আমরা এসে দাঁড়িয়েছি খোলা আকাশের নিচে;
নত আমাদের মাথা, চোখের পাতা
কাঁপছে অবিরত, বুকের ভেতর গড়িয়ে পড়ছে
নুড়ি পাথর, মড়ার খুলি। স্মৃতিতে কম্পমান কয়েকটি মুখ।
যদিও তোমাদের অনেকেই কবরই নেই, তবু
ভাবতে ভালো লাগে আমার,
তোমাদের কবরের উপর ঝুঁকে আছে
অনেকগুলো রক্তগোলাপ।
ভাবতে ভালো লাগে, প্রহরে প্রহরে গায়ক পাখিরা
তোমাদের কবরের উপর সুর ঝরিয়ে
উড়ে যায় যে যার গন্তব্যে। ভাবতে ভালো লাগে,
যে-হাওয়া বয়ে যায় তোমাদের কবরের উপর,
তার কণ্ঠে বেহাগের বেদনাপ্লুত স্বর এবং কবরের উন্নতশির
তরুণ ঘাসদল উচ্চারণ করছে আত্মোৎসর্গের মাতৃভাষা।
আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে
স্মরণ করছি তোমাদের, এই সেই ভৌতিক ইটখোলা,
করোটির ভেতরকার শূন্যতার মতো
অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সেই বধ্যভূমি; যেখানে
তোমরা রক্তখেকো ঘাতকদের অস্ত্রের বেলেল্লা
চিৎকার শুনেছ, ওদের পাশব চোখে দেখেছ
হিংসার আগুনের আষ্ফালন, তোমরা স্তব্ধতার স্থাপত্য হয়ে
সহ্য করেছ পৈশাচিক নির্যাতন, তোমাদের জীবন
জন্মান্ধ আক্রোশে খুবলে নিয়েছে নরপশুরা। সেই কালবেলায়
একঝাঁক শকুনের চঞ্চু আর নখরাঘাতে
আর্তনাদ করেছিল হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতা। মৃত্যুকে
তোমরা আলিঙ্গন করেছ কালজয়ী মহিমায়।
যাদের হাতের আস্তিনের আড়াল থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো
টুপটাপ পড়ছে তোমাদের রক্ত, আমরা দেখছি,
ওরা আজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, হা দেশ! হা মানুষ!
তোমাদের চোখ যারা উপড়ে নিয়ে, ছিন্ন ভিন্ন করেছে তোমাদের হৃৎপিণ্ড
তারাই আজ মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছ যেখানে সেখানে,
রক্তলিপ্সু নেকড়ের পাল জনসাধারণকে দিচ্ছে নৈতিকতার সবক।
আর্তনাদ করছে শহীদদের আত্মা, অট্রহাসিতে ফেটে পড়ছে ইটখোলা;
হা আমাদের বেঠিক পথের রাজনীতি! হা এ দেশের শাসকদল!
হে মহান শহীদেরা, তোমরা এই বাংলায় নেই, এই নির্দয় সত্য
মেনে নিতে পারি না কিছুতেই
আমরা যখন শীত সকালের মধুর রোদে হাঁটি কিংবা কোনো
জ্যোৎস্নারাতে শুনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, তখন
উপলব্ধি করি তোমাদের উপস্থিতি। যখন আমরা
সুন্দর এবং কল্যাণের অভিষেকের প্রস্তুতির জন্যে
মিছিল করি, যখন পশু-তাড়ানোর সংগ্রামে আমরা
মিলিত হই জনসভায়, তখন স্পষ্ট দেখতে পাই
তোমরা আছো আমাদের পাশে। তোমাদের চোখে মানবতার
অবিনশ্বর দীপ্তি, হাতে উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের ঠিকানা।
আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রার পথে
অজস্র ফুলের বিকাশ, পাখিদের নীলিমা-ছোঁয়া গীতিধারা।
[এই কবিতাটি বিজয় দিবস উপলক্ষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
আয়োজিত অনুষ্ঠানে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পঠিত। শা-রা]