১১. কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়

১১.

কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়-শিবিরের বিরাট ফটকটা অভিযাত্রীদের পেছনে যান্ত্রিক শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো। শব্দটা হিলারীর হতচেতন স্থাণু মনের ওপর যেন কেটে কেটে বসলো। শব্দটা যেন এই কথাই বলে গেলো, আশা ত্যাগ করো-তোমরা যারা ভেতরে এসেছে–ফেরার আশা ত্যাগ করো…এইবার সব শেষ, ভাবলো হিলারী…সত্যিই এবার সব শেষ, ফিরে যাবার শেষ পথটুকুও রুদ্ধ হয়ে গেলো।

শত্রুদের মাঝে সে এখন সম্পূর্ণ একা। কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার আর ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। অবচেতন মনে এই কথাটাই তার বারবার মনে হয়েছে। তবুও মানুষের আশা আর মনের জোর দিয়ে সে বারবার চিন্তাটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ক্যাসাব্লাঙ্কায় সে একবার জেসপকে জিজ্ঞেস করেছিলো, টম বেটারটনের সামনে যখন হাজির হবো, তখন কী ঘটবে?

জেসপ বলেছিলেন, সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। তিনি আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা আশাই রয়ে গেলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না হিলারীর, সেই আশা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

মিস হেদারিংটন যদি জেসপের পাঠানো গুপ্তচর হয়, তাহলে মিস হেদারিংটনও ম্যারাকেশে এদের কাছে বুদ্ধ বনে ফিরে গেছে। কী-ই বা করতে পারতো।

ভ্রমণার্থীদের দলটা এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হিলারী নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছিলো, হেরে গেছে। সে এখন আর কিছুতেই মরতে চায় না। সে মনে মনে ভাবছিলো, আমি আবার বেঁচে উঠবো, সম্পূর্ণ সুস্থ, পুরোপুরি একজন নারী..কিন্তু এখন–ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করছি আমি, পালাবার মতো একটা পথও যদি ভোলা থাকতো।…

নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকলেও আসল সমস্যার কথা মোটেও ভোলেনি। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে যখনই তার বেটারটনের সঙ্গে দেখা হবে তখনই সব শেষ হয়ে যাবে…বেটারটন হয়তো বলবে এ তো আমার স্ত্রী নয়–আর একথা বলা মানেই ব্যস। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বাইরে থেকে আসা ছোট দলটিকে একজন বিশালদেহী পুরুষ অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে দেখে দোভাষী মনে হলো কেননা সবার সাথেই তিনি দু-একটা কথা বললেন, তাদেরই ভাষায়। ডাঃ ব্যারনকে দেখে বললেন, ডাক্তার আপনার জ্ঞানের কথা অনেক শুনেছি। আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা কৃতার্থ। তারপরেই হিলারীর দিকে ফিরে বললো, আরে মিসেস বেটারটন! আপনাকে এখানে পেয়ে আমরা ভীষণ আনন্দিত। পথের ধকলে খুব কষ্ট পেয়েছেন? আপনার স্বামী খুব ভালো আছেন আর স্বভাবতই আপনার আসার জন্য উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছেন।

অদ্ভুত হাসি হেসে বললো, আপনিও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন।

মনের অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। পাশ থেকে অ্যান্ড্রু পিটার্স তার কাঁধে হাত রেখে যেন সাহস জোগালো। ভদ্রলোককে বললো, আমার মনে হচ্ছে মিসেস বেটারটন যে ক্যাসাব্লাঙ্কায় প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন, সেটা আপনি শোনেননি! অচিরেই স্বামীকে দেখার উত্তেজনাটাও ওঁর পক্ষে বোধহয় ভালো হবে না। আমি বলবো, এই মুহূর্তে একটা অন্ধকার ঘরে গিয়ে ওঁর শুয়ে পড়া উচিত। পিটার্সের গলায় আর হাতের চাপে স্পষ্ট সহানুভূতির ছোঁয়া পেলো হিলারী। মনটা আবারও যেন একটু দুলে উঠলো। এই মুহূর্তে এদের চোখের সামনে–সারাদেহ অবশ করে ধীরে ধীরে ঢলে পড়া কত সহজ..আস্তে আস্তে হাঁটু দুমড়ে পড়বে…অজ্ঞানের ভান করতে পারবে সে।

সাহস ফিরে পেলো হিলারী, পা-দুটোকে সোজা করে দাঁড় করালো, ফ্যাকাসে মুখে তাবার রক্ত চলাচল শুরু হলো, সে নিজেই বেটারটনের কাছে যাবে, আর সে যখন তাকে নিজের স্ত্রী বলে মানতে অস্বীকার করবে তখন সে তার শেষ মিথ্যে কথাটা ছুঁড়ে দেবে–অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নির্ভয়ে জবাব দেবে সে। না, নিশ্চয়ই আমি আপনার স্ত্রী নই, আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর সময় আমিও সেই হাসপাতালে ছিলাম। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে-করেই হোক আমি আপনার কাছে তার শেষ কথাগুলো পৌঁছে দেবো। তাই করছিলাম আমি।

গা-ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো হিলারী। এখন আর পিটার্সের আশ্বাসের প্রয়োজন নেই তার। বললো, না-না, আমি টমের সঙ্গে দেখা করবো। এক্ষুনি তার কাছে আমায় নিয়ে চলুন–প্লিজ–এক্ষুনি।

ভদ্রলোক হিলারীর মনের কথা বুঝে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়ই মিসেস বেটারটন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি। এই যে মিস জেনসেন এসে গেছেন।

চশমা পরা রোগামতন একটি মেয়ে এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল। ভদ্রলোক আমাদের সবার সাথে মেয়েটিকে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়েটিকে বললেন, আপনি এদের রেজিষ্ট্রি ঘরে নিয়ে যান আমি মিসেস বেটারটনকে নিয়ে ওঁর স্বামীর কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবো।

ভদ্রলোকের পিছু পিছু চললো হিলারী। বারান্দার বাঁকের মুখে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো অ্যান্ড্রু পিটার্স তখনও তাকে লক্ষ্য করছে। হিলারীর মনে হলো, ও হয়তো কিছু একটা সন্দেহ করেছে, হয়তো তার ব্যবহারে এমন কিছু বুঝেছে যাতে কোনো অশুভ চিন্তা করেছে–অথচ কী যে অশুভ চিন্তা তা বুঝতে পারছে না। বাঁকের মুখে অদৃশ্য হবার আগে হিলারী হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালো।

ভদ্রলোক হিলারীকে ডাকলেন, এইদিকে আসুন মিসেস বেটারটন। প্রথম প্রথম এই বাড়িটাকে আপনার গোলকধাঁধার মতো মনে হবে। অজস্র বারান্দা, সবগুলো প্রায় একইরকম।

স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো হিলারীর। ঝকঝকে সাদা বারান্দা এখান দিয়ে স্বপ্নের ঘোরে ঘুরে বেড়াও কিন্তু বেরোবার পথ কোনোদিনই খুঁজে পাবে না…। বললো, এটা যে একটা হাসপাতাল আমি ভাবতেও পারিনি।

-না না, বটেই তো, কিছুই বোঝার কথা নয় আপনার, তাই না? গলায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক। চোখ ধাঁধিয়ে যায় এখানে। হ্যাঁ, ভালো কথা, আমার নাম ভ্যান হিদেম। পল ভ্যান হিদেম।

–সবকিছুই যেন কেমন এখানে–ভীতিকরও বটে। ওই কুষ্ঠরোগীরা

-হা, ঠিকই বলেছেন, এখানে সবকিছুই যেন ছবির মতো। নতুন কেউ এলে ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এও আপনার অভ্যাস হয়ে যাবে। ভ্যান হিদেম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আসুন, এই সিঁড়িটা উঠলেই–উঁহু ব্যস্ত হবেন না। স্থির হোন এই তো পৌঁছে গেছি আমরা।

হ্যাঁ, এই তো পৌঁছে গেছি–পৌঁছে গেছি মৃত্যুর ঠিকানায়…আর মাত্র একটা ধাপ…ওপরে… ওপরে…গভীর…খাড়াই সিঁড়ি…ইউরোপীয় সিঁড়ির চেয়ে অনেক বেশি খাড়াই সিঁড়ি…পৌঁছে, গেছি। আর ওই তো। আরেকটা বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভ্যান হিদেম। দরজায় টোকা দিয়ে একটু অপেক্ষা করলো-তারপর দরজা খুলে ফেললো।

-এই যে বেটারটন-শেষ পর্যন্ত সত্যিই আমরা এসে পড়লাম। তোমার স্ত্রী-বলে হিলারীকে ভেতরে যাবার পথ করে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ভ্যান হিদেম।

ঘরে ঢুকলো হিলারী। না–ভয় করছে না আর। হাতে-পায়ে খিলও ধরছে না আর। থুতনি উঁচু করে সে এগিয়ে চললো অন্ধকার গহ্বরের দিকে।

অপূর্ব সুন্দর একজন জানালার কাছে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একনজর পুরুষের রূপে মুহূর্তের জন্য মুগ্ধ গয়ে গেলো হিলারী। কিন্তু টম বেটারটনকে যেমন দেখতে ভেবেছিলো এ যেন তেমন দেখতে নয়। না–অন্তত তাকে যে ছবি দেখানো হয়েছিলো, সেরকম তো নিশ্চয়ই নয় তবে?

এই বিভ্রান্তিকর চমকই তাকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিলো। এবার সে সর্বশক্তি দিয়ে, সাংঘাতিক কৌশলটাকে কাজে লাগাবে।

হঠাৎ সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে এসে চিৎকার করে বললো, না–এ টম নয়। এ আমার স্বামী নয়…।

অভিনয়টা এমন চমৎকার হয়েছে সে মনে মনে নিজেকে তারিফ করলো।

টম বেটারটন হো হো করে হেসে উঠলো। চমৎকার! চমৎকার-তাই না ভ্যান হিদেম। এত চমৎকার যে আমার নিজের স্ত্রীও আমাকে চিনতে পারছে না। দ্রুত কয়েক-পা এগিয়ে এসে সে হিলারীকে জড়িয়ে ধরে বললো–অলিভ, আমার অলিভ। তুমিও আমাকে চিনতে পারছো না? আমি টম–সত্যিই টম–যদিও আমার মুখটা এখন আর আগের মতো নেই, তবুও সত্যিই আমি টম। আবেগে তার গলা জড়িয়ে এলো। হিলারীকে খুব আদর করতে লাগলো এবং ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যাও। দোহাই তোমার! সাংঘাতিক বিপদ!

গলার পাশে টমের আঙুলের চাপে বিপদবার্তা শুনতে পেলো হিলারী। যেন তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, অত্যন্ত জরুরী বার্তায় তাকে সাবধান হতে বলছে।

কিছুক্ষণ পরেই টম তাকে ছেড়ে দিলো। একটু পিছিয়ে এসে সোজা তার মুখের দিকে তাকালো। এ আমি–এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, অলিভ। সত্যিই তুমি এলে? এবার বলল আমাকে চিনতে পারছো তোতা?

কিছু বুঝতে পারছে না হিলারী কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু তবুও যেন কোন্ অলৌকিক শক্তিবলে সে সত্যিকারের অলিভ বনে গিয়ে বললো-ওঃ টম্! এই ডাকটুকুর মধ্যেই সে যেন মনের সবটুকু আবেগ ঝরিয়ে ফেললো। টম, ওঃ!–কিন্তু তোমার মুখ

অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভিয়েনার হার্জ স্বয়ং এখানে আছেন। আরো জানাই তো, তিনি একজন জীবন্ত বিস্ময়! এবার অনেক সহজভাবে আলতো করে সে চুম্বন করলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ভ্যান হিদেমের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, ক্ষমা করো ভ্যান।

-আরে না না, এ তো খুব স্বাভাবিক।

কত-কত দিন পর, ওঃ। হিলারী বললো, আর আমি একটু যেন টলে উঠলো সে, আমি একটু বসতে পারি!

টম বেটারটন তাড়াতাড়ি তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো, আরে ছি ছি, বসো। আমার খেয়ালই ছিলো না। এই কদিনের গাড়ির ধকল আর সেই প্লেন দুর্ঘটনা–খুব কষ্ট গেছে তোমার। ঈশ্বর করুণাময়, তাই তোমাকে ফিরে পেয়েছি।

আচ্ছা–তাহলে সব খবরাখবরই এখানে পৌঁছে গেছে। প্লেন দুর্ঘটনার কথাও এরা জানে। হিলারী বললো, হ্যাঁ, পেন দুর্ঘটনা আমাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক কথা মনে করতে পারি না। সব যেন গুলিয়ে যায় তার ওপর আবার মাথায় যন্ত্রণা। তোমাকে দেখে তাই প্রথমে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক মনে হয়েছিলো, কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে তুমি অস্বস্তিতে পড়বে না তো?

তোমাকে নিয়ে অস্বস্তিতে পড়বো? কি বলছো তুমি! কক্ষনো না, তুমি শুধু ব্যাপারটাকে একটু সহজভাবে নেবার চেষ্টা করো তাহলেই হবে।

ভ্যান হিদেম দরজার দিকে এগোলেন। আমি এবার যাই, বেটারটন, একটু পরে তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে রেজিষ্ট্রি ঘরে আসতে পারবে তো? এখন কিছুক্ষণ তোমাদের একা থাকা উচিত-দরজাটা টেনে দিয়ে তিনি বেরিলয়ে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে বেটারটন হিলারীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো। তার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলতে লাগলো, সোনা, সোনা আমার

আবার হিলারী তার আঙুলের চাপে বিপদ সংকেত অনুভব করলো। আবার ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যান। ঘরের মধ্যে কোথাও লুকানো মাইক্রোফোন বা অদৃশ্য চোখ থাকতে পারে।

সত্যিই–থাকাটা স্বাভাবিক। আছে কিনা কে বলতে পারে…। ভয়–অস্বস্তি–অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে বিপদ, ঘরের আবহাওয়ায় এগুলো যেন স্পষ্ট অনুভব করলো হিলারী।

টম বেটারটনও কোলে মাথা রেখে মুখের দিকে তাকালো। তোমাকে দেখতে কী ভালোই না লাগছে। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন সত্যি নয়। তোমারও কি তাই মনে হচ্ছে?

–হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই মনে হচ্ছে। এখানে আসা শেষপর্যন্ত তোমার পাশে। সবটাই যেন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আমার। এটাকে সত্যি বলে বিশ্বাসই করতে পারছি না টম। টমের দুকাঁধে আলতো হাত রেখে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হাসলো। কে জানে-মাইক্রোফোনের মতো হয়তো অলেক্ষ্য কেউ তাদের লক্ষ্যও করছে।

টম বেটারটনের দিকে তাকিয়ে সে স্বস্তি বোধ করলো। তিরিশের ওপর বয়স–অপূর্ব সুন্দর চেহারার মানুষটার মধ্যে কেমন যেন একটা বোকা বোকা ভীতচকিত ভাব।

প্রথম বাধাটা সে অতিক্রম করেছে নিজের অভিনয় ক্ষমতায় অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো হিলারীর বুক। হ্যাঁ, তাকে অলিভ বেটারটন হতেই হবে। অলিভের মতো চিন্তা করলে, অলিভের মতো কাজ করলে তবেই না অলিভ বেটারটন হতে পারবে।

তুমি–এখানে সুখে আছো তো? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না? চিরন্তনী নারীর অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন।

চমৎকার আছি। ভীতসন্ত্রস্ত, অসুখী মুখটাকে আড়াল করে টম বেটারটন মুখে দৃঢ় হাসির রেখা ফোঁটালো। সবরকমের সুবিধে রয়েছে এখানে। একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না। নিজের কাজে ডুবে থাকার আদর্শ পরিবেশ। আর এই প্রতিষ্ঠান? অবিশ্বাস্য!

-হ্যাঁ, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই, যেভাবে আমাকে আনা হয়েছে–আচ্ছা, তুমিও কি ওই পথেই এসেছ?

–তা তো জানি না, আমাকে কেউ বলেনি।

–কিন্তু ওই কুষ্ঠরোগী? এটা কি সত্যিই একটা কুষ্ঠোরোগীদের আশ্রম?

–হ্যাঁ, একদল ডাক্তার এদের নিয়ে মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। কিন্তু ওদিকটা সম্পূর্ণ আলাদা। আসলে এটা একটা সুচতুর আবরণ–বাইরে থেকে যাতে কেউ এখানকার কাজকর্ম সম্বন্ধে একটুকুও সন্দেহ করতে না পারে।

–ও! ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো হিলারী। এটাই কি আমাদের বাসস্থান?

-হ্যাঁ, এটা বসবার ঘর। ওদিকে স্নানঘর আর ওপাশে শোবার ঘর। এসো তোমাকে দেখাই ঘরখানা। একপাশে দুটো বড় খাট, তার পাশেই বইয়ের আলমারি। ওপাশে পোশাক রাখার দেওয়াল-আলমারি। একটা ড্রেসিং টেবিল। পোশাকের আলমারিটা খুলে তার বিশাল গহ্বরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো হিলারী। এতে কি রাখবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। জামাকাপড় বলতে তো এই যা পরে আছি, তাই সব।

সেজন্য ভেবো না, যেমন খুশি পোশাকে ভরিয়ে ফেলতে পারো আলমারি। এখানে বিরাট একটা সাজসজ্জার বিভাগ আছে। জামাকাপড়, প্রসাধনসামগ্রী, সবকিছু পাবে সেখানে। দামীদামী জিনিষ সব। এখানকার এই সংস্থা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল। যা কিছু প্রয়োজন সব পাবে এখানে –কোনোদিনের জন্য একবারও বাইরে যাবার দরকার হবে না। টম বেটারটন খুব সহজভাবে বললেও হিলারী কথাটাকে এত সহজভাবে নিলো না।

কোনোদিনের জন্য বাইরে যাবার দরকার হবে না, আসলে কোনোদিনও বাইরে যাবার উপায় নেই। তোমরা যারা ভেতরে এসেছ ফেরার আশা ত্যাগ করো। শুধু কি এরই জন্য এত গুণী জ্ঞানী লোকগুলো তাদের দেশ, ঘর, সংসার সব ছেড়ে চলে এসেছে। ভেবে কূল পেলো না হিলারী! এই যে ডাঃ ব্যারন, অ্যান্ড্রু পিটার্স, স্বপ্নিল মুখ এরিকসন, হেলগা নীডহেইম এরা কি জানে কী জন্য তারা এখানে এসেছে? ওরা কি সন্তুষ্ট হবে এসব দেখে? এটাই কি ওরা চেয়েছিলো?

মনে মনে সে ভাবলোনা, বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো…হয়তো কেউ অলক্ষে তাদের কথাবার্তা শুনছে!

সত্যিই কি কেউ শুনছে? সত্যিই কি কেউ ওদের ওপর কড়া নজর রাখছে?

টম বেটারটন বললো, তুমি কি বিশ্রাম নিতে চাও?

–না, মানে, হিলারী বললো, তার দরকার নেই।

–তাহলে বরং চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।

–রেজিস্ট্রি ঘর কি জিনিষ?

–এখানে যারা আসে তাদের প্রত্যেককেই এই রেজিস্ট্রি ঘর হয়ে আসতে হয়। ওরা তোমার সবকিছু ওখানে নথিভুক্ত করে রাখবে।

-ও বাবা! এ যে মিলিটারি আদব-কায়দা–নাকি ডাক্তারি ব্যাপার?

–দুই-ই–টম বেটারটন বললো।

 হিলারী বললো, লোকমুখে তাই শোনা যায় বটে; মানে আমি বলতে চাইছি, লৌহ যবনিকার অন্তরালে সত্যিই সবকিছু একেবারে ছক বেঁধে পাকাঁপোক্ত ভাবে তৈরি। কে বলতে পারে, হয়তো অলিভ বেটারটনের কিছুটা সহানুভূতি ছিলো এই দল সম্পর্কে; যদিও সে এই দলের সদস্য নয় বলেই জানা গেছে।

বেটারটন বললো, এখানে অনেক কিছু জানার আছে তোমার। এখুনি সবকিছু জানার চেষ্টা না করাই ভালো। কানের কাছে বেটারটন হিলারীকে ফিসফিস করে বললো, এসব আলোচনা করো না, তারপর গলা চড়িয়ে বললো, এবার তাহলে চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।

.

১২.

 রেজেস্ট্রি ঘরের অধ্যক্ষ একজন মহিলা। দেখে বেশ কড়া স্কুল মাস্টারনী মনে হয়। চুলগুলো গুটিয়ে মাথার পেছনে খোঁপা করা। নাকের ওপর একটা চশমা। বেটারটনকে ঘরে ঢুকতেই বললেন, মিসেস বেটারটনকে একেবারে সঙ্গে নিয়ে এলেন? তা ভালোই করেছেন।

বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ, কিন্তু তবুও যেন হিলারীর মনে হলো উনি ইংরেজ নন। সত্যিই উনি সুইজারল্যান্ডের মেয়ে। ভদ্রমহিলা হিলারীকে বসতে ইঙ্গিত করে, কতকগুলো কাগজে কী সব লিখতে লাগলেন। টম বেটারটন উসখুস করে বললো, তাহলে অলিভ–আমি এখন যাই।

–কিছু যদি না মনে করেন, সেটাই ভালো হবে, মিঃ বেটারটন, ভদ্রমহিলা বললেন।

দরজাটা টেনে নিয়ে টম বেটারটন বেরিলয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা যন্ত্রের মতো ঘাড় হেঁট করে লিখেই চললেন। লেখা শেষ করে বললেন–বেশ, এবার বলুন, আপনার পুরো নাম, বয়েস, কোথায় জন্ম, বাবা, মায়ের নাম, বড় রকমের কোনো অসুখ আছে কিনা, রুচি, শখ, কোথাও চাকুরি করে থাকলে তার বর্ণনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাধি আছে কিনা। খাদ্য এবং পানীয়ের মধ্যে কোন্ কোন জিনিষ পছন্দ।

হাজারো প্রশ্ন। হিলারী ভাসাভাসা জবাব দিয়ে চললো। জেসপের কাছ থেকে শিক্ষাগুলো সযত্নে কাজে লাগাতে পেরে খুশি হলো হিলারী।

ভদ্রমহিলা কাগজে লিখে মাথা তুললেন। বেশ, এই দপ্তরের সব কাজ মিটলো মনে হচ্ছে। এবার আপনাকে ডাক্তার স্কুয়াংজের কাছে যেতে হবে–শারীরিক পরীক্ষার জন্য।

হিলারী বললো, সত্যিই এসবের দরকার আছে? কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে আমার।

সবকিছু খুঁটিয়ে যাচাই করাই আমাদের পছন্দ, মিসেস বেটারটন। সবকিছু পাকাপাকি নথিভুক্ত করাই অভ্যাস আমাদের। চলুন–ডাক্তার স্কুয়ার্জকে আপনার বেশ ভালোই লাগবে। ওখান থেকে ডাঃ রুবেকের কাছে চলে যাবেন।

ডাঃ স্কুয়ার্জও একজন মহিলা। চেহারা এবং ব্যবহার দুই-ই চমৎকার। হিলারীর স্বাস্থ্য খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, ঠিক আছে। এবার ডাঃ রুবেকের কাছে চলুন।

–ডাঃ রুবেক কে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো। আরেকজন ডাক্তার?

–ডাঃ রুবেক মনোবিজ্ঞানী।

–মনোবিজ্ঞানীতে আমার কাজ নেই। মনোবিদদের একটুও ভালো লাগে না আমার।

আহা-হা, এখুনি অত ঘাবড়াবেন না, মিসেস বেটারটন। আপনাকে তো এখুনি চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে না। শুধু কটা বুদ্ধির প্রশ্ন করবেন উনি আর তার থেকেই আপনার ব্যক্তিত্বের শ্রেণীবিভাগ করে নেবেন ব্যস।

ডাঃ রুবেকও সুইজ্যারল্যান্ডের লোক। বেশ লম্বা, আমুদে মানুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। হিলারীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে, ডাঃ স্কুয়াংজের হাত থেকে মিসেস বেটারটন সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলো নিয়ে চোখ বোলালেন। বললেন, আপনার শরীর বেশ সুস্থ দেখে আনন্দিত হলাম। আচ্ছা আপনি তো সম্প্রতি প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, তাই না?

-হ্যাঁ, হিলারী বললো, ক্যাসাব্লাঙ্কায়–চার-পাঁচদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো।

মাত্র চার-পাঁচদিন। না-না, এ ঠিক করেননি। আরও বেশ কিছুদিন থাকা উচিত ছিলো আপনার।

–আর বেশিদিন থাকতে চাইনি আমি। এখানে আমার স্বামীর কাছে পৌঁছবার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।

– অবশ্য ঠিক। মাথায় অমন চোট লাগলে যথেষ্ট বিশ্রামের প্রয়োজন। মাথার যন্ত্রণা হয়।

-হ্যাঁ। আর তাছাড়া মাঝে মাঝে সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায় অনেক কথাই যেন মনে করতে পারি না।

ডাঃ রুবেক বললেন, খুব স্বাভাবিক, এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আপনার মানসিকতা পরীক্ষা করার জন্য আমি কটা প্রশ্ন করবো-অনুষঙ্গ পরীক্ষা

হিলারী মনে মনে একটু দুর্বল হয়ে পড়লো, কিন্তু ভালোয় ভালোয় সব শেষ হলো। সাধারণ ছকবাঁধা পরীক্ষা-প্রশ্ন আর উত্তর।

ডাঃ রুবেক বলতে লাগলেন, মানবিক অনুভূতির প্রশ্নে একজন প্রথম শ্রেণীর টেনিস খেলোয়াড় বা মঞ্চের একজন প্রধানা গায়িকা বা একজন আণবি পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে তফাত সামান্যই।

-আপনার কথাই বোধহয় ঠিক। সে যে একজন বিজ্ঞানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটিয়েছে একথা প্রমাণ করার জন্য হিলারী বললো। এরা অদ্ভুত মেজাজী মাঝে মাঝে মনে হয়, এরা যেন ঠিক মানুষ নয় এরা অন্য কিছু।

–আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কী ধরনের মানসিক ঝড় চলছে এখানে। ঝগড়াঝাটি, হিংসে আর মান-অভিমান! কিন্তু আপনি মাদাম সংখ্যালঘুদের দলে। মানে আমার মনের কথা যদি বলতে পারেন তবে আপনি ভাগ্যবানদের দলে।

-আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না। সংখ্যালঘু বলতে?

এখানে খুব বেশি কারো স্ত্রী নেই। খুব অল্প কয়েকজন স্ত্রীকেই আসার অনুমতি দেওয়া হয়। স্বামী আর তাদের সহকর্মীদের বুদ্ধির ঝড়ে এদের গায়ে এতটুকুও আঁচ লাগে না। দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়ান

স্ত্রীরা তাহলে কী করে এখানে, হিলারী জিজ্ঞেস করলো।

–এখানে নানারকম খেলাধূলা, আনন্দ উৎসব আর শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপক সুযোগসুবিধে আছে। আশা করি এখানকার জীবনযাত্রায় সুখেই থাকবেন আপনি।

আপনার মতো?

এ প্রশ্ন করা উচিত হলো কিনা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো হিলারী। ডাঃ রুবেককে দেখে কিন্তু মনে হলো বেশ মজাই পেয়েছেন। বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, শেষপর্যন্ত এখানকার জীবন শান্তিপূর্ণ এবং আনন্দময় হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস।

যাক এরপর আমাকে কার কাছে যেতে হবে? হিলারী উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।

মাদমোয়াজেল লা রোজ আপনাকে পোশাক বিভাগে নিয়ে যাবেন। জায়গাটা যে খুব পছন্দ হবে আপনার সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

.

লা রোজ প্যারিসে থাকত, এক দর্জির দোকানে পোশাক বিক্রি করতো। চমৎকার মেয়েলী আপ্যায়নে অভিভূত করলো হিলারীকে। আজ আপনি খুব ক্লান্ত, সেইজন্যই আমি বলি কি, আপনি শুধু কয়েকটা একান্ত প্রয়োজনীয় পোশাক বেছে নিন এখন। পরে সময়মতো ভালো করে দেখেশুনে বাকি পোশাকগুলো নিয়ে যাবেন।

মিষ্টি হেসে চটপট মাপজোক নিয়ে হিলারীকে একটা বিরাট দেওয়াল আলমারির সামনে নিয়ে এসে কয়েকটা প্রয়োজনীয় পোশাক বেছে নেবার পর হিলারীকে প্রসাধনবিভাগে নিয়ে গেলো লা রোজ। টুকিটাকি কয়েকটা পাউডার, লিপস্টিক আর ক্রিম বেছে নিলো হিলারী। সমস্ত জিনিষ গুছিয়ে একটা স্থানীয় মেয়ের হাত দিয়ে হিলারীর ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সবকিছু যেন কেমন একের পর এক স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো হিলারীর।

আশাকরি শীঘ্রই আপনার সাথে দেখা হবে। লা রোজ খুশিতে বললেন।

মিস জেনসেনকে আসতে দেখা গেলো, এখানে আসার পরই যাকে দেখা গিয়েছিলো, তাকে আসতে দেখা গেলো। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার এখানে কাজ শেষ হয়েছে তো মিসেস বেটারটন?

-হা ধন্যবাদ।

–তাহলে আসুন, সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে আসবেন।

–সহকারী পরিচালক কে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।

–ডক্টর নিয়েলসন।

এখানে প্রত্যেকটি লোকই কি কোনো-না-কোনো বিষয়ের ডক্টরেট!–হিলারী ভাবলো, মুখে বললো, ঠিক কোন বিষয়ের ডক্টর উনি? চিকিৎশাস্ত্রের, বিজ্ঞানের না কোন্ বিষয়ের?

উনি চিকিৎসাশাস্ত্রের ডক্টর মিসেস বেটারটন। উনিই এখানকার প্রশাসনিক অধিকর্তা। যে কোনো রকমের অভিযোগ করতে হলে ওঁর কাছে যেতে হবে। দলের প্রশাসনিক দায়িত্বও ওঁর হাতে। নতুন কেউ এলে প্রত্যেকের সাথে উনি দেখা করেন। তারপর আর এঁকে-কোনোদিন দেখতে পাবেন না, যদি না গুরুতর কিছু ঘটে।

ও আচ্ছা! গলায় শ্রদ্ধা ফোঁটালো হিলারী।

 মিস জেনসেন হিলারীকে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলো। বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে ডাঃ নিয়েলসন উঠে দাঁড়ালেন। বিশাল দেহ, ধবধবে ফর্সা ভদ্রলোক, হাবভাব অনেকটা গ্রাম্য লোকের মতো।

এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললেন, এই তো হা, আপনিই তো মিসেস বেটারটন? আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুব আনন্দ পেলাম মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামী আপনার জন্য দারুণ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। এবার এসে পড়েছেন, গুছিয়ে গাছিয়ে নিন।

ধন্যবাদ, ডাঃ নিয়েলসন, হিলারী একটা চেয়ার টেনে বসলো।

ডাঃ নিয়েলসনও তাঁর চেয়ারে বসে একটু ঝুঁকে এলেন। আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আছে আপনার? সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রশ্ন।

হিলারী হেসে বললো, এটার উত্তর দেওয়াই সবচেয়ে কঠিন। অবশ্য ঠিক উত্তর যদি চান বলবো–এত অজস্ব প্রশ্ন করার রয়েছে যে, কোষ্টা দিয়ে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।

ঠিক ঠিক, বুঝতে পারছি আমি। আমার উপদেশ যদি শোনেন তাহলে বলবো–স্রেফ নিজের খেয়ালে থাকুন আর যা ঘটছে দেখে যান। এটাই সবচেয়ে ভালো পথ।

এখানকার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়–মনে হয় যেন অবাস্তব কিছু

বেশিরভাগ লোকই তাই ভাবে। সাধারণত এখানে আসার আগে একজন হয়তো ভাবে তাকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। আমাদের এই মরুগৃহ যে-কোনো লোককেই চমকে দেবে।

-আমার কাছে তো এটা একটা দারুণ চমক।

-হতেই পারে, কারণ আগে থেকে কাউকে আমরা কিছু জানাই না। বুঝতেই পারছেন, খোলাখুলি সবকিছু বলে দেওয়া বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়। আসল প্রয়োজন শুধু নির্দেশের। সেইটুকু আমরা শুধু দিয়ে দিই। এখানে কিন্তু আপনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতে পারবেন, যা কিছু আপনার অপছন্দ হবে কিংবা বিশেষ কোনো জিনিষের যদি প্রয়োজন হয়–শুধু একবার আমাদের জানাবেন, আমরা তার ব্যবস্থা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। যেমন ধরুন যদি আপনি শিল্পচর্চা, ছবি আঁকা এগুলোর প্রয়োজন মনে করেন তবে সবকিছুরই আলাদা আলাদা বিভাগ আছে আমাদের।

-না না, আমি ওসব বিষয়ে মোটেই পারদর্শী নয়।

–বেশ, এছাড়াও সামাজিক জীবনযাপনের অনেক উপায় রয়েছে। খেলাধুলা নিশ্চয়ই জানেন। এখানে টেনিস কোর্ট, স্কোয়াস কোর্ট সবই রয়েছে। এখানে আসার পর নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে কারো দুসপ্তাহ লাগে না বিশেষত স্ত্রীদের। আপনার স্বামীর কাজ রয়েছে, তাই নিয়েই তিনি ব্যস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে অন্যান্য স্ত্রীরা নিজেদের সময় কাটাবার রাস্তা নিজেরাই খুঁজে নেন। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন আশাকরি।

-কিন্তু এখানে কি কেউ থাকে?

–এখানে থাকে মানে। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিসেস বেটারটন।

থাকে মানে–আমি বলতে চাইছি, সবাই কি এখানেই থাকে, নাকি অন্য কোথাও চলে যায়?

ডাঃ নিয়েলসন কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, হুঁ, সেটা নির্ভর করছে আপনার স্বামীর ওপর। হ্যাঁ, এটা অনেকখানি নির্ভর করে তার ওপর। আমি বরং আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি তিন সপ্তাহ পরে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে বলে যাবেন–এখানে কেমন লাগছে?

-আচ্ছা এখান থেকে কেউ কোনোদিন বাইরে যেতে পারে? মানে এই চার দেওয়ালের বাইরে?

খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। এখানে এসে প্রায় সবাই এই প্রশ্নই করে। কিন্তু আমাদের এই প্রতিষ্ঠান নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। এইটাই হচ্ছে আপনার পুরোনো জগৎ যাকে আপনি ফেলে এসেছেন। হ্যাঁ এটা একটা পার্থিব স্বর্গ।

.

১৩.

 ঠিক যেন একটা স্কুলের মতো, তাই না? হিলারী বললো, নিজের ঘরে সে আবার ফিরে এসেছে। তার পছন্দ করা জামাকাপড় আর প্রসাধন সামগ্রীগুলো ইতিমধ্যেই বিছানার ওপর, তার অপেক্ষায়। আলমারির মধ্যে জামাকাপড়গুলো ঝুলিয়ে, অন্য জিনিষগুলো সে গুছিয়ে রাখলো।

–আমারও প্রথম প্রথম ঠিক এই কথাই মনে হতো, বেটারটন বললো।

দুজনের কথাবার্তা কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ক্লান্তিমাখা। লুকোনো একটা মাইক্রোফোনের সম্ভাবনা তখনও বোঝার মতো তাদের মনে চেপে রয়েছে। কেমন যেন রহস্য ভরা কথা বলছিলো বেটারটন। দেখতেই পাচ্ছো–বেশ আছি, আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি আমি। কিন্তু…

কথাটা সে শেষ করলো না। হিলারী কিন্তু তার না বলা কথাটা বুঝতে পারলো,–কিন্তু আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। সমস্ত জিনিষটাই যেন এক অবাস্তব দুঃস্বপ্ন, তাই মনে হচ্ছিলো, হিলারীর। সে এক সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে একই শয়নঘরে বাস করছে। কিন্তু তবুও অনিশ্চিত কোনোও বিপদের তীব্র তানভূতির ফলে এই অন্তরঙ্গতাটুকুকে দুজনের কেউই যেন এতটুকুও অশালীন মনে করতে পারেনি।

মিনিট দুয়েকের অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ভেঙে, গলাটাকে একেবারে খাদে নামিয়ে বেটারটন বললো, অভ্যস্থ হয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু আমাদের খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। অত্যন্ত সাধারণ স্বাভাবিক ব্যবহার–যেন এখনও আমরা আমাদের দেশের বাড়িতেই রয়েছি।

কথাগুলোর গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করলো হিলারী। সে ধরেই নিলো, যে অনিশ্চয়তাটুকু অনড় হয়ে রয়েছে তা আরও কিছুক্ষণ থাকবে। বেটারটনের ইংল্যান্ড ত্যাগের কারণ, তার আশা, তার স্বপ্নভঙ্গ এই সমস্ত এই মুহূর্তে আলোচনার প্রয়োজন নেই। এই মুহূর্তে তারা দুজন মাথার ওপর যে অনিশ্চয়তার খঙ্গ ঝুলছে সেই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করার একই ব্রতে ব্রতী। হিলারী বললো, আমাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কত কাণ্ডই না করলো। শারীরিক, মানসিক সব পরীক্ষাই হয়ে গেলো।

–হু, সবার বেলাই এগুলো করা হয়। এটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।

তোমার বেলাও এসব হয়েছিলো?

–হ্যাঁ, তা প্রায় সবই হয়েছিলো।

 তারপর আমাকে দেখা করতে নিয়ে গেলো ওই যে সহকারী পরিচালক না কী বলে যেন, তার সঙ্গে।

হ্যাঁ, উনিই এই অঞ্চলটা পরিচালনা করেন। অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি এবং সত্যিকারের ভালো প্রশাসক একজন।

-উনি তাহলে সংস্থার কর্তা নন?

–নানা সংস্থার মাথা হচ্ছেন খোদ পরিচালক নিজে।

–আমি তাকে দেখতে পাবো?

আশাকরি পাবে। তবে তিনি বড় একটা দেখা দেন না। মাঝে মাঝে এসে আমাদের সামনে বক্তৃতা করেন–চমৎকার ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ।

বেটারটনের ভুরুর উপর ক্ষীণ একটা ভাজ পড়লো। হিলারীর বুঝতে অসুবিধে হলো না এ আলোচনা এখন বন্ধ করা উচিত, এ তারই ইঙ্গিত। বেটারটন ঘড়ি দেখে বললো, আটটায় নৈশভোজ। আটটা থেকে সাড়ে আটটা। তুমি তৈরি হলে, চলো নিচে নামি। এমনভাবে বললো, হিলারীর মনে হলো ঠিক যেন তারা কোনো একটা হোটেলে রয়েছে।

হিলারী তৈরি হয়ে নিচে নেমে, লম্বা বারান্দা পেরিয়ে বিরাট খাবার ঘরে ঢুকতেই মিস জেনসেন এগিয়ে এলো। আজ তোমাদের জন্য একটা বড় টেবিলের ব্যবস্থা করেছি টম, বেটারটনকে বললো সে। তোমার স্ত্রীর সহযাত্রী তোমাদের সঙ্গে বসবেন, আর–মার্চিসনরা তো আছেই।

নির্দিষ্ট টেবিলে তারা বসলো। অ্যান্ড্রু পিটার্স আর এরিকসন আগে থেকেই তাদের টেবিলে বসেছিলো। হিলারী তার স্বামীর সঙ্গে দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু পরেই বাকি দুজন এসে পড়লো। বেটারটন পরিচয় করিয়ে দিলো, ডক্টর এবং মিসেস মার্চিসন। সাইমন আর আমি একই গবেষণা ঘরে কাজ করি, বুঝলে

সাইমন মার্চিসনের বয়স বেশি নয়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের রোগা যুবকটি এত ফর্সা, মনে হয় রক্তহীনতায় ভুগছে। তার স্ত্রী মোটাসোটা কালো। হিলারীর মনে হলো ভদ্রমহিলা ইতালিয়ান। নাম বিয়াঙ্কা। বিয়াঙ্কা বললো, কালকে আপনাকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবো। আপনি তো বিজ্ঞানবিশারদ নন, তাই না?

-না, বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ শিক্ষা আমি পাইনি বলেই আমার আশঙ্কা, হিলারী হাসলো।

বিয়াঙ্কার কিছু আইনসম্পর্কিত শিক্ষা আছে, সাইমন জানালো। অর্থনীতি আর বাণিজ্যিক আইন নিয়ে ও পড়াশুনা করেছে। মাঝেমধ্যে ও বক্তৃতা দেয়। কিন্তু বড় একটা কেউ মন দিয়ে শোনে না।

বিয়াঙ্কা কাঁধ ঝাঁকালো। ওসব আমি ঠিক করে নেবো। আমি তো এখানে এসেছিলাম শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে। কিন্তু এখানে দেখছি অনেক কিছুই করার আছে। আর মিসেস বেটারটন, উনিও হয়তো একাজে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।

হিলারী এককথাতেই রাজি হয়ে গেলো।

অ্যান্ড্রু পিটার্স জিজ্ঞাসা করলো, আপনার গবেষণার বিষয় কোন্টা? পুরুষ তিনজনের আলোচনা হিলারী কিছুই বুঝতে পারছিলো না। এরিকসনের দিকে ফিরে দেখলো, চেয়ারে গা এলিয়ে উদাস চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে। হেসে সে জিজ্ঞেস করলো, কি হলো, আপনারও কি ঘরকুনো কচি ছেলের মতো বাড়ির জন্য মন কেমন করছে নাকি?

যেন অনেক দূর থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে এনে এরিকসন তার দিকে তাকালো। বললো, না ঘরের প্রয়োজন নেই। এইসব-স্নেহের বন্ধন, বাবা, মা, ছেলেপুলে–এসব হচ্ছে বিরাট বাধা। কাজ করতে হলে সম্পূর্ণ মুক্ত পুরুষ হতে হবে।

-এখানে আপনি সেই মুক্তি পাবেন, মনে করছেন?

–এখুনি তা বলতে পারবো না, কিন্তু তাই আশা করছি।

 বিয়াঙ্কা হিলারীকে বললো নৈশভোজের পর সময় কাটাবার জন্য অনেক রকমের ব্যবস্থা আছে এখানে। তাস খেলার ঘরে গিয়ে ব্রিজ খেলতে পারেন বা সিনেমা দেখতে পারেন, কিংবা সপ্তায় তিনদিন করে যে নাটক হয় তাও দেখতে পারেন।

এরিকসন বিরক্তিভরে ভুরু কোচকালো। এসব একেবারেই অপ্রয়োজনীয় জিনিষ। এতে কর্মশক্তির অপচয় হয়।

–আমাদের মানে মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, বিয়াঙ্কা জবাব দিলো। মেয়েদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রয়োজনীয় জিনিষ।

হিলারী চেষ্টা করে একটা হাই তুললো। বললো, একটু সকাল সকাল শুয়ে পড়বো ভাবছি। আজ আর তাস খেলতে বা সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে না।

তার কথাটা লুফে নিয়ে টম বেটারটন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, আজ সকাল সকাল শুয়ে পড়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে শরীরটা ঠিক করে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো। রাস্তায় তো কম ধকল যায়নি

খাওয়া শেষ করে সবাই উঠে পড়লো। বেটারটন বললো, রাত্রের খাওয়াটা এখানে সত্যিই চমৎকার। রাত্রে পড়ার ঘরে ঢোকার আগে বা সিনেমা ক্লাবে যাওয়ার আগে সাধারণ আমরা ছাদের বাগানে একটু পায়চারি করে নিই। প্রথমে একটু বাগান থেকে ঘুরে আসি চলো তারপর বরং তুমি ঘুমোতে যেও।

লিফটে চড়ে ওরা ছাতে উঠলো। ওপরে উঠে বাগানের আশাতীত শোভায় হিলারীর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। একি সম্ভব! কত অজস্র অর্থ ব্যয় হয়েছে বাগানটা গড়তে, চিন্তাও করতে পারলো না সে। ঠিক যেন সেই আরব্য উপন্যাসের পরীর দেশ।

–এ যেন বিশ্বাসই করা যায় না, বললো হিলারী। এই দিগন্তবিস্তারী মরুভূমির মাঝখানে–এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের পরীর দেশ।

মার্চিসন বললো, আমিও আপনার সাথে একমত মিসেস বেটারটন, দেখলে মনে হয় সত্যিই যেন যাদুমন্ত্রে কেউ জীনকে দিয়ে একটা গড়িয়ে নিয়েছে। অবশ্য–আমার ধারণা, টাকা এবং জল এ দুটো জিনিষ প্রচুর পরিমাণে থাকলে, মরুভূমির বুকেও যা খুশি গড়ে তুলতে পারবেন।

এই এত জল কোথা থেকে আসে?

ওই পাহাড়ের তলায় গভীর প্রস্রবণ খোঁড়া হয়েছে।ওটা আমাদের এই সংস্থার প্রাণ।

ছাদবাগানের এখানে-ওখানে কিছু লোক ছড়িয়ে রয়েছে। ক্রমে ক্রমে তারা এদিক-ওদিক চলে গেলো। মার্চিসনরাও ব্যালে দেখতে যাবে বলে বিদায় নিলো। হিলারীর হাত ধরে বেটারটন তাকে আলসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো।

মাথার ওপর অজস্র তারা জ্বলজ্বল করছে। মৃদু শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। দুজনে এখন সম্পূর্ণ একা। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। একটু যেন সন্ত্রস্ত নিচু গলায় টম বেটারটন জিজ্ঞেস করলো, এবার বলুন, কে আপনি?

হিলারী তার চোখে চোখ রেখে একটু নীরব হয়ে ওর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো, আগে আপনি বলুন, কেন আমাকে আপনার স্ত্রী বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন?

দুজনেই দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। হিলারী জানে ইংল্যান্ড থাকতে টম বেটারটনের যত শক্তিই থাক-না-কেন এখানে এই অবস্থায় তার মনের জোর হিলারীর চেয়ে অনেক দুর্বল।

অবশেষে টম বেটারটন হার মানলো। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, তখন মানে সেই মুহূর্তে যেন আমার এটাই সঠিক মনে হয়েছিল। হয়তো ভীষণ বোকামি করেছি আমি, আমার যেন একবার আশা হয়েছিলো, আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবার জন্য আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।

–তাহলে আপনি এখান থেকে বের হতে চান?

–হায় ভগবান, আপনি একথা জিজ্ঞেস করতে পারলেন?

–প্যারিস থেকে আপনি কিভাবে এখানে এলেন?

 টম বেটারটন একটু হাসলো। আমাকে কেউ জোর করে এখানে আনেনি–অবশ্য জানি না, এই কথাই আপনি জানতে চাইছেন কিনা। আমি এসেছি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়।

–আপনি যে এখানেই আসছেন, সেটা আগে থেকেই জানতেন?

-না, আমি যে আফ্রিকায় আসছি সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না আমার। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক প্রলোভনেই আমি ভুলেছিলাম। আপনার সঙ্গে এলো, ঐ যে পিটার্স, ও বেচারাও ঠিক আমার মতোই ভুল করেছে।

–আর এখানে এসে দেখলেন যা ভেবেছিলেন, তা নয়?

 আবার একটু হাসল টম। নিজের চোখেই দেখবেন। ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত ছিল তা যেন নয়। এ–একে স্বাধীনতা বলে না।

হিলারীর পাশে বসে সে বলল, ইংল্যান্ডে থাকতে যে জ্বালায় ছটফট করতাম, এখানেও তাই। সবসময় মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার ওপর নজর রাখছে। এতরকমের সব নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যই হয়তো একথা মনে হতো। একজনের চলাফেরা, কাজকর্ম, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে একরকম গুপ্তচরবৃত্তি হয়তো দরকারও আছে, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি এতে মানুষ পাগল হয়ে উঠতে বাধ্য।

হিলারী স্পষ্ট সুরে বললো, আপনি বলতে চাইছেন–যে পারিপার্শ্বিকতা থেকে আপনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, এখানে এসে আপনাকে ঠিক সেই অবস্থাতেই পড়তে হয়েছে? এখানেও সেই একইভাবে আপনার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, গুপ্তচরবৃত্তি চলছে?

একটু বিব্রতবোধ করে বেটারটন বললো, এ বিষয়ে আমি ঠিক জানি না। আসলে আদৌ আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে কিনা তাও জানি না। কেনই বা আমার ওপর নজর রাখবে? কেনই বা এত মাথা ঘামাবে? এরা তো আমাকে এখানে এই জেলখানায় এনে রেখেছে?

–তার মানে–আপনি যা কল্পনা করেছিলেন, তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পাননি?

-না, সেইটেই সবচেয়ে আশ্চর্য। একদিক থেকে দেখলে কিন্তু এটা ভালোই লাগবে। কাজ করার আদর্শ পরিবেশ রয়েছে এখানে। সবরকমের সুযোগ সুবিধে যন্ত্রপাতি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আপনি ভুলতে পারবেন না যে আপনি বন্দী।

-জানি আমি। আমরা ভেতরে ঢোকার পর যখন বাইরের ফটকটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলোতখনই কেমন যেন ভয়ে গা শিরশির করে উঠেছিলো। হিলারী একটু কেঁপে উঠলো।

–বেশ। বেটারটন যেন অনেকটা আত্মস্থ হয়েছে মনে হলো। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন। অলিভের ছদ্মবেশে আপনি এখানে কী করতে এসেছেন?

-অলিভ বলেই সে থেমে গেল। কোন্ কথাটা বলা যায় চিন্তা করতে লাগলো।

–হ্যাঁ, বলুন? অলিভের কী হয়েছে? বলুন? কী বলতে যাচ্ছিলেন বলুন?

বেটারটনের করুণ ত্রস্ত মুখটা দেখে তার বেশ মায়া হলো। বললো, আপনাকে জানাতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।

তার মানে? আপনি বলতে চাইছেন–তার কোনো বিপদ ঘটেছে?

-হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি…আপনার স্ত্রী…মারা গেলেন।…আপনার সাথে দেখা করতে আসছিলেন তিনি। পথে প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান।

এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বেটারটন। শান্ত স্বরে শুধু বললো, অলিভ তাহলে মারা গেছে। এবার বুঝতে পারছি…অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সে হিলারীর দিকে মুখ ফেরালো। ঠিক আছে, বাকিটা একটা নিজেই আন্দাজ করে নিতে পারছি। আপনি তার স্থান দখল করে এখানে এসেছেন, কিন্তু কেন?

এবার কিন্তু হিলারীর জবাব তৈরি। টম বেটারটন বিশ্বাস করেছে যে, তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্যই ওকে পাঠানো হয়েছে–অবশ্য ওর কথা যদি সত্যি হয়।

হিলারীর মন বললো, ওর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা বিপজ্জনক হতে পারে। হিলারী বললো, আপনার স্ত্রী যখন মারা যান তখন আমি হাসপাতালে তার পাশে ছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি আপনার কাছে আসার চেষ্টা করতে পারি। তিনি আপনার একটা খবর পৌঁছে দেবার জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন।

ভুরু কুঁচকে বেটারটন বললো, কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই

তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিয়ে হিলারী বললো, শুনতে যতটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আসলে তা নয়। আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন এই সমস্ত ধ্যানধারণার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। সবদেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গোপনীয়তার আদান-প্রদান, একটা নতুন জগৎ-এসব সম্পর্কেই আমার অসীম উৎসাহ। আর তার উপর আমার এই চুল–ওরা যদি প্রায় একই বয়সের একটি লাল চুলওলা মেয়েকেই শুধু আপনার স্ত্রী বলে আশা করে থাকে তাহলে আমার ধারণা সার্থক।

-হ্যাঁ, বেটারটন হিলারীর মাথাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, আপনার চুলগুলো ঠিক অলিভের মতো।

-তারপর আপনার স্ত্রীও বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন–আপনাকে যে খবরটা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।

-ও হ্যাঁ, খবর। কী খবর বলুন তো?

-আমাকে বলতে বলেছিলেন, সাবধান থাকতে–খুব সাবধান থাকতে–খুব বিপদ আপনার সামনে কোনো একজনের সম্পর্কে সাবধান থাকতে–তার নাম বোরিস।

-বোরিস? মানে বোরিস গ্লাইদরের কথা বলছেন?

–হুঁ, তাকে আপনি চেনেন?

মাথা নাড়ল বেটারটন। কোনোদিন চোখে দেখিনি তবে নাম শুনেছি। সে আমার প্রথমা স্ত্রীর আত্মীয়। ভালোভাবেই চিনি তাকে।

-তাহলে সে কেন আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হবে?

–কী বললেন? কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো বেটারটন।

 হিলারীর কথাটা শুনে বেটারটন বাস্তবে ফিরে এসে বললো, তা আমি জানি না, কিন্তু একথা সত্যি যে সব দিক দিয়েই সে অতি সাংঘাতিক লোক।

–কোন্ দিক দিয়ে?

মানে–সে এমন এক ধরনের আদর্শবাদে বিশ্বাসী যদি মনে করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে মেরে ফেললে হয়তো কোনো ভালো হবে, তাহলে হাসতে হাসতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকেই খুন করে ফেলতে পারে।

হ্যাঁ, এ ধরনের লোকদের আমি চিনি, হিলারীর মনে হলো, সত্যিই সে এদের চেনে–খুব ভালোভাবে চেনে। কিন্তু কেন মনে হলো?

–অলিভের সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছিলো? অলিভকে সে বলেছিলো?

–তা তো আমি জানি না, শুধু–এইটুকুই তিনি আমাকে বলেছিলেন। বিপদের কথা–আর হ্যাঁ, বলেছিলেন একথা তিনি বিশ্বাস করেন না।

বিশ্বাস করে না। কোন কথা বিশ্বাস করে না?

—তাও তো আমি জানি না। একটু দ্বিধা করে সে আবার বললো, বুঝতেই পারছেন–তিনি তখন মৃত্যুর পথে…।

বেটারটনের মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ পড়লো। বুঝতে পেরেছি..আমি বুঝতে পেরেছি…সময়ে এসবই হয়ে যাবে। কিন্তু বোরিসের কথাটা নিয়ে কেমন যেন ধাঁধায় পড়ে গেছি। এখানে সে আমার পক্ষে কী করে বিপজ্জনক হতে পারে। সে নিশ্চয়ই লন্ডনে গিয়েছিলো, তার অলিভের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

-হ্যাঁ, সে লন্ডনে ছিলো।

 তাহলে, স্রেফ এটা আমার বুদ্ধির অগম্য…। আর তাতে কীই বা এসে যায়? আমরা এখানে এমনিতেই বন্দী..

-আশ্চর্য আমারও ঠিক এইকথাই মনে হচ্ছে।

–আমরা এখান থেকে আর বেরোতে পারবো না, সজোরে সে আলসের ওপর একটা ঘুসি মারলো।

হিলারী বললো, একশোবার পিরবো। চকিত বিস্ময়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো হিলারীর দিকে। কী বলছেন আপনি?

কেন, একটা পথ বের করবো আমরা।

পাগলী মেয়ে, বেদনার হাসিতে ভরে উঠলো তার মুখ। এখানে এই জায়গায় কাদের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই আপনার।

-যুদ্ধের সময় তো কত লোক, কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালিয়ে আসে, বললো হিলারী। তারা তো সুড়ঙ্গ কেটে, বা যা হয় কিছু একটা উপায় করে পালায়।

-কঠিন পাথরের মধ্যে দিয়ে কী করে সুড়ঙ্গ কাটবেন? তাছাড়া সুড়ঙ্গ করে যাবেনই বা কোথায়? চারিদিকে তো শুধু ধূ ধূ মরুভূমি।

–প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা-না-একটা পথ থাকেই। হয়তো তার জন্য সময় লাগবে, অনেক পরিকল্পনা করতে হবে,

আবার বেটারটনের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। সময়…এই সময় যে আমি দিতে পারছি না।

-কেন?

-জানি না আপনি বুঝবেন কিনা…আমি সত্যিই বলেছি। এখানে–একটুও কাজ করতে পারছি না আমি, সত্যি!

-কী বলছেন আপনি?

কী করে বোঝাই আপনাকে? আমি কাজ করতে পারছি না, চিন্তা করতে পারছি না। আমার যা কাজ তাতে অত্যন্ত মনঃসংযোগ দরকার। আমার কাজের অনেকটাই–প্রায় সবটাই সৃষ্টির কাজ। এখানে আসা থেকে সারা দিনরাত ধরে বাজে কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সময় কাটাই, যে কাজ অতি সাধারণ বিজ্ঞানীও করতে পারে। কিন্তু এরজন্য তো ওরা আমাকে নিয়ে আসেনি। ওরা চায় আসল সৃষ্টি-নতুন কিছু সৃষ্টি…আর আমি সেই সৃষ্টি করতে পারছি না।

বেটারটন বললো, আমি যদি কিছু সৃষ্টি করে ওদের হাতে তুলেই না দিতে পারি, তাহলে এত কাণ্ড, এমন এলাহী কাণ্ডকারখানায় ওদের দরকার কী? ওরা তো আমাকে রাস্তায় ফেলে দেবে।

-না না।

-হ্যাঁ–দেখেই। এখানে ওরা ভাবপ্রবণতায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে না। এই প্লাস্টিক সার্জারির ব্যাপারটা যা একটু বাঁচিয়েছে আমাকে। জানেন বোধহয়, একবারে এই অস্ত্রোপচার হয় না–একটু একটু করে করা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই যে লোকের ওপর দিনের পর দিন একটানা ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে, সে কোনো কাজে মনঃসংযোগ করতে পারে না।

–কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের কী দরকার ছিলো? কী জন্য করা হলো এটা?

–এটা? ওই–স্রেফ সাবধানতার জন্য। মানে–আমার সাবধানতার জন্য। এটা করা হয়–যদি আপনি পুলিসের প্রার্থিত লোক হন তখনই।

–আপনি কি তাহলে পুলিসের প্রার্থিত ব্যক্তি?

-হ্যাঁ, কেন আপনি জানেন না? ও আচ্ছা, ওরা বোধহয় ব্যাপারটা তেমন প্রচার করেনি। হয়তো অলিভও জানতো না। কিন্তু সত্যিই আমি ফেরারী।

–আপনি কি–মানে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলতে চাইছেন? মানে–আপনি এদের কাছে পারমাণবিক গোপনীয়তা বিক্রি করে দিয়েছেন?

বেটারটন ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুই আমি বিক্রি করিনি। আমি শুধু আমাদের কাজের পদ্ধতিগুলো ওদের বলে দিয়েছি–সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, নিঃস্বার্থভাবে দিয়েছি। যদি বিশ্বাস করেন বলবো আসলে আমিই ওগুলো ওদের দিতে চেয়েছিলাম। এটা সমগ্র গঠনব্যবস্থার একটা অংশ–বিজ্ঞানে সমস্ত জ্ঞানের একত্রীভবন। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না।

ঠিকই বুঝতে পারছিলো হিলারী, এও সে বুঝতে পারছে যে, অ্যান্ড্রু পিটার্সও ঠিক এই কাজই করছে। এই একই উন্মাদনায় পাগল।

হিলারীর মনে হলো, টম বেটারটন যে এই কাজে ব্রতী, এ যেন সে চিন্তা করতে পারছে না। বেটারটন মাত্র কমাস আগে প্রবল উৎসাহ আর আগ্রহ নিয়ে এখানে এসেছিলো, সেই বেটারটন এখন পরাজিত, বিধ্বস্ত–স্বপ্নের জগৎ থেকে আবার বাস্তব জগতে আছড়ে পড়া একটা সাধারণ মানুষের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত।

কথাটা কতখানি ঠিক তা যাচাই করার সময় পেলো না সে। চারদিকে তাকিয়ে বেটারটন বললো, সবাই নেমে গেছে, আমরাও বরং

উঠে দাঁড়ালো হিলারী। হ্যাঁ চলুন। কিন্তু অত ঘাবড়াবার কী আছে? এটাই তো অস্বাভাবিক। ওরাও তাই ভাববে–এটাই স্বাভাবিক–অন্তত এই পরিস্থিতিতে।

বেটারটন কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বললো, এইভাবেই আমাদেরকে থাকতে হবে, মানে আপনাকে আমার স্ত্রী হিসেবে থাকতে হবে।

–তা তো বটেই।

একই ঘরে থাকতে হবে–এইসব আর কি। তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন মানে আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।

হিলারী বলে উঠলো, এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের আসল কাজ হচ্ছে, এখান থেকে জীবন্ত অবস্থায় পালানো।

.

১৪.

 ম্যারাকেশের হোটেলে ম্যামাউনিয়ার একটা ঘরে জেসপ নামে সেই ভদ্রলোক মিস হেদারিংটনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ক্যাসাব্লাঙ্কা আর ফেজ-এ হিলারীর সঙ্গে যে হেদারিংটনের আলাপ হয়েছিলো, এ যেন সে হেদারিংটন নয়। একই রকম দেখতে, ঠিক যেন যমজ বোন, সেই একই রকম চুলবাঁধা, কিন্তু হাবভাব যেন সম্পূর্ণ আলাদা। এই মহিলা যেন অনেক চটপটে, কর্মদক্ষ, বয়েসও যেন অনেক কমে গেছে।

ঘরে তৃতীয় ব্যক্তিটি টেবিল চাপড়ে গুনগুন করে ফরাসি গানের কলি ভাঁজছিলো। লোকটির গায়ের রঙ কালো, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, চোখদুটো বুদ্ধির ছটায় উদ্ভাসিত।

তাহলে যতদূর আপনি জানেন, জেসপ বলছিলেন, কেবলমাত্র এই কটি লোকের সঙ্গে সে ফেজ-এ কথাবার্তা বলেছিলো?

জানেত হেদারিংটন ঘাড় নাড়লেন। কেলভিন বেকার নামে মহিলাটিও ওখানে ছিলো, যার সঙ্গে আগেই ক্যাসাব্লাঙ্কায় আমাদের আলাপ হয়েছিলো। তবে নির্দ্বিধায় আমি স্বীকার করছি, ভদ্রমহিলাকে এখনও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। স্রেফ বন্ধুত্ব করার জন্যই সে আগ বাড়িয়ে অলিভ বেটারটনের সঙ্গে আলপ করেছিলো, আমার সঙ্গেও তাই। আমেরিকানদের স্বভাবই তাই। হোটেলে, গাড়িতে গায়ে পড়ে আলাপ করে, তাদের সঙ্গে বেড়াবার ছক তৈরি করে ফেলে।

–হুঁ! জেসপ বললেন, আমরা যা খুঁজছি তার পক্ষে এগুলো এতই অস্পষ্ট…

–আর তাছাড়া, হেদারিংটন বললেন, ভদ্রমহিলা ওই প্লেনেই ছিলেন।

–আপনার কী ধারণা–এই দুর্ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত? জেসপ এবার ঘাড় ফিরিয়ে কালো মতন লোকটির দিকে তাকালেন, তোমার কী মনে হয়, লেবল্যাঙ্ক?

লেবল্যাঙ্ক বললো, অনেক কিছুই হতে পারে। হয়তো কেউ প্লেনের যন্ত্রপাতি বিগড়ে রেখেছিলো। যার ফলে এই দুর্ঘটনা। সেকথা তো আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না। প্লেনটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে–সাক্ষ্য দেবার মতো একজনও বেঁচে নেই।

-প্লেনের চালক সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে?

–আলকাডি? হা জোয়ান ছোকরা, মোটামুটি দক্ষ, ব্যস ওই পর্যন্ত।

লেবল্যাঙ্ক বললো, সাতটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সবকটাই বিশ্রীভাবে পোড়া, সনাক্ত করা সম্ভব নয়, কিন্তু পুরো সাতটা মৃতদেহ। তার মানে–একজনও রেহাই পায়নি।

জেসপ হেদারিংটনের দিকে ফিরলেন, আপনি যেন কী বলছিলেন?

–ফেজ-এ একটি ফরাসি পরিবারের সঙ্গে মিসেস বেটারটনের দু-একটা কথাবার্তা হয়েছিলো। ওখানে আর ছিলো একজন সুইডিস ব্যবসাদার আর তার সুন্দর প্রেয়সী। আর ছিলেন, ব্যবসায়ী জগতের চূড়ামণি, কোটিপতি বৃদ্ধ : মিঃ অ্যারিস্টাইডস।

ও, সেই টাকার খনিটা ওখানে ছিলো?

লেবল্যাঙ্ক বললল, লোকে বলে বুড়োর নাকি সাঙ আমলের সব চীনা মৃৎ-শিল্প সংগ্রহের বাতিক আছে।

চীনারা নিজেরাই কিন্তু বলে, ষাট থেকে সত্তর বছর বয়সটাই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। জীবনের এই সময়টাতেই সে জীবনের মাধুর্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি মুখর হয়ে ওঠে।

আমি ওদের দলে নেই, বললো লেবল্যাঙ্ক।

–কজন জার্মানও ছিলো ফেজ-এ, জানতে হেদারিংটন বলে চললেন, কিন্তু যতদূর জানি, অলিভ বেটারটনের সঙ্গে তাদের কোনো কথাবার্তা হয়নি।

–কোনো পরিচারক বা ভৃত্যের সঙ্গে সম্ভবত কথা বলেছিলেন?

–সে তো সবসময়ই হতে পারে।

–আর–আপনি বলছেন, পুরোনো শহর দেখতে একাই বেরিলয়েছিলেন?

-না, একজন পাকা পথপ্রদর্শক সঙ্গে ছিলেন। পুরোনো শহরেই হয়তো কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকবে।

–যে কারণেই হোক, তিনি একেবারে হঠাৎ ম্যারাকেশ যাওয়া ঠিক করে ফেলেন।

–হেদারিংটন বললেন, একেবারে নয়, আগে থেকেই ওঁর জন্য আসন সংরক্ষিত ছিলো।

-ও হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি–জেসপ বললেন, আমি বলতে চেয়েছিলাম, মিসেস কেলভিন বেকারই একেবারে হঠাৎ তার সঙ্গে যাওয়া ঠিক করে ফেললেন, উঠে পড়ে তিনি অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। উনি ম্যারাকেশের পথে পাড়ি দিলেন…আর প্লেনটা ধাক্কা খেয়ে জ্বলতে জ্বলতে আছড়ে পড়লো। কেমন যেন দুর্ভাগ্যের পূর্ব লক্ষণ–যেন অলিভ বেটারটন নামে কেউ প্লেনে চড়লেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথমে ক্যাসাব্ল্যাঙ্কার কাছে দুর্ঘটনা ঘটলো, তারপর এইটা। এটা কি সত্যিই দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পনা করে ঘটানো? যদি এমন কেউ থাকে, যে বা যারা অলিভ বেটারটনের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়। তারা তো-আমি বলবো, একটা প্লেন ধ্বংস করার চেয়ে অনেক সহজ উপায়ে এটা করতে পারতো।

-কে বলতে পারে বলুন, লেবল্যাঙ্ক বললো, আমাকে ভুল বুঝবেন না,-একবার যদি মনের এই অবস্থায় পৌঁছতে পারেন, যেখানে মানুষের জীবন নেওয়াটাই তুচ্ছ ব্যাপার, তখন কাউকে মারার জন্য অন্ধকার গলিখুঁজিতে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে প্লেনের একটা আসনের তলায় কিছুটা বিস্ফোরক পদার্থ রেখে দেওয়া অনেক সহজ। তাতে করে আরো ছটা লোক যদি মারা যায় তত ভারি বয়েই গেলো।

-তা ঠিক, জেসপ বললেন, আমি জানি, আমার সঙ্গে কেউ একমত হবে না, কিন্তু তবুও আমার দৃঢ় ধারণা এর একটা তৃতীয় সমাধান নিশ্চয় আছে। আমার ধারণা–এই দুর্ঘটনা সাজানো ব্যাপার।

উদগ্রীব চোখে তাকালো লেবব্যাঙ্ক, হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। প্লেনটাকে নামিয়ে এনে হয়তো আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু একটা ঘটনা আপনি উড়িয়ে দিতে পারেন না, মিঃ জেসপ–প্লেনের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ ছিলো। হ্যাঁ, সত্যিকারের কটা ঝলসানো দেহ।

–জানি, আর এইটাই যা কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। না, না আমার এই কল্পনা যে সম্পূর্ণ অবাস্তব এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু এ যেন আমাদের এই অভিযানের এক চমৎকার পরিসমাপ্তি। আমাদের এগোবার মতো আর কোনো সূত্রই নেই। একটু থেমে আবার লেবল্যাঙ্ককে জিজ্ঞেস করলেন, ওদিকে যে অনুসন্ধান নিতে বলেছিলাম সেটা কদ্দূর এগোল?

–দুদিন ধরে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। লোকজনও অনেক লাগানো হয়েছে। প্লেনটা যেখানে পড়েছে, জায়গাটা একেবারেই নির্জন, হ্যাঁ, প্লেনটা কিন্তু পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলো।

-যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, জেসপ বললেন।

–ওখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রাম, সব থেকে কাছে জনবসতি এবং সবচেয়ে কাছের গাড়ির চাকার দাগ সবকিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজে পরীক্ষা করা হয়েছে। আপনার মতো আমাদের দেশেও এই অনুসন্ধানের গুরুত্ব কম নয়। ফ্রান্সে আমরাও আমাদের কজন অল্পবয়সী কৃতী বিজ্ঞানীকে হারিয়েছি। কী যে এদের মতিগতি, কে জানে!

–যাত্রী তালিকাটা আর-একবার পরীক্ষা করা যাক, কি বলল?

লেবল্যাঙ্ক তালিকাটা টেবিলের ওপর মেলে ধরতে দুজনেই ঝুঁকে পড়লো। মিসেস কেলভিন বেকার–আমেরিকান। মিসেস বেটারটন-ইংরেজ। টরকুইল এরিকসন, নরওয়েবাসী–এর সম্পর্কে কিছু জানা আছে?

যতদূর জেনেছি, সেটা কিছুই নয়, লেবল্যাঙ্ক জানালো সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক একজন।

জেসপ বললো, নামটা আমার যেন কেমন চেনা চেনা ঠেকছে, মনে হচ্ছে–হ্যাঁ ঠিক, রয়্যাল সোসাইটিতে উনি একবার ওঁর গবেষণাপত্র

–আর একজন সন্ন্যাসিনী দিদিমণি, লেবল্যাঙ্ক আবার তালিকায় মন দিলো। মিস্টার মেরী না কি যেন নাম। অ্যান্ড্রু পিটার্স, ইনিও আমেরিকান।

–ডাঃ ব্যারন–হ্যাঁ একটা প্রতিষ্ঠিত নাম–মাননীয় ডাক্তার ব্যারন। বিরাট প্রতিভাবান লোক। সংক্রামক ব্যাধির ডাক্তার হিসেবে ওঁর জুড়ি নেই।

-হুঁ, জীবাণুযুদ্ধে এঁদের খুব প্রয়োজন, বেশ মিলে যাচ্ছে।

 টেলিফোনটা বেজে উঠলো। লেবল্যাঙ্ক ফোনটা তুলে নিলো, হ্যালো, কে বলছেন? আঁ? ও আচ্ছা, হ্যাঁ ওপরে পাঠিয়ে দাও। জেসপের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার একজন তোক এইমাত্র খবর দিলো, মিঃ জেসপ, ওরা একটা কিছু খোঁজ পেয়েছে। হা, এটা সম্ভব, আমি স্বীকার করছি আপনার অবাস্তব কল্পনা অত্যন্ত সঠিক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন লোক ঘরে ঢুকলো। প্রথম জনের সঙ্গে লেবল্যাঙ্কের যথেষ্ট মিল আছে। কালো গাট্টাগোট্টা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন স্থানীয় গ্রাম্যলো, দেহাতী সাদা পোশাক গায়ে। অবাক দৃষ্টিতে সে ঘরের চারদিকে দেখছিলো, আর সেই সময়ে অন্য লোকটি দ্রুত ফরাসি ভাষায় বলছিলো

পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিলো এবং ভালোভাবে প্রচারও করা হয়। এ লোকটি এবং এর পরিবারের আর সবাই বিপুল উদ্যমে খোঁজ শুরু করে। ও যেটা খুঁজে পেয়েছে সেটা ওকে নিজে হাতে পৌঁছে দেবার জন্য এবং আপনার যদি ওকে জিজ্ঞাসা থাকে সেই জন্যই ওকে নিয়ে এসেছি।

স্থানীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে লেবল্যাঙ্ক বললো, চমৎকার কাজ করেছো তুমি। কই দেখি, কী তুমি আবিষ্কার করেছ দেখাও।

কোচার ভাজ খুলে লোকটা একটা বস্তু বের করলো। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখলো। বেশ বড়মাপের ধূসর লাল রঙের একটা মুক্তো।

লোকটি বললো, আমাদের যে জিনিসটা দেখানো হয়েছিলো, এটা প্রায় সেইরকম দেখতে। দামি জিনিষ ভেবে এটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম।

জেসপ প্রায় ছোঁ মেরে মুক্তোটা তুলে নিলেন। পকেট থেকে ঠিক ওই রকম আর একটা মুক্তো বের করে দুটোকে পরীক্ষা করতে লাগলেন।

এই তো, হ্যাঁ ঠিক সেই দাগটা রয়েছে, গলায় তার খুশি উপচে পড়লো। টেবিলের কাছে ফিরে এসে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে, সত্যিই লক্ষ্মী মেয়ে সোনা মেয়ে। কাজটা তাহলে করতে পেরেছে।

লেবল্যাঙ্ক তখন লোকটিকে আরবি ভাষায় কী সব যেন জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছিলো। জেসপকে বললো, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, মিঃ জেসপ। এই লোকটা বলছে, মুক্তোটা সে নাকি ওই জলন্ত প্লেনটা থেকে প্রায় আধমাইল দূরে পেয়েছে।

জেসপ বলতে লাগল, যা থেকে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, অলিভ বেটারটন মারা যায়নি। যদিও বলা হয় ফেজ থেকে প্লেনটা সাতজন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিলো এবং তাতে সাতটা ঝলসানো দেহই পাওয়া গিয়েছিলো, তবু বলা যেতে পারে সাতটা মৃতদেহের মধ্যে একটা অন্তত অলিভ বেটারটনের নয়।

এবার তাহলে আমরা জোর তল্লাশী করতে পারি, বলে লেবল্যাঙ্ক লোকটির সঙ্গে আরো কি যেন কথা বললো। লোকটি খুশি হয়ে অন্য লোকটির সঙ্গে বেরিলয়ে গেলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ওকে ভালো পুরস্কারই দিতে হবে-জেসপকে সে বললো। আর এবার ওই মুক্তোগুলোর খোঁজ নিতে আশপাশের গ্রামগুলোয় ব্যাপক তল্লাশী করবো। আমি ভাবছি, মিঃ জেসপ, এবার আমরা সুফল পাবোই-শুধু বেটারা যদি মিসেস বেটারটনের ফেলে যাওয়া সূত্রগুলো ওলটপালট না করে ফেলে।

জেসপ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল। অথচ কত স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। কত মেয়েই তো গলায় অমন মুক্তোর আঁটো হার পরে। আর তা যে-কোনো সময়ে ছিঁড়ে-যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এরপর শুধু পকেটে একটা ছোট্ট ফুটো থাকলেই হলো। যেখানে যেমন দরকার একটি করে মুক্তো সেই ফুটো দিয়ে ঠেলে গলিয়ে ফেলে দেওয়া, ব্যস। তাছাড়া ওকে তারা সন্দেহই বা করে কেন? সে অলিভ বেটারটন স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে চলেছে।

লেবল্যাঙ্ক বললো, ব্যাপারটা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। অলিভ বেটারটন, ডাক্তার ব্যারন, নাম দুটোর নীচে তালিকায় দাগ দিলো। অতন্ত এই দুজনে যে সেখানে যাচ্ছিল এটা নিশ্চত, এদের গন্তব্যস্থল এক। ঐ বিমানের যাত্রীদের একই দিনে, একই প্লেনে নিয়ে যাবার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে অত্যন্ত সুচতুরভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। তারপর জ্বলন্ত প্লেনটা আবিষ্কার করা হলো–ভেতরে সমসংখ্যক মৃতদেহ। কিন্তু কী করে এটা সম্ভব করলো সেটাই আশ্চর্য।

-হ্যাঁ, বিশ্বাস করানোর মতো সূক্ষ্ম নিখুঁত কাজ। আমরা কিন্তু এখন জেনে ফেলেছি, ওই ছ-সাতটা নোক আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিলো। কোথা থেকে তারা তাদের নতুন যাত্রা আরম্ভ করেছে সেটাও আমরা জানতে পেরেছি। এরপর আমাদের জায়গাটা দেখে আসা উচিত নয় কি?

–সে তো একশোবার, অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়ে বসবো আমরা। আর আমার ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে, একবার এই সূত্র ধরে এগোতে শুরু করলে অন্যান্য প্রমাণগুলো পেয়ে যাবো।

একদিন লেবল্যাঙ্ক লাফিয়ে উঠে বললো, আব্দুল মহম্মদ নামে একজনের বাড়ির পায়খানার এক অন্ধকার কোণে চেবানো চুইংগামে আটকানো একটা মুক্তো পেয়েছি। আব্দুল এবং তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কিন্তু প্রথমে তারা বলতে চাইছিলো না। তারপর ভয় দেখানোর পর বললো, একটা মোটরগাড়িতে ছজন লোক একদিন এসে তাদের বাড়িতে রাত্রিবাস করেছিলো। বলেছিলো তারা নাকি জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ। অনেক টাকা ওদেরকে দিয়ে বলেছিলো কাউকে যেন কিছু না বলে। কারণ তারা নাকি এক অভূতপূর্ব বিস্ময়র খননকার্যে যাচ্ছে, যা কাউকে জানাতে চায় না। এ কেইফ গ্রামের কটা বাচ্চা ছেলে দুটো মুক্তো কুড়িয়ে পেয়েছে। আপনার ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে, ওই যে ওকে ধরে এনেছি ও আপনাকে এ ব্যাপারে সবকিছু বলতে পারবে।

ওই যে–বলে যাকে দেখালো সে একজন স্থানীয় লোক, বিকট দেখতে। বললো, সেদিন রাত্তিরে আমি আমার দলবল নিয়ে ফিরছিলুম, হঠাৎ একটা মোটরগাড়ির আওয়াজ কানে এলো। গাড়িটা সাঁ করে পাশ দিয়ে বেরিলয়ে গেলো–আর স্পষ্ট দেখলুম, গাড়ির একপাশে ফতিমার হাত। হ্যাঁ বাবু, বিশ্বাস করুন, ওই অন্ধকারেও হাতটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলো।

দস্তানার গায়ে ফসফরাস মাখিয়ে দিলে চমৎকার ফল পাওয়া যায়, প্রায় ফিসফিস করে জেসপের কানে কানে বললো লেবল্যাঙ্ক। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো স্যার–এরকম একটা চিন্তা মাথায় আসা

-এটা খুব কার্যকরী হয়, জেসপ বললেন, কিন্তু ভীষণ বিপজ্জনক কাজ! মানে-একটা সাংঘাতিক কাজ করে পালাবার সময় অপরাধীরা এত সজাগ হয়ে থাকে যে, যে-কোনো সময়েই তারা এটা দেখে ফেলতে পারে।

দিনের বেলা এটা তো আর দেখা যায় না।

–না। কিন্তু অন্ধকারে যদি কোনো কারণে তারা গাড়ি থেকে নামে তো

-তখন ওরা কিছু ভাববে না। এটা আরবদেশের এত প্রচলিত কুসংস্কার যে কিছু সন্দেহই করতে পারবে না ওরা। কত গাড়িতেই ওই হাত এঁকে দেওয়া হয়। বড়জোর ওরা ভাববে, কোনো ধার্মিক মুসলমান বেশি করে চোখে পড়ার জন্য–কোনো জ্বলজ্বলে রঙ দিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠার ছাড় দিয়েছে।

তা সত্যি। কিন্তু আমাদের সতর্কতাটুকু আমাদের বজায় রাখতে হবে। কোনোক্রমে আমাদের শত্রুরা যদি এটা বুঝতে পেরে যায়, তাহলে আমাদের জন্য তারা ভুল পথের নিশানা রেখে যাবে। চারদিকে তখন হয়তো দেখবো, অজস্র গাড়িতে ফতিমার হাতের ছাপ।

পরদিন সকালে লেবল্যাঙ্ক আরেকটা জিনিষ এনে হাজির করলো। চেবানো চুইংগামের ওপর তিনটি ঝুটো মুক্তো ত্রিকোণাকারে সাজানো।

–এর মানে হচ্ছে, দেখে জেসপ বললেন, এরপর থেকে ওরা প্লেনে রওয়ানা হয়েছে। তিনি লেবল্যাকের দিকে তাকালেন।

–আপনি এক্কেবারে ঠিক বলেছেন, লেবল্যাঙ্ক বললো, একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে এটা পাওয়া গেছে। একেবারে নির্জন, দুর্গম জায়গা সেটা–অনেকদূর এখান থেকে। একটা প্লেন যে খুব শীঘ্রই সেখানে নেমেছিলো এবং আবার উড়ে গিয়েছিলো তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এখানে এসে আবার থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে–জানি না এরপর আবার কোথায় ওদের সন্ধান করার মতো সূত্র খুঁজে পাবো।

.

১৫.

 এ অসম্ভব, নিজের মনেই ভাবছিলো হিলারী। দশ-দশটা দিন আমি এখানে রয়েছি, এ যেন ভাবাই যায় না। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও আমি কত সহজে মেনে নিয়েছি।

প্রথম এখানে এসে, ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো, বন্দিত্ব আর হতাশার এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি–সেই বন্দিত্ব আবার যখন নানারকম বিলাস উপকরণের প্রলেপে মুক্তির মুখোশ ধরে আসে, সে যেন আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু তবুও এখন, একটা সপ্তাহ কাটতেই, মনের অগোচরে কখন যেন সে এই জীবনটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে! সত্যিই অদ্ভুত! স্বপ্নের ঘোরে বাস যেন।

এই ভয়াবহ পরিবেশকেও মেনে নিতে পেরেছে, তার একটা কারণ সম্ভবত–সে নারী। মেয়েরা প্রকৃতির বশ। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে সে, তার সঙ্গে যারা এখানে এসেছে তাদের হাবভাব দেখে। হেলগা নীডহেইমকে তো খাবার সময় ছাড়া দেখাই যায় না। চোখাচোখি হয়ে গেলে জার্মান মহিলাটি একটু সেঁতো হাসি হেসে তাকে এড়িয়ে যায়। যতদূর সে বুঝেছে, তাতে হেলগা নীডহেইমকে বেশ সুখী সন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। তার কল্পনার সঙ্গে এই সংস্থার জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই মিলে গেছে। নিজের এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীদের মর্যাদার আসন যে সবার উপরে একথা প্রমাণ করাই যেন তার প্রধান কাজ। মানবজাতির মুক্তি, বিশ্বশান্তি বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।

ডাঃ ব্যারন কিন্তু হেলগা নীডহেইমের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। মাঝেমধ্যে হিলারীর সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তাও হয়েছে। বেশ লোক। নিজের কাজে ডুবে আছেন। কাজ করার যে সুযোগ-সুবিধা তাকে দেওয়া হয়েছে তাতে একেবারে মুগ্ধ।

একদিন তিনি বলেছিলেন, এটা–ঠিক যেমনটা আমি আশা করে এসেছিলাম তেমন নয়। খোলাখুলি বলছি আপনাকে–একদম নয়। আরও একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি, মিসেস বেটারটন-বন্দীদশা আমার মনে কোনো রেখাপাত করে না। আর এখানকার জীবন–আমি মনে করি বন্দীজীবন।

-মানে–আপনি বলতে চাইছেন, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না? হিলারী জিজ্ঞেস করেছিলো।

হেসেছিলেন ডাক্তার, ক্ষীণ, বেদনাঝরা হাসি। বলেছিলেন, না না, আপনি ভুল করছেন। আসলে মুক্তির স্বাদ নিতে আমি আসিনি এখানে। আমি আপনাকে বলেছি, আমি এখানে এসেছি স্রেফ টাকার জন্য।

হিলারী তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে টাকা নিয়ে আপনি কী করবেন?

-না–আসলে, গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এরা কিনে দেয়, ডাঃ ব্যারন বলেছিলেন। আমি স্রেফ বিজ্ঞানের নবতম আবিষ্কারের আনন্দে ডুবে থাকতে চাই। এছাড়া–ফ্রান্স ছাড়ার আগে ওরা আমাকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলো। অন্য একটা নামে ব্যাঙ্কে সেগুলো নিরাপদে বেড়ে চলেছে। যথাসময়ে যখন এসব শেষ হবে তখন যেমন খুশী সেগুলো খরচ করতে পারবো।

–যখন এসব শেষ হবে? অবাক চোখে তাকিয়ে হিলারী কথাটা আওড়ালো।

ডাঃ ব্যারন হাসলেন। একটু বুদ্ধি থাকলেই বোঝা যায়, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আমার বিশ্বাস, কোনো কমিউনিস্ট শক্তি এ জায়গাটাকে চালাচ্ছে না। স্রেফ একজন পাগল-বদ্ধ পাগল এটাকে চালাচ্ছে।

এরিকসন, সে এই সংস্থার আবহাওয়ায় বেশ মানিয়ে নিয়েছে। ডাঃ ব্যারনের মতো বাস্তববাদী নয় সে, আত্মচিন্তায় বিভোর।

আমেরিকান যুবক অ্যান্ড্রু পিটার্সকে কিন্তু হিলারীর ভালো মনে হয়। পিটার্স একদিন বলেছিলো, আমি যে ঠিক কোথায় যাচ্ছি তাই অমি জানি না। এই জায়গার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো যোগসূত্র থাকতেই পারে না। মস্কোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।

হিলারী বলেছিলো, এ জায়গার আসল মালিক কে তা জানার জন্য আপনি একটু বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না?

–তা হয়তো সত্যি, বলেছিলো পিটার্স। আশেপাশে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই যখন তখন বলেই ফেলি। আমি এখান থেকে পালাতে চাই, সত্যি পালাতে চাই।

–খুব সোজা কাজ হবে না সেটা, গলা নামিয়ে বলেছিলো হিলারী।

 ছাদবাগানে হাঁটছিলো তখন ওরা। নৈশভোজ শেষ হয়ে গেছে। পিটার্স বললো, মোটেই সহজ হবে না, কিন্তু কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

হিলারী বললো, আপনার মুখ থেকে একথা শুনতেও ভালো লাগছে না।

 সহানুভূতির চোখে তাকাল পিটার্স। আপনি কি ভেঙে পড়েছেন?

–অনেকটাই তাই। তবে ঠিক তার জন্য আমি আতঙ্কিত নই।

 –তার জন্য নয়? তবে কিসের জন্য?

-না মানে–এই পরিবেশের সঙ্গে পাছে আমি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই, ভয় আমার সেই জন্য।

মাঝে মাঝে আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনোরকম ভোজবাজি চলছে না তো?

–ভোজবাজি? ভোজবাজি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

-স্রেফ ভোজবাজি মানে ধোকা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, কোনোরকম আফিম টাফিম খাওয়াচ্ছে না তো?

-মানে–ওই ধরনের কোনো ওষুধ-টষুধ বলতে চাইছেন?

হ্যাঁ, ওই ধরুন, খাবার বা মদের সঙ্গে এমন কিছু মিশিয়ে দেওয়া হলো–যার ফলে আপনি কুঁদ হয়ে রইলেন যে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া চলে–মানে একেবারে বশ করা যাকে বলে।

-কিন্তু এমন কোনো ওষুধ আছে কি?

-না–মানে এমন ওষুধ আছে যাতে রোগীরা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে, অস্ত্রোপচারের আগে তাদের অচেতন করে দেয়। কিন্তু বহুকাল ধরে নেশায় বুঁদ করে রেখে কাউকে বশ করে রাখা এবং একই সঙ্গে সেই লোককে দিয়ে বড় বড় কাজ করানোর দক্ষতা অর্জন করানোর মতো কোনো ওষুধ বেরিলয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এখানে এরা যে কোনো উপায়েই থোক প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলবো, আমার ধারণা এখানকার প্রশাসক এবং উদ্যোক্তরা নিশ্চয়ই সম্মোহনী বিদ্যায় খুব পোক্ত। একথা স্বীকার করতেই হবে। যে লোক নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে স্বেচ্ছায় কোনো কাজ করতে আসে তাকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যায়।

–কিন্তু তা বলে তো এ অবস্থা আমরা মুখ বুজে মেনে নিতে পারি না, রাগে প্রায় কুঁসিয়ে উঠলো হিলারী। এক মুহূর্তের জন্যও আমরা যেন না ভাবি, এখানে যা চলছে তা ভালো।

পিটার্স জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্বামী কী বলেন?

–টম? সে-মানে, তার কথা আমি ঠিক জানি না। জানা সহজও নয়। আমি–কথা শেষ না করে সে চুপ করে গিয়েছিলো।

এমন একজন দরদী শ্রোতাকেও সে তার অদ্ভুত জীবনের কাহিনী শোনাতে পারলো না। গত দশদিন ধরে সে সম্পূর্ণ এক অচেনা লোকের সঙ্গে বাস করছে। একই শয়নঘরে কত বিনিদ্র রাতে পাশের বিছানা থেকে একজন অপরিচিত পুরুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনেছে। দুজনেই এ অবস্থাটাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েছে। নেবেই বা না কেন? সে তো একজন ছদ্মবেশী গুপ্তচর। যে-কোনো পরিবেশ, যে-কোনো ব্যবস্থাই তাকে মেনে নিতে হবে। সত্যি বলতে কি, টম বেটারটনকে সে এতটুকুও বুঝতে পারে না। শুধু এই সংস্থায় এসে কয়েক মাসে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর তাজা মনের যে কী হাল হয়, ও যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যে কারণেই হোক, ও যেন তার অদৃষ্টকে অত্যন্ত সহজ শান্তভাবে মেনে নিয়েছে মনে হয়। কাজের আনন্দে ডুবে থাকা তো দূরের কথা, কাজে মন বসানোর অক্ষমতাই যেন ওকে আরো চিন্তিত করে তুলছে বলে মনে হয় হিলারীর। প্রথম দিন সন্ধ্যায় যা বলেছিলো, পরে আরও দু-একবার সেই কথাই বলেছে টম।

নাঃ! আর আমি ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে–আমার মনের মধ্যেটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

সত্যি বলেই বিশ্বাস করেছে হিলারী। টম বেটারটন একজন সত্যিকারের প্রতিভাধর। তার বিকাশের জন্য সবচেয়ে আগে দরকার–স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হারিয়ে ওর মনের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র সত্যিকারের মুক্ত পরিবেশই ওর পক্ষে কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব।

হিলারী বুঝেছে টম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। হিলারীকেও সে পরম উদাসীনতায় উপেক্ষা করে চলেছে। ওর কাছে হিলারী যেন রক্তমাংসের নারী নয়, বন্ধুও নয়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হিলারীর, নিজের স্ত্রীর মৃত্যুও ওকে নাড়া দিতে পেরেছে কিনা। একটি মাত্র চিন্তাই যেন ওকে দগ্ধ করে তুলেছে–তা বন্দী জীবনের চিন্তা। বার বার ও বলেছে, আমি জানি না, আমি জানি না। কোথায় যে এর শেষ কোনো ধারণাই নেই আমার। এখান থেকে কী করে আমি মুক্তি পাবো? কী করে? জানি না কিন্তু আমি মুক্তি পেতে চাই।

পিটার্সের কথাগুলো ছিল দৃপ্ত। মোহভঙ্গের ক্রোধে জ্বলে ওঠা গভীর প্রত্যয় ছিলো তাতে। যে জায়গায় সে এসে পড়েছে, তার পরিচালকদের বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিলারীর মনে হলো, হয়তো ছমাস এখানে থাকলে পিটার্স আর সেও টম বেটারটনের মতো দুর্বল হয়ে পড়বে।

পাশের এই দরদী মানুষটার কাছে মনের কথা সব উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হলো হিলারীর। শুধু–যদি সে বলতে পারতো : টম বেটারটন আমার স্বামী নয়। ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। জানি না এখানে আসার আগে ও কেমন লোক ছিল। কিছু জানি না আমি–সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি। ওকে আমি সাহায্য করতে পারি না, কারণ ওকে কী বলবো কী করবো কিছুই যে জানি না।

একথা মনে হতেই সাবধান হয়ে উত্তর দিলো হিলারী। বললো, টমকে এখন আমার কেমন যেন অচেনা মানুষ বলে মনে হয়। ও আমাকে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই খোঁয়াড়ে বন্দী থাকার চিন্তায় ও পাগল হতে বসেছে।

–খুবই স্বাভাবিক, পিটার্স বললো, হতেই পারে।

–কিন্তু আপনি বলুন–একটু আগে আপনি জোর গলায় এখান থেকে পালাবার কথা বলছিলেন। কেমন করে পালাবেন? সত্যিকারের কোনো সম্ভাবনা কি দেখতে পাচ্ছেন?

-সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা করে, পরিকল্পনা করে আমাদের পালাতে হবে। কত বন্দীই তো কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালায়। জার্মানির বন্দীশালা থেকে পালানোর ঘটনা নিয়ে আমার এবং আপনার দেশে তো কত বই লেখা হয়েছে।

-সেটা সম্পূর্ণই আলাদা ব্যাপার।

–মূল কথাটা কিন্তু আলাদা নয়। যেখানে ঢোকার রাস্তা আছে, বেরুনোর রাস্তাও নিশ্চয়ই আছে সেখানে। যদি মনের জোর নিয়ে এগোনো যায়, তাহলে ছদ্মবেশ ধরে, অভিনয় করে, ঘুষ দিয়ে বা যে-কোনো শঠতার আশ্রয় নিয়ে এগোলে এ কাজ অসম্ভব নাও হতে পারে। তবে অনেক ভাবতে হবে–বুদ্ধি বের করতে হবে। এখন আমি জোর গলায় বলছি–এখান থেকে আমি পালাবোই, সে যেভাবেই হোক।

–আপনি তা পারবেন বলেই বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি কি পারবো?

 –তা-আপনার ক্ষেত্রে অবশ্য এটা আলাদা।

পিটার্সের গলাটা যেন কেমন ধরা ধরা ঠেকছিলো হিলারীর কানে। ওর কথাটা উপলব্ধি করতে মুহূর্তের জন্য মনটা থমকে দাঁড়ালো। মনে পড়লো–সে যে তার ইঙ্গিত বস্তু লাভ করেছে এটাই তো লোকের ভাবা স্বাভাবিক। এখানে সে এসেছে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হতে। এখানে একা পালানোর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয় থাকতে পারে না।

এই মুহূর্তে পিটার্সকে সত্যি কথাটা বলে দেবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে উঠলো হিলারী–কিন্তু কোন্ এক শক্তি যেন তাকে থামিয়ে দিলো।

শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি সে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলো।