নিম্নোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলি সাজানো হয়নি

নায়কের ছায়া

বরাবর তিনি দূর গ্রামেই থাকেন। পাড়াতলি
গ্রাম, নদী চিরে জেগে-ওঠা, গাছপালা, ইঁদারা পুকুর, হাট
বাজার নিঝুম গোরস্তান নিয়ে আছে। তাকে মেঘনার অঞ্জলি
বলা যায়; আশি বছরের দেহমন জানে সোনার কপাট
এ গ্রামে কোথাও নেই, নেই কোনো কামধেনু হতশ্রী বাথানে,
বিলক্ষণ জানে
কোন্‌ ঘরে কার বাস, কার গরু বিয়োয় কখন, কোন্‌ দোষে
কাকে ধরে নিয়ে যায় থানার পুলিশ।
যে-পাখিটা মগডালে বসে দেয় শিস্‌
জর্দার রঙের মতো বিকেলবেলায় তার নাম
বলে দিতে পারেন নিমেষে। বসে বসে
দ্যাখেন পশ্চিমে সূর্য রঙিন পোশাক
কেমন আড়লে ছেড়ে উধাও সন্ন্যাসে।
মাঝে মাঝে রাতে ঝাঁ ঝাঁ কাশির দমক
দেয় না ঘুমোতে তাঁকে, তখন শোনেন তিনি প্যাঁচা কিংবা শেয়ালের ডাক।
নাকি মধ্যরাতে নিশি ডাকে
তাঁকে নদীতীরে ঝোপঝাড়ে, জোনাকির ঝাঁকে?
কখনো হাঁটেন ঘুমে, এ কেমন বেহুদা ব্যারাম?

একমাত্র ছেলে তাঁর বিবাহিত, শহরে পড়ায় ছাত্র, বাড়ি আসে
গ্রীষ্মের ছুটিতে সঙ্গে আনে ইস্পাহানী গ্রীনস্পট, এই একটাই শখ
রয়ে গেছে তাঁর আর গৃহিনীর পড়ন্ত বেলায়।
বৈঠকখানায় নাতি পড়ে ইতিহাস, কিছু তাঁর জানা, কিছুরা অজানা
কেমন ধোঁয়াটে লাগে মাঝে মাঝে
সবকিছু, চোখে রোশ্‌নি নেই বেশি, তবুও রোজানা
খুব ভোরে পড়েন কোরান, আয়াতের ধ্বনি বাজে
সত্তাময়, কখনোবা দ্যাখেন নাতনি মাতে পুতুল খেলায়।
ফজরের নামাজের পর লাঠি হাতে যখন হাঁটেন তিনি
পুকুরের পাড় ঘেঁষে, ঋণী
ভাবেন নিজেকে গাছপালা, দিঘি, ধানের সম্পন্ন জমি, বাবুই পাখির
চারু বাসাটির
কাছে; প্রতিদিন থানকুনি পাতা, শাপলা শালুক, ধুধু মাঠ
এবং লাউয়ের ডগা, মোরগের ঝুঁটি, ঘাসফুলের বাহার
গাছের পাতায় বসবাসকারী পোকা গভীর করেন পাঠ,
যেমন পড়েন তিনি খুব মনোযোগে বার বার
শিক্ষক পুত্রের পত্র। ছিল না আমীরী

তাঁর ধাতে কোনোদিন, যদিও প্রাচীন বংশে জন্ম, আজ আর
যে-বংশের নেই কোনো ছিরি,
এখন যে-বংশ ক্ষয়রোগীর মতই রক্তময় হাহাকার
নিয়ে করে দিনগত পাপক্ষয়। নিজে
তিনি দুমড়ানো কাগজের মতো সংকুচিত সকল সময়।
অথচ একদা তাঁর হাঁকডাকে কী-যে
সাড়া পড়ে যেত মেঘনাতীরে গ্রামময়।
সেদিনের কথা,-তিনি পাগলা ষাঁড়ের শিং ধরেন মুঠিতে
চেপে আর কাটেন সাঁতার
নিরলস গহন নদীতে লাগাতার,
অমাবস্যা-রাতে যান একা প্রেতায়িত, বিলুপ্ত নীলকুঠিতে,
দেশজোড়া দাঙ্গাহাঙ্গামায় দোনলা বন্দুক হাতে
নিঃশঙ্ক দাঁড়ান এসে মৃত্যুসন্ধানী ভিড়ের মুখে
গোক্ষুরের তাড়া-খাওয়া খরগোশের মতো কিছু কৈবর্ত বাঁচাতে।

এখন দ্যাখেন তিনি ছায়াছন্ন চোখে-ক্রমশ বদলে যায়
আমল-মামুল, সারা জাহান পড়ছে ঢাকা কামানে বন্দুকে
আর রূপকথার দানোর চিৎকারের মতো ট্যাঙ্কের ঘর্ঘরে
কানে লাগে তালা, এ কেমন জমানায়
এখনো আছেন বেঁচে তিনি? দ্যাখেন দু’চোখ মেলে, কে যুবক
পা চালিয়ে যাচ্ছে একা আগামীর অত্যন্ত বিরান মাঠ, খাদ
এবং মড়ার খু’লি পেরিয়ে , অভুক্ত নিচ্ছে তুলে
খাদ্যের ভাণ্ডার থেকে জহরিলা তন্দল নিছক।
কে এই অচেনা যুবা বার বার পথ ভুলে
অন্য হিমযুগে, হাড়-ক্ষয়কারী শীতে
যাচ্ছে চলে ভস্ম-ঢাকা নিসর্গ ও নগরীতে?
তাঁরই আওলাদ?