১. ছমাসের জন্য বিশ্রাম

এ.বি.সি. মার্ডার (এরকুল পোয়ারো)

ছমাসের জন্য বিশ্রাম। অখণ্ড অবসর। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তাই দেরি না করে গিন্নিকেতের খামারের হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাবো ইংল্যান্ড।

উনিশশো পঁয়ত্রিশ সাল। জুনের শেষ ভাগ। বহুদিন আগে ইংল্যান্ডে এসেছিলাম।

ইংল্যান্ডে হাজির হয়ে আগে খোঁজ করলাম আমার প্রাণের বন্ধু এরকুল পোয়ারোর। লন্ডনের এক আভিজাত্যপূর্ণ এলাকায় দামী ফ্ল্যাটে নাকি সে আছে, অনুসন্ধান করে জানলাম।

আমি তার ফ্ল্যাটে গিয়ে তো একেবারে থ। একেবারে রাজকীয় ব্যাপার চাকর-বাকরের অভাব নেই। তবে ফ্ল্যাটের ঘরগুলো দেখে আমার ঠিক মন ভরলো না। কোনোটা ত্রিভুজাকৃতি, কোনোটা আবার পঞ্চভুজ। এরকম আকৃতির ঘর করার কারণ কি জানতে চাইলাম বন্ধুর কাছে।

সে আমার প্রশ্নের জবাবে জানালো–চারপাশে সরলরেখার এত ছাড়াছাড়ি যে সরল জীবনযাপনের জন্য এ এক আদর্শ পীঠস্থান। কি তাই তো?

আমি ঘাড় নেড়ে তাকে সায় জানালাম।

আমরা দুজনে অনেকদিন পর মিলিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় গা ভাসিয়ে দিলাম। হঠাৎ পোয়ারোর চেহারার দিকে নজর পড়লো আমার।

বন্ধু, তোমাকে অনেকদিন পর দেখছি। কিন্তু তোমার চেহারার পরিবর্তন কিছু দেখছি না তো, চেহারার উজ্জ্বলতা আগের তুলনায় খানিকটা বেড়েছে। চুলও সাদা হয়নি এখনও। তুমি কি বুড়ো হবে না। এর কারণ কি?

–এর কারণ, পোয়ারো স্মিত হেসে জবাব দিলো। তুমি একে বৈজ্ঞানিক বা অবৈজ্ঞানিক যা-ই বলো না কেন, মাঝে মাঝে তারও একটু হেরফের হয়। তুমি বরং এত না ভেবে প্রশ্নের সমাধান তুমি নিজেই করে ফেলো।

এই বলে পোয়ারো তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পাশেই তার শোবার ঘর। ঐ ঘরে গিয়ে ঢুকলো। খানিক বাদে হাতে একটি ছোট্ট শিশি নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো। আমার হাতে দিলো।

আমি শিশিটা হাতে নিয়ে গায়ে লাগানো লেবেলটা পড়তে লাগলাম। আসলে শিশিটা কলপের।

-এবার বুঝেছি, তোমার চুলে এখনও পাক ধরেনি কেন? তুমি কলপ ব্যবহার করো। তাহলে এরপর এসে দেখবো আমার বন্ধু প্রবর একজোড়া ইয়া বড় মোচ লাগিয়ে নাক উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গোঁফের ব্যাপারে পোয়ারো আগাগোড়া একটু স্পর্শকাতর।

-না, সেদিন যেন জীবনে না আসে, এই প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে করে পোয়ারো জবাব দিলো। নকল গোঁফ, ভাবতেও ঘেন্না করে। কথা শেষ করে সে তার গোঁফ জোড়ায় হাত বুলোত লাগলো।

সে যে মনে মনে একটু বিরক্ত হয়েছে বুঝে তাই প্রসঙ্গ পাল্টালাম।

–গোয়েন্দাগিরি তাহলে তুমি সত্যিই ছেড়ে দিয়ে অবসর নিলে?

-না, ছাড়িনি, ভেবেছিলাম, অবশ্য অনেকদিন আগে ভেবেছিলাম। তারপর ঠিক করলাম অযথা সময় নষ্ট না করে বিজ্ঞানের কারিগরি নিয়ে মাথা ঘামাই। তাই বইপত্রও কিনলাম বেশকিছু অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ যখন শেষ করে ফেলেছি, এমন সময় শুনলাম একটি খুনের খবর। অতএব আবার সেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করলাম। একটু থেমে পোয়ারো বলতে থাকে, আসলে কি জানো যেখানেই সূক্ষ্ম বিচার সেখানেই পোয়ারো স্বয়ং হাজির। তখন মাথার মধ্যে অকেজো স্নায়ু কিলবিল করে ওঠে। বলো, চুপ করে বসে থাকা যায়? আর এই বুদ্ধিটুকুর জন্য সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলাম।

-বাঃ, খুনির কাজের প্রশংসা করতে হয়।

–তা যা বলেছো, তুমি তো এতদিন পর এলে…কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।

–বিপদ? তার মানে?

-হ্যাঁ, ভাই। হেস্টিংস, ভাগ্যের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখি। পোয়ারো বলতে থাকে, তোমাকে তোমার নিয়তি এতদিন পরে আমার কাছে টেনে এনেছে। বিপদ তোমার মাথার শিয়রে। এ গন্ধ চিনতে আমার ভুল হয় না বন্ধু।

-তুমি কি সে রকম কিছু আন্দাজ করতে পেরেছো?

–হয়তো পেরেছি…হয়তো পারিনি…হয়তো, পোয়ারো ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবে উত্তর দিলো।

তার মুখে বিচলিত ভাব লক্ষ্য করলাম। সে দেরাজ টেনে বের করলো, কাগজপত্র সাজানো রয়েছে। ওর মধ্যে থেকে কয়েকটা প্রয়োজনীয় কাগজ এনে আমার হাতে দিলো। তারপর বললো, তুমি এই কাগজগুলো প্রথম থেকে পড়ে যাও। তারপর কি বুঝতে পারছো তা আমাকে বলবে।

আমি হাতে নিয়ে দৃষ্টি দিলাম, ওগুলো কয়েকটি চিঠি।

চিঠির ভাষা এইরকম—

নমস্কার পোয়ারো মশাই, দণ্ডবৎ,
আপনার অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে আমি অবগত আছি। আমাদের ব্রিটিশ পুলিশদের মাথা গবেট। কিছুই ওদের মগজে ঢোকে না। আপনি নাকি সব অদ্ভুত রহস্যের সমাধান ঝটাপট করে দেন। গোয়েন্দাপ্রবর, এবার আপনার বুদ্ধির খেলা দেখান তো। আরে বাবা, এ যেমন-তেমন ব্যাপার নয়। ভীষণ শক্ত চাই। এ মাসের একুশ তারিখে এ্যান্ডোভারে কেমন নাকানি-চোবানি খাওয়াই, সেটাই কেবল চোখ মেলে দেখবেন।
ইতি
বশংবদ

এ.বি.সি. তারপর একটি খাম আমার হাতে দিলো–এটা দেখো।

লক্ষ্য করলাম, লন্ডনের পোস্ট অফিসের স্টাম্প মারা। ঠিকানাটা হাতে লেখা নয়। টাইপ করা হয়েছে। বললাম–এ নিশ্চয়ই কারো পাগলামি।

কেবল কি পাগলামো? পোয়ারো বলতে থাকে–কথায় আছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কোনো কাজ নেই যা পাগলে পারে না।

পৃথিবীতে খ্যাতিসম্পন্ন মানুষরা এমন চিঠি দিনে কয়েকখানা করে পায়। আমি বললাম। এ নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কোনো যুক্তি দেখি না। এই চিঠির ব্যাপারে কোনো খোঁজ নিয়েছো?

-না, জ্যাপের সঙ্গে দেখা করে চিঠিটা দেখিয়েছিলাম। সে-ও তোমার মতো কথা বললো। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নাকি এধরনের চিঠি স্তূপ করে জমা রাখা আছে। কিন্তু এ চিঠিতে এমন কিছু আছে যা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

–সেটা কি, বলবে তুমি?

 আমার কথায় কর্ণপাত না করে সে মুখ বুজে রইলো।

অতএব আমি কৌতূহলী হয়ে ঐ কথার জের টেনে বললাম–চিঠিখানা নিয়ে এত না ভেবে . সন্দেহ নিরসনের ব্যবস্থা করো।

কিন্তু হেস্টিংস, আমি এ ব্যাপারে কি করতে পারি। পুলিশকে দেখলাম, গুরুত্ব দিলো না। তোমারও ঐ হাল লক্ষ্য করলাম।

টাইপ করা চিঠি। তাই হাতের লেখা ধরার উপায় নেই। তাই আমি বললাম–অনুমানের ওপর নির্ভর করে তোমাকে এগোতে হবে। কোনো সূত্র পেলেও পেতে পারো।

–আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পোয়ারো চটপট করে বলে উঠলো, কিছু অঘটন খুব শিগগিরই ঘটতে চলেছে। এটা আমার ধারণা নয়। আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

-আসছে শুক্রবার, একটা দিন কেটে যাবে, শনিবার কাগজ খুলে দেখবে, কিছুই ঘটেনি, হয়তো বা এ্যান্ডোভারে একটা ছোটোখাটো কেলেঙ্কারি হয়েছে।

–আহা, যদি তোমার সান্ত্বনা কাজে লাগতো।

 সান্ত্বনা! ডাকাতি আর সান্ত্বনা এক হলো!

-না হেস্টিংস, তুমি আমার কথার মানে বুঝতে পারছে না। দুটো এক জিনিস নয় ঠিকই তবে একদিক থেকে বিচার করলে কিছু মারাত্মক অঘটনের তুলনায় এ সান্ত্বনাই হোক।

–অঘটন বলতে…

–খুন। শুধু একটা শব্দ পোয়ারোর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো।

প্রায় ছফুট লম্বা মিঃ আলেকজান্ডার বোনাপার্ট। তিনি কাস্ট চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, ভুরু কুঁচকে তাকালেন, চোখে কম দেখেন। লোকটাকে ঠকবাজ, প্রতারক বলে মনে হয়।

ছোট্ট ঘরটি তার শোবার ঘর। অগোছালো অপরিচ্ছন্ন। ছোট ছোট চোখে তিনি ঘরের চারদিকে তাকালেন। দেখে মনে হয় যেন চোখ বন্ধ। দেওয়ালে ঝুলছে বাদশাহী আমলের কোট। কোটের পকেটে তিনি হাত ঢোকালেন। একটা সস্তাদামের সিগারেট আর দেশলাই বের করলেন। তারপর ধীর পায়ে টেবিলের সামনে এসে বসলেন। একটা কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরলেন। টাইপ করা নামের তালিকা লক্ষ্য করে একটা নামের ওপর দাগ দিলেন।

জুন মাস, আজ কুড়ি তারিখ, বৃহস্পতিবার। সেদিনের পর এ ব্যাপারে পোয়ারোর সঙ্গে আর কথা হয়নি।

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনসপেক্টর প্রধান জ্যাপ এলো ঠিক তার দুদিন পর অর্থাৎ বাইশ তারিখে। আমাকে দেখে হৈ হৈ করে এগিয়ে এলো।

–সত্যিই, আপনাদের দেখে পুরোনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ে যায়। তারপর ইনসপেক্টর আমার টাক লক্ষ্য করে বললো, ওটি কেবল এগোচ্ছে।

অনেকদিন পর দেখা হওয়ার প্রথম কথা এমন ধরনের, আমি একটু বিরক্ত হলাম মনে মনে।

পোয়ারোর চেহারা নিয়ে সে গর্ব বোধ করলো। বললো, যেখানেই যাই কেবল এরকুল পোয়ারো আর পোয়ারো। এবার এই কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে আমাদের সুযোগ করে দিন।

–অবসর নেবো বলেই বসে আছি। কিন্তু সুস্থির থাকার সুযোগ মিলছে না।

–দেখুন, হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজের খুনের তদন্তেই আপনাকে না নামতে হয়।

–বা রে, এ যে দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম।

পোয়ারো পাল্টা জবাব না দিয়ে আমার দিকে কেবল তাকালো।

কয়েকদিন চুপচাপ থাকার পর তোমার এই আইডিয়া নিয়ে সে দেখবে দারুণ এক গল্প তৈরি করেছে। আমি বললাম।

জ্যাপ হো হো করে হেসে উঠলো। প্রসঙ্গ পাল্টে আমার দিকে তাকিয়ে বললো–আপনি কি সেই অদ্ভুত চিঠিটা দেখেছেন?

জবাবে পোয়ারো বললো–হ্যাঁ, আমি দেখিয়েছি। ওখানে শুধু একটা তারিখ ২১ শে জুনের উল্লেখ আছে।

-হ্যাঁ, তাই আমি এখানে আসার আগে এ্যান্ডোভার থানায় ফোন করেছি। ওরা জানালো তেমন কিছু খবর নেই। কেবল একটা দোকানের শোকেস ভাঙা ছাড়া। আপনি এ ব্যাপারে আর চিন্তা করবেন না। যাদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তারাই এমন গোছের মস্করা করে। এসব তুচ্ছ ব্যাপার এ বয়সে আর ভাববেন না। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। তাই একটু দেখা করে গেলাম।

জ্যাপের কথার ধরন-ধারণে বোঝা গেল ওর আচরণের কোনো রদবদল হয়নি।

 বললাম–তাহলে তোমার চিঠির ব্যাপারটা পর্বতের মুষিক প্রসবের নামান্তর।

পোয়ারোর ঠোঁটে শুকনো একটু হাসির ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

–এরকম আশা করিনি আমি, ভুল হয়ে গেলো।

বেশ তো, এটা ছেড়ে অন্য কোনো রহস্যের সন্ধান কর। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম।

-ঠিক আছে। পোয়ারো বললো, যখন সত্যি রহস্য পেলাম না, তখন এসো আমরা একটা নকল রহস্য সাজাই।

আমি বললাম-ধরা যাক, প্রথমে একজন পুরুষ খুন হবে। তিনি হলেন খবরের কাগজের মালিক। রাজনীতিও করেন না, ব্যাবসা করেন না। রক্তাক্ত দেহে লাইব্রেরির ছোট্ট টেবিলে তাকে পড়ে থাকতে দেখা গেল।

মনে কর পিস্তল দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় পাওয়া গেলো একটি মেয়েকে। যার সঙ্গে লোকটির প্রেমের খেলায় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো, এছাড়া রয়েছে, একজন বয়স্কা মহিলা, একজন সেক্রেটারি, আর একজন যুবক যে প্রেমের খেলায় লোকটির প্রতিপক্ষ। এছাড়া এক ধাপ্পাবাজ বয়স্ক লোক, ছাঁটাই হওয়া কিছু কাজের লোক এবং জ্যাপের মতো বোকা মাথাওয়ালা একজন গোয়েন্দা। ব্যাস, গল্পের এখানেই ইতি।

শেষ? পোয়ারো হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, এ তো সেই চিরাচরিত গল্প হেস্টিংস। একটা নতুন গল্প বানাও।

–আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমিই নতুন গল্প বলল।

-বেশ, তাই হোক, তবে আমার গল্পে কোনো জটিলতা নেই। কোনো আবেগ টাবেগের সহবাস নেই সেখানে। সাদামাটা যেমন হওয়া উচিত তেমনই অপরাধজনক গল্প।

মনে করো, একটি ঘরে চারজন লোক বসে ব্রিজ খেলছে। ফায়ারপ্লেসের পাশে একটি চেয়ারে আর একজন লোক বসে আছে। সন্ধে নাগাদ ঘটে গেল অঘটন। পঞ্চম লোকটি খুন হয়েছে। চারজনের মধ্যে একজন ডামি অবস্থায় খেলার মাঝখানে উঠে গিয়ে তাকে খুন করেছে। খেলার ঝোঁকে সেটা অন্যদের নজরে পড়েনি। এখন প্রশ্ন হলো, খুন করলো কে?

পোয়ারোর গল্প শুনে আমি একটুও উত্তেজিত হলাম না।

পোয়ারো সেটা লক্ষ্য করে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকালো–হেস্টিংস, তোমরা লেখকরা এখন সস্তা জিনিসকে ভালোবেসে লিখছে। তোমরা অনেক খুনের গল্প চাও।

–কথাটা ভুল নয়। প্রথম খুনের পর পাঠককে ধরে রাখার জন্য দ্বিতীয় খুনের প্রয়োজন হয়। কথার মাঝে ফোন বেজে উঠলো, পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলো। দু-মিনিট পরে সে নিজের জায়গায় ফিরে এলো। অমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।

তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নিজে বললো–জ্যাপ ফোন করেছিলো। ও এখান থেকে এ্যাভোর থানায় যায়। সেখানে একটা ঘটনা ঘটেছে। রাস্তার পাশে সিগারেট, খবরের কাগজের দোকানের সামনে এ্যাম্বার নামে এক বয়স্কা মহিলা মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

-খুনই যখন করলো তখন বুড়িকে না করে একটা চুঁড়িকে করতে পারতো।

–এ্যান্ডোভারের পুলিশের ধারণা, খুনী তাদের অজানা নয়। তারা তাকে যখন খুশী গ্রেপ্তার করতে পারে। পোয়ারো গম্ভীর কণ্ঠে জানালো, মনে হয় স্বামীর সঙ্গে মহিলাটির বনিবনা ছিলো না। অপদার্থ মাতাল স্বামী স্ত্রীকে সর্বদা খুন করবে বলে ভয় দেখাতো।

লোকটিকে ধরার আগে পুলিশ পোয়ারোর চিঠিটা দেখতে চায়। তাই আমরা রোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ঘণ্টাখানেকের পথ। পোয়ারো গাড়িতে উঠে কেবল একটাই কথা বললো–হেস্টিংস, এই শুরু। থানায় গিয়ে হাজির হতেই পুলিশ ইনসপেক্টর হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ছফুট দশাসই চেহারর সদালাপী মানুষ। আমরা তার ব্যবহারে খুশী হলাম।

আমাদের খুনের বর্ণনা করলো। সে বলতে তাকে–খুনটা হয়েছে বাইশ তারিখ ভোরে। আমাদের একজন কনস্টেবল ডোভার মৃতদেহ আবিষ্কার করে। সে তার দোকানের খোলা দরজার কাউন্টারের সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। মেডিকেল রিপোর্টে জানা গেছে, আচমকা তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করা হয় এবং কোনো ভারী অস্ত্র দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এবং ছটা বেজে পাঁচ মিনিটে দুজন ক্রেতা দোকানে গিয়েছিলো। তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই বলা যেতে পারে ঐ সময়ের মধ্যে মহিলা খুন হয়েছে। কিন্তু এই পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে মহিলার স্বামীকে তার দোকানের ধারে-কাছে দেখা যায়নি। রাত নটার সময় ফ্রি ক্রাউন্স শুড়িখানায় তাকে দেখা গেছে।

মহিলার স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে পোয়ারো কৌতূহল প্রকাশ করলে ইনসপেক্টর জানালো ভদ্রলোক জাতে জার্মান। আগে খানসামার কাজ করতো। কিন্তু মাতলামির জন্য সে চাকরি তাকে হারাতে হয়। অগত্যা মিসেস এ্যাম্বার কি করবেন, কাজে নামতে হলো। মহিলা যা রোজগার করতো সব অর্থ ঐ মাতালটার হাতে দিয়ে দিতো। তবু তার মন ভরত না। মিস রোজের বাড়িতে মিসেস এ্যাম্বার কাজ করতে গেলো। তারপর মিস রোজ মারা যায়। ঐ সময় মহিলা কিছু অর্থ পায়। সেই অর্থ নিয়ে শেষে এই সিগারেট, খবরের কাগজের দোকান খোলে। মহিলার তবুও শান্তি ছিলো না। যখন তখন তার স্বামী দোকানে এসে হামলা করতো। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে মহিলা তাকে সপ্তাহে পনেরো শিলিং হাতখরচা দিতে শুরু করে। ওদের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। তবে মিসেস এ্যাম্বারের একটি সুন্দরী বোনঝি আছে।

–দোকান থেকে কোনো জিনিস চুরি যায়নি? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।

–না।

–তাহলে উন্মত্ত অবস্থায় দোকানে ঢুকে গালিগালাজ করে স্ত্রীকে হত্যা করে!

–আপাতত তাই মনে হয়। পুলিশ ইনসপেক্টর গ্লেন এবার পোয়ারের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে চোখ বোলালো। তারপর বললো–লোকটি জার্মান। তাহলে আমাদের ব্রিটিশ পুলিশ লিখবে কেন? তাছাড়া ওর মতো উন্মত্ত মাতাল লোকের পক্ষে টাইপ করা সম্ভব নয়। হয়তো তারিখটার সঙ্গে…এটা একটা নিছক কাকতালীয় ব্যাপার।

–সেটাই স্বাভাবিক পোয়ারো বললো; কিছুক্ষণ কি ভেবে তারপর জানতে চাইলো, মিসেস এ্যাম্বারের সঙ্গে তার আলাপ এবং বিবাহ।

এই সময় একজন কনস্টেবল ঘরে এসে ঢুকলো–মিঃ এ্যাম্বারকে থানায় আনা হয়েছে।

 এ যেন দারিদ্র্য ও লাম্পট্যের এক প্রতিমূর্তি, কানসৎ এ্যাম্বারকে দেখে তাই মনে হলো।

গ্লেনকে দেখে লোকটি ভীষণভাবে চটে গেলো। চিৎকার করে বললো, এসব কি ইতরামি। জানেন, আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা করতে পারি। আমি খুন করিনি। একটুক্ষণ থেমে নিজেকে সংযত করে বললো, কিছু মনে করবেন না। এই ছোট্ট শহরে একজনও আমার মতো বুড়ো মানুষকে দয়া দেখায় না। ভালো ফর্মে না। এরপর লোকটি কেঁদে ফেললো।

গ্লেন বললো–থানায় তোমাকে আনা হয়েছে ঠিকই, তাই বলে তুমি যে দোষী সেটা প্রমাণ হচ্ছে না। যতক্ষণ না বিচার করে দেখা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যায় না, তোমার স্ত্রীর খুনী তুমি।

এ্যাম্বার দুম করে ক্ষেপে গিয়ে বললো–আপনারা, গোটা ইংরেজ জাতটা আমার পেছনে লেগেছেন, আমি আবার বলছি, তাকে আমি খুন করিনি। অবশ্য তাকে আমি খুন করার ভয় দেখাতাম ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিলো আমার তামাশা, এ্যালিন্সও সেটা ভালো করে জানতো। আমি কাল তার ধারেকাছে যাইনি। তার সঙ্গে কার্ডি, জর্জ, প্ল্যাট ছিল।

গ্লেন ইশারায় তাকে লকআপে বন্দী করতে বললো।

–আচ্ছা, ও যেসব লোকের নাম বললো, তারা কারা?

কারা আবার? ওরই মতো লম্পট শয়তানের দল।

–দোকান থেকে কি কোনো জিনিস চুরি যায়নি, আপনি নিশ্চিত?

হ্যাঁ, টাকাপয়সা খোয়া যায়নি। তবু দু-এক প্যাকেট সিগারেট সরলেও সরতে পারে।

–আচ্ছা, দোকানের অসামঞ্জস্য কোনো কিছু আপনার দৃষ্টিতে পড়েনি। পোয়ারো প্রশ্ন করলো।

কাউন্টারে একটা বই খোলা অবস্থায় পড়েছিলো, রেলওয়ে গাউড। যে পৃষ্ঠা দুটো খেলা ছিলো, তার মধ্যে এ্যান্ডোভারে যাওয়া-আসার ট্রেনের তালিকা ছিলো। মিসেস এ্যাম্বার এক পেনি দামের পকেট গাইড রাখতো।

সহসা পোয়ারোর চোখ খুশীতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে বললো–এটা কী ব্রাডশ না এ.বি.সি.?

পোয়ায়োর আগ্রহ দেখে গ্লেন বিস্মিত হলো-ওটা এ.বি.সি.।

.

মৃতদেহ দেখার জন্য পোয়ারো মর্গে গেল। মহিলার মৃত মুখটা দেখে পোযারোর দুঃখ হলো। সঙ্গের সার্জেন্টটি জানালো–যে অস্ত্রের সাহায্যে ওকে খুন করা হয়েছে সেটা পাওয় যায়নি।

পোয়ারো ডঃ কারকে জিজ্ঞেস করলো, যেটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা ব্যবহার করতে কি অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়?

-না, তেমন কোনো বলপ্রয়োগ করতে হয় না।

–তাহলে খুনী পুরুষ বা মহিলা, যে কেউ হতে পারে। পোয়ারো বললো।

–সব কিছুই সম্ভব। তবে কি জানেন, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সাধারণ নিয়মে পুরুষের কথাই আগে মনে আসে। কাউন্টারে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতে দেখে ছটা পাঁচের কোন ক্রেতা তাকে দেখতে না পেয়ে চলে যায়।

মৃতদেহ দেখা শেষ করে পোয়ারো সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

ধরা যাক, এ্যাম্বার দোকানে গিয়ে বৌকে গালিগালাজ করেছিলো। সেটা নিশ্চয়ই পেছন থেকে নয়। সামনাসামনি ঘটবে। যাই হোক, তার আগে আমরা মিসেস এ্যাম্বারের বোনঝি-র সঙ্গে আলাপ করে আসি।

ঠিকানা নিয়ে আমরা নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলাম। যেমন-তেমন বাড়ি নয়, অট্টালিকা, একজন সুন্দরী মেয়ে দরজা খুলে দিলো। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মেরি ডোয়ার কিনা?

–হ্যাঁ, আমিই মেরি।

সে আমাদের বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলো। জানতে পারলাম, বাড়ির লোকেরা কেউ নেই। আমরা একটা ছোট্ট ঘরে গিয়ে বসলাম।

-তোমার মাসির মৃত্যু সংবাদ তুমি নিশ্চয় পেয়েছে। পোয়ারো বললো।

–হ্যাঁ, আজ সকালে খবরটা পেয়েছি। মেয়েটির গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো।

–পুলিশ তোমাকে এ্যান্ডোভারে যেতে বলেনি?

–হ্যাঁ, বলেছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেতে যেতে পারি না। যার চাকরি করি তার মতামত না পেলে যেতে পারি না।

–মাসিকে তো তুমি ভালোবাসতে।

-হ্যাঁ, মা-কে হারাবার পর আমি আমার মাসির সঙ্গে লন্ডনে পাঁচ বছর কাটিয়েছি। তারপর আমি চাকরি জীবন শুরু করি। তখন অন্তত সপ্তাহে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। জানেন, ঐ হতচ্ছাড়া জার্মানটাকে নিজের মেসোমশাই ভাবতে গা ঘিন ঘিন করে। মাসিকে সব সময় তিনি ভয় দেখাতেন, বলতেন, গলা কেটে ধড়-মুণ্ডু অলাদা করে দেবে। ছুরি মেরে খুন করবে।

-আচ্ছা, তোমার মাসির খুন হওয়ার খবর পেয়ে তোমার প্রথমে কি মনে হলো?

পোয়ারো তার কাছে জানতে চাইলো।

-প্রথমে কথাটা বিশ্বাস হয়নি। কারণ আমার মেসোমশাই মুখেই লম্ফঝম্ফ করতো। কিন্তু আসলে লোকটা একটা ভীতুর ডিম।

-ধরো, তোমার মাসিকে তোমার মেশোমশাই খুন করেনি।

করেনি?

এ.বি.সি. মার্ডার–আমি নিশ্চিত নই। এটা ধরে নিচ্ছি। খুনী কে, এ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?

–না না, আমরা এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

–আচ্ছা, তুমি বলতে পারবে, তোমার মাসির নামে কোনো টাইপ করা চিঠি আসতো কিনা?

-না, আমি ছাড়া মাসির কোনো জীবিত আত্মীয় নেই।

–তোমার মাসির সঞ্চয়?

–সেই টাকা দিয়ে মাসির সংসার চালানো ছাড়া আর কিছু হবে না।

–আচ্ছা মেরি, তোমাকে পরে আমার দরকার হতে পারে, পোয়ারো বললো, তোমাকে এই ঠিকানায় চিঠি দিতে পারি তো?

-না, এ শহরে আর কি করতে থাকবো? আমার মাসি-ই যখন রইলো না। আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমি ঠিক করেছি, এখান থেকে লন্ডনে চলে যাবো।

–বেশ, যাওয়ার আগে তুমি আমার এই ঠিকানায় যোগাযোগ করে তোমার হদিশ জানিও।

–আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

–তাহলে মাসির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কি কোনো অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে?

–হ্যাঁ, আমরা তোমার কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারি কি?

নিশ্চয়ই, আমি রাজী।

এবার আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাজির হলাম মিসেস এ্যাম্বারের দোকানে। এই সময়ে আমার উদ্দেশ্যটা হলো, পোয়ারো ঠিক কালকের পরিবেশটা তৈরি করতে চেয়েছিল, আজ রাস্তাটা ফাঁকা। তবে খানিক বাদে লক্ষ্য করলাম জায়গায় জায়গায় কয়েকজন মিলে জটলা করতে। দোকানের সামনে সব বয়সের লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। উল্টোদিকের ফুটপাথ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে দোকানের নামটা লক্ষ্য করলাম।

এ. এ্যাম্বার।

ভিড় সরিয়ে আমরা দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। পুলিশও রয়েছে সেখানে, দোকানে একটা স্তিমিত আলো জ্বলছে। ফলে পরিবেশটা কেমন ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। কয়েকখানা সস্তা দামের ম্যাগাজিন দোকানের একপাশে পড়ে আছে যেগুলো গতকাল বিক্রি হয়নি। কাউন্টারের ওপর এক কোণে দুটো কাঁচের জার। একটাতে পিপারমেন্ট ও অন্যটাত মিহিদানার চিনি রয়েছে।

রেলওয়ে গাইডটা কোথায় ছিল সেটা কনস্টেবলের কাছ থেকে জানা গেল। সে বললো-মনে হয় লন্ডনে যাওয়ার ট্রেনের সময় খুনী ঐ গাইডবুক দেখছিলো বা কোন ক্রেতা ভুল করে ওটা ফেলে রেখে গেছে।

আমি এবার প্রশ্ন করলাম–কোনো হাতের ছাপ পাওয়া গেছে?

-না স্যার। তবে কাউন্টারের ওপরে কয়েকটি হাতের ছাপ এমনভাবে জড়িয়ে আছে যা থেকে চেষ্টা করেও কিছু উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

এবার আমরা দোতলায় গেলাম যেখানে মিসেস এ্যাম্বার থাকতো। জায়গাটা বেশি বড় নয়। তবে পরিপাটি করে সাজানো। অগ্নিকুণ্ডের ওপরে একটি ছোট স্ট্যান্ডে তিনখানা ছবি রাখা। একটা মেরির ফটো, দ্বিতীয়টি এক বয়স্কা মহিলার। হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট রয়েছে। পরনে দামী ফারের কোট। বেশ সচ্ছল ঘরের মহিলা সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল। ইনি বোধহয় মিস রোজ। তৃতীয়টি বহু পুরানো। এক যুবক ও এক যুবতী হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে, যুবকের পকেটে একগুচ্ছ গোলাপ শোভা পাচ্ছে। মনে হয় কোনো আনন্দ উৎসবে ছবিটি তোলা হয়েছিলো।

পোয়ারো বললো–এই ছবিটা মিঃ এবং মিসেস এ্যাম্বারের বিয়ের ছবি।

পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। একেবারে ফাঁকা। কোনো আসবাবপত্র নেই তবে বাঁপাশে একটা ছোট শেলফ, তাতে কিছু বাসনপত্র রয়েছে এবং পোশাক রয়েছে কিন্তু খুঁজে পেতে কোনো চিঠি পাওয়া গেল না।

আমরা এ. এ্যাম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। উল্টোদিকের ফুটপাথে একটি মেয়ে বসে আনাজপত্র বিক্রি করছিল, পোয়ারো তার দিকে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে সে কিছু সবজি কিনলো, তারপর মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বললো–আপনার দোকানের সামনে এরকম একটা খুন হওয়ায় আপনি ভীষণ ঝামেলায় পড়েছেন তাই না?

-কি আর বলবো। সকাল সন্ধে সবসময় তোক গিজগিজ করছে। কিন্তু কাল যদি এত লোকের ভিড় এখানে থাকতে হয়তো খুনটা হত না। অমন লম্বাচওড়া দাড়িওয়ালা লোকটা দোকানে ঢুকে কেমন করে খুন করে বেরিয়ে গেল…।

-তাই নাকি? আপনাকে কে বললো?

-কে আবার বলবে? লোকে কানাকানি করছে, তাই শুনছি। পুলিশ নাকি তাকে হাতকড়া পরিয়েছে। আহা-হা, শেষ পর্যন্ত বুড়িটার একটা উটকো লোকের হাতে মরণ হলো।

-আপনি কি তাকে দেখেছেন?

-না, সুযোগ বা সময় হয়নি। দোকানে সব সময় খদ্দেরের ভিড়। তবে দাড়িওয়ালা কাউকে আমার নজরে পড়েনি।

–ভুল শুনেছেন, আমি কথা বলে উঠলাম, লোকটা মোটেই দশাসই চেহারার নয়।

লক্ষ্য করলাম, আমার এই কথা শুনে আরো লোক দাঁড়িয়ে পড়লো। তবে প্রত্যেকে যা বললো, তার মূল কথা হলো বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত প্রায় জনা চারেক কালো রোগা বেঁটে চোহারার লোক দোকানে ঢুকেছে।

আসলে পোয়ারোর উদ্দেশ্য ছিল কায়দা করে জেনে নেওয়া যে ঐ দোকানে অচেনা লোক ঢুকেছিল কিনা।

-ভণিতার প্রয়োজন ছিলো, নতুবা কোনো ইংরেজ মুখ খুলতে না। পোয়ারো বললো। শামুকের মতো নিজেদের খোলর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবে। কিন্তু এলোমেলোভাবে কিছু বলতে সব কথা হুড়মুড় করে বলে যাবে।

এরপর আমরা একটা ছোটো টিলার ওপর উঠলাম। লক্ষ্য করলাম ওখান থেকে মিসেস এ্যাম্বারের দোকানটা দেখা যায় কিনা। হ্যাঁ, দোকানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পোয়ারো একটা মাঠকোঠা বাড়ির দরজায় করাঘাত করলো। একটা ছোটো ছেলে এসে দরজা খুলে দিলো। পেছনে পেছনে তার মা এসে জানালো–আমরা কিছু নেবো না।

–আমরা ইভনিং ফ্লিকার পত্রিকার তরফ থেকে আসছি। পোয়ারেরা মিথ্যের আশ্রয় নিলো। মৃত এ্যাম্বার সম্পর্কে আমরা কিছু আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। বিনিময়ে আপনি পাঁচ পাউন্ড পাবেন।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মহিলার মধ্যে খুশী লক্ষ্য করলাম। তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো।

মহিলা নিজের পরিচয় দিলো।

মিসেস ডরোথি, ডরোথি ফাউলার।

 পোয়ারো তার সামনে টাকাটা মেলে ধরলো। মহিলা বলে চললো-মিসেস এ্যাম্বার তেমন মিশুকে ছিলো না। রাত আটটায় দোকান বন্ধ করে নিজের ঘরে সেই যে ঢুকতো আর বেরোতে না। তার স্বামীটা ছিলো মাতাল, লম্পট। ফলে মহিলাকে অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হত। শেষ পর্যন্ত ঐ শান্ত মহিলাটিকে খুন করে মাতালটা তার কষ্টের অবসান ঘটালো।

–আচ্ছা, আপনি কি জানেন, মিসেস এ্যাম্বার কোনো বেনামী চিঠি পেতেন কিনা?

একটুক্ষণ চুপ করে মিসেস ডরোথি বললো, গালমন্দে ভরা চিঠি? না, সেরকম কিছু আমার কানে আসেনি।

-কাল কোনো সময়ে মিঃ এ্যাম্বারকে দোকানের আশেপাশে দেখেছেন?

–দেখবো কি করে? চোরের মতো এসে নিজের কাজ সেরে সরে পড়েছে।

আশানুরূপ কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। তবুও কথামতো পোয়ারো তার হাতে টাকা দিলো।

ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা থানায় এলাম। গ্লেনকে দেখলাম, খুব ক্লান্ত লাগছে। সারাদিন তার অনেক ধকল গেছে। দোকানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যেটা বোঝা গেছেমিঃ এ্যাম্বারকে কেউই চোখে দেখেনি। অতএব ঐ নামের তালিকা থেকে দুটো নাম নোট করে নিয়ে আমরা থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

বড় রাস্তার ওপরে মিঃ পাত্রিজের বাড়িতে প্রথমে গিয়ে ঢুকলাম। তিনি মিসেস এ্যাম্বারকে শেষ জীবিতাবস্থায় দেখেছিলেন সাড়ে পাঁচটায়, সিগারেট তামাক কিনতে গিয়ে। তবে শেষ দেখা কথাটার ওপর তিনি ভীষণ জোর দিলেন। তার মতে, তার পরেও দোকানে অনেকে জিনিস কিনতে গিয়েছিলো।

–ঠিক বলেছেন। তবে তাদের কেউই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি। পোয়ারো বললো।

-আসলে কি জানেন মিঃ পোয়ারো, আমার মতো কর্তব্যজ্ঞান অনেকের নেই। সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করে খুনিকে ধরতে পুলিশের সুবিধা হবে বলেই আমি মনে করি। তিনি বলে চললেন, আমি যখন ওর দোকানে ঢুকলাম। তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটার ঘণ্টা পড়ে। আমি মাঝে মাঝেই ঐ দোকানে যেতাম। আমাদের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক ছিলো।

–আচ্ছা, তার স্বামী যে তাকে খুন করবে বলে শাসাতো, সেটা কি আপনি শুনেছেন?

–ওর যে স্বামী আছে সেটা আমার অজানা ছিলো। আপনার মুখে এই প্রথম কথাটা শুনলাম।

–আচ্ছা, তাকে কোনোদিন চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হতে দেখেছেন?

–না, যতদুর মন পড়ছে, ঐদিন তাকে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক দেখেছিলাম।

আমরা দরজার দিকে ফেরার জন্য পা বাড়ালাম। হঠাৎ পোয়ারো থমকে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলোআপনার কাছে কি এ.বি.সি. গাইড আছে? যদি দেন, তহলে লন্ডনে ফেরার সময়টা..

এতে এত দ্বিধা করার কি আছে? আপনার পেছনের শেলফে গাইডটা আছে। শুধু এ.বি.সি. নয় ব্রাড়শ থেকে শুরু করে ইয়ার বুক পর্যন্ত আপনি পাবেন।

আট পৃষ্টায় এ্যান্ডোভার ট্রেনের সময় দেখার আছিলা করে খানিকক্ষণ এলোমেলোভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করে ওখান থেকে চলে এলাম।

এরপর আমরা চিনেমাটির বাসন প্রস্তুতকারী আলবার্ট রিডিলের সঙ্গে দেখা করলাম। বাড়ির বাইরে তার কারখানা। পোয়ারো তার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্য জানালো।

জবাবে লোকটি বললো–ঐ ব্যাপারে পুলিশকে যা বলার বলেছি। আপনারা বরং তাদের কাছ থেকে দরকার মতো জেনে নেবেন। আপনি ভাবলেন কি করে, যে যখন যা জানতে আসবে তার সঙ্গেই আমি কথা বলতে বসে যাবো। আমার কি কোনো সময়ের দাম নেই? এটা আপনারা ভাবলেন কি করে? রিডেল প্রায় ধমকের সুরে বললো।

তারপর তর্কের মধ্যে দিয়ে মিঃ রিডেল জানালো, গতকাল সন্ধে ছটার সময় যখন সে দোকানে গিয়েছিলো তখন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ ছিলো, একটু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে কাউন্টারে কাউকে দেখতে না পেয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো মৃতদেহ তার নজরে পড়েনি। তবে কাউন্টারে একটা রেলওয়ে গাইড তার নজরে পড়েছিলো।

পোয়ারো একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলো।

বিরক্ত হয়ে রিডেল বললো, আমি এমন কি সন্দেহজনক কাজ করেছি, যার জন্য আপনারা আমার পেছনে লেগেছেন?

–অত ঘাবড়াবার কিছু নেই, পোয়ারো গম্ভীরভাবে বললো–সব জানবেন, খুব শীগগির জানবেন, আজ আসি।

ট্রেন ধরার তাড়া আছে আমাদের। তাই দেরি না করে ওখান থেকে চলে এলাম, প্রথম শ্ৰেণীর কামরায় আমরা কেবল দুজন।

পোয়ারো চোখ বন্ধ করে বললো, আমাদের ঐ অপরাধীটি লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট। মাথার চুল কালো, বাঁ চোখটা একটু ছোটো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কাঁধ বরাবর নিচের দিকে একটা তিল আছে।

আততায়ীর চেহারার বর্ণনা ওর মুখে শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।

সে আবার বলতে থাকে–প্রকৃতপক্ষে আততায়ীর বিন্দুমাত্র পরিচয় আমার জানা নেই। সে কোনো সূত্র আমাদের জন্য রেখে যায়নি। এমনকি সিগারেটের ছাইও পাওয়া যায়নি। চালাক আছে লোকটা, কি বলো হেস্টিংস। তবে গাইডটা সে-ই ফেলে গেছে, এবং এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু গাইডে হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। সে তার সম্পর্কে কিছু পরিচয় জানাতে না চাইলেও সে প্রমাণ করতে চায় যে সে ভীষণ চালাক। গাইড বুকটা তারই প্রমাণ। তবে ওর সম্পর্কে একটা ধারণা আমি মনে মনে তৈরি করেছি।

…যে দামী কাগজ ছাড়া কাগজ কেনে না, যে টাইপ করার সময় অতিরিক্ত যত্ন নেয়। নিজের ব্যক্তিত্ব বা নিজের শক্তি লোককে জাহির করে, তেমন লোকের বিবেকবোধ বা ন্যায়-অন্যায়ের বিচার থাকে না। সে শয়তান, বদ্ধ উন্মাদ, সে খুনী। আচ্ছা হেস্টিংস, তুমি কি অনুমান করতে পারো, সে কেন এ.বি.সি. গাইড, কেন এ্যাভোভার, আর কেনই বা মিসেস এ্যাম্বারকে বেছে নিলো? আসলে মিঃ পাত্রিজ ও মিঃ রিডেলকে খুনী সন্দেহ না করার কোনো কারণ নেই। খুনী হয়তো এ্যান্ডোভারের লোক নয়, এটা ভাবা নিষ্প্রয়োজন। এ্যান্ডোভারের লোকের কাছেও গাইড থাকে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

-যদি তোমার অনুমান সত্যি হয়, আমি বলতে থাকি, তাহলে আমি একবাক্যে বলতে পারি ঐ মেদী রিডেলই হলো খুনী।

-না, সে সন্দেহের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে। লোকটা যেমন ভীতু তেমনি কাণ্ডজ্ঞানহীন। অমন লোকের পক্ষে খুন করা সম্ভব নয়। এখানে খুনী হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে পার্জিজকে। বেনামী চিঠি থেকে শুরু করে খুনের পরিকল্পনা করা সবই তার স্বপক্ষে যাচ্ছে। তবুও প্রমাণের অভাবে আমার কিছু করার নেই। হাত-পা বাঁধা, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, খুনী এ্যান্ডোভারের লোক নয় এবং সে যে কোন লিঙ্গের মানুষ একথাও বলতে পারি না।

পোয়ারো চুপ করে রইলো, আমিও বোবা হয়ে রইলাম। আমি তাকে বারে বারে লক্ষ করলাম। বুঝলাম, সে এই ঘটনাটা প্রায় ভুলতে বসেছে। অমি চুপ করে বসে থাকতে না পেরে প্রসঙ্গ তুলতেই সে আমার দিকে এমনভাবে দৃষ্টি হানলো যে মুখ বন্ধ না করে কোনো উপায় নেই।

আমি আপন মনে ভাবতে লাগলাম, মিসেস এ্যাম্বারের খুনকে কেন্দ্র করে এ.বি.সি.-র যে চ্যালেঞ্জ তাতে সে হেরে গেছে বলেই হয়তো এই বিষয়ের আলোচনার সূত্রপাতেই ক্ষেপে ওঠে।

আমার ইচ্ছে না থাকলেও পোয়ালরার অনুরোধে জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমাকে ইয়র্কশায়ারে যেতে হলো। কিছুদিন ওখানে কাটিয়ে তেইশ তারিখ বিকেলে ট্রেন ধরে আমি লন্ডনে ফিরে এলাম।

চায়ের কাপ নিয়ে সবে বসেছি এমন সময় পোয়ারো এগিয়ে এসে একটি খাম আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

–এটি এ.বি.সি.-র দ্বিতীয় চিঠি। পোয়ারো বললো, পড়ে দেখো।

লন্ডনে কিছুদিন না থাকার ফলে এই ব্যাপারটা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। খামটা হাতে পেয়ে আমার মন নড়েচড়ে উঠলো। কাগজ, টাইপ সবই আগের মতো। কেবল চিঠির মধ্যেকার লেখাটা যা তফাত। এখানে একটা কথা চাবুকের আঘাতের মতো মনে হলো।

চিঠিটা এইরকম—

 নমস্কার পোয়ারো মশাই।
ভালো আছেন তো? অবশেষে আপনি বিফল হলেন। এ্যান্ডোভারের খেলাটা দেখে নিশ্চয়ই হতবাক হয়েছেন তাই না? আপনার নিশ্চয়ই আফশোস হচ্ছে। বাজি রাখলে আপনার কাছ থেকে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নেওয়া যেতো।
…অবশ্য আফশোস বললে ভুল বলা হয়। বাজি রাখার মতো সুযোগ হবে ভবিষ্যতে। গোয়েন্দাপ্রবর, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। কলির সবে তো সন্ধে।
..আগামী পঁচিশ-তারিখ তাহলে বেক্সহিলে দুজনের দেখা হবে। সমুদ্রের ধারে খেলাটা দারুণ জমবে বলে মনে হয়।
…ভেবে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, জানেন। আপনি উৎফুল্ল হচ্ছেন না?
ইতি বশংবদ
এ.বি.সি।

আমি চিঠিটার আদ্যোপান্ত পড়ে মন্তব্য করলাম–এ যে দেখছি, আরকেটি খুনের হুমকি।

 –সেই রকমই তো মনে হচ্ছে।

পরদিন সকালে আমরা হাজির হলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। গোয়েন্দা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার স্যার লায়নেলের ঘরে আমাদের জরুরি আলোচনা হলো, সেখানে উপস্থিত ছিলো সাসেক্সের চিফ কনস্টেবল, এ্যান্ডোভারের ইনসপেক্টর গ্লেন, সুপারিনটেনডেন্ট কার্টার জ্যাপ, ইনসপেক্টর ক্রোম এবং বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ববিদ ডঃ টম্পসন।

দ্বিতীয় চিঠিটায় হ্যাম্পস্টেড পোস্টাফিসের স্ট্যাম্প লাগানো আছে। দুটো মেলানো হলো। দেখা গেলো একজন লোকই পাঠিয়েছে দুটো চিঠি এবং একই টাইপরাইটার মেশিনে টাইপ করা হয়েছে। চিঠি পড়ে এটা বোঝা গেল যে পঁচিশে জুলাই বেক্সহিলে আর একটি খুন অনুষ্ঠিত হবে।

পোয়ারো বললো, আমার অনুমান, খুনীর নামের পদবীর প্রথম অক্ষর ব, এটা আমার অনুমান। মিসেস এ্যাম্বারের দোকানে গিয়ে এই চিন্তা আমার মাথায় প্রথম আসে। এখন দ্বিতীয় চিঠি পড়ে আমার অনুমান ঠিক সেটা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

বরং একটা কাজ করো, স্যার লায়নেল বললো, বেক্সহিলের ব পদবীধারী লোকেদের নামের একটা তালিকা তৈরি করো। সিগারেট আর খবরের কাগজ বিক্রির ছোটো দোকানগুলোর ওপর কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা করো। অজানা অচেনা কাউকে বেক্সহিলের ধারে-কাছে দেখলে তাকে সোজা ধরে নিয়ে এসে থানায় ভরে দাও তারপর জিজ্ঞাসাবাদ করো।

–মিসেস এ্যাম্বারের খুনের ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে পাত্রিজ ও রিডেল আছে। তারা যদি এ্যান্ডোভার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবো। গ্লেন বললো।

আলোচনা শেষ করে আমরা বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

পথে যেতে যতে আমি বললাম, এবারের খুনটা হয়তো আটকানো যাবে।

পোয়ারো চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো–যেহেতু শহরসুদ্ধ লোক এই পাগলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তাই একথা তুমি বলছো। কিন্তু আমার তবু ভয় হচ্ছে।

-ভয়?

–হ্যাঁ, পাগলারা সব কাজ নির্দ্বিধায় করতে পারে। সেখানেই আমার ভয়।

বেশ আরামে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশ ফিরতে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি পোয়ারো উৎকণ্ঠিত মুখে বসে আছে। আমি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। আজ পঁচিশে জুলাই। এখন সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। বন্ধুর উদ্বেগ লক্ষ্য করে আমি শেষ পর্যন্ত জানতে চাইলাম–

–তোমার কি হয়েছে, পোয়ারো?

–যা হবার তাই হয়েছে। পোয়ারোর ঠোঁট কাঁপছে। আজ ভোরের দিকে বেহিলের সমুদ্রতটে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মৃতের নাম এলিজাবেথ বার্নার্ড। সামানেই একটি কাফেতে সে ওয়েটারের চাকরি করতো। সে ঐ শহরে বাবা-মার সঙ্গে বাস করতো। ডাক্তারি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, রাত সাড়ে এগারোটা থেকে একটার মধ্যে কাজটা করা হয়েছে। এবারেও একটা এ.বি.সি. গাইড পাওয়া যায় মৃতদেহের কাছ থেকে।

এরপর কুড়ি মিনিটে কেটে গেল। আমরা ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলো অনেক খুনের সমাধান করে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে সেই ইনসপেক্টর ক্রোম। যুবক বয়স। কিন্তু কথাবার্তায় বা চালচলনে একটা অহংকার লক্ষ্য করা যায়। বেশ কিছু নিজের কাজ সম্পর্কে জাহির করে বললো।-বেক্সহিলের খুনের ব্যাপারে কিছু জানার থাকলে আমি বলে দিতে পারি।

বেশ তো, মেয়েটার সম্পর্কে কিছু বলুন। পোয়ারো জানতে চাইলো।

-ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানার নেই। ক্রোম বললো, বয়স হবে প্রায় তেইশ বছর। জিজ্ঞার ক্যাট কাফেতে ওয়েটারের চাকরি করতো।

–তারা চেহারা?

–তাকে দেখিনি, অতএব বলতে পারবো না। ক্রোম কেমন বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো।

মেয়েটি কিভাবে খুন হলো, সেটা কি আপনি জানেন?

–শাসরুদ্ধ করে তাকে খুন করা হয়। একটি বেল্ট যেটি তার নিজের কোমরে ছিল। সেই বেল্ট দিয়ে খুনী তার গলায় ফাঁস লাগায়।

–এই খবরটুকুর ওপর নির্ভর করে তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। পোয়ারো মন্তব্য করলো।

–কিভাবে? ক্রোম হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলো।

-এটা তো না বোঝার কিছু নেই, আমি বললাম। একনম্বরের বদমাস না হলে কেউ কখনো কারো গলায় বেল্ট জড়িয়ে দমবন্ধ করে মারতে পারে? আমি পোয়ারোর দিকে তাকালাম।

পোয়ারো আমাকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বললো। আমি কথা না বাড়িয়ে থেমে গেলাম।

ওখানে পৌঁছানোর পর কার্টারের কাছে জানতে পারলাম, মেয়েটির বাবা এই ঘটনায় ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদ আপাতত করা যাচ্ছে না।

-বাবা-মা ছাড়া মেয়েটির আর কোনো আত্মীয় আছে? পোয়ারো জানতে চাইলো।

-হ্যাঁ, এক বোন আছে। লন্ডনে থাকে। কোনো এক অপিসে টাইপিস্টের কাজ করে। আত্মীয়ের মধ্যে আর এক যুবক ছিল, যার সঙ্গে গতকাল রাতে ওর দেখা করার কথা ছিল। কার্টার জানালো।

সুযোগ বুঝে ক্রোম প্রশ্ন করলো, এ.বি.সি. গাইড থেকে কি কিছু পাওয়া গেছে?

-না, কেবল মৃতদেহের পাশে ওটি ভোলা অবস্থায় পড়ে ছিল। যে পৃষ্ঠা খোলা ছিল সেটিতে বেক্সহিলে যাতায়াত করার ট্রেনের সময় তালিকা ছিল। গাইডটা একেবারে নতুন। কাছাকাছি দোকানদারদের থেকে জানা গেছে এই বই এখান থেকে বিক্রি হয়নি।

-মৃতদেহটি আবিষ্কার করে কর্নেল জেরোম। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে নজরে পড়ে এবং পাশের হোটেল থেকে থানায় ফোন করে সব কিছু জানায়। আমরা এত সকালে কারো সঙ্গে তখনও কথা বলতে পারিনি।

পোয়ারো ক্রোমকে সঙ্গে না নেওয়ায় সে মনে মনে একটু অপমানিত বোধ করে। একটু বাঁকা হাসি হেসে বললো–স্যার, আপনি বরং মিঃ পোয়ারোকে বেল্টটা দেখিয়ে দিন। ওটা নাকি ওঁর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দেখি, উনি কী এমন তথ্য আবিষ্কার করেন। আসলে বেল্ট থেকে হাতের ছাপ আপনি পাবেন না। ওটা সিষ্কের, চামড়ার নয়।

আমরা জিঞ্জার ক্যাট কাফেতে গিয়ে ঢুকলাম। ঐ কাফেটি চালনা করে মিস মেরিয়ান। সস্তাদামের কিছু কাপড় দিয়ে ঢাকা কতকগুলো বেতের চেয়ার ছাড়া আর কিছু নজরে পড়লো না। কেমন যেন চাকচিক্যহীন। আমরা কাফের মালকানর সঙ্গে দেখা করে আসার কারণ জানালাম।

জানেন, আমাদের কত ক্ষতি হলো, মিস মেরিয়ন রেগে কই। কোনো খদ্দেরই এই দোকানে ঢুকবে না।

আপনার দোকানে মিস বার্নার্ড কতদিন চাকরি করছে? ওর স্বভাব কেমন? ক্রোম জানতে চাইলো।

এখানে প্রায় বছর খানেক ও কাজ করছে। বেশ চালাক, কাজেকর্মে বেশ চটপটে ছিল। তবে ওর চরিত্র সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। কারণ দোকান সামলে ও সব দিকে নজর দেওয়ার অবসর আমার হত না।

–মেয়েটি দেখতে কেমন ছিল?

 পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে মিস মেরিয়ান ও ক্রোম একসঙ্গে তার দিকে তাকালো।

মেরিয়ান তারপর চোখ ঘুরিয়ে বললো, ভালোই, খারাপ নয়।

-কাল কত রাতে সে এখান থেকে বেরিয়েছিল? ক্রোম প্রশ্ন করলো।

–ছটার সময় দোকানে ভীষণ ভিড় হয়। খদ্দেরদের ঝামেলা মিটিয়ে আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা দোকান খুলে রাখি। তারপর দোকান বন্ধ হয়। বার্নার্ড অন্যান্য দিনের মতো আটটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে চলে যায়।

-কোথায় যাচ্ছে, আপনাকে বলেছিল?

–না।

–দোকানে থাকাকালীন বাইরের কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো?

–না।

–ও কি আপনার মাস মাইনের কর্মচারী ছিল?

–হ্যাঁ, ও আর হিগলি।

–আমরা একটু হিগলির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

–বেশ বলুন, তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তবে বেশি সময় নেবেন না।

পঁচিশ বছরের এক যুবতী আমাদের সামনে হাজির হলো। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ-

–তুমি মিস বার্নার্ডকে চিনতে?

-হ্যাঁ, আমি ভাবতেই পারছি না যে এভাবে ওর মৃত্যু হয়েছে। অত্যন্ত শান্ত ও মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে ছিল।