এখানে কবিতা ঝরে ভোরবেলাকার মৃদু কামিনীর মতো,
‘আমি তো বকুল’ বলে কোনো কোনো কবিতা আবার
শিউলির কাছে চলে যায়। এখানে কবিতা লেখালেখি
চলে অবিরত। কবিত্বের চূড়ায় চূড়ায় ঘোরে বাস্তবতা,
পরাবাস্তবতা; কেউ কেউ উদার অক্ষরবৃত্তে গোলাপের
আকৃতির শোভা ধরে রাখে, কেউবা নির্ভৃত চন্দ্রকলা
দ্যায় পুরে মাত্রামৃত্তে। এবং আমারও পাণ্ডুলিপি স্ফীত হয়,
যেমন জনসভায় ক্রমে জমে লোক। আওড়াই কত শ্লোক।
বিষাদ উৎপন্ন হয় স্তবকে স্তবকে, প্রায় প্রতি প্যারাগ্রাফে
ম্লান টেডিবালকের মতো হাঁটে নিঃসঙ্গ নৈরাশ। কী-যে হয়,
লিখতে গেলেই আজ শব্দে শব্দে লাগে শুধু জান্তব বিশ্বাস,
বাজে কঙ্কালের শুকনো হাড়, ঘন ঘন ত্রঁকেবেঁকে যায় পংক্তি,
অক্ষর বেঢপ হয় বড়ো। শাদা কাগজে স্প্রিংয়ের মতো ক্ষিপ্র
কেবলি লাফিয়ে ওঠে বিষাক্ত উদ্ভিদ। মাঝে মাঝে ভালোবেসে
সুস্নিগ্ধ লোলাপজল দিই কবিতার চোখে, তবু তার চোখে
রক্তজবা লেগে থাকে সারাক্ষণ। কখনও বিলাপ শুনি শুধু।
হঠাৎ শহরে ভাসে জন্তুগন্ধ, তামসিক গুহা থেকে রুক্ষ
বুভুক্ষায় জেগে ওঠে একটি হাভাতে পশু। খাচ্ছে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
রবীন্দ্ররচনাবলি, গীতবিতানের সেট, তার অতিশয়
ক্রুর মূঢ় মুখের গহ্বরে পড়ে ক্রমাগত রমণী, পুরুষ,
অত্যন্ত নিষ্পাপ শিশু শত শত। হেলে-দুলে চলে একা,
যেন সে সামন্তরাজ, মগ্ন স্বৈরাচার। তার ক্রুদ্ধ পদধ্বনি,
ক্ষুধিত গর্জন ক্রমান্বয়ে ব্যাপ্ত হয়, গ্রাম ও শহরে জন্মে
হাহাকার। এখন যাবে কি রোখা তাকে, হায় কাব্যের কৃপাণে?
ভয়ে চোখ বুজে থাকে সমস্ত শহর; কখন যে কার পালা,
কে বলবে? লেখার টেবিল ছেড়ে যাই, ফিরে আসি পুনরায়,
কখনও-বা ব্যক্তিগত মশারির ভিতরে লুকাই। যত্রতত্র
ওড়ে হল্কা পশুটার নিশ্বাসের, নিমেষে ঝলসে যায় চোখ
মুখ আর পাঁজর বেরিয়ে পড়ে সবাকার। সব একাকার
বেঢপ পায়ের নিচে তার; পশু অন্য কোনো দিকে চলে যাবে
ভেবে ইতস্তত রাখি চোখ, বস্তুত আশ্বাস খুঁজি চেনা রৌদ্রে,
বিপন্ন প্রতিবেশীর অস্থির দৃষ্টিতে জব্দ, নষ্ট লোকালয়ে।
আমিও মাথার ঘাম মুছে
আতপ চালের মতো রাশি রাশি নক্ষত্রের দিকে ছুটে যাই।