১. আইরিস মারলে

স্পার্কলিং সায়ানাইড

প্রথম অধ্যায়

আইরিস মারলে

১.১

 স্মৃতি ভীষণ ভয়ঙ্কর, বড়ই বেদনাদায়ক, ফতে আক্রান্ত হন রোজমেরি। হাসিখুশী সুন্দরী রোজমেরিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল বোন আইরিস মারলের কাছ থেকে, নীল বর্ণ মুখ, আঙুলগুলো মুঠোর মধ্যে বন্দী।

তবে কি রোজমেরি আত্মহত্যা করেছিলেন? ভাবতেও মন চায় না আইরিশের।

মৃত্যুর কারণ জানার জন্য অনুসন্ধান চললো এবং একদিন তা শেষও হলো। তারপর থেকে আইরিস ঐ ভয়ঙ্কর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় না। কেবল নিজের মনকে বুঝিয়েছেন, ভুলে যাও।

কিন্তু ভুললে তাকে চলবে না। এটা তিনি বুঝতে পারছেন।

আগের দিন জর্জের সঙ্গে সেই বিস্ময়কর সাক্ষাৎকার। জর্জের আচরণ, তার অন্যমনস্কতা, তার আচ্ছন্ন ভাব, তার সন্দেহজনক আচরণ, এসবের মধ্যে কি কোনো অর্থ লুকিয়ে নেই?

তার প্রিয় বোন রোজমেরি। তার মনে পড়ে যায় সুদূর অতীতের কথা। যখন তারা বাচ্চা ছিলেন তখনকার কথা স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে, রোজমেরি তার থেকে ছবছরের বড় ছিলেন।

মনে পড়ে কত বিচ্ছিন্ন ঘটনা, টুকরো টুকরো দৃশ্য। রোজমেরির সখ ছিলো, শূকরের লেজের মতো বেনী দোলানো।

রোজমেরি বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশুনা করতেন। ছুটিতে বাড়িতে আসতেন। যখন আইরিস স্কুলে ঢুকলেন তখন রোজমেরি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে চলে এসেছেন। তখন তার পরিবর্তন এসেছে সবকিছুতেই। আগের সেই হ্যাঁবলা ক্যাবলা রোজমেরি নেই। পোষাকে-আশাকে ফুটে উঠেছে, রুচির আভাস, কোমল কণ্ঠস্বর, মাধুর্যভরা চেহারা। গাঢ় নীল দুটি চোখে অন্তর্ভেদী চাউনি, সোনালি চুল মাথায়, যেন এক নিখুঁত সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। এক পাগল করা রূপ।

তারপর থেকে দুজনের দেখা খুব কমই হতো।

তখন আইরিসের চলছে স্কুল জীবন, আর রোজমেরি এদিকে একা একা জীবনকে উপভোগ করছে। ছুটিতে আইরিস বাড়ি এলেও তাদের মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে গেল। হয়তো ছবছরের ব্যবধান।

একদিন জর্জ বারটনের সঙ্গে রোজমেরির বাগদান পর্বচুকলো, কেনাকাটা, বিয়ের আয়োজনে কয়েকটা দিন হুল্লোড়ে কেটে গেল।

কিন্তু ঐ অল্প বয়সে আমার মনে এটা প্রশ্ন জেগেছে–রোজমেরি কেন তার থেকে পনেরো বছরের বড় জর্জকে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন? এটা কি তার দয়া দেখান, না কি বোকামির পরিচয়?

অবশ্য রোজমেরির নিজের যথেষ্ট টাকা ছিলো, পল কাকার টাকা। আসলে তিনি ওদের আসল কাকা ছিলেন না। আইরিস যতটুকু শুনেছেন, তাদের মায়ের সঙ্গে পল বেনেটের ভালোবাসা ছিল। তাদের মা অন্য একজন গরীব লোককে পছন্দ করেন। পল বেনেট তার সেই পরাজয় রোমান্টিক মনোভাব নিয়ে মেনে নেন এবং সেই থেকে তাদের পরিবারে পল কাকা হিসাবে থেকে যান। রোজমেরির কাছে তিনি ছিলেন ধর্ম পিতা, তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায়, তার সমস্ত অর্থ সম্পত্তির একমাত্র মালিকানা হলেন তার ছোট্ট ধর্ম কন্যা রোজমেরি।

আইরিসের কখনও মনে হয় না, রোজমেরি জর্জকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যেতো না যে তিনি দাম্পত্য জীবনে অসুখী। রোজমেরির বিয়ের এক বছর পর মারা যান মা ভায়োলা মারলে। মায়ের মৃত্যুর পর আইরিস চলে আসেন দিদি-জামাইবাবুর সংসারে। তখন তার বয়স সতেরো, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন দিদি এবং তার স্বামীর প্রকৃত সম্পর্কের কথা।

অবশ্য ঐ বয়সে আইরিসের গভীর ভাবে চিন্তা করার মত ক্ষমতা জন্মায়নি। তাদের মা তাদের ঠিক মত যত্ন করতে পারতেন না কারণ তিনি ছিলেন রুগ্ন। কাজের লোকের ওপর তাকে ভরসা করতে হতো, কিন্তু মেয়েরা কাছে এলে তিনি তার ভালোবাসা উজার করে দিতেন। আইরিসের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন অতিরিক্ত মদ্যপান করার জন্য অসময়ে মারা যান হেকটর মারলে। আর সতেরো বছর বয়সে তিনি মাকে হারালেন।

দিদির বাড়িতে তার মন বসতো না, কিন্তু এক বছর না হলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবেন না। তিনি এইসময় ফরাসি আর জার্মান ভাষা শিখতে লাগলেন। ডোমেস্টিক সায়েন্সের ক্লাসও শুরু করলেন। এক এক সময় হাতে কাজ থাকতো না, তখন আপন মনে বসে থাকতে হতো।

তখন রোজমেরি মার্কেটিং ককটেল পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। তার সঙ্গে গল্প করার সময় কোথায়। একই বাড়িতে দুই বোনের বাস ছিল, অথচ অন্তরঙ্গতা ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় দিদি রোজমেরির সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানতে পারেন? তবু তাকে ঘাঁটতে হবে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিকে।

ঘটনাটা ঘটার এক সপ্তাহ আগে আইরিস ভুলতে পারবেন না সেই দিনটির কথা। চোখ বন্ধ করে স্মৃতি রোমন্থন করলেন আইরিস।

রোজমেরির বসার ঘরে ঢুকে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়া

তিনি কি দেখেছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। রোজমেরি লেখার টেবিলের ওপর মাথা হেঁট করে কাঁদছেন। কেন এই কান্ন? আগে তো কখনো কাঁদতে দেখেননি। দারুণ ভয়ে পেয়ে যান আইরিস।

তবে রোজমেরির শরীর ক্লান্ত ছিল। কারণ দুদিন আগে ফ্লু থেকে উঠেছেন তিনি।

আইরিস নিজেকে সামলাতে না পেরে জোরে কেঁদে ওঠেন।

রোজমেরি ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ালেন, এলোমলো চুলগুলি কপালের ওপর থেকে সরিয়ে দিলেন, সম্ভব মতো নিজেকে সহ্য করে নিয়ে রোজমেরি বললেন-ও কিছু না, ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।

দিদির আচরণে আইরস হতাশ হয়ে পড়লেন। বসার ঘরে আবার এসে ঢুকলেন। টেবিলের ওপর তিনি তার সন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরলেন, প্যাডের ওপর একটা চিঠির ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল। চিঠিতে নিজের নাম দেখে আইরিস চমকে উঠলেন। তবে কি রোজমেরি তাকে চিঠি লিখছিলেন।

চিঠির ওপর ঝুঁকি চোখ রাখলেন তিনি,

প্রিয় আইরিস,
তোমার জন্য আলাদা করে আর উইল করার দরকার নেই। আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার সব অর্থ তোমারই হবে। তবে আমার একান্ত যে সব জিনিস সেগুলো আমি কয়েকজনকে দিয়ে যেতে চাই।

চিঠি পড়ে আইরিস পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

এর মানে কি? তবে কি রোজমেরি বুঝতে পেরেছেন, তার মৃত্যু আসন্ন? কিন্তু সামান্য ফুতে কেউ মারা যায় না, অথচ অনেকটা সুস্থ ও।

বারবার একটা লাইন তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো–আমার সব অর্থ তোমারই হবে।

অবশ্য পল বেনেটের উইলের শর্ত কি ছিল সেটা সঠিক জানেন না আইরিস। তিনি জানতেন কাকা পলের প্রচুর অর্থের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হয়েছেন রোজমেরি। যে প্রশ্ন এতদিন তার মনের মধ্যে গেঁথে ছিল সে উত্তর তো উনি এই চিঠিতেই পেলেন। রোজমেরির মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবেন আইরিস, স্ত্রী বা স্বামীর তো টাকাটা পাওয়া আইনসম্মত উচিত। কিন্তু বোনের কি সে অধিকার আছে? মনে হয় রোজমেরি নিশ্চিত। তাই তিনি লিখেতে পেরেছেন, আমি ভালো করেই জানি যে আমরা সব অর্থ তোমারই হবে।

তবে মাঝে মাঝে আইরিসের মন যে বিদ্রোহ করে ওঠেনি তা নয়। একই মায়ের দুই মেয়ে। অতএব পল কেন তার সমস্ত অর্থ একা বরাজমারিকে দিয়ে যাবেন?

রোজমেরি নিত্য নতুন পোষাক পরে, বেড়াতে যায়, পার্টিতে যায়, বন্ধুদের ভালোবাসা, স্বামী সংসার, তার কিছুর অভাব নেই, অথচ আইরিস?

চিঠিটা তিনি দুভাজ করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলেন।

সেই অভিশপ্ত জন্মদিনের উৎসবের পর চিঠিটা আবার ড্রয়ার থেকে বের করা হয়। রোজমেরির আত্মহত্যা করার স্বপক্ষে এটা একটা বাড়তি প্রমাণ। দরকারে এই চিঠি প্রমাণ করে দেবে যে দুদিনের ফুতে ভুগে সেরে ওঠা শরীর ও মন নিয়ে রোজমেরি খুশী ছিলেন না, হয়তো তাই তিনি আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকবেন।

তদন্তের সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা আর হতাশা প্রকাশ পায়। রোজমেরির চিঠিটা সেই মোটিভটা জোরদার করতে সাহায্য করলো।

রোজমেরির মৃত্যুর স্বপক্ষে তখন অন্য কোনো উদ্দেশ্য দেখাতে পারেননি আইরিস, বা জর্জ বারটন বা অন্য কেউ।

সেদিনের সেই চিলেকোঠায় দুর্ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে আইরিস অবাক হচ্ছেন।

.

রোজমেরির মৃত্যুর ছমাস পরে ঘটলো সেই চিলেকোঠার ঘটনা।

আইরিস তখনো বোনের সংসারে আছে। তিনি একদিন মারলে পরিবারের সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, ভদ্র অথচ চোখে শয়তানির ছাপ। তিনি আইরিসকে বোঝালেন যে পল বেনেটের উইলের শর্ত অনুযায়ী প্রথম উত্তরাধিকারী হলেন রোজমেরি। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা হবে অর্থের মালিক। আর যদি অপুত্রক হন তাহলে তার বোন আইরিস পাবেন সেই অর্থ। তবে একটা শর্তে, একুশ বছর হলে কিংবা বিবাহ হলেই সেই অর্থের অধিকারিণী হবেন, নতুবা নয়।

রোজমেরির মৃত্যুর পর আইরিসের থাকা নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। জর্জ বারটনের ইচ্ছা ছিল, তার পিসি মিসেস ড্রেকের কাছে আইরিস যেন থাকেন। কিন্তু আইরিস এই প্রস্তাব মেনে নেননি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো আইরিস আপাতত জর্জ বারটনের বাড়িতে ছোট বোনের মতো থাকবেন। সাংসারিক বিধি-ব্যবস্থাও শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে গেল।

অনেকদিন ধরেই আইরিস তার অতি প্রিয় পুরোনো লাল পুলওভারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওটা খুঁজতেই তিনি গিয়ে ঢুকলেন চিলেকোঠার ঘরে। ট্রাঙ্ক ভর্তি পুরোনো পোশাক ঐ ঘরে রাখা ছিল। ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে একটি সিল্কের ড্রেসিং গাউন আবিস্কার করলেন যেটা রোজমেরি বহুদিন ব্যবহার করেছেন। রোজমেরির সমস্ত পোশাক পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই ড্রেসিং গাউনটা কিভাবে এখানে পড়ে রইলো।

তিনি ট্রাঙ্কে ওটা আবার রাখতে গিয়ে চমকে উঠলেন। পকেটের মধ্যে এটা কি? দ্রুত হাত ঢুকিয়ে দিলেন। বেরিয়ে এলো একটা কাগজের টুকরো। খুলে ধরলেন। রোজমেরির হাতে লেখা একটা চিঠি।

 প্রিয়তম লিওপার্ড,
তোমার হয়তো জানা নেই, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি জানো না,…আমরা পরস্পরকে তো ভলোবাসি। আমরা ওকে অপরের জন্য। একথা তোমারও জানা উচিত। যে যার জীবন নিয়ে আমরা বাঁচতে পারি না। আমাদের হৃদয় অভিন্ন। চলো আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমি সুখী করবোই। লিওপার্ড, তোমার হয়তো মনে নেই, তুমি বলেছিলে আমি ছাড়া তোমার জীবন অপূর্ণ। অথচ তুমি লিখেছে, যা কিছু আমাদের মধ্যে হয়েছে সব ভুলে যেতে। সবকিছুর এখানেই সমাপ্তি টানতে। সেটা অসম্ভব, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। লিওপার্ড, সাহসী হও। আমি জর্জকে জানাবো। তবে জন্মদিনের উৎসবের পরে।
আমি জানি, আমি যা করতে যাচ্ছি, তা ঈশ্বরের ইচ্ছায়। তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কখনোই ছাড়তে পারবো না। ওঃ প্রিয়তম–

পলকহীন চোখে চিঠির দিকে আইরিস তাকিয়ে রইলেন। তার দিদির যে একজন প্রেমিক ছিলেন, তা তিনি জানতেন না? অবশ্য কতটুকুই বা তার সম্পর্কে তিনি জানতেন?

এই চিঠি তিনি পাঠাননি। তাহলে কোন্ চিঠি রোজমেরি পাঠিয়েছিলেন? শেষ পর্যন্ত ওরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

কে এই লিওপার্ড? তিনিও নিশ্চয়ই রোজমেরিকে খুব ভালোবাসতেন। হয়তো তিনি শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই ভালো লাগা-ভালোবাসার জের টানতে আর চাননি তাই তিনি সব সম্পর্কের সমাপ্তি চেয়েছিলেন।

অথচ রোজমেরি? তিনি তাদের ভালোবাসাটাকে ব্যর্থ হতে দিতে চাননি। তাই তিনি স্থির করে ফেলেছিলেন

আইরিস কেঁপে উঠলো।

তবে তার ধারণা ছিলো অন্ধ। নতুবা তার দিদির জীবনে এতবড় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছিল, তিনি এক বিন্দুও আন্দাজ করতে পারেননি।

কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?

আইরিস স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। কত পুরুষ তো রোজমেরির কাছে আসতো, গল্প করতো, ফোন করতো। তাদের মধ্যে কি এই প্রতারক ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল? কে সে?

এদের মধ্যে স্টিফেন ফ্যারাডেকে মনে পড়ে আইরিসের। ওঁর মধ্যে রোজমেরি কি এমন দেখলেন। যুবক বয়েস। উঠতি রাজনীতিবিদ। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা রাখে। এটাকেই কি রোজমেরি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো? তবে লোকে বলে স্টিফেনের স্ত্রী ওকে ভীষণ ভালোবাসে। শোনা যায় বাড়ির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটিকে স্টিফেন বিয়ে করে, তার রাজনৈতিক জীবন মেয়েটির একান্ত কাম্য ছিল বলে। একটি মেয়ে যদি স্টিফেনের মধ্যে ভালোবাসার গন্ধ পেয়ে থাকে তাহলে অন্য মেয়ের পক্ষে তাকে ভালোবাসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হ্যাঁ সেই লোক স্টিফেন ফ্যারাডেই বটে।

তবে স্টিফেন যদি না হয় তবে এ্যানথনি ব্রাউন তো হবেই। সে ছিল রোজমেরির অনুগত। ঠিক যেন চাকর। হুকুম তামিল করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। লোকটা রসিকপ্রিয়। কিন্তু রোজমেরির কাছে নিজেকে এতো খেলো করে ফেলেছিল যে মনে হয় না তার মধ্যে কোনো গভীরতা আছে।

রোজমেরির মৃত্যুর পর তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। মনে হয় ভদ্রলোক আমেরিকান নতুবা কানাডিয়ান ছিলেন।

সে ছিল রোজমেরির বন্ধু। তাই তার মৃত্যুর পর ব্রাউনের আসা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজন তো নেই।

তখনও হাতের মধ্য চিঠিটা ছিলো। আইরিস সেটা আবার ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইলেন হাতে নিয়ে। এটা এবার কি করবেন?

পরক্ষণে মনে হলো, চিঠিটা পরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রমাণ হিসাবে কাজে লাগতে পারে। তাই তিনি গহনার বাক্সে সেটা রেখে দিলেন।

.

তারপর?

আইরিস আবার তার স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন।

আগের দিন রাতে সেই বিস্ময়কর সাক্ষাৎকারের রহস্যটা একটু একটু করে স্মৃতির পর্দায় পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। ঠিক তখনই এ্যানথনি ব্রাউনের আবির্ভাব ঘটলো।

নভেম্বরে মারা যান রোজমেরি, পরের মে মাসে লুসিল ড্রেকের তত্ত্বাবধানে তিনি তার সামাজিক জীবন শুরু করেন। দিনের পর দিন পাটি নাচ-গানে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।

জুনের শেষে এক অতি নীরস নাচের আসরে আইরিসের কানে হঠাৎ ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর।

-আপনিই কি আইরিস মারলে?

আইরিস ঘুরে তাকলেন, সামনে দাঁড়িয়ে এ্যানথনি, মুখে তার হাসির ঝিলিক।

সে আবার বললো, আপনি যে আমাকে চিনতে পারবেন সেটা অশা করিনি।

–হ্যাঁ, আপনাকে আমার মনে আছে। সম্ভবত রোজমেরির জন্মদিনের পর থেকে আর

আইরিস আর শেষ করলেন না কথাটা। তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে তার দিকে তাকালেন।

এ্যানথনি অপ্রস্তুত হলেন। তিনি ক্ষমা চাইলেন–আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কথাটা আপনাকে মনে করিয়ে দিয়ে, অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করেছি।

একটু থেমে আবার বললো, আসুন আমরা ওসব ভুলে একটু নাচ করি।

এ্যানথনির কথায় আইরিস রাজী হয়ে গেলেন। এ্যানথনির বাহুপাশে নিজেকে ধরা দিলেন।

এ কি সেই লোক, যে রোজমেরির বন্ধু ছিল। সেই চিঠিটা এর উদ্দেশ্যেই কি রোজমেরি লিখেছিলেন? তবে কি এর ছদ্মনাম লিওপার্ড? আইরিস বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো।

-এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন? আইরিস লোকটির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।

মুহূর্তের মধ্যে নাচ থেমে গেল। আইরিসের থেকে একটু দুরে সরে গেল সে। তার মুখের হাসি নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

-ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল।

–তাহলে আবার ফিরে এলেন কেন? আইরিস প্রশ্ন করলো।

এবার সে হেসে বললো–তোমাকে দেখার জন্য আমি আবার ফিরে এসেছি, আইরিস মারলে।

এ্যানথনি তাকে কাছে টেনে নিলো। নাচের তালে তালে আইরিসের সঙ্গে সে ছন্দ মিলিয়ে নাচে। এ্যানথনির স্পর্শে তার দেহ মনে শিহরণ জাগছে কেন?

এরপর থকে এ্যানথনি সপ্তাহে অন্তত একবার তার সঙ্গে দেখা করতোই। যখন যেখানে ভালো লাগতো সেখানে ওরা পরস্পরের সঙ্গে মিলতো, কিন্তু এ্যানথনি কখনো এলভাস্টন স্কোয়ারে আসতো না। কারণ একদিন আইরিস তাকে ঐ বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু এ্যানথনি সেটা অগ্রাহ্য করে। তখনি তার মনে হলো, কেন, কেন এই প্রত্যাখ্যান? তবে কি রোজমেরি আর সে

একদিন আইরিসকে চমকে দিয়ে জর্জ বারটন বললেন-তুমি কি এ্যানথনি ব্রাউনকে জানো? সে কি রোজমেরির বন্ধু ছিল? জর্জের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।

আইরিস গম্ভীর গলায় বললেন–ছিলো বৈ কি। কিন্তু সে তো আজ অতীত। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে বললেন, একথা মনে করিয়ে দেওয়ায় আমি দুঃখিত।

-আমি রোজমেরিকে ভুলতে চাই না। জর্জের কণ্ঠস্বর শান্ত। সে আমার স্ত্রী ছিল। আজ আমার কাছে কেবল স্মৃতি। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বললেন, আইরিস, তোমার দিদিকে আমি ভুলতে চাই না। কিন্তু এই এ্যানথনি ব্রাউনকে রোজমেরি হয়তো পছন্দ করতো। তার সম্বন্ধে রোজমেরি বিশেষ কিছু জানতো বলে আমার মনে হয় না। তাই তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। মনে রেখো, তুমি একজন ধনী মহিলা। হতে পারে সে একজন সম্মানিত ও পয়সাওয়ালা লোক। কিন্তু তার ব্যাপারে খুব কম লোকেরই আগ্রহ আছে।

আইরিস রাগে জ্বলে উঠলো।

–হয়তো তাই কিন্তু এ বাড়িতে সে বেশি একটা আসে না।

–ভেবেছিলাম তোমার ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না। কিন্তু তুমি আমার আত্মীয়। তাই তোমাকে আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। জর্জ বলতে থাকেন, নতুবা মাকে পরিষ্কার জানাতে হবে, তোমার বয়স কম, তোমার সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। আমি চাই, তুমি তোমার জীবন সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করো।

–জর্জ, তুমি ভেবো না। আমি তা করছি।

পরে মিসেস ড্রেকের সঙ্গে এ্যানথনি ব্রাউনের ব্যাপারে তার কথা হয়েছিল। কিন্তু এমন কপাল খারাপ যে তখন লুসিল তার অকর্মণ্য ছেলের তারবার্তা নিয়ে ব্যস্ত। ভিক্টর ছিলো মায়ের চোখের মণি। দুর্বল মায়ের মনের ওপর বার বার চাপ সৃষ্টি করে সে টাকা আদায় করে নিতো। এবার ভিক্টর দুশো পাউন্ড পাঠাতে বলেছে। জীবন তার বিপন্ন। লুসিল তাই কাঁদছিল।

এই টাকা না পেলে সে নিশ্চয়ই নিজেকে গুলি করবে।

-না, তা সে করবে না। জর্জ অন্যমনস্কভাবে কথাটা বললো।

–আমার নিজের ছেলের স্বভাব আমার খুব ভালো ভাবে জানা আছে। তাই ভাবছি আমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেবো।

 –দেখো লুসিল, জর্জ বললেন, তুমি দু-একদিন অপেক্ষা করো, ওখানে আমার একজন লোক আছে। তার মাধ্যমে আমি তোমার ছেলের প্রকৃত অবস্থা জেনে নিচ্ছি। তবে আমি বলি কি, তুমি ওর স্বভাব পাল্টাতে সাহায্য করো। ও নিজের অভাব নিজেই মেটাক।

লুসিল একটু ঠান্ডা হলো, তবে অন্তত পঞ্চাশ পাউন্ড পাঠাতে চাইলো ছেলের কাছে। টাকাটা জর্জ দিতে চাইলেন, কিন্তু ভিক্টর জানবে যে তার মা শেয়ার বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছে।

-সে ত তোমার পরিবারের কেউ নয়, তাহলে তোমার অত দায় কেন? আইরিস প্রশ্ন করলো।

-রোজমেরির পরিবার মানে আমার পরিবার।

–সত্যি তুমি কত মহান জর্জ। আবেগ জড়ানো গলায় আইরিস বললেন।

জর্জ এখন ভাবছেন রিও-ডি জেনেরিওর সেই যুবকটিকে নিয়ে। যে যুবক বিবেকহীন, কেবল বাক চাতুর্যের কলাকৌশল রপ্ত করেছে।

আইরিসের কথা ভেবে জর্জ ঠিক করলেন, লুসিলকে ওর দায়িত্ব পুরোপুরি নিতে বললেন। এ্যানথনি ব্রাউনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের ফলাফলের ওপর সতর্ক নজর রাখা উচিত।

রোজমেরির মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে জর্জের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। অনেক যেন বয়েস হয়ে গেছে, চেহারায় একটা ভারিক্কী ভাব। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এই পরিবর্তন যখন স্বাভাবিক সীমারেখা অতিক্রম করে তখন অন্যের কাছে সেটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

জর্জের সঙ্গে এ্যানথনি ব্রাউনের মতবিরোধ হওয়ার পর তিনি নিজেকে আইরিসের কাছ থেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। বিনা প্রয়োজনে স্টাডিরুমে গিয়ে বসে থাকতেন। তার দৃষ্টিতে উদাস ভাব, হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন এমন গোছের। প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাননি আইরিস। কেবল তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মনে হয় কোথায় যেন তার একটা আঘাত লেগেছে।

দিনে দিনে জর্জকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো। এ ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামার্লো না।

কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন জর্জ বললেন, আইরিস। রোজমেরি কি তোমার সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলতো।

প্রশ্ন শুনে আইরিস অবাক হলেন, কেন জর্জ। ছোট বোনের সঙ্গে কথা বলবেন না তো আর কার সঙ্গে কথা বলবেন?

–ও কি নিজের প্রসঙ্গে কথা বলতো? না কি ওর বন্ধুবান্ধবদের কথাও তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে?

–তিনি বেশি কথা বলতেন না। তার কাজ নিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন?

ভেবেছিলাম, রোজমেরি হয়তো তোমাকে কিছু বলে থাকবে।

এই ধরনের নানা প্রশ্ন করতেন জর্জ। যেমন রোজমেরির কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা? তারা কারা? ওর কোনো গোপন কথা বলেছে কিনা ইত্যাদি।

–আচ্ছা আইরিস, রোজমেরির কোনো শত্রু ছিল? সত্যিকারের শত্রু? যার কাছ থেকে তার ক্ষতির আশঙ্কা করা যেতে পারে? হঠাৎ একদিন এই বিস্ময়কর প্রশ্নটা করে বসলেন জর্জ।

আইরিসের চোখের চাউনি দেখে জর্জ ঘাবড়ে যান।

আবার কয়েকদিন পর জর্জ জানতে চাইলেন ফ্যারাডেদের সঙ্গে রোজমেরির দেখাসাক্ষাৎ হত কিনা।

–আচ্ছা, ফ্যারাডেদের সম্বন্ধে তোমার দিদি তোমাকে কিছু বলেছিল?

না, মনে পড়ে না। তবে রাজনৈতিক আলোচনায় ওর খুব আগ্রহ দেখতাম।

–হ্যাঁ, রাজনৈতিকের রা পর্যন্ত জানতো না। সুইজারল্যান্ডে ফ্যারাডেদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে ও এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

…তবে ও ছিলো চাপা স্বভাবের শান্ত মেয়ে। স্টিফেনের জন্য যে রোজমেরি পাগল ছিল, এ খবর আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি।

হতে পারে।

–আচ্ছা, এ্যানথনি ব্রাউনকে দেখে তোমার কি মনে হয়?

সুন্দর স্বভাবের কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক।

–সে কিসের ব্যাবসা করে জানো?

–না, সেটা জানি না। এটা সে আমাকে বলেনি।

-আমি জানি। জর্জ বলেন। অস্ত্র উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে যুক্ত। গত হেমন্তে ইউনাইটেড আর্মস লিমিডেটের চেয়ারম্যান ডিউস বেরিলর সঙ্গে তার অনেক টাকার ব্যাবসার একটা চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হয়। এই এ্যানথনি ব্রাউনের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখেছিলেন রোজমেরি। কিন্তু

জর্জ বলে চললেন, ওদের পরিচয় অল্প কয়েকদিনের। মাঝে মাঝে তারা নাচের আসরে যেতো। রোজমেরি এই অল্প পরিচয়ের সূত্র ধরে কেন যে জন্মদিনের আসরে ওকে কামনা করে ছিল সেটা আমার কাছে আজও রহস্য বলে মনে হয়।

চকিতে ভেসে উঠলো সেই সন্ধ্যার দৃশ্য আইরিসের চোখের পর্দায়।

লাক্সেমবার্গের গোল টেবিল। মিষ্টি নীলাভ আলো, বাতাসে ফুলের গন্ধ। নাচের তালে তালে বাজনার মিষ্টি সুর। টেবিলের চারধারে বসেছিলেন সাতজন লোক। তার পাশে বসেছিল এ্যানথনি ব্রাউন, রোজমেরি, স্টিফেন ফ্যারাডে, রুথ লেসিং, জর্জ এবং জর্জের ডানদিকে স্টিফেন ফ্যারাডের স্ত্রী লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডে।

সেই পার্টি চলাকালীন মাঝপথে রোজমেরিনা না, আইরিস সে কথা ভাবতে চায় না।

-আইরিস, ব্রাউনকে একদিন নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিও, তার সঙ্গে আবার আমি আলাপ করতে চাই।

খুশীতে আইরিস লাফিয়ে উঠলেন। জর্জ আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। এ্যানথনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল ঠিকই। কিন্তু ব্যাবসার কাজে তাকে বাইরে চলে যেতে হয়। ফলে সে কথা রাখতে পারেনি।

একদিন জুলাই মাসের শেষে জর্জ একটা চমকপ্রদ খবর দিলো আইরিস আর লুসিলকে। একটা বাড়ি তিনি কিনেছেন। যে জায়গাটা প্রায়রস নামে পরিচিত সেখানে। দশ একর জমির ওপর বাড়িটা। ছোট-খাটো জর্জিয়ান হাউস।

পুরোনো বাড়ি আবার নতুন করে সাজাতে হবে। মিসেস ড্রেক বললেন।

–ওদিকটা দেখার দায়িত্ব রুথের। ওর ওপর কাজ দিয়ে ভরসা করা যায়।

জর্জের অতি বিশ্বস্ত সেক্রেটারি হলো রুথ লেসিং। রূপে গুণে চমৎকার। হাসতে হাসতে সব সমস্যা সহজ সরল ভাবে সমাধান করে ফেলে সে। জর্জের অফিস চালায় সে। অনেকের ধারণা জর্জকেও সে চালনা করে। তার সিদ্ধান্ত জর্জকে মাথা নত করে মেনে নিতে হয়। আর রুথকে দেখে মনে হয় যেন ওর কোনো চাহিদা নেই।

–আচ্ছা জর্জ, সেখানে টেনিস কোর্ট আছে?

-হ্যাঁ, গলফ লিঙ্ক থেকে মাত্র ছমাইল দূরে, সমুদ্র মাত্র চোদ্দ মাইলের মধ্যে। তাছাড়া সেখানে আমাদের প্রতিবেশী হিসাবে যাদের পাচ্ছি–

-প্রতিবেশী? আইরিস কথার মাঝখানে প্রশ্ন করলেন।

আইরিসের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না জর্জ। অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন–হ্যাঁ, মাত্র মাইল দেড়েক দূরে, পার্কটা পেরিয়ে ফ্যারাডেদের বাড়ি।

আইরিসের বুঝতে দেরি হলো না কেন হঠাৎ গোপনে জর্জ সাসেক্সে ঐ বাড়িটা কিভাবে পেলেন। আসলে স্টিফেন এবং সান্দ্রা ফ্যারাডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যই তাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়ি তিনি কিনেছেন।

কিন্তু এর কারণ কি?

তাহলে কি জর্জের বিশ্বাস স্টিফেন আর রোজমেরির মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক ছিলো? সেই গোপন তথ্যটা জানার জন্যই সেখানে তার যাওয়া?

ইদানিং জর্জকে কেমন সন্দেহজনক পুরুষ বলে মনে হয়েছে।

ধীরে ধীরে জর্জকে সন্দেহ রোগে ধরলো। তার দেহ ও মনের অবস্থার অবনতি ঘটলো।

আগস্টের বেশির ভাগ সময় তারা কাটালেন লিটল পায়রসে। মস্ত বাড়িটার অদ্ভুত নির্জনতা আইরিসকে বিরক্ত করে তোলে। সাজানো গোছানো, সুন্দর পরিবেশ। তবু আইরিসের সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে ওঠেন তিনি।

সপ্তাহের শেষে টেনিস খেলা, ফ্যারাডেদের বাড়িতে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া এ যেন একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো। সেখানকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সান্দ্রাই পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু লুসিল ডিনার পার্টি বা নাচ-গান পছন্দ করতেন না। কিন্তু তার ঠোঁটে হাসিটুকু লেগে থাকতো সবসময়।

কে বলতে পারে তিনি তার হাসির আড়ালে কি অভিসন্ধি লুকিয়ে রেখেছেন? তিনি যেন এক রহস্যময় নারী।

স্টিফেন নাকি রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত। তাই তাকে বেশি দেখা যেতো না। কিন্তু আইরিসের মনে হয়, তিনি ইচ্ছে করেই লিটল প্রায়রসের বাড়িতে আসছেন না।

এইভাবে কেটে গেল সেপ্টেম্বর মাস। ঠিক হলো নভেম্বরে তারা লন্ডনে ফিরে যাবেন।

ওখান থেকে চলে আসার ঠিক আগের দিন, ঠিক রাত একটায় আইরিসের চোখে সবে মাত্র ঘুম এসেছে এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। আইরিস উঠে দরজা খুলে দিলেন। জর্জ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যে এখনো ঘুমোতে যাননি সেটা তার পোশাক দেখেই আইরিস বুঝতে পারলেন। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মুখের রঙ পাল্টে গেছে।

-আইরিস, তুমি আমার স্টাডিরুমে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আর একজনের সঙ্গেও আমাকে কথা বলতে হবে।

তারা দুজনে স্টাডিরুমে এসে ঢুকলেন। জর্জ দরজা বন্ধ করে দিলেন। জর্জের নির্দেশে তার উল্টোদিকের একটা চেয়ারে আইরিস বসলেন।

–কি ব্যাপার জর্জ? আইরিস আচমকা প্রশ্ন করলো। তোমাকে এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন?

আমি আর একা একা ভাবতে পারছি না। জর্জ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলতে থাকেন, তোমাকেও বলতে হবে, তুমি কি ভাবছে–এটা কি সম্ভব?

–কিন্তু জর্জ, তুমি কি বলতে চাইছে, আমি তো বুঝতে পারছি না।

জর্জ দুহাতে কপাল টিপে ধরলেন।

–তুমি বুঝতে পারছো, তাই না? তুমি ওরকমভাবে আমার দিকে তাকিও না। আমার ভীষণ ভয় করছে, আইরিস। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। তুমি বিশ্বাস করো, আর একটু দেরি হলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে দুটি কাগজ বের করলেন তিনি। এগিয়ে দিলেন আইরিসের দিকে।

–পড়ে দেখো।

চিঠিতে নজর দিলো আইরিস। চিঠির বক্তব্য অতি সহজ ও সরল।

–তুমি ভাবছো, তোমার স্ত্রী রোজমেরি আত্মহত্যা করেছে? না, সে খুন হয়েছে।

দ্বিতীয় চিঠিতেও ঐ একই লেখা।

-চিঠিগুলো তিনমাস আগে পেয়ে প্রথমে কোনো গুরুত্ব দিইনি। জর্জ বলতে থাকেন। তারপর গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করি, কেন রোজমেরি আত্মহত্যা করতে যাবে?

–হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে তার মন ভেঙে গিয়েছিল, নতুবা তিনি ছিলেন অসুখী?

আইরিসের দ্বিতীয় মন্তব্য জর্জ মেনে নিলেন সহজভাবে–তা হতে পারে। তবে আমার মনে হয় না, অসুখী ছিলো বলে সে আত্মহত্যা করবে। ও আমাকে ভয় দেখাতে পারতো। তারপর যদি বাধা পেতো তাহলে তো অন্য পথ বেছে নিতে পারতো, যেটা এখনো আছে।

..আমি অনেক কথা ভেবেছি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই তো তোমার কাছে রোজমেরি সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন করছি। যাই হোক, যে-ই ওকে খুন করুক না কেন, খুনের উদ্দেশ্য কি ছিল তার।

–জর্জ, তুমি কি পাগল হলে–

-না, না, আইরিস, আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। তোমাকেও এ ব্যাপারে ভাবতে হবে, আইরিস। ফলে কাজটা আমার এগিয়ে যাবে আরো। বার বার সেই অভিশপ্ত রাতটার কথা স্মরণ করো। তুমি ওর কাছাকাছি ছিলে, রোজমেরির খুনী নিশ্চয়ই ওর আশেপাশে কোথাও থাকবেন। তুমি নিশ্চয়ই খুনীকে দেখে থাকবে?

সেই দৃশ্যটা আইরিসের নিশ্চয়ই মনে আছে। স্বল্প নীলাভ আলোর স্বপ্নময় পরিবেশে বাজনার তালে তালে ড্রামের আওয়াজ। একসময় রোজমেরি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। মুখের রঙ পাল্টে নীল হয়ে গিয়েছিল।

আইরিস কেঁপে ওঠে।

রোজমেরি এক স্মৃতি, বড় মর্মান্তিক স্মৃতি।

.

রুথ লেসিং

১.২

 কাজের অবসরে রুথ লেসিং ভাবছিল তার বসের স্ত্রী রোজমেরি বারটনের কথা।

রোজমেরিকে খুব একটা পছন্দ করতো না সে। তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সে জানতো না। ভিক্টর ড্রেক তাকে অনেক কিছু জানায় ওর সম্বন্ধে।

জর্জ বারটনের ওপর তার আনুগত্য কখনো শিথিল হয়নি। যখন সে জর্জের কাছে চাকরিতে আসে তখন তার বয়স মাত্র তেইশ বছর। জর্জের দায়িত্ব নেওয়া তার একান্ত প্রয়োজন। সেই থেকে রুথ সেই ভার বহন করে চলেছে। রুথের উপস্থিতি জর্জের পছন্দ হতো। তার সব কাজই নির্ভুল বলে মনে হতো জর্জের। জর্জ তার ব্যক্তিগত ব্যাপারেও রথের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

কখনো কখনো জর্জ ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে রুখের সঙ্গে আলোচনা করতেন। রুথ মন দিয়ে শুনে তার সমাধান করে দিতো। প্রয়োজনে উপদেশ দিতো। রোজমেরির সঙ্গে জর্জের বিয়েটা মন থেকে মেনে সায় না দিলেও মেনে নেয় শেষ পর্যন্ত।

ধীরে ধীরে রুথ বারটন ফ্যামিলিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করলো। সকলের তাকে পছন্দ। এখন রুথের বয়েস ঊনত্রিশ। কিন্তু সে আগের মতো পূর্ণ যুবতী উজ্জ্বল এবং ভাস্বর।

বিয়ের পর আনন্দমুখর দিনগুলির কথা রুথের অজানা নয়। যেমন অজানা নয় পরবর্তীকালে তার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু জর্জের অন্যমনস্কতার কারণ তার জানা ছিল না।

একদিন ভিক্টর ড্রেকের কথা জর্জ তাকে বললেন।

-রুথ আমার হয়ে তোমাকে একটা অপ্রিয় কাজ করতে হবে।

 রুথ চোখ তুলে তাকিয়েছিল।

–আমাদের পরিবারে একটা গাধা আছে। সে হলো আমার স্ত্রীর পিসতুতো ভাই। সে একটা অকালকুষ্মাণ্ড। ইতিমধ্যে সে তার মায়ের শেয়ার কিছু বেনামে বিক্রি করে দিয়েছে। এইভাবে তার মাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। সে এখন বেকার উদ্দেশ্যহীন ভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

…এখন সে লন্ডনে। আমার স্ত্রীকে টাকার জন্য চিঠি পাঠিয়ে ভীষণ জ্বালাতন করে। কথাবার্তায় সে চোস্ত। আমি ওর অন্যায় জুলুম আর সহ্য করতে পারছি না। তাই আজ বেলা বারোটার সময় ওকে হোটেলে আসতে বলেছি। আমি চাই, তুমি আমার হয়ে ওর সঙ্গে মোকাবিলা করো।

–কিন্তু এখন তার চাহিদা কি? রুথ এই ধরনের চরিত্র মোটেও পছন্দ করে না।

-নগদ একশো পাউন্ড ও বুয়েন্স এয়ারসে যাওয়ার জন্য একটা টিকিট। জাহাজে ওঠার সময় তাকে টাকাটা দিতে হবে।

তার মানে আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে চান যে সে জাহাজে উঠলো কিনা, তাই তো?

-হ্যাঁ, তুমি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে দেখছি। জর্জ বললেন, ছেলেটার নাম ভিক্টর ড্রেক, ঠিকানা রুপার্ট রাসেল স্কোয়ার। তার নামে ক্রিস্টোপস জাহাজের টিকিট কাটা আছে। আগামী কাল টিলবাড়ি থেকে জাহাজ ছাড়ছে।

জাহাজের চিকিটটা হাতে নিয়ে রুথ তার হাত ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।

–প্রিয় রুথ, তোমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি আমি। জর্জ বললেন, তুমি জানো না রুথ, তুমি আমার কত প্রিয়।

রুথ তার আনন্দ ঢাকতে হেসে উঠলো–আপনি এইসব সুন্দর সুন্দর কথা বলে আমাকে দেখছি নষ্ট করে দেবেন।

-না না, রুথ আমাকে তুমি বলতে দাও। তুমি আমার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের একজন বিশেষ অংশীদার। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচিন্ত্যনীয়।

তার কথার উষ্ণ আবেশ ছড়িয়ে পড়ে রুথের সর্বাঙ্গে।

ঠিক সময়ে সে রুপার্ট হোটেলে এসে পৌঁছালো।

ভিক্টরকে দেখে তার মনে হলো, মেকী ব্যক্তিত্বসর্বস্ব একটি লোক। তবে রীতিমতো আকর্ষণীয়। রুথ তাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় না, পাছে সে ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে পড়ে।

জর্জের গুপ্তচর? কিন্তু আপনার দেখা পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ভিক্টর তাকে চিত্ত সম্ভাষণ জানায়।

জর্জের শর্তের কথা রুথ তাকে জানায়। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ভিক্টর সব শর্ত মেনে নিতে রাজী হয়ে গেল।

সুন্দরী পিসতুতো বোন আইরিসকে স্পর্শ না করা, সুযোগ্য পিসতুতো ভগ্নিপতি জর্জকে কোনো ব্যাপারে বিরক্ত না করে, আমি সব মেনে নিচ্ছি। সান ক্রিস্টোপলে সে আমাকে বিদায় জানাতে আসছে। প্রিয় মিস লেসিং আপনি?

আবেগে ভিক্টরের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসে, সে ভালো করেই জানে মেয়েদের কাছে সে দারুণ ভাবে আকর্ষণীয়।

–আচ্ছা মিস লেসিং, বারটন আপনাকে ছাড়া এক পাও এগোতে পারে না, তাই না? আমি সব কিছু জানি। রোজমেরি আমাকে বলেছে। ভিক্টর হাসে

-রোজমেরি?

–এই পর্যন্ত থাক। রোজমেরি খুব ভালো মেয়ে। অত্যন্ত সহানুভূতিশীল তিনি। ইতিমধ্যেএকশো পাউন্ড তার কাছ থেকে পেয়ে গেছি আমি।

–আপনি

ভিক্টর হাসতে থাকে। মনে হয় ওর হাসিটা সংক্রামক। রুথ লেসিংও হাসতে থাকে।

–এ আপনার খুব অন্যায়, মিঃ ড্রেক। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।

-লজ্জা? আমি আপনার কথার প্রতিবাদ করছি? মিস লেসিং। আপনি জানেন না, আমি কতো খারাপ একজন দুর্নীতি পরায়ণ লোক, কেন আমি খারাপ হলাম আপনাকে সেটা বলতে চাই।

-কেন? রুথ কৌতূহলী হয়ে বললো।

-জীবনে আমি অনেক উপভোগ করেছি। ভালো দিকটাও আমি দেখেছি। ভিক্টর আপন মনে বলে চলে। অনেক দেশ আমি ঘুরেছি। একসময় আমি ছিলাম অভিনেতা, স্টোরকীপার, রেস্তোরাঁর ওয়েটার, মালবাহী পোর্টার, সার্কাসে অংশ নেওয়া। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি একসময়। কিছুদিন জেলে কাটিয়েছি। কিন্তু একদিনের জন্য সৎ হওয়ার চেষ্টা করিনি এবং আমার নিজের পথে কখনো চলিনি। এই দুটোকে আমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি।

ভিক্টর রুথের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তার সম্মোহন শক্তির কাছে রুথের প্রতিবাদ করার ইচ্ছাশক্তি হেরে গেল।

মিস লেসিং, আপনার চোখে ঐ সরল চাহনি মানায় না। আপনি অফিসের বসকে বিয়ে করা মেয়েদের পর্যায়ে আছেন। সাফল্য আপনার অন্ধ প্রত্যাশা। রোজমেরিকে বিয়ে না করে জর্জের উচিত ছিলো আপনাকে বিয়ে করা।

–আপনি আমাকে অপমান করছেন?

—না, মোটেও না। রোজমেরি যেমন স্বর্গের মতো সুন্দরী তেমনি খরগোসের মতো বোকা, ওকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু সে ভালোবাসাকে জড়িয়ে থাকা যায় না। কিন্তু আপনি তার বিপরীত। আপনার প্রেমে যে পুরুষ পড়বে সে কোনোদিন ভালোবাসায় ক্লান্তি অনুভব করবে না।

-কিন্তু আমার প্রেমে তিনি পড়বেন না।

–জর্জ আপনার প্রেমে পড়েনি? নিজেকে আপনি বোকা বানাবার চেষ্টা করবেন না, রুথ। রোজমেরির কোনো অঘটন ঘটলে জর্জ আপনাকে বিয়ে করতেন।

রুথ মনে মনে ভাবে, তার সূত্রপাত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুথের দিকে তাকালো ভিক্টর–আপনি একথা খুব ভালো ভাবেই জানেন। শান্ত গলায় বলতে থাকে, আমি আপনার ভালো কামনা করি। নিজের ওপর আরো বিশ্বাস রাখুন। জর্জকে চাপ দিন।

ভিক্টর, আসল কথাই বলেছে। কথ ভাবে। মাঝখানে রোজমেরি না থাকলে এতদিনে সে জর্জকে বিয়ে করতো। তার আরো কাছে আসতে পারতো। তার ভালো মন্দ দেখতে পারতো।

এইভাবেই শুরু হলো ঘটনা। ভিক্টরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ব্যাপারটা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। রুথ অফিসে ফিরে এলো, তার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটা কেউ লক্ষ্য করলো না।

একটু পরেই রোজমেরি ফোন করলেন–রুথ, জানো, কর্ণেল রেস আমার পার্টিতে আসতে পারবেন না টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছেন। ওর পরিবর্তে কাকে নিমন্ত্রণ করা যায় সেটা তুমি জর্জের কাছ থেকে জেনে নাও। আসলে আমাদের এখানে একজনকে দরকার। আমি ভেবে পাচ্ছি না, সেই একজন কে হতে পারে।

-কেন, ঐ একজন তো আমি হতে পারি। আমাকে আপনি দয়া করে ঐ পার্টিতে থাকতে বলেছেন।

–ও হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম।

রোজমেরি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। এদিকে রুথের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রোজমেরি যা দেখতে পেলেন না।

রোজমেরিকে সে একেবারেই পছন্দ করে না। তিনি ধনী, সুন্দরী, অমনোযোগী এবং বুদ্ধিহীন। জর্জের স্ত্রী হওয়ার একেবারে অনুপযুক্ত।

সেদিন অপরাহ্নে রোজমেরি বারটনকে সে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। আজ এক বছর পরেও সেই মনোভাব অটুট আছে। সেই নভেম্বরের দিনগুলোর কথা রুথ ইচ্ছা করে ভাবতে লাগলো।

পরদিন সকালে সাম ক্রিস্টোরাল জাহাজ ছাড়ার খবর পেয়ে জর্জ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন– তাহলে শেষ পর্যন্ত জাহাজে উঠেছে সে?

–হ্যাঁ।

–রুথ, তার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?

ইচ্ছে করে রুথ নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দেয়, আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। দুর্বল মনের নোক সে।

কিন্তু তার বুকের ভেতর তখন অব্যক্ত যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছিল। কান্না জড়ানো গলায় নিজেই বলে ওঠে–আপনি কেন আমাকে ওর কাছে পাঠালেন? গতকাল থেকে আমি যে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছি। আপনি জানেন না, কি দারুণ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছি আমি? কেউ জানে না, আমি এখন কি করতে পারি?

মুখে সে কিছু প্রকাশ করলো না।

রোজমেরির জন্মদিনের কাজে সবাই ব্যস্ত। আয়নায় নিজের মুখ দেখে রুথ চমকে উঠলো। অন্য এক মুখ। থমথমে দৃঢ়তার ছাপ সেই মুখে স্পষ্ট। সত্যিই তার দয়ামায়া বলে কিছু নেই। রোজমেরির কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, নীল চোখের দিকে তাকিয়ে তার একটুও মায়া হলো না।

এগারো মাস পরে, সেই কথা ভাবতে বসে সে শঙ্কিত হলো।

.

এ্যানথনি ব্রাউন

১.৩

 রোজমেরি বারটনের কথা মনে করতে গিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন ভুরু কোঁচকায়।

সে প্রচণ্ড ভাবে রোজমেরির প্রেমে পড়ে যায়। তার সঙ্গে যে সে মিশেছিল সেজন্য সে অনুতপ্ত। কিন্তু সেই ঘটনার জের যে আজও তাকে টানতে হবে সেটা কে জানতো?

আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, সেই সব দিনগুলির কথা, স্বপ্নমধুর দিন অন্যের ঈর্ষা জাগানো দিন। তাকে নিয়ে যেখানে সে গেছে, তার ভক্তরা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছে। ওরা পরস্পরের সঙ্গ পেয়ে ধন্য হয়েছিল একদিন। সঙ্গীতের প্রয়োজন হতো না, রোজমেরির পায়ের ছন্দে একটা অদ্ভুত ব্যঞ্জনা এনে দিতো, তার পায়ের সঙ্গে তাল রেখে নাচতো এ্যানথনি।

আজ একটা কথা ভেবে এ্যানথনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। রোজমেরির সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি, তার ভাগ্য ভালো। তাহলে কি যে হাল হতো, কে জানে। তাকে সে বিয়ে করেনি বটে, কিন্তু তার প্রেমে পড়েছিল সে এটা তো অস্বীকার করা যায় না।

তার নাচ দেখা, তাকে টেলিফোন করা, তার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, নাচা ট্যাক্সিতে তার ফুলের মতো নরম ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো, সেই অভিশপ্ত দিনটির আগে সে কি একটুও টের পেয়েছিল যে তার পেছনে এভাবে ছুটে বেড়ানো নিজেকে মুখের পর্যায়ে ফেলা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না।

এ্যানথনির আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন কিরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিলেন রোজমেরি। এলোমেলো চুল কানের দুপাশে ছড়ানো। নীল চোখের ভেতর দিয়ে বোকা বোকা চাউনি। লাল নরম ঠোঁটের স্পর্শ।

রোজমেরির ডাকে ইশ হয় এ্যানথনির।

–আমার প্রতি আপনার দেখছি দারুণ মোহ।

–হ্যাঁ, নামটা যে খুব সুন্দর।

 তারপর হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একটা কথা শোনালো রোজমেরি।

টমি মোরেলির থেকেও চমৎকার।

এ্যানথনি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ যেন অবিশ্বাস্য অসম্ভব।

রোজমেরির হাত চেপে ধরে কর্কশ গলায় সে বললো–আপনি ঐ নাম কোথা থেকে শুনলেন?

অদ্ভুত কথাটি শুনে রোজমেরি হাসতে থাকেন। ওঁর হাসি দেখে এ্যানথনির গা-পিত্তি জ্বলে যায়।

-রোজমেরি, ব্যাপারটা সাধারণ নয়। আমি জানতে চাই, তার নাম কি?

ভিক্টর ড্রেক, আমার পিসতুতো ভাই বলেছে।

 –ঐ নামে কারো সঙ্গে আমার আলাপ নেই।

–হয়তো, আসল নাম সে তোমার কাছে চেপে রেখেছে।

–তাই বুঝি? ধীরে ধীরে এ্যানথনির মনে পড়ে, হা, জেলহাজতে।

-আমি একদিন ভিক্টরকে বলেছিলাম, তুমি একটা অপদার্থ। সেকথা অবশ্য সে গায়ে মাখে না। উল্টে আমাকে বললো, তুমি কি নিজের সম্বন্ধে সচেতন? এক প্রাক্তন জেল ঘুঘুর সঙ্গে তোমাকে সেদিন নাচতে দেখলাম। তোমার যত ছেলে বন্ধু আছে তাদের মধ্যে সে অন্যতম তাই না? শুনেছি, সে নিজেকে এ্যানথনি ব্রাউন নামে পরিচয় দেয়, কিন্তু তার একটা কুখ্যাত নাম আছে টমি মোরেলি।

-ভিক্টর ড্রেক আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা দুজন জেল ফেরত বন্ধু। আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতে চাই।

গতকালই সে জাহাজের টিকিট কেটে দক্ষিণ আমেরিকায় রওনা হয়েছে। রোজমেরি মাথা নেড়ে বলেন।

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে এ্যানথনিবলে, তাহলে তুমি একমাত্র আমার গোপন অপরাধের কথা জানো।

–সে কথা আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।

-দেখ রোজমেরি, তুমি তোমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। শাসনের ভঙ্গিতে এ্যানথনি বললো, তুমি জানো যে মেয়েদের জীবনে রূপ হলো আসল সম্পদ। সেই সম্পদ যদি তোমার নষ্ট হয়ে যায়, বীভৎস হয়ে যায় তোমার মুখশ্রী, তাহলে তুমি কি পুরুষদের জগতে ঠাই পাবে? তুমি ভেবো না, সিনেমা গল্পে এরকম ঘটনা কেবল ঘটে থাকে। বাস্তবেও ঘটে, এটা খেয়াল রেখো।

তবে তিনি তো মুখ বন্ধ করে থাকবার মতো মহিলা নন। এ্যানথনি তাই প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলে, টমি মোরেলির নাম যে তুমি শুনেছো, সেটা তুমি ভুলে যাও, বুঝলে?

তুমি কি জানো না, আমার মনটা কত উদার। একজন আসামীর সঙ্গে আমি যে মেলামেশা করছি, এর মধ্যে একটা উত্তেজনা অনুভব করি আমি। এতে তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত নয়।

কি অপদার্থ। গাধার মতো কথা বলে। তারপর থেকে এ্যানথনির কেবল মনে হয়েছে, তার জীবনের পৃষ্ঠা থেকে রোজমেরির নাম কেটে দেবে। এ ধরনের মহিলার ওপর ভরসা রাখা যায় না।

ফিক ফিক করে হাসছিলেন রোজমেরি–অত ক্ষেপে যেও না। আগামী সপ্তাহে জ্যাগের নাচ দেখতে নিয়ে যেও। কথাটা মনে থাকে যেন।

-আমি বাইরে যাচ্ছি। এখানে থাকছি না।

–যেখানে খুশী যাও। কিন্তু আমার জন্মদিনের পার্টিতে তোমার আসা আমি কামনা করি। তুমি ওরকমভাবে বলো না। রোজমেরি বলতে থাকেন। তুমি তো জানো ইনফ্লুয়েঞ্জা আমাকে দেহের ও মনের দিক থেকে কতখানি দুর্বল করে দিয়েছে। এ অবস্থায় তোমার কাছ থেকে আমি ব্যথা পেতে চাই না। তোমাকে আসতে হবেই।

ঐ মুহূর্তে রোজমেরির জীবন থেকে সরে পড়া-উচিত ছিলো এ্যানথনির।

কিন্তু তার পরিবর্তে

খোলা দরজা দিয়ে তার চোখ চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা আইরিসের দিকে। রোজমেরির মতো সুন্দরী না হলেও চারিত্রিক ও মানসিক দৃঢ়তা অনেক বেশি।

সেই মুহূর্তে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো, ঘৃণা করতে ইচ্ছে হলো, রোজমেরির প্রেমে পড়ার জন্য।

আইরিসকে দেখা মাত্র তার সমস্ত কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।

 নিজের মত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললল এ্যানথনি ব্রাউন। সে তখন অন্য মানুষ অন্য মন নিয়ে হাজির হলো রোজমেরির সামনে।

.

স্টিফেন ফ্যারাডে

১.৪

 স্টিফেন ফ্যারাডের সেই অবিশ্বাসী মন আজও বিহ্বল করে তোলে রোজমেরির কথা ভাবতে বসলে। বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রেস্তোরাঁর প্রথম দৃশ্যটা।

এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার জীবনের অতীতকে। জীবন তার দুটি ভাগে বিভক্ত। বড় অংশে আছে স্থির মস্তিষ্কসম্পন্ন একজন মানুষের আশা-আকক্ষা, উন্নতির নাসনা–অন্যটি মেরুদণ্ডহীন, অনুভূতিশূন্য জীবন।

মাত্র সাত বছর বয়সে সে জেনে গিয়েছিল তার কপালের লেখা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। সেই লেখা ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সৎ ইচ্ছা ও মনের জোর। অভিভাবকদের দ্বারা তার কোনো উপকার হবে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়ে তুলতে হবে। এটা সে ঐ বয়সেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।

এই দৃঢ় মনোভাব নিয়ে স্টিফেন নিজের জীবন সুচারুরূপে চিত্রায়িত করেছিল। সে একটু তোতলা ছিল। তাই প্রথমেই সে আন্তরিক চেষ্টার ফলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শিখলো। লেখা পড়ায় ভালো ছিল। স্কলারশিপ পেতে তার খুব বেশি দেরি হয়নি।

মাত্র বাইশ বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে সসম্মানে বেরিয়ে এলো স্টিফেন। হয়ে উঠলো একজন নামকরা লেখক ও সুবক্তা। স্বাভাবিক জড়তা কাটিয়ে উঠে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করার প্রবণতা জাগে তার মধ্যে। পরবর্তীকালে রাজনীতি তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করলো। লেবার পার্টিতে যোগ দিল। কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রতিভাবান যুবক হিসাবে চিহ্নিত করলো।

কনজারভেটিভ পার্টি তখন স্টিফেনকে লেবার পার্টির একটা শক্ত ঘাঁটি থেকে তাদের প্রার্থী মনোনীত করে। জয়ী হয়ে হাউস অব কমন্সের আসনে বসলো। সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে ছিলো। কখন তাদের তোষামোদ করতে হয়, কখন তাদের বিপক্ষে যেতে হয় সে সম্পর্কে সে ছিল সচেতন। ক্যাবিনেটে তাকে প্রবেশ করতেই হবে এই ছিল তার প্রতিজ্ঞা।

বিয়ে করা তার এখনও হয়ে ওঠেনি। সে ব্যাপারে খুব কমই চিন্তা করেছে। তবে এমন একজন জীবনসঙ্গিনী তার চাই, যে হবে সুন্দরী। তার সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করবে। তার সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার হবে, খুশী মনে তার সন্তানদের প্রতিপালন করবে। সেই নারী তার সাফল্যে যেমন গর্বিত হবে তেমনি ব্যর্থতায় সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসবে তার হৃদয়ের সব অনুভূতি উজাড় করে দিয়ে।

সেদিন কিডারমিনস্টার হওয়াতে এক বিরাট অভ্যর্থনা সভার আয়োজন হলো। স্টিফেনও ওখানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলো।

ইংলন্ডে কিডারমিনস্টার দারুণ প্রভাবশালী। লর্ড কিডারমিনস্টারের চেহারায় রীতিমতো রাজকীয়, দীর্ঘদেহী সুপরিচিত। এককথায় সবাই তাকে চেনে। যে কোন পাবলিক মিটিং-এ বা ইংলন্ডের যে কোনো কমিটির সভানেত্রীর স্থান অলঙ্কৃত করতে দেখা যায় লেডি কিল্ডারমিনস্টারকে। তাদের পাঁচ কন্যা, একটি পুত্র। কন্যাদের মধ্যে তিনজন ছিলো খুব সুন্দরী, গম্ভীর প্রকৃতির।

লোকে লোকারণ্য। জনারণ্য থেকে দূরে একটা নির্জনে দাঁড়িয়েছিল সে। হঠাৎ স্টিফেনের নজরে পড়লো টেবিলের সামনে একা দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলা, পরনে মেঘে ঢাকা পোশাক, অগোছালো ভাব, লেডি আলেকজান্ডার হেইলি আর্নের, কিডারমিনস্টারের তৃতীয় কন্যা।

কিডারমিনস্টারদের পাঁচ,মেয়ের মধ্যে এই আলেকজান্ডার মেয়েটিই অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। স্টিফেন জানতো মেয়েটা অসুস্থ ও অসুখী।

মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। টেবিলের ওপর থেকে একটুকরো স্যান্ডউইচ তুলে নেয়। তারপর ঘুরে গিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনি কি কিছু মনে করবেন? সত্যি কথা বলতে কি আমি ভীষণ লাজুক। আপনিও মনে হয় লাজুক, তাই না?

মেয়েটি শান্তভাবে স্টিফেনের অনুমানকে স্বীকার করে নিলো।

–এক একসময় আমার কথা জড়িয়ে যায়। এরকম অবস্থায় আর কেউ পড়েছে কিনা জানি না।

-আমারও তাই।

স্টিফেন তার সঙ্গে চলতি একটা নাটকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। সেই নাটকটা সান্দ্রাও দেখেছিল।

সেই সময় লেডি কিডারমিনস্টার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।

 নিজের পরিচয় গোপন রেখে সে অস্ফুটে বিদায় সম্ভাষণ জানায়।

-আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলাম। এখানে সব কিছু একঘেয়ে। ওদের মেপে মেপে কথা বলা, নোক দেখানো ভদ্রতা আমার অসহ্য লাগে।কিন্তু আপনার সঙ্গ খুব ভালো লাগলো। তার জন্য ধন্যবাদ।

বেশ কয়েকদিন পর সান্দ্রাকে আবার সে দেখতে পেলো কিডারমিনস্টার হাউসের বাইরে চার বোনদের সঙ্গে বা কখনো একা। তারপর সেদিন সেই পার্টির এক সপ্তাহ পরে এক সকালে একটি কালো কুকুর সঙ্গে নিয়ে অলস পায়ে পায়ে পার্কের দিকে এগিয়ে চললো।

পাঁচ মিনিট পরে সান্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায় স্টিফেন। চোখে মুখে হাসি উপছে পড়ছে।

–আমার কি সৌভাগ্য। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি।

মেয়েটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।

কিছুক্ষণ ওদের মধ্য কুকুরটির সম্পর্কে আলোচনা চললো।

–সেদিন আপনাকে আমার পরিচয় দিইনি। আবেগ জড়ানো গলায় বললো–আমার নাম স্টিফেন ফ্যারাডে। আমি এক অজ্ঞাত এম.পি.।

মেয়েটির চোখে মুখে লজ্জার আভা তখনো লেগে আছে।

–আমি আলেকজান্ডার হেইলি।

সেই থেকে তারা ঐ পার্কে অনেকবার মিলিত হয়েছে। সে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা তাকে জানায়। কখনো রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। ওর কথা শুনে স্টিফেনের ধারণা হয়, মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী, যথেষ্ট জ্ঞান আছে। সেই সঙ্গে সহানুভূতিশীলও বটে।

লেডি কিডারমিনস্টারের মনটা পরখ করার জন্য একদিন শান্তস্বরে সান্দ্রা বলে–আচ্ছা, স্টিফেন ফ্যারাডেকে তোমার কি মনে হয়?

স্টিফেন ফ্যারাডে?

–হ্যাঁ, সেদিন সে ত তোমার পার্টিতে এসেছিল। পরে কয়েকবার তার সঙ্গে আমি দেখা করেছি।

–দারুণ মেধাবী যুবক। প্রখর বুদ্ধি। জনসাধারণের সঙ্গে তার খুব বেশি পরিচয় নেই। তবে একদিন সে নাম করবেই।

সেই থেকে স্টিফেন নিজেকে কিডারমিনস্টার পরিবারের মধ্যে খুব সহজেই মানিয়ে নিলো। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো।

মাস দুই পরে স্টিফেন নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য সারপেনটাইনে সান্দ্রার সঙ্গে দেখা করলো।

সান্দ্রা, তোমাকে আমি ভালোবাসি। স্টিফেন বলতে থাকে। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমাকে তুমি তোমার জীবনসঙ্গিনী করে লজ্জা পাবে না।

-না না, লজ্জা পাবো কেন? আমিও তো তোমার কথা ভাবি। তুমি বুঝতে পারো না?

-পারি, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারি না। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

–আমিও তোমাকে ঐ দিন ভালোবেসে ফেলি।

 সান্দ্রার পরিবারের সকলে যখন জানতে পারলো যে সে স্টিফেন ফ্যারাডেকে বিয়ে করতে চলেছে। তখন সবাই প্রতিবাদ করে উঠলো। কি তার পরিচয়? ওর সম্বন্ধে সান্দ্রা কতটুকুই বা জানে?

লর্ড কিডারমিনস্টার জানতেন তার মেয়ের স্বভাবের কথা। তার মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে, অনমনীয় মনোভাব তার। যদি সে মনে করে স্টিফেনকে বিয়ে করবে তাহলে তাকে কেউ সেই ইচ্ছে থেকে বিরত করাতে পারবে না।

-সত্যি, ছেলেটার মধ্যে প্রতিভা আছে। সুযোগ পেলে উন্নতি করতে পারবে। আমরা হয়তো এই যুবকটিকে আমাদের কাজে লাগাতে পারি।

লেডি কিডারমিনস্টারের মত কিন্তু অন্য। তার মেয়ের সঙ্গে স্টিফেন যে একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারবে, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তার অন্য মেয়েদের চেয়ে সান্দ্রার আকর্ষণ নিশ্চয়ই কম, তাছাড়া লাজুক মেয়ে। কিন্তু যুবকটির মধ্যে ভবিষ্যত অছে, সেকথা সকলে ভেবেই–

লেডি কিডারমিনস্টার একটি শর্তে রাজী হলেন এই বিয়েতে, যে তার হয়ে কাউকে প্রভাব খাটাতে হবে।

অতএব আড়ম্বরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আলোকজান্ডার ক্যাথেলিন হেইলির সঙ্গে স্টিফেন লিওনার্ড ফ্যারাডের। ইটালিতে তারা মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে এলো। ওয়েস্ট-মিনিস্টারে ছোটোখাটো একটা সুন্দর বাড়িতে ফিরে এলো। তাদের বিবাহিত জীবন সুখেই কাটতে লাগলো। স্টিফেন পার্লামেন্টের জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করলো আর সান্দ্রা তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো তার মনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে। তার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ভেবে স্টিফেন নিজেই এক একসময় অবাক হয়ে যেতো।

প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী হিসাবে সান্দ্রা যথার্থ। প্রতিটি কাজে ওর বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ স্পষ্ট। স্টিফেনের সঙ্গ সান্দ্রার আদর্শ বলে মনে হয়। তাদের দুজনের ভালোবাসা যেন একই খাতে প্রবাহিত। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে সাফল্যকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।

সাফল্যের আতিশয্যে স্টিফেন তখন আত্মহারা। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সে পনেরো দিনের জন্য যায় মরটিজে। হোটেল লাউঞ্জ অতিক্রম করতে গিয়েই রোজমেরি বারটনকে দেখতে পায়।

সেই মুহূর্তটুকু তার যে কি হয়েছিল সেই অনুভূতি কোনদিন সে উপলব্ধি করতে পারেনি। কাব্য করে বলা যায়, সেই মুহূর্তটি যেন এক বিদ্যুতের ঝলকানি। স্পর্শে আঁকুনি কিন্তু তার রেশ বহুদূর বিস্তৃত। সে অনুভব করে রোজমেরির প্রেমে পড়ে গেছে সে, সে প্রেমে আছে এক বেপরোয়া উন্মাদনা। তবে একথা ঠিক স্টিফেন কখনোই ভাবপ্রবণ নয়। ভালোবাসা হলো তার কাছে সীমাহীন, বলগাহীন, অনন্ত তত্ত্বহীন প্রেম।

তবে কি সে সান্দ্রাকে ভালোবাসে না। নিশ্চয়ই ভালোবাসে। কিন্তু সান্দ্রার বাবা যদি ধনী না হতেন তাহলে তাকে বিয়ে করার কথা ভাবত না। আজও সান্দ্রাকে সে ভালোবাসে, তার প্রতি আছে তার মমত্ববোধ, আর কৃতজ্ঞতাবোধ। তার সঙ্গ সাহচর্যে সে আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে পেরেছে।

কিন্তু রোজমেরির প্রেমে সে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে, পাগল করে দেওয়া রূপ, সোনালি চুল, নীল রঙের চোখের দৃষ্টি তাকে করে দিলো দিশেহারা। ঘুম-খাওয়া বিদায় নিলো তার কাছ থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় সান্দ্রার সঙ্গে সে নাচলো বটে, কিন্তু সেই নাচে ছিল না উন্মাদনা, কেমন বিমর্ষ ভাব। কিন্তু রোজমেরি জানে না স্টিফেনের আবির্ভাবটা তার মনে ঠিক কি রকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

বারটনরা এক সপ্তাহ আগে সেন্ট মরটিজ ছেড়ে চলে গেছে। তাদের আরো সাতদিন সেখানে থাকার কথা। কিন্তু স্টিফেনের মন বসলো না। স্টিফেন লন্ডন ফিরে এলো। সান্দ্রা কোনো আপত্তি করলো না।

লন্ডনে ফেরার পনেরো দিনের মধ্যে রোজমেরির সঙ্গে তার প্রেম হলো। মাত্র ছমাস তাদের ভালোবাসা স্থায়ী হয়েছিল। সেই ছমাস স্টিফেন কিন্তু কাজে একটুও গাফিলতি দেয়নি। সে তার রুটিনমাফিক কাজ করে গেছে। নির্বাচন এলাকা পরিদর্শন করেছে, পার্লামেন্টে রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে ঝড় তুলেছে। বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত থেকেছে, সান্দ্রার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেছে, এরই ফাঁকে রোজমেরির সঙ্গে দেখা করেছে।

একটা গোপন ফ্ল্যাটে তাদের দেখা হতো। রোজমেরির রূপের মাধুর্য, তার প্রতি স্টিফেনের দুর্বার আকর্ষণ, তার আবেগভরা আলিঙ্গন-সব যেন স্বপ্ন। সাড়া জাগানো মন মাতানো স্বপ্ন।

কিন্তু প্রেমিকার বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে স্টিফেন ভাবতো, সে আর রোজমেরির সঙ্গে দেখা করবে না। সে হচ্ছে সান্দ্রার স্বামী। যদি সান্দ্রা তাকে সন্দেহ করে বসে। এতখানি ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু সান্দ্রা স্বামীর প্রতি কখনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। রোজমেরির স্বামী বড় অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক। স্ত্রীর ন্যায়-অন্যায়ের দিকে কি তার নজর পড়ে না? না কি বয়সে অনেক বড় বলে সে তার যুবতী স্ত্রীকে হারাবার ভয়ে কোনো খবরদারি করতে চায় না।

-ফেয়ারহেভনে গেলে কেমন হয়? স্টিফেন স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, গলফ খেলে একঘেয়েমিটা কাটাতে চাই।

-বেশ তো কালই চলে। তবে তোমার কয়েকটা মিটিং বাতিল করতে হবে।

 –ওতে কিছু অসুবিধা হবে না। পরে উদ্যোক্তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।

স্টিফেন মনে মনে ভাবে গলফ খেলার নাম করে রোজমেরির সঙ্গে তার দেখা হওয়াটাই বড় কথা।

রোজমেরি তাকে চিঠি লেখে। নিষেধ করেছে স্টিফেন। এ মারাত্মক খেলা। এ অন্যায়। সান্দ্রা অবশ্য কোনোদিন তাকে প্রশ্ন করেনি এ ব্যাপারে। কিন্তু এটা যে অন্যায় তা তো স্বীকার করতেই হবে। তাছাড়া চাকর-বাকরদের ওপর সবসময় বিশ্বাস করা যায় না।

খাম খুলে স্টিফেন তাজ্জব। পাতার পর পাতা প্রেমপত্র। রোজমেরি লিখেছে, স্টিফেনকে রোজ না দেখতে পেয়ে সে থাকতে পারে না। স্টিফেনেরও কি একই অবস্থা হয়? আদর করে রোজমেরি তাকে লিওপার্ড বলে ডাকতো এবং স্টিফেন তার নাম রেখেছিল ব্ল্যাক চিউটি।

এই চিঠি লেখালেখি তাদের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে, রোজমেরিকে সেটা বোঝানো যাচ্ছে না।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে আর একটা চিঠি এলো। খামের ওপরে সান্দ্রা চোখ বুলিয়ে নিলো। স্টিফেন ভয়ে সচকিত হয়ে রইলো। তবে অহেতুক প্রশ্ন করার স্বভাব নেই সান্দ্রার, সেটা স্টিফেন জানে। হলোও তাই। চিঠিটা দেখলো। কিন্তু কিছুই জানতে চাইলো না।

স্টিফেন গাড়ি নিয়ে বেরোলো! শহর থেকে আট মাইল দূরে একটা বাজার থেকে সে রোজমেরিকে ফোন করলো।

-হ্যালো রোজমেরি, তুমি আর চিঠি লিখো না।

প্রিয়তম স্টিফেন, আমার চিঠি কি তোমার পছন্দ হয়নি? আমার চিঠি পড়তে পড়তে তোমার কি মনে হয়নি যে আমি তোমারই পাশে আছি। তোমাকে আমি প্রতি মুহূর্তে কাছে পেতে চাই স্টিফেন। তোমারো কি তাই মনে হয়?

নিশ্চয়ই মনে হয় রোজমেরি। কিন্তু তোমার জন্য আমার চিন্তা হয়। আমার জন্য তুমি কষ্ট পাও তা আমি চাই না।

-ও সব আমি তোয়াক্কা করি না। ছাড়ো ওসব কথা। তুমি কবে আসছো?

মঙ্গলবার।

–অতোদিন অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় প্রিয়তম। কিন্তু কি আমাকে..

স্টিফেনের কোনো কাজে রোজমেরির আগ্রহ নেই। সে কেবল শুনতে চায় যে স্টিফেন তাকে ভালোবাসে কি না। এই একটি কথাই সে বার বার জিজ্ঞেস করে।

ভালোবাসে ঠিকই। কিন্তু বিবাহিতদের পক্ষে ঘন ঘন ফোন করা, চিঠি দেওয়া, দেখা করতে বলা, এটা কি সম্ভব।

কিন্তু স্টিফেন যদি তার কথার সায় না দেয় তাহলেই রেগে যাবে। তখনই ঐ একই সুরে বলতে হবে তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি প্রিয়তমা। তবেই তার মন ভাঙবে।

তারপর হঠাৎ একদিন রোজমেরি এক অস্বাভাবিক দাবী নিয়ে হাজির হলো তার কাছে। স্টিফেনকে নিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে যেতে চায়, নতুবা সিসিলি অথবা কোরসিকায় যেখানে তাদের কেউ চিনবে না, সেখানে তারা একসঙ্গে মিলিত হবে।

কিন্তু এই দাবী মেনে নিতে পারেনি স্টিফেন।

এরপর রোজমেরি হাসতে হাসতে আর একটি প্রস্তাব দিলো। সেটা যে কত ভয়ঙ্কর তা তার মাথায় এলো না।

–প্রিয়তম লিওপার্ড, এরকম ভাবে লুকোচুরি খেলা আর ভালো লাগছে না। আমি জর্জকে ডিভোর্স করি, তুমিও সান্দ্রাকে ডিভোর্স নোটিস দাও। তারপর আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি।

স্টিফেন প্রবলভাবে ঘাড় নেড়ে জানালো, এ সম্ভব নয়। নিজের কবর নিজে খোঁড়ার মতো অবস্থা।

কিন্তু রোজমেরি বেপরোয়া।

-প্রেম মানুষের জীবনে এক অতি প্রয়োজনীয় বস্তু। লোকের কথায় কিছু যায় আসে না।

-না না, তা কখনো হয় না। আমার এতদিনের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠা নিমেষের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার রাজনৈতিক জীবন একেবারে ধুলোর সঙ্গে মিশে যাবে।

–তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। আমার অনেক অর্থ আছে। আমরা পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়াবো। নতুবা কোনো দ্বীপে আমরা দুজনে বাস করবো। সেখানে কেবল তুমি আর আমি থাকবো। 

এসবও ভেবেছে স্টিফেন। কিন্তু এসবই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। সে উপলব্ধি করলো, এখনো সময় আছে রোজমেরির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার। নতুবা তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। রোজমেরি কোনোরকম তার আপত্তি শুনবে না। অতএব তাকেই ওর কাছ থেকে সরে আসতে হবে।

তাকে ভালো করে বোঝাতে হবে, তাদের গোপন সম্পর্কের সমাপ্তি এখানেই।

রোজমেরির প্রেম যতই তাকে আকৃষ্ট করুক না কেন, সান্দ্রাকে হারানো তার চলবে না। সান্দ্রার ওপর অন্যায় করা হবে। তাহলে মস্ত অবিচার করা হবে। না সে কোনোমতেই সান্দ্রাকে হারাতে পারবে না। এর জন্য যদি রোজমেরির সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়

কিন্তু রোজমেরির বন্ধন ছিন্ন করে সে কি করে বেরিয়ে আসবে? ওর কোনো যুক্তির ধার ধারে না। ওকে নিজের পথ থেকে সরাতে একটা মাত্র উপায় আছে, খুন করা। বিষ দিয়ে তাকে চিরদিনের মতো চুপ করিয়ে দেবে। অবশ্য এর জন্য তাকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

এর মধ্যে রোজমেরি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলো। ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে রোজমেরিকে সৌজন্যতা জানিয়ে এলো।

পরের সপ্তাহে রোজমেরির জন্মদিনের পার্টিতে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হলো। স্টিফেন একান্তে ডেকে তাকে তার মনের কথা জানাতে চাইলো যে ওদের গোপন সম্পর্ক এখানেই শেষ। সম্ভবত রোজমেরি সেটা বুঝে থাকবে। তাই আগে ভাগে বলে দিলো–আজ ওসব আলোচনা নয়। জর্জকে দুদিন পর জানাবো। সে তো আমার স্বামী। তাকে আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। তাই ভাবছি দুদিন পর তাকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেবো। তারপরেই আমি তোমার হবো, তুমি আমার হবে।

সর্বনাশ! এ অবস্থায় যদি স্টিফেন তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে সান্দ্রা জর্জের মুখ চেয়ে সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় তাহলে তো এক বিশ্রী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে রোজমেরি। কান্নাকাটি করে জর্জকে সে সব কথা জানাবে। স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে সে ডিভোর্সে রাজী হয়ে যাবে। তারপর রোজমেরি যাবে সান্দ্রার কাছে। একজন নারীর মনে তার স্বামী সম্পর্কে একবার সন্দেহ ঢুকলে তার অবসান করা মুশকিল। সে চাইবে না, তার স্বামীকে মিথ্যে ধরে রাখার। অতএব রোজমেরির অনুরোধে সান্দ্রা স্টিফেনকে মুক্তি দিয়ে দেবে।

তাহলে উপায়?

বিষ মেশানো এক গ্লাস শ্যাম্পেন দিয়ে রোজমেরির জীবন শেষ করে দিতে হবে। রোজমেরির শ্যাম্পেনের গ্লাসে পটাশিয়াম সায়ানাইড। টেবিলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় স্টিফেন দেখলো, সান্দ্রা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ এক বছর পরেও সে দৃষ্টি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

.

আলেকজান্ডার ফ্যারাডে

১.৫

 রোজমেরি বারটনকে আজও মনে পড়ে সান্দ্রা ফ্যারাডের। সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রেস্টুরেন্টে ডাইনিং টেবিল অতিক্রম করতে গিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, স্টিফেন তাকে লক্ষ্য করছে।

সে কি লক্ষ্য করেছিলো, তার চোখে কি পরিমাণে ঘৃণা, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল?

ওর স্মৃতির মণিকোঠায় আজও রোজমেরি উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। সান্দ্রার মনে এমন কি স্টিফেনের মনেও রোজমেরি আজও জাগ্রত।

সান্দ্রা ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সবই যেন চক্রান্ত। এমন কি ফেয়ারহেভেনও আজ আর প্রশ্নাতীত নয়, বিশেষ করে কাছেই লিটল প্রায়রসে জর্জ বারটনের বাড়ি কিনে বসবাসের পর থেকে।

জর্জ বারটন এক বিচিত্র মানুষ, বলা চলে বোকা। এরকম প্রতিবেশী সান্দ্রার পছন্দ নয়।

স্টিফেন আর সান্দ্রা খুব সুখেই ছিলো। চিরজীবন তারা এইভাবে কাটাতে পারতো। কিন্তু রোজমেরির আবির্ভাবে সব এলোমেলো হয়ে গেল। স্টিফেন পাল্টে গেল। সে যেন সান্দ্রার মধ্যে আগের মতো আর আকর্ষণ অনুভব করে না।

বিয়ের পরেই সান্দ্রা লক্ষ্য করেছিলো, স্টিফেনের মনোভাব। ও যেমন স্টিফেনকে ভালোবাসে, স্টিভেন কিন্তু তেমন করে তাকে ভালোবাসে না। হয়তো সান্দ্রা ভালোবাসার পক্ষে অযোগ্য। সেদিন হঠাৎ এ কথাটা তার মনে উদয় হয়েছিল। অথচ ওর একসময় মনে হয়েছিলো, স্টিফেনের ভালোবাসা ওর কাছে এতই তীব্র এবং আকাঙ্ক্ষিত ছিল যে তার জন্য ও স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, মিথ্যে কথা বলতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করতে পারে। বিনিময়ে সান্দ্রা চেয়েছিলো, ওর সাহচর্য, ওর সহানুভূতি, ওর বুদ্ধিদীপ্ত সাহায্য। এই সমস্ত সুযোগ এবং সুবিধা পাওয়ার জন্যই স্টিফেন বোধ হয় ওকে চেয়েছিলো, ওর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্য নয়।

এই সেদিনও সান্দ্রার বিশ্বাস ছিলো, স্টিফেন তাকে ভালোবাসে।

তারপর একদিন ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হলেন রোজমেরি। সেই থেকে শুরু হলো তার বেদনাদায়ক জীবন।

কিন্তু স্টিফেন কি বুঝতে পারেনি, রোজমেরির আবির্ভাবে সান্দ্রার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে? সে প্রথম দিনই সেন্ট মারটিজে রোজমেরির সঙ্গে স্টিফেনের প্রথম আলাপের সময় যে ভাবে তাকায়, ঠিক সেই রকম যেন, সেইদিনই সান্দ্রার বুঝতে দেরি হয় না, ভদ্রমহিলা স্টিফেনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায়।

তারপর থেকেই তার বুকের মধ্যে জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। তার মন বিষিয়ে উঠেছে তার পরের দিন থেকে। কিন্তু সমস্ত মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। নিজের বংশমর্যাদা আভিজাত্য এবং মনের প্রসন্নতা দিয়েও উপলব্ধি করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছে, এইসব মানসিক যন্ত্রণার কথা স্টিফেনকে একটুও বুঝতে দেবে না। মনের সঙ্গে সমানে লড়াই করতে করতে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, রাতের ঘুমও উধাও হয়েছে। সে কেন রাতের পর রাত জেগে কাটাচ্ছে, সে সব খোঁজ কখনো স্টিফেন নেয়নি। তার অত সময় কোথায়? তখন সে রোজমেরিকে নিয়ে ব্যস্ত। সেই জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য উত্তেজক ট্যাবলেট খেয়েছে, তবু স্টিফেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কখনো করেনি।

তবে সে একটা সত্যি উপলব্ধি করেছে স্টিফেনকে ত্যাগ করার ইচ্ছে তার নেই। অপরদিকে স্টিফেন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য তাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না। ওর আশা রোজমেরির ওপর মোহ একদিন লোপ পাবে, তার শুভবুদ্ধি জেগে উঠবে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে রোজমেরির মধ্যে এমন কি আছে, যার জন্য স্টিফেন পাগলের মতো তাকে নিয়ে মেতে উঠেছে।

সান্দ্রার মতে, রোজমেরি একটা নিরেট বোকা। স্বীকার করতে হবে পুরুষদের ভোলানোর মতো রূপ আছে তার। বশ করার যাদুমন্ত্রও তার জানা আছে। কিন্তু একদিন না একদিন তার সেই রূপ ধসে যাবে। তখন তার সঙ্গের মধ্যে ক্লান্তি খুঁজে পাবে। তখন সে রোজমেরির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসবে, এটা সান্দ্রার বিশ্বাস।

স্টিফেনের উচ্চাশাই সান্দ্রাকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছে। স্টিফেন কখনো নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিসর্জন দিয়ে চিরদিন একজন বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে পড়ে থাকবে না। তাই সে হাজার দুঃখ-যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেছে।

তাই অন্তর থেকে নিজেকে বুঝিয়েছে, সে কেবল স্টিফেনের, স্টিফেন তার একার। সে তার দেহমন সব স্টিফেনকে সমর্পণ করেছে, এটা কখনো মিথ্যা হতে পারে না।

সেই আশাতে বুক বেঁধে একদিন স্টিফেনকে নিয়ে সে চলে আসে ফেয়ারহেভেনে। স্টিফেন আগের মতো তার সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। আবার আগের মানুষে সে ফিরে এলো। সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে স্টিফেনের ভালোবাসায় সাড়া দিলো সে। বোধহয় এখানেই সান্দ্রার ভালোবাসার সার্থকতা লাভ করলো। ও ঠিক করলো, এই ভাবেই রোজমেরি আর স্টিফেনের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করবে।

একদিন তারা লন্ডনে ফিরে এলো। স্টিফেন তখন আর সেই মানুষ রইল না। কেবল চঞ্চল মন। কাজে মন বসাতে পারে না। আগের মতো উন্মনা ভাব।

রোজমেরি তাকে নিয়ে কোথায় পালিয়ে যেতে চায়, তাই স্টিফেনের মন উতলা, এটা সান্দ্রার কাছে অজানা রইলো না।

একদিন এক ককটেল পার্টিতে দুজনের গোপন কথাবার্তা সান্দ্রা আড়াল থেকে শুনছিল। তবে টুকরো টুকরো।

–আমাদের ইচ্ছের কথা জর্জকে জানাচ্ছি।

এর কয়েকদিন পর রোজমেরি ফ্রতে পড়ে। নিউমোনিয়া তাকে শয্যাশায়ী করে দিলো। অনেকে এই অসুখে মারা যায়। সেদিন সান্দ্রাও তার মৃত্যু কামনা করেছিল ঈশ্বরের কাছে।

কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হলো না।

লুক্সেমবার্গের সেই ক্লোক রুমে সেদিন রোজমেরিকে অপরূপ লাগছিল। পরনে শৃগালের চামড়ার লাল স্টোল এলোমলা ভাবে রয়েছে, ধবধবে সাদা কাধ দেখা যাচ্ছে। মুখটা বিষণ্ণ। কিন্তু তার সৌন্দর্যে এতুকু ভাটা পড়েনি। হাতে তার শূন্য গ্লাস, মনে হয় স্বর্গ থেকে কোনো দেবী পৃথিবীতে নেমে এসেছে।

সান্দ্রা ঠিক তার পেছনেই ছিল। তার চোখ পড়লো আয়নায়। এ কার মুখ দেখছে সান্দ্রা। নিজের মুখকে চিনতে কষ্ট হলো তার। চোখে একরাশ ঘৃণা, পাথরের মতো শক্ত চোয়াল।

ও সান্দ্রা, রোজমেরির ডাকে সান্দ্রা সচেতন হয়। আমি কি আজ খুব ড্রিঙ্ক করেছি? আমার গ্লাস যে খালি হয়ে গেল। আমার একটু মাথা ধরেছে জানো। ইনফ্লুয়েঞ্জার পর থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তোমার কাছে অ্যাসপিরিন আছে?

-না, অ্যাসপিরিন নেই। তবে ক্যাচেট ফেভর আছে।

-তাই দাও। তারপর রোজমেরি সেটা সান্দ্রার কাছ থেকে নিয়ে হাত ব্যাগে রেখে বললো, এখন থাক, প্রয়োজনে খাবো।

ওরা ক্লোক রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সান্দ্রার ঠোঁটে রূঢ় হাসি এবার আর স্টিফেন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে না।

হলঘরে ঢুকে সান্দ্রা স্টিফেনের দুর্দান্ত চোখের দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেল।

.

 জর্জ বারটন

১.৬

 রোজমেরি…

একটু ড্রিঙ্ক করে জর্জ বারটন আজ কেমন বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

রোজমেরি জানতো, যে তার জন্য জর্জ পাগল ছিল। রোজমেরি সম্পর্কে কোনো চিন্তা ভাবনা, এমনকি বিয়ের প্রস্তাবের সময়েও তাকে কেন জানি না তার হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল।

-রোজমেরি, আমি জানি এই বয়সে তুমি আমার দিকে তাকাবে না। সেটাই স্বাভাবিক। আমি বোকা বোকা ভাব নিয়ে সবসময় ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকবো। তবু তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

রোজমেরি সেদিন হেসে উঠেছিলেন। জর্জের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিলেন, তুমি অনেক সুন্দর জর্জ। তোমার প্রস্তাব আমি মনে রাখবো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।

–বেশ তো, ভালো করে ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত জানিও।

জর্জ খুব ভালো করেই জানতেন যে রোজমেরি তাকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি রোজমেরি বলেছিলেন–তুমি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারো না। এতটুকু ভালোবাসার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি। তোমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে চাই। আমি জানি, সব ভালোবাসারই পরিণতি সুখের হয় না। তুমি আমাকে ভালোবাসো, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট।

বিয়ের পর প্রথম দিকে তাদের সুখ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। জর্জ জানতেন, এই সুখ নামে পাখিটা একদিন আকাশে উড়তে চাইবে। একদিন না একদিন অপ্রত্যাশিত বাধা আসবেই। ওদিকে তাঁর মতো নিরুত্তাপ পুরুষের সঙ্গ পেয়ে রোজমেরি তৃপ্ত হতে পারলেন না।

তাই তিনি নিজের মনকে তৈরি করছিলেন সেই অপ্রিয় ঘটনাকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য। রোজমেরির একটা দুর্বলতা ছিলো স্বামীর প্রতি। জর্জের ভালোবাসা স্থায়ী এবং অপরিবর্তিত।

রোজমেরির অসাধারণ রূপ, তার সন্দেহজনক আচরণের ফলে একটা কিছু যে ঘটবে তা আর বিচিত্র কি। কিন্তু কখনো তিনি তার মনে প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করেননি।

প্রথমদিকে জর্জ বিশেষ গুরুত্ব দেননি। একটি যুবকের সঙ্গে রোজমেরির প্রেমের ভাব হতে পারে। কিন্তু একদিন তিনি জানতে পারনে তার সন্দেহে কোনো ভেজাল নেই। সেটা যে কত নোংরা, জঘন্য বলে মনে হয়েছিল সেদিন জর্জের, তা বলার মতো নয়।

অতীতের পৃষ্ঠা ওলটাতে লাগলেন জর্জ বারটন। চোখের পরদায় ফুটে উঠলো সেই ছবি। রোজমেরির বসার ঘরে একদিন হঠাৎ জর্জ ঢুকে পড়লেন। ভূত দেখার মতো তিনি চমকে উঠলেন। দ্রুত হাতে টেবিলের ওপর কোর প্যাড আড়াল করলেন। জর্জ বুঝতে পারলেন, রোজমেরি তার প্রেমিকাকে চিঠি লিখছেন।

খানিক বাদে রোজমেরি চিঠির প্যাড সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জর্জ টেবিলের কাছে এগিয়ে এলেন। ব্লটারটা হাতে তুলে নিলেন। সদ্য পড়া কালির দাগ স্পষ্ট। তিনি নিজের ঘরে সেটি নিয়ে এলেন। চশমা চোখে পড়ে ব্লটারের ওপর নজর দিলেন–আমার প্রিয়তম…রোজমেরির হাতের লেখা স্পষ্ট ভেসে উঠলো।

তার চোখ লাল হয়ে উঠলো। ক্রোধে কান দিয়ে আগুন বেরোতে লাগলো। তিমি মনে মনে। স্থির করলেন, ঐ যুবকটিকে চিরদিনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় দেবেন। কিন্তু কে সেই যুবক? কে রোজমেরির প্রেমিক? ব্রাউন? না কি নাছোড়বান্দা স্টিফেন ফ্যারাডে। এই দুটি নাম জর্জের মনে পড়লো কারণ ওরা রোজমেরির দিকে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাতো। রোজমেরির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওরা কেমন হাবা হয়ে যায়।

জর্জের সব মনে পড়ে। উত্তেজনার চোটে তার হাত থেকে চশমা নিচে পড়ে যায়। এমন কি এখনো

তিনি আজ সেই সব বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করতে চান না। কোন লাভ নেই ওসব ভেবে। কেবল মন ক্ষত-বিক্ষত হয়। বরং রোজমেরির মৃত্যু তার জীবনে এনেছে শান্তি। পরম শান্তি।

আশ্চর্য, রুথকে তো একথা বলা হয়নি যে রোজমেরি মরে গিয়ে তাকে শান্তি দিয়ে গেছে। রুথকে বিশ্বাস করে সব বলা যায়। ঐ মুহূর্তে তিনি একটা জিনিস উপলব্ধি করেন, রুথ না থাকলে তার দারুণ কষ্ট হবে। তার প্রতিটি কাজে সে সহযোগিতা করে প্রয়োজনে উপদেশ দেয়, এমন কি দুঃখজনক ব্যাপারে সে সহানুভূতি জানায়। রুথের অবর্তমানে তার কাছে সব কিছু ফাঁকা লাগবে। শূন্য হয়ে যাবে সব। রোজমেরি কেবল দিয়ে গেছে, কখনো কিছু নেয়নি। এমনকি কখনো কামনা বাসনার কোনো আভাস দেয়নি সে।

আবার স্মৃতি উঁকি দিলো জর্জের মনের কোণে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ওঠার পর রোজমেরিকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছিল। একটি রেস্তোরাঁর গোল টেবিলের সামনে সে বসেছিল, তার এক ঘণ্টা পরে

না, আর তিনি অতীতকে মনে করবেন না। অগে তিনি তার পরিকল্পনা ভেবে দেখবেন।

 চিঠিগুলি রেসকে দেখাবেন তিনি। ঐ চিঠির ব্যাপারে আইরিসের যে বিন্দুমাত্র ধরাণা নেই সেটা তার বোবা মুখ দেখে বোঝা গেছে।

যা করার তিনি নিজেই করবেন।

দোসরা নভেম্বর, খ্রিস্টানদের পরবের দিন লুক্সেমবার্গে সেই টেবিলটা দখল করবেন তিনি।

এ্যানথনি ব্রাউন, স্টিফেন ফ্যারাডে, সান্দ্রা ফ্যারাডে আমন্ত্রিত হবেন এছাড়া থাকবেন রুথ, আইরিস এবং তিনি নিজে। সপ্তম অতিথি হবেন রেস। তারপরেও একটি চেয়ার খালি থেকে যায়। ব্যাপারটা অত্যন্ত নাটকীয় হবে। নতুন করে ফিরে আসবে সেই সব দৃশ্য।

রোজমেরির জন্মদিন, জর্জ বারটন উদাস হয়ে ভাবেন।

গোল টেবিলে ফুলের স্তূপ। হাত-পা ছড়ানো টানটান করে টেবিলের ওপর পড়ে আছে রোজমেরির-মৃত…