১০৯. দশম-দিবসীয় যুদ্ধ—উভয়পক্ষের সৈন্যসমাবেশ

১০৯তম অধ্যায়

দশম-দিবসীয় যুদ্ধ—উভয়পক্ষের সৈন্যসমাবেশ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! শিখণ্ডী ভীষ্মের সহিত ও ভীষ্ম পাণ্ডবগণের সহিত কি প্রকার যুদ্ধ করিয়াছিলেন, বল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সূৰ্য্যোদয় হইলে ভেরী, মৃদঙ্গ, আনক ও দধিকর্ণ শঙ্খসকল ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখন পাণ্ডবগণ শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া বহির্গত হইলেন। শিখণ্ডী অতি দুর্ভেদ্য বূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক সকল সৈন্যের অগ্রে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভীম ও ধনঞ্জয় তাঁহার চক্ররক্ষক এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও বীৰ্য্যবান অভিমন্যু তাঁহার পৃষ্ঠরক্ষক হইলেন; সাত্যকি, চেকিতান ও পাঞ্চলরক্ষিত মহাবল ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমসেন প্রভৃতিকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। পরে রাজা যুধিষ্ঠির নকুল ও সহদেবের সহিত সিংহনাদ করিতে করিতে গমন করিলেন। বিরাট স্বসৈন্যে পরিবৃত হইয়া তাঁহার পশ্চাৎ এবং দ্রুপদ বিরাটের পশ্চাৎ গমন করিলেন। কেকায়েরা পঞ্চভ্ৰাতা ও মহাবীর ধৃষ্টকেতু পাণ্ডবব্যূহের জঘনীভাগ রক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন। পাণ্ডবগণ সৈন্যগণকে এইরূপে ব্যূহিত করিয়া জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক আপনার সৈন্যাভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন।

“এ দিকে কৌরবগণও মহারথ ভীষ্মকে সকল সৈন্যের অগ্রসর করিয়া পাণ্ডবগণের অভিমুখে গমন করিলেন। আপনার মহাবল পুত্ৰগণ তাঁহার রক্ষাকাৰ্য্যে ব্যাপৃত হইলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর দ্রোণ, মহাবল অশ্বত্থামা, গজসৈন্যপরিবৃত ভগদত্ত, কৃপ ও কৃতবর্ম্মা ক্ৰমান্বয়ে তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। কাম্বোজরাজ বলবান সুদক্ষিণ, মগধরাজ জয়ৎসেন, বৃহদ্বল, শকুনি এবং সুশর্ম্মা প্রভৃতি অন্যান্য মহাধনুৰ্দ্ধর বীরগণ কৌরবসৈন্যের জঘনরক্ষক হলেন। ভীষ্ম প্রতিদিন এইরূপ আসুর, পৈশাচ অথবা রাক্ষস ব্যূহ নির্ম্মাণ করিতেন।

কৌরব-পাণ্ডবের পরস্পর যুদ্ধ

“ অনন্তর পরস্পর প্রহারে প্রবৃত্ত হইলে যমরাজ্যবিবর্দ্ধন যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অর্জ্জুনপ্রভৃতি কৌন্তেয়গণ শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া নানাবিধ শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক ভীষ্মের সম্মুখীন হইলেন। এই যুদ্ধে আপনার সৈন্যগণ ভীমসেনের সায়কজালে তাড়িত ও রুধিরপ্রবাহে ক্লেদিত হইয়া পরলোকে প্রস্থান করিতে লাগিল। নকুল, সহদেব এবং মহারথ সাত্যকিও কুরুসৈন্যগণকে প্রাপ্ত হইয়া বলপূর্ব্বক নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ কর্ত্তৃক আহন্যমান কৌরবসেনা পাণ্ডবসেনাকে প্রতিহত করিতে অসমর্থ ও আশ্রয়প্রাপ্ত না হইয়া দশদিকে পলায়ন করিল।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবগণ আমাদিগের সৈন্যগণকে নিতান্ত পীড়ন করিতেছে দেখিয়া মহাবলপরাক্রান্ত শান্তনুতনয় জাতক্ৰোধ হইয়া কি করিয়াছিলেন এবং সোমকগণকে আঘাত করিতে করিতে কি প্রকারে পাণ্ডবগণের অভিমুখীন হইলেন, বল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “নরনাথ! পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ কুরুসৈন্যগণকে নিগৃহীত করিলে ভীষ্ম যাহা করিয়াছিলেন, শ্রবণ করুন। শৌৰ্য্যশালী পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্তে কৌরবসেনা নিহত করিতে করিতে ভীষ্মের সম্মুখীন হইলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর দুষ্পরাজেয় ভীষ্ম শক্রহস্তে মানুষ, হস্তী ও অশ্বগণের বিনাশ সহ্য করিতে অসমৰ্থ হইয়া জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক নারাচ, বৎসদন্ত ও অঞ্জলিকদ্বারা পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে আঘাত করিতে লাগিলেন, শরজালদ্বারা পাণ্ডবগণের পাঁচজন প্রধান মহারথকে নিবারিত করিলেন; বীৰ্য্য ও রোষসহকারে নানা অস্ত্র বর্ষণপূর্ব্বক অপরিমিত হস্তী ও অশ্বগণকে সংহার করিলেন। এই ভয়ঙ্কররূপে অরাতিগণের রথে রথিগণকে, অশ্বপৃষ্ঠে অশ্বারোহীদিগকে, ভূমিতে পদাতিসকলকে ও গজে গজারোহীদিগকে আঘাত করিতে লাগিলেন। যেমন অসুরগণ দেবরাজের সম্মুখীন হয়, পাণ্ডবগণ মহারথ ভীষ্মকে সমরে ত্বরান্বিত দেখিয়া সেইরূপ তাঁহার অভিমুখীন হইলেন। ভীষ্মও বজ্রসদৃশ। শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন; সকল দিকেই তাঁহার ভীষণমূর্ত্তি ও ইন্দ্ৰধনুসদৃশ বৃহৎ শরাসন প্রতিনিয়ত মণ্ডলীভুতই নয়নগোচর হইতে লাগিল। আপনার পুত্ৰগণ ভীষ্মের তাদৃশ কর্ম্ম নিরীক্ষণ করিয়া বিস্মিতচিত্তে তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন। অমরগণ যেমন বিপ্রচিত্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন, পাণ্ডবগণ বিমনায়মান হইয়া ব্যাদিতবদন অন্তকসদৃশ ভীষ্মের প্রতি সেইরূপ দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন; কিন্তু তাঁহাকে নিবারণ করিতে পারিলেন না। অগ্নি যেমন কাননকে দগ্ধ করে, দশম দিবসের যুদ্ধে সেইরূপ ভীষ্ম নিশিতশরজালে শিখণ্ডীর রথসৈন্যকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন।

ভীষ্মের প্রতি শিখণ্ডীর বাণনিক্ষেপ

“তখন শিখণ্ডী তিনটি শরদ্বারা জাতরোষ, আশীবিষ ও কালসৃষ্ট অন্তকসম ভীষ্মের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলে ভীষ্ম তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন এবং যেন অনিচ্ছাপূর্ব্বক ক্রুদ্ধ হইয়া সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে শিখণ্ডী! তুমি আমার প্রতি শর নিক্ষেপ কর বা না কর, আমি তোমার সহিত কোনক্রমেই যুদ্ধ করিব না। বিধাতা তোমাকে শিখণ্ডিনীরূপে সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তুমি সেই শিখণ্ডিনীই আছ।”

“শিখণ্ডী ভীষ্মের বাক্যে ক্রুদ্ধ হইয়া সৃক্কণীদ্বয় পরিলেহনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভীষ্ম! হে ক্ষত্রিয়ক্ষয়কারিন! আমি তোমাকে বিলক্ষণ জানি; তুমিও যে পরশুরামের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলে, তাহাও শ্রবণ করিয়াছি এবং তোমার এই দিব্যপ্রভাবও আমার অবিদিত নাই। তথাপি আমি আপনার ও পাণ্ডারগণের প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত তোমার সহিত যুদ্ধ করিব এবং সত্য কহিতেছি যে, নিশ্চয়ই তোমার প্রাণসংহার করিব। হে ভীষ্ম! আমার বাক্য শ্রবণ করিলে; এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয়, কর তুমি আমার প্রতি শরনিক্ষেপ কর বা না কর, তুমি জীবিত থাকিতে আমার নিকট পরিত্ৰাণ পাইবে না; অতএব এই লোকসকলকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ কর।”

“শিখণ্ডী ভীষ্মকে প্রথমে বাক্যবাণে ব্যথিত করিয়া পশ্চাৎ সন্নতপর্ব্ব পাঁচশরে বিদ্ধ করিলেন। মহারথ ধনঞ্জয় শিখণ্ডীর বাক্যশ্রবণে প্রকৃত অবসর উপস্থিত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া শিখণ্ডীকে উত্তেজিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে শিখণ্ডী! আমি তোমায় সাহায্য করিব; তুমি শরনিকরে শূরগণকে উৎসাহিত করিয়া ক্রুদ্ধচিত্তে ভীষণ পরাক্রম ভীষ্মকে আক্রমণ কর। কেহই তোমাকে পীড়ন করিতে পরিবে না, তুমি অবহিত হইয়া ভীষ্মকে আক্রমণ কর। যদি ভীষ্মকে সংহার না করিয়া প্ৰত্যাগমন কর, তাহা হইলে তুমি আমার সহিত এই সমস্ত লোকের উপহাসাম্পদ হইবে। অতএব যাহাতে আমরা উপহাসাম্পদ না হই, সেইরূপ যত্ন কর এবং পিতামহকে সংহার কর। আমি দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, দুৰ্য্যোধন, চিত্ৰসেন, বিকৰ্ণ, জয়দ্ৰথ, বিন্দ, অনুবিন্দ, সুদক্ষিণ, ভগদত্ত, মগধরাজ, সৌমদত্তি, রাক্ষস আৰ্য্যশৃঙ্গ, সুশর্ম্মা এবং অন্যান্য মহারথ কৌরবগণকে নিবারণ করিয়া তোমাকে রক্ষা করিব; তুমি পিতামহকে সংহার কর।” ”