২. পিটার লর্ড

২.১.১

পিটার লর্ড এরকুল পোয়ারোকে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন।

আপনার কেসটা কি? শান্ত গলায় জানতে চাইলেন পোয়ারো।

একজন কম বয়েসী মহিলা আছেন। তাকে খুন করার চার্জে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি চাই আপনি সাক্ষ্য প্রমাণ খুঁজে বের করুন, যাতে মহিলা নির্দোষ প্রমাণিত হন।

তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের কথা তুলতেই ড. লর্ড বললেন, আমি মহিলাকে একতরফাভাবে ভালোবেসেছি বলতে পারেন, আমি চাই না ওঁর ফাঁসি হোক।

মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?

মেরী জেরার্ড নামে একটি মেয়েকে মরফিন হাউড্রোক্লোরাইড বিষ দিয়ে খুন করার অপরাধ উদ্দেশ্যটা কি?

ঈর্ষা, সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ড. লর্ড।

পোয়ারো বললেন, সত্য ঘটনা খুঁজে বের করতে গিয়ে যদি ঘটনাটি মহিলার বিপক্ষে যায়। তবুও কি আপনি চাইবেন…

ড. লর্ডের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললেন, ওর বিরুদ্ধে এ যাবত যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে সেটাই ওকে বুঝিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তবে ওকে বাঁচাবার মতো কিছু করতে পারেন তাই দেখুন।

ড. লর্ড জানালেন মহিলার উকিল ধরে নিয়েছেন মহিলা অপরাধী। আর সেইজন্যই বোধহয় কিংস কাউন্সেল বামারকে লাগিয়েছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না।

পোয়ারো সব ব্যাপারটা আগাগোড়া জানতে চাইলেন। ড. লর্ড সংক্ষেপে পোয়ারোকে ঘটনাটা জানালেন। এলিনর কার্লির্সল তার মাসির বাড়ি হান্টারবেরী হলের মালিক হয়েছে সম্প্রতি বাড়িটা সে বিক্রি করে দেয় সামারভিল নামের এম.পিকে। মাসির ব্যক্তিগত সম্পত্তি সরিয়ে নিতে সে এসেছে ২৭শে জুলাই সকালে। মেরী জেরার্ড এসেছে আউট হাউস থেকে তার সদ্যমৃত বাবার জিনিসপত্র সরাতে সেই একই দিনে। এলিনর কার্লিসল একটা স্থানীয় হোটেলে উঠেছিল। মুদির দোকানে মাছের পেস্ট কেনার সমর দোকানদারের সঙ্গে ফুড পয়জনিং নিয়ে তার কথা হয়। তারপর ঐ বাড়িতেই দুপুর একটার সময় এলিনর মেরী আর নার্স হপকিন্সকে স্যাণ্ডউইচ খেতে ডাকেন এবং ঘণ্টাখানেক পরে যখন আমায় ডেকে পাঠানো হয় তখন মেরী জেরার্ড অজ্ঞান। পোস্ট মর্টেমে দেখা যায় মারা যাবার বেশ কিছুক্ষণ আগে মেরী যথেষ্ট পরিমাণে মরফিন খেয়েছিল। আর পুলিশ। আর পুলিশ মরফিয়া হাইড্রোক্লোরার লেবেলের ছেঁড়া টুকরো পায় যেখানে এলিনর স্যাণ্ডউইচ তৈরি করছিল, সেখানে।

মেরী জেরার্ড আর কি খেয়েছিল?

চা। চা তৈরী করছিল ঐ নার্স। তবে মেরী নিজের হাতে চা ঢেলেছিল, সরকারী কৌসুলী অবশ্য বলতে পারেন–স্যাণ্ডউইচ তত তিনজনেই খেয়েছিল। অতএব শুধু একজনেরই পয়জনিং হলো কেন?

পোয়ারো বোঝাল, ধরুন স্যাণ্ডউইচগুলো থাক করে সাজানো হলো। তার মধ্যে একটাতেই বিষ মাখানো। প্লেট বাড়িয়ে দিলে হাতের সবচেয়ে কাছের খাবারটাই তুলে নিই আমরা, এলিনর কার্লিসল হয়তো মেরীর দিকেই প্রথম প্লেট এগিয়ে দিয়েছিল।

ড. লর্ড জানাল ঘটনাটা তাই হয়েছিল। পোয়ারো বলল, এমন কথা কি বলা যেতে পারে যে এলিনর কার্লিসল আশা করেছিল লোকে ধরে নেবে ফুড পয়জনিং-এর জন্যই মেয়েটি মারা গেছে?

ড. লর্ড বলল, মাছের দুটো পেস্ট ছিল। এমনও হতে পারে, একটা কৌটো ঠিক ছিল, মেরী যেটা খেয়েছে সেটাই বিষাক্ত ছিল।

পোয়ায়ো বললেন, মরফিনের লক্ষণগুলো ফুড পয়জনিংয়ের লক্ষণের সঙ্গে মেলে না অ্যাট্রোপিনের মেলে। ফুড পয়জনিং-এর উদ্দেশ্য থাকলে ঐ বিষ কেন ব্যবহার করবে?

পিটার লর্ড বললেন, জেলানার্সের ব্যাগ থেকে মরফিরেন একটা টিউব হারিয়ে গিয়েছিল, যে রাতে মিসেস ওয়েলম্যান মারা যান। তা প্রায় সপ্তাহখানেক আগে।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু কিছু কথা আপনি চেপে যাচ্ছেন?

ড. লর্ড লজ্জা পেয়ে বলল, আমার মনে হয়েছিল মিসেস ওয়েলম্যান আত্মহত্যা করেছেন। কারণ উনি প্রায়ই মরার কথা বলতেন, এমনকি আমাকেও বলেছিলেন তাকে যত তাড়াতাড়ি পারি যেন মেরে ফেলি। উনি যাওয়ার পর নার্সকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে আমি ভালোভাবে ওঁকে পরীক্ষা করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, উনি আত্মহত্যা করেছেন।

পোয়ারো জানতে চাইলেন মিসেল ওয়েলম্যান কিভাবে মরফিন পেতে পারেন। লর্ড জানালনে, মিসেস ওয়েলম্যানের সঙ্গে নানা লোকের খাতির ছিল।

পিটার লর্ড পোয়ারোকে বললেন, মিসেস ওয়েলম্যান উইল করার জন্য বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন এবং কথা হয়েছিল পরদিন সকালে এলিনর কার্লিসল সবার আগে ফোন করবে উকিলকে। লর্ড আরো জানলেন যে এলিনর জানতই না যে ওঁর মাসি কোন উইল করেননি।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন অ্যাটাচিকেস থেকে মরফিন সরানো কার্লিসলের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা। উত্তরে লর্ড জানাল যে কোন লোকের পক্ষেই কাজটা সম্ভব ছিল-রডারিক ওয়েলম্যান, মার্স ও’ব্রায়ান, যে কোন চাকর।

মঁসিয়ে পোয়ারো ড. লর্ডকেও সন্দেহের বাইরে রাখলেন না।

 পিটার লর্ড বললেন, পোয়ারো তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।

এরকুল পোয়ারো বললেন, সরকার যদি মিসেস ওয়েলম্যানের পেটে মরফিন পায়?

গম্ভীর গলায় ড. লর্ড বললেন, তাহলে এলিনর যদি এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পায় তবে আবার তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এবং মাসিকে খুন করার চার্জে তার বিচার হবে।

পোয়ারো বললেন, মিসেস ওয়েলম্যানকে খুন করা হয়েছে লাভের জন্য। মেরী জেরার্ডকে ঈর্ষার জন্য। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাহলে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোন্ লাইন আপনারা নেবেন?

ড. লর্ড বললেন, তাঁদের বক্তব্য হবে এই খুনের পিছনে কোনো উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই। বুড়িকে খুশী করার জন্য এলিনর ও রডারিকের সম্পর্কটা ওরা দেখাতো, রডারিক এ ব্যাপারে সাক্ষী দেবে কারণ সে একথাটা বিশ্বাস করে।

পোয়ারো বললেন, যদি এলিনর রডারিককে ততটা নাই ভালোবাসতো তাহলে মেরী জেরার্ডকে খুন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কে খুন করতে পারে মেরীকে?

মেরী নিজেই আত্মহত্যা করেছে পোয়ারোর এই কথাগুলো ড. লর্ডের ভালো লাগল না। পোয়ারা জিজ্ঞেস করলেন রডারিক মেরীকে ভালোবাসত কি না? বা ড. লর্ডের মেরীর প্রতি কোন দুর্বলতা ছিল কিনা। ড. লর্ড জানালেন মেরীর প্রতি তার কোন দুর্বলতা কোনকালেই ছিল না।

এলিনর আর রডারিকের মধ্যে সম্পর্কটা কি ধরনের ছিল তার উত্তরে পিটার বিরক্তির সুরে বললেন, ভালোবাসাতো তবে রাহুর ভালোবাসা।

তাহলে কিন্তু একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ড. লর্ড রেগে বললেন, ধরুন করেছে? আমি পরোয়া করি না।

পোয়ারো বললেন, প্রেম মানুষকে মরিয়া করে তোলে। হয়তো এলিনর বাধ্য হয়ে খুনটা করেছে। কিন্তু খুন করাটাকে আমি সমর্থন করি না।

এরপর এরকুল পোয়ারো ড. লর্ডের কথা মতোই কাজ করতে রাজী হলেন।

.

২.২.১

বেশ নার্ভাস হয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে ড. লর্ড বললেন, আরে আপনি তো আমাকে দারুণ ল্যাজে খেলাচ্ছেন। যাই হোক…।

পোয়ারো বললেন, এলিনর কার্লিসলের বিরুদ্ধে মামলা কিভাবে দাঁড় করানো যেতে পারে তাই দেখছিলাম। মেরী জেরার্ডকে স্যাণ্ডউইচের সঙ্গে মরফিন দেওয়া হয়েছে। এলিনর ছাড়া আর কেউ স্যাণ্ডউইচে হাত দেয়নি আর মেরীকে খুন করার একটা উদ্দেশ্যও আছে এলিনরের। আবার অন্য কেউও মেরীকে খুন করতে পারে বা মেরী আত্মহত্যা করতে পারে। এলিনর ছাড়া মেরীর মৃত্যুতে কে লাভবান হতে পারে? ওর কি কোনো টাকা পয়সা ছিল?

ড. লর্ড জানালেন এখন নেই। তবে আগামী মাসের মধ্যে ওর দু-হাজার পাউণ্ড পাবার কথা ছিল।

মাসিয়ে পোয়ারো নিশ্চিত হলেন যে টাকার জন্য কেউ মেরীকে হত্যা করতে পারে না। প্রশ্ন করলেন ওর অনুরাগীদের বিষয়।

ড. লর্ড তার সঠিক জবাব দিতে পারলেন না। তবে নার্স হপকিন্স এ ব্যাপারে জানতে পারেন বলে জানালেন।

এরপর এরকুল পোয়ারো নার্স দুজন সম্বন্ধে জেনে নিলেন ড. লর্ডের কাছ থেকে।

এরপর মেরী জার্মানীতে কারুর সাথে গণ্ডগোল পাকিয়ে আসতে পারে বলে জানালেন পোয়ারো। তবে সে মেরীকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে এবং পেয়ে সে মেরীকে হত্যা করেছে–এটা খুব সম্ভব নয় বলেই বললেন পোয়ারো।

পোয়ারো আর একটি সম্ভাবনার কথা বললেন, ধরা যাক জুন মাসের ঐ রাতে কাউকে মরফিনের শিশি বের করতে দেখেছিস মেরী, তাই তাকে সরিয়ে ফেলা হল।

তাহলে তো সে কথা মেরী বলত?

মঁসিয়ে পোয়োরো বললেন, যে মিসেস ওয়েলম্যানকে খুন করছে সে মেরীকে দেখে ফেলে তাকে সরিয়ে ফেলেছে কিন্তু মেরী ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্বই দেয়নি। ভেবেছে নার্স হপকিন্সের কথায় কেউ মরফিনের শিশিটা নিতে এসেছে। তাই মেরী কথাটা কাউকে কিছু বলেনি।

লর্ড বললেন, তাঁর ধারণা মিসেস ওয়েলম্যান কোনক্রমে ওটা সংগ্রহ করে উনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। হতে পারে হপকিন্সের কাছে থেকে ওটা আগেই গিয়েছিল, উনি সেদিনমাত্র জেনেছিলেন।

কিন্তু পোয়ারো যেন কথাটা মানতে চাইলেন না।

ড. লর্ড বললেন, নার্সেরা কেউ ঘুষ খাবে না সুতরাং তাদের দিয়ে কাজটা হয়নি।

পোয়ারো বললেন, হয় বিরাট সম্পত্তি একা পাবার জন্য, কিম্বা মাসির দুঃখ লাঘব করার জন্য করুণাবশতঃ মাসির কথায় এলিনর কার্লিসল মরফিন চুরি করেছিল এবং মেরী সেটা দেখে ফেলে। আর তারপরই এলিনর কার্লিসল নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মেরীকে সরিয়ে ফেলে। নানাভাবে ড. লর্ড এলিনরকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। এলিনর যে একাজ করতে পারে না, তার যে টাকা পয়সার প্রতি লোভ নেই সেকথা মঁসিয়েকে বারবার বিশ্বাস করাতে চাইলেন।

এলিনর এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা জেনে পোয়ারো এলিনরের মৃত্যুতে কে সম্পত্তি পাবে জানতে চাইলেন এবং এলিনর কোন উইল করেছে কিনা তাও জানতে চাইলেন।

ড. লর্ড সংক্ষেপে বললেন, জানি না।

মঁসিয়ে পোয়ারো একটু চাপ দিতেই সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বে ড. লর্ড বললেন, মেরীকে উইল করতে দেখে সজোরে হেসে উঠেছিল।

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পোয়ারো বললেন, তার মানে এলিনর জানতো মেরী আর বেশিদিন বাঁচবে না।

.

২.৩.১

ড. লর্ড নার্স হপকিন্সের কটেজে মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

নার্স হপকিন্স পোয়ারোকে স্থির বিশ্বাসে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে এলিনরই মেরী জেরার্ডকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে। হপকিন্স বললেন, ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আমাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে অকারণে কথায় কথায় আটকে রাখল, এদিকে মেরীর ঐ অবস্থা দেখে যখন ওর মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম এটা যে ঘটবে সেটা ও জানতো। অন্ততঃ ওর মুখ দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

পোয়ারো বললেন, মেরী আত্মহত্যাও করতে পারে? নার্স হপকিন্স সে সম্ভবনা একেবারেই উড়িয়ে দিলেন।

পোয়ারো বললেন, মেরী আপনাদের নজর এড়িয়ে নিজের পাত্রে কিছু মিশিয়ে নিতে পারে। নার্স হপকিন্স বললেন, তা হলেও হতে পারে কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন না যে মেরী আত্মহত্যা করেত পারে।

এরপর পোয়ারো জানতে চাইলেন মেরীকে গ্রামের কেউ পছন্দ করত কিনা? নার্স হপকিন্স জানালেন টেড বিগল্যাণ্ড বলে একটি ছেলে মেরীকে ভালোবাসত। কিন্তু টেডকে তিনি বলেছিলেন যে, সে মেরীর উপযুক্ত নয়।

তাহলে বলা যায় মেরী ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল, তাই ক্ষেপে ছিল ও মেরীর ওপর।

নার্স হপকিন্স জানালেন টেড তার জন্য নার্সকেই অনেক কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু মেরীর মতো সহজ সরল একটা মেয়েকে উনি বাজে পথে চলতে দিতে চাননি।

পোয়ারোকে নার্স হপকিন্স জানালেন মেরী বুড়ো জেরার্ডের মেয়ে নয়। মেরীর মা ছিলেন মিসেস ওয়েলম্যানের খাস ঝি। মেরী হবার পর ওর সঙ্গে জেরার্ডের বিয়ে হয়।

এবার পোয়ারো নার্স হপকিন্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ রডারিক-এর সঙ্গে মেরীর কি ধরনের সম্পর্ক ছিল।

নার্স হপকিন্স বললেন, মিঃ রডারিক মেরীকে পছন্দ করত কিন্তু মেরী তাকে পছন্দ করত না।

এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে এই পছন্দ থেকে ভবিষ্যতে আরও অন্য কিছু জন্মাতে পারতো?

নার্স হপকিন্স জানালেন, মেরী রডারিককে বলেছিল যে, মিস এলিনরের সঙ্গে এনগেজমেন্ট যখন আছে তখন অমন কথা বলা উচিত নয়।

এবার পোয়ারো মিঃ রডরিকের সম্পর্কে হপকিন্সকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। রডারিক ওয়েলম্যান সম্পর্ক তার ধারণা, রডারিক তার কাকীকে কতটা ভালোবাসত ইত্যাদি ইত্যাদি।

নার্স হপকিন্স জানালেন, মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার আগের রাতে ওরা লণ্ডন থেকে এসেছিলেন এবং তাঁর বিশ্বাস রডারিক ওয়েলম্যান সে ঘরে ঢোকেননি।

পোয়ারো যাচাই করে নিতে চাইলেন যে, সত্যিই রডারিক মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে ঢুকেছিল কিনা?

অন্ততঃ আমি যতক্ষণ ডিউটিতে ছিলাম, ততক্ষণ যাননি। ভোর তিনটের সময় আমার জায়গায় এসেছিলেন নার্স ও’ব্রায়ান, উনি ওকে ডেকে আনতে পারেন, তবে সে কথা আমাকে বলা হয়নি।

আপনার অনুপস্থিতেও তো যেতে পারেন ঘরে? ধরুন জল গরম করতে বা কোন বিশেষ ওষুধ আনতে আপনি নীচে গিয়ে থাকতে পারেন?

নার্স হপকিন্স জানালেন বোতলে গরম জল ভরতে তিনি গিয়েছিলেন এবং মিনিট পাঁচেক পরেই তিনি ফিরে আসেন।

তবে ঠিক ঐ সময়রে মধ্যে মিঃ ওয়েলম্যান ভিতরে এসে কাকীকে দেখে থাকতে পারেন? যদি করে থাকেন বলতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করেছেন।

.

২.৪.১

মিসেস বিশপ একটু রক্ষণশীল স্বভাবের। বিদেশী পোয়াবোর প্রতিটি কথাতেই উনি একটু সন্দিগ্ধ হয়ে উত্তর দিচ্ছিলেন। মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। মিস কার্লিসলের গ্রেপ্তারের ব্যাপারটাকে অপমানজনক, নতুন পুলিশী ব্যবস্থায় পরিণতি প্রভৃতি আখ্যা দিলেন। মেরীর মৃত্যুর ব্যাপারে অস্পষ্ট কিছু উত্তর দিলেন।

পোয়ারো তাঁর শেষ তুরুপের তাসটা কাজে লাগালেন। স্ট্যাণ্ডিংহামের রাজপরিবারে তার যাতায়াত আছে যেন দুজনে বেশ ঘরোয়া হয়ে উঠলেন। নানা কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করে বসলেন, বিয়ের ব্যাপারে নানা ঝঞ্ঝাট…।

পোয়ারো সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ রডারিক আর এলিনয়ের বিয়ের এনগেজমেন্টটা ঐ বৃদ্ধাকে খুশী করার জন্য করা হয়েছিল কিনা?

মিসেস বিশপ জানালেন, মিস এলিনর আর মিঃ রডারিক দজনেই দুজনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাদের এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে যাবার কারণ মেরী। মিসেস ওয়েলম্যানের অসুস্থতার সুযোগে মেরী তাকে কজা করে ফেলে, যখন তখন ফুল পাঠিয়ে, বই পড়ে শুনিয়ে। এরপর মেরী কিভাবে মিঃ রডারিককে ফাঁদে ফেলেছিল সেকথাও বললেন মিসেস বিশপ। এছাড়া টেড বিগল্যাণ্ড মেরীকে পছন্দ করত একথাও জানালেন মিসেস বিশপ। মেরী মিসেস ওয়েলম্যানের সম্পত্তি গ্রাস করার চেষ্টকরছিল বলে জানালেন তিনি। এবং মিস এলিনরকে ভদ্র মেয়ে বলেই চিহ্নিত করলেন।

নানা কথার পর পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, খুবই দুঃখের বিষয়, মারা যাবার আগে মিঃ রডারিক ওঁর কাকীমার সঙ্গে দেখা করলেন না।

মিসেস বিশপ জানালেন, তিনি মিঃ রডারিককে তার কাকীমার ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন।

এরপর পোয়ারো মেরী জেরার্ডের মৃত্যু সম্বন্ধে মিসেস বিশপের ধারাণা জানতে চাইলেন। তিনি জানালেন টিনের মাছ খেয়েই মেরীর মৃত্যু হয়। মরফিনের ব্যাপারে তিনি তেমন কিছু বলতে পারলেন না। মেরী আত্মহত্যা করে থাকতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করাতে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন মিসেস বিশপ।

.

২.৫.১

পোয়ারো টেড বিগল্যাণ্ডকে পেল তার বাবার খামারে। টেড জানাল এলিনর কার্লিসলের মতো ভদ্র, নরম মনের মেয়ে মেরীকে খুন করতে পারে না। মেরীর মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে টেড তাকে কোনোরকম সাহায্যই করতে পারল না।

মেরী সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন লোকের ভিন্ন ভিন্ন মত হঠাৎ পোয়ারের মনে পড়ে গেল। ড. লর্ড বলেছিলেন, চমৎকার মেয়ে। নার্স হপকিন্সের মন্তব্য। যে কোনদিন ও সিনেমায় নামতে পারতো। মিসেস বিশপের কথায় বড্ড দেমাকী চালচলন আর টেডের কথায় ফুলের মতো নিষ্পাপ।

টেডের বিশ্বাস মেরীর মৃত্যু একটা অ্যাক্সিডেন্ট। যেটা ঘটার নয়, অথচ ঘটে গেছে তাতে অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?

টেড জানাল মেরী বিদেশে যাওয়া ও সেখানে লেখাপড়া করার ফলে একটু পাল্টে গিয়েছিল। ও তার আগের জীবনটা ভুলে গিয়েছিল। টেড তার উপযুক্ত ছিল না। আবার মিঃ ওয়েলম্যানের মতো সত্যিকারের ভদ্রলোকের উপযুক্ত ছিল না মেরী।

মিঃ ওয়েলম্যানকে টেড পুরুষ হিসাবে গণ্যই করে না। এবং কথায় কথায় মিঃ ওয়েলম্যানের ওপর টেডের অসন্তোষ প্রকাশ হয়ে পড়ে।

টেড বিগল্যাণ্ড জানান রডি ওয়েলম্যান মেরীর আশেপাশে বড্ড বেশী ঘুরঘুর করতেন। মেডেনসফোর্ড সবাই মেরীকে ভালোবাসত। মিসেস ওয়েলম্যান মেরী না হলে চোখে অন্ধকার দেখতেন। কিন্তু মিসেস বিশপ মেরীকে পছন্দ করতেন না।

হঠাৎ পোয়ারো বললেন নার্স হপকিন্স এমন কথা কি চেপে যেতে পারেন যেটা মেরীকে সবার চোখে নামিয়ে দিতে পারে?

টেড জানাল মেরীকে তিনি ভালোবাসতেন, এক্ষেত্রে একমাত্র মেরীর কথাই উনি না। রটাতে পারেন।

টেড মাথা নাড়ল, নার্স হপকিন্স তেমন কিছু জানেন না।

.

২.৬.১

হাতের কার্ডের দিকে চোখ নামিয়ে রেখে বেশ ভয়ের সঙ্গেই রডি ওয়েলম্যান জানাল যে, ড. লর্ডের সঙ্গে তাদে কোন সম্পর্ক নেই একমাত্র চিকিৎসক হিসাবে ছাড়া। এসব কাজ তাদের উকিল মিঃ সেলডনেরই করা উচিত।

রডি ওয়েলম্যান জানাল, সেলডনের ওপর তার বিশেষ ভরসা নেই তাই বামারের মতো উকিলকে সে একাজের দায়িত্ব দিয়েছে।

পোয়ারে মিঃ বামারের স্তুতি গাইলেন।

পোয়ারো মিস এলিনরকে বাঁচাবার জন্য রডি ওয়েলম্যানের সাহায্য করলেন এবং পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে রডি কি জানে তা জানতে চাইলেন।

রডি জানান এলিনর ছোটবেলা থেকেই বেশ শান্ত, সংযত বুদ্ধিমতী, কোমল স্বভাবের। এলিনরের পক্ষে কাজটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর নার্স ও কাজ করতেই পারে না বলে রডির ধারণা।

পোয়ারো বললেন, আমি সব খুঁটিয়ে খবর নিয়েছি। স্যাণ্ডউইচের ধারে-কাছে সে আসেনি। তাছাড়া চায়ে বিষ দিলে তাকে নিজেও মরতে হত।

মেরীর মৃত্যুতে রডির একটা দিক ভীষণ ফাঁকা হয়ে গেছে কিনা জানতে চাইলেন মিঃ পোয়ারো।

রডি জানাল ঘটনার সঙ্গে তার প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি যদি ঠিক কথাটি আমায় বলতে পারেন পরিষ্কারভাবে দেখাতে পারেন, তবে ব্যাপারটার অবসান ঘটতে পারে।

রডি জানাল মেরীর প্রতি তার আবেগভরা ভালোবাসা তার নিজেরই মনে হয় পাগলামি। মেরী যখন মারা যায় আপনি তো ইংল্যাণ্ডের বাইরে? রডি জানাল ৯ই জুলাই গিয়ে সে ১লা আগষ্ট ফিরেছিল।

মিঃ ওয়েলম্যান মেরী জেরার্ড সম্বন্ধে আপনি কি এবং কতটুকু জানেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রডি বলল, মেরী ছিল মিষ্টি, শান্ত-ভদ্র, তবে চালাক নয়, স্পর্শকাতর। তার ভদ্রতাবোধ ওদের শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে আশা করা যায় না।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন যারা সহজেই শত্রুতার সৃষ্টি করে সেই ধরনের মেয়ে ছিল কিনা মেরী।

না না, আমি ভাবতেই পারি না কেউ ওকে অপছন্দ করতে পারে। ঈর্ষা অন্য জিনিস। ঈর্ষার ব্যাপার ছিল না কি?

নিশ্চয়ই ছিল…তা না হলে ঐ চিঠিটা আসে কি করে?

পোয়ারো বললেন, কিসের চিঠি?

রডি জানাল, একটা বেনামী চিঠি যেটা সে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেছে।

রডি জানাল কোন অস্বস্তি, দুঃশ্চিন্তা বা আশংকায় তারা হান্টারবেরীতে সেদিন ছুটে আসেনি। এসেছিল অসুস্থ কাকীমাকে দেখতে।

পোয়ারো বললেন, আপনারা যখন হান্টারবেরীতে গেলেন তখন পর্যন্ত আপনার কাকীমা কিন্তু কোন উইল করেননি। তার কিছু পরে আবার তার দ্বিতীয় অ্যাটাক হয়, তখন উইল করার ইচ্ছা হয়েছিল। অথচ মিস কার্লির্সলকে সুযোগ দিয়ে তিনি উইল করার আগের রাতেই মারা যান।

রডির রাগত মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো যা বললেন, তা হল ঐ চিঠি পড়ে এলিনর কার্লিসল আশংকা করে থাকতে পারে যে বাইরের কেউ তাকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। আর মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার আগের রাতে যা বলেছিলেন তা তার আশংকাকে দৃঢ় করে তোলে। এক তলায় হলঘরে একটা অ্যাটাচিকেসে নানা ধরনের ওষুধপত্র ছিল। সুতরাং মরফিনের শিশি জোগাড় করা এলিনরের পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না আবার রোগিণীর ঘরে তিনি একা বসেছিলেন যখন রডি নার্সদের সঙ্গে ডিনার করতে যায়।

রডি চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাল মিঃ পোয়ারোর কথাগুলোর এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানাল কাকীমার মৃতদেহ কবর খুঁড়ে তুললেও কোন সাক্ষ্য পাওয়া যাবে না এলিনরের বিরুদ্ধে।

পোয়ারো বললেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। ঐ অবস্থায় মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশী লাভবান কে হত?

পোয়ারো জানালেই প্রকৃত ঘটনার সম্মুখীন তাঁদের হতেই হবে মিঃ ওয়েলম্যান যতই সত্য এড়াবার চেষ্টা করুন না কেন।

রডি অসহায়ের মতো জানতে চাইল নার্সদের সন্দেহের বাইরে কেন রাখছেন মিঃ পোয়ারো।

পোয়ারো জানালেন, নার্স হপকিন্স যদি অপরাধী হতেন তবে তিনি চেঁচামেচি করে মরফিনের শিশি হারানোর খবর জানিয়ে আর পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন না। নার্স ও’ব্রায়ান সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। কারণ মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে তার কোন স্বার্থ থাকতে পারে না।

রডি তার কথায় সম্মতি জানাতেই পোয়ারো বললেন, আপনিও কাজটা করতে পারেন। সে রাতে অল্পক্ষণের জন্য হলেও আপনি একবার ওঁর ঘরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু উনি বেঁচে থাকলে আপনি সেই সম্পত্তি কিছু পেতেন তাই এক্ষেত্রে আপনারও কোন দূরভিসন্ধি থাকতে পারে না। মাত্র দুজনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

রডির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, দুজন? হ্যাঁ একজন এলিনর, অপরজন ঐ বেনামী চিঠির লেখক।

পোয়ারো বললেন, কেউ না কেউ ঐ চিঠিটা লিখেছিল, যে চাইত না মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে মেরী জেরার্ড লাভবান হোক। কে হতে পারে বলুন তো?

রডি বলল, এলিনর আর তার ধারণা হয়েছিল ওটা কোন চাকর-বাকরের কাজ।

 পোয়ারো প্রশ্ন করলেন আপনারা কি মিসেস বিশপকে সন্দেহ করেছিলেন?

রডি জানাল, উনি অত্যন্ত সম্মানিতা মহিলা, তাছাড়া ওর চিঠি দেখেছি, ভাষার দারুণ বাঁধুনি কিন্তু চিঠিটা ছিল ভুলে ভরা।

পোয়ারো রডিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মিসেস বিশপ মেরী জেরার্ডকে পছন্দ করতেন না মনে হয়।

কিন্তু আমি নিজে কিছু দেখিনি তেমন।

তবে এও তো হতে পারে, আপনি সব জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন না।

রডি ধীরে ধীরে বলল আপনি বলতে চাইছেন যে আমার কাকীমা নিজেই মরফিন খেয়েছেন? সেক্ষেত্রে নার্স দুজনের প্রতি ইঙ্গিত করল রডি।

পোয়ারো বললেন, না, নার্সরা নয়। এতে তাদের বিপদের কথা তারা জানে। নার্সদের সন্দেহ করা যায় না…

তাহলে কে…কে…? রডির প্রশ্ন।

শান্ত গলায় পোয়ারো বললেন, কিছু একটা কথা মনে পড়েছে আপনার, তাই না?

রডি জানাল টেলিগ্রাম পেয়ে ট্রেনে আসার সময় এলিনর বলেছিল, কেউ যদি এই অবস্থা থেকে নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তি চায় তবে তাকে মুক্তি দেওয়া উচিত। রডি জানাল, সে এলিনরের কথায় সায় দিয়েছিল।

একটু আগে, মিঃ ওয়েলম্যান, আপনি সম্পত্তির লোভে এলিনর যে তার মাসিকে খুন করতে পারে তার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে দয়াপরবশ হয়ে মাসিকে মরতে সাহায্য করার দোষেও এলিনরকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রশ্নটা উড়িয়ে দেবেন সরাসরি?

আমি..আমি…না, আমি বলতে পারি না…।

.

২.৭.১

 মঁসিয়ে পোয়ারো মিঃ সেলডনকে জানালেন, ড. লর্ডের অনুরোধে তিনি মিঃ সেলডনের মক্কেলের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করছেন।

মিঃ সেলডন জানালেন যে, ড. লর্ডকে সরকার পক্ষে সাক্ষী হিসাবে সমন দেওয়া হয়েছে। মিস কার্লিসলের মামলার দেখাশোনার ভার তার উপর, তাতে বাইরের কারুর সাহায্যর তাঁদের প্রয়োজন নেই।

পোয়ারো বললেন, তার কারণ কি এই যে, আপনার মক্কেলের কোন অপরাধ নেই তা সহজে প্রমাণ করতে পারবেন?

মিঃ সেলডন চটে গিয়ে বললেন, প্রশ্নটি অত্যন্ত অসঙ্গত।

মিঃ পোয়ারো জানালেন, যদিও ড. লর্ড তাঁকে একাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তবে মিঃ ওয়েলম্যানও তাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠিটা তিনি দেখালেন মিঃ সেলডনকে।

মিঃ ওয়েলম্যানের লেখা কয়েক লাইনের চিঠিটাকে চোখ বুলিয়ে একটু উষ্ম প্রকাশ করলেন মিঃ সেলডন এবং জানালেন কিংস কাউন্সেল স্যার এডউইন বামারকে এ-কেসে নিযুক্ত করেছে।

পোয়ারো জানালেন, বাগ্মীতা বা হৃদয়াবেগের কাছে আবেদন জানালে কিন্তু আপনার মক্কেলকে বাঁচানো যাবে না, তার জন্য আরো কিছু দরকার।

নীরস গলায় মিঃ সেলডন জানতে চাইলেন কি? আপনি কি করতে বলেন?

আমি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই।

মিঃ সেলডন জানালেন, তাঁর মক্কেলের অনুমতি ছাড়া তিনি কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না।

মিস কার্লিসল কাকে উইল করেছেন একথা জানতে চাইলে মিঃ সেলডন আপত্তি জানালেন। আর মিঃ পোয়ারো মিস কার্লিসলের সঙ্গে দেখা করার সঙ্গত মনে করলেন।

.

২.৮.১

 স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চীফ ইনসপেক্টর মার্সডেন নিঃসন্দেহ যে এলিনর কার্লিসলই ঠাণ্ডা মাথায় স্যাণ্ডউইচের উপর মরফিন ছড়িয়ে মেরী জেরার্ডকে হত্যা করেছে এবং পোয়ারোকে সেকথা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন।

.

২.৯.১

ড. লর্ড প্রশ্ন করলেন, এখনও কিছু ধরতে পারেননি না?

পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন, ঈষাবশতঃ এলিনর কালির্সল মেরী জেরার্ডকে খুন করেছে, সম্পত্তি পাবার লোভে এলিনর তার মাসিকে খুন করেছে, মাসির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে এলিনর তার মাসিকে খুন করেছে–তিনটের মধ্যে যে কোন একটা বেছে নিতে পারেন আপনি।

ড. লর্ড রেগে বললেন কি বলতে চান আপনি? আপনি কি মনে করেন মাসির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এলিনর তাকে সাহায্য করেছিল।

প্রশ্নটা শুনে রেগে উঠলেন ড. লর্ড। বাজে কথা।

কেন আপনি আমাকে বলেননি যে, মিসেস ওয়েলম্যান ঐ ধরনের কথা আপনাকে বলেছিলেন? ঐ চিন্তাটা ওঁর মাথায় ছিল। এলিনর তাঁকে সাহায্য করে থাকতে পারে?

ড. লর্ড জানালেন, এলিনর কার্লিসল ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে, চিন্তাভাবনাও সুস্থ। সে এমন ঝুঁকির কাজ কখনোই করতে পারে না। ধরা পড়লে খুনের দায়ে পড়তে পারে তা সে জানে।

পোয়ারো চিন্তাগ্রস্তভাবে জানতে চাইলেন রডারিককে দিয়ে ঐ কাজ করানো সম্ভব।

তাচ্ছিল্যের সুরে ড. লর্ড জানালেন, সাহস তার নেই।

পোয়ারো বললেন, মি ওয়েলম্যান যেমন ধূর্ত, আবার লোককে মোহিত করার ক্ষমতাও তার আছে। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এলিনরকে কি কেউ ঘৃণা করতো?

ড. লর্ড মাথা নাড়লেন।

আপনার কি ধারণা কেউ ওকে ওই অপরাধে জড়িয়েছে, মানে ওকে ফাঁদে ফেলে করিয়েছে? না।

এরপর পোয়ারো তাকে ঐ বেনামী চিঠির কথা বললেন, তাতে কেসটা আরো বিপক্ষে যাচ্ছে এলিনরের। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে একথা ভেবে, তার উপর মাসির উইল করার কথা শুনে দেরী করতে চায়নি এলিনর।

রডারিক একাজ করতে পারে কিনা একথা জিজ্ঞেস করতে ড. লর্ড প্রতিবাদ করলেন, বিয়ে হলে ওর সম্পত্তি তো রডারিকই পেত।

পোয়ারো বললেন, তা ঠিক, কিন্তু এনগেজমেন্ট ভাঙার পরেই রডারিক নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও একটা কিছু আছে, ধাঁধার একটা জায়গায় জট আছে, সেটি খুললেই সব জানা যাবে। আর সেটা মেরী জেরার্ডকে কেন্দ্র করে। পোয়ারো হঠাৎই জানতে চাইলেন, আচ্ছা ওর বিরুদ্ধে কিছু শুনেছেন কি আপনি? তার অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে? তাকে নিয়ে কোন কেলেঙ্কারী, তার সততা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ, কোন বাজে গুজব, যাহোক কিছু একটা মানে, যাতে তার ক্ষতি হতে পারে?

ড. লর্ড ধীরে ধীরে বললেন, নিরীহ একটি মৃত যুবতী, সে সপক্ষে এখন কিছুই বলতে পারবে না, তার সম্বন্ধে ঐ ধরনের অভিযোগ খোঁজা কি ঠিক হবে?

তাহলে বলছেন অত্যন্ত নির্মল চরিত্রের মেয়ে ছিল মেরী জেরার্ড?

জোর দিয়ে ড. লর্ড জানালেন, হ্যাঁ।

শান্ত গলায় পোয়ারো বললেন, নার্স হপকিন্স সম্বন্ধে এমন কিছু জানেন যা বলতে ভয় পেয়েছেন। যদিও নার্সের ধারণা ঐ ব্যাপারটার সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক নেই, এলিনরই মেরীর হত্যাকারী। এমনও তো হতে পারে মেরী কোন এক তৃতীয় ব্যক্তির ক্ষতি করেছে, আর সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি মেরীর মৃত্যু চেয়েছিল।

ড. লর্ড জানালেন, বাপারটা এতো ঘোরালো হলে নার্স হপকিন্স নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন।

নার্স হপকিন্স বুদ্ধীমতী হলেও আমার সমান বুদ্ধি নিশ্চয়ই রাখেন না। অতএব তিনি যা বুঝতে পারেননি আমি পারতে পারি।

পোয়ারো জানালেই টেড বিগল্যাণ্ড যার জীবন মেরীর সঙ্গে এখানেই কেটেছে সেও জানে না, মিসেস বিশপও কিছু জানে না। একমাত্র আশা নার্স ও’ব্রায়ান।

ড. লর্ড জানালেন, মাত্র দুমাস হল তিনি বদলি হয়ে এসেছেন এখানে।ও ব্যাপারে তিনি বিশেষ কিছু জানেন না।

পোয়ারো বললেন, মেরীর কথাটা কথাচ্ছলে যদি নার্স হপকিন্স বলে থাকেন নার্স ও’ব্রায়ানকে তবে তার কিছু জানার কথা।

.

২.১০.১

চায়ের টেবিলের অন্যধারে বসে কপালের ওপর এসে পরা লাল চুলের গোছ ঝাঁকুনি দিয়ে পিছন দিকে সরিয়ে আবার পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন ছোটোখাটো লোকটিকে।

পোয়ারো বললেন, স্বাস্থ্য আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর এমন কারুকে দেখলে মন খুব প্রসন্ন হয়। আমার স্থির বিশ্বাস আপনার রোগীরা ভালো হবেই হবে।

উত্তরে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, তার হাতে কম রোগীই মারা গেছে।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঐ সময়ে আপনার মনে কোন সন্দেহ হয়নি?

নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, বিন্দুমাত্র না, তবে হওয়া উচিত ছিল। কারণ সেদিন সকালে ড. লর্ড অকারণে একবার একাজে–একবার অন্যকাজে সর্বত্র ছোটাছুটি করিয়েছিলেন, আর ঐ অবসরেই ডেথ সার্টিফিকেট লিখে ফেললেন।

পোয়ারো বললেন যে, মিসেস ওয়েলম্যান আত্মহত্যা করেছেন এমন কথা উঠেছে।

শুনে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, যিনি কোনরকমে শুধু একটা হাত তুলতে পারতেন, বিছানা থেকে ওঠা তো দূরের কথা উনি কিভাবে আত্মহত্যা করবেন? আবার মিস কার্লির্সল, মিঃ ওয়েলম্যান বা মেরী জেরার্ড কারুর পক্ষেই একাজ করা অসম্ভব বলে জানালেন নার্স ও’ব্রায়ান।

পোয়ারো তার কথা মেনে নিয়ে বললেন, আচ্ছা নার্স হপকিন্সের মরফিনের শিশি কখন হারিয়েছিল?

ঠিক পরের দিন সকালে। উনি বললেন শিশিটা এখানে ছিল, তারপর ওঁর ধারণা হল মরফিন হয়তো বাড়িতে ফেলে এসেছেন।

পোয়ারো বললেন, কি আশ্চর্য তখনও আপনার সন্দেহ হয়নি?

নার্স ও’ব্রায়ান জানালেন, আমার মাথায় ওসব চিন্তা আসেনি। পুলিশরে ওটা নিছক সন্দেহ ছাড়া কিছুই নয়।

উত্তরটা মনঃপুত না হওয়াতে পোয়ারো বললেন, মরফিনের শিশি হারিয়ে গেছে, অথচ আপনাদের দুজনের মনে কোন সন্দেহই জাগল না?

ব্লু-টি কাফেতে বসে নার্স হপকিন্সের সঙ্গে তার যা কথা হয়েছিল, জানালেন নার্স ও’ব্রায়ান। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এখন আপনার কি ধারণা?

যদি মেরীর পেটে মরফিন পাওয়া যায়, তবে আন্দাজ করা যাবে কে ওটা চুরি করেছিল বা কোন কাজে লাগানো হয়েছিল, তবে ওর শরীরে মরফিন না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই বিশ্বাস করবো না, তবে মেরী জেরার্ডকে যে এলিনর খুন করেছে সে বিষয়ে আপনার কোন সন্দেহ নেই?

নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, সে রাতেবৃদ্ধা কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন আর মি এলিনর তার সমস্ত ইচ্ছাপূরণের কথা দিয়েছিলেন, সে রাতে আমি যদি উপস্থিত না থাকতাম বা একদিন মেরী যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল আর কুটিল মুখে এলিন ওর দিকে তাকিয়েছিল, সে দৃশ্য যদি না দেখতাম তবে হয়ত অন্য কথা ভাবতাম।

পোয়ারো প্রশ্নের জবাবে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, দুই লাখ পাউণ্ডের সম্পত্তির লোভেই এলিনর মেরীকে খুন করেছে।

নার্স জানাল, মিসেস ওয়েলমান উইল করে গেলে ওনার পাইপয়সা মেরীকেই দিয়ে যেতেন।

পোয়ারো বললেন, একথাও তো কেউ বলতে পারে যে, মেরী জেরার্ড কায়দা করে বুড়ীকে হাত করে নিয়েছিল, ফলে নিজের আত্মীয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছিল।

ঘাড় নেড়ে নার্স ও’ব্রায়ান কথাটা স্বীকার করলেন।

পোয়ারোর প্রশ্ন, মেরী জেরার্ড কি খুব ধূর্ত, ফন্দিবাজ মেয়ে?

 নার্স ও’ব্রায়ান জানালেন, মেরী মোটেই সেরকম মেয়ে ছিল না।

হঠাৎ এক অদ্ভুত মর্মভেদী স্বরে পোয়ারো বলে উঠলেন, আপনি আর নার্স হপকিন্স দুজনেই একটা কথা জনসমক্ষে উপস্থিত করবেন না এমন বোঝাপড়া করে নিয়েছেন, তাই না?

আপনার কথার অর্থ?

নার্স ও’ব্রায়ানের কণ্ঠস্বরে পোয়ারো তাড়াতাড়ি বললেন, না না, এই খুনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই–সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

নার্স ও’ব্রায়ান শান্তভাবে বললেন, পুরানো ময়লার গাদা খুঁচিয়ে লাভ কি বলুন? তাছাড়া উনি একজন বয়স্কা সম্মানিতা মহিলা, ওর সম্বন্ধে কোন কেচ্ছা নেই, মারাও গেছেন সম্মান নিয়ে।

আপনি বলছেন মিসেস ওয়েলম্যানকে মেডেনসফোর্ডে সবাই খুব সম্মান করতো।

নার্স ও’ব্রায়ান আপন মনে বলতে লাগলেন, বহুদিন আগে সব শেষ হয়ে গেছে, মানুষ ভুলেও গেছে। যার স্ত্রী পাগলা-গারদে সেই পুরুষের পক্ষে আমৃত্যু একা একা কাটানো বড়ো কঠিন।

আন্দাজে পোয়ারো বললেন, যা বলেছেন, বড় কঠিন।

নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, নার্স হপকিন্স কি আপনাকে বলেছেন কিভাবে একই সঙ্গে আমার আর তাঁর চিঠি দুজনের কাছে পৌঁছেছিল। না বলে চললেন, এরকম কাকতালীয় ব্যাপার অনেক সময়ই ঘটে, আমি যখন পিয়ানোর ওপর রাখা একটা ফটো দেখছি, ঠিক সেই সময় ডাক্তারের বাড়ির ঝিয়ের কাছ থেকে ঐ ফটো সম্বন্ধেই গল্প শুনেছেন নার্স হপকিন্স।

খুবই মজার ব্যাপার, কিন্তু মেরী জেরার্ড কি কথাটা জানত?

 নার্স জানালেন, নার্স হপকিন্স বা উনি কেউই তাকে একথা জানাননি।

.

২.১১.১

 দুজনের মধ্যে একটি টেবিলের ব্যবধান, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, ফর্সা চৌকো কপাল, নাক কানের গঠন বেশ কোমল, মুখের রেখাগুলো সুন্দর, অহংকারী, সংবেদনশীল, আত্মসংযমী, প্যাশন আছে–পোয়ারো কি যেন খুঁজছেন এলিনরের মুখে।

আমি এরকুল পোয়ারো, ডাক্তার লর্ড আমায় পাঠিয়েছেন। তার ধারণা আমি আপনার উপকারে লাগতে পারি।

আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? নিরপরাধদের তুলে ধরাই আমার কাজ। এলিনর তার স্বচ্ছ নীল চোখের তারা দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল পোয়ারোর দিকে, আপনি বিশ্বাস করুন আমি নিরপরাধ।

আপনার আত্মীয় মানে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সুবিধার জন্য ভাই বলছি, মিঃ রডারিক ওয়েলম্যান। অহংকারের আবরণে নিস্পৃহ মুখে রক্তের কালিমার ছোপ লাগলো ধীরে ধীরে। বিনা প্রশ্নেই যা জানাবার ছিল পোয়ারোর তা জানা হয়ে গেল।

পোয়ারো জানালেন যে, রডারিক ওয়েলম্যান তার জন্য যথাসাধ্য করছেন। পোয়ারো আরো বললেন, আপনি শুনেছেন তো, পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় আপনার মাসি যে মরফিন ক্রিয়ায় মারা গেছেন তা জানা গেছে।

হিমশীতল গলায় এলিনর কার্লিসল বলল, আমি ওঁকে খুন করিনি।

এলিনর তার সম্পত্তি কাকে দিয়ে গেছেন জানতে চাইলেন পোয়ারো।

শান্তভাবে এলিনর উত্তর দিল, আমি সব কিছু রডিক..রডারিক ওয়েলম্যানকে দিয়ে গেছি।

সে সম্পর্কে রডারিক কিছু জানে কিনা প্রশ্ন করলে এলিনর জানাল, না।

আপনার উইলের মূল বক্তব্য আর কে জানে?

শুধু মিঃ সেলডন…আর তার কেরানীরাও জানতে পারে।

এলিনর জানাল যেদিন পিটার লর্ড আমাকে উইল করার কথা বলেন সেদিন সন্ধ্যেবেলা সে মিঃ সেলডনকে চিঠি লেখে।

চিঠিটা কি আপনি নিজে ডাকবাক্সে দিয়েছিলেন?

এলিনর বলল হান্টারবেরী থেকে অন্য চিঠির সঙ্গে সে চিঠিটা পাঠিয়েছিল।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন চিঠি লিখে একবারও না পড়ে তিনি বাক্সে দিয়েছিলেন কি চিঠিটা?

বিস্মিত হয়ে এলিনর বলল, না তো, আর একবার পড়েছিলাম, আমি স্ট্যাম্প আনতে ওপরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে নিশ্চিন্ত হবার জন্য আর একবার পড়ে মুখটা সেঁটেছিলাম।

ঘরে আর কেউ ছিল তখন?

শুধু রডি ছিল।

উনি কি জানতেন আপনি কি করছেন?

 পোয়ারার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে এলিনর বলল, রডি এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।

আপনি যখন ঘরের বাইরে ছিলেন তখন কি কেউ চিঠিটা পড়ে থাকতে পারে।

এলিনর এর কোন সুনিশ্চিত জবাব দিতে পারল না।

মানে মিঃ রডারিক ঘরে আসার আগে?

নিশ্চয়ই।

পোয়ারো বললেন, উনি নিজেও পড়ে থাকতে পারেন চিঠিটা?

এলিনর জানাল, অন্যের চিঠি পড়ার অভ্যেস রডির নেই।

পোয়ারো বললেন, ঐ দিনই কি প্রথম আপনার মাথায় মেরী জেরার্ডকে খুন করার কথাটা

মশালের মত জ্বলতে লাগল এলিনরের মুখ, একথা কি ড. লর্ড আপনাকে বলেছেন?

পোয়ারো প্রশ্নটা সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে শান্ত সুরে বললেন, ঠিক ঐ দিনেই? না? যখন আপনি জানালা দিয়ে দেখলেন মেরী উইল লিখছে, ঠিক সেই মুহূর্তে, তাই না, আপনার মনে হয়েছিল মেরী জেরার্ড যদি মারা যায় তাহলে কি মজার ব্যাপারই না হবে, আর সুযোগই বা কি অসামান্য…।

ধরা গলায় এলিনর বলল, উনি জানতেন, উনি আমার দিকে তাকালেন এবং বুঝেছিলেন…। এলিনর জানতে চাইল, সত্যিই কি আমাকে সাহায্য করার জন্য ড. লর্ড আপনাকে পাঠিয়েছেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন, হ্যাঁ কথাটা সত্যি, শুনুন কার্লিসল, মেরী যেদিন মারা যায় সেদিনের সব ঘটনা আমার শোনা উচিত, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, তার থেকেও বড়ো কথা এমন কি চিন্তা করেছিলেন তাও আমার জানা উচিত।

একদৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে থেকে এলিনর মৃদু হাসলো, আপনি আশ্চর্য রকমের সরল মানুষ মিস পোয়ারো। আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আপনাকে মিথ্যে কথা বলা আমার পক্ষে কত সহজ?

এরকুল পোয়ারো বললেন, না মাদমোয়াজেল, সত্যির মতো মিথ্যাও তার শ্রোতাকে সব কথা সমানভাবে জানিয়ে দেয়। কখনও কখনও একটু বেশী জানিয়ে দেয়।

এরপর পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, পরপর কি ঘটনা ঘটেছিল।

এলিনর জানাল, সে স্যাণ্ডউইচের জন্য মাছের পেস্ট কিনে হান্টারবেরীতে পৌঁছে মাসির ঘরে গিয়ে তার জিনিসপত্র দেখে ভড়ার ঘরে গিয়ে স্যাণ্ডউইচ তৈরী করছিল। খুব মৃদু স্বরে পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তখন কি চিন্তা করছিলেন?

এলিনরের নীল চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল, আমার নামের অন্য এক মহিলা, অ্যাকুইটেইনের এলিনরের কথা চিন্তা করছিলাম।

পোয়ারো জানালেন, আমি ওই অ্যাকুইটেইনের-এলিনরের গল্পটা জানি। মহিলা ফেয়ার রোজামণ্ডকে বেছে নিতে বলেছিলেন হয় ছোরা নয় বিষ। রোজামণ্ড বিষই বেছে নিয়েছিল।

এক্ষেত্রে কিন্তু বেছে নেবার কোন প্রশ্ন ছিল না–তারপর মাদমোয়াজেল, তারপর কি হল? এলিনর বলল, স্যাণ্ডউইচগুলো তৈরী করে প্লেটে রেখে আউটহাউসে গিয়ে নার্স হপকিন্স ও মেরীকে নিয়ে এসে তিনজনে মিলে স্যাণ্ডউইচ খেলাম।

বেশ…তখনো কিন্তু স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন…তারপর?

তারপর? মেরী জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিল, আমি আবার গেলাম ভাড়ার ঘরে, ঐ যে আপনি বললেন না, স্বপ্নের ঘোর ঠিক তাই।…নার্স ওখানে কাপ প্লেট ধুচ্ছিলেন, মাছের কৌটোটা আমি ওঁকে দিলাম। নার্সের কব্জিতে একটা দাগ ছিল। আমি প্রশ্ন করতে উনি বললেন, আউটহাউসের ধারে গোলাপ বাগানের কাটাতে কেটে গেছে। আমার মনে পড়ে গেল আমি আর রডি গোলাপের লড়াই খেলতাম। ঐ ভাড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে…হঠাৎ হঠাৎ একটা অন্ধকার ঘিরে ধরল আমায়,..মনের গোপন কোণ থেকে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ল…। আমি চাইনি ওর মৃত্যু হোক-পরে যখন আবার খাবার ঘরে গেলাম, দেখি মেরী মারা যাচ্ছে…।

পোয়ারোকে একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সলজ্জভাবে এলিনর প্রশ্ন করল, আপনি কি এখনও আমাকে প্রশ্ন করবেন…মেরী জেরার্ডকে আমি খুন করেছি কিনা?

পোয়ারো দ্রুতস্বরে বললেন, এমন অনেক জিনিস আছে যা আমি জানতে চাই না…।

.

২.১২.১

এরকুল পোয়ারো ট্রেন থেকে নামলেন। ড. লর্ড বললেন, যথাসম্ভব জোগাড় করে রেখেছি আপনার প্রশ্নের উত্তর। প্রথমতঃ, মেরী জেরার্ড ১০ই জুলাই এখান থেকে লণ্ডনে গিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, বাড়িতে আমার সংসারের কাজ করে কয়েকটি হাসিখুশি মেয়ে, আমার কোন হাউস-কীপার নেই। কাল সকালেই মিসেস স্ট্যাকারীর বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাব যিনি রানসমের (আমার পূর্বসূরীর) হাউস-কীপার ছিলেন।

ড. লর্ড বললেন, মিঃ পোয়ারোর সবচেয়ে আগে হান্টারবেরীতে যাওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের কেস হলে তিনি আগে ঐ বাড়িটাতেই ছুটে যেতেন যেখানে মেরী খুন হয়েছে।

পোয়ারো বললেন, বইপড়া বিদ্যে নিয়ে রহস্যের তদন্ত করা যায় না। নিজের স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয়।

ড. লর্ড বললেন, কোন না কোন সূত্র তো পেতে পারতেন?

পোয়ারো বললেন, পুলিশ তন্ন তন্ন করে বাড়িটাকে খুঁজেছে এলিনরের বিপক্ষে যেতে পারে এমন সব প্রামণের জন্য, তার স্বপক্ষের জন্য নয়। পোয়ারো আরো জানালেন, এখন তিনি কি চান তা বুঝছেন, মনে হয় সামান্য কিছু হলেও কিছু একটা ও বাড়িতে পাওয়া যেতে পারে।

ব্যগ্র হয়ে ড. লর্ড প্রশ্ন করলেন, মানে এলিনরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য।

গম্ভীর হয়ে পোয়ারো বললেন, অপেক্ষা করুন বন্ধু, এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

.

২.১২.২

 দুপুরের লাঞ্চের সময় ড. লর্ড আর পোয়ারোর মধ্যে কথা হচ্ছিল, পোয়ারো বললেন, কোন কোন অপরাধের মূল থাকে অতীতের মধ্যে ছড়ানো। আমার মনে হয় এই ঘটনারও তাই ছিল।

বিরক্ত ড. লর্ড বললেন, দেখুন মিঃ পোয়ারো, আপনি কোন পথে এগোচ্ছেন তা জানার অধিকার কি আমার আছে? না আমাকে অন্ধকারেই থাকতে হবে?

পোয়ারো বললেন, থাকতে হবে, কারণ এখনও পর্যন্ত এমন কোন সূত্র পাইনি যা থেকে ধারণা হতে পারে একজন ছাড়া অন্য মেরী জেরার্ডকে খুন করতে পারে এবং সেই একজন হল এলিনর।

এতটা নিশ্চিত হবেন না, জানেন তো মেরী বহুদিন বিদেশে ছিল?

পোয়ারো জানালেন, জার্মানীতে তার কিছু স্পাই আছে। ছোটখাট কাজে তিনি তাদের ওপর নির্ভর করেন। শেষ একজনকে মিঃ ওয়েলম্যানের ফ্ল্যাট সার্চ করার জন্য লাগিয়েছিলেন উনি কতটা মিথ্যা কথা বলেছেন তা জানবার জন্য। পোয়ারো বললেন, প্রায় প্রত্যেকেই মিথ্যে বলেছেন। নার্স ও’ব্রায়ান বলেছেন স্বপ্নের কল্পনার রং লাগিয়ে, নার্স হপকিন্স গোঁয়ারের মতো, মিসেস বিশপ ঈর্ষা আর দ্বেষ মিশিয়ে আর আপনি…

ড. লর্ড প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, আমি নিশ্চয়ই আপনাকে মিথ্যে বলিনি।

পোয়ারো অস্বীকার করলেন না।

হান্টারবেরীর গেট পেরিয়ে মাঝবরাবর আসার পর মালী হরলিক-এর সঙ্গে দেখা। ড. লর্ড হরলিকের সঙ্গে পোয়ারার আলাপ করালেন এবং পোয়ারোকে বললেন, সেদিন সকালে হরলিক কাজ করছিল। হরলিক জানাল, সেদিন এলিনর কার্লিসলকে একটু যেন উত্তেজিত মনে হচ্ছিল–যেন মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করছিলেন।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তুমি মেরী জেরার্ডকে চিনতে?

 হ্যাঁ স্যার, তবে খুব ভালো চিনতাম না।

কি ধরনের মেয়ে ছিল ও?

অত্যন্ত ভালো মেয়ে স্যার, সুন্দর কথাবার্তা, নিজের সম্বন্ধে একটু বড় ধারণা ছিল। জানেন মিসেস ওয়েলম্যান ওকে নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করতেন। ফলে ওর বাবা একেবারে ক্ষেপে গিয়েছিল।

পোয়ারো মেরীর বাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে হরলিক জানাল, সবসময়ে কটু কথা বলত মিঃ জেরার্ড।

সেদিন সকালে কোথায় কাজ করছিলে তুমি?

 হরলিক জানাল, তরকারীর বাগানে।

তুমি লাঞ্চ খেতে কখন গিয়েছিলে?

দুপুর ১টায় স্যার।

এবং তুমি কিছুই দেখতে পাওনি, আশেপাশে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে..বা কারুর গাড়ি…কোন কিছু।

মালী আশ্চর্য হয়ে বলল, পিছন দিকের গেটের বাইরে সে ড. লর্ডের গাড়ি দেখেছে।

ড. লর্ড প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, আমার গাড়ি? হতেই পারে না। সেদিন সকালে আমি উইদেরবেরীর দিকে গিয়েছিলাম দুটোর আগে ফিরিনি।

ড. লর্ড তাড়াতাড়ি পোয়ারাকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলেন এবং কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল গলিতে কার গাড়ি ছিল?

আপনার কি গাড়ি বন্ধু?

ফোর্ড-টেন, সমুদ্র-সবুজ রং। খুবই সাধারণ গাড়ি।

আর আপনি নিশ্চিত তো ঐ গাড়িটা আপনার ছিল না?

ড. লর্ড জানালেন, না।

পোয়ারো বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে বন্ধু, এতদিনে একটা কিছু হাতের মুঠোর পাওয়া যাচ্ছে।

গাড়ি ঢোকার রাস্তায় অর্ধেকের বেশী যাবার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, যে ভাগটা ফুলের বাগানের দিকে ঘুরে গেছে ওরা সেই পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন। কিছু দূরে গিয়ে বাঁক নিতেই ড. লর্ড পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সেই ভাঁড়ার ঘরের দিকে।

আপন মনে বিড় বিড় করে পোয়ারো বললেন, আর এখান থেকে যেকোন নোক ওটা দেখতে পারে। জানালা খোলা দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক।…আর বাড়ির ভেতর কি ঘটছে দেখার জন্য এই জায়গাটা বেছে নেওয়ার স্বাভাবিক।

দুজনে মিলে কিছু খুঁজতে লাগলেন, ড. লর্ড বললেন, ঐ যে জায়গাটা…ঝোঁপগুলির পাশে, ওখানে কিছু ঘাস-পাতার ওপর ভারী কিছুর ছাপ দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়, ঘাসগুলো মাথা তুলেছে বটে, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জায়গাটা দলামলা হয়েছিল।

হ্যাঁ, জায়গাটা ভালো, রাস্তা থেকে দেখা যায় না, অথচ এখান থেকে দাঁড়িয়ে জানালাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সেই বন্ধুটি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিল? সিগ্রেট খেয়েছিল কি?

হঠাৎ পোয়ারো মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দ করলেন। মুখ তুলে ডা. লর্ড দেখলেন পোয়ারোর হাতে ভাঙ্গা দোমড়ানো মোচড়ানো খালি একটা দেশলাই বাক্স। ভালো করে দেখে ড. লর্ড চমকে উঠলেন, বিদেশী দেশলাই। পোয়ারো প্রায় উদাস গলায় বললেন, এবং মেরী জেরার্ড সম্প্রতি জার্মানী থেকে ফিরেছিল?

ড. লর্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন, একটা ভালো সূত্র পেয়েছি, এ বিষয়ে আর কি সন্দেহ আছে?…কিন্তু, এখানে কার কাছেই বা বিদেশী দেশলাই থাকতে পারে।

আমি জানি, পোয়ারা বললেন, তবে আরো একটা অসুবিধে আছে, দেখতে পাচ্ছেন কি? না তো, বললেন ড. লর্ড।

ড. লর্ডের উত্তরের প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে পোয়ারো ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।

প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ড. লর্ড বলে উঠলেন, এমন কোন প্রমাণ নেই যে এলিনর কার্লিসল ঐ মরফিনের শিশিটা নিয়েছিল। ঐ বাগান থেকে কেউ ওকে লক্ষ্য করেছিল, তারপর এলিনর যখন মেরীদের ডাকবার জন্য আউটহাউসে গিয়েছিল সেই ফাঁকে কেউ এসে মরফিনের শিশির মুখ খুলে ওপরের স্যাণ্ডউইচের উপর ছড়িয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল গাড়ি করে, খেয়ালই করেনি লেবেলের টুকরোটা বেসিনের নীচে মেঝের ফলকটাতে আটকে রইল। পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এখনও আপনি দেখতে পেলেন না। মানুষ যে কত নিরেট হতে পারে ভাবা যায় না।

.

২.১২.৩

 শেষপর্যন্ত তারা সেই ঘরটিতে এলেন যেখানে মেরী মারা গেছিল। ড. লর্ড একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ঘরেই ঐ চেয়ারে মারা যায় মেরী জেরার্ড।

পোয়ারো সব দেখে আউটহাউসে যেতে চাইলেন। আউটহাউস থেকে বেরিয়ে একটা লতানো গোলাপ গাছ দেখিয়ে পোয়ারো আপন মনে বললেন, এই গোলাপের নাম জানেন? এর নাম জেফিরাইন দ্রুহিন।

ড. লর্ড বিরক্ত হলেন। পোয়ারো বললেন, এলিনর বলেছিলেন ছোটবেলায় তিনি আর রডারিক এই গোলাপ বাগানে গোলাপের যুদ্ধ খেলতেন। রডারিক ভালোবাসাত সাদা গোলাপ গন্ধ নেই।…এলিনর ভালোবাসত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা লাল গোপাল। এলিনর ও রডারিকের ওটাই ছিল পার্থক্য। এর থেকে বোঝা যায় এলিনর কার্লির্সল আবেগপ্রবণ, অহংকারী হলেও ভালোবাসত একটি পুরুষকে যে ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিল না।

পোয়ারো ঐ বাগানে যেতে চাইলেন।

নিঃশব্দে দুজনে গিয়ে বাগানে হাজির হলেন। সেই ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে যেন মৌনী নিলেন পোয়ারো, কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যাপারটা এতো সহজ অথচ আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার তত্ত্ব অনুসারে মেরী জেরার্ডকে জার্মানীর পরিচয় কেউ হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখুন, এখানে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল মেরী নয়, অন্য একটি মেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে স্যাণ্ডউইচ কাটছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কেন মনে করবে যে ঐ স্যাণ্ডউইচ দেওয়া হবে মেরীকে।

.

২.১৩.১

মুখভর্তি বানরুটির টুকরো নিয়ে নার্স হপকিন্স দেখলেন দরজায় মিঃ পোয়ারো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পোয়ারোকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন নার্স হপকিন্স। পোয়ারো জানালেন, তিনি সত্যি কথাটা জানার জন্য এসেছেন।

নার্স হপকিন্স রাগে ফেটে পড়ে বললেন, নিজেকে কোনভাবেই আমি বাঁচাতে চাই না, তাহলে তদন্তের সময় যেচে গিয়ে মরফিনের শিশি হারানোর কথা বলতাম না। পেশাগত অসাবধানতার জন্য ধমকানি শুনতে হবে জেনেও কথাটা আমি লুকোইনি। আমি সেইটুকুই করোনার কোর্টে বলেছি যেটুকু এ কেসের জন্য বলা দরকার। মেরী জেরার্ড-এর মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না।

পোয়ারো বাধা দেবার কোন চেষ্টাই করলেন না। শান্ত গলায় তিনি বললেন, মেরী জেরার্ডের জীবন বৃত্তান্তের কথা আপনি চেপে গিয়েছেন। আমি তাই জানতে চেয়েছি।

কেন চাপবো না, বিশেষ করে অপরাধের সঙ্গে যখন তার সম্পর্কে নেই।

যদি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুমান হয়…….তাহলে হয়তো সম্পর্ক নেই কিন্তু আপনি যদি প্রকৃত ঘটনাটা মানেন, তবে অন্য ব্যাপার।

পোয়ারো জানালেন, মিসেস ফ্লাটারীর সঙ্গে তার কথাবার্তায় তিনি জেনেছেন মিসেস ওয়েলম্যান আর স্যার লিউইস রাইক্রফট-এর মধ্যে বিশ বছরের বেশী একটা গভীর প্রেমের ব্যাপার ছিল। স্যার লিউইস রাইক্রফট-এর স্ত্রী ছিলেন পাগল কিন্তু তার শরীর স্বাস্থ্য ছিল খবুই মজবুত, অনায়াসে বছর নব্বই বেঁচে যেতে পারতেন। যেহেতু সেযুগে বিবাহ বিচ্ছেদের সুবিধাজনক আইন ছিল না তাই তাদের মিলন সম্ভব হয়নি। দুজনের প্রেমের গোপন সম্পর্কটা আন্দাজ করলেও কেউ সঠিকভাবে মানত না। পরে রাইক্রফট যুদ্ধে মারা যান। আমার অনুমান, রাইক্রফটের মৃত্যুর পর একটি শিশুর জন্ম হয় আর ঐ শিশুই হল মেরী জেরার্ড।

নার্স হপকিন্স বললেন, দেখছি আপনি সবই জানেন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নার্স হপকিন্স ঘরের অন্যদিকে একটা আলমারী খুলে একটা খাম নিয়ে পোয়ারোর হাতে দিয়ে বলেলেন, কি করে এটা আমার হাতে এল তা বলছি। মনে রাখবেন আমার একটু সন্দেহ ছিল। প্রথমতঃ মিসেস ওয়েলম্যান যে চোখে মেয়েটিকে দেখতেন এবং দ্বিতীয়তঃ, যে গুজব চালু হয়েছিল, অসুস্থ অবস্থায় বুড়ো জেরার্ড আমাকে বলেছিলেন, মেরী তার মেয়ে নয়। মেরী মারা যাবার পর আমি আউটহাউসের ঘর পরিষ্কার করছিলাম, একটা ড্রয়ারে বুড়োর অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে এই চিঠিটা পাই।

খামটার ওপর বিবর্ণ হয়ে আসা কালিতে লেখা, মেরীর জন্য, আমার মৃত্যুর পর পাঠাতে হবে। নার্স হপকিন্স জানালেন, চিঠিটা মেরীর মায়ের লেখা, যিনি প্রায় ১৪ বছর আগে মারা গেছেন।

পোয়ারো চিঠিটা বের করলেন–চিঠিতে লেখা–যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে সেইজন্য এই চিঠিতে সত্য কথাটি লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। হান্টারবেরীর মিসেস ওয়েলম্যানের পরিচারিকা ছিলাম আমি। উনি আমাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন, একবার আমি বিপদে পড়ি, উনি আমাকে সাহায্য করেন এবং সব শেষ হবার পর আবার কাজে বহাল করেন, বাচ্চাটা কিন্তু মারা যায়। আমার মনিবগিন্নী এবং স্যার লিউইল রাইক্রফট পরস্পর পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু তারা বিয়ে করতে পারেননি, কারণ ভদ্রলোকের স্ত্রী পাগলা-গারদে ছিলেন। স্যার রাইক্রফট অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান। অল্পকাল পরেই মনিবগিন্নী আমাকে জানান তার বাচ্চা হবে। তারপর তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্কটল্যাণ্ডে যান। ওখানে আরডলোক্রিতে শিশুটি জন্ম নেয়। জেরার্ড, যে আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়েছিল, আমার বিপদ কেটে গেছে দেখে আবার চিঠি লেখা শুরু করেছিল। বন্দোবস্ত হল যে জেরার্ড আমাকে বিয়ে করবে এবং বাচ্চাটি আমার বাচ্চা বলে মনে করবে, এবং আউটহাউসে থাকবে। উদ্দেশ্য বাচ্চাটিকে চোখের সামনে রাখা। তার লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে সমাজে একটা ভালো জায়গা করে দেওয়া। তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃত সত্য যেন কোনদিনও মেরীকে জানানো না হয়। মিসেস ওয়েলম্যান আমাদের দুজনকেই মোটা টাকা দেন। কিন্তু না দিলেও আমি তাকে সাহায্য করতাম। বরকে পেয়ে আমি সুখী হয়েছিলাম, কিন্তু ও মেরীকে সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে হয় মারা যাবার আগে একথাটা কাগজে কলমে লিখে রেখে যাওয়া ভাল।–এলিজা জেরার্ড (বিয়ের আগের নাম এলিজা রাইলি)।

জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠিটা রাখলেন পোয়ারো। নার্স হপকিন্স এসব ব্যাপার আর পাঁচজন না জানলেই ভালো। কারণ ওঁরা সবাই মৃত।

যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের কথাও তো চিন্তা করা উচিত? পোয়ারো বললেন।

কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে খুনের তো কোন সম্পর্ক নেই।

গম্ভীর হয়ে পোয়ারো বললন, কে বলতে পারে, অনেক কিছুই এ থেকে পাওয়া যেতে পারে। বলে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।

কিছুদুর যাবার পর হরলিকের সঙ্গে দেখা। হরলিক জানাল গাড়িটা ড. লর্ডেরই ছিল। গাড়ির নম্বর এম.এম.এস. ২০২২। হরলিককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।