার সন্দেহপ্রবণ তা না, ওডেল, বলেছেন মিঃ গার্ডেনার নিশ্চয়ই শোনা।

আমাদের আশ্বাস দিলেন মিঃ কেলসো, সঙ্গে সঙ্গে বললেন–এখন দেখছি সে কথা সত্যি, জলকলের ব্যবস্থা আধুনিক এবং রান্না অত্যন্ত চমৎকার, সময়ানুবর্তিতা আমি সবচেয়ে পছন্দ করি; বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাইছি। এলাকাটা ছোট হওয়ায় সুযোগ রয়েছে প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রত্যেকের পরিচয়ের। তারা একটু আলাদা থাকতে চায়, যদি ইংরেজদের কোনো দোষ থেকে থাকে তাহলে আপনার সঙ্গে পরিচয় বছর দুয়েকের পুরানো না হওয়া পর্যন্ত। এখন দেখতে পাচ্ছি, মিঃ কেলসো আরও বললেন, নানান ধরনের বিচিত্র সব মানুষেরা এসে ভীড় করে এই স্মাগলার্স দ্বীপে। সে কথা মিথ্যা নয়, আমার তো পালকের ঘায়ে মূৰ্ছা যাবার মতো অবস্থা আপনার আসল পরিচয় পেয়ে তাই না, ওডেল।

হ্যাঁ সোনা, সত্যি কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো। সামান্য সুযোগ পেয়েই সরব হলেন মিস ব্রুস্টার।

এরকুল পোয়ারো ক্ষীণ প্রতিবাদে হাত তুললেন, নিছক ভদ্রতাবশেই সে প্রতিবাদ এড়িয়ে চললেন মিসেস গার্ডেনার সাবলীলভাবে।

জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কিছু শুনেছি কর্নেলিয়া রবসনের কাছে। আমি এবং মিঃ গার্ডেনার ব্যাডনহফে ছিলাম গত মে মাসে। সেই সময়েই লিটেন বিজওয়ে খুন হয়। কর্নেলিয়া মিশরের ব্যাপারটা আমাদের বলেছে। আপনাকে দেখার জন্য আমি একবারে পাগল, আপনি যেভাবে ঘটনাটার সমাধান করছেন তাই না ওডেল?

হ্যাঁ সোনা, মিস ডার্নলির কথা। পোষাকগুলোর একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে কারণ বেশিরভাগ জামাকাপড়ই রোজমন্ড থেকে কেনা। আর রোজমন্ডের মালিক উনিই। ওর দোকান থেকেই কেনা গত রাতের পোষাকটা। মেয়েটিকে সব দিক দিয়ে ভীষণ ভালো লাগে।

মেজর ব্যারী তার বিস্ফারিত চোখ ওপরে নিবদ্ধ রেখে বসেছিলেন মিস ব্রুস্টারের পেছনে। গম্ভীর স্বরে মন্তব্য করলেন, মেয়েটির চেহারায় বিশেষত্ব আছে।

মিসেস গার্ডেনারের উল বোনার কাঁটা সশব্দে সচল হলো।

মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা কথা স্বীকার না করে পারব না। ভীষণ অবাক হয়েছি আপনাকে এখানে দেখে! মিঃ গার্ডেনারও সে কথা জানেন। আমি কি বলতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছেনও। নিশ্চয়ই আপনার পেশার প্রয়োজনে এসেছেন এখানে। মিঃ গার্ডেনারও সেই কথাই বলবেন, আমার অনুভূতি প্রখর। আমি একেবারেই বরদাস্ত করতে পারি না, যে কোনো ধরনের অপরাধকে।

দেখতেই পাচ্ছেন, মিঃ গার্ডেনার গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন। বললেন, মিসেস গার্ডেনারের যষ্ঠেন্দ্রিয় সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর। দুহাত শূন্যে বিক্ষিপ্ত হলো পোয়ারোর। মাদাম, আমাকে অন্তত একবার আশ্বাস দেবার সুযোগ দিন। কোনো অপরাধের কথা আমি এখন চিন্তাও করছি না; আপনাদের মতোই ছুটি কাটাতে আনন্দ করতে এসেছি।

স্মাগলার্স দ্বীপে কোনো দেহ নেই, রুক্ষ স্বরে মন্তব্য করলেন মিস ব্রুস্টার।

পুরোপুরি সত্যি নয়–এরকুল পোয়ারো বলেন। নিচের বেলাভূমির দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন, সারি সারি শুয়ে থাকা শরীরগুলো তাকিয়ে দেখুন, কি ওগুলো, মহিলা কিংবা পুরুষ নয়। ওরা শুধুই দেহ ওদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

সপ্রশংস সুরে বললেন, মেজর ব্যারী, ওদের মধ্যে কয়েকটা মেয়ের চেহারা দেখবার মতো। যদিও একটু রোগার দিকে।

জোরালো কণ্ঠে পোয়ারো বললেন, মানছি সুন্দর চেহারা, কিন্তু কি আবেদন আছে এর, রহস্য আছে কি? আমি বৃদ্ধ সেকালের লোক, বড়জোর গোড়ালিটুকু দেখা যেত যখন আমি ছোট ছিলাম। লুব্ধ করার মতো সফেন সেমিজের। মেজর ব্যারী কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন, দুষ্টু দুষ্টু।

মিস ব্রুস্টার বললেন, আজকাল আমরা যে সব পোশক পরি, তা অনেক বেশি মনোজ্ঞ।

মিসেস গার্ডেনার বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, জানেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেশি স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। সুন্দর মনের পরিচয় পাওয়া গেল, মুখের রক্তিম আভাসে মিসেস গার্ডেনার, বুঝতেই পারছেন তো মেলামেশার ফলাফলের কথা চিন্তা করে না।

এরকুল পোয়ারো বললেন, রীতিমতো দুঃখের কথা, আপনি ঠিকই বলেছেন।

 মিসেস গার্ডেনার তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, দুঃখের কথা!

সব কিছুরই মানদণ্ড নির্দিষ্ট হয়ে গেছে আজকাল দুঃখের কথা নয়, তিনি হাত তুলে নির্দেশ করলেন অর্ধশায়িত দেহগুলোর। এ কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্যারিসের লাশ রাখা ঘর।

মিসেস গার্ডেনার অস্বস্তি অনুযযাগের সুরে বলে উঠলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, অনেকটা মাংসের দোকানের মতো পাথরের ওপর সাজানো দেহগুলি। এ বড্ড কষ্টকল্পিত পোয়ারো, তাই না।

স্বীকার করলেন এরকুল পোয়ারো, হয়তো–হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত একটা বিষয়ে মিসেস গার্ডেনার দ্রুত হাতে বুনতে শুরু করলেন। তাদের হাতে পায়ে অতিরিক্ত লোম জন্মাতে বাধ্য। এভাবে খালি গায়ে মেয়েরা রোদে শুয়ে থাকে। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সেই কথাই বলেছি আমার মেয়ে আইরিনকে, ওকে বলেছি তুমি যদি এভাবে খালি গায়ে রোদে শুয়ে থাকো, সারা শরীর লোমে ছেয়ে যাবে, তোমার হাতে লোম হবে, পায়ে লোম হবে। তাহলে কি রকম দেখাবে বলতো তোমাকে। বলিনি ওডেল মিঃ গার্ডেনার বললেন, হ্যাঁ সোনা। তারা মনে মনে চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ সকলেই চুপচাপ। সেলাই গুছিয়ে নিয়ে মিসেস গার্ডেনার বললেন, তাই ভাবছি।

কি হলো সোনা, মিঃ গার্ডেনার বললেন।

মিসেস গার্ডেনারের কাছ থেকে সেলাই ও সেলাইয়ের বইটা নিলেন। দোলনা চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন হাত বাড়িয়ে। মিস ব্রুস্টার আসবেন নাকি, জিজ্ঞেস করলেন। একসঙ্গে বসে একটু গলা ভেজানো যাবে।

নাঃ, ধন্যবাদ, এখন নয়।

গার্ডেনাররা হোটেলের দিকে এগিয়ে চললেন। মার্কিন স্বামীরা দারুণ চমৎকার, মিস ব্রুস্টার বললেন।

.

১.৩

 মিসেস গার্ডেনারের শূন্যস্থান পূরণ করলেন ধর্মযাজক স্টিফেন লেন, শরীরের সতেজ আভাস সুস্পষ্ট দীর্ঘকায় পঞ্চাশস্পর্শী। মুখের রঙ তামাটে, পরনের গাঢ় ধূসর প্যান্টে অগোছালো ছাপ। লেদারকোম্ব উপসাগর থেকে হারফোর্ড পর্যন্ত গিয়েছিলাম, উৎসাহভরে বললেন। চমৎকার জায়গা পাহাড়ি রাস্তা ধরে ফেরার সময় এলাম। মেজর ব্যারী বললেন, আজকের দিনে পরিশ্রমের কাজ হেঁটে বেড়ানো। হাঁটাহাঁটি তিনি একদম পছন্দ করেন না।

মিস ব্রুস্টার বললেন, ভালো ব্যায়াম, আমার নৌকো নিয়ে বেরোনো হলো না। নৌকো চালানোর চেয়ে ভালো ব্যায়াম আর নেই, পেটের পেশীর পক্ষে।

নিজের স্ফীত মধ্যপ্রদেশের দিকে পোয়ারোর বিষণ্ণ দৃষ্টি ধীরে ধীরে নেমে এল।

মিস ব্রুস্টার সেটা লক্ষ্য করে সান্ত্বনার সুরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, রোজ যদি নৌকো নিয়ে বেরোন, আপনার ভুড়ি দিন কয়েকের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে।

আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি ঘোট নৌকো, মাপ করবেন। মাদমোয়াজেল চোখ বুজে শিউরে উঠলেন ছোট বড় সব রকমের নৌকো। মোটেই সুখের নয় সমুদ্রের দুলুনি। পুকুরের মতো শান্ত সমুদ্র আজ। উত্তর দিলেন পোয়ারো প্রত্যয়ের সুরে-সমুদ্র বলে সত্যি কিছু নেই, মাদমোয়াজেল। সেখানে সব সময় রয়েছে আলোড়ন। মেজর ব্যারী বললেন, যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবো-সমুদ্র রোগের দশভাগের ন ভাগই হচ্ছে স্নায়ুর ব্যাপার। মেজর ঠিক বলেছি তো, সামান্য হেসে ধর্মযাজক বললেন, একজন অভিজ্ঞ নাবিকের কথা শুনুন। ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সমুদ্র-রোগ জিনিষটাকে মনে একেবারেই আমল দেবেন না। আমার মত এই সমুদ্র রোগটা ভারী অদ্ভুত। মিস ব্রুস্টার আনমনা সুরে বললেন, এ ভারি অন্যায়, সবার হয় না কারো কারো হয় কেন? নিজের স্বাস্থ্যের উপর কারোর হাত নেই। রীতিমতো রুগ্ন চেহারার লোকও দক্ষ। আমাকে একজন নাবিক বলেছিলো। শিরদাঁড়ার কি একটা রোগের সঙ্গে নাকি এটার যোগ আছে। আবার অনেকে উঁচু জায়গা একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমিও ঐ দলের কিন্তু মিসেস রেডফার্মের আরও অবস্থা খারাপ। এই তো সেদিন হারফোর্ডের পাহাড়ি পথে মাথাঘুরে গিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়েই ধরলেন। তাঁর মুখেই শুনেছি, মিলান গির্জা পথে মাঝ-সিঁড়িতে আটকে পড়েছিলেন। চিন্তা না করেই উঠে গেছেন ওঠবার সময়। বিপদ হয়েছে নামার সময়।

মন্তব্য করলেন স্টিফেন লেন, পিক্সি কোভে নামার মইটা ব্যবহার না করাই উচিত, মুখভঙ্গী করলেন, মিস ব্রুস্টার কাওয়ান আর মাস্টারম্যানদের ছেলেরা দৌড়ে ওঠানামা করতে ভালোবাসে। ওটাকে আম ভয় করি। ছোটদের পক্ষে মইটা ঠিক আছে।

মিসেস রেডফার্ন স্নান সেরে ফিরে আসছেন, লেন বললেন।

উনি সূর্যস্নান করেন না। ওঁকে মঁসিয়ে পোয়াবোর পছন্দ হওয়া উচিত। মিস ব্রুস্টার মন্তব্য করলেন।

তরুণী মিসেস রেডফার্ন মাথা থেকে টুপিটা খুলে চুল ঝাড়ছিলো। মাথার চুল ছাইরঙা, ত্বকের রংও চুলের সঙ্গে মানানসই। অত্যন্ত সাদা হাত পায়ের রং। অন্যদের তুলনায় রোদে কম ভাজা হয়েছেন, তাই না। মেজর ব্যারী চাপা হাসিতে মুখ খুললেন। ক্রিস্টিন রেডফার্ণ বেলাভূমি ধরে এগিয়ে এলো, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো দীর্ঘ স্নান-পোশাকে নিজেকে আবৃত করে। মুখের ছায়া সুন্দর গম্ভীর হাত পায়ের গড়ন ছোট হলেও নিখুঁত। স্নান পোষাকটাকে ভালো করে জড়িয়ে ওদের পাশে এসে বসলো।

আপনি মঁসিয়ে পোয়ানোর মূল্যবান প্রশংসা অর্জন করেছেন। মিস ব্রুস্টার বললেন। তিনি একদম পছন্দ করেন না সূর্যস্নান করা। কসাইয়ের দোকানে সাজানো মাংসের মতো দেখায় যদি সত্যিই সূর্যস্নান করতে পারতাম।

ক্রিস্টিন রেডফার্ন বিষণ্ণভাবে হাসলো, বললো, আমার গায়ের রং বাদামী হয় না, ফোস্কা পড়ে শুধু ফোঁটা ফোঁটা দাগ পড়ে যায় বিশ্রী, সারা হাতে।

মিস স্টার বললেন, মিসেস গার্ডেনারের মেয়ে আইরিনের মতো সারা গায়ে চুল গজানো তবু ভালো, সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে ক্রিস্টিন বলে চলেন, আজ সকালে দারুণ মেজাজে ছিলেন মিসেস গার্ডেনার। এক নাগাড়ে একেবারে চালিয়ে গেছেন। তাই না ওডেল? হ্যাঁ সোনা। একটু থেমে গিয়ে-মঁসিয়ে পোয়ারো আমার মনে হচ্ছে, একটা চালাকি করলে ওঁর সঙ্গে পারতেন। করলেন না কেন? আপনি এখানে একটা খুনের সমাধান করতে এসেছেন বলবেন না কেন, সেই হোটেলের অতিথিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে উন্মাদ হত্যাকারীকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, পোয়ারো। সেটা হয়তো তিনি বিশ্বাস করে বসতেন।

মেজর ব্যারী সশব্দে হেসে উঠলেন, নির্ঘাত বিশ্বাস করতেন তিনি।

মিসেস গার্ডেনারের মতো মানুষও বিশ্বাস করতেন এমন খুনের কথা। কারণ এটা ঠিক জায়গা নয় আপনি মৃতদেহ পাবেন। এমিলি ব্রুস্টার বললেন, আমার মনে হয় না।

সামান্য নড়েচড়ে বসলেন পোয়ারো চেয়ারে। মাদমোয়াজেল, প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, কেন নয়, আমার স্মাগলার্স দ্বীপে মৃতদেহ পাওয়া কোনো অসুবিধেটা দেখলেন আপনি।

কতগুলো জায়গা খুনের পক্ষে উপযুক্ত নয়, এমিলি ব্রুস্টার বললেন, নিজের বক্তব্যকে ঠিক ভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে চুপ করে গেলেন তিনি।

এরকুল পোয়ারো বললেন, জায়গাটা স্বপ্নময় মানছি। শান্তি রয়েছে এখানে গভীর নীল সমুদ্র রয়েছে, উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ, ভুলে যাচ্ছেন আপনি। পৃথিবীতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অশুভ শক্তির ছায়া। মিস ব্রুস্টার নড়েচড়ে বসলেন, ধর্মযাজক ঝুঁকে এলেন সামনে। তার গভীর নীল চোখ চকচক করে উঠলো।

কাঁধ ঝাঁকালেন মিস ব্রুস্টার। ও হ্যাঁ, সে কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে, এ জায়গাটা ঠিক উপযুক্ত নয় কোনো অপরাধ সংঘটিত হবার পক্ষে।

মাদমোয়াজেল, একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন।

বোধহয় মানব-চরিত্রের কথা, হ্যাঁ, প্রথম এবং শেষ কথা সেটাই। আমি সে কথা বলতে চাইনি। এখানে সবাই ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন। আপনাকে মনে করিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।

এমিলি ব্রুস্টার তাকালেন তার দিকে বিহ্বল চোখে। বুঝতে পারলাম না ঠিক, তর্জনী না নাচিয়ে বোঝাতে চাইলেন তার বক্তব্যের ইঙ্গিত। এরকুল পোয়ারো করুণার হাসি হাসলেন।

আপনাকে যথেষ্ট উপযুক্ত কারণ দেখাতে হবে। যদি তার বাড়িতে অফিসে বা রাস্তায় তাকে খোঁজ করেন। আপনাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিন্তু এখন কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না সমুদ্রতীরে উপস্থিতির জন্য। আপনি কেন লেদারকোম্ব উপসাগরে এসেছেন?

অতি সহজ উত্তর। এখন আগস্ট মাস-লোকে এই মাসেই ছুটি কাটাতে আসে। আসাটা স্বাভাবিক, সমুদ্রতীরে ছুটি কাটাতে আসাটা ইংল্যান্ডের রীতি। অস্বীকার করা যায় না আপনার কথা। স্বীকার করলে আপনি কি বলবেন মিস ব্রুস্টার ও গার্ডেনার সম্পর্কে। মার্কিন তো ওরা, মৃদু হাসলেন পোয়ারো। বিশ্রামের প্রয়োজন অনুভব করেন মিসেস গার্ডেনারও। আমাদের বলেছেন তিনি নিজেই সমুদ্রতীরে তার সপ্তাহ দুয়েক কাটানো উচিত কারণ তিনি গোটা ইংল্যান্ডটা ঘুরে দেখেছেন। তিনি একজন ভালো ট্যুরিস্ট হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখতে ভালোবাসেন তাই না?

আমি মানুষ দেখতে ভালোবাসি মাদাম সে কথা আমি স্বীকার করি।

 আপনি অনেক বেশি দেখতে পান, ও চিন্তিত সুরে বললো।

.

১.৪

 অপ্রতিভ কণ্ঠে বললেন, স্টিফেন লেন–সশব্দে গলা খাঁকারি দিয়ে, মঁসিয়ে পোয়ারো, কথাগুলো আপনি বললেন, সে সম্পর্কে আমি একটু কৌতূহলী। পৃথিবীর সর্বত্রই অপরাধ সংঘটিত হয় আপনি বলছেন। আপনার কথাগুলোর সঙ্গে বিশেষ মিল আছে, বাইবেলেরইক্লিসিয়াস্তেস অধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতির। মুহূর্তের জন্য থামলেন তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন সত্য, মানুষের প্রতিটি পুত্রের হৃদয় অপরাধবাসনায় পরিপূর্ণ এবং জীবকালে তাদের সহিত জড়িত থাকে। ধর্মীয় দীপ্তিতে তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একথা শুনে আমি খুব খুশী হয়েছি। অশুভ শক্তিতে আজকাল বিশ্বাস করে না বড়জোর শুভর বিপরীত হিসেবে বিচার হয় মাত্র যাদের বুদ্ধি-জ্ঞানে যারা অসম্পূর্ণ অসৎ কাজ তারাই করেন। অশুভ শক্তির অস্তিত্ব আছে মঁসিয়ে পোয়ারো। বাস্তবে সত্য। আমি যেন অশুভ বিশ্বাস করি, তেমনি বিশ্বাস করি শুভ। পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত এর রাজত্ব। নিজস্ব ক্ষমতা আছে, প্রভাবও আছে। তিনি হঠাৎ ক্ষমাপ্রার্থীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তার শ্বাস ও প্রশ্বাস ঘন হয় উঠেছে। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।

দুঃখিত! একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন।

শান্ত স্বরে বললেন, পোয়ারো, আমি আপনার অর্থ বুঝতে পারছি। আমার সঙ্গে আংশিকভাবে একমত অশুভর রাজত্ব সারা পৃথিবীতে রয়েছে তার স্বরূপ আমাদের জানা আছে। গলা খাঁকারি দিলেন মেজর ব্যারী। কয়েকজন ফকির ভারতবর্ষে এ ধরনের কথা বলেছিলেন।

ভারতীয় প্রতি সর্বনাশা কাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের সাবধান হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। জলি রজারে কাটিয়েছেন মেজর ব্যারী। মিস ব্রুস্টার-ও মিসেস রেডফার্ন, দুজনেই বক্তব্যে কাঁপয়ে পড়লেন। সাঁতার থেকে ফিরে আসছে আপনার স্বামী তাই না, মিসেস রেডফার্ন ওর হাত টানার ভঙ্গী দেখবার মতো। আপনার স্বামী ভীষণ ভালো সাঁতারু।

ওই দেখুন! লাল রঙের পাল দেওয়া সুন্দর একটা ছোট নৌকা, বললো, মিসেস রেডফার্ন। ওটা মিঃ ব্ল্যাটের তাই না?

উপসাগরের সীমানা অতিক্রম করছে লাল পালের নৌকোটা।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন মেজর ব্যারী–আজব পছন্দ লাল-রঙা পাল। আতঙ্ক এড়ানো গেল না, ফকির কাহিনীর সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলেন এরকুল পোয়ারো। যুবকটি তখন সাঁতরে পাড়ে এসে পৌঁছেছে। প্যাট্রিক রেডফার্ন মানুষটির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তামাটে দীর্ঘকায় শরীর। সুগঠিত সঙ্কীর্ণ উরু, কাঁধ প্রশস্ত। তাকে ঘিরে রয়েছে একটা হাসিখুশি আনন্দের ঢেউ। তাকে সমস্ত মহিলা ও অধিকাংশ পুরুষের কাছে করে তুলেছে প্রিয়। সৈকতে দাঁড়িয়ে শরীরে জল ঝাড়ল সে, খুশিতে হাত নেড়ে ইশারা করলো স্ত্রীর দিকে। ইশারার প্রতি উত্তর ফিরিয়ে দিলো ক্রিস্টিন, ডেকে উঠলো, এসো এখানে প্যাট। আসছি। প্যাট্রিক আরো কিছুটা এগিয়ে গেল, সৈকত বালিতে পড়ে থাকা ভোয়ালেটা তুলে নিয়ে গেল। হোটেলের দিক থেকে একজন মহিলা তাদের অতিক্রম করে নেমে গেলো বেলাভূমির দিকে। নাটকীয় আবির্ভাবের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিলো তার উপস্থিতিতে। এ তার অজানা নয় উপরন্তু তার চলার ছন্দ জানিয়ে দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে অদৃশ্য আত্মসচেতনভাবে তার উপস্থিতির প্রভাব নাটকীয়তার কাছে নতুন কিছু নয়। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। নাটকীয় প্রভাব তার কাছে নতুন কিছু নয়।

শরীরের উন্মুক্ত প্রতিটি অংশে সূর্যস্নানে সুষম ব্রোঞ্জ প্রলেপ, পরনে সাধারণ পিঠ খোলা সাদা সাঁতার পোশাক, ভাস্কর্যের মতোই নিখুঁত তার গড়ন। উজ্জ্বল আগুন রঙ ঘাড়ের কাছে এসে নিয়েছে অন্তর্মুখী বাঁক। মুখমণ্ডলে সামান্য কাঠিন্য বিদায় নিলেও তিরিশ বছর বয়স। সব মিলিয়ে রয়েছে জমকালো গর্বিত সজীবতা, আর তারুণ্যতার চৈনিক স্থৈর্য ছড়িয়ে রয়েছে সারা মুখে, তার চোখের উপর দিকে সামান্য টানা মাথায় তার সবুজ পিচবোর্ডের এক স্বপ্নময় চীনে টুপি।

এমন একটা কিছু ছিল মহিলাটির মধ্যে, যা সৈকতে উপস্থিত অন্যান্য মহিলাদের তুচ্ছ ও নিষ্প্রভ করে দিলো। অনিবার্যভাবে উপস্থিত প্রতিটি পুরুষের চোখ সমান আকর্ষিত হয়ে গেঁথে গেলো তার শরীরে। মেজর ব্যারী সোজা হয়ে বসলেন, তার বিস্ফারিত চোখ আরও বিস্ফারিত হলো। এরকুল পোয়ারোর চোখ পুরোপুরি খুলে গেলো, গোঁফজোড়া প্রশংসায় নেচে উঠল।

স্টিফেন লেন গভীর শ্বাস নিলেন, শরীরে প্রতিটি পেশী হয়ে উঠল কঠিন।

ফিসফিসে স্বরে বললেন, মেজর ব্যারী, আর্লেনা স্টুয়ার্ট অভিনয় ছেড়ে দেবার আগে ওর শেষ নাটক কাম অ্যান্ড গো আমি দেখেছিলাম। কি বলেন দেখার মতো চেহারা।

ধীর স্বরে বললো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। শীতলতার পরশ যেন ওর কণ্ঠে। সত্যি ও সুন্দরী। তবে কি ওকে দেখে পশুর মতো মনে হয়।

এমিলি ব্রুস্টার হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি অশুভ শক্তির কথা এসব বলেছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার ধারণা সেই অশুভ শক্তির মানব রূপ এই মেয়েটি। ওর মধ্যে এতটুকু ভালোর ছোঁয়া নেই। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি।

স্মৃতি রোমন্থনের সুরে বললেন মেজর ব্যারী, সিমলার একটা মেয়ের কথা আমার মনে পড়েছে। মেয়েটির চুল ছিল লাল। মেয়েটি জনৈক নিম্নপদস্থ সৈনিকের বউ ছিলো। মেয়েটি সেখানে অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে গিয়ে অন্যান্য মহিলারা সুযোগ পেলে ওর চোখ উপড়ে নিতে ছাড়ত না, কারণ পুরুষেরা ওর অর্থাৎ মেয়েটির জন্য পাগল হয়ে যেত। তাছাড়া মেয়েটি অনেক সংসার ছারখার করে দিয়েছিলো।

তিনি চাপা হাসিতে স্মৃতিচারণ করলেন, শান্তশিষ্ট চমৎকার মানুষ ছিল তার স্বামীটি। বউয়ের অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করতো না। বউকে প্রায় পুজোই করতো। স্টিফেন লেন তীব্র আবেগভরা চাপা স্বরে বললেন, সমাজের পক্ষে এধরনের মেয়ে ভীষণ-ভীষণ ক্ষতিকারক।

তিনি থামলেন, ইতিমধ্যে আর্নেনা স্টুয়ার্ট জলের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যুবক দুটি সবে মাত্র কৈশোরের সীমারেখা পেরিয়েছে, যুবক দুটি আগ্রহের সঙ্গে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসেছে ওর দিকে। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওর দিকে তাকিয়ে যুবক দুজনকে অতিক্রম করে নজরে পড়লো সৈকত ধরে এগিয়ে আসা প্যাট্রিক রেডফানের দিকে।

ব্যাপারটা যেন অনেকটা কাঁটা কম্পাসের মতো–এরকুল পোয়ারো ভাবলেন, ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার মতো। গতিপথের বিচ্যুতি ঘটলো প্যাট্রিকের। রেডফার্নের পা-জোড়া দিক পরিবর্তন করলো। চুম্বক কম্পাসের কাটা সর্বদা উত্তরমুখী হবেই বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী। প্যাট্রিক রেডফানের পা তাকে নিয়ে এলো আর্লেনা স্টুয়ার্টের কাছে। তখন অল্প অল্প হাসলেন প্যাট্রিকের দিকে তাকিয়ে। তারপর সৈকত ধরে ও এগিয়ে চলে, ঢেউয়ের পাশাপাশি পা ফেলে প্যাট্রিক রেডফার্ন ওর সঙ্গ নিলো। ও শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো একটা পাথরের পাশে। রেডফার্ন বসলো ওর পাশে।

ক্রিস্টিন রেডফার্ন আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো।

.

১.৫

 একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ক্ষণেকের জন্য জমাট বেঁধে রইল, ও চলে যাবার পর। এমিলি স্টার বললেন ও ভীষণ ভালো মেয়ে, সত্যি খুব খারাপ লাগছে। মাত্র কয়েক বছর হলো ওরে বিয়ে হয়েছে। মেজর ব্যারী বললেন, আমি যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম, সেই মেয়েটি সিমলার মেয়ে। ও বেশ কয়েকটা সত্যিকারের সুখের বিয়ে বিগড়ে দিয়েছিলো কি বলেন।

দুঃখের কথা, মিস ব্রুস্টার বললেন, এ ধরনের মেয়ে আছে, যারা পরের সংসার ভেঙে দিতে ভালোবাসে। মিনিট কয়েক থেমে গিয়ে যোগ করলেন, প্যাট্রিক রেডফানটা এক নম্বরের বোকা।

এরকুল পোয়ারো একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নীরবে বেলাভূমির দিকে। কিন্তু প্যাট্রিক রেডফার্ন বা আর্লেনা স্টুয়ার্ট তার লক্ষ্য ছিল না। মিস ব্রুস্টার বললেন, আমি বরং যাই নৌকা নিয়ে বেরিলয়ে পড়ি। তিনি বিদায় নিলেন। পোয়ারোর দিকে মেজর ব্যারী ঘুরে তাকালেন। তার চোখ বিস্ফারিত, চাপা উত্তেজনা ও কৌতূহল। মঁসিয়ে পোয়ারো, বলুন কি এত ভাবছেন? কই আপনি মুখ খুললেন না তো, এই অপ্সরাটি সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

জব্বর চিজ, বললেন, পোয়ারো, তাই হয়তো…

 মশাই ঝেড়ে কাশুন! আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ফরাসিদের।

আমি ফরাসি নই। শীতল স্বরে বললেন পোয়ারো।

সুন্দরী মেয়েরা আপনার নজর কাড়ে না। তা বলে একথা বলবেন না, আপনার হুঁ বলে মনে হয় না ওকে দেখে কি?

উনি মোটেই তরুণী নন, এরকুল পোয়ারো বললেন,

তাতে কী আসে যায়? যে কোনো মহিলার চেহারা দেখে যা মনে হয়, বয়েস ঠিক তাই তার। কোনো গলতি নেই ওর চেহারায়।

এরকুল পোয়ারো বললেন মাথা নাড়িয়ে, হ্যাঁ, উনি সুন্দরী। কিন্তু শেষ কথা সুন্দরই নয়। সৈকতে উপস্থিত প্রত্যেকে যে তার দিকে তাকিয়েছে, তার কারণ সৌন্দর্য নয়। মেজর বললেন, মশাই ওটাই একমাত্র কারণ। তিনি হঠাৎ কৌতূহলী কণ্ঠে বললেন, কি দেখছেন বলুন তো একদৃষ্টে আপনি?

উত্তর দিলেন এরকুল পোয়ারা, তাকিয়ে আছি আমি ব্যতিক্রমটির দিকে। একমাত্র মানুষের দিকে; যিনি ভদ্রমহিলা যাওয়ার সময় চোখ তুলে তাকাননি।

পোয়ারোর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে মেজর ব্যারী সেই ব্যাতিক্রমটির দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, মুখশ্রী শান্ত সুন্দর, মাথার চুল হাল্কা রঙের, তামাটের গায়ের রঙ। তার ঠোঁটে ধূমায়িত পাইপ, চোখের নজর হাতের দি টাইমস-এ নিবদ্ধ।

মেজর ব্যারী বললেন, ওঃ উনি, আমাদের স্বামীদেবতা মশাই হলেন উনি। ক্যাপ্টেন মার্শাল।

হা, জানি–এরকুল পোয়ারো বললেন। মেজর নিজে অবিবাহিত, তিনি চাপা হাসি হাসলেন। স্বামীর ভূমিকা মাত্র তিন রকমের তার দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিবন্ধক, অসুবিধে সৃষ্টিকারী এবং রক্ষাকর্তা।

দেখে মনে হয় চমৎকার লোক তিনি। আমার টাইমসটা নিয়ে গেলো?

পা বাড়ালেন হোটেলের দিকে উঠে দাঁড়িয়ে স্টিফেন, লোনের দিকে তাকালেন ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিতে পোয়ারো। প্যাট্রিক রেডফার্নকে লক্ষ্য করছিলেন স্টিফেন লেন, আর্লেনা মার্শান পোয়ারোর দিকে হঠাই তিনি ফিরে তাকালেন, তার দুচোখে ঝিলিক মারলো বিতৃষ্ণার তীব্র আলো। আপনার কি এতে কোনো সন্দেহ আছে? তিনি বললেন, শয়তান বাসা বেঁধেছে মেয়েছেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া শক্ত–ধীর স্বরে উত্তর দিলেন পোয়োরো। বাতাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন না। স্টিফেন লেন বললেন, আপনার চারপাশে অশুভ উপস্থিতি।

এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে নীরব সম্মতি জানালেন।