৩. ভীমরুলের বাসা

০৩.

 ২৪শে ডিসেম্বর।

হ্যারি বলল–বাবা আপনি সত্যি আমায় এখানে থাকতে বলছেন? এ যেন ভীমরুলের বাসায় থাকা।

সাইমন রুক্ষকণ্ঠে বলল–তুমি কী বলতে চাইছ?।

হ্যারি বলল–অ্যালফ্রেড ভাই হিসাবে ভালো, তবে আমি থাকলে সে বিরক্ত হবে।

–তোমাকে আমি যা বলছি তাই হবে। বাড়িটা যখন আমার তখন আমি যা চাইব তাই হবে। আমার ইচ্ছা তুমি এখানে চিরকালের মতো থাকে বিবাহ কর।

–আমি কাকে বিবাহ করবো? কেউ তার নিজের ভগ্নীকে বিবাহ করতে পারে না। আর তরুণী পিলার সত্যিই আকর্ষণীয়া।

–তুমি সেটা লক্ষ্য করেছ নাকি?

 –জর্জ এদিক থেকে খুব ভালো করেছে। এ মেয়েটি কে?

–আমি তা কী করে জানবো? তবে আমার শোনা কথা সে নাকি একজন অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর অফিসারের মেয়ে।

–জর্জ সতর্ক না হলে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়তে পারে।

সাইমন বলে উঠলেন–জর্জ চিরকালই একটু বোকা ধরনের ছেলে ছিল।

হ্যারি বলে উঠল-মেয়েটি কীসের জন্য বিয়ে করতে চায়? টাকার জন্য? হ্যারি নিজে থেকে পুনরায় বলল–আপনার কী মনে হয় অ্যালফ্রেডের ব্যাপারটা কী আপনি মিটিয়ে নিতে পারবেন?

সাইমন গম্ভীর ভাবে বলল–খুব শীঘ্রই আমরা এই ব্যাপারে একমত হতে পারব। তারপর হারবারিকে বললেন অ্যালফ্রেডকে ডেকে আনার জন্য।

অ্যালফ্রেড দৌড়তে দৌড়তে এসে জিজ্ঞাসা করল–বাবা আপনি আমায় ডেকেছেন?

-হ্যাঁ বস, আবার সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে। এই বাড়িতে আরো দুজন মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবে।

–আরো দুজন?

-এখন থেকে এটাই পিলারের নিজের বাড়ি। হ্যারি আমাদের ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।

অ্যালফ্রেড জিজ্ঞাসা করল–হ্যারি এখানে থাকতে এসেছে?

হ্যারি নিজেই বলল–কেন নয় বস?

অ্যালফ্রেড তার দিকে তাকিয়ে বলল-তুমি বাবার সঙ্গে যেমন খারাপ ব্যবহার করে চলে গিয়েছিলে তারপরও তুমি এখানে থাকতে চাও?

হ্যারি হাত নেড়ে বলল–সেটা এখন অতীত হয়ে গেছে আর সেটা তোমার ব্যাপার না আমার ব্যাপার। তিনি যদি সব ভুলে আমায় ক্ষমা করতে চান।

সাইমন বলে উঠল-হা, সেটাই আমার ইচ্ছা। যতই হোক হ্যারি আমার পুত্র।

সাইমন অ্যালফ্রেডের কাঁধে হাত রেখে বলল–ও যখন এখানে এসেছে তখন এখানেই থাকুক। তাছাড়া, ও আমার খুব প্রিয়।

অ্যালফ্রেড মুখটা বিবর্ণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হ্যারিও হাসতে হাসতে তার পিছু নিল।

ওরা চলে যাবার পর সাইমন হারবারির দিকে তাকিয়েই বলল–তোমার এখন অনেক কাজ বাকী আছে। মধ্যাহ্নভোজের পর সবাইকে এখানে নিয়ে আসবে।

-হা মহাশয়।

দাঁড়াও তোমাকে আমার আরো কিছু বলার আছে। ওরা যখন এখানে আসবে তুমিও তখন ওদের সঙ্গে সঙ্গে এখানে আসবে। আর যদি কখনো বারান্দায় আসো তাহলে এমনভাবে মুখে আওয়াজ করবে যাতে আমি শুনতে পাই। কোনো রকম ভনিতা করবে না বুঝতে পারলে?

-হ্যাঁ মহাশয়।

নীচে নেমে সে ট্রেসিলিয়ানকে বলল–তুমি না বলেছিলে আমরা একটা সুন্দর খ্রীস্টমাস উপভোগ করতে চলেছি।

-তুমি কী বলতে চাও? ধৈর্য ধরো সবকিছুই দেখতে পাবে আমরা একটা সুন্দর খ্রীস্টমাস ভোগ করতে চলেছি।

ওরা যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো সাইমন তখন ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। হাত নেড়ে সকলকে ঘরের ভেতরে আসতে বললেন এবং বসতে বললেন-আমার কথা বলতে এক মিনিটও লাগবে না।

হকিন্স এ্যাণ্ড ব্রেসের চার্লটন,-চার্লটন তুমি? আমি সাইমন লী কথা বলছি। আমার একটা নতুন উইল তৈরী করার আছে। হা হা, যা বলছি শোন, তাড়াতাড়ির কিছু নেই। সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। তোমার খ্রীস্টমাস নষ্ট করো না। বক্সিং দিবস কিংবা তার পরের দিন এসো। না না, আমি ঠিক আছি এতো তাড়াতাড়ি মরছি না।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে আটজনের মুখের দিকে একবার দেখে নিয়ে বলল–কী ব্যাপার বল তো? তোমাদের সবাইকে খুব বিষণ্ণ লাগছে। ব্যাপার কী?

অ্যালফ্রেড বলল–আপনি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন?

সাইমন তক্ষুনি বলে উঠল-ওহো দুঃখিত-সেরকম কিছুই নয় খুবই স্বাভাবিক। আচ্ছা, তোমাদের কী মনে হয়? এটা একটা পারিবারিক মিলন সভা? না, মোটে সেটা না। মধ্যাহ্নভোজের পর তোমাদের কারুরই আসার দরকার নেই। আমি খুব ক্লান্ত আমি একটু ঘুমবো। খ্রীস্টমাসের উৎসবের জন্য একটু সতেজ হয়ে উঠতে চাই আমি। তিনি এ সমস্ত কথা বলার পর দাঁত বার করে হাসলেন।

জর্জ বলল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

সাইমন জর্জের দিকে তাকিয়ে বলল-শোন, জর্জ তোমায় একটা কথা বলি। তোমার মাসোহারা বোধহয় কমতে পারে। কারণ এখানকার খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় আগের তুলনায় কমেছে।

জর্জের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। সে বলল-কিন্তু যেহেতু সংসারের খরচ আগের থেকে বেড়েছে সেহেতু আমার মাসোহারা বাবদ টাকাটা যদি কমিয়ে দেন তাহলে আমাকে খুব অসুবিধায় পড়তে হবে।

-কেন তোমার স্ত্রী ইচ্ছা করলেই বাজে খরচ কমিয়ে ঐ টাকায় সংসার চালাতে পারে। আর তাছাড়া, তিনি তো খুবই বুদ্ধিমতী আশা করি এখন থেকে তিনি তাই করবেন। জানি তুমি আগে কখনও এরকম আর্থিক সংকটে পড়োনি। এখন তুমি যেতে পারো।

এরপর সাইমন ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।

এক এক করে সবাই চলে গেল। শুধু হিলডা দরজার সামনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এল সাইমনের সামনে।

সাইমন একবার চোখ মেলে তাকাতে গিয়ে চোখের সামনে হিলডাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হল এবং বলল-কী ব্যাপার তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ?

হিলডা বলল-দেখুন, আপনার চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী আমি ডেভিডকে অনুরোধ করেছিলাম এখানে আসার জন্য।

-হ্যাঁ, তাতে কী হল?

-আপনি পরিবারের সকলকে চারপাশে রেখে আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যা বললেন তার জন্য তো নয়। আপনি কী আমাদের নিয়ে কৌতুক করতে চেয়েছিলেন?

সাইমন মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলল–আমি কৌতুক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তা বলে কেউ আমায় তার জন্য প্রশংসা করুক তা আমি চাই না। আমি কেবল সেটা উপভোগ করতে চাই।

হিলডা কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সাইমনের মাথায় একটা চিন্তা হল। সে তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল–কী চিন্তা করছ তুমি?

–আমার ভয় করছে।

–ভয়-কাকে আমাকে?

–না আপনাকে নয়। আপনার জন্য আমার ভয় হচ্ছে।

 বিচারপতি যেমন শেষ রায় দিয়ে চলে যায়। হিলডাও তেমন করে তার শেষ কথাটা বলে ঘর থেকে চলে গেল।

সাইমন খুব আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল এবং বিড়বিড় করে নিজের মনে বলে উঠল–আমার সুন্দর জিনিষগুলো একবার দেখাই যাক না…

পৌনে আটটার সময় দরজার বেলটা বেজে উঠল। ট্রেসিলিয়ান দরজা খুলতে গেল। সে ফিরে আসতেই হারবারির সঙ্গে মুখোমুখি হল। সে তখন ট্রেতে কফির কাপগুলো সাজিয়ে রাখছিল।

-পুলিশ সুপারিনটেন্টে মিঃ সাগডেন। আরে তুমি ভালো করে চেয়ে দেখ তুমি কী করছ।

কফির একটা কাপ তার কাঁপা কাঁপা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।

ট্রেসিলিয়ান দুঃখ প্রকাশ করে বলল–ছিঃ ছিঃ আমি এগারো বছর ধরে কাপ ডিস ঘোয়া মোছা করছি। একটা কাপ বা একটা ডিস আজ পর্যন্ত আমার হাত থেকে ভাঙেনি। আর তুমি একদিন হাত দিয়েই ভাঙলে।

আতঙ্কিত মুখ করে সে বলল–আমি দুঃখিত মিঃ ট্রেসিলিয়ান। জানি না কেমন করে আমার কাছ থেকে এমন অঘটন ঘটে গেল। তুমি কী যেন বলছিলে? এ বাড়িতে পুলিশ সুপার এসেছেন?

-হ্যাঁ, মিঃ সাগডেন।

হারবারি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল–কেন কী চায় সে?

–দুঃস্থ পুলিশদের সাহায্য নিতে এসেছেন।

–ও, আচ্ছা, তাই বল। ঠিক আছে এখন আমি চললাম, এবার তার গলার স্বর স্বাভাবিক হল।

–কোথায়? সিনেমায়?

–সেই রকমই মনে হয়। টা টা মিঃ ট্রেসিলিয়ান।

পুলিশ সুপার চলে যাওয়ার পর নৈশভোজের আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। শেষ অতিথি ম্যাগজলেন ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই বৃদ্ধ খানসামা সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন–নৈশভোজের খাবার টেবিলে দেওয়া হয়ে গেছে।

আর এদিকে মিঃ ডেভিডের ব্যাপার। তাকে দেখে খুব চিন্তান্বিত লাগছিল। ডেভিডকে দেখতে ঠিক তার মায়ের মত। আর এখন তাকে পরিপূর্ণ পুরুষের মত লাগে। তবে সে চশমার কাঁচ দিয়ে দেখল সে একটু নার্ভাস।

কিছুক্ষণ আগে পুলিশ আসার খবরে হারবারির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই রকম লাগছিল ডেভিডের মুখ।

আজ রাতে হ্যারিকে সবচেয়ে বেশী মন মরা দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে অ্যালফ্রেডের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছিল যে তাদের ভ্রাতৃপ্রেম নষ্ট হবার নয়। অ্যালফ্রেড তবুও হ্যারিকে সহ্য করতে পারছে না।

কিন্তু মিঃ সাইমন সর্বাপেক্ষা স্নেহ করেন হ্যারিকে যেটা অ্যালফ্রেডের কাছে অসহ্য। আর সে যতই বাবাকে শ্রদ্ধা করুক না কেন মিঃ লী তাকে বেশী পাত্তা দেয় না।

রাতের আহারের শেষে লী পরিবারের পুরুষরা একে একে গিয়ে ড্রইংরুমে বসল। এদিকে ডাইনিংরুমে চারজন মহিলা পর পর বসে আছে অথচ কেউই কারো সাথে কথা বলতে প্রয়োজন বোধ করছে না। বৃদ্ধ ট্রেসিলিয়ানের এই ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগল।

প্যান্ট্রি থেকে কফির ট্রেটা হাতে করে নিয়ে সে এবার ডাইনিংরুমে হাজির হল। ডাইনিংরুম থেকে প্যান্ট্রিতে ফিরে যাবার সময় সে ডাইনিংরুমের দরজা খোলার শব্দ পেল। ডেভিড লী যে এতক্ষণ ডাইনিংরুমে বসেছিল সে তা লক্ষ্য করেনি। এখন ডেভিড ডাইনিংরুম থেকে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।

খ্রীস্টমাস ইভে লী পরিবারের সকলের মুখে একটা থমথমে ভাব তার ভালো লাগল না। সবাইয়ের মুখে একটা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর অপছন্দ।

ট্রেসিলিয়ান একটু বাদে খালি কফির কাপগুলো আনার জন্য ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখল, লিডিয়া জানলার ধারে বাইরের অন্ধকারে কী দেখছে।

পাশের ঘর থেকে পিয়ানোর আওয়াজ আসছিল। ডেভিড বাজাচ্ছিল। কিন্তু কেন? ট্রেসিলিয়ান নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল। ডেভিড কোনোদিন এইরকম করুণ সুরে পিয়ানো বাজায় না। মনে হয় এই খ্রীস্টমাস ইভে কোথাও কিছু একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। আস্তে আস্তে সে হাঁটতে হাঁটতে প্যান্ট্রিতে ফিরে গেল।

হঠাৎ সে ওপরতলা থেকে গণ্ডগোল শুনতে পেল। টেবিল চেয়ার, ফার্ণিচার ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে পেল।

ট্রেসিলিয়ান চিন্তা করল-মনিব একী করছেন? উপরতলা থেকে এইরকম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কেন?

তারপরই আর্তনাদ শোনা গেল বাড়ির মধ্যে। ট্রেসিলিয়ান চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর সে হলঘরে ছুটে এসে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে ছুটে গেল। সবাই তার সঙ্গে ছিল। ওপরে সবার লক্ষ্য ছিল বৃদ্ধ লীর ঘর। তার আগেই ওখানে মিঃ ফার এবং মিসেস ডেভিড পৌঁছে গেছেন। মিসেস ডেভিড দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে, ওদিকে দরজার হাতল ধরে ঘুরিয়ে–মিঃ ফার সেটা খোলবার চেষ্টা করছিল।

স্টিফেন ফার বলছিল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

হ্যারিও ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে এবং ফারের মত দরজার হাতল ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।

সে চেঁচিয়ে বলল–বাবা, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিন।

অন্যেরা চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছিল না।

বাড়ির সদর দরজার বেল বেজে উঠল সেদিকে কারো নজর গেল না।

ফার বলল-দরজা এখনি ভেঙে ফেলতে হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।

হারি বলল–কাজটা কঠিন হবে, পুরু কাঠের দরজা। যাই হোক অ্যালফ্রেড এসো আমরা কাজটা শুরু করি।

সবাই মিলে জোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া গেল না। কে যেন শেষে একটা বেঞ্চ নিয়ে এসে সজোরে দরজায় আঘাত করল। দরজার ফ্রেমটা অবশেষে নড়ে উঠল। এইভাবে কয়েকবার ধাক্কা মারার পর দরজাটা সব সুদ্ধ ভেঙে ঘরের ভেতর পড়ল।

ভেতরে ঢুকে সবাই অবাক হয়ে গেল। তারা চিন্তা করতে পারেনি ভেতরে ঢুকে তারা এমন দৃশ্য দেখবে।

ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল যে কিছুক্ষণ আগে ঘরের মধ্যে একটা লড়াই হচ্ছিল। সব আসবাবপত্র উল্টে পড়ে আছে; চায়না ভাসটা ভেঙে মেঝের উপর টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। সাইমন লীর দেহটা রক্তে মাখামাখি অবস্থায় ফায়ার প্লেসের সামনে কম্বলের উপর পড়ে আছে। জায়গাটা কসাই-এর দোকানের মতো লাগছে।

দুটি কণ্ঠস্বর সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল।

ডেভিড লী বলে উঠল–ঈশ্বরকে যেন ধীরে ধীরে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

 লিডিয়া বলে উঠল–কে জানত ঐ বৃদ্ধ মানুষটার দেহে এত রক্ত আছে?

সুপারিনটেন্টে সাগডেন তিন বার বেল বাজিয়ে তারপর জোরে জোরে দরজায় ঘুষি মারতে লাগল। শেষপর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ওয়ালটার দরজা খুলে দিল।

-ওহো আপনি? ওয়ালটারের মুখে একটা স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। আমি এক্ষুনি পুলিশে সংবাদ দিতে যাচ্ছিলাম।

সুপারিনটেন্টে সাগডেন রুস্বরে বলে উঠল–বেল? কীসের জন্য? এখানে কী হয়েছে?

ওয়ালটার ফিসফিস করে বলল,-বৃদ্ধ মিঃ লী…তাকে…

সুপারিনটেন্ডেন্ট তাকে একপ্রকার ধাক্কা মেরে উপরে ছুটলেন। তার আসার খবর কেউ জানতেও পারলো না। সে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল পিলার কী যেন মেঝে থেকে তুলে নিল। সে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ডেভিড লীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অ্যালফ্রেড বিষণ্ণ মুখে তার বাবার মৃত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

জর্জ লীকে একটা ঘোষণা করতে শোনা গেল–পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই ঘরের কোনো জিনিষে কেউ হাত দেবে না। এখানকার একটা জিনিষও কেউ ছুঁয়ো না। এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

অ্যালফ্রেড লী সুপারিনটেন্টে সাগডেনকে বলল–আপনি খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছেন দেখছি।

-হ্যাঁ, মিঃ সি। কিন্তু এসব কী ব্যাপার বলুন তো?

অ্যালফ্রেড ধরা গলায় বলল–আমার বাবা খুন হয়েছেন।

সুপারিনটেন্টে হাত তুলে বলল–একমাত্র মিঃ লী আর মিঃ জর্জলী ছাড়া সবাই আপনারা ঘর থেকে চলে যাবেন।

সবাই ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলে সুপারিনটেন্টে পিলারকে বাধা দিয়ে বললেন এখানকার কোনো জিনিষ এখন স্পর্শ বা সংগ্রহ করা যাবে না।

স্টিফেন ফার পিলারের দিকে তাকিয়ে বললেন,–সে কথা উনি ভালো করেই জানেন।

সুপারিনটেন্টে গলার স্বর নরম করে বলল–কিন্তু একটু আগে আমি মেঝে থেকে ওনাকে কী একটা কুড়িয়ে নিতে দেখেছি।

-আমি নিয়েছি?

–হ্যাঁ, আমি আপনাকে নিতে দেখেছি।

–ওহো!

–তাহলে ওটা আমাকে দিয়ে দিন। ওটা আপনার হাতের মুঠোয় রয়েছে।

–আস্তে আস্তে পিলার হাতের মুঠোটা খুলল। খুলতেই দেখা গেল সেখানে খড়ের আংটির মতো একটা রবার আর একটা কাঠের বস্তু রয়েছে। ওর হাত থেকে সেগুলো নিয়ে সুপারিনটেন্টে ভেতরে রেখে দিলেন। তারপর সেই খামটা যে তার বুক পকেটে চালান করলেন।

সে বলল-ধন্যবাদ।

তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলো-যদি আপনারা আর।

মিণ্ডলশয়ারের চীফ কনস্টেবল কর্নেল জনসনের ছুটি কাটাতে এসে এরকুল পোয়ারোর আলোচনা হচ্ছিল-খ্রীস্টমাসের সময় কোনো অপরাধ অনুষ্ঠান হয় কী না!

-খ্রীস্টমাসটা হল শান্তি, শুভেচ্ছা বিনিময়ের সব জায়গায় শুধু প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানানো।

এরকুল পোয়ারো তার চেয়ারে বসে ভালো করে জনসনকে দেখছিল। সে এখানে খ্রীস্টমাস উপলক্ষে জনসনের অতিথি হয়ে এসেছে। সে বলে উঠল তাহলে তোমাদের ধারণা হল-খ্রীস্টমাসের সময় কোনো অপরাধ অনুষ্ঠান হয় না? কেন হয় না? এর কারণটাই বা কী হতে পারে?

জনসন একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল–কেন? তোমাকে আমি আগেই বলেছি না খ্রীস্টমাসের সময় মানুষের মনে সৎ চিন্তা প্রতিষ্ঠা করার সময়। অতীতের সমস্ত হিংসা, বিবাদ ভুলে পরস্পর মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এইরকম আর কী?

এরকুল পোয়ারো নিজের মনে বলে উঠল–ইংরেজরা এত অনুভূতিপ্রবণ ছিল যে, তারা কখনও মন্দ কিছু কল্পনাই করতে পারত না।

জনসন জোর গলায় বলল–সেই পুরানো দিনের ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসবের কথা ভাবলে বরং লাভই হয়।

যাই হোক, এসো আমরা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখি তোমার মতে খ্রীস্টমাস হল–আনন্দ উপভোগ করার সময়। তার মানে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া আর মদ্যপান করা। আর তার মানেই অতিরিক্ত ভক্ষণ। আর তার ফলে হজমের গণ্ডগোল, তার থেকে শরীরে অস্বস্তি।

পোয়ারো বলল-জনসন, এর থেকেই অপরাধের উৎপত্তি হয়ে থাকে।

–আমি ঠিক এই ব্যাপারে একমত নই। এর আর একটা দিক হল–খ্রস্টমাস হল প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পন্থা।

–এর অর্থ হল যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা। পোয়ারো তার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করল–যেমন ধরুন পরিবারের কিছু সদস্য বিদেশে কাটিয়ে খ্রীস্টমাসের সময় মিলিত হয়। আবার বন্ধু তুমি এটা অস্বীকার করবে না যে, দীর্ঘদিন অদর্শনের জন্য পুরোনো ক্ষোভ, মনোমালিন্য জমে থাকার ফলে পরে সাক্ষাতের সময় সেটা সুখের না হয়ে দুঃখেরও হতে পারে। আর এই অশান্তি থেকে অপরাধের জন্ম হতে পারে।

কর্নেল জনসন বলল–আমি কিন্তু ঠিক এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি না।

-আরে, তোমার তো গ্রহণ করার দরকার নেই। যা গ্রহণ করার আমিই করছি। মানুষের স্বভাব বা ব্যবহারে যে কোনো পরিস্থিতিতে বদলে যেতে পারে। আর সেক্ষেত্রেও শান্ত প্রকৃতির মানুষও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যেতে পারে।

কর্নেল তার দিকে একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল।

–আমি বুঝতে পারি না কখন যে তুমি অস্থির হয়ে ওঠো আর কখনই তুমি আমার পেছনে লাগার জন্য তৎপর হয়ে ওঠো।

পোয়ারো হেসে বলল–আমি খুব মজার লোক। আমি এক কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করে মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার কথা জানতে পারি।

ঠিক সেই সময়ই কর্নেল জনসনের চাকর এসে বলল–স্যার, সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের ফোন এসেছে।

-তুমি যাও আমি আসছি।

ঠিক তিন মিনিট পরে সে ফিরে এল এবং জানাল–স্যার, যতসব অনাসৃষ্টির কাজ এই খ্রীস্টমাস ইভের শুভ দিনে।

পোয়ারো ভ্রূ উপরে তুলে বলল–অবশ্যই এটা খুন।

বৃদ্ধ সাইমন লী ছিলেন অনেক ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। আমার বিশ্বাস তিনি হীরের ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছিলেন। তারপর তিনি সেই টাকা মেসিন তৈরীর কারখানায় লাগিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলেন।

পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–তিনি সবার প্রিয় ছিলেন তো?

–তাকে সবাই অপছন্দ করত। বহুবছর তিনি পঙ্গু ছিলেন। অবশ্য তাঁর সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছুই জানি না। শুধু আমি এইটুকু জানি যে, তিনি আমাদের দেশের এক বিরাট পুরুষ ছিলেন।

–এই কেসটা তাহলে একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে?

 –আমাকে খুব শীঘ্রই লংডেন গিয়ে পৌঁছতে হবে।

জনসন বলল–একটা কথা তোমাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছি। সাগডেন মানুষ হিসেবে ভালো সাবধানী এবং পরিশ্রমী। কিন্তু অনুমান ক্ষমতা অতটা প্রখর নয়। তাই মনে হয় তোমার উপদেশ এখানে কাজে লাগতে পারে।

পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে জানালো–এতে আমি খুশীই হবে। আমাকে তোমার একজন করে ধরে নিতে হবে। আমি সুপারিনটেন্ডেন্টের মনে আঘাত দিতে চাই না।–এই কেসটা তার আমার নয়, যে সরকারী ভাবে আমি তার পরামর্শদাতা।

জনসন বলল-পোয়ারো তুমি একজন সজ্জন ব্যক্তি। তারপর তারা দুজন লংডেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

একজন কনস্টেবল সামনের দরজা খুলে দিল।

 সাগডেন বলল–স্যার আপনাকে পেয়ে আমি খুব খুশী। প্রথমে আমরা মিঃ লীর স্টাডিরুম থেকে ঘুরে আসি। সেখানে এই সম্বন্ধে একটু আলোচনা করে নিতে চাই।

চীফ কনস্টেবল পোয়ারোর সঙ্গে সাগডেনের পরিচয় করিয়ে দিল।

কর্নেল জনসন অধৈর্য হয়ে বলল-সাগডেন তাহলে এবার ঘটনাটা জানা যাবে।

-হ্যাঁ, স্যার এটা যে খুন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। ডাক্তারের কাছ থেকে জেনেছি গলার শিরা কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত।

-আপনাকে আমি সমস্ত ঘটনা জানাতে চাই স্যার।

-আজ বিকেল পাঁচটার পর এগজেনফিল্ড পুলিস স্টেশনে মিঃ লী ফোন করে আমাকে বলেন, আজ সন্ধ্যে আটটায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আর তার সঙ্গে তিনি এও বলে দেন, বাড়ির খানসামা যদি জিজ্ঞাসা করে কেন আসছি তাহলে আমি যেন বলি পুলিশ চ্যারিটির চাঁদা আদায় করতে।

–তার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে কোনো একটা অজুহাতে এই বাড়িতে প্রবেশ করা।

–ঠিক তাই স্যার। মিঃ লী একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাই ওনার অনুরোধ রাখতে আটটার কিছু আগেই আসি।লী আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠান। তিনি একটা ফায়ার প্লেসের সামনে বসেছিলেন। তিনি একটা ড্রেসিং গাউন পরেছিলেন, আমি বসার পর তিনি আমাকে জানালেন যে, ওনার আলমারি থেকে কতকগুলি মূল্যবান হীরে চুরি গেছে। সেগুলো কয়েক হাজার পাউণ্ডের।

চীফ কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করলেন হীরে?

আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি কী করতে বলেছেন? তিনি তখন আমায় বললেন ঠিক আছে আপনি রাত নটা নাগাদ একবার আসুন। আপনাকে তখন সঠিক খবর জানাবো হীরেগুলো চুরি গেছে না যায়নি। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যজনক লাগলেও আমি তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাই।

জনসন বলল–এটা সত্যিই রহস্যজনক।

অনেক রকম ধারণাই আমার আছে। এখানে কৌতুকের কোনো প্রশ্নই নেই। আমার দৃঢ়বিশ্বাস হীরেগুলো চুরিই হয়েছে। কিন্তু ঐ বৃদ্ধ লোক নিশ্চিত নন? কে চুরি করতে পারে ঠিক জানেন না। তবে তিনি দুজন লোকের ওপর সন্দেহ করেছেন। এক তার বাড়ির চাকর, আর দ্বিতীয় জন তার পরিবারের একজন সদস্য।

পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন–এর থেকে বোঝা যায় তার মনোভাব বেশ ভালোই ছিল। হয়তো তিনি এ কারণে পুলিশকে জানিয়েছেন, যদি তারা অপরাধ কবুল করেন তাহলে তিনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবেন।

জনসন বললেন–আর যদি তার সন্দেহ নিরশন না হয়?

তিনি তাহলে পুলিশের হাতে কেসটা তুলে দেবেন।

 –আচ্ছা, পরিবারের কে সেই সদস্য। সেই বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে?

–না স্যার।

মাথা নেড়ে জনসন বলল–ঠিক আছে তারপর কী হল বলুন।

সাগডেন আবার বলতে শুরু করল। ঠিক নটা পনেরো, আমি দরজায় বেল টিপতে যাবো আর ঠিক সেই সময়ই আমি ভেতর থেকে একটা আর্ত চিৎকার এবং সকলের সম্মিলিত চিৎকার শুনতে পাই। শুনে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং ঘনঘন বেল টিপতে থাকি। কিন্তু তিন-চার মিনিটের আগে দরজা খোলা হয়নি। যাই হোক যে চাকরটা এসে দরজা খোলে সেই চাকরটা জানায় লী খুন হয়েছে। আমি তখন তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যাই। গিয়ে দেখি ঘরের সব আসবাবপত্র ছড়ানো ছেটানো। আর লীর রক্তাপ্লুত দেহটা ফায়ার প্লেসের সামনে পড়ে আছে। তার গলা দিয়ে তখন রক্ত বেরোচ্ছে। কার্পেটটা লালে লাল হয়ে গেছে।

চীফ কনস্টেবল তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন হয়তো তিনি নিজেই এইরকম করেছেন।

সাগডেন মাথা নেড়ে বলল–অসম্ভব স্যার, যেভাবে চেয়ার টেবিল ওলটপালট ছিল তাতে মনে হয় না, তিনি তার পঙ্গু পা নিয়ে এসব করতে পারেন। আর তিনি যদি সত্যিই আত্মহত্যা করতেন তবে সেই ধারালো ছুরিটা পাশে পরে থাকতে দেখা যেত। এখানে কিন্তু সেইরকম কিছুই হয়নি।

-হ্যাঁ, আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক।

–এর থেকে কী অনুমান করা যায়? এই বাড়ির কেউ এইরকম নিষ্ঠুর কাজ করে থাকবে। বাইরের কেউ তাকে খুন করে পালাবে কী ভাবে?

-জানালাগুলো বন্ধ ছিল না ভোলা ছিল?

–তার ঘরের দুটো জানালার একটা বন্ধ আর লক করা ছিল। আর অপরটি ইঞ্চিখানেক ফাঁক করা ছিল। সেখানে কারো পায়ের বা হাতের ছাপ ছিল না। আর সেখান দিয়ে কেউ পালাতে পারে আমি তা চিন্তাই করতে পারি না।

জনসন বলে উঠল–আশ্চর্য, একটা বন্ধ ঘরে একজন খুন হল অথচ খুনী কোন পথে পালালো তা বোঝা যাচ্ছে না। এইরকম অদ্ভূত হত্যাকাণ্ড গোয়েন্দা গল্পেও পাওয়া যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এক অতি প্রকৃত শক্তির কাজ।

সাগডেন সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল–না স্যার, ঠিক ততটা মন্দ আমার মনে হয় না।

–কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন দরজাটা ভেতের দিক থেকে বন্ধ ছিল।

সুপারিনটেন্টে একটা চাবি বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল-দেখুন এতে কোনো হাতের ছাপ নেই। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুন।

সামনের দিকে ঝুঁকে দুজনে চাবিটাকে ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগল। পোয়ারো চাবির শেষ প্রান্তে কতকগুলো দাগ দেখতে পেল।

-হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। চাবির গর্তের ভেতর দিয়ে চাবিটা সাঁড়াশি জাতীয় কোনো বস্তু দিয়ে ঘরের ভেতরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে মনে হতে পারে ভেতর থেকে যখন দরজা বন্ধ ছিল তখন এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা। খুনী নিশ্চয়ই প্রথমে ঘটনাটা এইভাবে সাজিয়ে থাকবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আপনাদের খুনী যদি এতই চতুর, তাহলে একটা অস্ত্র ফেলে গেল না কেন? যাতে মনে হতে পারে সেই অস্ত্র দিয়েই মিঃ লী আত্মহত্যা করেছেন। পোয়ারো বলল –অস্ত্র যখন নেই তাহলে ধরে নেওয়া যাক এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা না। এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে খুনীর পক্ষে একটা মারাত্মক ভুল।

সুপারিনটেন্টে সাগডেন বললেন,–আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সব অপরাধীই একটা ভুল করে যাবেই।

পোয়ারো বলে–যাই হোক; ভুল করা সত্ত্বেও অপরাধী অপরাধ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। আমার অনুমান তাকে আমরা খুব শীঘ্রই সনাক্ত করতে পারব।

এই বাড়ির কাউকেই তো আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করিনি। সাগডেন দৃঢ়ভাবে বলল।

কর্নেল বলল-দুর্ঘটনার সময় যারা এ বাড়িতে ছিল তাদের কোনো তালিকা আছে?

সাগডেন নোটবুক পড়তে লাগল–মিঃ এবং মিসেস অ্যালফ্রেড লী, এম. পি. মিঃ জর্জ লী এবং তার স্ত্রী। মিঃ হেনরি লী, মিঃ এণ্ড মিসেস ডেভিড লী, মিস পিলার এস্ট্রাভাডোস, মিঃ স্টিফেন ফার, তারপর চাকর-চাকরানি, খানসামা এডওয়ার্ড ট্রেসিলিয়ান, ভৃত্য ওয়ালটার চ্যাম্পিয়ান, রাঁধুনী এমিলি রীভস, রান্নাঘরের পরিচারিকা কুইন জোন্স, প্রধান পরিচারিকা গ্লোডিয়া সেপাট, দ্বিতীয় পরিচারিকা গ্রেস ব্রেটে, তৃতীয় পরিচারিকা বেগ্রিস মস্কোব, পরিচারিকা জোরন ফেঞ্চ, সাজভৃত্য সিডনি হারবারি।

–কতজন পরিবার এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে, আর কতজনই বা খ্রীস্টমাসে বেড়াতে এসেছে? কর্নেল জিজ্ঞাসা করল।

–মিঃ এণ্ড মিসেস অ্যালফ্রেড লী স্থায়ীভাবে বাস করে আর বাকীরা বাইরে থেকে বেড়াতে এসেছে।

এরপর সাগডেন তাদের সাইমন লীর ওপরতলার ঘরে নিয়ে গেল।

ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে চেয়ার যত্রতত্র ছড়ানো, সর্বত্র রক্তের ছিট দেখে কর্নেল জনসন মন্তব্য করলনে-খুবই ভয়ঙ্কর। এ যেন কসাইখানা।

বৃদ্ধের মৃতদেহের সামনে বসে একজন মাঝবয়েসী ছেলে কী যেন পরীক্ষা করছিল।

ডাক্তার কিছু পেলেন নাকি?

–তদন্তের সময় আমি আপনাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় জানাবোখন। শূকরছানার মত কণ্ঠনালী, কাটা হয়েছে। এক মিনিটের মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।

পোয়ারো হামলা দুটো খুঁচিয়ে দেখে মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর ঘরের অবিন্যস্ত জিনিষগুলোর ওজন আন্দাজ করতে গিয়ে তার ভ্রু কুঁচকে উঠল।

বিড়বিড় করে পোয়ারো বলল–এমন দুর্বল বৃদ্ধ আর তবুও এসব ভারী ভারী জিনিষ।

 জনসন সার্জেন্টের দিকে ফিরে বলল–ছাপগুলোর ব্যাপার কী?

–ঘরের সর্বত্র অনেক ছাপ দেখতে পেয়েছি স্যার। আর আলমারীর ওপর ঐ বৃদ্ধের হাতের ছাপ ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ নেই।

এবার ডাক্তার অভিমত জানালোতাকে যেই খুন করুক না কেন নিশ্চয়ই তার গায়ে রক্ত লাগবে।

পোয়ারো বলল–প্রয়োজন নেই। রক্তক্ষরণ হয়েছে সম্পূর্ণভাবে কণ্ঠনালীর শিরা থেকে। অন্য শিরাগুলোর থেকে রক্ত ছিটকে যাবার সম্ভাবনাও কম। এখানে একটা কিছু আছে, সংঘর্ষ.. এবং রক্ত-রক্তের ধাঁধা…কিভাবে যে এর ব্যাখ্যা করব? চেয়ার, কার্পেট, টেবিলে এতে রক্তের ছড়াছড়ি। অমন শুকনো, রোগা, দুর্বল স্বাস্থ্যের বৃদ্ধের দেহে এত রক্ত আসে কী করে?

উত্তরে সাগডেন বলল–ঐ মহিলা, মিসেস অ্যালফ্রেড ফিসফিস করে বলেছিল–কে ভেবেছিল, ঐ বৃদ্ধটার দেহে এত রক্ত ছিল…,তখন কথাটার গুরুত্ব অনুভব করিনি।

পোয়ারো নরম গলায় বলল-ওটা লেডি ম্যাকবেথের উক্তি।

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অ্যালফ্রেড লী ছোট্ট স্টাডিরুমে এসে ঢুকল। সেখানে পোয়ারো, সাগডেন এবং চীফ কনস্টেবল অপেক্ষা করছিল।

কর্নেল জনসন এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হল এরপর মিঃ এণ্ড মিসেস লীর সঙ্গে পোয়ারোর পরিচয় করিয়ে দিল।

তারপর বলল–আজ রাতে যারা এই বাড়িতে ছিল তাদের একটা তালিকা পেয়েছি।

সাগডেন তালিকাটা মিঃ লীকে পড়ে শোনালেন।

অ্যালফ্রেড বলল–তালিকাটা ঠিক আছে।

–শুনেছি আপনার সব ভাইয়েরা এবং তাদের স্ত্রীরা এখানে খ্রীস্টমাসের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন? তবে মিস্ এস্ট্রাভাভোস আর মিঃ ফার এরা কারা? জানতে চাইলেন কর্নেল।

-মিস এস্ট্রাভোস আমার ভাগ্নী। আর মিঃ ফার, দক্ষিণ আফ্রিকার আমার বাবার একসময়ের পার্টনারের ছেলে।

হঠাৎ লিডিয়া বলে ওঠে–আসলে মিঃ ফার হঠাই এখানে এসে পড়ে। আমার শ্বশুরমশাই ওর পরিচয় পেয়ে ওকে এখানেই থেকে যেতে বলেন।

–আচ্ছা, মিসেস লী, আপনাদের চাকর-বাকর সকলকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?

-হ্যাঁ প্রায় সবাইকে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়। কেবল নবাগতা জোয়ান আর আমার শ্বশুরমশাইয়ের সাজভৃত্য সিডনী হারবারি ছাড়া। সে মাত্র একবছর হয়েছে এসেছে। তবে আমার মনে হয় আমার শ্বশুরমশাই তার কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন। জোয়ান ছিল বিশ্রী স্বভাবের মেয়ে।

এবার কর্নেল জনসনকে জিজ্ঞেস করল মিঃ লী, এবার আপনি আজ রাতের ঘটনার কথা বলুন।

অ্যালফ্রেড নীচু গলায় বলতে শুরু করল–তখন সোয়া ছটা হবে ওর কাছে কিছুক্ষণ থেকে ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে আসি।

বাধা দিয়ে পোয়ারো বলল–আপনি তাকে ছটার সময় শুভরাত্রি জানিয়ে আসেন কেন? রাত্রে ওর সাথে আপনার আর দেখা হয় না?

অ্যালফ্রেড জানালো যে, তার বাবা হাল্কা খাওয়ার জন্য সন্ধ্যে সাতটায় শুয়ে পড়েন আর তারা খেয়ে-দেয়ে ওঠে আটটায়। সেইদিন ওরা যখন নীচে ডাইনিংরুমে সকলে খাচ্ছে ঠিক সেইসময় ওপর থেকে আসবাবপত্র পড়ে যাওয়ার আওয়াজ আর ঠিক তার পরেই তার বাবার ভয়ঙ্কর চিৎকার যা ভোলা যাচ্ছে না। শুনে এক মিনিট হতবাক হওয়ার পরই ওরা ওপরে গিয়ে যখন দরজা বন্ধ দেখল তখন দরজা ভাঙতে বাধ্য হল এবং ভেতরে…

কর্নেল জনসন আলফ্রেডের উদভ্রান্ত দৃষ্টি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনে তাকে থামতে বলল।

পোয়ারা জানতে চাইল-চিৎকারের সময় কে ছিল?

–আমার ভাই হ্যারি।

 –আর কেউ ছিল না?

না।

-বাকী সকলে কোথায় ছিল?

-আমরা পারিবারিক আলোচনায় মেতে উঠি, জর্জ কাকে ফোন করতে চলে যায়, স্টিফেনও হঠাৎ উধাও হয় আর ডেভিড কোন ফাঁকে চলে যায় বুঝতেও পারিনি।

-তাহলে আপনি পরিবারের বিশেষ কোনো লোকের সাথে বিশেষ কিছু আলোচনা করছিলেন?

-আপনি কী বলতে চাইছেন মিঃ পোয়ারো? ফুঁসে উঠল লিডিয়া।

আপনার স্বামী এই মাত্র বললেন পারিবারিক আলোচনা, জর্জ, স্টিফেন, ডেভিড সকলেই চলে যায় যখন তখন এটা সীমাবদ্ধ আলোচনা!

-আমার দেওর হ্যারি বহুকাল বাইরে ছিল তাই তার সাথেই কথাবার্তা বলছিলেন আমার স্বামী।

এরপর জনসন হীরের কথা জানতে চাইলেন, অ্যালফ্রেড জানালো, সে হীরের ব্যাপারে জানে। তার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঐ অখচিত হীরেগুলো এনেছিলেন এবং সবসময় নিজের ঘরের আলমারীতেই রাখতেন। এক একটা হীরের মূল্য দশ পাউণ্ডের কাছে তাও জানালেন অ্যালফ্রেড।

এরপর কর্নেল তাদের জানালো হীরেগুলো চুরি গেছে। ওরা দুজনে হতবাক হয়ে গেল।

পোয়ারো মিসেস লীকে কোনো চাকর-বাকরকে সন্দেহ হয় কী না বলতে জানা গেল সবাই বিশ্বাসী লোক। তবে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে সবসময় থাকত দ্বিতীয় পরিচারিকা হারবারি। অন্যান্য সব মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে লিডিয়া জানালো ম্যাগজলেন ফোন করতে গেছিল, পিলার কোথায় গেছিল সে জানে না আর হিলডা ডেভিডের সঙ্গে অর্থাৎ সে একাই ছিল ডাইনিংরুমে।

এরপর মিঃ লীর কাছ থেকে জানা গেল পুরোনো আলমারী খোলার পদ্ধতি একটা নোটবুকে ছিল আর সেটা তার বাবার গাউনের মধ্যেই থাকে সবসময়।

আর বাকী সকলকে একে একে পাঠাতে বলে তাদের চলে যেতে বলল ওরা।

এরপর জর্জ এসে তার মতামত জানালো–সে তখন ফোনে কথা সবেমাত্র শেষ করেছে আর ঠিক সেই সময়ই তার ধারণা এটা কোনো পাগলের কাজ।

এরপর তাকে হীরের ব্যাপারে জানানো হল। তা শুনে জর্জ হতবাক হয়ে গেল। সে জানত না যে হীরেগুলো চুরি গেছে।

এরপর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘরে ঢুকলো হ্যারি, ঢুকেই কোনো একটা ব্যাপারে সে নার্ভাস হয়েছিল বটে কিন্তু কাউকেই বুঝতে দেয়নি।

হ্যারি জানাল দীর্ঘ কুড়ি বছর পর যখন তার বাড়িতে ফিরতে মন করছে ঠিক তখনই সে বাবার চিঠি পেল আর বাড়ি ফিরে এল স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য। তার বাবাও খুবই খুশী হয়েছিল। কিন্তু তার ভাই অ্যালফ্রেড এতে রেগে যায়। তবে তার স্ত্রীর কথা সে জানে না। সে খুব ভালো মেয়ে। আর অ্যালফ্রেড খুব কর্তব্যপরায়ণ।

খুনী কে হতে পারে বলতে গিয়ে হ্যারি বলল যে, সে ঐ বুড়ো শয়তানকে কখনই সহ্য করতে পারে না আর যেহেতু তার বাবা তাই খুনের বদলা নিতে সে চায়, তার ধারণা বাড়ির কেউ খুনী। তবে চাকর-বাকরদের কেউ না। তারা খুব বিশ্বাসী। অ্যালফ্রেড বাবাকে খুব ভালোবাসত। জর্জের খুন করার সাহস নেই আর ডেভিড নিজের হাতের আঙুল কেটে গেলেই অজ্ঞান হয়ে যায়।

তবে কী ফারকে সন্দেহ করা যেতে পারে?

হ্যারি আরো জানালো চায়ের পর বাবা তার সাথে উইল বদলের কথা বলছিলেন। আগের উইলে তার আর ভাগ্নী পিলারের নাম ছিল না, তাই যোগ করতে তিনি সকলের সামনেই খ্রস্টমাসের পর উকিলকে দেখা করতে বলে। আর আর্তনাদ হওয়ার আগের মুহূর্তে সে তার ভাই আলফ্রেডের সঙ্গে ডাইনিংরুমে তর্ক করছিল, এই কথা জানিয়ে সে চলে যায়।

এরপর আঁটো পোষাকে শরীরের উঁচু নীচু রেখাগুলো স্পষ্ট করে সামনে এসে দাঁড়ায় ম্যাগজলেন।

ম্যাগজলেন জানালো সে খুনের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে বিকেলে তারা সকলে মিঃ লীর ঘরে যায়। সেখানে হারি আর ডেভিডের এমন ঝগড়া হয় যে, সে যেন তক্ষুনি তার হ্যারিকে খুন করবে। কারণ তার স্ত্রীকে ইতর বলা হয়েছিল। এরপর ম্যাগজলেন সতর্ক হয়ে বলে সে এইভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়নি। এই ঘটনার পর হিলডা ডেভিডকে শান্ত করে।

খুনের সময় সে কোথায় ছিল জানতে চাইলে ম্যাগজলেন বলল, সে একা ফোন করতে এসে ছিল। ঠিক তখনই আর্তনাদ।

সে চলে গেল। পোয়ারো জানাল উপরে মিঃ লীর ঘর ছাড়া এখানে একটা ফোন আছে। এখানে মিঃ এবং মিসেস জর্জ লী একসাথে দুজায়গায় ফোন করল তাও একা…এটা একটু অবাস্তব। আরো একটা ব্যাপার সাইমন লী যে সময় সকলকে তার ঘরে ডাকলেন ঠিক সেই সময়ই তিনি উকিলকে ফোন করে মানুষের মনে অর্থলিপ্সা, লোভ জাগিয়ে তুলে একটা আনন্দ অনুভব করতে চেয়েছিলেন।

এরপর ঘরে ঢুকল অস্বাভাবিক শান্ত এক মানুষ। মিঃ ডেভিড লী।

সে জানালো, সে আর তার স্ত্রী ডাইনিংরুমের পাশে মিউজিক রুমে ঘটনাটা ঘটার আগে পর্যন্ত পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। চিৎকার শোনার পর ওপরে যায়।

তার বাবা আলোচনায় কী বলেছিল বলতে গিয়ে সে জানালো তার বাবার মতে তারা সকলে বাজে অকাজের। পৃথিবীর কোনো না কোনো জায়গায় কুপথে জন্মালেও তার ভালো ছেলেরা আছে ইত্যাদি। সব বাজে কথা।

খুনী কে বলতে গিয়ে সে জানালো কাউকে তার সন্দেহ হয় না এবং ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

এরপর শক্তসমর্থ চেহারায় সাধারণ পোষাক পড়ে ঘরে ঢুকল হিলডা।

পোয়ারো তাকে তার শ্বশুরমশাই-এর ঘরে সকলকে ডাকার পর তার শ্বশুরমশাই জর্জ লীকে কি বলেছিলে তাই জানতে চাইলে হিলডা বলল, তার শ্বশুরমশাই জর্জকে যে মাসোহারা পাঠাতো তা থেকে কম দেবেন বলেছিলেন। কারণ আয় কম আর পরিবারের সদস্য বাড়তে চলেছে বলে, মানে হ্যারির কথা তিনি বলেছিলেন। হীরের কথা বলতে হিলডা জানালো এই ব্যাপারে সে কিছু জানে না। তারপর তিনি আরো বলেন উইল বদল করুক আর না করুক, তার শ্বশুরমশাই আসলে সব ছেলেদের থেকে তারপর ফোন করার অর্থ ছেলেদের মনে অর্থলোভ জাগিয়ে তোলা। হিলডার ধারণা ছিল তার শ্বশুরমশাই সব ছেলেদের একত্র করে একটু আনন্দে দিন কাটাতেন কিন্তু তিনি একটা অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছিলেন, সে আরো বলল, তার শাশুড়ির নামে তিনি সকলের কাছে নিন্দা করলেই ডেভিড তার উপর রেগে যায় কারণ ডেভিড মায়ের ভক্ত ছিল।

উইল বদল করার ব্যাপারে হিলডা জানালেন হয়তো পিলারের নাম ঢোকানোর জন্য উইল বদলাতে চয়েছিলেন তিনি। অবশেষে সে জানালো সে তার স্বামীর সাথে মিউজিক রুমে ছিলেন এই বলে সে ঘর থেকে চলে গেল।

জীবজন্তু ফাঁদে পড়ার ভয় নিয়ে ঘরে ঢুকলো পিলার।

তারপর পিলার শুরু করল। সে তার মার কাছ থেকে শুনে এসেছিল তার দাদামশাই বৃদ্ধ শয়তান! এখানে এসে তার মনে হয়েছিল তিনি যৌবনে সুপুরুষ ছিলেন। হীরেগুলো সে দেখেছে এবং ভেবেছে যদি সে রোজ তার কাছে এসে বলে তাহলে তাকে দাদামশাই হীরে দিতে বাধ্য।

হীরে চুরি যাবার কথা শুনে সে বলল, বেড়ালের মতো স্বভাব হারবারির সব বেড়াল চুরি করে আর হয়তো এটা তারই কাজ।

এরপর সে দাদামশাইয়ের ঘরে আলোচনার কথা বলতে গিয়ে বলল তার দাদামশাইয়ের কোনো বংশধর নেই বলেই তিনি রেগে গিয়েছিলেন আরো। তারপরই সকলে ঘর থেকে চলে যায় শুধু হিলডা বাদে। অবশেষে জানায় অপরাধ ঘটনার সময় সে তার ঘরে যায় প্রসাধন সারার জন্য আর তখনই…

এরপর ঘরে ঢুকল স্টিফেন ফার। তার বাবা আর সাইমন ছিল বিজনেস পার্টনার।

তাকে প্রথমে হীরে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সে বলে সে ঐ ব্যাপারে জানে না। সাইমন লীর চরিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে সে বলে যে লী ছিলেন চরিত্রবান মানুষ এবং যৌবনে অনেক স্ত্রীঘটিত মামলাতে তিনি জড়িত ছিলেন। এবং একজনকে তিনি খুঁজছিলেন প্রতিশোধ নেবার জন্য। তবে সেটা আমার বাবা নয়। তার সঙ্গে আমার বাবার কখনই কোনা বিরোধ হয়নি। শেষে সে জানালো তার এই অঘটন ঘটার সময় সে এবং পিলার বলরুমে নাচ করছিল।

ফার চলে যেতে জনসন বলল হয়তো এ-ই হীরে চুরি করেছে। এর হাতের ছাপ নেবার ব্যবস্থা করো।

সাগডেন জানালো আগেই নেওয়া হয়ে গেছে।

এরপর জনসন বলল, ফোন কল কোন সময় এসেছিল তা জানার চেষ্টা করুন, হারবারি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কখন ঢুকেছে, কে তাকে দেখেছে খোঁজ নিন, প্রবেশ পথগুলো খুঁটিয়ে দেখুন। উকিলের সাথে কথা বলে বিষয়বস্তু কী জেনে নিন। বাড়ি ভালো করে সার্চ করুন কোথাও রক্তমাখা জামা বা হীরে পান কী না দেখুন।

পোয়ারো বলল বাড়ির সকলকে বারবার ধরে প্রশ্ন করলে আসল সত্যটা জানা যেতে পারে। এদের মধ্যে বেশীরভাগই মিথ্যা বলছে।

কর্নেল এক এক করে সকলের কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলল–অ্যালফ্রেড এবং তার স্ত্রী রমণীয়। জর্জ লী এম. পি. আর তার স্ত্রী আধুনিকা। ডেভিড ভীতু প্রকৃতির আর তার স্ত্রী সমঝদার। পিলার দাদুর গলায় ছুরি বসাতে পারে না। তাহলে স্টিফেন ফারের সম্ভাবনা থাকতে পারে।

পোয়ারো জানাল-স্টিফেন একমুহূর্তে বৃদ্ধকে খুন করতে পারে তার জন্য ধস্তাধস্তির দরকার হয় না। এটা কোনো দুর্বল লোক বা স্ত্রীলোকের কাজ।

এরপর বৃদ্ধ ট্রেসিলিয়ান ঘরে ঢুকতে তাকে হারবারি সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে জানালো পুলিশ আসার পর যা ঘটেছে। কাপ ভাঙার কথাও বলল সে এবং তার পরই হারবারি সিনেমা যায় তবে বাড়ির পেছনে যেখান দিয়ে চাকরেরা বের হয় সেখান দিয়ে নয় রান্নাঘর দিয়ে সে বেরিয়েছে সেখানকার পরিচারিকা তাকে দেখেছে। আরো জানালো পিছনে দরজার চাবি হারবারির কাছেই থাকে আর দরজাতে ছিটকানি দেওয়া থাকে না। তারপর সে চলে যায়।

হারবারি সবেমাত্র বাড়িতে প্রবেশ করে। তার ডাক পড়ল তখনই।

হারবারি জানালো সে সন্ধ্যে সাতটায় মিঃ সাইমনকে নৈশভোজ সারিয়ে সুপার হলে লাভ ইন ওল্ড সোভল সিনেমা দেখতে যায়। যেখানে তাকে কমিশনার দেখেন আর তারপর তার প্রেমিকা ডেরিসের সঙ্গে সে দেখা করে এসেছে। সে জানায় যে হীরের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। কিন্তু তারপরই হঠাৎ সে বলে বসে হীরে চুরি নিয়ে অ্যালফ্রেডকে কখনই মিঃ লী সন্দেহ করতে পারে না। তার সঙ্গে হ্যারির থাকা নিয়ে মিঃ লীর ঝগড়া হচ্ছিল।

পোয়ারো তাকে বলে–হীরের কথা তুমি তো আমরা বলার আগে জানতে না-তাহলে এখন কী করে হীরের কথা বলছ?

হারবারি জানালো মিঃলী ফোনে কাকে যেন হীরের কথা বলছিল তখনই সে শুনেছে। বলে সে চলে যায়।

পোয়ারো বলল–হয়তো সেই চোর আর খুনী। আবার বলল–হয়তো সে শুধুই চোর, আবার বলল, হয়তো আটটার সময় পুলিশ আসার কথা শুনে সে ভয়ে চলে গেছে পাছে তাকে সন্দেহ করা হয় তাই।

আলমারী খুঁজে হীরে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল খালি একটা ব্যাগ আর পনেরো বছর আগের একটা উইল, যাতে লেখা ছিল অর্ধেক সম্পত্তি অ্যালফ্রেডের বাকী অর্ধেক জর্জ, ডেভিড আর জেনিফার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে।