১২৪তম অধ্যায়
সমীপগত কর্ণের প্রতি ভীষ্ম-উপদেশ
সঞ্জয় কহিলেন, “পিতামহ ভীষ্ম তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলে পার্থিবগণ পুনরায় স্ব স্ব শিবিরে গমন করিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণ ভীষ্মের মৃত্যুতে কিঞ্চিৎ ভীত হইয়া শীঘ্র তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক দেখিলেন, মুদিতলোচন ভীষ্ম জন্মশয্যাগত [ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরবর্ত্তীকালের উপযুক্ত শয্যাপ্ৰাপ্ত] শরজন্মার [কার্ত্তিকেয়ের] ন্যায় শরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। মহাদুৰ্গতি কৰ্ণ তৎক্ষণাৎ তাহার পদতলে নিপতিত হইয়া অশ্রুপূৰ্ণকণ্ঠে কহিলেন, “হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে প্রতিদিন আপনার নয়নপথের অতিথি হইত, আপনি সর্ব্বদাই যাহার উপর দ্বেষ প্ৰকাশ করিতেন, আমি সেই রাধেয়।”
“ভীষ্ম এই বাক্য-শ্রবণে বলপূর্ব্বক নেত্রদ্বয় উন্মীলিত করিয়া শনৈঃ শনৈঃ দৃষ্টিপাত করিলেন; তথায় আর কোন ব্যক্তি নাই দেখিয়া রক্ষীগণকে অপসারিত করিলেন এবং পিতা যেমন পুত্রকে আলিঙ্গন করেন, সেইরূপ একহস্তে কর্ণকে আলিঙ্গন করিয়া সমেহবচনে কহিলেন, “হে কৰ্ণ৷ তুমি আমার বিরোধী হইয়া সর্ব্বদা আমার সহিত স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাক, কিন্তু এ সময় যদি আমার নিকট আগমন না করিতে, তাহা হইলে তোমার মঙ্গললাভ হইত না। আমি নারদ ও ব্যাসের মুখে শ্রবণ করিয়াছি, তুমি কুন্তীর নন্দন; রাধেয় নও; অধিরথ তোমার পিতা নহেন; ইহা যথার্থ কথা, ইহাতে সংশয় নাই। আমি সত্য কহিতেছি, কদাপি তোমার প্রতি দ্বেষ করি নাই; তুমি অকারণে পাণ্ডবগণের নিন্দা করিতে বলিয়া, আমি তোমার তেজোবধের [তেজোনাশের] নিমিত্ত তোমাকে পরুষবাক্য কহিতাম। নীচ আশ্রয়, মাৎসৰ্য্য ও ধর্ম্মলোপে তোমার প্রবৃত্তিবশতঃ তোমার এই গুণিজন-দ্বেষিণী [গুণিজনে দ্বেষকারিণী] বুদ্ধি উপস্থিত হইয়াছে; সেই নিমিত্ত আমি কুরুসভায় বারংবার তোমাকে রুক্ষবাক্য শ্রবণ করাইয়াছিলাম। আমি তোমার দুর্বিষহ বীরত্ব, ব্রহ্মনিষ্ঠ ও দানশৌণ্ডতা [দানশক্তিতে অনন্যসাধারণতা] অবগত আছি। এই ভূতলে তোমার সমকক্ষ একজনও নাই; কেবল কুলভেদভয়ে আমি তোমাকে পরুষবাক্য কহিতাম। তুমি শর, অস্ত্ৰ, অস্ত্রসন্ধান, অস্ত্ৰবল ও লঘুতায় অর্জ্জুন ও মহাত্মা বাসুদেবের সমান; তুমি একাকী কুরুরাজের নিমিত্ত কন্যা আনয়ন করিতে কাশিপুরে গমন করিয়া সমুদয় রাজাকে বিমর্দ্দিত করিয়াছিলে। অতুলনীয় বলশালী, সমরশ্লাঘী, দুরাসাদ, ব্রহ্মনিষ্ঠ, বল ও তেজে দেবতুল্য, যুদ্ধে সকল মনুষ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জরাসন্ধও তোমার সদৃশ নহে। আমি পূর্ব্বে তোমার প্রতি যে ক্ৰোধ করিয়াছিলাম, আজি তাহা অপনীত হইল। হে আদিত্যনন্দন! পুরুষকারদ্বারা দৈবকে অতিক্রম করা কাহারও সাধ্য নহে। এক্ষণে যদি আমার প্ৰিয়াচরণ অভিলাষ কর, তাহা হইলে স্বীয় সহোদর পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হও; আমার অবসানে যেন বৈরভাব না থাকে; ভূপিতগণও আজি নিরাময় হউন।”
কর্ণের কর্ত্তব্যতাজ্ঞাপনে ভীষ্মসম্মান রক্ষা
“কৰ্ণ কহিলেন, “হে মহাবাহো! আপনি যাহা কহিতেছেন, তাহাতে কিছুমাত্ৰ সংশয় নাই; আমি যথার্থই কৌন্তেয়; সূতপুত্ৰ নাহি। কিন্তু কুন্তী আমাকে পরিত্যাগ করিলে সূতের হস্তে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছি; পরে দুৰ্য্যোধনের ঐশ্বৰ্য্য ভোগ করিয়াছি; ইহা কদাপি মিথ্যা কহিতে পারিব না। যেমন দৃঢ়ব্ৰত বাসুদেব পাণ্ডবগণের নিমিত্ত ধন, শরীর, পুত্র, দারা ও যশ পরিত্যাগ করিয়াছেন, আমিও সেইরূপ দুৰ্য্যোধনের নিমিত্ত পুত্র, দারাপ্রভৃতি সমুদয় উৎসর্গ করিয়াছি। ক্ষত্ৰিয়গণের ব্যাধিমরণ বাঞ্ছনীয় নহে। পাণ্ডবগণ দুৰ্য্যোধনের প্রতি নিতান্ত কুপিত হইয়াছেন, অতএব এই অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার কোন ক্রমেই নিবারণ করা যায় না, কোন ব্যক্তি দৈবকে পুরুষকারদ্বারা নিবারণ করিতে পারে? আপনিও পৃথিবীক্ষয়সূচক নিমিত্তসকল উপলব্ধি করিয়া সভামধ্যে ইহা কহিয়াছিলেন। আমিও অবগত আছি যে, কোন ব্যক্তিই পাণ্ডবগণ ও বাসুদেবকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহে; তথাপি আমি তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে উৎসাহিত ও জয়লাভ করিব বলিয়া কৃতনিশ্চয় হইয়াছি। এই নিদারুণ বৈরভাব কিছুতেই নিরাকৃত হইবে না; অতএব আমি স্বধর্ম্মপ্রীত হইয়া ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়াছি; আপনি অনুজ্ঞা করুন, ক্ষত্রিধর্ম্ম সমুচিত আপনার অনুজ্ঞাত হইয়া যুদ্ধ করিব। আমি ক্রোধাবেগে ও বীরতা অবলম্বন করিয়া চপলতানিবন্ধন আপনাকে যাহা কিছু মন্দ ও বিরুদ্ধ বাক্য কহিয়াছি, এক্ষণে আপনি তাহা ক্ষমা করুন।”
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে কৰ্ণ! যদি এই সুদারুণ বৈরভাব পরিত্যাগ করিতে না পার, আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, স্বৰ্গকাম হইয়া যুদ্ধ কর; দীনতা ও ক্ৰোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক সদাচার হইয়া উৎসাহ ও শক্তি অনুসারে রাজা দুৰ্য্যোধনের কর্ম্ম সম্পাদন কর। আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, যাহা ইচ্ছা করিয়াছ, তাহা লাভ হউক, ক্ষাত্রধর্ম্ম সমুচিত লোকসকল লাভ কর। নিরহঙ্কার হইয়া বল ও বীরতা অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ কর, ধর্ম্মযুদ্ধ ব্যতীয় ক্ষত্রিয়গণের পক্ষে আর শুভকর্ম্ম কিছুই নাই। কিন্তু আমি সত্য কহিতেছি যে সন্ধি করিবার নিমিত্ত অনেক দিন সাতিশয় যত্ন করিয়াছিলাম কিন্তু কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলাম না।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ভীষ্ম এইরূপ কহিলে পর রাধেয় তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক প্রসন্ন করিয়া দুৰ্য্যোধনের নিকট গমন করিলেন।”
ভীষ্মবধপর্ব্বাধায় সমাপ্ত