১১১তম অধ্যায়
পাণ্ডবপক্ষের সমবেত ভীষ্মাক্রমণ
সঞ্জয় কহিলেন, “অর্জ্জুন সমরে ভীষ্মের পরাক্রম দর্শন করিয়া শিখণ্ডীকে কহিলেন, “শিখণ্ডী! পিতামহকে আক্রমণ কর; উহা হইতে তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। আমি তীক্ষ্ণ শরসমূহে উহাকে রথ হইতে নিপতিত করিব।” শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু, বিরাট, দ্রুপদ, কুক্তিভোজ, নকুল, সহদেব ও মহাবীর যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য মহারথীগণ সৈন্যসমভিব্যাহারে ধনঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। এই সমস্ত মহারথ সমাগত হইলে কৌরবপক্ষেরা শক্তি ও উৎসাহ অনুসারে তাঁহাদিগের সম্মুখীন হইল। যেমন ব্যাস্ত্ৰশিশু বৃষের অভিমুখীন হয়, সেইরূপ চিত্ৰসেন চেকিতানের অভিমুখীন হইলেন এবং কৃতবর্ম্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে, সৌমদত্তি ত্বরান্বিত হইয়া রোষাবিষ্ট ভীমসেনকে, বিকৰ্ণ বিশিখজাল [শরসমূহ] বর্ষণ করিতে করিতে শৌৰ্য্যশালী নকুলকে, জাতক্ৰোধ কৃপাচাৰ্য্য সহদেবকে, মহাবল দুমুখ ক্রুরকর্ম্ম ঘটোৎকচকে, দুৰ্য্যোধন সাত্যকিকে, সুদক্ষিণ অভিমন্যুকে, অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হইয়া বৃদ্ধ রাজা বিরাট ও দ্রুপদকে, দ্রোণাচাৰ্য্য যত্নসহকারে যুধিষ্ঠিরকে, মহাধনুৰ্দ্ধর দুঃশাসন শিখণ্ডী ও তাঁহার অনুগামী অমিততেজাঃ ধনঞ্জয়কে এবং কৌরবপক্ষীয় অন্যান্য যোদ্ধগণ ভীষ্মের জীবনরক্ষার্থ পাণ্ডবগণের অন্যান্য মহারথদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন কুপিতচিত্তে একমাত্র ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইয়া উচ্চৈঃস্বরে পুনঃ পুনঃ কহিতে লাগিলেন, “হে বীরগণ! এই অর্জ্জুন ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিতেছেন; তোমরা ভীষ্মকে আক্রমণ কর; ভীষ্ম তোমাদিগকে গ্ৰহণ করিতে সমর্থ হইবেন না; সত্ত্বহীন অল্পপ্ৰাণ ভীষ্মের কথা কি, দেবরাজও ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন না।” পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথীগণ সেনাপতির এবংবিধ বাক্য শ্রবণ করিয়া হৃষ্টচিত্তে ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ প্রবল প্রবাহের ন্যায় সম্মুখাগত অরাতিগণকে প্রফুল্লহৃদয়ে নিবারণ করিতে লাগিলেন; পাণ্ডবগণও ভীষ্মের রথসমীপে দুৰ্য্যোধপ্রভৃতি আপনার পুত্রগণকে আক্রমণ করিলেন।
ভীষ্মপার্শ্বরক্ষক দুঃশাসনসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ
“মহারথ দুঃশাসন পিতামহ ভীষ্মের জীবনরক্ষার্থী হইয়া নিৰ্ভয়ে ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! মহাবীর ধনঞ্জয় দুঃশাসনের রথ অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না; প্রত্যুত, যেমন তীরভূমি ক্ষোভিতসলিল [উদ্বেলিত—স্ফীত বারি] মহার্ণবকে নিরুদ্ধ করে, সেইরূপ তিনি ধনঞ্জয়কে নিবারিত করিলেন। তাঁহারা উভয়েই রথিশ্রেষ্ঠ, উভয়েই দুর্জ্জয়, উভয়েই চন্দ্রের ন্যায় কান্তিমান, সূৰ্য্যের ন্যায় দীপ্তিমান, উভয়েই ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন এবং উভয়েই উভয়ের বধ্যাকাঙ্ক্ষী হইয়া ময় ও শত্রুর ন্যায় পরস্পর আক্রমণ করিলেন। দুঃশাসন তিনবাণে অর্জ্জুনকে ও বিংশতিবাণে বাসুদেবকে আহত করিলে বাসুদেবকে পীড়িত অবলোকনপূর্ব্বক কুপিত হইয়া দুঃশাসনের প্রতি একশত নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। সেই সমস্ত নারাচ কবচ ভেদ করিয়া দুঃশাসনের শোণিত পান করিল। দুঃশাসন ক্রুদ্ধ হইয়া পাঁচবাণে ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিয়া পরিশেষে অতি তীক্ষ্ন তিনশরে তাঁহার ললাটদেশ বিদ্ধ করিলেন। ধনঞ্জয় সেই ললাটনিখাত [কপালে প্রোথিত] শরত্ৰয়ে উচ্ছ্রিত[উন্নত]শৃঙ্গ মেরুর ন্যায়, কুসুমিত কিংশুকের ন্যায় সুশোভিত হইলেন এবং যেমন রাহু ক্রুদ্ধ হইয়া পার্ব্বণ[পূর্ণিমার]-চন্দ্রকে নিগ্রহ করে, তদ্রূপ কুপিতচিত্তে দুঃশাসনকে পীড়িত করিতে লাগিলেন। দুঃশাসন অর্জ্জুনের হস্তে নিপীড়িত হইয়া কঙ্কপত্ৰশোভিত [হাড়গিলার পাখার ন্যায় পাখাযুক্ত] শিলাশিত শরজালে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন। অর্জ্জুন তিনবাণে তাঁহার রথ ও শরাসন ছেদন করিয়া যমদণ্ডসদৃশ ভয়ঙ্কর ভুরি ভুরি শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; কিন্তু সেই সমস্ত বাণ নিকটস্থ না হইতে হইতেই ছেদন করিয়া মহারথ দুঃশাসন যত্নশীল ধনঞ্জয়কে বিস্ময়াবিষ্ট ও নিশিত বিশিখজালে নিতান্ত বিদ্ধ করিলেন। ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া সন্ধানপূর্ব্বক শিলাশিত স্বর্ণপুঙ্খ শরজাল নিক্ষেপ করিলেন; সেইশকল শর তড়াগ[দীঘি]গত হংসগণের ন্যায় মহাত্মা দুঃশাসনের কলেবরে নিমগ্ন হইল। দুঃশাসন নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পার্থকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীষ্মের রথে গমন করিলেন; ভীষ্ম সেই অগাধজলনিমগ্ন দুঃশাসনের দ্বীপস্বরূপ [আশ্রয়] হইলেন। যেমন পুরন্দর বৃত্রাসুরকে প্রতিহত করিয়াছিলেন, শৌর্য্য ও পরাক্রমশালী দুঃশাসন চেতনা লাভ করিয়া সেইরূপ নিশিতশরজালে পুনরায় পার্থকে নিবারিত করিতে লাগিলেন কিন্তু ধনঞ্জয় ব্যথিত বা সংগ্রামে পরাঙ্মুখ হইলেন না।”