০১. শুক্রবার সকাল

দি হলো (অন্যান্য)

০১.

শুক্রবার সকাল ছ’টা তেরো মিনিটে বড়সড় মাপের চক্ষুজোড়া খুলতেই বরাবরের মতো লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল সম্পূর্ণরূপে নিদ্রা কাটিয়ে জেগে উঠলেন এবং চোখ খুলতে যতক্ষণ দেরি, চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার সদা ব্যস্ততৎপর মন সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলোচনার প্রয়োজনেই খুড়তুতো বোন মিডগে হার্ড ক্যাসলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং সে-ও গতকাল হলোতে এসে হাজির হয়ে গেছে। গৃহকত্রী এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট শয্যা ত্যাগ করে, নিজের অনিন্দ্যসুন্দর কাঁধের ওপর শিথিল হয়ে পড়া পোষাকটা সরিয়ে নিয়ে মিডগের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন। অহেতুক চিন্তার জাল ভদ্রমহিলার উর্বর মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ বিচরণ করে, তাই তিনি চলতে চলতে আপন খেয়ালের বশে কথোপকথনের অবতারণা করে ফেলেন এবং তাই মিডগের জবাবও নিজের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই জোগাতে থাকেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মিডগের শোবার ঘরের দরজা খুলে ঘরে পা রাখলেন, কথোপকথনের জের তখনও পুরোদমে চলছে। তিনি বললেন, প্রিয় বোনটি আমার, তুমি নিশ্চয়ই একথা স্বীকার করবে যে, সপ্তাহান্তে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

সদ্য সুনিদ্রা থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা মিডগে অস্পষ্ট স্বরেই বলে ওঠে, আঁ? হ্যাঁ!

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট করে খুব দ্রুত জানলাগুলো খুলে দিতেই, ঝঝন শব্দের রেশ তুলে জানলা দিয়ে শরৎপ্রাতের পাংশু আলোর রেখা ঘরে এসে পড়ে। তিনি আপনমনেই বলে ওঠেন, পাখিগুলো সত্যি কি সুন্দর।

মিডগে, কী?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলতে থাকেন, সে যাই হোক, মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার বোধগম্য হয়ে যাচ্ছে যে, আবহাওয়া কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছে না এবং খুব সম্ভব ভালোর দিকে যাবে। কিন্তু তাতে করে কী এসে যাবে, পরস্পরবিরোধী কতগুলো ব্যক্তিত্ব তো ঘরের মধ্যেই এসে ভিড় জমাবে। আমিও বলে রাখছি, গতবারের মতো এবারেও যদি রাউণ্ড গেম নিয়ে কোনো ঝাট বাধে, আর কেউ না বলুক, আমি জাদাকে ছেড়ে কথা বলব না। গতবারের অবশ্য গোলমালের পর আমি হেনরিকে বলেছিলাম। আবার এও ভেবে দেখলাম, এ কাজটা আমার পক্ষে মোটে শোভন হবে না–তাকে তো আনতেই হবে। তাছাড়া জার্দাকে বাদ রেখে জনকে আসতে বলা একদিকে যেমন হৃদয়হীনতা হবে, আবার অন্যদিকে দৃষ্টিকটুও বটে! সবচেয়ে বড় কথা, জার্দা অত্যন্ত ভালো হয়েও যে এমন নির্বোধ হতে পারে এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে। যাকগে কি আর করা যাবে।

মিডগে এতক্ষণে নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে, আচ্ছা তুমি ঠিক কোন্ ব্যাপারে কথা বলছে বল তো, লুসি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল জবাবে বলেন, আমি সপ্তাহান্তিক ছুটির কথা ভাবছি। কাল যাঁরা আসছেন আমি তাদের কথাই বলতে চাইছি। দিনরাত একটা ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যতই ভাবছি ততই মনটা বড় অস্থির লাগছে। মিডগে, ভাবনার হাত থেকে রেহাই পেতে তোমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছি, মনটা অনেক হালকাও লাগবে। তোমার বিচক্ষণতা আর বাস্তব বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না।

মিডগে রূঢ় স্বরে বলে ওঠে, লুসি, জানো এখন ক’টা বেজেছে?

–ঠিক জানি না, তোমার তো অজানা নয়। ঘড়ির কাটা ধরে চলার অভ্যাস আমার কস্মিনকালেও ছিল না।

মিডগের সঙ্গে সঙ্গে জবাব, এখন ঠিক ছ’টা বেজে পনেরো।

বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সপ্রতিভ থেকেই লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, তা হবে হয়তো বোন।

মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। সত্যি দিনকে দিন কী অসম্ভব পাগলাটে হয়ে উঠেছে আজকাল লুসি।

মিডগে ভাবতে বসে যায়, কেন যে ওকে আমরা সহ্য করে চলেছি? ওর সঙ্গে মনের মিল রেখে মানিয়ে চলছি-বা কেন?

কিন্তু প্রশ্নটা মনে উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটাও মনের মণিকোঠায় এসে হাজির হয়ে যায়, লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখে মুচকি হাসির রেখা এবং মিডগে তার দিকে দৃষ্টি যেতেই লুসির মোহিনী মায়ার জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, মুহূর্তের বিহ্বলতায় মনের সব ক্রোধ আর রূঢ়তা নিমেষে উবে গেল। সারা জীবন ধরে সে যে মোহজাল বিস্তার করে সকলকে ভুলিয়ে রেখেছে, আজ ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও তার সেই শক্তির মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষয়ে যায়নি–সেই জন্যই বোধহয় পৃথিবী জুড়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, এডি. কং এবং সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ সকলকেই অসুবিধা, অসন্তুষ্টি আর হতবুদ্ধিতার শিকার হতে হয়েছে। তার শিশুসুলভ স্বভাব আর চপলতাই তাকে সমালোচনার উর্ধ্বে নিয়ে যেত, ডাগর চোখে বিস্ফারিত নেত্রে কমনীয় ও রমণীয় শুভ্র হস্তদুটো মেলে ধরে ভ্রমরগুঞ্জনের মতো মিষ্টি সুরে বলে উঠতেন, ওঃ, আমি সত্যি দুঃখিত…তাঁর প্রতি সকলের সব অসন্তোষ মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যেত।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল এই সময় বলে ওঠেন, প্রিয় বোনটি আমার, সত্যি আমি দুঃখিত, আমাকে আগে থাকতে বলে দেওয়া উচিত ছিল।

–আমি এখন তোমাকে বলে দিচ্ছি…অবশ্য ঘুম তো আমার ভেঙে গেছে, আর বলেই বা। লাভ কি?

-বড়ই লজ্জার কথা! কেন? অসুবিধাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিছানার প্রায় প্রান্তে এসে বসে পড়ে, মিডগের মুহূর্তের জন্য মনে হল কোনো পরী বোধ হয় তার শয্যায় এসে বসেছে।

চঞ্চল হাত দুটো অত্যন্ত রমণীয় এবং অসহায় ভাবে মেলে ধরলেন লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হাত, নেড়ে বলে ওঠেন, সব খারাপ লোকেরাই তো একসঙ্গে হাজির হচ্ছে, মানে–আমার বক্তব্য হল- যারা আসছে তারা লোক হিসেবে খারাপ নয়, সত্যি তারা ভালো লোক, শুধু ভালো নয় খুব ভালো।

চতুষ্কোণ আকৃতির কপাল থেকে চুলগুলো ধীরে ধীরে সরাতে সরাতে মিডগে জিজ্ঞাসা করে, কারা আসছে?

কেন, জন এবং জার্দা? ব্যক্তি হিসেবে জন খুবই ভালো এবং তার একটা আশ্চর্য আকর্ষণী শক্তিও আছে। তবে বেচারা জার্দা-তাকে আমরা সকলেই দয়ার চোখে দেখব এবং আমাদের প্রায় সকলেরই তার প্রতি অনুকম্পা থাকা একান্তই উচিত।

জার্দার পক্ষ সমর্থন করে মিডগে বলে ওঠে, খারাপ যতটা ভাবছো তত খারাপ সে নয়।

-না, না, বোন, সে সত্যিই করুণার পাত্রী, তার কারণ সকলের বক্ষ জুড়ে দয়ার উদ্রেক হয়, লোকের একটা কথারও মানে বোঝে না।

-হয়তো বোঝে না, তোমার কথার অর্থ না বোঝার জন্য আমি তাকে চাপ দিতে পারি না। লুসি, তোমার মন এত দ্রুত এগিয়ে চলে যে, তার সাথে তাল রাখতে গিয়ে তোমার কথোপকথনের মাত্রাকেও বিস্ময়কর লাফ লাগাতে হয়। সংযোগের সব সূত্রই তাই মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–ঠিক বাঁদরের মতো? কি বলো?

মিডগে–ক্রিস্টোস ছাড়া আর কে আছে? হেনরিয়েটা নিশ্চয়?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, হা, তবে আমার মন বলে, হেনরিয়েটা একটা শক্তির পাহাড়। সে চিরটাকাল একইরকম রয়ে গেল। তোমার নিশ্চয়ই অজানা নয় হেনরিয়েটা দয়ার সাগর। সে জাদার ব্যাপারেও যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। গতবারের কথা ভেবে দেখো, সে কত সাহায্য করেছিল। সে বারে আমরা লিমেরিক বা শব্দবাঁধন বা উদ্ধৃতি নিয়ে খেলছিলাম এবং খেলা প্রায় শেষের দিকে তখন খেয়াল হলো, জার্দা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে; শুরুটাই সে করতে পারেনি। সে বুঝতেই পারেনি, কোন্ খেলায় আমরা মেতে উঠেছি! সত্যি এটা বড় বিপজ্জনক। নয় কি, মিডগে?

মিডগে-অন্যের কথা আর কি বলব, তোমার উর্বর মস্তিষ্কের ফল, রাউন্ড গেম, সেই সঙ্গে তোমার কথা বলার ধরন–এসব আমার কিছুই বোধগম্য হয় না। সত্যি লুসি, তোমার কথা বলার ধরনধারণ কি বরাবরই অদ্ভুত?

মিডগের কথায় কর্ণপাত না করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার বক্তব্য পেশ করেই যেন এগিয়ে চলেছে, হ্যাঁ বোন, আমাদের সকলেরই উচিত চেষ্টা করে দেখা, কিন্তু চেষ্টা করতে গেলে জার্দার মনে ঘৃণা জন্মাবে। আমার মনে হয়, জার্দার যদি সাহস থেকে থাকে তবে সাহসিকতার পরিচয় না দিয়ে সে যেন দূরে নিজেকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু তা সে করে না, হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে খুব অল্পেই, বিমর্ষের লক্ষণ চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। জন এইসব দেখে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, আমি কিছুতেই ভেবে পাই না, কী করলে অবস্থাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর, ঠিক তখনই হেনরিয়েটা ব্যাপারটাকে আরো ঘোলা করে তোলে। জার্দার দিকে ফিরে সে এমনভাবে পুলওভার সম্বন্ধে মুখরোচক আলোচনা জুড়ে দেয় যে, জার্দাও নিজের পোষাকের গর্বে এমন ভাব দেখাতে থাকে যে পুলওভারটা যেন তার নিজের হাতেই বোনা। ধীরে সুস্থে পূর্বের বিমর্ষতা কাটিয়ে জাদার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সমস্ত পরিবেশটা পরিচ্ছন্নতার আলোয় প্রস্ফুটিত হয়ে একটা নতুন দিকে বাঁক নেয়। বিশেষ এই গুণটার জন্য হেনরিয়েটার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ–সমস্ত সমস্যার এমন সুন্দর সুষ্ঠু সমাধান, সেইসঙ্গে মেঘমেদুর নীলাকাশে সূর্যালোকের আলোকে ভাসিয়ে দিতে হেনরিয়েটার জুড়ি নেই।

মিডগে–হ্যাঁ, সে ঝুঁকিটা ঘাড়ে নেয়।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা, সে জানে কোথায় কী বলতে হবে, কি করতে হবে।

মিডগে-কাজ করার শক্তিও আছে। সেবারে সে পুলওভারটা হেনরিয়েটা গায়ে চাপিয়েছিল, সত্যি কী সুন্দরই না তাকে মানিয়েছিল। হেনরিয়েটা ওটা নিজের হাতেই তৈরি করেছিল।

-সত্যি?

–নিশ্চয়ই।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–এই জন্যই তো, হেনরিয়েটার প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ। আর দেখো, হেনরিয়েটা যা করে ঠিকই করে, সুন্দর করে–সকলেই এক বাক্যে তার কাজের প্রশংসায় সামিল হয়। আর ঠিক এই একটা জায়গাতেই জার্দা ও হেনরিয়েটার মধ্যে অমিল চোখে পড়ে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও, সাপ্তাহাত্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা নানা ভাবে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সব কাজেই তার চাতুরী স্পষ্ট ধরা পড়ে। জাদাকে সে সাহায্য করবে, হেনরিয়েটাকে আনন্দ দেবে, জনকে তার মেজাজ বুঝে পরিচালনা করবে, আমার তো মনে হয় সে ডেভিডকেও সাহায্য করবে।

মিডগে–কোন ডেভিড? ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হ্যাঁ, এই তো সবে সে অক্সফোর্ড না কেমব্রিজ থেকে ফিরে আসছে। এই বয়সের ছেলেগুলোর সম্বন্ধে সমালোচনা করা সত্যি বড় কঠিন, বিশেষ করে যদি সে প্রখর বুদ্ধির অধিকারী হয়। ডেভিড তো নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন যুবক। এই ধরনের যুবকদের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যটা চোখে পড়ে তা হল, হয় তারা গম্ভীর, না হয় অত্যন্ত তার্কিক মনোভাবাপন্ন হয়। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, হেনরিয়েটা যেভাবেই হোক নিজের মতো করে তাকে মানিয়ে নেবে, কারণ অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে সে কাজ করে। এছাড়া আরও একটা গুণ, তার ভাস্কর্যের জন্যও সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সে শুধু পাথর কেটেই মূর্তি তৈরি করে না, নানাপ্রকার ধাতু ও প্লাস্টার দিয়ে সুন্দর সুন্দর শিশু, জন্তু বা মানুষ নির্মাণেও সে সিদ্ধহস্ত। গতবারে নিউ আর্টিস্ট-এ তার হাতের তৈরি বহু জিনিসের প্রদর্শনী হয়ে গেছে–সেগুলো দেখতে রবিনসনের মই বেয়ে ওঠার মতোই যেন লাগছিল। সুচিন্তার উর্ধ্বারোহন তাতে খুবই সুন্দর ভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। ডেভিডের মতো যুবক এই সব জিনিসের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হবে।…আমার কাছে কিন্তু এইসব নিছক বালখিল্য বলেই মনে হয়।

মিডগে-প্রিয় বোন লুসি।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হেনরিয়েটার কিছু কাজ আমার খুব মনোরম বলেই মনে হয়। যেমন ধরো; উয়িপিং এ্যাশট্রি ফিগার। মিডগে, একটা কথা না বলে পারছি না যে, হেনরিয়েটার মধ্যে প্রতিভা আছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত ভাবেও সে সকলের কাছে প্রিয়পাত্র।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েন, জানলার কাছটিতে এসে দাঁড়ান। অন্যমনস্ক ভাবে ছেঁড়া তারে সুর তোলার চেষ্টা করেন। আপন মনেই লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিড়বিড় করতে থাকেন, কেমন যেন বেসুরো লাগছে?

বেসুরো?

তাই তো ভাবি কেন এমন হচ্ছে। সদর দরজার দু’ধারে আনারস গাছের মতো বেমানান, বেসুরো কেন মনে হচ্ছে? ছেঁড়া তার বলে। একটা-না-একটা কারণ নিশ্চয়ই থাকবে।শূকরছানার মতো অনুসন্ধিৎসু হতে হবে, তবে যদি কারণ মেলে।

মিডগে-দেখো লুসি, একটা বিষয় শেষ হতে না হতেই অন্য প্রসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেও না। সপ্তাহান্তের আলোচনার জন্যই তোমার এখানে আগমন, এবং যতদূর দেখছি। তোমার মনে বিন্দুমাত্র উদ্বেগের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। তুমি যদি রাউন্ড গেম থেকে দুরে সরে থাক, জাদার সঙ্গে সহনশীলতার মাত্রা বজায় রেখে কথাবার্তা বলে চল এবং হেনরিয়েটাকে দিয়ে যদি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ডেভিডকে পোষ মানাতে পার, তবে আর অসুবিধাটা রইল কোথায়

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আছে, আছে বোনটি, অমও একটা জিনিষ আছে, এডওয়ার্ড আসছে যেন!

মিডগে-ওঃ, এডওয়ার্ড! মিডগে নামটা উচ্চারণ করেই চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে মুখ খুলল, কোন্ লোভের বশবর্তী হয়ে এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে আনছ শুনি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি তাকে ডাকিনি, সে নিজেই উপযাজক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সে “এখানে উপস্থিত হতে পারে কি না।” যদি তাকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দিই, সে আর কোনোদিন এ পথ মাড়াবে কিনা সন্দেহ, কারণ তার যা স্বভাব চরিত্র।

মিডগে ধীরে ধীরে শুধু মাথা নাড়ে। আর ভাবে, হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে নয় সত্যি তার যা স্বভাব। মুহূর্তের মধ্যে তার মনের মণিকোঠায় প্রিয় মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কতকটা যেন লুসির অহেতুক মোহময় মুখশ্রীর ন্যায় শান্ত নির্ভীক বিদ্রুপাত্মক…।

মিডগের মনের সুরের প্রতিধ্বনি তুলে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে চলেন, প্রিয় এডওয়ার্ড… হেনরিয়েটা যদি একবার মনস্থির করে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারত, যদি সে তাকে বিবাহ করত…আমি জানি, এডওয়ার্ডকে সে মনে মনে খুবই পছন্দ করে…যদি একবার সাপ্তাহান্তের ছুটিতে ক্রিস্টো এসে হাজির না হতো তবে সব পূর্বের মতোই চলতো, সব ঠিক হয়ে যেত…কি এডওয়ার্ডের ওপর জনের খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। জনের প্রয়োজন যত বাড়ে, এডওয়ার্ডের উপস্থিতি তত বেশি অপ্রয়োজনীয় আর নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

বুঝতে পারছ আমি ঠিক কী বলতে চাইছি?

মিডগে শুধু নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–এই সাপ্তাহান্তিক ছুটি উপভোগের ব্যবস্থা অনেক আগে থাকতেই ঠিক হয়ে আছে, তাই ক্রিস্টোফারকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একটা কথা ভেবেই আমার মন বারবার উতলা হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে একদিকে ডেভিড যেন দাঁতে রেখে নখ কাটবে, জাদাও বেসামাল হয়ে পড়বে। অপরদিকে জন অত্যন্ত ধনাত্মক এবং এডওয়ার্ড তেমনি ঋণাত্মক…কি যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।

মিডগে–পুডিংয়ের উপাদানগুলো মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

লুসি, মিডগের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। হাসিমুখেই বলে ওঠেন, এমন অনেক সময়ও গেছে যখন সমস্যাগুলোর সমাধান সহজভাবে হয়ে যায়। আগামী রবিবার আমরা একজন অপরাধশাখার লোককে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করার নিমন্ত্রণ করেছি–তাতে করে হয়তো অবস্থার কিছু হেরফেরও হতে পারে। কি বলো হতে পারে না?

মিডগে-শেষ পর্যন্ত অপরাধশাখার লোক?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হ্যাঁ, ভদ্রলোক আগে থাকতেন বাগদাদে, হেনির তখন হাইকমিশনার ছিলেন। অন্য জনাকয়েক সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে তাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ভদ্রলোক হাঁসের রঙের মতো সাদা স্যুট পরে এসেছিলেন, বোম ঘরে ছিল গোলাপী রঙের ফুল এবং পায়ে কালো পেটেন্ট চামড়ার জুতো। তাঁর সম্বন্ধে আর বেশি কিছু আমার জানা নেই। কারণ, কে কাকে মারল এই সব আজেবাজে গল্প শুনতে আমার কোনোদিনই ভালো লাগে না। আমার বক্তব্য হল যে, লোকটা মরে গেলে আর তার বাকি কী রইল? মৃত্যুর পরে-কে মারল, কেন মারল, কখন মারল–এইসব নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় বোকামি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!

মিডগে-তোমাদের এখানে কি কোনো খুন-টুন হয়েছে নাকি, লুসি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-না, না বোন, আমাদের এখানে খুন হতে যাবে কেন? ঐ ভদ্রলোক নতুন ঐ বাড়ির লোক–ঐ যে নতুন বাড়ি করেছে। বাড়িতে বিশ্রী রকমের একটা বাগানও করেছে লন্ডনের লোকেদের যা রুচি, তারা বরাবরই এরকম কুৎসিত জিনিষের প্রতি আসক্ত। ঐ ভদ্রলোকের বাড়ির গায়েরই বাড়িটা এক অভিনেত্রীর। তারা আমাদের মতো বারোমাস বাড়িতে কাটায় না…। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন এবং সেই সঙ্গে এও বললেন, যাকগে, ও সব বাজে ব্যাপার। এসব ভেবে আর কী লাভ, তোমার সাহায্য পেয়ে আমি বড়ই উপকৃত হলাম, প্রিয় মিডগে।

মিডগে–আমার তো মনে হয় না, আমি তোমার কোনো কাজে এসেছি বলে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিস্ময়ভরা চোখে মিডগের দিকে তাকাল।–কি? করোনি? আচ্ছা, একটা ভালো ঘুম দিয়ে নাও, প্রাতঃরাশেও ওঠা চলবে না। আর যদি ডাক দিয়েও থাকি, ওঠার পরিবর্তে যত খুশী মন চায় আমার প্রতি কঠোর হবে।

হাসিমাখা মুখে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে খোলা বাথরুমের দিকে চোখ পড়ল, কেটলি আর গ্যাসরিং দেখা মাত্র তার মাথায় আর এক বুদ্ধি খেলে গেল।

পৃথিবীতে এমন কোনো লোক নেই যে চা ভালোবাসে না। মিডগেকে চা করে দেওয়ার জন্য তিনি কেটলি চাপালেন। কেটলি চাপিয়েই আর দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন।

এবার তিনি এসে দাঁড়ালেন স্বামীর ঘরের সামনে, দরজার হাতলে হাত রাখলেন হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল। লুসিকে তিনি ভালোবাসতেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সকলের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এটা তিনি কখনোই মনেপ্রাণে চাইতেন না। তাই সবদিক ভেবেই দরজায় তালা দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছিলেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল নিজের ঘরে ফিরে এলেন। হেনরির সঙ্গে তাঁর আলোচনায় বসা সত্যিই দরকার ছিল, কিন্তু কি আর করেন–পরে হবে বলে এখনকার মতো তুলে রাখলেন।

ঘরের খোলা জানলার কাছটিতে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বিছানায় এসে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। বালিশের ওপর মাথা রেখে দুমিনিটের মধ্যেই শিশুর মতো তার চোখেও ঘুম নেমে এল।

বাথরুমের কেটলিতে জল ফুটছে তো ফুটেই চলেছে…দাসী সাইমনস বলে ওঠে, মিঃ গাজন, আর একটা কেটলিও অন্তিম যাত্রা নিল, খানসামা মুখের ভাষা আর জোগাতে না পেরে তার ধূসর মাথা নাড়ে।

সাইমনস-এর কাছে সে পুড়ে যাওয়া কেটলিটা নিয়ে আসে এবং আলমারি থেকে আর একটা নতুন টেনে বের করে। আলমারিতে তার জিম্মায় আধডজনের মতো কেটলি জমা ছিল। সে বলল, দেখে নিও, মিস সাইমন, গৃহকত্রীর কানে কিছুই পৌঁছবে না।

সাইমনস–তিনি কি আজ পর্যন্ত কখনো এসব ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করেছেন?

গাজন দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, গৃহকত্রীর দয়ার অন্ত নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কিছুই মনে থাকে না।

এই গৃহে তার উদ্বেগ বা অসন্তোষ যাতে কোনোদিন মাথা চাড়া না দিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাই।

.

০২.

হেনরিয়েটা স্যাভারনে একটা কাদার তালকে চাপড়ে চ্যাপ্টা করে, লম্বা করে, চেপে চেপে প্রস্তুতকার্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মাটি দিয়ে একটা বালিকার মাথা তৈরি করছিল। অভ্যাস আছে বলে তার মূর্তি নির্মাণের কাজ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিল।

মনের সৌন্দর্য মূর্তির মধ্যে স্থাপন করতে সে সক্ষম হয়েছিল। কাজের খুঁটিনাটি সব দিক, বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থাপনা, সেইসঙ্গে একাগ্রতা আর নৈপুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। এই সবের গুণেই একজন শিল্পী গড়ে ওঠেন। শিল্পী হেনরিয়েটা স্যাভারনেক, যতদূর মনে হয়, শিল্পীর চেয়ে শিল্পের ক্ষমতাই বোধ হয় বেশি হয়, কারণ শিল্পই পারে শিল্পীকে আত্মস্থ করতে, তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো যন্ত্রচালিত হয়ে সে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। হেনরিয়েটাও ঠিক তেমনি এক মানুষ। সে যেমন কাজ করে যাচ্ছে এবং এর-ওর সঙ্গে কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় নিজেকে সে এইভাবে তৈরি করেছে, অন্যের সঙ্গে মিশে মনটাও ভালো থাকে। কিন্তু কাজের জন্য যে ভাগটা পৃথক করে নিয়েছে সেটাই বড় ভাগ–অর্থাৎ মনের পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ তো বটে, বাকি এক ভাগ পড়ে থাকে বাইরের ভাগ চালানোর জন্য।

স্টুডিওতে বন্ধুবান্ধব বা অন্য দর্শনার্থী যারাই এখানে আসুক-না-কেন হেনরিয়েটা কাউকেই নিরাশ করে না। সকলকেই সে আদর করে বসায়, গল্পগুজব করে, চা-পান করায় অর্থাৎ আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখে না। সবকিছুর মধ্যে তার কাজ কিন্তু এগিয়ে চলেছে-কাজ সমানেই এগিয়ে চলেছে মনের সেই বড় অংশের সাহায্যে। ক্ষুদ্রতম এক-পঞ্চমাংশ গুণে কম নয়, বাইরের সব কাজ সে সুশৃঙ্খলভাবেই করে যাচ্ছে।

কারো বোঝার কোনো উপায় নেই–সকলেই খুশী হয় এবং প্রয়োজনের তাগিদেই যারা আসে, তারা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে আবার ফিরে যায়।

বহুদিনের অভ্যাসের ফলে হেনরিয়েটার মধ্যে এমন এক শক্তি জন্মেছে যে, সে তাস খেলতে খেলতে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতেও অসুবিধা হয় না বা নির্ভুল রচনা বা কোনো তর্জমা তৈরি করতে পারে, এমন কি কাউকে কোনো বিশেষ নির্দেশ বা উপদেশও দিয়ে যেতে পারে। এই মন-বিভাজন করে বিভিন্ন কাজ একই সঙ্গে করে যাওয়া কম-শক্তি বা দক্ষতার একমাত্র পরিচয় নয়।

কিন্তু আজ যে কী হয়েছে হেনরিয়েটার, তার আরব্ধ কাজ কিছুতেই সম্পূর্ণ হচ্ছে না। মাটি দিয়ে যে বালিকার মাথা তৈরির কাজে সে নেমেছিল তা কিছুতেই তার মনোমতো হচ্ছে না। চোয়াল ঠিক হয় তো ঠোঁট ঠিক হয় না, মুখের আদলের সঙ্গে চোখের গরমিল থেকেই যাচ্ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। মাটির পুতুলের সঙ্গে তার মনের ছবি মিলছে না–এই ব্যাধিই তাকে আজ বড় বিব্রত করছে।

সময় কেটে যায়…পরবর্তী আধঘণ্টায় তার কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে চলে, কপালে চুলে কাদার দাগ লাগে, অর্ধেক হাত আরও গতিশীল হয়ে পড়ে, চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে অন্ধ অভিব্যক্তির ভীষণতা…হচ্ছে, হবে, সে করতে পারবে…

এখনও যদি হেনরিয়েটা মাটির পুতুলের মাথা ঠিকমতো বানিয়ে উঠতে না পারে তবে সে ক্ষেপে আগুন হবে–গত দশদিন ধরে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ধৈর্য বলেও তো একটা জিনিষ আছে!

নসিকা–পুতুলের নাম রাখা হয়েছে নসিকা–কিন্তু শিল্পীর মনকে নসিকা কিছুতেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না। সদাই নসিকার সঙ্গে থাকে, নসিকার সঙ্গে প্রাতঃরাশ শেষ করে, নসিকার সঙ্গে ভ্রমণে গিয়েও তাকে তার নাগালের মধ্যে আনতে পারছে না শিল্পী হেনরিয়েটা। অন্য কিছুতেই তার মন আজ উতলা হচ্ছে, সে চাইছে সুন্দর মুখে দৃষ্টিহীন চোখের চাউনি–যেটা হেনরিয়েটার মানস চক্ষে সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু যেটা দেখছে তা কিছুতেই মূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। সে কম মডেল দেখেনি, গ্রীক মডেল দেখে চক্ষু সার্থক করেছে, ইতস্তত করেও মনকে শান্ত করতে পারেনি, পছন্দ হয়নি, অতৃপ্ত মন নিয়েই সে…

এখন তার দরকার একটি মডেলের। প্রথম ধাপ এগোতে পারলেই আশা করা যায় বাকি কাজটাও সে নিজেই উদ্ধার করতে পারবে–তার মনে যে ছবিটা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে তাকে একবার এনে স্থাপন করলেই হবে–কিন্তু প্রাথমিক একটা আধার দরকার। এইজন্য সে বহুদূর হেঁটে গেছে, বহু মেয়ে, স্ত্রীলোক, বালিকাও চোখে পড়েছে–দেখে দেখে চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে–হেঁটে হেঁটে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে, তবু মনের সাধ মেটেনি, মনের ছবির মিল খুঁজে পায়নি।

পথ চলতে চলতে হেনরিয়েটার মনে হল, তার নিজের চোখেই বোধহয় দৃষ্টিহীনতা আশ্রয় নিয়েছে, চারিদিকে চোখ বুলিয়েও কিছুই তার নজরে আসছে না…

..এই সময় নিজেকে বড় ক্লান্ত, পীড়িত আর অসহায় মনে হল…

হঠাৎ করে বাসের মধ্যে যেন তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। রক্তমাংসের চোখে সে দেখতে পেল তারই সামনে বসে আছে তার নসিকা, অন্যমনস্ক ভাবেই সে বাসে উঠে পড়েছিল পা রেখেছিল–কোথায় যাবে তাও সে জানত না…এবারে স্পষ্ট তার নজরে এল…শিশুসুলভ ছোট একটি মুখ, আধ-খোলা ঠোঁট এবং চোখ–সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, অন্ধ, ঠিক যেমনটি হেনরিয়েটার বাসনা ছিল।

ঘন্টা বাজিয়ে বালিকা নেমে গেল, হেনরিয়েটা তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলল। হেনরিয়েটা এখন ধীর-শান্ত–এতদিনের দৌড়ঝাঁপ শেষ হয়েছে। প্রার্থিত জিনিষ আজ মিলে গেছে। বালিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, মনে কিছু কোরো না। তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি। ভাস্কর্য আমার পেশা, তোমার মাথাটা আমি আমার মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে বড় উদগ্রীব।

বালিকার ব্যবহার বড়ই মধুর এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্র সে ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ল। শিল্পীর কথায় আপনা থেকে গর্ব আর সন্দেহ এসে ঠাই করে নিল। আমতা-আমতা করে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখুন আপনার যদি সত্যি কোনো মডেল প্রয়োজন হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা উঠছে না…কিন্তু…আমি কোনোদিন এমন কাজ করিনি…।

ডোরিস স্যান্ডার্স একটু ইতস্তত করায় হেনরিয়েটা তাকে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে, তোমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণে পীড়াপীড়ি করবো।

নসিকা মঞ্চের ওপর বসে নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে বিভোর হয়ে নিজের মনে ভাবছে যে, তার রূপ তাহলে অমর হয়ে গেল। স্টুডিওতে কিন্তু বিন্দুমাত্র ভালো লাগেনি। তবু হেনরিয়েটার কাজকর্ম দেখে তার একটা কথাই মনে হল যে, একজন শিল্পী মনপ্রাণ ঢেলে তার রূপের সুষমা আহরণ করছে একটা মাটির পুতুলকে রূপ দেবার জন্য এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কি হতে পারে!

প্রকারান্তরে এটাই তো অমরত্ব লাভ।

টেবিলের ওপর মডেলের ঠিক পাশটিতে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চশমা জোড়া পড়ে আছে। চশমা ছাড়া সে এক-পাও চলতে পারে না, তাই সে যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করে। হয়তো এটাও তার একটা ফ্যাশন। অনেক সময় সে চেষ্টা করে দেখেছে–চশমা ছাড়া পথ চলতে পারে কিনা–কিন্তু চশমা ছাড়া সে একগজ দূরে থেকেও কিছু ঠাওর করতে পারে না। একথা সে নিজের মুখেই হেনরিয়েটার কাছে স্বীকার করেছে। হেনরিয়েটার এখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চোখের চাহনির মাধুর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে তার দৈহিক অপটুতা।

সময় এগিয়ে চলে, হেনরিয়েটা তার যন্ত্রপাতি রেখে দিয়ে হঠাৎ বাহু ছড়িয়ে উঠে পড়ল এবং এও বলল, ঠিক আছে, আমার কাজ হয়ে গেছে। আশা রাখি, তোমাকে খুব বেশি ক্লান্ত করিনি, নয় কি?

-না, না, মোটেই না। ধন্যবাদ মিঃ স্যাভারনেক, আমার তো বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী করে সমাপ্ত করে ফেললেন? সত্যি কি আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

হেনরিয়েটা শুধু হাসে। হাসিমাখা মুখেই বলে, না কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে যতটা কাজ ছিল তা হয়ে গেছে। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি–তবে আসল কাঠামো বানানো হয়ে গেছে।

বালিকা মঞ্চ থেকে নেমে এল, তার চশমা চোখে পরে নিল। চশমা মুখে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখের সরল সৌন্দর্য মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল এবং তার স্থানে এসে বিরাজমান হল সহজ সস্তা এক সুষমা।

ডোরিস স্যান্ডার্স মাটির মডেলের দিকে চোখ পড়তে হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে, ওঃ! এটা ঠিক আমার মতো হয়নি তো, তাই না?

হেনরিয়েটা হেসে ফেলে,-ওঃ, এটা তো ঠিক ছবি নয়!

সত্যিই মিল চোখে না পড়াটাই স্বাভাবিক। হেনরিয়েটার কাল্পনিক নসিকার মুখশ্রী সৃষ্টি করতে প্রাথমিক কাজ হিসেবে যে জিনিষগুলো প্রয়োজন ছিল, শুধু আবশ্যিক জিনিষগুলোই সে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর কাছ থেকে গ্রহণ করছে। এগুলো হল-চোখের বিন্যাস এবং চোয়ালের হাড়ের সঠিক অবস্থান। মাটির যে পুতুলটা তৈরি হচ্ছে–সেটা মোটেই ভোরিস স্যান্ডার্স নয়, –একটি অন্ধ বালিকা–যার সম্বন্ধে একটা কবিতা রচনা করা যেতে পারে।

ডোরিসের মতো এর ঠোঁট দুটোও ফাঁক করা–কিন্তু কথা বলার সময় অন্য ভাষার আশ্রয় নেবে এবং যে ভাবনা তারা ব্যক্ত করবে তাও ভোরিসের ভাবনা হবে না

মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনোটাই স্পষ্ট নয়, এই নসিকাকে কল্পনা করা যায় কিন্তু তাকে দেখা যায় না, সন্দেহের বশেই মিস স্যান্ডার্স বলে ওঠে, মডেলের আরও কিছু কাজ হলে হয়তো বেশ ভালোই দেখাবে…আমাকে আর কোনো প্রয়োজন লাগবে না তো?

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না ধন্যবাদ। সত্যিই তুমি চমৎকার। আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

ডোরিসের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে হেনরিয়েটা কালো কফি বানানোর জন্য পা পাড়াল। সে সত্যিই খুব ক্লান্ত-ক্লান্তির মধ্যে তার মনে আজ খুশির ঢেউ–তৃপ্তি ও শান্তির আনন্দ, তাই প্রাপ্তির সুখও আলাদা।

হেনরিয়েটা আপন মনেই কথা বলতে থাকে, আমি আবার রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠব। তার চিন্তা এবার স্থান পরিবর্তন করে জনকে আশ্রয় করল। মনের কথা মনে হতেই তার গণ্ডদেশে এক দ্যুতি খেলে গেল। হৃদয়ের আস্ফালন তার সাহসিকতাকে আকাশচুম্বী করে তুলল। সে ভাবল, কাল আমি হলোতে যাচ্ছি–সেখানে গেলেই জনের দেখা পাব..

পেটে তিন-তিনবার গরম কফি পড়তেই হেনরিয়েটার মধ্যে অনেক শক্তি ফিরে এল। ডিভানের ওপর চিত হয়ে শুয়ে নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা ও সতেজ করে নিল।

রক্তমাংসের মানুষ হওয়া বোধহয় সবদিক থেকেই ভালো। অকারণে উদ্বাস্তুর মতো পথে পথে ছায়া আর মায়ার পেছনে ছোটাছুটি করা মোটেই ভালো নয়। নিছক অপ্রাপ্তির দুঃখে দগ্ধ হওয়ার মতো অশান্তি বোধহয় আর কিছুতে নেই। আসলে না পাওয়ার বিড়ম্বনার চেয়ে প্রার্থিত বস্তু কি, তা সঠিক না জানাই সব চেয়ে বড় দুঃখ এবং এই দুঃখই মানুষকে আর স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, সব কিছু ভুলে তাকে পাগল করে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। কঠোর পরিশ্রম কে না করতে পারে, পরিশ্রমের ভয়ে কেউ বা পিছু হাটে। কিন্তু পরিশ্রম করেও কি সব সময় ইঙ্গিত বস্তুর দর্শন মেলে?

হেনরিয়েটা কাপ খালি করে নসিকার নিকটে এসে দাঁড়াল। অপলক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাকালীন নিজের অজান্তে ভ্র-কুঁচকে সে বলে ওঠে, না ঠিক হয়নি; যেমনটি বাসনা ছিল, এখনও ঠিক যথাযথ হয়নি। তবে কি কিছু ভূল হল? দৃষ্টিহীন চোখ। এটাই তো চেয়েছিলাম। এর সুষমার কোনো বর্ণনাই করা যায় না। যে চোখের দৃষ্টিশক্তি আছে তা এত সুন্দর নয়, মধুরও নয়। দৃষ্টিহীন চোখ না হলে কী ভালো ছিল? কিন্তু অন্ধ চোখই তো পারে মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করতে, বিভিন্ন পন্থায় কথা বলাতে পারে, নানান ভাষায়! সে এটাই চেয়েছিল, এর জন্যই সে অধীর হয়ে পথে পথে ঘুরে ফিরেছে। এখন নাগালের মধ্যে পেয়েও মনে এত কুণ্ঠা, কেন এই অতৃপ্তি? না, অতৃপ্তি নয়। তার ভাগ্যে যা জুটেছে এটাই তার কাম্য ছিল, ভাগ্যদেবী প্রসন্ন থাকায় হয়তো পাওয়ার অতিরিক্তই সে পেয়েছে। এই অতিরিক্ত পাওয়ার কথা সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কাঠামোটা কিন্তু ভালোই হয়েছে, ভালো শুধু নয়, খুব ভালো…কাঠামোটা মোটামুটি ভালোই কিন্তু নির্দেশ কোথা থেকে এল? কে হেনরিয়েটাকে নসিকা গড়ার প্রেরণা জুগিয়েছে? না, কেউই না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে কানের কাছে কেউ গুনগুন করেছে; তবে সে নিঃসন্দেহে কোনো ঈর্ষাপ্রবণ প্রকৃতির লোক…কিন্তু হেনরিয়েটা তো কারো কথা শোনেনি, শুনে থাকলেও সেই মতো কাজও সে করেনি…কিন্তু হেনরিয়েটা কাজ না করলেও তার আঙুলগুলো হয়তো মাটির তালে তালে কাজ করে বেরিয়েছে… নিজের অজান্তেই আঙুলগুলো বোধহয় মডেল বানিয়ে ফেলেছে… কিন্তু সম্পূর্ণ এখনও হয়নি… হয়তো আর কোনোদিন হবে না, অসমাপ্তই থেকে যাবে…হেনরিয়েটার মন বলছে নসিকা গড়া তার বোধহয় কোনোদিন শেষ হবে না…ভাবল, এখন যদি না করি তবে আর কোনোদিন পেরে উঠব না, কাল দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে হয়তো অন্য চিন্তা ঘিরে ধরবে…নসিকার ছবি মন থেকে হয়তো চিরতরে মুছে যাবে, নয়তো অন্যরূপে সামনে হাজির হবে… হেনরিয়েটা সময় নষ্ট না করে মাটি নিয়ে কাজে লেগে পড়ল-মাটির কাজ আর বেশি বাকিও নেই, তবে তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই…হেনরিয়েটা স্টুডিওতে তার পায়চারি শুরু করে দিল…

হঠাৎ ‘পূজারিনী’ পুতুলটির কাছে এসে দাঁড়াল..এটা মনোমতো হয়েছে, কোনো খুঁত নেই…হ্যাঁ, এটা দেখলে মন ভরে যায়। মুখে লেগে আছে বিনীত আত্মনিবেদনের ভাব, ঘাড় এবং মাংসপেশীতে শক্তি, নুয়ে পড়া কাঁধ, ঈষৎ উপরের দিকে তোলা মুখ, বৈশিষ্ট্যহীন মুখশ্রী– সব মিলিয়ে সর্বগুণে গুণান্বিতা এই মডেল, এককথায় উপযুক্ত মডেল। চমৎকার হয়েছে। হেনরিয়েটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, জনের মনে রাগ নামক ভীষণ বস্তুটি যদি না থাকত, সে যদি অন্যের মতো শান্ত খোশমেজাজী হতো!

নসিকার কাছে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে হেনরিয়েটা। দু’চোখের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে। না, কোথাও কিছু বাকি নেই–সবই ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এইভাবে সোমবার কি মঙ্গলবার পর্যন্ত রেখে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই কারণ তার আগে যখন কিছু কাজ করা সম্ভব হবে না। ভিজে একটা কাপড় দিয়ে নসিকার সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখল। ধৈর্য ধরে এগোতে হবে–তাই কিছুদিন বাদে। তার মধ্যে তিনটি মধুর দিনও এসে যাবে–এ তিনটে দিন সে কাটাতে চায় লুসি, হেনরি এবং মিডগের সান্নিধ্যে, আর সঙ্গে থাকবে জন।

শরীরের প্রত্যেক কটা মাংসপেশী সঙ্কুচিত আর প্রসারিত করে এক মোচড়ে শরীরটাকে টেনে টান টান করে উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে তার অনুভূতি হল, সে আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত। গরম জলে যতটা তাড়াতাড়ি স্নানপর্ব সেরে শুতে গেল সে।

শয্যা থেকে স্কাইলাইটের মধ্যে দিয়ে সে নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল…সুদূর আকাশ জুড়ে কত-না অগুন্তি তারা…একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল কতগুলো তারা বিশেষ পরিচিত, আর কয়েকটা শুধু নতুন আগন্তুক…হয়তো তারা-কাশে সবগুলোই তারা তার পরিচিত, বা সকলেই হয়তো অপরিচিতের দল…সকলেই হয়তো অনাহুত আগন্তুক অথবা সকলেই চিরটাকাল ধরে আকাশ জুড়ে তার পরিক্রমা অব্যাহত রেখেছে, মহাশূন্যে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।

হেনরিয়েটা ঘুমোত চাইছে, কিন্তু ঘুম ধরা দিল না…মনের অর্গল বোধহয় ভোলা আছে, তাই চিন্তাগুলোও একে একে মুক্ত হয়ে চলে এসেছে, বাইরে থেকে আসছে গাড়ি চলার শব্দ, হর্ন, ভাঙা গলার বিদীর্ণ চিৎকার, উচ্চকণ্ঠে হাসি…এই মুহূর্তে গাড়ির শব্দটা শোনার পর তার মনে হতে লাগল বাঘ গর্জন করছে..হলদে কালো ডোরাকাটা বাঘ…রঙবাহারী পাতার মতো রঙের…আলোছায়া…ঘন জঙ্গল…নদীর তীর…গ্রীষ্মপ্রধান দেশের চওড়া নদী এসে মিশেছে নীল বিশাল সমুদ্রে…জাহাজে মাত্র দুটি প্রাণী…হেনরিয়েটা আর জন…দুজনেই ডেকের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে…নীল সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ এগিয়ে চলেছে কোনো এক অজানা দেশের সন্ধানে…জাহাজের ডাইনিং রুমে মুখোমুখি বসে জন ও হেনরিয়েটা ভোজন পর্ব শেষ করতে ব্যস্ত..হঠাৎ জন যেন রেগে ওঠে, ডাইনিং স্যালুনের নিচে নীল সমুদ্র, কিন্তু রাগ তাকে স্পর্শ করতে পারে না–শুধু হাসে…হেসে হেসে কোথায় কোন্ অনির্দিষ্টের পথে চলে যায় সে…জন ও হেনরিয়েটা এখন জাহাজের সুন্দর একটি সুস্থিত কক্ষে..দুজনেই আবার একই সঙ্গে লন্ডন শহরে…দু’জনে একটি ছোট্ট গাড়ির মধ্যে…পাশাপাশি…হেনরিয়েটার হাতে স্টিয়ারিং ধরা, জন তার পাশটিতে বসে…লন্ডন ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে তারা চলেছে গ্রাম্য পরিবেশের উদ্দেশ্যে..সুন্দর সুন্দর কত ঝর্ণা, পাহাড়ি নদী, লতাগুল্ম, গাছ, ফুল, ফলের বাগান…তারা যাচ্ছে কোথায়?…আবার…হলো…লুসি, হেনরি…জন…জন…জন…হেনরিয়েটার চোখে ঘুম নেমে এসেছে সুখের স্বপ্নে সে এখন বিভোর…তার অবচেতন মনে ঘুরে ফিরে একটি মাত্র ব্যক্তিত্ব ধরা দিচ্ছে–একজন পুরুষজন।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়–স্বপ্নও কোথাও বিলীন হয়ে যায়…অপরাধীর মুখে হেনরিয়েটা বাস্তব জগতে ফিরে আসে–কি যেন করা হয়নি, কোথায় যেন একটা অন্যায় করা হয়েছে, কি যেন করা উচিত ছিল, কিন্তু সে করেনি!

নসিকা?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেনরিয়েটা বিছানা ত্যাগ করে, আললাগুলো জ্বেলে দেয়, নসিকার কাছটিতে এসে দাঁড়ায়, ঢাকা তুলে ফেলে–জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে থাকে।

নসিকা নয়–ডোরিস স্যান্ডার্স।

হেনরিয়েটা কোথায় যেন একটা অজানা ব্যথা অনুভব করে, নিজের মনকে নিজেই বোঝাবার চেষ্টা করে–আমি ভুলটা সংশোধন করে নিতে পারি, শুধরে নিতে পারি আমার করা ভুলটা। আপন মনেই বলে যেতে থাকে, মূর্খ তুমি কী জান তোমার কী করণীয়।

আগেই এখুনি সেরে ফেলতে হবে–কাল আর করার সাহস কুলোবে না। এটা যেন ঠিক নিজের রক্তমাংস ধ্বংস করার পথে। এতেই বড় আঘাত লাগে-হ্যাঁ, এটাই মনে বড় আঘাত হানে।

হেনরিয়েটার মনে হল, বেড়ালজাতটাও বোধহয় এমনটাই অনুভব করে। তাদের সদ্যোজাত কোনো ছানার মধ্যে যখন কোনো খুঁত নজরে আসে তখন তারা ছানাটিকে বাঁচিয়ে রাখে না এবং হত্যা করার ঠিক পূর্বে তাদের মনেও হয়তো যেন চিন্তাধারার উদয় হয়।

ঘন ঘন দ্রুতগতিতে নিশ্বাস পড়তে থাকে হেনরিয়েটার। মাটির মডেলটাকে সে ধরে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে কাঠামো থেকে মাটি তুলে নিয়ে বড় মাপের একটা তাল মাটিতে পরিণত করে। কাদামাখা হাতের দিকে সে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, শারীরিক আর মানসিক দিক দিয়ে উত্তেজনা তার মনকে বড় নাড়া দিচ্ছে।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলে। একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা সঙ্গী করে সে শুতে চলল। বিষণ্ণ মনে সে ভাবতে থাকে, নসিকা এই পৃথিবীতে এসেছিল অল্প কিছুদিনের জন্য, কিন্তু রোগে তার অকালমৃত্যু ডেকে আনে। অদ্ভুত সব ভাবনা-চিন্তা, মানুষ টেরও পায় না, তার নিজের অজ্ঞাতে কখন জেগে ওঠে আবার বিলীন হয়ে যায়।

কারুর কথাই সে কানে ঢোকায়নি–তবু নিজের অজান্তেই ডোরিসের ঈর্ষান্বিত গুঞ্জন বা মন–এই দুটি বস্তু বোধহয় হেনরিয়েটার কানের মধ্যে দিয়ে বা মনের মধ্যে দিয়ে হেনরিয়েটার আঙুলগুলোকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাই নসিকা–ডোরিস হয়ে উঠতে পেরেছিল।

স্বপ্নবিষ্টের মায়ায় বিভোর হয়ে হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, যাকে মারণ নামে সম্বোধন করা হয়, তবে কি এটা তাই?

যাকে আমরা ব্যক্তিত্ব বলে থাকি? তা কি কোনো ব্যক্তি বিশেষের চিন্তার গঠন। কার চিন্তার? ঈশ্বরের।

পিয়ার গিন্টের চিন্তাধারা কি একেই বলে? বোম প্রস্তুতকারীর হাতার মধ্যে ফিরে যাওয়া। আমি কোথায়? স্বয়ং আমি? সম্পূর্ণ মানুষটা? প্রকৃত মানুষটা? আমার তে ঈশ্বরের মার্কা কোথায়?

জন কি এভাবে অনুভব করেছিল? সেই রাতে সে এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল–এইরূপ হতাশ হয়ে পড়েছিল। রিজওয়ের ব্যাধি–সেই বইগুলোর কোনোটাতেই উল্লেখ করেনি রিজওয়ে কে?

মুর্খ, সে ভেবে নিল, সে জানবে…রিজওয়ের ব্যাধি..জন।..

.

০৩.

 ডাক্তার জন ক্রিস্টো তার রোগী দেখার ঘরে বসে সকালের সর্বশেষ রোগীর আগের রোগীটিকে দেখা শেষ করলো। তার চোখমুখ এখন সহানুভূতি ও উৎসাহব্যঞ্জনায় ভরপুর। রোগের খুঁটিনাটি জানার সময় সে বারেবারে মাথা নাড়ছিল এবং মাঝে মাঝে নির্দেশ প্রদানও করছিল।

প্রশ্নোত্তরের পর্ব সমাধা হতেই দেখা গেল, রোগীর মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যিই বিস্ময়কর! রোগীর প্রতিভার প্রকৃত দরদ এবং যথার্থ নিরাময় করার উদ্দেশ্যে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা অভূতপূর্ব। তার সঙ্গে কথা বলেও অনেক রোগীরা নিজেদের হালকা বোধ করে এবং উপকৃত হয় ও শরীরে পুনরায় শক্তিও পেয়ে যায়।

জন ক্রিস্টো একখানা কাগজ নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লেখার কাজ শুরু করে দেয়। রেচক ওষুধের দরকার, সেই আমেরিকার সোফেন মোড়কে ফিকে গোলাপী রঙের চিত্তাকর্ষক ওষুধটাই ভালো ফল দেবে। সংগ্রহ করতে হলে ওয়ার্ডার স্ট্রিটের সেই ছোট্ট দোকানে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু মূল্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে, আর সব দোকানে তা মেলা ভার। আশা করা যায় দু’একমাস এতেই ভালো করে চলে যাবে এবং উপকারও ভালো হবে, পরে না হয় অন্য কিছু ভেবে ঠিক করা যাবে। এর চাইতে আর বেশি কিছু তার জন্য করা সম্ভবপরও নয়, শারীরিক গঠন খারাপ হওয়ার দরুন কিছু করাও যাবে না এবং দাঁত গজানোর জন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যাবে না। বুড়িমা ক্যাবট্রির মতো অসম্ভব অবস্থা নয়।…

একঘেয়ে সকাল, আর্থিক সুবিধা এখন উন্নতির দিকে–কিন্তু ঐ পর্যন্তই, আর কিছুই নয়। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রুণ স্ত্রীলোক এবং তাদের নিত্য নতুন ব্যাধি; তাকে শরীর আর মন দুয়ের দিক থেকে অবসন্ন করে ফেলেছে।

কিছু কথা বলা বা উপশম, এছাড়া আর কিছু নয়। এমন অনেক সময় আসে যখন তার বড় অবাক লাগে, এইটুকুই কি যথেষ্ট। তখনই তার মনে পড়ে যায় ক্রিস্টোফার হাসপাতালের মার্গারেট রাসেল ওয়ার্ডের শয্যা শ্রেণী এবং মিসেস ক্যাবট্রির দন্তহীন মুখের বিগলিত হাসি।

ডাক্তার ক্রিস্টো এবং রোগিণী পরস্পর পরস্পরের কাছে পরিচিত। পাশের শয্যার থলথলে চেহারার খোসা ছাড়ানো স্ত্রীলোকটির পর্যায়ে তাকে ফেলা যায়। সে একজন যোদ্ধী। সে তার দিকেই ছিল, বাঁচার জন্য সে অধীর ছিল–একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষে জানা সম্ভব কেন তার মধ্যে বাঁচার প্রবণতা ছিল। আমরা অবশ্য তার জঘন্য বেঁচে থাকার দুর্দশা দেখেই একথা জানতে বাধ্য হচ্ছি। সে এক নোংরা বস্তিতে বাস করত, মাতাল স্বামী আর এক দঙ্গল অবাধ্য সন্তান নিয়েই ছিল তার সংসার। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে সে বাধ্য থাকত। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অসংখ্য গৃহস্থ বাড়িতে, অনেক খেটে খেটে বেড়ায় অফিস বাড়িতে, বিরতিহীন হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম,অমানুষিক কষ্ট, আনন্দ লেশহীন জীবনই সে বেছে নিয়েছিল তবু সে বাঁচতে চায়, প্রাণভরে জীবন উপভোগ করতে চায়, জন ক্রিস্টো যেমন ভাবে জীবন উপভোগ করছে। জীবনের অবস্থা কিন্তু তারা উপভোগ করতে চায় না, শুধু জীবনটাই উপভোগ করে ক্ষান্ত হয়

বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শুধু রঙ্গকৌতুক, অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা। অত্যন্ত অদ্ভুত ব্যাপার–তার যথাযথ ব্যাখ্যা বোধ হয় কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। মনে মনে ক্রিস্টো ভাবে, হেনরিয়েটার সঙ্গে সে এ বিষয়ে কথা বলতে চায়।

ডাক্তার রোগিণীকে দরজা পর্যন্ত ছেড়ে আসার জন্য উঠে পড়ল। উষ্ণ সহৃদয়তার সঙ্গে তার হাত তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে, বন্ধুর মতো উৎসাহ দিতে দিতে এগিয়ে চলল। তার কণ্ঠস্বর থেকে বর্ষিত হচ্ছিল সহানুভূতি এবং উৎসাহ। রোগিণী যেন তার ব্যাধির যন্ত্রণা ভুলে গেছে। তাকে দেখে অতিশয় সুখী ও সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। ডাক্তার ক্রিস্টো এমনই একজন যত্নপরায়ণ চিকিৎসক।

দরজা বন্ধ হবার যতক্ষণ দেরি, দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র ক্রিস্টোর মন থেকে তার অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। দরজার আড়ালে উপস্থিত থাকলেও ক্রিস্টো তার অস্তিত্ব টের পায় না। মুখ বুজে সে তার কর্তব্য করে যায়। সবই যেন গতানুগতিক। তার মনোজগতে এ বিষয়ে যদিও কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না, তবু তার শক্তি ক্ষয়ের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।

আরোগ্যকারীর স্বতঃস্ফূর্ত ডাকে সে সাড়া না দিয়ে পারে না। আবার নিঃশেষিত শক্তিও অনুভব করে। সে মনে মনে এও অনুভব করে যে, সে বড় ক্লান্ত।

আর একটি মাত্র রোগী দেখা শেষ হলেই সপ্তাহান্তের স্থান পরিষ্কার হয়ে যায়। কৃতজ্ঞ চিত্তে তার মনে এই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। লাল এবং কটা রঙ মেশানো সোনালি পাতা, শরতের নরম সিক্ত গন্ধ-বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাদাবানল–সবকিছু মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ছুটির আমেজ গৃহকত্রী লুসির কথা মনে পড়তেই এক অজানা খুশীর হিল্লোল তার সারা মনে প্রবাহিত হয়ে যায়। অতিথিপরায়ণা এবং অকপট মনের এমন স্ত্রীলোকের সন্ধান সংখ্যায় খুব কমই। মেলে। অনেক সময় তিনি এমন ইন্দ্রজাল রচনা করেন যে, তাকে আলেয়া বলে ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। হেনরি এবং লুসির মতো লোকের আতিথ্য গ্রহণ বোধহয় খুব কম জনের ভাগ্যেই জোটে, অর্থাৎ এরকম আতিথেয়তা পাওয়া সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয়। ইংলন্ডে তারা ছাড়া আর অন্য কারো আতিথ্য গ্রহণে মনের দিক থেকে সাড়া পায় না ক্রিস্টো। তাছাড়া হলোর মতো সুদৃশ্য বাড়িও তার নজরে আসে না। রবিবারে সে বনের মধ্যে প্রমোদভ্রমণে সঙ্গী হিসেবে হেনরিয়েটাকে কাছে পাবে-কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো পর্বতের সানুদেশে স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযোগ তারা পেয়ে যাবে।

হেনরিয়েটার সঙ্গে বেড়াবার কথা তার ভুলেও স্মরণে আসবে না, জগত জুড়ে এত ব্যাধি এত যন্ত্রণা! ডাঃ ক্রিস্টো মনে মনে ভাবে, হেনরিয়েটার সাহচর্যে বোধহয় সব কদর্যতা দূরীভূত হয়ে যায়। সে যেন তাকে ঘাড়ে নতুন কোনো দুঃখের বোঝা চাপাতে চায় না। তার মোহময়ী আবেষ্টনী সে যে কোন মহিমায় সৃষ্টি করে। ভাবতেও সত্যি অবাক লাগে।

তার একজন মাত্র রুগী দেখা বাকি। কিছুক্ষণ পরেই সে টেবিলের ঘণ্টা বাজাবে। যদিও তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। উপরে খাবারের ঘরে লাঞ্চ প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে, জার্দা এবং তার সন্তানেরা তার জন্যই পথ চেয়ে বসে আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে হাজির হতে হবে।

তবু সে একইভাবে বসে আছে। নড়েচড়ে বসার শক্তি সে হারিয়েছে, আজ সে ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।

কিছুদিন ধরেই তাকে এক ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে। যার ফলস্বরূপ তার মেজাজটাও দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। অত্যাধিক পরিশ্রম বা মনের অশান্তি বা অবসাদ এর কারণ হলেও হতে পারে। বেচারী জার্দা, সে তো তার সঙ্গে মানিয়ে নেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তার স্বভাব যদি বিনীত নষস্বভাবের না হতো এবং নিজের দোষ স্বীকার করে না নিত তবে হয়তো একটা কারণ মিলে যেত। এমন একটা সময় ছিল, যখন জার্দা যা কিছু বলতো ক্রিস্টো তাতেই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠতো, এবং সে মনে করতো যে, জার্দা যুক্তি করেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য এরকম কথা বলছে, তার কথা বলার ধরনই ঐরকম, লোককে ক্ষেপিয়ে তোলা। তার ধৈর্যশক্তি, তার স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন ভাব, তার নিজের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ–ক্রিস্টোর রাগের মাত্রাকে আরও দ্বিগুণ করে ফেলত। জার্দা কখনো প্রতিবাদ করেনি, নিজের জেদ ধরে সে বসে থাকতো তা নয় কিন্তু নিজের কথার ধরনধারণ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করত না।

কিন্তু অদ্ভুত লাগে তখনই যখন দেখা যায় যে, জার্দার যে গুণগুলো ক্রিস্টোকে ক্ষেপিয়ে তুলত, সেই গুণগুলো সে হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়, যে জিনিষে ক্রিস্টোর রোগ হয় তা হলো হেনরিয়েটার একপ্রসঙ্গ থেকে অন্যপ্রসঙ্গে যাওয়ার সাধুতা।

একদিন ক্রিস্টো তাকে কথাচ্ছলে বলেছিল, আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী তুমি। হেনরিয়েটা বলেছিলেন, বোধহয় তাই হবে।

ক্রিস্টো–তুমি সদাই লোকের মন বুঝে কথা বল।

হেনরিয়েটা–সেটাই আমার ইচ্ছে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

 ক্রিস্টো–সত্য বলার থেকেও কী প্রয়োজনীয়?

হেনরিয়েটা-প্রয়োজনটা সত্যই একটু বেশি।

 ক্রিস্টো–তাহলে তুমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে আমার কাছে মিথ্যে বুলি আওড়াও না কেন?

হেনরিয়েটা–তুমি আমাকে এমনটি করতে বল?

ক্রিস্টো-হা।

হেনরিয়েটা–সত্যি আমি অনুতপ্ত, জন, আমি পারি না।

ক্রিস্টো-তোমার অনেক সময় জানা উচিত, আমি কি বলতে চাই। না, হেনরিয়েটার কথা আর নয়। সে আজ বিকেলের দিকে হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এখানকার যা কাজ আছে তা তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে নিতে হবে। দশভাগের এক ভাগ আসল রোগ, অবশিষ্টটা বিষাদ ব্যাধি বা চিত্তোন্মাদনা–একপ্রকার স্নায়বিক রোগ। নড়াচড়ার নামগন্ধও নেই, চুপচাপ স্থবিরের মতো বসে রইল, রোগী দেখার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও সে করল না। ডাক্তার জন ক্রিস্টো ক্লান্ত অত্যন্ত ক্লান্ত। তার মনে হল সে বহুদিন ধরেই ক্লান্ত। কোনো একটা জিনিসের অভাব ঘটেছে তার শরীরে, খুব অভাব। হঠাৎ সে মনের তাগিদ অনুভব করল, তার বাড়ি যাওয়ার বাসনা জেগেছে।

তার খুব অবাক লাগল, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল এই চিন্তা? এর অর্থই বা কি? বাড়ি? কোনো দিন তার বাড়ি ছিল না। তার মা-বাবা ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, সে বড় হয়েছে কখনো মাসির স্নেহে কখনো কাকার কাছে–একটা ছুটি সে একজনের কাছেই কাটাত। হার্লি স্ট্রিটের বাড়িটা বোধহয় তার জীবনের প্রথম স্থায়ী গৃহকোণ। কিন্তু এই গৃহকোণকে সে কোনোদিন বাড়ি বলে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পেরেছে কি? সে মাথা নাড়ে। না, কোনো দিন ভাবতেও পারেনি। তবে? এই চিন্তা তার মনে উদয় হলো কী করে? কেনই বা হল? কোথা থেকে এল? চিকিৎসকের উৎসুক মনে এই চিন্তা বার বার ঘুরপাক খেতে লাগল

‘আমি বাড়ি যেতে চাই।

কারণ খুঁজলে কিছু একটার সন্ধান নিশ্চয়ই মিলবে–কোনো প্রচ্ছদপট অবশ্যই থাকবে।

খুব স্পষ্ট, সে তার মানস চক্ষে দেখতে পেল অগভীর নীল ভূমধ্যসাগর, সারিবদ্ধ পাম গাছ, কন্টকময় নাশপাতি আর ক্যাক্টাসের সমারোহ। কল্পনার জগৎ থেকে তার নাকে আসছে গ্রীষ্মের গন্ধ এবং সমুদ্রসৈকতে সূর্যের চড়া রোদে শুয়ে শুয়েই অনুভব করছে জলের শীতলতা। সল মিগুয়েল।

হঠাৎ যেন চমকে ওঠে–একটু যেন বিব্রতও বোধ করে। অনেক বছর হয়ে গেল সল মিগুয়েলের কথা তার স্মরণে আসেনি। সে আর সেখানে ফিরে যেতে চায় না। সেখানকার সবকিছুই এখন তার জীবনের অতীত অধ্যায়।

সে আজ বারো-চোদ্দ কী বছর পনেরো আগের কথা। সে ঠিক কাজই করেছে। তার কাছে তার বিচার অভ্রান্ত! সে ভেরোনিকার প্রেমে পাগল হয়ে উঠেছিল। ভেরোনিকা তার দেহমন জুড়ে বসেছিল। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না এবং তা সে লুকোনোর চেষ্টাও করতো না। ভেরোনিকা একবার যা চাইত তা সে জোর করে হলেও আদায় করে নিত। কেবল জনকেই সে জোর করে নিজের করতে পারেনি। কোনো ভাবে সে মুক্তি পেয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। সোজা কথায় প্রেমের ব্যাপারে সে তার কাছে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সত্যি কথা, সে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ভেরোনিকা সে ব্যাপারে রাজী ছিল না। ভেরোনিকা নিজের মতো করে তার জীবন কাটাতে চেয়েছিল এবং তার জীবনে জনের স্থান ছিল অতিরিক্তের তালিকায়। সে যখন জনকে তার সঙ্গে হলিউডে যাবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল, জন তার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় সে অবাক হয়েছিল। ক্ষুণ্ণ মনেই সে বলেছিল, তুমি যদি সত্যিকারের একজন ডাক্তার হতে চাও, তুমি আমেরিকা থেকেও এই ডিগ্রি পেতে পার, তবে তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তোমার কাছে আছে তাই যথেষ্ট এবং আমিও প্রচুর উপার্জন করব।

জন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠেছিল, আমি যে পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি সেই পেশার বিষয়ে আমি যথেষ্ট উৎসাহী এবং মনোযোগী। র‍্যাড়লের সঙ্গে কাজ করার জন্যই আমি যাচ্ছি।

তার কণ্ঠস্বর-উৎসাহী-উগ্রীব তরুণের কণ্ঠস্বর–অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, গুরুগম্ভীর এবং নির্ভীক। ভেরোনিকার কণ্ঠ দিয়ে নিশ্বাস টানার শব্দ বেরিয়ে আসে। বলে, সেই নস্য-টানা বুড়োটা? জন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, সেই নস্য-টানা বুড়ো লোকটা প্র্যাটু তার রোগ নিয়েই তার মূল্যবান গবেষণা করছে।

বাধা প্রদান করে সে বলে ওঠে, পাটের রোগ নিয়ে কারা এত মাথা ঘামাচ্ছে– ক্যালিফোর্নিয়ার জলহাওয়া কি সত্যি চমৎকার! জগৎটাকে দেখা কি কৌতুকের। এই জন্যই তোমাকে আমার প্রয়োজন জন!

প্রত্যুত্তরে জন বলেছিল, ভেরোনিকা, তুমি হলিউডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমাকে বিবাহ কর এবং চল, আমরা বরং লন্ডনে গিয়ে বসবাস করি। জনের এই প্রস্তাব শুনে ভেরোনিকা মনে মনে হেসেছিল তাই বলেছিল যে, হলিউডে যাবেই এবং জন যখন তাকে মন দিয়ে বসে আছে, বিবাহ তাদের কোনো কারণেই আটকাবে না। নিজের রূপ এবং শক্তি সম্বন্ধে তার খুব অহংকার ছিল।

জনের কাছে তখন একটা রাস্তা খোলা ছিল, বাগদান সে ভেঙে দিল।

 সে যথেষ্ট ভুগেছে কিন্তু সে, যে কাজ করেছে তাতে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয়ই মেলে। সে আবার লন্ডনে ফিরে এল এবং র‍্যাড়লের সঙ্গে কাজও শুরু করে দিল। একবছর বাদে জাদার সঙ্গে তার বিবাহ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। সব দিক থেকে বিচার করলে জার্দা ভেরোনিকার থেকে একেবারে পৃথক ছিল…

দরজা খুলে গেল এবং সেক্রেটারি বেরিল ভেতরে প্রবেশ করল।

মিসেস ফরেস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ আপনার এখনও বাকি।

সংক্ষেপে ছোট্ট উত্তর দিল সে, আমি জানি।

সেক্রেটারি বলে উঠল, আমি ভাবলাম, আপনার হয়তো মনে নেই।

ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। ক্রিস্টোর দৃষ্টিও নিঃশব্দে নিষ্ক্রমণ অনুসরণ করলো। বেরিল একটা সাধারণ মেয়ে, কিন্তু খুবই কর্মঠ। ছ’বছর ধরে সে এখানে কাজ করে যাচ্ছে, এর মধ্যে এমন একটা দিনও যায়নি যেখানে একটা ভুলও হয়েছে। চঞ্চলতা, উদ্বেগ, বা ব্যস্ততা এর কোনোটাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার কালো কেশ, মেটে মেটে রঙ এবং দৃঢ়চেতা চিবুক।

যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন চশমার সাহায্যে সে তাকে এবং পুরো জগৎটাকে সমান নিরাসক্ত ভাবে দেখতে পায়।

সে খুব সাধারণ, সৎ স্বভাবের সেক্রেটারি চেয়েছিল এবং সে তার বরাত জোরে পেয়েও গেছে। কিন্তু জন ক্রিস্টো মাঝে মাঝে অকারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মঞ্চ এবং কাহিনীর সব নিয়মে বেরি তার মা প্রভুর কাছে নিরাশ মন নিয়েই অনুগতশীল, কিন্তু সে জানে যে সে বেরিলকে কখনোই মূল্যহীন ভাবে না। কোনো ভক্তি বা আত্মোৎসর্গ নয়–বেরিল তাকে নিশ্চয়ই ভ্রমণশীল এক মানুষ রূপেই গণ্য করে। সে তার ব্যক্তিত্বে অভিভূত বা মাধুর্যে বিগলিত হবার পাত্র নয়। অনেক সময় তার মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধে যে, বেরিল হয়তো তাকে পছন্দ করে না।

জন একদিন নিজের কানে বেরিলকে তার বন্ধুকে টেলিফোনে বলতে শুনেছে, না, আমি এটা ভাবি না যে, তিনি আগের থেকেও আরও বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠেছেন বরং চিন্তারহিত ও অবিবেচক হিসেবেই তিনি জ্ঞাত।

জন ক্রিস্টোর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, বেরিল ও তার বন্ধুর আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে এবং এই কথা শোনা মাত্র পুরো চব্বিশ ঘন্টা সে ক্রুদ্ধ ছিল।

জার্দার অসংলগ্ন ভঙ্গীপনা যেমন জনকে স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, তেমনি বেরিলের হৃদয়হীন মূল্যায়নও তাকে সহজেই রাগিয়ে দেয়। বেরিলের ধারণা যে, প্রায় সব ব্যাপারেই জন ক্ষেপে যায়…

কোনো একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম? হয়তো তাই। না, সেটা নেহাত ঐ অজুহাত মাত্র। অধৈর্য, কাজে বিরক্তি, হঠাৎ রেগে ওঠা–সবকিছুর মূলে একটা না-একটা নিশ্চয়ই থাকবে। সে ভাবে এভাবে চলতে পারে না, আমি এভাবে থাকতে পারি না! আমার কী হয়েছে? আমি যদি পালিয়ে যাই..

আবার সেই এক চিন্তা–অন্ধ আবেগ আর মুক্তির পথের সন্ধানে ঘুরে ফিরছে–পালিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসছে!

আমি বাড়ি যেতে চাই…জাহান্নামে যা সব। ৪০৪, হার্লি স্ট্রিটের বাড়ি আমার!

ওয়েটিং রুমে চুপচাপ বসেছিলেন মিসেস ফরেস্টার। বিরক্তিকর স্ত্রীলোক। অত্যধিক অর্থের অধিকারিণী এবং নিজের ব্যাধি সম্বন্ধে চিন্তা করার অফুরন্ত সময় তার হাতে। কে যেন তাকে বলেছিল, ধনী রোগীরাই তোমাকে আরও ক্লান্ত করে তুলবে, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিও। তারা সদাই চিন্তা করবে এবং এটাই দেখাতে চাইবে যে, তারা পীড়িত, কিন্তু গরীব লোকেরা তোমার কাছে তখনই হাজির হবে যখন তারা সত্যি-সত্যিই কোনো রোগের শিকার হবে। একমাত্র ধনী লোকেরাই বিনা কারণে ডাক্তারখানায় এসে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ মিসেস পিয়ারস্টক পাঁচটি বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রতিসপ্তাহে উপস্থিত হয় এবং পিঠের, বুকের, ঘাড়ের, সর্দি, কাশির, হজমের, মাথা ঠাণ্ডা রাখার, হাত-পা কন্ করার সবরকম ব্যাধির কথা ভেবে সব ওষুধ নিয়ে থাকে। সেবারে বয়সে তরুণ এক ডাক্তার তাকে সাদা রঙের ওষুধ দিয়েছিল, ভদ্রমহিলা ওষুধের রঙ দেখামাত্র বলে ওঠে, চোদ্দ বছর হয়ে গেল আমি বাদামী রঙের ওষুধ ব্যবহার করছি এবং তাতে একটু উপকারও হয়, কিন্তু এ সাদা ওষুধে আমার কোনো কাজ হবে না। আমাকে বাদামী রঙের ওষুধ দাও।

ওতেই…

অথচ ভদ্রমহিলার কোনো ব্যাধি নেই, শরীরস্বাস্থ্যও বেশ ভালো। কণ্ঠস্বর ঘন্টার মতো, সারা দেহে তার কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, তবু মুখে একটাই বুলি লেগে আছে, রোগের জ্বালা আর সে সহ্য করতে পারছে না।

হটেনহ্যামের মিসেস পিয়ারস্টক এবং পার্ক লেন কোর্টের মিসেস ফরেস্টার একই প্রকৃতির স্ত্রীলোক। তারা যেন পরস্পর পরস্পরের সহোদরা। অর্থ আর সময়ের কোনো হিসেব তারা রাখে না, তাই তার সদ্ব্যবহারও বোধহয় একই পদ্ধতিতে করে থাকে…

জন ক্রিস্টোর সরল সাদাসিধে স্বভাবের এক সেক্রেটারি আছে এবং সে বিবাহও করেছে সহজসারল্যযুক্ত একটি মেয়েকে। এটাই বোধহয় তার মনোগত বাসনা ছিল।নয় কি? সে নিজের সৌন্দর্যের এক ডালি, অন্য লোকের ক্ষেত্রে হলে হয়তো অনেক কিছুই করতে পারতো! জীবনে চলার জন্য পৃথক পথই হয়তো বেছে নিত, কিন্তু সে তো তা করলো না। সে তো সোজা পথ ধরেই চলতে শুরু করেছিল এবং এখনও সে তার চলার পথে কোনো পরিবর্তন করেনি। মানুষ রূপের জোরে কি করতে পারে তা সে ভেরোনিকাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতো না। তাছাড়া, রূপবান পুরুষদের দর্শনও সে পেয়েছে তারা কি করতে চায় এবং করে থাকে। ভেরোনিকার কাছ থেকে সে জীবনের নিরাপত্তা পেতে চেয়েছিল, আর সেইসঙ্গে শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন সুখেরও কামনা করেছিল। কিন্তু তার মনের বাসনা মনেই রয়ে গেছে–তা সে কোনোদিন পায়নি! জার্দাকে জীবনসঙ্গিনী রূপেই সে হয়তো চেয়েছিল। জাদার মধ্যে সে জীবনের শান্তি, সহনশীলতা আর জীবনের প্রতি তার আনুগত্য এইগুলোর সন্ধান পেয়ে গেছে! তবে কী জার্দার মধ্যে সে সব কিছু খুঁজে পেল? জার্দাই কী তার জীবনের সাদ মিটিয়েছে? জন কিন্তু এ কথার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। মনে মনে সে বোধ হয় জার্দাকেই চেয়েছিল। কিন্তু তার মনে এত অস্থিরতা কেন?

কার মুখে জন শুনেছিল, মানুষ যা পাবার আশা করে; তা সে পেয়ে গেলেই জীবনে নেমে আসে ট্র্যাজেডি!

ক্রুদ্ধভাবে জন টেবিলের ঘন্টায় ঘা বসায়।

.

এখন সে মিসেস ফরেস্টারকে দেখবে। দর্শন পেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগল না। আরও একবার সহজেই হাতের মুঠোয় টাকা এসে গেল। এবার সে রোগিণীর কথা মন দিয়ে শুনলো, জিজ্ঞাসাবাদ করলো, সহানুভূতিও দেখাল, সাহস দেখাল, সব শেষে নিজেকে সারিয়ে তোলার শক্তিও একই সঙ্গে রোগিণীকে দান করল। পরিশেষে মূল্যবান একটা ওষুধের ব্যবস্থাপত্র শোনানোর পরেই তার কর্তব্য শেষ হল।

এতক্ষণ ধরে ঠায় বসে বসে যে রোগিণী নিজের ব্যাধির চিন্তায় আকুল হয়ে অবসন্ন মনে বসেছিল, এখন সে অন্য এক মানুষ, সদর্পে উৎসাহ-উদ্দীপনাকে সঙ্গে করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল–তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে, চোখমুখ জুড়ে বিরাজ করছে নতুন এক রঙ।

জন ক্রিস্টো চেয়ারে গিয়ে আবার নিজেকে হেলিয়ে দিল। এখন তার অবকাশ, উপরে গিয়ে জার্দা এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলিত হবার কথা। সারা সপ্তাহ ধরে রোগ আর রোগীর যন্ত্রণা উপশমের প্রচেষ্টার অফুরন্ত বিশ্রাম।

কিন্তু কিছুতেই আর নড়েচড়ে বসতে মন চাইছে না। এই কি তার সদিচ্ছার অদ্ভুত অবসাদ?, মনের ক্লান্তি, সে অত্যন্ত ক্লান্ত, ক্লান্ত…।

.

০৪.

 রোগী দেখার ঠিক উপরের ফ্ল্যাটে জার্দা ক্রিস্টো একদৃষ্টে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে একটা ভেড়ার মাংসের টুকরোর দিকে।

কল্পনার জগতে থেকে সে আবার চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে, রান্নাঘরে গরম রাখার জন্য মাংসটাকে পাঠাবে কিনা তাই ভাবছে। জন যদি আসতে একটু দেরি করে তবে মাংস একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং ব্যাপারটা তখন বড়ই খারাপ দেখাবে। কিন্তু মাংসটা যদি রান্নাঘরে গরম করতে পাঠানো হয় এবং এই সময় যদি জন এসে উপস্থিত হয়ে যায় তাহলে ব্যাপারটা বিসদৃশ ঠেকবে। কারণ জন দেরি হোক এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। সে অধৈর্য হয়েই বিরক্তির সুরে বলে উঠবে, তুমি তো জান আমার রোগী দেখা যখন শেষ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি চলে আসব।…জনের এই ধৈর্যচ্যুতি নানা অশান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া বেশি গরম করলে মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে এবং জন তখন আরও চটে যাবে, ফারণ বেশি সিদ্ধ করা জিনিস জন কখনোই খুশী মনে মুখে তুলবে না। আবার মাংস ঠান্ডা থাকলেও সে রেগে যাবে, কারণ ঠান্ডা খাদ্য সে একেবারেই পছন্দ করে না।

মাংসের পদটা কিন্তু খুবই সুস্বাদু হয়েছিল। তার মন এখন দোদুল্যমান এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তা একইসঙ্গে তার মনকে আরও বিচলিত করে তুলেছিল।

সমস্ত জগৎ যেন তার চোখের সামনে মেষের পায়ের মাংসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে শীতল হয়ে যেতে লাগল। ডাইনিং টেবিলের অন্য প্রান্তে বারো বছরের টরেন্স বলে ওঠে, বোরাসিক সল্ট সবুজ শিখাতেই জ্বলে, হলদে রঙের শিখা সোডিয়াম সল্টের।

জার্দা টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ছেলে কী বলে চলেছে এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র অনুমান পর্যন্ত নেই।

মা, তুমিও জান না? ]

জার্দা-কি আর জানবো, বাবা?

 টরেন্স–সল্ট সম্বন্ধে?

জাদার চোখ গিয়ে থামল লবণ রাখা কৌটার দিকে।

হ্যাঁ, লবণ এবং গোলমরিচের গুঁড়ো টেবিলের ওপর সযত্নে রাখা আছে, তা ঠিকই আছে। গত সপ্তাহে লুই ওটা রাখতে ভুল করেছিল এবং জন আরও রেগে গিয়েছিল। সদাসর্বদাই একটা-না-একটা গোলমাল…

টরেন্স স্বপ্নালু চোখে বলে উঠল, এটা একটা রাসায়নিক পরীক্ষা।

জেনা বোধহয় এই ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ পাবে।

ন-বছরের জেনা তার সুন্দর মুখের মুখভঙ্গী করে বলে ওঠে, আমি আমার ডিনার চাইছি। মা, আমরা কি শুরু করে দিতে পারি না?

এক মিনিটের মধ্যেই কিন্তু খেতে শুরু করবে, তোমার বাবার জন্য কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা অন্তত কর।

টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমরা শুরু করতে পারি, বাবা মনে কিছু করবেন না। দেখোনি, তিনি কত চটপট ভোজন সমাপ্ত করেন?

জাদা নীরবে মাথা নাড়ে।

মাংস কাটবো? সে ঠিক করে উঠতে পারে না, কোন্ দিক থেকে চাকু বসানো উচিত। লুই অবশ্য ঠিক ভাবেই চাকু দিয়ে সুন্দর করে মাংস কাটছিল। কিন্তু অনেক সময় হয়েছে যখন সে ভুল করে ফেলেছে এবং জন তাতে ক্ষেপে গেছে। লুই ভুল করে চাকু ধরলে জার্দা তাকে ধমক লাগাতে ভোলে না। কিন্তু আজ আর ধমক বর্ষণ হলো না। আজ সে অন্য কারণে উদ্বিগ্ন।

মাংসের ঝোল এর মধ্যে ঠান্ডাও হয়ে গেছে এবং ঝোলের ওপর একটা পাতলা সুর ভেসে উঠেছে। তাকে যতশীঘ্র সম্ভব ওটা রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে–কিন্তু জন যদি এর মধ্যে এসে হাজির হয়ে যায়–এখন তার আসার সময় হয়েই গেছে। তার মনে ক্রমেই দুশ্চিন্তা আসতে লাগল..ঠিক খাঁচায়বন্দী প্রাণীর ন্যায়।…

আবার কেদারায় বসে ডাক্তার জন ক্রিস্টো কতকিছুই না ভেবে চলেছে। এক হাত সামনের টেবিলের ওপর রেখে অতীতে ফিরে গিয়ে তখনকার স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎ তার মনে হচ্ছে জাদা এবং ছেলেমেয়েরা ওপরে খাবার টেবিলে তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে আছে। তার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুতেই সে উঠে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না।

চোখের সামনে এসে ভিড় জমাচ্ছে সব মিগুয়েল..নীল সমুদ্র…সিনেমার গন্ধ…উজ্জ্বল সূর্য…ধূলিকণা…দুঃসাহসিক সেই ভালোবাসা এবং যন্ত্রণা…

সে ভাবতে থাকে, হায় ভগবান, আবার এসব চিন্তা কেন! এসব চিন্তার দিনের অবসান ঘটেছে?

হঠাৎ তার মনে হল, তার সঙ্গে ভেরোনিকার যদি কোনো পরিচয় না থাকতো, জার্দার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হতো, এবং হেনরিয়েটার সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ না হতো।…

মিসেস ক্যাবট্রির কথা তার মনে পড়ে যায়। তার বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক। প্রতিক্রিয়া তো খুবই উত্তম, সে এখন .০০৫ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। টক্সিসিটির অসম্ভব শ্রীবৃদ্ধি এবং ডি.এল, প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক না হয়ে ঋণাত্মক-এ দাঁড়িয়েছে। তার রোগ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে। ডাক্তার তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলেছিল, আপনাকে আমরা সুস্থ করেই তুলবো।

সে প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ভগবান তোমার সহায় হোন, তুমি পরীক্ষা চালিয়ে যাও।

 নাড়ী ধরে ডাক্তার শুধু প্রশ্ন করেছিল, আপনি অসুস্থ বোধ করছেন কি?

ডাক্তারের হাতের স্পর্শ পেতেই রোগিণীর মধ্যে যেন সতেজ ভাব ফিরে আসে। শ্বাস নিতে নিতে রোগিণী শুধু কটা কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি কিছু ভেবো না, আমি ঠিক সহ্য করতে পারব, তোমার কাজ তুমি বন্ধ রেখো না, চালিয়ে যাও।

জন ক্রিস্টো উৎসাহিত হয়ে বলে উঠেছিল, আপনি বড় মহৎ। আমার সব রোগী যদি আপনার মতো মন পেত।

–আমি সুস্থ হতে চাই, তাই সবকিছু সহ্য করার মতো শক্তি পেয়ে যাই। আমার মা আশি বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, ঠাকুমা নব্বই বছরের ওপর ইহকাল ত্যাগ করেছিলেন। আমার দীর্ঘ আয়ুর গোষ্ঠী হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ডাক্তার মনে দুশ্চিন্তা আর সংশয় নিয়ে ফিরে এসেছিল। যদিও সে তার কাজের ব্যাপারে পরম নিশ্চন্ত ছিল যে, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে, তবু তার মনে ভয় ছিল। কোনো কিছু ভুল হয়ে যায়নি তো?

নিশ্চিন্ত থেকেও তার মনের চিন্তা আর দূর হয় না। কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে হাসপাতালের সিঁড়িতে একটা দুরন্ত অবসাদ এসে ক্রিস্টোফারকে ঘিরে ধরল–বহুদিন ধরে এই গবেষণার কাজ করতে করতে তার ঘৃণা জন্মে গেছে। হঠাৎ করে হেনরিয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক তার জন্য নয়, তার রূপ, সজীবতা, স্বাস্থ্য এবং তার আলোকোজ্জ্বল জীবনীশক্তির জন্যই তার কথা বারে বারে মনে পড়ে যায়, আর মনে পড়ে তার চুলে আটকানো গোলাপের মোহিত করা গন্ধের জন্য।

বাড়িতে টেলিফোন করে খবর পাঠিয়ে সোজা হেনরিয়েটার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো, হেনরিয়েটার স্টুডিওতে পা রেখেই সে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং সজোরে টেনে আনল বুকের খুব কাছে।

তাদের সম্পর্কে এমন আলিঙ্গনের বহর এই প্রথম। হেনরিয়েটার চোখেমুখে অবাক বিস্ময়। জনের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কফি তৈরি করে খাওয়াল জনকে। স্টুডিওর মধ্যে চলাফেরা করতে করতে সে তাকে নানা প্রশ্নও করতে লাগল। সে জানতে চাইল, জন সোজা হাসপাতাল থেকে আসছে কিনা। জন কিন্তু চুপ করে থাকে। সে এখানে এসে হাজির হয়েছিল খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে, আবার কিছুটা হেনরিয়েটার প্রেমে অন্ধ হয়ে।

হাসপাতালের কথা উল্লেখ করতে জনের ঠিক মন চাইছিল না। হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেমের গল্প করার বাসনা নিয়েই তাকে কাছে পাবার আশা নিয়েই সে হাজির হয়েছিল, হাসপাতলের কথা এবং মিসেস ক্যাবট্রি এবং রিজওয়ের রোগ সংক্রান্ত সব কথাই সে ভোলার জন্য উপস্থিত হয়েছিল।

প্রথমটায় অনিচ্ছাসত্ত্বে এবং পরে খুব দ্রুত তার প্রশ্নের জবাব ও দিল। চিকিৎসাবিদ্যার কতগুলো সহজলভ্য ভাষা তাকে বোঝাতে গিয়ে জন দু-একবার চুপ করে গিয়েছিল, হেনরিয়েটা চটপট উত্তর দিয়েছিল, হা, হা ডি. এল. প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক-এ রূপান্তরিত হতে হবে। আমার ওসব বুঝতে অসুবিধে হয় না, তুমি বলে যাও।

সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি করে জানলে?

হেনরিয়েটা-একখানা বইতে আমি পড়েছি।

জন–কি বই? কার বই?

হেনরিয়েটা ছোট্ট একটা বইয়ের টেবিলের দিকে এগিয়ে চললো। বই দেখে নিয়ে জন বলে উঠলো, স্কুবেলের বই মোটেই ভালো না, তার গোড়ায় গলদ। তোমার যদি বই পড়ার ইচ্ছা থাকে আমি তোমাকে উচ্চমানের ভালো বই দিতে পারি।

সে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, না না, আমায় বই দিয়ে কি হবে? আমি শুধু তোমার বক্তব্যগুলো বুঝতে পারছি এই পর্যন্ত, তার চেয়ে বেশি জানতে চাওয়ার কোনো প্রবণতা আমার আছে কি? তুমি বলে যাও, মোটামুটি বোধগম্য আমার হবে।

আচ্ছা, মনে রেখো কিন্তু স্কুবেলের বই ঠিক নয়।

জন আড়াই ঘন্টা ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব পরিবেশন করে নিল। সে যখন হেনরিয়েটাকে এইসব কিছু বোঝাচ্ছিল, তখন তার এই খেয়ালও আসেনি যে, হেনরিয়েটা উপস্থিত আছে কিনা! তার দৃঢ় বিশ্বাস যে সে ভ্রান্ত নয়, নানান পদ্ধতিতে তার উপপাদ্য প্রমাণের চেষ্টায় লেগে গেল।

হঠাৎ সে মনের দিক থেকে ক্লান্তি অনুভব করল। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত’ একথা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে মরার মতো নিদ্রাদেবীর কোলে ঢোলে পড়ল।

শিশুর মতো সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে যখন সে চোখ খুলল, তার চোখে পড়ল যে হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসি হাসছে এবং সকালের চা তৈরি করতে বসে গেছে।

জন হেসে বইয়ের টেবিলের দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তুমি সত্যি খুব ভালো লোক, তবে দেখ, বই যদি পড়তে চাও তবে আমি তোমার হাতে ভালো বই তুলে দেব, স্কুবেলের নিম্নমানের বই পড়া তোমার বোধহয় উচিত হবে না।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না-না ওসব পড়াশোনার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমি যা কিছু উদ্দীপনা পাই তোমার মধ্যে এবং তোমার কথা শোনার পরই। এই বলে সে হেসে ফেলে।

জন কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, হেনরিয়েটার হাসির পেছনে আসলে কোনো কারণ লুকিয়ে আছে কি না? তবে কি হেনরিয়েটা স্কুবেলের বইকে উন্নতমানের বলে মনে করে? হেনরিয়েটা তবে কি তাকে উপহাস করছে? এমন পরিহাসে সে বড় একটা অভ্যস্থ নয়। জাদা তার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-তামাশা করে না। ভেরোনিকা তো নিজেই স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। হেনরিয়েটা কিন্তু অভিনবপন্থায় মাথা পেছন দিকে ফিরিয়ে আধবোজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলতে পারে, আমি কৌতুকপূর্ণ চোখে জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বহুদূরে চলে যেতে পারি…।

সে ভেবে নেয় হেনরিয়েটা বোধহয় এখন একটু পালটে গিয়েছে–বোধহয় নিজেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তার মনোগত বাসনা নয়। জন চায় যে, হেনরিয়েটা তার কথা ভাবুক, শুধু মাত্র তার কথাই ভাবুক–কোনো সময়ের জন্য যেন জনের অস্তিত্ব ছেড়ে অন্য কোথাও যেন চলে না যায়। কিন্তু যে গুণগুলো জার্দার মধ্যে দেখে জন নিজেকে ধরে রাখতে না পারে, সেগুলোই বা সে কেন হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়? এর একমাত্র অর্থ হয় যে, ন্যায়শাস্ত্র সম্বন্ধে সে একেবারে অজ্ঞ এবং তার মনের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে সে নিজেই জানে না।

আমি বাড়ি যেতে চাই–কি সম্ভবের বাইরে এবং বিদ্রুপের কথা! তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে?

দু-একটা ঘন্টার মধ্যে জন লন্ডন থেকে বেরিয়ে পড়বে এবং শরৎ বনানীর মধ্যে দিয়ে পল্লীর পথ ধরে এগিয়ে যাবে…গাড়ির গতি তার মনে খুশী ডেকে আনবে…পল্লীপ্রকৃতির লতা-গুল্ম, ফল-ফুল, ঝর্না-নদী তার মনে আনন্দের ঢেউ তুলবে…

কিন্তু এসব কিছুই নির্ভর করছে একমাত্র জার্দার ওপর, ঈশ্বর জাদার প্রতি সহায় হোন। জার্দা খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারে না।

সে থেকে থেকে গিয়ার বদল করে, জন তখন একেবারে নীরব থাকে। কখনও কখনও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু সাহস করে কিছু বলার মতো ক্ষমতা তার নেই। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু জানিয়েছে–সে জানে কিছু বললেই জাদা ক্ষেপে যাবে। আশ্চর্যের কথা এটাই যে, জার্দাকে কেউ গিয়ার বদল করা শেখাতে পারল না, এমনকি স্বয়ং হেনরিয়েটাও নয়। হেনরিয়েটার হাতে সে জাদাকে সমর্পণ করেছিল কারণ সে ভেবেছিল যে, তার উগ্র মেজাজের চাইতে হেনরিয়েটার শান্ত, উৎসাহ তাকে ভালো করার পেছনে যথেষ্ট লাভজনক।

হেনরিয়েটা গাড়ি ভালোবাসে। গাড়ির নাম উঠলেই সব কিছু ভুলে যায়। কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বললেই তার মনে কাব্যরসের সঞ্চার হয় এবং সে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য নির্ণয়ের সঙ্গে গাড়ির শব্দধ্বনি, গতিবেগ প্রভৃতি তুলনা করে দেয় যে, শ্রোতারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। জন তো বলেই বসল, হেনরিয়েটা তুমি কি তোমার গাড়ির কথা তুলে রেখে আমার জন্য দু’এক মিনিট ব্যয় করতে পার না? একদিন তো জনের এই ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বিরাট মনোমালিন্য হয়ে গেল!

জাদা একদিন জনকে বলে উঠেছিল, হেনরিয়েটা আমাকে যাবার জন্য বলেছে, আমার সঙ্গে তার কি কাজ আছে।

জন–কি কাজ? তোমাকে আবার কোন কাজে লাগবে তার? বোধহয় তোমার সঙ্গে ছলচাতুরি কিছু করবে।

জার্দা-কাল আমি স্টুডিওতে যাচ্ছি।

জাদাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব খুশী। জনের মনে হল জার্দা বোধহয় মডেল হতে চায়–মুখে কিছু বলল না।

তার ঠিক দশদিন পরে জাদা বিজয়িনীর মতো প্লাস্টারের তৈরি একটা ছোট মূর্তি জনকে দেখাল, মূর্তি, মূর্তিটা হেনরিয়েটার আর দশটা মূর্তির মতোই বেশ সুন্দর। দক্ষ শিল্পীর হাতের স্পর্শ লাগলে যেমন সুন্দর এবং নিখুঁত হয়; তেমনি ভাবে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে মূর্তিটি। জার্দাকে দেখেই তার অনুকরণে গড়া হয়েছে মূর্তিটি এবং আনন্দে আত্মহারা এখন জাদা, মূর্তির মধ্যে জাদা স্বয়ং যেন অমরত্ব লাভ করেছে–হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে।

জার্দা–আমার মনে হয়, জন মূর্তিটা সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে।

জন–এটা কি হেনরিয়েটার হাতের কাজ। কিন্তু তার কাজ তো এর চাইতে অনেক ভালো হতে পারতো। আমার তো দেখে মনেই হয় না এটা হেনরিয়েটার কাজ!

জার্দা–এটা যদিও একটু পৃথক ধরনের, কিন্তু আমার তো বেশ ভালোই লেগেছে। কাজের প্রশংসা না করে পারছি না, তুমি কী বল জন?

জন আর কিন্তু কিছু বলে না, জার্দার আনন্দে সে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চায় না। কিন্তু প্রথম সুযোগটাই সে সদ্ব্যবহার করল, হেনরিয়েটাকে আক্রমণ করল।

জন–তুমি জাদাকে এমনভাবে বোকা প্রতিপন্ন করতে চাইছ কেন? ওটা কী বানানো হয়েছে? তোমার মূর্তি গড়ার হাত তো বেশ পাকা!

হেনরিয়েটা–আমার তত মনে হয়, এটা বেশ ভালোই হয়েছে। জার্দাও এর জন্য যথেষ্ট খুশী।

জন–জাদা তো এ ব্যাপারে খুশী হবেই, কারণ আর্টের বিষয়ে সে কিছুই বোঝে না।

হেনরিয়েটা–আর্টের দিক থেকে বিচার করলে বোধহয় খুব খারাপ হয়নি জন। প্রতিকৃতি থেকেই যে মূর্তি বানানো হয়েছে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং সারল্যমিশ্রিত। বিন্দুমাত্র মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়নি।

জন–তুমি এমন সব নিম্নমানের কাজে সময় নষ্ট কোরো না…

জন পাঁচফুট উঁচু একটা কাঠের মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ওহে, এটা কি?

এটা বানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক গ্রুপের জন্য। পিয়ারউড। পূজারিনী।

হেনরিয়েটা তার দিকে পলক নয়নে চেয়ে আছে। তারও চোখের পলক পড়ছে না–তার ঘাড় হঠাৎ ফুলে উঠলো, এবং তার দৃষ্টির তখন রঙ পাল্টে গেছে, দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছিল কুদ্ধ ভাব।

তার মানে তোমার চোখে জার্দা এখন? তোমাকে কে এই সাহস প্রদান করল?

–আমি এই দেখে অবাক হচ্ছি যে তুমি বেশ এইসব বকে যাচ্ছ? তুমি যদি তা একবার চোখের দেখা দেখতে…সে একটা আঙুল রাখল তার বলিষ্ঠ চওড়া ঘাড়ের মাংসপেশীর ওপর।

হেনরিয়েটা মাথা নাড়ে, হা, এটা ঘাড় এবং কাঁধ–আমি এটাই করতে চেয়েছি–সেই ভারী সম্মুখে ঝোঁক–আত্মনিবেদন-নুয়ে পড়ার এক চিত্র। অত্যাশ্চর্য!

–অত্যাশ্চার্য? এদিকে একবার তাকিয়ে দেখ হেনরিয়েটা, জার্দার কি হাল করেছ তুমি!

জার্দা নিশ্চয়ই জানবে না, কেউ জানবে না। তুমি জান যে, জাদা মূর্তি দেখে কোনোদিনই নিজেকে চিনতে পারবে না, কেউ পারবে না। এটা জার্দা নয়, অন্য কেউও নয়।

জন–আমি কিন্তু ঠিক চিনতে পেরেছি, পারিনি?

হেনরিয়েটা–তুমি যা জেনেছ তা একটু অন্যরকম। তুমি দেখতে জান।

জন–চুলোয় যাক ঘাড়! কিন্তু হেনরিয়েটা তোমার এমন করার কোনো যুক্তি আমার চোখে পড়ছে না। তুমি অন্যায় করেছ।

হেনরিয়েটা–তাই কি?

জন–তুমি কি এখনও বুঝতে পারছ না? তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কি এখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে?

হেনরিয়েটা–তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই জন। আমার মনে হয় না, আমি তোমাকে কোনোদিন বোঝাতে পারব…তুমি বুঝতে পার না…কি করা হয়নি?…দিনের পর দিন দেখে দেখে সেই ঘাড়ের লাইনের পুনরাবৃত্তি এ মাংসপেশী-মস্তকের সামনের দিককার কোণ–পুরু ঠোঁট। আমি অনেক দেখেশুনে করেছি এবং আমি এই রূপটাই করতে চেয়েছি–প্রতিবার আমি জাদাকে প্রত্যক্ষ করেছি এবং দেখে দেখে ঐ রূপেই দাঁড় করাতে হয়েছে…দোষের মতো কিছু হয়েছে কি।

জন-বিবেকশূন্য!

হেনরিয়েটা-হা, ঠিক তাই। তোমার মনের বাসনা থাকে যদি এরকমটা পাওয়ার, তোমাকে তাই গ্রহণ করতে হবে।

জন–তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, তুমি কিছু গ্রাহ্য করো না, জাদাকেও তুমি গ্রাহ্য করো না…

হেনরিয়েটা–বোকার মতো কথা বলল না জন। জার্দাকে খুশী করার কথা ভেবেই আমি মূর্তিটা বানিয়েছি, আমি আর যাই হই, অমানুষ নই।

জন–নিঃসন্দেহে তুমি অমানুষ!

হেনরিয়েটা–তুমি সত্যি করে বলো তো জন, জার্দা কি নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাবার আশা রাখে?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জন পূজারিনীর মূর্তির দিকে তাকাল-পূজারিনী নাম না দেবতার কাছে মাথা খুঁড়ছে–প্রার্থনা করে চলেছে–মুখ উত্তোলিত–অন্ধ, বোবা, ভক্তিমতী-শক্তিশালিনী ধর্মোন্মত্তা।

জন হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তুমি যে জিনিষটা তৈরি করেছ হেনরিয়েটা, সেটা দেখলে মনে এক ভীতি জাগে।

ঈষৎ কেঁপে ওঠে হেনরিয়েটা। সে বলে ওঠে, হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম যে…

জন তাড়াতাড়ি করে তাকে বলে ওঠে, সে কার সন্ধান করছে? পূজারিনীর সামনে কে আছে?

হেনরিয়েটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, সে বলে ওঠে, আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় সে তোমার সন্ধানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হেনরিয়েটার কণ্ঠস্বর কেমন অদ্ভুত শোনাল।

.

০৫.

 খাবার ঘরে শিশু টেরি আরও একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করল।

সীসা লবণ গরম জলের চাইতে ঠান্ডা জলে অনেক বেশি দ্রবণশীল। যদি পটাসিয়াম আয়োডাইড যোগ করা হয় তবে সীসা–আয়োডাইডের হলদে তলানি তুমি পাবে।

সে তার মায়ের আশান্বিত চোখে তাকাল, কিন্তু আশার পরিবর্তে তাকে নিরাশ হতে হল। টরেন্সের মতে পিতা-মাতা সর্বদাই নিরাশ করেন।

-মা, তুমি জান কি?

আমি রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে ঠিক কিছুই জানি না বাবা। টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, তোমার বইতে এটা থাকলেও থাকতে পারে।

এর কতগুলো সহজ অভিব্যক্তি, কিন্তু এর পেছনেও অনেক আশা।

জাদার কোনো আশার কথাই পৌঁছচ্ছে না। সে যে এক উৎকণ্ঠার ফাঁদে পা দিয়েছে। বারংবার সে একই দুশ্চিন্তার কবলে আটক হচ্ছে। সকালে চোখ ভোলা থেকেই তার মন ভালো লাগছে না। এবং সবশেষে তার এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটানোর সময় এসে উপস্থিত। এই অবসরকে সে আগে থাকতে ভয় পাচ্ছিল।হলোতে বাস করা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সদাই তার বুদ্ধিভ্রম হতো এবং একাকিত্ব তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়াত। লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার অসম্পূর্ণ বাক্যের দ্বারা দ্রুত অসঙ্গতি এবং বিনয়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় এমন ভীতির সঞ্চার করতেন..যা, জাদার কাছে সত্যিই অহস্য লাগত। অন্যরাও তেমন ভালো নয়। জাদা এই দুটো দিন যেন শহীদের দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করতো, শুধু জনের মুখ চেয়েই তাকে সহ্য করতে হতো। সেদিন শুয়ে জন খুশীমনেই বলছিল, ভাবতেও ভালো লাগে যে, সপ্তাহের শেষে আমরা পল্লীগ্রামে যাব। তোমার পক্ষেও এটা ভালো হবে জাদা, কারণ এটা একান্তই প্রয়োজন।

জাদা কিন্তু যন্ত্রচালিতের মতোই মুখ নিয়ে বলে উঠেছিল, হা, আনন্দ বৈকি! তার কারণ সুখহীন চোখ ঘরের দিকেই তাকিয়েছিল। দেয়াল-সাজানো কাগজ, ডোরাকাটা পোষাকের আলমারি, মেহগিনী কাঠের সুন্দর ড্রেসিং টেবিল, তাতে ঝোলানো রয়েছে মনোহারি সুদৃশ্য আয়না, নীল রঙের চাকচিক্যে ভরা কার্পেট, জলরঙের হ্রদের ছবিগুলো–এইসব চির-পরিচিত প্রিয় জিনিষগুলো সে আর সোমবারের পূর্বে প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। বাড়ির চাকরানী একদিন মনের সুখে রাজত্ব চালাবে, তার শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় সাজানোর নামে ওলটপালট করবে, পর্দা টেনে দিয়ে হয়তো গভীর ঘুম দেবে, নয়তো মন যা চাইবে তাই করবে–এটা ভাবতেই জাদার বিশ্রী লাগছে। জাদা একদম পছন্দ করে না সে ছাড়া কেউ তার জিনিষ নিয়ে নাড়াচাঙ্গা করে। ছুটি কাটাতে গিয়েও সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, মন পড়ে থাকবে এখানেই, সদাই তার মনে হবে, তার সব প্রিয় জিনিষগুলো এই বুঝি নষ্ট হয়ে গেল! নিজের মনকে সে এইভাবে সান্ত্বনা দেবে, আর মাত্র তো একটা বা কয়েক ঘণ্টার মকদ্দমা। স্কুলের শিশুরা যেমন হা-পিত্যেশ করে গণনায় বসে যায় কবে ছুটির দিন আসবে, জার্দাও শিশুর মতোই ছুটি কাটাতে গিয়েও দিন-ঘন্টা গণনা করতে বসে যাবে–কবে ছুটি শেষ হবে আর কখন আবার বাড়ির মুখ দেখবে।

স্কুলও কোনোদিন জার্দার কাছে সুখের ছিল না। বাড়ি অবশ্য সেই তুলনায় ভালো ছিল, কিন্তু সেটাও তার পক্ষে ভালো ছিল একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বাড়িতে জার্দা ছাড়া বাকি সকলেই বেশ চালাক-চতুর ছিল, সকলেই তাকে উপদেশ দিয়ে চলত। জার্দা, চটপট করো, তুমি এত ধীরজ কেন?–এইসব উপদেশ এবং বিদ্রূপ-বাণ তার নিকট শীতের দিনের শিলাবৃষ্টির মতোই মনে হতো। জার্দা অবশ্য তার জন্য কোনো আক্ষেপ করত না।

কিন্তু এইসব উপদেশ তার উন্নতির থেকে অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। যতদিন যেতে লাগল সে আরও বেশি বোকা এবং ধীরজ হতে লাগল। উপস্থিত বুদ্ধি তার একদম ছিল না। অনেক সময় কোনো কথার জবাবে সে শুধু উদাস নয়নে চেয়ে থাকতো, মুখে বাক্য সরত না।

অবশেষে একদিন সে তার আত্মরক্ষার কৌশল খুঁজে পেল। হ্যাঁ কৌশলই বটে, অস্ত্র হিসেবেও উপযুক্ত।

যত দিন যেতে লাগল সে যেন আরও ধীর হয়ে যেতে লাগল। খানিকটা ইচ্ছে করেই সে কাজে দেরি করতে লাগল। অন্য লোকগুলো ধৈর্য হারিয়ে তাকে যতই তাড়া দিতে থাকে সে যেন আরও ধীর গতিতে চলতে থাকে। অবশেষে তারা তার ওপর আর ছেড়ে না দিয়ে নিজেরাই সেটা করে ফেলে। জার্দা ফ্যালফেলে চোখে বোকার মতোই তার মনের চাহিদার তাগিদে তাকিয়ে থাকে। অপরপক্ষতার এই ভাব দেখে ভেবে নেয় ওর দ্বারা কিছুই হবার নয় এবং সেই সঙ্গে পরামর্শ দেয়, ওকে বেশি কাজ না দেওয়াই ভাল–বেশী কাজ দিও না। জাদার বেশ সুবিধাই হয়েছে, কাজের হার কমে যাওয়ায় তাকে খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হয় না। এই কৌশলই সে শিখেছিল, মনে মনে সে খুব খুশী হতো, সকলে একটা কথাই ভাবতো, জার্দার জ্ঞানগম্যি আর হলো না, কোনো কাজ সে ভালো করে শেষ করে না। তারা মনে মনে এই ভাবনা ভেবেই সুখী থাকে যে তারা নিজেদের যথেষ্ট চালাক মনে করে, সেই সঙ্গে জ্ঞানীও।

জার্দা প্রকৃতপক্ষে মোটেই নিরেট নয়, তবে কাজের বেলায় শুধুমগতি। অনেকে সেটা পছন্দও করে না এবং তাতে অবশ্য সুবিধাই হয়। জাদার সবচেয়ে বড় অস্ত্র নীরবতা। কারুর কোনো কথায় সে প্রতিবাদ তোলে না। উত্যক্তর মাত্রা যদি একটু বেশি হয়, তবে আরও বোকা বোকা ভাব এনে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাই শ্রেয়। পাষণ্ডের চোখে পড়লে তারও মায়া না হয়ে পারবে না।

তবু এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মনে মনে সে ভয়ই পেত। এঁরা এত বেশি নিজেদের চতুর ভাবত যে, এদের নাগাল পাওয়া জার্দার পক্ষে সত্যি সম্ভব ছিল না। জার্দার গোপন অস্ত্রের কার্যকরী করার ক্ষেত্র এটা নয়, জার্দা এ্যঙ্গক্যাটেলদের যতই ঘৃণা করুক, জন এঁদের ভালোও বাসে। সেই জন্যই সাপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর জন্য ভালোবাসার টানে যেতে হয়।

জাদা মনে মনে ভাবে, জন সত্যি বড় ভালো,কী অত্যাশ্চর্য! জন সকলের কাছেই প্রিয়পাত্র। মেধাবী, যত্নশীল এমন ডাক্তার, যিনি রোগীদের প্রতি এমন স্নেহপ্রবণ, সকলের সঙ্গে এমন সুন্দর ব্যবহার–সত্যিই এমন মানুষের দর্শন খুব কমই মেলে। জন যে শুধু নিজের রোগীদের ক্ষেত্রেই যত্ন নেয় একথা ঠিক নয়। হাসপাতালের রোগীদের প্রতিও সমান যত্ন তার, জন তাই সত্যিই মহৎ। জার্দা প্রথম থেকেই এটা জানতো যে, ছাত্র হিসেবে জন সত্যিই মেধাবী এবং ডাক্তারি পরীক্ষাতেও সসম্মানে সে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে যে বৃক্ষের শীর্ষদেশে আরোহণ করবে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না। জার্দার সবথেকে অবাক লাগতো এই ভেবে যে, জন কেন তাকে পছন্দ করে বিবাহ করেছিল। জার্দা দেখতে মোটেই সুন্দরী নয়, নয় বুদ্ধিমতী, সেই সঙ্গে চাতুরী কলাও তার মধ্যে বিরল। সব কার্যেই তার মন্থর গতি! এর থেকে অনেক ভালো মেয়ে ডাক্তার জন চাইলে পেয়ে যেত। সে যখন তাকে পছন্দ করল, তখন সে ভালো ভাবেই জেনে গিয়েছিল যে জার্দা ধীরজ, বোকা এবং রূপের ডালিও নয়। জন শুধু বলেছিল, তুমি এ নিয়ে কিছু ভেবো না জার্দা, আমি তোমাকে খুব যত্ন করব…

একজন পুরুষ এর থেকে আর বেশি পৌরুষ কী বা দেখাতে পারে। জাদা শুধু নয়, জার্দার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই একসঙ্গে অবাক হয়েছিল যখন তারা শুনেছিল যে জন জার্দাকে পছন্দ করেছে। শুধু জন নামী-দামী বড় ডাক্তারই নয়, রূপেও সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কথাবার্তায় তুখোড় এবং লোকের সঙ্গে ব্যবহারে অমায়িক। এরকম পাত্র সকলের কাছেই লোভের বিষয়, আর যদি সৌন্দর্যের কথাই উল্লেখ করা যায়, তাহলে সে মঞ্চ বা চিত্রজগতে নায়কের ভূমিকায় অনায়াসেই অবতীর্ণ হতে পারবে।

সব দিক থেকে বিচার করলে জনের স্ত্রী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও জার্দার মধ্যে ছিল না।

 নজরকাড়া হাসি হেসে জন বলে উঠেছিল, আমি আমার নিজের পথ ভালোবাসি, জার্দা।

জাদা প্রত্যুত্তরে বলেছিল, সে তো অতি উত্তম, সেটাই করা উচিত। সেও জনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, জার্দার কোনো কাজ জনের ভালোই লাগেনি, তবু সে জার্দাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করেনি। কারণ জন সর্বদাই তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত এবং নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে ছিল বরাবরই উদাসীন–এজন্যই বোধহয় জনের কোনো কাজই জাদার কাছে দোষের ছিল না।

হা ঈশ্বর! ভেড়ার মাংসের টুকরোটা বরফের মতো ঠান্ডায় জমে গেছে। সেটাকে একবার রান্নাঘরে পাঠানো তার উচিত ছিল, কিন্তু জনের তো দর্শন মেলাই ভার! জনও আসছে না, অন্যদিকে জাদাও তার কর্তব্য স্থির করতে পারছে না। জার্দা তার দায়-দায়িত্ব কর্তব্যের ব্যাপারে কেন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না? এই চিন্তা মাথাতে আসতেই তার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে, হায় ভেড়ার মাংস! ভীতিপ্রদ এই সাপ্তাহান্তে–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে ছুটি কাটানো অখণ্ড অবসর-সত্যি বড় খারাপ লাগছে! কপালের দু’পাশে হঠাৎ একটা ব্যথা তাকে বড্ড অধীর করে তুলছে। এক্ষুনি মাথার যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে পড়বে, জনের কানে যদি একবার যায়, সে ক্ষেপে আগুন হবে, ওষুধ তো দেবেই না বরং পরামর্শ দেবে যে, মাথা ধরেছে এই কথাটা মনে আনতে নেই, ওটাকে ভুলে যাও, দেখবে মাথাধরাও উধাও। এক কাজ কর, চটপট পা চালিয়ে একটু ঘুরে এসো, অযথা ওষুধ গিলে শরীরকে আর বিষাক্ত করে তুলতে হবে না। ভেড়ার মাংস! এই ভেড়ার মাংসই হয়েছে কাল–মাথা ধরার একমাত্র কারণ। এই মাংসই হলো সব অশান্তির মূল..

জাদার চোখ জলে ভরে যায়। সে মনে মনে ভাবে, আমার বেলায় কেন কোনো কিছুই ভালো হয় না। আমার সব কাজেই একটা না একটা গোলমাল লেগে থাকে।

টরেন্স খাবার টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসা মায়ের দিকে একবার তাকাল, তারপরে চোখ নিয়ে গেল মাংসের টুকরোর দিকে। নিজের মনেই ভাবতে থাকে। ডিনার শুরু না করার পেছনে আমাদের কী কারণ থাকতে পারে? বয়স্ক লোকজন যারা উপস্থিত হয়েছে, এক কথায় সকলেই বোকার দল। জ্ঞান বলে কোনো বস্তু তাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।

একটু জোর দিয়েই বলে ওঠে, মা, আমি আর নিকলসন তাদের বাড়ির লতাগুল্মের উদ্যানে নাইট্রোগ্লিসারিন বানাবো। স্ট্র্যাথামে তাদের বাস। সম্মতির সুরে জার্দা বলে ওঠে, সে তো খুব উত্তম প্রস্তাব, একদিকে খুব ভালো হল।

–এখনও সময় আছে, ঘন্টা বাজিয়ে লুইকে বললেও এখন বলতে পারো, মাংসের টুকরোটা একবার গরম করে নাও।

টরেন্স উবে যাওয়া উদ্দীপনা নিয়েই মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। সে অনুভব করতে পারে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, যাতে করে মাতা-পিতার উৎসাহও মিলে যায়। সে ভেবেছিল, সুযোগ বুঝে মাতা-পিতার অনুমতি আদায় করার পালা, কারণ দুর্ঘটনা যদি কোনো ঘটে থাকে তবে আহত কণ্ঠে বলতে পারবে, মাকে আমার বলা তো বলেছিলাম।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার মনে আজ হতাশা।

সেভাবে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরির ব্যাপারটা মার কাছে একবার খুলে বলারও প্রয়োজন আছে।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টরেন্স, অসহায়তা এবং একাকিত্ব তাকে এখন ঘিরে ধরেছে। একথা শোনার মতো ধৈর্য এখন বাবার নেই, মাও সমান অমনোযাগী, জেনাকে তো ধর্তব্যের তালিকায় নেওয়া যায় না, নেহাতই ছোট এবং বোকা।

আর এমন সাধের রাসায়নিক পরীক্ষার কথা কার কাছে বলেই বা আনন্দ পাবে? ধৈর্য ধরে বসে শোনার মতো অবকাশ আছে?

কেউ না! কেউ না!

জার্দা চমকে ওঠে, তার কানে আসে জনের রোগী দেখার ঘরের দরজার শব্দ। জন ছুটে উপরে আসছে।

জন ক্রিস্টো ঘরে ঢোকে, নিজের উৎসাহের তাগিদ তাকে ঘরে এনে হাজির করেছে দ্রুতগতিতে। যদিও সে রঙ্গকৌতুক ভালোবাসে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটা একদম আলাদা ক্ষুধার জ্বালায় তার এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।

চেয়ারে বসতে বসতে সে বলে ওঠে, রোগীদের আমি বড় একটা ভালো চোখে দেখি না–আমার কাছে তারা ঘৃণার পাত্র।

-ওঃ জন, এমন বলা তোমার শোভা পায় না, তোমার রোগীদের মনে তোমার সম্পর্কে খারাপ মনোভাব সৃষ্টি করবে–জার্দা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত দেয়, তারা যেন নিজেদের ভোজন শুরু করে।

জন ক্রিস্টো এবার মুখ খোলে, আমার বক্তব্য হল, অসুস্থ হওয়া বোধহয় কারও উচিত নয়।

টরেন্সের উদ্দেশ্যে জার্দাও জবাব দিতে দেরি করে না, তোমার বাবা আজ রঙ্গরসে মেতে উঠেছেন।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে টরেন্স তার বাবাকে পরীক্ষা করে। সব জিনিষই সে গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পন্ন করে।

টরেন্স এবার বলে ওঠে, আমার তো মনে হচ্ছে না বাবা কৌতুক করছেন।

-তুমি যদি রুগণ লোককে ঘৃণার চোখে দেখ, তবে তোমার ডাক্তার হওয়া একেবারেই অনুচিত হয়েছে-জাদা হাসিমাখা মুখেই উত্তর দিয়েছে।

জন ক্রিস্টো–সেই জন্যেই বোধহয় ডাক্তারদের চোখে রোগীর ব্যাধি ধরা পড়ে না, হা ঈশ্বর মাংস যে পাথরের মতো ঠান্ডা-হিম হয়ে গেছে! কেন এটাকে, নিচে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গরম করতে পারলে না?

জার্দা–তোমার যে আসতে এত দেরি হবে কী করে জানব? আমি তো ভেবে বসেছিলাম তুমি এসে হাজির হবে বলে।

জোরে জোরে জন ক্রিস্টো ঘন্টা বাজাতে থাকে, চটপট চলে আসে লুই। এই মাংসটা বরং পাঁচক দিয়ে গরম করিয়ে নিয়ে এসো।

সে সংক্ষেপে কোনোরকমে বলে, হ্যাঁ, মহাশয়। এই বলেই লুই তাড়াতাড়ি চলে যায়।

জাদা–সত্যি আমি দুঃখিত জন, সবাই আমার দোষ, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তারপর যত সময় পার হতে লাগল ততই একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক করতে শুরু করে দিল, গরম করতে পাঠালে অনেক দেরি না হয়ে যায়–

অধৈর্য কণ্ঠে বাধা দিয়ে জন বলে ওঠে, ওঃ তাতে কিছু যাবে আসবে না, এটা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, এর জন্য নাচ আর গানের বন্দোবস্ত করতে হবে।

পরে সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, গাড়িটা এখানে আছে তো?

 –আমার তো তাই মনে হয়; কাল তো অর্ডার দিয়েছিল।

–তাহলে লাঞ্চের পরই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।

জন শুধু ভেবে যায়। অ্যালবার্ট ব্রীজ পেরিয়ে ক্ল্যাপহ্যাম–কমনের ঠিক উপর দিয়ে–ক্রিস্টাল প্যালেসের পাশ দিয়ে সোজা পথ–ক্রয়ত–পারলিওয়ে, পরে প্রধান রাস্তাটা ঠিক বাদ দিয়ে –ডানদিককার মেথ্যার্ডলি হিল-এর মধ্য দিয়ে সোভেলের নিচে দিয়ে সোনালি সারি সারি বৃক্ষশ্রেণীর মধ্য দিয়ে শরৎ বনানীর ভেতর দিয়ে শরতের মৃদু গন্ধ নিতে নিতে পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

লুসি এবং হেনরি…হেনরিয়েটা…।

চারদিন হল জন হেনরিয়েটার দেখা পায়নি। তার সঙ্গে যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিন সে রেগে গিয়েছিল। হেনরিয়েটার চোখেমুখেও সেই প্রভাব পড়েছিল। দুৰ্জেয় নয়, অন্যমনস্কতাও নয়–ঠিক বর্ণনা সে দিয়ে উঠতে পারছে না–কিছু–যার মধ্যে জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সে নিজের মনেই বলতে থাকে, আমি জানি, তার পরিচিতি সে একজন স্ত্রী-ভাস্কর। আমার অজানা নয়, তার হাতের কাজ উত্তম পর্যায়ের। চুলোর-দুয়ারে যাক সব! কখনও কি সে তার কাজ একাঁপাশে রেখে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না? কখনও কি সে এক মনে আমার কথা ভাবার সময় পায় না? শুধু আপনার কথা? ঐকান্তিক ভাবেই শুধু আমার কথা?

সে ভালো নয়। সে খুব ভালো করেই এই সত্য বোঝে যে, লোক হিসেবে সে মোটেই ভালো নয়–অন্ততপক্ষে নিজের সম্পর্কে তার চিন্তাধারা এইরকম। হেনরিয়েটা নিজের সম্বন্ধে মুখে কিছু প্রকাশ করে না। নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকে। অন্যান্য শিল্পীদের মতোই সে নিজের কাজ সম্বন্ধে কিছু বলা পছন্দ করে না। তবে তার শিল্পকে সমস্ত অন্তর দিয়েই সে ভালোবাসে। তাই শিল্পকে তার মনের সঙ্গে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছে, এই সংবাদ নেওয়ার সুযোগ অবশ্য জনের ভাগ্যে জোটেনি। তবে এমন ঘটনা খুবই কম চোখে পড়েছে যখন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতে হেনরিয়েটা জনকে উপেক্ষা করেছে। জনের প্রতি হেনরিয়েটার বিন্দুমাত্র উদাসীনতা সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। তার বিন্দুমাত্র অন্যমনস্কতাও জনের মনে খুব সহজেই ক্রোধের সৃষ্টি করে।

একদিন সে সোজাসুজি হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল, আমি যদি মরি তোমার পক্ষে এসব ছেড়ে দেওয়া কী সম্ভব?

–এসবগুলো কী? তার কণ্ঠজুড়ে বিস্ময়ের ধ্বনি।

সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, বোকা! তুমি কেন ওকে এসব বলছ? পরে আবার চিন্তাভাবনা করে দেখেছে, দেখাই যাক না সে কি বলতে চায়! মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই না হয় কিছু বলুক হ্যাঁ, জন আমি নিশ্চয়ই ছেড়ে দিতে পারি–শুধু তোমার মুখ চেয়ে।

কিন্তু যে কথাটা শোনার জন্য জন উদগ্রীব ছিল তা সে একটিবারের জন্যেও উচ্চারণ করল না। সে একেবারে নিশ্চুপ রইল। তার চোখ দুয়ে রহস্য সন্ধানে আপ্লুত হল। বহুক্ষণ এভাবে নীরব থাকার পর সে আবার বলে উঠল, হা, ছেড়ে দিলেও দিতে পারি; যদি তেমন কোনো প্রয়োজন সত্যি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। একটু থেমে থাকার পর আবার তার বক্তব্য চালু করে, তুমি বোধহয় রেগে আছ। কিন্তু কি বললে তোমার এই রাগ গলে জল হবে–এমন কিছু যা শুনলে তুমি খুশি হও?

-তুমি খুব ভালো ভাবেই সেটা জান। একটিমাত্র শব্দই বোধহয় যথেষ্ট।

–হ্যাঁ, তুমি আসল কথা দুরে রেখে, ঝুড়ি ঝুড়ি বাজে কথা বলে লোকের মন ভোলাতে চাও কেন, ঐসব মিথ্যে বুলি আমার কাছে আওড়াও না কেন?

তবু খুব ধীরে ধীরে সে উত্তর দেয়, আমি জানি না…সত্যিই, আমি বুঝি জন, আমি পারি না–এই পর্যন্ত জানি, আমি পারি না। মিনিট খানেক এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে জন বলে ওঠে, তুমি কী আমাকে শেষ পর্যন্ত পাগল না করে ছাড়বে না হেনরিয়েটা? আমার কখনও মনে হয় না যে, তোমার ওপর আমার কোনো অধিকার বা প্রভাব আছে বলে।

-তুমি অধিকার নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছ কেন–কেনই বা এই প্রভাব পেতে চাইছ? হেনরিয়েটা জিজ্ঞেসা করে।

-আমি নিজেও জানি না, কেন চাই, কিন্তু আমি অন্তত দিতে চাই। কথা বলতে বলতে জন ধপ করে চেয়ারে এসে বসে।

জন–আমি আগে থাকতে চাই।

হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়, জন।

জন–আমি যখন আর এই জগতের বাসিন্দা থাকব না, তখন তোমার প্রথম কি করণীয় হবে জান? তোমার গণ্ডদেশ প্লাবিত করে অশ্রুবারি ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি কোনো শাকার্ত রমণীর মডেল বা কোনো সেবকের প্রতিমূর্তি গড়বে।

হেনরিয়েটাওঃ, সত্যিই কী সাংঘাতিক কথা! হ্যাঁ, যত সাংঘাতিক হোক-না কেন আমি করব–আমি সেই ভীষণ ভয়ঙ্কর কাজ উদ্ধার করেই ছাড়ব।

বিষণ্ণ চোখে হেনরিয়েটা জনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুডিং পুড়ে গেছে। সেদিকে চোখ পড়তেই ক্রিস্টোর, জাদা কোনো কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে তাড়াতাড়ি মাপ চেয়ে নেয়। সে তার স্বীকারোক্তিতে বলে যায়, আমি সত্যিই এর জন্য অনুতপ্ত জন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, আমার বেলাতেই কী করে এগুলো হয়–এই সব আমারই দোষ। পুড়ে যাওয়া উপরের অংশটা না হয় আমাকে তুলে দাও এবং নিচের অংশটা তুমি নাও।

জনের দোষেই পুডিং-এর এই হাল। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বেশি রোগী দেখার ঘরে ঠায় বসে–হেনরিয়েটা, মিসেস ক্যাবট্রি সল মিগুয়েল প্রভৃতির কথা চিন্তা করার ফলেই তার আজ এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঠিক সময়েই যদি জনের আবির্ভাব ঘটত তবে আজ পুডিংটা পুড়ে যেত না। কিন্তু নিজের সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে সে যে সমস্যার সমাধান করতে প্রত্যাশী হয়েছে এটা তার নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। পুডিং-এর পোড়া অংশ নিজের জন্য নেওয়া তার নিছক পাগলামি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। সর্বদাই সে শহীদের যন্ত্রণা ভোগ করে আসছে কেন? টরেন্সের চোখের দৃষ্টি জনের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? জেনাই বা অনবরত নাকের শব্দ করে শ্বাস টেনে চলেছে কেন? সকলের ব্যবহার এমন অপ্রীতিকর ঠেকছে কেন? তার সব রাগ এসে পড়ে বেচারি জেনার ওপর।

-তুমি সমানে নিচের দিকে নাক ঝাড়ছ কেন?

 জাদা–ওর বোধহয় সর্দি হয়েছে!

জন–না, না, সর্দি ওর হয়নি। তোমাদের সবসময়ই এক চিন্তা যে ওর সর্দি হয়। জেনা বেশ ভালোই আছে।

এই সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্দা। তার মাথাতে কিছুতেই একটা ব্যাপার ঢোকে না যে, একজন ডাক্তার যে সর্বদা অন্যের রোগের চিকিৎসা করে বেড়ায়, সে নিজের ঘরের লোকের অসুখের ব্যাপারে কী করে এমন উদাসীন থাকতে পারে! ঘরের কারো রোগের কথা শোনামাত্রই সে অদ্ভুত আচরণ করে, উপহাস করে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়।

জেনা বলে ওঠে, লাঞ্চ নেবার পূর্বে আমি সময় করে বার আষ্টেক নাক ঝেড়েছি।

জন প্রত্যুত্তরে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, গরমের হচি।

টরেন্স এতক্ষণ বাদে এই প্রথম কথা বলে, গরম তো নেই বাবা, আমাদের হলের তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি।

জন উঠে পড়ে। আমাদের ভোজন প্রায় সমাপ্ত? ভালো উঠে পড়! ফেরার জন্য এবার প্রস্তুত হয়ে নাও জাদা।

-এক মিনিট জন, আমার কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার আছে।

নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে, কিন্তু আগে সেরে রাখতে পারতে! সারা সকালে বসে কী এমন রাজকার্য করেছিলে?

রাগে গজরাতে গজরাতে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জন, জার্দা একছুটে নিজের শোবার ঘরে আসে। তাড়াতাড়ি করার উদ্বেগে তার যেন আরও দেরি হয়ে যায়। কিন্তু এখনও সে প্রস্তুত হতে পারেনি কেন? জনের নিজের স্যুটকেস ভর্তি হয়ে হলঘরের মাটিতে পড়ে আছে!

জেনা হাতে কয়েকটা কার্ড নিয়ে বাবার পাশটিতে এসে দাঁড়ায়, খেলা দেখানোর বাসনা নিয়ে।

–তোমার ভাগ্য আমি বলে দিতে পারি বাবা, বলব? আমি বলতে পারি। মায়ের টেরির, জেনের এবং কুবের ভাগ্যের কথাও আমি বলে দিয়েছি।

-ভালো বল।

জনের সত্যি বিরক্ত লাগছিল, জার্দার যে কত দেরি হবে। সে এই বাড়ি থেকে, ভয়ানক এই বাড়ি থেকে, বাড়ির এই ভয়ঙ্কর রাস্তা থেকে এবং রোগে পরিপূর্ণ শহর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়–তবেই হাঁফ ছেড়ে সে বাঁচবে। বনানীর স্পর্শ চায়, পেতে চায় সে সবুজ পাতার স্পর্শ লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তার দেহ মন লাবণ্যের সান্নিধ্যে আসতে চায়।

জেনা নিজের খেয়ালেই তাসের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। এই তো বাবা, তুমি মাঝেই আছ, হরতনের সাহেব। যার ভাগ্য ভালো হবে সে সদাই হরতনের সাহেব থাকবে। এখন আমি অন্য মুখগুলো উল্টে নিচের দিকে করে রাখব। তোমার বামে দুটো, ডাইনে দুটো এবং মাথার উপরে একটা–তার প্রভাব থাকবে তোমার ওপর–এবং ঠিক তোমার পায়ের কাছে যেটা থাকবে, তার ওপর থাকবে তোমার প্রভাব। এটা কিন্তু তোমাকে ঢেকে দেবে। জেনা এক নিশ্বাসে বলে চলে, আমরা তাসগুলোকে এখন উল্টে দিলাম–ডাইনে রুইতনের বিবি–খুব কাছেই।

জন ভেবে নেয়, জেনার চাপল্য ভরা আন্তরিকতায় হেনরিয়েটা নিশ্চয়ই খুশী হতো।

জেনা বলে ওঠে, পরেরটা হল চিড়িতনের গোলাম–নিঃসঙ্গ এক যুবক। তোমার বাম দিকে ইস্কাবনের আট–তার পরিচিতি সে হল এক গুপ্ত শত্রু। বাবা, তোমার কি কোনো গুপ্তশত্রু আছে?

-আমি তো ঠিক জানি না।

 তারপরে আছে ইস্কাবনের বিবি–সে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা।

জন বলে ওঠে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল।

তোমার মাথার ঠিক ওপরে এখন যে অবস্থান করছে তার প্রভাব এসে সরাসরি পড়বে তোমার ওপর–সে হল হরতনের বিবি।

জন ভাবতে থাকে, ভেরোনিকা হলেও হতে পারে! না, আমি কি এতই নিরেট। ভেরোনিকা হতে যাবে কোন্ দুঃখে? ভেরোনিকার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।

তোমার ঠিক পায়ের নিচে আছে চিড়িতনের বিবি-তোমার প্রভাব আছে এর ওপর।

এমন সময় ব্যস্ত পদক্ষেপে জার্দা এসে ঢুকে বলে ওঠে, আমি একেবারে প্রস্তুত জন।

একটু অপেক্ষা কর মা, একটু। বাবার ভাগ্য বলা সবে মাত্র শুরু করেছি। শেষের তাসটি বাবা? এটা সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয়। এইটাকে তোমাকে ঢেকে রেখেছে।

জেনার ছোট্ট কাঠির মতো আঙুলগুলো তাসগুলোকে উল্টে দেয়। সে একবার শাস টেনে নিয়ে বলে, ওঃ–এটা তো ইস্কাবনের টেক্কা। এটা তো পরকালের–কিন্তু।

জন বলে ওঠে, লন্ডন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে তোমার মা হয়তো কাউকে চাপা দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চলে এসো জাদা, টেরি এবং জেনা,-তোমাদের উভয়ের কাছেই বিদায়!