মিস বার্নার্ড সম্পর্কে নতুন কিছু মিস হিগলির কাছ থেকে জানা গেল না। মিস মেরিয়ানের কথারই পুনরাবৃত্তি হলো মিস হিগলির কণ্ঠে। তবে হিগলি জানালো যে মাত্র চার মাস বার্নার্ড কাজে যোগ দিয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে একটা যুবক তার পেছন পেছন ঘুরতো। ছেলেটির সঙ্গে ওর প্রেম ছিল। ছেলেটি নাকি কোনো রিসিভারের দোকানে কেরানীর পদে কাজ করে। ছেলেটি দেখতে ভালো এবং চটপটে।
ঘটনার রাত্রে বার্নার্ড কাউকে কিছু না বললেও এইরকম আভাস দিয়েছিল।
আমরা কাফে থেকে বেরিয়ে মৃতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। মিঃ বার্নার্ড আমাদের বসার ঘরে নিয়ে গেলো। আমাদের সঙ্গে তার পরিচয় পর্ব শেষ করলাম। বার্নার্ডের স্ত্রী স্বামীর পাশে বসে কাঁদতে লাগলো। মিঃ বার্নার্ড তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। জানালো মেয়ের মৃত্যুতে ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছে।
মিঃ ক্রোম গলা ঝেড়ে নিয়ে নিজেকে তৈরি করলো। তারপর মিঃ বার্নার্ডের উদ্দেশ্যে বললো–আপনাদের এই বাড়িটা কি নতুন?
হ্যাঁ, আগে আমরা কেনিংটনে থাকতাম। সেখানে আমাদের ঢালাই-এর ব্যাবসা ছিল। ব্যাবসা ধীরে ধীরে মন্দা হয়ে যাওয়ায় সব বিক্রি করে দিয়ে এই সমুদ্রের তীরে এসে বসবাস শুরু করি। সমুদ্রের ধার আমার খুব প্রিয়।
কাল রাতে তো আপনার মেয়ে বাড়ি ফেরেনি, আপনার সেজন্য চিন্তা হয়নি?
–রাত নটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়া আমাদের অভ্যাস–মিসেস বার্নার্ড জবাব দিলো। আমরা অন্যান্য দিনের মতো তাই করেছিলাম। পুলিশ সকালে না এসে জানালে আমরা কিছু জানতে পারতাম না। মেয়ে আমার এগারোটা নাগাদ ফিরতো।
–ওর জন্য কি দরজা খোলা থাকতো?
–হা দরজা খোলা থাকতো, কার্পেটের নিচে চাবি থাকতো।
–আপনার মেয়ের নাকি বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে?
হতে পারে। কারণ মেয়েরা বড় হয়ে গেলে আজকাল নিজের পাত্র নিজে ঠিক করে নিয়ে বিয়ে করে। ও হয়তো তাই করতো।
মিসেস বার্নার্ড জানালেন–আমি জানতাম, ছেলেটির নাম ডোনাল্ড ফ্রেসার। সে-ও হয়তো ভীষণ আঘাত পেয়েছে এই ঘটনায়। চমৎকার দেখতে। পোর্ট এ্যান্ড ব্রান্সকিল অফিসে ছেলেটি চাকরি করে। সপ্তাহে দুদিন সে এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করতে।
–আপনি কি জানেন, কাল তার সঙ্গে আপনার মেয়ের দেখা করার কথা ছিল কিনা?
–না, ভারী সরল ও খেয়ালী মেয়ে ছিল। আমাকে খুব ভালোবাসতো।
-ওর মাকে ও ভীষণ বিশ্বাস করতো-খানিকটা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে মিঃ বার্নার্ড জানালো, আমার ওপর ভরসা করতো না। তাই আমাদের মধ্যে একটা বড় দূরত্ব ছিল।
-ওর ঘরখানা একবার দেখাবেন?
আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো এলিজাবেথের ঘরে। সবার শেষে আমি ছিলাম। জুতোর ফিতে খুলে যাওয়াতে আমি ওদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়লাম। ঠিক সেই সময় ট্যাক্সি থেকে একটা মেয়ে নেমে এলো সোজা আমার কাছে। আমাকে প্রশ্ন করলো
–আপনি কে?
আমি চট করে জবাব দিতে পারলাম না। কারণ নিজের পরিচয় দেওয়া বারণ, আবার পুলিশের লোক বলে নিজেকে জাহির করা যাবে না। তাই চুপ করে রইলাম।
মেয়েটি বললো-বুঝেছি, আর বলার প্রয়োজন নেই।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্নের ধাপ কাটিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম–আপনি মিস বার্নার্ড, তাই না?
–হ্যাঁ, আমার নাম মেগান বার্নার্ড, ওর মতো মেয়ে হয় না। পুরুষ বন্ধু ওর ছিল না।
আমি সাংবাদিক বা পুলিশ নই জানতে পেরে আমাকে আবার প্রশ্ন করলো,–তাহলে আপনি কে? আমার বাবা-মা কোথায়?
–আপনার বাবা-মা আপনার বোনের ঘর দেখতে গেছে।
তারপর সে কি ভেবে আমাকে ইশারা করলো। আমি তার পেছনে পেছনে এগোলাম। আমরা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম। সে আমাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বললো। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে বাধা পেলাম। বাইরে থেকে দরজা ঠেলে পোয়ারো এসে ঢুকলো। এরপর আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
পোয়ারো মেগানের সামনে এগিয়ে গেলো। মাথা ঝাঁকিয়ে স্মিত হেসে বললো-সুপ্রভাত মাদমোয়াজেল।
আমি মেয়েটির পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। দেখলাম তার ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
-আপনিই সেই বিখ্যাত ডিটেকটিভ পোয়ারো?
পোয়ারো বললো, মাদমোয়াজেল, আপনাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে মৃত্যুর একটা আলাদা চেহারা আমি দেখেছি। আমি আপনার সব কথা শুনেছি। মানুষের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে সকলেই ভালো ভালো কথা বলে। অতএব আমি সেসব নতুন করে জানতে চাই না। আমি এমন একজনকে এখন চাই যে এলিজাবেথ বার্নার্ডকে জানে বা জানে সে মারা গেছে। এরকম কাউকে পেলে আমি হয়তো সত্যের মুখোমুখি হতে পারবো।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল। একসময় মেগান বলে উঠলো,-বেটি একটা বোকা, একটা অপদার্থ, একটা আস্ত গর্দভ।
মেগানের এ ধরনের মন্তব্য শুনে আমি বোকা বনে গেলাম। পোয়ারোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না।
মেগান তখনও বলে চলেছে, সে ভালো হলেই দোষ ছিল। তার চরিত্র সংশোধন করতে বলেছিলাম, কিন্তু তা করেনি।
–কিন্তু মাদমোয়াজেল, পোয়ারো বলল, আপনি হেস্টিংসকে বলেছেন আপনার বোনের কোনো ছেলে বন্ধু ছিল না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং আপনার কথার উল্টোটাই সে ছিল।
-হ্যাঁ, সেটা ঠিকই বলেছেন, সে ভালোমন্দের ধার ধারতো না। কেউ একটু আদর করে কথা বললে একেবারে গলে যেতো। হৈ-হুল্লোড় পছন্দ করতো।
নিশ্চয়ই সুন্দরী ছিল, তাই না?
সকাল থেকে এই একই প্রশ্নের উত্তর পোয়ারো তিনবার জানতে চেয়েছিল, দুবারে কোনো জবাব পায়নি। এবারে কাজ হলো। মেগান তার বোনের একটা ছবি আমাদের দেখালো। আহামরি এমন কিছু নয়, তবে চমকে দেওয়ার মতো মুখ।
-আপনার সঙ্গে আপনার বোনের কোনো সাদৃশ্য নেই। পোয়ারো বললো।
–না, আমার চরম শত্রুও আমাকে সুন্দরী বলে না। হেসে জবাব দিল মেগান।
–আপনার বোন কি ধরনের বোকামি করেছিল? যদি তার বন্ধুটির সম্পর্কে আমাদের কিছু জানান?
-হ্যাঁ, ডন শান্ত স্বভাবের ছেলে। কোনো ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করে না। বেটির কোনো ব্যাপারে সে নাক গলাতো না। তবে অতিরিক্ত হয়ে গেল…।
-তারপর? অতিরিক্ত হয়ে গেলে…।
-জানেন তো, অতিরিক্ত কিছু হলে বিশ বছরের পুরানো প্রেমেও ভাঙন ধরে। ডনের সঙ্গে বেটির বিচ্ছেদ ঘটেছে সেটা আমি অনুমানে বুঝতে পারি। ও যদি নিজেকে সংশোধন করতে তাহলে ডন দুমাসের মধ্যে তাকে বিয়ে করতো। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।
মেগান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পোয়ারোর কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো।
–আপনাকে একটা কথা বলি। এই বলে পোয়ারো তাকে এ.বি.সি.-র বেনামী চিঠি পাওয়া থেকে এ্যান্ডোভারের খুন, দ্বিতীয় চিঠি সব ঘটনা বিস্তারিত জানালো।
মেগান আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–আপনার কথা কি সব সত্যি? তাহলে আপনি কি বলেন ঐ বদ্ধ উন্মাদটা বোনকে খুন করেছে?
–হ্যাঁ, আমার ধারণা তাই। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। সব খুলে বলেন তাহলে আমাদের কাজের সুবিধা হয়। এখানে আসার গুরুত্বটা আপনি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারেছেন।
–বেশ শুনুন, আগেই বলেছি, ডন শান্ত ছেলে। বেটিকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসতো। সে একটা চাপা স্বভাবের ছিলো। মনের মধ্যে সব কিছু চেপে রাখতো, মুখে প্রকাশ করতো না। বেটির বেপরোয়া চালচলনকে সে মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু বেটির সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। ডনকে সে কোনোদিন বুঝতে চায়নি। কেবল বলতো, বিয়ের পর তো বন্দি হয়ে যাবো। তার আগে মনের সুখে ফুর্তি করে নিই। তার এই উচ্ছলতা আরো বেড়ে গেল জিঞ্জার ক্যাটে চাকরি পাওয়ার পর। অফুরন্ত সুযোগ, যাদের সঙ্গে ওখানে ওর আলাপ হতো, তাদের পেছন পেছন সে ছুটতো।…এইভাবে চলছিলো। তারপর শুরু হলো ভুল বোঝাবুঝি, দোষারোপ ইত্যাদি।
…জানেন তো, শান্ত লোক একদিকে ভীষণ ভালো, কিন্তু তারা ক্ষেপে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঠিক সেরকমটি ডনের ক্ষেত্রেও ঘটলো। এই তো কয়েকমাস আগের কথা, আমি ওদের দুজনকে ডেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সব কিছু মিটমাট করে দিলাম। বেটি কোনো কিছু মানতে নারাজ। কেবল একই কথা : কি এমন অন্যায় করেছি। আসলে দোষ ছিল বেটির। সে ডনকে বলেছিল, হেস্টিংসে এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিন্তু সে মিথ্যে কথা বলেছিল। কিন্তু সেদিন বিকেলে তাকে দেখা গেল একজন বয়স্ক লোকের হাত ধরে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাস, ডানের ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটলো। আসলে ঐ লোকটার বাড়িতে ছেলে-বৌ আছে। এক শয়তান, চরিত্রের ঠিক নেই, লম্পট। ডন ঐ দৃশ্য দেখে রেগে যায় ভয়ঙ্করভাবে। বেটিকে বলেছিল, একদিন না একদিন তার হাতে বেটি খুন হবে।…তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না। সে বড় জোড় কয়েকবার ঝগড়া করতে পারতো। তাই বলে..অবশ্য রাগের মাথায়…।
হা, অসম্ভব কিছু নয়। আচ্ছা আপনার বোন কি সেই লোকটির সঙ্গে পরে কখনো দেখো করতো?
-আমি বলতে পারবো না। কারণ আমি তো এখানে থাকি না। তবে দেখা করলেও করতে পারে। ওর একটা দোষ ছিল, একজনকে নিয়ে ও বেশিদিন খুশী থাকতো না। ও আমাকে ওর মনের কথা সব বলতো, অন্য কাউকে নয়।
হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এলো একটা গলার আওয়াজ–ডন এসেছে।
ইনসপেক্টর যাতে তাকে আক্রমণ না করে তাই আগেভাগে পোয়ারো মেগানকে ওকে নিয়ে আসতে বললো।
সুদর্শন যুবক। প্রেমিকার মৃত্যুতে ভীষণভাবে আঘাত পেয়েছে, তা তার মুখ দেখে বোঝ গেল। ফ্রেসার মেগানকে উদ্দেশ্য করে বললো–কি মেগান। তাড়াতাড়ি চল। আমি যা শুনে চললাম…বেটি…।
পোয়ারো তাকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল। ওর বিচলিত ভাব দেখে সে ফ্রেসারকে চেয়ারে বসতে বললো। তারপর নিজের পকেট থেকে ব্র্যান্ডির শিশি বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো। বাচ্চা ছেলের মতো সে কিছুটা ব্র্যান্ডি গলায় ঢেলে দিয়ে শিশিটা ফেরত দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে চাঙ্গা হয়ে উঠলো।
-তাহলে কি আমার বেটি সত্যিই খুন হয়েছে? সে বললো।
–হ্যাঁ।
–বাবার ফোন পেয়েই আমি লন্ডন থেকে চলে এলোম।
–নটা কুড়ির গাড়িতে এলে বুঝি?
নিজের উদ্বেগ চাপতে সে যে কি বলবে ভেবে পোলো না। বিক্ষিপ্তভাবে বলে উঠলো, পুলিশ এসেছে? কি করছে? ধরতে পেরেছে? হঠাৎ আমাদের দিকে এমনভাবে তাকালো যে মেগান ছাড়া ঘরে যে আমরা দুজন উপস্থিত আছি সে এতক্ষণ সেটা টের পায়নি।
-মঁসিয়ে ফ্রেসার, সময় নষ্ট না করে পোয়ারো কাজের কথায় এলো, কাল রাতে মিস বার্নার্ড কোথায় যাবেন, আপনাকে কি বলেছিলেন?
হা, বলেছিলো, সেন্ট লিওনার্ডে ওর নাকি এক বান্ধবী থাকে, তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল।
-তার কথা সত্যি বলে আপনি কি মেনে নিয়েছিলেন?
–বুঝলাম না, আপনি কি বলতে চাইছেন?
–কিছু না, কেবল সত্যিটা জানতে চাই। মিস বার্নার্ড যে এক বদ্ধ উন্মাদের হাতে খুন হয়েছে, আশা করি আপনি তা জানেন না।
-ভয় নেই, মেগান ফ্রেসারকে লক্ষ্য করে বললো, সব কথা ওদের খুলে জানাও। ওরা ডিটেকটিভ। সত্যকে আবিষ্কার করা ওদের কাজ।
–প্রথমে ওর কথা বিশ্বাস করেছিলাম, ফ্রেসার আশ্বাস পেয়ে বলতে থাকে। কিন্তু পরে মনের মধ্যে কেমন যেন সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলো। তাই আগু-পিছু না ভেবে সন্ধেবেলা জিঞ্জার ক্যাটের ধারে-কাছে ঘুর ঘুর করতে শুরু করলাম। বেটি দোকান বন্ধ করে বেরোলো। আমি নিঃশব্দে তার পেছন ধরলাম। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম যদি বেটি টের পায় আমি তার পিছু নিয়েছি তাহলে ভীষণ দুঃখ পাবে। অতএব ওখান থেকে আমি চলে এলোম। কিন্তু এসেও আমি স্থির থাকতে পারলাম না। সন্দেহের খোঁচা আমাকে পাগল করে তুললো। অগত্যা সেন্ট লিওনার্ডে আটটা নাগাদ পৌঁছালাম। বাস, ট্যাক্সি, টাঙ্গা, টমটম, সব দেখলাম, কিন্তু বেটিকে দেখতে পেলাম না।
আমার বুঝতে দেরি হলো না। সে আমাকে সত্যিই মিথ্যে বলেছে। তাহলে কি ঐ বুড়োটার সঙ্গে ঘুরছে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ইস্টবোনে তাকে কোনোদিন পা দিতে দেখিনি। তাহলে সে গেল কোথায়? হেস্টিংসেও যেতে পারে ভেবে সেদিকে ছুটলাম। সব জায়গায় তার খোঁজ করলাম। পেলাম না। কূলকিনারা কিছু ভেবে না পেয়ে আমি আপন মনে নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরেছিলাম। তখন রাত বারোটা কি সাড়ে বারোটা হবে।
এরপর ঘরে এসে ঢুকলো ক্রোম, কেলসি। পোয়ারো ওদের সঙ্গে মেগানের এবং ফ্রেসারের পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।
আমি তার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম–কি ভাবছো, বন্ধু?
–ভাবছি…ভাবছি, কি আশ্চর্য মহানুভব আমাদের এই খুনী।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আবার বেক্সহিলের খুন নিয়ে গোল মিটিং শুরু হয়েছে। লক্ষ্য করলাম, মিসেস এ্যাম্বারের চেয়ে বেটি বার্নার্ডের খুন বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এখানে। হয়তো মেয়েটি যুবতী এবং অবিবাহিতা বলে সবাই বেশি মাথা ঘামাচ্ছে। চারদিকের সমার্লোচনার ঝামেলায় জর্জরিত হয়ে স্যার লায়নেলকে বৈঠকে ডাকা হয়েছে।
সে বললো–পরিস্থিতি যেমন দাঁড়িয়েছে তাতে সর্বসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে-কোনো অবস্থায় ঐ বদ্ধ পাগলটার খবর পেলে…
কথার মাঝখানে টম্পসন বলে উঠলো…তার আগে আমাদের ভালো করে জানতে হবে খুনী আসলে অদ্ভুত না কি আমাদের মতো সাধারণ।
-নতুন কিছু না ঘটা পর্যন্ত আমাদের চুপ করে থাকা উচিত। ক্রোম মন্তব্য করলো।
ক্রোমের কথায় পোয়ারো সমর্থন করলো। প্রচার হলে হয়তো তৃতীয় খুন আবার অনুষ্ঠিত হবে।
-কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি হয়তো খুনীর মনস্তত্ত্বটা বুঝে উঠতে পারেননি। ক্রোম বললো, তাই এখানে অসুবিধা হচ্ছে। পৃথিবীর সেরা চালাক লোক হিসাবে খুনী নিজেকে মনে করে। তাই একের পর এক খুন করে শেষ রক্ষা করতে পারে না।
-বেক্সহিলে তদন্ত করে কিছু আবিষ্কার করেছেন আপনি? পোয়ারো ক্রোমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।
না, বিশেষ কিছু নয়। নিছক কয়েকটা খবর মাত্র। ইস্টবোনের স্ পেলম ডাইভ রেস্তরাঁর এক বেয়ারা মেয়েটির ছবি দেখে চিনতে পারলো।
সে জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাতে মেয়েটির সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক চশমাওয়ালা ভদ্রলোক ছিল। তারা একসঙ্গে ডিনার করেছে। বেক্সহিল ও লন্ডনের মাঝামাঝি এক চায়ের দোকানের মালিকও ঐ একই কথা জানিয়েছে। ভদ্রলোককে দেখে তার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই সে জাহাজের অফিসার অথবা ঐ ধরনের কিছু। অতএব দুজনের কথার মধ্যে সাদৃশ্য আছে একটা–ঘটনার রাতে বেটি বার্নার্ডের একজন সঙ্গী ছিলো এবং আমাদের ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে ঐ সঙ্গীটিই হলো তার খুনী।
পোয়ারো নীচু কণ্ঠে বলে উঠলো, আমাদের সর্বপ্রথম খুনের মোটিভ জানতে হবে। তাহলে সূত্রের সন্ধান পেতে অসুবিধা হবে না।
-মোটিভ তো জলের মতো পরিষ্কার।
বর্গমালার ব্যাপারটা হয় যে কোনো প্রকারে তার মাথায় ঢুকে গেছে, তাই এটাকে নিয়ে সে ক্ষেপে উঠেছে। আসলে খুনী একজন বিকারগ্রস্ত লোক। সে মোটেও সুস্থ নয়। বিবেকবুদ্ধিহীন বদ্ধ উন্মাদ।
কিন্তু বিকারের ঘোরেনা, সে যা করে সবকিছুর পেছনে তার অবচেতন মনে একটা যুক্তি, একটা কারণ থেকে যায়।
মাথা নেড়ে ক্রোম সায় দিল।
–যুক্তি থাকতেই হবে এমন কোনো মানে নেই। ১৯২৯-এ সেই স্টোনম্যান যে কোনো যুক্তির তোয়াক্কা করতো না। তাকে কেউ বিরক্ত করলে সে তাকে ঘৃণা করতো।
কিন্তু এখানে একটা কারণ আছে। বিরাট এক সূত্রের চিরন্তন ব্যবধান, যেমন ধরুন কোনো মাছি বা মশা দুবার আপনাকে বিরক্ত করলে আপনি কি তিনবারের পর তাকে মেরে ফেলবেন। এখানে মাছি আর আপনার মধ্যে ক্ষুদ্র-বৃহতের একটা প্রাচীর আছে। স্টোনম্যানের নাম কে না জানতো। সে কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তির বেয়াদপি সহ্য করতো না। তাই সে নির্দ্বিধায় খুন করতো।
পোয়ারোর বিশ্লেষণ শুনে টম্পসন খুশী হলো। বললো–আপনার কথা অনুযায়ী বলা যায়, খুনীর যখন মাথায় খুন চাপে তখন সে কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। একের পর এক লোককে হত্যা করে সে পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু এখানে একটু ব্যতিক্রম আছে। ঐ চিরাচরিত নিয়ম প্রযোজ্য নয়। অবশ্য খুনির উদ্দেশ্য যদি যৌন বিকার হয় তাহলে স্বতন্ত্র ব্যাপার। যে দুজন খুন হয়েছে তারা দুজনেই মহিলা। তাই এখনই কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছিয়ে পরবর্তী।
পোয়ারো ইতস্ততঃ করে বললো, এটাকে আমি পাগলামি বা ফাজলামি বলে মনে করি না। অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে আবছা কুয়াশায় ভরা। প্রতিটি খুনের আগে এরকুল পোয়ারোর নামে সে তীব্র শ্লেষ, চ্যালেঞ্জের প্রছন্ন আহ্বান জানিয়েছে। তবে…তবে কি তার আক্রোশ আমার ওপর? আমি কি জ্ঞানে বা অজ্ঞানে তার কোনো ক্ষতি করেছি। তাই কি সে একের পর এক খুন করে গায়ের জ্বাল মেটাচ্ছে? অথবা, আমাকে পছন্দ করে না, আমি বিদেশী বলে এর কারণ কি?
–আপনার কথাগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ। টম্পসন বললো।
ঝট করে ক্রোম বলে উঠলো–কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই। তার কথায় কেমন ব্যঙ্গ লক্ষ্য করা গেল।
–ঠিক বলেছেন, এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে আমার রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। পোয়ারো ক্রোমের কথার জের টেনে বললো। যদি এই প্রশ্নগুলির কোনো একটির জবাব আমার জানা থাকতো তাহলে খুনীর তৃতীয় শিকারের নাম-ধাম জানতে আমার বেগ পেতে হতো না। তবে খুনী যে মহান, উদার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটা জিনিস লক্ষ্য করুন, মিসেস এ্যাম্বারের খুনের সঙ্গে তার স্বামীকে জড়িয়ে ফেলা হলো, আবার বেটি বার্নার্ডের হত্যাকারী হিসেবে স্বাবাবিক ভাবেই ডোনাল্ড ফ্রেসারের নাম চলে আসছে। কিন্তু তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হলো না। এর কারণ কি? এর মূলে আছে ঐ বেনামী চিঠি দুটি। সে চিঠিতে তার অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। সে তার অপরাধের বোঝা অন্য কারোর ঘাড়ে চাপাতে চায় না। এটাই তার মহৎ মনের প্রমাণ।
-তাহলে পরের চিঠি পাওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। ক্রোম বললো। তারপরেই আমরা জনসাধারণের কাছে সব প্রকাশ করবো। এর ফলে সমস্ত মানুষ সর্বদা সচকিত থাকবে। আততায়ী যখন তার কাজ হাসিল করতে যাবে তখন স্বাভাবিকভাবে হাতেনাতে ধরা পড়বে।
অবশেষে তিন নম্বরে চিঠি হাজির হলো। বার্নার্ডের ঘটনার পর থেকে স্যার লায়নেলের হুকুমে পোয়রোর দরজায় চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা হলো। আমরা যখন বাড়ির বাইরে যাই তখন সার্জেন্টটি বেশি সতর্ক থাকে, কারণ খুনীর তৃতীয় চিঠিটা আসার সেই মুহূর্তেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে যাবে দেরি না হয়। আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের চিঠি সে খুলে পড়তে পারে। এমন নির্দেশ তার ওপর দেওয়া আছে।
শুক্রবার দশটা নাগাদ দিনের শেষ এবং পঞ্চম ডাক এলো। পাঁচটা চিঠি নিয়ে আমি দেখতে লাগলাম, শেষ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আমি অস্ফুটে চেঁচিয়ে উঠলাম।
–পোয়ারো।
আমার বন্ধু তখন চোখ বুঝে চিন্তায় মগ্ন ছিলো। আমাদের কণ্ঠস্বরে সে চোখ খুলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, এসেছে নাকি? খুলে ফেলল। পড়ো।
আমি দেরি না করে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
বেচারা পোয়ারো,
বলুন তো, আমার এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। আপনি একজন স্বনামধন্য ডিটেকটিভ। বারে বারে এমন ব্যর্থতা। ছি ছি, ভাবতেও আমার লজ্জা লাগছে। আমি যদি আগে জানতাম, তাহলে এমন ক্ষুদ্র ব্যাপারে আপনাকে জড়াতাম না।
তা, দু-দুটো খেলায় আপনি হেরে গিয়ে বেশ ভুঝতে পারছনে, আপনার বুদ্ধি কতখানি। এবার আর একটা খেলা খেলবো আপনার সঙ্গে। তবে সেটা সহজ সরল সাদামাটা গোছের খেলা। জটিল খেলায় খেলতে নামিয়ে লাভ নেই।
…তিরিশে, হ্যাঁ, তারিখটা ভুলবেন না। এ মাসের তিরিশ তারিখে কার্স্টনে হবে খেলাটা। দেখুন আপনি এবার জিততে পারেন কি না। স্বীকার করতে দোষ নেই, আমার নিজেরও কেমন খারাপ লাগছে। নিজের খেলায় বার বার নিজেই অনায়াসে জিতে যাবো…তা কি কখনো কারো ভালো লাগে বলুন।
…আমি ঈশ্বরের কাছে আপনার শুভ কামনা প্রার্থনা করছি।
ইতি
বশংবদ
এ.বি.সি
কবে চিঠিটা লেখা হয়েছে, সেটা দেখো আর কবে খুন হবে? পোয়ারো আমাকে বললো।
–সাতাশে আগস্ট চিঠিটা লেখা হয়েছে। খুন হবে তিরিশ আগস্ট।
-তাহলে তো আজই খুন হওয়ার কথা। সে মেঝে থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে ভালো করে দেখে বললো-ই, ঠিকানাটা ভুল লেখা হয়েছে, হবে হোয়াইট হাউস ম্যানসন, তার পরিবর্তে বসানো হয়েছে হোয়াইট হর্স ম্যানসন। যাতে ডাকবিভাগ নাকানি-চোবানি খেয়েছে। তিনদিনে চিঠিটা পেলাম, হেস্টিংস, তুমি বরং এক কাজ করো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করে চিঠির ব্যাপারটা এক্ষুণি জানিয়ে দাও। সত্যি আমাদের ভীষণ দেরি হয়ে গেল। এখন দশটা বেজে কুড়ি। তার মানে হাতে আমাদের এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট ময় আছে। হেস্টিংস দেখ তো, কান জায়গাটা ঠিক কোথায়?
জায়গাটা ডিভনের উপকূলবর্তী। ছোট্ট একটা গ্রাম। প্যাডিংটন থেকে দুশো চার মাইল ভেতরে। জনসংখ্যা পাঁচশো চুয়াল্লিশ।
জায়গার বর্ণনা শুনে পোয়ারো বললো–যাক, একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এত লোকের মধ্যে একটা আনাড়ি লোকের আবির্ভাব হলে কারো না কারো নজরে ঠিকই পড়বে। অতএব তার চেহারার বর্ণনা হয়তো আমরা তাদের কাছ থেকে পেতে পারি। একটু চুপ করে থেকে আবার বললো, দুশো চার মাইল রাস্তা গাড়ির চেয়ে ট্রেনেই ভালো। তুমি দেখ তো, কাস্টন যাওয়ার রাতের কোনো ট্রেন আছে কিনা?
-প্যাডিংটন থেকে ঠিক বারোটায় ট্রেন। নিউটন এ্যাবাট পৌঁছবে ছটা পাঁচে। সাতটা পনেরো নাগাদ ট্রেন হাজির হবে কানে।
-চলো বেরিয়ে পড়া যাক। তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমি ততক্ষণ ক্রোমকে একটা ফোন করি। ফোন করে সে পিরে এসে জানালো, ক্রোমও আমাদের সঙ্গী হচ্ছে।
স্টেশনে ক্রোমের সঙ্গে আমরা মিলিত হলাম। সে জানালো, কানের সমস্ত সিঅক্ষরধারী নাম পদবীধারী মানুষকে সতর্ক করে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সব দিক রক্ষা হলেই ভালো।
চিঠিটা ক্রোমকে দেখানো হলো। সে বললো–যদি চিঠিটা সময়মতো এসে পৌঁছোত তাহলে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা ভালোভাবে করা যেতো।
-যদি সে ইচ্ছা করেই ঠিকানাটা ভুল লেখে? আমি জানতে চাইলাম।
-না না, ভুল সে করবে না। নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না। ঠিক সময়েই সে চিঠিটা পাঠিয়েছে। দেরি করে পাওয়ার জন্য আমাদের কপাল দায়ী। হয়তো হোয়াইট হর্স হুইস্কির বোতল খুলে সে চিঠি লিখতে বসেছিল। তাই নেশার ঝেকে হ্যাভনের পরিবর্তে হর্স হয়ে গেছে।
ক্রোমের যুক্তি পোয়ারোর পছন্দ হলো। সে ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।
এমন সময় স্টেশনে ট্রেন এসে ঢুকলো তীব্র বাঁশি বাজিয়ে। আমরা যে যার জায়গায় গিয়ে বসলাম। ট্রেন একসময় ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো।
এক সার্জেন্ট কি যেন খোঁজাখুঁজি করছিলো। তারপর ক্রোমের দিকে এগিয়ে এসে হাত-পা নেড়ে কি যেন বললো। খানিকবাদে সার্জেন্ট চলে গেল। আমরা ক্রোমের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম সার্জেন্ট কি বলে গেল। ক্রোম বললো–কার্স্টনের সার্জন শ্রদ্ধেয় স্যার কার মাইকেল ক্লার্ক খুন হয়েছে। ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথাটা একেবারে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই শান্ত সদাশয় নিঃশত্ৰু মানুষটি একসময় খুব নাম করেছিলো। সম্প্রতি এই কাজ থেকে সে অবসর গ্রহণ করেছে। জীবনের বাকি দিনগুলো নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য সে ডিভনের প্রাকৃতিক পরিবেশ পছন্দ করেছিলো। চাকরি করাকালীন সে অনেক অর্থ রোজগার করেছে। বছর তিনেক আগে এক দূর সম্পর্কের কাকার সম্পত্তি সে লাভ করে। সংসারে কেবল স্ত্রী এবং ভাই ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে বাস করতো। ভাই বিয়ে করেনি। নিজের সন্তানও ছিল না। অথচ বিস্তর টাকা। খরচ তত করতে হবে। হালে তার একটা নেশা হয়েছিল। শহরের পুরানো জিনিস বিক্রির দোকান ঘুরে দেশীয় বস্তু সংগ্রহ করতো। ফলে তার এক বিরাট সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে। সেখানে চীনের মাটির বাসনপত্র থেকে চীনের কারুকার্যখচিত পোশাক ও আসবাবপত্র ছিলো।
সব শুনে পোয়ারো মন্তব্য করলো–এবার খুনী শহরের মান্যগণ্য ব্যক্তি। হেস্টিংস, আমরা প্রথম থেকে খুনীকে উন্মাদ বা পাগল ভেবেছি, আসলে সেটা ভুল। একটা পাগল দিনের পর দিন নিপুণভাবে সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক খুন করে যাবে অথচ ঘুণাক্ষরেও সে ভুল করবে না। তার এই অদ্ভুত পরিকল্পনার আড়ালে একটা অদৃশ্য ইতিহাস আছে। সেটা আমাকে আবিষ্কার করতেই হবে।
স্থানীয় থানার পুলিশ অফিসার ওয়েলস স্টেশনেই ছিলো। স্টেশনে থেকে গাড়িতে করে আমরা তার সঙ্গে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলাম।
পথে যেতে যেতে পুলিশ অফিসার জানালো, রোজ খাওয়া-দাওয়া সেরে নৈশ ভ্রমণে বেরোনো মৃতের অভ্যাস ছিল। অন্যান্য দিনের মতো বেড়াতেও বেরিয়েছিল।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জরুরী নির্দেশ পেয়ে ভদ্রলোককে সাবধান করে দেওয়ার জন্য ওয়েলস তার বাড়িতে ফোন করে। কিন্তু তখনও সে বাড়িতে ফেরেনি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। এত রাত পর্যন্ত সে কখনো বাইরে থাকতো না। ওয়েলসের মনে সন্দেহ জাগে। দেরি না করে লোকজন নিয়ে সে তার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সে কোন পথ দিয়ে বেড়াতো সেটা মোটামুটি জানা ছিল। অতএব সেইমতো কিছুটা এগোতেই পথের পাশে ঝোঁপের মধ্যে তার মৃতদেহ নজরে পড়ে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভারী কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। তাই মাথাটা থেঁতলে গিয়েছিল। তার পাশে পড়ে আছে এ.বি.সি. গাইড বুক।
নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমাদের গাড়ি থামলো। বাড়ির জন্য স্থান নির্বাচনে তার ভুল হয়নি একটুও। নাম-যশ সব পেয়েছিলো সে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাড়ির নাম রাখা হয়েছে নিরালা। বৃদ্ধ খানসামা ডেভরিন আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে বসলো। তারপর সে মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে খবর দিতে চলে গেল।
তামাটে গায়ের রঙ, মুখের রেখায় ইস্পাত কাঠিন্য, ঝকঝকে দুটো নীল চোখে বুদ্ধির ছাপ পরিস্ফুট। ঘরে ঢুকে ফ্রাঙ্কলিন ক্লার্ক আমাদের সঙ্গে পরিচয় করলো। তারপর ব্রেকফাস্ট সাড়া হলো।
ইনসপেক্টর ওয়েলসের মুখে দাদার মৃত্যুর বিবরণ শুনলাম। ফ্রাঙ্কলিন বলতে থাকে। আমি তো ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। ভাবতে পারিনি দাদা সেই উন্মাদ, সেই পাগলটার…এ.বি.সি.-র হাতে মারা যাবে। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। তাকে খুন করে খুনীর কি যে লাভ হলো এবং কেন করলো?
-এই কেন-র জবাব আমাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। এটাই করা উচিত।
–কে শুনছে এই উচিত শব্দটি? খুনের রক্ত মাথায় চেপে গেলে হাতের কাছে যাকে পেয়েছে তাকে খুন করেছে। ঝোঁকের মাথায় খুন করে ফেলেছে এমন ঘটনা আমি অনেক দেখেছি।
ক্রোম বললো, আপনার দাদা কি কোনো বেনামী চিঠি…
-না, সেরকম কিছু শুনিনি।
–গতকাল সে অন্য দিনের মতো সুস্থ ও স্বাভাবিক কি ছিলো?
-তবে দাদার স্বাভাবিকত্ব ছিল কিছুটা অন্যরকম। উত্তেজক প্রকৃতি ছিল তার। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কালকেও তার ব্যস্তবাগীশ চেহারার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখিনি। তবে বৌদির অসুখের পর থেকেই তার এই সচেতনতা লক্ষ্য করি। আমার বৌদি ক্যান্সারে ভুগছে। সে কোনোদিন ভালো হয়ে উঠবে না। এটা প্রত্যেকেই মানে।
মনে করুন আপনার দাদা, পোয়ারো প্রশ্ন করলো, সমুদ্রের উপকূলে বালির ওপর অথবা নির্জন কোনো ঝোঁপের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, পাশে একটা পিস্তল, তাহলে আপনার কি মনে হতো?
–তাহলে ভাবতাম, দাদা নিজে আত্মঘাতী হয়েছে।
–আচ্ছা, আপনার দাদা রোজই কি রাতের খাওয়া সেরে ভ্রমণে বেরোতেন?
–রোজই যেতো, তবে বৃষ্টি-বাদল হলে অবশ্যই বাদ পড়তো।
–তিনি যে রোজ রাতে ঘুরতে বেরোতেন সেটা কি সকলে জানতো? অর্থাৎ গ্রামের লোকজনও কি জানতো?
–ঠিক বলতে পারবো না। তবে জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ এখানে তো লোকজনের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
যদি কোনো অচেনা উটকো লোক গ্রামে প্রবেশ করে তাহলে যে কোনো লোকের নজরে নিশ্চয়ই পড়বে।
–জুলাইয়ের আগে হলে হ্যাঁ বলতাম। কিন্তু তারপর থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এখানে সবসময় ট্যুরিস্টে ভর্তি থাকে। অতএব কারোকে স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
-কাল কি আপনার দাদার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?
–এটা ডেভরিন বলতে পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করি।
ডেভরিন জানালো, চেনা বা অচেনা কোনো লোকই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। এমন কি বাড়ির ধারেকাছে সন্দেহজনকভাবে কাউকে ঘুরঘুর করতেও সে দেখেনি।
ডেভরিন চলে গেল। ঘরে এসে ঢুকলো বছর সাতাশের এক যুবতী। মেয়েটিকে সুন্দরী বলা চলে। তার সঙ্গে ফ্রাঙ্কলিন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল–দাদার সেক্রেটারি মিস গ্রে।
একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে সে বললো, যদি আমি আপনাদের কোনো সহযোগিতা করতে পারি…
-আপনি তো স্যার মাইকেলের চিঠিপত্র দেখতেন, তাই না? ক্রোম প্রশ্ন করলো। আপনি কি এমন কোনো চিঠি পেয়েছেন যেটা এ.বি.সি. পাঠিয়েছে?
-না!
আমরা উঠে পড়লাম। ঘটনাস্থলের দিকে আমরা রওনা হলাম। সবার পিছনে মিস গ্রে আর আমি ছিলাম।
আমি গলা ঝেড়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এমন একটা ঘটনা স্যার কারমাইকেলের মতো লোক…
-সত্যি, এ যেন অবিশ্বাস্য। আমি তো এখনও ভাবতে পারি না। রাতে আমি যখন বিছানায় শুয়ে তখন থানা থেকে খবরটা এলো। বাইরে ব্যস্ততা, শোরগোল শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। দেখি, ডেভরিন আর মিঃ ফ্রাঙ্কলিন বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছেন।
–আচ্ছা, উনি নৈশভ্রমণ সেরে কখন ফিরতেন?
দশটা নাগাদ, খুব বেশি হলে সোয়া দশটা, তিনি খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। মাঝে মাঝে না শুয়ে গ্যালারিতে গিয়ে জিনিসপত্র দেখতেন, ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। থানা থেকে খবর না দিলে আমরা জানতেই পারতাম না যে এমন একটা অঘটন ঘটে গেছে।
–ওঁর স্ত্রী নিশ্চয়ই খবরটা পেয়ে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন?
–না, ডাক্তার তার আগেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুশ করে দিয়েছে।
মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল। জায়গার নামও তার কাছ থেকে আমরা জানতে পারছিলাম। পায়ে পায়ে আমরা এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ মিস গ্রে আমার বাঁ হাত চেপে ধরে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বুজলো। ওর দেহটা এলিয়ে পড়লো। মিঃ ফ্রাঙ্কলিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল।
-থরা, কি হলো? চোখ খোল, এখানে আমাদের আসাই ভুল হয়েছে। থরা, থরা বাড়ি চলো।
মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, বুঝতেই পারছেন, এমন জায়গায় বেশিক্ষণ…
অতএব কি আর করা। ধীর পায়ে আমরাও ফিরে এলাম মৃতদেহটি নিজের চোখে দেখবো বলে। ততক্ষণে মিস গ্রে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফ্রাঙ্কলিনের হাত ছেড়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো।
ঘরের কাছাকাছি হতে আমরা লক্ষ্য করলাম সৌম্য শান্ত চেহারার এক প্রৌঢ় ডাক্তারি ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
–ডাক্তার, কেমন দেখলেন? ফ্রাঙ্কলিন তাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো।
–না, বিশেষ কিছু নয়। এটি একটি হত্যাকাণ্ড সহজ ও সাধারণ। শক্ত কোনো অস্ত্র নিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করা হয়েছিল। যাই লেডি ক্লার্ককে একবার দেখে যাই। এলাম যখন, ডাক্তারবাবু সেখান থেকে চলে গেল।
আমি ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিস গ্রে-র দিকে দৃষ্টি চলে গেল। আমি তার পাশে গিয়ে বললাম–আপনি কি ভাবছেন?
–ভাবছি সেই পরবর্তী হতভাগ্যের কথা, যার নাম বর্গমালার চতুর্থ অক্ষর দিয়ে শুরু।
–সত্যি, তা যা বলেছেন। এভাবে কতদিন যে চলবে।
-ঠিক বলেছেন। কখন যে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। তার গলার আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালাম।
-কাল রাত থেকে কেবল ভেবেই চলেছি। ফ্রাঙ্কলিন বলতে থাকে। কিন্তু কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাইনি। ঠিক করলাম, এ ব্যাপারে সঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। বুঝলেন মিঃ হেস্টিংস, এ রহস্যের সমাধান করা ক্রোমের কর্ম নয়। কার দ্বারা কি হতে পারে আমি তোক দেখলে বুঝতে পারি। অবশ্য ইতিমধ্যে আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। পরে পোয়ারোকে জানাবো।
ফ্রাঙ্কলিন আর কথা না বাড়িয়ে লেডি ক্লার্কের ঘরের দিকে চলে গেল।
-বারো ঘণ্টাও হয়নি খুনটা হয়েছে। থরা বললো, এর মধ্যে খুনী কি কর্পূরের মতো উবে গেল? পুলিশও তাকে ধরতে পারলো না, কেন? সেটা ভেবে পাচ্ছি না।
–পুলিশ ঠিক ধরতে পারবে। দুদিন আগে আর পরে…। আমি কথা বলতে বলতে পাশে তাকালাম। দেখি থরা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। মনে হয় হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে তার।
আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
এটা ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের লেখা নয়, অতএব এমন ধারণা পোষণ করবেন না।
ছবিটার নাম শেষ পাখি।
ম্যাটিনি শো শেষ হলো, সবার বেরোবার তাড়া। হুড়োহুড়ি করে লোকেরা দরজার দিকে এগোতে থাকে।
তখন রাস্তার ফেরিওয়ালা নিউজ ডেইলি-র সন্ধ্যা সংস্করণ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। কোটের পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে একটি কাগজ কিনে কাস্ট সমুদ্রের ধারে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়ে একটি বেঞ্চিতে বসলেন। কাগজের প্রথম পাতাটি মেলে ধরলেন চোখের সামনে
বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে—
স্যার কার মাইকেলক্লার্ক নিহত। কানে শোকের ছায়া, খুনী উন্মাদের নতুন অপকীর্তি।
নীচে দুকলম জুড়ে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়েছে।
বেক্সহিলে মাত্র একমাস আগে এলিজাবেথ বার্নার্ডের অদ্ভূত হত্যা রহস্যের ঘটনা হয়তো পাঠকদের মনে আছে। তার পাশে খোলা অবস্থায় একটা এ.বি.সি. গাইড পাওয়া গিয়েছিল। আবার মৃত স্যার কারমাইকেলের নিষ্প্রাণ দেহের পাশে ঐরকমই একটা গাইডবুক পাওয়া যায়। প্রশাসনের ধারণা, দুটি ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিই নায়ক। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ…
-দেখুন দেখি, কি বিশ্রী কাণ্ডই না ঘটে গেল।
চমকে উঠলো কাস্ট। কাগজ ভাঁজ করে পাশে তাকালেন। এক যুবক তার পাশে বসে আছে।
-কাণ্ড…কাণ্ডই বটে, বিশ্রী, ভয়ঙ্কর।
–এই মত পাগলদের, কাস্টের হাত থেকে নিচে পড়ে যাওয়া কাগজটা তুলতে তুলতে যুবকটি বলতে থাকে, ওপর থেকে এদের চেনা ভীষণ অসুবিধা, আমার আপনার মতো সহজ সাধারণ দেখতে…
–তা যা বলেছেন।
–কিন্তু তফাত আছে। নেশার ঝোঁকে যেন যুবকটি কথা বলছে, হয়তো সে ভীষণভাবে কারো কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে, হয়তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে, হয়তো বা…।
কাস্ট মাথা নেড়ে সায় দিলেন, আপনার কথা মিথ্যে নয়।
–আমি কিন্তু যুদ্ধ-টুদ্ধ পছন্দ করি না মোটেও।
–আমিও আপনার মতো। যুদ্ধ, প্লেগ, ক্যান্সার এদের ধারে কাছে যেতে নারাজ। এবার হো হো করে কাস্ট হেসে উঠলেন।
সামান্য কথাতে এত হাসির অর্থ কি, সেটা যুবকটি বুঝতে চেষ্টা করলো।
হাসতে হাসতে কাস্টের যেন খেয়াল হল, এবার হাসি থামিয়ে বললেন–মানে…বুঝলেন কিনা…যুদ্ধে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন বিগড়ে গেছে। মাঝে মাঝে কি যে হয়। চিন চিন করে থেকে থেকে মাথার যন্ত্রণা হয়। এমন অবস্থা হয় তখন কি যে করবো ভেবে পাই না..বুঝতে পারি না… কেমন যেন ঝোঁকের মাথায়..মানে, শরীর স্বাস্থ্য আমার তেমন সুবিধের নয়।
যুবকটি উঠে দাঁড়ালো, হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো–এখন চলি, এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরে আবার আমাদের দেখা হবে।
কাস্ট নির্বিকার নিস্পৃহ চিত্তে একইভাবে বেঞ্চির ওপর বসে রইলেন।
সামনের চওড়া রাস্তা দিয়ে কত মানুষের যাতায়াত। মানুষ…কথা…পায়ের আওয়াজ…কথা…।
–বেক্সহিলের পর খুনীর কার্স্টনে পায়ের ধুলো পড়েছে।
–আমি তো শুনলাম, সমুদ্রের ধারে বালির ওপর মুখ থুবড়ে…
–বলো কি! আমি আর তুমি, সবে আমরা গতকাল বাঁকের মুখে দোকানটায় বসে চা খেলাম…
–খুনী ধরা পড়বেই..হ্যাঁ, আলবাত ধরা পড়বে..ইয়ার্ডের লোকজন…
–বাছাধন, কুকর্ম করে কতদিন আর লুকিয়ে দিন কাটাবে। একদিন না একদিন…
–হয়তো লোকটা এই শহরেই ঘুর ঘুর করছে…হয়তো আমাদের কাছাকাছি কোথাও আছে…আমাদের সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে…
কাস্ট ধীরে ধীরে বেঞ্চি থেকে উঠে পড়লেন। তিনি নিজের মনে রাস্তা বরাবর হেঁটে এলেন চৌমাথায়। চায়ের দোকানে ঢুকে এক কোণে বসলেন, হাতে চায়ের কাপ।
..কি করে যে অতসব অদ্ভুত খবর মানুষ পাচ্ছে ভেবে পাই না। তবে হ্যাঁ, এই অজস্র প্রহসনের মধ্যে আশার যেটুকু হলো-বেটি বার্নার্ড এবং কারমাইকেল ক্লার্কের নামের সঙ্গে এ্যান্ডোভারের সেই অখ্যাত অনামী সত্তর বছরের বুড়ি এলিন এ্যাম্বারের নামটাও এতদিন পর যুক্ত হলো, আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
স্যার ক্লার্কের মৃত্যুর চারদিন পর পার্লামেন্টের এক বিশেষ অধিবেশনের তর্ক-বিতর্ক ডেইলি ফ্লিকার-এর পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপা হলো সংবাদ শিরোনামে
রহস্য সমাধানের মঞ্চে অবশেষে এরকুল পোয়ারোর পদার্পণ। প্রথম দিনের তদন্তের ফলে রহস্য আশু মীমাংসার পথে।
পৃষ্ঠার এককোণে আরেকটি সংবাদ শিরোনাম নজরে পড়লো।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির সহিত পোয়ারোর বিশিষ্ট সুহৃৎ ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের নিভৃত সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবৃতি
আমি পোয়ারোকে বললাম, খবরের কাগজের প্রতিনিধি দূরে থাক, এক্স, ওয়াই কারো সঙ্গেই আমার এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।
–জানি। তিলকে তাল করা ওদের স্বভাব, পোয়ারো বললো।
–কিন্তু, কিন্তু…।
–আর কিন্তু কিন্তু কোরো না, ওসব ভুলে যাও। দিনের পর দিন যদি খবর ওভাবে ছাপা হয় তাহলে আমাদের লাভ হবে। ক্ষতি হবে না।
–একথা বলছো কেন?
কারণ কাগজওয়ালারা জানে, যে এই কেসের তদন্তের ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছে।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আগত লোকেদের সঙ্গে ক্রোম কথা বলে জেনেছে তা দিয়ে কেবল কাগজের পর কাগজ লেখা হলো ঠিকই, কিন্তু কোনো কাজে লাগলো না।
পোয়ারো কিন্তু আর মুখ খুললো না। কিছু জানতে চাইলে কেবল এই বলে, এ বয়সে ছুটোছুটি আর সহ্য হয় না। পুলিশ যা করার তা তো করছে। অবশ্য তুমি ভাবছো আমি চুপ করে কেবল ঘরে বসে আছি। তবে বন্ধু, তুমি কি জানো না যে আমার পা কাজ করে না, মাথা কাজ করে। আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলি এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে আমি খুনীর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। খুনীর মনের গোপন কথাটুকু উদ্ধারের চেষ্টা করছি মাত্র।
–মানে উন্মাদের মনস্তত্ত্ব?
–কথাটা শুনতে সহজ ও ছোটো। কিন্তু কাজটা কঠিন। খুনীর আসল রূপ কি? বাইরে থেকে আমরা তাকে যেমন ভাবছি, সেরকম না অন্য কিছু? তবে হয়তো ধীরে ধীরে তার স্বরূপ আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। এ্যান্ডোভারের খুনের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল বেটি বার্নার্ড পরে সে জায়গা পূরণ করে দিলো অনেকটা। আর স্যার কারমাইকেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেই খালি জায়গা আরো বেশ কিছুটা পূরণ হলো। তার মুখোশ আমার সামনে একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। আসলে মুখ ঢাকতে সে মুখোশ ব্যবহার না করে করছে মন, পরবর্তী খুন না হওয়া পর্যন্ত
–পোয়ারো, তুমি কি বলছো!
-কেন? অন্যায় কিছু বলেছি? তা তো নয়। খুন আর একটা হবেই। আমরা কোনোভাবেই সে খুন আটকাতে পারবো না। অবশ্য এই চতুর্থ খুনটি আমাদের রহস্যে যথেষ্ঠ আলোকপাত করবে। একটা না একটা সূত্র রেখে যাবে। ঐ সূত্র ধরেই আমরা তাকে একদিন না একদিন ধরবো।
-কে সেই পাগল?
–উত্তর জানা নেই। তার নাম বা ঠিকানা জানার কোনো উৎসাহ আমার নেই। কেবল আমি তার মনের খোঁজ পাওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছি। আমি ফাঁদ পেতেই রেখেছি। কেবল সেটা পড়ার অপেক্ষায়। তারপরেই সুতো ধরে টান।
তার মানে তোমার সুতোয় টান পড়তে না পড়তে আরো কয়েকজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হবে, তাই না?
-এর মধ্যে মাত্র তিনজন তো মারা গেল। অথচ…আচ্ছা, তাড়াতাড়ি উত্তর দাও তো, গাড়ি চাপা পড়ে সপ্তাহে যদি একশো চল্লিশ জন নিহত হয় তাহলে দুমাসে কত সংখ্যায় দাঁড়াবে?
–পোয়ারো, এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
–আমি জানি, বন্ধু। কিন্তু ভাবলে দেখবে, দুটোর মধ্যে কেনো ফারাক নেই। কারণ দুটোই মৃত্যু। গাড়ি চাপা পড়লে যা পরিণতি হয়, অজ্ঞাত কোনো আতাতায়ীর হাতে খুন হলেও একই ফল হয়। হেস্টিংস, তুমি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করো, তিন তিনটে খুন, অথচ ধরা পড়লো না। অর্থাৎ যারা যথার্থভাবে নির্দোষ, খুনী তাদের কোনোভাবেই আততায়ী বলে প্রতিপন্ন করতে দিলো না।
-তাতে লাভ কি?
–লাভ আছে বৈকি। সন্দেহের আগুনে সর্বক্ষণ জ্বলে মরা। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কিছু আছে! তিনটে খুনের অপরাধী একজনই, অথচ কাউকে সন্দেহ করার মতো সুযোগ আমরা এক বিন্দু পেলাম না। যাক, এবার কাজের কথা শোন।
কি কাজ?
কাজটা মোটামুটি সহজ। কথার জাল বুনে নিহতদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব পরিচিত যে যেখানে আছে পেট থেকে সমস্ত অজানা গোেপন খবর টেনে বের করে আনন।
তার মানে, তোমার ধারণা, সকলে ইচ্ছে করে কিছু না কিছু তথ্য গোপন রেখেছে?
–মানুষ সব কথা সবসময় গুছিয়ে বলতে পারে না। সেটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়। আমি তাদের কাছ থেকে এমন খবর শুনতে চাই যেগুলো ঐসব মানুষের কাছে ফালতু, অকেজো, অযৌক্তিক। হয়তো ঐ কাজগুলোই আমার রহস্য সমাধান করতে সাহায্য করবে।
এরপর পোয়ারো একটা ভাঁজ করা কাগজ পকেট থেকে বের করলো। আমাকে পড়তে দিলো। ওটা একটা চিঠি। হাতের লেখা বোঝা দুঃসাধ্য, মনে হয় কোনো নিচু ক্লাসের কারো লেখা। অজস্র বানান ভুল, সামনে এগিয়ে লিখেছে, বানান সংশোধন করার পর চিঠির বয়ানটা এইরকম দাঁড়ালো—
পরম পূজনীয়েষু,
প্রথমে আমার প্রণাম জানাই। আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আপনাকে চিঠি লেখার ধৃষ্টতার জন্য, মাফ করবেন।
মাসির খুন হওয়ার পর আরো একটা খুন হলো। কাগজে ঐ মেয়েটির ছবি আমি দেখেছি। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো…বেচারা। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। এত কম বয়েসে তাকে এইভাবে মরতে হলো।
মনের কষ্ট দূর করার জন্য কোনোরকমে মেয়েটির দিদির (লন্ডনে যে চাকরী করে) ঠিকানা যোগাড় করলাম, তাকে সমবেদনা জানিয়ে মস্ত বড় একটা চিঠি লিখলাম। সব কিছু চিঠিতে জানালাম, মাসির খুন থেকে শুরু করে আপনার সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত। এটাও জানালাম, আমি তার সঙ্গে বিশেষভাবে দেখা করতে আগ্রহী। অবশ্য এ দেখা সে দেখা নয়। একদিন দুদিনের নয়। স্থায়ীভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। দুজনে পাশাপাশি থাকবো। দুজনে মিলে কোমর বেঁধে খুনির হদিস বের করার কাজে লেগে পড়বো। আমরা দুজনে একই ব্যথায় কাতর। অতএব দুজনের বুদ্ধি একত্রে হলে একটা কিছু হবেই। মোদ্দা কথা, তাকে আমি বুঝিয়ে দিলাম যে ওভারটনের পাততাড়ি গুটিয়ে আমি লন্ডনে স্থায়ীভাবে থাকতে চাই।
…একদিন আমার চিঠির জবাব পেলাম। খুশিতে আমি উথলে উঠলাম। কি সুন্দর হাতের লেখা। সে লিখলো, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা সে ভেবেছিলো। কিন্তু ঠিকানা যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তবে আমার মতে তার মত আছে। তাছাড়া, সে…মিঃ পোয়ারো, শুনলে আপনি তাজ্জব বনে যাবেন, আমার জন্য তদবির করে একটা চাকরিও যোগাড় করে ফেলেছে।
..অতএব আপনার বুঝতে বাকি রইল না, আমি এখন লন্ডনে রওনা হচ্ছি। এই চিঠি স্টেশনে বসে লিখছি। আমার নতুন ঠিকানা এখানে দিলাম। যদি সময় সুযোগমতো একবার এখানে আসেন তাহলে খুব খুশি হবো।
প্রণাম জানবেন,
মেরি ড্রেয়ার।